মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৮

স্বালাতে মুবাশ্‌শির (৩য় পর্ব)

স্বালাতে মুবাশ্‌শির (৩য় পর্ব)



১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব

জুম'আ

জুমআর নামায

জুমআর নামায প্রত্যেক সাবালক জ্ঞান-সম্পন্ন পুরুষের জন্য জামাআত সহকারে ফরয।

মহান আল্লাহ বলেন,

(يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ، ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ)
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! যখন জুমআর দিন নামাযের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা সত্বর আল্লাহর স্মরণের জন্য উপস্থিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্জন কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (কুরআন মাজীদ ৬২/৯)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “দুনিয়াতে আমাদের আসার সময় সকল জাতির পরে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আমরা সকলের অগ্রবর্তী। (সকলের আগে আমাদের হিসাব-নিকাশ হবে।) অবশ্য আমাদের পূর্বে ওদেরকে (ইয়াহুদী ও নাসারাকে) কিতাব দেওয়া হয়েছে। আমরা কিতাব পেয়েছি ওদের পরে। এই (জুমআর) দিনের তা’যীম ওদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু ওরা তাতে মতভেদ করে বসল। পক্ষান্তরে আল্লাহ আমাদেরকে তাতে একমত হওয়ার তওফীক দান করেছেন। সুতরাং সকল মানুষ আমাদের থেকে পশ্চাতে। ইয়াহুদী আগামী দিন (শনিবার)কে তা’যীম করে (জুমআর দিন বলে মানে) এবং নাসারা করে তার পরের দিন (রবিবার)কে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক সাবালক পুরুষের জন্য জুমআয় উপস্থিত হওয়া ওয়াজেব।” (নাসাঈ, সুনান ১৩৭১নং)

হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “আমি ইচ্ছা করেছি যে, এক ব্যক্তিকে লোকেদের ইমামতি করতে আদেশ করে ঐ শ্রেণীর লোকেদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিই, যারা জুমআতে অনুপস্থিত থাকে।” (মুসলিম ৬৫২নং,হাকেম)

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) ও ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তাঁরা শুনেছেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁর মিম্বরের কাঠের উপর বলেছেন যে, “কতক সম্প্রদায় তাদের জুমুআহ ত্যাগ করা হতে অতি অবশ্যই বিরত হোক, নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে অবশ্যই মোহ্‌র মেরে দেবেন। অতঃপর তারা অবশ্যই অবহেলাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৬৫ নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

হযরত আবুল জা’দ যামরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি বিনা ওজরে তিনটি জুমুআহ ত্যাগ করবে সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭২৬নং)

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী (সাঃ) জুমআর দিন খাড়া হয়ে খুতবা দানকালে বললেন, “সম্ভবত: এমনও লোক আছে, যার নিকট জুমুআহ উপস্থিত হয়; অথচ সে মদ্বীনা থেকে মাত্র এক মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাযির হয় না।” দ্বিতীয় বারে তিনি বললেন, “সম্ভবত: এমন লোকও আছে  যার নিকট জুমুআহ উপস্থিত হয়; অথচ সে মদ্বীনা থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাজির হয় না।” অতঃপর তৃতীয়বারে তিনি বললেন, “সম্ভবত: এমন লোকও আছে যে মদ্বীনা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে থাকে এবং জুমআয় হাজির হয় না তার হৃদয়ে আল্লাহ মোহ্‌র মেরে দেন।” (আবূ য়্যা’লা, সহিহ তারগিব ৭৩১নং)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি পরপর ৩ টি জুমুআহ ত্যাগ করল, সে অবশ্যই ইসলামকে নিজের পিছনে ফেলে দিল।” (ঐ, সহিহ তারগিব৭৩২নং)

জুমুআহ যাদের উপর ফরয নয়
১-২-৩। মহিলা, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তি।

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জামাআত সহকারে জুমুআহ ফরয। অবশ্য ৪ ব্যক্তির জন্য ফরয নয়; ক্রীতদাস, মহিলা, শিশু ও অসুস্থ।” (আবূদাঊদ, সুনান ১০৬৭নং)

৪। যে ব্যক্তি (শত্রু, সম্পদ বিনষ্ট, সফরের সঙ্গী ছুটে যাওয়ার) ভয়ে, অথবা বৃষ্টি, কাদা বা অত্যন্ত শীত বা গ্রীষ্মের কারণে মসজিদে উপস্থিত হতে অক্ষম।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি মুআযযিনের (আযান) শোনে এবং কোন ওজর (ভয় অথবা অসুখ) তাকে জামাআতে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়, তাহলে যে নামায সে পড়ে, তার সে নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১নং)

একদা ইবনে আব্বাস (রাঃ) এক বৃষ্টিময় জুমআর দিনে তাঁর মুআযযিনকে বললেন, ‘তুমি যখন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্‌’ বলবে তখন বল, ‘তোমরা তোমাদের ঘরে নামায পড়ে নাও।’ এ কথা শুনে লোকেরা যেন আপত্তিকর মনোভাব ব্যক্ত করল। কিন্তু তিনি বললেন, ‘এরুপ তিনি করেছেন যিনি আমার থেকে শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ, আল্লাহর রসূল (সাঃ) এরুপ করেছেন। আর আমিও তোমাদেরকে এই কাদা ও পিছল জায়গার মাঝে বের হওয়াকে অপছন্দ করলাম।’ (বুখারী ৯০১, মুসলিম, সহীহ ৬৯৯নং)

প্রকাশ থাকে যে, যারা দূরের মাঠে অথবা জঙ্গলে অথবা সমুদ্রে কাজ করে এবং আযান শুনতে পায় না, তাছাড়া কাজ ছেড়ে শহর বা গ্রামে আসাও সম্ভব নয়, তাদের জন্য জুমুআহ ফরয নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১৪, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৯৯)

৫। মুসাফির :

মহানবী (সাঃ) জুমআর দিন সফরে থাকলে, জুমআর নামায না পড়ে যোহরের নামায পড়তেন। বিদায়ী হজ্জের সময় তিনি আরাফাতে অবস্থানকালে জুমআর নামায পড়েননি। বরং যোহ্‌র ও আসরের নামাযকে অগ্রিম জমা করে পড়েছিলেন। অনুরুপ আমল ছিল খুলাফায়ে রাশেদ্বীন (রাঃ) দেরও।

উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের জন্য জুমআর নামায ফরয নয়। কিন্তু যোহরের নামায অবশ্যই ফরয। পরন্তু যদি তারাও জুমআর মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামাআতে জুমুআহ পড়ে নেয়, তাহলে তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে তাদের জুমুআহ হয়ে যাবে এবং যোহরের নামায মাফ হয়ে যাবে।

একাধিক হাদীস এ কথা প্রমাণ করে যে, মহানবী (সাঃ) এবং খুলাফায়ে রাশেদ্বীন (রাঃ) দের যুগে মহিলারা জুমুআহ ও জামাআতে উপস্থিত হয়ে নামায আদায় করত।

উল্লেখ্য যে, কোন মুসাফির জুমুআহ খুতবা দিলে ও ইমামতি করলে তা শুদ্ধ হয়ে যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৩)

জুমআর জামাআতে কোন মুসাফির যোহরের কসর আদায় করার নিয়ত করতে পারে না। কারণ, যোহ্‌র অপেক্ষা জুমআর ফযীলত অনেক বেশী। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭৪)

জুমআর সময়
অধিকাংশ সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণের নিকট জুমআর সময় যোহরের সময় একই। অর্থাৎ, সূর্য ঢলার পর থেকে নিয়ে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হওয়া (আসরের আগে) পর্যন্ত।

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) জুমুআহ তখন পড়তেন, যখন সূর্য পশ্চিম আকাশেঢলে যেত।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)

ইমাম বুখারী বলেন, ‘জুমআর সময় সূর্য ঢলার পরই শুরু হয়। হযরত উমার, আলী, নু’মান বিন বাশীর এবং আম্‌র বিন হুয়াইরিষ কর্তৃক এ ব্যাপারে বর্ণনা পাওয়া যায়।’ (বুখারী)

হযরত সালামাহ্‌ বিন আকওয়া’ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা যখন নবী (সাঃ)-এর সাথে জুমআর নামায পড়ে ঘরে ফিরতাম, তখন দেওয়ালের কোন ছায়া থাকত না।’ (বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘ঠান্ডা খুব বেশী হলে নবী (সাঃ) জুমআর নামায সকাল সকাল পড়তেন এবং গরম খুব বেশী হলে দেরী করে পড়তেন।’ (বুখারী)

অবশ্য সূর্য ঢলার পূর্বেও জুমুআহ পড়া বৈধ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ২২-২৫পৃ:) তবে সূর্য ঢলার পরই জুমুআহর (খুতবার) আযান হওয়া উত্তম। কারণ, প্রথমত: এতে অধিকাংশ উলামার সাথে সহ্‌মত প্রকাশ হয়। দ্বিতীয়ত: যারা জুমআয়হাজির হয় না এবং সময়ের খবর না রেখে আযান শুনে নামায পড়তে অভ্যাসী (ওযরগ্রস্ত ও মহিলারা) সময় হওয়ার পূর্বেই নামায পড়ে ফেলে না। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ৫/৩৪)

প্রকাশ থাকে যে, সকাল সকাল মসজিদে গিয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ্‌ অন্যান্য নফল পড়া সূর্য ঠিক মাথার উপরে থাকার সময়ে হলেও তা নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। (ঐ)

জুমআর জন্য নিম্নতম নামাযী সংখ্যা

জুমআর নামায যেহেতু জামাআত সহকারে ফরয, সেহেতু যে কয় জন লোক নিয়ে জামাআত হবে, সে কয় জন লোক নিয়ে জুমআহও প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট লোক সংখ্যা হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়।

জুমআর স্থান
জুমুআহ যেমন শহরবাসীর জন্য ফরয, তেমনি ফরয গ্রামবাসীর জন্যও। এর জন্য খলীফা হওয়া, শহর হওয়া, জামে মসজিদ হওয়া বা ৪০ জন নামাযী হওয়া শর্ত নয়। বরং যেখানেই স্থানীয় স্থায়ী বসবাসকারী জামাআত পাওয়া যাবে, সেখানেই জুমুআহ ফরয। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২২/৭৫, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২৪)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ)-এর মসজিদে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসলামে সর্বপ্রথম যে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হল বাহ্‌রাইনের জুয়াষা নামক এক গ্রামে।’ (বুখারী ৮৯২, ৪৩৭১, আবূদাঊদ, সুনান ১০৬৮নং)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) মক্কা মুকার্রামা ও মদ্বীনা নববিয়ার মধ্যবর্তী পথে অবস্থিত ছোট ছোট জনপদে জুমুআহ প্রতিষ্ঠিত হতে লক্ষ্য করতেন। তিনি তাতে কোন আপত্তি জানাতেন না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ)

হযরত উমার (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক, সেখানেই জুমুআহ পড়।’ (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৩২পৃ:)

পক্ষান্তরে পাড়া-গ্রামে জুমুআহ হবে না বলে হযরত আলী কর্তৃক যে হাদীস বর্ণনা করা হয়, তা সহীহ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৬/৩৫২-৩৫৪, ২২/৭৫)

কোন অমুসলিম দেশে পড়াশোনা বা চাকরী করতে গিয়ে সেখানে মসজিদ না থাকলে বা যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম না থাকলেও ৩ জনেই যে কোন রুমে জুমুআহ কায়েম হবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৮৫)

একই বড় গ্রাম বা শহরে বিচ্ছন্নতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়, বরং মসজিদ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে, অথবা দূর হওয়ার কারণে, অথবা ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনে একাধিক মসজিদে জুমুআহ কায়েম করা যায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৮/১১১, ১৯/১৬৫-১৬৬)

কোন মসজিদে জুমুআহ পড়ার জন্য নির্মাণের সময় ঐ নিয়ত শর্ত নয়। অক্তিয়ারুপে নির্মাণের পর প্রয়োজনে সেখানে জুমুআহ পড়া যায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৮/১১০)

জুমআর আযান
মহানবী (সাঃ), হযরত আবূ বাকর ও হযরত উমার (রাঃ)-এর যামানায় জুমআর মাত্র ১টি আযানই প্রচলিত ছিল। আর এ আযান দেওয়া হত, যখন ইমাম খুতবাহ্‌ দেওয়ার জন্য মিম্বরে চড়ে বসতেন তখন মসজিদের দরজার সামনে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে। এইরুপ আযান চালু ছিল হযরত আবূ বাকর, উমারের খেলাফত কাল পর্যন্ত। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) মদ্বীনার বাড়ি-ঘর দূরে দূরে এবং জনসংখ্যা বেশী দেখে উক্ত আযানের পূর্বে আরো একটি অতিরিক্ত আযান চালু করলেন। যাতে লোকেরা পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে জুমআর খুতবাহ্‌ শুনতে প্রথম থেকেই উপস্থিত হয়। আর এই আযান দেওয়া হত বাজারে যাওরা নামক একটি উঁচু ঘরের ছাদে। এ আযান শুনে লোকেরা জুমুআহর সময় উপস্থিত হয়েছে বলে জানতে পারত। এইভাবে ঐ আযান প্রচলিত থাকল। এতে কেউ তাঁর প্রতিবাদ বা সমালোচনা করল না। অথচ মিনায় (২ রাকআতের জায়গায়) ৪ রাকআত নামায পড়ার কারণে লোকেরা তাঁর সমালোচনা করেছিল। (বুখারী, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৮-৯পৃ:)

বলাই বাহুল্য যে, যে কাজ একজন খলীফায়ে রাশেদ করেছেন তা বিদআত হতে পারে না। বিশেষ করে মহানবী (সাঃ)-এর বিরোধিতা নেই যেখানে সেখানে সাহাবীর ইজতিহাদ ও আমল আমাদের জন্যও সুন্নত। কেননা, মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আমার পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার সুন্নাহ্‌ (পথ ও আদর্শ) এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাহ্‌ অবলম্বন করো। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করো, দাঁতে কামড়ে ধরো। আর দ্বীনে নবরচিত কর্ম থেকে সাবধান থেকো। কারণ প্রত্যেক নবরচিত (দ্বীনী) কর্মই হল ‘বিদআত’। আর প্রত্যেক বিদআতই হল ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৬০৭, তিরমিযী, সুনান ২৮১৫ নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১৬৫নং) (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭৫)

অতএব যদি অনুরুপ প্রয়োজন বোধ করে মাঠে-ঘাটে ও অফিসে-বাজারে সর্বসাধারণকে জুমআর জন্য প্রস্তুত হওয়ার কথা জানানো একান্ত জরুরী হয়েই থাকে, তাহলে তৃতীয় খলীফার সে সুন্নত ব্যবহার করতে আমাদের বাধা কোথায়?

