স্বালাতে মুবাশ্শির (২য় পর্ব)
১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব
তাশাহহুদের জন্য বসতে আদেশ দিয়ে নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি বলেছেন, “--- অতঃপর তুমি যখন নামাযের মাঝে বসবে, তখন স্থির হবে এবং বাম ঊরুকে বিছিয়ে দিয়ে তাশাহহুদ পড়বে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৬০ নং, বায়হাকী)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমার দোস্ত (সাঃ) আমাকে কুকুরের মত (দুই পায়ের রলাকে খাড়া রেখে, দুই পাছার উপর ভর করে ওহাত দু’টিকে মাটিতে রেখে) বসতে নিষেধ করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৬৫, ত্বায়ালিসী, ইবনে আবী শাইবা) উক্ত প্রকার বসাকে তিনি শয়তানের বৈঠক বলে অভিহিত করেছেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৯৮নং, আহমাদ, মুসনাদ)
তাশাহ্হুদে বসে তিনি ডানহাতের চেটোকে ডান ঊরু (জাং) বা হাঁটুর উপর রাখতেন, আর বামহাতের চেটোকে রাখতেন বাম জাং বা হাঁটুর উপর বিছিয়ে। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০নং, আহমাদ, মুসনাদ) ডানহাতের কনুই-এর শেষ প্রান্ত ডান জাং-এর উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৫৭নং, নাসাঈ, সুনান) অর্থাৎ কনুইকে পায়ের রলার উপর না রেখে ঊরুর উপর পাঁজরে লাগিয়ে রাখতেন।
কখনো বা (আরবীয়) আঙ্গুল গণনার হিসাবের ৫৩ গোনার মত করে রাখতেন। অর্থাৎ, কনিষ্ঠা, অনামিকা ও মধ্যমাকে চেটোর সাথে লাগিয়ে তর্জনীকে লম্বা ছেড়ে এবং বৃদ্ধার মাথাকে তর্জনীর গোড়াতে লাগিয়ে রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০, মিশকাত ৯০৬নং)
তিনি তর্জনীকে তুলে হিলিয়ে হিলিয়ে এর মাধ্যমে দুআ করতেন। (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৫৬, ১২০৩ নং, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১৮, ৫/৭২) সুতরাং দুআ শেষ না করা (সালাম ফিরার পূর্ব) পর্যন্ত তর্জনী হিলানো সুন্নত। যেহেতু দুআ সালাম ফিরার পূর্বেই শেষ হয়ে থাকে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮-১৫৯ পৃ:)
তিনি বলতেন, “অবশ্যই ঐ তর্জনী শয়তানের পক্ষে লোহা অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক (খোঁচার দন্ড)। (আহমাদ, মুসনাদ ২/১১৯, বাযযার, মাক্বদিসী, বায়হাকী, প্রমুখ)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘ঐ আঙ্গুলটি শয়তানের জন্য আঘাত-দন্ড। যে এইভাবে ইশারা করে, সে (নামাযে) উদাসীন হয় না।’
হুমাইদী বলেন, মুসলিম বিন আবী মারয়্যামের নিকট এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে যে, সে শামের এক গির্জায় নামাযরত অবস্থায় কিছু নবীর ছবি দেখেছে; তাঁদের তর্জনী আঙ্গুলটি ঐরুপ ইশারা করা অবস্থায় ছিল। (মুসনাদে হুমাইদী, আবূ য়্যা’লা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮পৃ:)
তিনি তর্জনী দ্বারা এই ইশারা ও হ্রকত প্রত্যেক তাশাহ্হুদে করতেন। তবে ঠিক কোন্ সময়ে হ্রকত করতেন বা হিলাতেন, সে বিষয়ে কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং যেখানেই দুআ (প্রার্থনার) অর্থ পাওয়া যাবে সেখানেই তর্জনী হিলানো সুন্নত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২০২) আর দুআর অর্থ না থাকলেও একটানা ক্রমাগত হিলিয়ে যাওয়া বিধেয় নয়।
তিনি তাশাহহুদ পড়তে আদেশও করতেন। বলতেন, “যখন তোমরা প্রত্যেক দুই রাকআতে বসবে তখন ‘আত্তাহিয়্যাতু---’ বল। অতঃপর তোমাদের প্রত্যেকের পছন্দমত দুআ বেছে নিয়ে আল্লাহ আযযা অজাল্লার নিকট প্রার্থনা করা উচিৎ।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১১১৪ নং, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম কাবীর) এই তাশাহহুদ পড়তে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও আদেশ করেছিলেন।
اَلتَّحِيَّاتُ للهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ।
অর্থ- মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক যাবতীয় ইবাদত আল্লাহর নিমিত্তে। হে নবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহ্মত ও তাঁর বর্কত বর্ষণ হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাগণের উপর সালাম বর্ষণ হোক। আমি সাক্ষি দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষি দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর দাস ও প্রেরিত রসূল।
নামাযী যখন ‘আস্সালা-মু আলাইনা অআলা ইবা-দিল্লা-হিস স্বা-লিহীন’ বলে, তখন আকাশ ও পৃথিবীর সকল নেক বান্দার নিকট ঐ সালাম পৌঁছে থাকে। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আমরা এরুপ বলতাম। অতঃপর তাঁর ইন্তেকাল হলে আমরা বলতে লাগলাম, ‘আসসালা-মু আলান নাবিয়্যি---।’ (বুখারী, মুসলিম, ইবনে আবী শাইবা, আবূ য়্যা’লা, সিরাজ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩২১, মিশকাত ৯০৯নং)
২। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ الْمُبَارَكَاتُ الصَّلَوَاتُ الطَّيِّبَاتُ لله।।।।
৩। আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ الطَّيِّبَاتُ الصَّلَوَاتُ لله।।।।।
বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মতই। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’র পর ‘অহ্দাহু লা শারীকা লাহু’ বাক্য বাড়তি আছে। (মুসলিম, সহীহ ৪০৪নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
৪। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর তাশাহহুদ। তিনি মিম্বরের উপর লোকদেরকে এই তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন:-
اَلتَّحِيَّاتُ للهِ الزَّاكِيَاتُ للهِ الطَّيِّبَاتُ للهِ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ।।।।
বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মত। (মালেক, মুঅত্তা ৩০০নং, বায়হাকী ২/১৪২)
৫। আয়েশা رضي الله عنها এর তাশাহহুদ:-
আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর ১০ বার রহ্মত বর্ষণ করবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ৯২১ নং)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, “---এবং তার ১০টি পাপ মোচন হবে ও সে ১০টি মর্যাদায় উন্নীত হবে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৫৫০, মিশকাত ৯২২নং)
সাহাবাগণ তাঁকে বললেন, ‘আমরা আপনার উপর দরুদ কিভাবে পাঠ করব?’ তখন তিনি তাঁদেরকে দরুদ শিক্ষা দিলেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯১৯-৯২০নং)
দরুদের শব্দবিন্যাস কয়েক প্রকার:-
১।اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدُ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত।
হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (বুখারী, মিশকাত ৯১৯নং)
২। اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى أَزْوَاجِهِ وَ ذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلىآلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ কর যেমন তুমি হযরত ইবরাহীমের বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ করেছ। এবং তুমি হযরত মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর যেমন তুমি হযরত ইবরাহীমের বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯২০নং)
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ
এই দরুদের অর্থ প্রায় পূর্বেকার দরুদের মতই।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ। وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ
এ দরুদে তাঁর পত্নীগণের কথার উল্লেখ নেই। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, আবূ য়্যা’লা)
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ فِي الْعَالَمِيْنَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উক্ত দরুদে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর গুণ বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নিরক্ষর নবী।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ।
উক্ত দরুদে তাঁর গুণস্বরুপ ‘তোমার (আল্লাহর) দাস ও রসূল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে তার নামাযে দুআ করতে শুনলেন, লোকটি মহান আল্লাহর গৌরব বর্ণনা করল না, আর তাঁর নবীর উপর দরুদও পড়ল না। তিনি বললেন, “এ তো তাড়াতাড়ি করল।” অতঃপর তাকে ডেকে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউনামায পড়বে, তখন সে যেন তার প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনার মাধ্যমে আরম্ভ করে। অতঃপর নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করে। তারপর পছন্দ বা ইচ্ছামত দুআ করে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৮১ নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯৩০ নং)
তিনি অন্য এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে নামাযে আল্লাহর প্রশংসা করল এবং নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করল। তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, “ওহে নামাযী! এবার দুআ কর। কবুল হবে।” (ঐ)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি নামায পড়ছিলাম। পাশে আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) সহ্ নবী (সাঃ) বসেছিলেন। অতঃপর যখন আমি (তাশাহ্হুদে) বসলাম, তখন আল্লাহর প্রশংসা শুরু করলাম, অতঃপর নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করলাম, তারপর নিজের জন্য দুআ করলাম। এ শুনে নবী (সাঃ) বললেন, “চাও, তোমাকে দান করা হবে। চাও, তোমাকে দান করা হবে।” (তিরমিযী, সুনান ৫৯৮, মিশকাত ৯৩১ নং)
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ(শেষ) তাশাহহুদ সম্পন্ন করবে, তখন সে যেন আল্লাহর নিকট চারটি জিনিস থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। এরপর সে ইচ্ছামত দুআ করবে।”
দুআটি নিম্নরুপ:-
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَ فِتْنَةِ الْمَمَاتِ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি জাহান্নাম ও কবরের আযাব থেকে, কানা দাজ্জাল, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৫, আবূদাঊদ, সুনান ৯৮৩, নাসাঈ, সুনান ১৩০৯, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৯০৯, দারেমী, সুনান, ইবনুল জারুদ ১১০, সিরাজ, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৭, ৪৪৭, বায়হাকী ২/১৫৪, মিশকাত ৯৪০ নং)
তিনি বলেন, “তোমরা কবরের আযাব থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও, জাহান্নামের আযাব থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও, মাসীহ্ দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও।” (মুসলিম, সহীহ ৫৮৮ নাসাঈ, সুনান)
সুতরাং নামাযের শেষ তাশাহ্হুদে দরুদের পর অন্যান্য দুআর পূর্বে উক্ত চার প্রকার আযাব ও ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা ওয়াজেব।
এই দুআ তিনি নিজেও তাশাহ্হুদে পাঠ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮৮০, ৯৮৪, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৯৩৯ নং) পরন্তু সাহাবাগণকে কুরআনের সূরা শিখানোর মত উক্ত দুআও শিক্ষা দিতেন। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৯৪১ নং)
তাশাহহুদের বৈঠক
দ্বিতীয় রাকআতের সকল কর্ম (শেষ সিজদাহ) শেষ করে মহানবী (সাঃ) দুই সিজদার মাঝের বৈঠকের মত বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসে যেতেন এবং ডান পায়ের পাতাকে খাড়া করে রাখতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ৭৩১নং)
তাশাহহুদের জন্য বসতে আদেশ দিয়ে নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি বলেছেন, “--- অতঃপর তুমি যখন নামাযের মাঝে বসবে, তখন স্থির হবে এবং বাম ঊরুকে বিছিয়ে দিয়ে তাশাহহুদ পড়বে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৬০ নং, বায়হাকী)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমার দোস্ত (সাঃ) আমাকে কুকুরের মত (দুই পায়ের রলাকে খাড়া রেখে, দুই পাছার উপর ভর করে ওহাত দু’টিকে মাটিতে রেখে) বসতে নিষেধ করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৬৫, ত্বায়ালিসী, ইবনে আবী শাইবা) উক্ত প্রকার বসাকে তিনি শয়তানের বৈঠক বলে অভিহিত করেছেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৯৮নং, আহমাদ, মুসনাদ)
তাশাহ্হুদে বসে তিনি ডানহাতের চেটোকে ডান ঊরু (জাং) বা হাঁটুর উপর রাখতেন, আর বামহাতের চেটোকে রাখতেন বাম জাং বা হাঁটুর উপর বিছিয়ে। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০নং, আহমাদ, মুসনাদ) ডানহাতের কনুই-এর শেষ প্রান্ত ডান জাং-এর উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৫৭নং, নাসাঈ, সুনান) অর্থাৎ কনুইকে পায়ের রলার উপর না রেখে ঊরুর উপর পাঁজরে লাগিয়ে রাখতেন।
এক ব্যক্তি নামাযে বাম হাতের উপর মাটিতে ঠেস দিয়ে বসলে তিনি তাঁকে বারণ করে বলেছিলেন, “এরুপ হল ইয়াহুদীদের নামায।” (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০নং) “এরুপ বসো না। কারণ, এটা তো তাদের বৈঠক, যাদেরকে আযাব দেওয়া হবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০নং) “এটা হল তাদের বৈঠক, যাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত।” (আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৩ নং, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ)
তাশাহহুদের বৈঠকে তর্জনীর ইশারা
তিনি বাম হাতের চেটোকে বাম হাঁটুর উপর বিছিয়ে দিতেন। কখনো বাম হাঁটুকে বামহাতের লোকমা বা গ্রাস বানাতেন। ডান হাতের (তর্জনী ছাড়া) সমস্ত আঙ্গুলগুলোকে বন্ধ করে নিতেন। আর তর্জনী (শাহাদতের) আঙ্গুল দ্বারা কেবলার দিকে ইশারা করতেন এবং তার উপরেই নিজ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯, ৫৮০নং, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ) কখনো বা ইশারার সময় তিনি তাঁর বুড়ো আঙ্গুলকে মাঝের আঙ্গুলের উপর রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯নং, আহমাদ, মুসনাদ) আর উক্ত উভয় আঙ্গুলকে মিলিয়ে গোল বালার মত গোলাকার করে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৫৭নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ প্রভৃতি)
কখনো বা (আরবীয়) আঙ্গুল গণনার হিসাবের ৫৩ গোনার মত করে রাখতেন। অর্থাৎ, কনিষ্ঠা, অনামিকা ও মধ্যমাকে চেটোর সাথে লাগিয়ে তর্জনীকে লম্বা ছেড়ে এবং বৃদ্ধার মাথাকে তর্জনীর গোড়াতে লাগিয়ে রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০, মিশকাত ৯০৬নং)
তিনি তর্জনীকে তুলে হিলিয়ে হিলিয়ে এর মাধ্যমে দুআ করতেন। (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৫৬, ১২০৩ নং, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১৮, ৫/৭২) সুতরাং দুআ শেষ না করা (সালাম ফিরার পূর্ব) পর্যন্ত তর্জনী হিলানো সুন্নত। যেহেতু দুআ সালাম ফিরার পূর্বেই শেষ হয়ে থাকে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮-১৫৯ পৃ:)
তিনি বলতেন, “অবশ্যই ঐ তর্জনী শয়তানের পক্ষে লোহা অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক (খোঁচার দন্ড)। (আহমাদ, মুসনাদ ২/১১৯, বাযযার, মাক্বদিসী, বায়হাকী, প্রমুখ)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘ঐ আঙ্গুলটি শয়তানের জন্য আঘাত-দন্ড। যে এইভাবে ইশারা করে, সে (নামাযে) উদাসীন হয় না।’
হুমাইদী বলেন, মুসলিম বিন আবী মারয়্যামের নিকট এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে যে, সে শামের এক গির্জায় নামাযরত অবস্থায় কিছু নবীর ছবি দেখেছে; তাঁদের তর্জনী আঙ্গুলটি ঐরুপ ইশারা করা অবস্থায় ছিল। (মুসনাদে হুমাইদী, আবূ য়্যা’লা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮পৃ:)
তিনি তর্জনী দ্বারা এই ইশারা ও হ্রকত প্রত্যেক তাশাহ্হুদে করতেন। তবে ঠিক কোন্ সময়ে হ্রকত করতেন বা হিলাতেন, সে বিষয়ে কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং যেখানেই দুআ (প্রার্থনার) অর্থ পাওয়া যাবে সেখানেই তর্জনী হিলানো সুন্নত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২০২) আর দুআর অর্থ না থাকলেও একটানা ক্রমাগত হিলিয়ে যাওয়া বিধেয় নয়।
তর্জনীর একটি মাত্র আঙ্গুল হিলিয়েই দুআ করা বিধেয়। মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে দুই আঙ্গুল হিলিয়ে দুআ করছে। তিনি তাকে বললেন, “একটি আঙ্গুল হিলাও, একটি আঙ্গুল হিলাও।” আর এই সঙ্গে তিনি তর্জনীর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। (ইবনে আবী শাইবা, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯১৩নং)
তাশাহহুদের গুরুত্ব
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) প্রত্যেক দুই রাকআতে ‘তাহিয়্যাহ্’ (তাশাহহুদ) পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৯৮, আহমাদ, মুসনাদ) বৈঠকের শুরুতেই তিনি বলতেন, “আত্ তাহিয়্যা-তু লিল্লা-হি---।” (বায়হাকী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৬০পৃ:) দুই রাকআত পড়ে ‘তাশাহহুদ’ পাঠ করতে ভুলে গেলে তিনি তার জন্য ভুলের সিজদাহ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৩৮ নং)
তিনি তাশাহহুদ পড়তে আদেশও করতেন। বলতেন, “যখন তোমরা প্রত্যেক দুই রাকআতে বসবে তখন ‘আত্তাহিয়্যাতু---’ বল। অতঃপর তোমাদের প্রত্যেকের পছন্দমত দুআ বেছে নিয়ে আল্লাহ আযযা অজাল্লার নিকট প্রার্থনা করা উচিৎ।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১১১৪ নং, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম কাবীর) এই তাশাহহুদ পড়তে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও আদেশ করেছিলেন।
তাছাড়া তিনি সাহাবাগণকে ‘তাশাহহুদ’ শিখাতেন, যেমন কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ৪০৩নং) তাশাহহুদ নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯১৮নং)
তাশাহহুদের দুআ
১। তিনি সাহাবাগণকে যে তাশাহহুদ শিখিয়েছিলেন তা কয়েক প্রকারের। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) ও ইবনে ইমার (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ للهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ।
উচ্চারণ:- আত-তাহিয়্যা-তু লিল্লা-হি অস্বস্বালা-ওয়া-তু অত্বত্বাইয়্যিবা-তু, আসসালা-মু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু অরাহ্মাতুল্লা-হি অবারাকা-তুহ্, আসসালা-মু আলাইনা অ আলা ইবা-দিল্লা-হিস্ব স্বা-লিহীন, আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ্।
অর্থ- মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক যাবতীয় ইবাদত আল্লাহর নিমিত্তে। হে নবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহ্মত ও তাঁর বর্কত বর্ষণ হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাগণের উপর সালাম বর্ষণ হোক। আমি সাক্ষি দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষি দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর দাস ও প্রেরিত রসূল।
নামাযী যখন ‘আস্সালা-মু আলাইনা অআলা ইবা-দিল্লা-হিস স্বা-লিহীন’ বলে, তখন আকাশ ও পৃথিবীর সকল নেক বান্দার নিকট ঐ সালাম পৌঁছে থাকে। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আমরা এরুপ বলতাম। অতঃপর তাঁর ইন্তেকাল হলে আমরা বলতে লাগলাম, ‘আসসালা-মু আলান নাবিয়্যি---।’ (বুখারী, মুসলিম, ইবনে আবী শাইবা, আবূ য়্যা’লা, সিরাজ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩২১, মিশকাত ৯০৯নং)
২। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ الْمُبَارَكَاتُ الصَّلَوَاتُ الطَّيِّبَاتُ لله।।।।
আত্ তাহিয়্যা-তুল মুবা-রাকা-তুস স্বালাওয়া-তুত ত্বাইয়িবা-তু লিল্লা-হি---। (বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের অনুরুপ।) (মুসলিম, সহীহ ৪০৩, আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯১০ নং) অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় দ্বিতীয় শাহাদতে কেবল ‘অআশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’ উল্লেখিত হয়েছে। (মিশকাত ৯১০নং)
৩। আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ الطَّيِّبَاتُ الصَّلَوَاتُ لله।।।।।
‘আত্ তাহিয়্যা-তুত ত্বাইয়িবা-তুস স্বালাওয়া-তু লিল্লা-হি--।’
বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মতই। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’র পর ‘অহ্দাহু লা শারীকা লাহু’ বাক্য বাড়তি আছে। (মুসলিম, সহীহ ৪০৪নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
৪। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর তাশাহহুদ। তিনি মিম্বরের উপর লোকদেরকে এই তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন:-
اَلتَّحِيَّاتُ للهِ الزَّاكِيَاتُ للهِ الطَّيِّبَاتُ للهِ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ।।।।
আত্ তাহিয়্যাতু লিল্লা-হিয যা-কিয়া-তু লিল্লা-হিত ত্বাইয়িবা-তু লিল্লা-হ্, আস্সালা-মু আলাইকা---।
বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মত। (মালেক, মুঅত্তা ৩০০নং, বায়হাকী ২/১৪২)
৫। আয়েশা رضي الله عنها এর তাশাহহুদ:-
اَلتَّحِيَّاتُ الطَّيِّبَاتُ الصَّلَوَاتُ الزَّاكِيَاتُ للهِ، اَلسَّلاَمُ عَلَى النَّبِيِّ।।।।।
‘আত্ তাহিয়্যা-তুত ত্বাইয়িবা-তুস স্বালাওয়া-তুয যা-কিয়া-তু লিল্লা-হ্, আস্সালা-মু আলান্নাবিয়্যি---।’
বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মত। (ইবনে আবী শাইবা, সিরাজ, বায়হাকী ২/১৪৪)
দরুদ
তাশাহহুদের পর নবী মুবাশ্শির (সাঃ) নিজের উপর দরুদ পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৫/৩৭৪, হাকেম, মুস্তাদরাক) আর উম্মতের জন্যও তাঁর উপরের সালামের পর দরুদ পড়াকে বিধিবদ্ধ করেছেন। মহান আল্লাহর সাধারণ আদেশ রয়েছে, “--- হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর দরুদ পাঠ কর এবং উত্তমরুপে সালাম পেশ কর।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৫৬)
আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর ১০ বার রহ্মত বর্ষণ করবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ৯২১ নং)
অন্য এক বর্ণনায় আছে, “---এবং তার ১০টি পাপ মোচন হবে ও সে ১০টি মর্যাদায় উন্নীত হবে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৫৫০, মিশকাত ৯২২নং)
সাহাবাগণ তাঁকে বললেন, ‘আমরা আপনার উপর দরুদ কিভাবে পাঠ করব?’ তখন তিনি তাঁদেরকে দরুদ শিক্ষা দিলেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯১৯-৯২০নং)
দরুদের শব্দবিন্যাস কয়েক প্রকার:-
১।اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدُ، اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা ইবরা-হীমা অ আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। আল্লা-হুম্মা বা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅ আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হীমা অ আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত।
হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (বুখারী, মিশকাত ৯১৯নং)
২। اَللّهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى أَزْوَاجِهِ وَ ذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلىآلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلى مُحَمَّدٍ وَّعَلى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:- আল্লাহুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউঅ আলা আযওয়া-জিহী অ যুরিয়্যাতিহী কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম, অ বা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আযওয়া-জিহী অ যুরির্য়াতিহী কামা বা-রাকতা আলা আ-লি ইবরাহীম, ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি হযরত মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ কর যেমন তুমি হযরত ইবরাহীমের বংশধরের উপর রহ্মত বর্ষণ করেছ। এবং তুমি হযরত মুহাম্মাদ, তাঁর পত্নীগণ ও তাঁর বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ কর যেমন তুমি হযরত ইবরাহীমের বংশধরের উপর বর্কত বর্ষণ করেছ। নিশ্চয় তুমি প্রশংসিত গৌরবান্বিত। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯২০নং)
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ
كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ،
উচ্চারণ:- আল্লা- হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মা দিঁ উঅআলা আহ্লি বাইতিহি অআলা আযওয়া-জিহি অযুরিGয়্যাতিহি কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আহ্লি বাইতিহি অআলা আযওয়া-জিহি অযুরির্য়াতিহী কামা বারাকতা আলা আ-লি ইবরা-হীম, ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। (আহমাদ, মুসনাদ ৫/৩৭৪, ত্বাহাকেম, মুস্তাদরাক)
এই দরুদের অর্থ প্রায় পূর্বেকার দরুদের মতই।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ। وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ
إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা ইবরা-হীমা অআ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিঁউঅআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হীমা অআ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ।
এ দরুদে তাঁর পত্নীগণের কথার উল্লেখ নেই। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, আবূ য়্যা’লা)
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ فِي الْعَالَمِيْنَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা আ-লি ইবরা-হীমা ফিল আ’-লামীন। ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ।
উক্ত দরুদে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর গুণ বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নিরক্ষর নবী।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُوْلِكَ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা অরাসূলিক, কামা স্বাল্লাইতা আলা আ-লি ইবরা-হীম। অবা-রিক আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা অরাসূলিকা অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা বা-রাকতা আলা ইবরা-হীমা অআলা আ-লি ইবরা-হীম। (বুখারী, নাসাঈ, সুনান, ত্বাহাকেম, মুস্তাদরাক, আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৬৬পৃ:)
উক্ত দরুদে তাঁর গুণস্বরুপ ‘তোমার (আল্লাহর) দাস ও রসূল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ، إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, অবা-রিক আলা মুহাম্মাদ অআলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা স্বাল্লাইতা অবা-রাকতা আলা ইবরা-হীমা অআ-লি ইবরা-হীম। ইন্নাকাহামীদুম মাজীদ। (নাসাঈ, সুনান, ত্বাহাকেম, মুস্তাদরাক, প্রমুখ, দরুদের উক্ত শব্দবিন্যাসগুলি ‘সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী’ হতে গৃহীত।)
লক্ষণীয় যে, উক্ত শব্দ বিন্যাসের কোন স্থানেই ‘সাইয়িদিনা, মাওলানা, শাফীইনা’ বা ‘হাবীবিনা’ ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ নেই। তিনি আমাদের ‘সাইয়িদিনা, মাওলানা, শাফীইনা’ ও ‘হাবীবিনা’ হওয়া সত্ত্বেও ঐ শ্রেণীর শব্দ দরুদে সংযোজন করা বিদআত।
দুআ মাসূরার পূর্বে দরুদের গুরুত্ব
তিনি অন্য এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে নামাযে আল্লাহর প্রশংসা করল এবং নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করল। তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, “ওহে নামাযী! এবার দুআ কর। কবুল হবে।” (ঐ)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি নামায পড়ছিলাম। পাশে আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) সহ্ নবী (সাঃ) বসেছিলেন। অতঃপর যখন আমি (তাশাহ্হুদে) বসলাম, তখন আল্লাহর প্রশংসা শুরু করলাম, অতঃপর নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করলাম, তারপর নিজের জন্য দুআ করলাম। এ শুনে নবী (সাঃ) বললেন, “চাও, তোমাকে দান করা হবে। চাও, তোমাকে দান করা হবে।” (তিরমিযী, সুনান ৫৯৮, মিশকাত ৯৩১ নং)
আর এ জন্যই তিনি বলেছেন, “ফরয নামাযের পশ্চাতে দুআ অধিকরুপে শোনা (কবুল করা) হয়।” (তিরমিযী, সুনান ৩৭৪৬, মিশকাত ৯৬৮নং) বলা বাহুল্য এটাই হল আল্লাহর সাথে প্রকৃত মুনাজাতের সময়। কারণ “নামাযী মাত্রই নামাযে আল্লাহর সাথে মুনাজাত করে।” (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৬, ৪/৩৪৪)
ওয়াজেব দুআয়ে মাসূরাহ্
দুআটি নিম্নরুপ:-
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَ فِتْنَةِ الْمَمَاتِ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিন আযা-বি জাহান্নাম, অ আঊযু বিকা মিন আযা-বিল ক্বাবর, অআঊযু বিকা মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ দাজ্জা-ল, অআঊযু বিকা মিন ফিতনাতিল মাহ্য়্যা অ ফিতনাতিল মামা-ত।
অর্থ:- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি জাহান্নাম ও কবরের আযাব থেকে, কানা দাজ্জাল, জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৫, আবূদাঊদ, সুনান ৯৮৩, নাসাঈ, সুনান ১৩০৯, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৯০৯, দারেমী, সুনান, ইবনুল জারুদ ১১০, সিরাজ, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৭, ৪৪৭, বায়হাকী ২/১৫৪, মিশকাত ৯৪০ নং)
তিনি বলেন, “তোমরা কবরের আযাব থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও, জাহান্নামের আযাব থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও, মাসীহ্ দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও।” (মুসলিম, সহীহ ৫৮৮ নাসাঈ, সুনান)
সুতরাং নামাযের শেষ তাশাহ্হুদে দরুদের পর অন্যান্য দুআর পূর্বে উক্ত চার প্রকার আযাব ও ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা ওয়াজেব।
এই দুআ তিনি নিজেও তাশাহ্হুদে পাঠ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮৮০, ৯৮৪, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৯৩৯ নং) পরন্তু সাহাবাগণকে কুরআনের সূরা শিখানোর মত উক্ত দুআও শিক্ষা দিতেন। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৯৪১ নং)
এ সব কিছু উক্ত দুআর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।
দু‘আ-এ মাসূরাহ্
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) নামাযে বহু প্রকার দুআ (প্রার্থনা) করতেন। এক এক সময়ে এক এক প্রকার দুআ তিনি পাঠ করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন। সাহাবাগণকে ‘তাহিয়্যাত’ শিখানোর পর বলেছিলেন, “এরপর তোমাদের মধ্যে যার যা ইচ্ছা ও পছন্দ সেই দুআ বেছে নিয়ে দুআ করা উচিৎ।” (বুখারী ৮৩৫, মুসলিম, মিশকাত ৯০৯নং) অবশ্য সেই দুআ অপেক্ষা আর কোন্ দুআ অধিকতর পছন্দনীয় হতে পারে, যা তিনি নিজে পড়েছেন বা অপরকে শিখিয়েছেন? তাঁর ঐ সকল দুআকে ‘দুআয়ে মাসূরাহ্’ বলা হয়, যা নিম্নরুপ:-
এক:
اَللّهًمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْمَأْثَمِ وَ مِنَ الْمَغْرَمِ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিনাল মা’সামি অ মিনাল মাগরাম।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট পাপ ও ঋণ হতে পানাহ চাচ্ছি। (বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি, মিশকাত ৯৩৯নং)
দুই:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিন শার্রি মা আমিলতু অ মিন শার্রি মা লাম আ’মাল।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট আমার কৃত (পাপের) অনিষ্ট হতে এবং অকৃত (পুন্যের) মন্দ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (নাসাঈ, সুনান ১৩০৬)
তিন:
اَللّهُمَّ حَاسِبْنِيْ حِسَاباً يَسِيْراً।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাহা-সিবনী হিসা-বাই য়্যাসীরা।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমার সহ্জ হিসাব গ্রহণ করো। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪৮,হাকেম, মুস্তাদরাক)
চার:
اَللّهُمَّ بِعِلْمِكَ الْغَيْبَ وَقُدْرَتِكَ عَلَى الْخَلْقِ، أَحْيِنِيْ مَا عَلِمْتَ الْحَيَاةَ خَيْراً لِّيْ وَتَوَفَّنِيْ إِذَا كَانَتِ الْوَفَاةُ خَيْراً لِّيْ، اَللّهُمَّ وَ أَسْأَلُكَ خَشْيَتَكَ فِي الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، وَ أَسْأَلُكَ كَلِمَةَ الْحَقِّ وَالْعَدْلِ فِي الْغَضَبِ وَالرِّضى، وَ أَسْأَلُكَ الْقَصْدَ فِي الْفَقْرِ وَالْغِنى، وَ أَسْأَلُكَ نَعِيْماً لاَّ يَبِيْدُ، وَأَسْأَلُكَ قُرَّةَ عَيْنٍ لاَّ تَنْفَدُ وَلاَ تَنْقَطِعُ، وَ أَسْأَلُكَ الرِّضى بَعْدَ الْقَضَاءِ، وَأَسْأَلُكَ بَرْدَ الْعَيْشِ بَعْدَ الْمَوْتِ، وَأَسْأَلُكَ لَذَّةَ النَّظَرِ إِلى وَجْهِكَ، وَالشَّوْقَ إِلى لِقَائِكَ، فِيْ غَيْرِ ضَرَّآءَ مُضِرَّةٍ، وَلاَ فِتْنَةٍ مُضِلَّةٍ، اَللّهُمَّ زَيِّنَّا بِزِيْنَةِ الإِيْمَانِ وَاجْعَلْناَ هُدَاةً مُهْتَدِيْنَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা বিইলমিকাল গাইবা অক্বুদরাতিকা আলাল খালক্ব, আহ্য়িনী মা আলিমতালহায়্যাতা খাইরাল লী, অতাওয়াফফানী ইযা কা-নাতিল অফা-তু খাইরাল লী। আল্লা-হুম্মা অ আসআলুকা খাশয়্যাতাকা ফিল গাইবি অশশাহা-দাহ্। অ আসআলুকা কালিমাতালহা ক্বি অলআদলি ফিল গাযাবি অররিযা। অ আসআলুকাল ক্বাসদা ফিল ফাক্বরি অলগিনা। অ আসআলুকা নাঈমাল লা য়্যাবীদ। অ আসআলুকা ক্বুর্রাতা আইনিল লা তানফাদু অলা তানক্বাতি’। অ আসআলুকার রিযা বা’দাল ক্বাযা-ই, অ আসআলুকা বারদাল আইশি বা’দাল মাউত। অ আসআলুকা লাযযাতান নাযারি ইলা অজহিক, অশশাওক্বা ইলা লিক্বা-ইক, ফী গাইরি যার্রা-আ মুযির্রাহ্, অলা ফিতনাতিম মুযিল্লাহ্। আল্লা-হুম্মা যাইয়িন্না বিযীনাতিল ঈমান, অজ্আলনা হুদা-তাম মুহ্তাদ্বীন।
অর্থ: হে আল্লাহ! তোমার অদৃশ্যের জ্ঞানে এবং সৃষ্টির উপর শক্তিতে আমাকে জীবিত রাখ যতক্ষণ জীবনকে আমার জন্য কল্যাণকর জান এবং আমাকে মৃত্যু দাও যদি মৃত্যু আমার জন্য কল্যাণকর হয়। হে আল্লাহ আর আমি গোপনে ও প্রকাশ্যে তোমার ভীতি চাই, ক্রোধ ও সন্তুষ্টিতে সত্য ও ন্যায্য কথা চাই, দারিদ্র ও ধনবত্তায় মধ্যবর্তিতা চাই, সেই সম্পদ চাই যা বিনাশ হয় না। সেই চক্ষুশীতলতা চাই যা নিঃশেষ ও বিচ্ছিন্ন হয় না। ভাগ্য-মীমাংসার পরে সন্তুষ্টি চাই, মৃত্যুর পরে জীবনের শীতলতা চাই, তোমার চেহারার প্রতি দর্শনের স্বাদ চাই, তোমার সাক্ষাতের প্রতি আকাঙ্খা চাই, বিনা কোন কষ্ট ও ক্ষতিতে, কোন ভ্রষ্টকারী ফিতনায়। হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঈমানের সৌন্দর্যে সুন্দর কর এবং আমাদেরকে হেদায়াতকারী ও হেদায়াতপ্রাপ্ত কর। (নাসাঈ১৩০৮, আহমাদ৪/ ৩৬৪)
পাঁচ:
اَللّهُمَّ إِنِّييْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ ظُلْماً كَثِيْراً وَّلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ فَاغْفِرْ لِيْ مَغْفِرَةً مِّنْ عِنْدِكَ وَارْحَمْنِيْ إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী যালামতু নাফসী যুলমান কাসী রাঁ উঅলা য়্যাগ্ফিরুয যুনূবা ইল্লা আন্তা ফাগ্ফিরলী মাগফিরাতাম মিন ইন্দিকা অরহামনী ইন্নাকা আন্তাল গাফূরুর রাহীম।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি নিজের উপর অনেক অত্যাচার করেছি এবং তুমি ভিন্ন অন্য কেহ্ গুনাহসমূহ মাফ করতে পারে না। অতএব তোমার তরফ থেকে আমাকে ক্ষমা করে দাও এবং আমার উপর দয়া কর। নিশ্চয় তুমি মহা ক্ষমাশীল বড় দয়াবান। (বুখারী, মুসলিম)
ছয়:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ مِنَ الْخَيْرِ كُلِّهِ عَاجِلِهِ وَآجِلِهِ مَا عَلِمْتُ مِنْهُ وَمَا لَمْ أَعْلَمْ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ الشَّرِّ كُلِّهِ عَاجِلِهِ وَآجِلِهِ مَا عَلِمْتُ مِنْهُ وَمَا لَمْ أَعْلَمْ، وَأَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ أَوْ عَمَلٍ، وَّأَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ أَوْ عَمَلٍ، وَأَسْأَلُكَ مِنَ الْخَيْرِ مَا سَألَكَ عَبْدُكَ وَ رَسُوْلُكَ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا اسْتَعَاذَكَ مِنْهُ عَبْدُكَ وَ رَسُوْلُكَ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَ أَسْأَلُكَ مَا قَضَيْتَ لِيْ مِنْ أَمْرٍ أَنْ تَجْعَلَ عَاقِبَتَهُ لِيْ رُشْداً।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাইন্নীআসআলুকা মিনাল খাইরি কুল্লিহীআ’ জিলিহী অ আ-জিলিহী মা আলিমতু মিনহু অমা লাম আ’লাম। অ আউযু বিকা মিনাশ শার্রি কুল্লিহী আ’-জিলিহী অ আ-জিলিহী মা আলিমতু মিনহু অমা লাম আ’লাম, অ আসআলুকাল জান্নাতা অমা ক্বার্রাবা ইলাইহা মিন ক্বাউলিন আউআমাল। অ আঊযু বিকা মিনান্না-রি অমা ক্বার্রাবা ইলাইহা মিন ক্বাউলিন আউআমাল। অ আসআলুকা মিনাল খাইরি মা সাআলাকা আব্দুকা অ রাসূলুকা মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম। অ আঊযু বিকা মিন শার্রি মাসতাআ-যাকা মিনহু আব্দুকা অরাসূলুকা মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম। অ আসআলুকা মা ক্বাযাইতা লী মিন আমরিন আন তাজ্আলা আ-ক্বিবাতাহু লী রুশ্দা।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট আমার জানা ও অজানা, অবিলম্বিত ও বিলম্বিত সকল প্রকার কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং আমার জানা ও অজানা, অবিলম্বিত ও বিলম্বিত সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তোমার নিকট জান্নাত এবং তার প্রতি নিকটবর্তীকারী কথা ও কাজ প্রার্থনা করছি, এবং জাহান্নাম ও তার প্রতি নিকটবর্তীকারী কথা ও কাজ থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তোমার নিকট সেই কল্যাণ ভিক্ষা করছি যা তোমার দাস ও রসূল মুহাম্মদ (সাঃ) তোমার নিকট চেয়েছিলেন। আর সেই অকল্যাণ থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা থেকে তোমার দাস ও রসূল মুহাম্মদ (সাঃ) তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। যে বিষয় আমার উপর মীমাংসা করেছ তার পরিণাম যাতে মঙ্গলময় হয় তা আমি তোমার নিকট কামনা করছি। (মুসলিম, সহীহ আহমাদ ৬/১৩৪, ত্বায়ালিসী)
সাত:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাতা অ আঊযু বিকা মিনান্না-র।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট জান্নাত চাচ্ছি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবু দাঊদ, সহীহ ইবনে মাজাহ্ ২/৩২৮)
আট:
اَللّهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাবআসু ইবা-দাক।
অর্থ: হে আল্লাহ! যেদিন তুমি তোমার বান্দাদেরকে পুনরুত্থিত করবে সেদিনকার আযাব থেকে আমাকে রক্ষা করো। (মুসলিম, মিশকাত ৯৪৭নং)
নয়:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ يَا الله بِأَنَّكَ الْوَاحِدُ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِيْ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ أَنْ تَغْفِرَ ليِْ ذُنُوِبْي إِنَّكَ أَنْتَ الغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ।
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইয়া-ল্লা-হু বিআন্নাকাল ওয়া-হিদুল আহাদুস স্বামাদুল্লাযী লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ, আন তাগ্ফিরা লী যুনূবী, ইন্নাকা আন্তাল গাফূরুর রাহীম।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, হে এক, একক, ভরসাস্থল আল্লাহ! যিনি জনক নন জাতকও নন এবং যাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তুমি আমার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দাও, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল দয়াবান।
এই দুআটি এক ব্যক্তি তাশাহ্হুদে পাঠ করেছিল। মহানবী (সাঃ) তা শুনে বললেন, “ওকে ক্ষমা করা হল, ওকে ক্ষমা করা হল।” (অর্থাৎ, আল্লাহ ওর দুআ কবুল করে নিয়েছেন।) (আবূদাঊদ, সুনান ৯৮৫নং, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১২৩৪নং, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
দশ:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدُ، لاَ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ الْمَنَّانُ بَدِيْعُ السَّموَاتِ وَالأَرْضِ،
يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ، يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ। إِنِّيْ أَسْاَلُكَ الْجَنَّةَ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআ লু কা বিআন্না লাকালহাম্দ, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তাল মান্না-নু বাদীউস সামা-ওয়া-তি অল আরয্ব, ইয়া যাল জালা-লি অল ইকরা-ম, ইয়্যাহাই য়্যু ইয়া কায়্যূম। ইন্নী আসআলুকাল জান্নাতা অআঊযু বিকা মিনান্না-র।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এই অসীলায় যে, সমস্ত প্রশংসা তোমারই, তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি পরম অনুগ্রহদাতা, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আবিষ্কর্তা, হে মহিমাময় এবং মহানুভব, হে চিরঞ্জীব অবিনশ্বর! আমি তোমার নিকট বেহেশ্ত প্রার্থনা করছি এবং দোযখ থেকে পানাহ চাচ্ছি।
এক ব্যক্তি তাশাহ্হুদে এই দুআ পাঠ করছিল। তা শুনে নবী (সাঃ) সাহাবাগণকে বললেন, “তোমরা কি জান, ও কি (বাক্য) দিয়ে দুআ করল?” তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই জানেন।’ তিনি বললেন, “সেই সত্তার কসম! যাঁরহাতে আমার প্রাণ আছে। ও তো আল্লাহর নিকট তাঁর ইসমে আ’যম (বৃহত্তম নাম) দ্বারা প্রার্থনা করেছে; যা দ্বারা দুআ করলে তিনি কবুল করেন ও যা দ্বারা তাঁর কাছে চাইলে তিনি দিয়ে থাকেন।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৪৯৫, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, প্রমুখ)
এগার:
মুআয বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমার হাত ধরে বললেন, “মুআয! আমি তোমাকে অবশ্যই ভালোবাসি।” আমি বললাম, আমিও আপনাকে ভালোবাসি, হে আল্লাহর রসূল! এরপর তিনি বললেন, “সুতরাং প্রত্যেক নামাযের পশ্চাতে তুমি এই দুআ বলতে ছেড়ো না,
اَللُّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা আইন্নী আলা যিক্রিকা অশুকরিকা অহুসনি ইবা-দাতিক।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার যিক্র (স্মরণ), শুক্র (কৃতজ্ঞতা) এবং সুন্দর ইবাদত করতে সাহায্য দান কর। (আহমাদ, মুসনাদ ৫/২৪৪, ২৪৫, ২৪৭, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ১৩০২ নং)
বার:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَأعُوْذُ بِكَ مِنْ أَنْ أُرَدَّ إِلى أَرْذَلِ الْعُمُرِ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَ عَذَابِ الْقَبْرِ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিনাল বুখলি অ আউযু বিকা মিনাল জুবনি অ আউযু বিকা মিন আন উরাদ্দা ইলা আরযালিল উমুরি অ আঊযু বিকা মিন ফিতনাতুদ্দুন্য়্যা অ আযা-বিল ক্বাব্র।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট কার্পণ্য ও ভীরুতা থেকে পানাহ চাচ্ছি, স্থবিরতার বয়সে কবলিত হওয়া থেকে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি আর দুনিয়ার ফিতনা ও কবরের আযাব থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি। (বুখারী, মিশকাত ৯৬৪নং)
তের:
اللّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ، إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الْغَفُوْر।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাগফির লী অতুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আন্তাত তাউওয়াবুল গাফূর।
অর্থ: আল্লাহ গো! তুমি আমাকে ক্ষমা কর এবং আমার তওবা গ্রহণ কর। নিশ্চয় তুমি তওবাগ্রহণকারী, বড় ক্ষমাশীল।
এই দুআটি তিনি নামাযের শেষাংশে ১০০ বার পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৫/৩৭১, ইবনে আবী শাইবা, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৬০৩নং)
চৌদ্দ:
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ।
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিনাল কুফরি অলফাক্বরি অআযা-বিল ক্বাবর।
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট কুফরী, দারিদ্র ও কবরের আযাব থেকে পানাহ চাচ্ছি। (হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩৫, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৩৩পৃ:)
পনেরো:
اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ وَمَا أَسْرَفْتُ وَمَا أَنْتَ
أَعْلَمُ بِهِ مِنِّيْ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ لآ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাগফিরলী মা ক্বাদ্দামতু অমা আখখারতু অমা আসরারতু অমা আ’লানতু অমা আসরাফতু অমা আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নী, আন্তাল মুক্বাদ্দিমু অ আন্তাল মুআখখিরু লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মার্জনা কর, যে অপরাধ আমি পূর্বে করেছি এবং যা পরে করেছি, যা গোপনে করেছি এবং যা প্রকাশ্যে করেছি, যা অতিরিক্ত করেছি এবং যা তুমি অধিক জান। তুমি আদি তুমিই অন্ত। তুমি ব্যতীত কেউসত্য উপাস্য নেই।
এই দুআটি সবার শেষে পাঠ করে তিনি সালাম ফিরতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭৭১নং)
তাশাহহুদের পর
নামায ২ রাকআত বিশিষ্ট (যেমন ফজর, জুমুআহ, ঈদ প্রভৃতি) হলে দুআ মাসূরার পর সালাম ফিরলে নামায শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ৩ বা ৪ রাকআত বিশিষ্ট (মাগরিব, এশা, যোহ্র, আসর, ইত্যাদি) হলে তাশাহহুদ পড়ে তৃতীয় রাকআতের জন্য উঠে যেতে হবে। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘---অতঃপর নামাযের মাঝে হলে নবী (সাঃ) তাশাহহুদ পাঠ করে উঠে যেতেন। নচেৎ নামাযের শেষে হলে তাশাহহুদের পর যতক্ষণ ইচ্ছা (মাশাআল্লাহ) দুআ পড়তেন, তারপর সালাম ফিরতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৪৫৯, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭০৮নং, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/১৪২)
প্রশ্ন ওঠে, দরুদও কি তাশাহহুদের শামিল?
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর মতে তাশাহহুদ ও দরুদ একই জিনিস। অর্থাৎ, সব তাশাহ্হুদেই দরুদ পড়তে হবে। (কিতাবুল উম্ম ১/১০২, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৭০পৃ:) তাছাড়া উপরোক্তহাদীসে তাশাহহুদ ও দুআর কথা আছে, দরুদের কথা নেই। আর তার মানেই তাশাহ্হুদে দরুদ অবশ্যই শামিল আছে।
পরন্তু সাহাবাগণ তাশাহ্হুদে সালাম শিখার পর মহানবী (সাঃ) কে বললেন, (তাশাহ্হুদে) কেমন করে আমরা আপনার প্রতি সালাম পেশ করব তা (তাহিয়্যাত) তো শিখলাম। কিন্তু আপনার উপর দরুদ কিভাবে পাঠ করব (তা শিখিয়ে দিন)। তখন তিনি বললেন, “তোমরা বল, আল্লা-হুম্মা স্বাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ---।” সুতরাং এখানেও স্পষ্টত: দরুদ তাশাহহুদেরই শামিল। তাছাড়া এখানে প্রথম না শেষ তাশাহহুদ তা নির্দিষ্ট নয়। অতএব বলা যায় যে, প্রথম তাশাহ্হুদেও দরুদ পড়তে হবে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৬৪পৃ:)
অবশ্য মা আয়েশা رضي الله عنها এর একটিহাদীসে প্রথম তাশাহ্হুদে স্পষ্ট দরুদ পড়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর জন্য তাঁর মিসওয়াক ও ওযুর পানি প্রস্তুত রাখতাম। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি রাত্রের কোন অংশে জেগে উঠতেন। তারপর মিসওয়াক করে ওযু করতেন। অতঃপর ৯ রাকআত নামায পড়তেন। এতে তিনি অষ্টম রাকআত ছাড়া পূর্বে আর কোথাও (তাশাহহুদের জন্য) বসতেন না। সুতরাং (অষ্টম রাকআতে বসে) আল্লাহর নিকট দুআ করতেন এবং তাঁর নবীর উপর দরুদ পাঠ করতেন। অতঃপর সালাম না ফিরে তিনি উঠে যেতেন। তারপর নবম রাকআত পড়ে বসতেন। অতঃপর তাঁর প্রতিপালকের প্রশংসা বর্ণনা করে তাঁর নবীর উপর দরুদ পাঠ করতেন এবং দুআ করতেন। অতঃপর আমাদেরকে শুনিয়ে সালাম ফিরতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ২/৩২৪, ভিন্ন শব্দে ঘটনাটি রয়েছে মুসলিমে ৭৪৬ নং)
উক্ত ব্যাপারটি তাহাজ্জুদ বা বিত্র নামাযের হলেও এর আমল ফরয নামাযেও চলবে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২২৪-২২৫পৃ:) এ জন্যই ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ্)ও বলেন, নামাযী প্রথম তাশাহ্হুদে দরুদ পড়বে। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্ ১২৯পৃ:)
আবার প্রথম তাশাহ্হুদে দুআ করার কথাও একাধিকহাদীসে উল্লেখ হয়েছে। যেমন উপরোক্ত হযরত আয়েশা رضي الله عنها এরহাদীসেও দুআর কথা স্পষ্টভাবে রয়েছে। একহাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমরা প্রত্যেক দু’ রাকআতে বসবে, তখন ‘আত্-তাহিয়্যাতু---’ বল। অতঃপর তোমাদের প্রত্যেকের পছন্দমত দুআ বেছে নিয়ে আল্লাহর নিকট দুআ কর।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১১১৪ নং, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম)
সুতরাং প্রথম তাশাহ্হুদেও দুআ করা বিধেয়। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৬০পৃ:)
পরন্তু গরম পাথরের উপর বসে এত কিছু পড়া কি সম্ভব? কারণ নবী (সাঃ) প্রথম বৈঠক থেকে এত তাড়াতাড়ি উঠতেন যে, মনে হত তিনি যেন গরম পাথরের উপর বসেছিলেন। কিন্তু এ হাদীসটি যয়ীফ। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৭৭, যতিরমিযী, সুনান ৫৭, যনাসাঈ, সুনান ৫৫নং, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২২৪পৃ:)
তৃতীয় রাকআত
তাশাহহুদ শেষ করে তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট নামাযের জন্য যখন মহানবী (সাঃ) উঠতেন, তখন ‘তকবীর’ (আল্লাহু আকবার) বলতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৯নং) তিনি ওঠার পূর্বেই তকবীর দিতেন। (আবূ য়্যা’লা, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬০৪নং) ওঠার পর নয়।
দুই হাত দ্বারা মাটির উপর ভর করে (খমীর সানার মত উভয় হাতকে মাটিতে রেখে) উঠে খাড়া হতেন। (আবূ ইসহাকহারবী, বায়হাকী, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৯৬পৃ:)
আযরাক বিন কাইস বলেন, আমি ইবনে উমার (রাঃ) কে দেখেছি, তিনি যখন দ্বিতীয় রাকআত থেকে (তৃতীয় রাকআতের জন্য) উঠতেন, তখন তাঁর উভয়হাত দ্বারা মাটির উপর ভর করতেন। পরে আমি তাঁর ছেলে ও তাঁর সঙ্গীদেরকে বললাম, ‘সম্ভবত: এরুপ তিনি তাঁর বাধ্যকের কারণে করে থাকেন।’ কিন্তু তাঁরা বললেন, ‘না, বরং এইরুপই হবে।’ (অর্থাৎ, এইরুপ ওঠাই সুন্নত।) (বায়হাকী ২/১৩৫, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২০০পৃ:)
এই সময় তিনি ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯৪নং) খাড়া হওয়ার পর তিনি দ্বিতীয় রাকআতের মত সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। কিন্তু এই রাকআতে অন্য সূরা পাঠ করতেন না। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮২৮নং)
অবশ্য কখনো কখনো যোহরের নামাযে (প্রায় ১৫) আয়াত মত অন্য সূরা পাঠ করতেন। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৯, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৫০৯, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৩, ১৭৮পৃ:)
সুতরাং শেষ (তৃতীয় ও চতুর্থ) রাকআতে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ করা ও না করা উভয়ই বৈধ। যোহরের নামাযের উপর কিয়াস করে অন্যান্য নামাযেও পড়া বৈধ। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ১/২৫৬, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৩পৃ:)
তাছাড়া উক্ত হাদীসে সাহাবাগণ তাঁর যোহরের প্রথম দু’ রাকআতে প্রায় ৩০ আয়াত মত, শেষ দু’ রাকআতে তার অর্ধেক প্রায় ১৫ আয়াত মত, আসরের প্রথম দু’ রাকআতে তার অর্ধেক প্রায় ৭/৮ আয়াত মত এবং শেষ দু’ রাকআতে তার অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৩/৪ আয়াত মত পড়া আন্দাজ করতেন। এতে বুঝা যায় যে, আসরের শেষ দু’ রাকআতেও অন্য সূরা (অপেক্ষাকৃত ছোট ধরনের) পড়া চলবে।
এ ছাড়া আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নামাযে ক্বিরাআত আছে ----। কিন্তু যে ব্যক্তি কেবল সূরা ফাতিহা পড়বে, তা তার জন্য যথেষ্ট হবে। আর যে ব্যক্তি এর বেশী পড়বে, তা তার জন্য উত্তম হবে।’ (বুখারী ৭৭২, মুসলিম, সহীহ ৩৯৬ নং) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘পুরো নামাযেই ক্বিরাআত পড়া হয়---।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৬ নং) অর্থাৎ প্রত্যেক রাকআতেই। হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, ‘নামাযের সমস্ত রাকআতেই ক্বিরাআত মুস্তাহাব।’ অবশ্য আবূ হুরাইরার এইহাদীসের প্রকাশ্য অর্থ তাই ইঙ্গিত করে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৯৫) সুতরাং সূরা ফাতিহার পর মহানবী (সাঃ) এর অন্য এক সূরা পড়া ও না পড়ার ব্যাপারে উভয় প্রকার বর্ণনা থাকায় এ কথা বলা যায় যে, তিনি শেষ দু’ রাকআতে কখনো কখনো সূরা পড়তেন, আবার কখনো পড়তেন না।
মোট কথা, তিন বা চার রাকআত নামাযে সূরা ফাতিহার পর প্রত্যেক রাকআতেই সূরা লাগানো যায়। কোন রাকআতেই না লাগালেও চলে। আবার কেবল প্রথম দু’ রাকআতে লাগিয়ে শেষ রাকআতগুলিতে না পড়লেও চলে। সব রকমই জায়েয।
ক্বিরাআতের পর মহানবী (সাঃ) বাকী রুকূ, কওমাহ্, সিজদাহ ও বৈঠক প্রভৃতি পূর্বের রাকআতের মত করে মাটির উপর উভয়হাত দ্বারা ভর করে তকবীর বলে চতুর্থ রাকআতের জন্য উঠে খাড়া হতেন। আর এই সময় তিনি কখনো কখনো ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান)
চতুর্থ রাকআত
নামায ৩ রাকআত বিশিষ্ট (মাগরেবের) হলে ৩ রাকআত পড়ে, নচেৎ ৪ রাকআত বিশিষ্ট হলে তা তৃতীয় রাকআতের মত পড়ে শেষ তাশাহহুদের জন্য বসে যেতেন। এই বৈঠকে তিনি তাঁর বাম পাছার উপর বসতেন। এতে তাঁর দু’টি পায়ের পাতা এক দিকে হয়ে যেত। (বুখারী ৮২৮, আবূদাঊদ, সুনান ৯৬৫নং, বায়হাকী) বাম পা-কে ডান পায়ের রলা ও ঊরুর নিচে রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ) আর ডান পায়ের পাতাকে খাড়া রাখতেন। (বুখারী ৮২৮নং) কখনো কখনো খাড়া না রেখে বিছিয়েও রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯, আহমাদ, মুসনাদ) পায়ের আঙ্গুলগুলো কেবলামুখী করে রাখতেন। তাঁর হাত দু’টি প্রথম বৈঠকের মতই থাকত। অবশ্য বামহাত দ্বারা বাম জানুর উপর ভরনা দিতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৮৯, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১২০৫ নং)
সুতরাং পাছার উপর বসা কেবল ৩ বা ৪ রাকআত (অন্য কথায় দুই তাশাহহুদ) বিশিষ্ট নামাযে সুন্নত। পক্ষান্তরে এক তাশাহহুদ বিশিষ্ট ২ রাকআত নামাযে বাম পায়ের পাতার তলদেশ বিছিয়ে তার উপর বসা সুন্নত। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৬, ১৮১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০০, মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্ ১২৮পৃ:) কারণ পাছার উপর বসার কথাহাদীসে কেবল দুই তাশাহহুদ বিশিষ্ট নামাযের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। নচেৎ নামাযে বসার সাধারণ সুন্নত হল, বাম পায়ের পাতার উপরেই বসা। (নাসাঈ, সুনান ১১৫৬, ১১৫৭, ১১৫৮, ১২৬১, দারেমী, সুনান ১৩৩০ নং)
অতঃপর নবী মুবাশ্শির (সাঃ) তাশাহহুদ ও দুআ আদি পড়ে ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেন,
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله।
‘আস্সালা-মু আলাইকুম অরাহ্মাতুল্লা-হ্।’
অর্থাৎ, তোমাদের উপর শান্তি ও আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক।
তিনি এতটা মুখ ফিরাতেন যে, (পেছন থেকে) তাঁর ডান গালের শুভ্রতা দেখা যেত। অতঃপর বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে অনুরুপ বলে সালাম ফিরতেন। আর এতেও তাঁর বাম গালের শুভ্রতা (পেছন থেকে) দেখা যেত। (মুসলিম, সহীহ ৫৮২, আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৬ নং, নাসাঈ, সুনান)
কখনো কখনো তিনি ডান দিকের (প্রথম) সালামের সাথে ‘---অবারাকাতুহ্’ও যোগ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৭, ত্বাবারানী, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, আবূ য়্যা’লা ৩/১২৫২)
আবার কখনো ডান দিকে ‘আস্সালা-মু আলাইকুম অরাহ্মাতুল্লা-হ্’ এবং বাম দিকে কেবল ‘আস্সালা-মু আলাইকুম’ বলে সালাম ফিরতেন। (নাসাঈ, সুনান ১৩২০ নং, আহমাদ, মুসনাদ, সিরাজ) আবার কখনো বা ডান দিকে একটু ঝুঁকে ঐ মুখেই ‘আস্সালা-মু আলাইকুম’ বলে মাত্র একটি সালাম ফিরতেন। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭২৯, বায়হাকী, মাক্বদেসী, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম আউসাত্ব,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩২৭ নং) মা আয়েশা رضي الله عنها এরও এই আমল ছিল। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩০, ৭৩২, বায়হাকী ২/১৭৯) অনুরুপ এক সালামের আমল ছিল যুবাইর (রাঃ) এরও। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩১ নং, বায়হাকী ২/১৭৯) অতএব কখনো কখনো এ সুন্নাহ্ পালন করা আমাদেরও উচিৎ।
সালাম ফিরার সময় হাত দ্বারা ইশারা বৈধ নয়। একদা সাহাবাদেরকে এমন ইশারা করতে দেখলে তিনি বললেন, “কি ব্যাপার তোমাদের? দুরন্ত ঘোড়ার লেজের মত করে হাত দ্বারা ইশারা করছ? যখন তোমাদের কেউ সালাম ফিরবে, তখন সে যেন তার (পার্শ্ববর্তী) সঙ্গীর প্রতি চেহারা ফেরায় এবং হাত দ্বারা ইশারা না করে।” অতঃপর সাহাবাগণ এরুপ ইশারা করা হতে বিরত হয়ে যান।
অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, “তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, (সালাম ফিরার সময়) হাত নিজ ঊরুর উপর রাখবে। অতঃপর ডাইনে ও বামে (উপবিষ্ট) ভাই-এর প্রতি সালাম দেবে।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩১, আহমাদ, মুসনাদ, সিরাজ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩৩ নং, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম)
উক্ত হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জামাআতের নামাযে নামাযী সালাম দেয় পাশের নামাযীকে। কিন্তু একা নামাযে সালাম দেওয়া হয় ফিরিশ্তাকে। পরন্তু পাশের নামাযী সালাম ফিরলে তার জওয়াব দিতে হয় না। কারণ, সে সময় সকলেই একে অপরকে সালাম দিয়ে থাকে। অতএব জওয়াব থাকে তাতেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৮৮-২৮৯)
যেরুপ সালাম ফেরার সময় হাতের ইশারা বৈধ নয়, তদ্রুপ বিধেয় নয় মাথা হিলানোও। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৮৯পৃ:)
সালাম ফিরেই নামাযের কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে খেয়াল রাখার বিষয় যে, যে তরতীব ও পর্যায়ক্রমে মহানবী (সাঃ) নামায ও তার সকল আমল সম্পন্ন করেছেন, সেই পর্যায়ক্রমেই নামায পড়া নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত অথবা ফরয। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ৯৫পৃ:)
দশটি সূরা এবং তার উচ্চারণ ও অনুবাদ
নিম্নে কয়েকটি ছোট ছোট সূরা উচ্চারণ ও অর্থসহ্ লেখা হল। এগুলি এবং অন্যান্য আরো বড় সূরা কুরআন মাজীদ থেকে অথবা কোন ক্বারীর মুখ থেকে শুনে মুখস্থ করা নেওয়া নামাযীর কর্তব্য। প্রকাশ থাকে যে, কুরআনী আয়াতের উচ্চারণ অন্য ভাষায় করা সম্ভব নয় এবং অনেক উলামার মতে তা বৈধও নয়।
(১) সূরা নাস
قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) إِلهِ النَّاسِ (৩) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ (৪) اَلَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِي صُدُوْرِ النَّاسِ (৫) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ (৬)
উচ্চারণ:- ক্বুল আঊযু বিরব্বিন্ না-স। মালিকিন্ না-স। ইলা-হিন্ না-স। মিন্ শার্রিল অসওয়া-সিল খান্না-স। আল্লাযী ইউওয়াসবিসু ফী সুদূরিন্ না-স। মিনাল জিন্নাতি অন্ না-স।
অর্থ:- তুমি বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, মানুষের প্রতিপালক, মানুষের অধীশ্বর, মানুষের উপাস্যের কাছে- তার কুমন্ত্রণার অনিষ্ট হতে, যে সুযোগমত আসে ও (কুমন্ত্রণা দিয়ে) সরে পড়ে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের হৃদয়ে, জিন ও মানুষের মধ্য হতে।
(২) সূরা ফালাক্ব
قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (১) مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ (২) وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ (৩) وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ (৪) وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ (৫)
উচ্চারণ:- ক্বুল আঊযু বিরব্বিল ফালাক্ব। মিন শার্রি মা খালাক্ব। অমিন শার্রি গা-সিক্বিন ইযা অক্বাব। অমিন শার্রিন্ নাফ্ফা-ষা-তি ফিল উক্বাদ। অমিন শার্রিহা-সিদিন ইযাহাসাদ।
অর্থ:- তুমি বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রভুর নিকট। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে। এবং রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। এবং গ্রন্থিতে ফুত্কারিণী (যাদুকরী)দের অনিষ্ট হতে। এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে যখন সে হিংসা করে।
(৩) সূরা ইখলাস
قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ (১) اَللهُ الصَّمَدُ (২) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ (৩) وَلَمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُواً أَحَدٌ (৪)
উচ্চারণ:- ক্বুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ। আল্লা-হুস সামাদ। লাম য়্যালিদ, অলাম ইউলাদ। অলাম য়্যাকুল্ লাহু কুফুওয়ান আহাদ।
অর্থ:- বল, তিনি আল্লাহ একক। আল্লাহ ভরসাস্থল। তিনি জনক নন এবং জাতকও নন। আর তাঁর সমকক্ষ কেউই নেই।
(৪) সূরা লাহাব
تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَّتَبَّ (১) مَا أَغْنى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ (২) سَيَصْلى نَاراً ذَاتَ لَهَبٍ (৩) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (৪) فِيْ جِيْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ (৫)
উচ্চারণ:- তাব্বাৎ য়্যাদা আবী লাহাবিঁউঅতাব্ব মা আগনা আনহু মা-লুহু অমা কাসাব। সায়্যাস্বলা না-রান যা-তা লাহাব। অমরাআতুহুহাম্মা-লাতালহাত্বাব। ফী জীদিহাহাবলুম মিম মাসাদ।
অর্থ:- ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের দুইহাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও উপর্জিত বস্তু তার কোন উপকারে আসবে না। সে প্রবেশ করবে লেলিহান শিখাবিশিষ্ট অগ্নিকুন্ডে। আর তার স্ত্রীও -যে কাঠের বোঝা বহনকারিণী। ওর গলদেশে খেজুর চোকার রশি হবে।
(৫) সূরা নাস্বর
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجاً (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً (৩)
উচ্চারণ:- ইযা জা-আ নাস্বরুল্লা-হি অল ফাতহ। অরাআইতান্ না-সা ইয়্যাদখুলুনা ফী দ্বীনিল্লা-হি আফওয়াজা। ফাসাব্বিহ্ বিহামদি রাব্বিকা অস্তাগফিরহু; ইন্নাহু কা-না তাউওয়া-বা।
অর্থ:- যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। তুমি দেখবে মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল।
(৬) সূরা কা-ফিরুন
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ (১) لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ (২) وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ (৩) وَلاَ أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدْتُّمْ (৪) وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ (৫) لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ (৬)
উচ্চারণ:- ক্বুল ইয়া আই য়ুহাল কা-ফিরুন। লা- আ’বুদু মা- তা’বুদূন। অলা- আন্তুম আ’-বিদূনা মা- আ’বুদ। অলা- আনা আ’-বিদুম মা আ’বাত্তুম। অলা- আন্তুম আ’-বিদূনা মা- আ’বুদ। লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়া দ্বীন।
অর্থ:- বল, হে কাফের দল! আমি তার উপাসনা করি না, যার উপাসনা তোমরা কর। তোমরাও তাঁর উপাসক নও, যাঁর উপাসনা আমি করি। আমি তার উপাসক হ্ব না, যার উপাসনা তোমরা কর। আর তোমরাও তাঁর উপাসক নও, যাঁর উপাসনা আমি করি। তোমাদের ধর্ম তোমাদের এবং আমার ধর্ম আমার (কাছে প্রিয়)।
(৭) সূরা কাউষার
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (১) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (২) إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الأَبْتَرُ (৩)
উচ্চারণ:- ইন্না- আ’ত্বাইনা-কাল কাউষার। ফাস্বাল্লি লিরব্বিকা অন্হার। ইন্না- শা-নিআকা হুওয়াল আবতার।
অর্থ:- নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে কাউসার (হাওয) দান করেছি। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড় এবং কুরবানী কর। নিশ্চয় তোমার শত্রুই হল নির্বংশ।
(৮) সূরা ক্বুরাইশ
لإِيْلاَفِ قُرَيْشٍ (১) إِيْلاَفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ (২) فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هذَا الْبَيْتِ (৩) اَلَّذِيْ أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوْعٍ وَّآمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ (৪)
উচ্চারণ:- লিঈলা-ফি ক্বুরাইশ্ ঈলা-ফিহিম রিহ্লাতাশ শিতা-ই অস্স্বাইফ্ ফাল য়্যা’বুদু রব্বাহা-যাল বাইত্ আল্লাযী আত্বআমাহুম মিন জু’ । অআ-মানাহুম মিন খাঊফ।
অর্থ:- যেহেতু কুরাইশের জন্য শীত ও গ্রীষ্মের সফরকে তাদের স্বভাব সুলভ করা হয়েছে, সেহেতু ওরা উপাসনা করুক এই গৃহের রক্ষকের। যিনি ক্ষুধায় ওদেরকে আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হতে নিরাপদ করেছেন।
(৯) সূরা ফীল
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيْلِ (১) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ (২) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيْلَ (৩) تَرْمِيْهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ (৪) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ (৫)
উচ্চারণ:- আলাম তারা কাইফা ফাআলা রব্বুকা বিআস্বহা-বিল ফীল। আলাম য়্যাজ্আল কাইদাহুম ফী তায্বলীল। অআরসালা আলাইহিম ত্বাইরান আবা-বিল। তারমীহিম বিহিজারাতিম মিন সিজ্জীল। ফাজাআলাহুম কাআস্বফিম মা’কূল।
অর্থ:- তুমি কি দেখ নি, তোমার প্রতিপালক হ্স্তীবাহিনীর সঙ্গে কি করেছিলেন? তিনি কি ওদের কৌশলকে ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন। যারা ওদের উপর নিক্ষেপ করে কঙ্কর। অতঃপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন।
(১০) সূরা আসর
وَالْعَصْرِ (১) إِنَّ الإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ (২) إِلاَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (৩)
উচ্চারণ:- অল আসর। ইন্নাল ইনসা-না লাফী খু সর। ইল্লাল্লাযীনা আ-মানূ অআ’মিলুস স্বা-লিহা-তি অতাওয়াস্বাউবিলহাক্বি অতাওয়াস্বাউবিসস্বাবর।
অর্থ:- মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে তারা নয়, যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করেছে এবং একে অপরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।
অর্থ:- আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (৩ বার)
কিছু যিক্র আছে, যা লোক মাঝে প্রচলিত অথচ তা সহীহ সুন্নাহর অনুকূল নয়, অথবা তা মনগড়া; যা ত্যাগ করে সহীহ সুন্নাহ্ ভিত্তিক যিক্র ও দু'আ পড়া কর্তব্য।
‘আল্লা-হুম্মা আজিরনী মিনান্না-র।’ ফজর ও মাগরেব পর ৭ বার করে পাঠ করে ঐ দিনে বা রাতে মারা গেলে দোযখ থেকে নিস্ক্রিতি পাওয়া যায়। এ হাদীসটি সহীহ নয়, বরং যয়ীফ। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ১৬২৪ নং)
মাথায় হাত রেখে ‘ইয়া ক্বাবিয়্যু’ বা ‘ইয়া নূরু’ বলা। এটি মনগড়া।
মাথায় হাত রেখে ‘বিসমিল্লাহিল্লাযী ---- আল্লাহুম্মা আযহিব আন্নলহাম্মা অলহুযন।’ এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি খুব দুর্বল অথবা জাল। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৬৬০, ১০৫৯ নং)
এত এত বার দরুদ পড়া। দরুদ সালামের পূর্বে বা অন্যান্য অনির্দিষ্ট সময়ে পড়াই বিধেয়।
মিলিত কণ্ঠে অথবা একাকী ‘আসসালা-তু অসসালা-মু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্’ বলা। এটি বিদআত। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৭০-৭১, ২০/১৪৭)
প্রকাশ থাকে যে, তাসবীহ ডানহাতে গোনাই হল সুন্নত। মহানবী (সাঃ) ডানহাতের আঙ্গুল দ্বারাই তাসবীহ গুনেছেন এবং অপরকে ডানহাতের আঙ্গুল ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর তিনি বলেছেন যে, ঐ আঙ্গুলগুলোকে কিয়ামতের দিন কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫০১, মিশকাত ২৩১৬ নং) সুতরাং তাসবীহ মালা ব্যবহার করা বিধেয় নয়। এতে রয়েছে রিয়ার (লোক-প্রদর্শনের) গন্ধ, যা ছোট শির্ক। পক্ষান্তরে কাঁকর বা খেজুর আঁটি দ্বারা তাসবীহ গোনার হাদীস সহীহ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫০০, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৯৩পৃ:)
ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত প্রসঙ্গে
নামাযী যখন নামায পড়ে তখন সে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে। আল্লাহর সাথে নিরালায় যেন কানে কানে কথা বলে। (মুঅত্তা, মুসনাদে আহ্মদ ২/৩৬, ৪/ ৩৪৪)
নামাযের মাঝেই আব্দ (দাস) মাবুদের (প্রভুর) ধ্যনে ধ্যানমগ্ন থাকে। যেন সে তাকে দেখতে পায়। যতক্ষণ সে নামাযে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর সাথে কথা বলে। তিনি তার প্রতি মুখ ফিরান এবং সালাম না ফিরা পর্যন্ত তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন না। (বাইহাকী, সহীহুল জামে’১৬১৪ নং)
পরক্ষণে যখনই সে সালাম ফিরে দেয় তখনই সে মুনাজাতের অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দূর হয়ে যায় নৈকট্যের বিশেষ যোগসূত্র। বান্দা সরে আসে সেই মহান বিশ্বাধিপতির খাস দরবার থেকে। সুতরাং তার নিকট কিছু চাওয়া তো সেই সময়ে অধিক শোভনীয় যে সময়ে ভিখারী বান্দা তাঁর ধ্যনে তার নিকটে ও তাঁর খাস দরবারে থাকে। অতএব সেই নৈকট্যের ধ্যান ভঙ্গ করে এবং মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশিত মুনাজাত থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় মুনাজাত সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত নয়।
অবশ্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত যে, একদা সাহাবাগণ আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে কোন্ সময় দুআ অধিকরুপে কবুল হয় - সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, “গভীর রাতের শেষাংশে এবং সকল ফরয নামাযের পশ্চাতে।” (তিরমিযী, সুনান ৩৪৯৯, নাসাঈ, সুনান আমালুল ইয়াউমি অল্লাইলাহ্ ১০৮নং, মিশকাত ৯৬৮ নং) হাদীসটি অনেকের নিকট দুর্বল হলেও আসলে তা হাসান। (তিরমিযী, সুনান২৭৮২নং)
সুতরাং এটাই হ্চ্ছে ফরয নামাযের পর মুনাজাত করার প্রায় সহীহ ও সব চেয়ে বড় দলীল, যদিও এতে হাত তুলে দুআর কথা নেই। এইখান হতেই ধোকা খেয়ে মুনাজাত-প্রেমীরা উদ্ভাবন করেছেন যে, ‘ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। আর হাত তুলে দুআ করলে আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। তাছাড়া নামাযের পর লোক ও জামাআত বেশী থাকে। আর জামাআতী দুআ বেশী কবুল হয়।’ ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে আযানের সময়, আযান ও ইকামতের মাঝে, ইকামতের সময়, বৃষ্টি বর্ষণের সময় ও আরো যে সব সময়ে দুআ কবুল হয় সে সব সময়ে কৈ জামাআতী দুআ নজরে পড়ে না। অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কেবল ফরয নামাযের পর দুআ।
শুরুতে একটা কথা খেয়াল রাখা উচিৎ যে, ইবাদত যখন, যেভাবে, যে গুণ, সংখ্যা ও পদ্ধতিতে বিধিবদ্ধ হয়েছে প্রত্যেকটি ইবাদত সেই গুণ, পদ্ধতি, সংখ্যা ও সময় অনুসারে করা জরুরী। অনির্দিষ্ট বা সাধারণ থাকলে তা কোন গুণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা বিদআতের পর্যায়ভুক্ত।
সুতরাং দুআর এক সাধারণ নিয়ম হল, হাত তুলে দুআ করা। অর্থাৎ কেউ নিজ প্রয়োজন সাধারণ সময়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে হাত তুলে করবে। এখন যদি কেউ বলে, ‘আমি আমার প্রয়োজন নামাযে চাই বা না চাই, নামাযের পরে রসূলের বা নিজের ভাষায় হাত তুলে চাইব’- তাহলে তার প্রথমে জানা উচিৎ যে, নামাযের পর একটি নির্দিষ্ট সময়। আর তাতে রয়েছে নির্দিষ্ট ইবাদত (যিকর-আযকার)। অতএব ঐ নির্দিষ্ট সময়ে শরীয়ত কি করতে নির্দেশ করেছে? যা করতে নির্দেশ করেছে তার নিয়ম কি? ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে অনুরুপ সাধারণ নিয়ম সংযোজন করা যাবে না। করলেই তা অতিরঞ্জন তথা বিদআত রুপে পরিগণিত হবে। ফলকথা, তাকে দেখতে হবে যে, ঐ নির্দিষ্ট ইবাদতের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টরুপে দুআ বা মুনাজাতের নির্দেশ শরীয়তে আছে কি? নচেৎ আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (শরীয়তের) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যা ওর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী মুসলিম, মিশকাত১৪০নং) “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যার উপর আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম ১৭১৮নং)
• এবার প্রশ্ন থাকছে উপরোক্ত হাদীস মুনাজাতের স্বপক্ষে দলীল কি না?
উক্তহাদীসে যে ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে তার অর্থ হল, পিঠ, পাছা, পশ্চাৎ বা শেষাংশ। যাঁদের অর্থে ‘দুবুর’ মানে ‘পরে’, তাঁদের মতে এই হাদীসটি ফরয নামাযের পর দুআ বা মুনাজাতের বড় দলীল। (যদিও হাত তুলে নয়।) কিন্তু উক্ত হাদীসে ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ পরে করা ঠিক কি ?
এখন যদি বলি, ‘গরুর দুবুর (পাছা)’, তাহলে শ্রোতা এই বুঝবে যে, গরুর পাছা দেহের অবিচ্ছেদ্য পিছনের অঙ্গ। তার দেহাংশের বাইরের কিছু নয়। সুতরাং নামাযের দুবুর, বা পাছা অথবা পশ্চাৎ বলতে বুঝা দরকার যে, তা নামাযেরই শেষ অঙ্গ বা অংশ। নামাযের বাইরে কিছু নয়; অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বের অংশ।
অবশ্য ‘দুবুর’ (পশ্চাৎ) বলে পরের অংশকেও বুঝানো যায়। যেমন যদি বলি, ‘ইমাম সাহেব বাসের দুবুরে (পশ্চাতে বা পেছনে) দাঁড়িয়ে আছেন।’ তাহলে ইমাম সাহেবকে যে দেখেনি সে শ্রোতা দুই রকম বুঝতে পারে; প্রথমত: এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনের অংশে বাসের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছেন। আর দ্বিতীয়ত: এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনে রোড (বাসের বাইরে) দাঁড়িয়ে আছেন। আর এক্ষেত্রে শ্রোতার দুই প্রকার বুঝাই সঠিক, ভুল নয়। কিন্তু ইমাম সাহেবের আসল দাঁড়াবার জায়গা বাস্তবপক্ষে একটাই, বিধায় অপরটি অসম্ভব।
সুতরাং উক্ত হাদীসের অর্থ যদি ‘নামাযের পশ্চাতে অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বে দুআ কবুল হয়’ বলি, তাহলে একথাও বলতে হয় যে, ‘সালাম ফেরার পূর্বেই তাসবীহ-তাহ্লীলও করতে হবে।’ কারণ ওখানেও ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থে উলামাগণ নামাযের পর যিক্র পড়ার কথা বলে থাকেন। অতএব উক্ত দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যা খুঁজতে আমাদেরকে শরীয়তের সাহায্য নিতে হবে। যেহেতু মহানবী (সাঃ) এর এক উক্তিকে তাঁর অপর উক্তি বা আমল ব্যাখ্যা করে। চলুন এবারে আমরা তাই দেখে ‘দুবুর’ এর সঠিক অর্থ নির্ধারণ করি।
সালাম ফেরার পরে কি করা উচিৎ সে ব্যাপারে আল্লাহর এক নির্দেশ হল,
“অতঃপর যখন তোমরা নামায সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর যিক্র কর----।” (কুরআন মাজীদ ৪/১০৩)
“তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির একাংশে এবং নামাযের পরেও।” (কুরআন মাজীদ ৫০/৪০)
তাই তো আল্লাহর নবী (সাঃ) এর আমল ও অভ্যাস ছিল সালাম ফিরার পর আল্লাহর যিক্র করা।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) “আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালাম--- “ বলার মত সময়ের চেয়ে অধিক সময় সালাম ফেরার পর বসতেন না। (মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৬০ নং)
সাওবান (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন নামায শেষ করতেন তখন তিনবার ইস্তিগফার করে “আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালাম---- “ বলতেন।
আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন সালাম ফিরতেন তখন উঁচু শব্দে বলতেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু ---।” (মুসলিম, মিশকাত৯৬৩ নং) (এ ব্যাপারে ফরয নামাযের পর যিক্রের আলোচনা দেখুন।)
সালাম ফিরা হলে তিনি মহিলাদের জন্য একটু অপেক্ষা করতেন, যাতে তারা পুরুষদের আগেই মসজিদ ত্যাগ করতে পারে। অতঃপর তিনি উঠে যেতেন। (বুখারী ৮৩৭)
সামুরাহ্ বিন জুনদুব (রাঃ) বলেন, ফজরের নামায শেষ করে আল্লাহর নবী (সাঃ) আমাদের দিকে ফিরে বসে বলতেন, “গত রাত্রে তোমাদের মধ্যে কে স্বপ্ন দেখেছে?” অতঃপর কেউ দেখলে সে বর্ণনা করত। নচেৎ তিনি নিজে স্বপ্ন দেখে থাকলে তা বর্ণনা করতেন। (বুখারী, মিশকাত ৪৬২১ নং)
অবশ্য একদা কা’বা শরীফের নিকট মহানবী (সাঃ) এর নামায পড়া কালে কুরাইশের দুষ্কৃতিরা তাঁর সিজদারত অবস্থায় ঘাড়ে উটনীর (গর্ভাশয়) ফুল চাপিয়ে দিলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) খবর পেয়ে ছুটে এসে তা সরিয়ে ফেলেন। এহেন দুর্ব্যবহার ফলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায শেষ করে উচ্চস্বরে ঐ দুষ্কৃতিদের জন্য বদ দু’আ করেন এবং তা কবুলও হয়ে যায়। (বুখারী ২৪০, মুসলিম ১৭৯৪ নং)
কিন্তু সে নামায ফরয ছিল না নফল, তা নিশ্চিত নয়। পরন্তু এতে হাত তোলার কথা নেই। তাছাড়া এটি ছিল সাময়িক বদ দু’আ; যা তাদেরকে শুনিয়ে করা হয়েছিল।
আর একটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, তিনি ফজরের নামাযে সালাম ফিরে বলতেন, “আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআউ] অরিযকান ত্বাইয়িবাঁউঅআমালাম মুতাক্বাব্বালা।” (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অবশ্যই ফলপ্রসূ জ্ঞান, উত্তম রুযী এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।) (ত্বাবারানীরানী, সাগীর, মাজমাউয যাওয়াইদ১০/১১১, সহীহ ইবনে মাজাহ্ ১/১৫২) অবশ্য এখানেও হাত তোলার কথা নেই।
সুতরাং বলা যায় যে, সালাম ফিরার পর আল্লাহর নবী (সাঃ) অধিকাংশ সময়ে আল্লাহর যিক্র পড়েছেন। আর কখনো কখনো তিনি ফজরের পর ঐ দুআ (হাত না তুলে) পাঠ করেছেন।
পক্ষান্তরে সালামের পূর্বে তিনি (প্রার্থনামূলক) দুআ পড়তে আদেশ দিয়ে বলেন, “এরপর (তাশাহহুদের পর) তোমাদের যার যা ইচ্ছা ও পছন্দ সেই মত দুআ বেছে নিয়ে দুআ করা উচিৎ।” (বুখারী ৮৩৫, মুসলিম,মিশকাত ৯০৯ নং)
“যখন তোমাদের মধ্যে কেউ (শেষ) তাশাহহুদ সম্পন্ন করবে তখন সে যেন আল্লাহর নিকট চারটি জিনিস থেকে পানাহ চায়; জাহান্নামের আযাব, কবরের আযাব, দাজ্জালের ফিতনা এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে। এরপর সে ইচ্ছামত দুআ করবে।” (মুসলিম, আবু আওয়ানাহ্, আবূ দাঊদ ৯৮৩নং, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্, প্রমুখ, মিশকাত ৯৪০নং)
সালাম ফিরার পূর্বে তাশাহহুদের পর তিনি নিজেও বিবিধ প্রকার দুআ পড়ে প্রার্থনা করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৩৯নং) (দুআয়ে মাসুরা দ্রষ্টব্য) এমন কি উক্ত চার প্রকার আযাব ও ফিতনা হতে পানাহ চাওয়ার দুআ আল্লাহর নবী (সাঃ) কুরআন কারীমের সূরা শিখানোর মত সাহাবাগণকে শিক্ষা দিতেন। তাই তো ৩ অথবা ৪ জন সাহাবী হতে উক্ত দুআর হাদীস বর্ণনাকারী তাবেয়ী ত্বাউস একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তোমার নামাযে ঐ দুআ পড়েছ কি? বলল, না। তিনি বললেন তাহলে তুমি তোমার নামায ফিরিয়ে পড়।’ (মুসলিম ১/৪১৩ নং)
কেননা, তাঁর নিকট উক্ত দুআর এত গুরুত্ব ছিল যে, তিনি মনে করতেন, যে দুআ পড়তে আল্লাহর নবীর আদেশ, আমল ও শিক্ষা রয়েছে তা না পড়লে নামাযই হবে না!
একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) (মসজিদে) বসে ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি প্রবেশ করে নামায শুরু করল। (নামাযে) সে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি দয়া কর।’ তা শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “তাড়াহুড়ো করলে তুমি হে নামাযী! যখন তুমি নামাযে বসবে তখন আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রসংশা কর এবং আমার উপর দরুদ পড়, তারপর আল্লাহর নিকট দুআ কর।”
কিছুক্ষণ পরে আর এক ব্যক্তি নামায পড়তে শুরু করল, সে আল্লাহর প্রশংসা করে নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করল। তখন তা শুনে তিনি বললেন, “হে নামাযী! (এবার তুমি) দুআ কর, কবুল হবে ।” (তিরমিযী, সুনান ৩৪৭৬, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত ৯৩০ নং)
ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমি নামায পড়ছিলাম, আর নবী (সাঃ), আবু বকর ও উমর (রাঃ) (পাশেই বসে) ছিলেন। যখন আমি বসলাম তখন আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শুরু করলাম। তারপর আমি নিজের জন্য দুআ করলাম। তা শুনে নবী (সাঃ) বললেন, “তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে, তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে।” (তিরমিযী, মিশকাত ৯৩১ নং)
আর আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউযখন নামাযে দাঁড়ায় সে তখন তার রবের সাথে মুনাজাত করে। অতএব মুনাজাতে সে কি বলে, তা তার জানা উচিৎ। (মুঅত্তা, মুসনাদে আহ্মদ ২/৩৬, ৪৯২৮নং)
অতএব সঠিক মুনাজাতের স্থান ও দুআ কবুল হওয়ার সময় সালাম ফিরার পূর্বে নয় কি?
পরন্তু যদি ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ ‘পরে’ ধরে নেওয়া যায় তবুও তাতে হাত তুলে মুনাজাত প্রমাণ হয় না। আর এখানে হাত তুলে দুআ করা দুআর আদব বলে এবং আল্লাহ (হাত তুলে দুআ করলে) খালি হাত ফিরিয়ে দেন না বলে এখানেও তোলা হবে বা তুলতে হবে, তা বলা যায় না। ঐ দেখুন না, জুমআর খুতবায় দুআ বিধেয়। নবী (সাঃ) বৃষ্টির জন্যহাত তুলে খুতবায় দুআও করেছেন। কিন্তু সাধারণ সময়ে খুতবায় তিনি হাত তুলতেন না। তাইতো উমারাহ্ বিন রুয়াইবাহ্ যখন বিশর বিন মারওয়ানকে জুমআর খুতবায় হাত তুলে দুআ করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ঐ হাত দুটিকে বিকৃত করুক! আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে কেবল তাঁর আঙ্গুল দ্বারা এভাবে ইশারা করতে দেখেছি। (মুসলিম ৮৭৪, আবূ দাঊদ,তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে আবী শাইবাহ্ ৫৪৯৬ নং)
সুতরাং হাত তুলে দুআর আদব হলেও যেহেতু ঐ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি হাত তুলেন নি, তাই সলফগণ তা বৈধ মনে করতেন না। যুহ্রী বলেন, ‘জুমআর দিনহাত তোলা নতুন আমল (বিদআত)।’ (ইবনে আবী শাইবাহ্ ৫৪৯১ নং) ত্বাউস জুমআর দিনহাত তুলে দুআকে অপছন্দ করতেন এবং তিনি নিজেও হাত তুলতেন না। (ঐ ৫৪৯৩ নং)
ইমাম ও মুক্তাদীগণের খুতবায়হাত তুলে দুআ প্রসঙ্গে মাসরুক বলেন, (যারা ঐভাবে দুআ করে) ‘আল্লাহ তাদেরহাত কেটে নিক।’ ( ঐ ৫৪৯৪ নং)
সুতরাং একথা স্পষ্ট হল যে, ফরয নামাযের পর দুআ বৈধ ধরা গেলেও হাত তুলে দুআর আদব বলে হাত তোলা এখানেও বিদআত হবে, যেমন জুমআর খুতবায় হবে। কারণ নামাযের পরে মহানবী (সাঃ) এর আদর্শ ও তরীকা আমাদের সামনে মজুদ।
এ তো গেল একাকী হাত তুলে মুনাজাতের কথা। অর্থাৎ একাকী নামাযীর জন্যও বিধেয় নয় ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত করা ।
বাকী থাকল জামাআতী দুআর কথা, তো তার প্রমাণ আরো দুঃসাধ্য। যাঁরা করেন বা করা ভালো মনে করেন তাঁরা বলেন, যে, ‘জামাআতের দুআ একটি সুবর্ণ সুযোগ।’ এর প্রমাণে তাঁরা এই যুক্তি পেশ করেন যে, ‘জামাআতে দুআ করলে দুআ কবুল হয়। একাকী অনেকের দুআ কবুল নাও হতে পারে। সুতরাং পাঁচজন ভালো লোকের ফাঁকে একজন মন্দলোকেরও দুআ কবুল হয়ে যায়!’ তাঁরা আরো বলেন, ‘কোন নেতার কাছে কোন দাবী বা আবেদনের ব্যাপারে একার চেয়ে যৌথ ও জামাআতী চেষ্টাতেই কৃতার্থ হওয়া অধিক সম্ভব।’ ইত্যাদি।
কিন্তু প্রথমত: যুক্তিটি দলীল-সাপেক্ষ। দ্বিতীয়ত: দুনিয়ার ভীতু নেতাদের সাথে সার্বভৌম ক্ষমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার অধিকারী মহান আল্লাহকে তুলনা করা বেজায় ভুল ও হারাম।
পরন্তু যদি তাই হয়, তবে এ যুক্তি ও সুযোগের কথা মহানবী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ কি জানতেন না? নাকি তাঁদের চেয়ে ওরা বেশী জানলেন? কই তাঁরা তো এই সুযোগ গ্রহণ করে অনুরুপ জামাআতী দুআ ফরয নামাযের পর করে গেলেন না?
পরন্তু তাঁরাও জামাআতবদ্ধভাবে দুআ করেছেন; বিপদ-আপদের সময় ফরয নামাযের শেষ রাকআতে রুকু থেকে উঠার পর কওমায় হাত তুলে মুসলিমদের জন্য জামাআতী দুআ ও কাফেরদের জন্য বদদু’আ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৮৮, ১২৮৯, ১২৯০ নং)
সাহাবাগণ রমযানের বিত্র নামাযে রুকুর পূর্বে বা পরে হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন। (মুঅত্তা, মিশকাত ১৩০৩ নং)
তাঁরা নামাযের ভিতরেই হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন। কিন্তু নামাযের পর করা উত্তম হলে তা করতেন না কি?
একদা মহানবী (সাঃ) জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী (বেদুঈন) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেল, আর পরিবার-পরিজন (খাদ্যের অভাবে) ক্ষুধার্ত থেকে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’ তখন মহানবী (সাঃ) নিজের দুইহাত তুলে দুআ করলেন। ফলে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে পরবর্তী জুমআতে উক্ত (বা অন্য এক) ব্যক্তি পুনরায় খাড়া হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! ঘর-বাড়ি ভেঙে গেল এবং মাল-ধন ডুবে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দুআ করুন!’ মহানবী (সাঃ) তখন তিনি নিজের হাত তুলে পুনরায় বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করলেন এবং বৃষ্টিও গেল থেমে। (বুখারী ৯৩৩নং, মুসলিম, নাসাঈ, মুসনাদ আহ্মদ ৩/২৫৬, ২৭১)
অতএব বুঝা গেল যে, নামাযের পর দুআর অভ্যাস ছিল না বলেই উক্ত সাহাবী যে সময় কথা বলা এবং কেউ কথা বললে তাকে চুপ করতে বলাও নিষিদ্ধ সেই সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) কে দু’ দু’বার দুআর আবেদন জানালেন।
সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ) এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম ৮৮৩, আবু দাঊদ ১১২৯নং, মুসনাদে আহ্মদ ৪/৯৫, ৯৯)
উক্ত হাদীস নিয়ে একটু চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, সাহাবাদের যুগেও ঐ মুনাজাতের ঘটা বিদ্যমান ছিল না। সুতরাং তা যে নব-আবিষ্কৃত বিদআত তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু অজান্তে লোকেরা শাস ছেড়ে আঁটিতে কামড় মারছে! যেখানে দুআ করা ওয়াজিব বা বিধেয় সেখানে না করে অসময় ও অবিধেয় স্থানে দুআ করার জন্য মারামারি! আবার কেউনা করলে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি!! কিন্তু তাও কি বৈধ?