পক্ষান্তরে বিদআত ও বাধা হল, একই উদ্দেশ্যে এর পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা। যেমন, মাইকে জুমআর সময় বলে দেওয়া, ওযূ-গোসল সেরে মসজিদে আসতে  অনুরোধ করা, সূরা জুমআর শেষ ৩টি আয়াত পাঠ করা, গজল পড়া, বেল বা ঘন্টা বাজানো ইত্যাদি। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১১, ৪২১)

অবশ্য এই আযান দিতে হবে খুতবার আযানের সময়ের যথেষ্ট পূর্বে। নচেৎ, আযানের প্রধান উদ্দেশ্যই বাতিল হয়ে যাবে। যেমন ৫ বা ১০ মিনিট আগে হলে তাতে তেমন কিছু লাভ পরিলক্ষিত হবে না। অন্ততঃপক্ষে আধা থেকে এক ঘন্টা আগে হলে তবেই উদ্দেশ্য সফল হবে।

উল্লেখ্য যে, জুমআর দিন (খুতবার আগে দ্বিতীয়) আযান হওয়ার পর বেচা-কেনা (অনুরুপ সফর করা) হারাম হয়ে যায়। কারণ, মহান আল্লাহর আদেশ হল, “হে ঈমানদারগণ! যখন জুমআর দিন নামাযের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা সত্বর আল্লাহর স্মরণের জন্য উপস্থিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্জন কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।” (কুরআন মাজীদ ৬২/৯)

দ্বিতীয় আযান (মাইকে হলেও) দেওয়া উচিৎ মসজিদের সামনে কোন উঁচু জায়গায়। এ আযান মসজিদের ভিতরে মিম্বরের সামনে দেওয়া বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ১৪-১৯পৃ:)

জুমআর খুতবার আহ্‌কাম
জুমআর খুতবার দুটি অংশ। প্রথম অংশটি প্রথম খুতবা এবং শেষ অংশটি দ্বিতীয় খুতবা নামে প্রসিদ্ধ। খুতবাহ্‌ মানে হল ভাষণ বা বক্তৃতা। এই ভাষণ দেওয়া ও শোনার বহু নিয়ম-নীতি আছে। যার কিছু নিম্নরুপ :-

খুতবার জন্য ওযূ হওয়া শর্ত নয়। তবে খুতবার পরেই যেহেতু নামায, তাই ওযু থাকা বাঞ্ছনীয়। খুতবা চলাকালে খতীবের ওযূ নষ্ট হলে খুতবার পর তিনি ওযূ করবেন এবং সে পর্যন্ত লোকেরা অপেক্ষা করবে। (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দার্ব, ইবনে উষাইমীন ১/২০৮)

খুতবা পরিবেশিত হবে দন্ডায়মান অবস্থায়। বিনা ওজরে বসে জুমআর খুতবা সহীহ নয়।

মহানবী (সাঃ) খুতবায় দাঁড়াবার সময় লাঠি অথবা ধনুকের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১০৯৬নং)  অবশ্য অনেকে বলেন, এ ছিল মিম্বর বানানোর পূর্বে। অল্লাহু আ’লাম।

মহানবী (সাঃ)-এর অধিকাংশ সময়ে মাথায় পাগড়ী ব্যবহার করতেন। সুতরাং যারা পাগড়ী ব্যবহার করে না তাদের বিশেষ করে জুমুআহ বা খুতবার জন্য পাগড়ী ব্যবহার করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৭পৃ:)

জুমআর খুতবা হবে কোন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে। যাতে সকল নামাযীকে খতীব দেখতে পান এবং তাঁকে সকলে দেখতে পায়। এ ক্ষেত্রে ২ থাকি বা ৩ থাকি অথবা তার চেয়ে বেশী থাকির কোন প্রশ্ন নেই। আসল উদ্দেশ্য হল উঁচু জায়গা। অতঃপর সেই উঁচু জায়গায় পৌঁছনোর জন্য যতটা সিড়ির দরকার ততটা করা যাবে। এতে বাধ্যতামূলক কোন নীতি নেই। শুরুতে মহানবী (সাঃ) একটি খেজুর গাছের উপর খুতবা দিতেন। তারপর এক ছুতোর সাহাবী তাঁকে একটি মিম্বর বানিয়ে দিয়েছিলেন; যার সিড়ি ছিল ২টি। (আবূদাঊদ, সুনান ১০৮১নং)  এই দুই সিড়ি চড়ে তৃতীয় (শেষ) ধাপে মহানবী (সাঃ) বসতেন। বলা বাহুল্য, তাঁর মিম্বর ছিল তিন ধাপ বিশিষ্ট। আর এটাই হল সুন্নত। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩১) (এবং করতে হয় মনে করে) তার বেশী ধাপ করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৭পৃ:)

বিশেষ করে জুমআর জন্য জুমআর দিন মিম্বরের উপর কার্পেট বিছানো বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৬৬পৃ:)

মিম্বরে চড়ে মহানবী (সাঃ)  মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে সালাম দিতেন। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১০৯, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২০৭৬নং) এরপর বসে যেতেন। মুআযযিন আযান শেষ করলে উঠে দাঁড়াতেন।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। তিনি খুতবায় কুরআনের আয়াত পাঠ করে লোকেদেরকে নসীহত করতেন। (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

খুতবাহ্‌ হবে মহান আল্লাহর প্রশংসা, মহানবীর নবুওয়াতের সাক্ষ্য, আল্লাহর তাওহীদের গুরুত্ব, ঈমান ও ইসলামের শাখা-প্রশাখার আলোচনা, হালাল ও হারামের বিভিন্ন আহ্‌কাম, কুরআন মাজীদের কিছু সূরা বা আয়াত পাঠ, লোকেদের জন্য উপদেশ, আদেশ-নিষেধ বা ওয়ায-নসীহত এবং মুসলিম সর্বসাধারণের জন্য দুআ সম্বলিত।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে খুতবায় তাশাহহুদ, শাহাদত বা আল্লাহর তাওহীদের ও রসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য থাকে না, তা কাটা হাতের মত (ঠুঁটো)।” (আবূদাঊদ, সুনান ৪৮৪১, জামে ৪৫২০নং)

তাঁর খুতবার ভূমিকায় মহানবী (সাঃ) যা পাঠ করতেন তা বক্ষ্যমাণ পুস্তকের (প্রথম খন্ডের) ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ খুতবা পাঠ করার পর তিনি ‘আম্মা বা’দ’ (অতঃপর) বলতেন।

কখনো কখনো মহানবী ঐ খুতবায় উল্লেখিত আয়াত ৩টি পাঠ করতেন না। কখনো কখনো আম্মা বা’দের পর বলতেন,

فإن خير الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد (সাঃ)، وشر الأمور محدثاتها،

 وكل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة، وكل ضلالة في النار।

অর্থাৎ, অতঃপর নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী আল্লাহর গ্রন্থ। সর্বশ্রেষ্ঠ হেদায়াত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হেদায়াত। আর সর্বনিকৃষ্ট কর্ম হল নব রচিত কর্ম। প্রত্যেক নব রচিত কর্মই বিদআত। প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা দোযখে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৩৪-৩৩৫পৃ:)

তিনি খুতবায় সূরা ক্বাফ এত বেশী পাঠ করতেন যে, উম্মে হিশাম (রাঃ) প্রায় জুমআতে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে মিম্বরের উপরে পাঠ করতে শুনে তা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৭২-৮৭৩নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান)

তারপর একটি খুতবা দিয়ে একটু বসতেন।

এ বৈঠকে পঠনীয় কোন দুআ বা যিক্‌র নেই। খতীব বা মুক্তাদী সকলের জন্যই এ সময়ে সূরা ইখলাস পাঠ করা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ১২২পৃ:)  মহানবী (সাঃ) বসে কোন কথা বলতেন না। অতঃপর উঠে দ্বিতীয় খুতবা দিতেন। (বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ১০৯২, ১০৯৫নং)

এই সময় (দুই খুতবার মাঝে) কারো দুআ করা এবং তার জন্য হাত তোলা বিধেয় নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭০পৃ:)

তাঁর উভয় খুতবাতেই নসীহত হত। সুতরাং একটি খুতবাতে কেবল ক্বিরাআত এবং অপর খুতবাতে কেবল নসীহত, অথবা একটি খুতবাতে নসীহত এবং অপরটিতে কেবল দুআ করা সঠিক নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭১পৃ:)

খুতবা হবে সংক্ষেপ অথচ ব্যাপক বিষয়ভিত্তিক। মহানবী (সাঃ)-এর খুতবা এবং নামায মাঝামাঝি ধরনের হত। (মুসলিম, সহীহ ৮৬৬, আহমাদ, মুসনাদ ১১০১, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান) তিনি বলতেন, “(খতীব) মানুষের নামায লম্বা এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া তার দ্বীনী জ্ঞান থাকার পরিচয়। সুতরাং তোমরা নামাযকে লম্বা এবং খুতবাকে সংক্ষেপ কর।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৬৯নং) হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে খুতবা ছোট করতে আদেশ দিয়েছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান ১১০৬নং)

জুমআর খুতবার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া এবং উচ্চস্বরে প্রভাবশালী ও হৃদয় গ্রাহী ভাষা ব্যবহার করে পরিবেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি সামনে রেখে ভাষণ দান করা খতীবের কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) যখন খুতবা দিতেন, তখন তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠস্বর উঁচু হত এবং তাঁর ক্রোধ বেড়ে যেত; যেন তিনি লোকেদেরকে এমন এক সেনাবাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করছেন, যা আজই সন্ধ্যা অথবা সকালে তাদেরকে এসে আক্রমণ করবে। (মুসলিম,  ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

গান গাওয়ার মত সুর করে খুতবা দেওয়া বিধেয় নয়, বরং তা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭২পৃ:)

খতীবের উচিৎ, খুতবায় দুর্বল ও জাল হাদীস ব্যবহার না করা। প্রত্যেক খুতবা প্রস্তুত করার সময় ছাঁকা ও গবেষণালব্ধ কথা বেছে নেওয়া উচিৎ।

জুমুআহবারীয় খুতবার মধ্যে খতীব মুসলিম জনসাধারণকে সহীহ আকীদাহ্‌ শিক্ষা দেবেন, কুসংস্কার নির্মূল করবেন, বিদআত অনুপ্রবেশ করার ব্যাপারে ও তা বর্জন করতে আহবান জানাবেন। সচ্চরিত্রতা ও শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দেবেন। ইসলামের বিরুদ্ধে সকল প্রকার সন্দেহের নিরসন ঘটাবেন। মার্জিত ভাষায় ও ভঙ্গিমায় বাতিল মতবাদ ও বক্তৃতা-লেখনীর খন্ডন করবেন। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ও ঐক্যের উপর বিশেষ জোর দিয়ে তার গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলবেন ভাষণের মাধ্যমে। উদ্বুদ্ধ করবেন মযহাব, ভাষা, বর্ণ ও বংশ ভিত্তিক সকল প্রকার অন্ধ পক্ষপাতিত্ব ও তরফদারী বর্জন করতে।

মিম্বর মুসলিম জনসাধারণের। এ মিম্বরকে বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। কোন দলেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তরফদারী করা যাবে না এতে চড়ে। খতীব সাহেব সাধারণভাবে সকলকে নসীহত করবেন। তিনি হবেন সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। অবশ্য ইসলাম-বিরোধী কোন কথা বা কাজে তিনি কারো তোষামোদ করবেন না।

বলা বাহুল্য, মসজিদ আল্লাহর ঘর। এটা কোন মানবরচিত রাজনীতির আখড়া নয়। এখানে দ্বীন উঁচু করার কথা ছাড়া অন্য দল বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা আলোচিত হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

وأَنَّ الْمَسَاجِدَ للهِ فَلاَ تَدْعُوْا مَعَ اللهِ أَحَداً

অর্থাৎ, আর অবশ্যই মসজিদসমূহ আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকে আহবান করো না। (কুরআন মাজীদ ৭২/১৮)

খুতবা দানে বিভিন্ন উপলক্ষ্য সামনে রাখবেন খতীব। মৌসম অনুপাতে খুতবার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করবেন। বারো চাঁদের খুতবার মত বাঁধা-ধরা খুতবা পাঠ করেই দায় সারা করে কর্তব্য পালন করবেন না।

সপ্তাহান্তে একবার এই বক্তৃতা একটি সুবর্ণ সুযোগ দ্বীনের আহ্‌বায়কের জন্য। যেহেতু এই দিনে নামাযী-বেনামাযী, আমীর-গরীব, মুমিন-মুনাফিক এবং অনেক সময় মুসলিম নামধারী নাস্তিকও কোন স্বার্থের খাতিরে উপস্থিত হয়ে থাকে। সুতরাং এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সকলের কাছে আল্লাহর বিধান পৌঁছে দেওয়া খতীবের কর্তব্য।

খুতবায় হাত তুলে দুআ বিধেয় নয়। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭২পৃ:) বরং এই সময় কেবল তর্জনীর ইশারায় দুআ করা বিধেয়। খতীবকে হাত তুলে দুআ করতে দেখে বহু সলফ বদ-দু’আ করতেন।

বিশর বিন মারওয়ানকে খুতবায় হাত তুলে দুআ করতে দেখে উমারাহ্‌ বিন রুয়াইবাহ্‌ বললেন, ‘ঐ হাত দুটিকে আল্লাহ বিকৃত করুন।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৭৪, আবূদাঊদ, সুনান ১১০৪নং)

মাসরুক বলেন, ‘(জুমআর দিন ইমাম-মুক্তাদী মিলে যারা হাত তুলে দুআ করে) আল্লাহ তাদের হাত কেটে নিন।’ (ইবনে আবী শাইবা ৫৪৯১ ও ৫৪৯৩ নং)

বিধেয় নয় মুক্তাদীদের হাত তুলে দুআ। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৩পৃ:) বরং ইমাম খুতবায় (হাত না তুলে) দুআ করলে, মুক্তাদীহাত না তুলেই একাকী নিম্নস্বরে বা চুপে-চুপে ‘আমীন’ বলবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২৭, ৪২৮)

হ্যাঁ, খুতবায় বৃষ্টি প্রার্থনা বা বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য দুআ করার সময় ইমাম-মুক্তাদী সকলে হাত তুলে ইমাম দুআ করবেন এবং মুক্তাদীরা ‘আমীন-আমীন’ বলবে। (বুখারী ৯৩২, ৯৩৩, ১০১৩, ১০২৯, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং)

কোন জরুরী কারণে খুতবা ত্যাগ করে প্রয়োজন সেরে পুনরায় খুতবা পূর্ণ করা খতীবের জন্য বৈধ। একদা মহানবী (সাঃ) খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় হযরত হাসান ও হুসাইন (রাঃ) পড়ে-উঠে তাঁর সামনে আসতে লাগলে তিনি মিম্বর থেকে নিচে নেমে তাঁদেরকে উপরে তুলে নিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআলা সত্যই বলেছেন,

(إنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلاَدُكُمْ فِتْنَةٌ)

(অর্থাৎ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য ফিতনাই তো।) আমি এদেরকে পড়ে-উঠে চলে আসতে দেখে ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বরং খুতবা বন্ধ করে এদেরকে তুলে নিলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌)