অতএব আপনি যদি জ্ঞান ও বিবেকের সাহায্যে শরীয়তের মাপকাঠিতে ইনসাফ করতে চান এবং দ্বিধাবিভক্ত সমাজের সংকীর্ণ মনের মানুষদের হৃদয়-দ্বারকে উদার ও উন্মুক্ত করে শৃঙ্খলা আনতে চান, তাহলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে আসল সত্য আপনার নিকটও প্রকট হয়ে উঠবে ইন শা-আল্লাহ। পক্ষান্তরে আপনি তো চান আল্লাহর অনুগ্রহ, আল্লাহর রহ্মত ও মাগফিরাত। তবে তা যদি এ সময় ছাড়া অন্য সময়েই পাওয়া যায়, তাহলে তা সে সময়েই চেয়ে নিতে বাধা কোথায়? কথায় বলে, “ঢেকিশালে যদি মানিক পাই, তবে কেন পর্বতে যাই?” মোট কথা আপনার প্রয়োজন আপনি আপনার নামাযেই ভিক্ষা করুন। আপনার আপদে-বিপদে ও বালা-মসীবতে নামাযেই সাহায্য প্রার্থনা করুন। বিশেষ করে আল্লাহ যেহেতু বলেন, “তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাক্বারাহ্ ৪৫,১৫৩ আয়াত)
অতএব খেয়াল করে দেখুন হয়তো বা যে প্রয়োজন আপনি ভিক্ষা করবেন সেই প্রয়োজনের দুআ নামাযেই রয়েছে। নচেৎ অনুরুপ সহীহ দুআ বেছে নিয়ে আপনি দুআর স্থানে নামাযেই করতে পারেন। আর যদি নিজের ভাষাতেই দুআ করতে হয়, তাহলে দুআ কবুল হওয়ার আরো বহু সময় আছে। সেই সাধারণ সময়ে আপনি আপনার বিনয়ের হাত তুলে খুব করে যত পারেন আল্লাহর নিকট চেয়ে নিন। আপনি একা হলেও -আল্লাহর ওয়াদা- তিনি বান্দার দুআ কবুল করেন; যদি সঠিক নিয়মে হয়। নাইবা চাইলেন ঐ বিতর্কিত সময়ে!
তাছাড়া নামাযের ভিতর মুনাজাতের ঐ নয়নাভিরাম বাগিচায় প্রায় আটটি স্থানে দুআ করার সুযোগ রয়েছে;
তাকবীরে তাহ্রীমার পর, রুকুতে, কওমাতে, সিজদায়, দুই সিজদার মাঝে, তাশাহ্হুদে, রুকুর পূর্বে অথবা পরে কুনূতে এবং কুরআন পাঠকালে রহ্মতের আয়াত এলে রহ্মত চেয়ে এবং আযাবের আয়াত এলে আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে নামাযী দুআ করে থাকে। (ফতহুল বারী ১১/১৩৬) আর উক্ত স্থানগুলিতে কি নিয়ে দুআ করবেন তা তো পূর্বের পরিচ্ছেদগুলিতে জেনেছেন। সুতরাং এতগুলো স্থান কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?
কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকে সে সব দুআকে কেবল নামায বলেই জানে ও চেনে। দুআ বলে নয়। ফলে পূর্ণ সমর্থন করে জামাআতী দুআকে। হয়তো বা তার কারণ এই যে, মুখস্থ করে দুআ করা কষ্টকর ব্যাপার, অথচ নামাযের পর জামাআতে কেমন আরামসে কেবল ‘আমীন-আমীন’ বললেই দুআ ও সহজে কিস্তিমাত হয়ে যায়! পক্ষান্তরে ইমাম সাহেব কি দুআ করলেন তার খবর নেই, দুআর অর্থের প্রতি খোঁজ নেই, দুআর প্রতি মনোযোগ নেই - এমন দুআয় ফল কোথায়? মহানবী (সাঃ) বলেন, “আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ বিস্মৃত ও উদাসীন হৃদয় থেকে দুআ মঞ্জুর করেন না।” (তিরমিযী ৩৪৭৯ নং)
দুআ বিদআতের ফতোয়া শুনে অনেকের অনেক রকম অভিযোগ। কেউ বলেন, ‘দুআ উঠে যাচ্ছে, কিছু দিন পর নামাযও উঠে যাবে হয়তো!’ অথচ দুআ ও নামায এক নয়। নামায হল দ্বীনের খুঁটি। আর নামাযের পর হাত তুলে দুআ তো ভিত্তিহীন। সুতরাং যার ভিত নেই, তা টিকে কেমনে?
এক মসজিদে জামাআতের সময় হয়ে এসেছিল। ওযু করতে দেরী হওয়ায় আমাদের অপেক্ষা করছিল জামাআত। এক সাহেব কারণ জানতে চাইলে কেউ বললেন, ‘আরবের মাওলানা ওযু করছেন, একটু থামুন।’ কিন্তু চট করেই এক সাহেব বলে উঠলেন, ‘আরবের লোকদের দুআ না হলে চলে, ওযু না হলেও তো চলবে!’
অনেকে বলেন, ‘কম্বলের রোয়া বাছতে সব শেষ।’
বক্তার ধারণামতে শরীয়তের সবকিছুই কম্বলের রোয়া। অর্থাৎ ফরয, সুন্নত, নফল, বিদআত সবই সমান! অথচ প্রকৃতপক্ষে বিদআত উচ্ছেদ কম্বলের রোয়া বাছা নয়; বরং ফুল বাগানের আগাছা অথবা ধানক্ষেতের ঝেড়া বাছা।
অনেকে বলেন, ‘পায়জামা খাটাতে খাটাতে শেষকালে দেখছি আন্ডারপ্যান্ট হয়ে যাবে!’ ‘ছিল ঢেকি হল শূল, কাটতে কাটতে নির্মূল - হয়ে যাবে।’
অর্থাৎ ফরয নামাযের পর হাত তুলে দুআ উঠে গেলে যেন দ্বিনের মূল অংশ বাদ পড়ে গেল! এঁদের নিকটে মুড়ি-মুড়কির সমান দর। কাক-কোকিলের কোন পার্থক্য নেই। অথচ ইসলামে অতিরঞ্জনের স্থান নেই। ইসলামে কোন কিছু এমন নেই যাতে সংযোজন করা যাবে অথবা কিছু হরাস করা যাবে। বাড়তি নখণ্ডচুল কাটা অবশ্য বাঞ্জিত, আঙ্গুল বা মাথা কাটা নয়। পায়জামা গাঁটের নিচে ঝুলে রাস্তার ময়লা লাগলে অবশ্যই জ্ঞানীগণ তা কেটে গাঁটের উপর পর্যন্ত করে নেন। কারণ তাঁরা জানেন যে, গাঁটের নিচে কাপড় পরা হারাম। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় বাড়তি অংশ কাটা তো সকলের নিকট জ্ঞান ও বিজ্ঞান-সম্মত। আর বাড়তি অংশ কাটলেই যে আসল অংশও কাটা যাবে তা জরুরী নয়। অবশ্য যাঁদের নিকটে আসল-নকলের কোন পার্থক্য-জ্ঞান নেই তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।
তাছাড়া বাড়তি ও বেশী করার প্রয়োজন কোথায়? অল্প মেহনতে ফল ও কাজ একই হলে সেটাই যথেষ্ট ও ইপ্সিত নয় কি? নচেৎ ‘চাষার চাষ করা দেখে চাষ করলে গোয়াল, ধানের সঙ্গে খোঁজ নাই বোঝা বোঝা পোয়াল’ হবে না কি?
অনেকে বলেন, ‘ওঁরা কি জানতেন না, যাঁরা এতদিন নিয়মিতভাবে দুআ করে গেলেন?’ কিন্তু এর উত্তরে আমরাও প্রশ্ন করতে পারি, ‘ওঁরা কি জানতেন না, যাঁরা কখনো মুনাজাত করে যান নি, বা জানেন না যাঁরা এখনো মুনাজাত করেন না?’ সুতরাং দলীলই প্রমাণ করবে কে জানতেন আর কে জানতেন না। পক্ষান্তরে যাঁরা ইজতিহাদে ভুল করে গেছেন, আল্লাহ তাঁদের ভুল ক্ষমা করবেন এবং তাঁরা একটি নেকীর অধিকারীও হবেন। অতএব যাঁরা না জেনে করে গেছেন তাঁদেরকে বিদআতী বলার অধিকারও কারো নেই। তবে সঠিকতা জানার পর তার দিকে প্রত্যাবর্তন করা অবশ্যই ওয়াজেব।
অনেকে বলেন, দুআ তো ভালো জিনিস। ওতে ক্ষতি কি? কিন্তু ভালো হলেই যে বাড়তি করার অধিকার আছে, তা নয়। নামায ভালো বলে ২ রাকআতের স্থানে ৩ রাকআত বেশী পড়া যায় না। দরুদ ভালো হলেও জামাআতী সমস্বরে বা দাঁড়িয়ে কিয়াম করে দরুদ পড়া যায় না। এই বাড়তি করার নামই তো বিদআত।
অনেকে বলেন, ‘দুআ উঠে গেল তাই তো নানা কষ্ট, নানা বিপদ-আপদ দেখা দিচ্ছে মুসলিম সমাজে।’ অবশ্য এমন লোকেরা নামাযের পর হাত তুলে দুআ ছাড়া আর অন্য দুআ চেনেন না। তাই তো কেউ ফরয নামাযের পর মুনাজাত না করলে অনেকে কুরআনের আয়াত থেকে দলীল উদ্ধৃত করে তাকে জাহান্নামী বানিয়ে থাকেন! কারণ আল্লাহ বলেন, “তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমার নিকট দুআ কর, আমি তা কবুল করব। যারা অহংকারে আমার ইবাদত (দুআ) করায় বিমুখ তারা লাঞ্জিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা মুমিন ৬০ আয়াত)
বলাই বাহুল্য যে, এমন বক্তার নিকট দুআ এবং ফরয নামাযের পরহাত তুলে দুআর মাঝে কোন পার্থক্যই নেই। তাই তো ঝোপ না বুঝেই কোপ মেরে থাকেন!
অনেকে বলেন, ‘ফরয নামাযের পর ঐরুপ দুআ করতে নিষেধ আছে কি?’
কিন্তু নিষেধ না থাকলে যদি করা যেত, তাহলে তো বহু কিছু করা যায়। আযান ও নামায ভালো জিনিস বলে সকাল ৯ টায় আযান দিয়ে জামাআত করে নামায পড়তে পারি কি? কারণ ঐ সময় ঐ আমল তো নিষেধ নয়। তবে দরুদে সমস্বরকে কেন বিদআত বলি, সমস্বরে দরুদ তো নিষেধ নয়---ইত্যাদি। এরুপ মুনাজাত নেই তার প্রমাণ হল হাদীসে বা আসারে তার উল্লেখ নেই। পরন্তু কোন ইবাদত ‘নেই’ প্রমাণ করতে দলীলের প্রয়োজন হয় না; কারণ ‘নেই’ এর দলীলই হল কুরআন-হাদীসে এর উল্লেখ নেই। অবশ্য ‘আছে’ প্রমাণ করতে স্পষ্ট দলীল জরুরী। তাই তো যে কর্ম করতে নিষিদ্ধ বলে প্রমাণ আছে তা করাকে ‘হারাম’ বলে, ‘বিদআত’ নয়। পক্ষান্তরে যা ‘আছে’ বলে প্রমাণ নেই তা দ্বীন ও ভালো মনে করে করাকেই নতুনত্ব বা বিদআত বলে। আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীন) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা তার পর্যায়ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪০নং) “যে ব্যক্তি এমন আমল করে, যাতে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম ১৭১৮নং) “আর নবরচিত কর্মসমূহ থেকে দূরে থেকো। কারণ, নবরচিত কর্ম হল বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (মুসনাদে আহ্মদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত১৬৫নং) “আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই হল জাহান্নামে।” (সহীহ নাসাঈ ১৪৮৭নং)
সুতরাং বিদআতের ভালো-মন্দ কিছু নেই। বরং তার সবটাই মন্দ। আর যা বিদআত, তা জরুরী মনে না করে করলেও বিদআত এবং কখনো কখনো করাও বিদআত। নচেৎ এর প্রমাণে দলীল জরুরী। যেমন যদি বলি, ‘কিয়াম করা বিদআত, তবে জরুরী না মনে করে করা বিদআত নয় বা কখনো কখনো করা বিদআত নয়’ তবে নিশ্চয় তা যুক্তিসঙ্গত নয়। তদনুরুপ ফরয নামাযের পর হাত তুলে দুআ যদি বিদআতই হয় তবে তা অজরুরী মনে করে কখনো কখনো করা কোন যুক্তিকে দূষণীয় হবে না?
পরিশেষে এখানে ইবনে মসউদ (রাঃ) এর একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করি; তিনি বলেন, “তোমরা অনুসরণ কর, নতুন কিছু রচনা করো না। কারণ তোমাদের জন্য তাই যথেষ্ট। আর তোমরা পুরাতন পন্থাই অবলম্বন কর।” (সিলসিলা যয়ীফাহ্ ২/১৯)
ফরয নামাযের পর একাকী বা জামাআতী মুনাজাত বিদআত হওয়া প্রসঙ্গে ফতোয়া দেখুন। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৫৫, ২০/১৪৭, ২৪/৭০, ৯২, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন১/৩৬৭, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৭৭-২৮২, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৯, প্রভৃতি)
সবশেষে, হাত তুলে মুনাজাত নেই বলে সালাম ফিরার পরপরই উঠে সুন্নত পড়তে লাগা অথবা প্রস্থান করা এবং যিক্র-আযকার ত্যাগ করা অবশ্য উচিৎ নয়।
নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতি একই
পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি একই প্রকার। সুতরাং মহিলাও ঐরুপ একই তরীকায় নামায পড়বে, যেরুপ ও যে তরীকায় পুরুষ পড়ে থাকে। কারণ, (নারী-পুরুষ উভয় জাতির) উম্মতকে সম্বোধন করে রসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা সেইরুপ নামায পড়, যেরুপ আমাকে পড়তে দেখেছ।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬৮৩নং) আর উভয়ের নামায পৃথক হওয়ার ব্যাপারে কোন দলীলও নেই।
সুতরাং যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদেরকে করেছে, সে আদেশ মহিলাদের জন্যও এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদেরকে করেছে তাও পুরুষদের ক্ষেত্রে পালনীয় -যদি বিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার দলীল না থাকে। যেমন, “যারা সতী মহিলাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হল ৮০ কোড়া---।” (কুরআন মাজীদ ২৪/৪) পরন্তু যদি কেউ কোন সৎ পুরুষকে অনুরুপ অপবাদ দেয়, তবে তার জন্যও ঐ একই শাস্তি প্রযোজ্য।
সুতরাং মহিলারাও তাদের নামাযে পুরুষদের মতই হাত তুলবে, পিঠ লম্বা করে রুকূ করবে, সিজদায় জানু হতে পেট ও পায়ের রলাকে দূরে রেখে পিঠ সোজা করে সিজদাহ করবে। তাশাহ্হুদেও সেইরুপ বসবে, যেরুপ পুরুষরা বসে। উম্মে দারদা (রাঃ) তাঁর নামাযে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহ্ ছিলেন। (আত্-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ৯৫পৃ:, বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৫৫) আর মহিলাদের জড়সড় হয়ে সিজদাহ করার ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ নয়। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২৬৫২ নং) এ জন্যই ইবরাহীম নাখয়ী (রহঃ) বলেন, ‘নামাযে মহিলা ঐরুপই করবে, যেরুপ পুরুষ করে থাকে।’ (ইবনে আবী শাইবা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৮৯পৃ:)
পক্ষান্তরে দলীলের ভিত্তিতেই নামাযের কিছু ব্যাপারে মহিলারা পুরুষদের থেকে ভিন্নরুপ আমল করে থাকে। যেমন:-
১। বেগানা পুরুষ আশে-পাশে থাকলে (জেহরী নামাযে) মহিলা সশব্দে কুরআন পড়বে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩০৪) যেমন সে পূর্ণাঙ্গ পর্দার সাথে নামায পড়বে। তাছাড়া একাকিনী হলেও তার লেবাসে বিভিন্ন পার্থক্য আছে।
২। মহিলা মহিলাদের ইমামতি করলে পুরুষদের মত সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে।
৩। ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মহিলা পুরুষের মত ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ না বলে হাততালি দেবে।
৪। মহিলা মাথার চুল বেঁধে নামায পড়তে পারে, কিন্তু (লম্বা চুল হলে) পুরুষ তা পারে না।
এ সব ব্যাপারে দলীলসহ্ বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে দ্রষ্টব্য।
অনেক মহিলা আছে, যারা মসজিদে বা বাড়িতে পুরুষদের নামায পড়া না হলে নামায পড়ে না। এটা ভুল। আযান হলে বা নামাযের সময় হলে আওয়াল অক্তে নামায পড়া মহিলারও কর্তব্য। (মুত্বাসা ১৮৮-১৮৯পৃ:)
কুরআন মুখস্থ না হলে
কারো পক্ষে কুরআন মুখস্থ কোন প্রকারে সম্ভব না হলে, অথবা ফরয হওয়ার পর তৎপর মুখস্থ করার সুযোগ না হলে সে মুখস্থ করার পূর্বের নামাযগুলোতে ক্বিরাআতের স্থানে ‘সুবহা-নাল্লাহ্, অলহামদু লিল্লা-হ্, অলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, অল্লা-হু আকবার, অলাহাওলা অলা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্’ বলবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৩২ নং, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায ভুলকারী সাহাবীকে বলেছিলেন, “অতঃপর যদি তোমার কুরআন মুখস্থ থাকে, তাহলে তা পাঠ কর। নচেৎ তাহ্মীদ (আলহামদু লিল্লা-হ্), তাকবীর (আল্লা-হু আকবার) ও তাহ্লীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) পড়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৬১ নং, তিরমিযী, সুনান)
সুতরাং কুরআন মুখস্থ হয় না বলে বা কুরআন মুখস্থ নেই বলে এই ওজরে নামায মাফ নয়। তাসবীহ্-তাহ্লীল পড়েও নামায পড়তে হবে এবং তার সাথে চেষ্টা থাকবে মহান আল্লাহর মহাবাণী মুখস্থ করার।
নামায কায়েম হবে কিভাবে?
মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে ও তাঁর রসূলের মুখে আমাদেরকে নামায পড়তে ও কায়েম করতে বলেছেন। সুতরাং নামায পড়াই যথেষ্ট নয়; নামায কায়েম করা জরুরী। আর নামায কায়েম হবে তখনই, যখন নামাযী নামাযের শর্তাবলী, রুক্ন, ফরয বা ওয়াজেব প্রভৃতি পালন করে বাহ্যিকভাবে এবং তার আধ্যাত্মিক বিষয়াবলী প্রতিষ্ঠা করে আন্তরিকভাবে নামায আদায় করবে। আর তখনই নামায সেই নামায হবে, যে নামায পাপ ও নোংরা কাজ হতে নামাযীকে বিরত রাখে।
নামাযের বাহ্যিক দিকটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা আমরা পূর্বেই জেনেছি। এবারে তার আধ্যাত্মিক দিকটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে তাই আলোচিতব্য।
আন্তরিক বিষয়াবলীর মধ্যে হৃদয় উপস্থিত রেখে একাগ্রতা ও মনোনিবেশের সাথে নামায পড়াই প্রধান। এর সঙ্গে থাকবে মনের কাকুতি-মিনতি, অনুনয়-বিনয়, সর্বমহান বিশ্বাধিপতি এবং একমাত্র প্রভু ও উপাস্যের সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে অন্তরে থাকবে নিরতিশয় আদব, ভক্তি ও বিনতি। আল্লাহ তাআলা বলেন, “মু’মিনগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে; যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র---।” (কুরআন মাজীদ ২৩/১)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে মুসলিম ব্যক্তির নিকটে কোন ফরয নামায উপস্থিত হয়, অতঃপর সে ঐ নামাযের ওযু, কাকুতি-মিনতি ও রুকূ সুন্দরভাবে করে, তাহলে এর ফলে কাবীরা গুনাহ না করলে তার পূর্বেকার গুনাহসমূহের তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়। আর এরুপ হয় সব সময়ের জন্য। (মুসলিম, মিশকাত ২৮৬ নং)
“যে মুসলিম ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে, অতঃপর খাড়া হয়ে সে তার দেহ্-মন নিয়ে একাগ্রতার সাথে ২ রাকআত নামায পড়ে, সে ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যায়।” (মুসলিম, সহীহ ২৩৪ নং)
বিনতির মানে এই নয় যে, নামাযীকে নামাযে কাঁদতে হবে। বিনতি হল হৃদয়ের উপস্থিতি ও সর্বাঙ্গের স্থিরতার নাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৫৬)
অতএব একাগ্রতা, মনোযোগ ও বিনতির সাথে আপনি আপনার নামায কায়েম করতে চাইলে নিম্নেক্ত কয়েকটি উপদেশ গ্রহণ করুন :-
১। আপনি যে নামায পড়ছেন তা নিশ্চয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, তাঁর হুকুম পালনার্থে, তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরাগ, ভক্তি ও প্রেম প্রকাশার্থে, তাঁর নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জনের আশায়, তাঁর আযাবের ভয়ে, তাঁর সওয়াব ও ক্ষমার কামনাতেই আপনি নামায পড়ুন।
২। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনি মনে করুন যে, আল্লাহর খাস দরবারে আপনি হাজির হয়েছেন। আপনি যেন তাঁকে দেখছেন, তিনি আরশের উপর রয়েছেন। সেখান হতেই তিনি সারা সৃষ্টির প্রতি সূক্ষ্ণদৃষ্টি রেখেছেন। তিনি আপনার নামায পড়াও দেখছেন। অবশ্য তাঁর কোন প্রকার আকার ও প্রতিমূর্তি মনে কল্পনা করবেন না। কারণ, তাঁর মত কোন কিছুই নেই।
আপনি আপনার মর্মমূলে ভাবুন যে, তিনি অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়। তিনি আদেশ করেন, নিষেধ করেন, ভালোবাসেন আবার ক্রোধান্বিতও হন। বান্দার কোনও গোপন বা প্রকাশ্য কথা বা কর্ম তাঁর নিকট গুপ্ত নয়। সকল বিষয়ে তিনি সবিশেষ অবহিত। “চক্ষুর ছল-চাহ্নি এবং হৃদয় যা গোপন করে তা তিনি জানেন।” (কুরআন মাজীদ ৪০/১৯) এই প্রত্যয়ের সাথে সাথে তাঁর জন্য আপনার অন্তরে যথার্থ তা’যীম, ভক্তি, অনুরাগ, ভীতি, প্রেম, আগ্রহ্, আশা, ভরসা, বিনতি প্রভৃতি সমবেত হবে। টুটে যাবে সাংসারিক সকল বন্ধন। শুধু টিকে থাকবে আল্লাহ ও আপনার মাঝে মুনাজাতের ও নিরালায় গভীর আলাপের বন্ধন।
৩। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনি স্মরণ করুন, আপনাকে মরতেই হবে এবং ফিরে যেতে হবে সেই বিশাল বাদশার নিকট, যাঁর সামনে আপনি দন্ডায়মান আছেন, আর হিসাবও লাগবে তাঁর কাছে সকল কাজের। ধরে নিন্ হয়তো আপনার এটা শেষ নামায। সালাম ফিরে হয়তো আর নামাযের সুযোগ পাবেন না। যেন আপনি আপনার প্রিয়তমের নিকট থেকে বিদায়কালে শেষ সাক্ষাৎ করছেন, শেষ কথা বলছেন ও শেষ আবেদন জানিয়ে নিচ্ছেন। আর এই সময় কি আপনি আপনার চোখের পানি রুখে রাখতে পারেন? এই মুহূর্তে কি আপনার মন অন্য দিকে ছুটতে পারে?
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তুমি তোমার নামাযে মরণকে স্মরণ কর। কারণ, মানুষ যখন তার নামাযে মরণকে স্মরণ করে, তখন যথার্থই সে তার নামাযকে সুন্দর করে। আর তুমি সেই ব্যক্তির মত নামায পড়, যে মনে করে না যে, এ ছাড়া সে অন্য নামায পড়তে পারবে। তুমি প্রত্যেক সেই কর্ম থেকে দূরে থাক, যা করে তোমাকে (অপরের নিকটে) ক্ষমা চাইতে হয়। (মুসনাদে ফেরদাঊস, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪২১, জামে ৮৪৯ নং)
এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আমাকে সংক্ষেপে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, “যখন তুমি তোমার নামাযে দাঁড়াবে তখন (মরণ পথের পথিকের বিদায় নেওয়ার সময়) শেষ নামায পড়ার মত নামায পড়। এমন কথা বলো না, যা বলে (অপরের নিকট) ক্ষমা চাইতে হয়। আর লোকেদেরহাতে যা আছে তা থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে যাও।” (বুখারী তারীখ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৪১৭১ নং, আহমাদ, মুসনাদ ৫/৪১২, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৪০১ নং)
আর এক বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “তুমি (মরণ পথের পথিকের বিদায় নেওয়ার সময়) শেষ নামায পড়ার মত নামায পড়। (মনে মনে কর,) যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, নচেৎ তিনি তোমাকে দেখছেন---।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী, প্রমুখ সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৯১৪ নং)
৪। মনে করুন আপনি আল্লাহর সাথে কথা বলছেন এবং আল্লাহ আপনার কথা শুনছেন ও জওয়াবও দিচ্ছেন। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি নামাযকে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে প্রার্থনা করে।’ সুতরাং বান্দা যখন বলে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’-লামীন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল ---।’ (মুসলিম, মিশকাত ৮২৩ নং)
আপনি মনে করুন, আপনি তাঁর সাথে একান্ত নিরালায় আলাপন করছেন। সুতরাং কারো সাথে নিভৃত আলাপে কানে-কানে কথা বলার সময় আপনার মন ও খেয়াল কি অন্য দিকে থাকতে পারে? মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রভুর সাথে নির্জনে আলাপ করে ---।” (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৬ নং)
৫। নামাযে খেয়াল করুন। আপনি এক অপরাধী, ক্ষমার ভিখারী। আপনি এক পলাতক দাস, অ নু তপ্ত হয়ে তাঁর অনুগ্রহ-প্রার্থনা। আপনি একজন দুর্বল ক্ষমতাহীন, ক্ষমতার ভিখারী। আপনি একজন নিঃস্ব অসহায়, সাহায্য ও সহায়তার অভিলা ষী । পথভ্রষ্ট, পথ-নির্দেশের আশাধারী। কি¾ষ্ট ও পীড়িত, নিরাপত্তা ও নিরাময়ের ভিখারী। রুযীহীন, রুযীর ভিখারী। আর মনে রাখুন যে, এসব ভিক্ষা আপনি তাঁর দরজা ছাড়া অন্য কারো দরজায় পাবেন না, পেতে পারেন না। তাই তো আপনি প্রত্যেক রাকআতে বলে থাকেন, “আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করে থাকি এবং তোমারই নিকট সাহায্য ভিক্ষা করি।” (সূরা ফাতিহা/৪)
৬। নামাযে আপনার চক্ষু শীতল হোক। হৃদয়-মন ভরে উঠুক শান্তি ও স্বস্তিতে। উপশম হোক সকল প্রকার ব্যথা ও বেদনার। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযে আমার চক্ষু শীতল করা হয়েছে।” (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, জামে ৩১২৪ নং) একদা তিনি বিলাল (রাঃ) কে বললেন, “নামাযের ইকামত দিয়ে ত্বরা আমাদেরকে শান্তি দাও, হে বিলাল!” (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮৫, মিশকাত ১২৫৩ নং) অতএব আপনিও আপনার মনের পরম শান্তি নামাযেই খুঁজে পাবেন।
৭। এই সময় আপনি মিষ্টি সুরে সুন্দর ক্বিরাআত করুন। দেখবেন, যত পড়বেন তত আরো পড়তে মন হবে। ক্বিরাআত ছাড়তেই ইচ্ছা হবে না। সেই সময় মুনাজাতের এমন এক মিষ্ট স্বাদ আছে, যা ত্যাগ করতেই মন হবে না। ইমামের পশ্চাতে হলে মনে হবে নামায আরো লম্বা হোক।
৮। আর নামায যদি আপনার চক্ষুর শীতলতা হয় তাহলে নিশ্চয়ই কোন নামায আপনার পক্ষে ভারি হওয়া উচিৎ নয়। তা এক প্রকার বোঝা মনে করা এবং সময় হলে তা কোন রকম আদায় করে নামিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে থাকাও উচিৎ নয়। কারণ নামাযকে ভারি মনে করা মুনাফিকের চরিত্র ও লক্ষণ। ঐ দেখুন না, আল্লাহ তার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, “মুনাফিকরা --- যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে কেবল লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।” (কুরআন মাজীদ ৪/১৪২) “আর তারা আলস্য ভরা মন নিয়ে নামাযে উপস্থিত হয়।” (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “এশা ও ফজরের নামায মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে বেশী ভারি নামায।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০৬৬ নং)
সুতরাং নামাযকে ভারি মনে করবেন না এবং দায় সারার মত চটপট পড়ে নিয়ে কি করে অব্যাহ্তি মিলে সেই চেষ্টায় থাকবেন না। কারণ, জানেন যে, শান্তির সময় সংক্ষেপ হয় এবং কষ্টের সময় লম্বা। অতএব নামায যদি আপনার জন্য শান্তিপ্রদ হয়, তবে আপনাকে মনে হবে যে, তা চট করে শেষ হয়ে গেল। পক্ষান্তরে যদি তা ভারি ও কষ্টদায়ক মনে করে তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য অস্বস্তিবোধ করে থাকেন, তাহলে সে নামাযের সময় আপনাকে আরো লম্বা লাগারই কথা। পরন্তু মহান আল্লাহ যদি আপনার নিকট প্রিয়তম হন, তবে তাঁর সাথে নিরালায় আলাপ করতে তো বিরক্তি ও অস্বস্তিবোধ করার কথা নয়!
৯। কিন্তু প্রিয়তমের সাথে নিরালায় আলাপনের মিষ্ট স্বাদ তখনই পাবেন, যখন আপনি সজ্ঞানে তার সাথে কথা বলবেন। নচেৎ, পাগল যেমন প্রলাপ বকে কোন শান্তি পায় না, তেমনি আপনিও পাবেন না। সুতরাং নামাযে আপনি যা বলছেন, তা সম্পূর্ণ না হলেও মোটামুটি বুঝে বলুন। যা বলছেন, তা সঠিকভাবে বলুন। নচেৎ আপনি কি বলছেন, তা যদি আপনি নিজেই না বোঝেন অথবা ‘দাদা’ বলতে ‘গাধা’ বলেন, তাহলে নিশ্চয়ই সেই আলাপে মজা পাবেন না, বিধায় ফলও হবে অপরিণত বা বিপরীত।
ঐ দেখুন না, প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। সুতরাং সে কি আলাপ করছে, তা যেন সে লক্ষ্য করে।” (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৬ নং)
যদি আপনি বুঝে ও খেয়াল করে সূরা তথা দুআ-দরুদ পড়েন, তাহলে তার ফল যে সুন্দর ও মিষ্ট হবে তা নিশ্চিত। ঐ ফলের ব্যাপারে রসূল (সাঃ) বলেন, “যখনই কোন মুসলিম পূর্ণরুপে ওযূ করে নামায পড়তে দাঁড়ায় এবং (তাতে) যা বলছে তা সে বুঝে, তখনই সে প্রথম দিনের শিশুর মত (নিষ্পাপ) হয়ে নামায সম্পন্ন করে।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ১৮৩, ৫৪৪ নং)
নামাযে ‘রুহ্’ বা ‘জান’ আনতে যে জিনিস বেশী সাহায্য করে, তা হল নামাযে যা পড়া বা বলা হয় তার অর্থ বুঝা। অন্যথায় নারকেলের খোসা না ভেঙ্গে উপরে কামড় দিলে যেমন নারকেলের স্বাদ পাওয়া যায় না, পরন্তু মেহনত বরবাদ ও দাঁতে দরদ হয়, অনুরুপ আরবী ভেঙ্গে না বুঝে নামায পড়লে নামাযেরও কোন স্বাদ পাওয়া যায় না। তাতে বিশেষ তৃপ্তি ও ফললাভ হয় না।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “বান্দা নামায পড়ে, অথচ তার নামাযের ১০, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩ অথবা ২ ভাগের ১ ভাগ মাত্র (কবুল বলে) লিপিবদ্ধ হয়!” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৯৬ নং, নাসাঈ, সুনান)
বলাই বাহুল্য যে, যার নামায যত মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাহ্ মোতাবেক এবং রুহ্বিশিষ্ট হবে, তার নামায তত পূর্ণাঙ্গ ও বেশী শুদ্ধ হবে। নচেৎ, সেই কমি অনুসারে সওয়াবও কম হতে থাকবে।
মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশার অবস্থায় নামাযের নিকটব র্তী হ্য়ো না, যতক্ষণ না তোমরা কি বলছ তা বুঝতে পার---।” (কুরআন মাজীদ ৪/৪৩) সুতরাং মাদকদ্রsব্যর মত ঔদাস্য, গাফলতি, খেল-তামাশা, পার্থিব সম্পদ এবং (নামাযী নামাযে যা বলছে তা বুঝতে চেষ্টা না করার) আলস্য যাকে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে সে কি নামাযের নিকটে আসার অযোগ্য নয়?
ফলকথা, সর্বপ্রকার মাদকতা, নেশা, ঔদাস্য ও অমনোযোগিতা থেকে পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে আলাপ করাই মু’মিনের কর্তব্য।
১০। নামাযের ভিতর আপনি আপনার আত্মf ও শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। আপনি নামাযে মন বসালেও শয়তান কিন্তু আপনার পিছন ছাড়ে না। তাই তো অনেক ভুলে যাওয়া কথা নামাযে মনে পড়ে থাকে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযের জন্য আযান দেওয়া হলে শয়তান পাদতে পাদতে এত দূরে পালায়, যেখানে আযান শোনা যায় না। আযান শেষ হলে আবার ফিরে আসে। ইকামত শুরু হলে পুনরায় পালায়। ইকামত শেষ হলে নামাযীর কাছে এসে তার মনে বিভিন্ন কুমন্ত্রণা আনয়ন করে বলে, ‘এটা মনে কর, ওটা মনে কর।’ এইভাবে নামাযীর যা মনে ছিল না তা মনে করিয়ে দেয়। এর ফলে নামাযী শেষে কত রাকআত নামায পড়ল তা জানতে পারে না।” (বুখারী ৬০৮ নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩১৩)
উসমান বিন আবুল আস (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসূল! শয়তান আমার ও আমার নামায এবং ক্বিরাআতের মাঝে অন্তরাল ও গোলমাল সৃষ্টি করে। (বাঁচার উপায় কি?)’ তিনি বললেন, “ওটা হল ‘খিনযাব’ নামক এক শয়তান। সুতরাং ঐরুপ অনুভব করলে তুমি আল্লাহর নিকট ওর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করো এবং তোমার বাম দিকে ৩ বার থুথু মেরো।” উসমান বলেন, এরুপ করলে আল্লাহ আমার নিকট থেকে শয়তানের ঐ কুমন্ত্রণা দূর করে দেন। (মুসলিম, সহীহ ২২০৩ নং)
১১। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনার দৃষ্টিকে ঠিক সিজদার জায়গায় নিবদ্ধ রাখুন। তাশাহ্হুদে বসে দৃষ্টি রাখুন শাহাদতের আঙ্গুলের উপর। এতে আপনার মন সজাগ ও সতর্ক থাকবে। এ ব্যাপারেহাদীস পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
১২। উপর দিকে খবরদার নজর তুলবেন না। আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায পড়তে পড়তে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলে দেখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “লোকেদের কি হয়েছে যে, ওরা নামাযের মধ্যে ওদের দৃষ্টি আকাশের দিকে তোলে?” এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য খুব কঠেfর হয়ে উঠল। পরিশেষে তিনি বললেন, “অতি অবশ্যই ওরা এ কাজ হতে বিরত হোক, নচেৎ ওদের চক্ষু ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে।” (বুখারী৭৫০নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
নবী (সাঃ) আরো বলেন, “নামাযের মধ্যে আকাশের (উপরের) দিকে দৃষ্টিপাত করা হতে লোকেরা অতি অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ ওদের দৃষ্টি আর ফিরে না-ও আসতে পারে। (ওরা অন্ধ হয়ে যেতে পারে!)” (মুসলিম, সহীহ৪২৮নং)
১৩। আর এদিক-সেদিকও তাকাবেন না। চোরা ও টেরা নজরে কোন কিছু দেখবেন না। কারণ, এই দৃষ্টি আকর্ষণ ও চুরি করা শয়তানের কাজ। (বুখারী ৭৫১নং, আবূদাঊদ, সুনান)
বান্দা যদি তার নামাযে এদিক-ওদিক দৃষ্টি না ফিরায়, তাহলে আল্লাহ তার নামাযের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হন। (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৫৫০ নং) বান্দার এদিক-ওদিক চেহারা ফিরিয়ে দিলে আল্লাহও আর সে নামাযের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন না। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫২ নং) সুতরাং সাবধান! আপনার নামায থেকে মহান আল্লাহ যেন মুখ ফিরিয়ে না নেন এবং দুশমন শয়তানও যেন আপনার নামায ছিনতাই করে না নেয়।
১৪। আপনি নামাযে দাঁড়াবার আগে আপনার সম্মুখ হতে সেই সমস্ত জিনিসকে দূরে সরিয়ে দেন, যা আপনার নজর কেড়ে নেবে, মনোযোগ ছিনিয়ে নেবে, খেয়াল আকর্ষণ করবে ও একাগ্রতা নষ্ট করবে বলে আশঙ্কা করেন। এই জন্যই প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “গৃহে (মসজিদে) এমন কোন জিনিস থাকা উচিৎ নয়, যা নামাযীকে মশগুল (অন্যমনস্ক) করে ফেলে।” (আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/৬৮, ৫/৩৮০) একদা তিনি নক্সাদার কাপড়ে নামায পড়ে বললেন, “আমি এর নক্সার দিকে একবার তাকালে আমাকে তা আমার নামায থেকে অমনোযোগী করে ফেলার উপক্রম করেছিল।” (বুখারী, মুসলিম, মালেক, মুঅত্তা, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৭৬ নং) মা আয়েশা رضي الله عنها এর একটি ছবিযুক্ত কাপড় টাঙ্গানো থাকলে সেদিকে মুখ করে নামায পড়ার পর তিনি বললেন, “এটাকে আমার নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দাও। কারণ, এর ছবিগুলো আমার নামাযে বাধা সৃষ্টি করছিল।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আহমাদ, মুসনাদ ৬/১৭২)
১৫। নামাযের পূর্বে আপনি প্রস্রাব-পায়খানার কাজ সেরে নিন এবং প্রস্রাব বা পায়খানার চাপ নিয়ে নামাযে দাঁড়ান না। কারণ, এতে নামাযে মন বসে না। হয়তো বা তাড়াহুড়ো করে নামায শেষ করতে হয় অথবা নামাযে অন্যমনõতা আসে। অনুরুপ পেটে খিদে রেখে সামনে খাবার উপস্থিত থাকলে অথবা খাবারের দিকে মন পড়ে থাকলেও নামাযে দাঁড়ানো উচিৎ নয়। কারণ এতে নামায হয় না। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে আবী শাইবা, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৮নং)
১৬। এমন কোন ভারী জিনিস সঙ্গে নিয়ে নামাযে দাঁড়াবেন না, যাতে নামাযের বদলে ঐ ভারের প্রতিই আপনার মন লেগে না থাকে।
১৭। এমন কোন স্থানে বা লেবাসে নামায পড়তে শুরু করবেন না, যার দুর্গন্ধ আপনাকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
১৮। এমন টাইট-ফিট লেবাস পরে নামায পড়বেন না, যাতে বসা-ওঠা কষ্টকর হয়।
১৯। বেপর্দা মহিলারা যখন গায়ে-মাথায় কাপড় বা চাদর নিয়ে নামায পড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবে তাদেরকে গরম লাগে। এতে নামাযে মন বসে না এবং যত তাড়াতাড়ি শেষ করে চাদর খুলতে পায় সেই চেষ্টা করে। সুতরাং নামাযী হওয়ার সাথে সাথে আপনি পর্দানশীন মহিলা হতে চেষ্টা করুন। যেমন ওযু করার পর ‘মেক-আপ’ করলে যাতে নামাযের আগে ওযু ভেঙ্গে গিয়ে পুনরায় ওযুতে তা নষ্ট হয়ে না যায়, তার জন্য তাড়াতাড়ি নামায শেষ করা এবং মাথার চুল বেঁধে বা চুলে ফুল গুঁজে নামায পড়তে পড়তে চুলের ও ফুলের পারিপাট্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বারবার ওড়নার প্রতি খেয়াল করাও নামাযে অমনোযোগিতার দলীল।
২০। পরনে এমন ওড়না, কাপড়, শাল, চাদর, বা শাড়ি হতে হবে, যেন নামাযের অবস্থায় তা বারবার পড়ে না যায়। নচেৎ, সোজা করতে করতেই নামায শেষ হবে অথচ নামাযে মন থাকার পরিবর্তে মন থাকবে কাপড় পড়ার দিকে। পক্ষান্তরে যদি মহিলাদের মাথা, বুক, পেট অথবা হাত বা পায়ের রলা থেকে কাপড় সরে যায়, তাহলে তো মূলে নামাযই নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরী।
২১। কোন লটকে রাখা কাজ বন্ধ করে - যেমন চুলোর উপর হাঁড়ি রেখে নামায পড়বেন না। কারণ, এ অবস্থায় নামাযে মন না থেকে মন পড়ে থাকবে ঐ চুলোর হাঁড়ির উপরেই। পাছে উল্টে না যায় বা পুড়ে না যায়, ইত্যাদি।
২২। সম্ভব হলে এমন স্থানে নামায পড়ুন, যেখানে খুব গরম আপনাকে অতিষ্ঠ করবে না এবং খুব শীতও আপনাকে কাতর করে ফেলবে না। অনুরুপ যে স্থানে হৈ-হুল্লোড়, চেচামেচি বা গোলমাল-গন্ডগোলের ফলে আপনার নামাযে একাগ্রতার ব্যাঘাত ঘটে, সে স্থানে নামায পড়বেন না। (কাইফা তাখশাঈনা ফিস স্বালাহ্ ১৯-২৪ দ্র:)
২৩। আপনার সামনে কোন ঘুমন্ত ব্যক্তি থাকলে এবং তার কাপড় সরে যাওয়া বা ঘুমের ঘোরে আপনার নামাযের স্থান দখল করার আশঙ্কা হলে সে জায়গায় নামায পড়তে দাঁড়াবেন না। অনুরুপ যে ব্যক্তি কথা বলছে, তাকে সামনে করেও নামায পড়বেন না। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৯৪ নং)
২৪। নামাযের সময় ঘুম এলে যথাসম্ভব তা দূর করে নামায পড়ুন। নচেৎ, মন যে আপনাকে ফাঁকি দেবে, তা বলাই বাহুল্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়া অবস্থায় ঘুমে ঢুলতে থাকলে সে যেন একটু শুয়ে ঘুম তাড়িয়ে নেয়। নচেৎ, ঢুলতে ঢুলতে নামায পড়তে থাকলে সে হয়তো আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসবে।” (বুখারী ২১২ নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৬/৫৬)
তিনি আরো বলেন, “কেউ নামাযে ঢুলতে লাগলে সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যাতে সে কি পড়ছে, তা বুঝতে পারে।” (বুখারী ২১৩ নং)
অবশ্য এমন ঘুম বৈধ নয়, যাতে নামাযের সময়ই পার হয়ে যায়।
২৫। আপনি নামায পড়ছেন তার জন্য নিজে নিজে গর্বিত না হয়ে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ হন। যেহেতু তাঁর তওফীক দানের ফলেই আপনি এত বড় ইবাদত পালনে সক্ষম হয়েছেন। ঈমান, ইবাদত প্রভৃতি এক একটি অমূল্য ধন ও এক একটি বিশেষ অনুগ্রহ। আর বান্দার যাবতীয় ধন ও অনুগ্রহ তো আল্লাহরই দান। (কুরআন মাজীদ ১৬/৫৩)
২৬। আপনি আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব করেছেন। এই দাসত্ব আপনার ঠিকমত হ্চ্ছে কি না, তা আপনি জানেন না। সুতরাং আপনি নিজের ত্রুটি ও অবহেলা স্বীকার করে মনকে ইবাদত কবুল না হওয়ার আশঙ্কা ও ভীতি দ্বারা পরিপূর্ণ রাখুন। মহান আল্লাহ বলেন, “আর যারা তাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাবে এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা ভয়-ভয় মনে দান করে। তারাই দ্রুত কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করে এবং তারা ওতে অগ্রগামী হয়।” (কুরআন মাজীদ ২৩/৬০-৬১)
মা আয়েশা رضي الله عنها জিজ্ঞাসার ছলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বললেন, ‘ওরা কি তারা, যারা মদ খায়, চুরি করে (বা ব্যভিচার করে এবং এর কারণেই আল্লাহকে ভয় করে)?’ তিনি বললেন, “না, হে সিদ্দীক-তনয়া! বরং (আল্লাহ তাদের কথা বলেছেন) যারা রোযা করে, নামায পড়ে, দান-খয়রাত করে, অথচ তারা এই ভয় করে যে, হয়তো এসব তাদের কবুল হবে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩১৭৫, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৪১৯৮ নং)
আপনি যতই ইবাদত করুন না কেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই কম। জান্নাতের মূল্য তো অবশ্যই নয়। এ জন্যই প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “কেউই তার আমলের জোরে জান্নাত যেতে পারবে না।” বলা হল, ‘আপনিও কি নন, হে আল্লাহর রসূল?’ বললেন, “আমিও নই। তবে যদি আল্লাহ তাঁর রহ্মত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করেন তাহলে!” (বুখারী ৫৬৭৩, ৬৪৬৩, মুসলিম, সহীহ ২৮১৬ নং, প্রমুখ, দ্র: স্বালাতুল মুহিব্বীন, ইবনুল কাইয়িম)
ইবনুল জাওযী বলেন, ‘হে সেই নামাযী! যে তার দেহ্ নিয়ে নামাযে দন্ডায়মান অথচ তার হৃদয় অনুপস্থিত! যেটুকু বন্দেগী তুমি করেছ তা তো বেহেশ্তের মোহ্র হওয়ার জন্যও যথেষ্ট নয়, বেহেশ্তের মূল্য হওয়া তো দূরের কথা। একদা একটি ইদুর এক উট দেখে তাকে পছন্দ করল। (বন্ধুত্ব গড়ার আশায়) সে তার লাগাম ধরে টান দিলে উটটি তার অনুসরণ করল। অতঃপর যখন উভয়ে ইদুরের ঘরের দরজায় সামনে উপস্থিত হল, তখন থমকে দাঁড়িয়ে উট যেন তার ভাব-জিভে বলতে লাগল, প্রেম করতে হলে তুমি প্রেমিকের জন্য এমন ঘর প্রস্তুত কর, যা তোমার প্রেমিকের জন্য উপযুক্ত অথবা এমন প্রেমিক নির্বাচন কর, যে তোমার ঘরের উপযুক্ত।
এই উদাহ্রণ থেকে তুমি শিক্ষা নাও, আর এমন নামায পড় যা তোমার সেই (বিশাল পরাক্রমশালী) মা’বূদের জন্য উপযুক্ত। নচেৎ এমন মা’বূদ দেখ, যে তোমার নামাযের উপযুক্ত।’ (আল-মুদহিশ ৪৭২-৪৭৩পৃ:)
এই সকল উপদেশ যদি মেনে চলেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনার নামাযে রুহ্ আসবে এবং তা কায়েম ও প্রতিষ্ঠা হবে। আর এই নামাযই হবে আপনাকে মন্দ কাজ হতে বিরতকারী।
এবার সলফে সালেহীনের নিকট থেকে একাগ্রতার কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নিন। ইনশাআল্লাহ আপনি তাতে আরো উৎসাহ্ ও উদ্দীপনা পাবেন।
নামাযে সলফদের একাগ্রতার কিছু নমুনা
‘যাতুর রিকা’ অভিযানে মুসলিমদের এক ব্যক্তি এক মুশরিক মহিলাকে হ্ত্যা করে ফেললে তার স্বামী প্রতিজ্ঞা করল যে, মুহাম্মাদের সঙ্গীদের মধ্যে কারো রক্ত না বহানো পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হবে না। এই সংকল্প নিয়ে সে মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের খোঁজে বের হয়ে পড়ল। এদিকে মহানবী (সাঃ) এক মঞ্জিলে বিশ্রাম নিতে অবতরণ করলে সাহাবাগণের উদ্দেশ্যে বললেন, “কে আমাদের (নিরাপত্তার) জন্য পাহারা দেবে?” এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুহাজিরদের মধ্যে এক ব্যক্তি এবং আনসারদের মধ্য হতে আর এক ব্যক্তি পাহারা দিতে প্রস্তুত হলেন। তাঁদেরকে মহানবী (সাঃ) বললেন, “তোমরা এই উপত্যকার মুখে অবস্থান কর।”
অতঃপর তাঁরা দু’জন যখন উপত্যকার মুখে পৌঁছলেন, তখন মুহাজেরী (বিশ্রামের জন্য) শয়ন করলেন এবং আনসারী উঠে নামায পড়তে শুরু করলেন। এমতাবস্থায় উক্ত মুশরিক লোকটি কাছাকাছি এসে যখন তাঁর (নামাযীর) আবছা দেহ্ দেখতে পেল, তখন সে বুঝল, নিশ্চয় ও মুহাম্মাদের গুপ্তচর। সুতরাং তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করলে তা সঠিক নিশানায় পৌঁছে আনসারীকে আঘাত করল। তিনি তীর দেহ্ থেকে বের করে দিয়ে নামাযেই মশগুল থাকলেন। এইভাবে পরপর তিন খানা তীর খেয়ে ও তা বের করে ফেলে রুকু-সিজদাহ করে সম্পন্ন করলেন। অতঃপর তার মুহাজেরী সঙ্গী জেগে উঠলেন। মুশরিকটি তার কথা ওরা জানতে পেরেছেন ভেবে পালিয়ে গেল। এরপর মুহাজেরী যখন আনসারীর রক্তাক্ত দেহের প্রতি লক্ষ্য করলেন, তখন বলে উঠলেন, ‘সুবহানাল্লাহ্! প্রথম বারেই যখন তীর মারল, তখনই কেন আমাকে জাগিয়ে দাওনি?’ আনসারী উত্তরে বললেন, ‘আমি এমন একটি সূরা পাঠ করছিলাম, যা শেষ না করে আমি ছাড়তে পছন্দ করলাম না!’ (আবূদাঊদ, সুনান ১৯৮ নং, আহমাদ, মুসনাদ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
আলী বিন হুসাইন (রহঃ) যখন নামাযের জন্য ওযু সম্পন্ন করতেন, তখন তাঁর দেহে কম্পন শুরু হত! এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘ধিক তোমাদের প্রতি! তোমরা জান কি, কার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি? কার সাথে মুনাজাত (নির্জনে আলাপ) করতে চলেছি?’ (হিলয়্যাতুল আওলিয়া ৩/১৩৩)
মুহাম্মাদ বিন মুনকাদিরের ব্যাপারে কথিত আছে যে, তিনি এক রাত্রে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন এবং এত বেশী কাঁদতে লাগলেন যে, তাঁর ঘরের লোক ভয় পেয়ে গেল। তারা তাঁকে এত কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কোন উত্তর পেল না। অবশেষে তাঁকে চুপ না হতে দেখে তারা আবূহাযেমের নিকট ব্যাপার খুলে বললে তিনি তাঁর নিকট এলেন। দেখলেন, তখনও তিনি কাঁদছেন। আবূহাযেম বললেন, ‘কি হল ভাই? কাঁদছ কেন? তোমার বাড়ির লোকেরা যে ভয় খেয়ে গেছে! কোন অসুখ তো করে নি? অথবা কি হয়েছে তোমার?’
মুহাম্মাদ বললেন, ‘(নামাযে কুরআন মাজীদের) একটি আয়াত পাঠ করে আমি কান্না রুখতে পারছি না।’ আবূহাযেম বললেন, ‘কোন্ আয়াত?’ বললেন,
(وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مَا لَمْ يَكُوْنُوْا يَحْتَسِبُوْنَ)
অর্থাৎ, (সেদিন) আল্লাহর তরফ থেকে ওদের উপর এমন শাস্তি এসে পড়বে, যা ওরা (পূর্বে) কল্পনাও করে নি। (কুরআন মাজীদ ৩৯/৪৭)
এ কথা শুনে আবূহাযেমও তাঁর সাথে কাঁদতে শুরু করে দিলেন এবং কান্নার ধারা আরো বেড়ে গেল! তা দেখে মুহাম্মাদের বাড়ির একটি লোক আবূহাযেমকে বলল, ‘ওর নির্জনতা কাটাবার জন্যই আপনাকে ডেকে আনলাম। (কিন্তু আপনিও যে ওর সাথে কাঁদতে লাগলেন?) অতঃপর তাঁরা তাদেরকে কান্নার কারণ বর্ণনা করলেন। (হিলয়্যাতুল আওলিয়া ৩/১৪৬)
অবশ্য মুনাজাতের এ মিঠf স্বাদ তখনই অনুভূত হবে, যখন নামাযী বুঝবে যে, সে তার নামাযে কাকে ও কি বলছে। নচেৎ গরম পানিতে ঘর পোড়া সম্ভব নয়। যেমন মুখে চিনি চিনি বললে চিনির মিষ্ট স্বাদ অনুভব হবে না।
মাইমূন বিন মিহ্রান বলেন, মুহাজেরদের এক ব্যক্তি এক ব্যক্তিকে খুব হাল্কা নামায পড়তে দেখে তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু লোকটি অজুহাত দেখিয়ে বলল, ‘আমার একটি দামী জিনিস নষ্ট হওয়ার কথা মনে পড়লে নামায তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম।’ মুহাজেরী বললেন, ‘কিন্তু তার চেয়ে অধিক মূল্যবান জিনিস তুমি নষ্ট করে দিলে!’ (ঐ ৪/৮৪)
নামাযের মধ্যে যা করা বৈধ
নামায পড়তে পড়তে এমন কিছু কাজ আছে যা করা বৈধ, অথচ সাধারণত: তা অবৈধ মনে হয় বা বড় ভুল ভাবা হয়। এ রকম কিছু কাজ নিম্নরুপ :-
১। কাঁদা;
নামায পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে অশ্র ঝরা অথবা ডুকরে বা গুমরে কেঁদে ওঠা দূষণীয় নয়। আল্লাহর ভয়ে এমন কান্না কাঁদা তাঁর নেক ও বিনম্র বান্দার বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, “--- তাদের নিকট করুণাময় (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদা ও ক্রন্দন করত।” (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৮)
আব্দুল্লাহ বিন শিখখীর বলেন, ‘একদা আমি নবী (সাঃ) এর নিকটে এলাম। তখন তিনি নামায পড়ছিলেন। আর তাঁর ভিতর থেকে চুলোর উপর হাঁড়িতে পানি ফোটার মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যাঁতার শব্দের মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০০০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর অসুখ যখন খুব বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বললে তিনি বললেন, “তোমরা আবূ বাকারকে নামায পড়াতে বল।” আয়েশা رضي الله عنها বললেন, ‘আবূ বাকার তো নরম-দেলের মানুষ। উনি যখন কুরআন পড়েন, তখন কান্না রুখতে পারেন না।’ মহানবী (সাঃ) বললেন, “তোমরা ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।” আয়েশা رضي الله عنها পুনরায় ঐ একই কথা বললে মহানবী (সাঃ) ও পুন: বললেন, “ওকে বল, ওই নামায পড়াবে ---।” (বুখারী, মিশকাত ১১৪০ নং)
এ কান্না দীর্ঘ হলেও তাতে নামায নষ্ট হয় না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১)
২। হাঁচি ও তার জন্য দুআ;
নামাযের মধ্যে হাঁচি এলে হাঁচির পর নির্দিষ্ট দুআ পাঠ বৈধ। আর সেই দুআর বড় ফযীলতও রয়েছে। কওমার ৫নং দুআ দেখুন।
৩। হাই তোলা;
নামাযে যদিও হাই তোলা বৈধ, তবুও যেহেতু হাই আলস্য জনিত বা নিদ্রা জনিত কারণে মুখ ব্যাদানোর নাম, তাই তা যথাসম্ভব দমন করা কর্তব্য। কারণ, নামাযে নামাযী আলস্য প্রদর্শন করলে শয়তান খোশ হয়।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কারো যখন নামাযে হাই আসে, তখন তার উচিৎ, তা যথাসাধ্য দমন করা এবং ‘হা-হা’ না বলা। কেন না, হাই শয়তানের তরফ থেকে আসে। আর সে তা দেখে হাসে।” (বুখারী, মিশকাত ৯৮৬ নং)
“তোমাদের কেউ হাই তুললে সে যেন তার মুখে হাত রেখে নেয়। কারণ, শয়তান হাই-এর সাথে (মুখে) প্রবেশ করে যায়!” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৪২৬ নং)
৪। থুথু ফেলা;
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে দাঁড়ালে সে যেন তার সম্মুখ দিকে থুথু না ফেলে। কারণ, সে যতক্ষণ নামাযের জায়গায় থাকে ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত (নিরালায় আলাপ) করে। আর তার ডান দিকেও যেন থুথু না ফেলে। কারণ, তার ডানে থাকে (বামদিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সম্মানিত নেকী-লেখক) ফিরিশ্তা। বরং সে যেন (মসজিদের মেঝে কাঁচা মাটির হলে অথবা মাঠে-ময়দানে নামায পড়লে) তার বাম দিকে অথবা (সেদিকে কেউ থাকলে) তার (বাম) পায়ের নিচে ফেলে। যা পরে সে দাফন করে দেবে।” (বুখারী, মুসলিম, ৭১০, ৭১১নং)
একদা তিনি মসজিদের কিবলার দিকে দেওয়ালে কফ লেগে থাকতে দেখে মর্মাহত হলেন এবং তা তাঁর চেহারাতেও ফুটে উঠল। তিনি উঠলেন এবং নিজ হাত দ্বারা তা পরিষ্কার করলেন। অতঃপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। তার প্রতিপালক থাকেন তার ও তার কিবলার মাঝে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন তার সামনের দিকে অবশ্যই থুথু না ফেলে। বরং সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে থুথু ফেলে।” অতঃপর তিনি তাঁর চাদরের এক প্রান্ত ধরে তার উপর থুথু ফেললেন এবং পাশাপাশি কাপড় ধরে কচলে দিলেন, আর বললেন, “অথবা সে যেন এইরুপ করে।” (বুখারী, মিশকাত ৭৪৬নং)
নাক ঝাড়লেও অনুরুপ করা উচিৎ। অবশ্য পৃথক রুমাল বা টিসু-পেপার ব্যবহার উত্তম।
৫। অনিষ্টকর জীব-জন্তু মারা:-
নামায পড়তে পড়তে সাপ, বিছা, বোলতা প্রভৃতি বিষধর ও অনিষ্টকর জন্তু মারা বৈধ। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযে দুই কালো জন্তু; সাপ ও বিছা মেরে ফেলো।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৯২১, তিরমিযী, সুনান ৩৯০, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৪৫, ত্বায়ালিসী ২৫৩৮, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ১৭৫৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮৯৬, ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৩৫১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৫৬, বায়হাকী ২/২৬৬, প্রমুখ)
অনুরুপ উকুন বা উকুন-জাতীয় পোকাও নামাযে মারা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০)
৬। চুলকানো:-
দেহে অস্বস্তিকর চুলকানি শুরু হলে নামায পড়া অবস্থাতেও চুলকানো বৈধ। কারণ, চুলকানিতে নামাযীর একাগ্রতা নষ্ট হয়। আর চুলকে দিলে অস্বস্তিবোধ দূর হয়ে যায়। সুতরাং এখানে ধৈর্য ধরা উত্তম নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০-৩৫১)
৭। প্রয়োজনবোধে চলা:-
শত্রুর ভয় হলে (জিহাদের ময়দানে) চলা অবস্থায় নামায বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামায সমূহের প্রতি -বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি- যত্নবান হও এবং আল্লাহর সম্মুখে বিনীতভাবে দাঁড়াও। কিন্তু যদি (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে চলা অথবা সওয়ার অবস্থায় (নামায পড়)।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮-২৩৯)
একদা মহানবী (সাঃ) স্বগৃহে দরজার খিল বন্ধ করে নফল নামায পড়ছিলেন। মা আয়েশা رضي الله عنها এসে দরজা খুলতে বললে তিনি চলে গিয়ে তাঁর জন্য দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর পুনরায় নিজের মুসাল্লায় ফিরে গেলেন। অবশ্য দরজা ছিল কিবলার দিকেই। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৯২২, তিরমিযী, সুনান ৬০১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, আবূ য়্যা’লা ৪৪০৬, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ২/২৬৫, মিশকাত ১০০৫ নং)
একদা তিনি সূর্যগ্রহণের নামাযে বেহেশ্ত দেখে অগ্রসর এবং দোযখ দেখে পশ্চাদপদ হয়েছিলেন। (বুখারী ১০৫২, মুসলিম, সহীহ ৫২৫ নং)
সাহাবাগণকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি মিম্বরে চড়ে নামায পড়েছেন। মিম্বরের উপর রুকূ করে পিছ-পায়ে নেমে নিচে সিজদাহ করেছেন। (বুখারী ৯১৭, মুসলিম, সহীহ ৫৪৪ নং) একদা আবূ বাকার (সাঃ) এর ইমামতি কালে মহানবী (সাঃ) এসে উপস্থিত হলে তিনি (আবূ বাকার) পিছ-পায়ে সরে এসেছিলেন। (বুখারী ৬৮০, ১২০৫ নং) আবূ বারযাহ্ আসলামী (রাঃ) ফরয নামায পড়তে পড়তে তাঁর ঘোড়া পালাতে শুরু করলে তিনি তার পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন। (বুখারী ১২১১ নং, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী)
৮। ছেলে তোলা:-
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) ইমামতি করতেন, আর আবুল আসের শিশু কন্যা তাঁর কাঁধে থাকত। অতঃপর যখন তিনি রুকূ করতেন, তখন তাকে নিচে নামিয়ে দিতেন। পুনরায় যখন সিজদাহ থেকে উঠতেন, তখন আবার কাঁধে তুলে নিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৮৪ নং) এ ব্যাপারে ‘দীর্ঘ সিজদাহ’ শিরোনামে শাদ্দাদ (রাঃ) এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
৯। শিশুদের ঝগড়া থামানো:-
একদা বানী মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে মহানবী (সাঃ) এর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি নামায পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৭২৭ নং)
১০। খোঁচা দিয়ে সরে যেতে ইঙ্গিত করা:-
মা আয়েশা رضي الله عنها মহানবী (সাঃ) এর নামায পড়া কালে তাঁর সামনে কিবলার দিকে পা মেলে শুয়ে থাকতেন। তিনি (অন্ধকারে) যখন সিজদাহ করতেন, তখনহাতের খোঁচা দিয়ে তাঁকে (স্ত্রীকে) পা সরিয়ে নিতে ইঙ্গিত করতেন। (বুখারী ৩৮২, ১২০৯ নং)
১১। ইশারায় সালামের জওয়াব দেওয়া:-
নামাযী নামাযে রত থাকলেও তাকে সালাম দেওয়া বিধেয় এবং নামাযীর নামায পড়া অবস্থাতেই সালামের জওয়াব দেওয়া কর্তব্য। তবে মুখে নয়, হাত বা আঙ্গুলের ইশারায়। (মুসলিম, সহীহ ৫৩৮, আদা, মিশকাত ৯৮৯ নং)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, আমি বিলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (সাঃ) এর নামাযে রত থাকা অবস্থায় ওঁরা (সাহাবীগণ) যখন সালাম দিতেন, তখন তিনি কিভাবে উত্তর দিতেন? বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘হাত দ্বারা ইশারা করে।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, শাফেয়ী, মিশকাত ৯৯১নং)
একদা তিনি উটের উপর নামায পড়ছিলেন। জাবের (রাঃ) তাঁকে সালাম দিলে তিনি হাতের ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৪০নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা সুহাইব (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি আঙ্গুলের ইশারায় জওয়াব দিয়েছিলেন। (তিরমিযী, সুনান ৩৬৭নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা আবূ হুরাইরা (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৯৯৮)
একদা ইবনে উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির নিকট গেলেন, তখন সে নামায পড়ছিল। তিনি তাকে সালাম দিলে সে মুখে উত্তর দিল। পরে ইবনে উমার (সাঃ) তাকে বললেন, ‘নামায পড়া অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কাউকে সালাম দেওয়া হলে সে যেন মুখে উত্তর না দেয়। বরং সে যেন হাত দ্বারা ইশারা করে উত্তর দেয়।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০১৩ নং)
সালামের জওয়াব ছাড়া নামাযে প্রয়োজনে অন্য জরুরী কথাও ইঙ্গিত ও ইশারার মাধ্যমে বুঝানো যায়। একদা মহানবী (সাঃ) নামায পড়ছিলেন। তিনি সিজদাহ করলে হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) তাঁর পিঠে চড়ে বসলে সাহাবীগণ বারণ করলেন। কিন্তু তিনি ইশারা করে বললেন, “ওদেরকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও।” অতঃপর নামায শেষ করলে তিনি উভয়কে কোলে রেখে বললেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এই দু’জনকেও ভালোবাসে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৭৮ নং, বায়হাকী ২/২৬৩)
১২। নামাযে কাউকে কোন জরুরী ব্যাপারে সতর্কীকরণ
নামাযী নামাযে রত আছে এ কথা জানাতে অথবা ইমাম নামাযে কিছু ভুল করলে তার উপর তাঁকে সতর্ক করতে পুরুষদের জন্য ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ বলা এবং মহিলাদের জন্য হাততালি দেওয়া বিধেয়।
প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের নামাযের মধ্যে (অস্বাভাবিক) কিছু ঘটে গেলে পুরুষেরা যেন ‘তাসবীহ’ পড়ে এবং মহিলারা যেন হাততালি দেয়।” (বুখারী ৬৮৪, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৮৮ নং)
নারী এমন এক সৃষ্টি, যার রুপ, সৌরভ ও শব্দে পুরুষের মন প্রকৃতিগতভাবে চকিত হয়ে ওঠে। ফলে, যাতে নামাযের সময় তাদের মোহ্নীয় কণ্ঠস্বরে পুরুষরা সংকটে না পড়ে তার জন্য শরীয়তের এই বিধান। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় ফিরে বেড়ায়। (বুখারী ৩২৮১, মুসলিম, সহীহ ২১৭৫ নং) এবং পুরুষদের জন্য নারী হল সবচেয়ে বড় ফিতনার জিনিস। (বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম, সহীহ ২৭৪০ নং)
এখান থেকে বুঝা যায় যে, মহিলাদের পৃথক জামাআত হলে এবং সেখানে কোন বেগানা পুরুষ না থাকলে হাততালি না দিয়ে তাসবীহ পড়ে মহিলারা (মহিলা) ইমামকে সতর্ক করতে পারে। কারণ, তাসবীহ হল নামাযের এক অংশ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬২-৩৬৩)
মুক্তাদীদের মধ্যেও কেউ কিছু ভুল করলে, (যেমন সিজদায় বা বৈঠকে ঘুমিয়ে পড়লে) তাকেও সতর্ক করার জন্য তাসবীহ ব্যবহার চলবে। (ঐ ৩/৩৬৭-৩৬৮)
১৩। ইমামের ক্বিরাআত সংশোধন:-
নামাযে কুরআন পাঠ করতে করতে যদি ইমাম সাহেব কোন আয়াত ভুলে যান, থেমে যান অথবা ভুল পড়েন, তাহলে ‘লুকমাহ্’ দিয়ে তা মনে পড়ানো, ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করা বিধেয়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমিও ভুলে যাই, যেমন তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে মনে পড়িয়ে দিও।” (বুখারী ৪০১, মুসলিম, সহীহ ৫৭২নং)
একদা তিনি নামাযে কুরআন পড়তে পড়তে ভুলে কিছু অংশ ছেড়ে দিলেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক আয়াত আপনি ছেড়ে দিয়েছেন, (পড়েন নি)। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে মনে পড়িয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
একদা নামাযে ক্বিরাআত পড়তে পড়তে তাঁর কিছু গোলমাল হল। সালাম ফেরার পর উবাই (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “তুমি আমাদের সাথে নামায পড়লে?” উবাই (রাঃ) বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তবে ভুল ধরিয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭, ইহি, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২১২)
উল্লেখ্য যে, সূরা ফাতিহা নামাযের একটি রুক্ন অথবা ফরয। সুতরাং তা পড়তে ইমাম কোন প্রকারের ভুল করলে (যাতে অর্থ বদলে যায় তা) মুক্তাদীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ওয়াজেব। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৬)
১৪। প্রয়োজনে কাপড় বা পাগড়ীর উপর সিজদাহ করা:-
অতি গ্রীষ্ম বা শীতের সময় সিজদার স্থানে কপাল রাখা কষ্টকর হলে চাদর, আস্তীন বা পাগড়ীর বাড়তি অংশ ঐ স্থানে রেখে সিজদাহ করা বৈধ।
মহানবী (সাঃ) এর যামানায় সাহাবাগণ এরুপ করতেন। (বুখারী ৩৮৫, ৫৪২ নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/১০০)
জাবের (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে যোহরের নামায পড়তাম। আমার হাতের মুঠেfয় কিছু কাঁকর রেখে ঠান্ডা করে নিতাম এবং প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য তা কপালের স্থানে (সিজদার জায়গায়) রেখে নিতাম। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০১১ নং)
১৫। জুতা পরে নামায-
জুতা পাক-সাফ হলেও অনেকে বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাতের সময় তা পায়ে রাখে না। যা শ্রদ্ধার অতিরঞ্জন এবং বিদআত। বলাই বাহুল্য, এমন লোকদের নিকট জুতা পায়ে নামায পড়া তাদের কল্পনার বাইরে।
কিন্তু হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) জুতা পায়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৩৮৬, মুসলিম, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন আম্র বলেন, আমি নবী (সাঃ) কে খালি পায়ে ও জুতা পায়ে উভয় অবস্থাতেই নামায পড়তে দেখেছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৩ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
রসূল (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন তার জুতা পরে নেয় অথবা খুলে তার দু’ পায়ের মাঝে রাখে। আর সে যেন তার জুতা দ্বারা অপরকে কষ্ট না দেয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৫ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
তিনি আরো বলেন, “তোমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ কর (এবং জুতা পরে নামায পড়)। কারণ, ওরা ওদের জুতো ও চামড়ার মোজায় নামায পড়ে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫২ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
জুতা খুলে নামায পড়লে এবং মসজিদে জুতা রাখার কোন নির্দিষ্ট জায়গা না থাকলে যদি বাম পাশে কেউনা থাকে তাহলে বাম পাশে, নচেৎ দুই পায়ের মাঝে রাখতে হবে। ডান দিকে রাখা যাবে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
অবশ্য জুতায় ময়লা বা নাপাকী লেগে থাকলে তা পরে নামায হয় না। নাপাকী বা ময়লা মাটিতে বা ঘাসে রগড়ে মুছে দূর করে নিয়ে তাতে নামায পড়া যায়। নামাযের মাঝে জুতায় ময়লা লেগে আছে দেখলে বা জানতে পারলে তা সাথে সাথে খুলে ফেলা জরুরী। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫০, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৪ নং)
খেয়াল রাখার বিষয় যে, মসজিদ পাকা ও গালিচা-বিছানো হলে তার ভিতরে জুতা পরে গিয়ে নোংরা করা বৈধ নয়। মসজিদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার খেয়াল অবশ্যই জরুরী।
১৬। মনে অন্য চিন্তা এসে পড়া:-
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে অন্য চিন্তা এসে পড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় না। অবশ্য অন্য চিন্তা এনে দেওয়ার কাজ শয়তানই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে করে থাকে। আর এ কথা আমরা ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামে পড়েছি এবং শয়তান ও তার কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও সেখানে জেনেছি।
হযরত উমার (রাঃ) স্বীকার করেন যে, তিনি কোন কোন নামাযে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত ও প্রেরণ করার কথা চিন্তা করতেন। (বুখারী বিনা সনদে ২৩৯পৃ:)
একদা আসরের নামাযে মহানবী (সাঃ) এর মনে পড়ল যে, তাঁর ঘরে কিছু সোনা বা চাঁদির টুকরা থেকে গেছে। তাই সালাম ফিরেই সত্বর তিনি কোন পত্নীর গৃহে প্রবেশ করে রাত্রি আসার পূর্বেই দান করতে আদেশ করে এলেন! (বুখারী ৮৫১, ১২২১ নং)
সাহাবাগণের মধ্যে এমন অনেক সাহাবা ছিলেন, যাঁরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে নামায পড়তেন। কিন্তু গত রাত্রে এশার নামাযে তিনি (সাঃ) কোন্ সূরা পড়েছেন তা খেয়াল রাখতে পারতেন না। (বুখারী ১২২৩ নং)
অবশ্য প্রত্যেকের উচিৎ, যথাসম্ভব অন্য চিন্তা এবং অন্যমনস্কতা দূর করা। নচেৎ অন্য খেয়াল বা চিন্তা যত বেশী হবে, নামাযের সওয়াব তত কম হয়ে যাবে।
১৭। সিজদার জায়গা সাফ করা:-
সিজদার জায়গা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে নামাযের মাঝে (সিজদার সময়) ফুঁক দেওয়া বৈধ। আল্লাহর নবী (সাঃ) সূর্য-গ্রহণের নামাযের সিজদায় ফুঁক দিয়েছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৯৪, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ২/১৮৮, বুখারী বিনা সনদে ২৩৮পৃ:)
পক্ষান্তরে ফুঁক দেওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩১৩পৃ:) অনুরুপ কাঁকর সরানো নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীসও যয়ীফ। (ঐ) পরন্তু সহীহ হাদীসে একবার মাত্র সরানোর অনুমতি আছে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮০ নং) তবে না সরানো ১০০টি উৎকৃষ্ট উটনী অপেক্ষা উত্তম। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫৫ নং)
১৮। নামাযীর লেবাসের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক কাপড়ে এবং খালি মাথায় নামায পড়া বৈধ।
১৯। মুসহাফ হাতে দেখে দেখে কুরআন পাঠ:-
তারাবীহ্ প্রভৃতি লম্বা নামাযে (লম্বা ক্বিরাআতের) হাফেয ইমাম না থাকলে ‘কুল-খানী’ করে ঠকাঠক কয়েক রাকআত পড়ে নেওয়ার চেয়ে মুসহাফ (কুরআন মাজীদ) দেখে দেখে পাঠ করে দীর্ঘ ক্বিরাআত করা উত্তম। (অবশ্য কুরআন খতমের উদ্দেশ্যে নয়।) অনুরুপ (জামাআতে অন্য হাফেয মুক্তাদী না থাকলে) হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুক্তাদীর কুরআন দেখে যাওয়া বৈধ। এ সব কিছু প্রয়োজনে বৈধ; ফলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।
মা আয়েশা رضي الله عنها এর আযাদকৃত গোলাম যাকওয়ান রমযানে (তারাবীতে) দেখে দেখে কুরআন পাঠ করে তাঁর ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
ইমাম হাসান, মুহাম্মদ, আত্বা প্রমুখ সলফগণ এরুপ (প্রয়োজনে) বৈধ মনে করতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২১৪, ৭২১৮, ৭২১৯, ৭২২০, ৭২২১ নং)
বর্তমান বিশ্ব তথা সঊদী আরবের উলামা ও মুফতী কমিটির সিদ্ধান্ত মতেও প্রয়োজনে মুসহাফ দেখে তারাবীহ্ পড়ানো বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৪, ২১/৫৬) সঊদিয়ার প্রায় অধিকাংশ মসজিদে আমলও তাই।
হযরত আনাস (রাঃ) নামাযে ক্বিরাআত পড়তেন আর তাঁর গোলাম তাঁর পশ্চাতে মুসহাফ ধরে দাঁড়াতেন। তিনি কিছু ভুলে গেলে গোলাম ভুল ধরিয়ে দিতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২২২ নং)
নামাযের ভিতরে কুরআন খতম করলে খতমের পরে দুআ করার কোন দলীল নেই। তাই কুরআন খতমের দুআ নামাযের ভিতরে না করাই উচিৎ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭-৫৮) অবশ্য নামাযের বাইরে হযরত আনাস (রাঃ) কুরআন খতম করলে তাঁর পরিবার-পরিজনকে সমবেত করে দুআ করতেন। (ইবনুল মুবারাক, যুহ্দ ৮০৯ পৃ:, ইবনে আবী শাইবা ১০৮৭ নং, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ৭/১৭২)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, কুরআনের খতমের কোন নির্দিষ্ট দুআও নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৬৫, ১৮৬) অতএব কুরআন মাজীদের শেষ পৃষ্ঠার পর ‘দুআ-এ খতমিল কুরআন’ নামে যে দুআ প্রায় মুসহাফে ছাপা থাকে তা মনগড়া।
নামাযে যা করা মাকরুহ অথবা নিষিদ্ধ
১। নামাযে যে সমস্ত কার্যাবলী করা সুন্নত (যেমন রফ্য়ে ইয়াদাইন, ইস্তিরাহার বৈঠক, বুকেহাত বাঁধা ইত্যাদি) তার কোন একটিও ত্যাগ করা মাকরুহ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১২৫পৃ:)
২। মুখ ঘুরিয়ে বা আড় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখা, ঘড়ি বা অন্য কিছু দেখা বৈধ নয়।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, চোরা দৃষ্টিতে বা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে শয়তান নামাযীর নামায চুরি করে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮২নং) যেমন অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করে মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহও মুখ ফিরিয়ে নেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৯৯৫ নং)
নফল নামাযেও এদিক-ওদিক দেখা বৈধ নয়। বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীসগুলি সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩০৮-৩০৯পৃ:)
অবশ্য চোখের কোণে ডাইনে-বামের জিনিস দেখা বা নজরে পড়া নামাযের জন্য ক্ষতিকর নয়। কারণ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায পড়া অবস্থায় ডাইনে ও বামে লক্ষ্য করতেন। আর পিঠের দিকে ঘাড় ঘুরাতেন না।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৯৮ নং)
অনুরুপ ভয় ও প্রয়োজনের সময় দৃষ্টি নিক্ষেপ দূষণীয় নয়। একদা মহানবী (সাঃ) এক উপত্যকার দিকে জাসূস পাঠালেন। অতঃপর ফজরের নামায পড়তে পড়তে তার অপেক্ষায় সেই উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯১৬ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৩৭)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) যোহ্র ও আসরের নামাযে কুরআন পড়তেন তা সাহাবাগণ তাঁর দাড়ি হিলার ফলে বুঝতে পারতেন। (বুখারী ৭৪৬, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) অনুরুপ তাঁরা তাঁকে সিজদায় মাথা রাখতে না দেখার পূর্বে কেউ কওমা থেকে সিজদায় যেতেন না। (বুখারী ৭৪৭ নং)
অতএব শিশুর মা নামায পড়তে পড়তে যদি তার শিশুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে আড় নয়নে তাকায়, তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১২)
৩। আকাশের (বা উপর) দিকে তাকানো:-
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যেন অবশ্য অবশ্যই নামাযের মধ্যে আকাশের দিকে তাকানো হতে বিরত হয়, নচেৎ তাদের চক্ষু ছিনিয়ে নেওয়া হবে!” (বুখারী ৭৫০, মুসলিম, মিশকাত ৯৮৩ নং) অতএব নামায পড়তে পড়তে উপর বা আকাশ দিকে দৃষ্টিপাত করা হারাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১৫)
৪। চোখ বুজা-
মহানবী (সাঃ) যখন নামায পড়তেন, তখন তিনি তাঁর চোখ দু’টিকে খুলে রাখতেন। তাঁর দৃষ্টি থাকত সিজদার জায়গায়। তাশাহ্হুদে বসার সময় তিনি তাঁর তর্জনী আঙ্গুলের উপর নজর রাখতেন। এ ছাড়া তিনি চোখ খুলে রাখতেন বলেই মা আয়েশা رضي الله عنها এর দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিযুক্ত পর্দা তাঁর সম্মুখ থেকে সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। সুতরাং সুন্নত হল, চোখ খোলা রেখে নামায পড়া।
তবে হ্যাঁ, যদি প্রয়োজন পড়ে; যেমন সামনে কারুকার্য, নক্সা, ফুল বা এমন কোন জিনিস থাকে, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অথবা মনোযোগ কেড়ে নেয় অথবা ক্বিরাআত ভুলিয়ে দেয় এবং তা দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে নামায পড়ায় কোন দোষ নেই। বরং এই ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করেই নামায পড়া উত্তম হওয়া শরীয়ত এবং তার উদ্দেশ্য ও নীতির অধিক নিকটবর্তী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/২৯৩-২৯৪, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৮, ৫২, ৩১৬, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯-২৯০, মুত্বাসা ১৩০-১৩১পৃ:)
৫। এমন জিনিস (যেমন নক্সাদার মুসাল্লা, সৌন্দর্য ও কারুকার্যময় দেওয়াল বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যপূর্ণ কাপড় ইত্যাদি) সামনে রেখে নামায পড়া, যাতে নামাযীর মনোযোগ ও একাগ্রতা নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে ‘যে সব স্থানে নামায পড়া মাকরুহ’ শিরোনাম দেখুন।
৬। কোন প্রাণীর বা মানুষের ছবি, মূর্তি বা আগুন সামনে করে নামায পড়া। কারণ, এতে থাকে শির্কের গন্ধ এবং অমুসলিমদের সদৃশতা। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫০-২৫১পৃ:)
৭। কোন প্রাণী বা মানুষের ছবি চিত্রিত কাপড় পরে নামায পড়া। (ঐ ২৫১পৃ:)
৮। নিজের বা আর কারো ছবি পকেটে রেখেও নামায মাকরুহ। অবশ্য কোথাও রেখে নামায পড়লে চুরি হয়ে বা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় অবস্থায় ছবিযুক্ত টাকা-পয়সা, পাশপোর্ট, পরিচয়-পত্র প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে নামায পড়ায় দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৯৮, ১৯/১৬১)
৯। দুই হাতের আঙ্গুলসমূহকে পরস্পর খাঁজাখাঁজি করা:-
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সুন্দরভাবে ওযু করে মসজিদের উদ্দেশে বের হয়, তখন সে যেন অবশ্যই তার (দুইহাতের) আঙ্গুলসমূহকে খাঁজাখাঁজি না করে। কারণ, সে নামায অবস্থায় থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২৪২, ২৪৩, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২, তিরমিযী, সুনান ৩৮৬, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৩৩৩৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৪১নং, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২৩০,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২০৬, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/১০২) অর্থাৎ নামায পড়া অবস্থায় ঐরুপ নিষিদ্ধ।
নামাযের জন্য ওযূ করার পর থেকে নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐরুপ করা নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে আরো হাদীস দেখুন। (সহিহ তারগিব ২৯২, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৯৪, জামে ৪৪৫, ৪৪৬ নং)
১০। আঙ্গুল ফুটানো:-
নামাযের মধ্যে আঙ্গুল ফুটানো মাকরুহ। কারণ, এটি একটি বাজে ও নিরর্থক কর্ম এবং অপর নামাযীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৪)
১১। কোমরে হাত রাখা:-
আল্লাহর নবী (সাঃ) নামায পড়ার সময় কোমরে হাত রাখতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ১২১৯, ১২২০, মুসলিম, সহীহ ৫৪৫, মিশকাত ৯৮১ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এমন কাজ ইয়াহুদীদের। (বুখারী ৩৪৫৮, ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯১, ৪৬০০ নং) অথবা জাহান্নামীরা জাহান্নামে এরুপ কোমরে হাত রেখে আরাম নেবে। (ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯২, ৪৫৯৫ নং) সুতরাং তাদের সদৃশতা অবলম্বন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। অনেকে বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ, এরুপ কাজ অহংকারী, বিপদগ্রস্ত অথবা ভাবনা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের। তাই নামাযে এরুপ প্রদর্শন অবৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৫৫পৃ:)
১২। কুকুরের মত বসা:-
দুই পায়ের রলা খাড়া রেখে,হাত দু’টিকে মাটিতে রেখে এবং দুই পাছার উপর ভর করে কুকুরের মত বৈঠক নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক শয়তানের। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩১৬নং) এ ব্যাপারে অধিক জানতে তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৩। বামহাত দ্বারা ভর করে বসা:-
নামাযের বৈঠকে বামহাতকে মাটি বা মুসাল্লার উপর রেখে ঠেস দিয়ে বসা নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক আল্লাহর ক্রোধভাজন ইয়াহুদীদের। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০ নং) অতিরিক্ত তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৪। কাপড় গাঁটের নিচে ঝুলানো:-
পুরুষদের জন্য তাদের কাপড়; লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট, চোগা প্রভৃতি গাঁটের নিচে ঝুলিয়ে পরা সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ। পরন্তু মহান বাদশার সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে অহংকারীদের মত এমনভাবে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা অধিকভাবে নিষিদ্ধ। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য)
১৫। কাপড় (শাল বা চাদর) না জড়িয়ে দুই কাঁধে দু’ দিকে ঝুলিয়ে রাখা অথবা চাদরে জড়িয়ে থাকা অবস্থায়হাত দু’টিকেও তার ভিতরে রেখেই রুকূ-সিজদা করা:-
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) নামাযে এইভাবে কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৭৬৪ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে, এরুপ অভ্যাস ইয়াহুদীদের।
১৬। চাদর, শাল, কম্ফর্টার প্রভৃতির মাধ্যমে মুখ ঢাকা:-
নামায পড়া অবস্থায় মুখ ঢাকতে মহানবী (সাঃ) নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ৭৬৪ নং)
মদ্বীনার ফকীহ্ সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার কাউকে নামাযে মুখ ঢেকে থাকতে দেখলে তার মুখ থেকে তার কাপড়কে সজোরে টেনে সরিয়ে দিতেন। (মালেক, মুঅত্তা ৩০নং)
১৭। পুরুষের লম্বা চুল পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়া:-
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি তার (লম্বা) চুলকে পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়ে, সে সেই ব্যক্তির মত যে তার দুইহাত বাঁধা অবস্থায় নামায পড়ে।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) তিনি আরো বলেন, “ঐ বাঁধা চুল হল শয়তান বসার জায়গা!” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সিজদার বিবরণ দ্রষ্টব্য)
ইবনুল আষীর বলেন, লম্বা চুল খোলা অবস্থায় থাকলে সিজদাহ অবস্থায় সেগুলিও মাটিতে পড়ে যাবে। ফলে সিজদাহকারীকে ঐ চুলের সিজদাহ করার সওয়াব দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে বাঁধা বা গাঁথা থাকলে সেগুলো সিজদায় পড়তে পারবে না। তাই বাঁধতে নিষেধ করা হয়েছে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, মনে হয় এ বিধান কেবল পুরুষদের জন্যই, মহিলাদের জন্য নয়। ইবনুল আরাবী থেকে এ কথা উদ্ধৃত করে শওকানী তাই বলেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪৩পৃ:) কারণ, মেয়েদের চুল থাকবে বাঁধা ও কাপড়ের পর্দার ভিতরে। যা বের হলে মহিলার নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
১৮। কাপড় গুটানো:-
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি ৭ অঙ্গ দ্বারা সিজদাহ করি --- এবং কাপড় ও চুল না গুটাই।” (বুখারী, মুসলিম, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৮২, জামে ১৩৬৯ নং)
মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘এই নিষেধ কেবল নামায অবস্থাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং নামাযের পূর্বেও যদি কেউ তার চুল বা কাপড় গুটায় অতঃপর নামাযে প্রবেশ করে, তাহলে অধিকাংশ উলামাগণের মতে সে ঐ নিষেধে শামিল হবে। আর চুল বেঁধে নামায পড়া নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীস উক্ত মতকে সমর্থন করে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪৩পৃ:)
এখান থেকেই বহু উলামা বলেছেন যে, জামার আস্তীন বা হাতা গুটিয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ মহানবী (সাঃ) ও তাঁর উম্মত নামাযে কাপড় না গুটাতে আদিষ্ট হয়েছেন। আর জামারহাতা গুটানো কাপড় গুটানোরই শামিল।
ইমাম নওবী বলেন, উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, কাপড় বা জামার আস্তীন গুটিয়ে, চুল বেঁধে বা পাগড়ীর নিচে গুটিয়ে রেখে নামায পড়া নিষিদ্ধ। অবশ্য এই নিষেধের মান হল মাকরুহ। অর্থাৎ, এতে নামায নষ্ট হয় না। (শারহু মুসলিম ৪/২০৯, আউনুল মা’বূদ ২/২৪৭)
উক্ত নিষেধের কারণ বর্ণনায় অনেকে বলেন যে, কাপড় গুটানো বা তোলা অহংকারীদের লক্ষণ। তাই তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন নিষিদ্ধ। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৪৬)
অবশ্য কাপড় খুলে গেলে তা পরা উক্ত নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। বরং লজ্জাস্থান খুলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তো নামায অবস্থাতেও পরা ওয়াজেব। অনুরুপ উলঙ্গ নামাযী নামাযের মাঝে যদি কাপড় পায়, তাহলে সেই অবস্থাতেই তার জন্যও তা পরা ওয়াজেব। কারণ, কাপড় বর্তমান থাকতে লজ্জাস্থান বের করে নামায পড়লে নামায বাতিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৭-৩৪৮)
নামায পড়তে পড়তে খুব শীত লাগলে এবং পাশে কাপড় থাকলে নামাযী নামাযের মধ্যেই তা পরতে বা গায়ে নিতে পারে। কারণ না পরলে তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। (ঐ ৩/৩৪৮) অনুরুপ খুব গরম লাগলেও অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় কাপড় নামায অবস্থাতেই সরিয়ে ফেলতে পারে।
১৯। কাঁধ খোলা রেখে নামায-
কাঁধ খোলা রেখে নামায নিষিদ্ধ। (এ ব্যাপারে ‘নামাযীর লেবাস’ প্রসঙ্গে আলোচনা দেখুন।) সুতরাং বহু হাজীদের ইহ্রাম পরে এক কাঁধ খোলা অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫১পৃ:)
২০। সশব্দে কুরআন পাঠ:-
অনেকে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা ইত্যাদি পড়ার সময় মাঝে মাঝে গুন্গুন্ করে বা ফিসফিসিয়ে ওঠে। যাতে পাশের নামাযীর বড় ডিষ্টার্ব হয়। এমন করাও হাদীস থেকে নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। সুতরাং কি নিয়ে আলাপ করছে, তা যেন সে লক্ষ্য করে। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের পাশে কুরআন সশব্দে না পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মালেক, মুঅত্তা, প্রমুখ মিশকাত ৮৫৬ নং)
২১। খাবার সামনে রেখে নামায-
খাবার জিনিস সামনে হাজির থাকলে এবং খাওয়ার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা থাকলে তা না খেয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ, সে সময় খাবারের দিকে মন পড়ে থাকে এবং নামাযে যথার্থ মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের রাতের খাবার প্রস্তুত থাকে এবং সেই সময়ে নামাযের ইকামতও হয়, তখন তোমরা প্রথমে খাবার খাও। আর খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত কেউ যেন তাড়াহুড়ো না করে।” ইবনে উমার (রাঃ) এর জন্য খাবার বাড়া হলে সেই সময় যদি নামাযের ইকামত হত, তাহলে তা খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত নামাযে আসতেন না। সেই সময় তিনি ইমামের ক্বিরাআতও শুনতে পেতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১০৫৬ নং)
২২। প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রেখে নামায পড়া:-
প্রস্রাব-পায়খানার চাপ থাকলে সেই অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। সময় বা জামাআত ছুঠে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও প্রস্রাব-পায়খানার কাজ না সেরে নামাযে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “খাবার সামনে রেখে নামায নেই। আর তারও নামায নেই, যাকে প্রস্রাব-পায়খানার বেগ পেয়েছে।” (মুসলিম, সহীহ ৫৬০, মিশকাত ১০৫৭ নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৫-৩২৮)
তিনি আরো বলেন, “তোমাদের কারো পায়খানার তলব হলে এবং অন্য দিকে নামাযের ইকামত হলে প্রথমে সে যেন পায়খানাই করে।” (তিরমিযী, সুনান, আবূদাঊদ, সুনান ৮৮, নাসাঈ, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০৬৯ নং)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে তার জন্য প্রস্রাব-পায়খানার বেগ চেপে রেখে এবং (প্রয়োজন সেরে) হাল্কা হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নামায পড়া বৈধ নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৯১নং, প্রমুখ)
২৩। ঢুল বা তন্দ্রা অবস্থায় নামায-
ঘুমের ঘোর থাকলে বা ঢুল এলে (নফল) নামায পড়া উচিৎ নয়। বরং একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পড়া উচিৎ। অবশ্য ফরয নামাযের ক্ষেত্রে জামাআত ও নির্দিষ্ট সময় খেয়াল রাখা একান্ত জরুরী। (এ ব্যাপারে ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামের আলোচনা দ্রষ্টব্য)
২৪। মাদকদ্রব্য বা কোন হারাম বস্তু বহন করা:-
হ্কপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের নিকট কুরআন, সুন্নাহ্, বিবেক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিত্তিক বহু দলীল বর্তমান থাকার কারণে বিড়ি, সিগারেট, গালি, তামাক, গুল-জর্দা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য মাকরুহে তাহ্রীমী অর্থাৎ হারাম। তাই এ সব জিনিস পকেটে রেখে মসজিদে যাওয়া ও নামায পড়া মাকরুহ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৯-২০০)
২৫। হেলা-দোলা:-
নামায পড়তে পড়তে আগে-পিছে বা ডানে-বামে হেলা-দোলা বৈধ নয়। কেন না, এ কাজ নামাযে একাগ্রতা ও স্থিরতার প্রতিকূল। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২২০পৃ:)
অনেকে কেবল ডান অথবা বাম পায়ের উপর ভরনা দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়; যাতে কাতারের পাশের নামাযীরও ডিষ্টার্ব হয়। পক্ষান্তরে প্রিয় নবী (সাঃ) নামায শুরু করার পূর্বে সাহাবাগণের কাঁধ স্পর্শ করে বলতেন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও। বিভিন্নরুপে দাঁড়ায়ো না। নচেৎ তোমাদের হৃদয়ও বিভিন্ন হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮ নং)
অবশ্য নামায লম্বা হলে পা ধরার ফলে দু-একবার পা বদলে আরাম নেওয়া দূষণীয় নয়। তবে শর্ত হল, যেন এক পা অপর পায়ের চেয়ে বেশী আগা-পিছা না হয়ে যায়। বরং উভয় পা যেন বরাবর থাকে এবং এ কাজ বারবারও না হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩-৩২৪) তাছাড়া যেন পাশের মুসল্লীর ডিষ্টার্ব না হয়।
২৬। নামাযের প্রতিকূল কিছু আচরণ:-
নামায পড়তে পড়তে মাথা বা দাড়ি চুলকানো, বারবার মাথার টুপী, পাগড়ী বা রুমাল সোজা করা, ঘড়ি হিলানো ও দেখা, নখ, দাঁত, নাক ও ব্রণ খোঁটা প্রভৃতি অপ্রয়োজনীয় কর্ম বৈধ নয়। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৭২-১৭৫পৃ:) একটি কথা খুবই সত্য যে, হৃদয় চাঞ্চল্যময় থাকলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চঞ্চল থাকে। আর হৃদয়কে যদি শান্ত ও স্থির রাখা যায়, তাহলে বাহিরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সেই মহান বাদশার জন্য শান্ত ও স্থির থাকবে।
২৭। সালাম ফেরার সময়হাতের ইশারা মাকরুহ। (সালামের বিবরণ দ্রষ্টব্য)
নামায যাতে বাতিল হয়
এমন বহু কর্ম আছে, যা নামাযের ভিতরে করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। সে সব কর্মের কিছু নিম্নরুপ:-
১। অপ্রয়োজনে নামাযের ভিতর এত বেশী নড়া-সরা বা চলা-ফেরা করা যাতে অন্য কেউ দেখলে এই মনে করে যে, সে নামায পড়ে নি। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫২-৩৫৩) কারণ, কথা বলার মত নামাযের বহির্ভূত অন্যান্য কর্ম করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, “--- আর তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়াও।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮)
২। নামাযের কোন রুক্ন বা শর্ত ত্যাগ করা:-
ধীর-স্থিরভাবে নামায না পড়ার কারণে মহানবী (সাঃ) নামায ভুলকারী সাহাবাকে তিন-তিনবার ফিরিয়ে নামায পড়তে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ, মিশকাত ৭৯০ নং) কারণ, ধীর-স্থির ও শান্তভাবে নামায পড়া নামাযের এক রুক্ন ও ফরয। যা ত্যাগ করার পর সহু সিজদাহ করলেও সংশোধন হয় না।
অনুরুপ সূরা ফাতিহা, রুকূ, কোন সিজদাহ, সালাম বা অন্য কোন রুক্ন ত্যাগ করলে নামাযই হয় না। অবশ্য প্রয়োজনের চাপে কিছু অবস্থা ব্যতিক্রমও আছে, যাতে দু-একটি রুক্ন (যেমন কিয়াম, সূরা ফাতিহা) বাদ গেলেও নামায হয়ে যায়। সে কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি নাপাক হয়ে যায়, সে ব্যক্তি পুনরায় ওযূ না করা পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০০নং) “পবিত্রতা বিনা নামাযই কবুল হয় না।” (মুসলিম, মিশকাত ৩০১নং)
সুতরাং নামায পড়তে পড়তে কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে তার নামায বাতিল। নামায ত্যাগ করে পুনরায় ওযূ করে এসে নতুনভাবে নামায পড়তে হবে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১০০৭ নং)
অবশ্য ওযূ ভাঙ্গার নিছক সন্দেহের কারণে নামায বাতিল হয় না। নিশ্চিতরুপে ওযূ নষ্ট হওয়ার কথা না জানা গেলে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেন, “ (নামাযে হাওয়া বের হওয়ার সন্দেহ্ হলে) শব্দ না শোনা অথবা দুর্গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন নামায ত্যাগ না করে।” (বুখারী ১৩৭নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
নামায পড়তে পড়তে শরমগাহ্ বের হয়ে পড়লে, মহিলাদের পেট, পিঠ, হাতের বাজু, চুল ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়লে (তা কোন বেগানা পুরুষ দেখতে পাক অথবা না পাক) নামায বাতিল হয়ে যায়।
নামায পড়তে থাকা কালে কাপড়ে বীর্য (স্বপ্নদোষের) চিহ্ন অথবা (মহিলা) মাসিকের দাগ দেখলে নামায ত্যাগ করা জরুরী।
নামায অবস্থায় দেহ্ বা লেবাসের কোন স্থানে নাপাকী লেগে থাকতে নজর পড়লে যদি তা সত্বর দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে তা দূর করে নামায হয়ে যাবে। যেমন অতিরিক্ত লেবাসে; অর্থাৎ টুপী, রুমাল, গামছা বা পাগড়ী অথবা জুতায় নাপাকী দেখলে এবং সত্বর তা খুলে ফেলে দিলে নামায শুদ্ধ।
একদা নামায পড়তে পড়তে জিবরীল (আঃ) মারফৎ মহানবী (সাঃ) তাঁর জুতায় নাপাকী লেগে থাকার সংবাদ পেলে তিনি তা খুলে ফেলে নামায সম্পন্ন করেছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৬৬ নং)
সত্বর খোলা সম্ভব না হলে অথবা পূর্ণ লেবাস পরিবর্তন করা দরকার হলে নামায ত্যাগ করে পবিত্র লেবাস পরে পুনরায় নামায পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯)
কারো নামায পড়ার পর যদি মনে পড়ে যে সে বিনা ওযূতে নামায পড়েছে, অথবা কাপড়ে (নিজের) বীর্য (স্বপ্নদোষ) বা (মহিলা) মাসিকের চিহ্ন দেখে, তাহলে নামায শুদ্ধ হয় নি। যথা নিয়মে পবিত্র হওয়ার পর সে নামায পুনরায় পড়তে হবে। কারণ, দেহ্ নাপাক রেখে নামাযই হয় না।
পক্ষান্তরে নামায পড়ার পর যদি দেখে, কাপড়ে প্রস্রাব, পায়খানা বা অন্য কোন নাপাকী লেগে আছে; অর্থাৎ সে তা নিয়েই নামায পড়েছে, তাহলে না জানার কারণে তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। কারণ, বাইরের কাপড়ে (অনুরুপ কোন অঙ্গে) নাপাকী লেগে থাকলেও তার দেহ্ আসলে পাক ছিল। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৮, ২৯৮)
৩। জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত কথা বলা:-
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর নামায পড়া অবস্থায় আমরা তাঁকে সালাম দিতাম এবং তিনি সালামের উত্তরও দিতেন। অতঃপর যখন নাজাশীর নিকট থেকে ফিরে এলাম, তখন সালাম দিলে তিনি উত্তর দিলেন না। পরে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “নামাযে মগ্নতা আছে।” (বুখারী ১১৯৯ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর যুগে আমরা নামাযে কথা বলতাম; আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গীকে নিজের প্রয়োজনের কথা বলত। অতঃপর যখন আল্লাহর এই নির্দেশ অবতীর্ণ হল, “তোমরা নামাযসমূহ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” তখন আমরা চুপ থাকতে (নামাযের সূরা, দুআ, দরুদ ছাড়া অন্য কথা না বলতে) আদিষ্ট হ্লাম। (বুখারী ১২০০ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
অবশ্য নামাযে কথা বলা হারাম তা না জেনে যদি কেউ কথা বলেই ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল নয়। এক ব্যক্তি নামাযে হাঁচলে (ছিকি মারলে) মুআবিয়া বিনহাকাম নামাযের অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির জন্য ‘য়্যারহামুকাল্লাহ্’ বলে দুআ করলে সাহাবাগণ নিজেদের জানুতে আঘাত করে তাঁকে চুপ করাতে চাইলেন। নামায শেষ হলে আদর্শ শিক্ষক প্রিয় রসূল (সাঃ) তাঁকে নরমভাবে বুঝিয়ে বললেন, “এই নামাযে লোক-সমাজের কোন কথা বলা বৈধ (সঙ্গত) নয়। এতে যা বলতে হয় তা হল; তাসবীহ, তকবীর ও কুরআন পাঠ।” (মুসলিম, মিশকাত ৯৭৮ নং)
উক্ত হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, তিনি তাঁকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বলেছিলেন। সুতরাং বুঝা গেল, অজান্তে কেউ কথা বলে ফেললে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৯)
উল্লেখ্য যে, নামাযের সূরা, দুআ-দরুদ ইত্যাদির অনুবাদও যদি নামাযে বলা হয়, তাহলেও নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, অনুবাদও মানুষের সাধারণ কথার শামিল।
প্রকাশ থাকে যে, কথা যদি নামায সংশোধন করার মানসেও বলা প্রয়োজন হয়, তবুও বলা বৈধ নয়। যেমন যদি ইমাম আসরের সময় জোরে ক্বিরাআত পড়তে শুরু করে এবং কোন মুক্তাদী তা সংশোধনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এটা আসরের নামায’ অথবা যদি ইমাম এক সিজদার পর বসে যায় এবং কোন মুক্তাদী ‘তাসবীহ’ বলার পরও বুঝতে না পারে যে, দ্বিতীয় সিজদাহ করতে হবে; ফলে সে উঠতে যায়। এ ক্ষেত্রে কোন মুক্তাদীর ‘সিজদাহ’ বা ‘সিজদাহ করুন’ বলাও বৈধ নয়। এরুপ বললে নামায বাতিল। কারণ, পূর্বেই আমরা জেনেছি যে, নামাযে কিছু ঘটলে মহানবী (সাঃ) আমাদেরকে (পুরুষের জন্য) তাসবীহ এবং (মহিলার জন্য) হাততালি বিধেয় করেছেন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬৪-৩৬৫)
এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম ব্যাপার এই যে, কোন জামাআতের লোক ভুল করে চার রাকআতের জায়গায় তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের কেউ এই ভুল সম্বন্ধে স্মরণ দিলে এবং ইমামও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরো এক রাকআত নামায অবশ্যই পড়বে এবং সহু সিজদাহ করবে। আর এর মাঝে ইমাম-মুক্তাদীর ঐ কথোপকথন নামাযের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যেহেতু এ কথা তখনই বলা হয়, যখন সালাম ফিরে দেওয়া হয়। আর তখন কথা বলা বৈধ। পক্ষান্তরে নিশ্চিত জানা যায় না যে, সত্যই নামায কম পড়া হয়েছে কি না। এ রকমই হয়েছিল মহানবী (সাঃ) ও সাহাবাগণের। (দেখুন, বুখারী ৭১৪, মুসলিম, সহীহ ৫৭৩ নং)
৪। পানাহার করা:-
নামায পড়তে পড়তে খেলে অথবা পান করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মুখের ভিতর পান, গালি (?), চুইংগাম প্রভৃতি রেখে নামায হয় না। কারণ এ কাজ নামাযের পরিপন্থী। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০ পৃ:)
৫। হাসা:-
হাসলেও অনুরুপ কারণে নামায বাতিল পরিগণিত হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০পৃ:) অবশ্য কোন হাস্যকর জিনিস দেখে অথবা হাস্যকর কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে না পেরে যদি কেউ মুচকি হাসি (শব্দ না করে) হেসে ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল হবে না।
প্রকাশ থাকে যে, নামাযী কে হাসাবার চেষ্টা করা তথা তার নামায নষ্ট করার কাজ শয়তানের। কোন মুসলিম মানুষের এ কাজ হওয়া উচিৎ নয়।
৬। পিতার হারাম উপায়ে উপর্জিত অর্থ খেলে ও ব্যয় করলে পুত্রের নামায বাতিল নয়। তবে সেই অর্থ ব্যবহার না করতে যথাসাধ্য প্রয়াস থাকতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে পরহেযগারী অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য চলার পথ সহ্জ করে দেন। আর তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রুযী দান করে থাকেন, যা সে বুঝতে ও কল্পনাই করতে পারে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)
৭। ‘যাতে ওযূ নষ্ট হয় না’ শিরোনামে আলোচিত হয়েছে যে, গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে ওযূ ও নামায কিছুই বাতিল হয় না। অবশ্য এমন কাজ করলে তার উপর থেকে মহান আল্লাহর সুনজর ও দায়িত্ব উঠে যায়। আর ওযূ ও নামায বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীলের হাদীস সহীহ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০১)
৮। কোন কারণে ইমামের নামায বাতিল হলে পশ্চাতে মুক্তাদীদের নামায বাতিল নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৫-৩১৭) এ বিষয়ে ইমামতির বিবরণ দ্রষ্টব্য।
১০। নামাযী যদি জানে যে তার সামনে দিয়ে কোন মহিলা, গাধা বা কালো কুকুর অতিক্রম করবে এবং এ জানা সত্ত্বেও বিনা সুতরায় নামায পড়ে, তাহলে ঐ তিনটের একটাও তার সামনে বেয়ে পার হয়ে গেলে তার নামায বাতিল। কারণ, সুতরার বিবরণে আমরা জেনেছি যে, ঐ তিনটি জিনিস নামায নষ্ট করে দেয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৩, ৩৯২)
অনুরুপ মুক্তাদীর সুতরাহ্ ইমামের সুতরাই। অতএব ইমাম সুতরাহ্ রেখে নামায না পড়লে এবং ঐ তিনটের একটা সামনে বেয়ে অতিক্রম করলে ইমাম-মুক্তাদী সকলের নামায বাতিল।
প্রকাশ যে, নামায পড়তে পড়তে নামায বাতিল হওয়া জানা গেলে অথবা ওযূ নষ্ট হওয়া বুঝতে পারলে সাথে সাথে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসা ওয়াজেব। লজ্জায় বা অন্য কারণে নামায শেষ করা হারাম এবং তা এক প্রকার আল্লাহর সাথে ব্যঙ্গ করা! কারণ, যা তিনি গ্রহণ করবেন না, তা জেনেশুনেও নিবেদন করতে থাকা উপহাস বৈকি? (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯২-৩৯৩)
অবশ্য জামাআতে থাকলে লজ্জা হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে হাওয়া বের হওয়ার ফলে ওযূ নষ্ট হলে অনেকে নামায বা জামাআত ত্যাগ করে কাতার ভেঙ্গে আসতে লজ্জা ও সংকোচবোধ করে। কিন্তু মহানবী (সাঃ) এই লজ্জা ঢাকার জন্য এক কৃত্রিম উপায়ের কথা বলে দিয়েছেন; তিনি বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ তার নামাযে নাপাক হয়ে যাবে তখন সে যেন তার নাক ধরে নেয়। অতঃপর বের হয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/১৮৪, মিশকাত ১০০৭ নং)
ত্বীবী বলেন, এই নির্দেশ এই জন্য যে, যাতে লোকেরা মনে করে তার নাকে রক্ত আসছে (তাই বের হয়ে যাচ্ছে)। আর এরুপ করা মিথ্যা নয়, বরং তা ‘তাওরিয়াহ্’ বা বৈধ অভিনয়। শয়তান যাতে তার মনে লোকদেরকে শরম করার কথা সুশোভিত না করে ফেলে (এবং নামায পড়তেই থেকে যায়)। তাই তার জন্য এ কাজের অনুমতি ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (আউনুল মা’বূদ, মিরকাত, মিশকাতের টীকা ১নং, ১/৩১৮)
কার নামায কবুল নয়?
কিছু নামাযী আছে, যারা নামায তো পড়ে; কিন্তু তাদের নামায আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল ও গৃহীত হয় না। নামাযী অথবা নামাযের অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন না। এমন কতকগুলি নামাযী নিম্নরুপ:-
১। পলাতক ক্রীতদাস-
২। এমন স্ত্রী, যার স্বামী তার উপর রাগ করে আছে। স্ত্রী স্বামীকে সর্বদা খোশ রাখবে, তার (ভালো কথা ও কাজে) আনুগত্য করবে, তার সব কথা মেনে চলবে, যৌনসুখ দিয়ে তাকে সর্বদা তৃপ্ত রাখবে, কোন বিষয়ে রাগ হলে তা সত্বর মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সব কিছুতে তাকে সন্তুষ্ট রাখবে -এটাই হল স্ত্রীর ধর্ম। মহানবী (সাঃ) বলেন, তোমাদের (সেই) স্ত্রীরাও জান্নাতী হবে, যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, বারবার ভুল করে বারবার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী, যার স্বামী রাগ করলে সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি রাজী (ঠান্ডা) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৭ নং)
কিন্তু এমন বহু মহিলা আছে, যারা তাদের স্বামীর খেয়ে-পরেও এমন রাগ-রোষকে পরোয়া করে না। নারী-স্বাধীনতার পক্ষপাতিনী স্বামীর সংসারেও পরম স্বাধীনতা-সুখ ভোগ করতে গিয়ে স্বামীকে নারাজ রাখে। ফলে বিশ্বস্বামীও নারাজ হন এবং সেই স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী স্বামীকে খোশ করার আগে নামায পড়লেও সে নামাযে তিনি খোশ হন না। কারণ, ‘হুকূকুল ইবাদ’ আদায় না করা পর্যন্ত মহান আল্লাহ বান্দার তাওবাতে সন্তুষ্ট হন না। যার প্রতি অন্যায় করা হয়, তার নিকট আগে ক্ষমা পেলে তবেই মহান আল্লাহ ক্ষমা করেন। নচেৎ না।
৩। এমন লোক যে কারো বিনা অনুমতি ও আদেশেই কারো জানাযা পড়ায় (ইমামতি করে)। এমন ইমাম, যার ইমামতি অধিকাংশ মুক্তাদীরা পছন্দ করে না। তার পিছনে নামায পড়তে তাদের রুচি হয় না। ইমামতিতে ভুল আচরণ অথবা চরিত্রগত কোন কারণে অধিকাংশ লোকে তাকে ইমামতি করতে দিতে চায় না। এমন ইমামের নামায তার কান অতিক্রম করে না, মাথার উপরে যায় না, আকাশের দিকে ওঠে না, সাত আসমান পার হয়ে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া তো বহু দূরের কথা।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)
৪।এমন লোক, যে কোন গণকের কাছে ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জানার আশায় গণককে ‘ইলমে গায়বের মালিক’ মনে করে হাত দেখায়। এমন ব্যক্তির -কেবল গণকের কাছে যাওয়ার কারণেই- তার ৪০ দিনের (২০০ ওয়াক্তের) নামায কবুল হয় না! তার উপর গণক যা বলে তা বিশ্বাস করলে তো অন্য কথা। বিশ্বাস করলে তো সে মূলেই ‘কাফের’-এ পরিণত হয়ে যায়। আর কাফেরের নামায-রোযা অবশ্যই মকবূল নয়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট উপস্থিত হয়ে কোন (ভূত-ভবিষ্যৎ বা গায়বী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, সে ব্যক্তির ৪০ দিনের নামায কবুল হয় না।” (মুসলিম, সহীহ ২২৩০নং)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর নিকট উপস্থিত হয়ে সে যা বলে তা সত্য মনে (বিশ্বাস) করল, সে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ (কুরআনের) প্রতি কুফরী করল।” (আহ্মদ,হাকেম, সহীহুল জামে’ ৫৯৩৯নং)
৫। শারাবী, মদ্যপায়ী:-
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমার উম্মতের যে ব্যক্তি মদ পান করবে, আল্লাহ তার ৪০ দিন নামায কবুল করবেন না।” (নাসাঈ, সুনান, জামে ৭৭১৭ নং)
৬। এমন নামাযী, যে নামায পড়ে কিন্তু নামায চুরি করে। দায় সারা করে পড়ে। ঠিকমত রুকূ-সিজদাহ করে না। রুকূতে স্থির হয় না, সিজদায় স্থির থাকে না। কোমর বাঁকানো মাত্র তুলে নেয়। ‘সু-সু-সু’ করে দুআ পড়ে চটপট উঠে যায়! কারো কোমর ঠিকমত বাঁকে না। মাথা উঁচু করেই রুকূ করে। কারো সিজদার সময় নাক মুসাল্লায় স্পর্শ করে না। কারো পা দু’টি উপর দিকে পাল্লায়হাল্কা হওয়ার মত উঠে যায়। কেউ রুকূ ও সিজদার মাঝে স্থির হয়ে দাঁড়ায় না।হাফ দাঁড়িয়ে সিজদায় যায়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে মুসলিম দল! সে ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি রুকূ ও সিজদাতে নিজ পিঠ সোজা করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫২৪ নং)
“আল্লাহ সেই বান্দার নামাযের দিকে তাকিয়েও দেখেন না, যে রুকূ ও সিজদার মাঝে নিজ পিঠকে সোজা করে (দাঁড়ায়) না।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২২, ত্বাবারানী, সহিহ তারগিব ৫২৫, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৬ নং)
“মানুষ ৬০ বছর ধরে নামায পড়ে, অথচ তার একটি নামাযও কবুল হয় না! কারণ, হয়তো বা সে রুকূ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু সিজদাহ পূর্ণরুপে করে না। অথবা সিজদাহ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু রুকূ ঠিকমত করে না।” (আসবাহানী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৫ নং)
“নামায ৩ ভাগে বিভক্ত; এক তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক তৃতীয়াংশ রুকূ এবং আর এক তৃতীয়াংশ হল সিজদাহ। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে, তার নিকট থেকে তা কবুল করা হবে এবং তার অন্যান্য সমস্ত আমলও কবুল করা হবে। আর যার নামায রদ করা হবে, তার অন্য সকল আমলকে রদ্দ্ করে দেওয়া হবে।” (বাযযার, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৭ নং)
৭। আযান শুনেও যে নামাযী বিনা ওজরে মসজিদের জামাআতে নামায পড়ে না-
জামাআতে নামায পড়া ওয়াজেব। এই ওয়াজেব ত্যাগ করলে তার নামায কবুল নাও হতে পারে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনা সত্ত্বেও মসজিদে জামাআতে এসে নামায আদায় করে না, কোন ওজর না থাকলে সে ব্যক্তির নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৩০০ নং)
৮। এমন মহিলা, যে আতর বা সেন্ট মেখে মসজিদের জন্য বের হয়:-
এমন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত না নাপাকীর গোসল করার মত গোসল করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামায কবুল হবে না। (ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ২৭০৩ নং)
৯। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান।
১০। দান করে যে দানের কথায় গর্ব ভরে প্রচার করে বেড়ায়।
১১। তকদীর অস্বীকারকারী ব্যক্তি। (ত্বাবারানী, জামে ৩০৬৫ নং)
১২। পরের বাপকে যে নিজের বাপ বলে দাবী করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
১৩। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে হ্ত্যা করে এবং তাতে সে গর্ববোধ করে ও খুশী হয়। (বায়হাকী ৮/২১, জামে ৬৪৫৪ নং)
১৪। খুনের বদলে খুনের বদলা নিতে যে ব্যক্তি (শাসন কর্তৃপক্ষকে) বাধা দেয়। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ৬৪৫১ নং)
১৫। যে ব্যক্তি মদ্বীনায় কোন বিদআত কাজ করে অথবা কোন বিদআতীকে আশ্রয় দেয়। অথবা কোন দুষ্কর্ম করে বা দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেয়।
১৬। যে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ১৩৭০ নং)
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের কোন ফরয-নফল নামায ও ইবাদতই (অথবা তওবা ও মুক্তিপণ কিয়ামতে) কবুল করা হবে না।
কাযা নামাযের বিধিবিধান
কেউ যথাসময়ে নামায পড়তে ঘুমিয়ে অথবা ভুলে গেলে এবং তার নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে, পরে যখনই তার চেতন হবে অথবা মনে পড়বে তখনই ঐ (ফরয) নামায কাযা পড়া জরুরী।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তার কাফফারা হল স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া।” অন্য এক বর্ণনায় বলেন, “এ ছাড়া তার আর কোন কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) নেই।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩ নং)
তিন আরো বলেন, “নিদ্রা অবস্থায় কোন শৈথিল্য নেই। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থায় হয়। সুতরাং যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার উচিৎ, স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া। কেন না, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।” (কুরআন মাজীদ ২০/১৪, মুসলিম, মিশকাত ৬০৪নং)
অতএব কাযা নামায পড়ার জন্য কোন সময়-অসময় নেই। দিবা-রাত্রের যে কোন সময়ে চেতন হলে বা মনে পড়লেই উঠে সর্বাগ্রে নামায পড়ে নেওয়া জরুরী। অন্যথা পরবর্তী সময়ের অপেক্ষা বৈধ নয়।
বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে বা সুযোগ ও সময় থাকা সত্ত্বেও না পড়ে অন্য ওয়াক্ত এসে গেলে পাপ তো হবেই; পরন্তু সে নামাযের আর কাযা নেই। পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিনা ওজরে যথাসময়ে নামায না পড়ে অন্য সময়ে কাযা পড়ায় কোন লাভ নেই। বরং যে ব্যক্তি এমন করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামায পড়ায় যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে নফল নামায বেশী বেশী করে পড়া। (মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ৭৮পৃ:, ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩নংহাদীসের আলবানীর টীকা দ্র:)
কেউ অজ্ঞান থাকলে জ্ঞান ফিরার পূর্বের নামায কাযা পড়তে হবে না। কারণ, সে জ্ঞানহীন পাগলের পর্যায়ভুক্ত। আর পাগলের পাপ-পুণ্য কিছু নেই। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৩২৮৭ নং, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৬/১২৮, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১২৬) ইবনে উমার (রাঃ) অজ্ঞান অবস্থায় কোন নামায ত্যাগ করলে তা আর কাযা পড়তেন না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১)
অবশ্য নামায পড়তে পারত এমন সময়ের পর অজ্ঞান হলে জ্ঞান ফিরার পর সেই সময়ের নামায কাযা পড়া জরুরী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১২৬-১২৭)
পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি কোন কারণে কোন বস্তু ব্যবহার করে স্বেচ্ছায় বেহুশ হয়, তাহলে তার জন্য কাযা পড়া জরুরী। (ঐ ২/১৮)
কাযা নামায পড়ার জন্য আযান ও ইকামত বিধেয়। কয়েক ওয়াক্তের নামায কাযা পড়তে হলে, প্রথমবার আযান ও তারপর প্রত্যেক নামাযের জন্য পূর্বে ইকামত বলা কর্তব্য।
এক সফরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) সহ্ সাহাবাগণ ঘুমিয়ে পড়লে ফজরের নামায ছুটে যায়। তাঁদের চেতন হয় সূর্য ওঠার পর। অতঃপর একটু সরে গিয়ে তাঁরা ওযূ করেন। বিলাল (রাঃ) আযান দেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান) অতঃপর সুন্নত কাযা পড়ে ইকামত দিয়ে ফজরের ফরয কাযা পড়েন। (বুখারী ৩৪৪, মুসলিম, সহীহ ৬৮০ নং, নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৭)
খন্দকের যুদ্ধের সময় মহানবী (সাঃ) ও সাহাবাগণের চার ওয়াক্তের নামায ছুটে গেলে গভীর রাত্রিতে তিনি বিলাল (রাঃ) কে আযান দিতে আদেশ করেন। (শাফেয়ী, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) অতঃপর প্রত্যেক নামাযের পূর্বে ইকামত দিতে বলেন। এইভাবে প্রথমে যোহ্র, অতঃপর আসর, মাগরেব ও এশার নামায পরপর কাযা পড়েন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী প্রমুখ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৫৭)
উল্লেখ্য যে, ফজরের আযান দিনে দিতে হলেও ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম” বলতে হবে। কারণ ফজরের ঐ কাযা নামাযে মহানবী (সাঃ) ফজরের সময় যা করেন, দিনেও তাই করে নামায আদায় করেছেন বলে প্রমাণ আছে। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ১/২০৪)
যে নামায যে অবস্থায় কাযা হয়, সেই নামাযকে সেই অবস্থা ও আকারে পড়া জরুরী। সুতরাং রাতের নামায দিনে কাযা পড়ার সুযোগ হলে রাতের মতই করে জোরে ক্বিরাআত করতে হবে। কারণ, মহানবী (সাঃ) যখন ফজরের নামায দিনে কাযা পড়েছিলেন, তখন ঠিক সেই রুপই পড়েছিলেন, যেরুপ প্রত্যেক দিন ফজরের সময় পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং) তদনুরুপ ছুটে যাওয়া নামায রাতে কাযা পড়ার সুযোগ হলে দিনের মতই চুপে চুপে ক্বিরাআত পড়তে হবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৭, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২০৪, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১০)
তদনুরুপ কেউ মুসাফির অবস্থায় নামায কাযা করে বাড়ি ফিরলে, বাড়ি ফিরার পর নামায কসর করে না পড়ে পুরোপুরি পড়বে; কিন্তু ঐ কাযা নামায কসর করেই আদায় করবে। কারণ, সফর অবস্থায় তার কসর নামাযই কাযা হয়েছে। আর বাড়িতে থাকা অবস্থায় কোন ছুটে যাওয়া নামায সফরে মনে পড়লে বা কাযা পড়ার সুযোগ হলে তা পুরোপুরিই আদায় করতে হবে। মোট কথা যেমন নামায কাযা হবে, ঠিক তেমনিভাবে তা আদায় করতে হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫১৮)
কোন নামায ছুটে গেলে সে নামায কাযা পড়ার পরই বর্তমান নামায পড়া যাবে। অনুরুপ কয়েক ওয়াক্তের নামায এক সঙ্গে কাযা পড়তে হলে অনুক্রম ও তরতীব অনুযায়ী প্রথমে ফজর, অতঃপর যোহ্র, অতঃপর আসর, মাগরেব, এশা -এই নিয়মে আদায় করতে হবে। আগা-পিছু করে পড়া বৈধ নয়। খন্দকের যুদ্ধে মহানবী (সাঃ) ও সাহাবাগণের কয়েক ওয়াক্তের নামায ছুটলে ঐ তরতীব খেয়াল রেখেই পরপর আদায় করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ, নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৯)
এখন যদি কেউ যোহরের নামায কাযা রেখে আসরের অক্তে মসজিদে আসে, তাহলে সে প্রথমে যোহরের নামায পড়ে নেবে। তারপর পড়বে আসরের নামায। কিন্তু কেউ যদি এমন সময় মসজিদে আসে, যে সময় আসরের জামাআত চলছে, তাহলে সে একাকী কাযা পড়তে পারে না। কারণ, জামাআত চলাকালে একই স্থানে দ্বিতীয় জামাআত বা পৃথক একাকী (জামাআতী) নামায হয় না। (মুসলিম, মিশকাত ১০৫৮ নং) আবার কাযা রেখে আসরের নামায জামাআতে পড়লে যোহরের পূর্বে আসর পড়া হয়। আর তা হল তরতীব ও অনুক্রমের পরিপন্থী। সুতরাং সে ব্যক্তি তরতীব বজায় রেখে যোহরের কাযা আদায়ের নিয়তে জামাআতে শামিল হবে এবং তারপর একাকী আসর পড়ে নেবে। (তুহ্ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৬৬পৃ:)
এ ক্ষেত্রে ইমামের নিয়ত ভিন্ন হলেও উক্ত মুক্তাদীর নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। কারণ, ইমাম-মুক্তাদীর নিয়ত পৃথক পৃথক হলেও উভয়ের নামায যে শুদ্ধ, তার প্রমাণ সুন্নাহতে মজুদ।
মহানবী (সাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়তে দেখলে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এমন কেউ কি নেই, যে এর সাথে নামায পড়ে একে (জামাআতের সওয়াব) দান করবে?” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৪, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬ নং) অথচ সে মহানবী (সাঃ) এর সাথে ঐ নামায পূর্বে পড়েছিল। সুতরাং ইমামের ছিল ফরয এবং মুক্তাদীর নফল।
একদা তিনি সালাম ফিরে দেখলেন, মসজিদের এক প্রান্তে দুই ব্যক্তি জামাআতে নামায পড়ে নি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমরা আমাদের বাসায় নামায পড়ে নিয়েছি।’ তিনি বললেন, “এমনটি আর করো না। বরং যখন তোমাদের কেউ নিজ বাসায় নামায পড়ে নেয়, অতঃপর (মসজিদে এসে) দেখে যে, ইমাম নামায পড়ে নি, তখন সে যেন (দ্বিতীয়বার) তাঁর সাথে নামায পড়ে। আর এ নামায তার জন্য নফল হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৫, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১১৫২ নং)
অনুরুপ মুআয বিন জাবাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর সাথে তাঁর মসজিদে (নববীতে) নামায পড়তেন। অতঃপর নিজ গোত্রে ফিরে এসে ঐ নামাযেরই ইমামতি করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৫০ নং) অতএব বুঝা গেল যে, এক নামাযের পশ্চাতে অন্য নামায পড়া দোষাবহ্ ও অশুদ্ধ নয়। সুতরাং উক্ত ক্ষেত্রে তরতীবের ওয়াজেব উলঙ্ঘন না করে যোহরের কাযা নামায আসরের জামাআতে পড়ে নেওয়াই উত্তম।
পক্ষান্তরে মহানবী (সাঃ) এর এই হাদীস “যখন নামায খাড়া হয়, তখন ফরয (বা সেই) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।” (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৪, মুসলিম, সহীহ ৭১০ নং, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫২, প্রমুখ) এর অর্থ হল জামাআত খাড়া হলে ফরয বা (ঐ নামায তাকে পড়তে হলে) ঐ নামাযে শামিল হওয়া ছাড়া পৃথক করে কোন নফল বা সুন্নত নামায পড়া বৈধ নয়। অর্থাৎ ইকামতের পর আর কোন সুন্নত বা নফল নামায শুদ্ধ হবে না। হাদীসের ব্যাখ্যা দাতাগণ এরুপই ব্যাখ্যা করেছেন। (দেখুন, শরহুন নওবী ৫/২২১, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১) এখানে এক নামাযের জামাআতে অন্য নামাযের নিয়ত করে নামায হবে না -সে উদ্দেশ্য নয়। (এ ব্যাপারে ইমামতির বিবরণও দ্রষ্টব্য।) তাছাড়া ইমাম-মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও যে উভয়ের নামায শুদ্ধ, তা পূর্বেই প্রতিপাদিত হয়েছে।
মাগরেব কাযা রেখে কেউ মসজিদে এলে এবং এশার জামাআত শুরু দেখলে সে মাগরেবের কাযা আদায় করার নিয়তে শামিল হবে। অতঃপর তার তিন রাকআত পড়া হলে বসে যাবে। ইমাম তাশাহ্হুদে বসলে তার সঙ্গে তাশাহহুদ আদি পড়ে ইমামের সাথে সালাম ফিরবে। (ইবনে বায, কিদারেমী, সুনান ৯৬পৃ:)
পক্ষান্তরে ইমামের এক রাকআত হয়ে যাওয়ার পর জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথেই সালাম ফিরলে ৩ রাকআত মাগরেবের কাযা আদায় হয়ে যাবে। অতঃপর উঠে একাকী এশার নামায পড়বে। অথবা অন্য লোক থাকলে দ্বিতীয় জামাআতে পড়ে নেবে।
অনুরুপভাবে কেউ আসরের নামায কাযা রেখে মসজিদে এসে মাগরেবের জামাআত খাড়া দেখলে আসর কাযা পড়ার নিয়তে শামিল হবে। অতঃপর ইমাম সালাম ফিরলে সে আর এক রাকআত উঠে পূর্ণ ৪ রাকআত আসরের নামায আদায় করে নেবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১০) পরে একাকী অথবা দ্বিতীয় জামাআতে মাগরেব পড়বে।
জামাআতে শামিল হয়ে কাযা নামায পড়ার পর সময় অভাবে যে নামায একাকী বা দ্বিতীয় জামাআতে আদায় করা সম্ভব নয়, সে নামায জামাআতেই আদায় করা জরুরী। আর এ ক্ষেত্রে তরতীব বিবেচ্য নয়। যেমন, কেউ জুমআর নামায পড়তে এসে জামাআত খাড়া দেখে তার ফজরের নামায কাযা আছে তা মনে পড়ল। এখন তরতীব বজায় রেখে জামাআতে ফজরের কাযা আদায় করার নিয়তে শামিল হলে পরে একাকী বা দ্বিতীয় জামাআতে জুমআর নামায পড়া সম্ভব নয়। অতএব তখন সে জুমুআহ পড়ার নিয়তেই জামাআতে শামিল হবে এবং তার পরই ফজরের নামায কাযা পড়তে পারবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৪১)
তদনুরুপ বর্তমান নামাযের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলেও তরতীব বিবেচ্য নয়। যেমন, এক ব্যক্তি ফজরের নামায পড়তে এমন সময় উঠল যখন সূর্য উঠতে চলেছে। এই সময় তার মনে পড়ল যে, তার এশার নামায কাযা আছে। তখন কাযা পড়তে গেলে সূর্য উঠে যাবে এবং ফজরের নামাযও কাযা হয়ে যাবে। সুতরাং দু’টো নামাযকে কাযা না করে ফজরের নামায তার যথা (শেষ) সময়ে আদায় করে তারপর এশার নামায কাযা পড়বে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৪০-১৪১, তুহ্ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৬৬পৃ:, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯৭)
একইভাবে আসরের নামাযের শেষ সময়ে যোহ্র কাযা আছে মনে পড়লে, আসর আগে পড়ে তারপর যোহ্র পড়তে হবে। যাতে আসরও কাযা না হয়ে যায়।
বর্তমান নামায পড়তে শুরু করার পর অথবা পড়ে নেওয়ার পর পূর্বের নামায কাযা আছে মনে পড়লে আর তরতীব বিবেচ্য নয়। ভুলের জন্য তা ক্ষমার্হ হবে; ধর্তব্য হবে না। অতএব বর্তমান নামায শেষ করে কাযা নামায পড়ে নিতে হবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯৭)
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করলে সে নামাযের কাযা নেই। অতএব তওবার পর কাযা উমরী বলে শরীয়তে কোন নামায নেই। বিধায় তা বিদআত।
অবশ্য এই তওবাকারী ব্যক্তির উচিৎ, বেশী বেশী করে নফল নামায পড়া এবং অন্যান্য নফল ইবাদতও বেশী বেশী করে করা। (দারেমী, সুনান ২/৪২) তার জন্য ওয়াজেব এই যে, সে সর্বদা নামায ত্যাগ করার ঐ অবহেলাপূর্ণ পাপ ও ক্ষতির কথা মনে রেখে তার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) সদা সচেতন থাকবে। সম্ভবত: তার ঐ হারিয়ে দেওয়া দিনের কিছু ক্ষতিপূরণ অর্জন হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৩৫)
রসূল (সাঃ) বলেন, “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে তার আমল সমূহের মধ্যে যে আমলের হিসাব সর্বাগ্রে নেওয়া হবে, তা হল নামায। নামায ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামায ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং (হিসাবের সময়) ফরয নামাযে কোন কমতি দেখা গেলে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা ফিরিশ্তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘দেখ, আমার বান্দার কোন নফল (নামায) আছে কি না।’ অতএব তার নফল নামায দ্বারা ফরয নামাযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরো সকল আমলের হিসাব অনুরুপ গ্রহণ করা হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০, তিরমিযী, সুনান ৩৩৭, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১৭নং, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নামায অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যায়, তার জন্য কাযা আছে। আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন। তার মনে অবহেলা ও শৈথিল্য না থাকলে তিনি তার কাযা গ্রহণ করবেন। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “(এই কাযা আদায় করা ছাড়া) এর জন্য আর অন্য কোন কাফফারা নেই।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩নং)
পক্ষান্তরে কাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হয় না। সুতরাং এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরুপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত। (ইসলাহুল মাসাজিদ, আল্লামা আলবানীর টীকা সহ্ উর্দু তর্জমা মালেক, মুঅত্তা ২৯৬পৃ:, আহ্কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১৬৪পৃ:) বলা বাহুল্য এমন পাপস্খলনের রীতি তো অমুসলিমদের; যারা ইয়া বড় বড় পাপ করে কোন পানিতে ডুব দিলে অথবা কিছু অর্থ ব্যয় করলে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে!
জামাআত সম্পর্কীয় মাসায়েল
ইসলাম জামাআতবদ্ধ জীবন পছন্দ করে; অপছন্দ করে বিচ্ছিন্নতাকে। কারণ, শান্তি ও শ£খলা রয়েছে জামাআতে। আর নামায একটি বিশাল ইবাদত। (শিশু, ঋতুমতী মহিলা ও পাগল ছাড়া) নামায পড়তেও হয় সমাজের সকল শ্রেণীর সভ্যকে। তাই সমষ্টিগতভাবে এই ইবাদতের জন্যও একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতির প্রয়োজন ছিল। বিধিবদ্ধ হল জামাআত।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয় ইসরা’ ও মি’রাজের রাত্রে। ঠিক তার পরের দিন যোহরের সময় জিবরীল (আঃ) প্রিয় নবী (সাঃ)-কে নিয়ে জামাআত সহকারে প্রথম নামায পড়েন। অনুরুপভাবে মুসলিমরাও মহানবী (সাঃ)-এর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আর জিবরীলের ইমামতির পর মহানবী (সাঃ) মক্কা মুকার্রামায় কোন কোন সাহাবীকে নিয়ে কখনো কখনো জামাআত সহকারে নামায আদায় করেছেন। কিন্তু মদ্বীনায় হিজরত করার পর জামাআত একটি বাঞ্জিত নিয়ম ও ইসলামী প্রতীকরুপে গুরুত্ব পেল। আর সকল নামাযীকে জামাআতবদ্ধ ও জমায়েত করার জন্য বিধিবদ্ধ হল আযান।
ইসলামী শরীয়তের একটি মাহাত্ম এই যে, তার বিভিন্ন ইবাদতে জামাআত ও ইজতিমা বিধিবদ্ধ রয়েছে। যা আসলে এক একটি সম্মেলন। যে সম্মেলনে মুসলিম নিয়মিতভাবে জমায়েত হয়। তাতে তারা এক অপরের অবস্থা জানতে পারে। একে অন্যকে উপদেশ দিতে পারে। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সলা-পরামর্শ করতে পারে। উপস্থিত সমস্যfর সঠিক সমাধান অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরস্পর সহ্যোগিতা করতে পারে। এক সাথে বসে পরস্পর মত-বিনিময় করতে পারে।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে অজ্ঞ ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান লাভ করতে পারে। দরিদ্র সাহায্য পেতে পারে। ঐক্যের মহামিলন দেখে মুসলিমের হৃদয় নরম হয়ে থাকে। প্রকাশ পায় ইসলামী শান-শওকত, সমতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা।
জামাআতে ভেঙ্গে চুরমার হয় বর্ণ-বৈষম্যের সকল প্রাচীর। একাকার হয় সকল জাত-পাত। আমীর-গরীব, আতরাফ-আশরাফ, বাদশা-ফকীরের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের মহান আদর্শর অভিব্যক্তি ঘটে এই জামাআতে।
সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খলতা এই জামাআতের মহান বৈশিষ্ট্য । সভ্য জাতির আদর্শ শিক্ষা লাভ হয় এই পুন: পুন: ইজতিমায়।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে একে অপরের দেখাদেখি আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রতিযোগিতামূলক মন-মানসিকতা সৃষ্টি হয় মুসলিমের।
জামাআতের এই মহা মিলনক্ষেত্রে ইসলামী সম্প্রীতির যে সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়, তাতে সামাজিক জীবনের চলার পথে নিজেকে একাকী ও অসহায় বোধ হয় না। মনে জাগে খুশী, প্রাণে জাগে উৎফুল্লুতা, ইবাদতে আসে মনোযোগ, উৎসাহ্, উদ্দীপনা ও স্ফূর্তি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি মুসলিমের কাম্য। অপর ভায়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে উভয় মুসলিম এক অপরের জন্য শান্তি কামনা করে দুআ দিয়ে থাকে। ‘আস-সালামু আলাইকুম, অআলাইকুমুস সালাম’ বলার মাধ্যমে আল্লাহর তরফ থেকে এবং উভয়ের হৃদয়-মনেও শান্তি লাভ হয় এই জামাআতে হাজির হলে।
নামাজ জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। বিধায় বিনা ওজরে জামাআত ত্যাগ করা কাবীরাহ্ গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেন,
বরং জামাআতে নামায না পড়লে নামায কবুল নাও হতে পারে। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
“যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)
“যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫১১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
যারা নামাযের জামাআতে মসজিদে হাজির হয় না, মহানবী (সাঃ) তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামায হল এশা ও ফজরের নামায। ঐ দুই নামাযের কি মাহাত্ম আছে, তা যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে উপস্থিত হত। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কাউকে নামাযের ইকামত দিতে আদেশ দিই, অতঃপর একজনকে নামায পড়তেও হুকুম করি, অতঃপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাদের সাথে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের নিকট যাই, যারা নামাযে হাজির হয় না। অতঃপর তাদেরকে ঘরে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।” (বুখারী ৬৫৭, মুসলিম, সহীহ ৬৫১নং)
হযরত উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা জামাআত ত্যাগ করা হতে অবশ্য অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ আমি অবশ্যই তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৩০নং)
কোন অন্ধ মানুষকেও মহানবী (সাঃ) জামাআতে অনুপস্থিত থেকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেননি। অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-এর দরবারে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মসজিদে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার মত আমার উপযুক্ত মানুষ নেই। তাছাড়া মদ্বীনায় প্রচুর হিংস্র প্রাণী (সাপ-বিছা-নেকড়ে প্রভৃতি) রয়েছে। (মসজিদের পথে অন্ধ মানুষের ভয় হয়)। সুতরাং আমার জন্য ঘরে নামায পড়ার অনুমতি হবে কি?’ আল্লাহর নবী (সাঃ) তাঁর ওজর শুনে তাঁকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দিলেন। তিনি চলে যেতে লাগলে মহানবী (সাঃ) তাঁকে ডেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কি আযান ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্,হাইয়্যা আলাল ফালাহ্’ শুনতে পাও।” তিনি উত্তরে বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ মহানবী (সাঃ) বললেন, “তাহলে তুমি (মসজিদে) উপস্থিত হও, তোমার জন্য কোন অনুমতি পাচ্ছি না।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৫২, ৫৫৩নং)
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদলের সম্মুখেও জামাআত মাফ নয়। মহান আল্লাহ বিধিবদ্ধ করলেন স্বালাতে খওফ। (কুরআন মাজীদ ৪/১০২) জামাআত সহকারে নামায একান্ত বাঞ্জিত ও জরুরী কর্তব্য না হলে ঐ ভীষণ সময়ে মরণের মুখে তিনি তা মাফ করতেন।
তদনুরুপ জামাআত বাঞ্জিত বলেই প্রয়োজনে নামায জমা করে পড়া বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। মসজিদের পথে শত্রুর ভয় হলে, প্রচুর ঠান্ডা বা বৃষ্টি হলে অথবা সফরে থাকলে যোহ্র-আসর এবং মাগরেব-এশাকে জমা করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে জামাআতের ফযীলত লাভ করার জন্যই।
জামাআত ত্যাগ করা মুমিনের গুণ নয়; বরং তা মুনাফিকের গুণ। মহান আল্লাহ এদের গুণ বর্ণনা করে বলেন,
অর্থাৎ, ---ওরা (মুনাফেকরা) নামাযে শৈথিল্যর সাথে হাজির হয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দান করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামায মুনাফেকের জন্য অধিক ভারী। আর একথা পূর্বে এক হাদীসে আলোচিত হয়েছে।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন কোন লোককে ফজরের নামাযে অনুপস্থিত দেখতাম, তখন তার প্রতি কু ধারণা করতাম।’ (ত্বাবরানি, ইবনে আবী শাইবা, বাযয়ীফ, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/৪০)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাল আল্লাহর সাথে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করতে আনন্দবোধ করে তার উচিৎ, যেখানে আহবান করা হয় সেখানে (অর্থাৎ মসজিদে) ঐ নামাযগুলির হিফাযত করা। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাদের নবীর জন্য বহু হেদায়াতের পথ ও আদর্শ বিধিবদ্ধ করেছেন এবং ঐ (নামায)গুলি হেদায়াতের পথ ও আদর্শর অন্তর্ভুক্ত। যদি তোমরা তোমাদের স্বগৃহে নামায পড়ে নাও; যেমন এই পশ্চাদগামী তার স্বগৃহে নামায পড়ে থাকে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেলবে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেল, তাহলে তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে পবিত্রতা অর্জন (ওযু) করে এই মসজিদসমূহের কোন মসজিদের প্রতি (যেতে) প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ তার প্রত্যেক পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি করে নেকী লিপিবদ্ধ করেন, এর দ্বারায় তাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করেন ও এর দ্বারায় তার একটি পাপ হরাস করেন। আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না। আর মানুষকে দুটি লোকের কাঁধে ভর করে হাঁটিয়ে এনে কাতারে খাড়া করা হত।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৪নং)
হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তির মসজিদে থাকা অবস্থায় আযান হয়, অতঃপর বিনা কোন প্রয়োজনে বের হয়ে যায় এবং ফিরে আসার ইচ্ছা না রাখে, সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ১৫৭নং)
যারা আহবানকারী মুআযযেনের আযানে সাড়া দিয়ে জামাআতে উপস্থিত হয় না, কিয়ামতে তাদের বিশেষ অবস্থা ও শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
এমন কি মসজিদে জামাআতে উপস্থিত থেকে মুআযযিনের আযান শুনেও যে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, সে আল্লাহর নবীর অবাধ্য ও নাফরমান রুপে পরিগণিত হয়। একদা মসজিদে আযান হলে এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আবূ হুরাইরা (রাঃ) তার দিকে নিনিGমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ‘আসলে এ ব্যক্তি তো আবূল কাসেম (সাঃ)-এর নাফরমানী করল।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৫নং) আর এ কথা বিদিত যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে, সে আসলে স্পষ্টরুপে ভ্রষ্ট হয়ে যায়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৩৬)
অবশ্য যদি কেউতার জরুরী কাজে; যেমন, প্রস্রাব-পায়খানা বা ওযূ করতে মসজিদের বাইরে যায়, তাহলে তা নাফরমানীর আওতাভুক্ত নয়। (মাজমূউফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১২/২০০)
আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর সাহাবাগণও ফরয নামাযের জন্য জামাআতে উপস্থিত হওয়াকে ওয়াজেব মনে করতেন।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া (জামাআতে) নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না।’ (মুসলিম ৬৫৪নং)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আবূ মূসা আশআরী, আলী বিন আবী তালেব, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।’ (তিরমিযী, সুনান ২১৭নং, যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম )
ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি রোযা রাখে, তাহাজ্জুদ পড়ে; কিন্তু জামাআত ও জুমআয় হাজির হয় না। উত্তরে তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে!’ (তিরমিযী, সুনান ২১৮নং, এটির সনদ দুর্বল)
আত্বা বিন আবী রাবাহ্ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি কোন শহর বা গ্রামবাসীর জন্য এ অনুমতি নেই যে, সে আযান শোনার পর জামাআতে নামায ত্যাগ করে।’
হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, ‘কারো আম্মা যদি তাকে মায়া করে এশার নামায জামাআতে পড়তে বারণ করে, তাহলে সে তার ঐ বারণ শুনবে না।’ (বুখারী)
আওযায়ী (রহঃ) বলেন, ‘জুমুআহ ও জামাআত ত্যাগ করার ব্যাপারে পিতার আনুগত্য নেই, চাহে সে আযান শুনতে পাক, আর না-ই পাক।’
অবশ্য জেনে রাখা ভাল যে, যে ব্যক্তি জামাআত ছাড়াই নামায পড়ে, তার নামায শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জামাআত ত্যাগ করার জন্য সে (কাবীরা) গুনাহগার হয়। তবে তার ঐ নামায কবুল হওয়া ও না হওয়ার ব্যাপার তো আল্লাহর কাছে। (মারা: ১৭২পৃ:)
জামাআতের আসল মর্যাদা ছিল সলফে সালেহীনের কাছে। তাঁরা জামাআতের এত গুরুত্ব দিতেন যে, তা ছুটে গেলে অথবা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। একে অপরকে দেখা করে সান্তনা দিতেন।
সাঈদ বিন আব্দুল আযীয জামাআত ছুটে গেলে কাঁদতেন।
হাতেম আল-আসাম্ম বলেন, ‘একদা আমার এক নামাযের জামাআত ছুটে গেল। এর জন্য আবূ ইসহাক বুখারী আমাকে দেখা করতে এলেন। অথচ আমার কোন ছেলে মারা গেলে দশহাজারেরও বেশী লোক আমাকে দেখা করতে আসত। কেন না, মানুষের নিকট দুনিয়ার মসীবতের তুলনায় দ্বীনের মসীবত নেহাতই হাল্কা।’
নামাযের জামাআত কোনক্রমেই তাঁদের নিকট কোন পার্থিব জিনিসের সমতুল্য ছিল না; যে তুচ্ছ জিনিসের পশ্চাতে আমরা অনেক ক্ষেত্রে লালসার নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকি। যার জন্য কখনো বা নামায যথা সময়ে পড়তে পারি না। কেউবা তারই জন্য মূলেই নামায ত্যাগ করে বসে। ব্যবসা-বানিজ্য, কাজ-কারবার, খেলাধূলা, সরগরম মজলিসে আজেবাজে গল্প, রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবাদ ও সমীক্ষা প্রভৃতি নামাযের জামাআত; কখনো বা নামায নষ্ট করে ফেলে বর্তমান যুগের বহু সংখ্যক মানুষের!
একদা মাইমূন বিন মিহ্রান মসজিদে এলেন। দেখলেন, নামায শেষ হয়ে গেলে নামাযীরা মসজিদ থেকে ফিরে গেছে। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন! অবশ্যই আমার নিকট এই জামাআতের মর্যাদা ইরাকের রাজত্ব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’
ইউনুস বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার কি হল যে, মুরগী নষ্ট হলে আমি তার জন্য দু:খিত হ্ব, অথচ নামায (জামাআত) নষ্ট হলে তার জন্য দু:খিত হ্ব না?’
সলফে সালেহীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পর আযান শুনলে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করতেন। যাতে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহ্রীমা ছুটে না যায়, তার বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
সাঈদ বিন মুসাইয়েব বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে আমার নামাযের প্রথম তাকবীর ছুটেনি! আর পঞ্চা শ বছর ধরে নামাযে কোন মানুষের পিঠ দেখিনি।’ অর্থাৎ, পঞ্চাশ বছর যাবৎ তিনি প্রথম কাতারেই নামায পড়েছেন!
অকী’ বিন জার্রাহ্ বলেন, ‘প্রায় সত্তর বছর ধরে আ’মাশের প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’
ইবনে সামাআহ্ বলেন, ‘যে দিন আমার আম্মা মারা যান, সে দিন ছাড়া চল্লিশ বছর ধরে আমার প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’ (ফাযায়িলু অষামারাতুস স্বা লাতি মাআল জামাআহ্ ৬পৃ:)
ইবরাহীম নাখয়ী বলেন, ‘যখন কোন মানুষকে দেখবে, সে প্রথম তাকবীরের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করছে, তখন তুমি তার ব্যাপারে হাত ধুয়ে নাও।’
আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান আদব শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ছেলে উমারকে মদ্বীনায় পাঠালেন। আর তার দেখাশোনা করার জন্য সালেহ্ বিন কায়সানকে চিঠি লিখলেন। তিনি তাকে নামায পড়তে বাধ্য করতেন। একদিন সে এক নামাযে পিছে থেকে গেলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তোমাকে আটকে রেখেছিল?’ উমার বলল, ‘আমার দাসী আমার চুল আঁচড়াচ্ছিল।’ তিনি বললেন, ‘ব্যাপার এত দূর গড়িয়ে গেল যে, তোমার চুল আঁচড়ানো তোমার নামাযকে প্রভাবান্বিত করে ফেলল?’ এরপর সে কথা জানিয়ে তিনি তার আব্বা (আব্দুল আযীয)কে চিঠি লিখলেন। তা জেনে আব্দুল আযীয একটি দূত পাঠালেন এবং কোন কথা বলার আগেই সে দূত উমারের মাথা নেড়া করে দিল! (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা’, ইমাম যাহাবী ৫/১১৬)
যে ব্যক্তি মসজিদে জামাআত সহকারে নামায পড়তে আসত না তাকে মক্কার আমীর আত্তাব বিন উসাইদ উমাবী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার ধমকি দিতেন। (গায়াতুল মারাম, ইযযুদ্দ্বীনহাশেমী ১/১৮-১৯)
হযরত আলী (রাঃ) প্রত্যহ্ রাস্তায় পার হওয়ার সময় ‘আস-স্বালাত, আস-স্বালাত’ বলে লোকেদেরকে ফজরের নামাযের জন্য জাগাতেন। (তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬৫০পৃ:) যেমন আজও সঊদী আরবে আযান হলেই নির্দিষ্ট অফিসের নিযুক্ত লোক ঐ একই কথা বলে নামাযের জন্য দোকান-পাট বন্ধ করতে তাকীদ করে থাকে। তাতে মুসলিমরা সাথে সাথে দোকান বন্ধ করে মসজিদে যায়। আর মুনাফিক ও কাফেররা যায় নিজ নিজ বাসায়। আর নামাযের সময়টুকু বন্ধ থাকে সমস্ত দোকান-পাট।
বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে বিরাট। তাঁদের নিকট নামাযের গুরুত্ব আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। তাঁদের ছিল আগ্রহ্, আশা ও অধিক সওয়াব লাভের বাসনা। পক্ষান্তরে আমাদের মাঝে আছে পার্থিব প্রেম ও দুনিয়া লাভের কামনা। তাই আমরা নামাযের উপর দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি, আমাদের নিকট গুরুত্ব পায় পার্থিব ভোগ-বিলাস ও তার জন্য কর্ম-ব্যস্ততা।
অবশ্য এ কথা বলা অত্যুক্তি নয় যে, আমাদের জামাআতে হাজির হয়ে নামায না পড়া আমাদের দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর সে তা’যীমনেই, আল্লাহর প্রতি সে প্রেম, ভক্তি ও ভয় নেই, তাঁর আদেশ ও অধিকার পালনে সে আগ্রহ্ ও উৎসাহ্ নেই, তাই আমরা এমন শৈথিল্য প্রদর্শন করতে লজ্জাও করি না।
ওয়াজেব হওয়ার সাথে সাথে জামাআতের বিভিন্নমুখী কল্যাণ ও মাহাত্ম রয়েছে; যা জেনে জ্ঞানী নামাযীকে জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হওয়া উচিৎ।
জামাআতে হাজির হয়ে যারা আল্লাহর ঘর মসজিদ আবাদ রাখে, তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত; মহান আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে বলেন,
অর্থাৎ, আসলে তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। আর আশা করা যায়, তারাই হল হেদায়াত-প্রাপ্ত। (কুরআন মাজীদ ৯/১৮)
জামাআতে উপস্থিতি দোযখ ও মুনাফেকী থেকে মুক্তি দেয়; মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্রীমার তকবীরও পাবে, (সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হবে; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)
জামাআতে উপস্থিত নামাযীদেরকে নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর ফিরিশ্তাসভায় গর্ব করেন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। এই যে তোমাদের পালনকর্তা আসমানের দরজাসমূহের একটি দরজা খুলে তাঁর ফিরিশ্তামন্ডলীর কাছে তোমাদেরকে নিয়ে গর্ব করছেন; বলছেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা এক ফরয (নামায) আদায় করেছে এবং অন্য এক ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮০১নং)
মহান আল্লাহ জামাআতের নামায দেখে মুগ্ধ হন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “জামাআতের নামাযে আল্লাহ মুগ্ধ হন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৬৫২নং)
জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করলে একাকীর তুলনায় ২৫ থেকে ২৭ গুণ সওয়াব বেশী পাওয়া যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষের জামাআত সহকারে নামাযের মান একাকী নামাযের মান অপেক্ষা ২৭ গুণ অধিক।” (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ জামে ৩৮২০নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “একাকীর নামায অপেক্ষা জামাআতের নামায সাতাশ গুণ উত্তম।” (বুখারী ৬৪৫নং, মুসলিম ৬৫০নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “পুরুষের স্বগৃহে বা তার ব্যবসাক্ষেত্রে নামায পড়ার চেয়ে (মসজিদে) জামাআতে শামিল হয়ে নামায পড়ার সওয়াব পঁচিশ গুণ বেশি। কেননা, যে যখন সুন্দরভাবে ওযু করে কেবল মাত্র নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই মসজিদের পথে বের হয় তখন চলামাত্র প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে তাকে এক-একটি মর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং তার এক-একটি গুনাহ মোচন করা হয়। অতঃপর নামায আদায় সম্পন্ন করে যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে বসে থাকে ততক্ষণ ফিরিশ্তাবর্গ তার জন্য দুআ করতে থাকে; ‘হে আল্লাহ ওর প্রতি করুণা বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা কর। আর সে ব্যক্তি যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষা করে, ততক্ষণ যেন নামাযের অবস্থাতেই থাকে।” (বুখারী ৬৪৭নং, মুসলিম ৬৪৯নং, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নামাযের জন্য পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায পড়ার উদ্দেশ্যে যায় এবং তা লোকেদের সাথে অর্থাৎ জামাআত সহকারে অথবা মসজিদে পড়ে, আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।” (মুসলিম, সহীহ ২৩২নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে (মসজিদে) যায়, অতঃপর তা ইমামের সাথে আদায় করে সে ব্যক্তির পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৪০১নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি স্বগৃহ্ থেকে ওযূ করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার সওয়াব হল ইহ্রাম বাঁধা হাজীর মত।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৮নং)
“যে ব্যক্তি জামাআতে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, সে ব্যক্তির সওয়াব হয় একটি হজ্জ করার মত এবং যে ব্যক্তি কোন নফল (চাশতের) নামায পড়ার জন্য পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, তার সওয়াব হয় নফল উমরাহ্ করার মত।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ত্বাব, জামে ৬৫৫৬নং)
বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি স্বগৃহে ওযূ করে ফরয নামায আদায় করার জন্য প্রত্যহ্ ৫ বার মসজিদে যায় এবং সে তাতে ঐ বিশাল সওয়াবের আশা রাখে, সে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন ৫টি করে; অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৮০০টি হজ্জ করার সওয়াব লাভ করে! আর ৬০ বছরের জীবনে প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার বার হজ্জ করা হয় একজন মসজিদ-ভক্ত নামাযীর! অতএব অনায়াসে সে ৬০ বছরেই যেন ১০৮০০০ বছরের জীবন লাভ করে থাকে। বরং এত বছর বাঁচলেও সে হয়তো প্রত্যেক বছর হজ্জ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু জামাআতের ঐ নামায তাকে এত দীর্ঘ জীবন দান করে থাকে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “এই নামাযের জামাআতে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি জানত যে, তাতে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য কত সওয়াব নিহিত রয়েছে তাহলে অবশ্যই সে হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়েও হাজির হত। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম,সহিহ তারগিব ৪০৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমি তোমাদেরকে কি সেই কথা বলে দেব না; যার দরুন আল্লাহ গুনাহসমূহকে মোচন করে দেন এবং মর্যাদা আরো উন্নত করেন?” সকলে বলল, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “কষ্টের সময় পরিপূর্ণ ওযু করা, মসজিদের দিকে অধিকাধিক পদক্ষেপ করা (চলা), আর এক নামাযের পর আগামী নামাযের অপেক্ষা করা। উপরন্তু এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ২৫১নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, অনুরুপ অর্থে।)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আজ রাত্রে আমার কাছে আমার প্রতিপালকের এক দূত এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি জানেন কি, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশ্তামন্ডলী কি নিয়ে মতভেদ করছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, (তাঁরা মতভেদ করছেন) পাপ মোচন, মর্যাদা বর্ধন, জামাআতে শামিল হওয়ার জন্য পদক্ষেপ, প্রচন্ড ঠান্ডার সময় পরিপূর্ণরুপে ওযূ এবং নামাযের অপেক্ষা নিয়ে। যে ব্যক্তি উক্ত কর্মসমূহ সম্পাদন করতে যত্নবানহবে, সে ব্যক্তির জীবন হবে কল্যাণময় এবং মরণ হবে কল্যাণময়। আর সে তার পাপ থেকে পবিত্র হয়ে সেই দিনকার মত নিষ্পাপ হবে, যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩২৩৩নং)
এ ব্যাপারে আরো মাহাত্ম ‘মসজিদে যাওয়ার মাহাত্ম’ শিরোনামে দ্রষ্টব্য।
জামাআতে লোক যত বেশী হবে তত বেশী সওয়াব লাভ হবে নামাযীদের। মহানবী (সাঃ) বলেন, “---এক ব্যক্তির কোন অন্য ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায একাকী পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। অনুরুপ অন্য দুই ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায এক ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। এইভাবে জামাআতের লোক সংখ্যা যত অধিক হবে ততই আল্লাহ আয্যা অজাল্লার নিকট অধিক প্রিয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৪০৬নং)
তিনি বলেন, “১ জনের ইমামতিতে ২ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৪ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, ১ জনের ইমামতিতে ৪ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৮ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর এবং ১ জনের ইমামতিতে ৮ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ১০০ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।” (বায়হাকী, বাযয়ীফ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৮৩৬নং)
বিশেষ করে ফজর ও এশার নামায জামাআতে পড়ার পৃথক মাহাত্ম রয়েছে।
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া কোন অন্য উপায় না পেত তাহলে লটারিই করত। আর তারা যদি (নামাযের জন্য মসজিদের প্রতি) সকাল-সকাল আসার মাহাত্ম জানত, তাহলে অবশ্যই তার জন্য প্রতিযোগিতা করত। আর যদি এশা ও ফজরের নামাযের মাহাত্ম তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে চলেও তারা উভয় নামাযে উপস্থিত হত।” (বুখারী ৬১৫নং,মুসলিম, সহীহ ৪৩৭নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এশার নামায জামাআতের সঙ্গে পড়ল, সে যেন অর্ধরাত্রি (নফল) নামায পড়ল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়ল, সে যেন পুরো রাত্রিই নামায পড়ল।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ৬৫৬নং, আবূদাঊদ, সুনান)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের জামাআতের নামায একাকী নামাযের তুলনায় ২৫ গুণ অধিক মর্যাদা রাখে। আর রাত্রি ও দিনের ফিরিশ্তা ফজরের নামাযে একত্রিত হন।”
উক্ত হাদীস বর্ণনার পর আবূ হুরাইরা বলেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে তোমরা পড়ে নাও :
অর্থাৎ, নিশ্চয় ফজরের নামাযে ফিরিশ্তা হাযির হয়। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮) (বুখারী ৬৪৮, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৯৭৪নং)
নবী (সাঃ) বলেন, “(ফজরের সময়) যে ব্যক্তি (স্বগৃহে) ওযু করে। অতঃপর মসজিদে এসে ফজরের (ফরয) নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়ে। অতঃপর বসে (অপেক্ষা ক’রে) ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সেই ব্যক্তির সেদিনকার নামায নেক লোকদের নামায রুপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তার নাম পরম করুণাময় (আল্লাহর) প্রতিনিধিদলের তালিকাভুক্ত হয়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৪১৩নং)
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সে ব্যক্তি (সন্ধ্যা পর্যন্ত) আল্লাহর দায়িত্বে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৬৫৭, তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৬৩৪৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে পড়ে, অতঃপর সূর্যোদয় অবধি বসে আল্লাহর যিক্র করে তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে, সেই ব্যক্তির একটি হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হয়।” বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ।” অর্থাৎ কোন অসম্পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব নয় বরং পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব। (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬১নং)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “ইসমাঈলের বংশধরের চারটি মানুষকে দাসত্বমুক্ত করা অপেক্ষা ফজরের নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যিক্রকারী দলের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক প্রিয়। অনুরুপ চারটি জীবন দাসমুক্ত করার চেয়ে আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যিক্রকারী সম্প্রদায়ের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬২নং)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ফজরের নামায জামাআতে পড়ার জন্য কয়েকটি জিনিস জরুরী:
আল্লাহর আযাবের ভয় এবং তার সওয়াবের লোভ মনের মাঝে স্থান দিতে হবে।
অবৈধ কাজে তো নয়ই; বরং বৈধ কাজেও বেশী রাত না জেগে আগে আগে ঘুমাতে হবে।
জামাআত ধরার পাক্কা এরাদা হতে হবে।
ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় এমন অসীলা ব্যবহার করতে হবে; যেমন এলার্ম ঘড়ি, কোন সুহৃদ সাথী ইত্যাদি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, দুনিয়ার কাজের জন্য ফজরের আগেও উঠতে মানুষ অসুবিধা বোধ করে না, অথচ যত অসুবিধা বোধ করে আল্লাহর কাজে যথা সময়ে জাগতে। সুতরাং এমন মানুষের এমন অবহেলা তার ঈমানী দুর্বলতার পরিচয় নয় কি?
এখানে প্রসঙ্গত: ফজরের নামায যথা সময়ে না পড়ার যে বিধান, সে সম্পর্কিত একটি ফতোয়া উল্লেখ করা সমীচীন বলে মনে করি।
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য প্রত্যেক নামায তার যথাসময়ে মসজিদে জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। আর প্রত্যেক সেই বিষয় থেকে দূরে থাকা জরুরী, যে বিষয় তাকে কোন নামায তার নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা থেকে বাধা দিতে পারে। বিশেষ করে ফজরের নামাযের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিৎ, যাতে ঘুমিয়ে থেকে জামাআত ছুটে না যায় বা তার সময় পার না হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ফজরের নামাযকে কোন মুসলিমের জন্য ভারী মনে করা উচিৎ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “মুনাফিকের জন্য সবচেয়ে বেশী ভারী নামায হল, এশা ও ফজরের নামায। ঐ উভয় নামাযে কি রাখা আছে তা যদি ওরা জানতো তাহলে হাঁটু গেড়ে হলেও তার জামাআতে এসে উপস্থিত হত।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
সুতরাং এমন সব উপায় ও অসীলা অবলম্বন করা উচিৎ, যাতে যথা সময়ে উঠে ফজরের নামায জামাআত সহকারে পড়া সহ্জ হয়। যেমন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়া, বেশী রাত না জাগা, কাউকে জাগিয়ে দিতে অনুরোধ করা, এলার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা, ইত্যাদি।
এত বেশী রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত বা কোন ইলমী আলোচনা করাও বৈধ নয়, যার ফলে ফজরের নামায ছুটে যাওয়ার ভয় থাকে। সুতরাং টিভি-ভিসিআর দেখে, তাস খেলে অথবা অন্য কোন অবৈধ কারণে রাত জেগে ফজরের নামায নষ্ট করা যে কত বড় পাপের কাজ -তা অনুমেয়। পক্ষান্তরে যদি ইচ্ছা করে কেউফজরের আযান শুনেও না ওঠে, অথবা তাকে জাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও না ওঠে, পরন্তু যে জাগিয়ে দেয় তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়, অথবা ইচ্ছা করেই ঘড়িতে এলার্ম ফজরের সময় না দিয়ে সূর্য উদয় হওয়ার পর ঠিক তার ডিউটির সময়ে দেয়, তাহলে এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট থেকে শাস্তির উপযুক্ত এবং শাসন কর্তৃপক্ষের নিকটেও শাস্তিযোগ্য।
আর ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওযরে ফজরের নামায সূর্য ওঠার পর আদায় করলেও যথাসময়ে নামায ত্যাগ করার জন্য (বহু উলামার ফতোয়া মতে) সে কাফের হয়ে যাবে। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তি হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করবে সে কাফের হয়ে যাবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) আর মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নামাযীদের জন্য রয়েছে ‘ওয়াইল’ দোযখ; যে নামাযীরা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন।” (সূরা মাঊন) অর্থাৎ, যারা নামায যথাসময়ে আদায় করে না। (দ্র: ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২, ৩৬৫)
অতএব গাফলতি ছাড়cন এবং যে কোন প্রকারে ফজর ও অন্যান্য নামায যথাসময়ে আদায় করুন। আল্লাহ আমাদেরকে খাঁটি মুসলমান করুন এবং আমাদের নামায কবুল করে নিন। আমীন।
জায়গার গুরুত্ব হিসাবে জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে; যেমন মাসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী, বায়তুল মাকদেস, মসজিদে কুবা প্রভৃতি।
অমসজিদের তুলনায় মসজিদের জামাআতে সওয়াব বেশী। অবশ্য জনহীন মরুভূমীতে রুকূ-সিজদাহ ইত্যাদি পরিপূর্ণরুপে করলে তার সওয়াব ৫০ গুণ বেশী। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, জামাআতে পড়া নামায পঁচিশটি নামাযের সমতুল্য। আর যদি কেউ সেই নামায কোন জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে এবং তার রুকু ও সিজদা পূর্ণরুপে আদায় করে, তবে ঐ নামায পঞ্চাশটি নামাযের সমমানে পৌঁছায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬০, সহিহ তারগিব ৪০৭নং)
বাসা থেকে মসজিদ যত দূরে হবে, পদক্ষেপ হিসাবে জামাআতের সওয়াব তত বেশী হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৬নং)
জামাআতের লোকসংখ্যা যত বেশী হবে, তার সওয়াবও তত বেশী হবে।
তাকবীরে তাহ্রীমা সহ্ পূর্ণ নামাযের জামাআতের সওয়াব কিছু অংশ বাদ যাওয়া নামাযের জামাআতের সওয়াব অপেক্ষা বেশী।
নামায অনুযায়ীও জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে। যেমন, ফজরের জামাআত এশার তুলনায় এবং এশার জামাআত অন্যান্য ওয়াক্তের জামাআতের তুলনায় সওয়াবে অধিক বেশী।
স্বাধীন জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম পুরুষের জন্য সুস্থতা-অসুস্থতা, ঘরে-সফরে, বিপদে-নিরাপদে সর্বাবস্থায় যথাসাধ্য জামাআতে শামিল হয়ে নামায আদায় করা ওয়াজেব।
অবশ্য জামাআত কেবল ফরয নামাযের জন্য ওয়াজেব। এ ছাড়া (মুআক্কাদাহ ও গায়র মুআক্কাদাহ) সুন্নত এবং নফল নামাযের জন্য; যেমন সুনানে রাওয়াতেব, বিত্র, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল উযূ, তাহিয়্যাতুত ত্বাওয়াফ, স্বালাতুত তাসবীহ্ (?) স্বালাতুত তাওবাহ্, ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন প্রভৃতি নামাযের জন্য জামাআত বিধিবদ্ধ নয়।
পক্ষান্তরে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের নামায, ঈদ, ইস্তিস্কা ও তারাবীহ্র নামাযের জন্য জামাআত সুন্নত। যেমন কাযা ও তাহাজ্জুদের নামাযেও জামাআত চলে। আর এ সব কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইন শাআল্লাহ।
আবার সাধারণ অতিরিক্ত নফল নামায জামাআত করে পড়া যায়। দলীল স্বরুপ দেখুন, বুখারী ১১৮৬ ও মুসলিম ৫৬৮নংহাদীস।
(ঈদের নামায ছাড়া অন্য নামাযের জন্য) মহিলাদের মসজিদের জামাআতে শামিল হওয়ার চাইতে স্বগৃহে; বরং গৃহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অন্দর মহলে নামায পড়াই হল উত্তম। মহানবী (সাঃ) বলেন, “মহিলাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মসজিদ তার গৃহের ভিতরের কক্ষ।” (আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২০৯, বায়হাকী, জামে ৩৩২৭নং)
তিনি বলেন, “মহিলা স্বগৃহে থেকে তার রবের অধিক নিকটবর্তী থাকে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “মহিলা তার ঘরে থেকে রবের ইবাদত করার মত ইবাদত আর অন্য কোথাও করতে পারে না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৪২নং)
তিনি মহিলাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমাদের খাস কক্ষের নামায সাধারণ কক্ষে নামায অপেক্ষা উত্তম, তোমাদের সাধারণ কক্ষের নামায বাড়ির ভিতরে কোন জায়গায় নামায অপেক্ষা উত্তম এবং তোমাদের বাড়ির ভিতরের নামায মসজিদে জামাআতে নামায অপেক্ষা উত্তম।” (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, বায়হাকী, জামে ৩৮৪৪নং)
উল্লেখ্য যে, সাহাবিয়া উম্মে হুমাইদ উক্ত হাদীস শোনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর বাড়ির সব চাইতে অধিক অন্দর ও অন্ধকার কামরাতে নামায পড়েছেন।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “মহিলা হল গোপনীয় জিনিস। বাইরে বের হলে শয়তান তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখতে থাকে।” (ত্বাবারানী, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১, ৩৪২নং)
এ তো ইবলীস জিনের কথা। পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের দ্বীনহীন যুবকদল; যারা মহিলার জন্য হাজার শয়তান অপেক্ষা বেশী ক্ষতিকর, তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে গোপনে থাকা নারীর একান্ত কর্তব্য।
তবে যদি সে একান্ত মসজিদের জামাআতে শরীক হয়ে নামায পড়তে চায়, তাহলে তাতে অনুমতি আছে। অবশ্য এর জন্য কয়েকটি শর্ত আছে:
মসজিদের পথে যেন (লম্পটদের) কোন অশুভ ফিতনার আশঙ্কা না থাকে।
মহিলা যেন সাদাসিধাভাবে পর্দার সাথে আসে। অর্থাৎ, সেজেগুজে প্রসাধন-সেন্ট লাগিয়ে না আসে। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য।)
এতে যেন তার স্বামীর অনুমতি থাকে।
স্বামীর জন্যও উচিৎ, যদি তার স্ত্রী মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাকে বাধা না দেওয়া। সাহাবাদের মহিলাগণ মসজিদে গিয়ে জামাআতে নামায আদায় করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘মুমিন মহিলারা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সাথে ফজরের নামায পড়ার জন্য দেহে চাদর জড়িয়ে হাযির হত। অতঃপর নামায শেষ হলে তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত, আবছা অন্ধকারে তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না।’ (বুখারী ৫৭৮,মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৪২৩, তিরমিযী, সুনান ১৫৩, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৬৬৯নং)
পরন্তু এতে মসজিদের দরস ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করার উপকারিতাও রয়েছে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যদি তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের কাছে রাত্রে মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তোমরা তাদেরকে অনুমতি দিয়ে দাও।” (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, যদিও তাদের ঘরই তাদের জন্য ভালো।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬৭,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৭৪৫৮নং)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, তবে তারা যেন খোশবূ ব্যবহার না করে সাদাসিধা ভাবে আসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৭৪৫৭নং)
একদা আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমাদের মহিলারা যদি মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাদেরকে বাধা দিও না।” এ হাদীস শোনার পর তাঁর ছেলে বিলাল বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ তার মুখোমুখি হয়ে এমন গালি দিলেন, যেমনটি আর কোনদিন শোনা যায়নি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি তোকে আল্লাহর রসূল (সাঃ) থেকে খবর দিচ্ছি। আর তুই বলিস, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ (মুসলিম, সহীহ ৪৪২নং)
অবশ্য সত্যপক্ষে ফিতনা, নজরবাজি বা নষ্টি ফষ্টির আশঙ্কা থাকলে অথবা মহিলা সেজেগুজে বেপর্দায় কিংবা সেন্ট ব্যবহার করে যেতে চাইলে অভিভাবক বা স্বামী তাকে অনুমতি দেবে না।
অনুরুপভাবে যে মহিলারা জামাআতে হাযির হবে, তাদের জন্য জরুরী এই যে, তারা পুরুষদের ইমামের সালাম ফেরা মাত্র উঠে বাড়ি রওনা দেবে। যাতে পুরুষদের সাথে মসজিদের দরজায় বা পথে কোন প্রকার দেখা-সাক্ষাৎ না হয়। হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যুগে মহিলারা যখন ফরয নামাযের সালাম ফিরত, তখন তারা উঠে চলে যেত। আর রসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাথে অন্যান্য নামাযীরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। অতঃপর আল্লাহর রসূল উঠে গেলে পুরুষরা উঠে যেত।’ (বুখারী ৮৬৬, ৮৭০নং)
অবশ্য মহিলাদের পর্দাযুক্ত পৃথক মুসাল্লা ও পৃথক দরজা হলে সালাম ফেরা মাত্র সত্বর উঠে যাওয়া জরুরী নয়। (আনিঃ ১/২৮৭)
প্রকাশ যে, মহিলা সঙ্গে তার ছোট শিশুকেও মসজিদে আনতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যাতে মসজিদের কোন জিনিস, কুরআন, পবিত্রতা আদি নষ্ট এবং নামাযীদের কোন প্রকার ডিষ্টার্ব না করে।
মসজিদের বর্ণনায় মসজিদে যাওয়ার কিছু আদব আলোচিত হয়েছে। জামাআতের প্রাসঙ্গিকতায় এখানে আরো কিছু কথা উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি।
জামাআতে হাযির হওয়ার জন্য বাসা থেকে ওযূ করে বিনয়ের সাথে বের হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, বাসা থেকে ওযূ করে নামাযে যাওয়ার কথা একাধিক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
এ সময়ে সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লেবাস পরিধান করা কর্তব্য। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর আদেশ রয়েছে। (কুরআন মাজীদ ৭/৩১)
সর্বশরীর থেকে সর্বপ্রকার দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া জরুরী। লেবাসের, মুখের, ঘামের, কাঁচা পিঁয়াজ ও রসুন তথা বিড়ি-সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া আবশ্যিক। যাতে সে গন্ধে ফিরিশ্তা ও পাশের নামাযী কষ্ট না পান এবং ঐ গন্ধ-ওয়ালার প্রতি নামাযীদের মনে মনে ঘৃণার উদ্রেক না হয়।
চলার পথে দুইহাতের আঙ্গুলসমূহের মাঝে খাজাখাজি করা নিষিদ্ধ। কারণ, নামাযের জন্য চলাও নামায পড়ার মতই গুরুত্ব রাখে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২নং)
চলার সময় নামাযী যেন এদিক-ওদিক না তাকায়, হৈ-হাল্লা না করে, নামাযের কিছু অংশ ছুটে গেলেও যেন না দৌড়ে। বরং ভদ্রতা ও গম্ভীরতার সাথে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে জামাআতে শামিল হয়।
চলার পথে আল্লাহর যিক্র মনে রাখা কর্তব্য। (মসজিদে যাওয়ার আদব দ্রষ্টব্য)
উল্লেখ্য যে, মসজিদে প্রবেশ করার সময় (জুমআর খুতবার আযান ছাড়া অন্য) আযান হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আযানের উত্তর দিয়ে দরুদ-দুআ পড়ে তারপর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ অথবা অন্য সুন্নত পড়বে নামাযী।
ইমাম ছাড়া কম পক্ষে একটি নামাযী হলে জামাআত গঠিত হবে; চাহে সে নামাযী জ্ঞানসম্পন্ন শিশু হোক অথবা মহিলা।
মহানবী (সাঃ) ইবনে আব্বাসকে নিয়ে জামাআত করে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আসু:) তিনি সফরে উদ্যত দুইজন লোককে বলেছিলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (বুখারী ৬৩০নং, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)
নামাযের এক রাকআত ইমামের সাথে পেলে জামাআতের পূর্ণ ফযীলত পাওয়া যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪১২নং)
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি জুমুআহ অথবা অন্য নামাযের এক রাকআত পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১২৩নং)
অবশ্য ইমামের সালাম ফিরার আগে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে নামাযের যেটুকু অংশ পাওয়া যায় সেটুকুকে ভিত্তি করে জামাআতে শামিল হওয়া যায়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযের ইকামত হয়ে গেলে তোমরা দৌড়ে এস না। বরং তোমরা স্বাভাবিকভাবে চলে এস। আর তোমাদের মাঝে যেন স্থিরতা থাকে। অতঃপর যেটুকু নামায পাও তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যায় তা পুরা করে নাও।” (মুসলিম, সহীহ ৬০২)
উল্লেখ্য যে, জামাআত করার মত লোক থাকলেও শেষ রাকআতে রুকূর পর বা শেষ তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল না হয়ে ইমামের সালাম ফিরার পর দ্বিতীয় জামাআত করা উত্তম নয়। উত্তম হল, ইমামের সালাম ফিরার আগে পর্যন্ত জামাআতে শামিল হওয়া। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিস-স্বালাহ্, ইবনে বায ৭৬পৃ:)
কেউ কেউ বলেন, সঙ্গে জামাআত করার মত লোক থাকলে এবং ইমাম শেষ তাশাহ্হুদে থাকলে জামাআতে শামিল না হয়ে তাদের সালাম ফিরার পর নতুনভাবে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। কেননা, মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” আর তার মানেই হল যে এক রাকআত পেল না বরং সিজদাহ বা তাশাহহুদ পেল, সে নামায পেল না। অতএব নতুন করে জামাআত করলে প্রথম থেকে জামাআত পাওয়া যাবে এবং পূর্ণ নামাযও পাওয়া যাবে। আর এটাই হবে উত্তম। (ফাতাওয়া তাতাআল্লাকু বিজামাআতিল মাসজিদ ৫০পৃ:) অতএব আল্লাহই ভালো জানেন।
মসজিদের জামাআত ছুটে গেলে বা জামাআত শেষ হওয়ার পর মসজিদে এলে যদি অন্য লোক থাকে তাহলে তাদের সাথে মিলে একজন ইমাম হয়ে জামাআত করে নামায পড়বে।
যদি আর কোন লোকের উপস্থিতির আশা না থাকে, তাহলে অন্য মসজিদে জামাআত না হওয়ার ধারণা পাকা হলে সেখানে গিয়ে জামাআতে নামায পড়বে।
তা না হলে মসজিদে একাকী নামায পড়ার চাইতে বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। মহানবী (সাঃ) এরুপ করেছেন বলে প্রমাণ আছে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৫৫পৃ:, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ৫৬পৃ:) অবশ্য বাড়িতে জামাআত করার মত লোক না থাকলে ফরয নামায বাড়ির চেয়ে মসজিদে পড়াই উত্তম। কারণ, নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাওয়ার পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে এবং ফরয নামায মসজিদে পড়ার আদেশ আছে।
একই মসজিদে একই সময়ে দুটি জামাআত করা বৈধ নয়। কেননা তাতে জামাআত না হয়ে বিচ্ছিন্নতাই প্রকাশ পায়।
অবশ্য কোন মসজিদে নির্দিষ্ট ইমাম না থাকলে সেখানে প্রথম জামাআতের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাআত দূষণীয় নয়।
যেমন পথের ধারে বা বাজারের মসজিদে বারবার জামাআত হওয়াও দোষাবহ্ নয়। বরং যারা যখন আসবে তারা তখনই জামাআত সহকারে নামায আদায় করে নিজ নিজ কাজে বের হয়ে যাবে।
যেমন মসজিদ ছোট হওয়ার কারণে প্রথম জামাআতে বিরাট সংখ্যক মানুষের এক সাথে নামায পড়া সম্ভব না হলে, জামাআত শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাআত করাও বৈধ।
মসজিদের নির্ধারিত ইমামের ইমামতিতে জামাআত শেষ হয়ে যাওয়ার পর জামাআত হওয়ার মত লোক মসজিদে এলে জামাআতের ফযীলত নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের দ্বিতীয় জামাআত করা বৈধ।
একদা জামাআত হয়ে গেলে এক ব্যক্তি মসজিদে এল। মহানবী (সাঃ) বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬নং)
হযরত আনাস (রাঃ) এক মসজিদে এলেন। দেখলেন, সেখানে জামাআত হয়ে গেছে। তিনি সেখানে আযান-ইকামত দিয়ে জামাআত সহকারে নামায আদায় করলেন। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৫৪)
অবশ্য এই সুবাদে কেউ যেন প্রথম জামাআতে উপস্থিত হওয়াতে ঢিলেমি না করে। কারণ, (কোন ওযর না থাকলে) আযান শোনামাত্র মসজিদে হাযির হওয়ার জন্য তৎপর হওয়া ওয়াজেব। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিস-স্বালাহ্, ইবনে বায ৭৪পৃ:)
আওয়াল-অক্তে একাকী নামায পড়ার চাইতে একটু দেরীতে জামাআত সহ্ নামায পড়া উত্তম। বিশেষ করে রাতের এশার নামায দেরীতে হলে একাকী আওয়াল অক্তে নামায পড়ে শুয়ে পড়া উত্তম নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযে সবচেয়ে সওয়াব বেশী তার, যাকে (মসজিদের পথে) হাঁটতে হয় বেশী। আর যে ব্যক্তি অপেক্ষা করে ইমাম ও জামাআতের সাথে পড়ে সে ব্যক্তির সওয়াব তার থেকে বেশী, যে (একাকী) নামায পড়ে নিয়ে ঘুমিয়ে যায়।” (বুখারী ৬৫১নং)
অবশ্য ইমাম যদি খুব ঢিলে হন এবং খুব দেরী করে নামায পড়েন, তাহলে তার নির্দেশ ভিন্ন। মহানবী (সাঃ) একদা আবূ যার (রাঃ)-কে বললেন, “কি করবে তুমি, যখন এমন কিছু আমীর হবে, যারা যথা সময় থেকে নামায দেরী করে পড়বে?” আবূ যার বললেন, ‘আমাকে আপনি কি আদেশ করেন? বললেন, “তুমি তোমার নামায যথাসময়ে পড়ে নাও। অতঃপর যদি সেই নামায তাদের সাথে পাও, তাহলে পুনরায় তাদের সাথে (জামাআতে) পড়ে নাও। এটা তোমার জন্য নফল হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
ইমামতির বিবরণ
সর্বাঙ্গ সুন্দর ইসলামের সুষ্ঠ এক বিধান হল জামাআত তথা তার পরিচালক একক ইমাম বা নেতার বিধান। ইমাম হলেন সমাজের নেতা। সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠ জীবন-যাপন করার জন্য নেতার দরকার একান্ত। যিনি হবেন মুসলিমের সমাজ-কেন্দ্র মসজিদের ইমাম এবং তিনিই হবেন ইসলামী-শরীয়ত ব্যাখ্যা দাতা তথা নির্দেশ প্রদানকারী। তিনি হবেন সকলের সকল কাজের আগে। তাঁর মুগ্ধকারী আখলাক-চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং সর্বপ্রকার আচরণে সমাজের জন্য দিক-নির্ণয়ক তারা। তিনি প্রচলিত ‘মোল্লা’ নন, তাঁর দৌড় মসজিদ পর্যন্তই নয়। বরং তাঁর দৌড় গোরের পরেও পরপারের সুখময় জীবন পর্যন্ত।
তিনি সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়। তিনি সমাজ-সংস্কারক, সুপরামর্শদাতা, কল্যাণকামী ও শুভানুধ্যয়ী। তিনি ইসলামের বিশাল ইবাদত নামাযের নেতা, তিনিই জিহাদের ময়দানে প্রধান সেনাপতি।
ইমাম হওয়ার সর্বাধিক বেশী যোগ্য কে?