হযরত আবূ রিফাআহ্‌ আদাবী (রাঃ) বলেন, একদা আমি মসজিদে এসে দেখলাম নবী (সাঃ) খুতবা দিচ্ছেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! একজন অপরিচিত বিদেশী মানুষ; যার দ্বীন সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই। এক্ষণে সে জ্ঞান লাভ করতে চায়।’ তিনি খুতবা ছেড়ে দিয়ে আমার প্রতি অভিমুখ করলেন। এমনকি তিনি আমার নিকট এসে একটি কাঠের চেয়ার আনতে বললেন যার পায়া ছিল লোহার। তিনি তারই উপর বসে আমাকে দ্বীনের কথা বললেন। অতঃপর মিম্বরে এসে খুতবা পূর্ণ করলেন। (মুসলিম, সহীহ ৮৭৬নং, নাসাঈ, সুনান)

প্রকাশ থাকে যে, জরুরী মনে করে নিয়মিতভাবে إن الله وملائكته।।।  এবং

 اذكروا الله يذكركم।।। আয়াত পাঠ করে খুতবা শেষ করা বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৩পৃ:)

জুমআয় উপস্থিত ব্যক্তির কর্তব্য
নামাযীর জন্য যথাসম্ভব ইমামের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা আল্লাহর যিকরে উপস্থিত হও এবং ইমামের নিকটবর্তী হও। আর লোকে দূর হতে থাকলে বেহেশত প্রবেশেও দেরী হবে তার; যদিও সে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১০৮নং)

জুমআর দিন নামাযী মসজিদে এসে যেখানে জায়গা পাবে সেখানে বসে যাবে। দেরী করে এসে (সামনের কাতারে ফাঁক থাকলেও) কাতার চিরে সামনে যাওয়া এবং তাতে অন্যান্য নামাযীদেরকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক জুমআর দিনে এক ব্যক্তি লোকেদের কাতার চিরে (মসজিদের ভিতর) এল। সে সময় নবী (সাঃ) খুতবা দিচ্ছিলেন। তাকে দেখে নবী (সাঃ) বললেন, “বসে যাও, তুমি বেশ কষ্ট দিয়েছ এবং দেরী করেও এসেছ।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৩ নং)

খুতবা চলাকালে মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তির জন্য নামায নিষিদ্ধ। কিন্তু এই সময়ে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তার জন্য হাল্কা করে ২ রাকআত নামায পড়া বিধেয়। যেমন কাউকে নামায না পড়ে বসতে দেখলে খতীবের উচিৎ তাকে ঐ নামায পড়তে আদেশ করা। খুতবা শোনা ওয়াজেব হলেও এ নামাযের গুরুত্ব দিয়েছেন খোদ মহানবী (সাঃ)। একদা খুতবা চলাকালে এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লে তিনি তাকে বললেন, “তুমি নামায পড়েছ কি?” লোকটা বলল, না। তিনি বললেন, “ওঠ এবংহাল্কা করে ২ রাকআত পড়ে নাও।” (বুখারী ৯৩০, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ১১১৫-১১১৬, তিরমিযী, সুনান ৫১০নং) অতঃপর তিনি সকলের জন্য চিরস্থায়ী একটি বিধান দেওয়ার উদ্দেশ্যে লোকেদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “তোমাদের কেউযখন ইমামের খুতবা দেওয়া কালীন সময়ে উপস্থিত হয়, সে যেন (সংক্ষেপে) ২ রাকআত নামায পড়ে নেয়।” (বুখারী, ১১৭০, মুসলিম, সহীহ ৮৭৫, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৭নং)

একদা হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) মসজিদ প্রবেশ করলেন। তখন মারওয়ান খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি নামায পড়তে শুরু করলে প্রহ্‌রীরা তাঁকে বসতে আদেশ করল। কিন্তু তিনি তাদের কথা না শুনেই নামায শেষ করলেন। নামায শেষে লোকেরা তাকে বলল, আল্লাহ আপনাকে রহ্‌ম করুন। এক্ষনি ওরা যে আপনার অপমান করত। উত্তরে তিনি বললেন, আমি সে নামায ছাড়ব কেন, যে নামায পড়তে নবী (সাঃ)-কে আদেশ করতে দেখেছি। (তিরমিযী, সুনান ৫১১নং)

বলা বাহুল্য, খুতবা শুরু হলে লাল বাতি জ্বেলে দেওয়া, অথবা কাউকে ঐ ২ রাকআত নামায পড়তে দেখে চোখ লাল করা, অথবা তার জামা ধরে টান দেওয়া, অথবা খোদ খতীব সাহেবের মানা করা সুন্নাহ্‌-বিরোধী তথা বিদআত কাজ।

জুমআর আযানের সময় মসজিদে এলে দাঁড়িয়ে থেকে আযানের উত্তর না দিয়ে, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়ে খুতবা শোনার জন্য বসে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৩৫, ৩৪৯)

প্রকাশ থাকে যে, আযানের উত্তর দেওয়া মুস্তাহাব। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪০পৃ:) আর খুতবা শোনা ওয়াজেব। সুতরাং আযানের সময় পার করে খুতবা শুরু হলে নামায পড়া বৈধ নয়। পক্ষান্তরে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ ওয়াজেব না হলেও ঐ সময় মহানবী (সাঃ)-এর মহা আদেশ পালন করা জরুরী।

ইমামের দিকে চেহারা করে বসা মুস্তাহাব। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন মিম্বরে চড়তেন, তখন আমরা আমাদের চেহারা তাঁর দিকে ফিরিয়ে বসতাম।’ (তিরমিযী, সুনান ৫০৯নং)

পরিধানে লুঙ্গি বা লুঙ্গি জাতীয় এক কাপড় পরে খুতবা চলাকালে বসার সময় উভয় হাঁটুকে খাড়া করে রানের সাথে লাগিয়ে উভয় পা-কে দুইহাত দ্বারা জড়িয়ে ধরে অথবা কাপড় দ্বারা বেঁধে বসা বৈধ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ১১১০, তিরমিযী, সুনান ৫১৪নং)  কারণ, এতে শরমগাহ্‌ প্রকাশ পাওয়ার, চট করে ঘুম চলে আসার এবং তাতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাই।

খুতবা শোনা ওয়াজেব। আর এ সময় সকল প্রকার কথাবার্তা, সালাম ও সালামের উত্তর, হাঁচির হামদের জবাব, এমনকি আপত্তিকর কাজে বাধা দেওয়াও নিষিদ্ধ।

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দানকালে কথা বললে তুমি অনর্থ কর্ম করলে এবং (জুমুআহ) বাতিল করলে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭১৬ নং)

উক্ত হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “জুমআর দিন ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় যদি তুমি তোমার (কথা বলছে এমন) সঙ্গীকে ‘চুপ কর’ বল তাহলে তুমিও অসার কর্ম করবে।” (বুখারী ৯৩৪, মুসলিম, সহীহ ৮৫১নং, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

‘অসার বা অনর্থক কর্ম করবে’ এর একাধিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে; যেমন, তুমি জুমআর সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। অথবা তোমারও কথা বলা হবে। অথবা তুমিও ভুল করবে। অথবা তোমার জুমুআহ বাতিল হয়ে যাবে। অথবা তোমার জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে -ইত্যাদি। তবে বিশেষজ্ঞ উলামাদের নিকট শেষোক্ত ব্যাখ্যাই নির্ভরযোগ্য। কারণ, এরুপ ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করল, তার স্ত্রীর সুগন্ধি (আতর) থাকলে তা  ব্যবহার করল, উত্তম লেবাস পরিধান করল, অতঃপর (মসজিদে এসে) লোকেদের কাতার চিরে (আগে অতিক্রম) করল না এবং ইমামের উপদেশ দানকালে কোন বাজে কর্ম করল না, সে ব্যক্তির জন্য তা উভয় জুমআর মধ্যবর্তী কৃত পাপের কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি অনর্থক কর্ম করল এবং লোকেদের কাতার চিরে সামনে অতিক্রম করল সে ব্যক্তির জুমুআহ যোহরে পরিণত হয়ে যাবে।” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৭২০নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “জুমআর দিন ৩ শ্রেণীর মানুষ (মসজিদে) উপস্থিত হয়। প্রথম শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে বাজে কথা বলে; তার সেটাই হল প্রাপ্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে দুআ করে; আর সে এমন লোক, যে আল্লাহর কাছে দুআ করে, আল্লাহ তার দুআ কবুল করেন অথবা না করেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত হয়ে চুপ ও নির্বাক থাকে, কোন মুসলিমের কাঁধ ডিঙিয়ে (কাতার চিরে) আগে যায় না এবং কাউকে কোন প্রকার কষ্ট দেয় না। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য তার ঐ কাজের ফলে তার ঐ জুমুআহ থেকে আগামী জুমুআহ পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত ৩ দিনে (অর্থাৎ, ১০ দিনে) কৃত গুনাহর কাফফারা হবে। কেননা আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল্‌ বলেন, (من جاء بالحسنة فله عشر أمثالها) (অর্থাৎ, যে ব্যক্তি একটি সওয়াবের কাজ করবে, সে তার ১০ গুণ সওয়াব লাভ করবে।)” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১১১৩নং)

আলকামাহ্‌ বিন আব্দুল্লাহর সাথে তাঁর এক সাথী খুতবা চলাকালে কথা বলছিল। তিনি তাকে চুপ করতে বললেন। নামাযের পর ইবনে উমার (রাঃ)-এর কাছে এ কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন, ‘তোমার তো জুমুআহই হয়নি। আর তোমার সাথী হল একটা গাধা।’ (ইবনে আবী শাইবা ৫৩০৩নং)

প্রকাশ থাকে যে, ইমাম মিম্বরের উপর বসে থাকা অবস্থায়, অর্থাৎ খুতবা বন্ধ থাকা অবস্থায় কথা বলা অবৈধ নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু১৭৩পৃ:) যেমন ইমামের খুতবা শুরু না করা পর্যন্ত (প্রয়োজনীয়) কথাবার্তা (এমনকি আযানের সময়ও) বলা বৈধ। ষা’লাবাহ্‌ বিন আবী মালেক কুরাযী বলেন, হযরত উমার ও উসমানের যুগে ইমাম বের হলে আমরা নামায ত্যাগ করতাম এবং ইমাম খুতবা শুরু করলে আমরা কথা বলা ত্যাগ করতাম। (ইবনে আবী শাইবা, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪০পৃ:)

খুতবা চলা অবস্থায় কেউ মসজিদ এলে মসজিদে প্রবেশ করার আগে রাস্তায় খুতবা শুনতে পেলে রাস্তাতেও কারো সঙ্গে কথা বলাও বৈধ নয়।

বৈধ নয় খুতবা চলা অবস্থায় হাতে কোন কিছু নিয়ে ফালতু খেলা করা। যেমন মিসওয়াক করা, তাসবীহ-মালা (?) নিয়ে খেলা করা, মসজিদের মেঝে, কাঁকর বা কুটো স্পর্শ করে খেলা করা ইত্যাদি। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে জুমআর উদ্দেশ্যে (মসজিদে) উপস্থিত হয়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে (খুতবাহ্‌) শ্রবণ করে ও নীরব থাকে সেই ব্যক্তির ঐ জুমুআহ  থেকে দ্বিতীয় জুমুআহর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের পাপ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (খুতবা চলাকালে) কাঁকর স্পর্শ করে সে অসার (ভুল) কাজ করে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৫৭ নং, আবূদাঊদ, সুনান ১০৫০, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

খুতবা চলাকালে তন্দ্রা (ঢুল) এলে জায়গা পরিবর্তন করে বসা বিধেয়। এতে তন্দ্রা দূরীভূত হয়ে যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউমসজিদে বসে ঢুললে সে যেন তার বসার জায়গা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় বসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৯ নং, তিরমিযী, সুনান, জামে ৮০৯নং)

কাউকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে সেখানে বসা, কেউ কোন কারণে জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে এবং সে ফিরে আসবে ধারণা হওয়া সত্ত্বেও তার সেই জায়গায় বসা বৈধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নিজ জায়গা ছেড়ে উঠে যায় এবং পরক্ষণে সে ফিরে আসে, তাহলে সেই ঐ জায়গার অধিক হ্‌কদার।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) কেউ তার জায়গা ছেড়ে উঠে গেলে সে জায়গায় বসতেন না। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ)

কিন্তু খুতবা শুনতে শুনতে ঘুম এলে (কথা না বলে) ইঙ্গিতে পাশের সাথীর সাথে জায়গা বদল করা উত্তম। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ জুমআর দিন ঢুলতে শুরু করে, তখন তার উচিৎ তার সঙ্গীর জায়গায় গিয়ে বসা এবং তার সঙ্গীর উচিৎ তার ঐ জায়গায় বসা।” (বায়হাকী, জামে ৮১২নং)

জ্ঞাতব্য যে, ইমামের কলেমা অথবা দরুদ পড়ার সাথে সাথে মুসল্লীদের সমস্বরে সশব্দে তা পড়া বিদআত। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ২৬৫পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, বিশেষ করে জুমুআহ বা ঈদের নামাযে অত্যন্ত ভিঁড়ের ফলে যদি সিজদাহ করার জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলেও জামাআতে নামায পড়তে হবে। আর এই অবস্থায় সামনের নামাযীর পিঠে সিজদা করতে হবে। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) আমাদের কাছে সিজদার সূরা পড়তেন। অতঃপর সিজদায় জায়গায় তিনি সিজদাহ করতেন এবং আমরাও সিজদাহ করতাম। এমনকি ভিঁড়ের ফলে আমাদের কেউ সিজদাহ করার মত জায়গা না পেলে অপরের (পিঠের) উপরে সিজদাহ করতাম।’ (বুখারী ১০৭৬নং)

হযরত উমার বলেন, পিঠের উপর উপর সিজদাহ করতে হবে। এই মত গ্রহণ করেছেন কুফাবাসীগণ, ইমাম আহমাদ এবং ইসহাক। পক্ষান্তরে আত্বা ও যুহ্‌রী বলেন, সামনের লোকের উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে উঠে গেলে তারপর সিজদাহ করবে। আর এমত গ্রহণ করেছেন ইমাম মালেক ও অধিকাংশ উলামাগণ। (কিন্তু এর ফলে ইমামের বিরোধিতা হবে।) ইমাম বুখারীর লিখার ভঙ্গিতে বুঝা যায় যে, তিনি মনে করেন, এই অবস্থায় নামাযী নিজ সামথ্য অনুযায়ী সিজদাহ করবে। এমনকি নিজ ভায়ের পিঠে সিজদাহ করতে হলে তাও করবে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৬৫২)

অবশ্য (মাসজিদুলহারামাইনে) সামনে মহিলা পড়লে সিজদাহ না করে একটু ঝুঁকে বা ইশারায় নামায আদায় করবে।

স্থানীয় ভাষায় খুতবা
জুমআর জমায়েত মুসলিমদের একটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র। সাপ্তাহিক এই প্রশিক্ষণে মুসলিমের বিস্মৃত কথা স্মরণ হয়, চলার পথে অন্ধকারে আলোর দিশা পায়, সুন্দর চরিত্র ও ব্যবহার গড়তে সহায়তা পায়, ঈমান নবায়ন হয়, হৃদয় নরম হয়, মৃত্যু ও পরকালের স্মরণ হয়, তওবা করতে অনুপ্রাণিত হয়, ভালো কাজ করতে এবং খারাপ কাজ বর্জন করতে উৎসাহ্‌ পায়, ইত্যাদি।