ইমামতির সবচেয়ে বেশী যোগ্য তিনি, যিনি কুরআনের হাফেয; যিনি (তাজবীদ সহ্) ভালো কুরআন পড়তে পারেন। তাজবীদ ছাড়া হাফেয ইমামতির যোগ্য নয়। পূর্ণ হাফেয না হলেও যাঁর পড়া ভালো এবং বেশী কুরআন মুখস্থ আছে তিনিই ইমাম হওয়ার অধিক যোগ্য।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তি হলে ওদের মধ্যে একজন ইমামতি করবে। আর ইমামতির বেশী হ্কদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে।” (মুসলিম, মিশকাত ১১১৮নং)
তিনি আরো বলেন, “লোকেদের ইমাম সেই ব্যক্তি হবে যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে। পড়াতে সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যে বেশী সুন্নাহ্ জানে, সুন্নাহর জ্ঞান সকলের সমান থাকলে ওদের মধ্যে যে সবার আগে হিজরত করেছে, হিজরতেও সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যার বয়স বেশী সে ইমাম হবে। আর কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১১৭নং)
উল্লেখ্য যে, সাধারণ নামাযীর মত ইমামতির জন্যও সুন্নতী লেবাস উত্তম। তবে মাথায় পাগড়ী, রুমাল বা টুপী হওয়া কিংবা মাথা ঢাকা ইমামতির জন্য শর্ত, ফরয বা জরুরী নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮৬, ৩৮৯) সুতরাং যার মাথা ঢাকা আছে তার থেকে যার মাথা ঢাকা নেই, সে ভালো কুরআন পড়তে পারলে সেই ইমামতির হ্কদার।
যাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ
এমন কতক লোক আছে যাদেরকে আপাত:দৃষ্টিতে ইমামতির অযোগ্য মনে হলেও প্রকৃতদৃষ্টিতে তাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ। অবশ্য শুরুতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি মনে রাখলে এ প্রসঙ্গে অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তির নামায শুদ্ধ, তার ইমামতিও শুদ্ধ এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ। আর যার নামায শুদ্ধ নয়, তার ইমামতিও শুদ্ধ নয় এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৬-৩১৭)
যারা ইমাম হওয়ার যোগ্য নয় বলে ধারণা হতে পারে অথচ (ইমামতির গুণাবলী বর্তমান থাকলে) তারা আসলে তার যোগ্য এমন কিছু লোক নিম্নরুপ :-
১ । অন্ধ :
অন্ধ মানুষের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সন্দেহ্ থাকলেও সব অন্ধ সমান নয়। সুতরাং যোগ্যতা থাকলে সে ইমাম হতে পারে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূমকে দু-দু বার মদ্বীনার ইমাম বানিয়েছিলেন এবং তিনি লোকেদের নামাযের ইমামতি করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১২১নং)
২। ক্রীতদাস :
ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দী দাস, মুক্তদাস, সাধারণ দাস, ভৃত্য, চাকর, বা রাখাল যোগ্য হলে তার ইমামতি শুদ্ধ এবং এমন আতরাফদের পশ্চাতে আশরাফদেরও নামায শুদ্ধ। মহানবী (সাঃ) যখন মদ্বীনায় প্রথম প্রথম হিজরত করে এলেন, তখন মুহাজেরীনরা কুবার নিকটবর্তী উসবাহ্ নামক এক জায়গায় অবস্থান শুরু করলেন। সেখানে আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর মুক্ত করা দাস সালেম (রাঃ) লোকেদের ইমামতি করতেন। তাঁর সবার চাইতে বেশী কুরআন মুখস্থ ছিল। অথচ তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীদের মধ্যে হযরত উমার এবং আবূ সালামাও ছিলেন। (বুখারী, ৬৯২, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৮নং, মিশকাত ১১২৭নং)
তদনুরুপ হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মুক্ত করা দাস আবূ আম্র নামাযের ইমামতি করতেন। (মুসনাদ ইমাম শাফেয়ী) তাঁর যাকওয়ান নামক আর এক মুক্ত করা দাসও ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
৩। মুসাফির :
মুসাফিরের জন্য সফরে নামায জমা ও কসর করা সুন্নত হলেও এবং সে ইমামতি করার সময় নামায কসর করে পড়লেও তার পিছনে গৃহ্বাসীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গৃহ্বাসীরা ঐ মুসাফির ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায পূরণ করে নেবে। অর্থাৎ, ইমাম ও মুক্তাদী মিলে ২ রাকআত হয়ে গেলে মুক্তাদীরা ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একা একা আরো বাকী ২ রাকআত পড়ে নেবে। আর সে নামায জমা করে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা তা করবে না।
৪। দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি :
দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ। তবে মুক্তাদীরাও (দাঁড়ানোর সময়) বসে নামায পড়বে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম এ জন্যই বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং --- সে যখন দাঁড়িয়ে নামায পড়বে, তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড় এবং যখন বসে নামায পড়বে তখন তোমরাও বসে নামায পড়। আর সে বসে থাকলে তোমরা দাঁড়াও না; যেমন পারস্যর লোকেরা তাদের সম্মানার্হ ব্যক্তিদের জন্য করে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৩৫৬নং)
কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বসে নামায পড়লে তাঁর পশ্চাতে সাহাবীগণ দাঁড়িয়েই নামায পড়েছেন। এর ফলে উলামাগণ বলেন যে, ইমাম সাময়িক অসুবিধার কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বে। নচেৎ, শেষ জীবনে বাধ্যক্যজনিত কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরা (দাঁড়ানোর সময়) দাঁড়িয়েই নামায পড়বে।
বলা বাহুল্য, তাঁর পূর্বেকার আমল মনসূখ নয়। কারণ, তাঁর আমল দ্বারা তাঁর আদেশ মনসূখ হয় না। তাছাড়া তাঁর পরবর্তীতে সাহাবাগণও ইমাম বসে নামায পড়লে বসেই নামায পড়েছেন। অবশ্য ঐ ক্ষেত্রে বসে নামায পড়া ওয়াজেব না বলে মুস্তাহাব বলা যেতে পারে। (মিশকাত ১১৩৯নং, ১/৩৫৭ আলবানীর টীকা সহ্ দ্র:)
৫। তায়াম্মুমকারী :
যে ব্যক্তি ওযূ করতে না পেরে তায়াম্মুম করে নামায পড়ে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে যারা ওযূ করে নামায পড়ে তাদের নামায শুদ্ধ।
হযরত আম্র বিন আস (রাঃ) বলেন, যাতুস সালাসিল যুদ্ধ-সফরে এক শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হল। আমার ভয় হল যে, যদি গোসল করি তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) ফজরের নামায পড়লাম। আমার সঙ্গীরা একথা নবী (সাঃ)-র নিকটে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “হে আম্র! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সঙ্গীদের ইমামতি করেছ?” আমি গোসল না করার কারণ তাঁকে বললাম। আরো বললাম যে, আল্লাহ তাআলার এ বাণীও আমি শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমরা আত্মহ্ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড় দয়াশীল।” (কুরআন মাজীদ ৪/২৯)
একথা শুনে তিনি হাসলেন এবং আর কিছুই বললেন না। (বুখারী, সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৩নং, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
৬। কেবল মহিলাদের জন্য মহিলা :
মহিলা মহিলা নামাযীদের ইমামতি করতে পারে। উম্মে অরাকাহ্ বিন নাওফাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-এর নির্দেশমতে তাঁর পরিবারের মহিলাদের ইমামতি করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯১-৫৯২নং)
অবশ্য এ ক্ষেত্রে মহিলা ইমাম মহিলাদের কাতার ছেড়ে পুরুষের মত সামনে একাকিনী দাঁড়াবে না। বরং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবে। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, মুহাল্লা ৩/১৭১-১৭৩) আশেপাশে বেগানা পুরুষ না থাকলে সশব্দে তকবীর ও কিরাআত পড়বে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৩০/১১৩)
৭। কেবল মহিলাদের জন্য পুরুষ :
কোন পুরুষ কেবল মহিলা জামাআতের ইমামতি করতে পারে। তবে শর্ত হল, মহিলা যেন এগানা হয়, নচেৎ বেগানা হলে যেন একা না হয়, পরিপূর্ণ পর্দার সাথে একাধিক থাকে এবং কোন প্রকার ফিতনার ভয় না থাকে অথবা তার সঙ্গে যেন কোন এগানা মহিলা বা অন্য পুরুষ থাকে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৫২)
একদা ক্বারী সাহাবী হযরত উবাই বিন কা’ব (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! গতরাত্রে আমি একটি (অস্বাভাবিক) কাজ করেছি।’ তিনি বললেন, “সেটা কি?” উবাই বললেন, ‘কিছু মহিলা আমার ঘরে জমা হয়ে বলল, আপনি (ভালো ও বেশী) কুরআন পড়তে পারেন, আমরা পারি না। অতএব আপনি আজ আমাদের ইমামতি করেন। তাদের এই অনুরোধে আমি তাদেরকে নিয়ে ৮ রাকআত এবং বিতর পড়েছি।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাঃ) চুপ থাকলেন। অর্থাৎ তাঁর এই নীরব থাকা এ ব্যাপারে তাঁর মৌনসম্মতি হয়ে গেল। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা)
৮। নাবালক কিশোর :
জ্ঞানসম্পন্ন নাবালক কিশোরের জন্য যদিও নামায ফরয নয়, তবুও বড়দের জন্য ফরয-নফল সব নামাযেই তার ইমামতি শুদ্ধ।
আম্র বিন সালামাহ্ ৬-৭ বছর বয়সে লোকেদের ইমামতি করেছেন। আর তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে বেশী কুরআনের হাফেয। (বুখারী ৪৩০২, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৫নং)
৯। জারজ :
ব্যভিচারজাত সন্তানের কোন দোষ নেই। তার মা-বাপের দোষ তার ঘাড়ে আসতে পারে না। সুতরাং অন্যান্য দিকে যোগ্যতা থাকলে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে নামায শুদ্ধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৪৭-১৪৮)
১০। যে নফল বা ভিন্ন ফরয নামায পড়ছে :
যে নফল নামায পড়ছে তার পিছনে ফরয নামায শুদ্ধ; যেমন তারাবীহ্র জামাআতে এশার নামায, অথবা আসরের জামাআতে যোহরের কাযা নামায অথবা কাযা নামায আদায়কারীর পিছনে ফরয নামায আদায় করা শুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও তা কোন দোষের নয়। যেহেতু জরুরী হল বাহ্যিক কর্মাবলীতে ইমামের অনুসরণ করা।
হযরত মুআয বিন জাবাল মহানবী (সাঃ)-এর সাথে এশার নামায পড়তেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজের গোত্রের লোকেদের ঐ নামাযই পড়াতেন। এক বর্ণনায় আছে যে, এ নামায তাঁর নফল হত এবং লোকেদের হত ফরয। (বুখারী, মুসলিম, শাফেয়ী, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ৩/৮৬, মিশকাত ১১৫০-১১৫১নং)
১১। সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত লোকের ইমামতি
সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত ব্যক্তির ইমামতি বৈধ। একদা আব্দুর রহ্মান বিন আওফের পশ্চাতে মহানবী (সাঃ) নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪নং)
যাদের ইমামতি শুদ্ধ নয়
১। পুরুষের জন্য মহিলা :
পুরুষের জন্য মহিলার ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সে জাতি কোন দিন সফল হবে না, যে জাতি তাদের কর্মভার একজন মহিলাকে সমর্পণ করবে।” (বুখারী, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)
বলা বাহুল্য, মহিলা যত বড়ই যোগ্য হোক, মুক্তাদী নিজের ছেলে হোক অথবা অন্য কেউ হোক, স্বামী জাহেল এবং স্ত্রী কুরআনের হাফেয হোক তবুও কোন ক্ষেত্রেই মহিলা পুরুষের ইমামতি করতে পারে না। এটি পুরুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮২)
২। মুশরিক ও বিদআতী :
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন ইবাদতে অন্য কোন সৃষ্টিকে শরীক করে, যেমন মাযার পূজা করে, মাযারে গিয়ে সিজদা, নযর-নিয়ায, মানত, কুরবানী, তওয়াফ প্রভৃতি নিবেদন করে, সেখানে সুখণ্ডসমৃদ্ধি বা সন্তান চায়, সাহায্য প্রার্থনা করে, যে ব্যক্তি গায়বী (অদৃশ্যের খবর জানার) দাবী করে ও লোকেরহাত বা ভাগ্য-ভবিষ্যৎ বলে দেয়, যে (কোন পশু বা পাখীর চামড়া, হাড়, লোম বা পালক দিয়ে, কোন গাছপালার শিকড় বা ফুল-পাতা দিয়ে, কারো কাপড়ের কোন অংশ দিয়ে, ফিরিশ্তা , জিন, নবী, সাহাবী, ওলী বা শয়তানের নাম লিখে অথবা বিভিন্ন সংখ্যার নকশা বানিয়ে, অথবা তেলেসমাতি বিভিন্ন কারসাজি করে, নোংরা ও নাপাক কোন জিনিস দিয়ে) শির্কী তাবীয লিখে, যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে) প্রেম বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য তাবীয করে, যোগ বা যাদু করে, এ শ্রেণীর ইমামের নামায শুদ্ধ নয়, ইমামতি শুদ্ধ নয় এবং তার পশ্চাতে নামাযও শুদ্ধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৯, ২২/৮২, ২৪/৭৮, ৮৯, ২৬/৯৭, ২৮/৫৫)
তদনুরুপ বিদআতী যদি বিদআতে মুকাফফিরাহ্ বা এমন বিদআত করে যাতে মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাহলে সে বিদআতীর পিছনে নামায শুদ্ধ নয়।
৩। ফাসেক :
ফাসেক হল সেই ব্যক্তি, যে অবৈধ, হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ করে এবং ফরয বা ওয়াজেব কাজ ত্যাগ করে; অর্থাৎ কাবীরা গুনাহ করে। যেমন, ধূমপান করে, বিড়ি-সিগারেট, জর্দা-তামাক প্রভৃতি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে, অথবা সূদ বা ঘুস খায়, অথবা মিথ্যা বলে, অথবা (অবৈধ প্রেম) ব্যভিচার করে, অথবা দাড়ি চাঁছে বা (এক মুঠির কম) ছেঁটে ফেলে, অথবা মুশরিকদের যবেহ্ (হালাল মনে না করে) খায়, (হালাল মনে করে খেলে তার পিছনে নামায হবে না।) অথবা স্ত্রী-কন্যাকে বেপর্দা রেখে তাদের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়, অথবা মা-বাপকে দেখে না বা তাদেরকে ভাত দেয় না ইত্যাদি।
উক্ত সকল ব্যক্তি এবং তাদের অনুরুপ অন্যান্য ব্যক্তির পিছনে নামায মাকরুহ (অপছন্দনীয়)। বিধায় তাকে ইমামরুপে নির্বাচন ও নিয়োগ করা বৈধ ও উচিৎ নয়।
কিন্তু যদি কোন কারণে বা চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই তার পিছনে নামায পড়তেই হয়, তাহলে নামায হয়ে যাবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯০, ৩০০, ৬/২৫১, ১৫/৮০, ১৮/৯০, ১১১, ১৯/১৫২, ২২/৭৫, ৭৭, ৯২, ২৪/৭৮)
সাহাবাগণের যামানায় সাহাবাগণ ফাসেকের পিছনে নামায পড়েছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) হাজ্জাজের পিছনে নামায পড়েছেন। (বুখারী) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মারওয়ানের পিছনে নামায পড়েছেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)
হযরত ওসমান (রাঃ) ফিতনার সময় যখন স্বগৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন, তখন উবাইদুল্লাহ্ বিন আদী বিন খিয়ার তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আপনি জনসাধারণের ইমাম। আর আপনার উপর যে বিপদ এসেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ফিতনার ইমাম আমাদের নামাযের ইমামতি করছে; অথচ তার পশ্চাতে নামায পড়তে আমরা দ্বিধাবোধ করি।’ তিনি বললেন, ‘নামায হল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। সুতরাং লোকে ভালো ব্যবহার করলে তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার কর। আর মন্দ ব্যবহার করলে তাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাক।’ (বুখারী ৬৯৫, মিশকাত ৬২৩নং)
৪। ইমামতির বিনিময়ে অর্থগ্রহণকারী ব্যক্তি :
ইমামতিকে যে অর্থকরী পেশা মনে করে ইমামতি করে; অর্থাৎ, কেবল পয়সার ধান্দায় ইমামতি করে, এমন ইমামের পশ্চাতে নামায মাকরুহ।
আবূ দাঊদ বলেন, (ইমাম) আহমাদ এমন ইমামের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলেন, যে বলে, ‘আমি এত এত (টাকার) বিনিময়ে রমযানে তোমাদের ইমামতি করব।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। কে এর পেছনে নামায পড়বে?’ (মারা: ৯৯পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, ইমামতির জন্য সৌজন্য সহকারে ইমামকে বেতন, ভাতা বা বিনিময় দেওয়া মুক্তাদীদের কর্তব্য। ইমামের উচিৎ, কোন চুক্তি না করা; বরং মুক্তাদীদের বিবেকের উপর যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে ইমামতির দায়িত্ব পালন করা। পক্ষান্তরে জামাআতের উচিৎ, ইমামের এই দ্বীনদারীকে সস্তার সুযোগরুপে ব্যবহার না করা। বরং বিবেক, ন্যায্য ও উচিৎ মত তাঁর কালাতিপাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেমন উচিৎ নয় এবং আদৌ উচিৎ নয়, ইমাম সাহেবকে জামাআতের ‘কেনা গোলাম’ মনে করা।
৫। ক্বিরাআত ভুল যার :
যে কুরআন পড়তে এমন ভুল পড়ে, যাতে মানে বদলে যায়, তার ইমামতি ও তার পিছনে যে ভালো কুরআন পড়তে পারে তার নামায শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৬৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৪৮)
বলা বাহুল্য, ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে ক্বারীর নামায শুদ্ধ নয়। তবে অক্বারীর নামায হয়ে যাবে। অবশ্য যদি কোন ক্বারী ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে অজান্তে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে নেয়, তাহলে তার নামায হয়ে যাবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১২১পৃ:)
সুতরাং যে সকল মসজিদে সস্তা দরে অক্বারী ইমাম রাখা হয়, সে সকল গ্রাম শহরের ক্বারীদের (যারা ইমাম অপেক্ষা ভালো কুরআন পড়তে পারে তাদের) নামাযের অবস্থা কি হবে তা মসজিদের মতওয়াল্লীদেরকে ভেবে দেখা দরকার।
৬। যাকে মুক্তাদীরা অপছন্দ করে :
চরিত্রগত বা শিক্ষাগত কোন কারণে মুক্তাদীরা ইমামকে অপছন্দ করলে ইমামের নামায আল্লাহর দরবারে কবুল নয়। সুতরাং জেনেশুনে তার ইমামতি করা বৈধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)
অবশ্য ব্যক্তিগত কোন কারণে কেউ কেউ ইমামকে অপছন্দ করলে, দোষ নেই অথচ তাকে খামাখা কেউ অপছন্দ করলে অথবা বেশী সংখ্যক লোক পছন্দ এবং অল্প সংখ্যক লোক অপছন্দ করলে কারো কোন ক্ষতি হয় না। অবশ্য ক্ষতি তার হয়, যে একজন নির্দোষ মানুষকে খামাখা অপছন্দ করে। তবুও জ্ঞানী ইমামের উচিৎ, যে জামাআতের অধিকাংশ লোক তাকে অপছন্দ করে, সে জামাআতের ইমামতি ত্যাগ করা এবং তার ইমামতিকে কেন্দ্র করে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি না করা।
৭। সুন্নাহ্ত্যাগী :
যে মানুষ সুন্নাহর পাবন্দ নয়; সুন্নত নামায-রোযা ইত্যাদি ত্যাগ করে, নিশ্চয় সে মানুষ পরহেযগার ও ভালো লোক নয়। তবে সে যে পাপী তা কেউবলতে পারে না। অতএব তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। তদনুরুপ কোন বিতর্ক থাকার ফলে বা কোন সন্দেহের কারণে কেউ কোন সুন্নাহ্ ত্যাগ করলে; যেমন বুকের উপরহাত না বাঁধলে, রুকূর আগে-পরে রফ্য়ে ইয়াদাইন না করলে বা জোরে আমীন না বললেও তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৫/৪৬)
৮। পেশাব-ঝরা রোগী :
যে ব্যক্তির সর্বদা পেশাব ঝরার রোগ আছে সে ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯৭)
৯। বোবা :
বোবার পিছনে নামায পড়লে নামায শুদ্ধ। কিন্তু তাকে ইমাম করা যাবে না। যেহেতু সে তকবীর শুনাতে ও জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করতে অক্ষম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩২০)
১০। জলদিবাজ :
যে ব্যক্তি ঠকাঠক কাকের দানা খাওয়ার মত নামায পড়ে এবং পশ্চাতে মুক্তাদীরা তার অনুসরণ করতে সক্ষম হয় না, রুকূ ও সিজদা থেকে উঠে পিঠ সোজা করে না, তার নামায এবং তার পশ্চাতে মুক্তাদীদেরও নামায হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৬৭)
১১। বেওযূ ব্যক্তি :
কোন ইমাম নাপাক বা বেওযূ অবস্থায় নামায পড়লে এবং সালাম ফিরার পর তা জানতে পারলে কেবল তার নামায বাতিল হবে এবং মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। কেবল ইমামই ঐ নামায পুনরায় পড়বে, মুক্তাদীরা নয়। (আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ১৪৭পৃ:) জেনেশুনে কোন বেওযূর পিছনে নামায হবে না।
১২। রেডিও-টিভির ইমাম :
কোন পুরুষ অথবা মহিলা, সুস্থ অথবা অসুস্থ, ওজরে অথবা বিনা ওজরে রেডিও বা টিভির পিছনে দাঁড়িয়ে সম্প্রচারিত কোন মসজিদের ফরয অথবা নফল, জুমুআহ অথবা অন্য যে কোন নামাযে তার ইমামের অনুসরণ করা বৈধ নয়। যদিও তাদের বাসা উক্ত মসজিদের পাশে হোক অথবা সামনে, উপরে হোক অথবা পিছনে। কোন অবস্থাতেই মসজিদে হাজির না হয়ে দূর থেকে কেবল শব্দ অথবা শব্দ ও ছবির অনুকরণ করে জামাআত পাওয়া যায় না। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৭৩পৃ:)
ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম
মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিৎ নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিৎ।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিৎ, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিৎ। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ইমামের কর্তব্য
১। ইমামতির নিয়ত :
সাধারণভাবে ইমামতির নিয়ত (সংকল্প) জরুরী। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৭০) অবশ্য একাকী নামায পড়া অবস্থায় কেউ জামাআতের নিয়তে তার সাথে শামিল হলে জামাআত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে নামায পড়তে পড়তে ইমামতির সংকল্প করে নেওয়া যথেষ্ট হবে। নামায শুরু করার আগে থেকে ইমামতির নিয়ত জরুরী নয়। (ঐ ১৭/৫৯) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, এক রাত্রে আমি আমার খালা মায়মূনার ঘরে শুয়ে ছিলাম। নবী (সাঃ) রাত্রে উঠে যখন নামায পড়তে লাগলেন, তখন আমিও তাঁর সাথে শামিল হয়ে গেলাম। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়া দেখে বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)
২। কাতার সোজা করতে বলা :
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) নামাযে ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে তাদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। (বুখারী ৭১৯নং) যেমন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও।” “কাতার সোজা কর।” “কাতার পূর্ণ কর।” “ঘন হয়ে দাঁড়াও।” “সামনে এস।” “ঘাড় ও কাঁধসমূহকে সমপর্যায়ে সোজা কর।” “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” “কাতারের ফাঁক বন্ধ কর।” “বাজারের মত হৈ-চৈ করা থেকে দূরে থাক।” ইত্যাদি।
কাতারে কেউ আগে-পিছে সরে থাকলে তাকে বরাবর হতে বলা এমন কি নিজে কাছে গিয়ে কাতার সোজা করা ইমামের কর্তব্য। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না কাতার পূর্ণরুপে সোজা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত নামায শুরু করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৬) বরং কাতার সোজা ও ঠিক হওয়ার আগে ইমামের নামায শুরু করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:)
নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নামাযে দাঁড়ালে আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদের কাতার সোজা করতেন। অতঃপর আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে তবেই তকবীর দিতেন।’ (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৫নং)
৩। মুক্তাদীদের খেয়াল করে নামায হাল্কা করে পড়া :
জামাআতে বিভিন্ন ধরনের লোক নামায পড়ে থাকে। ইমামের উচিৎ, নিজের ইচ্ছামত নামায না পড়া; বরং তাদের খেয়াল রেখে ক্বিরাআত ইত্যাদি লম্বা করা। অবশ্য কারো ইচ্ছা অনুসারে নামায এমন হাল্কা করা উচিৎ নয়, যাতে নামাযের বিনয়, ধীরতা-স্থিরতা, পরিপূর্ণরুপে রুক্ন-ওয়াজেব-সুন্নত আদি আদায় ব্যাহত হয়। বলা বাহুল্য, যাতে উভয় দিক বজায় থাকে তার খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে।
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ) অপেক্ষা কোন ইমামের পিছনে অধিক সংক্ষেপ অথচ অধিক পরিপূর্ণ নামায পড়ি নি। এমন কি তিনি যখন কোন শিশুর কান্না শুনতেন তখন তার মায়ের উদ্বিগ´ হওয়ার আশংকায় নামায সংক্ষেপ করতেন।’ (বুখারী ৭০৮নং, মুসলিম, সহীহ)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমি অনেক সময় নামায শুরু করে তা লম্বা করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু যখন আমি কোন শিশুর কান্না শুনি, তখন আমার নামাযকে সংক্ষেপ করি। কারণ, তার কান্নায় তার মায়ের মনের উদ্বেগ যে বেড়ে যাবে তা আমি জানি।” (বুখারী ৭০৯নং)
তিনি বলেন, “যখন তোমাদের কেউ লোকেদের নামায পড়ায়, তখন সে যেন হাল্কা করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও বৃদ্ধ লোক থাকে। অবশ্য যখন তোমাদের কেউ একা নামায পড়ে, তখন সে যত ইচ্ছা লম্বা করতে পারে।” (বুখারী ৭০৩নং, মুসলিম, সহীহ)
এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি ফজরের নামাযে অমুকের কারণে হাজির হ্ই না; সে আমাদের নামায খুব লম্বা করে পড়ায়।’ আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘এর পর সেদিন আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে ওয়াযে যেরুপ রাগান্বিত হতে দেখেছি সেরুপ আর অন্য কোন দিন দেখি নি। তিনি বললেন, “তোমাদের কেউ কেউ লোকদেরকে (জামাআতের প্রতি) বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তোমাদের যে কেউ কোন নামাযের ইমামতি করে সে যেন নামায সংক্ষেপ করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও (বিভিন্ন) প্রয়োজন-ওয়ালা লোক আছে।” (বুখারী ৭০২নং, মুসলিম, সহীহ)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “জামাআতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির খেয়াল করে নামায পড়াও। আর এমন মুআযযিন রেখো না, যে আযানের পারিশ্রমিক চায়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৭৭৩নং)
তিনি মুআয (রাঃ) কে এশার ইমামতিতে লম্বা ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করে বলেছিলেন, “তুমি কি লোকদেরকে ফিতনায় ফেলতে চাও হে মুআয? তুমি যখন ইমামতি করবে তখন ‘অশশামসি অয্বহা-হা, সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা, ইক্বরা বিসমি রাব্বিকা, অল্লাইলি ইযা য়্যাগশা’ পাঠ কর। কারণ তোমার পশ্চাতে বৃদ্ধ, দুর্বল ও প্রয়োজনে উদ গ্রী ব মানুষ নামায পড়ে থাকে। (বুখারী ৭০৫, মুসলিম, না, মিশকাত ৮৩৩ নং)
আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিনত্বারখান বলেন, একদা আমরা শায়খ ইমাদের পশ্চাতে নামায পড়ছিলাম। আমার পাশে এক ব্যক্তি নামায পড়ছিল, -আমার মনে হয়- তার কোন ব্যস্ততা ছিল। যখন নামায থেকে ফারেগ হ্লাম, তখন সে কসম করে বলল, আর কখনো তাঁর পিছনে নামায পড়বে না। আর সেই সঙ্গে মুআযের ঐ হাদীস উল্লেখ করল। আমি তাকে বললাম, তুমি কেবল এই হাদীসটিই জান? অতঃপর আমি তার কাছে নবী (সাঃ)-এর নামায লম্বা করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলি উল্লেখ করলাম। এরপর আমি শায়খ ইমাদের পাশে বসলাম এবং ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং এই কামনা করি যে, আপনার বিরুদ্ধে যেন কোন প্রকার সমালোচনা না হয়। সুতরাং যদি আপনি নামাযকে একটু হাল্কা করে পড়তেন। তিনি আমার এ কথা শুনে বললেন, ‘সম্ভবত: অতি নিকটে ওরা আমার ও আমার নামায থেকে নিস্ক্রিতি পাবে। ইয়া সুবহানাল্লাহ্! ওদের কেউ কেউ (দুনিয়ার) রাজা-বাদশার সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলে কোন প্রকারের বিরক্তি প্রকাশ করে না; অথচ ওরা ওদের (দ্বীন-দুনিয়ার বাদশা) প্রভুর সামনে সামান্য সময় দাঁড়াতে বিরক্তিবোধ করে?! (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৮৮পৃ:)
৪। দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত দীর্ঘ করা :
প্রথম রাকআতকে একটু লম্বা করে পড়া উত্তম। যাতে পিছে থেকে যাওয়া মুসল্লীরা প্রথম রাকআতেই এসে শামিল হতে পারে।
আবূ কাতাদাহ্ কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) যোহরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত লম্বা করে পড়তেন। অনুরুপ আসর ও ফজরের নামাযেও। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮০০ নং) আবূ দাঊদের বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, আমরা মনে করতাম, তিনি তা এই জন্য করছেন; যাতে লোকেরা প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারে।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নামাযের ইকামত হয়ে যেত, আর আমাদের কেউ কেউ বাকী গিয়ে নিজের প্রয়োজন (প্রস্রাব-পায়খানা) সেরে ওযূ করে প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারত। কারণ, নবী (সাঃ) ঐ রাকআতকে লম্বা করে পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
তদনুরুপ ইমাম রুকূতে থাকা কালে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার জন্য রুকূ একটু লম্বা করা বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২) পক্ষান্তরে বেশী লম্বা করে জামাআতের মুসল্লীদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। অভিজ্ঞ ইমাম তাঁর মুক্তাদীদের অভ্যাস ও আচরণের মাধ্যমে তাদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টির কথা অবশ্যই বুঝতে পারবেন।
৫। দুআয় নিজেকে খাস না করা :
দুআর সময় এক বচন শব্দ ব্যবহার করে নিজের জন্য দুআকে খাস করা ইমামের জন্য বৈধ নয় বলে যেহাদীস মহানবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (দ্র: তামামুহ্ মিন্নাহ্ ২৭৮-২৮০পৃ:) আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (সাঃ) নিজে ইমাম হয়েও অনেক সময় একবচন শব্দ ব্যবহার করে নামায পড়েছেন। উদাহ্রণস্বরুপ ‘বা-ইদ বাইনী’রহাদীস।
তবুও সাধারণ দুআর সময় এক বচনের স্থলে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা দোষাবহ্ নয়। ইমাম বগবী (রহঃ) বলেন, ইমাম হলে (দুআয়) এক বচনের স্থলে বহু বচন শব্দ ব্যবহার করবে। ‘আল্লাহুম্মাহ্দিনা---- অআ-ফিনা --- বলবে এবং দুআকে নিজের জন্য খাস করবে না। (শারহুস সুন্নাহ্ ৩/১২৯) অনুরুপ বলেন ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ্। (স্বালাতুত তারাবীহ্ ৪১পৃ:, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১৭০-১৭১পৃ:)
৬। সালাম ফিরে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসা :
নামাযে সালাম ফিরার পর ডান অথবা বাম দিকে ঘুরে মুক্তাদীদের প্রতি মুখ করে বসা ইমামের জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ১০৪১, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৯৪৪নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বহুবার বাম দিক হতে ঘুরতে দেখেছি। (বুখারী ৮৫২নংও মুসলিম ৭০৭নং, মিশকাত ৯৪৬নং)
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে অধিকাংশ ডান দিক হতে ঘুরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম৭০৮নং)
৭। যিক্র-আযকারের পর জায়গা বদলে সুন্নত আদি পড়া :
মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম যে জায়গায় (ফরয) নামায পড়ে সে জায়গাতেই সে যেন (সুন্নত) নামায না পড়ে। বরং সে যেন অন্য জায়গায় সরে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬১৬নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
শুধু ইমামই নয়; বরং মুক্তাদীর জন্যও জায়গা বদলে সুন্নত পড়া মুস্তাহাব। নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউকি (সুন্নত পড়ার জন্য) তার সামনে, পিছনে, ডাইনে বা বামে সরে যেতে অক্ষম হবে?” (আবূদাঊদ, সুনান ১০০৬, ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ২৬৬২নং)
সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ)-এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৮৩, আবূদাঊদ, সুনান ১১২৯নং, আহমাদ, মুসনাদ৪/৯৫, ৯৯)
উদ্দেশ্য হল, নামাযের জায়গা বেশী করলে, কিয়ামতে ঐ সকল জায়গা আল্লাহর আনুগত্যের সাক্ষ্য দেবে। (মিশকাত ৯৫৩হাদীসের টীকা দ্র:)
অবশ্য এ সময় খেয়াল রাখা উচিৎ, যাতে উক্ত মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে কোন নামাযীর সিজদার জায়গার ভিতর বেয়ে পার হয়ে গুনাহ না হয়ে বসে।
মুক্তাদীর কর্তব্য
১। ইমামের অপেক্ষা করা :
ইমাম থাকতে তাঁর জায়গায় তাঁর বিনা অনুমতিতে অন্যের ইমামতি করা অবৈধ, আর তা বড় বেপরোয়া লোকের কাজ। এ সব লোকেদের ইমামের একটু দেরী সয় না। সামান্য দেরী হলেই আর তাঁর অপেক্ষা না করে জামাআত খাড়া করে দেয়। এ ধরনের ধৈর্যহারা মানুষরা কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমান।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত (নামাযের জন্য উঠে) দাঁড়াও না।” (বুখারী ৬৩৭, মুসলিম, সহীহ ৬০৪নং)
তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৬৭৩নং)
অবশ্য অস্বাভাবিক বেশী দেরী হলে মুক্তাদীদের অধিকার আছে জামাআত করার। কিন্তু ইমাম উপস্থিত হওয়ার যথাসময় পার হওয়ার পর মুক্তাদীদের কোন এক উপযুক্ত ব্যক্তি ইমামতি শুরু করলে ইতিমধ্যে যদি নিযুক্ত ইমাম এসে পড়েন, তাহলে ইমাম অগ্রসর হয়ে নিজ ইমামতি করতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে ঐ মুক্তাদী ইমাম পিছে হ্টে যাবেন। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৩) যেমন দু-দুবার হযরত আবূ বাক্র (রাঃ) নামায পড়াতে শুরু করলে ইতিমধ্যে মহানবী (সাঃ) এসে উপস্থিত হন এবং আবূ বাক্র পিছে হ্টে যান ও তিনি ইমামতি করেন। (বুখারী ৬৮৪, ৭১২, মুসলিম, সহীহ)
অবশ্য ইমাম চাইলে মুক্তাদী হয়েও নামায সম্পন্ন করতে পারেন। যেমন একদা এক সফরে মহানবী (সাঃ) নিজ প্রয়োজনে দূরে গেলে আসতে দেরী হল। হযরত আব্দুর রহ্মান বিন আওফ (রাঃ) ইমামতি করতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলে আব্দুর রহ্মান পিছে হ্টতে চাইলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে ইঙ্গিতে বললেন যে, তুমি ইমামতি করতে থাক। অতঃপর তিনি সেদিন মুক্তাদী হয়ে নামায পড়লেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৩৬নং)
২। ইক্তিদার নিয়ত :
ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময় মনে মনে ইক্তিদার নিয়ত (সংকল্প) করা জরুরী। যেহেতু মুক্তাদী অবস্থায় ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব, ইমামের পিছনে মুক্তাদী ভুল করলে সহু সিজদা করতে হয় না এবং অনেক সময় ইমামের নামায বাতিল হলে মুক্তাদীরও বাতিল; তাই এই নিয়ত জরুরী। সুতরাং নিয়ত না হলে মুক্তাদীর নামায জামাআতী নামায হবে না। (আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ২০৬পৃ:)
জ্ঞাতব্য যে, ‘ইক্তাদাইতু বিহাযাল ইমাম’ বলে মুখে উচ্চারিতব্য নিয়ত বিদআত।
৩। যথাসময়ে জামাআতে দাঁড়ানো :
ইকামত হয়ে গেলে এবং ইমাম দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে থাকা অথবা তেলাওয়াত বা মুনাজাতে মশগুল থাকা অথবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকা উচিৎ নয়। বরং সত্বর উঠে ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্রীমা দিয়ে নামায শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ।
যেমন তাকবীরে-তাহ্রীমা ইমামের সাথে না পাওয়া এক বড় বঞ্চনার কারণ। অতএব ইমাম তকবীর দিয়ে ফেললে কোন কথাবার্তায় অথবা মনগড়া নিয়ত আওড়ানোতে অথবা মিসওয়াকের সুন্নত পালনে ব্যস্ত হয়ে তকবীর দিতে দেরী করা মোটেই উচিৎ নয়। ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্রীমার একটি পৃথক মর্যাদা রয়েছে শরীয়তে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্রীমার তকবীরও পাবে, সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হয়; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)
মুজাহিদ বলেন, এক বদরী সাহাবী একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি আমাদের সাথে জামাআত পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘প্রথম তাকবীর পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘যা তোমার ছুটে গেছে তা এক শত কালো চক্ষুবিশিষ্ট (উৎকৃষ্ট) উটনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর!’ (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২০২১নং)
অনুরুপভাবে জামাআত শুরু হয়ে গেলে সুন্নত নামাযে মশগুল থাকাও বৈধ নয়। বৈধ নয় কোন সুন্নত শুরু করা। ফজরের সুন্নত হলেও জামাআতের ইকামত শোনার পর তা আর পড়া চলে না। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন নামায খাড়া হয়, তখন ফরয (বা সেই) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।” (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৪, মুসলিম, সহীহ ৭১০ নং, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫২, প্রমুখ) অর্থাৎ, জামাআত খাড়া হলে ফরয বা (ঐ নামায তাকে পড়তে হলে) ঐ নামাযে শামিল হওয়া ছাড়া পৃথক করে কোন নফল বা সুন্নত নামায পড়া বৈধ নয়। অর্থাৎ ইকামতের পর আর কোন সুন্নত বা নফল নামায শুদ্ধ হবে না।। (শরহুন নওবী ৫/২২১, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১)
এক ব্যক্তি মসজিদে এল। তখন আল্লাহর রসূল (সাঃ) ফজরের নামাযে ছিলেন। সে ২ রাকআত নামায পড়ে জামাআতে শামিল হল। নামায শেষে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাকে বললেন, “হে অমুক! তোমার নামায কোন্টা? যেটা আমাদের সাথে পড়লে সেটা, নাকি যেটা তুমি একা পড়লে সেটা? (নাসাঈ, সুনান ৮৬৮নং)
একদা এক ব্যক্তি মুআযযিনের ইকামত বলার সময় নামায পড়ছিল। তা দেখে তিনি বললেন, “একই সাথে কি দুটি নামায!” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭১, ২৫৮৮নং)
একদা ফজরের নামাযের ইকামত হওয়ার সময় মহানবী (সাঃ) দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে। তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ফজরের নামায ৪ রাকআত পড়বে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১১, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭২)
একদা তিনি ফজরের নামায পড়ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এক প্রান্তে ২ রাকআত নামায পড়ে তাঁর সাথে জামাআতে শামিল হল। সালাম ফিরার পর তিনি তাকে বললেন, “ওহে অমুক! তুমি কোন্ নামাযকে (ফরয বলে) গণ্য করলে? তোমার একাকী পড়া নামাযকে, নাকি আমাদের সাথে পড়া নামাযকে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১২নং)
অবশ্য কারো সুন্নত পড়া কালে যদি ইকামত হয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয় রাকআতে থাকলে বাকীটা হাল্কা করে পড়ে পূর্ণ করে নেবে। পক্ষান্তরে প্রথম রাকআতে থাকলে নামায ছেড়ে জামাআতে শামিল হয়ে যাবে। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২৪/১৪, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৫)
প্রকাশ যে, নামায ছাড়ার সময় সালাম ফিরা বিধেয় নয়। বরং নিয়ত বাতিল করলেই নামায থেকে বের হওয়া যায়। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২২পৃ:)
৪। যথা নিয়মে কাতার বাঁধা :
মহান আল্লাহর তা’যীম প্রকাশের উদ্দেশ্যে কাতার বাঁধার যে নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী কাতার বাঁধা মুক্তাদীর কর্তব্য। আর তা যথাক্রমে নিম্নরুপ :-
কাতার সোজা করা :
কাতার সোজা করা ওয়াজেব। কাতার সোজা হবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক অপরের কাঁধ ও পায়ের গাঁট বরাবর সোজা রেখে; যাতে একজনের কাঁধ আগে এবং অপর জনের পিছে না হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আঙ্গুল মিলিয়ে কাতার সোজা হবে না। কারণ, পা ছোট-বড় থাকার ফলে কাতার বাঁকা থেকে যাবে। আর বসা অবস্থায় বাহুমূল বা কাঁধের সাথে বাহুমূল বা কাঁধ বরাবর থাকলে কাতার সোজা বলে ধরা যাবে।
যেমন মসজিদে কাতারের দাগ থাকলে দাগের মাথায় বুড়ো আঙ্গুল রেখে কাতার সোজা হয় না। কারণ, এতে যার পা লম্বা সে কাতার থেকে পিছনের দিকে এবং যার পা ছোট সে কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে থাকবে। সুতরাং পায়ের গোড়ালিকে দাগের মাথায় রাখলে তবেই কাতার বাঞ্ছনীয় সোজা হবে।
কাতার সোজা করার ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর। কারণ, কাতার সোজা করা নামায প্রতিষ্ঠা বা পরিপূর্ণ করার অন্তর্গত কর্ম।” (বুখারী ৭২৩, মুসলিম, সহীহ ৪৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৮নং)
আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নামাযের (কাতার বাঁধার) সময় নবী (সাঃ) আমাদের বাহুমূল স্পর্শ করতেন ও বলতেন, “সোজা হয়ে দাঁড়াও এবং বিভিন্নরুপে দাঁড়াও না; তাতে তোমাদের অন্তরসমূহ বিভিন্নমুখী হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮নং)
কাতার মিলিয়ে ঘন হয়ে জমে দাঁড়ানো এবং মাঝের ফাঁক বন্ধ করা :
কাতারে দাঁড়ানোর সময় ঘন হয়ে দাঁড়ানো জরুরী; যাতে মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। পার্শ্ববর্তী নামাযীর পায়ের পাতার সাথে পায়ের পাতা (পায়ের বাইরের দিকটা সোজা কেবলামুখী করে কনিষ্ঠা আঙ্গুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অংশ) ও বাহুর সাথে বাহু লাগিয়ে জমে দাঁড়াতে হবে নামাযীকে। আল্লাহর এ দরবারে আমীর-গরীব, ছোট-বড় ও প্রভু-দাসের কোন ভেদাভেদ নেই, কোন বেআদবী নেই। সাহাবাগণ কাতারে পরস্পর এইভাবেই দাঁড়াতেন। তাহলে কি তাঁরা বেআদব ছিলেন? আল্লাহর কসম! না। ঐ দেখেন না, একজন ছাত্র যদি তার শিক্ষকের গায়ে গা লাগিয়ে বসে, তাহলে শিক্ষক ও সমস্ত লোক তাকে বেআদব বলবেই। কিন্তু সেই ছাত্রই যদি বাস বা ট্রেনের সীটে ঐরুপ বসে, তাহলে তখন আর কেউ তাকে বেআদব বলে না। বলা বাহুল্য নামাযের সারিতে পাশাপাশি এই প্রেমের সূত্রে বড়-ছোটর কোন প্রভেদ নেই।
আসলে মনের সাথে মনের মিল থাকলে পায়ের সাথে পা মিলে যাওয়া দূরের কথা নয়। আর মনের মাঝে দূরত্ব থাকলে, মনের মাঝে ঔদ্ধত্ব, অহংকার ও ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকলে অথবা ভুল বুঝাবুঝির ফলে অভিমান ও ক্ষেfভ থাকলে অবশ্যই দেহের দূরত্ব বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে আরো মনের দূরত্ব। দূর হবে সম্প্রীতির বাঁধন। শয়তান সেই ভুল বুঝাবুঝির সুযোগে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা আনতে বড় কৃতকার্য হবে।
পরন্তু যদি আপনি মনে করেন যে, পাশের মুসল্লী থেকে আপনি বড় এবং সে আপনার পায়ে পা লাগালে আপনার সম্মানে বাধবে, তাহলে আপনি আপনার পা তার পায়ে লাগিয়ে দিন। আর এ ক্ষেত্রে আশা করি আপনার মনের ঐ আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে না।
পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর আমল মহানবী (সাঃ)-এর যামানায় প্রচলিত ছিল। তিনি সাহাবাদের সে আমল দেখেও বেআদবী মনে করে বাধা দেননি। তিনি নামাযের মধ্যে যেমন সামনে দেখতেন তেমনি পিছনে। ঘন হয়ে দাঁড়ানোর ব্যাখ্যাতে সাহাবাগণের এই আমল অবশ্যই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাতে তিনি-সম্মতি প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, এ কাজ যে সুন্নত তাতে কোন সন্দেহ্ থাকতে পারে না।
কিন্তু বড় দু:খের বিষয় যে, তাবেঈনদের যামানা থেকেই এ আমল অনেকের কাছে বর্জনীয় হয়ে চলে আসছে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আজকে যদি কারোর সাথে ঐ কাজ করি, তাহলে সে সেরকশ (দুরন্ত) খচ্চরের মত চকে যাবে।’ (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৪৭) সুতরাং আল্লাহ তার প্রতি রহ্ম করেন যে এই মৃত সুন্নতকে জীবিত করে। (মারা: ২২৫পৃ:)
মহানবী (সাঃ) নামাযের কাতার তীরের মত সোজা করতেন। অতঃপর সাহাবাগণ যখন সে কাজ সমAক বুঝে উঠতে পেরেছেন এ কথা বুঝতে পারতেন, তখন তিনি তাকবীরে তাহ্রীমা দিতেন। একদিন তাকবীরে দিতে উদ্যত হতে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটা লোকের বুক কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর বান্দাগণ! হয় তোমরা ঠিকমত কাতার সোজা কর, নচেৎ আল্লাহ তোমাদের চেহারাসমূহের মাঝে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে দেবেন।” (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৩, মিশকাত ১০৮৫নং)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নামাযের ইকামত হল। নবী (সাঃ) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর এবং ঘন হয়ে দাঁড়াও। নিশ্চয় আমি আমার পিছন দিক হতেও দেখে থাকি।” আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর আমাদের প্রত্যেকে নিজ বাহুমূল তার পার্শ্ববর্তী সঙ্গীর বাহুমূলের সাথে এবং নিজ পা তার পায়ের সাথে (হাঁটু তার হাঁটুর সাথে, পায়ের গাঁট তার পায়ের গাঁটের সাথে) লাগিয়ে দিত। (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬২নং)
হযরত জাবের বিন সামুরাহ্ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদের কাছে এলেন। সে সময় আমরা গোলাকার দলে দলে বিভক্ত ছিলাম। তিনি বললেন, “তোমাদেরকে আমি বিক্ষিপ্তরুপে দেখছি কেন?” অতঃপর একদিন তিনি আমাদের কাছে এসে (আমাদেরকে অনুরুপ বিক্ষিপ্ত দেখে) বললেন, “তোমরা প্রতিপালকের সামনে ফিরিশ্তাবর্গের কাতার বাঁধার মত কাতার বেঁধে দাঁড়াবে না কি?” আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! ফিরিশ্তাবর্গ তাঁদের প্রতিপালকের সামনে কিরুপে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।’ তিনি বললেন, “প্রথমকার কাতারসমূহ পূর্ণ করেন এবং ঘন হয়ে জমে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩০, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬১, মিশকাত ১০৯১নং)
প্রকাশ থাকে যে, ঘন করে দাঁড়ানোর অর্থ এই নয় যে, পরস্পর ঠেলাঠেলি ও চাপাচাপি করে দাঁড়াতে হবে। বরং এইরুপ দাঁড়ানোতে নামাযের একাগ্রতা ও বিনয় নষ্ট হতে পারে। অতএব যাতে পায়ে পা এবং বাহুতে বাহু স্বাভাবিকভাবে লেগে থাকে তারই চেষ্টা করতে হবে। আর তার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই পা ফাঁক করে দাঁড়াতে হবে।
সামনের কাতার খালি থাকলে (রাকআত বা রুকূ ছুটে যাওয়ার ভয়ে) পিছনে দাঁড়ানো বৈধ নয়। যেমন সামনের কাতারে ফাঁক দেখা দিলে তা বন্ধ করা জরুরী। সামনে কাতারে যেতে দূর হলে এবং নামাযের মধ্যে হলেও অগ্রসর হয়ে যেতে হবে কাতার মিলানোর উদ্দেশ্যে। এর জন্য রয়েছে আদেশ, পুরস্কার এবং তিরস্কারও।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭১নং)
তিনি বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর, বাহুমূলসমূহকে পাশাপাশি সমপর্যায় করে দাঁড়াও, কাতারের ফাঁক বন্ধ কর, পার্শ্ববর্তী নামাযী ভাইদের জন্য নিজ নিজহাতসমূহকে নরম কর এবং শয়তানের জন্য (কাতারে) ফাঁক রেখো না। আর যে ব্যক্তি কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায় সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ মিলন (সম্পর্ক) রাখেন এবং যে ব্যক্তি কাতার ছিন্ন করে সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ (সম্পর্ক অথবা কল্যাণ) ছিন্ন করেন।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৬নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের প্রতি রহ্ম করেন এবং ফিরিশ্তাবর্গ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন, যারা কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায়। আর যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ১৮৪৩নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি (কাতারের মাঝে) কোন ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তার জন্য জান্নাতে এক গৃহ্ নিমাGণ করেন।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম আওসাত্ব, সহিহ তারগিব ৫০২নং)
তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ রহ্মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তাবর্গ দুআ করতে থাকেন তাদের জন্য যারা প্রথম কাতার মিলিয়ে (ব্যবধান না রেখে) দাঁড়ায়। আর যে পদক্ষেপ দ্বারা বান্দা কোন কাতারের ফাঁক বন্ধ করতে যায় তা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অন্য কোন পদক্ষেপ অধিক পছন্দনীয় নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, অবশ্য এতে পদক্ষেপের উল্লেখ নেই, সহিহ তারগিব ৫০৪নং)
পাশের নামাযীর জন্য নিজের বাহুকে নরম করে দাঁড়ানো :
পাশের নামাযী যাতে মনে কষ্ট না পায় তার জন্য প্রত্যেক নামাযীর কর্তব্য নিজ নিজ বাহুকে নরম করে রাখা। এতে উভয়ের মনে বিদ্বেষ দূর হয়ে প্রীতির সঞ্চার হবে। দূর হবে ঘৃণা ও কাতারের ফাঁক।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক তারাই, যারা নামাযের মধ্যে নিজেদের বাহুসমূহকে (পাশের নামাযীর জন্য) নরম রাখে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭২নং)
বলা বাহুল্য, পায়ে পা লাগাবার সময়, বাম পা-কে ডান পায়ের নিচে বের করে বসার সময়ও পাশের নামাযীর সাথে কঠেfরতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ নয়। বরং কাতারে চাপাচাপি বা ঠসাঠসি থাকলে পা বের করে অপরকে কষ্ট দেওয়ার চাইতে পা না বের করে উক্ত সুন্নত পালন না করাই উত্তম। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২২/৩০)
কাতারসমূহের মাঝে বেশী দূরত্ব না রাখা :
ইমাম ও প্রথম কাতার এবং অনুরুপ দ্বিতীয় ও তার পরের কাতারসমূহের মাঝে প্রয়োজনের অধিক দূরত্ব রাখা উচিৎ নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা তোমাদের কাতারসমূহকে ঘন কর, কাতারগুলোর মাঝে ব্যবধান কাছাকাছি কর এবং তোমাদের ঘাড়সমূহকে সমপর্যায়ে সোজা রাখ। সেই আল্লাহর কসম! যাঁর হাতে আমার জান আছে, নিশ্চয় আমি শয়তানকে কাল ভেঁড়ার বাচ্চার মত তোমাদের কাতারের ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করতে দেখছি।” (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪২৩, ৪৩৩, ৪৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৭নং)
সামনে কাতার করার মত জায়গা ফাঁক থাকলে পিছনে কাতার বেঁধে নামায হবে না। যেমন পিছনে কাতার বাঁধলে এবং সামনে ফাঁকা জায়গায় রাস্তায় লোক চলাচল করলেও নামায হবে না। মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলে তারপর রাস্তা পূর্ণ হবে এবং তার পরে দোকান ইত্যাদিতে কাতার বাঁধা চলবে। রাস্তা খালি থাকতে দোকানে কাতার বাঁধা বৈধ হবে না। (মাজমূউফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ্ ২৩/৪১০, দ্র: তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮২পৃ:)
থামসমূহের ফাঁকে কাতার না বাঁধা :
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যামানায় এই (থামের ফাঁকে কাতার বাঁধা) থেকে দূরে থাকতাম।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭৩নং, তিরমিযী, সুনান)
হযরত কুর্রাহ্ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যুগে আমাদেরকে থামের ফাঁকে কাতার বাঁধতে নিষেধ করা হত এবং কেউ বাঁধলে তাকে সেখান থেকে দস্তুর মত তাড়িয়ে দেওয়া হত।’ (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১০০২, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী)
এর কারণ হল এই যে, মাঝে থাম হওয়ার ফলে কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই জন্য ইমাম বা একাকী নামাযীর জন্য দুই থামের মাঝে দাঁড়িয়ে নামায পড়া নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। যেমন অধিক ভিঁড়ে মসজিদে জায়গা না থাকলে ঐ জায়গাতেও কাতার বাঁধা প্রয়োজনে বৈধ। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২০৮-২০৯পৃ:)
পরিশেষে ইবনুল কাইয়েম (রহঃ)-এর একটি মূল্যবান উক্তির উল্লেখ করে এ বিষয়ের ইতি টানি; তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সামনে বান্দার দুই সময় দাঁড়াতে হবে। নামাযে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হয় এবং তাঁর সাক্ষাতের সময় (কিয়ামতে) তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে (নামাযে) সঠিকভাবে দাঁড়াবে, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো সহ্জ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে দাঁড়ানোতে অবহেলা প্রদর্শন করবে এবং তার যথার্থ হ্ক আদায় করবে না, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’
৫। ইমামের অনুসরণ করা :
যথা নিয়মে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজেব এ বং তাঁর অন্যথা আচরণ গুনাহর কাজ।
ইমামের পশ্চাতে সাধারণত: মুক্তাদীর ৪ প্রকার আচরণ হতে পারে :
(ক) অগ্রগমন : অর্থাৎ ইমামের আগে-আগে রুকূ-সিজদা করা অথবা মাথা তোলা। এমন আচরণ গুনাহর কাজ। বরং জেনেশুনে স্বেচ্ছায় করলে নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (মিন আহ্কামিস স্বালাহ্, ইবনে উসাইমীন ৪৬পৃ:) যেমন ইমামের আগে তাকবীরে তাহ্রীমা দিলে নামাযের বন্ধনই শুদ্ধ হবে না। ভুলে দিয়ে ফেললে পুনরায় ইমামের তকবীর দেওয়ার পর তকবীর দিতে হবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৬৩পৃ:)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম এই জন্য বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং তার বিরুদ্ধাচরণ করো না।” (মুসলিম, সহীহ ৪১৪নং) “তোমরা ইমামের পূর্বে (কিছু করতে) তাড়াতাড়ি করো না। যখন সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তখন তোমরাও ‘আল্লাহু আকবার’ বল। --- যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকালহাম্দ’ বল।” (ঐ ৪১৫নং) “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬০৩নং)
তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কি এ কথার কে উভয় করে না যে, ইমামের আগে মাথা তুললে তার চেহারা অথবা আকৃতি গাধার মত হয়ে যাবে।” (বুখারী ৬৯১, মুসলিম, সহীহ ৪২৭, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
একদা তিনি মুক্তাদীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১৩৭নং)
(খ) পশ্চাদগমন : অর্থাৎ ইমামের অনেক পিছনে দেরী করে রুকূ-সিজদা করা। ইমাম রু কূ বা সিজদা থেকে উঠে গেলেও মুক্তাদীর দেরী করে রুকূ বা সিজদাতে পড়ে থাকা। এমন করাও বৈধ নয়। কারণ, রসূল (সাঃ) বলেন, “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর।”
(গ) সহ্গমন : অর্থাৎ চটপট ইমামের সাথে সাথেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। এরুপ করাটাও অবৈধ।
(ঘ) অনুগমন : অর্থাৎ, ইমাম রুকূ-সিজদা করলে তবেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। আর এরুপ করাটাই ওয়াজেব।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।”
সাহাবী বারা’ বিন আযেব (উক্ত আমলের ব্যাখ্যায়) বলেন, ‘আমরা নবী (সাঃ)-এর পিছনে নামায পড়তাম। যখন তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্’ বলতেন, তখন আমাদের মধ্যে কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করার জন্য নিজের পিঠ ঝুকাত না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি মাটিতে নিজের কপাল রেখে নিতেন।’ (বুখারী ৬৯০নং, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
ইমামের তকবীর বলার পর তকবীর বলতে হবে। ইমামের ‘আমীন’-এর ‘আ-’ বলতে শুরু করার পরেই ‘আমীন’ বলতে হবে।
কোন ওজরের ফলে ইমামের আগে হয়ে গেলে নামায বাতিল নয়। যেমন কোন ব্যথার কারণে অসহ্য যন্ত্রণায় তাড়াতাড়ি ইমামের আগে সিজদা থেকে উঠে পড়লে তা ধর্তব্য নয়।
তদনুরুপ কোন ওজরের ফলে কেউ ইমামের পিছনে থেকে গেলে তাও ধর্তব্য নয়। যেমন যদি কেউ সিজদায় গিয়ে ঘুমিয়ে গেল, অতঃপর পরের রাকআতে রুকূর সময় জেগে উঠল অথবা কোন বড় জামাআতে বা মসজিদের অন্য তলায় নামায পড়তে পড়তে সূরা ফাতিহা শোনার পর মাইকের শব্দ বন্ধ হওয়ার ফলে ইমামের রুকূ করার কথা ঠিকমত বুঝা না গেলে হ্ঠাৎ করে জানতে পারা গেল যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু---’ বলে রুকূ থেকে উঠছেন -এ ক্ষেত্রে ছুটে যাওয়া রুক্ন নিজে নিজে আদায় করে বাকী নামাযে ইমামের অনুসরণ করবে। আর তার এ নামায হয়ে যাবে।
তবে যে জায়গা থেকে নামায ছুটে গেছে পরের রাকআতে সেই জায়গায় যদি ইমাম চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে তার এক রাকআত বাতিল হবে। সেখান থেকেই ইমামের অনুসরণ করে বাকী নামায পড়ে ইমামের (দুই) সালাম ফিরার পর উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত নিজে পড়ে নেবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৪-২৬৫)
ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে মুক্তাদীর সালাম ফিরা বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৯১)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। সুতরাং তোমরা রুকূ, সিজদা, কি য়াম ও বৈঠকে, আর না সালামে আমার অগ্রবর্তী হ্য়ো না।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত১১৩৭নং)
আফযল হল ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরার পরই সালাম ফিরা। অবশ্য যদি কেউ ইমামের ডান দিকে সালাম ফিরার পর ডান দিকে এবং তাঁর বাম দিকে সালাম ফিরার পর বাম দিকে সালাম ফিরে, তাহলে তা দোষের নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭)
অনেকের মতে ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে যদি মুক্তাদী সালাম ফিরে দেয় অথবা বাকী নামায পড়ার জন্য উঠে যায়, তাহলে তার নামায নষ্ট হয়ে নফলে পরিণত হয়ে যায়। (ফাতওয়া শায়খ সা’দী ১৭৪পৃ:, মুত্বাসা ৯৭পৃ:)
জ্ঞাতব্য যে, গুপ্ত বিষয়সমূহ ইমামের আগে-পিছে বা সাথে-সাথে হলে কোন দোষের নয়। যেমন সির্রী নামাযে সূরা ফাতিহা, কোনও নামাযে তাশাহহুদ ইমামের আগে বা সাথে সাথে পড়া হলে তাতে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, সাধারণত: এর শুরু ও শেষ বুঝা যায় না এবং এ ব্যাপারে ইমামের অনুসরণ করতে মুক্তাদী আদিষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭-২৬৮)
বুকেহাত বাঁধেন না এমন ইমামের পশ্চাতে বুকেহাত বেঁধে এবং রফ্য়ে ইয়াদাইন করেন না এমন ইমামের পশ্চাতে রফ্য়ে ইয়াদাইন করে মুক্তাদীর নামায পড়া ইমামের বিরুদ্ধাচরণ নয়। যেমন যে ইমাম তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতবিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে বাম পা-কে ডান পায়ের রলার নিচে বের করে বসেন না, তাঁর পিছনে মুক্তাদী ঐরুপ বসলে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ হয় না।
জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্ করেন না এমন ইমামের পিছনে নামায পড়লে প্রথম বা তৃতীয় রাকআতের সিজদা থেকে সরাসরি উঠে গেলে মুক্তাদীর জন্য বসা বৈধ নয়। কারণ, এটি ইমামের বাহ্যিক কর্ম। অতএব তিনি দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে যাওয়া চলবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১২)
অবশ্য অনেকে বলেন, এটি হাল্কা বৈঠক। এতে ইমামের বিরুদ্ধাচরণ হয় না। অতএব ইমাম জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্র সুন্নত পালন না করলেও মুক্তাদীর হাল্কা বসে সাথে সাথে উঠে গিয়ে তা পালন করায় দোষ নেই।
ইমাম ফজরের নামাযে হাত তুলে কুনুত পড়লে মুক্তাদীর জন্য হাত তুলে আমীন বলে তাঁর অনুসরণ করা জরুরী। তবে সেই ইমামের পিছনে নামায পড়া উত্তম, যে ফজরে কুনুত পড়ে না। যেহেতু তা বিদআত। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৯৩)
ইমাম সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের প্রতি ফিরে না বসা পর্যন্ত মুক্তাদীর উঠে মসজিদ ত্যাগ করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৩২, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯১)
ইমাম তাশাহ্হুদে দেরী করলে মুক্তাদীর চুপচাপ বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং এ সময়ে সহীহ নববী দুআ দ্বারা মুনাজাত করে আল্লাহর কাছে বহু কিছু চেয়ে নেওয়া উচিৎ। কারণ, এটা হল দুআ কবুল হওয়ার সময়। অনুরুপ প্রথম তাশাহ্হুদে দেরী করলে আধা তাশাহহুদ পড়ে নীরব বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং তাশাহহুদের পর দরুদ এবং তার পরেও সময় থাকলে মু নাজাত করা উচিৎ। আর এ ব্যাপারে তাশাহহুদের বর্ণনায় (১ম খন্ডে) আলোচনা করা হয়েছে।
সতর্কতার বিষয় যে, তাশাহহুদের বৈঠকে ইমামকে দেরী করতে দেখে অনেকে গলা ঝাড়তে শুরু করে। এমন করা তাদের ধৈর্যহীনতা ও অজ্ঞতার পরিচয়।
ইমামের পশ্চাতে ক্বিরাআত
ইমাম সশব্দে ক্বিরাআত করলে মুক্তাদীকে ক্বিরাআত করতে হয় না। বিশেষ করে সশব্দে কোন সূরা পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য বৈধ নয়। বরং ইমামের ক্বিরাআত চুপ করে শুনতে হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
(وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا)
অর্থাৎ, যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শো ন এবং চুপ থাক। (কুরআন মাজীদ ৭/২০৪)
সাহাবাগণ নামাযে সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন। একদা কোন জেহরী নামায থেকে সালাম ফিরে আল্লাহর নবী (সাঃ) বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কি আমার সাথে (সশব্দে) কুরআন পড়েছে?” এক ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “তাতেই আমি ভাবছি যে, আমার ক্বিরাআতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হ্চ্ছে কেন।” আবূ হুরায়রা বলেন, এই কথা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল। (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ৮৫৫নং)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যার ইমাম আছে, তার ইমামের ক্বিরাআত তার ক্বিরাআত।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ৬৪৮৭নং)
তিনি বলেন, “ইমাম তো এই জন্য বানানো হয় যে, তার অনুসরণ করা হবে। অতএব সে যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহু আকবার’ বল এবং যখন ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাক।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে আবী শাইবা, ইবনে মাজাহ্, সুনান, বায়হাকী, জামে ২৩৫৮-২৩৫৯নং)
এ হল সাধারণ হুকুম। জেহরী নামাযে সশব্দে মুক্তাদী কোন ক্বিরাআত করতে পারবে না। কিন্তু নিঃশব্দে কেবল সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। কারণ, সূরা ফাতিহার রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“সেই ব্যক্তির নামায যথেষ্ট নয়, যে তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“যে ব্যক্তি এমন কোনও নামায পড়ে, যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ঐ নামায (গর্ভচ্যুত ভ্রুণের ন্যায়) অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩নং)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)
“উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা) এর মত আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ২১৪২ নং)
সাহাবী উবাদাহ্ বিন সামেত বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর পশ্চাতে ফজরের নামায পড়ছিলাম। তিনি ক্বিরাআত পড়তে লাগলে তাঁকে ক্বিরাআত ভারী লাগল। সালাম ফিরার পর তিনি বললেন, “সম্ভবত: তোমরা ইমামের পিছনে ক্বিরাআত কর।” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রসূল! (আমরা তো তা করি।) তিনি বললেন, “না, ক্বিরাআত করো না। অবশ্য সূরা ফাতিহা পড়ো। কারণ, যে তা পড়ে না তার নামায হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৮২৩নং)
পক্ষান্তরে ইমাম জেহরী নামাযের শেষ এক বা দুই রাকআতে অথবা সির্রী নামাযে নিঃশব্দে ক্বিরাআত করলে অথবা তাঁর ক্বিরাআত শুনতে না পাওয়া গেলেও মুক্তাদী সূরা ফাতিহা অবশ্যই পড়বে এবং সেই সাথে অন্য সূরাও পড়তে পারে।
যে আবূ হুরাইরা বলেন, ‘এই কথা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল।’ সেই (সূরা ফাতিহার গুরুত্ব নিয়ে হাদীস বর্ণনাকারী) আবূ হুরাইরাকে প্রশ্ন করা হল যে, (সূরা ফাতিহার এত গুরুত্ব হলে) ইমামের পশ্চাতে কিভাবে পড়া যাবে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার মনে মনে পড়ে নাও। কারণ, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি ; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রা র্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)
যদি বলেন, আদবের নিয়ম এই যে, জামাআতের মধ্যে একজন কথা বলবে এবং বাকী সবাই চুপ থাকবে। সবাই কথা বললে শ্রোতা বুঝতে পারে না এবং সম্মানিত শ্রোতার শানে বেআদবী হয়।
তাহলে আমরা বলব যে, তাই যদি হয়, তাহলে ইস্তিফতাহ্, তাসবীহ্, তাশাহহুদ ইত্যাদি কেন সবাই বলে থাকে? তাতে কি বেআদবী হয় না? তা কি বুঝতে আল্লাহর অসুবিধা হয় না? তাছাড়া একই সাথে বিশ্বের কত শত মুসলমান একই সময়ে এক সাথে কত ইমাম, কত নফল নামাযী নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন কি এই অসুবিধা হয় না? মানুষের সাথে আল্লাহর তুলনা? নাকি আল্লাহর কুদরতে সন্দেহ্? আসলে যেখানে দলীল আছে সেখানে আকেল দ্বারা কাজ নেওয়া আ ক্কে লের কাজ নয়।
প্রকাশ থাকে যে, যদি কোন কারণবশত: মুক্তাদী ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তে ভুলে যায়, তাহলে তাতে তার নামায হয়ে যাবে। ঐ রাকআত তাকে কাযা করতে হবে না। কারণ, ভুলের আমল ধর্তব্য নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)
সির্রী নামাযে ইমামের পিছনে মুক্তাদী সিজদার আয়াত পাঠ করলে তিলাওয়াতের সিজদা করতে পারে না। তিলাওয়াতের সিজদা সুন্নত। আর ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব। অতএব সুন্নত পালন করতে গিয়ে গুনাহ করতে কেউ পারে না। আবার এ কথা জেনে শুনে কেউ সিজদা করলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ঐ ১/২৯০)
মুক্তাদীর জামাআতে শামিল হওয়ার বিভিন্ন অবস্থা
জামাআত শুরু হয়ে যাওয়ার পর কোন নামাযী নামাযে শামিল হতে চাইলে নিয়মিত দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে তাকে তাই করতে হবে, যা ইমাম করছেন। তাড়াহুড়ো না করে ইমাম যে অবস্থায় থাকবেন সেই অবস্থায় ধীরে-সুস্থ শামিল হতে হবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযে আসার সময় ধীর-স্থিরতার সাথে এস এবং তাড়াহুড়ো করে এসো না। এরপর যা পাবে, তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যাবে, তা পুরা করে নাও।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, জামে ২৭৫নং)
তিনি বলেন, “তোমাদের কেউ নামাযে এলে এবং ইমাম কোন অবস্থায় থাকলে, সে যেন তাই করে, যা ইমাম করছে।” (তিরমিযী, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৮৮, জামে ২৬১নং)
ইমাম সির্রী নামাযে প্রথম রাকআতে কিয়াম অবস্থায় থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে ইস্তিফতাহ্র দুআ পড়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পাঠ করবে। কিন্তু ইমামের রুকূ চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। ফাতিহা পাঠ করতে করতে ইমাম রুকূ চলে গেলে পুরো না পড়েই রুকূতে যেতে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৯) এ ক্ষেত্রে ফাতিহা পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বৈধ নয়।
জেহরী নামাযে ইমামের সূরা ফাতিহা বা অন্য সূরা পাঠ করা অবস্থায় শামিল হলে মুক্তাদী ইস্তিফতাহ্ বা সানা পড়বে না। বরং চুপে চুপে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪)
ইমাম রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদী তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থ যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর রুকুতে যাওয়ার তকবীর পড়ে রুকূতে যাবে এবং রুকূর তাসবীহ পাঠ করবে। অবশ্য সময় সংকীর্ণ বুঝলে কেবল তাহ্রীমার তকবীরই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তকবীরের পর বুকে হাতও রাখবে না এবং সানা বা ফাতিহাও পড়বে না। কারণ, ইমামের অনুসরণ জরুরী। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪২-২৪৩)
রুকূ পেলে রাকআত গণ্য :
ইমামের সাথে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হবে কি না সে বিষয়টি বিতর্কিত। বর্তমান বিশ্বের সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের সুচিন্তিত মতানুসারে রুকু পেলে রাকআত গণ্য হবে।
এ ব্যাপারে যে সকল স্পষ্ট হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও এক জামাআত সাহাবার আমল এ কথার সমর্থন করে।
এ ব্যাপারে ইবনে মাসঊদ, ইবনে উমার, যায়দ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন আম্র প্রভৃতি কর্তৃক রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে। পক্ষান্তরে আবূ বাকরার সহীহ হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে হাদীসটিকে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার দলীল হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আবূ বাকরাহ্ একদা মসজিদ প্রবেশ করতেই দেখলেন নবী (সাঃ) রুকূতে চলে গেছেন। তিনি তাড়াহুড়ো করে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই রুকূ করলেন। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। একথা নবী (সাঃ)-কে বলা হলে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, “আল্লাহ তোমার আগ্রহ্ আরো বৃদ্ধি করুন। আর তুমি দ্বিতীয় বার এমনটি করো না। (অথবা আর তুমি ছুটে এসো না। অথবা তুমি নামায ফিরিয়ে পড়ো না।)” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১১০নং)
উক্ত হাদীসে রুকূ পেলে রাকআত পেয়ে নেওয়ার কথা ইঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া আর একটি সুন্নতের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে ইমামকে রুকূর অবস্থায় দেখে তাহলে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই তার জন্য রুকূ করা সুন্নত। তাতে যদি সে ইমামের মাথা তোলার পর কাতারে শামিল হয় তাহলেও তার ঐ রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮৬পৃ:)
ইবনুয যুবাইর (রাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে (জামাআতের) লোকেরা রুকূর অবস্থায় আছে, তাহলে সে যেন প্রবেশ করেই রুকূ করে। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে শামিল হয়। কারণ, এটাই হল সুন্নাহ্।” (ত্বাবরানী, আওসাত্ব, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ১৫৭১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৪, বায়হাকী ৩/১০৬, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২২৯নং, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/২৬০-২৬৫)
মোট কথা, কেউ যদি ইমামকে রুকূর অবস্থায় পেয়ে তাঁর সাথে রুকূর (কমপক্ষে একবার) তাসবীহ পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে তার সে রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। কিয়াম ও সূরা ফাতিহা না পেলেও রাকআত হয়ে যাবে। সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। কিন্তু কিয়াম অবস্থায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে ইমামের সাথে রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদীর হ্ক্কে তা মার্জনীয়। কারণ, সাধারণ দলীল থেকে এ ব্যাপারটাও ব্যতিক্রম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪৪) পরন্তু ইচ্ছা করে যদি কেউ কিয়ামে শামিল না হয়ে (লম্বা তারাবীহ্র) রুকূতে শামিল হয়, তাহলে তার ঐ রাকআত হবে না। কারণ সে ইচ্ছাকৃত নামাযের একটি রুক্ন কিয়াম ও সূরা ফাতিহা ত্যাগ করে।
সতর্কতার বিষয় যে, ইমাম রুকূ অবস্থায় থাকলে মসজিদে প্রবেশ করে অনেক মুক্তাদী তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার আশায় গলা ঝাড়া দিয়ে ইমামকে সতর্ক করে। এমন করা বৈধ নয়।
ইমাম কওমার অবস্থায় থাকলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর কওমার দুআ পাঠ করবে। এ ক্ষেত্রে আর রাকআত গণ্য হবে না।
ইমাম সিজদায় চলে গেলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর (বুকেহাত না বেঁধে) আবার তকবীর বলে সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করবে। আর এ ক্ষেত্রেও রাকআত গণ্য হবে না এবং ইমামের দ্বিতীয় রাকআতে কিয়ামে দাঁড়ানোর সময় ইস্তিফতাহও পড়বে না। বরং ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমরা সিজদারত থাকা অবস্থায় তোমরা নামাযে এলে তোমরাও সিজদা কর এবং সেটাকে কিছুও গণ্য করো না।” (বুখারী ৫৫৬, মুসলিম, সহীহ ৬০৭-৬০৮, আবূদাঊদ, সুনান ৮৯৩নং)
ইমাম দুই সিজদার মাঝের বৈঠকে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকেহাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ বৈঠকের দুআ পাঠ করবে।
ইমাম শেষ সিজদায় থাকলেও তাঁর জন্য উঠে দাঁড়ানোর অপেক্ষা বৈধ নয়। বরং যথানিয়মে সিজদায় যেতে হবে এবং যথানিয়মে ইমামের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিজদা খামাখা নষ্ট করা উচিৎ নয়। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “তুমি আল্লাহর জন্য অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও; কারণ যখনই তুমি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করবে তখনই আল্লাহ তার বিনিময়ে তোমাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং তার দরুন একটি গুনাহ মোচন করবেন।” (মুসলিম, সহীহ ৪৮৮নং তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক বান্দাই, যখন সে আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন, তার একটি গুনাহ ক্ষালন করে দেন এবং তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী করে সিজদা কর।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৩৭৯নং)
বলাই বাহুল্য যে, ইমামের রুকূ থেকে মাথা তোলার পর রাকআতের কোন অংশে শামিল হলে ঐ রাকআত গণ্য হবে না। ইমাম সালাম ফিরে দিলে ঐ নামাযী সালাম না ফিরে তকবীর দিয়ে উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত একাকী যথানিয়মে পূরণ করে সালাম ফিরবে।
অনুরুপ দ্বিতীয় রাকআতে শামিল হলে অনুরুপভাবে রাকআত গণ্য ও অগণ্য হবে।
ইমাম তাশাহ্হুদে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকে হাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ তাশাহহুদের দুআ পাঠ করবে। এর ফলে কোন কোন ৪ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ বার, ৩ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ থেকে ৪ বার এবং ২ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ২ বার তাশাহহুদ হয়ে যেতে পারে।
যেমন যোহ্র, আসর বা এশার নামাযের প্রথম তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল হলে মুক্তাদী ইমামের সাথে ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। আর তার হবে প্রথম তাশাহহুদ। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ তাশাহহুদ।
অনুরুপভাবে দ্বিতীয় রাকআতে বা শেষ তাশাহ্হুদে শামিল হলে ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায আদায় করলেও যথানিয়মে তার ৩টি তাশাহহুদ হবে।
মাগরেবের নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর পর বা প্রথম তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথে শেষের রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়তে প্রথম যে রাকআত সে একাকী পড়বে সেটি তার দ্বিতীয় রাকআত। ফলে সে তার হিসাবে সে প্রথম তাশাহহুদ পড়বে। তারপর উঠে তৃতীয় রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে ঐ মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ রাকআতে ৪টি তাশাহহুদ।
কিন্তু এই নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর আগে বা রুকূতে শামিল হলে প্রত্যেক রাকআতে ১টি করে মোট ৩টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে। যেমন শেষ তাশাহ্হুদে শামিল হলেও যথানিয়মে ৩টি তাশাহহুদ হবে।
ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতে অথবা তাশাহ্হুদে শামিল হলে ২ রাকআত নামাযে ২টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে।
অবশ্য তাশাহহুদ বেশী হওয়ার জন্য কোন সহু সিজদা লাগবে না।
প্রকাশ থাকে যে, মুক্তাদী ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একাকী যে নামায পড়বে সেগুলো তার শেষ রাকআত। অতএব শেষ রাকআত গুলো সে একাকী যে নিয়মে পড়ে ঠিক সেই নিয়মে আদায় করবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৬৬, ১৮/১০৭, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৮) জেহরী নামায হলে জেহরী ক্বিরাআতে যদি পাশের নামাযীর ডিষ্টার্ব না হয়, তাহলে জেহরী, নচেৎ সির্রী ক্বিরাআত করে নামায শেষ করবে। যেহেতু একাকী নামাযে জোরে জোরে ক্বিরাআত বাধ্যতামূলক নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৪০)
ইমাম সালাম ফিরে দিলে আর জামাআতে শামিল না হয়ে অন্য নামাযী থাকলে তাকে নিয়ে দ্বিতীয় জামাআত করে নামায পড়বে।
ইমাম প্রথম সালাম ফিরে শেষ করলেই মসবূক নিজের বাকী নামায পড়ার জন্য উঠতে পারে। কারণ, এক সালামেও নামায হয়ে যায়। তবে সতর্কতার বিষয় যে, তাঁর সালাম শুরু করার সাথে সাথে উঠবে না। পক্ষান্তরে অনেকে বলেছেন, ইমাম যতক্ষণ দ্বিতীয় সালাম থেকে ফারেগ না হয়েছেন, ততক্ষণ উঠা বৈধ নয়। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, কোন মসবূক যেন ইমামের উভয় সালাম ফিরে শেষ না করা পর্যন্ত তার বাকী নামায আদায় করতে না উঠে। (মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ৪১পৃ:) মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)
অনেকে বলেছেন, ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে উঠে গেলে মসবূকের নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ফাতাওয়াশ শায়খ ইবনি সা’দী ১৭৪পৃ:, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ৯৬-৯৭পৃ:) অতএব নামাযী সাবধান!
মসবূকের ইক্তিদা
যদি কোন নামাযী মসজিদে এসে দেখে যে জামআত শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু মসবূক (যাদের কিছু নামায ছুটে গেছে তারা) উঠে একাকী নামায পূর্ণ করছে, তাহলে জামাআতের সওয়াব লাভের আশায় ঐ নামাযীর কোন এক মসবূকের ডাইনে দাঁড়িয়ে তার ইক্তিদা করে নামায পড়া বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৬)
কিন্তু শায়খ ইবনে উষাইমীন (রহঃ) বলেন, এর যেহেতু সঠিক প্রমাণ নেই এবং অনেকে এরুপ শুদ্ধ নয় বলেছেন, সেহেতু তা না করাই উত্তম। আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে বিষয়ে সন্দেহ্ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ্ নেই।” (তিরমিযী, সুনান ২৫১৮, জামে ৩৩৭৮নং) “সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে।” (বুখারী ৫২, মুসলিম, সহীহ ১৫৯৯নং) বলা বাহুল্য, অনেকে তা জায়েয বললেও না করাটাই উত্তম। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৭১, লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ৫৩-৫৪পৃ:)
আয়াতের জবাবে মুক্তাদীর দুআ বলা
(নিঃশব্দে) কতিপয় আয়াতের জবাব দেওয়া এবং (যে কোনও নামাযে) রহ্মতের আয়াত পঠিত হলে সেই সময় আল্লাহর রহ্মত ভিক্ষা করা এবং আযাবের আয়াত পঠিত হলে সেই সময়ে আল্লাহর আযাব থেকে পানাহ চাওয়া মুক্তাদীর জন্যও মুস্তাহাব। অবশ্য শর্ত হল, তাতে যেন ইমামের ক্বিরাআত শোনাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।
অতএব ইমাম দুআ পড়লে মুক্তাদীও পড়বে। নচেৎ ইমাম একটানা ক্বিরাআত করে গেলে আয়াতের জবাবে বা অন্য কোন দুআ পড়া বৈধ হবে না। কারণ তাতে মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে আদেশ লঙ্ঘন করা হবে। যেহেতু ইমাম ক্বিরাআত করলে মুক্তাদী চুপ থেকে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে আদিষ্ট হয়েছে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪-৩৯৫)
ইমাম ভুল করলে মুক্তাদীর কর্তব্য
ইমাম কোন ভুল করলে মুক্তাদীর তা ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করে দেওয়া কর্তব্য। আর বড় মারাত্মক ভুলে (যেমন নামাযের কোন শর্ত বা রুক্ন ছাড়াতে) তাঁর অনুসরণ করা মোটেই উচিৎ নয়।
ইমাম ভুলে বিনা ওযূতে নামায পড়ালে এবং মুক্তাদীরাও তা জানতে না পারলে, অতঃপর নামায শেষ করার পর জানা গেলে মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য ইমামকে সে নামায পুনরায় পড়তেই হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৩৯, লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ৯৯পৃ:)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “লোকেরা তোমাদের ইমামতি করে; সুতরাং তারা যদি ঠিকভাবে পড়ায় তাহলে তা তোমাদের জন্য এবং তাদের জন্যও। (অর্থাৎ, তোমাদের নামায হয়ে যাবে এবং তাদেরও।) পক্ষান্তরে তারা যদি ভুল পড়ায় তাহলে তোমাদের (নামায শুদ্ধ) হয়ে যাবে এবং ওদের (নামায শুদ্ধ) হবে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মিশকাত ১১৩৩নং)
একদা হযরত উমার (রাঃ) অপবিত্র অবস্থায় ভুলে লোকেদের ইমামতি করলেন। অতঃপর তিনি নিজে নামায ফিরিয়ে পড়লেন আর লোকেরা পড়ল না। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ৩/১৪৭)
নামায পড়া অবস্থায় ইমাম যদি জানতে পারে যে, সে নাপাকে আছে অথবা তার ওযূ ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু লজ্জায় সে নামায ত্যাগ না করে পড়ে শেষ করে তাহলেও মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য ইমামের নামায বাতিল এবং তার জন্য জেনে শুনে নাপাকে নামায পড়া হারাম।
পক্ষান্তরে মুক্তাদী যদি জানতে পারে যে, ইমাম নাপাক অবস্থায় নামায পড়াচ্ছেন, তাহলে তারও নামায বাতিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪০)
বলা বাহুল্য, ইমাম হোক চাহে মুক্তাদী নামায পড়তে পড়তে কারো ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে অথবা নাপাকে আছে মনে পড়লে সে নাক ধরে নামায ছেড়ে বের হয়ে আসবে।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযে বেওযূ হয়ে যায়, তখন সে যেন নাক ধরে নামায ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪নং)
নাক ধরে বেরিয়ে আসার পশ্চাতে হিকমত এই যে, যাতে লোকেরা মনে করে, তার নাক দিয়ে হয়তো রক্ত আসছে। আর এটা মিথ্যা নয়; বরং এটি এক প্রকার ছদ¹কর্ম, যা তার জন্য বৈধ করা হয়েছে। যাতে সে লোকেদেরকে লজ্জা করলে শয়তান তাকে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধা না দেয়।
- ইমামের ইমামতি করায় কোন সমস্যf দেখা দিলে
ইমামতি করতে করতে ইমামের কোন প্রতিবন্ধক বা সমস্যা সৃষ্টি হলে; যেমন ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে, অথবা ওযূ নেই বা ফরয গোসল বাকী আছে মনে পড়লে, অথবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে, অথবা গলার আওয়ায বন্ধ হয়ে গেলে, অথবা নাক থেকে রক্ত পড়লে, অথবা প্রস্রাব-পায়খানার বেগ বেসামাল হয়ে উঠলে, ইমাম তৎক্ষণাৎ একজন উপযুক্ত মুক্তাদীকে ইমাম বানিয়ে নাক ধরে মসজিদ ত্যাগ করবেন।
নামায পড়ার পড় ইমাম কাপড়ে নাপাকী দেখলে সকলের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। নামায পড়তে পড়তে দেখলে যদি তা সেই অবস্থাতেই দূর করা সম্ভব হয় তো উত্তম। নচেৎ নামায ত্যাগ করে বেরিয়ে এসে কাপড় পবিত্র করা জরুরী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪৩)
নামায পড়তে দাঁড়িয়ে হযরত উমার (রাঃ)-কে খঞ্জরাঘাত করা হলে তিনি হযরত আব্দুর রহ্মান বিন আওফকে আগে বাড়িয়ে ইমামতি করতে ইঙ্গিত করলে তিনি হাল্কাভাবে নামায পড়িয়ে শেষ করলেন। (বুখারী ৩৭০০নং)
একদা নামায পড়তে পড়তে হযরত আলী (রাঃ)-এর নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে তিনি একজনকে তার হাত ধরে আগে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে বেরিয়ে এলেন। (সুনান সাঈদ বিন মানসূর, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৫৬পৃ:)
কোন মসবূক (যার দু-এক রাকআত ছুটে গেছে এমন মুক্তাদী)কে ও ইমামতি করতে আগে বাড়িয়ে দেওয়া ইমামের জন্য বৈধ।
সেই সময় কোন অমুক্তাদী (তখনও জামাআতে শামিল হয়নি এমন) লোককেও ইমাম করা যায়। এ ক্ষেত্রে সে ইমামের তরতীব অনুযায়ী নামায পড়বে। মুক্তাদীদের নামায শেষ হয়ে গেলে তারা বসে তার সালাম ফিরার অপেক্ষা করবে। (অর্থাৎ, তার অনুসরণে নির্ধারিত রাকআত অপেক্ষা বেশী পড়বে না।) অতঃপর সে তার বাকী নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরলে মুক্তাদীরাও তার সাথে সালাম ফিরবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৭৩, আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ২৪৫-২৫১পৃ:)
ইমাম যদি কাউকে নায়েব করতে সুযোগ না পান, তাহলে উপযুক্ত একজন মুক্তাদীর অগ্রসর হয়ে ইমামতি করে নামায সম্পন্ন করা কর্তব্য। অবশ্য এও বৈধ যে, ইমাম নামায ত্যাগ করলে মুক্তাদীরা নিজে নিজে একাকী নামায সম্পন্ন করবে। যেমন হযরত মুআবিয়াকে ইমামতি করা অবস্থায় আক্রমণ করা হলে লোকেরা নিজে নিজে নামায শেষ করেছিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪১, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৫৬পৃ:)
- ইমামের শরমগাহ্ খোলা দেখলে
নামায পড়তে পড়তে মুক্তাদী ইমামের শরমগাহ্ খোলা দেখলে চুপ থেকে তাঁর ইক্তিদা করে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, সে জানে যে, শরমগাহ্ বের হয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যায়। আর যার নামায বাতিল, তার ইক্তিদা করা বৈধ নয়। অতএব জরুরী হল, নামায ছেড়ে ইমামকে সে বিষয়ে সতর্ক করা। (ইবনে বায, মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২৬পৃ:)
- ইমাম সূরা ভুল পড়লে
ইমাম সূরা ভুল পড়লে সংশোধন করা, কোন আয়াত ভুলে ছেড়ে দিলে তা ধরিয়ে দেওয়া মুক্তাদীর কর্তব্য।
‘নামাযের মধ্যে যা করা বৈধ’ শিরোনামে এ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে যে, ইমাম সূরা ফাতিহায় ভুল করলে তা ধরিয়ে বা সংশোধন করে দেওয়া মুক্তাদীর জন্য ওয়াজেব। এ ছাড়া অন্যান্য সূরা ভুল পড়লেও মনে করিয়ে দেওয়া বিধেয়।
ইমাম সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ করার সময় কোন আয়াতে গিয়ে আটকে গেলে এবং মুক্তাদীদের কারো সে সূরা মুখস্থ না থাকলে বা কেউ ধরিয়ে না দিলে তিনি দুয়ের মধ্যে এক করতে পারেন; (কয়েক আয়াত পড়া হয়ে থাকলে) তিনি ইচ্ছা করলে তকবীর দিয়ে রুকূতে চলে যেতে পারেন। নতুবা (বিশেষ করে ক্বিরাআতের শুরুতে হলে) অন্য সূরা বা সূরার কতক আয়াত পাঠ করে রুকূতে যেতে পারেন। পক্ষান্তরে সূরা ফাতিহা পড়তে পড়তে আটকে গেলে তাকে যে কোন প্রকারে সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করতেই হবে। নচেৎ নামাযই হবে না। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২৬পৃ:)
মুক্তাদী কেউ হাফেয না থাকলে কোন লম্বা নামাযে হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কোন মুক্তাদীর মুসহাফ নিয়ে নামাযে দেখে যাওয়া প্রয়োজনে বৈধ। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৬৫)
ইমাম ভুল করে নামাযের কোন রুক্ন বা রাকআত ত্যাগ করলে মুক্তাদী ‘সুবহানাল্লাহ্’ বলে সতর্ক করবে। রাকআত বেশী করলে তাতে তাঁর অনুসরণ করবে না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৭) বরং তাসবীহ বলে তাঁকে বসে যেতে ইঙ্গিত করবে।
পক্ষান্তরে ইমাম প্রথম তাশাহহুদের বৈঠক ছেড়ে ভুলে উঠে পড়লে মুক্তাদীও তাঁর সাথে উঠে যাবে। এ ক্ষেত্রে বারবার তাসবীহ পড়ে তাঁকে বসতে বাধ্য করবে না এবং ইমামও বসতে বাধ্য হবেন না। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা ‘সহু সিজদার’ বর্ণনায় আসবে।)
সতর্কতার বিষয় যে, মুক্তাদীদের মাঝে ভুল বুঝার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেই ক্বারী ইমামের উচিৎ নয়, নামাযের ভিতরে প্রচলিত ক্বিরাআত ছাড়া অন্যান্য বিরল ক্বিরাআতে সূরা পড়া। কারণ, নামাযের ভিতরে একাধিক নিয়মে ক্বিরাআত পড়া বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩১৭পৃ:)
একই নামায দুইবার পড়া যায় কি?