তাই খুতবার ভূমিকা আরবীতে হওয়ার পর স্থানীয় ভাষায় বাকী খুতবা পাঠ বৈধ। যেহেতু খুতবার আসল উদ্দেশ্য হল জনসাধারণকে শরীয়তের শিক্ষা ও উপদেশ দান করা। আর তা আরবীতে হলে উদ্দেশ্য বিফল হয়। সুতরাং যে খুতবা আরবীতে হত তারই ভাবার্থ স্থানীয় ভাষায় হলে মুসলিমদেরকে সপ্তাহান্তে একবার উপদেশ ও পথ নির্দেশনা দান করার মত মহান উদ্দেশ্য সাধিত হয়। পক্ষান্তরে খুতবা নামাযের মত নয়। নামাযে অন্য ভাষা বললে নামায বাতিল। কিন্তু খুতবা তা নয়। যেমন খুতবা ছেড়ে অন্য কথা বলা যায়, নামাযে তা যায় না। ইত্যাদি। (দ্র: ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪২২-৪২৩, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৮৪)

পক্ষান্তরে খুতবার আগে স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেওয়া বিধেয় নয়। কারণ, উপায় থাকতেও ডবল খুতবা হয়ে যায় তাতে। ডিষ্টার্ব হয় নামায, তেলাওয়াত ও যিক্‌ররত মুসল্লীদের। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৭১-৭২)

উল্লেখ্য যে, কোন স্থানের জামাআতে খুতবা দেওয়ার মত কোন লোক না থাকার ফলে যদি খুতবা দেওয়া না হয়, তাহলে সেই জামাআতের লোক জুমুআহ না পড়ে যোহ্‌র পড়বে। (ইবনে আবী শাইবা ৫২৬৯-৫২৭৬নং দ্র:)

জ্ঞাতব্য যে, যিনি খুতবা দেবেন তাঁরই নামায পড়া জরুরী নয়। যদিও সুন্নত হল খতীবেরই ইমামতি করা। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১০, ৪১৩)

জুমআর নামায ও তার সুন্নতী ক্বিরাআত

জুমআর নামায ফরয ২ রাকআত। এতে ক্বিরাআত হবে জেহরী। এ নামাযে সূরা ফাতিহার পর যে কোন সূরা বা আয়াত যথানিয়মে পড়া যায়। তবুও সুন্নত হল, প্রথম রাকআতে সূরা জুমুআহ (সম্পূর্ণ) এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকূন (সম্পূর্ণ) পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান) অথবা প্রথম রাকআতে সূরা জুমুআহ (সম্পূর্ণ) এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ্‌ পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)  অথবা প্রথম রাকআতে সূরা আ’লা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ্‌ পাঠ করা। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

জুমআর রাকআত ছুটে গেলে
কারো জুমআর এক রাকআত ছুটে গেলে বাকী আর এক রাকআত ইমামের সালাম ফিরার পর উঠে পড়ে নিলে তার জুমুআহ হয়ে যাবে। অনুরুপ কেউ দ্বিতীয় রাকআতের রুকূ পেলেও ঐ রাকআত এবং তার সাথে আর এক রাকআত পড়লে তারও জুমুআহ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ দ্বিতীয় রাকআতের রুকূ থেকে ইমামের মাথা তোলার পর জামাআতে শামিল হয়, তাহলে সে জুমআর নামায পাবে না। এই অবস্থায় তাকে যোহরের ৪ রাকআত আদায়ের নিয়তে জামাআতে শামিল হয়ে ইমামের সালাম ফিরার পর ৪ রাকআত ফরয পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১৮, ৪২১) যেমন জামাআত ছুটে গেলে জুমআও ছুটে যাবে। এ ক্ষেত্রেও একাকী যোহ্‌র পড়তে হবে। কারণ জামাআত ছাড়া জুমুআহ হয় না।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকআত নামায পায়, সে যেন অপর এক রাকআত পড়ে নেয়।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৬২২, জামে ৫৯৯১নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি এক রাকআত নামায পায়, সে নামায পেয়ে যায়।” (বুখারী ৫৭৯, মুসলিম, সহীহ ৬০৭, তিরমিযী, সুনান ৫২৪নং)

এর বিপরীত অর্থ এই দাঁড়ায় যে, “যে ব্যক্তি এক রাকআত নামায পায় না, সে নামায পায় না।” এ জন্যই ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীসের টীকায় বলেছেন, ‘এ হাদীসটি হাসান সহীহ। নবী (সাঃ)-এর অধিকাংশ সাহাবা ও অন্যান্য আহলে ইলমগণ এহাদীসের উপর আমল করেছেন। তাঁরা বলেছেন, “যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকআত পেয়ে যায়, সে ব্যক্তি যেন আর এক রাকআত পড়ে নেয়। কিন্তু যে (দ্বিতীয় রাকআতের তাশাহহুদের) বৈঠক অবস্থায় জামাআত পায়, সে যেন যোহরের ৪ রাকআত পড়ে নেয়।” এ মত গ্রহণ করেছেন সুফয়্যান সওরী, ইবনুল মুবারক, শাফেয়ী, আহমাদ এবং ইসহাক (রহঃ)।’

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকআত পেয়ে যায়, সে ব্যক্তি যেন আর এক রাকআত পড়ে নেয়। কিন্তু যে (দ্বিতীয় রাকআতের) রুকূ না পায়, সে যেন যোহরের ৪ রাকআত পড়ে নেয়।” (ইবনে আবী শাইবা, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৬২১নং)

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর এক রাকআত পেয়ে যায়, সে ব্যক্তি যেন আর এক রাকআত পড়ে নেয়। কিন্তু যে (দ্বিতীয় রাকআতের) তাশাহহুদ পায়, সে যেন যোহরের ৪ রাকআত পড়ে নেয়।” (বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৬২১)

কোন কোন বর্ণনায় তাশাহহুদ পেলে নামায পেয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তার মানে হল জামাআতের সওয়াব পেয়ে যাওয়া। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/৮২)

প্রকাশ থাকে যে, জুমআর খুতবা না শুনলেও; বরং ১ রাকআত নামায না পেলেও জুমুআহ হয়ে যাবে। যেমন, জুমআর খুতবা দিলে অথবা শুনলেও যদি নামাযের ১ রাকআতও না পায়, তাহলে তাকে যোহ্‌রই পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪১০)

উল্লেখ্য যে, জুমআর নামায পড়তে পড়তে যদি কারো ওযূ নষ্ট হয়ে যায় এবং ওযূ করে ফিরে এসে যদি দ্বিতীয় রাকআতের রুকূ পেয়ে যায়, তাহলে সে আর এক রাকআত পড়ে নেবে। নচেৎ সিজদা বা তাশাহহুদ পেলে যোহরের নিয়তে শামিল হয়ে ৪ রাকআত পড়বে। তদনুরুপ জামাআত ছুটে গেলেও যোহ্‌র পড়বে।

অনুরুপ কোন ইমাম সাহেব যদি বিনা ওযূতে জুমুআহ পড়িয়ে নামাযের শেষে মনে হয়, তাহলে মুক্তাদীদের নামায সহীহ হয়ে যাবে। আর ইমাম ঐ নামায কাযা করতে ৪ রাকআত যোহ্‌র পড়বেন। (আল-মুন্তাকা মিন ফাতাওয়াল ফাওযান ৩/৬৮)

জুমআর আগে ও পরে সুন্নত
জুমআর খুতবার পূর্বে ‘কাবলাল জুমুআহ’ বলে কোন নির্দিষ্ট রাকআত সুন্নত নেই। অতএব নামাযী মসজিদে এলে ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ ২ রাকআত সুন্নত পড়ে বসে যেতে পারে এবং দুআ, দরুদ তাসবীহ- যিকর বা তেলাওয়াত করতে পারে। আবার ইচ্ছা হলে নামাযও পড়তে পারে। তবে এ নামায হবে নফল এবং অনির্দিষ্ট সংখ্যায়।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন যথা নিয়মে গোসল করে, দাঁত পরিষ্কার করে, খোশবূ থাকলে তা ব্যবহার করে, তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে, অতঃপর (মসজিদে) যায়, নামাযীদের ঘাড় ডিঙিয়ে (কাতার চিরে) আগে যায় না, অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী নামায পড়ে। তারপর ইমাম উপস্থিত হলে নীরব ও নিশ্চুপ থাকে এবং নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন কথা বলে না, সে ব্যক্তির এ কাজ এই জুমুআহ থেকে অপর জুমআর মধ্যবর্তীকালে কৃত পাপের কাফফারা হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬০৬৬নং)

প্রকাশ থাকে যে, “প্রত্যেক আযান ও ইকামতের মাঝে নামায আছে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৬২নং) এই হাদীস দ্বারা কাবলাল জুমআর সুন্নত প্রমাণ হয় না। কারণ, বিদিত যে, জুমআর আযান ও ইকামতের মাঝে থাকে খুতবা। আর মহানবী (সাঃ)-এর যুগে পূর্বের আর একটি আযান ছিল না। আর সুন্নত প্রমাণ হলেও মুআক্কাদাহ ও নির্দিষ্ট সংখ্যক নয়।

তদনুরুপ “এমন কোন ফরয নামায নেই, যার পূর্বে ২ রাকআত নামায নেই।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩২, জামে ৫৭৩০নং)  এ হাদীস দ্বারাও জুমআর পূর্বে ২ রাকআত সুন্নত প্রমাণ হয় না। কারণ, জুমআর ফরয নামাযের পূর্বে খুতবা হয়। আর খুতবার পূর্বে ২ রাকআত নামায এ দ্বারা প্রমাণিত হয় না। (দ্র: সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩২নং)

সতর্কতার বিষয় যে, ইমামের খুতবা চলাকালে কেউ মসজিদে উপস্থিত হলে তাকে সেই অবস্থায় হাল্কা করে যে ২ রাকআত পড়তে হয়, তা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নয়; বরং তা হল তাহিয়্যাতুল মাসজিদ।

জুমআর পরে বা বা’দাল জুমআর ৪ অথবা ২ রাকআত সুন্নত :
জুমআর পর মসজিদে সুন্নত পড়লে একটু সরে গিয়ে বা কারো সাথে কোন কথা বলার পরে ৪ রাকআত নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়তে হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমআর পর নামায পড়ে, সে যেন ৪ রাকআত পড়ে।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, জামে ৬৪৯৯নং)

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমআর নামায পড়ে সে যেন তার পর ৪ রাকআত নামায পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান, জামে ৬৪০নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জুমুআহ পড়ে, সে যেন তার পর কোন কথা না বলা অথবা বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোন নামায না পড়ে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম,সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৩২৯নং)

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) জুমআর নামায পড়ে বাসায় ফিরে ২ রাকআত নামায পড়তেন। (বুখারী ৯৩৭নং, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌)

অবশ্য যদি কেউ মসজিদে ২ রাকআত পড়ে তাও বৈধ। পরন্তু যদি কেউ ২ অথবা ৪ রাকআত বাসায় পড়ে তাহলে সেটাই উত্তম। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “ ফরয নামায ছাড়া মানুষের শ্রেষ্ঠতম নামায হল তার স্বগৃহে পড়া নামায।” (নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৪৩৭নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩৪১-৩৪২পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, জুমআর পরে যোহরের নিয়তে ৪ রাকআত এহ্‌তিয়াতী যোহ্‌র পড়া বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১২০, ৩২৭পৃ:) যেমন বিদআত রমযানের শেষ জুমআকে জুমআতুল বিদা নাম দিয়ে কোন খাস মসজিদে ঐ জুমুআহ পড়তে যাওয়া।

জুমআর দিনের ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য
১। জুমুআহ অর্থাৎ জমায়েত বা সমাবেশ ও সম্মেলনের দিন। এটি মুসলিমদের সাপ্তাহিক ঈদ ও বিশেষ ইবাদতের দিন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “এই দিন হল ঈদের দিন। আল্লাহ মুসলিমদের জন্য তা নির্বাচিত করেছেন। অতএব যে জুমআয় আসে, সে যেন গোসল করে এবং খোশবূ থাকলে তা ব্যবহার করে। আর তোমরা দাঁতন করায় অভ্যাসী হও।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৯৮নং)

২। জুমআর দিন সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ দিন। এমনকি ঈদুল ফিতর ও আযহা থেকেও শ্রেষ্ঠ।

৩। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বেহেশ্‌ত দান করা হয়েছে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যার উপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমআর দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে বেহেশ্তে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছে বেহেশ্‌ত থেকে। (এই দিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়েছে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে এই দিনেই। আর কিয়ামত সংঘটিত হবে এই দিনেই।” (মুসলিম,  মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে হিব্বান, সহীহ, জামে ৩৩৩৪নং)

তিনি বলেন, “জুমআর দিন সকল দিনের সর্দার এবং আল্লাহর নিকট সবার চেয়ে মহান দিন। এমনকি এ দিনটি আল্লাহর নিকট আযহা ও ফিতরের দিন থেকেও শ্রেষ্ঠ। এই দিনে রয়েছে ৫টি বিশেষ বৈশিষ্ট্য; এই দিনে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন, এই দিনে তাঁকে পৃথিবীতে অবতারণ করেছেন, এই দিনে তাঁর ইন্তিকাল হয়েছে, এই দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যদি কোন মুসলিম বান্দা সে মুহূর্তে আল্লাহর নিকট কোন কিছু বৈধ জিনিস প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে তা দিয়ে থাকেন। এই দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর প্রত্যেক নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশ্‌তা, আকাশ, পৃথিবী, বাতাস, পর্বত, সমুদ্র এই দিনকে ভয় করে।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৮৪নং)

৪। এই দিনে মহান আল্লাহ জান্নাতে প্রত্যেক সপ্তাহে বেহেশতী বান্দাগণকে দর্শন দেবেন। হযরত আনাস (রাঃ) (ولدينا مزيد) এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মহান আল্লাহ বেহেশতীদের জন্য প্রত্যেক জুমআর দিন জ্যোতিষ্মান হবেন।’ এই দিনের আসমানী ফিরিশ্‌তাবর্গের নিকট নাম হল, ‘য়্যাউমুল মাযীদ।’

৫। এই দিনে গুনাহ মাফ হয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ)  বলেছেন, “যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে জুমআর উদ্দেশ্যে (মসজিদে) উপস্থিত হয়। অতঃপর মনোযোগ সহকারে (খুতবাহ্‌) শ্রবণ করে ও নীরব থাকে সেই ব্যক্তির ঐ জুমুআহ  থেকে দ্বিতীয় জুমুআহর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের পাপ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (খুতবা চলাকালে) কাঁকর স্পর্শ করে সে অসার (ভুল) কাজ করে।” (মুসলিম, সহীহ ৮৫৭ নং আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