একই নামায দুইবার পড়া নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “একই নামাযকে একই দিনে দুইবার পড়ো না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৯নং)
একদা তিনি এক সাহাবীকে ফজরের পরে নামায পড়তে দেখে বললেন, “এটি আবার কোন্ নামায? (ফজরের নামায কি দুইবার?)” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৬৭, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
কিন্তু যদি কেউ কোন অসুবিধার কারণে বাসায় নামায পড়ে নিয়ে মসজিদে এসে দেখে যে, তখনও জামাআত চলছে, তাহলে জামাআতের ফযীলত পাওয়ার আশায়, এক জামাআতে (মসজিদে) নামায পড়ার পর দ্বিতীয় জামাআতে (মসজিদে) কোন কাজের খাতিরে গিয়ে জামাআত চলছে দেখলে অধিক সওয়াবের আশায়, ইমাম অত্যন্ত দেরী করে নামায পড়লে আওয়াল অক্তে নামায পড়ে নেওয়ার পর পুনরায় ঐ ইমামের জামাআতে এবং এ সকল ক্ষেত্রে নফলের নিয়তে ও বেনামাযী বা জামাআত ত্যাগী হওয়ার অপবাদ অপনোদন করার উদ্দেশ্যে একই নামায দ্বিতীয়বার পড়া উত্তম। অনুরুপ কোন সাধারণ মসজিদের ইমাম শ্রেষ্ঠতর মসজিদে (মাহাত্মপূর্ণ ৪ মসজিদের কোন একটিতে) নামায পড়ার পর নিজের মসজিদে ইমামতি করার জন্য, অথবা একাকী নামাযীকে জামাআতের সওয়াব অর্জন করাবার উদ্দেশ্যেও পড়ে নেওয়া নামায নফলের নিয়তে পুনরায় পড়া যায়।
একদা মসজিদে খাইফে তিনি ফজরের নামাযে সালাম ফিরে দেখলেন, মসজিদের এক প্রান্তে দুই ব্যক্তি জামাআতে নামায পড়েনি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমরা আমাদের বাসায় নামায পড়ে নিয়েছি।’ তিনি বললেন, “এমনটি আর করো না। বরং যখন তোমাদের কেউ নিজ বাসায় নামায পড়ে নেয়, অতঃপর (মসজিদে এসে) দেখে যে, ইমাম নামায পড়ে নি, তখন সে যেন (দ্বিতীয়বার) তাঁর সাথে নামায পড়ে। আর এ নামায তার জন্য নফল হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৫, তিরমিযী, সুনান ২১৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১১৫২, জামে ৬৬৭নং)
সাহাবী মিহ্জান (রাঃ) এক মজলিসে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সাথে বসেছিলেন। ইতিমধ্যে আযান (ইকামত) হলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) উঠে গেলেন। তিনি নামায পড়ে এসে দেখলেন, মিহ্জান তাঁর সেই মজলিসেই বসে আছেন। আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, “লোকেদের সাথে নামায পড়তে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি মুসলিম নও?” মিহ্জান বললেন, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল! তবে আমি আমার ঘরে নামায পড়ে নিয়েছি।’ এ কথা শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, “তুমি নামায পড়ার পর যখন মসজিদে আস এবং নামাযের জামাআত শুরু হয়, তখন তুমিও লোকেদের সাথে নামায পড়ে নাও; যদিও তুমি পূর্বে সে নামায পড়ে নিয়ে থাক।” (মালেক, মুঅত্তা, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩৩৭নং)
একদা মহানবী (সাঃ) আবূ যার (রাঃ)-কে বললেন, “তোমার অবস্থা কি হবে, যখন এমন এমন আমীর হবে, যারা নামায মেরে ফেলবে অথবা যথাসময় থেকে দেরী করে পড়বে?” আবূ যার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি আমাকে কি আদেশ করেন?’ তিনি বললেন, “তুমি যথাসময়ে নামায পড়ে নাও। অতঃপর যদি সেই নামায তাদের সাথে পাও, তাহলে তা আবার পড়ে নাও; এটা তোমার জন্য নফল হবে।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৬০০নং)
মুআয বিন জাবাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর সাথে তাঁর মসজিদে (নববীতে) নামায পড়তেন। অতঃপর নিজ গোত্রে ফিরে এসে ঐ নামাযেরই ইমামতি করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৫০ নং)
মহানবী (সাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়তে দেখলে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এমন কেউ কি নেই, যে এর সাথে নামায পড়ে একে (জামাআতের সওয়াব) দান করে?” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৪, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬ নং) অথচ সে মহানবী (সাঃ) এর সাথে ঐ নামায পূর্বে পড়েছিল।
দুটি নামাযের মধ্যে কোন্ নামাযটি নফল হবে সে বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘উভয় নামাযের মধ্যে কোন্টি আমার (ফরয) নামায গণ্য করব?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ এখতিয়ার কি তোমার আছে? এ এখতিয়ার আছে একমাত্র আল্লাহ আয্যা জাল্লারই। তিনি উভয়ের মধ্যে যেটিকে ইচ্ছা ফরয রুপে গণ্য করবেন।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১১৫৬নং) অবশ্য পূর্বোক্ত অনেক বর্ণনায় স্পষ্ট আছে যে, শেষের নামাযটাই নফল গণ্য হবে।
ইমামের তকবীর পৌছানো
ইমামের আওয়াজ ক্ষীণ হলে অথবা জামাআত বড় হলে ইমামের তকবীর সকল মুসল্লী পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে মুক্তাদীর উচ্চস্বরে তকবীর বলা বৈধ।
একদা মহানবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বসে বসে নামায পড়েন। তাঁর আওয়াজ ছিল ক্ষীণ। হযরত আবূ বাক্র (রাঃ) তাঁর তকবীর শুনে তকবীর বলছিলেন এবং লোকেরা আবূ বাকরের তকবীর শুনে তকবীর বলছিল। (বুখারী ৭১২-৭১৩, মুসলিম, সহীহ)
মুক্তাদীদের মধ্যে যে মুবাল্লেগ নির্বাচিত হবে সে ইমামের তকবীর বলার পরই তকবীর বলবে। তাঁর আগে-আগে বা সাথে-সাথে বলবে না। ইমাম ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্’ বললে মুবাল্লেগ ‘রাব্বানা অলাকালহাম্দ’ বলবে।
প্রকাশ থাকে যে, মুবাল্লেগ হল প্রয়োজনের ক্ষেত্রে। অপ্রয়োজনে অর্থাৎ যেখানে সকল নামাযী ইমামের তকবীর শুনতে পায় সেখানে মুবাল্লেগের তকবীর পড়া ঘৃণিত বিদআত। (ফিকহুস সুন্নাহ্ আরাবী ১/২১৬, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ৬২পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ৯৪পৃ:)
মাইক যন্ত্র মুসলিমদের জন্য এক বড় নেয়ামত। আওয়াজকে দূরে ও জোরে পৌঁছানোর জন্য তার অবদান বিরাট। আর এটি আযান, ইকামত, খোতবা ও নামাযের জন্য ব্যবহার করা বিদআত নয়। যেমন বিদআত নয় বিশাল জনসভা ও ইজতেমায় তার মাধ্যমে বক্তৃতা ও ওয়ায-নসীহত করা। বলা বাহুল্য, যেখানে মাইকের মাধ্যমে সকল মুক্তাদী ইমামের তকবীরের শব্দ অনায়াসে শুনতে পারে সেখানে মুবাল্লেগের প্রয়োজন নেই। আর যেখানে মাইক ব্যবহার করা বিদআত নয় সেখানে বিশাল জামাআতে ৫০টা বা তারও বেশী সংখ্যক মুবাল্লেগ রেখে নামায পড়া অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জন। এর ফলে ইমামের আওয়াজ শেষ কাতারে পৌঁছতে পৌঁছতে এমন হয় যে, ইমাম যখন সিজদা থেকে মাথা তুলেন, শেষের কাতারের মুসল্লীরা তখন রুকূ থেকে মাথা তোলে! ফলে জামাআতের মাঝে বিরাট বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। (মু’জামুল বিদা’ ২৫, ৩৩৪পৃ:) আশ্চর্যের বিষয় যে, উক্ত প্রকার ইজতেমায় ওয়ায-নসীহত মাইকে হয়, কিন্তু নামায হয় বিনা মাইকে। হয়তো বা ওঁদের নিকট প্রথমটা বিদআত নয় এবং দ্বিতীয়টি বিদআত! কি জানি এ কোন্ বিচার?
এক নামায পড়ার পর অপর নামাযের জন্য অপেক্ষা করার ফযীলত
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নামাযের অবস্থাতেই থাকে যতক্ষণ নামায তাকে (অন্যান্য কর্ম হতে) আটকে রাখে। তাকে নামায ব্যতীত অন্য কিছু তার পরিবারের নিকট ফিরে যেতে বাধা দেয় না।” (বুখারী ৬৫৯নং, মুসলিম ৬৪৯নং)
বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় এরুপ এসেছে, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নামাযেই থাকে যতক্ষণ নামায তাকে আটকে রাখে। (আগামী নামায পড়ার জন্য অপেক্ষা করে মসজিদেই বসে থাকে।) আর সেই সময় ফিরিশ্তাবর্গ বলতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! ওর প্রতি সদয় হও।’ (এই দুআ ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে) যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নামাযের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা তার ওযু নষ্ট হয়েছে।” (বুখারী ৩২২৯নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের পর আর এক নামাযের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তি সেই অশ্বারোহীর সমতুল্য যে তার অশ্বসহ্ আল্লাহর পথে শত্রুর বিরুদ্ধে বিক্রমের সাথে সদা প্রস্তুত; যে থাকে বৃহ্ৎ প্রতিরক্ষার কাজে।” (আহ্মদ, ত্বাবারানীরানীর আওসাত্ব, সহীহ তারগীব ৪৪৭নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের জন্য বসে প্রতীক্ষারত ব্যক্তি নামাযের দন্ডায়মান ব্যক্তির মত। তার নাম নামাযে মশগুল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত থাকে -তার স্বগৃহ্ থেকে বের হওয়া হতে পুনরায় গৃহে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত।” (ইবনে হিব্বান, আহ্মদ, প্রমুখ, সহীহ তারগীব ৪৫১নং)
আরও পড়ুনঃ স্বালাতে মুবাশ্শির (১ম পর্ব)
আরও পড়ুনঃ স্বালাতে মুবাশ্শির (৩য় পর্ব)
আরও পড়ুনঃ কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে রাতের সালাত
তাশাহহুদ শেষ করে তিন বা চার রাকআত বিশিষ্ট নামাযের জন্য যখন মহানবী (সাঃ) উঠতেন, তখন ‘তকবীর’ (আল্লাহু আকবার) বলতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৯নং) তিনি ওঠার পূর্বেই তকবীর দিতেন। (আবূ য়্যা’লা, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬০৪নং) ওঠার পর নয়।
দুই হাত দ্বারা মাটির উপর ভর করে (খমীর সানার মত উভয় হাতকে মাটিতে রেখে) উঠে খাড়া হতেন। (আবূ ইসহাকহারবী, বায়হাকী, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৯৬পৃ:)
আযরাক বিন কাইস বলেন, আমি ইবনে উমার (রাঃ) কে দেখেছি, তিনি যখন দ্বিতীয় রাকআত থেকে (তৃতীয় রাকআতের জন্য) উঠতেন, তখন তাঁর উভয়হাত দ্বারা মাটির উপর ভর করতেন। পরে আমি তাঁর ছেলে ও তাঁর সঙ্গীদেরকে বললাম, ‘সম্ভবত: এরুপ তিনি তাঁর বাধ্যকের কারণে করে থাকেন।’ কিন্তু তাঁরা বললেন, ‘না, বরং এইরুপই হবে।’ (অর্থাৎ, এইরুপ ওঠাই সুন্নত।) (বায়হাকী ২/১৩৫, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২০০পৃ:)
এই সময় তিনি ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯৪নং) খাড়া হওয়ার পর তিনি দ্বিতীয় রাকআতের মত সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। কিন্তু এই রাকআতে অন্য সূরা পাঠ করতেন না। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮২৮নং)
অবশ্য কখনো কখনো যোহরের নামাযে (প্রায় ১৫) আয়াত মত অন্য সূরা পাঠ করতেন। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৯, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৫০৯, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৩, ১৭৮পৃ:)
সুতরাং শেষ (তৃতীয় ও চতুর্থ) রাকআতে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ করা ও না করা উভয়ই বৈধ। যোহরের নামাযের উপর কিয়াস করে অন্যান্য নামাযেও পড়া বৈধ। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ১/২৫৬, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৩পৃ:)
তাছাড়া উক্ত হাদীসে সাহাবাগণ তাঁর যোহরের প্রথম দু’ রাকআতে প্রায় ৩০ আয়াত মত, শেষ দু’ রাকআতে তার অর্ধেক প্রায় ১৫ আয়াত মত, আসরের প্রথম দু’ রাকআতে তার অর্ধেক প্রায় ৭/৮ আয়াত মত এবং শেষ দু’ রাকআতে তার অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৩/৪ আয়াত মত পড়া আন্দাজ করতেন। এতে বুঝা যায় যে, আসরের শেষ দু’ রাকআতেও অন্য সূরা (অপেক্ষাকৃত ছোট ধরনের) পড়া চলবে।
এ ছাড়া আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নামাযে ক্বিরাআত আছে ----। কিন্তু যে ব্যক্তি কেবল সূরা ফাতিহা পড়বে, তা তার জন্য যথেষ্ট হবে। আর যে ব্যক্তি এর বেশী পড়বে, তা তার জন্য উত্তম হবে।’ (বুখারী ৭৭২, মুসলিম, সহীহ ৩৯৬ নং) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘পুরো নামাযেই ক্বিরাআত পড়া হয়---।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৬ নং) অর্থাৎ প্রত্যেক রাকআতেই। হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, ‘নামাযের সমস্ত রাকআতেই ক্বিরাআত মুস্তাহাব।’ অবশ্য আবূ হুরাইরার এইহাদীসের প্রকাশ্য অর্থ তাই ইঙ্গিত করে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৯৫) সুতরাং সূরা ফাতিহার পর মহানবী (সাঃ) এর অন্য এক সূরা পড়া ও না পড়ার ব্যাপারে উভয় প্রকার বর্ণনা থাকায় এ কথা বলা যায় যে, তিনি শেষ দু’ রাকআতে কখনো কখনো সূরা পড়তেন, আবার কখনো পড়তেন না।
মোট কথা, তিন বা চার রাকআত নামাযে সূরা ফাতিহার পর প্রত্যেক রাকআতেই সূরা লাগানো যায়। কোন রাকআতেই না লাগালেও চলে। আবার কেবল প্রথম দু’ রাকআতে লাগিয়ে শেষ রাকআতগুলিতে না পড়লেও চলে। সব রকমই জায়েয।
ক্বিরাআতের পর মহানবী (সাঃ) বাকী রুকূ, কওমাহ্, সিজদাহ ও বৈঠক প্রভৃতি পূর্বের রাকআতের মত করে মাটির উপর উভয়হাত দ্বারা ভর করে তকবীর বলে চতুর্থ রাকআতের জন্য উঠে খাড়া হতেন। আর এই সময় তিনি কখনো কখনো ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান)
চতুর্থ রাকআত
নামায ৩ রাকআত বিশিষ্ট (মাগরেবের) হলে ৩ রাকআত পড়ে, নচেৎ ৪ রাকআত বিশিষ্ট হলে তা তৃতীয় রাকআতের মত পড়ে শেষ তাশাহহুদের জন্য বসে যেতেন। এই বৈঠকে তিনি তাঁর বাম পাছার উপর বসতেন। এতে তাঁর দু’টি পায়ের পাতা এক দিকে হয়ে যেত। (বুখারী ৮২৮, আবূদাঊদ, সুনান ৯৬৫নং, বায়হাকী) বাম পা-কে ডান পায়ের রলা ও ঊরুর নিচে রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ) আর ডান পায়ের পাতাকে খাড়া রাখতেন। (বুখারী ৮২৮নং) কখনো কখনো খাড়া না রেখে বিছিয়েও রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯, আহমাদ, মুসনাদ) পায়ের আঙ্গুলগুলো কেবলামুখী করে রাখতেন। তাঁর হাত দু’টি প্রথম বৈঠকের মতই থাকত। অবশ্য বামহাত দ্বারা বাম জানুর উপর ভরনা দিতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৮৯, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১২০৫ নং)
সুতরাং পাছার উপর বসা কেবল ৩ বা ৪ রাকআত (অন্য কথায় দুই তাশাহহুদ) বিশিষ্ট নামাযে সুন্নত। পক্ষান্তরে এক তাশাহহুদ বিশিষ্ট ২ রাকআত নামাযে বাম পায়ের পাতার তলদেশ বিছিয়ে তার উপর বসা সুন্নত। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৬, ১৮১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০০, মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্ ১২৮পৃ:) কারণ পাছার উপর বসার কথাহাদীসে কেবল দুই তাশাহহুদ বিশিষ্ট নামাযের ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। নচেৎ নামাযে বসার সাধারণ সুন্নত হল, বাম পায়ের পাতার উপরেই বসা। (নাসাঈ, সুনান ১১৫৬, ১১৫৭, ১১৫৮, ১২৬১, দারেমী, সুনান ১৩৩০ নং)
সালাম
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ الله।
‘আস্সালা-মু আলাইকুম অরাহ্মাতুল্লা-হ্।’
অর্থাৎ, তোমাদের উপর শান্তি ও আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক।
তিনি এতটা মুখ ফিরাতেন যে, (পেছন থেকে) তাঁর ডান গালের শুভ্রতা দেখা যেত। অতঃপর বাম দিকে মুখ ফিরিয়ে অনুরুপ বলে সালাম ফিরতেন। আর এতেও তাঁর বাম গালের শুভ্রতা (পেছন থেকে) দেখা যেত। (মুসলিম, সহীহ ৫৮২, আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৬ নং, নাসাঈ, সুনান)
কখনো কখনো তিনি ডান দিকের (প্রথম) সালামের সাথে ‘---অবারাকাতুহ্’ও যোগ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৭, ত্বাবারানী, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, আবূ য়্যা’লা ৩/১২৫২)
আবার কখনো ডান দিকে ‘আস্সালা-মু আলাইকুম অরাহ্মাতুল্লা-হ্’ এবং বাম দিকে কেবল ‘আস্সালা-মু আলাইকুম’ বলে সালাম ফিরতেন। (নাসাঈ, সুনান ১৩২০ নং, আহমাদ, মুসনাদ, সিরাজ) আবার কখনো বা ডান দিকে একটু ঝুঁকে ঐ মুখেই ‘আস্সালা-মু আলাইকুম’ বলে মাত্র একটি সালাম ফিরতেন। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭২৯, বায়হাকী, মাক্বদেসী, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম আউসাত্ব,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩২৭ নং) মা আয়েশা رضي الله عنها এরও এই আমল ছিল। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩০, ৭৩২, বায়হাকী ২/১৭৯) অনুরুপ এক সালামের আমল ছিল যুবাইর (রাঃ) এরও। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩১ নং, বায়হাকী ২/১৭৯) অতএব কখনো কখনো এ সুন্নাহ্ পালন করা আমাদেরও উচিৎ।
সালাম ফিরার সময় হাত দ্বারা ইশারা বৈধ নয়। একদা সাহাবাদেরকে এমন ইশারা করতে দেখলে তিনি বললেন, “কি ব্যাপার তোমাদের? দুরন্ত ঘোড়ার লেজের মত করে হাত দ্বারা ইশারা করছ? যখন তোমাদের কেউ সালাম ফিরবে, তখন সে যেন তার (পার্শ্ববর্তী) সঙ্গীর প্রতি চেহারা ফেরায় এবং হাত দ্বারা ইশারা না করে।” অতঃপর সাহাবাগণ এরুপ ইশারা করা হতে বিরত হয়ে যান।
অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, “তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, (সালাম ফিরার সময়) হাত নিজ ঊরুর উপর রাখবে। অতঃপর ডাইনে ও বামে (উপবিষ্ট) ভাই-এর প্রতি সালাম দেবে।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩১, আহমাদ, মুসনাদ, সিরাজ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৩৩ নং, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম)
উক্ত হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জামাআতের নামাযে নামাযী সালাম দেয় পাশের নামাযীকে। কিন্তু একা নামাযে সালাম দেওয়া হয় ফিরিশ্তাকে। পরন্তু পাশের নামাযী সালাম ফিরলে তার জওয়াব দিতে হয় না। কারণ, সে সময় সকলেই একে অপরকে সালাম দিয়ে থাকে। অতএব জওয়াব থাকে তাতেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৮৮-২৮৯)
যেরুপ সালাম ফেরার সময় হাতের ইশারা বৈধ নয়, তদ্রুপ বিধেয় নয় মাথা হিলানোও। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৮৯পৃ:)
সালাম ফিরেই নামাযের কাজ শেষ হয়ে যায়। তবে খেয়াল রাখার বিষয় যে, যে তরতীব ও পর্যায়ক্রমে মহানবী (সাঃ) নামায ও তার সকল আমল সম্পন্ন করেছেন, সেই পর্যায়ক্রমেই নামায পড়া নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত অথবা ফরয। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ৯৫পৃ:)
সূরা এবং তার উচ্চারণ ও অনুবাদ
নিম্নে কয়েকটি ছোট ছোট সূরা উচ্চারণ ও অর্থসহ্ লেখা হল। এগুলি এবং অন্যান্য আরো বড় সূরা কুরআন মাজীদ থেকে অথবা কোন ক্বারীর মুখ থেকে শুনে মুখস্থ করা নেওয়া নামাযীর কর্তব্য। প্রকাশ থাকে যে, কুরআনী আয়াতের উচ্চারণ অন্য ভাষায় করা সম্ভব নয় এবং অনেক উলামার মতে তা বৈধও নয়।
(১) সূরা নাস
قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) إِلهِ النَّاسِ (৩) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ (৪) اَلَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِي صُدُوْرِ النَّاسِ (৫) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ (৬)
উচ্চারণ:- ক্বুল আঊযু বিরব্বিন্ না-স। মালিকিন্ না-স। ইলা-হিন্ না-স। মিন্ শার্রিল অসওয়া-সিল খান্না-স। আল্লাযী ইউওয়াসবিসু ফী সুদূরিন্ না-স। মিনাল জিন্নাতি অন্ না-স।
অর্থ:- তুমি বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি, মানুষের প্রতিপালক, মানুষের অধীশ্বর, মানুষের উপাস্যের কাছে- তার কুমন্ত্রণার অনিষ্ট হতে, যে সুযোগমত আসে ও (কুমন্ত্রণা দিয়ে) সরে পড়ে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের হৃদয়ে, জিন ও মানুষের মধ্য হতে।
(২) সূরা ফালাক্ব
قُلْ أَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (১) مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ (২) وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ (৩) وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ (৪) وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ (৫)
উচ্চারণ:- ক্বুল আঊযু বিরব্বিল ফালাক্ব। মিন শার্রি মা খালাক্ব। অমিন শার্রি গা-সিক্বিন ইযা অক্বাব। অমিন শার্রিন্ নাফ্ফা-ষা-তি ফিল উক্বাদ। অমিন শার্রিহা-সিদিন ইযাহাসাদ।
অর্থ:- তুমি বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রভুর নিকট। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে। এবং রাতের অনিষ্ট হতে যখন তা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। এবং গ্রন্থিতে ফুত্কারিণী (যাদুকরী)দের অনিষ্ট হতে। এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতে যখন সে হিংসা করে।
(৩) সূরা ইখলাস
قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ (১) اَللهُ الصَّمَدُ (২) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُوْلَدْ (৩) وَلَمْ يَكُنْ لَّهُ كُفُواً أَحَدٌ (৪)
উচ্চারণ:- ক্বুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ। আল্লা-হুস সামাদ। লাম য়্যালিদ, অলাম ইউলাদ। অলাম য়্যাকুল্ লাহু কুফুওয়ান আহাদ।
অর্থ:- বল, তিনি আল্লাহ একক। আল্লাহ ভরসাস্থল। তিনি জনক নন এবং জাতকও নন। আর তাঁর সমকক্ষ কেউই নেই।
(৪) সূরা লাহাব
تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَّتَبَّ (১) مَا أَغْنى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ (২) سَيَصْلى نَاراً ذَاتَ لَهَبٍ (৩) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (৪) فِيْ جِيْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ (৫)
উচ্চারণ:- তাব্বাৎ য়্যাদা আবী লাহাবিঁউঅতাব্ব মা আগনা আনহু মা-লুহু অমা কাসাব। সায়্যাস্বলা না-রান যা-তা লাহাব। অমরাআতুহুহাম্মা-লাতালহাত্বাব। ফী জীদিহাহাবলুম মিম মাসাদ।
অর্থ:- ধ্বংস হোক আবূ লাহাবের দুইহাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও উপর্জিত বস্তু তার কোন উপকারে আসবে না। সে প্রবেশ করবে লেলিহান শিখাবিশিষ্ট অগ্নিকুন্ডে। আর তার স্ত্রীও -যে কাঠের বোঝা বহনকারিণী। ওর গলদেশে খেজুর চোকার রশি হবে।
(৫) সূরা নাস্বর
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجاً (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً (৩)
উচ্চারণ:- ইযা জা-আ নাস্বরুল্লা-হি অল ফাতহ। অরাআইতান্ না-সা ইয়্যাদখুলুনা ফী দ্বীনিল্লা-হি আফওয়াজা। ফাসাব্বিহ্ বিহামদি রাব্বিকা অস্তাগফিরহু; ইন্নাহু কা-না তাউওয়া-বা।
অর্থ:- যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়। তুমি দেখবে মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল।
(৬) সূরা কা-ফিরুন
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ (১) لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ (২) وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ (৩) وَلاَ أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدْتُّمْ (৪) وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ (৫) لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ (৬)
উচ্চারণ:- ক্বুল ইয়া আই য়ুহাল কা-ফিরুন। লা- আ’বুদু মা- তা’বুদূন। অলা- আন্তুম আ’-বিদূনা মা- আ’বুদ। অলা- আনা আ’-বিদুম মা আ’বাত্তুম। অলা- আন্তুম আ’-বিদূনা মা- আ’বুদ। লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়া দ্বীন।
অর্থ:- বল, হে কাফের দল! আমি তার উপাসনা করি না, যার উপাসনা তোমরা কর। তোমরাও তাঁর উপাসক নও, যাঁর উপাসনা আমি করি। আমি তার উপাসক হ্ব না, যার উপাসনা তোমরা কর। আর তোমরাও তাঁর উপাসক নও, যাঁর উপাসনা আমি করি। তোমাদের ধর্ম তোমাদের এবং আমার ধর্ম আমার (কাছে প্রিয়)।
(৭) সূরা কাউষার
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (১) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (২) إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الأَبْتَرُ (৩)
উচ্চারণ:- ইন্না- আ’ত্বাইনা-কাল কাউষার। ফাস্বাল্লি লিরব্বিকা অন্হার। ইন্না- শা-নিআকা হুওয়াল আবতার।
অর্থ:- নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে কাউসার (হাওয) দান করেছি। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড় এবং কুরবানী কর। নিশ্চয় তোমার শত্রুই হল নির্বংশ।
(৮) সূরা ক্বুরাইশ
لإِيْلاَفِ قُرَيْشٍ (১) إِيْلاَفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ (২) فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هذَا الْبَيْتِ (৩) اَلَّذِيْ أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوْعٍ وَّآمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ (৪)
উচ্চারণ:- লিঈলা-ফি ক্বুরাইশ্ ঈলা-ফিহিম রিহ্লাতাশ শিতা-ই অস্স্বাইফ্ ফাল য়্যা’বুদু রব্বাহা-যাল বাইত্ আল্লাযী আত্বআমাহুম মিন জু’ । অআ-মানাহুম মিন খাঊফ।
অর্থ:- যেহেতু কুরাইশের জন্য শীত ও গ্রীষ্মের সফরকে তাদের স্বভাব সুলভ করা হয়েছে, সেহেতু ওরা উপাসনা করুক এই গৃহের রক্ষকের। যিনি ক্ষুধায় ওদেরকে আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হতে নিরাপদ করেছেন।
(৯) সূরা ফীল
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيْلِ (১) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ (২) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيْلَ (৩) تَرْمِيْهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ (৪) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ (৫)
উচ্চারণ:- আলাম তারা কাইফা ফাআলা রব্বুকা বিআস্বহা-বিল ফীল। আলাম য়্যাজ্আল কাইদাহুম ফী তায্বলীল। অআরসালা আলাইহিম ত্বাইরান আবা-বিল। তারমীহিম বিহিজারাতিম মিন সিজ্জীল। ফাজাআলাহুম কাআস্বফিম মা’কূল।
অর্থ:- তুমি কি দেখ নি, তোমার প্রতিপালক হ্স্তীবাহিনীর সঙ্গে কি করেছিলেন? তিনি কি ওদের কৌশলকে ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন। যারা ওদের উপর নিক্ষেপ করে কঙ্কর। অতঃপর তিনি ওদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন।
(১০) সূরা আসর
وَالْعَصْرِ (১) إِنَّ الإِنْسَانَ لَفِيْ خُسْرٍ (২) إِلاَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (৩)
উচ্চারণ:- অল আসর। ইন্নাল ইনসা-না লাফী খু সর। ইল্লাল্লাযীনা আ-মানূ অআ’মিলুস স্বা-লিহা-তি অতাওয়াস্বাউবিলহাক্বি অতাওয়াস্বাউবিসস্বাবর।
অর্থ:- মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে তারা নয়, যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করেছে এবং একে অপরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।
যিকর ও দুআ
ফরয নামাযের পর পঠনীয় যিকর ও দুআ
এক:
أَسْتَغْفِرُ الله
উচ্চারণ:- আস্তাগফিরুল্লাহ্, অর্থ:- আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (৩ বার)
দুই:
اَللّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ تَبَارَكْتَ يَاذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালা-মু অমিন্কাস সালা-মু তাবা-রাকতা ইয়া যাল জালা-লি অল ইকরা-ম।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি শান্তি (সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র) এবং তোমার নিকট থেকেই শান্তি। তুমি বরকতময় হে মহিমময়, মহানুভব! (মুসলিম ১/৪১৪)
তিন:
لاَ إِلهَ إِلاَّ الله وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَ هُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ:- “ লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু লা শারীকা লাহ্, লাহুল মুলকু অলাহুলহামদু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ:- আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই, তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব, তাঁরই সমস্ত প্রশংসা এবং তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।
চার:
اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الَجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা লা মা-নিয়া লিমা আ’ত্বাইতা, অলা মু’তিয়া লিমা মানা’তা অলা য়্যানফাউযাল জাদ্দি মিনকাল জাউঊ।
অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি যা দান কর তা রোধ করার এবং যা রোধ কর তা দান করার সাধ্য কারো নেই। আর ধনবানের ধন তোমার আযাব থেকে মুক্তি পেতে কোন উপকারে আসবে না। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ , মিশকাত ৯৬২ নং)
পাঁচ:
لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِالله
উচ্চারণ:- লা-হাউলা অলা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ্।
অর্থ:- আল্লাহর প্রেরণা দান ছাড়া পাপ থেকে ফিরার এবং সৎকাজ করার শক্তি নেই।
ছয়:
لآ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُوْنَ
উচ্চারণ:- লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অলা না’বুদু ইল্লা ইয়্যা-হু লাহুন্ন’মাতু অলাহুল ফায্বলু অলাহুস সানা-উল হাসান, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুখলিস্বিনা লাহুদ্দ্বীনা অলাউকারিহাল কা-ফিরুন।
অর্থ:- আল্লাহ ব্যতীত কেউসত্য উপাস্য নেই। তাঁর ছাড়া আমরা আর কারো ইবাদত করি না, তাঁরই যাবতীয় সম্পদ, তাঁরই যাবতীয় অনুগ্রহ, এবং তাঁরই যাবতীয় সুপ্রশংসা, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। আমরা বিশুদ্ধ চিত্তে তাঁরই উপাসনা করি, যদিও কাফেরদল তা অপছন্দ করে। (মুসলিম, সহীহ , মিশকাত ৯৬৩ নং)
সাত:
سُبْحانَ الله
সুবহা-নাল্লাহ্। অর্থাৎ, আমি আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। ৩৩ বার।
اَلْحَمْدُ لله
আলহামদু লিল্লা-হ্। অর্থাৎ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্তে। ৩৩ বার।
اَللهَ أَكْبَر
আল্লা-হু আকবার। অর্থাৎ আল্লাহ সর্বমহান। ৩৩ বার।
আর ১০০ পূরণ করার জন্য উপরোক্ত ৩নং দুআ একবার পঠনীয়। এগুলি পাঠ করলে সমুদেaর ফেনা বরাবর পাপ হলেও মাফ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ ১/৪১৮, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৭১)
‘আল্লাহু আকবার’ ৩৪ বারও বলা যায়। (মুসলিম, সহীহ ১৩৭৭নং)
প্রকাশ যে, তাসবীহ গণনায় বামহাত বা তাসবীহ মালা ব্যবহার না করে কেবল ডানহাত ব্যবহার করাই বিধেয়। (সহীহুল জামে’ ৪৮৬৫নং)
আট:
সুরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস ১ বার করে। (আবু দাঊদ২/৮৬, সহীহ তিরমিযী ১/৮, নাসাঈ ৩/৬৮)
নয়:
আয়াতুল কুরসী ১বার। প্রত্যেক নামাযের পর এই আয়াত পাঠ করলে মৃত্যু ছাড়া জান্নাত যাওয়ার পথে পাঠকারীর জন্য আর কোন বাধা থাকে না। (সহীহ জামে’ ৫/৩৩৯, সি: সহীহাহ্ ৯৭২)
দশ:
لآ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ:- লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু অলাহুলহামদু য়্যুহ্য়ী অ য়্যুমীতু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ:- আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। সমস্ত রাজত্ব ও প্রশংসা তাঁরই, তিনি জীবিত করেন, তিনিই মরণ দান করেন এবং তিনি সর্বেfপরি শক্তিমান।
এটি ফজর ও মাগরিবের নামাযে সালাম ফিরার পর দশবার পড়লে দশটি নেকী লাভ হবে, দশটি গুনাহ ঝরবে, দশটি মর্যাদা বাড়বে, চারটি গোলাম আযাদ করার সওয়াব লাভ হবে এবং শয়তান থেকে নিরাপদে থাকবে। (সহীহ তারগীব ২৬২- ২৬৩ পৃ:)
এগার:
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ عِلْماً نَّافِعاً وَّرِزْقاً طَيِّباً وَّعَمَلاً مُّتَقَبَّلاً
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআঁউঅ রিযক্বান ত্বাইয়িবাঁউঅ আমালাম মুতাক্বাব্বালা।
অর্থ:- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট ফলদায়ক শিক্ষা,হালাল জীবিকা এবং গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।
ফজরের নামাযের পর এটি পঠনীয়। (ইবনে মাজাহ্, সুনান১/১৫২, ত্বাবারানী সাগীর, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/১১১)
বার:
اَللّهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাবআসু ইবা-দাক।
অর্থ:- হে আল্লাহ! যেদিন তুমি তোমার বান্দাদেরকে পুনরুত্থিত করবে সেদিনকার আযাব থেকে আমাকে রক্ষা করো। (মুসলিম)
তের:
لآ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الُحَمْدُ يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ:- লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু অলাহুলহামদু য়্যুহ্য়ী অ য়্যুমীতু বিয়্যাদিহিল খাইরু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ:- আল্লাহ ভিন্ন কেউ সত্য মা’বুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সারা রাজত্ব এবং তাঁরই নিমিত্তে সকল প্রশংসা। তিনিই জীবন দান করেন ও তিনিই মরণ দেন। তাঁর হাতেই সকল মঙ্গল। আর তিনি সর্বোপরি ক্ষমতাবান।
এটি ফজরের নামাযের পর পা ঘুরিয়ে বসার পূর্বে ১০০ বার পড়লে পৃথিবীর মধ্যে ঐ দিনে সেই ব্যক্তিই অধিক উত্তম আমলকারী বলে গণ্য হবে। (সহীহ তারগীব ২৬২-২৬৩ পৃ:)
চৌদ্দ:
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘ফরয নামাযের সালাম ফেরার পর সশব্দে যিক্র পাঠ আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর যুগে প্রচলিত ছিল।’ (বুখারী ৮৪১নং, মুসলিম, সহীহ)
প্রকাশ থাকে যে, এই সকল যিক্রকে সূর করে পড়া বিদআত বলা হয়েছে।
কতিপয় অশুদ্ধ যিক্র
‘আল্লা-হুম্মা আজিরনী মিনান্না-র।’ ফজর ও মাগরেব পর ৭ বার করে পাঠ করে ঐ দিনে বা রাতে মারা গেলে দোযখ থেকে নিস্ক্রিতি পাওয়া যায়। এ হাদীসটি সহীহ নয়, বরং যয়ীফ। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ১৬২৪ নং)
মাথায় হাত রেখে ‘ইয়া ক্বাবিয়্যু’ বা ‘ইয়া নূরু’ বলা। এটি মনগড়া।
মাথায় হাত রেখে ‘বিসমিল্লাহিল্লাযী ---- আল্লাহুম্মা আযহিব আন্নলহাম্মা অলহুযন।’ এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি খুব দুর্বল অথবা জাল। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৬৬০, ১০৫৯ নং)
এত এত বার দরুদ পড়া। দরুদ সালামের পূর্বে বা অন্যান্য অনির্দিষ্ট সময়ে পড়াই বিধেয়।
মিলিত কণ্ঠে অথবা একাকী ‘আসসালা-তু অসসালা-মু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্’ বলা। এটি বিদআত। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৭০-৭১, ২০/১৪৭)
প্রকাশ থাকে যে, তাসবীহ ডানহাতে গোনাই হল সুন্নত। মহানবী (সাঃ) ডানহাতের আঙ্গুল দ্বারাই তাসবীহ গুনেছেন এবং অপরকে ডানহাতের আঙ্গুল ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর তিনি বলেছেন যে, ঐ আঙ্গুলগুলোকে কিয়ামতের দিন কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং তাদেরকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫০১, মিশকাত ২৩১৬ নং) সুতরাং তাসবীহ মালা ব্যবহার করা বিধেয় নয়। এতে রয়েছে রিয়ার (লোক-প্রদর্শনের) গন্ধ, যা ছোট শির্ক। পক্ষান্তরে কাঁকর বা খেজুর আঁটি দ্বারা তাসবীহ গোনার হাদীস সহীহ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫০০, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৯৩পৃ:)
মুনাজাত
নামাযী যখন নামায পড়ে তখন সে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে। আল্লাহর সাথে নিরালায় যেন কানে কানে কথা বলে। (মুঅত্তা, মুসনাদে আহ্মদ ২/৩৬, ৪/ ৩৪৪)
নামাযের মাঝেই আব্দ (দাস) মাবুদের (প্রভুর) ধ্যনে ধ্যানমগ্ন থাকে। যেন সে তাকে দেখতে পায়। যতক্ষণ সে নামাযে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহর সাথে কথা বলে। তিনি তার প্রতি মুখ ফিরান এবং সালাম না ফিরা পর্যন্ত তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন না। (বাইহাকী, সহীহুল জামে’১৬১৪ নং)
পরক্ষণে যখনই সে সালাম ফিরে দেয় তখনই সে মুনাজাতের অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দূর হয়ে যায় নৈকট্যের বিশেষ যোগসূত্র। বান্দা সরে আসে সেই মহান বিশ্বাধিপতির খাস দরবার থেকে। সুতরাং তার নিকট কিছু চাওয়া তো সেই সময়ে অধিক শোভনীয় যে সময়ে ভিখারী বান্দা তাঁর ধ্যনে তার নিকটে ও তাঁর খাস দরবারে থাকে। অতএব সেই নৈকট্যের ধ্যান ভঙ্গ করে এবং মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশিত মুনাজাত থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় মুনাজাত সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত নয়।
অবশ্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত যে, একদা সাহাবাগণ আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে কোন্ সময় দুআ অধিকরুপে কবুল হয় - সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, “গভীর রাতের শেষাংশে এবং সকল ফরয নামাযের পশ্চাতে।” (তিরমিযী, সুনান ৩৪৯৯, নাসাঈ, সুনান আমালুল ইয়াউমি অল্লাইলাহ্ ১০৮নং, মিশকাত ৯৬৮ নং) হাদীসটি অনেকের নিকট দুর্বল হলেও আসলে তা হাসান। (তিরমিযী, সুনান২৭৮২নং)
সুতরাং এটাই হ্চ্ছে ফরয নামাযের পর মুনাজাত করার প্রায় সহীহ ও সব চেয়ে বড় দলীল, যদিও এতে হাত তুলে দুআর কথা নেই। এইখান হতেই ধোকা খেয়ে মুনাজাত-প্রেমীরা উদ্ভাবন করেছেন যে, ‘ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। আর হাত তুলে দুআ করলে আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। তাছাড়া নামাযের পর লোক ও জামাআত বেশী থাকে। আর জামাআতী দুআ বেশী কবুল হয়।’ ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে আযানের সময়, আযান ও ইকামতের মাঝে, ইকামতের সময়, বৃষ্টি বর্ষণের সময় ও আরো যে সব সময়ে দুআ কবুল হয় সে সব সময়ে কৈ জামাআতী দুআ নজরে পড়ে না। অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কেবল ফরয নামাযের পর দুআ।
শুরুতে একটা কথা খেয়াল রাখা উচিৎ যে, ইবাদত যখন, যেভাবে, যে গুণ, সংখ্যা ও পদ্ধতিতে বিধিবদ্ধ হয়েছে প্রত্যেকটি ইবাদত সেই গুণ, পদ্ধতি, সংখ্যা ও সময় অনুসারে করা জরুরী। অনির্দিষ্ট বা সাধারণ থাকলে তা কোন গুণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা বিদআতের পর্যায়ভুক্ত।
সুতরাং দুআর এক সাধারণ নিয়ম হল, হাত তুলে দুআ করা। অর্থাৎ কেউ নিজ প্রয়োজন সাধারণ সময়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলে হাত তুলে করবে। এখন যদি কেউ বলে, ‘আমি আমার প্রয়োজন নামাযে চাই বা না চাই, নামাযের পরে রসূলের বা নিজের ভাষায় হাত তুলে চাইব’- তাহলে তার প্রথমে জানা উচিৎ যে, নামাযের পর একটি নির্দিষ্ট সময়। আর তাতে রয়েছে নির্দিষ্ট ইবাদত (যিকর-আযকার)। অতএব ঐ নির্দিষ্ট সময়ে শরীয়ত কি করতে নির্দেশ করেছে? যা করতে নির্দেশ করেছে তার নিয়ম কি? ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে অনুরুপ সাধারণ নিয়ম সংযোজন করা যাবে না। করলেই তা অতিরঞ্জন তথা বিদআত রুপে পরিগণিত হবে। ফলকথা, তাকে দেখতে হবে যে, ঐ নির্দিষ্ট ইবাদতের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টরুপে দুআ বা মুনাজাতের নির্দেশ শরীয়তে আছে কি? নচেৎ আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (শরীয়তের) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যা ওর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী মুসলিম, মিশকাত১৪০নং) “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যার উপর আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম ১৭১৮নং)
• এবার প্রশ্ন থাকছে উপরোক্ত হাদীস মুনাজাতের স্বপক্ষে দলীল কি না?
উক্তহাদীসে যে ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে তার অর্থ হল, পিঠ, পাছা, পশ্চাৎ বা শেষাংশ। যাঁদের অর্থে ‘দুবুর’ মানে ‘পরে’, তাঁদের মতে এই হাদীসটি ফরয নামাযের পর দুআ বা মুনাজাতের বড় দলীল। (যদিও হাত তুলে নয়।) কিন্তু উক্ত হাদীসে ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ পরে করা ঠিক কি ?
এখন যদি বলি, ‘গরুর দুবুর (পাছা)’, তাহলে শ্রোতা এই বুঝবে যে, গরুর পাছা দেহের অবিচ্ছেদ্য পিছনের অঙ্গ। তার দেহাংশের বাইরের কিছু নয়। সুতরাং নামাযের দুবুর, বা পাছা অথবা পশ্চাৎ বলতে বুঝা দরকার যে, তা নামাযেরই শেষ অঙ্গ বা অংশ। নামাযের বাইরে কিছু নয়; অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বের অংশ।
অবশ্য ‘দুবুর’ (পশ্চাৎ) বলে পরের অংশকেও বুঝানো যায়। যেমন যদি বলি, ‘ইমাম সাহেব বাসের দুবুরে (পশ্চাতে বা পেছনে) দাঁড়িয়ে আছেন।’ তাহলে ইমাম সাহেবকে যে দেখেনি সে শ্রোতা দুই রকম বুঝতে পারে; প্রথমত: এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনের অংশে বাসের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছেন। আর দ্বিতীয়ত: এই যে, ইমাম সাহেব বাসের পেছনে রোড (বাসের বাইরে) দাঁড়িয়ে আছেন। আর এক্ষেত্রে শ্রোতার দুই প্রকার বুঝাই সঠিক, ভুল নয়। কিন্তু ইমাম সাহেবের আসল দাঁড়াবার জায়গা বাস্তবপক্ষে একটাই, বিধায় অপরটি অসম্ভব।
সুতরাং উক্ত হাদীসের অর্থ যদি ‘নামাযের পশ্চাতে অর্থাৎ সালাম ফিরার পূর্বে দুআ কবুল হয়’ বলি, তাহলে একথাও বলতে হয় যে, ‘সালাম ফেরার পূর্বেই তাসবীহ-তাহ্লীলও করতে হবে।’ কারণ ওখানেও ‘দুবুর’ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যার অর্থে উলামাগণ নামাযের পর যিক্র পড়ার কথা বলে থাকেন। অতএব উক্ত দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যাখ্যা খুঁজতে আমাদেরকে শরীয়তের সাহায্য নিতে হবে। যেহেতু মহানবী (সাঃ) এর এক উক্তিকে তাঁর অপর উক্তি বা আমল ব্যাখ্যা করে। চলুন এবারে আমরা তাই দেখে ‘দুবুর’ এর সঠিক অর্থ নির্ধারণ করি।
সালাম ফেরার পরে কি করা উচিৎ সে ব্যাপারে আল্লাহর এক নির্দেশ হল,
“অতঃপর যখন তোমরা নামায সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর যিক্র কর----।” (কুরআন মাজীদ ৪/১০৩)
“তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির একাংশে এবং নামাযের পরেও।” (কুরআন মাজীদ ৫০/৪০)
তাই তো আল্লাহর নবী (সাঃ) এর আমল ও অভ্যাস ছিল সালাম ফিরার পর আল্লাহর যিক্র করা।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) “আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালাম--- “ বলার মত সময়ের চেয়ে অধিক সময় সালাম ফেরার পর বসতেন না। (মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৬০ নং)
সাওবান (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন নামায শেষ করতেন তখন তিনবার ইস্তিগফার করে “আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালাম---- “ বলতেন।
আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন সালাম ফিরতেন তখন উঁচু শব্দে বলতেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু ---।” (মুসলিম, মিশকাত৯৬৩ নং) (এ ব্যাপারে ফরয নামাযের পর যিক্রের আলোচনা দেখুন।)
সালাম ফিরা হলে তিনি মহিলাদের জন্য একটু অপেক্ষা করতেন, যাতে তারা পুরুষদের আগেই মসজিদ ত্যাগ করতে পারে। অতঃপর তিনি উঠে যেতেন। (বুখারী ৮৩৭)
সামুরাহ্ বিন জুনদুব (রাঃ) বলেন, ফজরের নামায শেষ করে আল্লাহর নবী (সাঃ) আমাদের দিকে ফিরে বসে বলতেন, “গত রাত্রে তোমাদের মধ্যে কে স্বপ্ন দেখেছে?” অতঃপর কেউ দেখলে সে বর্ণনা করত। নচেৎ তিনি নিজে স্বপ্ন দেখে থাকলে তা বর্ণনা করতেন। (বুখারী, মিশকাত ৪৬২১ নং)
অবশ্য একদা কা’বা শরীফের নিকট মহানবী (সাঃ) এর নামায পড়া কালে কুরাইশের দুষ্কৃতিরা তাঁর সিজদারত অবস্থায় ঘাড়ে উটনীর (গর্ভাশয়) ফুল চাপিয়ে দিলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) খবর পেয়ে ছুটে এসে তা সরিয়ে ফেলেন। এহেন দুর্ব্যবহার ফলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায শেষ করে উচ্চস্বরে ঐ দুষ্কৃতিদের জন্য বদ দু’আ করেন এবং তা কবুলও হয়ে যায়। (বুখারী ২৪০, মুসলিম ১৭৯৪ নং)
কিন্তু সে নামায ফরয ছিল না নফল, তা নিশ্চিত নয়। পরন্তু এতে হাত তোলার কথা নেই। তাছাড়া এটি ছিল সাময়িক বদ দু’আ; যা তাদেরকে শুনিয়ে করা হয়েছিল।
আর একটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, তিনি ফজরের নামাযে সালাম ফিরে বলতেন, “আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান না-ফিআউ] অরিযকান ত্বাইয়িবাঁউঅআমালাম মুতাক্বাব্বালা।” (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অবশ্যই ফলপ্রসূ জ্ঞান, উত্তম রুযী এবং কবুলযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি।) (ত্বাবারানীরানী, সাগীর, মাজমাউয যাওয়াইদ১০/১১১, সহীহ ইবনে মাজাহ্ ১/১৫২) অবশ্য এখানেও হাত তোলার কথা নেই।
সুতরাং বলা যায় যে, সালাম ফিরার পর আল্লাহর নবী (সাঃ) অধিকাংশ সময়ে আল্লাহর যিক্র পড়েছেন। আর কখনো কখনো তিনি ফজরের পর ঐ দুআ (হাত না তুলে) পাঠ করেছেন।
পক্ষান্তরে সালামের পূর্বে তিনি (প্রার্থনামূলক) দুআ পড়তে আদেশ দিয়ে বলেন, “এরপর (তাশাহহুদের পর) তোমাদের যার যা ইচ্ছা ও পছন্দ সেই মত দুআ বেছে নিয়ে দুআ করা উচিৎ।” (বুখারী ৮৩৫, মুসলিম,মিশকাত ৯০৯ নং)
“যখন তোমাদের মধ্যে কেউ (শেষ) তাশাহহুদ সম্পন্ন করবে তখন সে যেন আল্লাহর নিকট চারটি জিনিস থেকে পানাহ চায়; জাহান্নামের আযাব, কবরের আযাব, দাজ্জালের ফিতনা এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে। এরপর সে ইচ্ছামত দুআ করবে।” (মুসলিম, আবু আওয়ানাহ্, আবূ দাঊদ ৯৮৩নং, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্, প্রমুখ, মিশকাত ৯৪০নং)
সালাম ফিরার পূর্বে তাশাহহুদের পর তিনি নিজেও বিবিধ প্রকার দুআ পড়ে প্রার্থনা করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৩৯নং) (দুআয়ে মাসুরা দ্রষ্টব্য) এমন কি উক্ত চার প্রকার আযাব ও ফিতনা হতে পানাহ চাওয়ার দুআ আল্লাহর নবী (সাঃ) কুরআন কারীমের সূরা শিখানোর মত সাহাবাগণকে শিক্ষা দিতেন। তাই তো ৩ অথবা ৪ জন সাহাবী হতে উক্ত দুআর হাদীস বর্ণনাকারী তাবেয়ী ত্বাউস একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তোমার নামাযে ঐ দুআ পড়েছ কি? বলল, না। তিনি বললেন তাহলে তুমি তোমার নামায ফিরিয়ে পড়।’ (মুসলিম ১/৪১৩ নং)
কেননা, তাঁর নিকট উক্ত দুআর এত গুরুত্ব ছিল যে, তিনি মনে করতেন, যে দুআ পড়তে আল্লাহর নবীর আদেশ, আমল ও শিক্ষা রয়েছে তা না পড়লে নামাযই হবে না!
একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) (মসজিদে) বসে ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি প্রবেশ করে নামায শুরু করল। (নামাযে) সে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি দয়া কর।’ তা শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “তাড়াহুড়ো করলে তুমি হে নামাযী! যখন তুমি নামাযে বসবে তখন আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রসংশা কর এবং আমার উপর দরুদ পড়, তারপর আল্লাহর নিকট দুআ কর।”
কিছুক্ষণ পরে আর এক ব্যক্তি নামায পড়তে শুরু করল, সে আল্লাহর প্রশংসা করে নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করল। তখন তা শুনে তিনি বললেন, “হে নামাযী! (এবার তুমি) দুআ কর, কবুল হবে ।” (তিরমিযী, সুনান ৩৪৭৬, আবূ দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত ৯৩০ নং)
ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমি নামায পড়ছিলাম, আর নবী (সাঃ), আবু বকর ও উমর (রাঃ) (পাশেই বসে) ছিলেন। যখন আমি বসলাম তখন আল্লাহর প্রশংসা ও দরুদ শুরু করলাম। তারপর আমি নিজের জন্য দুআ করলাম। তা শুনে নবী (সাঃ) বললেন, “তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে, তুমি চাও, তোমাকে দান করা হবে।” (তিরমিযী, মিশকাত ৯৩১ নং)
আর আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউযখন নামাযে দাঁড়ায় সে তখন তার রবের সাথে মুনাজাত করে। অতএব মুনাজাতে সে কি বলে, তা তার জানা উচিৎ। (মুঅত্তা, মুসনাদে আহ্মদ ২/৩৬, ৪৯২৮নং)
অতএব সঠিক মুনাজাতের স্থান ও দুআ কবুল হওয়ার সময় সালাম ফিরার পূর্বে নয় কি?
পরন্তু যদি ‘দুবুর’ শব্দের অর্থ ‘পরে’ ধরে নেওয়া যায় তবুও তাতে হাত তুলে মুনাজাত প্রমাণ হয় না। আর এখানে হাত তুলে দুআ করা দুআর আদব বলে এবং আল্লাহ (হাত তুলে দুআ করলে) খালি হাত ফিরিয়ে দেন না বলে এখানেও তোলা হবে বা তুলতে হবে, তা বলা যায় না। ঐ দেখুন না, জুমআর খুতবায় দুআ বিধেয়। নবী (সাঃ) বৃষ্টির জন্যহাত তুলে খুতবায় দুআও করেছেন। কিন্তু সাধারণ সময়ে খুতবায় তিনি হাত তুলতেন না। তাইতো উমারাহ্ বিন রুয়াইবাহ্ যখন বিশর বিন মারওয়ানকে জুমআর খুতবায় হাত তুলে দুআ করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ঐ হাত দুটিকে বিকৃত করুক! আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে কেবল তাঁর আঙ্গুল দ্বারা এভাবে ইশারা করতে দেখেছি। (মুসলিম ৮৭৪, আবূ দাঊদ,তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে আবী শাইবাহ্ ৫৪৯৬ নং)
সুতরাং হাত তুলে দুআর আদব হলেও যেহেতু ঐ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি হাত তুলেন নি, তাই সলফগণ তা বৈধ মনে করতেন না। যুহ্রী বলেন, ‘জুমআর দিনহাত তোলা নতুন আমল (বিদআত)।’ (ইবনে আবী শাইবাহ্ ৫৪৯১ নং) ত্বাউস জুমআর দিনহাত তুলে দুআকে অপছন্দ করতেন এবং তিনি নিজেও হাত তুলতেন না। (ঐ ৫৪৯৩ নং)
ইমাম ও মুক্তাদীগণের খুতবায়হাত তুলে দুআ প্রসঙ্গে মাসরুক বলেন, (যারা ঐভাবে দুআ করে) ‘আল্লাহ তাদেরহাত কেটে নিক।’ ( ঐ ৫৪৯৪ নং)
সুতরাং একথা স্পষ্ট হল যে, ফরয নামাযের পর দুআ বৈধ ধরা গেলেও হাত তুলে দুআর আদব বলে হাত তোলা এখানেও বিদআত হবে, যেমন জুমআর খুতবায় হবে। কারণ নামাযের পরে মহানবী (সাঃ) এর আদর্শ ও তরীকা আমাদের সামনে মজুদ।
এ তো গেল একাকী হাত তুলে মুনাজাতের কথা। অর্থাৎ একাকী নামাযীর জন্যও বিধেয় নয় ফরয নামাযের পর হাত তুলে মুনাজাত করা ।
বাকী থাকল জামাআতী দুআর কথা, তো তার প্রমাণ আরো দুঃসাধ্য। যাঁরা করেন বা করা ভালো মনে করেন তাঁরা বলেন, যে, ‘জামাআতের দুআ একটি সুবর্ণ সুযোগ।’ এর প্রমাণে তাঁরা এই যুক্তি পেশ করেন যে, ‘জামাআতে দুআ করলে দুআ কবুল হয়। একাকী অনেকের দুআ কবুল নাও হতে পারে। সুতরাং পাঁচজন ভালো লোকের ফাঁকে একজন মন্দলোকেরও দুআ কবুল হয়ে যায়!’ তাঁরা আরো বলেন, ‘কোন নেতার কাছে কোন দাবী বা আবেদনের ব্যাপারে একার চেয়ে যৌথ ও জামাআতী চেষ্টাতেই কৃতার্থ হওয়া অধিক সম্ভব।’ ইত্যাদি।
কিন্তু প্রথমত: যুক্তিটি দলীল-সাপেক্ষ। দ্বিতীয়ত: দুনিয়ার ভীতু নেতাদের সাথে সার্বভৌম ক্ষমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার অধিকারী মহান আল্লাহকে তুলনা করা বেজায় ভুল ও হারাম।
পরন্তু যদি তাই হয়, তবে এ যুক্তি ও সুযোগের কথা মহানবী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ কি জানতেন না? নাকি তাঁদের চেয়ে ওরা বেশী জানলেন? কই তাঁরা তো এই সুযোগ গ্রহণ করে অনুরুপ জামাআতী দুআ ফরয নামাযের পর করে গেলেন না?
পরন্তু তাঁরাও জামাআতবদ্ধভাবে দুআ করেছেন; বিপদ-আপদের সময় ফরয নামাযের শেষ রাকআতে রুকু থেকে উঠার পর কওমায় হাত তুলে মুসলিমদের জন্য জামাআতী দুআ ও কাফেরদের জন্য বদদু’আ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৮৮, ১২৮৯, ১২৯০ নং)
সাহাবাগণ রমযানের বিত্র নামাযে রুকুর পূর্বে বা পরে হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন। (মুঅত্তা, মিশকাত ১৩০৩ নং)
তাঁরা নামাযের ভিতরেই হাত তুলে জামাআতী দুআ করেছেন। কিন্তু নামাযের পর করা উত্তম হলে তা করতেন না কি?
একদা মহানবী (সাঃ) জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী (বেদুঈন) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেল, আর পরিবার-পরিজন (খাদ্যের অভাবে) ক্ষুধার্ত থেকে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’ তখন মহানবী (সাঃ) নিজের দুইহাত তুলে দুআ করলেন। ফলে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে পরবর্তী জুমআতে উক্ত (বা অন্য এক) ব্যক্তি পুনরায় খাড়া হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! ঘর-বাড়ি ভেঙে গেল এবং মাল-ধন ডুবে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দুআ করুন!’ মহানবী (সাঃ) তখন তিনি নিজের হাত তুলে পুনরায় বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করলেন এবং বৃষ্টিও গেল থেমে। (বুখারী ৯৩৩নং, মুসলিম, নাসাঈ, মুসনাদ আহ্মদ ৩/২৫৬, ২৭১)
অতএব বুঝা গেল যে, নামাযের পর দুআর অভ্যাস ছিল না বলেই উক্ত সাহাবী যে সময় কথা বলা এবং কেউ কথা বললে তাকে চুপ করতে বলাও নিষিদ্ধ সেই সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) কে দু’ দু’বার দুআর আবেদন জানালেন।
সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ) এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম ৮৮৩, আবু দাঊদ ১১২৯নং, মুসনাদে আহ্মদ ৪/৯৫, ৯৯)
উক্ত হাদীস নিয়ে একটু চিন্তা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, সাহাবাদের যুগেও ঐ মুনাজাতের ঘটা বিদ্যমান ছিল না। সুতরাং তা যে নব-আবিষ্কৃত বিদআত তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
কিন্তু অজান্তে লোকেরা শাস ছেড়ে আঁটিতে কামড় মারছে! যেখানে দুআ করা ওয়াজিব বা বিধেয় সেখানে না করে অসময় ও অবিধেয় স্থানে দুআ করার জন্য মারামারি! আবার কেউনা করলে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি!! কিন্তু তাও কি বৈধ?
অতএব আপনি যদি জ্ঞান ও বিবেকের সাহায্যে শরীয়তের মাপকাঠিতে ইনসাফ করতে চান এবং দ্বিধাবিভক্ত সমাজের সংকীর্ণ মনের মানুষদের হৃদয়-দ্বারকে উদার ও উন্মুক্ত করে শৃঙ্খলা আনতে চান, তাহলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে আসল সত্য আপনার নিকটও প্রকট হয়ে উঠবে ইন শা-আল্লাহ। পক্ষান্তরে আপনি তো চান আল্লাহর অনুগ্রহ, আল্লাহর রহ্মত ও মাগফিরাত। তবে তা যদি এ সময় ছাড়া অন্য সময়েই পাওয়া যায়, তাহলে তা সে সময়েই চেয়ে নিতে বাধা কোথায়? কথায় বলে, “ঢেকিশালে যদি মানিক পাই, তবে কেন পর্বতে যাই?” মোট কথা আপনার প্রয়োজন আপনি আপনার নামাযেই ভিক্ষা করুন। আপনার আপদে-বিপদে ও বালা-মসীবতে নামাযেই সাহায্য প্রার্থনা করুন। বিশেষ করে আল্লাহ যেহেতু বলেন, “তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা বাক্বারাহ্ ৪৫,১৫৩ আয়াত)
অতএব খেয়াল করে দেখুন হয়তো বা যে প্রয়োজন আপনি ভিক্ষা করবেন সেই প্রয়োজনের দুআ নামাযেই রয়েছে। নচেৎ অনুরুপ সহীহ দুআ বেছে নিয়ে আপনি দুআর স্থানে নামাযেই করতে পারেন। আর যদি নিজের ভাষাতেই দুআ করতে হয়, তাহলে দুআ কবুল হওয়ার আরো বহু সময় আছে। সেই সাধারণ সময়ে আপনি আপনার বিনয়ের হাত তুলে খুব করে যত পারেন আল্লাহর নিকট চেয়ে নিন। আপনি একা হলেও -আল্লাহর ওয়াদা- তিনি বান্দার দুআ কবুল করেন; যদি সঠিক নিয়মে হয়। নাইবা চাইলেন ঐ বিতর্কিত সময়ে!
তাছাড়া নামাযের ভিতর মুনাজাতের ঐ নয়নাভিরাম বাগিচায় প্রায় আটটি স্থানে দুআ করার সুযোগ রয়েছে;
তাকবীরে তাহ্রীমার পর, রুকুতে, কওমাতে, সিজদায়, দুই সিজদার মাঝে, তাশাহ্হুদে, রুকুর পূর্বে অথবা পরে কুনূতে এবং কুরআন পাঠকালে রহ্মতের আয়াত এলে রহ্মত চেয়ে এবং আযাবের আয়াত এলে আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে নামাযী দুআ করে থাকে। (ফতহুল বারী ১১/১৩৬) আর উক্ত স্থানগুলিতে কি নিয়ে দুআ করবেন তা তো পূর্বের পরিচ্ছেদগুলিতে জেনেছেন। সুতরাং এতগুলো স্থান কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?
কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেকে সে সব দুআকে কেবল নামায বলেই জানে ও চেনে। দুআ বলে নয়। ফলে পূর্ণ সমর্থন করে জামাআতী দুআকে। হয়তো বা তার কারণ এই যে, মুখস্থ করে দুআ করা কষ্টকর ব্যাপার, অথচ নামাযের পর জামাআতে কেমন আরামসে কেবল ‘আমীন-আমীন’ বললেই দুআ ও সহজে কিস্তিমাত হয়ে যায়! পক্ষান্তরে ইমাম সাহেব কি দুআ করলেন তার খবর নেই, দুআর অর্থের প্রতি খোঁজ নেই, দুআর প্রতি মনোযোগ নেই - এমন দুআয় ফল কোথায়? মহানবী (সাঃ) বলেন, “আর জেনে রেখো যে, আল্লাহ বিস্মৃত ও উদাসীন হৃদয় থেকে দুআ মঞ্জুর করেন না।” (তিরমিযী ৩৪৭৯ নং)
দুআ বিদআতের ফতোয়া শুনে অনেকের অনেক রকম অভিযোগ। কেউ বলেন, ‘দুআ উঠে যাচ্ছে, কিছু দিন পর নামাযও উঠে যাবে হয়তো!’ অথচ দুআ ও নামায এক নয়। নামায হল দ্বীনের খুঁটি। আর নামাযের পর হাত তুলে দুআ তো ভিত্তিহীন। সুতরাং যার ভিত নেই, তা টিকে কেমনে?
এক মসজিদে জামাআতের সময় হয়ে এসেছিল। ওযু করতে দেরী হওয়ায় আমাদের অপেক্ষা করছিল জামাআত। এক সাহেব কারণ জানতে চাইলে কেউ বললেন, ‘আরবের মাওলানা ওযু করছেন, একটু থামুন।’ কিন্তু চট করেই এক সাহেব বলে উঠলেন, ‘আরবের লোকদের দুআ না হলে চলে, ওযু না হলেও তো চলবে!’
অনেকে বলেন, ‘কম্বলের রোয়া বাছতে সব শেষ।’
বক্তার ধারণামতে শরীয়তের সবকিছুই কম্বলের রোয়া। অর্থাৎ ফরয, সুন্নত, নফল, বিদআত সবই সমান! অথচ প্রকৃতপক্ষে বিদআত উচ্ছেদ কম্বলের রোয়া বাছা নয়; বরং ফুল বাগানের আগাছা অথবা ধানক্ষেতের ঝেড়া বাছা।
অনেকে বলেন, ‘পায়জামা খাটাতে খাটাতে শেষকালে দেখছি আন্ডারপ্যান্ট হয়ে যাবে!’ ‘ছিল ঢেকি হল শূল, কাটতে কাটতে নির্মূল - হয়ে যাবে।’
অর্থাৎ ফরয নামাযের পর হাত তুলে দুআ উঠে গেলে যেন দ্বিনের মূল অংশ বাদ পড়ে গেল! এঁদের নিকটে মুড়ি-মুড়কির সমান দর। কাক-কোকিলের কোন পার্থক্য নেই। অথচ ইসলামে অতিরঞ্জনের স্থান নেই। ইসলামে কোন কিছু এমন নেই যাতে সংযোজন করা যাবে অথবা কিছু হরাস করা যাবে। বাড়তি নখণ্ডচুল কাটা অবশ্য বাঞ্জিত, আঙ্গুল বা মাথা কাটা নয়। পায়জামা গাঁটের নিচে ঝুলে রাস্তার ময়লা লাগলে অবশ্যই জ্ঞানীগণ তা কেটে গাঁটের উপর পর্যন্ত করে নেন। কারণ তাঁরা জানেন যে, গাঁটের নিচে কাপড় পরা হারাম। সুতরাং অপ্রয়োজনীয় বাড়তি অংশ কাটা তো সকলের নিকট জ্ঞান ও বিজ্ঞান-সম্মত। আর বাড়তি অংশ কাটলেই যে আসল অংশও কাটা যাবে তা জরুরী নয়। অবশ্য যাঁদের নিকটে আসল-নকলের কোন পার্থক্য-জ্ঞান নেই তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।
তাছাড়া বাড়তি ও বেশী করার প্রয়োজন কোথায়? অল্প মেহনতে ফল ও কাজ একই হলে সেটাই যথেষ্ট ও ইপ্সিত নয় কি? নচেৎ ‘চাষার চাষ করা দেখে চাষ করলে গোয়াল, ধানের সঙ্গে খোঁজ নাই বোঝা বোঝা পোয়াল’ হবে না কি?
অনেকে বলেন, ‘ওঁরা কি জানতেন না, যাঁরা এতদিন নিয়মিতভাবে দুআ করে গেলেন?’ কিন্তু এর উত্তরে আমরাও প্রশ্ন করতে পারি, ‘ওঁরা কি জানতেন না, যাঁরা কখনো মুনাজাত করে যান নি, বা জানেন না যাঁরা এখনো মুনাজাত করেন না?’ সুতরাং দলীলই প্রমাণ করবে কে জানতেন আর কে জানতেন না। পক্ষান্তরে যাঁরা ইজতিহাদে ভুল করে গেছেন, আল্লাহ তাঁদের ভুল ক্ষমা করবেন এবং তাঁরা একটি নেকীর অধিকারীও হবেন। অতএব যাঁরা না জেনে করে গেছেন তাঁদেরকে বিদআতী বলার অধিকারও কারো নেই। তবে সঠিকতা জানার পর তার দিকে প্রত্যাবর্তন করা অবশ্যই ওয়াজেব।
অনেকে বলেন, দুআ তো ভালো জিনিস। ওতে ক্ষতি কি? কিন্তু ভালো হলেই যে বাড়তি করার অধিকার আছে, তা নয়। নামায ভালো বলে ২ রাকআতের স্থানে ৩ রাকআত বেশী পড়া যায় না। দরুদ ভালো হলেও জামাআতী সমস্বরে বা দাঁড়িয়ে কিয়াম করে দরুদ পড়া যায় না। এই বাড়তি করার নামই তো বিদআত।
অনেকে বলেন, ‘দুআ উঠে গেল তাই তো নানা কষ্ট, নানা বিপদ-আপদ দেখা দিচ্ছে মুসলিম সমাজে।’ অবশ্য এমন লোকেরা নামাযের পর হাত তুলে দুআ ছাড়া আর অন্য দুআ চেনেন না। তাই তো কেউ ফরয নামাযের পর মুনাজাত না করলে অনেকে কুরআনের আয়াত থেকে দলীল উদ্ধৃত করে তাকে জাহান্নামী বানিয়ে থাকেন! কারণ আল্লাহ বলেন, “তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমার নিকট দুআ কর, আমি তা কবুল করব। যারা অহংকারে আমার ইবাদত (দুআ) করায় বিমুখ তারা লাঞ্জিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা মুমিন ৬০ আয়াত)
বলাই বাহুল্য যে, এমন বক্তার নিকট দুআ এবং ফরয নামাযের পরহাত তুলে দুআর মাঝে কোন পার্থক্যই নেই। তাই তো ঝোপ না বুঝেই কোপ মেরে থাকেন!
অনেকে বলেন, ‘ফরয নামাযের পর ঐরুপ দুআ করতে নিষেধ আছে কি?’
কিন্তু নিষেধ না থাকলে যদি করা যেত, তাহলে তো বহু কিছু করা যায়। আযান ও নামায ভালো জিনিস বলে সকাল ৯ টায় আযান দিয়ে জামাআত করে নামায পড়তে পারি কি? কারণ ঐ সময় ঐ আমল তো নিষেধ নয়। তবে দরুদে সমস্বরকে কেন বিদআত বলি, সমস্বরে দরুদ তো নিষেধ নয়---ইত্যাদি। এরুপ মুনাজাত নেই তার প্রমাণ হল হাদীসে বা আসারে তার উল্লেখ নেই। পরন্তু কোন ইবাদত ‘নেই’ প্রমাণ করতে দলীলের প্রয়োজন হয় না; কারণ ‘নেই’ এর দলীলই হল কুরআন-হাদীসে এর উল্লেখ নেই। অবশ্য ‘আছে’ প্রমাণ করতে স্পষ্ট দলীল জরুরী। তাই তো যে কর্ম করতে নিষিদ্ধ বলে প্রমাণ আছে তা করাকে ‘হারাম’ বলে, ‘বিদআত’ নয়। পক্ষান্তরে যা ‘আছে’ বলে প্রমাণ নেই তা দ্বীন ও ভালো মনে করে করাকেই নতুনত্ব বা বিদআত বলে। আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীন) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা তার পর্যায়ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪০নং) “যে ব্যক্তি এমন আমল করে, যাতে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম ১৭১৮নং) “আর নবরচিত কর্মসমূহ থেকে দূরে থেকো। কারণ, নবরচিত কর্ম হল বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (মুসনাদে আহ্মদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত১৬৫নং) “আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই হল জাহান্নামে।” (সহীহ নাসাঈ ১৪৮৭নং)
সুতরাং বিদআতের ভালো-মন্দ কিছু নেই। বরং তার সবটাই মন্দ। আর যা বিদআত, তা জরুরী মনে না করে করলেও বিদআত এবং কখনো কখনো করাও বিদআত। নচেৎ এর প্রমাণে দলীল জরুরী। যেমন যদি বলি, ‘কিয়াম করা বিদআত, তবে জরুরী না মনে করে করা বিদআত নয় বা কখনো কখনো করা বিদআত নয়’ তবে নিশ্চয় তা যুক্তিসঙ্গত নয়। তদনুরুপ ফরয নামাযের পর হাত তুলে দুআ যদি বিদআতই হয় তবে তা অজরুরী মনে করে কখনো কখনো করা কোন যুক্তিকে দূষণীয় হবে না?
পরিশেষে এখানে ইবনে মসউদ (রাঃ) এর একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করি; তিনি বলেন, “তোমরা অনুসরণ কর, নতুন কিছু রচনা করো না। কারণ তোমাদের জন্য তাই যথেষ্ট। আর তোমরা পুরাতন পন্থাই অবলম্বন কর।” (সিলসিলা যয়ীফাহ্ ২/১৯)
ফরয নামাযের পর একাকী বা জামাআতী মুনাজাত বিদআত হওয়া প্রসঙ্গে ফতোয়া দেখুন। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৫৫, ২০/১৪৭, ২৪/৭০, ৯২, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন১/৩৬৭, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৭৭-২৮২, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৯, প্রভৃতি)
সবশেষে, হাত তুলে মুনাজাত নেই বলে সালাম ফিরার পরপরই উঠে সুন্নত পড়তে লাগা অথবা প্রস্থান করা এবং যিক্র-আযকার ত্যাগ করা অবশ্য উচিৎ নয়।
নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতি
পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি একই প্রকার। সুতরাং মহিলাও ঐরুপ একই তরীকায় নামায পড়বে, যেরুপ ও যে তরীকায় পুরুষ পড়ে থাকে। কারণ, (নারী-পুরুষ উভয় জাতির) উম্মতকে সম্বোধন করে রসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা সেইরুপ নামায পড়, যেরুপ আমাকে পড়তে দেখেছ।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬৮৩নং) আর উভয়ের নামায পৃথক হওয়ার ব্যাপারে কোন দলীলও নেই।
সুতরাং যে আদেশ শরীয়ত পুরুষদেরকে করেছে, সে আদেশ মহিলাদের জন্যও এবং যে সাধারণ আদেশ মহিলাদেরকে করেছে তাও পুরুষদের ক্ষেত্রে পালনীয় -যদি বিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কোন প্রকার দলীল না থাকে। যেমন, “যারা সতী মহিলাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হল ৮০ কোড়া---।” (কুরআন মাজীদ ২৪/৪) পরন্তু যদি কেউ কোন সৎ পুরুষকে অনুরুপ অপবাদ দেয়, তবে তার জন্যও ঐ একই শাস্তি প্রযোজ্য।
সুতরাং মহিলারাও তাদের নামাযে পুরুষদের মতই হাত তুলবে, পিঠ লম্বা করে রুকূ করবে, সিজদায় জানু হতে পেট ও পায়ের রলাকে দূরে রেখে পিঠ সোজা করে সিজদাহ করবে। তাশাহ্হুদেও সেইরুপ বসবে, যেরুপ পুরুষরা বসে। উম্মে দারদা (রাঃ) তাঁর নামাযে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহ্ ছিলেন। (আত্-তারীখুস স্বাগীর, বুখারী ৯৫পৃ:, বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৫৫) আর মহিলাদের জড়সড় হয়ে সিজদাহ করার ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ নয়। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২৬৫২ নং) এ জন্যই ইবরাহীম নাখয়ী (রহঃ) বলেন, ‘নামাযে মহিলা ঐরুপই করবে, যেরুপ পুরুষ করে থাকে।’ (ইবনে আবী শাইবা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৮৯পৃ:)
পক্ষান্তরে দলীলের ভিত্তিতেই নামাযের কিছু ব্যাপারে মহিলারা পুরুষদের থেকে ভিন্নরুপ আমল করে থাকে। যেমন:-
১। বেগানা পুরুষ আশে-পাশে থাকলে (জেহরী নামাযে) মহিলা সশব্দে কুরআন পড়বে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩০৪) যেমন সে পূর্ণাঙ্গ পর্দার সাথে নামায পড়বে। তাছাড়া একাকিনী হলেও তার লেবাসে বিভিন্ন পার্থক্য আছে।
২। মহিলা মহিলাদের ইমামতি করলে পুরুষদের মত সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে।
৩। ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মহিলা পুরুষের মত ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ না বলে হাততালি দেবে।
৪। মহিলা মাথার চুল বেঁধে নামায পড়তে পারে, কিন্তু (লম্বা চুল হলে) পুরুষ তা পারে না।
এ সব ব্যাপারে দলীলসহ্ বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে দ্রষ্টব্য।
অনেক মহিলা আছে, যারা মসজিদে বা বাড়িতে পুরুষদের নামায পড়া না হলে নামায পড়ে না। এটা ভুল। আযান হলে বা নামাযের সময় হলে আওয়াল অক্তে নামায পড়া মহিলারও কর্তব্য। (মুত্বাসা ১৮৮-১৮৯পৃ:)
কুরআন মুখস্থ
কারো পক্ষে কুরআন মুখস্থ কোন প্রকারে সম্ভব না হলে, অথবা ফরয হওয়ার পর তৎপর মুখস্থ করার সুযোগ না হলে সে মুখস্থ করার পূর্বের নামাযগুলোতে ক্বিরাআতের স্থানে ‘সুবহা-নাল্লাহ্, অলহামদু লিল্লা-হ্, অলা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, অল্লা-হু আকবার, অলাহাওলা অলা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্’ বলবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৩২ নং, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায ভুলকারী সাহাবীকে বলেছিলেন, “অতঃপর যদি তোমার কুরআন মুখস্থ থাকে, তাহলে তা পাঠ কর। নচেৎ তাহ্মীদ (আলহামদু লিল্লা-হ্), তাকবীর (আল্লা-হু আকবার) ও তাহ্লীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) পড়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৬১ নং, তিরমিযী, সুনান)
সুতরাং কুরআন মুখস্থ হয় না বলে বা কুরআন মুখস্থ নেই বলে এই ওজরে নামায মাফ নয়। তাসবীহ্-তাহ্লীল পড়েও নামায পড়তে হবে এবং তার সাথে চেষ্টা থাকবে মহান আল্লাহর মহাবাণী মুখস্থ করার।
নামায কায়েম
মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে ও তাঁর রসূলের মুখে আমাদেরকে নামায পড়তে ও কায়েম করতে বলেছেন। সুতরাং নামায পড়াই যথেষ্ট নয়; নামায কায়েম করা জরুরী। আর নামায কায়েম হবে তখনই, যখন নামাযী নামাযের শর্তাবলী, রুক্ন, ফরয বা ওয়াজেব প্রভৃতি পালন করে বাহ্যিকভাবে এবং তার আধ্যাত্মিক বিষয়াবলী প্রতিষ্ঠা করে আন্তরিকভাবে নামায আদায় করবে। আর তখনই নামায সেই নামায হবে, যে নামায পাপ ও নোংরা কাজ হতে নামাযীকে বিরত রাখে।
নামাযের বাহ্যিক দিকটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা আমরা পূর্বেই জেনেছি। এবারে তার আধ্যাত্মিক দিকটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে তাই আলোচিতব্য।
আন্তরিক বিষয়াবলীর মধ্যে হৃদয় উপস্থিত রেখে একাগ্রতা ও মনোনিবেশের সাথে নামায পড়াই প্রধান। এর সঙ্গে থাকবে মনের কাকুতি-মিনতি, অনুনয়-বিনয়, সর্বমহান বিশ্বাধিপতি এবং একমাত্র প্রভু ও উপাস্যের সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে অন্তরে থাকবে নিরতিশয় আদব, ভক্তি ও বিনতি। আল্লাহ তাআলা বলেন, “মু’মিনগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে; যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র---।” (কুরআন মাজীদ ২৩/১)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে মুসলিম ব্যক্তির নিকটে কোন ফরয নামায উপস্থিত হয়, অতঃপর সে ঐ নামাযের ওযু, কাকুতি-মিনতি ও রুকূ সুন্দরভাবে করে, তাহলে এর ফলে কাবীরা গুনাহ না করলে তার পূর্বেকার গুনাহসমূহের তার জন্য কাফফারা হয়ে যায়। আর এরুপ হয় সব সময়ের জন্য। (মুসলিম, মিশকাত ২৮৬ নং)
“যে মুসলিম ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে, অতঃপর খাড়া হয়ে সে তার দেহ্-মন নিয়ে একাগ্রতার সাথে ২ রাকআত নামায পড়ে, সে ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যায়।” (মুসলিম, সহীহ ২৩৪ নং)
বিনতির মানে এই নয় যে, নামাযীকে নামাযে কাঁদতে হবে। বিনতি হল হৃদয়ের উপস্থিতি ও সর্বাঙ্গের স্থিরতার নাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৫৬)
অতএব একাগ্রতা, মনোযোগ ও বিনতির সাথে আপনি আপনার নামায কায়েম করতে চাইলে নিম্নেক্ত কয়েকটি উপদেশ গ্রহণ করুন :-
১। আপনি যে নামায পড়ছেন তা নিশ্চয় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে। সুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, তাঁর হুকুম পালনার্থে, তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরাগ, ভক্তি ও প্রেম প্রকাশার্থে, তাঁর নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জনের আশায়, তাঁর আযাবের ভয়ে, তাঁর সওয়াব ও ক্ষমার কামনাতেই আপনি নামায পড়ুন।
২। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনি মনে করুন যে, আল্লাহর খাস দরবারে আপনি হাজির হয়েছেন। আপনি যেন তাঁকে দেখছেন, তিনি আরশের উপর রয়েছেন। সেখান হতেই তিনি সারা সৃষ্টির প্রতি সূক্ষ্ণদৃষ্টি রেখেছেন। তিনি আপনার নামায পড়াও দেখছেন। অবশ্য তাঁর কোন প্রকার আকার ও প্রতিমূর্তি মনে কল্পনা করবেন না। কারণ, তাঁর মত কোন কিছুই নেই।
আপনি আপনার মর্মমূলে ভাবুন যে, তিনি অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়। তিনি আদেশ করেন, নিষেধ করেন, ভালোবাসেন আবার ক্রোধান্বিতও হন। বান্দার কোনও গোপন বা প্রকাশ্য কথা বা কর্ম তাঁর নিকট গুপ্ত নয়। সকল বিষয়ে তিনি সবিশেষ অবহিত। “চক্ষুর ছল-চাহ্নি এবং হৃদয় যা গোপন করে তা তিনি জানেন।” (কুরআন মাজীদ ৪০/১৯) এই প্রত্যয়ের সাথে সাথে তাঁর জন্য আপনার অন্তরে যথার্থ তা’যীম, ভক্তি, অনুরাগ, ভীতি, প্রেম, আগ্রহ্, আশা, ভরসা, বিনতি প্রভৃতি সমবেত হবে। টুটে যাবে সাংসারিক সকল বন্ধন। শুধু টিকে থাকবে আল্লাহ ও আপনার মাঝে মুনাজাতের ও নিরালায় গভীর আলাপের বন্ধন।
৩। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনি স্মরণ করুন, আপনাকে মরতেই হবে এবং ফিরে যেতে হবে সেই বিশাল বাদশার নিকট, যাঁর সামনে আপনি দন্ডায়মান আছেন, আর হিসাবও লাগবে তাঁর কাছে সকল কাজের। ধরে নিন্ হয়তো আপনার এটা শেষ নামায। সালাম ফিরে হয়তো আর নামাযের সুযোগ পাবেন না। যেন আপনি আপনার প্রিয়তমের নিকট থেকে বিদায়কালে শেষ সাক্ষাৎ করছেন, শেষ কথা বলছেন ও শেষ আবেদন জানিয়ে নিচ্ছেন। আর এই সময় কি আপনি আপনার চোখের পানি রুখে রাখতে পারেন? এই মুহূর্তে কি আপনার মন অন্য দিকে ছুটতে পারে?
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তুমি তোমার নামাযে মরণকে স্মরণ কর। কারণ, মানুষ যখন তার নামাযে মরণকে স্মরণ করে, তখন যথার্থই সে তার নামাযকে সুন্দর করে। আর তুমি সেই ব্যক্তির মত নামায পড়, যে মনে করে না যে, এ ছাড়া সে অন্য নামায পড়তে পারবে। তুমি প্রত্যেক সেই কর্ম থেকে দূরে থাক, যা করে তোমাকে (অপরের নিকটে) ক্ষমা চাইতে হয়। (মুসনাদে ফেরদাঊস, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪২১, জামে ৮৪৯ নং)
এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আমাকে সংক্ষেপে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, “যখন তুমি তোমার নামাযে দাঁড়াবে তখন (মরণ পথের পথিকের বিদায় নেওয়ার সময়) শেষ নামায পড়ার মত নামায পড়। এমন কথা বলো না, যা বলে (অপরের নিকট) ক্ষমা চাইতে হয়। আর লোকেদেরহাতে যা আছে তা থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে যাও।” (বুখারী তারীখ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৪১৭১ নং, আহমাদ, মুসনাদ ৫/৪১২, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৪০১ নং)
আর এক বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “তুমি (মরণ পথের পথিকের বিদায় নেওয়ার সময়) শেষ নামায পড়ার মত নামায পড়। (মনে মনে কর,) যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, নচেৎ তিনি তোমাকে দেখছেন---।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী, প্রমুখ সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৯১৪ নং)
৪। মনে করুন আপনি আল্লাহর সাথে কথা বলছেন এবং আল্লাহ আপনার কথা শুনছেন ও জওয়াবও দিচ্ছেন। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি নামাযকে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে প্রার্থনা করে।’ সুতরাং বান্দা যখন বলে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’-লামীন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল ---।’ (মুসলিম, মিশকাত ৮২৩ নং)
আপনি মনে করুন, আপনি তাঁর সাথে একান্ত নিরালায় আলাপন করছেন। সুতরাং কারো সাথে নিভৃত আলাপে কানে-কানে কথা বলার সময় আপনার মন ও খেয়াল কি অন্য দিকে থাকতে পারে? মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রভুর সাথে নির্জনে আলাপ করে ---।” (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৬ নং)
৫। নামাযে খেয়াল করুন। আপনি এক অপরাধী, ক্ষমার ভিখারী। আপনি এক পলাতক দাস, অ নু তপ্ত হয়ে তাঁর অনুগ্রহ-প্রার্থনা। আপনি একজন দুর্বল ক্ষমতাহীন, ক্ষমতার ভিখারী। আপনি একজন নিঃস্ব অসহায়, সাহায্য ও সহায়তার অভিলা ষী । পথভ্রষ্ট, পথ-নির্দেশের আশাধারী। কি¾ষ্ট ও পীড়িত, নিরাপত্তা ও নিরাময়ের ভিখারী। রুযীহীন, রুযীর ভিখারী। আর মনে রাখুন যে, এসব ভিক্ষা আপনি তাঁর দরজা ছাড়া অন্য কারো দরজায় পাবেন না, পেতে পারেন না। তাই তো আপনি প্রত্যেক রাকআতে বলে থাকেন, “আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করে থাকি এবং তোমারই নিকট সাহায্য ভিক্ষা করি।” (সূরা ফাতিহা/৪)
৬। নামাযে আপনার চক্ষু শীতল হোক। হৃদয়-মন ভরে উঠুক শান্তি ও স্বস্তিতে। উপশম হোক সকল প্রকার ব্যথা ও বেদনার। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযে আমার চক্ষু শীতল করা হয়েছে।” (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, জামে ৩১২৪ নং) একদা তিনি বিলাল (রাঃ) কে বললেন, “নামাযের ইকামত দিয়ে ত্বরা আমাদেরকে শান্তি দাও, হে বিলাল!” (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮৫, মিশকাত ১২৫৩ নং) অতএব আপনিও আপনার মনের পরম শান্তি নামাযেই খুঁজে পাবেন।
৭। এই সময় আপনি মিষ্টি সুরে সুন্দর ক্বিরাআত করুন। দেখবেন, যত পড়বেন তত আরো পড়তে মন হবে। ক্বিরাআত ছাড়তেই ইচ্ছা হবে না। সেই সময় মুনাজাতের এমন এক মিষ্ট স্বাদ আছে, যা ত্যাগ করতেই মন হবে না। ইমামের পশ্চাতে হলে মনে হবে নামায আরো লম্বা হোক।
৮। আর নামায যদি আপনার চক্ষুর শীতলতা হয় তাহলে নিশ্চয়ই কোন নামায আপনার পক্ষে ভারি হওয়া উচিৎ নয়। তা এক প্রকার বোঝা মনে করা এবং সময় হলে তা কোন রকম আদায় করে নামিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতে থাকাও উচিৎ নয়। কারণ নামাযকে ভারি মনে করা মুনাফিকের চরিত্র ও লক্ষণ। ঐ দেখুন না, আল্লাহ তার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, “মুনাফিকরা --- যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে কেবল লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।” (কুরআন মাজীদ ৪/১৪২) “আর তারা আলস্য ভরা মন নিয়ে নামাযে উপস্থিত হয়।” (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “এশা ও ফজরের নামায মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে বেশী ভারি নামায।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০৬৬ নং)
সুতরাং নামাযকে ভারি মনে করবেন না এবং দায় সারার মত চটপট পড়ে নিয়ে কি করে অব্যাহ্তি মিলে সেই চেষ্টায় থাকবেন না। কারণ, জানেন যে, শান্তির সময় সংক্ষেপ হয় এবং কষ্টের সময় লম্বা। অতএব নামায যদি আপনার জন্য শান্তিপ্রদ হয়, তবে আপনাকে মনে হবে যে, তা চট করে শেষ হয়ে গেল। পক্ষান্তরে যদি তা ভারি ও কষ্টদায়ক মনে করে তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য অস্বস্তিবোধ করে থাকেন, তাহলে সে নামাযের সময় আপনাকে আরো লম্বা লাগারই কথা। পরন্তু মহান আল্লাহ যদি আপনার নিকট প্রিয়তম হন, তবে তাঁর সাথে নিরালায় আলাপ করতে তো বিরক্তি ও অস্বস্তিবোধ করার কথা নয়!
৯। কিন্তু প্রিয়তমের সাথে নিরালায় আলাপনের মিষ্ট স্বাদ তখনই পাবেন, যখন আপনি সজ্ঞানে তার সাথে কথা বলবেন। নচেৎ, পাগল যেমন প্রলাপ বকে কোন শান্তি পায় না, তেমনি আপনিও পাবেন না। সুতরাং নামাযে আপনি যা বলছেন, তা সম্পূর্ণ না হলেও মোটামুটি বুঝে বলুন। যা বলছেন, তা সঠিকভাবে বলুন। নচেৎ আপনি কি বলছেন, তা যদি আপনি নিজেই না বোঝেন অথবা ‘দাদা’ বলতে ‘গাধা’ বলেন, তাহলে নিশ্চয়ই সেই আলাপে মজা পাবেন না, বিধায় ফলও হবে অপরিণত বা বিপরীত।
ঐ দেখুন না, প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। সুতরাং সে কি আলাপ করছে, তা যেন সে লক্ষ্য করে।” (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৬ নং)
যদি আপনি বুঝে ও খেয়াল করে সূরা তথা দুআ-দরুদ পড়েন, তাহলে তার ফল যে সুন্দর ও মিষ্ট হবে তা নিশ্চিত। ঐ ফলের ব্যাপারে রসূল (সাঃ) বলেন, “যখনই কোন মুসলিম পূর্ণরুপে ওযূ করে নামায পড়তে দাঁড়ায় এবং (তাতে) যা বলছে তা সে বুঝে, তখনই সে প্রথম দিনের শিশুর মত (নিষ্পাপ) হয়ে নামায সম্পন্ন করে।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ১৮৩, ৫৪৪ নং)
নামাযে ‘রুহ্’ বা ‘জান’ আনতে যে জিনিস বেশী সাহায্য করে, তা হল নামাযে যা পড়া বা বলা হয় তার অর্থ বুঝা। অন্যথায় নারকেলের খোসা না ভেঙ্গে উপরে কামড় দিলে যেমন নারকেলের স্বাদ পাওয়া যায় না, পরন্তু মেহনত বরবাদ ও দাঁতে দরদ হয়, অনুরুপ আরবী ভেঙ্গে না বুঝে নামায পড়লে নামাযেরও কোন স্বাদ পাওয়া যায় না। তাতে বিশেষ তৃপ্তি ও ফললাভ হয় না।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “বান্দা নামায পড়ে, অথচ তার নামাযের ১০, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫, ৪, ৩ অথবা ২ ভাগের ১ ভাগ মাত্র (কবুল বলে) লিপিবদ্ধ হয়!” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৯৬ নং, নাসাঈ, সুনান)
বলাই বাহুল্য যে, যার নামায যত মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাহ্ মোতাবেক এবং রুহ্বিশিষ্ট হবে, তার নামায তত পূর্ণাঙ্গ ও বেশী শুদ্ধ হবে। নচেৎ, সেই কমি অনুসারে সওয়াবও কম হতে থাকবে।
মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশার অবস্থায় নামাযের নিকটব র্তী হ্য়ো না, যতক্ষণ না তোমরা কি বলছ তা বুঝতে পার---।” (কুরআন মাজীদ ৪/৪৩) সুতরাং মাদকদ্রsব্যর মত ঔদাস্য, গাফলতি, খেল-তামাশা, পার্থিব সম্পদ এবং (নামাযী নামাযে যা বলছে তা বুঝতে চেষ্টা না করার) আলস্য যাকে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে সে কি নামাযের নিকটে আসার অযোগ্য নয়?