৬। এই দিনে এমন একটি সময় আছে, যাতে দুআ কবুল হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “জুমআর দিনে এমন একটি (সামান্য) মুহূর্ত আছে, যদি কোন মুসলিম বান্দা নামায পড়া অবস্থায় তা পায় এবং আল্লাহর নিকট কোন মঙ্গল প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে তা দিয়ে থাকেন।” (বুখারী ৯৩৫নং, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৫৭নং)

এই মুহূর্তের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তা হল ইমামের মিম্বরে বসা থেকে নিয়ে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়। (মুসলিম,  মিশকাত ১৩৫৮নং) অথবা তা হল আসরের পর যে কোন একটি সময়। অবশ্য এ প্রসঙ্গে আরো অন্য সময়ের কথাও অনেকে বলেছেন। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/৩৮৯-৩৯০)

৭। এই দিনে দান-খয়রাত করার সওয়াব বেশী। হযরত কা’ব (রাঃ) বলেন, ‘অন্যান্য সকল দিন অপেক্ষা এই দিনে সদকাহ্‌ করার সওয়াব অধিক।’ (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম)

৮। জুমআর ফজরের নামায জামাআত সহকারে পড়ার পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহর নিকটে সব চাইতে শ্রেষ্ঠ নামায হল, জুমআর দিন জামাআত সহকারে ফজরের নামায।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৫৬৬নং)

৯। এই দিনে বা তার রাতে কেউ মারা গেলে কবরের আযাব থেকে রেহাই পাবে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে মুসলিম জুমআর দিন অথবা রাতে মারা যায়, আল্লাহ তাকে কবরের ফিতনা থেকে বাচান।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, জামে ৫৭৭৩)

জুমআর দিনে করণীয়
১। জুমআর ফজরের প্রথম রাকআতে সূরা সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা দাহ্‌র (ইনসান) পাঠ করা। উভয় সূরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করাই সুন্নত। প্রত্যেক সূরার কিছু করে অংশ পড়া সুন্নত নয়।

অবশ্য অন্য সূরা পড়া দোষাবহ্‌ নয়। বরং কখনো কখনো ঐ দুই সূরা না পড়াই উচিৎ। যাতে সাধারণ মানুষ তা পড়া জরুরী মনে না করে বসে। বরং তা জরুরী মনে করে পড়া এবং কখনো কখনো না ছাড়া বা কেউতা না পড়লে আপত্তি করা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ২৮১পৃ:)


২। সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া। আগে আগে মসজিদে গিয়ে উপস্থিত হওয়ার বিশেষ মাহাত্ম আছে।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন নাপাকীর গোসলের মত গোসল করল। অতঃপর প্রথম সময়ে (মসজিদে গিয়ে) উপস্থিত হল, সে যেন এক উষ্ট্রী কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় সময়ে উপস্থিত হল, সে যেন একটি গাভী কুরবানী করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি শিং-বিশিষ্ট মেষ কুরবানী করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি মুরগী দান করল। আর যে ব্যক্তি পঞ্চম সময়ে পৌঁছল, সে যেন একটি ডিম দান করল। অতঃপর যখন ইমাম (খুতবাদানের জন্য) বের হয়ে যান (মিম্বরে চড়েন), তখন ফিরিশ্‌তাগণ (হাজরী খাতা গু টিয়ে) যিক্‌র (খুতবা) শুনতে উপস্থিত হন।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী ৮৮১, মুসলিম, সহীহ ৮৫০, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান)


 ৩। জুমআর জন্য প্রস্তুতিস্বরুপ দেহের দুর্গন্ধ দূর করা, সে জন্য গোসল করা, আতর ব্যবহার করা :

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমুআহ পড়তে আসবে, সে যেন গোসল করে আসে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করবে, যথাসাধ্য পবিত্রতা অর্জন করবে, তেল ব্যবহার করবে, অথবা নিজ পরিবারের সুগন্ধি নিয়ে ব্যবহার করবে, অতঃপর (জুমআর জন্য) বের হয়ে (মসজিদে) দুই নামাযীর মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করবে না (কাতার চিরবে না), অতঃপর যতটা তার ভাগ্যে লিখা আছে ততটা নামায পড়বে, অতঃপর ইমাম খুতবা দিলে চুপ থাকবে, সে ব্যক্তির এই জুমুআহ থেকে আগামী জুমুআহ পর্যন্ত কৃত পাপ মাফ হয়ে যাবে।” (বুখারী, মিশকাত ১৩৮১নং)

গোসল করা ওয়াজেব না হলেও ঈদ, জুমুআহ ও জামাআতের জন্য পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা একটি প্রধান কর্তব্য। [1] কোন কোন বর্ণনায়, “ধৌত করায় ও করে” বা “গোসল করায় ও করে” শব্দ এসেছে। যাতে গোসল যে তাকীদপ্রাপ্ত আমল তা স্পষ্ট হয়। অবশ্য এর অর্থে অনেকে বলেন, ঐ দিন স্ত্রী-সহ্‌বাস করে নিজে গোসল করে এবং স্ত্রীকেও গোসল করায়। অথবা মাথা ও দেহ্‌ ধৌত করে পরিপূর্ণ পরিচ্ছন্নতা অর্জন করে। যারা করে তাদের জন্য রয়েছে উক্তরুপ পুরস্কার।

৪। দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করা :

দাঁতন ব্রাশ করে দাঁত ও মুখের দুর্গন্ধ দূরীভূত করে নেওয়া জুমআর পূর্বে একটি করণীয় কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক সাবালকের জন্য জুমআর দিন গোসল করা, মিসওয়াক করা এবং যথাসাধ্য সুগন্ধি ব্যবহার করা কর্তব্য।” (মুসলিম, সহীহ ৮৪৬নং)

৫। সুন্দর পোশাক পরা :

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করে, খোশবূ থাকলে তা ব্যবহার করে এবং তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরিধান করে, অতঃপর স্থিরতার সাথে মসজিদে আসে, অতঃপর ইচ্ছামত নামায পড়ে এবং কাউকে কষ্ট দেয় না, অতঃপর ইমাম বের হলে নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকে, সে ব্যক্তির এ কাজ দুই জুমআর মাঝে কৃত গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, মিশকাত ১৩৮৭নং)

জুমআর জন্য সাধারণ আটপৌরে পোশাক বা কাজের কাপড় ছাড়া পৃথক তোলা পোশাক ও কাপড় পরা বাঞ্ছনীয়। যেহেতু জুমআর দিন মুসলিমদের সমাবেশের দিন। আর এ দিনে সাজসজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। যাতে অপরের কাছে কেউ ঘৃণার পাত্র না হয়ে যায়। অথবা তার অপরিচ্ছন্নতায় কেউ কষ্ট না পায়।

একদা খুতবার মাঝে মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যাদের সামথ্য আছে তাদের পরিশ্রমের কাপড় ছাড়া জুমআর জন্য অন্য এক জোড়া কাপড় থাকলে কি অসুবিধা আছে?” (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৯৫-১০৯৬নং)

৬। পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া।

এর জন্য মর্যাদাও আছে পৃথক। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন (মাথা) ধৌত করে ও যথা নিয়মে গোসল করে, সকাল-সকাল ও আগে-আগে (মসজিদে যাওয়ার জন্য) প্রস্তুত হয়, সওয়ার না হয়ে পায়ে হেঁটে (মসজিদে) যায়, ইমামের কাছাকাছি বসে মনোযোগ সহকারে (খোতবা) শ্রবণ করে, এবং কোন অসার ক্রিয়া-কলাপ করে না, সে ব্যক্তির প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে এক বৎসরের নেক আমল ও তার (সারা বছরের) রোযা ও নামাযের সওয়াব লাভ হয়!” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৬৮৭ নং)

প্রকাশ থাকে যে, যে ব্যক্তি গাড়ি করে জুমুআহ পড়তে আসে, তার এ সওয়াব লাভ হয় না। বলা বাহুল্য, যে বাসা থেকে ১০০ কদম পায়ে হেঁটে জামে মসজিদে পৌঁছবে, তার আমল-নামায় ১০০ বছরের রোযা-নামাযের সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে; যাতে একটি গোনাহও থাকবে না। আর তা এখানেই শেষ নয়। এইভাবে সে প্রতি মাসে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ এবং প্রতি বছরে প্রায় ৫২০০ বছরের নামায-রোযার সওয়াব অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ। আর এ হল মুসলিম বান্দাদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।

(ذلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَّشَاءُ، وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْم)

৭।  সূরা কাহ্‌ফ পাঠ :

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহ্‌ফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।” (নাসাঈ, সুনান, বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৭৩৫ নং)

অন্য বর্ণনায় আছে, “যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহ্‌ফ পাঠ করবে তার জন্য তার ও কা’বা শরীফের মধ্যবর্তী জ্যোতির্ময় হবে।” (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, জামে ৬৪৭১নং)

উল্লেখ্য যে, জুমআর সময় মসজিদে এই সূরা তেলাওয়াত করলে এমনভাবে তেলাওয়াত করতে হবে, যাতে অপরের ডিষ্টার্ব না হয়।

জ্ঞাতব্য যে, এ দিনে সূরা দুখান পড়ার হাদীস সহীহ নয়। (যইফ জামে ৫৭৬৭, ৫৭৬৮নং) যেমন আলে ইমরান সূরা পাঠ করার হাদীসটি জাল। (যইফ জামে ৫৭৫৯নং)

তদনুরুপ জুমআর নামায পড়ে ৭ বার সূরা ফাতিহা, ইখলাস, ফালাক, নাস পড়ে অযীফা করার হাদীসদ্বয়ের ১টি জাল এবং অপরটি দুর্বল হাদীস। (যইফ জামে ৫৭৫৮, ৫৭৬৪, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৪৬৩০নং) সুতরাং এমন অযীফা পাঠ বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ১২২, ৩২৬পৃ:)

 ৮। বেশী বেশী দরুদ পাঠ :

জুমআর রাতে (বৃহ্‌স্পতিবার দিবাগত রাতে) ও (জুমআর) দিনে প্রিয়তম হাবীব মহানবী (সাঃ)-এর শানে অধিকাধিক দরুদ পাঠ করা কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল, জুমআর দিন। এই দিনে তোমরা আমার প্রতি দরুদ পাঠ কর। যেহেতু তোমাদের দরুদ আমার উপর পেশ করা হয়ে থাকে। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫৩১নং)

তিনি আরো বলেন, “জুমআর রাতে ও দিনে তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরুদ পাঠ কর। আর যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির উপর আল্লাহ ১০ বার রহ্‌মত বর্ষণ করবেন।” (বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪০৭নং)

([1]) প্রকাশ থাকে যে, সত্যানুসন্ধানী কিছু উলামার নিকট জুমআর দিন গোসল করা ওয়াজিব। দেখুন : (তামিশকাত ১২০পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/১৬৩, ৫/১০৮) সুতরাং গোসল ত্যাগ না করাই উচিত।

ঈদের দিন জুমুআহ পড়লে
ঈদের দিন জুমুআহ পড়লে ইমাম জুমুআহ পড়বেন। সাধারণ মুসলিমদের জন্য এখতিয়ার থাকবে; তারা জুমুআহ পড়তেও পারে, নচেৎ যোহ্‌র পড়াও বৈধ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ‘রোযা ও রমযানের ফাযায়েল ও মাসায়েল’)

আর পূর্বে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, বৃষ্টি-বন্যার কারণে মসজিদে উপস্থিত হতে না পারলে ঘরে যোহ্‌র পড়ে নিতে হবে।

 মুসাফির ও কসরের সালাত

মুসাফিরের নামায

সফর একটি কঠিন জিনিস। সফর ভীতি, কষ্ট ও উদ্বেগপূর্ণ সময়, ব্যস্ততা ও শঙ্কাময় কাল। তাই এই সময়কালে দয়াময় মহান আল্লাহ দয়াপূর্বক বান্দার উপর কিছু নামায হাল্কা করেছেন এবং এ মর্মে আরো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দান করেছেন। তন্মধ্যে কসর ও জমা করে নামায পড়া অন্যতম।

কসর নামায

সফরে ৪ রাকআত বিশিষ্ট ফরয নামাযকে ২ রাকআত কসর (সংক্ষেপ) করে পড়া সুন্নত ও আফযল। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوْا مِنَ الصَّلاَةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَّفْتِنَكُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا)
অর্থাৎ, যখন তোমরা ভূপৃষ্ঠে সফর কর, তখন তোমরা নামায সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; যদি তোমরা এই আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে বিব্রত করবে। (কুরআন মাজীদ ৪/১০১)

বাহ্যত: উক্ত আয়াত থেকে যদিও এই কথা বুঝা যায় যে, কেবল ভয়ের সময় নামায কসর করা বৈধ, তবুও ভয় ছাড়া নিরাপদ সময়েও কসর করা যায়। মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-গণ ভয়-অভয় উভয় অবস্থাতেই কসর করেছেন বলে প্রমাণিত।

একদা হযরত য়্যা’লা বিন উমাইয়া (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে বলেন, কি ব্যাপার যে, লোকেরা এখনো পর্যন্ত নামায কসর পড়েই যাচ্ছে, অথচ মহান আল্লাহ তো কেবল বলেছেন যে, “যখন তোমরা ভূপৃষ্ঠে সফর কর, তখন তোমরা নামায সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন অপরাধ নেই; যদি তোমরা এই আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদেরকে বিব্রত করবে।” আর বর্তমানে তো ভীতির সে অবস্থা অবশিষ্ট নেই?

হযরত উমার (রাঃ) উত্তরে বললেন, যে ব্যাপারে তুমি আশ্চর্যবোধ করছ, আমিও সেই ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করে নবী (সাঃ)-এর নিকট এ কথার উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “এটা তোমাদেরকে দেওয়া আল্লাহর একটি সদকাহ্‌। সুতরাং তোমরা তাঁর সদকাহ্‌ গ্রহণ কর।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১৩৩৫নং)

মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘মক্কাতে প্রথমে ২ রাকআত করে নামায ফরয করা হয়। অতঃপর নবী (সাঃ) যখন মদ্বীনায় হিজরত করে আসেন, তখন আরো ২ রাকআত করে নামায বৃদ্ধি করা হল। কেবল মাগরেবের নামায (৩ রাকআত) করা হল। কারণ, তা দিনের বিত্‌র। আর ফজরের নামাযও ২ রাকআত রাখা হল। কারণ, তার ক্বিরাআত লম্বা। কিন্তু নবী (সাঃ) যখন সফরে যেতেন, তখন তিনি ঐ প্রথমকার সংখ্যাই (মক্কায় ফরযকৃত ২ রাকআত নামাযই) পড়তেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

মহানবী (সাঃ) প্রত্যেক সফরেই কসর করে নামায পড়েছেন এবং কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত দ্বারা এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি কোন সফরে নামায পূর্ণ করে পড়েছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ), আবূ বাক্‌র, উমার ও উসমান (রাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। কিন্তু কখনো দেখি নি যে, তাঁরা ২ রাকআতের বেশী নামায পড়েছেন।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৩৮নং)

অবশ্য হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে মিনায় পূর্ণ (৪ রাকআত) নামায পড়েছেন। (বুখারী ১০৮২, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৪৭নং) তদনুরুপ মা আয়েশাও সফরে পূর্ণ নামায পড়তেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৪৮নং) অবশ্য তাঁদের এ কাজের ব্যাখ্যা এই ছিল যে, প্রথমত: তাঁরা জানতেন, কসর করা সুন্নত; ওয়াজেব নয়। আর দ্বিতীয়ত: যাতে অজ্ঞ লোকেরা তাঁদের কসর করা দেখে মনে না করে বসে যে, যোহ্‌র, আসর ও এশার নামায মাত্র ২ রাকআত। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৬৬৪-৬৫)

পক্ষান্তরে ফজর ও মাগরেবের নামাযে কসর নেই।

কতদূর সফরে কসর বিধেয়

কুরআন মাজীদের উপর্যুক্ত আয়াতে বা কোন হাদীসে সেই সফরের কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ বা দূরত্ব উল্লেখ হয়নি, যতটা দূরত্ব যাওয়ার পর নামায কসর করে পড়া বিধেয়। এই জন্য সঠিক এই যে, পরিভাষায় বা প্রচলিত অর্থে যাকে সফর বলা হয়, সেই সফরে নামায কসর করা চলবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৯৭-৪৯৮)

সাহাবাদের মধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমার (রাঃ) ৪৮ মাইল দূরে গিয়ে কসর করতেন এবং রোযা রাখতেন না। (বুখারী)

প্রকাশ থাকে যে, এই সফর পায়ে হেঁটে হোক অথবা উটের পিঠে, সাইকেলে হোক বা বাসে-ট্রেনে, পানি-জাহাজে হোক অথবা এরোপ্লেনে, কষ্টের হোক অথবা আরামের, বৈধ কোন কাজের জন্য হলে তাতে কসর বিধেয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২০/১৫৭)

দূরবর্তী সফর থেকে যদি একদিনের ভিতরেই ফিরে আসে অথবা নিকটবর্তী সফরে ২/৩ দিন অবস্থান করে তবুও তাতে কসর-জমা চলবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৯৯)


কোত্থেকে কসর শুরু হবে?


মহানবী (সাঃ) শহর বা জনপদ ছেড়ে বের হয়ে গেলেই কসর শুরু করতেন। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে (মক্কা যাওয়ার পথে) মদ্বীনায় যোহরের ৪ রাকআত এবং (মদ্বীনা থেকে ৬ মাইল দূরে) যুল-হুলাইফায় গিয়ে আসরের ২ রাকআত পড়তাম।’ (বুখারী ১০৮৯নং, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান)

বলা বাহুল্য, সফর করতে শহর বা গ্রাম ত্যাগ করার পূর্ব থেকেই নামায কসর বা জমা করা চলবে না।

নামাযের সময় আসার পরেও সফর করলে পথে কসর করা বৈধ। অনুরুপ সফরে নামাযের সময় হওয়ার পরেও বাসায় ফিরে এলে পূর্ণ নামায পড়তে হবে। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ৭৯পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫২৩)

সফরে বের হয়ে শহর ছেড়ে (শহরের বাইরে) বিমান-বন্দর, স্টেশন বা বাস-স্ট্যান্ডে কসর চলবে। সেখানে কসর করে নামায পড়ার পর যদি কোন কারণবশত: প্লেন বা গাড়ি না আসার ফলে বাড়ি ফিরতে হয়, তবুও ঐ কসর করা নামায আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫১৪)

সফরে বের হয়ে প্লেন বা গাড়ি যদিও মুসাফিরের গ্রাম বা শহরের উপর বা ভিতর দিয়ে যায়, তাহলেও তার ঐ বিমান-বন্দরে বা স্টেশনে বা বাস-স্ট্যান্ডে কসর করা চলবে। (ঐ ৪/৫৬৯)


কসরের সময়সীমা


সফরে গিয়ে নির্দিষ্ট দিন থাকার সংকল্প না হলে, বরং কাজ হাসিল হলেই ফিরে আসার নিয়ত হলে অথবা পথে কোন বাধা পড়লে যতদিন ঐ কাজ না হবে অথবা বাধা দূর না হবে ততদিন সফরে কসর করা চলবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৪০৬-৪০৭)

মহানবী (সাঃ) এক সফরে ১৯ দিন ছিলেন এবং তাতে নামায কসর করেছেন। (বুখারী ১০৮০নং)

হযরত আনাস (রাঃ) শাম দেশে ২ বছর ছিলেন এবং ২ বছরই নামায কসর করে পড়েছেন। (মালেক, মুঅত্তা ৩/৪৮৮, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৮৬)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ইবনে উমার (রাঃ) পথে বরফ থাকার ফলে আযারবাইজানে ৬ মাস আটক ছিলেন এবং তাতে কসর করে নামায পড়েছিলেন। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২/৪৩৩৯, বায়হাকী ৩/১৫২)

কিছু সাহাবা রামাহুরমুযে ৭ মাস অবস্থান কালে কসর করে নামায পড়েছিলেন। (বায়হাকী ৫২৬৭নং)

পক্ষান্তরে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে; ব্যবসা, চাকুরী, অধ্যয়ন প্রভৃতির জন্য বিদেশে থাকতে হলে তখন আর কসর চলবে না।

বাকী থাকল এত দিন সফরে থাকার নিয়ত করলে কসর চলবে এবং এত দিন করলে চলবে না, তো সে কথার উপযুক্ত দলীল নেই। ৪ কিংবা তার থেকে বেশী দিনের অবস্থান নিয়তে থাকলেও যতদিন তার কাজ শেষ না হয়েছে ততদিন মুসাফির মুসাফিরই; যতক্ষণ না সে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করেছে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৩২-৫৩৯)

প্রকাশ থাকে যে, যারা ভাড়া গাড়ি চালায়, প্রত্যহ্‌ বাস, ট্রেন বা প্লেন চালায় তারাও মুসাফির। তাদের জন্যও নামায কসর করা বিধেয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২২/১০৩)


সফরে সুন্নত ও নফল নামায


মহানবী (সাঃ) সফরে সাধারণত: ফরয নামাযের আগে বা পরে সুন্নত নামায পড়তেন না। তবে বিত্‌র ও ফজরের সুন্নত তিনি সফরেও নিয়মিত পড়তেন। যেমন এর পূর্বেও ইঙ্গিত করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, সফরে (বিত্‌র ও ফজরের আগে ২ রাকআত ছাড়া) সুন্নত (মুআক্কাদাহ) না পড়াই সুন্নত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) এক সফরে লোকেদেরকে ফরয নামাযের পর সুন্নত পড়তে দেখে বললেন, ‘যদি আমাকে সুন্নতই পড়তে হত, তাহলে ফরয নামায পুরা করেই পড়তাম। আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। আমি তাঁকে সুন্নত পড়তে দেখিনি।’ অতঃপর তিনি বললেন,

(لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ)
অর্থাৎ, নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (কুরআন মাজীদ ৩৩/২১) (বুখারী ১১০১নং, মুসলিম, সহীহ)

 আমি নবী (সাঃ)-এর সাথে সফরে থেকেছি। তিনি ২ রাকআতের বেশী নামায পড়তেন না। অনুরুপ আবূ বাক্‌র, উমার ও উসমান (রাঃ)-ও করতেন।’ (বুখারী ১১০২নং, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৩৮নং)

তবে সফরে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়া যাবে না এমন কথা নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) কখনো কখনো কিছু কিছু সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়তেন। (মিশকাত আলবানীর টীকা ১/৪২৩)

অবশ্য সাধারণ নফল, তাহাজ্জুদ, চাশত, তাহিয়্যাতুল মাসজিদ প্রভৃতি নামায সফরে পড়া চলে। যেমন ফরয নামাযের আগে-পরেও নফলের নিয়তে নামায পড়া দূষণীয় নয়।

মক্কা বিজয়ের দিন উম্মেহানীর ঘরে তিনি চাশতের নামায পড়েছেন। (বুখারী) এ ছাড়া তিনি সফরে উটের পিঠে নফল ও বিত্‌র নামায পড়তেন। (বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান)


মুসাফিরের ইমাম ও মুক্তাদী হয়ে নামায


মুসাফির ইমামতি করতে পারে এবং এ অবস্থাতেও সে কসর করে নামায পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে গৃহ্‌বাসী অমুসাফির মুক্তাদীরা মুসাফির ইমামের সালাম ফিরার পর সালাম না ফিরে উঠে বাকী নামায পূরণ করতে বাধ্য হবে। (লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উষাইমীন ৭/১৮)

অনুরুপ মুসাফির অমুসাফির ইমামের পিছনে নামায পড়তে পারে। আর এ ক্ষেত্রে সে ঐ ইমামের মতই পূর্ণ নামায পড়তে বাধ্য হবে। এমন কি ইমামের শেষের ২ রাকআতে জামাআতে শামিল হলেও মুসাফির বাকী ২ রাকআত একাকী আদায় করতে বাধ্য। এখানে ঐ ২ রাকআতকে কসর ধরে নিলে হবে না।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, মুসাফির একাকী নামায পড়লে ২ রাকআত, আর অমুসাফির ইমামের পশ্চাতে পড়লে ৪ রাকআত নামায পড়ে, তার কারণ কি? উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটাই হল আবুল কাসেম (সাঃ)-এর সুন্নত।’ (আহমাদ, মুসনাদ ১৮৬২, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম ১২৮৯৫নং)

তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘মক্কায় থেকে ইমামের সাথে জামাআতে নামায না পেলে কিভাবে নামায পড়ব?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘দুই রাকআত আবুল কাসেম (সাঃ)-এর সুন্নত।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৮৮নং, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

যদি কোন মুসাফির পথের কোন মসজিদে জামাআত চলতে দেখে এবং সে বুঝতে না পারে যে, ইমাম স্থানীয় বসবাসকারী, বিধায় পূর্ণ নামায পড়ার নিয়ত করে জামাআতে শামিল হবে, নাকি মুসাফির, বিধায় কসর করার নিয়তে শামিল হবে?

এমত অবস্থায় মুসাফির ইমামের আকার-আকৃতি ও সফরের চিহ্ন দেখে মোটামুটি আন্দাজ লাগাবে, ইমাম কি? এরপর যদি প্রবল ধারণা হয় যে, সে স্থায়ী বসবাসকারী, তাহলে পূর্ণ নামায পড়ার নিয়তে জামাআতে শামিল হবে।

পক্ষান্তরে যদি তার প্রবল ধারণা এই হয় যে, সে মুসাফির, তাহলে কসরের নিয়তে জামাআতে শামিল হবে।

কিন্তু সালাম ফিরার পর যদি বুঝতে পারে যে, ইমাম স্থানীয় বাসিন্দা এবং তার পিছনে যে ২ রাকআত নামায সে পড়েছে তা ইমামের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআত, তাহলে সে উঠে আরো ২ রাকআত পড়ে নিয়ে নামায পূর্ণ করবে। আর এর জন্য তাকে সিজদা-এ সাহও করতে হবে। এতে যদি সে মাঝে প্রকৃত জানার জন্য কথাও বলে থাকে তাতে কোন ক্ষতি হবে না। (মা-যা তাফআলু ফিলহা-লা-তিল আ-তিয়াহ্‌, মুহাম্মাদ সালেহ্‌ আল-মুনাজ্বিদ ১৬পৃ:)

পরন্তু যদি প্রবল ধারণায় কোন এক দিক বুঝা না যায়, তাহলে মুসাফির সম্ভাবনাময় নিয়ত করতে পারে। যেমন মনে এই সংকল্প করতে পারে, যদি ইমাম পূর্ণ নামায পড়ে তাহলে আমিও পূর্ণ পড়ব। নচেৎ, কসর পড়লে আমিও কসর পড়ব। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫২১)

জ্ঞাতব্য যে, মুসাফির নামাযে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহ্‌রীমা দেওয়ার পর যদি কসরের নিয়ত করে তাহলেও চলবে। পূর্ব থেকেই কসরের নিয়ত জরুরী নয়। (ঐ ৪/৫২৫)

প্রকাশ থাকে যে, মুসাফিরের জন্যও স্থানীয় জামাআতে শরীক হয়ে নামায পড়া উত্তম। অবশ্য সফরের পথে কোন ক্ষতির আশঙ্কা হলে ভিন্ন কথা। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১২/৮৯)


মুসাফিরের সফরের আগে-পরে নামায

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তুমি তোমার ঘর থেকে বের হওয়ার সংকল্প করবে, তখন দুই রাকআত নামায পড়; তোমাকে বাহির পথের সকল মন্দ থেকে রক্ষা করবে। আবার যখন তুমি তোমার ঘরে প্রবেশ করবে তখনও দুই রাকআত নামায পড়; তোমাকে প্রবেশ পথের সকল মন্দ থেকে রক্ষা করবে।” (বাযযার, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, জামে ৫০৫নং)

নামায জমা করা

নামায জমা করে পড়ার বিধান

মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি বড় দয়াবান, বড় অনুগ্রহশীল। তিনি বান্দার কষ্ট চান না। তাই অনুগ্রহ করেই বিধান দিয়েছেন দুই সময়ের নামাযকে প্রয়োজনে এক সময়ে একত্রিত করে পড়ার। অনুমতি দিয়েছেন আগের নামাযকে পরের সাথে (বিলম্ব করে) অথবা পরের নামাযকে আগের সাথে (ত্বরান্বিত করে) পড়ার।

অবশ্য এ কেবল সীমাবদ্ধ নামাযের মাঝেই সম্ভব। যেমন, যোহ্‌র ও আসর এক সাথে এবং মাগরেব ও এশা এক সাথে দুটির মধ্যে একটির সময়ে জমা করে পড়া যাবে। পক্ষান্তরে ফজরের নামাযকে আগে-পরের কোন নামাযের সাথে জমা করে পড়া যাবে না। যেমন পড়া যাবে না আসর ও মাগরেবের নামাযকে এক সাথে জমা করে। অনুরুপ জুমআর নামায যোহ্‌র থেকে পৃথক। অতএব জুমআর সাথে আসরের নামাযকে জমা করে পড়া যাবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭২-৫৭৩)


কোন্‌ কোন্‌ অবস্থায় জমা করা যায়?
যথা সময়ে নামায পড়াই প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য ফরয। কিন্তু দলীলের ভিত্তিতেই নিম্নোক্ত সময় ও অবস্থায় এক সময়ের নামাযকে অন্য সময়ের নামাযের সাথে জমা করে পড়া বৈধ :-

আরাফাত ও মুযদালিফায় :

বিদায়ী হ্‌জ্জে মহানবী (সাঃ) আরাফাতে যোহ্‌র ও আসরের নামাযকে যোহরের সময় এবং মুযদালিফায় মাগরেব ও এশার নামাযকে এশার সময় জমা করে পড়েছিলেন।

সফরে মুসাফির অবস্থায় :