ফলকথা, সর্বপ্রকার মাদকতা, নেশা, ঔদাস্য ও অমনোযোগিতা থেকে পবিত্র হয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে আলাপ করাই মু’মিনের কর্তব্য।
১০। নামাযের ভিতর আপনি আপনার আত্মf ও শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। আপনি নামাযে মন বসালেও শয়তান কিন্তু আপনার পিছন ছাড়ে না। তাই তো অনেক ভুলে যাওয়া কথা নামাযে মনে পড়ে থাকে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযের জন্য আযান দেওয়া হলে শয়তান পাদতে পাদতে এত দূরে পালায়, যেখানে আযান শোনা যায় না। আযান শেষ হলে আবার ফিরে আসে। ইকামত শুরু হলে পুনরায় পালায়। ইকামত শেষ হলে নামাযীর কাছে এসে তার মনে বিভিন্ন কুমন্ত্রণা আনয়ন করে বলে, ‘এটা মনে কর, ওটা মনে কর।’ এইভাবে নামাযীর যা মনে ছিল না তা মনে করিয়ে দেয়। এর ফলে নামাযী শেষে কত রাকআত নামায পড়ল তা জানতে পারে না।” (বুখারী ৬০৮ নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩১৩)
উসমান বিন আবুল আস (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসূল! শয়তান আমার ও আমার নামায এবং ক্বিরাআতের মাঝে অন্তরাল ও গোলমাল সৃষ্টি করে। (বাঁচার উপায় কি?)’ তিনি বললেন, “ওটা হল ‘খিনযাব’ নামক এক শয়তান। সুতরাং ঐরুপ অনুভব করলে তুমি আল্লাহর নিকট ওর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করো এবং তোমার বাম দিকে ৩ বার থুথু মেরো।” উসমান বলেন, এরুপ করলে আল্লাহ আমার নিকট থেকে শয়তানের ঐ কুমন্ত্রণা দূর করে দেন। (মুসলিম, সহীহ ২২০৩ নং)
১১। নামাযে দাঁড়িয়ে আপনার দৃষ্টিকে ঠিক সিজদার জায়গায় নিবদ্ধ রাখুন। তাশাহ্হুদে বসে দৃষ্টি রাখুন শাহাদতের আঙ্গুলের উপর। এতে আপনার মন সজাগ ও সতর্ক থাকবে। এ ব্যাপারেহাদীস পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
১২। উপর দিকে খবরদার নজর তুলবেন না। আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায পড়তে পড়তে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলে দেখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “লোকেদের কি হয়েছে যে, ওরা নামাযের মধ্যে ওদের দৃষ্টি আকাশের দিকে তোলে?” এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য খুব কঠেfর হয়ে উঠল। পরিশেষে তিনি বললেন, “অতি অবশ্যই ওরা এ কাজ হতে বিরত হোক, নচেৎ ওদের চক্ষু ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে।” (বুখারী৭৫০নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
নবী (সাঃ) আরো বলেন, “নামাযের মধ্যে আকাশের (উপরের) দিকে দৃষ্টিপাত করা হতে লোকেরা অতি অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ ওদের দৃষ্টি আর ফিরে না-ও আসতে পারে। (ওরা অন্ধ হয়ে যেতে পারে!)” (মুসলিম, সহীহ৪২৮নং)
১৩। আর এদিক-সেদিকও তাকাবেন না। চোরা ও টেরা নজরে কোন কিছু দেখবেন না। কারণ, এই দৃষ্টি আকর্ষণ ও চুরি করা শয়তানের কাজ। (বুখারী ৭৫১নং, আবূদাঊদ, সুনান)
বান্দা যদি তার নামাযে এদিক-ওদিক দৃষ্টি না ফিরায়, তাহলে আল্লাহ তার নামাযের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হন। (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৫৫০ নং) বান্দার এদিক-ওদিক চেহারা ফিরিয়ে দিলে আল্লাহও আর সে নামাযের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন না। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫২ নং) সুতরাং সাবধান! আপনার নামায থেকে মহান আল্লাহ যেন মুখ ফিরিয়ে না নেন এবং দুশমন শয়তানও যেন আপনার নামায ছিনতাই করে না নেয়।
১৪। আপনি নামাযে দাঁড়াবার আগে আপনার সম্মুখ হতে সেই সমস্ত জিনিসকে দূরে সরিয়ে দেন, যা আপনার নজর কেড়ে নেবে, মনোযোগ ছিনিয়ে নেবে, খেয়াল আকর্ষণ করবে ও একাগ্রতা নষ্ট করবে বলে আশঙ্কা করেন। এই জন্যই প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “গৃহে (মসজিদে) এমন কোন জিনিস থাকা উচিৎ নয়, যা নামাযীকে মশগুল (অন্যমনস্ক) করে ফেলে।” (আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/৬৮, ৫/৩৮০) একদা তিনি নক্সাদার কাপড়ে নামায পড়ে বললেন, “আমি এর নক্সার দিকে একবার তাকালে আমাকে তা আমার নামায থেকে অমনোযোগী করে ফেলার উপক্রম করেছিল।” (বুখারী, মুসলিম, মালেক, মুঅত্তা, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৭৬ নং) মা আয়েশা رضي الله عنها এর একটি ছবিযুক্ত কাপড় টাঙ্গানো থাকলে সেদিকে মুখ করে নামায পড়ার পর তিনি বললেন, “এটাকে আমার নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দাও। কারণ, এর ছবিগুলো আমার নামাযে বাধা সৃষ্টি করছিল।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আহমাদ, মুসনাদ ৬/১৭২)
১৫। নামাযের পূর্বে আপনি প্রস্রাব-পায়খানার কাজ সেরে নিন এবং প্রস্রাব বা পায়খানার চাপ নিয়ে নামাযে দাঁড়ান না। কারণ, এতে নামাযে মন বসে না। হয়তো বা তাড়াহুড়ো করে নামায শেষ করতে হয় অথবা নামাযে অন্যমনõতা আসে। অনুরুপ পেটে খিদে রেখে সামনে খাবার উপস্থিত থাকলে অথবা খাবারের দিকে মন পড়ে থাকলেও নামাযে দাঁড়ানো উচিৎ নয়। কারণ এতে নামায হয় না। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে আবী শাইবা, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৮নং)
১৬। এমন কোন ভারী জিনিস সঙ্গে নিয়ে নামাযে দাঁড়াবেন না, যাতে নামাযের বদলে ঐ ভারের প্রতিই আপনার মন লেগে না থাকে।
১৭। এমন কোন স্থানে বা লেবাসে নামায পড়তে শুরু করবেন না, যার দুর্গন্ধ আপনাকে অতিষ্ঠ করে তোলে।
১৮। এমন টাইট-ফিট লেবাস পরে নামায পড়বেন না, যাতে বসা-ওঠা কষ্টকর হয়।
১৯। বেপর্দা মহিলারা যখন গায়ে-মাথায় কাপড় বা চাদর নিয়ে নামায পড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবে তাদেরকে গরম লাগে। এতে নামাযে মন বসে না এবং যত তাড়াতাড়ি শেষ করে চাদর খুলতে পায় সেই চেষ্টা করে। সুতরাং নামাযী হওয়ার সাথে সাথে আপনি পর্দানশীন মহিলা হতে চেষ্টা করুন। যেমন ওযু করার পর ‘মেক-আপ’ করলে যাতে নামাযের আগে ওযু ভেঙ্গে গিয়ে পুনরায় ওযুতে তা নষ্ট হয়ে না যায়, তার জন্য তাড়াতাড়ি নামায শেষ করা এবং মাথার চুল বেঁধে বা চুলে ফুল গুঁজে নামায পড়তে পড়তে চুলের ও ফুলের পারিপাট্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বারবার ওড়নার প্রতি খেয়াল করাও নামাযে অমনোযোগিতার দলীল।
২০। পরনে এমন ওড়না, কাপড়, শাল, চাদর, বা শাড়ি হতে হবে, যেন নামাযের অবস্থায় তা বারবার পড়ে না যায়। নচেৎ, সোজা করতে করতেই নামায শেষ হবে অথচ নামাযে মন থাকার পরিবর্তে মন থাকবে কাপড় পড়ার দিকে। পক্ষান্তরে যদি মহিলাদের মাথা, বুক, পেট অথবা হাত বা পায়ের রলা থেকে কাপড় সরে যায়, তাহলে তো মূলে নামাযই নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরী।
২১। কোন লটকে রাখা কাজ বন্ধ করে - যেমন চুলোর উপর হাঁড়ি রেখে নামায পড়বেন না। কারণ, এ অবস্থায় নামাযে মন না থেকে মন পড়ে থাকবে ঐ চুলোর হাঁড়ির উপরেই। পাছে উল্টে না যায় বা পুড়ে না যায়, ইত্যাদি।
২২। সম্ভব হলে এমন স্থানে নামায পড়ুন, যেখানে খুব গরম আপনাকে অতিষ্ঠ করবে না এবং খুব শীতও আপনাকে কাতর করে ফেলবে না। অনুরুপ যে স্থানে হৈ-হুল্লোড়, চেচামেচি বা গোলমাল-গন্ডগোলের ফলে আপনার নামাযে একাগ্রতার ব্যাঘাত ঘটে, সে স্থানে নামায পড়বেন না। (কাইফা তাখশাঈনা ফিস স্বালাহ্ ১৯-২৪ দ্র:)
২৩। আপনার সামনে কোন ঘুমন্ত ব্যক্তি থাকলে এবং তার কাপড় সরে যাওয়া বা ঘুমের ঘোরে আপনার নামাযের স্থান দখল করার আশঙ্কা হলে সে জায়গায় নামায পড়তে দাঁড়াবেন না। অনুরুপ যে ব্যক্তি কথা বলছে, তাকে সামনে করেও নামায পড়বেন না। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৯৪ নং)
২৪। নামাযের সময় ঘুম এলে যথাসম্ভব তা দূর করে নামায পড়ুন। নচেৎ, মন যে আপনাকে ফাঁকি দেবে, তা বলাই বাহুল্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়া অবস্থায় ঘুমে ঢুলতে থাকলে সে যেন একটু শুয়ে ঘুম তাড়িয়ে নেয়। নচেৎ, ঢুলতে ঢুলতে নামায পড়তে থাকলে সে হয়তো আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসবে।” (বুখারী ২১২ নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৬/৫৬)
তিনি আরো বলেন, “কেউ নামাযে ঢুলতে লাগলে সে যেন ঘুমিয়ে নেয়। যাতে সে কি পড়ছে, তা বুঝতে পারে।” (বুখারী ২১৩ নং)
অবশ্য এমন ঘুম বৈধ নয়, যাতে নামাযের সময়ই পার হয়ে যায়।
২৫। আপনি নামায পড়ছেন তার জন্য নিজে নিজে গর্বিত না হয়ে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ হন। যেহেতু তাঁর তওফীক দানের ফলেই আপনি এত বড় ইবাদত পালনে সক্ষম হয়েছেন। ঈমান, ইবাদত প্রভৃতি এক একটি অমূল্য ধন ও এক একটি বিশেষ অনুগ্রহ। আর বান্দার যাবতীয় ধন ও অনুগ্রহ তো আল্লাহরই দান। (কুরআন মাজীদ ১৬/৫৩)
২৬। আপনি আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব করেছেন। এই দাসত্ব আপনার ঠিকমত হ্চ্ছে কি না, তা আপনি জানেন না। সুতরাং আপনি নিজের ত্রুটি ও অবহেলা স্বীকার করে মনকে ইবাদত কবুল না হওয়ার আশঙ্কা ও ভীতি দ্বারা পরিপূর্ণ রাখুন। মহান আল্লাহ বলেন, “আর যারা তাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাবে এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা ভয়-ভয় মনে দান করে। তারাই দ্রুত কল্যাণকর কাজ সম্পাদন করে এবং তারা ওতে অগ্রগামী হয়।” (কুরআন মাজীদ ২৩/৬০-৬১)
মা আয়েশা رضي الله عنها জিজ্ঞাসার ছলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বললেন, ‘ওরা কি তারা, যারা মদ খায়, চুরি করে (বা ব্যভিচার করে এবং এর কারণেই আল্লাহকে ভয় করে)?’ তিনি বললেন, “না, হে সিদ্দীক-তনয়া! বরং (আল্লাহ তাদের কথা বলেছেন) যারা রোযা করে, নামায পড়ে, দান-খয়রাত করে, অথচ তারা এই ভয় করে যে, হয়তো এসব তাদের কবুল হবে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩১৭৫, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৪১৯৮ নং)
আপনি যতই ইবাদত করুন না কেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই কম। জান্নাতের মূল্য তো অবশ্যই নয়। এ জন্যই প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “কেউই তার আমলের জোরে জান্নাত যেতে পারবে না।” বলা হল, ‘আপনিও কি নন, হে আল্লাহর রসূল?’ বললেন, “আমিও নই। তবে যদি আল্লাহ তাঁর রহ্মত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করেন তাহলে!” (বুখারী ৫৬৭৩, ৬৪৬৩, মুসলিম, সহীহ ২৮১৬ নং, প্রমুখ, দ্র: স্বালাতুল মুহিব্বীন, ইবনুল কাইয়িম)
ইবনুল জাওযী বলেন, ‘হে সেই নামাযী! যে তার দেহ্ নিয়ে নামাযে দন্ডায়মান অথচ তার হৃদয় অনুপস্থিত! যেটুকু বন্দেগী তুমি করেছ তা তো বেহেশ্তের মোহ্র হওয়ার জন্যও যথেষ্ট নয়, বেহেশ্তের মূল্য হওয়া তো দূরের কথা। একদা একটি ইদুর এক উট দেখে তাকে পছন্দ করল। (বন্ধুত্ব গড়ার আশায়) সে তার লাগাম ধরে টান দিলে উটটি তার অনুসরণ করল। অতঃপর যখন উভয়ে ইদুরের ঘরের দরজায় সামনে উপস্থিত হল, তখন থমকে দাঁড়িয়ে উট যেন তার ভাব-জিভে বলতে লাগল, প্রেম করতে হলে তুমি প্রেমিকের জন্য এমন ঘর প্রস্তুত কর, যা তোমার প্রেমিকের জন্য উপযুক্ত অথবা এমন প্রেমিক নির্বাচন কর, যে তোমার ঘরের উপযুক্ত।
এই উদাহ্রণ থেকে তুমি শিক্ষা নাও, আর এমন নামায পড় যা তোমার সেই (বিশাল পরাক্রমশালী) মা’বূদের জন্য উপযুক্ত। নচেৎ এমন মা’বূদ দেখ, যে তোমার নামাযের উপযুক্ত।’ (আল-মুদহিশ ৪৭২-৪৭৩পৃ:)
এই সকল উপদেশ যদি মেনে চলেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনার নামাযে রুহ্ আসবে এবং তা কায়েম ও প্রতিষ্ঠা হবে। আর এই নামাযই হবে আপনাকে মন্দ কাজ হতে বিরতকারী।
এবার সলফে সালেহীনের নিকট থেকে একাগ্রতার কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নিন। ইনশাআল্লাহ আপনি তাতে আরো উৎসাহ্ ও উদ্দীপনা পাবেন।
নামাযে সলফদের একাগ্রতার কিছু নমুনা
‘যাতুর রিকা’ অভিযানে মুসলিমদের এক ব্যক্তি এক মুশরিক মহিলাকে হ্ত্যা করে ফেললে তার স্বামী প্রতিজ্ঞা করল যে, মুহাম্মাদের সঙ্গীদের মধ্যে কারো রক্ত না বহানো পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হবে না। এই সংকল্প নিয়ে সে মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের খোঁজে বের হয়ে পড়ল। এদিকে মহানবী (সাঃ) এক মঞ্জিলে বিশ্রাম নিতে অবতরণ করলে সাহাবাগণের উদ্দেশ্যে বললেন, “কে আমাদের (নিরাপত্তার) জন্য পাহারা দেবে?” এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুহাজিরদের মধ্যে এক ব্যক্তি এবং আনসারদের মধ্য হতে আর এক ব্যক্তি পাহারা দিতে প্রস্তুত হলেন। তাঁদেরকে মহানবী (সাঃ) বললেন, “তোমরা এই উপত্যকার মুখে অবস্থান কর।”
অতঃপর তাঁরা দু’জন যখন উপত্যকার মুখে পৌঁছলেন, তখন মুহাজেরী (বিশ্রামের জন্য) শয়ন করলেন এবং আনসারী উঠে নামায পড়তে শুরু করলেন। এমতাবস্থায় উক্ত মুশরিক লোকটি কাছাকাছি এসে যখন তাঁর (নামাযীর) আবছা দেহ্ দেখতে পেল, তখন সে বুঝল, নিশ্চয় ও মুহাম্মাদের গুপ্তচর। সুতরাং তাঁর প্রতি তীর নিক্ষেপ করলে তা সঠিক নিশানায় পৌঁছে আনসারীকে আঘাত করল। তিনি তীর দেহ্ থেকে বের করে দিয়ে নামাযেই মশগুল থাকলেন। এইভাবে পরপর তিন খানা তীর খেয়ে ও তা বের করে ফেলে রুকু-সিজদাহ করে সম্পন্ন করলেন। অতঃপর তার মুহাজেরী সঙ্গী জেগে উঠলেন। মুশরিকটি তার কথা ওরা জানতে পেরেছেন ভেবে পালিয়ে গেল। এরপর মুহাজেরী যখন আনসারীর রক্তাক্ত দেহের প্রতি লক্ষ্য করলেন, তখন বলে উঠলেন, ‘সুবহানাল্লাহ্! প্রথম বারেই যখন তীর মারল, তখনই কেন আমাকে জাগিয়ে দাওনি?’ আনসারী উত্তরে বললেন, ‘আমি এমন একটি সূরা পাঠ করছিলাম, যা শেষ না করে আমি ছাড়তে পছন্দ করলাম না!’ (আবূদাঊদ, সুনান ১৯৮ নং, আহমাদ, মুসনাদ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
আলী বিন হুসাইন (রহঃ) যখন নামাযের জন্য ওযু সম্পন্ন করতেন, তখন তাঁর দেহে কম্পন শুরু হত! এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘ধিক তোমাদের প্রতি! তোমরা জান কি, কার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি? কার সাথে মুনাজাত (নির্জনে আলাপ) করতে চলেছি?’ (হিলয়্যাতুল আওলিয়া ৩/১৩৩)
মুহাম্মাদ বিন মুনকাদিরের ব্যাপারে কথিত আছে যে, তিনি এক রাত্রে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন এবং এত বেশী কাঁদতে লাগলেন যে, তাঁর ঘরের লোক ভয় পেয়ে গেল। তারা তাঁকে এত কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কোন উত্তর পেল না। অবশেষে তাঁকে চুপ না হতে দেখে তারা আবূহাযেমের নিকট ব্যাপার খুলে বললে তিনি তাঁর নিকট এলেন। দেখলেন, তখনও তিনি কাঁদছেন। আবূহাযেম বললেন, ‘কি হল ভাই? কাঁদছ কেন? তোমার বাড়ির লোকেরা যে ভয় খেয়ে গেছে! কোন অসুখ তো করে নি? অথবা কি হয়েছে তোমার?’
মুহাম্মাদ বললেন, ‘(নামাযে কুরআন মাজীদের) একটি আয়াত পাঠ করে আমি কান্না রুখতে পারছি না।’ আবূহাযেম বললেন, ‘কোন্ আয়াত?’ বললেন,
(وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مَا لَمْ يَكُوْنُوْا يَحْتَسِبُوْنَ)
অর্থাৎ, (সেদিন) আল্লাহর তরফ থেকে ওদের উপর এমন শাস্তি এসে পড়বে, যা ওরা (পূর্বে) কল্পনাও করে নি। (কুরআন মাজীদ ৩৯/৪৭)
এ কথা শুনে আবূহাযেমও তাঁর সাথে কাঁদতে শুরু করে দিলেন এবং কান্নার ধারা আরো বেড়ে গেল! তা দেখে মুহাম্মাদের বাড়ির একটি লোক আবূহাযেমকে বলল, ‘ওর নির্জনতা কাটাবার জন্যই আপনাকে ডেকে আনলাম। (কিন্তু আপনিও যে ওর সাথে কাঁদতে লাগলেন?) অতঃপর তাঁরা তাদেরকে কান্নার কারণ বর্ণনা করলেন। (হিলয়্যাতুল আওলিয়া ৩/১৪৬)
অবশ্য মুনাজাতের এ মিঠf স্বাদ তখনই অনুভূত হবে, যখন নামাযী বুঝবে যে, সে তার নামাযে কাকে ও কি বলছে। নচেৎ গরম পানিতে ঘর পোড়া সম্ভব নয়। যেমন মুখে চিনি চিনি বললে চিনির মিষ্ট স্বাদ অনুভব হবে না।
মাইমূন বিন মিহ্রান বলেন, মুহাজেরদের এক ব্যক্তি এক ব্যক্তিকে খুব হাল্কা নামায পড়তে দেখে তাকে ভৎসনা করলেন। কিন্তু লোকটি অজুহাত দেখিয়ে বলল, ‘আমার একটি দামী জিনিস নষ্ট হওয়ার কথা মনে পড়লে নামায তাড়াতাড়ি পড়ে নিলাম।’ মুহাজেরী বললেন, ‘কিন্তু তার চেয়ে অধিক মূল্যবান জিনিস তুমি নষ্ট করে দিলে!’ (ঐ ৪/৮৪)
নামাযের মধ্যে যা বৈধ এবং অবৈধ
নামায পড়তে পড়তে এমন কিছু কাজ আছে যা করা বৈধ, অথচ সাধারণত: তা অবৈধ মনে হয় বা বড় ভুল ভাবা হয়। এ রকম কিছু কাজ নিম্নরুপ :-
১। কাঁদা;
নামায পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে অশ্র ঝরা অথবা ডুকরে বা গুমরে কেঁদে ওঠা দূষণীয় নয়। আল্লাহর ভয়ে এমন কান্না কাঁদা তাঁর নেক ও বিনম্র বান্দার বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, “--- তাদের নিকট করুণাময় (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদা ও ক্রন্দন করত।” (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৮)
আব্দুল্লাহ বিন শিখখীর বলেন, ‘একদা আমি নবী (সাঃ) এর নিকটে এলাম। তখন তিনি নামায পড়ছিলেন। আর তাঁর ভিতর থেকে চুলোর উপর হাঁড়িতে পানি ফোটার মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যাঁতার শব্দের মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০০০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর অসুখ যখন খুব বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বললে তিনি বললেন, “তোমরা আবূ বাকারকে নামায পড়াতে বল।” আয়েশা رضي الله عنها বললেন, ‘আবূ বাকার তো নরম-দেলের মানুষ। উনি যখন কুরআন পড়েন, তখন কান্না রুখতে পারেন না।’ মহানবী (সাঃ) বললেন, “তোমরা ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।” আয়েশা رضي الله عنها পুনরায় ঐ একই কথা বললে মহানবী (সাঃ) ও পুন: বললেন, “ওকে বল, ওই নামায পড়াবে ---।” (বুখারী, মিশকাত ১১৪০ নং)
এ কান্না দীর্ঘ হলেও তাতে নামায নষ্ট হয় না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১)
২। হাঁচি ও তার জন্য দুআ;
নামাযের মধ্যে হাঁচি এলে হাঁচির পর নির্দিষ্ট দুআ পাঠ বৈধ। আর সেই দুআর বড় ফযীলতও রয়েছে। কওমার ৫নং দুআ দেখুন।
৩। হাই তোলা;
নামাযে যদিও হাই তোলা বৈধ, তবুও যেহেতু হাই আলস্য জনিত বা নিদ্রা জনিত কারণে মুখ ব্যাদানোর নাম, তাই তা যথাসম্ভব দমন করা কর্তব্য। কারণ, নামাযে নামাযী আলস্য প্রদর্শন করলে শয়তান খোশ হয়।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কারো যখন নামাযে হাই আসে, তখন তার উচিৎ, তা যথাসাধ্য দমন করা এবং ‘হা-হা’ না বলা। কেন না, হাই শয়তানের তরফ থেকে আসে। আর সে তা দেখে হাসে।” (বুখারী, মিশকাত ৯৮৬ নং)
“তোমাদের কেউ হাই তুললে সে যেন তার মুখে হাত রেখে নেয়। কারণ, শয়তান হাই-এর সাথে (মুখে) প্রবেশ করে যায়!” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৪২৬ নং)
৪। থুথু ফেলা;
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে দাঁড়ালে সে যেন তার সম্মুখ দিকে থুথু না ফেলে। কারণ, সে যতক্ষণ নামাযের জায়গায় থাকে ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত (নিরালায় আলাপ) করে। আর তার ডান দিকেও যেন থুথু না ফেলে। কারণ, তার ডানে থাকে (বামদিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সম্মানিত নেকী-লেখক) ফিরিশ্তা। বরং সে যেন (মসজিদের মেঝে কাঁচা মাটির হলে অথবা মাঠে-ময়দানে নামায পড়লে) তার বাম দিকে অথবা (সেদিকে কেউ থাকলে) তার (বাম) পায়ের নিচে ফেলে। যা পরে সে দাফন করে দেবে।” (বুখারী, মুসলিম, ৭১০, ৭১১নং)
একদা তিনি মসজিদের কিবলার দিকে দেওয়ালে কফ লেগে থাকতে দেখে মর্মাহত হলেন এবং তা তাঁর চেহারাতেও ফুটে উঠল। তিনি উঠলেন এবং নিজ হাত দ্বারা তা পরিষ্কার করলেন। অতঃপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। তার প্রতিপালক থাকেন তার ও তার কিবলার মাঝে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন তার সামনের দিকে অবশ্যই থুথু না ফেলে। বরং সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে থুথু ফেলে।” অতঃপর তিনি তাঁর চাদরের এক প্রান্ত ধরে তার উপর থুথু ফেললেন এবং পাশাপাশি কাপড় ধরে কচলে দিলেন, আর বললেন, “অথবা সে যেন এইরুপ করে।” (বুখারী, মিশকাত ৭৪৬নং)
নাক ঝাড়লেও অনুরুপ করা উচিৎ। অবশ্য পৃথক রুমাল বা টিসু-পেপার ব্যবহার উত্তম।
৫। অনিষ্টকর জীব-জন্তু মারা:-
নামায পড়তে পড়তে সাপ, বিছা, বোলতা প্রভৃতি বিষধর ও অনিষ্টকর জন্তু মারা বৈধ। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযে দুই কালো জন্তু; সাপ ও বিছা মেরে ফেলো।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৯২১, তিরমিযী, সুনান ৩৯০, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৪৫, ত্বায়ালিসী ২৫৩৮, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ১৭৫৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮৯৬, ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৩৫১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৫৬, বায়হাকী ২/২৬৬, প্রমুখ)
অনুরুপ উকুন বা উকুন-জাতীয় পোকাও নামাযে মারা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০)
৬। চুলকানো:-
দেহে অস্বস্তিকর চুলকানি শুরু হলে নামায পড়া অবস্থাতেও চুলকানো বৈধ। কারণ, চুলকানিতে নামাযীর একাগ্রতা নষ্ট হয়। আর চুলকে দিলে অস্বস্তিবোধ দূর হয়ে যায়। সুতরাং এখানে ধৈর্য ধরা উত্তম নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০-৩৫১)
৭। প্রয়োজনবোধে চলা:-
শত্রুর ভয় হলে (জিহাদের ময়দানে) চলা অবস্থায় নামায বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামায সমূহের প্রতি -বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি- যত্নবান হও এবং আল্লাহর সম্মুখে বিনীতভাবে দাঁড়াও। কিন্তু যদি (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে চলা অথবা সওয়ার অবস্থায় (নামায পড়)।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮-২৩৯)
একদা মহানবী (সাঃ) স্বগৃহে দরজার খিল বন্ধ করে নফল নামায পড়ছিলেন। মা আয়েশা رضي الله عنها এসে দরজা খুলতে বললে তিনি চলে গিয়ে তাঁর জন্য দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর পুনরায় নিজের মুসাল্লায় ফিরে গেলেন। অবশ্য দরজা ছিল কিবলার দিকেই। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৯২২, তিরমিযী, সুনান ৬০১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, আবূ য়্যা’লা ৪৪০৬, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ২/২৬৫, মিশকাত ১০০৫ নং)
একদা তিনি সূর্যগ্রহণের নামাযে বেহেশ্ত দেখে অগ্রসর এবং দোযখ দেখে পশ্চাদপদ হয়েছিলেন। (বুখারী ১০৫২, মুসলিম, সহীহ ৫২৫ নং)
সাহাবাগণকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি মিম্বরে চড়ে নামায পড়েছেন। মিম্বরের উপর রুকূ করে পিছ-পায়ে নেমে নিচে সিজদাহ করেছেন। (বুখারী ৯১৭, মুসলিম, সহীহ ৫৪৪ নং) একদা আবূ বাকার (সাঃ) এর ইমামতি কালে মহানবী (সাঃ) এসে উপস্থিত হলে তিনি (আবূ বাকার) পিছ-পায়ে সরে এসেছিলেন। (বুখারী ৬৮০, ১২০৫ নং) আবূ বারযাহ্ আসলামী (রাঃ) ফরয নামায পড়তে পড়তে তাঁর ঘোড়া পালাতে শুরু করলে তিনি তার পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন। (বুখারী ১২১১ নং, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী)
৮। ছেলে তোলা:-
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) ইমামতি করতেন, আর আবুল আসের শিশু কন্যা তাঁর কাঁধে থাকত। অতঃপর যখন তিনি রুকূ করতেন, তখন তাকে নিচে নামিয়ে দিতেন। পুনরায় যখন সিজদাহ থেকে উঠতেন, তখন আবার কাঁধে তুলে নিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৮৪ নং) এ ব্যাপারে ‘দীর্ঘ সিজদাহ’ শিরোনামে শাদ্দাদ (রাঃ) এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
৯। শিশুদের ঝগড়া থামানো:-
একদা বানী মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে মহানবী (সাঃ) এর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি নামায পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৭২৭ নং)
১০। খোঁচা দিয়ে সরে যেতে ইঙ্গিত করা:-
মা আয়েশা رضي الله عنها মহানবী (সাঃ) এর নামায পড়া কালে তাঁর সামনে কিবলার দিকে পা মেলে শুয়ে থাকতেন। তিনি (অন্ধকারে) যখন সিজদাহ করতেন, তখনহাতের খোঁচা দিয়ে তাঁকে (স্ত্রীকে) পা সরিয়ে নিতে ইঙ্গিত করতেন। (বুখারী ৩৮২, ১২০৯ নং)
১১। ইশারায় সালামের জওয়াব দেওয়া:-
নামাযী নামাযে রত থাকলেও তাকে সালাম দেওয়া বিধেয় এবং নামাযীর নামায পড়া অবস্থাতেই সালামের জওয়াব দেওয়া কর্তব্য। তবে মুখে নয়, হাত বা আঙ্গুলের ইশারায়। (মুসলিম, সহীহ ৫৩৮, আদা, মিশকাত ৯৮৯ নং)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, আমি বিলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (সাঃ) এর নামাযে রত থাকা অবস্থায় ওঁরা (সাহাবীগণ) যখন সালাম দিতেন, তখন তিনি কিভাবে উত্তর দিতেন? বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘হাত দ্বারা ইশারা করে।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, শাফেয়ী, মিশকাত ৯৯১নং)
একদা তিনি উটের উপর নামায পড়ছিলেন। জাবের (রাঃ) তাঁকে সালাম দিলে তিনি হাতের ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৪০নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা সুহাইব (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি আঙ্গুলের ইশারায় জওয়াব দিয়েছিলেন। (তিরমিযী, সুনান ৩৬৭নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা আবূ হুরাইরা (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৯৯৮)
একদা ইবনে উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির নিকট গেলেন, তখন সে নামায পড়ছিল। তিনি তাকে সালাম দিলে সে মুখে উত্তর দিল। পরে ইবনে উমার (সাঃ) তাকে বললেন, ‘নামায পড়া অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কাউকে সালাম দেওয়া হলে সে যেন মুখে উত্তর না দেয়। বরং সে যেন হাত দ্বারা ইশারা করে উত্তর দেয়।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০১৩ নং)
সালামের জওয়াব ছাড়া নামাযে প্রয়োজনে অন্য জরুরী কথাও ইঙ্গিত ও ইশারার মাধ্যমে বুঝানো যায়। একদা মহানবী (সাঃ) নামায পড়ছিলেন। তিনি সিজদাহ করলে হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) তাঁর পিঠে চড়ে বসলে সাহাবীগণ বারণ করলেন। কিন্তু তিনি ইশারা করে বললেন, “ওদেরকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও।” অতঃপর নামায শেষ করলে তিনি উভয়কে কোলে রেখে বললেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এই দু’জনকেও ভালোবাসে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৭৮ নং, বায়হাকী ২/২৬৩)
১২। নামাযে কাউকে কোন জরুরী ব্যাপারে সতর্কীকরণ
নামাযী নামাযে রত আছে এ কথা জানাতে অথবা ইমাম নামাযে কিছু ভুল করলে তার উপর তাঁকে সতর্ক করতে পুরুষদের জন্য ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ বলা এবং মহিলাদের জন্য হাততালি দেওয়া বিধেয়।
প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের নামাযের মধ্যে (অস্বাভাবিক) কিছু ঘটে গেলে পুরুষেরা যেন ‘তাসবীহ’ পড়ে এবং মহিলারা যেন হাততালি দেয়।” (বুখারী ৬৮৪, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৮৮ নং)
নারী এমন এক সৃষ্টি, যার রুপ, সৌরভ ও শব্দে পুরুষের মন প্রকৃতিগতভাবে চকিত হয়ে ওঠে। ফলে, যাতে নামাযের সময় তাদের মোহ্নীয় কণ্ঠস্বরে পুরুষরা সংকটে না পড়ে তার জন্য শরীয়তের এই বিধান। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় ফিরে বেড়ায়। (বুখারী ৩২৮১, মুসলিম, সহীহ ২১৭৫ নং) এবং পুরুষদের জন্য নারী হল সবচেয়ে বড় ফিতনার জিনিস। (বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম, সহীহ ২৭৪০ নং)
এখান থেকে বুঝা যায় যে, মহিলাদের পৃথক জামাআত হলে এবং সেখানে কোন বেগানা পুরুষ না থাকলে হাততালি না দিয়ে তাসবীহ পড়ে মহিলারা (মহিলা) ইমামকে সতর্ক করতে পারে। কারণ, তাসবীহ হল নামাযের এক অংশ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬২-৩৬৩)
মুক্তাদীদের মধ্যেও কেউ কিছু ভুল করলে, (যেমন সিজদায় বা বৈঠকে ঘুমিয়ে পড়লে) তাকেও সতর্ক করার জন্য তাসবীহ ব্যবহার চলবে। (ঐ ৩/৩৬৭-৩৬৮)
১৩। ইমামের ক্বিরাআত সংশোধন:-
নামাযে কুরআন পাঠ করতে করতে যদি ইমাম সাহেব কোন আয়াত ভুলে যান, থেমে যান অথবা ভুল পড়েন, তাহলে ‘লুকমাহ্’ দিয়ে তা মনে পড়ানো, ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করা বিধেয়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমিও ভুলে যাই, যেমন তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে মনে পড়িয়ে দিও।” (বুখারী ৪০১, মুসলিম, সহীহ ৫৭২নং)
একদা তিনি নামাযে কুরআন পড়তে পড়তে ভুলে কিছু অংশ ছেড়ে দিলেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক আয়াত আপনি ছেড়ে দিয়েছেন, (পড়েন নি)। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে মনে পড়িয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
একদা নামাযে ক্বিরাআত পড়তে পড়তে তাঁর কিছু গোলমাল হল। সালাম ফেরার পর উবাই (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “তুমি আমাদের সাথে নামায পড়লে?” উবাই (রাঃ) বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তবে ভুল ধরিয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭, ইহি, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২১২)
উল্লেখ্য যে, সূরা ফাতিহা নামাযের একটি রুক্ন অথবা ফরয। সুতরাং তা পড়তে ইমাম কোন প্রকারের ভুল করলে (যাতে অর্থ বদলে যায় তা) মুক্তাদীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ওয়াজেব। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৬)
১৪। প্রয়োজনে কাপড় বা পাগড়ীর উপর সিজদাহ করা:-
অতি গ্রীষ্ম বা শীতের সময় সিজদার স্থানে কপাল রাখা কষ্টকর হলে চাদর, আস্তীন বা পাগড়ীর বাড়তি অংশ ঐ স্থানে রেখে সিজদাহ করা বৈধ।
মহানবী (সাঃ) এর যামানায় সাহাবাগণ এরুপ করতেন। (বুখারী ৩৮৫, ৫৪২ নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/১০০)
জাবের (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে যোহরের নামায পড়তাম। আমার হাতের মুঠেfয় কিছু কাঁকর রেখে ঠান্ডা করে নিতাম এবং প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য তা কপালের স্থানে (সিজদার জায়গায়) রেখে নিতাম। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০১১ নং)
১৫। জুতা পরে নামায-
জুতা পাক-সাফ হলেও অনেকে বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাতের সময় তা পায়ে রাখে না। যা শ্রদ্ধার অতিরঞ্জন এবং বিদআত। বলাই বাহুল্য, এমন লোকদের নিকট জুতা পায়ে নামায পড়া তাদের কল্পনার বাইরে।
কিন্তু হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) জুতা পায়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৩৮৬, মুসলিম, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন আম্র বলেন, আমি নবী (সাঃ) কে খালি পায়ে ও জুতা পায়ে উভয় অবস্থাতেই নামায পড়তে দেখেছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৩ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
রসূল (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন তার জুতা পরে নেয় অথবা খুলে তার দু’ পায়ের মাঝে রাখে। আর সে যেন তার জুতা দ্বারা অপরকে কষ্ট না দেয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৫ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
তিনি আরো বলেন, “তোমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ কর (এবং জুতা পরে নামায পড়)। কারণ, ওরা ওদের জুতো ও চামড়ার মোজায় নামায পড়ে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫২ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
জুতা খুলে নামায পড়লে এবং মসজিদে জুতা রাখার কোন নির্দিষ্ট জায়গা না থাকলে যদি বাম পাশে কেউনা থাকে তাহলে বাম পাশে, নচেৎ দুই পায়ের মাঝে রাখতে হবে। ডান দিকে রাখা যাবে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
অবশ্য জুতায় ময়লা বা নাপাকী লেগে থাকলে তা পরে নামায হয় না। নাপাকী বা ময়লা মাটিতে বা ঘাসে রগড়ে মুছে দূর করে নিয়ে তাতে নামায পড়া যায়। নামাযের মাঝে জুতায় ময়লা লেগে আছে দেখলে বা জানতে পারলে তা সাথে সাথে খুলে ফেলা জরুরী। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫০, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৪ নং)
খেয়াল রাখার বিষয় যে, মসজিদ পাকা ও গালিচা-বিছানো হলে তার ভিতরে জুতা পরে গিয়ে নোংরা করা বৈধ নয়। মসজিদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার খেয়াল অবশ্যই জরুরী।
১৬। মনে অন্য চিন্তা এসে পড়া:-
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে অন্য চিন্তা এসে পড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় না। অবশ্য অন্য চিন্তা এনে দেওয়ার কাজ শয়তানই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে করে থাকে। আর এ কথা আমরা ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামে পড়েছি এবং শয়তান ও তার কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও সেখানে জেনেছি।
হযরত উমার (রাঃ) স্বীকার করেন যে, তিনি কোন কোন নামাযে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত ও প্রেরণ করার কথা চিন্তা করতেন। (বুখারী বিনা সনদে ২৩৯পৃ:)
একদা আসরের নামাযে মহানবী (সাঃ) এর মনে পড়ল যে, তাঁর ঘরে কিছু সোনা বা চাঁদির টুকরা থেকে গেছে। তাই সালাম ফিরেই সত্বর তিনি কোন পত্নীর গৃহে প্রবেশ করে রাত্রি আসার পূর্বেই দান করতে আদেশ করে এলেন! (বুখারী ৮৫১, ১২২১ নং)
সাহাবাগণের মধ্যে এমন অনেক সাহাবা ছিলেন, যাঁরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে নামায পড়তেন। কিন্তু গত রাত্রে এশার নামাযে তিনি (সাঃ) কোন্ সূরা পড়েছেন তা খেয়াল রাখতে পারতেন না। (বুখারী ১২২৩ নং)
অবশ্য প্রত্যেকের উচিৎ, যথাসম্ভব অন্য চিন্তা এবং অন্যমনস্কতা দূর করা। নচেৎ অন্য খেয়াল বা চিন্তা যত বেশী হবে, নামাযের সওয়াব তত কম হয়ে যাবে।
১৭। সিজদার জায়গা সাফ করা:-
সিজদার জায়গা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে নামাযের মাঝে (সিজদার সময়) ফুঁক দেওয়া বৈধ। আল্লাহর নবী (সাঃ) সূর্য-গ্রহণের নামাযের সিজদায় ফুঁক দিয়েছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৯৪, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ২/১৮৮, বুখারী বিনা সনদে ২৩৮পৃ:)
পক্ষান্তরে ফুঁক দেওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩১৩পৃ:) অনুরুপ কাঁকর সরানো নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীসও যয়ীফ। (ঐ) পরন্তু সহীহ হাদীসে একবার মাত্র সরানোর অনুমতি আছে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮০ নং) তবে না সরানো ১০০টি উৎকৃষ্ট উটনী অপেক্ষা উত্তম। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫৫ নং)
১৮। নামাযীর লেবাসের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক কাপড়ে এবং খালি মাথায় নামায পড়া বৈধ।
১৯। মুসহাফ হাতে দেখে দেখে কুরআন পাঠ:-
তারাবীহ্ প্রভৃতি লম্বা নামাযে (লম্বা ক্বিরাআতের) হাফেয ইমাম না থাকলে ‘কুল-খানী’ করে ঠকাঠক কয়েক রাকআত পড়ে নেওয়ার চেয়ে মুসহাফ (কুরআন মাজীদ) দেখে দেখে পাঠ করে দীর্ঘ ক্বিরাআত করা উত্তম। (অবশ্য কুরআন খতমের উদ্দেশ্যে নয়।) অনুরুপ (জামাআতে অন্য হাফেয মুক্তাদী না থাকলে) হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুক্তাদীর কুরআন দেখে যাওয়া বৈধ। এ সব কিছু প্রয়োজনে বৈধ; ফলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।
মা আয়েশা رضي الله عنها এর আযাদকৃত গোলাম যাকওয়ান রমযানে (তারাবীতে) দেখে দেখে কুরআন পাঠ করে তাঁর ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
ইমাম হাসান, মুহাম্মদ, আত্বা প্রমুখ সলফগণ এরুপ (প্রয়োজনে) বৈধ মনে করতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২১৪, ৭২১৮, ৭২১৯, ৭২২০, ৭২২১ নং)
বর্তমান বিশ্ব তথা সঊদী আরবের উলামা ও মুফতী কমিটির সিদ্ধান্ত মতেও প্রয়োজনে মুসহাফ দেখে তারাবীহ্ পড়ানো বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৪, ২১/৫৬) সঊদিয়ার প্রায় অধিকাংশ মসজিদে আমলও তাই।
হযরত আনাস (রাঃ) নামাযে ক্বিরাআত পড়তেন আর তাঁর গোলাম তাঁর পশ্চাতে মুসহাফ ধরে দাঁড়াতেন। তিনি কিছু ভুলে গেলে গোলাম ভুল ধরিয়ে দিতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২২২ নং)
নামাযের ভিতরে কুরআন খতম করলে খতমের পরে দুআ করার কোন দলীল নেই। তাই কুরআন খতমের দুআ নামাযের ভিতরে না করাই উচিৎ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭-৫৮) অবশ্য নামাযের বাইরে হযরত আনাস (রাঃ) কুরআন খতম করলে তাঁর পরিবার-পরিজনকে সমবেত করে দুআ করতেন। (ইবনুল মুবারাক, যুহ্দ ৮০৯ পৃ:, ইবনে আবী শাইবা ১০৮৭ নং, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ৭/১৭২)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, কুরআনের খতমের কোন নির্দিষ্ট দুআও নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৬৫, ১৮৬) অতএব কুরআন মাজীদের শেষ পৃষ্ঠার পর ‘দুআ-এ খতমিল কুরআন’ নামে যে দুআ প্রায় মুসহাফে ছাপা থাকে তা মনগড়া।
নামাযে যা করা মাকরুহ অথবা নিষিদ্ধ
১। নামাযে যে সমস্ত কার্যাবলী করা সুন্নত (যেমন রফ্য়ে ইয়াদাইন, ইস্তিরাহার বৈঠক, বুকেহাত বাঁধা ইত্যাদি) তার কোন একটিও ত্যাগ করা মাকরুহ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১২৫পৃ:)
২। মুখ ঘুরিয়ে বা আড় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখা, ঘড়ি বা অন্য কিছু দেখা বৈধ নয়।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, চোরা দৃষ্টিতে বা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে শয়তান নামাযীর নামায চুরি করে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮২নং) যেমন অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করে মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহও মুখ ফিরিয়ে নেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৯৯৫ নং)
নফল নামাযেও এদিক-ওদিক দেখা বৈধ নয়। বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীসগুলি সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩০৮-৩০৯পৃ:)
অবশ্য চোখের কোণে ডাইনে-বামের জিনিস দেখা বা নজরে পড়া নামাযের জন্য ক্ষতিকর নয়। কারণ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায পড়া অবস্থায় ডাইনে ও বামে লক্ষ্য করতেন। আর পিঠের দিকে ঘাড় ঘুরাতেন না।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৯৮ নং)
অনুরুপ ভয় ও প্রয়োজনের সময় দৃষ্টি নিক্ষেপ দূষণীয় নয়। একদা মহানবী (সাঃ) এক উপত্যকার দিকে জাসূস পাঠালেন। অতঃপর ফজরের নামায পড়তে পড়তে তার অপেক্ষায় সেই উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯১৬ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৩৭)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) যোহ্র ও আসরের নামাযে কুরআন পড়তেন তা সাহাবাগণ তাঁর দাড়ি হিলার ফলে বুঝতে পারতেন। (বুখারী ৭৪৬, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) অনুরুপ তাঁরা তাঁকে সিজদায় মাথা রাখতে না দেখার পূর্বে কেউ কওমা থেকে সিজদায় যেতেন না। (বুখারী ৭৪৭ নং)
অতএব শিশুর মা নামায পড়তে পড়তে যদি তার শিশুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে আড় নয়নে তাকায়, তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১২)
৩। আকাশের (বা উপর) দিকে তাকানো:-
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যেন অবশ্য অবশ্যই নামাযের মধ্যে আকাশের দিকে তাকানো হতে বিরত হয়, নচেৎ তাদের চক্ষু ছিনিয়ে নেওয়া হবে!” (বুখারী ৭৫০, মুসলিম, মিশকাত ৯৮৩ নং) অতএব নামায পড়তে পড়তে উপর বা আকাশ দিকে দৃষ্টিপাত করা হারাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১৫)
৪। চোখ বুজা-
মহানবী (সাঃ) যখন নামায পড়তেন, তখন তিনি তাঁর চোখ দু’টিকে খুলে রাখতেন। তাঁর দৃষ্টি থাকত সিজদার জায়গায়। তাশাহ্হুদে বসার সময় তিনি তাঁর তর্জনী আঙ্গুলের উপর নজর রাখতেন। এ ছাড়া তিনি চোখ খুলে রাখতেন বলেই মা আয়েশা رضي الله عنها এর দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিযুক্ত পর্দা তাঁর সম্মুখ থেকে সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। সুতরাং সুন্নত হল, চোখ খোলা রেখে নামায পড়া।
তবে হ্যাঁ, যদি প্রয়োজন পড়ে; যেমন সামনে কারুকার্য, নক্সা, ফুল বা এমন কোন জিনিস থাকে, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অথবা মনোযোগ কেড়ে নেয় অথবা ক্বিরাআত ভুলিয়ে দেয় এবং তা দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে নামায পড়ায় কোন দোষ নেই। বরং এই ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করেই নামায পড়া উত্তম হওয়া শরীয়ত এবং তার উদ্দেশ্য ও নীতির অধিক নিকটবর্তী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/২৯৩-২৯৪, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৮, ৫২, ৩১৬, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯-২৯০, মুত্বাসা ১৩০-১৩১পৃ:)
৫। এমন জিনিস (যেমন নক্সাদার মুসাল্লা, সৌন্দর্য ও কারুকার্যময় দেওয়াল বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যপূর্ণ কাপড় ইত্যাদি) সামনে রেখে নামায পড়া, যাতে নামাযীর মনোযোগ ও একাগ্রতা নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে ‘যে সব স্থানে নামায পড়া মাকরুহ’ শিরোনাম দেখুন।
৬। কোন প্রাণীর বা মানুষের ছবি, মূর্তি বা আগুন সামনে করে নামায পড়া। কারণ, এতে থাকে শির্কের গন্ধ এবং অমুসলিমদের সদৃশতা। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫০-২৫১পৃ:)
৭। কোন প্রাণী বা মানুষের ছবি চিত্রিত কাপড় পরে নামায পড়া। (ঐ ২৫১পৃ:)
৮। নিজের বা আর কারো ছবি পকেটে রেখেও নামায মাকরুহ। অবশ্য কোথাও রেখে নামায পড়লে চুরি হয়ে বা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় অবস্থায় ছবিযুক্ত টাকা-পয়সা, পাশপোর্ট, পরিচয়-পত্র প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে নামায পড়ায় দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৯৮, ১৯/১৬১)
৯। দুই হাতের আঙ্গুলসমূহকে পরস্পর খাঁজাখাঁজি করা:-
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সুন্দরভাবে ওযু করে মসজিদের উদ্দেশে বের হয়, তখন সে যেন অবশ্যই তার (দুইহাতের) আঙ্গুলসমূহকে খাঁজাখাঁজি না করে। কারণ, সে নামায অবস্থায় থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২৪২, ২৪৩, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২, তিরমিযী, সুনান ৩৮৬, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৩৩৩৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৪১নং, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২৩০,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২০৬, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/১০২) অর্থাৎ নামায পড়া অবস্থায় ঐরুপ নিষিদ্ধ।
নামাযের জন্য ওযূ করার পর থেকে নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐরুপ করা নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে আরো হাদীস দেখুন। (সহিহ তারগিব ২৯২, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৯৪, জামে ৪৪৫, ৪৪৬ নং)
১০। আঙ্গুল ফুটানো:-
নামাযের মধ্যে আঙ্গুল ফুটানো মাকরুহ। কারণ, এটি একটি বাজে ও নিরর্থক কর্ম এবং অপর নামাযীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৪)
১১। কোমরে হাত রাখা:-
আল্লাহর নবী (সাঃ) নামায পড়ার সময় কোমরে হাত রাখতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ১২১৯, ১২২০, মুসলিম, সহীহ ৫৪৫, মিশকাত ৯৮১ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এমন কাজ ইয়াহুদীদের। (বুখারী ৩৪৫৮, ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯১, ৪৬০০ নং) অথবা জাহান্নামীরা জাহান্নামে এরুপ কোমরে হাত রেখে আরাম নেবে। (ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯২, ৪৫৯৫ নং) সুতরাং তাদের সদৃশতা অবলম্বন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। অনেকে বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ, এরুপ কাজ অহংকারী, বিপদগ্রস্ত অথবা ভাবনা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের। তাই নামাযে এরুপ প্রদর্শন অবৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৫৫পৃ:)
১২। কুকুরের মত বসা:-
দুই পায়ের রলা খাড়া রেখে,হাত দু’টিকে মাটিতে রেখে এবং দুই পাছার উপর ভর করে কুকুরের মত বৈঠক নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক শয়তানের। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩১৬নং) এ ব্যাপারে অধিক জানতে তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৩। বামহাত দ্বারা ভর করে বসা:-
নামাযের বৈঠকে বামহাতকে মাটি বা মুসাল্লার উপর রেখে ঠেস দিয়ে বসা নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক আল্লাহর ক্রোধভাজন ইয়াহুদীদের। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০ নং) অতিরিক্ত তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৪। কাপড় গাঁটের নিচে ঝুলানো:-
পুরুষদের জন্য তাদের কাপড়; লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট, চোগা প্রভৃতি গাঁটের নিচে ঝুলিয়ে পরা সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ। পরন্তু মহান বাদশার সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে অহংকারীদের মত এমনভাবে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা অধিকভাবে নিষিদ্ধ। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য)
১৫। কাপড় (শাল বা চাদর) না জড়িয়ে দুই কাঁধে দু’ দিকে ঝুলিয়ে রাখা অথবা চাদরে জড়িয়ে থাকা অবস্থায়হাত দু’টিকেও তার ভিতরে রেখেই রুকূ-সিজদা করা:-
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) নামাযে এইভাবে কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৭৬৪ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে, এরুপ অভ্যাস ইয়াহুদীদের।
১৬। চাদর, শাল, কম্ফর্টার প্রভৃতির মাধ্যমে মুখ ঢাকা:-
নামায পড়া অবস্থায় মুখ ঢাকতে মহানবী (সাঃ) নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ৭৬৪ নং)
মদ্বীনার ফকীহ্ সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার কাউকে নামাযে মুখ ঢেকে থাকতে দেখলে তার মুখ থেকে তার কাপড়কে সজোরে টেনে সরিয়ে দিতেন। (মালেক, মুঅত্তা ৩০নং)
১৭। পুরুষের লম্বা চুল পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়া:-
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি তার (লম্বা) চুলকে পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়ে, সে সেই ব্যক্তির মত যে তার দুইহাত বাঁধা অবস্থায় নামায পড়ে।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) তিনি আরো বলেন, “ঐ বাঁধা চুল হল শয়তান বসার জায়গা!” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সিজদার বিবরণ দ্রষ্টব্য)
ইবনুল আষীর বলেন, লম্বা চুল খোলা অবস্থায় থাকলে সিজদাহ অবস্থায় সেগুলিও মাটিতে পড়ে যাবে। ফলে সিজদাহকারীকে ঐ চুলের সিজদাহ করার সওয়াব দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে বাঁধা বা গাঁথা থাকলে সেগুলো সিজদায় পড়তে পারবে না। তাই বাঁধতে নিষেধ করা হয়েছে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, মনে হয় এ বিধান কেবল পুরুষদের জন্যই, মহিলাদের জন্য নয়। ইবনুল আরাবী থেকে এ কথা উদ্ধৃত করে শওকানী তাই বলেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪৩পৃ:) কারণ, মেয়েদের চুল থাকবে বাঁধা ও কাপড়ের পর্দার ভিতরে। যা বের হলে মহিলার নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
১৮। কাপড় গুটানো:-
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি ৭ অঙ্গ দ্বারা সিজদাহ করি --- এবং কাপড় ও চুল না গুটাই।” (বুখারী, মুসলিম, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৮২, জামে ১৩৬৯ নং)
মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘এই নিষেধ কেবল নামায অবস্থাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং নামাযের পূর্বেও যদি কেউ তার চুল বা কাপড় গুটায় অতঃপর নামাযে প্রবেশ করে, তাহলে অধিকাংশ উলামাগণের মতে সে ঐ নিষেধে শামিল হবে। আর চুল বেঁধে নামায পড়া নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীস উক্ত মতকে সমর্থন করে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪৩পৃ:)
এখান থেকেই বহু উলামা বলেছেন যে, জামার আস্তীন বা হাতা গুটিয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ মহানবী (সাঃ) ও তাঁর উম্মত নামাযে কাপড় না গুটাতে আদিষ্ট হয়েছেন। আর জামারহাতা গুটানো কাপড় গুটানোরই শামিল।
ইমাম নওবী বলেন, উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, কাপড় বা জামার আস্তীন গুটিয়ে, চুল বেঁধে বা পাগড়ীর নিচে গুটিয়ে রেখে নামায পড়া নিষিদ্ধ। অবশ্য এই নিষেধের মান হল মাকরুহ। অর্থাৎ, এতে নামায নষ্ট হয় না। (শারহু মুসলিম ৪/২০৯, আউনুল মা’বূদ ২/২৪৭)
উক্ত নিষেধের কারণ বর্ণনায় অনেকে বলেন যে, কাপড় গুটানো বা তোলা অহংকারীদের লক্ষণ। তাই তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন নিষিদ্ধ। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৪৬)
অবশ্য কাপড় খুলে গেলে তা পরা উক্ত নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। বরং লজ্জাস্থান খুলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তো নামায অবস্থাতেও পরা ওয়াজেব। অনুরুপ উলঙ্গ নামাযী নামাযের মাঝে যদি কাপড় পায়, তাহলে সেই অবস্থাতেই তার জন্যও তা পরা ওয়াজেব। কারণ, কাপড় বর্তমান থাকতে লজ্জাস্থান বের করে নামায পড়লে নামায বাতিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৭-৩৪৮)
নামায পড়তে পড়তে খুব শীত লাগলে এবং পাশে কাপড় থাকলে নামাযী নামাযের মধ্যেই তা পরতে বা গায়ে নিতে পারে। কারণ না পরলে তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। (ঐ ৩/৩৪৮) অনুরুপ খুব গরম লাগলেও অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় কাপড় নামায অবস্থাতেই সরিয়ে ফেলতে পারে।
১৯। কাঁধ খোলা রেখে নামায-
কাঁধ খোলা রেখে নামায নিষিদ্ধ। (এ ব্যাপারে ‘নামাযীর লেবাস’ প্রসঙ্গে আলোচনা দেখুন।) সুতরাং বহু হাজীদের ইহ্রাম পরে এক কাঁধ খোলা অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫১পৃ:)
২০। সশব্দে কুরআন পাঠ:-
অনেকে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা ইত্যাদি পড়ার সময় মাঝে মাঝে গুন্গুন্ করে বা ফিসফিসিয়ে ওঠে। যাতে পাশের নামাযীর বড় ডিষ্টার্ব হয়। এমন করাও হাদীস থেকে নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। সুতরাং কি নিয়ে আলাপ করছে, তা যেন সে লক্ষ্য করে। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের পাশে কুরআন সশব্দে না পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মালেক, মুঅত্তা, প্রমুখ মিশকাত ৮৫৬ নং)
২১। খাবার সামনে রেখে নামায-
খাবার জিনিস সামনে হাজির থাকলে এবং খাওয়ার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা থাকলে তা না খেয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ, সে সময় খাবারের দিকে মন পড়ে থাকে এবং নামাযে যথার্থ মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের রাতের খাবার প্রস্তুত থাকে এবং সেই সময়ে নামাযের ইকামতও হয়, তখন তোমরা প্রথমে খাবার খাও। আর খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত কেউ যেন তাড়াহুড়ো না করে।” ইবনে উমার (রাঃ) এর জন্য খাবার বাড়া হলে সেই সময় যদি নামাযের ইকামত হত, তাহলে তা খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত নামাযে আসতেন না। সেই সময় তিনি ইমামের ক্বিরাআতও শুনতে পেতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১০৫৬ নং)
২২। প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রেখে নামায পড়া:-
প্রস্রাব-পায়খানার চাপ থাকলে সেই অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। সময় বা জামাআত ছুঠে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও প্রস্রাব-পায়খানার কাজ না সেরে নামাযে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “খাবার সামনে রেখে নামায নেই। আর তারও নামায নেই, যাকে প্রস্রাব-পায়খানার বেগ পেয়েছে।” (মুসলিম, সহীহ ৫৬০, মিশকাত ১০৫৭ নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৫-৩২৮)
তিনি আরো বলেন, “তোমাদের কারো পায়খানার তলব হলে এবং অন্য দিকে নামাযের ইকামত হলে প্রথমে সে যেন পায়খানাই করে।” (তিরমিযী, সুনান, আবূদাঊদ, সুনান ৮৮, নাসাঈ, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০৬৯ নং)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে তার জন্য প্রস্রাব-পায়খানার বেগ চেপে রেখে এবং (প্রয়োজন সেরে) হাল্কা হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নামায পড়া বৈধ নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৯১নং, প্রমুখ)
২৩। ঢুল বা তন্দ্রা অবস্থায় নামায-
ঘুমের ঘোর থাকলে বা ঢুল এলে (নফল) নামায পড়া উচিৎ নয়। বরং একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পড়া উচিৎ। অবশ্য ফরয নামাযের ক্ষেত্রে জামাআত ও নির্দিষ্ট সময় খেয়াল রাখা একান্ত জরুরী। (এ ব্যাপারে ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামের আলোচনা দ্রষ্টব্য)
২৪। মাদকদ্রব্য বা কোন হারাম বস্তু বহন করা:-
হ্কপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের নিকট কুরআন, সুন্নাহ্, বিবেক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিত্তিক বহু দলীল বর্তমান থাকার কারণে বিড়ি, সিগারেট, গালি, তামাক, গুল-জর্দা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য মাকরুহে তাহ্রীমী অর্থাৎ হারাম। তাই এ সব জিনিস পকেটে রেখে মসজিদে যাওয়া ও নামায পড়া মাকরুহ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৯-২০০)
২৫। হেলা-দোলা:-
নামায পড়তে পড়তে আগে-পিছে বা ডানে-বামে হেলা-দোলা বৈধ নয়। কেন না, এ কাজ নামাযে একাগ্রতা ও স্থিরতার প্রতিকূল। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২২০পৃ:)
অনেকে কেবল ডান অথবা বাম পায়ের উপর ভরনা দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়; যাতে কাতারের পাশের নামাযীরও ডিষ্টার্ব হয়। পক্ষান্তরে প্রিয় নবী (সাঃ) নামায শুরু করার পূর্বে সাহাবাগণের কাঁধ স্পর্শ করে বলতেন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও। বিভিন্নরুপে দাঁড়ায়ো না। নচেৎ তোমাদের হৃদয়ও বিভিন্ন হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮ নং)
অবশ্য নামায লম্বা হলে পা ধরার ফলে দু-একবার পা বদলে আরাম নেওয়া দূষণীয় নয়। তবে শর্ত হল, যেন এক পা অপর পায়ের চেয়ে বেশী আগা-পিছা না হয়ে যায়। বরং উভয় পা যেন বরাবর থাকে এবং এ কাজ বারবারও না হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩-৩২৪) তাছাড়া যেন পাশের মুসল্লীর ডিষ্টার্ব না হয়।
২৬। নামাযের প্রতিকূল কিছু আচরণ:-
নামায পড়তে পড়তে মাথা বা দাড়ি চুলকানো, বারবার মাথার টুপী, পাগড়ী বা রুমাল সোজা করা, ঘড়ি হিলানো ও দেখা, নখ, দাঁত, নাক ও ব্রণ খোঁটা প্রভৃতি অপ্রয়োজনীয় কর্ম বৈধ নয়। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৭২-১৭৫পৃ:) একটি কথা খুবই সত্য যে, হৃদয় চাঞ্চল্যময় থাকলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চঞ্চল থাকে। আর হৃদয়কে যদি শান্ত ও স্থির রাখা যায়, তাহলে বাহিরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সেই মহান বাদশার জন্য শান্ত ও স্থির থাকবে।
২৭। সালাম ফেরার সময়হাতের ইশারা মাকরুহ। (সালামের বিবরণ দ্রষ্টব্য)
নামায যাতে বাতিল হয়
এমন বহু কর্ম আছে, যা নামাযের ভিতরে করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। সে সব কর্মের কিছু নিম্নরুপ:-
১। অপ্রয়োজনে নামাযের ভিতর এত বেশী নড়া-সরা বা চলা-ফেরা করা যাতে অন্য কেউ দেখলে এই মনে করে যে, সে নামায পড়ে নি। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫২-৩৫৩) কারণ, কথা বলার মত নামাযের বহির্ভূত অন্যান্য কর্ম করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, “--- আর তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়াও।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮)
২। নামাযের কোন রুক্ন বা শর্ত ত্যাগ করা:-
ধীর-স্থিরভাবে নামায না পড়ার কারণে মহানবী (সাঃ) নামায ভুলকারী সাহাবাকে তিন-তিনবার ফিরিয়ে নামায পড়তে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ, মিশকাত ৭৯০ নং) কারণ, ধীর-স্থির ও শান্তভাবে নামায পড়া নামাযের এক রুক্ন ও ফরয। যা ত্যাগ করার পর সহু সিজদাহ করলেও সংশোধন হয় না।
অনুরুপ সূরা ফাতিহা, রুকূ, কোন সিজদাহ, সালাম বা অন্য কোন রুক্ন ত্যাগ করলে নামাযই হয় না। অবশ্য প্রয়োজনের চাপে কিছু অবস্থা ব্যতিক্রমও আছে, যাতে দু-একটি রুক্ন (যেমন কিয়াম, সূরা ফাতিহা) বাদ গেলেও নামায হয়ে যায়। সে কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি নাপাক হয়ে যায়, সে ব্যক্তি পুনরায় ওযূ না করা পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০০নং) “পবিত্রতা বিনা নামাযই কবুল হয় না।” (মুসলিম, মিশকাত ৩০১নং)
সুতরাং নামায পড়তে পড়তে কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে তার নামায বাতিল। নামায ত্যাগ করে পুনরায় ওযূ করে এসে নতুনভাবে নামায পড়তে হবে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১০০৭ নং)
অবশ্য ওযূ ভাঙ্গার নিছক সন্দেহের কারণে নামায বাতিল হয় না। নিশ্চিতরুপে ওযূ নষ্ট হওয়ার কথা না জানা গেলে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেন, “ (নামাযে হাওয়া বের হওয়ার সন্দেহ্ হলে) শব্দ না শোনা অথবা দুর্গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন নামায ত্যাগ না করে।” (বুখারী ১৩৭নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
নামায পড়তে পড়তে শরমগাহ্ বের হয়ে পড়লে, মহিলাদের পেট, পিঠ, হাতের বাজু, চুল ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়লে (তা কোন বেগানা পুরুষ দেখতে পাক অথবা না পাক) নামায বাতিল হয়ে যায়।
নামায পড়তে থাকা কালে কাপড়ে বীর্য (স্বপ্নদোষের) চিহ্ন অথবা (মহিলা) মাসিকের দাগ দেখলে নামায ত্যাগ করা জরুরী।
নামায অবস্থায় দেহ্ বা লেবাসের কোন স্থানে নাপাকী লেগে থাকতে নজর পড়লে যদি তা সত্বর দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে তা দূর করে নামায হয়ে যাবে। যেমন অতিরিক্ত লেবাসে; অর্থাৎ টুপী, রুমাল, গামছা বা পাগড়ী অথবা জুতায় নাপাকী দেখলে এবং সত্বর তা খুলে ফেলে দিলে নামায শুদ্ধ।
একদা নামায পড়তে পড়তে জিবরীল (আঃ) মারফৎ মহানবী (সাঃ) তাঁর জুতায় নাপাকী লেগে থাকার সংবাদ পেলে তিনি তা খুলে ফেলে নামায সম্পন্ন করেছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৬৬ নং)
সত্বর খোলা সম্ভব না হলে অথবা পূর্ণ লেবাস পরিবর্তন করা দরকার হলে নামায ত্যাগ করে পবিত্র লেবাস পরে পুনরায় নামায পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯)
কারো নামায পড়ার পর যদি মনে পড়ে যে সে বিনা ওযূতে নামায পড়েছে, অথবা কাপড়ে (নিজের) বীর্য (স্বপ্নদোষ) বা (মহিলা) মাসিকের চিহ্ন দেখে, তাহলে নামায শুদ্ধ হয় নি। যথা নিয়মে পবিত্র হওয়ার পর সে নামায পুনরায় পড়তে হবে। কারণ, দেহ্ নাপাক রেখে নামাযই হয় না।
পক্ষান্তরে নামায পড়ার পর যদি দেখে, কাপড়ে প্রস্রাব, পায়খানা বা অন্য কোন নাপাকী লেগে আছে; অর্থাৎ সে তা নিয়েই নামায পড়েছে, তাহলে না জানার কারণে তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। কারণ, বাইরের কাপড়ে (অনুরুপ কোন অঙ্গে) নাপাকী লেগে থাকলেও তার দেহ্ আসলে পাক ছিল। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৮, ২৯৮)
৩। জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত কথা বলা:-
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর নামায পড়া অবস্থায় আমরা তাঁকে সালাম দিতাম এবং তিনি সালামের উত্তরও দিতেন। অতঃপর যখন নাজাশীর নিকট থেকে ফিরে এলাম, তখন সালাম দিলে তিনি উত্তর দিলেন না। পরে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “নামাযে মগ্নতা আছে।” (বুখারী ১১৯৯ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর যুগে আমরা নামাযে কথা বলতাম; আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গীকে নিজের প্রয়োজনের কথা বলত। অতঃপর যখন আল্লাহর এই নির্দেশ অবতীর্ণ হল, “তোমরা নামাযসমূহ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” তখন আমরা চুপ থাকতে (নামাযের সূরা, দুআ, দরুদ ছাড়া অন্য কথা না বলতে) আদিষ্ট হ্লাম। (বুখারী ১২০০ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
অবশ্য নামাযে কথা বলা হারাম তা না জেনে যদি কেউ কথা বলেই ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল নয়। এক ব্যক্তি নামাযে হাঁচলে (ছিকি মারলে) মুআবিয়া বিনহাকাম নামাযের অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির জন্য ‘য়্যারহামুকাল্লাহ্’ বলে দুআ করলে সাহাবাগণ নিজেদের জানুতে আঘাত করে তাঁকে চুপ করাতে চাইলেন। নামায শেষ হলে আদর্শ শিক্ষক প্রিয় রসূল (সাঃ) তাঁকে নরমভাবে বুঝিয়ে বললেন, “এই নামাযে লোক-সমাজের কোন কথা বলা বৈধ (সঙ্গত) নয়। এতে যা বলতে হয় তা হল; তাসবীহ, তকবীর ও কুরআন পাঠ।” (মুসলিম, মিশকাত ৯৭৮ নং)
উক্ত হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, তিনি তাঁকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বলেছিলেন। সুতরাং বুঝা গেল, অজান্তে কেউ কথা বলে ফেললে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৯)
উল্লেখ্য যে, নামাযের সূরা, দুআ-দরুদ ইত্যাদির অনুবাদও যদি নামাযে বলা হয়, তাহলেও নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, অনুবাদও মানুষের সাধারণ কথার শামিল।
প্রকাশ থাকে যে, কথা যদি নামায সংশোধন করার মানসেও বলা প্রয়োজন হয়, তবুও বলা বৈধ নয়। যেমন যদি ইমাম আসরের সময় জোরে ক্বিরাআত পড়তে শুরু করে এবং কোন মুক্তাদী তা সংশোধনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এটা আসরের নামায’ অথবা যদি ইমাম এক সিজদার পর বসে যায় এবং কোন মুক্তাদী ‘তাসবীহ’ বলার পরও বুঝতে না পারে যে, দ্বিতীয় সিজদাহ করতে হবে; ফলে সে উঠতে যায়। এ ক্ষেত্রে কোন মুক্তাদীর ‘সিজদাহ’ বা ‘সিজদাহ করুন’ বলাও বৈধ নয়। এরুপ বললে নামায বাতিল। কারণ, পূর্বেই আমরা জেনেছি যে, নামাযে কিছু ঘটলে মহানবী (সাঃ) আমাদেরকে (পুরুষের জন্য) তাসবীহ এবং (মহিলার জন্য) হাততালি বিধেয় করেছেন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬৪-৩৬৫)
এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম ব্যাপার এই যে, কোন জামাআতের লোক ভুল করে চার রাকআতের জায়গায় তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের কেউ এই ভুল সম্বন্ধে স্মরণ দিলে এবং ইমামও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরো এক রাকআত নামায অবশ্যই পড়বে এবং সহু সিজদাহ করবে। আর এর মাঝে ইমাম-মুক্তাদীর ঐ কথোপকথন নামাযের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যেহেতু এ কথা তখনই বলা হয়, যখন সালাম ফিরে দেওয়া হয়। আর তখন কথা বলা বৈধ। পক্ষান্তরে নিশ্চিত জানা যায় না যে, সত্যই নামায কম পড়া হয়েছে কি না। এ রকমই হয়েছিল মহানবী (সাঃ) ও সাহাবাগণের। (দেখুন, বুখারী ৭১৪, মুসলিম, সহীহ ৫৭৩ নং)
৪। পানাহার করা:-
নামায পড়তে পড়তে খেলে অথবা পান করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মুখের ভিতর পান, গালি (?), চুইংগাম প্রভৃতি রেখে নামায হয় না। কারণ এ কাজ নামাযের পরিপন্থী। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০ পৃ:)
৫। হাসা:-
হাসলেও অনুরুপ কারণে নামায বাতিল পরিগণিত হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০পৃ:) অবশ্য কোন হাস্যকর জিনিস দেখে অথবা হাস্যকর কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে না পেরে যদি কেউ মুচকি হাসি (শব্দ না করে) হেসে ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল হবে না।
প্রকাশ থাকে যে, নামাযী কে হাসাবার চেষ্টা করা তথা তার নামায নষ্ট করার কাজ শয়তানের। কোন মুসলিম মানুষের এ কাজ হওয়া উচিৎ নয়।
৬। পিতার হারাম উপায়ে উপর্জিত অর্থ খেলে ও ব্যয় করলে পুত্রের নামায বাতিল নয়। তবে সেই অর্থ ব্যবহার না করতে যথাসাধ্য প্রয়াস থাকতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে পরহেযগারী অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য চলার পথ সহ্জ করে দেন। আর তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রুযী দান করে থাকেন, যা সে বুঝতে ও কল্পনাই করতে পারে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)
৭। ‘যাতে ওযূ নষ্ট হয় না’ শিরোনামে আলোচিত হয়েছে যে, গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে ওযূ ও নামায কিছুই বাতিল হয় না। অবশ্য এমন কাজ করলে তার উপর থেকে মহান আল্লাহর সুনজর ও দায়িত্ব উঠে যায়। আর ওযূ ও নামায বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীলের হাদীস সহীহ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০১)
৮। কোন কারণে ইমামের নামায বাতিল হলে পশ্চাতে মুক্তাদীদের নামায বাতিল নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৫-৩১৭) এ বিষয়ে ইমামতির বিবরণ দ্রষ্টব্য।
১০। নামাযী যদি জানে যে তার সামনে দিয়ে কোন মহিলা, গাধা বা কালো কুকুর অতিক্রম করবে এবং এ জানা সত্ত্বেও বিনা সুতরায় নামায পড়ে, তাহলে ঐ তিনটের একটাও তার সামনে বেয়ে পার হয়ে গেলে তার নামায বাতিল। কারণ, সুতরার বিবরণে আমরা জেনেছি যে, ঐ তিনটি জিনিস নামায নষ্ট করে দেয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৩, ৩৯২)
অনুরুপ মুক্তাদীর সুতরাহ্ ইমামের সুতরাই। অতএব ইমাম সুতরাহ্ রেখে নামায না পড়লে এবং ঐ তিনটের একটা সামনে বেয়ে অতিক্রম করলে ইমাম-মুক্তাদী সকলের নামায বাতিল।
প্রকাশ যে, নামায পড়তে পড়তে নামায বাতিল হওয়া জানা গেলে অথবা ওযূ নষ্ট হওয়া বুঝতে পারলে সাথে সাথে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসা ওয়াজেব। লজ্জায় বা অন্য কারণে নামায শেষ করা হারাম এবং তা এক প্রকার আল্লাহর সাথে ব্যঙ্গ করা! কারণ, যা তিনি গ্রহণ করবেন না, তা জেনেশুনেও নিবেদন করতে থাকা উপহাস বৈকি? (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯২-৩৯৩)
অবশ্য জামাআতে থাকলে লজ্জা হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে হাওয়া বের হওয়ার ফলে ওযূ নষ্ট হলে অনেকে নামায বা জামাআত ত্যাগ করে কাতার ভেঙ্গে আসতে লজ্জা ও সংকোচবোধ করে। কিন্তু মহানবী (সাঃ) এই লজ্জা ঢাকার জন্য এক কৃত্রিম উপায়ের কথা বলে দিয়েছেন; তিনি বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ তার নামাযে নাপাক হয়ে যাবে তখন সে যেন তার নাক ধরে নেয়। অতঃপর বের হয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/১৮৪, মিশকাত ১০০৭ নং)
ত্বীবী বলেন, এই নির্দেশ এই জন্য যে, যাতে লোকেরা মনে করে তার নাকে রক্ত আসছে (তাই বের হয়ে যাচ্ছে)। আর এরুপ করা মিথ্যা নয়, বরং তা ‘তাওরিয়াহ্’ বা বৈধ অভিনয়। শয়তান যাতে তার মনে লোকদেরকে শরম করার কথা সুশোভিত না করে ফেলে (এবং নামায পড়তেই থেকে যায়)। তাই তার জন্য এ কাজের অনুমতি ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (আউনুল মা’বূদ, মিরকাত, মিশকাতের টীকা ১নং, ১/৩১৮)
কার নামায কবুল নয়?
কিছু নামাযী আছে, যারা নামায তো পড়ে; কিন্তু তাদের নামায আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল ও গৃহীত হয় না। নামাযী অথবা নামাযের অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন না। এমন কতকগুলি নামাযী নিম্নরুপ:-
১। পলাতক ক্রীতদাস-
২। এমন স্ত্রী, যার স্বামী তার উপর রাগ করে আছে। স্ত্রী স্বামীকে সর্বদা খোশ রাখবে, তার (ভালো কথা ও কাজে) আনুগত্য করবে, তার সব কথা মেনে চলবে, যৌনসুখ দিয়ে তাকে সর্বদা তৃপ্ত রাখবে, কোন বিষয়ে রাগ হলে তা সত্বর মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সব কিছুতে তাকে সন্তুষ্ট রাখবে -এটাই হল স্ত্রীর ধর্ম। মহানবী (সাঃ) বলেন, তোমাদের (সেই) স্ত্রীরাও জান্নাতী হবে, যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, বারবার ভুল করে বারবার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী, যার স্বামী রাগ করলে সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি রাজী (ঠান্ডা) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৭ নং)
কিন্তু এমন বহু মহিলা আছে, যারা তাদের স্বামীর খেয়ে-পরেও এমন রাগ-রোষকে পরোয়া করে না। নারী-স্বাধীনতার পক্ষপাতিনী স্বামীর সংসারেও পরম স্বাধীনতা-সুখ ভোগ করতে গিয়ে স্বামীকে নারাজ রাখে। ফলে বিশ্বস্বামীও নারাজ হন এবং সেই স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী স্বামীকে খোশ করার আগে নামায পড়লেও সে নামাযে তিনি খোশ হন না। কারণ, ‘হুকূকুল ইবাদ’ আদায় না করা পর্যন্ত মহান আল্লাহ বান্দার তাওবাতে সন্তুষ্ট হন না। যার প্রতি অন্যায় করা হয়, তার নিকট আগে ক্ষমা পেলে তবেই মহান আল্লাহ ক্ষমা করেন। নচেৎ না।
৩। এমন লোক যে কারো বিনা অনুমতি ও আদেশেই কারো জানাযা পড়ায় (ইমামতি করে)। এমন ইমাম, যার ইমামতি অধিকাংশ মুক্তাদীরা পছন্দ করে না। তার পিছনে নামায পড়তে তাদের রুচি হয় না। ইমামতিতে ভুল আচরণ অথবা চরিত্রগত কোন কারণে অধিকাংশ লোকে তাকে ইমামতি করতে দিতে চায় না। এমন ইমামের নামায তার কান অতিক্রম করে না, মাথার উপরে যায় না, আকাশের দিকে ওঠে না, সাত আসমান পার হয়ে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া তো বহু দূরের কথা।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)
৪।এমন লোক, যে কোন গণকের কাছে ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জানার আশায় গণককে ‘ইলমে গায়বের মালিক’ মনে করে হাত দেখায়। এমন ব্যক্তির -কেবল গণকের কাছে যাওয়ার কারণেই- তার ৪০ দিনের (২০০ ওয়াক্তের) নামায কবুল হয় না! তার উপর গণক যা বলে তা বিশ্বাস করলে তো অন্য কথা। বিশ্বাস করলে তো সে মূলেই ‘কাফের’-এ পরিণত হয়ে যায়। আর কাফেরের নামায-রোযা অবশ্যই মকবূল নয়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট উপস্থিত হয়ে কোন (ভূত-ভবিষ্যৎ বা গায়বী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, সে ব্যক্তির ৪০ দিনের নামায কবুল হয় না।” (মুসলিম, সহীহ ২২৩০নং)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর নিকট উপস্থিত হয়ে সে যা বলে তা সত্য মনে (বিশ্বাস) করল, সে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ (কুরআনের) প্রতি কুফরী করল।” (আহ্মদ,হাকেম, সহীহুল জামে’ ৫৯৩৯নং)
৫। শারাবী, মদ্যপায়ী:-
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমার উম্মতের যে ব্যক্তি মদ পান করবে, আল্লাহ তার ৪০ দিন নামায কবুল করবেন না।” (নাসাঈ, সুনান, জামে ৭৭১৭ নং)
৬। এমন নামাযী, যে নামায পড়ে কিন্তু নামায চুরি করে। দায় সারা করে পড়ে। ঠিকমত রুকূ-সিজদাহ করে না। রুকূতে স্থির হয় না, সিজদায় স্থির থাকে না। কোমর বাঁকানো মাত্র তুলে নেয়। ‘সু-সু-সু’ করে দুআ পড়ে চটপট উঠে যায়! কারো কোমর ঠিকমত বাঁকে না। মাথা উঁচু করেই রুকূ করে। কারো সিজদার সময় নাক মুসাল্লায় স্পর্শ করে না। কারো পা দু’টি উপর দিকে পাল্লায়হাল্কা হওয়ার মত উঠে যায়। কেউ রুকূ ও সিজদার মাঝে স্থির হয়ে দাঁড়ায় না।হাফ দাঁড়িয়ে সিজদায় যায়।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে মুসলিম দল! সে ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি রুকূ ও সিজদাতে নিজ পিঠ সোজা করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫২৪ নং)
“আল্লাহ সেই বান্দার নামাযের দিকে তাকিয়েও দেখেন না, যে রুকূ ও সিজদার মাঝে নিজ পিঠকে সোজা করে (দাঁড়ায়) না।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২২, ত্বাবারানী, সহিহ তারগিব ৫২৫, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৬ নং)
“মানুষ ৬০ বছর ধরে নামায পড়ে, অথচ তার একটি নামাযও কবুল হয় না! কারণ, হয়তো বা সে রুকূ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু সিজদাহ পূর্ণরুপে করে না। অথবা সিজদাহ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু রুকূ ঠিকমত করে না।” (আসবাহানী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৫ নং)
“নামায ৩ ভাগে বিভক্ত; এক তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক তৃতীয়াংশ রুকূ এবং আর এক তৃতীয়াংশ হল সিজদাহ। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে, তার নিকট থেকে তা কবুল করা হবে এবং তার অন্যান্য সমস্ত আমলও কবুল করা হবে। আর যার নামায রদ করা হবে, তার অন্য সকল আমলকে রদ্দ্ করে দেওয়া হবে।” (বাযযার, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৭ নং)
৭। আযান শুনেও যে নামাযী বিনা ওজরে মসজিদের জামাআতে নামায পড়ে না-
জামাআতে নামায পড়া ওয়াজেব। এই ওয়াজেব ত্যাগ করলে তার নামায কবুল নাও হতে পারে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনা সত্ত্বেও মসজিদে জামাআতে এসে নামায আদায় করে না, কোন ওজর না থাকলে সে ব্যক্তির নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৩০০ নং)
৮। এমন মহিলা, যে আতর বা সেন্ট মেখে মসজিদের জন্য বের হয়:-
এমন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত না নাপাকীর গোসল করার মত গোসল করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামায কবুল হবে না। (ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ২৭০৩ নং)
৯। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান।
১০। দান করে যে দানের কথায় গর্ব ভরে প্রচার করে বেড়ায়।
১১। তকদীর অস্বীকারকারী ব্যক্তি। (ত্বাবারানী, জামে ৩০৬৫ নং)
১২। পরের বাপকে যে নিজের বাপ বলে দাবী করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
১৩। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে হ্ত্যা করে এবং তাতে সে গর্ববোধ করে ও খুশী হয়। (বায়হাকী ৮/২১, জামে ৬৪৫৪ নং)
১৪। খুনের বদলে খুনের বদলা নিতে যে ব্যক্তি (শাসন কর্তৃপক্ষকে) বাধা দেয়। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ৬৪৫১ নং)
১৫। যে ব্যক্তি মদ্বীনায় কোন বিদআত কাজ করে অথবা কোন বিদআতীকে আশ্রয় দেয়। অথবা কোন দুষ্কর্ম করে বা দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেয়।
১৬। যে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ১৩৭০ নং)
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের কোন ফরয-নফল নামায ও ইবাদতই (অথবা তওবা ও মুক্তিপণ কিয়ামতে) কবুল করা হবে না।
কাযা নামায
কেউ যথাসময়ে নামায পড়তে ঘুমিয়ে অথবা ভুলে গেলে এবং তার নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে, পরে যখনই তার চেতন হবে অথবা মনে পড়বে তখনই ঐ (ফরয) নামায কাযা পড়া জরুরী।
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে তার কাফফারা হল স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া।” অন্য এক বর্ণনায় বলেন, “এ ছাড়া তার আর কোন কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) নেই।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩ নং)
তিন আরো বলেন, “নিদ্রা অবস্থায় কোন শৈথিল্য নেই। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থায় হয়। সুতরাং যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার উচিৎ, স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া। কেন না, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।” (কুরআন মাজীদ ২০/১৪, মুসলিম, মিশকাত ৬০৪নং)
অতএব কাযা নামায পড়ার জন্য কোন সময়-অসময় নেই। দিবা-রাত্রের যে কোন সময়ে চেতন হলে বা মনে পড়লেই উঠে সর্বাগ্রে নামায পড়ে নেওয়া জরুরী। অন্যথা পরবর্তী সময়ের অপেক্ষা বৈধ নয়।
বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে বা সুযোগ ও সময় থাকা সত্ত্বেও না পড়ে অন্য ওয়াক্ত এসে গেলে পাপ তো হবেই; পরন্তু সে নামাযের আর কাযা নেই। পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। বিনা ওজরে যথাসময়ে নামায না পড়ে অন্য সময়ে কাযা পড়ায় কোন লাভ নেই। বরং যে ব্যক্তি এমন করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামায পড়ায় যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে নফল নামায বেশী বেশী করে পড়া। (মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ৭৮পৃ:, ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩নংহাদীসের আলবানীর টীকা দ্র:)
কেউ অজ্ঞান থাকলে জ্ঞান ফিরার পূর্বের নামায কাযা পড়তে হবে না। কারণ, সে জ্ঞানহীন পাগলের পর্যায়ভুক্ত। আর পাগলের পাপ-পুণ্য কিছু নেই। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৩২৮৭ নং, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৬/১২৮, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১২৬) ইবনে উমার (রাঃ) অজ্ঞান অবস্থায় কোন নামায ত্যাগ করলে তা আর কাযা পড়তেন না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪১)
অবশ্য নামায পড়তে পারত এমন সময়ের পর অজ্ঞান হলে জ্ঞান ফিরার পর সেই সময়ের নামায কাযা পড়া জরুরী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১২৬-১২৭)
পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি যদি কোন কারণে কোন বস্তু ব্যবহার করে স্বেচ্ছায় বেহুশ হয়, তাহলে তার জন্য কাযা পড়া জরুরী। (ঐ ২/১৮)
কাযা নামায পড়ার জন্য আযান ও ইকামত বিধেয়। কয়েক ওয়াক্তের নামায কাযা পড়তে হলে, প্রথমবার আযান ও তারপর প্রত্যেক নামাযের জন্য পূর্বে ইকামত বলা কর্তব্য।
এক সফরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) সহ্ সাহাবাগণ ঘুমিয়ে পড়লে ফজরের নামায ছুটে যায়। তাঁদের চেতন হয় সূর্য ওঠার পর। অতঃপর একটু সরে গিয়ে তাঁরা ওযূ করেন। বিলাল (রাঃ) আযান দেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান) অতঃপর সুন্নত কাযা পড়ে ইকামত দিয়ে ফজরের ফরয কাযা পড়েন। (বুখারী ৩৪৪, মুসলিম, সহীহ ৬৮০ নং, নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৭)
খন্দকের যুদ্ধের সময় মহানবী (সাঃ) ও সাহাবাগণের চার ওয়াক্তের নামায ছুটে গেলে গভীর রাত্রিতে তিনি বিলাল (রাঃ) কে আযান দিতে আদেশ করেন। (শাফেয়ী, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) অতঃপর প্রত্যেক নামাযের পূর্বে ইকামত দিতে বলেন। এইভাবে প্রথমে যোহ্র, অতঃপর আসর, মাগরেব ও এশার নামায পরপর কাযা পড়েন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী প্রমুখ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৫৭)
উল্লেখ্য যে, ফজরের আযান দিনে দিতে হলেও ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম” বলতে হবে। কারণ ফজরের ঐ কাযা নামাযে মহানবী (সাঃ) ফজরের সময় যা করেন, দিনেও তাই করে নামায আদায় করেছেন বলে প্রমাণ আছে। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ১/২০৪)
যে নামায যে অবস্থায় কাযা হয়, সেই নামাযকে সেই অবস্থা ও আকারে পড়া জরুরী। সুতরাং রাতের নামায দিনে কাযা পড়ার সুযোগ হলে রাতের মতই করে জোরে ক্বিরাআত করতে হবে। কারণ, মহানবী (সাঃ) যখন ফজরের নামায দিনে কাযা পড়েছিলেন, তখন ঠিক সেই রুপই পড়েছিলেন, যেরুপ প্রত্যেক দিন ফজরের সময় পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং) তদনুরুপ ছুটে যাওয়া নামায রাতে কাযা পড়ার সুযোগ হলে দিনের মতই চুপে চুপে ক্বিরাআত পড়তে হবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/২৭, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২০৪, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১০)
তদনুরুপ কেউ মুসাফির অবস্থায় নামায কাযা করে বাড়ি ফিরলে, বাড়ি ফিরার পর নামায কসর করে না পড়ে পুরোপুরি পড়বে; কিন্তু ঐ কাযা নামায কসর করেই আদায় করবে। কারণ, সফর অবস্থায় তার কসর নামাযই কাযা হয়েছে। আর বাড়িতে থাকা অবস্থায় কোন ছুটে যাওয়া নামায সফরে মনে পড়লে বা কাযা পড়ার সুযোগ হলে তা পুরোপুরিই আদায় করতে হবে। মোট কথা যেমন নামায কাযা হবে, ঠিক তেমনিভাবে তা আদায় করতে হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫১৮)
কাযা নামাযে তরতীব জরুরী
এখন যদি কেউ যোহরের নামায কাযা রেখে আসরের অক্তে মসজিদে আসে, তাহলে সে প্রথমে যোহরের নামায পড়ে নেবে। তারপর পড়বে আসরের নামায। কিন্তু কেউ যদি এমন সময় মসজিদে আসে, যে সময় আসরের জামাআত চলছে, তাহলে সে একাকী কাযা পড়তে পারে না। কারণ, জামাআত চলাকালে একই স্থানে দ্বিতীয় জামাআত বা পৃথক একাকী (জামাআতী) নামায হয় না। (মুসলিম, মিশকাত ১০৫৮ নং) আবার কাযা রেখে আসরের নামায জামাআতে পড়লে যোহরের পূর্বে আসর পড়া হয়। আর তা হল তরতীব ও অনুক্রমের পরিপন্থী। সুতরাং সে ব্যক্তি তরতীব বজায় রেখে যোহরের কাযা আদায়ের নিয়তে জামাআতে শামিল হবে এবং তারপর একাকী আসর পড়ে নেবে। (তুহ্ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৬৬পৃ:)
এ ক্ষেত্রে ইমামের নিয়ত ভিন্ন হলেও উক্ত মুক্তাদীর নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। কারণ, ইমাম-মুক্তাদীর নিয়ত পৃথক পৃথক হলেও উভয়ের নামায যে শুদ্ধ, তার প্রমাণ সুন্নাহতে মজুদ।
মহানবী (সাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়তে দেখলে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এমন কেউ কি নেই, যে এর সাথে নামায পড়ে একে (জামাআতের সওয়াব) দান করবে?” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৪, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬ নং) অথচ সে মহানবী (সাঃ) এর সাথে ঐ নামায পূর্বে পড়েছিল। সুতরাং ইমামের ছিল ফরয এবং মুক্তাদীর নফল।
একদা তিনি সালাম ফিরে দেখলেন, মসজিদের এক প্রান্তে দুই ব্যক্তি জামাআতে নামায পড়ে নি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমরা আমাদের বাসায় নামায পড়ে নিয়েছি।’ তিনি বললেন, “এমনটি আর করো না। বরং যখন তোমাদের কেউ নিজ বাসায় নামায পড়ে নেয়, অতঃপর (মসজিদে এসে) দেখে যে, ইমাম নামায পড়ে নি, তখন সে যেন (দ্বিতীয়বার) তাঁর সাথে নামায পড়ে। আর এ নামায তার জন্য নফল হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৫, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১১৫২ নং)
অনুরুপ মুআয বিন জাবাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর সাথে তাঁর মসজিদে (নববীতে) নামায পড়তেন। অতঃপর নিজ গোত্রে ফিরে এসে ঐ নামাযেরই ইমামতি করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৫০ নং) অতএব বুঝা গেল যে, এক নামাযের পশ্চাতে অন্য নামায পড়া দোষাবহ্ ও অশুদ্ধ নয়। সুতরাং উক্ত ক্ষেত্রে তরতীবের ওয়াজেব উলঙ্ঘন না করে যোহরের কাযা নামায আসরের জামাআতে পড়ে নেওয়াই উত্তম।
পক্ষান্তরে মহানবী (সাঃ) এর এই হাদীস “যখন নামায খাড়া হয়, তখন ফরয (বা সেই) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।” (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৪, মুসলিম, সহীহ ৭১০ নং, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫২, প্রমুখ) এর অর্থ হল জামাআত খাড়া হলে ফরয বা (ঐ নামায তাকে পড়তে হলে) ঐ নামাযে শামিল হওয়া ছাড়া পৃথক করে কোন নফল বা সুন্নত নামায পড়া বৈধ নয়। অর্থাৎ ইকামতের পর আর কোন সুন্নত বা নফল নামায শুদ্ধ হবে না। হাদীসের ব্যাখ্যা দাতাগণ এরুপই ব্যাখ্যা করেছেন। (দেখুন, শরহুন নওবী ৫/২২১, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১) এখানে এক নামাযের জামাআতে অন্য নামাযের নিয়ত করে নামায হবে না -সে উদ্দেশ্য নয়। (এ ব্যাপারে ইমামতির বিবরণও দ্রষ্টব্য।) তাছাড়া ইমাম-মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও যে উভয়ের নামায শুদ্ধ, তা পূর্বেই প্রতিপাদিত হয়েছে।
এশার জামাআতে মাগরেবের নামায
পক্ষান্তরে ইমামের এক রাকআত হয়ে যাওয়ার পর জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথেই সালাম ফিরলে ৩ রাকআত মাগরেবের কাযা আদায় হয়ে যাবে। অতঃপর উঠে একাকী এশার নামায পড়বে। অথবা অন্য লোক থাকলে দ্বিতীয় জামাআতে পড়ে নেবে।
অনুরুপভাবে কেউ আসরের নামায কাযা রেখে মসজিদে এসে মাগরেবের জামাআত খাড়া দেখলে আসর কাযা পড়ার নিয়তে শামিল হবে। অতঃপর ইমাম সালাম ফিরলে সে আর এক রাকআত উঠে পূর্ণ ৪ রাকআত আসরের নামায আদায় করে নেবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১০) পরে একাকী অথবা দ্বিতীয় জামাআতে মাগরেব পড়বে।
তরতীব কখন বিবেচ্য নয়?