সফরে পথে অথবা কোন অবস্থান ক্ষেত্রে বা বাসায় জমা (ও কসর) করে নামায পড়া যায়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে নবী (সাঃ)-এর নামায সম্পর্কে বর্ণনা দেব না?’ লোকেরা বলল, ‘অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘সফর করার সময় অবস্থান ক্ষেত্রে থাকতে থাকতেই যদি সূর্য ঢলে যেত, তাহলে সওয়ার হওয়ার আগেই যোহ্‌র ও আসরকে জমা করে পড়ে নিতেন। আর সূর্য না ঢললে তিনি বের হয়ে যেতেন। অতঃপর আসরের সময় হলে সওয়ারী থেকে নেমে যোহ্‌র ও আসরকে এক সঙ্গে জমা করে পড়ে নিতেন। অনুরুপ যদি অবস্থান ক্ষেত্রে থাকতে থাকতেই সূর্য ডুবে যেত, তাহলে মাগরেব ও এশার নামাযকে এক সঙ্গে জমা করে নিতেন। আর সূর্য না ডুবলে তিনি বের হয়ে যেতেন। অতঃপর এশার সময় হলে তিনি সওয়ারী থেকে নেমে মাগরেব ও এশার নামাযকে এক সঙ্গে জমা করে পড়ে নিতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, দ্র: বুখারী ১১১১-১১১২নং)

হযরত মুআয (রাঃ) বলেন, তবুক অভিযানে গিয়ে আল্লাহর রসূল (সাঃ) একদা দেরী করে নামায পড়লেন। তিনি বাইরে এসে যোহ্‌র ও আসরকে এক সাথে জমা করে পড়লেন। তারপর তিনি ভিতরে চলে গেলেন। অতঃপর বাইরে এসে তিনি মাগরেব ও এশাকে এক সাথে জমা করে পড়লেন। (মুসলিম,  মালেক, মুঅত্তা)

দুই নামাযকে একত্রে জমা করে পড়ার সময় সুন্নত হল নামাযের পূর্বে একটি আযান হবে এবং প্রত্যেক নামায শুরু করার আগে ইকামত হবে। আর উভয় নামাযের মাঝে কোন সুন্নত পড়া যাবে না। মহানবী (সাঃ) আরাফাত ও মুযদালিফায় অনুরুপই করেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান)

দুই নামায জমা করার সময় উভয়ের মাঝে সামান্য ক্ষণ দেরী হয়ে যাওয়া দোষাবহ্‌ নয়। কারণ, মুযদালিফায় পৌঁছে মহানবী (সাঃ) মাগরেবের নামায পড়েন। অতঃপর প্রত্যেকে নিজ নিজ উট নিজ নিজ অবতরণ স্থলে বসিয়ে দিল। তারপর এশার নামায পড়লেন এবং মাঝে কোন নামায পড়েননি। (বুখারী ১৬৭২, মুসলিম, সহীহ)

বৃষ্টি-বাদলে নামায জমা
বৃষ্টি-বাদলের দিনে কাদায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া বা পানিতে ভিজে যাওয়ার আশঙ্কায় বারবার মসজিদ আসতে মুসল্লীদের কষ্ট হবে বলেই সরল শরীয়তে সে সময়ও দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়ে নেওয়ার অনুমতি দান করেছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘মহানবী (সাঃ) মদ্বীনায় যোহ্‌র ও আসর এবং মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়েছেন।’ (এক বর্ণনাকারী) আইয়ুব (আবুশ শা’ষা জাবেরকে) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সম্ভবত: বৃষ্টির সময়?’ উত্তরে (জাবের) বললেন, ‘সম্ভবত:।’ (বুখারী ৫৪৩নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ৩২১পৃ:)

হযরত আবূ সালামাহ্‌ (রাঃ) বলেন, ‘বৃষ্টির দিনে মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়া সুন্নত।’ (আষরাম, নাইলুল আউতার, শাওকানী ৩/২১৮)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (সাঃ) মদ্বীনায় যোহ্‌র ও আসর এবং মাগরেব ও এশার নামাযকে জমা করে পড়েছেন। সেদিন না কোন ভয় ছিল আর না বৃষ্টি।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনি এমন কেন করলেন?’ উত্তরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, ‘তিনি তাঁর উম্মতকে অসুবিধায় না ফেলার উদ্দেশ্যে এমনটি করলেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৫নং)

উক্ত বর্ণনায় ‘বৃষ্টি ছিল না তাও জমা করে নামায পড়েছেন’ এই কথার দলীল যে, বৃষ্টি হলে জমা করে পড়া এমনিতেই বৈধ। আর এ জমা হবে হাক্বীক্বী (প্রকৃত) জমা (তাকদীম), সূরী (আপাত) জমা নয়। কারণ, তাতেই উম্মতকে অসুবিধায় পড়তে হবে। (দ্র: সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৩৭নং)

বৃষ্টির জন্য জমা কেবল তারাই করতে পারে, যারা জামাআতের লোক। যারা জামাআতে বা মসজিদে হাযির হয় না তাদের জন্য জমা বৈধ নয়। যেমন, রোগী (কষ্ট না হলে) বা মহিলা বাড়িতে জমা করতে পারে না।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মসজিদেই বা মসজিদের শামিল বা পাশাপাশি বাসায় বাস করে তার জন্যও জমা বৈধ। আসল কথা হল জামাআত। আর জামাআতের ফযীলত বেশী। অতএব জামাআত ছেড়ে তাদের যথাসময়ে নামায পড়া উচিৎ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৬০)

অন্য কোন অসুবিধার কারণে নামায জমা
ভয় বা বৃষ্টি ছাড়াও অন্য কোন বড় অসুবিধার কারণেও দুই নামাযকে জমা করে পড়া বৈধ। উপর্যুক্ত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীস সে কথাই ইঙ্গিত করে।

এ ছাড়া বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি যৌথ বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, মহানবী (সাঃ) মদ্বীনায় যোহ্‌র ও আসর এবং মাগরেব ও এশাকে জমা করে পড়েছেন। (বুখারী ৫৪৩, মুসলিম, সহীহ)

আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, একদা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আসরের পর আমাদের মাঝে বক্তব্য রাখলেন। এই অবস্থায় সূর্য ডুবে গেল এবং আকাশে তারা ফুটে উঠল। আর লোকেরা বলতে লাগল, ‘নামাযের সময় হয়ে গেছে, নামাযের সময় হয়ে গেছে।’

বনী তামীমের এক ব্যক্তি ‘নামায, নামায’ করতে করতে সোজা ইবনে আব্বাসের কাছে এল। তিনি লোকটাকে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সুন্নত শিখাতে এসেছ? আমি নবী (সাঃ)-কে যোহ্‌র ও আসর এবং মাগরেব ও এশার নামাযকে একত্রে জমা করে পড়তে দেখেছি।’

আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, ‘তাঁর এ কথায় আমার সন্দেহ্‌ হলে আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তিনি তাঁর এ কথার সমর্থন করেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭০৫নং)

প্রয়োজনে অসুস্থ অবস্থায়ও বারবার ওযূ করতে বা লেবাস পাল্টে পবিত্রতা অর্জন করতে কষ্ট হলে দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়া বৈধ। যেমন মহানবী (সাঃ) ইস্তিহাযাগ্রস্ত (সর্বদা মাসিক আসে এমন) মহিলাকে এক গোসলে দুই নামাযকে এক সাথে জমা করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৬১-৫৬৩নং)  অনুরুপ যার সব সময় প্রস্রাব ঝরার রোগ আছে সেও ২ নামাযকে জমা করে পড়তে পারে।

জমা বিষয়ক অন্যান্য জরুরী মাসায়েল
জ্ঞাতব্য যে, ত্বরান্বিত জমা (তাক্বদীম) অপেক্ষা (কষ্ট না হলে) বিলম্বিত (তা’খীর) জমাই উত্তম। এ ছাড়া যখন যার জন্য যেমন সুবিধা তার জন্য সেই জমাই উত্তম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৪৬১-৫৬৪) অবশ্য প্রথম অক্তে জমা না করলে সে সময়ে জমার নিয়ত জরুরী। নচেৎ, জমার নিয়ত ছাড়া বিনা ওযরে কোন নামাযকে যথাসময় থেকে পার করে দেওয়া হারাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭৪)

বলা বাহুল্য, প্রথম অক্তে জমার নিয়ত না রেখে সময় পার হওয়ার পর পরের ওয়াক্তের সাথে জমার নিয়ত সহীহ নয়। বরং এই সময় প্রথম নামায কাযা ও দ্বিতীয় নামায আদায়ের নিয়তে পড়া জরুরী। (ঐ ৪/৫৭৫)

প্রকাশ থাকে যে, কোন ওযরে প্রথম অক্তে দুই নামায জমা করে নেওয়ার পর দ্বিতীয় ওয়াক্ত আসার আগেই যদি সে ওযর দূর হয়ে যায়; যেমন রোগ ভাল হয়ে যায়, মুসাফির ঘরে ফিরে আসে অথবা বৃষ্টি থেমে যায়, তবুও জমা নামায বাতিল হবে না এবং দ্বিতীয় অক্তে ঐ পড়া নামায আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। এমন কি দ্বিতীয় নামায শেষ হওয়ার আগেই যদি ওযর দূর হয়ে যায় তবুও জমা বাতিল নয়। (ঐ ৪/৫৭৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৫৫, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১-২৬২)

মুসাফিরের জন্য জমা ও কসর একই সাথে করা জরুরী নয়। সুতরাং সে জমা না করে কেবল কসর এবং কসর না করে জমাও করতে পারে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১২/৮৮)


যানবাহনে নামায

বিভিন্ন যানবাহনে নামায
মহানবী (সাঃ) সওয়ারীর উপর ফরয নামায পড়তেন না। ফরয নামাযের সময় হলে তিনি উট থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়াতেন।

সুতরাং সফরে (মোটর গাড়ি, গরুর গাড়ি, উট,হাতি, ঘোড়া প্রভৃতি) যানবাহনে নামাযের সময় হলে যানবাহন থামিয়ে নামায পড়তে হবে। কিন্তু যে যানবাহনে থামার বা নামার সুযোগ নেই, অথচ সেখানে যথানিয়মে পূর্ণরুপে নামায আদায় সম্ভব, সে যানবাহনে যথা সময়ে নামায পড়তে হবে। পরন্তু সেখানে যদি যথানিয়মে পূর্ণরুপে নামায আদায় করার সুযোগ না থাকে, তাহলে গন্তব্যস্থল পৌঁছনোর আগেই নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সে যানবাহনের উপরেই যথাসময়ে নামায পড়ে নেওয়া জরুরী। (আহ্‌কামুল ইমামাতি অল-ই’তিমামি ফিস সালাত, আব্দুল মুহ্‌সিন আল-মুনীফ ৪০১নং)

অতএব প্লেন, ট্রেন, বাস প্রভৃতি যানবাহনের ভিতরে জামাআত সহকারে নামায সম্ভব হলে জামাআত সহকারেই পড়তে হবে। [1]

নচেৎ একাকী নিজ নিজ সিটে বসে সময় পার হওয়ার আগে আগেই নামায পড়ে নিতে হবে। না পড়লে এবং পরে কাযা পড়লেও গুনাহগার হতে হবে।

যথাসম্ভব কিবলামুখ হতে হবে। বিশেষ করে নামায শুরু করার পূর্বে কিবলামুখ হয়ে দাঁড়িয়ে পরে যানবাহন অন্যমুখ হলে যথাসম্ভব কিবলামুখে ঘুরে নামায পড়তে হবে। সম্ভব না হলে যে কোন মুখেই নামায হয়ে যাবে।

সাধ্যমত নামাযের রুক্‌ন ও ওয়াজেব আদায় করতে হবে। জমার নামায হলে এবং দ্বিতীয় সময় অতিবাহিত হওয়ার আগে গাড়ি গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে না আশঙ্কা হলে প্লেন বা গাড়িতেই নামায আদায় অপরিহার্য। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/১৯০)

নৌকা, পানি-জাহাজ বা স্টিমার প্রভৃতি জলযানেও নামায আদায় করা জরুরী। (কিয়ামের সময়) দাঁড়িয়ে পড়তে অসুবিধা হলে বসে বসে পড়ে নিতে হবে। ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) নৌকায় নামায পড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, “ডুবে যাওয়ার ভয় না থাকলে তাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়।” (বাযয়ীফ, দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৯পৃ:)

আব্দুল্লাহ বিন আবী উতবাহ্‌ বলেন, ‘একদা আমি জাবের বিন আব্দুল্লাহ, আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ হুরাইরা (রাঃ)-এর সাথে নৌকার সঙ্গী ছিলাম। তাঁরা সকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জামাআত সহকারে নামায পড়লেন। তাঁদের একজন ইমামতি করলেন। আর তাঁরা তীরে আসতে সক্ষমও ছিলেন।’ (সুনান সাঈদ বিন মানসূর, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, বায়হাকী ৩/১৫৫)

মহানবী (সাঃ) সফরে নিজের সওয়ারীতেই নফল ও বিত্‌র নামায পড়তেন। উটনী কেবলামুখে দাঁড় করিয়ে তকবীর দিয়ে নামায শুরু করতেন। অতঃপর পূর্ব-পশ্চিম যে মুখে পথ ও উটনী যেত, সে মুখেই তিনি নামায পড়তেন। আর এ ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে মহান আল্লাহর এই বাণী :-

(فَأَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ الله)

অর্থাৎ, তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও, সেদিকই আল্লাহর চেহারা (দিক বা কিবলাহ্‌)। (কুরআন মাজীদ ২/১১৫) (মুসলিম, সহীহ ৭০০নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)


([1])প্রকাশ থাকে যে, বিশেষ করে প্লেনে একাধিক ফাঁকা জায়গা আছে; যেখানে জামাআত করে নামায পড়া সম্ভব। খাকসার নিজে বহুবার সেসব জায়গায় জামাআত সহকারে যথানিয়মে পূর্ণরুপে নামায আদায করেছে।


রোগীর নামায

রোগীর নামাযের বিবরণ
রোগী হলেও জ্ঞান বর্তমান থাকা কাল পর্যন্ত কারো জন্য কোন অবস্থায় নামায মাফ নয়। ও যূ-গোসল না করতে পারলে তায়াম্মুম করে, তা না পারলেও বিনা তায়াম্মুমেই নামায পড়া জরুরী। পবিত্র না থাকতে পারলে অপবিত্র অবস্থাতেই, পবিত্র জায়গা না পেলে অপবিত্র জায়গাতেই নামায পড়তে হবে।

রোগী দাঁড়িয়ে নামায না পড়তে পারলে বসে নামায পড়বে। দুই পা-কে গুটিয়ে আড়াআড়িভাবে রেখে হাঁটু ভাঁজ করে (বাবু হয়ে) বসবে। কখনো কখনো প্রয়োজনে মহানবী (সাঃ) অনুরুপ বসে নামায পড়তেন। (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক) আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) অসুবিধার কারণে নামাযে অনুরুপ বসতেন। (বুখারী ৮২৭নং)  অবশ্য তাশাহহুদের বৈঠকে বসার মতও বসে নামায পড়তে পারে। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/২৪৩)