তদনুরুপ বর্তমান নামাযের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলেও তরতীব বিবেচ্য নয়। যেমন, এক ব্যক্তি ফজরের নামায পড়তে এমন সময় উঠল যখন সূর্য উঠতে চলেছে। এই সময় তার মনে পড়ল যে, তার এশার নামায কাযা আছে। তখন কাযা পড়তে গেলে সূর্য উঠে যাবে এবং ফজরের নামাযও কাযা হয়ে যাবে। সুতরাং দু’টো নামাযকে কাযা না করে ফজরের নামায তার যথা (শেষ) সময়ে আদায় করে তারপর এশার নামায কাযা পড়বে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৪০-১৪১, তুহ্ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৬৬পৃ:, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯৭)
একইভাবে আসরের নামাযের শেষ সময়ে যোহ্র কাযা আছে মনে পড়লে, আসর আগে পড়ে তারপর যোহ্র পড়তে হবে। যাতে আসরও কাযা না হয়ে যায়।
বর্তমান নামায পড়তে শুরু করার পর অথবা পড়ে নেওয়ার পর পূর্বের নামায কাযা আছে মনে পড়লে আর তরতীব বিবেচ্য নয়। ভুলের জন্য তা ক্ষমার্হ হবে; ধর্তব্য হবে না। অতএব বর্তমান নামায শেষ করে কাযা নামায পড়ে নিতে হবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯৭)
কাযা উমরী ও নামাযের কাফফারা
অবশ্য এই তওবাকারী ব্যক্তির উচিৎ, বেশী বেশী করে নফল নামায পড়া এবং অন্যান্য নফল ইবাদতও বেশী বেশী করে করা। (দারেমী, সুনান ২/৪২) তার জন্য ওয়াজেব এই যে, সে সর্বদা নামায ত্যাগ করার ঐ অবহেলাপূর্ণ পাপ ও ক্ষতির কথা মনে রেখে তার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) সদা সচেতন থাকবে। সম্ভবত: তার ঐ হারিয়ে দেওয়া দিনের কিছু ক্ষতিপূরণ অর্জন হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/১৩৫)
রসূল (সাঃ) বলেন, “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে তার আমল সমূহের মধ্যে যে আমলের হিসাব সর্বাগ্রে নেওয়া হবে, তা হল নামায। নামায ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামায ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং (হিসাবের সময়) ফরয নামাযে কোন কমতি দেখা গেলে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা ফিরিশ্তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘দেখ, আমার বান্দার কোন নফল (নামায) আছে কি না।’ অতএব তার নফল নামায দ্বারা ফরয নামাযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরো সকল আমলের হিসাব অনুরুপ গ্রহণ করা হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০, তিরমিযী, সুনান ৩৩৭, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১৭নং, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নামায অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যায়, তার জন্য কাযা আছে। আল্লাহ বান্দার অন্তরের খবর রাখেন। তার মনে অবহেলা ও শৈথিল্য না থাকলে তিনি তার কাযা গ্রহণ করবেন। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “(এই কাযা আদায় করা ছাড়া) এর জন্য আর অন্য কোন কাফফারা নেই।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০৩নং)
পক্ষান্তরে কাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হয় না। সুতরাং এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরুপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত। (ইসলাহুল মাসাজিদ, আল্লামা আলবানীর টীকা সহ্ উর্দু তর্জমা মালেক, মুঅত্তা ২৯৬পৃ:, আহ্কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১৬৪পৃ:) বলা বাহুল্য এমন পাপস্খলনের রীতি তো অমুসলিমদের; যারা ইয়া বড় বড় পাপ করে কোন পানিতে ডুব দিলে অথবা কিছু অর্থ ব্যয় করলে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে!
জামাআত
ইসলাম জামাআতবদ্ধ জীবন পছন্দ করে; অপছন্দ করে বিচ্ছিন্নতাকে। কারণ, শান্তি ও শ£খলা রয়েছে জামাআতে। আর নামায একটি বিশাল ইবাদত। (শিশু, ঋতুমতী মহিলা ও পাগল ছাড়া) নামায পড়তেও হয় সমাজের সকল শ্রেণীর সভ্যকে। তাই সমষ্টিগতভাবে এই ইবাদতের জন্যও একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম-নীতির প্রয়োজন ছিল। বিধিবদ্ধ হল জামাআত।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হয় ইসরা’ ও মি’রাজের রাত্রে। ঠিক তার পরের দিন যোহরের সময় জিবরীল (আঃ) প্রিয় নবী (সাঃ)-কে নিয়ে জামাআত সহকারে প্রথম নামায পড়েন। অনুরুপভাবে মুসলিমরাও মহানবী (সাঃ)-এর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুসরণ করেন। আর জিবরীলের ইমামতির পর মহানবী (সাঃ) মক্কা মুকার্রামায় কোন কোন সাহাবীকে নিয়ে কখনো কখনো জামাআত সহকারে নামায আদায় করেছেন। কিন্তু মদ্বীনায় হিজরত করার পর জামাআত একটি বাঞ্জিত নিয়ম ও ইসলামী প্রতীকরুপে গুরুত্ব পেল। আর সকল নামাযীকে জামাআতবদ্ধ ও জমায়েত করার জন্য বিধিবদ্ধ হল আযান।
ইসলামী শরীয়তের একটি মাহাত্ম এই যে, তার বিভিন্ন ইবাদতে জামাআত ও ইজতিমা বিধিবদ্ধ রয়েছে। যা আসলে এক একটি সম্মেলন। যে সম্মেলনে মুসলিম নিয়মিতভাবে জমায়েত হয়। তাতে তারা এক অপরের অবস্থা জানতে পারে। একে অন্যকে উপদেশ দিতে পারে। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সলা-পরামর্শ করতে পারে। উপস্থিত সমস্যfর সঠিক সমাধান অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরস্পর সহ্যোগিতা করতে পারে। এক সাথে বসে পরস্পর মত-বিনিময় করতে পারে।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে অজ্ঞ ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান লাভ করতে পারে। দরিদ্র সাহায্য পেতে পারে। ঐক্যের মহামিলন দেখে মুসলিমের হৃদয় নরম হয়ে থাকে। প্রকাশ পায় ইসলামী শান-শওকত, সমতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা।
জামাআতে ভেঙ্গে চুরমার হয় বর্ণ-বৈষম্যের সকল প্রাচীর। একাকার হয় সকল জাত-পাত। আমীর-গরীব, আতরাফ-আশরাফ, বাদশা-ফকীরের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের মহান আদর্শর অভিব্যক্তি ঘটে এই জামাআতে।
সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খলতা এই জামাআতের মহান বৈশিষ্ট্য । সভ্য জাতির আদর্শ শিক্ষা লাভ হয় এই পুন: পুন: ইজতিমায়।
জামাআতে উপস্থিত হয়ে একে অপরের দেখাদেখি আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রতিযোগিতামূলক মন-মানসিকতা সৃষ্টি হয় মুসলিমের।
জামাআতের এই মহা মিলনক্ষেত্রে ইসলামী সম্প্রীতির যে সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়, তাতে সামাজিক জীবনের চলার পথে নিজেকে একাকী ও অসহায় বোধ হয় না। মনে জাগে খুশী, প্রাণে জাগে উৎফুল্লুতা, ইবাদতে আসে মনোযোগ, উৎসাহ্, উদ্দীপনা ও স্ফূর্তি।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি মুসলিমের কাম্য। অপর ভায়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে উভয় মুসলিম এক অপরের জন্য শান্তি কামনা করে দুআ দিয়ে থাকে। ‘আস-সালামু আলাইকুম, অআলাইকুমুস সালাম’ বলার মাধ্যমে আল্লাহর তরফ থেকে এবং উভয়ের হৃদয়-মনেও শান্তি লাভ হয় এই জামাআতে হাজির হলে।
জামাআতের মান ও গুরুত্ব
(وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرَّاكِعِيْنَ)
অর্থাৎ, তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূকারিগণের সাথে রুকূ কর। (কুরআন মাজীদ ২/৪৩)
বরং জামাআতে নামায না পড়লে নামায কবুল নাও হতে পারে। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
“যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)
“যে কোন গ্রাম বা মরু-অঞ্চলে তিনজন লোক বাস করলে এবং সেখানে (জামাআতে) নামায কায়েম না করা হলে শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে ফেলে। সুতরাং তোমরা জামাআতবদ্ধ হও। অন্যথা ছাগ পালের মধ্য হতে নেকড়ে সেই ছাগলটিকে ধরে খায়, যে (পাল থেকে) দূরে দূরে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫১১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৪৫, সহিহ তারগিব ৪২২নং)
যারা নামাযের জামাআতে মসজিদে হাজির হয় না, মহানবী (সাঃ) তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামায হল এশা ও ফজরের নামায। ঐ দুই নামাযের কি মাহাত্ম আছে, তা যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে উপস্থিত হত। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কাউকে নামাযের ইকামত দিতে আদেশ দিই, অতঃপর একজনকে নামায পড়তেও হুকুম করি, অতঃপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাদের সাথে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের নিকট যাই, যারা নামাযে হাজির হয় না। অতঃপর তাদেরকে ঘরে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।” (বুখারী ৬৫৭, মুসলিম, সহীহ ৬৫১নং)
হযরত উসামা বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা জামাআত ত্যাগ করা হতে অবশ্য অবশ্যই বিরত হোক, নচেৎ আমি অবশ্যই তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেব।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৩০নং)
কোন অন্ধ মানুষকেও মহানবী (সাঃ) জামাআতে অনুপস্থিত থেকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেননি। অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-এর দরবারে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মসজিদে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার মত আমার উপযুক্ত মানুষ নেই। তাছাড়া মদ্বীনায় প্রচুর হিংস্র প্রাণী (সাপ-বিছা-নেকড়ে প্রভৃতি) রয়েছে। (মসজিদের পথে অন্ধ মানুষের ভয় হয়)। সুতরাং আমার জন্য ঘরে নামায পড়ার অনুমতি হবে কি?’ আল্লাহর নবী (সাঃ) তাঁর ওজর শুনে তাঁকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দিলেন। তিনি চলে যেতে লাগলে মহানবী (সাঃ) তাঁকে ডেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কি আযান ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্,হাইয়্যা আলাল ফালাহ্’ শুনতে পাও।” তিনি উত্তরে বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ মহানবী (সাঃ) বললেন, “তাহলে তুমি (মসজিদে) উপস্থিত হও, তোমার জন্য কোন অনুমতি পাচ্ছি না।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৫২, ৫৫৩নং)
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদলের সম্মুখেও জামাআত মাফ নয়। মহান আল্লাহ বিধিবদ্ধ করলেন স্বালাতে খওফ। (কুরআন মাজীদ ৪/১০২) জামাআত সহকারে নামায একান্ত বাঞ্জিত ও জরুরী কর্তব্য না হলে ঐ ভীষণ সময়ে মরণের মুখে তিনি তা মাফ করতেন।
তদনুরুপ জামাআত বাঞ্জিত বলেই প্রয়োজনে নামায জমা করে পড়া বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। মসজিদের পথে শত্রুর ভয় হলে, প্রচুর ঠান্ডা বা বৃষ্টি হলে অথবা সফরে থাকলে যোহ্র-আসর এবং মাগরেব-এশাকে জমা করে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে জামাআতের ফযীলত লাভ করার জন্যই।
জামাআত ত্যাগ করা মুমিনের গুণ নয়; বরং তা মুনাফিকের গুণ। মহান আল্লাহ এদের গুণ বর্ণনা করে বলেন,
(উوَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ)
অর্থাৎ, ---ওরা (মুনাফেকরা) নামাযে শৈথিল্যর সাথে হাজির হয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবেই দান করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৯/৫৪)
বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামায মুনাফেকের জন্য অধিক ভারী। আর একথা পূর্বে এক হাদীসে আলোচিত হয়েছে।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন কোন লোককে ফজরের নামাযে অনুপস্থিত দেখতাম, তখন তার প্রতি কু ধারণা করতাম।’ (ত্বাবরানি, ইবনে আবী শাইবা, বাযয়ীফ, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/৪০)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাল আল্লাহর সাথে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করতে আনন্দবোধ করে তার উচিৎ, যেখানে আহবান করা হয় সেখানে (অর্থাৎ মসজিদে) ঐ নামাযগুলির হিফাযত করা। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাদের নবীর জন্য বহু হেদায়াতের পথ ও আদর্শ বিধিবদ্ধ করেছেন এবং ঐ (নামায)গুলি হেদায়াতের পথ ও আদর্শর অন্তর্ভুক্ত। যদি তোমরা তোমাদের স্বগৃহে নামায পড়ে নাও; যেমন এই পশ্চাদগামী তার স্বগৃহে নামায পড়ে থাকে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেলবে। আর যদি তোমরা তোমাদের নবীর আদর্শ ও তরীকা বর্জন করে ফেল, তাহলে তোমরা ভ্রষ্ট হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে পবিত্রতা অর্জন (ওযু) করে এই মসজিদসমূহের কোন মসজিদের প্রতি (যেতে) প্রবৃত্ত হয়, আল্লাহ তার প্রত্যেক পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি করে নেকী লিপিবদ্ধ করেন, এর দ্বারায় তাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করেন ও এর দ্বারায় তার একটি পাপ হরাস করেন। আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না। আর মানুষকে দুটি লোকের কাঁধে ভর করে হাঁটিয়ে এনে কাতারে খাড়া করা হত।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৪নং)
হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তির মসজিদে থাকা অবস্থায় আযান হয়, অতঃপর বিনা কোন প্রয়োজনে বের হয়ে যায় এবং ফিরে আসার ইচ্ছা না রাখে, সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ১৫৭নং)
যারা আহবানকারী মুআযযেনের আযানে সাড়া দিয়ে জামাআতে উপস্থিত হয় না, কিয়ামতে তাদের বিশেষ অবস্থা ও শাস্তি রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
(يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ، خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ، وَقَدْ كَانُوْا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ وَهُمْ سَالِمُوْنَ)
অর্থাৎ, যেদিন পদনালী উন্মুক্ত করা হবে এবং ওদেরকে সিজদা করার জন্য আহবান করা হবে, কিন্তু ওরা তা করতে সক্ষম হবে না। হীনতাগ্রস্ত হয়ে ওরা ওদের দৃষ্টি অবনত করবে। অথচ যখন ওরা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল, তখন তো ওদেরকে সিজদা করতে আহবান করা হয়েছিল। (কুরআন মাজীদ ৬৮/৪২-৪৩) (বুখারী ৪৯১৯ নং)
এমন কি মসজিদে জামাআতে উপস্থিত থেকে মুআযযিনের আযান শুনেও যে মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, সে আল্লাহর নবীর অবাধ্য ও নাফরমান রুপে পরিগণিত হয়। একদা মসজিদে আযান হলে এক ব্যক্তি সেখান থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আবূ হুরাইরা (রাঃ) তার দিকে নিনিGমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। পরিশেষে তিনি বললেন, ‘আসলে এ ব্যক্তি তো আবূল কাসেম (সাঃ)-এর নাফরমানী করল।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৫৫নং) আর এ কথা বিদিত যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে, সে আসলে স্পষ্টরুপে ভ্রষ্ট হয়ে যায়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৩৬)
অবশ্য যদি কেউতার জরুরী কাজে; যেমন, প্রস্রাব-পায়খানা বা ওযূ করতে মসজিদের বাইরে যায়, তাহলে তা নাফরমানীর আওতাভুক্ত নয়। (মাজমূউফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১২/২০০)
আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর সাহাবাগণও ফরয নামাযের জন্য জামাআতে উপস্থিত হওয়াকে ওয়াজেব মনে করতেন।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে, বিদিত কপটতার কপট (মুনাফিক) ছাড়া (জামাআতে) নামায থেকে কেউ পশ্চাতে থাকত না।’ (মুসলিম ৬৫৪নং)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আবূ মূসা আশআরী, আলী বিন আবী তালেব, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আযান শোনে অথচ (মসজিদে জামাআতে) উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তির কোন ওজর ছাড়া (ঘরে নামায পড়লেও তার) নামাযই হয় না।’ (তিরমিযী, সুনান ২১৭নং, যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম )
ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি রোযা রাখে, তাহাজ্জুদ পড়ে; কিন্তু জামাআত ও জুমআয় হাজির হয় না। উত্তরে তিনি বললেন, ‘এ অবস্থায় মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে!’ (তিরমিযী, সুনান ২১৮নং, এটির সনদ দুর্বল)
আত্বা বিন আবী রাবাহ্ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি কোন শহর বা গ্রামবাসীর জন্য এ অনুমতি নেই যে, সে আযান শোনার পর জামাআতে নামায ত্যাগ করে।’
হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, ‘কারো আম্মা যদি তাকে মায়া করে এশার নামায জামাআতে পড়তে বারণ করে, তাহলে সে তার ঐ বারণ শুনবে না।’ (বুখারী)
আওযায়ী (রহঃ) বলেন, ‘জুমুআহ ও জামাআত ত্যাগ করার ব্যাপারে পিতার আনুগত্য নেই, চাহে সে আযান শুনতে পাক, আর না-ই পাক।’
অবশ্য জেনে রাখা ভাল যে, যে ব্যক্তি জামাআত ছাড়াই নামায পড়ে, তার নামায শুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জামাআত ত্যাগ করার জন্য সে (কাবীরা) গুনাহগার হয়। তবে তার ঐ নামায কবুল হওয়া ও না হওয়ার ব্যাপার তো আল্লাহর কাছে। (মারা: ১৭২পৃ:)
জামাআতের আসল মর্যাদা ছিল সলফে সালেহীনের কাছে। তাঁরা জামাআতের এত গুরুত্ব দিতেন যে, তা ছুটে গেলে অথবা নষ্ট হয়ে গেলে কেউ কেউ কেঁদে ফেলতেন। একে অপরকে দেখা করে সান্তনা দিতেন।
সাঈদ বিন আব্দুল আযীয জামাআত ছুটে গেলে কাঁদতেন।
হাতেম আল-আসাম্ম বলেন, ‘একদা আমার এক নামাযের জামাআত ছুটে গেল। এর জন্য আবূ ইসহাক বুখারী আমাকে দেখা করতে এলেন। অথচ আমার কোন ছেলে মারা গেলে দশহাজারেরও বেশী লোক আমাকে দেখা করতে আসত। কেন না, মানুষের নিকট দুনিয়ার মসীবতের তুলনায় দ্বীনের মসীবত নেহাতই হাল্কা।’
নামাযের জামাআত কোনক্রমেই তাঁদের নিকট কোন পার্থিব জিনিসের সমতুল্য ছিল না; যে তুচ্ছ জিনিসের পশ্চাতে আমরা অনেক ক্ষেত্রে লালসার নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকি। যার জন্য কখনো বা নামায যথা সময়ে পড়তে পারি না। কেউবা তারই জন্য মূলেই নামায ত্যাগ করে বসে। ব্যবসা-বানিজ্য, কাজ-কারবার, খেলাধূলা, সরগরম মজলিসে আজেবাজে গল্প, রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবাদ ও সমীক্ষা প্রভৃতি নামাযের জামাআত; কখনো বা নামায নষ্ট করে ফেলে বর্তমান যুগের বহু সংখ্যক মানুষের!
একদা মাইমূন বিন মিহ্রান মসজিদে এলেন। দেখলেন, নামায শেষ হয়ে গেলে নামাযীরা মসজিদ থেকে ফিরে গেছে। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন! অবশ্যই আমার নিকট এই জামাআতের মর্যাদা ইরাকের রাজত্ব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’
ইউনুস বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমার কি হল যে, মুরগী নষ্ট হলে আমি তার জন্য দু:খিত হ্ব, অথচ নামায (জামাআত) নষ্ট হলে তার জন্য দু:খিত হ্ব না?’
সলফে সালেহীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পর আযান শুনলে মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করতেন। যাতে ইমামের সাথে তাকবীরে তাহ্রীমা ছুটে না যায়, তার বিশেষ খেয়াল রাখতেন।
সাঈদ বিন মুসাইয়েব বলেন, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে আমার নামাযের প্রথম তাকবীর ছুটেনি! আর পঞ্চা শ বছর ধরে নামাযে কোন মানুষের পিঠ দেখিনি।’ অর্থাৎ, পঞ্চাশ বছর যাবৎ তিনি প্রথম কাতারেই নামায পড়েছেন!
অকী’ বিন জার্রাহ্ বলেন, ‘প্রায় সত্তর বছর ধরে আ’মাশের প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’
ইবনে সামাআহ্ বলেন, ‘যে দিন আমার আম্মা মারা যান, সে দিন ছাড়া চল্লিশ বছর ধরে আমার প্রথম তাকবীর ছুটে নি!’ (ফাযায়িলু অষামারাতুস স্বা লাতি মাআল জামাআহ্ ৬পৃ:)
ইবরাহীম নাখয়ী বলেন, ‘যখন কোন মানুষকে দেখবে, সে প্রথম তাকবীরের ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করছে, তখন তুমি তার ব্যাপারে হাত ধুয়ে নাও।’
আব্দুল আযীয বিন মারওয়ান আদব শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর ছেলে উমারকে মদ্বীনায় পাঠালেন। আর তার দেখাশোনা করার জন্য সালেহ্ বিন কায়সানকে চিঠি লিখলেন। তিনি তাকে নামায পড়তে বাধ্য করতেন। একদিন সে এক নামাযে পিছে থেকে গেলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তোমাকে আটকে রেখেছিল?’ উমার বলল, ‘আমার দাসী আমার চুল আঁচড়াচ্ছিল।’ তিনি বললেন, ‘ব্যাপার এত দূর গড়িয়ে গেল যে, তোমার চুল আঁচড়ানো তোমার নামাযকে প্রভাবান্বিত করে ফেলল?’ এরপর সে কথা জানিয়ে তিনি তার আব্বা (আব্দুল আযীয)কে চিঠি লিখলেন। তা জেনে আব্দুল আযীয একটি দূত পাঠালেন এবং কোন কথা বলার আগেই সে দূত উমারের মাথা নেড়া করে দিল! (সিয়ারু আ’লামুন নুবালা’, ইমাম যাহাবী ৫/১১৬)
যে ব্যক্তি মসজিদে জামাআত সহকারে নামায পড়তে আসত না তাকে মক্কার আমীর আত্তাব বিন উসাইদ উমাবী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার ধমকি দিতেন। (গায়াতুল মারাম, ইযযুদ্দ্বীনহাশেমী ১/১৮-১৯)
হযরত আলী (রাঃ) প্রত্যহ্ রাস্তায় পার হওয়ার সময় ‘আস-স্বালাত, আস-স্বালাত’ বলে লোকেদেরকে ফজরের নামাযের জন্য জাগাতেন। (তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬৫০পৃ:) যেমন আজও সঊদী আরবে আযান হলেই নির্দিষ্ট অফিসের নিযুক্ত লোক ঐ একই কথা বলে নামাযের জন্য দোকান-পাট বন্ধ করতে তাকীদ করে থাকে। তাতে মুসলিমরা সাথে সাথে দোকান বন্ধ করে মসজিদে যায়। আর মুনাফিক ও কাফেররা যায় নিজ নিজ বাসায়। আর নামাযের সময়টুকু বন্ধ থাকে সমস্ত দোকান-পাট।
বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে বিরাট। তাঁদের নিকট নামাযের গুরুত্ব আমাদের তুলনায় অনেক বেশী। তাঁদের ছিল আগ্রহ্, আশা ও অধিক সওয়াব লাভের বাসনা। পক্ষান্তরে আমাদের মাঝে আছে পার্থিব প্রেম ও দুনিয়া লাভের কামনা। তাই আমরা নামাযের উপর দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি, আমাদের নিকট গুরুত্ব পায় পার্থিব ভোগ-বিলাস ও তার জন্য কর্ম-ব্যস্ততা।
অবশ্য এ কথা বলা অত্যুক্তি নয় যে, আমাদের জামাআতে হাজির হয়ে নামায না পড়া আমাদের দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর সে তা’যীমনেই, আল্লাহর প্রতি সে প্রেম, ভক্তি ও ভয় নেই, তাঁর আদেশ ও অধিকার পালনে সে আগ্রহ্ ও উৎসাহ্ নেই, তাই আমরা এমন শৈথিল্য প্রদর্শন করতে লজ্জাও করি না।
জামাআতের ফযীলত ও মাহাত্ম
জামাআতে হাজির হয়ে যারা আল্লাহর ঘর মসজিদ আবাদ রাখে, তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত; মহান আল্লাহ তাদের প্রশংসা করে বলেন,
(إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللهَ، فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَّكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ)
অর্থাৎ, আসলে তারাই আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। আর আশা করা যায়, তারাই হল হেদায়াত-প্রাপ্ত। (কুরআন মাজীদ ৯/১৮)
জামাআতে উপস্থিতি দোযখ ও মুনাফেকী থেকে মুক্তি দেয়; মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্রীমার তকবীরও পাবে, (সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হবে; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)
জামাআতে উপস্থিত নামাযীদেরকে নিয়ে মহান আল্লাহ তাঁর ফিরিশ্তাসভায় গর্ব করেন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। এই যে তোমাদের পালনকর্তা আসমানের দরজাসমূহের একটি দরজা খুলে তাঁর ফিরিশ্তামন্ডলীর কাছে তোমাদেরকে নিয়ে গর্ব করছেন; বলছেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা এক ফরয (নামায) আদায় করেছে এবং অন্য এক ফরয আদায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮০১নং)
মহান আল্লাহ জামাআতের নামায দেখে মুগ্ধ হন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “জামাআতের নামাযে আল্লাহ মুগ্ধ হন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৬৫২নং)
জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করলে একাকীর তুলনায় ২৫ থেকে ২৭ গুণ সওয়াব বেশী পাওয়া যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষের জামাআত সহকারে নামাযের মান একাকী নামাযের মান অপেক্ষা ২৭ গুণ অধিক।” (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ জামে ৩৮২০নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “একাকীর নামায অপেক্ষা জামাআতের নামায সাতাশ গুণ উত্তম।” (বুখারী ৬৪৫নং, মুসলিম ৬৫০নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “পুরুষের স্বগৃহে বা তার ব্যবসাক্ষেত্রে নামায পড়ার চেয়ে (মসজিদে) জামাআতে শামিল হয়ে নামায পড়ার সওয়াব পঁচিশ গুণ বেশি। কেননা, যে যখন সুন্দরভাবে ওযু করে কেবল মাত্র নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই মসজিদের পথে বের হয় তখন চলামাত্র প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে তাকে এক-একটি মর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং তার এক-একটি গুনাহ মোচন করা হয়। অতঃপর নামায আদায় সম্পন্ন করে যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে বসে থাকে ততক্ষণ ফিরিশ্তাবর্গ তার জন্য দুআ করতে থাকে; ‘হে আল্লাহ ওর প্রতি করুণা বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা কর। আর সে ব্যক্তি যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষা করে, ততক্ষণ যেন নামাযের অবস্থাতেই থাকে।” (বুখারী ৬৪৭নং, মুসলিম ৬৪৯নং, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নামাযের জন্য পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায পড়ার উদ্দেশ্যে যায় এবং তা লোকেদের সাথে অর্থাৎ জামাআত সহকারে অথবা মসজিদে পড়ে, আল্লাহ তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেন।” (মুসলিম, সহীহ ২৩২নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি পরিপূর্ণরুপে ওযু করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে (মসজিদে) যায়, অতঃপর তা ইমামের সাথে আদায় করে সে ব্যক্তির পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৪০১নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি স্বগৃহ্ থেকে ওযূ করে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, তার সওয়াব হল ইহ্রাম বাঁধা হাজীর মত।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৮নং)
“যে ব্যক্তি জামাআতে কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, সে ব্যক্তির সওয়াব হয় একটি হজ্জ করার মত এবং যে ব্যক্তি কোন নফল (চাশতের) নামায পড়ার জন্য পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, তার সওয়াব হয় নফল উমরাহ্ করার মত।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ত্বাব, জামে ৬৫৫৬নং)
বলা বাহুল্য, যে ব্যক্তি স্বগৃহে ওযূ করে ফরয নামায আদায় করার জন্য প্রত্যহ্ ৫ বার মসজিদে যায় এবং সে তাতে ঐ বিশাল সওয়াবের আশা রাখে, সে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন ৫টি করে; অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৮০০টি হজ্জ করার সওয়াব লাভ করে! আর ৬০ বছরের জীবনে প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার বার হজ্জ করা হয় একজন মসজিদ-ভক্ত নামাযীর! অতএব অনায়াসে সে ৬০ বছরেই যেন ১০৮০০০ বছরের জীবন লাভ করে থাকে। বরং এত বছর বাঁচলেও সে হয়তো প্রত্যেক বছর হজ্জ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু জামাআতের ঐ নামায তাকে এত দীর্ঘ জীবন দান করে থাকে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “এই নামাযের জামাআতে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি জানত যে, তাতে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য কত সওয়াব নিহিত রয়েছে তাহলে অবশ্যই সে হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়েও হাজির হত। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম,সহিহ তারগিব ৪০৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমি তোমাদেরকে কি সেই কথা বলে দেব না; যার দরুন আল্লাহ গুনাহসমূহকে মোচন করে দেন এবং মর্যাদা আরো উন্নত করেন?” সকলে বলল, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “কষ্টের সময় পরিপূর্ণ ওযু করা, মসজিদের দিকে অধিকাধিক পদক্ষেপ করা (চলা), আর এক নামাযের পর আগামী নামাযের অপেক্ষা করা। উপরন্তু এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়, এগুলোই হল প্রতিরক্ষা-বাহিনীর কাজের ন্যায়।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ২৫১নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, অনুরুপ অর্থে।)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আজ রাত্রে আমার কাছে আমার প্রতিপালকের এক দূত এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি জানেন কি, নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশ্তামন্ডলী কি নিয়ে মতভেদ করছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, (তাঁরা মতভেদ করছেন) পাপ মোচন, মর্যাদা বর্ধন, জামাআতে শামিল হওয়ার জন্য পদক্ষেপ, প্রচন্ড ঠান্ডার সময় পরিপূর্ণরুপে ওযূ এবং নামাযের অপেক্ষা নিয়ে। যে ব্যক্তি উক্ত কর্মসমূহ সম্পাদন করতে যত্নবানহবে, সে ব্যক্তির জীবন হবে কল্যাণময় এবং মরণ হবে কল্যাণময়। আর সে তার পাপ থেকে পবিত্র হয়ে সেই দিনকার মত নিষ্পাপ হবে, যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩২৩৩নং)
এ ব্যাপারে আরো মাহাত্ম ‘মসজিদে যাওয়ার মাহাত্ম’ শিরোনামে দ্রষ্টব্য।
জামাআতে লোক যত বেশী হবে তত বেশী সওয়াব লাভ হবে নামাযীদের। মহানবী (সাঃ) বলেন, “---এক ব্যক্তির কোন অন্য ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায একাকী পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। অনুরুপ অন্য দুই ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায এক ব্যক্তির সাথে জামাআত করে পড়া নামায অপেক্ষা অধিকতর উত্তম। এইভাবে জামাআতের লোক সংখ্যা যত অধিক হবে ততই আল্লাহ আয্যা অজাল্লার নিকট অধিক প্রিয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৪০৬নং)
তিনি বলেন, “১ জনের ইমামতিতে ২ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৪ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর, ১ জনের ইমামতিতে ৪ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ৮ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর এবং ১ জনের ইমামতিতে ৮ জনের নামায আল্লাহর নিকট একাকী ১০০ জনের নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।” (বায়হাকী, বাযয়ীফ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৮৩৬নং)
বিশেষ করে ফজর ও এশার নামায জামাআতে পড়ার পৃথক মাহাত্ম রয়েছে।
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া কোন অন্য উপায় না পেত তাহলে লটারিই করত। আর তারা যদি (নামাযের জন্য মসজিদের প্রতি) সকাল-সকাল আসার মাহাত্ম জানত, তাহলে অবশ্যই তার জন্য প্রতিযোগিতা করত। আর যদি এশা ও ফজরের নামাযের মাহাত্ম তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে চলেও তারা উভয় নামাযে উপস্থিত হত।” (বুখারী ৬১৫নং,মুসলিম, সহীহ ৪৩৭নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এশার নামায জামাআতের সঙ্গে পড়ল, সে যেন অর্ধরাত্রি (নফল) নামায পড়ল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়ল, সে যেন পুরো রাত্রিই নামায পড়ল।” (মালেক, মুঅত্তা, মুসলিম, সহীহ ৬৫৬নং, আবূদাঊদ, সুনান)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের জামাআতের নামায একাকী নামাযের তুলনায় ২৫ গুণ অধিক মর্যাদা রাখে। আর রাত্রি ও দিনের ফিরিশ্তা ফজরের নামাযে একত্রিত হন।”
উক্ত হাদীস বর্ণনার পর আবূ হুরাইরা বলেন, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে তোমরা পড়ে নাও :
(إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْداً)
অর্থাৎ, নিশ্চয় ফজরের নামাযে ফিরিশ্তা হাযির হয়। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮) (বুখারী ৬৪৮, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৯৭৪নং)
নবী (সাঃ) বলেন, “(ফজরের সময়) যে ব্যক্তি (স্বগৃহে) ওযু করে। অতঃপর মসজিদে এসে ফজরের (ফরয) নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়ে। অতঃপর বসে (অপেক্ষা ক’রে) ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সেই ব্যক্তির সেদিনকার নামায নেক লোকদের নামায রুপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তার নাম পরম করুণাময় (আল্লাহর) প্রতিনিধিদলের তালিকাভুক্ত হয়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৪১৩নং)
প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সে ব্যক্তি (সন্ধ্যা পর্যন্ত) আল্লাহর দায়িত্বে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৬৫৭, তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৬৩৪৩নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে পড়ে, অতঃপর সূর্যোদয় অবধি বসে আল্লাহর যিক্র করে তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে, সেই ব্যক্তির একটি হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হয়।” বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ।” অর্থাৎ কোন অসম্পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব নয় বরং পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব। (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬১নং)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “ইসমাঈলের বংশধরের চারটি মানুষকে দাসত্বমুক্ত করা অপেক্ষা ফজরের নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত যিক্রকারী দলের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক প্রিয়। অনুরুপ চারটি জীবন দাসমুক্ত করার চেয়ে আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যিক্রকারী সম্প্রদায়ের সাথে বসাটা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬২নং)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ফজরের নামায জামাআতে পড়ার জন্য কয়েকটি জিনিস জরুরী:
আল্লাহর আযাবের ভয় এবং তার সওয়াবের লোভ মনের মাঝে স্থান দিতে হবে।
অবৈধ কাজে তো নয়ই; বরং বৈধ কাজেও বেশী রাত না জেগে আগে আগে ঘুমাতে হবে।
জামাআত ধরার পাক্কা এরাদা হতে হবে।
ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় এমন অসীলা ব্যবহার করতে হবে; যেমন এলার্ম ঘড়ি, কোন সুহৃদ সাথী ইত্যাদি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, দুনিয়ার কাজের জন্য ফজরের আগেও উঠতে মানুষ অসুবিধা বোধ করে না, অথচ যত অসুবিধা বোধ করে আল্লাহর কাজে যথা সময়ে জাগতে। সুতরাং এমন মানুষের এমন অবহেলা তার ঈমানী দুর্বলতার পরিচয় নয় কি?
এখানে প্রসঙ্গত: ফজরের নামায যথা সময়ে না পড়ার যে বিধান, সে সম্পর্কিত একটি ফতোয়া উল্লেখ করা সমীচীন বলে মনে করি।
প্রত্যেক মুসলিমের জন্য প্রত্যেক নামায তার যথাসময়ে মসজিদে জামাআত সহকারে আদায় করা ওয়াজেব। আর প্রত্যেক সেই বিষয় থেকে দূরে থাকা জরুরী, যে বিষয় তাকে কোন নামায তার নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা থেকে বাধা দিতে পারে। বিশেষ করে ফজরের নামাযের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিৎ, যাতে ঘুমিয়ে থেকে জামাআত ছুটে না যায় বা তার সময় পার না হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ফজরের নামাযকে কোন মুসলিমের জন্য ভারী মনে করা উচিৎ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “মুনাফিকের জন্য সবচেয়ে বেশী ভারী নামায হল, এশা ও ফজরের নামায। ঐ উভয় নামাযে কি রাখা আছে তা যদি ওরা জানতো তাহলে হাঁটু গেড়ে হলেও তার জামাআতে এসে উপস্থিত হত।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
সুতরাং এমন সব উপায় ও অসীলা অবলম্বন করা উচিৎ, যাতে যথা সময়ে উঠে ফজরের নামায জামাআত সহকারে পড়া সহ্জ হয়। যেমন সকাল-সকাল ঘুমিয়ে পড়া, বেশী রাত না জাগা, কাউকে জাগিয়ে দিতে অনুরোধ করা, এলার্ম ঘড়ি ব্যবহার করা, ইত্যাদি।
এত বেশী রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত বা কোন ইলমী আলোচনা করাও বৈধ নয়, যার ফলে ফজরের নামায ছুটে যাওয়ার ভয় থাকে। সুতরাং টিভি-ভিসিআর দেখে, তাস খেলে অথবা অন্য কোন অবৈধ কারণে রাত জেগে ফজরের নামায নষ্ট করা যে কত বড় পাপের কাজ -তা অনুমেয়। পক্ষান্তরে যদি ইচ্ছা করে কেউফজরের আযান শুনেও না ওঠে, অথবা তাকে জাগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও না ওঠে, পরন্তু যে জাগিয়ে দেয় তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়, অথবা ইচ্ছা করেই ঘড়িতে এলার্ম ফজরের সময় না দিয়ে সূর্য উদয় হওয়ার পর ঠিক তার ডিউটির সময়ে দেয়, তাহলে এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট থেকে শাস্তির উপযুক্ত এবং শাসন কর্তৃপক্ষের নিকটেও শাস্তিযোগ্য।
আর ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওযরে ফজরের নামায সূর্য ওঠার পর আদায় করলেও যথাসময়ে নামায ত্যাগ করার জন্য (বহু উলামার ফতোয়া মতে) সে কাফের হয়ে যাবে। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমাদের ও তাদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তি হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করবে সে কাফের হয়ে যাবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান) আর মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নামাযীদের জন্য রয়েছে ‘ওয়াইল’ দোযখ; যে নামাযীরা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন।” (সূরা মাঊন) অর্থাৎ, যারা নামায যথাসময়ে আদায় করে না। (দ্র: ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২, ৩৬৫)
অতএব গাফলতি ছাড়cন এবং যে কোন প্রকারে ফজর ও অন্যান্য নামায যথাসময়ে আদায় করুন। আল্লাহ আমাদেরকে খাঁটি মুসলমান করুন এবং আমাদের নামায কবুল করে নিন। আমীন।
কোন্ জামাআতে সওয়াব বেশী?
জায়গার গুরুত্ব হিসাবে জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে; যেমন মাসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী, বায়তুল মাকদেস, মসজিদে কুবা প্রভৃতি।
অমসজিদের তুলনায় মসজিদের জামাআতে সওয়াব বেশী। অবশ্য জনহীন মরুভূমীতে রুকূ-সিজদাহ ইত্যাদি পরিপূর্ণরুপে করলে তার সওয়াব ৫০ গুণ বেশী। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, জামাআতে পড়া নামায পঁচিশটি নামাযের সমতুল্য। আর যদি কেউ সেই নামায কোন জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে এবং তার রুকু ও সিজদা পূর্ণরুপে আদায় করে, তবে ঐ নামায পঞ্চাশটি নামাযের সমমানে পৌঁছায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬০, সহিহ তারগিব ৪০৭নং)
বাসা থেকে মসজিদ যত দূরে হবে, পদক্ষেপ হিসাবে জামাআতের সওয়াব তত বেশী হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫৬নং)
জামাআতের লোকসংখ্যা যত বেশী হবে, তার সওয়াবও তত বেশী হবে।
তাকবীরে তাহ্রীমা সহ্ পূর্ণ নামাযের জামাআতের সওয়াব কিছু অংশ বাদ যাওয়া নামাযের জামাআতের সওয়াব অপেক্ষা বেশী।
নামায অনুযায়ীও জামাআতের সওয়াব কম-বেশী হয়ে থাকে। যেমন, ফজরের জামাআত এশার তুলনায় এবং এশার জামাআত অন্যান্য ওয়াক্তের জামাআতের তুলনায় সওয়াবে অধিক বেশী।
কার উপর এবং কোন্ নামাযের জামাআত ওয়াজেব?
অবশ্য জামাআত কেবল ফরয নামাযের জন্য ওয়াজেব। এ ছাড়া (মুআক্কাদাহ ও গায়র মুআক্কাদাহ) সুন্নত এবং নফল নামাযের জন্য; যেমন সুনানে রাওয়াতেব, বিত্র, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ, তাহিয়্যাতুল উযূ, তাহিয়্যাতুত ত্বাওয়াফ, স্বালাতুত তাসবীহ্ (?) স্বালাতুত তাওবাহ্, ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন প্রভৃতি নামাযের জন্য জামাআত বিধিবদ্ধ নয়।
পক্ষান্তরে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের নামায, ঈদ, ইস্তিস্কা ও তারাবীহ্র নামাযের জন্য জামাআত সুন্নত। যেমন কাযা ও তাহাজ্জুদের নামাযেও জামাআত চলে। আর এ সব কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইন শাআল্লাহ।
আবার সাধারণ অতিরিক্ত নফল নামায জামাআত করে পড়া যায়। দলীল স্বরুপ দেখুন, বুখারী ১১৮৬ ও মুসলিম ৫৬৮নংহাদীস।
জামাআতে মহিলাদের অংশ গ্রহণ
তিনি বলেন, “মহিলা স্বগৃহে থেকে তার রবের অধিক নিকটবর্তী থাকে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “মহিলা তার ঘরে থেকে রবের ইবাদত করার মত ইবাদত আর অন্য কোথাও করতে পারে না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৪২নং)
তিনি মহিলাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমাদের খাস কক্ষের নামায সাধারণ কক্ষে নামায অপেক্ষা উত্তম, তোমাদের সাধারণ কক্ষের নামায বাড়ির ভিতরে কোন জায়গায় নামায অপেক্ষা উত্তম এবং তোমাদের বাড়ির ভিতরের নামায মসজিদে জামাআতে নামায অপেক্ষা উত্তম।” (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, বায়হাকী, জামে ৩৮৪৪নং)
উল্লেখ্য যে, সাহাবিয়া উম্মে হুমাইদ উক্ত হাদীস শোনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর বাড়ির সব চাইতে অধিক অন্দর ও অন্ধকার কামরাতে নামায পড়েছেন।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “মহিলা হল গোপনীয় জিনিস। বাইরে বের হলে শয়তান তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখতে থাকে।” (ত্বাবারানী, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৩৯, ৩৪১, ৩৪২নং)
এ তো ইবলীস জিনের কথা। পক্ষান্তরে বর্তমান যুগের দ্বীনহীন যুবকদল; যারা মহিলার জন্য হাজার শয়তান অপেক্ষা বেশী ক্ষতিকর, তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে গোপনে থাকা নারীর একান্ত কর্তব্য।
তবে যদি সে একান্ত মসজিদের জামাআতে শরীক হয়ে নামায পড়তে চায়, তাহলে তাতে অনুমতি আছে। অবশ্য এর জন্য কয়েকটি শর্ত আছে:
মসজিদের পথে যেন (লম্পটদের) কোন অশুভ ফিতনার আশঙ্কা না থাকে।
মহিলা যেন সাদাসিধাভাবে পর্দার সাথে আসে। অর্থাৎ, সেজেগুজে প্রসাধন-সেন্ট লাগিয়ে না আসে। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য।)
এতে যেন তার স্বামীর অনুমতি থাকে।
স্বামীর জন্যও উচিৎ, যদি তার স্ত্রী মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাকে বাধা না দেওয়া। সাহাবাদের মহিলাগণ মসজিদে গিয়ে জামাআতে নামায আদায় করতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘মুমিন মহিলারা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সাথে ফজরের নামায পড়ার জন্য দেহে চাদর জড়িয়ে হাযির হত। অতঃপর নামায শেষ হলে তারা নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত, আবছা অন্ধকারে তাদেরকে কেউ চিনতে পারত না।’ (বুখারী ৫৭৮,মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৪২৩, তিরমিযী, সুনান ১৫৩, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৬৬৯নং)
পরন্তু এতে মসজিদের দরস ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করার উপকারিতাও রয়েছে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যদি তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের কাছে রাত্রে মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তাহলে তোমরা তাদেরকে অনুমতি দিয়ে দাও।” (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, যদিও তাদের ঘরই তাদের জন্য ভালো।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬৭,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৭৪৫৮নং)
“আল্লাহর বা¦দীদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করো না, তবে তারা যেন খোশবূ ব্যবহার না করে সাদাসিধা ভাবে আসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৭৪৫৭নং)
একদা আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমাদের মহিলারা যদি মসজিদে যেতে অনুমতি চায়, তাহলে তাদেরকে বাধা দিও না।” এ হাদীস শোনার পর তাঁর ছেলে বিলাল বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ তার মুখোমুখি হয়ে এমন গালি দিলেন, যেমনটি আর কোনদিন শোনা যায়নি। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি তোকে আল্লাহর রসূল (সাঃ) থেকে খবর দিচ্ছি। আর তুই বলিস, ‘আল্লাহর কসম! আমরা ওদেরকে বাধা দেব।’ (মুসলিম, সহীহ ৪৪২নং)
অবশ্য সত্যপক্ষে ফিতনা, নজরবাজি বা নষ্টি ফষ্টির আশঙ্কা থাকলে অথবা মহিলা সেজেগুজে বেপর্দায় কিংবা সেন্ট ব্যবহার করে যেতে চাইলে অভিভাবক বা স্বামী তাকে অনুমতি দেবে না।
অনুরুপভাবে যে মহিলারা জামাআতে হাযির হবে, তাদের জন্য জরুরী এই যে, তারা পুরুষদের ইমামের সালাম ফেরা মাত্র উঠে বাড়ি রওনা দেবে। যাতে পুরুষদের সাথে মসজিদের দরজায় বা পথে কোন প্রকার দেখা-সাক্ষাৎ না হয়। হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যুগে মহিলারা যখন ফরয নামাযের সালাম ফিরত, তখন তারা উঠে চলে যেত। আর রসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাথে অন্যান্য নামাযীরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেন। অতঃপর আল্লাহর রসূল উঠে গেলে পুরুষরা উঠে যেত।’ (বুখারী ৮৬৬, ৮৭০নং)
অবশ্য মহিলাদের পর্দাযুক্ত পৃথক মুসাল্লা ও পৃথক দরজা হলে সালাম ফেরা মাত্র সত্বর উঠে যাওয়া জরুরী নয়। (আনিঃ ১/২৮৭)
প্রকাশ যে, মহিলা সঙ্গে তার ছোট শিশুকেও মসজিদে আনতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যাতে মসজিদের কোন জিনিস, কুরআন, পবিত্রতা আদি নষ্ট এবং নামাযীদের কোন প্রকার ডিষ্টার্ব না করে।
জামাআত তথা মসজিদে যাওয়ার কিছু আদব
জামাআতে হাযির হওয়ার জন্য বাসা থেকে ওযূ করে বিনয়ের সাথে বের হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ, বাসা থেকে ওযূ করে নামাযে যাওয়ার কথা একাধিক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।
এ সময়ে সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লেবাস পরিধান করা কর্তব্য। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর আদেশ রয়েছে। (কুরআন মাজীদ ৭/৩১)
সর্বশরীর থেকে সর্বপ্রকার দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া জরুরী। লেবাসের, মুখের, ঘামের, কাঁচা পিঁয়াজ ও রসুন তথা বিড়ি-সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর করে নেওয়া আবশ্যিক। যাতে সে গন্ধে ফিরিশ্তা ও পাশের নামাযী কষ্ট না পান এবং ঐ গন্ধ-ওয়ালার প্রতি নামাযীদের মনে মনে ঘৃণার উদ্রেক না হয়।
চলার পথে দুইহাতের আঙ্গুলসমূহের মাঝে খাজাখাজি করা নিষিদ্ধ। কারণ, নামাযের জন্য চলাও নামায পড়ার মতই গুরুত্ব রাখে। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২নং)
চলার সময় নামাযী যেন এদিক-ওদিক না তাকায়, হৈ-হাল্লা না করে, নামাযের কিছু অংশ ছুটে গেলেও যেন না দৌড়ে। বরং ভদ্রতা ও গম্ভীরতার সাথে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে জামাআতে শামিল হয়।
চলার পথে আল্লাহর যিক্র মনে রাখা কর্তব্য। (মসজিদে যাওয়ার আদব দ্রষ্টব্য)
উল্লেখ্য যে, মসজিদে প্রবেশ করার সময় (জুমআর খুতবার আযান ছাড়া অন্য) আযান হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আযানের উত্তর দিয়ে দরুদ-দুআ পড়ে তারপর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ অথবা অন্য সুন্নত পড়বে নামাযী।
কতগুলো নামাযী হলে জামাআত হবে?
মহানবী (সাঃ) ইবনে আব্বাসকে নিয়ে জামাআত করে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আসু:) তিনি সফরে উদ্যত দুইজন লোককে বলেছিলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (বুখারী ৬৩০নং, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)
নামাযের কতটুকু অংশ পেলে জামাআতের ফযীলত পাওয়া যায়?
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি জুমুআহ অথবা অন্য নামাযের এক রাকআত পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১২৩নং)
অবশ্য ইমামের সালাম ফিরার আগে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে নামাযের যেটুকু অংশ পাওয়া যায় সেটুকুকে ভিত্তি করে জামাআতে শামিল হওয়া যায়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযের ইকামত হয়ে গেলে তোমরা দৌড়ে এস না। বরং তোমরা স্বাভাবিকভাবে চলে এস। আর তোমাদের মাঝে যেন স্থিরতা থাকে। অতঃপর যেটুকু নামায পাও তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যায় তা পুরা করে নাও।” (মুসলিম, সহীহ ৬০২)
উল্লেখ্য যে, জামাআত করার মত লোক থাকলেও শেষ রাকআতে রুকূর পর বা শেষ তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল না হয়ে ইমামের সালাম ফিরার পর দ্বিতীয় জামাআত করা উত্তম নয়। উত্তম হল, ইমামের সালাম ফিরার আগে পর্যন্ত জামাআতে শামিল হওয়া। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিস-স্বালাহ্, ইবনে বায ৭৬পৃ:)
কেউ কেউ বলেন, সঙ্গে জামাআত করার মত লোক থাকলে এবং ইমাম শেষ তাশাহ্হুদে থাকলে জামাআতে শামিল না হয়ে তাদের সালাম ফিরার পর নতুনভাবে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। কেননা, মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পেয়ে গেল, সে নামায পেয়ে গেল।” আর তার মানেই হল যে এক রাকআত পেল না বরং সিজদাহ বা তাশাহহুদ পেল, সে নামায পেল না। অতএব নতুন করে জামাআত করলে প্রথম থেকে জামাআত পাওয়া যাবে এবং পূর্ণ নামাযও পাওয়া যাবে। আর এটাই হবে উত্তম। (ফাতাওয়া তাতাআল্লাকু বিজামাআতিল মাসজিদ ৫০পৃ:) অতএব আল্লাহই ভালো জানেন।
মসজিদের জামাআত ছুটে গেলে
যদি আর কোন লোকের উপস্থিতির আশা না থাকে, তাহলে অন্য মসজিদে জামাআত না হওয়ার ধারণা পাকা হলে সেখানে গিয়ে জামাআতে নামায পড়বে।
তা না হলে মসজিদে একাকী নামায পড়ার চাইতে বাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে জামাআত করে নামায পড়া উত্তম। মহানবী (সাঃ) এরুপ করেছেন বলে প্রমাণ আছে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৫৫পৃ:, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ৫৬পৃ:) অবশ্য বাড়িতে জামাআত করার মত লোক না থাকলে ফরয নামায বাড়ির চেয়ে মসজিদে পড়াই উত্তম। কারণ, নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাওয়ার পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে এবং ফরয নামায মসজিদে পড়ার আদেশ আছে।
মসজিদে দ্বিতীয় জামাআত
অবশ্য কোন মসজিদে নির্দিষ্ট ইমাম না থাকলে সেখানে প্রথম জামাআতের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাআত দূষণীয় নয়।
যেমন পথের ধারে বা বাজারের মসজিদে বারবার জামাআত হওয়াও দোষাবহ্ নয়। বরং যারা যখন আসবে তারা তখনই জামাআত সহকারে নামায আদায় করে নিজ নিজ কাজে বের হয়ে যাবে।
যেমন মসজিদ ছোট হওয়ার কারণে প্রথম জামাআতে বিরাট সংখ্যক মানুষের এক সাথে নামায পড়া সম্ভব না হলে, জামাআত শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় জামাআত করাও বৈধ।
মসজিদের নির্ধারিত ইমামের ইমামতিতে জামাআত শেষ হয়ে যাওয়ার পর জামাআত হওয়ার মত লোক মসজিদে এলে জামাআতের ফযীলত নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের দ্বিতীয় জামাআত করা বৈধ।
একদা জামাআত হয়ে গেলে এক ব্যক্তি মসজিদে এল। মহানবী (সাঃ) বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬নং)
হযরত আনাস (রাঃ) এক মসজিদে এলেন। দেখলেন, সেখানে জামাআত হয়ে গেছে। তিনি সেখানে আযান-ইকামত দিয়ে জামাআত সহকারে নামায আদায় করলেন। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৫৪)
অবশ্য এই সুবাদে কেউ যেন প্রথম জামাআতে উপস্থিত হওয়াতে ঢিলেমি না করে। কারণ, (কোন ওযর না থাকলে) আযান শোনামাত্র মসজিদে হাযির হওয়ার জন্য তৎপর হওয়া ওয়াজেব। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিস-স্বালাহ্, ইবনে বায ৭৪পৃ:)
জামাআতের নামায দেরীতে হলে
অবশ্য ইমাম যদি খুব ঢিলে হন এবং খুব দেরী করে নামায পড়েন, তাহলে তার নির্দেশ ভিন্ন। মহানবী (সাঃ) একদা আবূ যার (রাঃ)-কে বললেন, “কি করবে তুমি, যখন এমন কিছু আমীর হবে, যারা যথা সময় থেকে নামায দেরী করে পড়বে?” আবূ যার বললেন, ‘আমাকে আপনি কি আদেশ করেন? বললেন, “তুমি তোমার নামায যথাসময়ে পড়ে নাও। অতঃপর যদি সেই নামায তাদের সাথে পাও, তাহলে পুনরায় তাদের সাথে (জামাআতে) পড়ে নাও। এটা তোমার জন্য নফল হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
ইমামতি এবং মুক্তাদি সম্পর্কিত
সর্বাঙ্গ সুন্দর ইসলামের সুষ্ঠ এক বিধান হল জামাআত তথা তার পরিচালক একক ইমাম বা নেতার বিধান। ইমাম হলেন সমাজের নেতা। সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠ জীবন-যাপন করার জন্য নেতার দরকার একান্ত। যিনি হবেন মুসলিমের সমাজ-কেন্দ্র মসজিদের ইমাম এবং তিনিই হবেন ইসলামী-শরীয়ত ব্যাখ্যা দাতা তথা নির্দেশ প্রদানকারী। তিনি হবেন সকলের সকল কাজের আগে। তাঁর মুগ্ধকারী আখলাক-চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং সর্বপ্রকার আচরণে সমাজের জন্য দিক-নির্ণয়ক তারা। তিনি প্রচলিত ‘মোল্লা’ নন, তাঁর দৌড় মসজিদ পর্যন্তই নয়। বরং তাঁর দৌড় গোরের পরেও পরপারের সুখময় জীবন পর্যন্ত।
তিনি সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়। তিনি সমাজ-সংস্কারক, সুপরামর্শদাতা, কল্যাণকামী ও শুভানুধ্যয়ী। তিনি ইসলামের বিশাল ইবাদত নামাযের নেতা, তিনিই জিহাদের ময়দানে প্রধান সেনাপতি।
ইমাম হওয়ার সর্বাধিক বেশী যোগ্য কে?
ইমামতির সবচেয়ে বেশী যোগ্য তিনি, যিনি কুরআনের হাফেয; যিনি (তাজবীদ সহ্) ভালো কুরআন পড়তে পারেন। তাজবীদ ছাড়া হাফেয ইমামতির যোগ্য নয়। পূর্ণ হাফেয না হলেও যাঁর পড়া ভালো এবং বেশী কুরআন মুখস্থ আছে তিনিই ইমাম হওয়ার অধিক যোগ্য।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তি হলে ওদের মধ্যে একজন ইমামতি করবে। আর ইমামতির বেশী হ্কদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে।” (মুসলিম, মিশকাত ১১১৮নং)
তিনি আরো বলেন, “লোকেদের ইমাম সেই ব্যক্তি হবে যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে। পড়াতে সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যে বেশী সুন্নাহ্ জানে, সুন্নাহর জ্ঞান সকলের সমান থাকলে ওদের মধ্যে যে সবার আগে হিজরত করেছে, হিজরতেও সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যার বয়স বেশী সে ইমাম হবে। আর কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১১৭নং)
উল্লেখ্য যে, সাধারণ নামাযীর মত ইমামতির জন্যও সুন্নতী লেবাস উত্তম। তবে মাথায় পাগড়ী, রুমাল বা টুপী হওয়া কিংবা মাথা ঢাকা ইমামতির জন্য শর্ত, ফরয বা জরুরী নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮৬, ৩৮৯) সুতরাং যার মাথা ঢাকা আছে তার থেকে যার মাথা ঢাকা নেই, সে ভালো কুরআন পড়তে পারলে সেই ইমামতির হ্কদার।
যাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ
এমন কতক লোক আছে যাদেরকে আপাত:দৃষ্টিতে ইমামতির অযোগ্য মনে হলেও প্রকৃতদৃষ্টিতে তাদের ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ। অবশ্য শুরুতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি মনে রাখলে এ প্রসঙ্গে অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে। যে ব্যক্তির নামায শুদ্ধ, তার ইমামতিও শুদ্ধ এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ। আর যার নামায শুদ্ধ নয়, তার ইমামতিও শুদ্ধ নয় এবং তার পিছনে মুক্তাদীর নামাযও শুদ্ধ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৬-৩১৭)
যারা ইমাম হওয়ার যোগ্য নয় বলে ধারণা হতে পারে অথচ (ইমামতির গুণাবলী বর্তমান থাকলে) তারা আসলে তার যোগ্য এমন কিছু লোক নিম্নরুপ :-
১ । অন্ধ :
অন্ধ মানুষের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সন্দেহ্ থাকলেও সব অন্ধ সমান নয়। সুতরাং যোগ্যতা থাকলে সে ইমাম হতে পারে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূমকে দু-দু বার মদ্বীনার ইমাম বানিয়েছিলেন এবং তিনি লোকেদের নামাযের ইমামতি করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১২১নং)
২। ক্রীতদাস :
ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দী দাস, মুক্তদাস, সাধারণ দাস, ভৃত্য, চাকর, বা রাখাল যোগ্য হলে তার ইমামতি শুদ্ধ এবং এমন আতরাফদের পশ্চাতে আশরাফদেরও নামায শুদ্ধ। মহানবী (সাঃ) যখন মদ্বীনায় প্রথম প্রথম হিজরত করে এলেন, তখন মুহাজেরীনরা কুবার নিকটবর্তী উসবাহ্ নামক এক জায়গায় অবস্থান শুরু করলেন। সেখানে আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর মুক্ত করা দাস সালেম (রাঃ) লোকেদের ইমামতি করতেন। তাঁর সবার চাইতে বেশী কুরআন মুখস্থ ছিল। অথচ তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীদের মধ্যে হযরত উমার এবং আবূ সালামাও ছিলেন। (বুখারী, ৬৯২, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৮নং, মিশকাত ১১২৭নং)
তদনুরুপ হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মুক্ত করা দাস আবূ আম্র নামাযের ইমামতি করতেন। (মুসনাদ ইমাম শাফেয়ী) তাঁর যাকওয়ান নামক আর এক মুক্ত করা দাসও ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
৩। মুসাফির :
মুসাফিরের জন্য সফরে নামায জমা ও কসর করা সুন্নত হলেও এবং সে ইমামতি করার সময় নামায কসর করে পড়লেও তার পিছনে গৃহ্বাসীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে গৃহ্বাসীরা ঐ মুসাফির ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায পূরণ করে নেবে। অর্থাৎ, ইমাম ও মুক্তাদী মিলে ২ রাকআত হয়ে গেলে মুক্তাদীরা ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একা একা আরো বাকী ২ রাকআত পড়ে নেবে। আর সে নামায জমা করে পড়লে স্থানীয় বাসিন্দারা তা করবে না।
৪। দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি :
দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ। তবে মুক্তাদীরাও (দাঁড়ানোর সময়) বসে নামায পড়বে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম এ জন্যই বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং --- সে যখন দাঁড়িয়ে নামায পড়বে, তখন তোমরাও দাঁড়িয়ে নামায পড় এবং যখন বসে নামায পড়বে তখন তোমরাও বসে নামায পড়। আর সে বসে থাকলে তোমরা দাঁড়াও না; যেমন পারস্যর লোকেরা তাদের সম্মানার্হ ব্যক্তিদের জন্য করে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ২৩৫৬নং)
কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বসে নামায পড়লে তাঁর পশ্চাতে সাহাবীগণ দাঁড়িয়েই নামায পড়েছেন। এর ফলে উলামাগণ বলেন যে, ইমাম সাময়িক অসুবিধার কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরাও বসে নামায পড়বে। নচেৎ, শেষ জীবনে বাধ্যক্যজনিত কারণে বসে নামায পড়লে মুক্তাদীরা (দাঁড়ানোর সময়) দাঁড়িয়েই নামায পড়বে।
বলা বাহুল্য, তাঁর পূর্বেকার আমল মনসূখ নয়। কারণ, তাঁর আমল দ্বারা তাঁর আদেশ মনসূখ হয় না। তাছাড়া তাঁর পরবর্তীতে সাহাবাগণও ইমাম বসে নামায পড়লে বসেই নামায পড়েছেন। অবশ্য ঐ ক্ষেত্রে বসে নামায পড়া ওয়াজেব না বলে মুস্তাহাব বলা যেতে পারে। (মিশকাত ১১৩৯নং, ১/৩৫৭ আলবানীর টীকা সহ্ দ্র:)
৫। তায়াম্মুমকারী :
যে ব্যক্তি ওযূ করতে না পেরে তায়াম্মুম করে নামায পড়ে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে যারা ওযূ করে নামায পড়ে তাদের নামায শুদ্ধ।
হযরত আম্র বিন আস (রাঃ) বলেন, যাতুস সালাসিল যুদ্ধ-সফরে এক শীতের রাতে আমার স্বপ্নদোষ হল। আমার ভয় হল যে, যদি গোসল করি তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) ফজরের নামায পড়লাম। আমার সঙ্গীরা একথা নবী (সাঃ)-র নিকটে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “হে আম্র! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সঙ্গীদের ইমামতি করেছ?” আমি গোসল না করার কারণ তাঁকে বললাম। আরো বললাম যে, আল্লাহ তাআলার এ বাণীও আমি শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমরা আত্মহ্ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড় দয়াশীল।” (কুরআন মাজীদ ৪/২৯)
একথা শুনে তিনি হাসলেন এবং আর কিছুই বললেন না। (বুখারী, সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৩নং, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
৬। কেবল মহিলাদের জন্য মহিলা :
মহিলা মহিলা নামাযীদের ইমামতি করতে পারে। উম্মে অরাকাহ্ বিন নাওফাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ)-এর নির্দেশমতে তাঁর পরিবারের মহিলাদের ইমামতি করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯১-৫৯২নং)
অবশ্য এ ক্ষেত্রে মহিলা ইমাম মহিলাদের কাতার ছেড়ে পুরুষের মত সামনে একাকিনী দাঁড়াবে না। বরং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবে। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, মুহাল্লা ৩/১৭১-১৭৩) আশেপাশে বেগানা পুরুষ না থাকলে সশব্দে তকবীর ও কিরাআত পড়বে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৩০/১১৩)
৭। কেবল মহিলাদের জন্য পুরুষ :
কোন পুরুষ কেবল মহিলা জামাআতের ইমামতি করতে পারে। তবে শর্ত হল, মহিলা যেন এগানা হয়, নচেৎ বেগানা হলে যেন একা না হয়, পরিপূর্ণ পর্দার সাথে একাধিক থাকে এবং কোন প্রকার ফিতনার ভয় না থাকে অথবা তার সঙ্গে যেন কোন এগানা মহিলা বা অন্য পুরুষ থাকে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৫২)
একদা ক্বারী সাহাবী হযরত উবাই বিন কা’ব (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! গতরাত্রে আমি একটি (অস্বাভাবিক) কাজ করেছি।’ তিনি বললেন, “সেটা কি?” উবাই বললেন, ‘কিছু মহিলা আমার ঘরে জমা হয়ে বলল, আপনি (ভালো ও বেশী) কুরআন পড়তে পারেন, আমরা পারি না। অতএব আপনি আজ আমাদের ইমামতি করেন। তাদের এই অনুরোধে আমি তাদেরকে নিয়ে ৮ রাকআত এবং বিতর পড়েছি।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাঃ) চুপ থাকলেন। অর্থাৎ তাঁর এই নীরব থাকা এ ব্যাপারে তাঁর মৌনসম্মতি হয়ে গেল। (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা)
৮। নাবালক কিশোর :
জ্ঞানসম্পন্ন নাবালক কিশোরের জন্য যদিও নামায ফরয নয়, তবুও বড়দের জন্য ফরয-নফল সব নামাযেই তার ইমামতি শুদ্ধ।
আম্র বিন সালামাহ্ ৬-৭ বছর বয়সে লোকেদের ইমামতি করেছেন। আর তিনি ছিলেন সকলের মধ্যে বেশী কুরআনের হাফেয। (বুখারী ৪৩০২, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৮৫নং)
৯। জারজ :
ব্যভিচারজাত সন্তানের কোন দোষ নেই। তার মা-বাপের দোষ তার ঘাড়ে আসতে পারে না। সুতরাং অন্যান্য দিকে যোগ্যতা থাকলে তার ইমামতি এবং তার পশ্চাতে নামায শুদ্ধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৪৭-১৪৮)
১০। যে নফল বা ভিন্ন ফরয নামায পড়ছে :
যে নফল নামায পড়ছে তার পিছনে ফরয নামায শুদ্ধ; যেমন তারাবীহ্র জামাআতে এশার নামায, অথবা আসরের জামাআতে যোহরের কাযা নামায অথবা কাযা নামায আদায়কারীর পিছনে ফরয নামায আদায় করা শুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে ইমাম ও মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হলেও তা কোন দোষের নয়। যেহেতু জরুরী হল বাহ্যিক কর্মাবলীতে ইমামের অনুসরণ করা।
হযরত মুআয বিন জাবাল মহানবী (সাঃ)-এর সাথে এশার নামায পড়তেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজের গোত্রের লোকেদের ঐ নামাযই পড়াতেন। এক বর্ণনায় আছে যে, এ নামায তাঁর নফল হত এবং লোকেদের হত ফরয। (বুখারী, মুসলিম, শাফেয়ী, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ৩/৮৬, মিশকাত ১১৫০-১১৫১নং)
১১। সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত লোকের ইমামতি
সম্মানিত থাকতে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানিত ব্যক্তির ইমামতি বৈধ। একদা আব্দুর রহ্মান বিন আওফের পশ্চাতে মহানবী (সাঃ) নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪নং)
যাদের ইমামতি শুদ্ধ নয়
১। পুরুষের জন্য মহিলা :
পুরুষের জন্য মহিলার ইমামতি বৈধ ও শুদ্ধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সে জাতি কোন দিন সফল হবে না, যে জাতি তাদের কর্মভার একজন মহিলাকে সমর্পণ করবে।” (বুখারী, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)
বলা বাহুল্য, মহিলা যত বড়ই যোগ্য হোক, মুক্তাদী নিজের ছেলে হোক অথবা অন্য কেউ হোক, স্বামী জাহেল এবং স্ত্রী কুরআনের হাফেয হোক তবুও কোন ক্ষেত্রেই মহিলা পুরুষের ইমামতি করতে পারে না। এটি পুরুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৮২)
২। মুশরিক ও বিদআতী :
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন ইবাদতে অন্য কোন সৃষ্টিকে শরীক করে, যেমন মাযার পূজা করে, মাযারে গিয়ে সিজদা, নযর-নিয়ায, মানত, কুরবানী, তওয়াফ প্রভৃতি নিবেদন করে, সেখানে সুখণ্ডসমৃদ্ধি বা সন্তান চায়, সাহায্য প্রার্থনা করে, যে ব্যক্তি গায়বী (অদৃশ্যের খবর জানার) দাবী করে ও লোকেরহাত বা ভাগ্য-ভবিষ্যৎ বলে দেয়, যে (কোন পশু বা পাখীর চামড়া, হাড়, লোম বা পালক দিয়ে, কোন গাছপালার শিকড় বা ফুল-পাতা দিয়ে, কারো কাপড়ের কোন অংশ দিয়ে, ফিরিশ্তা , জিন, নবী, সাহাবী, ওলী বা শয়তানের নাম লিখে অথবা বিভিন্ন সংখ্যার নকশা বানিয়ে, অথবা তেলেসমাতি বিভিন্ন কারসাজি করে, নোংরা ও নাপাক কোন জিনিস দিয়ে) শির্কী তাবীয লিখে, যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে (বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে) প্রেম বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য তাবীয করে, যোগ বা যাদু করে, এ শ্রেণীর ইমামের নামায শুদ্ধ নয়, ইমামতি শুদ্ধ নয় এবং তার পশ্চাতে নামাযও শুদ্ধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৯, ২২/৮২, ২৪/৭৮, ৮৯, ২৬/৯৭, ২৮/৫৫)
তদনুরুপ বিদআতী যদি বিদআতে মুকাফফিরাহ্ বা এমন বিদআত করে যাতে মানুষ কাফের হয়ে যায়, তাহলে সে বিদআতীর পিছনে নামায শুদ্ধ নয়।
৩। ফাসেক :
ফাসেক হল সেই ব্যক্তি, যে অবৈধ, হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ করে এবং ফরয বা ওয়াজেব কাজ ত্যাগ করে; অর্থাৎ কাবীরা গুনাহ করে। যেমন, ধূমপান করে, বিড়ি-সিগারেট, জর্দা-তামাক প্রভৃতি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে, অথবা সূদ বা ঘুস খায়, অথবা মিথ্যা বলে, অথবা (অবৈধ প্রেম) ব্যভিচার করে, অথবা দাড়ি চাঁছে বা (এক মুঠির কম) ছেঁটে ফেলে, অথবা মুশরিকদের যবেহ্ (হালাল মনে না করে) খায়, (হালাল মনে করে খেলে তার পিছনে নামায হবে না।) অথবা স্ত্রী-কন্যাকে বেপর্দা রেখে তাদের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়, অথবা মা-বাপকে দেখে না বা তাদেরকে ভাত দেয় না ইত্যাদি।
উক্ত সকল ব্যক্তি এবং তাদের অনুরুপ অন্যান্য ব্যক্তির পিছনে নামায মাকরুহ (অপছন্দনীয়)। বিধায় তাকে ইমামরুপে নির্বাচন ও নিয়োগ করা বৈধ ও উচিৎ নয়।
কিন্তু যদি কোন কারণে বা চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই তার পিছনে নামায পড়তেই হয়, তাহলে নামায হয়ে যাবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ৫/২৯০, ৩০০, ৬/২৫১, ১৫/৮০, ১৮/৯০, ১১১, ১৯/১৫২, ২২/৭৫, ৭৭, ৯২, ২৪/৭৮)
সাহাবাগণের যামানায় সাহাবাগণ ফাসেকের পিছনে নামায পড়েছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) হাজ্জাজের পিছনে নামায পড়েছেন। (বুখারী) আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মারওয়ানের পিছনে নামায পড়েছেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)
হযরত ওসমান (রাঃ) ফিতনার সময় যখন স্বগৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন, তখন উবাইদুল্লাহ্ বিন আদী বিন খিয়ার তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘আপনি জনসাধারণের ইমাম। আর আপনার উপর যে বিপদ এসেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ফিতনার ইমাম আমাদের নামাযের ইমামতি করছে; অথচ তার পশ্চাতে নামায পড়তে আমরা দ্বিধাবোধ করি।’ তিনি বললেন, ‘নামায হল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। সুতরাং লোকে ভালো ব্যবহার করলে তাদের সাথেও ভালো ব্যবহার কর। আর মন্দ ব্যবহার করলে তাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করা থেকে দূরে থাক।’ (বুখারী ৬৯৫, মিশকাত ৬২৩নং)
৪। ইমামতির বিনিময়ে অর্থগ্রহণকারী ব্যক্তি :
ইমামতিকে যে অর্থকরী পেশা মনে করে ইমামতি করে; অর্থাৎ, কেবল পয়সার ধান্দায় ইমামতি করে, এমন ইমামের পশ্চাতে নামায মাকরুহ।
আবূ দাঊদ বলেন, (ইমাম) আহমাদ এমন ইমামের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলেন, যে বলে, ‘আমি এত এত (টাকার) বিনিময়ে রমযানে তোমাদের ইমামতি করব।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। কে এর পেছনে নামায পড়বে?’ (মারা: ৯৯পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, ইমামতির জন্য সৌজন্য সহকারে ইমামকে বেতন, ভাতা বা বিনিময় দেওয়া মুক্তাদীদের কর্তব্য। ইমামের উচিৎ, কোন চুক্তি না করা; বরং মুক্তাদীদের বিবেকের উপর যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর ওয়াস্তে ইমামতির দায়িত্ব পালন করা। পক্ষান্তরে জামাআতের উচিৎ, ইমামের এই দ্বীনদারীকে সস্তার সুযোগরুপে ব্যবহার না করা। বরং বিবেক, ন্যায্য ও উচিৎ মত তাঁর কালাতিপাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেমন উচিৎ নয় এবং আদৌ উচিৎ নয়, ইমাম সাহেবকে জামাআতের ‘কেনা গোলাম’ মনে করা।
৫। ক্বিরাআত ভুল যার :
যে কুরআন পড়তে এমন ভুল পড়ে, যাতে মানে বদলে যায়, তার ইমামতি ও তার পিছনে যে ভালো কুরআন পড়তে পারে তার নামায শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৬৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৪৮)
বলা বাহুল্য, ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে ক্বারীর নামায শুদ্ধ নয়। তবে অক্বারীর নামায হয়ে যাবে। অবশ্য যদি কোন ক্বারী ভুল ক্বিরাআতকারীর পিছনে অজান্তে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে নেয়, তাহলে তার নামায হয়ে যাবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১২১পৃ:)
সুতরাং যে সকল মসজিদে সস্তা দরে অক্বারী ইমাম রাখা হয়, সে সকল গ্রাম শহরের ক্বারীদের (যারা ইমাম অপেক্ষা ভালো কুরআন পড়তে পারে তাদের) নামাযের অবস্থা কি হবে তা মসজিদের মতওয়াল্লীদেরকে ভেবে দেখা দরকার।
৬। যাকে মুক্তাদীরা অপছন্দ করে :
চরিত্রগত বা শিক্ষাগত কোন কারণে মুক্তাদীরা ইমামকে অপছন্দ করলে ইমামের নামায আল্লাহর দরবারে কবুল নয়। সুতরাং জেনেশুনে তার ইমামতি করা বৈধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)
অবশ্য ব্যক্তিগত কোন কারণে কেউ কেউ ইমামকে অপছন্দ করলে, দোষ নেই অথচ তাকে খামাখা কেউ অপছন্দ করলে অথবা বেশী সংখ্যক লোক পছন্দ এবং অল্প সংখ্যক লোক অপছন্দ করলে কারো কোন ক্ষতি হয় না। অবশ্য ক্ষতি তার হয়, যে একজন নির্দোষ মানুষকে খামাখা অপছন্দ করে। তবুও জ্ঞানী ইমামের উচিৎ, যে জামাআতের অধিকাংশ লোক তাকে অপছন্দ করে, সে জামাআতের ইমামতি ত্যাগ করা এবং তার ইমামতিকে কেন্দ্র করে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি না করা।
৭। সুন্নাহ্ত্যাগী :
যে মানুষ সুন্নাহর পাবন্দ নয়; সুন্নত নামায-রোযা ইত্যাদি ত্যাগ করে, নিশ্চয় সে মানুষ পরহেযগার ও ভালো লোক নয়। তবে সে যে পাপী তা কেউবলতে পারে না। অতএব তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। তদনুরুপ কোন বিতর্ক থাকার ফলে বা কোন সন্দেহের কারণে কেউ কোন সুন্নাহ্ ত্যাগ করলে; যেমন বুকের উপরহাত না বাঁধলে, রুকূর আগে-পরে রফ্য়ে ইয়াদাইন না করলে বা জোরে আমীন না বললেও তার পিছনে নামায পড়তে কোন দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৫/৪৬)
৮। পেশাব-ঝরা রোগী :
যে ব্যক্তির সর্বদা পেশাব ঝরার রোগ আছে সে ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯৭)
৯। বোবা :
বোবার পিছনে নামায পড়লে নামায শুদ্ধ। কিন্তু তাকে ইমাম করা যাবে না। যেহেতু সে তকবীর শুনাতে ও জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করতে অক্ষম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩২০)
১০। জলদিবাজ :
যে ব্যক্তি ঠকাঠক কাকের দানা খাওয়ার মত নামায পড়ে এবং পশ্চাতে মুক্তাদীরা তার অনুসরণ করতে সক্ষম হয় না, রুকূ ও সিজদা থেকে উঠে পিঠ সোজা করে না, তার নামায এবং তার পশ্চাতে মুক্তাদীদেরও নামায হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৬৭)
১১। বেওযূ ব্যক্তি :
কোন ইমাম নাপাক বা বেওযূ অবস্থায় নামায পড়লে এবং সালাম ফিরার পর তা জানতে পারলে কেবল তার নামায বাতিল হবে এবং মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। কেবল ইমামই ঐ নামায পুনরায় পড়বে, মুক্তাদীরা নয়। (আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ১৪৭পৃ:) জেনেশুনে কোন বেওযূর পিছনে নামায হবে না।
১২। রেডিও-টিভির ইমাম :
কোন পুরুষ অথবা মহিলা, সুস্থ অথবা অসুস্থ, ওজরে অথবা বিনা ওজরে রেডিও বা টিভির পিছনে দাঁড়িয়ে সম্প্রচারিত কোন মসজিদের ফরয অথবা নফল, জুমুআহ অথবা অন্য যে কোন নামাযে তার ইমামের অনুসরণ করা বৈধ নয়। যদিও তাদের বাসা উক্ত মসজিদের পাশে হোক অথবা সামনে, উপরে হোক অথবা পিছনে। কোন অবস্থাতেই মসজিদে হাজির না হয়ে দূর থেকে কেবল শব্দ অথবা শব্দ ও ছবির অনুকরণ করে জামাআত পাওয়া যায় না। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৭৩পৃ:)
ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়াবার স্থান ও নিয়ম
মুক্তাদীর সংখ্যা হিসাবে ইমাম ও মুক্তাদীর দাঁড়ানোর নিয়ম-পদ্ধতি বিভিন্ন রকম।
১। ইমামের সাথে মাত্র একজন মুক্তাদী (পুরুষ বা শিশু) হলে উভয়ে একই সাথে সমানভাবে দাঁড়াবে; ইমাম বাঁয়ে এবং মুক্তাদী হবে ডানে। এ ক্ষেত্রে ইমাম একটু আগে এবং মুক্তাদী একটু পিছনে আগাপিছা হয়ে দাঁড়াবে না। ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে মহানবী (সাঃ) নিজের বরাবর দাঁড় করিয়েছিলেন। (বুখারী ৬৯৭নং) মৃত্যুরোগের সময় তিনি আবূ বাক্র (রাঃ)-এর বাম পাশে তাঁর বরাবর এসে বসেছিলেন। (ঐ ১৯৮নং)
নাফে’ বলেন, ‘একদা আমি কোন নামাযে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-এর পিছনে দাঁড়ালাম, আর আমি ছাড়া তাঁর সাথে অন্য কেউ ছিল না। তিনি আমাকে তাঁর হাত দ্বারা তাঁর পাশাপাশি বরাবর করে দাঁড় করালেন।’ (মালেক, মুঅত্তা ১/১৫৪) অনুরুপ বর্ণিত আছে হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃকও।
এ জন্যই ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উক্ত বিষয়ক পরিচ্ছেদ বাঁধার সময় বলেন, ‘দুজন হলে (মুক্তাদী) ইমামের পাশাপাশি তার বরাবর ডান দিকে দাঁড়াবে।’ (বুখারী ৬৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৯০ নং, ৬/১৭৫-১৭৬)
জ্ঞাতব্য যে, একক মুক্তাদীর ইমামের ডানে দাঁড়ানো সুন্নত বা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, যদি কেউ ইমামের বামে দাঁড়িয়ে নামায শেষ করে, তাহলে ইমাম-মুক্তাদী কারো নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭৫, সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১১১পৃ:)
২। মুক্তাদী ২ জন বা তার বেশী (পুরুষ) হলে ইমামের পশ্চাতে কাতার বাঁধবে।
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়ার জন্য দাঁড়ালেন। এই সময় আমি এসে তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালাম। তিনি আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করালেন। ইতিমধ্যে জাব্বার বিন সাখার (রাঃ) এলেন। তিনি তাঁর বাম দিকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আমাদের উভয়ের হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাঁর পশ্চাতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১০৭নং)
উল্লেখ্য যে, দুই জন মুক্তাদী যদি ইমামের ডানে-বামে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭০) নামায হয়ে যাবে, কারণ ইবনে মাসঊদ আলক্বামাহ্ ও আসওয়াদের মাঝে দাঁড়িয়ে ইমামতি করেছেন এবং তিনি নবী (সাঃ)-কে ঐরুপ দাঁড়াতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৩৮নং) অবশ্য মহানবী (সাঃ)-এর সাধারণ সুন্নাহ্ হল, তিন জন হলে একজন সামনে ইমাম এবং দুই জনের পিছনে কাতার বাঁধা। পক্ষান্তরে আগে-পিছে জায়গা না থাকলে তো এক সারিতে দাঁড়াতে বাধ্যই হবে।
৩। মুক্তাদী একজন মহিলা হলে (সে নিজের স্ত্রী হলেও) ইমাম (স্বামীর) পাশাপাশি বরাবর না দাঁড়িয়ে তার পিছনে দাঁড়াবে। (আদাবুয যিফাফ, আলবানী ৯৬পৃ: দ্র:)
৪। মুক্তাদী দুই বা ততোধিক পুরুষ হলে এবং একজন মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা কাতার বাঁধবে এবং মহিলা সবশেষে একা দাঁড়াবে।
একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর ঘরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) ইমামতি করেন। আনাস (রাঃ) ও তাঁর ঘরের এক এতীম দাঁড়ান নবী (সাঃ)-এর পিছে এবং তাঁর আম্মা দাঁড়ান তাঁদের পিছে (একা)। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১০৮-১১০৯নং)
৫। মুক্তাদী একজন শিশু ও একজন বা একাধিক পুরুষ হলে শিশুও পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে দাঁড়াবে।
৬। মুক্তাদী দুই বা দুয়ের অধিক পুরুষ, শিশু ও মহিলা হলে, ইমামের পিছনে পুরুষরা, অতঃপর শিশুরা এবং সবশেষে মহিলারা কাতার বাঁধবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “পুরুষদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল প্রথম কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল সর্বশেষ কাতার। আর মহিলাদের শ্রেষ্ঠ কাতার হল সর্বশেষ কাতার এবং নিকৃষ্ট কাতার হল প্রথম কাতার।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ১০৯২নং)
প্রকাশ থাকে যে, শিশু ছেলেদের পৃথক কাতার করার কোন সহীহ দলীল নেই। তাই শিশু ছেলেরাও পুরুষদের সঙ্গে কাতার করতে পারে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮৪পৃ:)
৭। ইমামের সামনে কাতার বেঁধে নামায হয় না। অবশ্য ভিড়ের সময় ইমামের সামনে ছাড়া কোন দিকে জায়গা না থাকলে নিরুপায় অবস্থায় নামায হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৭২-৩৭৩)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, জুমুআহ ও ঈদের নামাযের জামাআতে যদি এত ভিঁড় হয় যে সিজদার জন্য জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে সামনের মুসল্লীর পিঠে সিজদা করে নামায সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জায়গা নেই বলে অপেক্ষা করে দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা যাবে না। একদা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) খুতবায় বলেন, ‘ভিঁড় বেশী হলে তোমাদের একজন যেন অপরজনের পিঠে সিজদা করে।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১/৩২, বায়হাকী ৩/১৮২-১৮৩, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৫৪৬৫, ৫৪৬৯নং, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩৪১পৃ:)
৮। ইমামের নিকটবর্তী দাঁড়াবে জ্ঞানী লোকেরা। যাতে তাঁরা ইমামের কোন ভুল চট করে ধরে দিতে পারেন এবং ইমাম নামায পড়াতে পড়াতে কোন কারণে নামায ছাড়তে বাধ্য হলে তাঁদের কেউ জামাআতের বাকী কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। বলা বাহুল্য, সাধারণ মূর্খ মানুষদের ইমামের সরাসরি পশ্চাতে দাঁড়ানো উচিৎ নয়। জ্ঞানী (আলেম-হাফেয-ক্বারী) মানুষদের জন্য ইমামের পার্শ্ববর্তী জায়গা ছেড়ে রাখা উচিৎ।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই লোকদেরকে আমার নিকটবর্তী দাঁড়ানো উচিৎ, যারা জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক। অতঃপর তারা যারা তাদের চেয়ে কম জ্ঞানের। অতঃপর তারা যারা তাদের থেকে কম জ্ঞানের। আর তোমরা বাজারের ফালতু কথা (হৈচৈ) থেকে দূরে থাক।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৮৯নং)
৯। সামনের কাতারে জায়গা থাকতে পিছনে একাকী দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নামায হয় না।
এক ব্যক্তি কাতারের পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বললেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৮২নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি কাতারের পিছে একা নামায পড়ে, সে যেন নামায ফিরিয়ে পড়ে।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতএব যদি কোন ব্যক্তি জামাআতে এসে দেখে যে, কাতার পরিপূর্ণ, তাহলে সে কাতারে কোথাও ফাঁক থাকলে সেখানে প্রবেশ করবে। নচেৎ সামান্যক্ষণ কারো অপেক্ষা করে কেউ এলে তার সঙ্গে কাতার বাঁধা উচিৎ। সে আশা না থাকলে বা জামাআত ছুটার ভয় থাকলে (মিহ্রাব ছাড়া বাইরে নামায পড়ার সময়) যদি ইমামের পাশে জায়গা থাকে এবং সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এবং এ সব উপায় থাকতে পিছনে একা দাঁড়াবে না।
পরন্তু কাতার বাঁধার জন্য সামনের কাতার থেকে কাউকে টেনে নেওয়া ঠিক নয়। এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ ও শুদ্ধ নয়। (যইফ জামে ২২৬১নং) তাছাড়া এ কাজে একাধিক ক্ষতিও রয়েছে। যেমন; যে মুসল্লীকে টানা হবে তার নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হবে, প্রথম কাতারের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে, কাতারের মাঝে ফাঁক হয়ে যাবে, সেই ফাঁক বন্ধ করার জন্য পাশের মুসল্লী সরে আসতে বাধ্য হবে, ফলে তার জায়গা ফাঁক হবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বা সামনের কাতারের ডান অথবা বাম দিককার সকল মুসল্লীকে নড়তে-সরতে হবে। আর এতে তাদের সকলের একাগ্রতা নষ্ট হবে। অবশ্য হাদীস সহীহ হলে এত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধা ছিল না।
তদনুরুপ ইমামের পাশে যেতেও যদি অনুরুপ ক্ষতির শিকার হতে হয়, তাহলে তাও করা যাবে না।
ঠিক তদ্রুপই জায়গা না থাকলেও কাতারের মুসল্লীদেরকে এক এক করে ঠেলে অথবা সরে যেতে ইঙ্গিত করে জায়গা করে নেওয়াতেও ঐ মুসল্লীদের নামাযের একাগ্রতায় বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং এ কাজও বৈধ নয়।
বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে সঠিক ফায়সালা এই যে, সামনে কাতারে জায়গা না পেলে পিছনে একা দাঁড়িয়েই নামায হয়ে যাবে। কারণ, সে নিরুপায়। আর মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে ভার দেন না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২২৭পৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মহিলা জামাআতের মহিলা কাতারে জায়গা থাকতে যে মহিলা পিছনে একা দাঁড়িয়ে নামায পড়বে তারও নামায পুরুষের মতই হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৭) পক্ষান্তরে পুরুষদের পিছনে একা দাঁড়িয়ে মহিলার নামায হয়ে যাবে।
১০। ইমাম মুক্তাদী থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) কর্তৃক এরুপ দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৬১০-৬১১,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১৬৯২, জামে ৬৮৪২নং)