বসে না পারলে (ডান) পার্শ্বদেশে শুয়ে, তা না পারলে চিৎ হয়ে শুয়ে, (মাথাটা বালিশ ইত্যাদি দিয়ে একটু উঁচু করে) কেবলার দিকে মুখ ও পা করে নামায পড়বে। দাঁড়াবার সামথ্য থাকলে এবং বসতে না পারলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়বে।

মহান আল্লাহ বলেন,

(فَاذْكُرُوا اللهَ قِيَاماً وَّقُعُوْداً وَّعَلَى جُنُوْبِكُمْ)

অর্থাৎ, তোমরা দাঁড়িয়ে, বসে ও পার্শ্বদেশে শয়ন করে আল্লাহকে স্মরণ কর। (কুরআন মাজীদ ৪/১০৩)

  তিনি আরো বলেন,  (فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ)

অর্থাৎ, আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করে চল। (কুরআন মাজীদ ৬৪/১৬)

ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমার অর্শ রোগ ছিল। আমি (কিভাবে নামায পড়ব তা) আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়। না পারলে বসে পড়। তাও না পারলে পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়।” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১২৪৮ নং)

কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও যদি রোগী বসে না পড়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে, তাহলে তার জন্য রয়েছে ডবল সওয়াব। একদা একদল লোকের নিকট মহানবী (সাঃ) বের হয়ে দেখলেন, তারা অসুস্থতার কারণে বসে বসে নামায পড়ছে। তা দেখে তিনি বললেন, “বসে নামায পড়ার সওয়াব দাঁড়িয়ে নামায পড়ার সওয়াবের অর্ধেক।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

অনুরুপ বসে নামায পড়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি আরামনেওয়ার জন্য রোগী শুয়ে নামায পড়ে তাহলে তার জন্য রয়েছে অর্ধেক সওয়াব। (বুখারী ১১১৫নং)

যতটা সম্ভব দাঁড়িয়ে এবং যতটা প্রয়োজন বসেও নামায পড়তে পারে। বৃদ্ধ বয়সে মহানবী (সাঃ) রাতের নামাযে বসে ক্বিরাআত করতেন। অতঃপর ৩০/৪০ আয়াত ক্বিরাআত বাকী থাকলে তিনি উঠে তা পাঠ করে রুকূ করতেন। (বুখারী ১১১৮নং)

রোগী সাধ্যমত রুকূ-সিজদাহ করবে। না পারলে মস্তক দ্বারা ইঙ্গিত করবে। রুকূর চাইতে সিজদার সময় অধিক ঝুঁকবে। তা সম্ভব না হলে চোখের ইশারায় রুকূ-সিজদাহ করবে। রুকূর চাইতে সিজদার ক্ষেত্রে চক্ষুকে অধিকতর নিমীলিত করবে।

হাত বা আঙ্গুল দ্বারা ইশারা বিধিসম্মত নয়। কারণ, অনুরুপ নির্দেশ শরীয়তে আসেনি। (ইবনে বায, ইবনে উষাইমীন)

চক্ষু দ্বারা ইশারা সম্ভব না হলে অন্তরে (কল্পনায়) কিয়াম, রুকূ ও সিজদা আদির নিয়ত করে তকবীর, কিরাআত ও দুআ-দরুদ পাঠ করবে।

আত্মাকে কষ্ট দিয়ে সাধ্যের অতীত আমল করা শরীয়তে পছন্দনীয় নয়। সিজদাহ মাটিতে না করতে পারলে কোন জিনিস উঁচু করে বা তুলে তাতে সিজদাহ করা বৈধ নয়। একদা মহানবী (সাঃ) এক রোগীকে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন, সে বালিশের উপর সিজদাহ করছে। তিনি তা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সে একটি কাঠ নিলে কাঠটাকেও ছুঁড়ে ফেললেন। অতঃপর বললেন, “যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে মাটিতে নামায পড় (সিজদাহ কর)। তা না পারলে কেবল ইশারা কর। আর তোমার রুকূর তুলনায় সিজদাকে অধিক নিচু কর।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, বাযযার, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৩২৩নং)

অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে যাওয়ার ভয় হলে দেওয়াল বা খুঁটিতে ভর করে দাঁড়াতে পারে। মহানবী (সাঃ) যখন বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন এবং স্বাস্থ্য মোটা হয়ে গেল, তখন তাঁর নামাযের জায়গায় একটি খুঁটি বানানো হয়েছিল; যাতে তিনি ভর করে নামায পড়তেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক,সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৩১৯, ইর: ৩৮৩নং)

রোগী হলেও প্রত্যেক নামায যথাসময়ে পড়বে। না পারলে জমা করার নিয়ম অনুযায়ী ২ ওয়াক্তের নামায জমা করে পড়বে।

অসুস্থ অবস্থায় পূর্ণরুপে নামায আদায় করতে সক্ষম না হলেও সুস্থ অবস্থার মত পূর্ণ সওয়াব লাভ হয়ে থাকে রোগীর। মহানবী (সাঃ) বলেন, “বান্দা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে অথবা সফর করে, তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য সেই সওয়াবই লিখে থাকেন, যে সওয়াব সে সুস্থ ও ঘরে থাকা অবস্থায় আমল করে লাভ করত।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, জামে ৭৯৯নং)


অসুস্থতার সময় রোগীর বেকার বসে বা শুয়ে থাকার সময়। এ সময়কে মূল্যবান জেনে আল্লাহর যিক্‌র করা উচিৎ রোগীর। কষ্টের সময়ে কেবল তাঁরই সকাশে আকূল আবেদনের সাথে নফল নামায ও খাস মুনাজাত করার এটি একটি সুবর্ণ সময়। রাত্রে বহু রোগীর ঘুম আসে না। এমন অনিদ্রায় ফালতু রাত্রি অতিবাহিত না করে তাহাজ্জুদ পড়ে রোগী তার পরপারের জন্য সম্বল বৃদ্ধি করতে পারে।


স্বালাতুল খাওফ (ভয়ের নামায)

স্বালাতুল খাওফ (ভয়ের নামায) - বিস্তারিত
শত্রুর সামনে খুন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও নামায ও জামাআত মাফ নয়। সে অবস্থাতেও জিহাদের ময়দানে যথাসময়ে জামাআত সহকারে নামায পড়তেই হবে মুসলিমকে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(وَإِذَا كُنْتَ فِيْهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلاَةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِّنْهُمْ مَّعَكَ وَلْيَأْخُذُوْا أَسْلِحَتَهُمْ، فَإِذَا سَجَدُوْا فَلْيَكُوْنُوْا مِنْ وَّرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّوْا فَلْيُصَلُّوْا مَعَكَ، وَلْيَأْخُذُوْا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ، وَدَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ تَغْفُلُوْنَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيْلُوْنَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَّاحِدَةً، وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِّنْ مَّطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَّرْضَى أَنْ تَضَعُوْا أَسْلِحَتَكُمْ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ، إِنَّ اللهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِيْنَ عَذَاباً مُّهِيْناً)

অর্থাৎ, তুমি যখন তাদের মাঝে অবস্থান করবে ও তাদের নিয়ে নামায পড়বে তখন একদল যেন তোমার সঙ্গে দাঁড়ায়, আর তারা যেন সশস্ত্র থাকে। অতঃপর সিজদাহ করা হলে তারা যেন তোমাদের পিছনে অবস্থান করে; আর অপর একদল যারা নামাযে শরীক হয়নি তারা তোমার সাথে যেন নামাযে শরীক হয় এবং তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে। কাফেররা কামনা করে, যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্র-শস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও, যাতে তারা তোমাদের উপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর অস্ত্র রাখাতে তোমাদের কোন দোষ নেই যদি বৃষ্টি-বাদলের জন্য তোমাদের কষ্ট হয় অথবা তোমাদের অসুখ হয়। কিন্তু অবশ্যই তোমরা হুশিয়ার থাকবে। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (কুরআন মাজীদ ৪/১০২)

ভয়ের নামায শুদ্ধ বর্ণনা মতে মোটামুটি ৬ ভাবে পড়া যায়। যা সংক্ষেপে নিম্নরুপ :-

১। শত্রু কিবলা ছাড়া অন্য দিকে থাকলে ইমাম একদল সৈন্যের সাথে এক রাকআত নামায পড়ে অপেক্ষা করবেন। মুক্তাদীগণ নিজে নিজে আর এক রাকআত নামায পড়ে সালাম ফিরে উঠে গিয়ে শত্রুর সামনে খাড়া হবে। অতঃপর অন্য দল সৈন্য এসে ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পড়বে। এরপর ইমাম বসে যাবেন এবং মুক্তাদীগণ নিজে নিজে বাকী এক রাকআত পুরা করে নেবে। পরিশেষে ইমাম তাদেরকে নিয়ে সালাম ফিরবেন। (বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান)

২। শত্রু কিবলা ছাড়া অন্য দিকে থাকলে ইমাম একদল সৈন্যের সাথে এক রাকআত নামায পড়ে অপেক্ষা করবেন। মুক্তাদীগণ সালাম ফিরে উঠে গিয়ে শত্রুর সামনে খাড়া হবে। অতঃপর অন্য দল সৈন্য এসে ইমামের সাথে এক রাকআত নামায পড়বে। এরপর ইমাম সালাম ফিরবেন এবং মুক্তাদীরা বাকী এক রাকআত পুরা করে নেবে। অতঃপর এ দল শত্রুর সামনে খাড়া হলে প্রথম দলও তাদের বাকী এক রাকআত কাযা করে নেবে। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

৩। ইমাম প্রথম দলকে নিয়ে ২ রাকআত নামায পড়ে সালাম ফিরবেন। অতঃপর তারা শত্রুর সামনে গেলে দ্বিতীয় দলকে নিয়ে আবার ২ রাকআত নামায পড়বেন। আর এ ২ রাকআত নামায ইমামের জন্য নফল হবে। (আহমাদ, মুসনাদ, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান)

৪। শত্রু কিবলার দিকে হলে সকলে মিলে নামাযে দাঁড়িয়ে যাবে। সকলেই এক সঙ্গে রুকূ করবে, অতঃপর মাথা তুলে প্রথম দল (কাতার) ইমামের সাথে সিজদাহ করবে এবং দ্বিতীয় দল (কাতার) শত্রুর মোকাবেলায় খাড়া থাকবে। অতঃপর প্রথম কাতার সিজদাহ শেষ করলে দ্বিতীয় কাতার সিজদায় যাবে। অনুরুপ দ্বিতীয় রাকআত পড়বে এবং সর্বশেষে সকলে এক সাথে সালাম ফিরবে। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বায়হাকী)

৫। উভয় দলই ইমামের সাথে নামাযে দাঁড়াবে। অতঃপর একদল শত্রুর সামনে খাড়া থাকবে এবং এক দলকে নিয়ে ইমাম এক রাকআত নামায পড়বেন। এরপর এ দল উঠে শত্রুর মোকাবেলায় থাকবে এবং অপর দল এসে নিজে নিজে এক রাকআত নামায পড়ে নেবে, আর এ সময় ইমাম খাড়া থাকবেন। তারপর এই দলকে নিয়ে ইমাম দ্বিতীয় রাকআত পড়বেন এবং সকলে বসে যাবে। অতঃপর অপর দল এসে নিজে নিজে তাদের বাকী এক রাকআত পড়ে নেবে। সর্বশেষে ইমাম ও মুক্তাদী মিলে এক সাথে সালাম ফিরবে। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান নাসাঈ, সুনান)

৬। ইমামের সাথে প্রত্যেক দল এক রাকআত করে নামায পড়বে। ইমামের হবে ২ রাকআত এবং মুক্তাদীদের এক রাকআত। প্রথম দল এক রাকআত পড়ে (সালাম ফিরে) শত্রুর মোকাবেলায় চলে যাবে। অতঃপর দ্বিতীয় দল এসে ইমামের পিছনে শরীক হয়ে মাত্র এক রাকআত পড়বে। পরিশেষে এই দলকে নিয়ে ইমাম সালাম ফিরবেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

মাগরেবের নামায হলে ইমাম প্রথম দলকে নিয়ে ২ রাকআত এবং দ্বিতীয় দলকে নিয়ে এক রাকআত নামায পড়বেন। অথবা প্রথম দলকে নিয়ে এক রাকআত এবং দ্বিতীয় দলকে নিয়ে ২ রাকআত নামায পড়বেন। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/২৪৭)


ভয় বেশী হলে
ভয় বেড়ে গেলে এবং যুদ্ধ সংঘটিত হলে প্রত্যেকে নিজ নিজ সামথ্য অনুযায়ী চলা অবস্থায়, সওয়ার অবস্থায়, কেবলার দিকে মুখ করে অথবা না করে, যেভাবেই হোক, ইঙ্গিতে-ইশারায় রুকূ-সিজদাহ করে নামায সম্পন্ন করবে। ঝুঁকে রুকূ-সিজদাহ করলে রুকূর চেয়ে সিজদার অবস্থায় বেশী ঝুঁকবে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ) ঝুঁকার সুযোগ না থাকলে কেবল তকবীর বলে মাথার ইশারায় নামায আদায় করতে হবে। (বায়হাকী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৬পৃ:)


সুন্নত ও নফল নামায

সুন্নত ও নফল (অতিরিক্ত) নামায
যে নামায পড়া বাধ্যতামূলক নয়, যা ত্যাগ করলে গুনাহ হয় না কিন্তু পড়লে সওয়াব হয় সেই শ্রেণীর নামাযের বড় মাহাত্ম রয়েছে শরীয়তে।

রসূল (সাঃ) বলেন, “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে তার আমলসমূহের মধ্যে যে আমলের হিসাব সর্বাগ্রে নেওয়া হবে, তা হল নামায। নামায ঠিক হলে সে পরিত্রাণ ও সফলতা লাভ করবে। নচেৎ (নামায ঠিক না হলে) ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং (হিসাবের সময়) ফরয নামাযে কোন কমতি দেখা গেলে আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা ফিরিশ্‌তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘দেখ, আমার বান্দার কোন নফল (নামায) আছে কি না।’ অতএব তার নফল নামায দ্বারা ফরয নামাযের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর আরো সকল আমলের হিসাব অনুরুপ গ্রহণ করা হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০, তিরমিযী, সুনান ৩৩৭, সইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৭নং, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)

মহানবী (সাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওলীর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। বান্দা যা কিছু দিয়ে আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে তার মধ্যে আমার নিকট প্রিয়তম হল সেই ইবাদত, যা আমি তার উপর ফরয করেছি। আর সে নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। পরিশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। অতঃপর আমি তার শোনার কান হয়ে যাই, তার দেখার চোখ হয়ে যাই, তার ধরার হাত হয়ে যাই, তার চলার পা হয়ে যাই! সে আমার কাছে কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিয়ে থাকি। আর আমি যে কাজ করি তাতে কোন দ্বিধা করি না -যতটা দ্বিধা করি এজন মুমিনের জীবন সম্পর্কে; কারণ, সে মরণকে অপছন্দ করে। আর আমি তার (বেঁচে থেকে) কষ্ট পাওয়াকে অপছন্দ করি