একদা হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকেদের ইমামতি করতে লাগলেন। তা দেখে আবূ মাসঊদ (রাঃ) তাঁর জামা ধরে টেনে তাঁকে নিচে নামিয়ে দিলেন। নামাযের সালাম ফেরার পর তিনি হুযাইফাকে বললেন, ‘আপনি কি জানেন না যে, এরুপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ?’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ, যখনই আপনি আমাকে টান দিলেন, তখনই আমার মনে পড়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৯৭নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অবশ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে নামায পড়ানো যায়। যেমন নবী মুবাশ্শির (সাঃ) মিম্বরের উপর খাড়া হয়ে নামায পড়ে সাহাবাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (বুখারী ৩৭৭নং, মুসলিম, সহীহ) আর এই হাদীসকে ভিত্তি করেই উলামাগণ বলেন, মিম্বরের এক সিড়ি পরিমাণ (প্রায় একহাত) মত উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করলে দোষাবহ্ নয়। (মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্ ১০০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪২৪-৪২৬)
পক্ষান্তরে মুক্তাদী ইমাম থেকে উঁচু জায়গায় দাঁড়াতে পারে। হযরত আবূ হুরাইরা নিচের ইমামের ইক্তেদা করে মসজিদের ছাদের উপর জামাআতে নামায পড়েছেন। (শাফেয়ী, বায়হাকী, বুখারী তা’লীক)
১১। প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ার পৃথক মাহাত্ম আছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকেরা যদি আযান ও প্রথম কাতারে নিহিত মাহাত্ম জানত, তাহলে তা অর্জন করার জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী৬১৫নং, মুসলিম, সহীহ৪৩৭নং)
তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ প্রথম কাতার ও সামনের কাতারসমূহের প্রতি রহ্মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তাগণ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৪৮৯নং)
একদা তিনি সাহাবাদেরকে পশ্চাদপদ হতে দেখে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও এবং আমার অনুসরণ কর। আর তোমাদের পিছনের লোক তোমাদের অনুসরণ করুক। এক শ্রেণীর লোক পিছনে থাকতে চাইবে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে (নিজ রহ্মত থেকে) পিছনে ফেলে দেবেন।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৯০ নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় প্রথম কাতার থেকে পিছনে সরে আসতে থাকলে অবশেষে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে পশ্চাদ্ববর্তী করে দেবেন।” (অর্থাৎ, জাহান্নামে আটকে রেখে সবার শেষে জান্নাত যেতে দেবেন, আর সে প্রথম দিকে জান্নাত যেতে পারবে না।) (আউনুল মা’বূদ ২/২৬৪নং, আবূ দাউদ, ইবনে খুযাইমাহ্, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৫০৭নং)
১২। প্রথম কাতারে ডান দিকের জায়গা অপেক্ষাকৃত উত্তম। সাহাবী বারা’ বিন আযেব বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর ডান দিকে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাম। যাতে তিনি আমাদের দিকে মুখ করে ফিরে বসেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৯, আবূদাঊদ, সুনান ৬১৫নং)
১৩। ইমামের ডানে-বামে লোক যেন সমান-সমান হয়। অতএব কাতার বাঁধার সময় তা খেয়াল রাখা সুন্নত। যেহেতু ২ জন মুক্তাদী হলে এবং আগে-পিছে জায়গা না থাকলে একজন ইমামের ডানে ও অপরজন বামে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানোরও ফযীলত আছে। সুতরাং সাধারণভাবে ইমামের ডান দিকে দাঁড়ানো উত্তম নয়। যেমন ইমামের বাম দিকে লোক কম থাকলে ডান দিকে দাঁড়ানো থেকে বাম দিকে দাঁড়ানো উত্তম। কারণ তখন বাম দিকটা ইমামের অধিক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ডানে-বামে যদি লোক সমান সমান থাকে, তাহলে বামের থেকে ডান দিক অবশ্যই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯)
১৪। (বিরল মাসআলায়) যদি কোন স্থান-কালে কোন জামাআতের দেহে সতর ঢাকার মত লেবাস না থাকে তাহলে ইমাম সামনে না দাঁড়িয়ে কাতারের মাঝে দাঁড়াবে। অবশ্য ঘন অন্ধকার অথবা মুক্তাদীরা অন্ধ হলে বিবস্ত্র ইমাম সামনে দাঁড়াবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৮৯)
ইমামের কর্তব্য
১। ইমামতির নিয়ত :
সাধারণভাবে ইমামতির নিয়ত (সংকল্প) জরুরী। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৭০) অবশ্য একাকী নামায পড়া অবস্থায় কেউ জামাআতের নিয়তে তার সাথে শামিল হলে জামাআত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে নামায পড়তে পড়তে ইমামতির সংকল্প করে নেওয়া যথেষ্ট হবে। নামায শুরু করার আগে থেকে ইমামতির নিয়ত জরুরী নয়। (ঐ ১৭/৫৯) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, এক রাত্রে আমি আমার খালা মায়মূনার ঘরে শুয়ে ছিলাম। নবী (সাঃ) রাত্রে উঠে যখন নামায পড়তে লাগলেন, তখন আমিও তাঁর সাথে শামিল হয়ে গেলাম। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়া দেখে বললেন, “কে আছে যে এর জন্য সাদকাহ্ করবে? (এর সওয়াব বর্ধন করবে?)” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)
২। কাতার সোজা করতে বলা :
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) নামাযে ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে তাদেরকে বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন। (বুখারী ৭১৯নং) যেমন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও।” “কাতার সোজা কর।” “কাতার পূর্ণ কর।” “ঘন হয়ে দাঁড়াও।” “সামনে এস।” “ঘাড় ও কাঁধসমূহকে সমপর্যায়ে সোজা কর।” “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” “কাতারের ফাঁক বন্ধ কর।” “বাজারের মত হৈ-চৈ করা থেকে দূরে থাক।” ইত্যাদি।
কাতারে কেউ আগে-পিছে সরে থাকলে তাকে বরাবর হতে বলা এমন কি নিজে কাছে গিয়ে কাতার সোজা করা ইমামের কর্তব্য। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না কাতার পূর্ণরুপে সোজা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত নামায শুরু করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৬) বরং কাতার সোজা ও ঠিক হওয়ার আগে ইমামের নামায শুরু করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:)
নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নামাযে দাঁড়ালে আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদের কাতার সোজা করতেন। অতঃপর আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে তবেই তকবীর দিতেন।’ (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৫নং)
৩। মুক্তাদীদের খেয়াল করে নামায হাল্কা করে পড়া :
জামাআতে বিভিন্ন ধরনের লোক নামায পড়ে থাকে। ইমামের উচিৎ, নিজের ইচ্ছামত নামায না পড়া; বরং তাদের খেয়াল রেখে ক্বিরাআত ইত্যাদি লম্বা করা। অবশ্য কারো ইচ্ছা অনুসারে নামায এমন হাল্কা করা উচিৎ নয়, যাতে নামাযের বিনয়, ধীরতা-স্থিরতা, পরিপূর্ণরুপে রুক্ন-ওয়াজেব-সুন্নত আদি আদায় ব্যাহত হয়। বলা বাহুল্য, যাতে উভয় দিক বজায় থাকে তার খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে।
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ) অপেক্ষা কোন ইমামের পিছনে অধিক সংক্ষেপ অথচ অধিক পরিপূর্ণ নামায পড়ি নি। এমন কি তিনি যখন কোন শিশুর কান্না শুনতেন তখন তার মায়ের উদ্বিগ´ হওয়ার আশংকায় নামায সংক্ষেপ করতেন।’ (বুখারী ৭০৮নং, মুসলিম, সহীহ)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমি অনেক সময় নামায শুরু করে তা লম্বা করতে ইচ্ছা করি। কিন্তু যখন আমি কোন শিশুর কান্না শুনি, তখন আমার নামাযকে সংক্ষেপ করি। কারণ, তার কান্নায় তার মায়ের মনের উদ্বেগ যে বেড়ে যাবে তা আমি জানি।” (বুখারী ৭০৯নং)
তিনি বলেন, “যখন তোমাদের কেউ লোকেদের নামায পড়ায়, তখন সে যেন হাল্কা করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে রোগী, দুর্বল ও বৃদ্ধ লোক থাকে। অবশ্য যখন তোমাদের কেউ একা নামায পড়ে, তখন সে যত ইচ্ছা লম্বা করতে পারে।” (বুখারী ৭০৩নং, মুসলিম, সহীহ)
এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি ফজরের নামাযে অমুকের কারণে হাজির হ্ই না; সে আমাদের নামায খুব লম্বা করে পড়ায়।’ আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘এর পর সেদিন আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে ওয়াযে যেরুপ রাগান্বিত হতে দেখেছি সেরুপ আর অন্য কোন দিন দেখি নি। তিনি বললেন, “তোমাদের কেউ কেউ লোকদেরকে (জামাআতের প্রতি) বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তোমাদের যে কেউ কোন নামাযের ইমামতি করে সে যেন নামায সংক্ষেপ করে পড়ে। কেননা, তাদের মধ্যে দুর্বল, বৃদ্ধ ও (বিভিন্ন) প্রয়োজন-ওয়ালা লোক আছে।” (বুখারী ৭০২নং, মুসলিম, সহীহ)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “জামাআতের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির খেয়াল করে নামায পড়াও। আর এমন মুআযযিন রেখো না, যে আযানের পারিশ্রমিক চায়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, জামে ৩৭৭৩নং)
তিনি মুআয (রাঃ) কে এশার ইমামতিতে লম্বা ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করে বলেছিলেন, “তুমি কি লোকদেরকে ফিতনায় ফেলতে চাও হে মুআয? তুমি যখন ইমামতি করবে তখন ‘অশশামসি অয্বহা-হা, সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা, ইক্বরা বিসমি রাব্বিকা, অল্লাইলি ইযা য়্যাগশা’ পাঠ কর। কারণ তোমার পশ্চাতে বৃদ্ধ, দুর্বল ও প্রয়োজনে উদ গ্রী ব মানুষ নামায পড়ে থাকে। (বুখারী ৭০৫, মুসলিম, না, মিশকাত ৮৩৩ নং)
আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিনত্বারখান বলেন, একদা আমরা শায়খ ইমাদের পশ্চাতে নামায পড়ছিলাম। আমার পাশে এক ব্যক্তি নামায পড়ছিল, -আমার মনে হয়- তার কোন ব্যস্ততা ছিল। যখন নামায থেকে ফারেগ হ্লাম, তখন সে কসম করে বলল, আর কখনো তাঁর পিছনে নামায পড়বে না। আর সেই সঙ্গে মুআযের ঐ হাদীস উল্লেখ করল। আমি তাকে বললাম, তুমি কেবল এই হাদীসটিই জান? অতঃপর আমি তার কাছে নবী (সাঃ)-এর নামায লম্বা করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলি উল্লেখ করলাম। এরপর আমি শায়খ ইমাদের পাশে বসলাম এবং ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং এই কামনা করি যে, আপনার বিরুদ্ধে যেন কোন প্রকার সমালোচনা না হয়। সুতরাং যদি আপনি নামাযকে একটু হাল্কা করে পড়তেন। তিনি আমার এ কথা শুনে বললেন, ‘সম্ভবত: অতি নিকটে ওরা আমার ও আমার নামায থেকে নিস্ক্রিতি পাবে। ইয়া সুবহানাল্লাহ্! ওদের কেউ কেউ (দুনিয়ার) রাজা-বাদশার সামনে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলে কোন প্রকারের বিরক্তি প্রকাশ করে না; অথচ ওরা ওদের (দ্বীন-দুনিয়ার বাদশা) প্রভুর সামনে সামান্য সময় দাঁড়াতে বিরক্তিবোধ করে?! (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৮৮পৃ:)
৪। দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত দীর্ঘ করা :
প্রথম রাকআতকে একটু লম্বা করে পড়া উত্তম। যাতে পিছে থেকে যাওয়া মুসল্লীরা প্রথম রাকআতেই এসে শামিল হতে পারে।
আবূ কাতাদাহ্ কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) যোহরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতের তুলনায় প্রথম রাকআত লম্বা করে পড়তেন। অনুরুপ আসর ও ফজরের নামাযেও। (বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৮০০ নং) আবূ দাঊদের বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, আমরা মনে করতাম, তিনি তা এই জন্য করছেন; যাতে লোকেরা প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারে।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নামাযের ইকামত হয়ে যেত, আর আমাদের কেউ কেউ বাকী গিয়ে নিজের প্রয়োজন (প্রস্রাব-পায়খানা) সেরে ওযূ করে প্রথম রাকআতে শামিল হতে পারত। কারণ, নবী (সাঃ) ঐ রাকআতকে লম্বা করে পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
তদনুরুপ ইমাম রুকূতে থাকা কালে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার জন্য রুকূ একটু লম্বা করা বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫২) পক্ষান্তরে বেশী লম্বা করে জামাআতের মুসল্লীদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। অভিজ্ঞ ইমাম তাঁর মুক্তাদীদের অভ্যাস ও আচরণের মাধ্যমে তাদের বিরক্তি ও সন্তুষ্টির কথা অবশ্যই বুঝতে পারবেন।
৫। দুআয় নিজেকে খাস না করা :
দুআর সময় এক বচন শব্দ ব্যবহার করে নিজের জন্য দুআকে খাস করা ইমামের জন্য বৈধ নয় বলে যেহাদীস মহানবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (দ্র: তামামুহ্ মিন্নাহ্ ২৭৮-২৮০পৃ:) আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (সাঃ) নিজে ইমাম হয়েও অনেক সময় একবচন শব্দ ব্যবহার করে নামায পড়েছেন। উদাহ্রণস্বরুপ ‘বা-ইদ বাইনী’রহাদীস।
তবুও সাধারণ দুআর সময় এক বচনের স্থলে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করা দোষাবহ্ নয়। ইমাম বগবী (রহঃ) বলেন, ইমাম হলে (দুআয়) এক বচনের স্থলে বহু বচন শব্দ ব্যবহার করবে। ‘আল্লাহুম্মাহ্দিনা---- অআ-ফিনা --- বলবে এবং দুআকে নিজের জন্য খাস করবে না। (শারহুস সুন্নাহ্ ৩/১২৯) অনুরুপ বলেন ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ্। (স্বালাতুত তারাবীহ্ ৪১পৃ:, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১৭০-১৭১পৃ:)
৬। সালাম ফিরে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসা :
নামাযে সালাম ফিরার পর ডান অথবা বাম দিকে ঘুরে মুক্তাদীদের প্রতি মুখ করে বসা ইমামের জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ১০৪১, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৯৪৪নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বহুবার বাম দিক হতে ঘুরতে দেখেছি। (বুখারী ৮৫২নংও মুসলিম ৭০৭নং, মিশকাত ৯৪৬নং)
আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে অধিকাংশ ডান দিক হতে ঘুরে বসতে দেখেছি। (মুসলিম৭০৮নং)
৭। যিক্র-আযকারের পর জায়গা বদলে সুন্নত আদি পড়া :
মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম যে জায়গায় (ফরয) নামায পড়ে সে জায়গাতেই সে যেন (সুন্নত) নামায না পড়ে। বরং সে যেন অন্য জায়গায় সরে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬১৬নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
শুধু ইমামই নয়; বরং মুক্তাদীর জন্যও জায়গা বদলে সুন্নত পড়া মুস্তাহাব। নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউকি (সুন্নত পড়ার জন্য) তার সামনে, পিছনে, ডাইনে বা বামে সরে যেতে অক্ষম হবে?” (আবূদাঊদ, সুনান ১০০৬, ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ২৬৬২নং)
সায়েব বিন য়্যাযীদ বলেন, একদা আমি মুআবিয়া (রাঃ)-এর সাথে (মসজিদের) আমীর-কক্ষে জুমআর নামায পড়লাম। তিনি সালাম ফিরলে আমি উঠে সেই জায়গাতেই সুন্নত পড়ে নিলাম। অতঃপর তিনি (বাসায়) প্রবেশ করলে একজনের মারফৎ আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা আর দ্বিতীয়বার করো না। জুমআর নামায সমাপ্ত করলে কথা বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তার সাথে আর অন্য কোন নামায মিলিয়ে পড়ো না। কারণ, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, (মাঝে) কথা না বলে বা বের হয়ে না গিয়ে কোন নামাযকে যেন অন্য নামাযের সাথে মিলিয়ে না পড়ি।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৮৩, আবূদাঊদ, সুনান ১১২৯নং, আহমাদ, মুসনাদ৪/৯৫, ৯৯)
উদ্দেশ্য হল, নামাযের জায়গা বেশী করলে, কিয়ামতে ঐ সকল জায়গা আল্লাহর আনুগত্যের সাক্ষ্য দেবে। (মিশকাত ৯৫৩হাদীসের টীকা দ্র:)
অবশ্য এ সময় খেয়াল রাখা উচিৎ, যাতে উক্ত মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে কোন নামাযীর সিজদার জায়গার ভিতর বেয়ে পার হয়ে গুনাহ না হয়ে বসে।
মুক্তাদীর কর্তব্য
১। ইমামের অপেক্ষা করা :
ইমাম থাকতে তাঁর জায়গায় তাঁর বিনা অনুমতিতে অন্যের ইমামতি করা অবৈধ, আর তা বড় বেপরোয়া লোকের কাজ। এ সব লোকেদের ইমামের একটু দেরী সয় না। সামান্য দেরী হলেই আর তাঁর অপেক্ষা না করে জামাআত খাড়া করে দেয়। এ ধরনের ধৈর্যহারা মানুষরা কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমান।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত (নামাযের জন্য উঠে) দাঁড়াও না।” (বুখারী ৬৩৭, মুসলিম, সহীহ ৬০৪নং)
তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৬৭৩নং)
অবশ্য অস্বাভাবিক বেশী দেরী হলে মুক্তাদীদের অধিকার আছে জামাআত করার। কিন্তু ইমাম উপস্থিত হওয়ার যথাসময় পার হওয়ার পর মুক্তাদীদের কোন এক উপযুক্ত ব্যক্তি ইমামতি শুরু করলে ইতিমধ্যে যদি নিযুক্ত ইমাম এসে পড়েন, তাহলে ইমাম অগ্রসর হয়ে নিজ ইমামতি করতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে ঐ মুক্তাদী ইমাম পিছে হ্টে যাবেন। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৩) যেমন দু-দুবার হযরত আবূ বাক্র (রাঃ) নামায পড়াতে শুরু করলে ইতিমধ্যে মহানবী (সাঃ) এসে উপস্থিত হন এবং আবূ বাক্র পিছে হ্টে যান ও তিনি ইমামতি করেন। (বুখারী ৬৮৪, ৭১২, মুসলিম, সহীহ)
অবশ্য ইমাম চাইলে মুক্তাদী হয়েও নামায সম্পন্ন করতে পারেন। যেমন একদা এক সফরে মহানবী (সাঃ) নিজ প্রয়োজনে দূরে গেলে আসতে দেরী হল। হযরত আব্দুর রহ্মান বিন আওফ (রাঃ) ইমামতি করতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলে আব্দুর রহ্মান পিছে হ্টতে চাইলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে ইঙ্গিতে বললেন যে, তুমি ইমামতি করতে থাক। অতঃপর তিনি সেদিন মুক্তাদী হয়ে নামায পড়লেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৪, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৩৬নং)
২। ইক্তিদার নিয়ত :
ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময় মনে মনে ইক্তিদার নিয়ত (সংকল্প) করা জরুরী। যেহেতু মুক্তাদী অবস্থায় ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব, ইমামের পিছনে মুক্তাদী ভুল করলে সহু সিজদা করতে হয় না এবং অনেক সময় ইমামের নামায বাতিল হলে মুক্তাদীরও বাতিল; তাই এই নিয়ত জরুরী। সুতরাং নিয়ত না হলে মুক্তাদীর নামায জামাআতী নামায হবে না। (আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ২০৬পৃ:)
জ্ঞাতব্য যে, ‘ইক্তাদাইতু বিহাযাল ইমাম’ বলে মুখে উচ্চারিতব্য নিয়ত বিদআত।
৩। যথাসময়ে জামাআতে দাঁড়ানো :
ইকামত হয়ে গেলে এবং ইমাম দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে থাকা অথবা তেলাওয়াত বা মুনাজাতে মশগুল থাকা অথবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকা উচিৎ নয়। বরং সত্বর উঠে ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্রীমা দিয়ে নামায শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ।
যেমন তাকবীরে-তাহ্রীমা ইমামের সাথে না পাওয়া এক বড় বঞ্চনার কারণ। অতএব ইমাম তকবীর দিয়ে ফেললে কোন কথাবার্তায় অথবা মনগড়া নিয়ত আওড়ানোতে অথবা মিসওয়াকের সুন্নত পালনে ব্যস্ত হয়ে তকবীর দিতে দেরী করা মোটেই উচিৎ নয়। ইমামের সাথে তাকবীরে-তাহ্রীমার একটি পৃথক মর্যাদা রয়েছে শরীয়তে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন জামাআতে নামায আদায় করবে এবং তাতে তাহ্রীমার তকবীরও পাবে, সেই ব্যক্তির জন্য দুটি মুক্তি লিখা হয়; দোযখ থেকে মুক্তি এবং মুনাফেকী থেকে মুক্তি।” (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪০৪নং)
মুজাহিদ বলেন, এক বদরী সাহাবী একদা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘তুমি আমাদের সাথে জামাআত পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, ‘প্রথম তাকবীর পেয়েছ?’ ছেলে বলল, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘যা তোমার ছুটে গেছে তা এক শত কালো চক্ষুবিশিষ্ট (উৎকৃষ্ট) উটনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর!’ (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২০২১নং)
অনুরুপভাবে জামাআত শুরু হয়ে গেলে সুন্নত নামাযে মশগুল থাকাও বৈধ নয়। বৈধ নয় কোন সুন্নত শুরু করা। ফজরের সুন্নত হলেও জামাআতের ইকামত শোনার পর তা আর পড়া চলে না। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন নামায খাড়া হয়, তখন ফরয (বা সেই) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায নেই।” (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৪, মুসলিম, সহীহ ৭১০ নং, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৫২, প্রমুখ) অর্থাৎ, জামাআত খাড়া হলে ফরয বা (ঐ নামায তাকে পড়তে হলে) ঐ নামাযে শামিল হওয়া ছাড়া পৃথক করে কোন নফল বা সুন্নত নামায পড়া বৈধ নয়। অর্থাৎ ইকামতের পর আর কোন সুন্নত বা নফল নামায শুদ্ধ হবে না।। (শরহুন নওবী ৫/২২১, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৭৫, আউনুল মা’বূদ ৪/১০১)
এক ব্যক্তি মসজিদে এল। তখন আল্লাহর রসূল (সাঃ) ফজরের নামাযে ছিলেন। সে ২ রাকআত নামায পড়ে জামাআতে শামিল হল। নামায শেষে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাকে বললেন, “হে অমুক! তোমার নামায কোন্টা? যেটা আমাদের সাথে পড়লে সেটা, নাকি যেটা তুমি একা পড়লে সেটা? (নাসাঈ, সুনান ৮৬৮নং)
একদা এক ব্যক্তি মুআযযিনের ইকামত বলার সময় নামায পড়ছিল। তা দেখে তিনি বললেন, “একই সাথে কি দুটি নামায!” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭১, ২৫৮৮নং)
একদা ফজরের নামাযের ইকামত হওয়ার সময় মহানবী (সাঃ) দেখলেন, এক ব্যক্তি নামায পড়ছে। তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ফজরের নামায ৪ রাকআত পড়বে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১১, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১৭২)
একদা তিনি ফজরের নামায পড়ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে এক প্রান্তে ২ রাকআত নামায পড়ে তাঁর সাথে জামাআতে শামিল হল। সালাম ফিরার পর তিনি তাকে বললেন, “ওহে অমুক! তুমি কোন্ নামাযকে (ফরয বলে) গণ্য করলে? তোমার একাকী পড়া নামাযকে, নাকি আমাদের সাথে পড়া নামাযকে?” (মুসলিম, সহীহ ৭১২নং)
অবশ্য কারো সুন্নত পড়া কালে যদি ইকামত হয়ে যায়, তাহলে সে দ্বিতীয় রাকআতে থাকলে বাকীটা হাল্কা করে পড়ে পূর্ণ করে নেবে। পক্ষান্তরে প্রথম রাকআতে থাকলে নামায ছেড়ে জামাআতে শামিল হয়ে যাবে। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২৪/১৪, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৫)
প্রকাশ যে, নামায ছাড়ার সময় সালাম ফিরা বিধেয় নয়। বরং নিয়ত বাতিল করলেই নামায থেকে বের হওয়া যায়। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২২পৃ:)
৪। যথা নিয়মে কাতার বাঁধা :
মহান আল্লাহর তা’যীম প্রকাশের উদ্দেশ্যে কাতার বাঁধার যে নিয়ম আছে সেই অনুযায়ী কাতার বাঁধা মুক্তাদীর কর্তব্য। আর তা যথাক্রমে নিম্নরুপ :-
কাতার সোজা করা :
কাতার সোজা করা ওয়াজেব। কাতার সোজা হবে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক অপরের কাঁধ ও পায়ের গাঁট বরাবর সোজা রেখে; যাতে একজনের কাঁধ আগে এবং অপর জনের পিছে না হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুলে আঙ্গুল মিলিয়ে কাতার সোজা হবে না। কারণ, পা ছোট-বড় থাকার ফলে কাতার বাঁকা থেকে যাবে। আর বসা অবস্থায় বাহুমূল বা কাঁধের সাথে বাহুমূল বা কাঁধ বরাবর থাকলে কাতার সোজা বলে ধরা যাবে।
যেমন মসজিদে কাতারের দাগ থাকলে দাগের মাথায় বুড়ো আঙ্গুল রেখে কাতার সোজা হয় না। কারণ, এতে যার পা লম্বা সে কাতার থেকে পিছনের দিকে এবং যার পা ছোট সে কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে থাকবে। সুতরাং পায়ের গোড়ালিকে দাগের মাথায় রাখলে তবেই কাতার বাঞ্ছনীয় সোজা হবে।
কাতার সোজা করার ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর। কারণ, কাতার সোজা করা নামায প্রতিষ্ঠা বা পরিপূর্ণ করার অন্তর্গত কর্ম।” (বুখারী ৭২৩, মুসলিম, সহীহ ৪৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৮নং)
আবূ মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নামাযের (কাতার বাঁধার) সময় নবী (সাঃ) আমাদের বাহুমূল স্পর্শ করতেন ও বলতেন, “সোজা হয়ে দাঁড়াও এবং বিভিন্নরুপে দাঁড়াও না; তাতে তোমাদের অন্তরসমূহ বিভিন্নমুখী হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮নং)
কাতার মিলিয়ে ঘন হয়ে জমে দাঁড়ানো এবং মাঝের ফাঁক বন্ধ করা :
কাতারে দাঁড়ানোর সময় ঘন হয়ে দাঁড়ানো জরুরী; যাতে মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। পার্শ্ববর্তী নামাযীর পায়ের পাতার সাথে পায়ের পাতা (পায়ের বাইরের দিকটা সোজা কেবলামুখী করে কনিষ্ঠা আঙ্গুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অংশ) ও বাহুর সাথে বাহু লাগিয়ে জমে দাঁড়াতে হবে নামাযীকে। আল্লাহর এ দরবারে আমীর-গরীব, ছোট-বড় ও প্রভু-দাসের কোন ভেদাভেদ নেই, কোন বেআদবী নেই। সাহাবাগণ কাতারে পরস্পর এইভাবেই দাঁড়াতেন। তাহলে কি তাঁরা বেআদব ছিলেন? আল্লাহর কসম! না। ঐ দেখেন না, একজন ছাত্র যদি তার শিক্ষকের গায়ে গা লাগিয়ে বসে, তাহলে শিক্ষক ও সমস্ত লোক তাকে বেআদব বলবেই। কিন্তু সেই ছাত্রই যদি বাস বা ট্রেনের সীটে ঐরুপ বসে, তাহলে তখন আর কেউ তাকে বেআদব বলে না। বলা বাহুল্য নামাযের সারিতে পাশাপাশি এই প্রেমের সূত্রে বড়-ছোটর কোন প্রভেদ নেই।
আসলে মনের সাথে মনের মিল থাকলে পায়ের সাথে পা মিলে যাওয়া দূরের কথা নয়। আর মনের মাঝে দূরত্ব থাকলে, মনের মাঝে ঔদ্ধত্ব, অহংকার ও ঘৃণা-বিদ্বেষ থাকলে অথবা ভুল বুঝাবুঝির ফলে অভিমান ও ক্ষেfভ থাকলে অবশ্যই দেহের দূরত্ব বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে আরো মনের দূরত্ব। দূর হবে সম্প্রীতির বাঁধন। শয়তান সেই ভুল বুঝাবুঝির সুযোগে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা আনতে বড় কৃতকার্য হবে।
পরন্তু যদি আপনি মনে করেন যে, পাশের মুসল্লী থেকে আপনি বড় এবং সে আপনার পায়ে পা লাগালে আপনার সম্মানে বাধবে, তাহলে আপনি আপনার পা তার পায়ে লাগিয়ে দিন। আর এ ক্ষেত্রে আশা করি আপনার মনের ঐ আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন হবে না।
পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়ানোর আমল মহানবী (সাঃ)-এর যামানায় প্রচলিত ছিল। তিনি সাহাবাদের সে আমল দেখেও বেআদবী মনে করে বাধা দেননি। তিনি নামাযের মধ্যে যেমন সামনে দেখতেন তেমনি পিছনে। ঘন হয়ে দাঁড়ানোর ব্যাখ্যাতে সাহাবাগণের এই আমল অবশ্যই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাতে তিনি-সম্মতি প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, এ কাজ যে সুন্নত তাতে কোন সন্দেহ্ থাকতে পারে না।
কিন্তু বড় দু:খের বিষয় যে, তাবেঈনদের যামানা থেকেই এ আমল অনেকের কাছে বর্জনীয় হয়ে চলে আসছে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আজকে যদি কারোর সাথে ঐ কাজ করি, তাহলে সে সেরকশ (দুরন্ত) খচ্চরের মত চকে যাবে।’ (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৪৭) সুতরাং আল্লাহ তার প্রতি রহ্ম করেন যে এই মৃত সুন্নতকে জীবিত করে। (মারা: ২২৫পৃ:)
মহানবী (সাঃ) নামাযের কাতার তীরের মত সোজা করতেন। অতঃপর সাহাবাগণ যখন সে কাজ সমAক বুঝে উঠতে পেরেছেন এ কথা বুঝতে পারতেন, তখন তিনি তাকবীরে তাহ্রীমা দিতেন। একদিন তাকবীরে দিতে উদ্যত হতে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটা লোকের বুক কাতারের সামনের দিকে বের হয়ে আছে। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর বান্দাগণ! হয় তোমরা ঠিকমত কাতার সোজা কর, নচেৎ আল্লাহ তোমাদের চেহারাসমূহের মাঝে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে দেবেন।” (বুখারী ৭১৭, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৩, মিশকাত ১০৮৫নং)
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নামাযের ইকামত হল। নবী (সাঃ) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর এবং ঘন হয়ে দাঁড়াও। নিশ্চয় আমি আমার পিছন দিক হতেও দেখে থাকি।” আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর আমাদের প্রত্যেকে নিজ বাহুমূল তার পার্শ্ববর্তী সঙ্গীর বাহুমূলের সাথে এবং নিজ পা তার পায়ের সাথে (হাঁটু তার হাঁটুর সাথে, পায়ের গাঁট তার পায়ের গাঁটের সাথে) লাগিয়ে দিত। (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪৩৬, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬২নং)
হযরত জাবের বিন সামুরাহ্ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদের কাছে এলেন। সে সময় আমরা গোলাকার দলে দলে বিভক্ত ছিলাম। তিনি বললেন, “তোমাদেরকে আমি বিক্ষিপ্তরুপে দেখছি কেন?” অতঃপর একদিন তিনি আমাদের কাছে এসে (আমাদেরকে অনুরুপ বিক্ষিপ্ত দেখে) বললেন, “তোমরা প্রতিপালকের সামনে ফিরিশ্তাবর্গের কাতার বাঁধার মত কাতার বেঁধে দাঁড়াবে না কি?” আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! ফিরিশ্তাবর্গ তাঁদের প্রতিপালকের সামনে কিরুপে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।’ তিনি বললেন, “প্রথমকার কাতারসমূহ পূর্ণ করেন এবং ঘন হয়ে জমে কাতার বেঁধে দাঁড়ান।” (মুসলিম, সহীহ ৪৩০, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬১, মিশকাত ১০৯১নং)
প্রকাশ থাকে যে, ঘন করে দাঁড়ানোর অর্থ এই নয় যে, পরস্পর ঠেলাঠেলি ও চাপাচাপি করে দাঁড়াতে হবে। বরং এইরুপ দাঁড়ানোতে নামাযের একাগ্রতা ও বিনয় নষ্ট হতে পারে। অতএব যাতে পায়ে পা এবং বাহুতে বাহু স্বাভাবিকভাবে লেগে থাকে তারই চেষ্টা করতে হবে। আর তার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই পা ফাঁক করে দাঁড়াতে হবে।
সামনের কাতার খালি থাকলে (রাকআত বা রুকূ ছুটে যাওয়ার ভয়ে) পিছনে দাঁড়ানো বৈধ নয়। যেমন সামনের কাতারে ফাঁক দেখা দিলে তা বন্ধ করা জরুরী। সামনে কাতারে যেতে দূর হলে এবং নামাযের মধ্যে হলেও অগ্রসর হয়ে যেতে হবে কাতার মিলানোর উদ্দেশ্যে। এর জন্য রয়েছে আদেশ, পুরস্কার এবং তিরস্কারও।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “প্রথম কাতারকে আগে পূর্ণ কর, তারপর তার পরের কাতারকে। অপূর্ণ থাকলে যেন শেষের কাতার থাকে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭১নং)
তিনি বলেন, “তোমরা কাতার সোজা কর, বাহুমূলসমূহকে পাশাপাশি সমপর্যায় করে দাঁড়াও, কাতারের ফাঁক বন্ধ কর, পার্শ্ববর্তী নামাযী ভাইদের জন্য নিজ নিজহাতসমূহকে নরম কর এবং শয়তানের জন্য (কাতারে) ফাঁক রেখো না। আর যে ব্যক্তি কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায় সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ মিলন (সম্পর্ক) রাখেন এবং যে ব্যক্তি কাতার ছিন্ন করে সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ (সম্পর্ক অথবা কল্যাণ) ছিন্ন করেন।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৬নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের প্রতি রহ্ম করেন এবং ফিরিশ্তাবর্গ তাদের জন্য দুআ করে থাকেন, যারা কাতার মিলিয়ে দাঁড়ায়। আর যে ব্যক্তি কাতারের ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ১৮৪৩নং)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি (কাতারের মাঝে) কোন ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তার জন্য জান্নাতে এক গৃহ্ নিমাGণ করেন।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম আওসাত্ব, সহিহ তারগিব ৫০২নং)
তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ রহ্মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তাবর্গ দুআ করতে থাকেন তাদের জন্য যারা প্রথম কাতার মিলিয়ে (ব্যবধান না রেখে) দাঁড়ায়। আর যে পদক্ষেপ দ্বারা বান্দা কোন কাতারের ফাঁক বন্ধ করতে যায় তা অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অন্য কোন পদক্ষেপ অধিক পছন্দনীয় নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, অবশ্য এতে পদক্ষেপের উল্লেখ নেই, সহিহ তারগিব ৫০৪নং)
পাশের নামাযীর জন্য নিজের বাহুকে নরম করে দাঁড়ানো :
পাশের নামাযী যাতে মনে কষ্ট না পায় তার জন্য প্রত্যেক নামাযীর কর্তব্য নিজ নিজ বাহুকে নরম করে রাখা। এতে উভয়ের মনে বিদ্বেষ দূর হয়ে প্রীতির সঞ্চার হবে। দূর হবে ঘৃণা ও কাতারের ফাঁক।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক তারাই, যারা নামাযের মধ্যে নিজেদের বাহুসমূহকে (পাশের নামাযীর জন্য) নরম রাখে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭২নং)
বলা বাহুল্য, পায়ে পা লাগাবার সময়, বাম পা-কে ডান পায়ের নিচে বের করে বসার সময়ও পাশের নামাযীর সাথে কঠেfরতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ নয়। বরং কাতারে চাপাচাপি বা ঠসাঠসি থাকলে পা বের করে অপরকে কষ্ট দেওয়ার চাইতে পা না বের করে উক্ত সুন্নত পালন না করাই উত্তম। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ২২/৩০)
কাতারসমূহের মাঝে বেশী দূরত্ব না রাখা :
ইমাম ও প্রথম কাতার এবং অনুরুপ দ্বিতীয় ও তার পরের কাতারসমূহের মাঝে প্রয়োজনের অধিক দূরত্ব রাখা উচিৎ নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা তোমাদের কাতারসমূহকে ঘন কর, কাতারগুলোর মাঝে ব্যবধান কাছাকাছি কর এবং তোমাদের ঘাড়সমূহকে সমপর্যায়ে সোজা রাখ। সেই আল্লাহর কসম! যাঁর হাতে আমার জান আছে, নিশ্চয় আমি শয়তানকে কাল ভেঁড়ার বাচ্চার মত তোমাদের কাতারের ফাঁকে ফাঁকে প্রবেশ করতে দেখছি।” (বুখারী ৭১৮, মুসলিম, সহীহ ৪২৩, ৪৩৩, ৪৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৬৬৭নং)
সামনে কাতার করার মত জায়গা ফাঁক থাকলে পিছনে কাতার বেঁধে নামায হবে না। যেমন পিছনে কাতার বাঁধলে এবং সামনে ফাঁকা জায়গায় রাস্তায় লোক চলাচল করলেও নামায হবে না। মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলে তারপর রাস্তা পূর্ণ হবে এবং তার পরে দোকান ইত্যাদিতে কাতার বাঁধা চলবে। রাস্তা খালি থাকতে দোকানে কাতার বাঁধা বৈধ হবে না। (মাজমূউফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ্ ২৩/৪১০, দ্র: তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮২পৃ:)
থামসমূহের ফাঁকে কাতার না বাঁধা :
হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যামানায় এই (থামের ফাঁকে কাতার বাঁধা) থেকে দূরে থাকতাম।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৬৭৩নং, তিরমিযী, সুনান)
হযরত কুর্রাহ্ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর যুগে আমাদেরকে থামের ফাঁকে কাতার বাঁধতে নিষেধ করা হত এবং কেউ বাঁধলে তাকে সেখান থেকে দস্তুর মত তাড়িয়ে দেওয়া হত।’ (ইবনে মাজাহ্, সুনান ১০০২, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী)
এর কারণ হল এই যে, মাঝে থাম হওয়ার ফলে কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই জন্য ইমাম বা একাকী নামাযীর জন্য দুই থামের মাঝে দাঁড়িয়ে নামায পড়া নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। যেমন অধিক ভিঁড়ে মসজিদে জায়গা না থাকলে ঐ জায়গাতেও কাতার বাঁধা প্রয়োজনে বৈধ। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২০৮-২০৯পৃ:)
পরিশেষে ইবনুল কাইয়েম (রহঃ)-এর একটি মূল্যবান উক্তির উল্লেখ করে এ বিষয়ের ইতি টানি; তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সামনে বান্দার দুই সময় দাঁড়াতে হবে। নামাযে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হয় এবং তাঁর সাক্ষাতের সময় (কিয়ামতে) তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে (নামাযে) সঠিকভাবে দাঁড়াবে, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো সহ্জ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি প্রথম সময়ে দাঁড়ানোতে অবহেলা প্রদর্শন করবে এবং তার যথার্থ হ্ক আদায় করবে না, তার জন্য দ্বিতীয় সময়ে (কিয়ামতে) দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’
৫। ইমামের অনুসরণ করা :
যথা নিয়মে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজেব এ বং তাঁর অন্যথা আচরণ গুনাহর কাজ।
ইমামের পশ্চাতে সাধারণত: মুক্তাদীর ৪ প্রকার আচরণ হতে পারে :
(ক) অগ্রগমন : অর্থাৎ ইমামের আগে-আগে রুকূ-সিজদা করা অথবা মাথা তোলা। এমন আচরণ গুনাহর কাজ। বরং জেনেশুনে স্বেচ্ছায় করলে নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (মিন আহ্কামিস স্বালাহ্, ইবনে উসাইমীন ৪৬পৃ:) যেমন ইমামের আগে তাকবীরে তাহ্রীমা দিলে নামাযের বন্ধনই শুদ্ধ হবে না। ভুলে দিয়ে ফেললে পুনরায় ইমামের তকবীর দেওয়ার পর তকবীর দিতে হবে। (সালাতুল জামাআতি হুকমুহা অআহকামুহা, ডক্টর সালেহ সাদলান ১৬৩পৃ:)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইমাম এই জন্য বানানো হয়েছে যে, তার অনুসরণ করা হবে। সুতরাং তার বিরুদ্ধাচরণ করো না।” (মুসলিম, সহীহ ৪১৪নং) “তোমরা ইমামের পূর্বে (কিছু করতে) তাড়াতাড়ি করো না। যখন সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তখন তোমরাও ‘আল্লাহু আকবার’ বল। --- যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকালহাম্দ’ বল।” (ঐ ৪১৫নং) “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬০৩নং)
তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কি এ কথার কে উভয় করে না যে, ইমামের আগে মাথা তুললে তার চেহারা অথবা আকৃতি গাধার মত হয়ে যাবে।” (বুখারী ৬৯১, মুসলিম, সহীহ ৪২৭, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
একদা তিনি মুক্তাদীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ১১৩৭নং)
(খ) পশ্চাদগমন : অর্থাৎ ইমামের অনেক পিছনে দেরী করে রুকূ-সিজদা করা। ইমাম রু কূ বা সিজদা থেকে উঠে গেলেও মুক্তাদীর দেরী করে রুকূ বা সিজদাতে পড়ে থাকা। এমন করাও বৈধ নয়। কারণ, রসূল (সাঃ) বলেন, “যখন সে রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ কর। যখন সে সিজদা করে, তখন তোমরা সিজদা কর।”
(গ) সহ্গমন : অর্থাৎ চটপট ইমামের সাথে সাথেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। এরুপ করাটাও অবৈধ।
(ঘ) অনুগমন : অর্থাৎ, ইমাম রুকূ-সিজদা করলে তবেই রুকূ-সিজদা ইত্যাদি করা। আর এরুপ করাটাই ওয়াজেব।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত রুকূ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে রুকূ না করে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সিজদা না করে।”
সাহাবী বারা’ বিন আযেব (উক্ত আমলের ব্যাখ্যায়) বলেন, ‘আমরা নবী (সাঃ)-এর পিছনে নামায পড়তাম। যখন তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্’ বলতেন, তখন আমাদের মধ্যে কেউই ততক্ষণ পর্যন্ত সিজদা করার জন্য নিজের পিঠ ঝুকাত না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি মাটিতে নিজের কপাল রেখে নিতেন।’ (বুখারী ৬৯০নং, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্)
ইমামের তকবীর বলার পর তকবীর বলতে হবে। ইমামের ‘আমীন’-এর ‘আ-’ বলতে শুরু করার পরেই ‘আমীন’ বলতে হবে।
কোন ওজরের ফলে ইমামের আগে হয়ে গেলে নামায বাতিল নয়। যেমন কোন ব্যথার কারণে অসহ্য যন্ত্রণায় তাড়াতাড়ি ইমামের আগে সিজদা থেকে উঠে পড়লে তা ধর্তব্য নয়।
তদনুরুপ কোন ওজরের ফলে কেউ ইমামের পিছনে থেকে গেলে তাও ধর্তব্য নয়। যেমন যদি কেউ সিজদায় গিয়ে ঘুমিয়ে গেল, অতঃপর পরের রাকআতে রুকূর সময় জেগে উঠল অথবা কোন বড় জামাআতে বা মসজিদের অন্য তলায় নামায পড়তে পড়তে সূরা ফাতিহা শোনার পর মাইকের শব্দ বন্ধ হওয়ার ফলে ইমামের রুকূ করার কথা ঠিকমত বুঝা না গেলে হ্ঠাৎ করে জানতে পারা গেল যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু---’ বলে রুকূ থেকে উঠছেন -এ ক্ষেত্রে ছুটে যাওয়া রুক্ন নিজে নিজে আদায় করে বাকী নামাযে ইমামের অনুসরণ করবে। আর তার এ নামায হয়ে যাবে।
তবে যে জায়গা থেকে নামায ছুটে গেছে পরের রাকআতে সেই জায়গায় যদি ইমাম চলে গিয়ে থাকেন, তাহলে তার এক রাকআত বাতিল হবে। সেখান থেকেই ইমামের অনুসরণ করে বাকী নামায পড়ে ইমামের (দুই) সালাম ফিরার পর উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত নিজে পড়ে নেবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৪-২৬৫)
ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে মুক্তাদীর সালাম ফিরা বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৯১)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। সুতরাং তোমরা রুকূ, সিজদা, কি য়াম ও বৈঠকে, আর না সালামে আমার অগ্রবর্তী হ্য়ো না।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত১১৩৭নং)
আফযল হল ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরার পরই সালাম ফিরা। অবশ্য যদি কেউ ইমামের ডান দিকে সালাম ফিরার পর ডান দিকে এবং তাঁর বাম দিকে সালাম ফিরার পর বাম দিকে সালাম ফিরে, তাহলে তা দোষের নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭)
অনেকের মতে ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে যদি মুক্তাদী সালাম ফিরে দেয় অথবা বাকী নামায পড়ার জন্য উঠে যায়, তাহলে তার নামায নষ্ট হয়ে নফলে পরিণত হয়ে যায়। (ফাতওয়া শায়খ সা’দী ১৭৪পৃ:, মুত্বাসা ৯৭পৃ:)
জ্ঞাতব্য যে, গুপ্ত বিষয়সমূহ ইমামের আগে-পিছে বা সাথে-সাথে হলে কোন দোষের নয়। যেমন সির্রী নামাযে সূরা ফাতিহা, কোনও নামাযে তাশাহহুদ ইমামের আগে বা সাথে সাথে পড়া হলে তাতে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, সাধারণত: এর শুরু ও শেষ বুঝা যায় না এবং এ ব্যাপারে ইমামের অনুসরণ করতে মুক্তাদী আদিষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৬৭-২৬৮)
বুকেহাত বাঁধেন না এমন ইমামের পশ্চাতে বুকেহাত বেঁধে এবং রফ্য়ে ইয়াদাইন করেন না এমন ইমামের পশ্চাতে রফ্য়ে ইয়াদাইন করে মুক্তাদীর নামায পড়া ইমামের বিরুদ্ধাচরণ নয়। যেমন যে ইমাম তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতবিশিষ্ট নামাযের শেষ বৈঠকে বাম পা-কে ডান পায়ের রলার নিচে বের করে বসেন না, তাঁর পিছনে মুক্তাদী ঐরুপ বসলে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ হয় না।
জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্ করেন না এমন ইমামের পিছনে নামায পড়লে প্রথম বা তৃতীয় রাকআতের সিজদা থেকে সরাসরি উঠে গেলে মুক্তাদীর জন্য বসা বৈধ নয়। কারণ, এটি ইমামের বাহ্যিক কর্ম। অতএব তিনি দাঁড়িয়ে গেলে মুক্তাদীর বসে যাওয়া চলবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১২)
অবশ্য অনেকে বলেন, এটি হাল্কা বৈঠক। এতে ইমামের বিরুদ্ধাচরণ হয় না। অতএব ইমাম জালসায়ে ইস্তিরাহাহ্র সুন্নত পালন না করলেও মুক্তাদীর হাল্কা বসে সাথে সাথে উঠে গিয়ে তা পালন করায় দোষ নেই।
ইমাম ফজরের নামাযে হাত তুলে কুনুত পড়লে মুক্তাদীর জন্য হাত তুলে আমীন বলে তাঁর অনুসরণ করা জরুরী। তবে সেই ইমামের পিছনে নামায পড়া উত্তম, যে ফজরে কুনুত পড়ে না। যেহেতু তা বিদআত। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৯৩)
ইমাম সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের প্রতি ফিরে না বসা পর্যন্ত মুক্তাদীর উঠে মসজিদ ত্যাগ করা উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৩২, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯১)
ইমাম তাশাহ্হুদে দেরী করলে মুক্তাদীর চুপচাপ বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং এ সময়ে সহীহ নববী দুআ দ্বারা মুনাজাত করে আল্লাহর কাছে বহু কিছু চেয়ে নেওয়া উচিৎ। কারণ, এটা হল দুআ কবুল হওয়ার সময়। অনুরুপ প্রথম তাশাহ্হুদে দেরী করলে আধা তাশাহহুদ পড়ে নীরব বসে থাকা উচিৎ নয়। বরং তাশাহহুদের পর দরুদ এবং তার পরেও সময় থাকলে মু নাজাত করা উচিৎ। আর এ ব্যাপারে তাশাহহুদের বর্ণনায় (১ম খন্ডে) আলোচনা করা হয়েছে।
সতর্কতার বিষয় যে, তাশাহহুদের বৈঠকে ইমামকে দেরী করতে দেখে অনেকে গলা ঝাড়তে শুরু করে। এমন করা তাদের ধৈর্যহীনতা ও অজ্ঞতার পরিচয়।
ইমামের পশ্চাতে ক্বিরাআত
ইমাম সশব্দে ক্বিরাআত করলে মুক্তাদীকে ক্বিরাআত করতে হয় না। বিশেষ করে সশব্দে কোন সূরা পাঠ করা মুক্তাদীর জন্য বৈধ নয়। বরং ইমামের ক্বিরাআত চুপ করে শুনতে হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,
(وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا)
অর্থাৎ, যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শো ন এবং চুপ থাক। (কুরআন মাজীদ ৭/২০৪)
সাহাবাগণ নামাযে সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন। একদা কোন জেহরী নামায থেকে সালাম ফিরে আল্লাহর নবী (সাঃ) বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ কি আমার সাথে (সশব্দে) কুরআন পড়েছে?” এক ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “তাতেই আমি ভাবছি যে, আমার ক্বিরাআতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হ্চ্ছে কেন।” আবূ হুরায়রা বলেন, এই কথা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল। (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ৮৫৫নং)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “যার ইমাম আছে, তার ইমামের ক্বিরাআত তার ক্বিরাআত।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ৬৪৮৭নং)
তিনি বলেন, “ইমাম তো এই জন্য বানানো হয় যে, তার অনুসরণ করা হবে। অতএব সে যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তখন তোমরা ‘আল্লাহু আকবার’ বল এবং যখন ক্বিরাআত করে তখন চুপ থাক।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে আবী শাইবা, ইবনে মাজাহ্, সুনান, বায়হাকী, জামে ২৩৫৮-২৩৫৯নং)
এ হল সাধারণ হুকুম। জেহরী নামাযে সশব্দে মুক্তাদী কোন ক্বিরাআত করতে পারবে না। কিন্তু নিঃশব্দে কেবল সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। কারণ, সূরা ফাতিহার রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেই ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“সেই ব্যক্তির নামায যথেষ্ট নয়, যে তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“যে ব্যক্তি এমন কোনও নামায পড়ে, যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ঐ নামায (গর্ভচ্যুত ভ্রুণের ন্যায়) অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩নং)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)
“উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা) এর মত আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ২১৪২ নং)
সাহাবী উবাদাহ্ বিন সামেত বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর পশ্চাতে ফজরের নামায পড়ছিলাম। তিনি ক্বিরাআত পড়তে লাগলে তাঁকে ক্বিরাআত ভারী লাগল। সালাম ফিরার পর তিনি বললেন, “সম্ভবত: তোমরা ইমামের পিছনে ক্বিরাআত কর।” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর রসূল! (আমরা তো তা করি।) তিনি বললেন, “না, ক্বিরাআত করো না। অবশ্য সূরা ফাতিহা পড়ো। কারণ, যে তা পড়ে না তার নামায হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৮২৩নং)
পক্ষান্তরে ইমাম জেহরী নামাযের শেষ এক বা দুই রাকআতে অথবা সির্রী নামাযে নিঃশব্দে ক্বিরাআত করলে অথবা তাঁর ক্বিরাআত শুনতে না পাওয়া গেলেও মুক্তাদী সূরা ফাতিহা অবশ্যই পড়বে এবং সেই সাথে অন্য সূরাও পড়তে পারে।
যে আবূ হুরাইরা বলেন, ‘এই কথা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছ থেকে শোনার পর লোকেরা তাঁর সাথে জেহরী নামাযে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হয়ে গেল।’ সেই (সূরা ফাতিহার গুরুত্ব নিয়ে হাদীস বর্ণনাকারী) আবূ হুরাইরাকে প্রশ্ন করা হল যে, (সূরা ফাতিহার এত গুরুত্ব হলে) ইমামের পশ্চাতে কিভাবে পড়া যাবে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার মনে মনে পড়ে নাও। কারণ, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি ; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রা র্থনা করে।’ (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)
যদি বলেন, আদবের নিয়ম এই যে, জামাআতের মধ্যে একজন কথা বলবে এবং বাকী সবাই চুপ থাকবে। সবাই কথা বললে শ্রোতা বুঝতে পারে না এবং সম্মানিত শ্রোতার শানে বেআদবী হয়।
তাহলে আমরা বলব যে, তাই যদি হয়, তাহলে ইস্তিফতাহ্, তাসবীহ্, তাশাহহুদ ইত্যাদি কেন সবাই বলে থাকে? তাতে কি বেআদবী হয় না? তা কি বুঝতে আল্লাহর অসুবিধা হয় না? তাছাড়া একই সাথে বিশ্বের কত শত মুসলমান একই সময়ে এক সাথে কত ইমাম, কত নফল নামাযী নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন কি এই অসুবিধা হয় না? মানুষের সাথে আল্লাহর তুলনা? নাকি আল্লাহর কুদরতে সন্দেহ্? আসলে যেখানে দলীল আছে সেখানে আকেল দ্বারা কাজ নেওয়া আ ক্কে লের কাজ নয়।
প্রকাশ থাকে যে, যদি কোন কারণবশত: মুক্তাদী ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তে ভুলে যায়, তাহলে তাতে তার নামায হয়ে যাবে। ঐ রাকআত তাকে কাযা করতে হবে না। কারণ, ভুলের আমল ধর্তব্য নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)
সির্রী নামাযে ইমামের পিছনে মুক্তাদী সিজদার আয়াত পাঠ করলে তিলাওয়াতের সিজদা করতে পারে না। তিলাওয়াতের সিজদা সুন্নত। আর ইমামের অনুসরণ ওয়াজেব। অতএব সুন্নত পালন করতে গিয়ে গুনাহ করতে কেউ পারে না। আবার এ কথা জেনে শুনে কেউ সিজদা করলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ঐ ১/২৯০)
মুক্তাদীর জামাআতে শামিল হওয়ার বিভিন্ন অবস্থা
জামাআত শুরু হয়ে যাওয়ার পর কোন নামাযী নামাযে শামিল হতে চাইলে নিয়মিত দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে তাকে তাই করতে হবে, যা ইমাম করছেন। তাড়াহুড়ো না করে ইমাম যে অবস্থায় থাকবেন সেই অবস্থায় ধীরে-সুস্থ শামিল হতে হবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “নামাযে আসার সময় ধীর-স্থিরতার সাথে এস এবং তাড়াহুড়ো করে এসো না। এরপর যা পাবে, তা পড়ে নাও এবং যা ছুটে যাবে, তা পুরা করে নাও।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, জামে ২৭৫নং)
তিনি বলেন, “তোমাদের কেউ নামাযে এলে এবং ইমাম কোন অবস্থায় থাকলে, সে যেন তাই করে, যা ইমাম করছে।” (তিরমিযী, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৮৮, জামে ২৬১নং)
ইমাম সির্রী নামাযে প্রথম রাকআতে কিয়াম অবস্থায় থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দুই হাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দিয়ে ইস্তিফতাহ্র দুআ পড়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পাঠ করবে। কিন্তু ইমামের রুকূ চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। ফাতিহা পাঠ করতে করতে ইমাম রুকূ চলে গেলে পুরো না পড়েই রুকূতে যেতে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৯) এ ক্ষেত্রে ফাতিহা পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা বৈধ নয়।
জেহরী নামাযে ইমামের সূরা ফাতিহা বা অন্য সূরা পাঠ করা অবস্থায় শামিল হলে মুক্তাদী ইস্তিফতাহ্ বা সানা পড়বে না। বরং চুপে চুপে কেবল ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪)
ইমাম রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদী তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থ যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর রুকুতে যাওয়ার তকবীর পড়ে রুকূতে যাবে এবং রুকূর তাসবীহ পাঠ করবে। অবশ্য সময় সংকীর্ণ বুঝলে কেবল তাহ্রীমার তকবীরই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তকবীরের পর বুকে হাতও রাখবে না এবং সানা বা ফাতিহাও পড়বে না। কারণ, ইমামের অনুসরণ জরুরী। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪২-২৪৩)
রুকূ পেলে রাকআত গণ্য :
ইমামের সাথে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হবে কি না সে বিষয়টি বিতর্কিত। বর্তমান বিশ্বের সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের সুচিন্তিত মতানুসারে রুকু পেলে রাকআত গণ্য হবে।
এ ব্যাপারে যে সকল স্পষ্ট হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে কিছু কিছু দুর্বলতা থাকলেও এক জামাআত সাহাবার আমল এ কথার সমর্থন করে।
এ ব্যাপারে ইবনে মাসঊদ, ইবনে উমার, যায়দ বিন সাবেত, আব্দুল্লাহ বিন আম্র প্রভৃতি কর্তৃক রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে। পক্ষান্তরে আবূ বাকরার সহীহ হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে হাদীসটিকে রুকূ পেলে রাকআত গণ্য হওয়ার দলীল হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আবূ বাকরাহ্ একদা মসজিদ প্রবেশ করতেই দেখলেন নবী (সাঃ) রুকূতে চলে গেছেন। তিনি তাড়াহুড়ো করে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই রুকূ করলেন। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। একথা নবী (সাঃ)-কে বলা হলে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, “আল্লাহ তোমার আগ্রহ্ আরো বৃদ্ধি করুন। আর তুমি দ্বিতীয় বার এমনটি করো না। (অথবা আর তুমি ছুটে এসো না। অথবা তুমি নামায ফিরিয়ে পড়ো না।)” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১১০নং)
উক্ত হাদীসে রুকূ পেলে রাকআত পেয়ে নেওয়ার কথা ইঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া আর একটি সুন্নতের কথা বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে ইমামকে রুকূর অবস্থায় দেখে তাহলে কাতারে শামিল হওয়ার আগেই তার জন্য রুকূ করা সুন্নত। তাতে যদি সে ইমামের মাথা তোলার পর কাতারে শামিল হয় তাহলেও তার ঐ রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৮৬পৃ:)
ইবনুয যুবাইর (রাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে (জামাআতের) লোকেরা রুকূর অবস্থায় আছে, তাহলে সে যেন প্রবেশ করেই রুকূ করে। অতঃপর রুকূর অবস্থায় চলতে চলতে কাতারে শামিল হয়। কারণ, এটাই হল সুন্নাহ্।” (ত্বাবরানী, আওসাত্ব, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ১৫৭১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৪, বায়হাকী ৩/১০৬, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২২৯নং, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/২৬০-২৬৫)
মোট কথা, কেউ যদি ইমামকে রুকূর অবস্থায় পেয়ে তাঁর সাথে রুকূর (কমপক্ষে একবার) তাসবীহ পড়তে সক্ষম হয়, তাহলে তার সে রাকআত গণ্য হয়ে যাবে। কিয়াম ও সূরা ফাতিহা না পেলেও রাকআত হয়ে যাবে। সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না। কিন্তু কিয়াম অবস্থায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে ইমামের সাথে রুকূতে চলে গেলে মুক্তাদীর হ্ক্কে তা মার্জনীয়। কারণ, সাধারণ দলীল থেকে এ ব্যাপারটাও ব্যতিক্রম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৪৪) পরন্তু ইচ্ছা করে যদি কেউ কিয়ামে শামিল না হয়ে (লম্বা তারাবীহ্র) রুকূতে শামিল হয়, তাহলে তার ঐ রাকআত হবে না। কারণ সে ইচ্ছাকৃত নামাযের একটি রুক্ন কিয়াম ও সূরা ফাতিহা ত্যাগ করে।
সতর্কতার বিষয় যে, ইমাম রুকূ অবস্থায় থাকলে মসজিদে প্রবেশ করে অনেক মুক্তাদী তাকে রুকূ পাইয়ে দেওয়ার আশায় গলা ঝাড়া দিয়ে ইমামকে সতর্ক করে। এমন করা বৈধ নয়।
ইমাম কওমার অবস্থায় থাকলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর কওমার দুআ পাঠ করবে। এ ক্ষেত্রে আর রাকআত গণ্য হবে না।
ইমাম সিজদায় চলে গেলে যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর (বুকেহাত না বেঁধে) আবার তকবীর বলে সিজদায় গিয়ে সিজদার তাসবীহ পাঠ করবে। আর এ ক্ষেত্রেও রাকআত গণ্য হবে না এবং ইমামের দ্বিতীয় রাকআতে কিয়ামে দাঁড়ানোর সময় ইস্তিফতাহও পড়বে না। বরং ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।
মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমরা সিজদারত থাকা অবস্থায় তোমরা নামাযে এলে তোমরাও সিজদা কর এবং সেটাকে কিছুও গণ্য করো না।” (বুখারী ৫৫৬, মুসলিম, সহীহ ৬০৭-৬০৮, আবূদাঊদ, সুনান ৮৯৩নং)
ইমাম দুই সিজদার মাঝের বৈঠকে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকেহাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ বৈঠকের দুআ পাঠ করবে।
ইমাম শেষ সিজদায় থাকলেও তাঁর জন্য উঠে দাঁড়ানোর অপেক্ষা বৈধ নয়। বরং যথানিয়মে সিজদায় যেতে হবে এবং যথানিয়মে ইমামের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে ‘আঊযু বিল্লাহ্-বিসমিল্লাহ্’ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা সিজদা খামাখা নষ্ট করা উচিৎ নয়। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “তুমি আল্লাহর জন্য অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও; কারণ যখনই তুমি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করবে তখনই আল্লাহ তার বিনিময়ে তোমাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং তার দরুন একটি গুনাহ মোচন করবেন।” (মুসলিম, সহীহ ৪৮৮নং তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক বান্দাই, যখন সে আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন, তার একটি গুনাহ ক্ষালন করে দেন এবং তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী করে সিজদা কর।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, সহিহ তারগিব ৩৭৯নং)
বলাই বাহুল্য যে, ইমামের রুকূ থেকে মাথা তোলার পর রাকআতের কোন অংশে শামিল হলে ঐ রাকআত গণ্য হবে না। ইমাম সালাম ফিরে দিলে ঐ নামাযী সালাম না ফিরে তকবীর দিয়ে উঠে ছুটে যাওয়া ঐ রাকআত একাকী যথানিয়মে পূরণ করে সালাম ফিরবে।
অনুরুপ দ্বিতীয় রাকআতে শামিল হলে অনুরুপভাবে রাকআত গণ্য ও অগণ্য হবে।
ইমাম তাশাহ্হুদে থাকলে মুক্তাদী যথানিয়মে দাঁড়িয়ে দুইহাত তুলে তাকবীরে তাহ্রীমা দেওয়ার পর পুনরায় তকবীর দিয়ে (বুকে হাত না বেঁধে) সরাসরি ইমামের মত বসে যাবে এবং ঐ তাশাহহুদের দুআ পাঠ করবে। এর ফলে কোন কোন ৪ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ বার, ৩ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ৩ থেকে ৪ বার এবং ২ রাকআত বিশিষ্ট নামাযে ২ বার তাশাহহুদ হয়ে যেতে পারে।
যেমন যোহ্র, আসর বা এশার নামাযের প্রথম তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল হলে মুক্তাদী ইমামের সাথে ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। আর তার হবে প্রথম তাশাহহুদ। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ তাশাহহুদ।
অনুরুপভাবে দ্বিতীয় রাকআতে বা শেষ তাশাহ্হুদে শামিল হলে ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে বাকী নামায আদায় করলেও যথানিয়মে তার ৩টি তাশাহহুদ হবে।
মাগরেবের নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর পর বা প্রথম তাশাহ্হুদে জামাআতে শামিল হলে ইমামের সাথে শেষের রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পড়বে। তারপর ইমামের সালাম ফিরার পর তকবীর দিয়ে উঠে বাকী ২ রাকআত নামায পড়তে প্রথম যে রাকআত সে একাকী পড়বে সেটি তার দ্বিতীয় রাকআত। ফলে সে তার হিসাবে সে প্রথম তাশাহহুদ পড়বে। তারপর উঠে তৃতীয় রাকআত পড়ে শেষ তাশাহহুদ পাঠ করবে। এইভাবে ঐ মুক্তাদীর হয়ে যাবে ৩ রাকআতে ৪টি তাশাহহুদ।
কিন্তু এই নামাযের দ্বিতীয় রাকআতে রুকূর আগে বা রুকূতে শামিল হলে প্রত্যেক রাকআতে ১টি করে মোট ৩টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে। যেমন শেষ তাশাহ্হুদে শামিল হলেও যথানিয়মে ৩টি তাশাহহুদ হবে।
ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকআতে অথবা তাশাহ্হুদে শামিল হলে ২ রাকআত নামাযে ২টি তাশাহহুদ হয়ে যাবে।
অবশ্য তাশাহহুদ বেশী হওয়ার জন্য কোন সহু সিজদা লাগবে না।
প্রকাশ থাকে যে, মুক্তাদী ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে একাকী যে নামায পড়বে সেগুলো তার শেষ রাকআত। অতএব শেষ রাকআত গুলো সে একাকী যে নিয়মে পড়ে ঠিক সেই নিয়মে আদায় করবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৭/৬৬, ১৮/১০৭, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৮) জেহরী নামায হলে জেহরী ক্বিরাআতে যদি পাশের নামাযীর ডিষ্টার্ব না হয়, তাহলে জেহরী, নচেৎ সির্রী ক্বিরাআত করে নামায শেষ করবে। যেহেতু একাকী নামাযে জোরে জোরে ক্বিরাআত বাধ্যতামূলক নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৪০)
ইমাম সালাম ফিরে দিলে আর জামাআতে শামিল না হয়ে অন্য নামাযী থাকলে তাকে নিয়ে দ্বিতীয় জামাআত করে নামায পড়বে।
ইমাম প্রথম সালাম ফিরে শেষ করলেই মসবূক নিজের বাকী নামায পড়ার জন্য উঠতে পারে। কারণ, এক সালামেও নামায হয়ে যায়। তবে সতর্কতার বিষয় যে, তাঁর সালাম শুরু করার সাথে সাথে উঠবে না। পক্ষান্তরে অনেকে বলেছেন, ইমাম যতক্ষণ দ্বিতীয় সালাম থেকে ফারেগ না হয়েছেন, ততক্ষণ উঠা বৈধ নয়। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, কোন মসবূক যেন ইমামের উভয় সালাম ফিরে শেষ না করা পর্যন্ত তার বাকী নামায আদায় করতে না উঠে। (মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ৪১পৃ:) মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। অতএব আমার আগে তোমরা রুকূ করো না, সিজদা করো না, বসো না এবং সালাম ফিরো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)
অনেকে বলেছেন, ইমামের দুই সালাম ফিরার আগে উঠে গেলে মসবূকের নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ফাতাওয়াশ শায়খ ইবনি সা’দী ১৭৪পৃ:, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ৯৬-৯৭পৃ:) অতএব নামাযী সাবধান!
মসবূকের ইক্তিদা
যদি কোন নামাযী মসজিদে এসে দেখে যে জামআত শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু মসবূক (যাদের কিছু নামায ছুটে গেছে তারা) উঠে একাকী নামায পূর্ণ করছে, তাহলে জামাআতের সওয়াব লাভের আশায় ঐ নামাযীর কোন এক মসবূকের ডাইনে দাঁড়িয়ে তার ইক্তিদা করে নামায পড়া বৈধ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৬)
কিন্তু শায়খ ইবনে উষাইমীন (রহঃ) বলেন, এর যেহেতু সঠিক প্রমাণ নেই এবং অনেকে এরুপ শুদ্ধ নয় বলেছেন, সেহেতু তা না করাই উত্তম। আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে বিষয়ে সন্দেহ্ আছে সে বিষয় বর্জন করে তাই কর যাতে সন্দেহ্ নেই।” (তিরমিযী, সুনান ২৫১৮, জামে ৩৩৭৮নং) “সুতরাং যে সন্দিহান বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকবে, সে তার দ্বীন ও ইজ্জতকে বাঁচিয়ে নেবে।” (বুখারী ৫২, মুসলিম, সহীহ ১৫৯৯নং) বলা বাহুল্য, অনেকে তা জায়েয বললেও না করাটাই উত্তম। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৭১, লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ৫৩-৫৪পৃ:)
আয়াতের জবাবে মুক্তাদীর দুআ বলা
(নিঃশব্দে) কতিপয় আয়াতের জবাব দেওয়া এবং (যে কোনও নামাযে) রহ্মতের আয়াত পঠিত হলে সেই সময় আল্লাহর রহ্মত ভিক্ষা করা এবং আযাবের আয়াত পঠিত হলে সেই সময়ে আল্লাহর আযাব থেকে পানাহ চাওয়া মুক্তাদীর জন্যও মুস্তাহাব। অবশ্য শর্ত হল, তাতে যেন ইমামের ক্বিরাআত শোনাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।
অতএব ইমাম দুআ পড়লে মুক্তাদীও পড়বে। নচেৎ ইমাম একটানা ক্বিরাআত করে গেলে আয়াতের জবাবে বা অন্য কোন দুআ পড়া বৈধ হবে না। কারণ তাতে মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে আদেশ লঙ্ঘন করা হবে। যেহেতু ইমাম ক্বিরাআত করলে মুক্তাদী চুপ থেকে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে আদিষ্ট হয়েছে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪-৩৯৫)
ইমাম ভুল করলে মুক্তাদীর কর্তব্য
ইমাম কোন ভুল করলে মুক্তাদীর তা ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করে দেওয়া কর্তব্য। আর বড় মারাত্মক ভুলে (যেমন নামাযের কোন শর্ত বা রুক্ন ছাড়াতে) তাঁর অনুসরণ করা মোটেই উচিৎ নয়।
ইমাম ভুলে বিনা ওযূতে নামায পড়ালে এবং মুক্তাদীরাও তা জানতে না পারলে, অতঃপর নামায শেষ করার পর জানা গেলে মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য ইমামকে সে নামায পুনরায় পড়তেই হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৩৯, লিকাউবাবিল মাফতূহ্, ইবনে উষাইমীন ৯৯পৃ:)
মহানবী (সাঃ) বলেন, “লোকেরা তোমাদের ইমামতি করে; সুতরাং তারা যদি ঠিকভাবে পড়ায় তাহলে তা তোমাদের জন্য এবং তাদের জন্যও। (অর্থাৎ, তোমাদের নামায হয়ে যাবে এবং তাদেরও।) পক্ষান্তরে তারা যদি ভুল পড়ায় তাহলে তোমাদের (নামায শুদ্ধ) হয়ে যাবে এবং ওদের (নামায শুদ্ধ) হবে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মিশকাত ১১৩৩নং)
একদা হযরত উমার (রাঃ) অপবিত্র অবস্থায় ভুলে লোকেদের ইমামতি করলেন। অতঃপর তিনি নিজে নামায ফিরিয়ে পড়লেন আর লোকেরা পড়ল না। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ৩/১৪৭)
নামায পড়া অবস্থায় ইমাম যদি জানতে পারে যে, সে নাপাকে আছে অথবা তার ওযূ ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু লজ্জায় সে নামায ত্যাগ না করে পড়ে শেষ করে তাহলেও মুক্তাদীদের নামায শুদ্ধ। অবশ্য ইমামের নামায বাতিল এবং তার জন্য জেনে শুনে নাপাকে নামায পড়া হারাম।
পক্ষান্তরে মুক্তাদী যদি জানতে পারে যে, ইমাম নাপাক অবস্থায় নামায পড়াচ্ছেন, তাহলে তারও নামায বাতিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪০)
বলা বাহুল্য, ইমাম হোক চাহে মুক্তাদী নামায পড়তে পড়তে কারো ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে অথবা নাপাকে আছে মনে পড়লে সে নাক ধরে নামায ছেড়ে বের হয়ে আসবে।
নবী মুবাশ্শির (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযে বেওযূ হয়ে যায়, তখন সে যেন নাক ধরে নামায ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪নং)
নাক ধরে বেরিয়ে আসার পশ্চাতে হিকমত এই যে, যাতে লোকেরা মনে করে, তার নাক দিয়ে হয়তো রক্ত আসছে। আর এটা মিথ্যা নয়; বরং এটি এক প্রকার ছদ¹কর্ম, যা তার জন্য বৈধ করা হয়েছে। যাতে সে লোকেদেরকে লজ্জা করলে শয়তান তাকে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধা না দেয়।
- ইমামের ইমামতি করায় কোন সমস্যf দেখা দিলে
ইমামতি করতে করতে ইমামের কোন প্রতিবন্ধক বা সমস্যা সৃষ্টি হলে; যেমন ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে, অথবা ওযূ নেই বা ফরয গোসল বাকী আছে মনে পড়লে, অথবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে, অথবা গলার আওয়ায বন্ধ হয়ে গেলে, অথবা নাক থেকে রক্ত পড়লে, অথবা প্রস্রাব-পায়খানার বেগ বেসামাল হয়ে উঠলে, ইমাম তৎক্ষণাৎ একজন উপযুক্ত মুক্তাদীকে ইমাম বানিয়ে নাক ধরে মসজিদ ত্যাগ করবেন।
নামায পড়ার পড় ইমাম কাপড়ে নাপাকী দেখলে সকলের নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। নামায পড়তে পড়তে দেখলে যদি তা সেই অবস্থাতেই দূর করা সম্ভব হয় তো উত্তম। নচেৎ নামায ত্যাগ করে বেরিয়ে এসে কাপড় পবিত্র করা জরুরী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪৩)
নামায পড়তে দাঁড়িয়ে হযরত উমার (রাঃ)-কে খঞ্জরাঘাত করা হলে তিনি হযরত আব্দুর রহ্মান বিন আওফকে আগে বাড়িয়ে ইমামতি করতে ইঙ্গিত করলে তিনি হাল্কাভাবে নামায পড়িয়ে শেষ করলেন। (বুখারী ৩৭০০নং)
একদা নামায পড়তে পড়তে হযরত আলী (রাঃ)-এর নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলে তিনি একজনকে তার হাত ধরে আগে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে বেরিয়ে এলেন। (সুনান সাঈদ বিন মানসূর, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৫৬পৃ:)
কোন মসবূক (যার দু-এক রাকআত ছুটে গেছে এমন মুক্তাদী)কে ও ইমামতি করতে আগে বাড়িয়ে দেওয়া ইমামের জন্য বৈধ।
সেই সময় কোন অমুক্তাদী (তখনও জামাআতে শামিল হয়নি এমন) লোককেও ইমাম করা যায়। এ ক্ষেত্রে সে ইমামের তরতীব অনুযায়ী নামায পড়বে। মুক্তাদীদের নামায শেষ হয়ে গেলে তারা বসে তার সালাম ফিরার অপেক্ষা করবে। (অর্থাৎ, তার অনুসরণে নির্ধারিত রাকআত অপেক্ষা বেশী পড়বে না।) অতঃপর সে তার বাকী নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরলে মুক্তাদীরাও তার সাথে সালাম ফিরবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৭৩, আহ্কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্সিন আল-মুনীফ ২৪৫-২৫১পৃ:)
ইমাম যদি কাউকে নায়েব করতে সুযোগ না পান, তাহলে উপযুক্ত একজন মুক্তাদীর অগ্রসর হয়ে ইমামতি করে নামায সম্পন্ন করা কর্তব্য। অবশ্য এও বৈধ যে, ইমাম নামায ত্যাগ করলে মুক্তাদীরা নিজে নিজে একাকী নামায সম্পন্ন করবে। যেমন হযরত মুআবিয়াকে ইমামতি করা অবস্থায় আক্রমণ করা হলে লোকেরা নিজে নিজে নামায শেষ করেছিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৩৪১, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৫৬পৃ:)
- ইমামের শরমগাহ্ খোলা দেখলে
নামায পড়তে পড়তে মুক্তাদী ইমামের শরমগাহ্ খোলা দেখলে চুপ থেকে তাঁর ইক্তিদা করে যাওয়া বৈধ নয়। কারণ, সে জানে যে, শরমগাহ্ বের হয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যায়। আর যার নামায বাতিল, তার ইক্তিদা করা বৈধ নয়। অতএব জরুরী হল, নামায ছেড়ে ইমামকে সে বিষয়ে সতর্ক করা। (ইবনে বায, মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২৬পৃ:)
- ইমাম সূরা ভুল পড়লে
ইমাম সূরা ভুল পড়লে সংশোধন করা, কোন আয়াত ভুলে ছেড়ে দিলে তা ধরিয়ে দেওয়া মুক্তাদীর কর্তব্য।
‘নামাযের মধ্যে যা করা বৈধ’ শিরোনামে এ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে যে, ইমাম সূরা ফাতিহায় ভুল করলে তা ধরিয়ে বা সংশোধন করে দেওয়া মুক্তাদীর জন্য ওয়াজেব। এ ছাড়া অন্যান্য সূরা ভুল পড়লেও মনে করিয়ে দেওয়া বিধেয়।
ইমাম সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ করার সময় কোন আয়াতে গিয়ে আটকে গেলে এবং মুক্তাদীদের কারো সে সূরা মুখস্থ না থাকলে বা কেউ ধরিয়ে না দিলে তিনি দুয়ের মধ্যে এক করতে পারেন; (কয়েক আয়াত পড়া হয়ে থাকলে) তিনি ইচ্ছা করলে তকবীর দিয়ে রুকূতে চলে যেতে পারেন। নতুবা (বিশেষ করে ক্বিরাআতের শুরুতে হলে) অন্য সূরা বা সূরার কতক আয়াত পাঠ করে রুকূতে যেতে পারেন। পক্ষান্তরে সূরা ফাতিহা পড়তে পড়তে আটকে গেলে তাকে যে কোন প্রকারে সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করতেই হবে। নচেৎ নামাযই হবে না। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্, মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্বিদ ২৬পৃ:)
মুক্তাদী কেউ হাফেয না থাকলে কোন লম্বা নামাযে হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য কোন মুক্তাদীর মুসহাফ নিয়ে নামাযে দেখে যাওয়া প্রয়োজনে বৈধ। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৬৫)
ইমাম ভুল করে নামাযের কোন রুক্ন বা রাকআত ত্যাগ করলে মুক্তাদী ‘সুবহানাল্লাহ্’ বলে সতর্ক করবে। রাকআত বেশী করলে তাতে তাঁর অনুসরণ করবে না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৫/৮৭) বরং তাসবীহ বলে তাঁকে বসে যেতে ইঙ্গিত করবে।
পক্ষান্তরে ইমাম প্রথম তাশাহহুদের বৈঠক ছেড়ে ভুলে উঠে পড়লে মুক্তাদীও তাঁর সাথে উঠে যাবে। এ ক্ষেত্রে বারবার তাসবীহ পড়ে তাঁকে বসতে বাধ্য করবে না এবং ইমামও বসতে বাধ্য হবেন না। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা ‘সহু সিজদার’ বর্ণনায় আসবে।)
সতর্কতার বিষয় যে, মুক্তাদীদের মাঝে ভুল বুঝার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেই ক্বারী ইমামের উচিৎ নয়, নামাযের ভিতরে প্রচলিত ক্বিরাআত ছাড়া অন্যান্য বিরল ক্বিরাআতে সূরা পড়া। কারণ, নামাযের ভিতরে একাধিক নিয়মে ক্বিরাআত পড়া বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩১৭পৃ:)
একই নামায দুইবার পড়া যায় কি?
একই নামায দুইবার পড়া নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “একই নামাযকে একই দিনে দুইবার পড়ো না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৯নং)
একদা তিনি এক সাহাবীকে ফজরের পরে নামায পড়তে দেখে বললেন, “এটি আবার কোন্ নামায? (ফজরের নামায কি দুইবার?)” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৬৭, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১১৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
কিন্তু যদি কেউ কোন অসুবিধার কারণে বাসায় নামায পড়ে নিয়ে মসজিদে এসে দেখে যে, তখনও জামাআত চলছে, তাহলে জামাআতের ফযীলত পাওয়ার আশায়, এক জামাআতে (মসজিদে) নামায পড়ার পর দ্বিতীয় জামাআতে (মসজিদে) কোন কাজের খাতিরে গিয়ে জামাআত চলছে দেখলে অধিক সওয়াবের আশায়, ইমাম অত্যন্ত দেরী করে নামায পড়লে আওয়াল অক্তে নামায পড়ে নেওয়ার পর পুনরায় ঐ ইমামের জামাআতে এবং এ সকল ক্ষেত্রে নফলের নিয়তে ও বেনামাযী বা জামাআত ত্যাগী হওয়ার অপবাদ অপনোদন করার উদ্দেশ্যে একই নামায দ্বিতীয়বার পড়া উত্তম। অনুরুপ কোন সাধারণ মসজিদের ইমাম শ্রেষ্ঠতর মসজিদে (মাহাত্মপূর্ণ ৪ মসজিদের কোন একটিতে) নামায পড়ার পর নিজের মসজিদে ইমামতি করার জন্য, অথবা একাকী নামাযীকে জামাআতের সওয়াব অর্জন করাবার উদ্দেশ্যেও পড়ে নেওয়া নামায নফলের নিয়তে পুনরায় পড়া যায়।
একদা মসজিদে খাইফে তিনি ফজরের নামাযে সালাম ফিরে দেখলেন, মসজিদের এক প্রান্তে দুই ব্যক্তি জামাআতে নামায পড়েনি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমরা আমাদের বাসায় নামায পড়ে নিয়েছি।’ তিনি বললেন, “এমনটি আর করো না। বরং যখন তোমাদের কেউ নিজ বাসায় নামায পড়ে নেয়, অতঃপর (মসজিদে এসে) দেখে যে, ইমাম নামায পড়ে নি, তখন সে যেন (দ্বিতীয়বার) তাঁর সাথে নামায পড়ে। আর এ নামায তার জন্য নফল হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৫, তিরমিযী, সুনান ২১৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১১৫২, জামে ৬৬৭নং)
সাহাবী মিহ্জান (রাঃ) এক মজলিসে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সাথে বসেছিলেন। ইতিমধ্যে আযান (ইকামত) হলে আল্লাহর রসূল (সাঃ) উঠে গেলেন। তিনি নামায পড়ে এসে দেখলেন, মিহ্জান তাঁর সেই মজলিসেই বসে আছেন। আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, “লোকেদের সাথে নামায পড়তে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি মুসলিম নও?” মিহ্জান বললেন, ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রসূল! তবে আমি আমার ঘরে নামায পড়ে নিয়েছি।’ এ কথা শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, “তুমি নামায পড়ার পর যখন মসজিদে আস এবং নামাযের জামাআত শুরু হয়, তখন তুমিও লোকেদের সাথে নামায পড়ে নাও; যদিও তুমি পূর্বে সে নামায পড়ে নিয়ে থাক।” (মালেক, মুঅত্তা, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩৩৭নং)
একদা মহানবী (সাঃ) আবূ যার (রাঃ)-কে বললেন, “তোমার অবস্থা কি হবে, যখন এমন এমন আমীর হবে, যারা নামায মেরে ফেলবে অথবা যথাসময় থেকে দেরী করে পড়বে?” আবূ যার (রাঃ) বললেন, ‘আপনি আমাকে কি আদেশ করেন?’ তিনি বললেন, “তুমি যথাসময়ে নামায পড়ে নাও। অতঃপর যদি সেই নামায তাদের সাথে পাও, তাহলে তা আবার পড়ে নাও; এটা তোমার জন্য নফল হবে।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৬০০নং)
মুআয বিন জাবাল (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর সাথে তাঁর মসজিদে (নববীতে) নামায পড়তেন। অতঃপর নিজ গোত্রে ফিরে এসে ঐ নামাযেরই ইমামতি করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১১৫০ নং)
মহানবী (সাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়তে দেখলে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এমন কেউ কি নেই, যে এর সাথে নামায পড়ে একে (জামাআতের সওয়াব) দান করে?” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তার সাথে নামায পড়ল। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৭৪, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৪৬ নং) অথচ সে মহানবী (সাঃ) এর সাথে ঐ নামায পূর্বে পড়েছিল।
দুটি নামাযের মধ্যে কোন্ নামাযটি নফল হবে সে বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘উভয় নামাযের মধ্যে কোন্টি আমার (ফরয) নামায গণ্য করব?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এ এখতিয়ার কি তোমার আছে? এ এখতিয়ার আছে একমাত্র আল্লাহ আয্যা জাল্লারই। তিনি উভয়ের মধ্যে যেটিকে ইচ্ছা ফরয রুপে গণ্য করবেন।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১১৫৬নং) অবশ্য পূর্বোক্ত অনেক বর্ণনায় স্পষ্ট আছে যে, শেষের নামাযটাই নফল গণ্য হবে।
ইমামের তকবীর পৌছানো
ইমামের আওয়াজ ক্ষীণ হলে অথবা জামাআত বড় হলে ইমামের তকবীর সকল মুসল্লী পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে মুক্তাদীর উচ্চস্বরে তকবীর বলা বৈধ।
একদা মহানবী (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বসে বসে নামায পড়েন। তাঁর আওয়াজ ছিল ক্ষীণ। হযরত আবূ বাক্র (রাঃ) তাঁর তকবীর শুনে তকবীর বলছিলেন এবং লোকেরা আবূ বাকরের তকবীর শুনে তকবীর বলছিল। (বুখারী ৭১২-৭১৩, মুসলিম, সহীহ)
মুক্তাদীদের মধ্যে যে মুবাল্লেগ নির্বাচিত হবে সে ইমামের তকবীর বলার পরই তকবীর বলবে। তাঁর আগে-আগে বা সাথে-সাথে বলবে না। ইমাম ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্’ বললে মুবাল্লেগ ‘রাব্বানা অলাকালহাম্দ’ বলবে।
প্রকাশ থাকে যে, মুবাল্লেগ হল প্রয়োজনের ক্ষেত্রে। অপ্রয়োজনে অর্থাৎ যেখানে সকল নামাযী ইমামের তকবীর শুনতে পায় সেখানে মুবাল্লেগের তকবীর পড়া ঘৃণিত বিদআত। (ফিকহুস সুন্নাহ্ আরাবী ১/২১৬, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ৬২পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ৯৪পৃ:)
মাইক যন্ত্র মুসলিমদের জন্য এক বড় নেয়ামত। আওয়াজকে দূরে ও জোরে পৌঁছানোর জন্য তার অবদান বিরাট। আর এটি আযান, ইকামত, খোতবা ও নামাযের জন্য ব্যবহার করা বিদআত নয়। যেমন বিদআত নয় বিশাল জনসভা ও ইজতেমায় তার মাধ্যমে বক্তৃতা ও ওয়ায-নসীহত করা। বলা বাহুল্য, যেখানে মাইকের মাধ্যমে সকল মুক্তাদী ইমামের তকবীরের শব্দ অনায়াসে শুনতে পারে সেখানে মুবাল্লেগের প্রয়োজন নেই। আর যেখানে মাইক ব্যবহার করা বিদআত নয় সেখানে বিশাল জামাআতে ৫০টা বা তারও বেশী সংখ্যক মুবাল্লেগ রেখে নামায পড়া অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জন। এর ফলে ইমামের আওয়াজ শেষ কাতারে পৌঁছতে পৌঁছতে এমন হয় যে, ইমাম যখন সিজদা থেকে মাথা তুলেন, শেষের কাতারের মুসল্লীরা তখন রুকূ থেকে মাথা তোলে! ফলে জামাআতের মাঝে বিরাট বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। (মু’জামুল বিদা’ ২৫, ৩৩৪পৃ:) আশ্চর্যের বিষয় যে, উক্ত প্রকার ইজতেমায় ওয়ায-নসীহত মাইকে হয়, কিন্তু নামায হয় বিনা মাইকে। হয়তো বা ওঁদের নিকট প্রথমটা বিদআত নয় এবং দ্বিতীয়টি বিদআত! কি জানি এ কোন্ বিচার?
এক নামায পড়ার পর অপর নামাযের জন্য অপেক্ষা করার ফযীলত
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নামাযের অবস্থাতেই থাকে যতক্ষণ নামায তাকে (অন্যান্য কর্ম হতে) আটকে রাখে। তাকে নামায ব্যতীত অন্য কিছু তার পরিবারের নিকট ফিরে যেতে বাধা দেয় না।” (বুখারী ৬৫৯নং, মুসলিম ৬৪৯নং)
বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় এরুপ এসেছে, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি নামাযেই থাকে যতক্ষণ নামায তাকে আটকে রাখে। (আগামী নামায পড়ার জন্য অপেক্ষা করে মসজিদেই বসে থাকে।) আর সেই সময় ফিরিশ্তাবর্গ বলতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! ওর প্রতি সদয় হও।’ (এই দুআ ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে) যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নামাযের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা তার ওযু নষ্ট হয়েছে।” (বুখারী ৩২২৯নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের পর আর এক নামাযের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তি সেই অশ্বারোহীর সমতুল্য যে তার অশ্বসহ্ আল্লাহর পথে শত্রুর বিরুদ্ধে বিক্রমের সাথে সদা প্রস্তুত; যে থাকে বৃহ্ৎ প্রতিরক্ষার কাজে।” (আহ্মদ, ত্বাবারানীরানীর আওসাত্ব, সহীহ তারগীব ৪৪৭নং)
আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের জন্য বসে প্রতীক্ষারত ব্যক্তি নামাযের দন্ডায়মান ব্যক্তির মত। তার নাম নামাযে মশগুল ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত থাকে -তার স্বগৃহ্ থেকে বের হওয়া হতে পুনরায় গৃহে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত।” (ইবনে হিব্বান, আহ্মদ, প্রমুখ, সহীহ তারগীব ৪৫১নং)
লেখক: শায়খ আব্দুল হামীদ আল ফাইযী আল-মাদানী
লিসান্স: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদিআরব
(সৌদী আরবের আল-মাজমাআ অঞ্চলের দাওয়াত সেন্টারে কর্মরত দাওয়াত-কর্মী এবং বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক ও অনুবাদক।)
আরও পড়ুনঃ স্বালাতে মুবাশ্শির (১ম পর্ব)
আরও পড়ুনঃ স্বালাতে মুবাশ্শির (৩য় পর্ব)
আরও পড়ুনঃ কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে রাতের সালাত
আরও পড়ুনঃ তারবীহর রাকায়াত সংখ্যা ৮ না ২০?
আরও পড়ুনঃ তারাবীহর নামাযের রাকআত সংখ্যা
আরও পড়ুনঃ তারাবীহ -এর সালাতের রাক্‘আত সংখ্যা
আরও পড়ুনঃ কিয়ামুল লাইলের সমপরিমাণ সওয়াব
আরও পড়ুনঃ ছহীহ্ সুন্নাহ্র আলোকে বিতর নামায
আরও পড়ুনঃ সফরে থাকা অবস্থায় নামাযের নিয়ম
আরও পড়ুনঃ সফরের বিধান
আরও পড়ুনঃ কসর ও জমা করে সালাত আদায় সম্পর্কে কিছু বিধান
আরও পড়ুনঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) - ১ম পর্ব
আরও পড়ুনঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) - ২য় পর্ব
আরও পড়ুনঃ সালাত আদায়ের পদ্ধতি
আরও পড়ুনঃ সালাতের আহকাম ও পদ্ধতি
আরও পড়ুনঃ নামায শিক্ষা
আরও পড়ুনঃ জামা‘আতের সাথে নামায আদায়
আরও পড়ুনঃ সালাত পরবর্তী দুয়া ও জিকির সমূহ
ডাউনলোড করুনঃ বই কালেকশন - শায়খ আব্দুল হামীদ আল ফাইযী আল-মাদানী (ফ্রি ডাউনলোড)
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ স্বালাতে মুবাশ্শির - ফ্রি ডাউনলোড
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ স্বালাতে মুবাশ্শির - ফ্রি ডাউনলোড
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ রাসূল (সা)-এর নামায (ফ্রি ডাউনলোড)
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) - ফ্রি ডাউনলোড
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ সালাতুত তারাবীহ - ফ্রি ডাউনলোড
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ তারাবীহ ও ই’তিকাফ - ফ্রি ডাউনলোড
“সালাত” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন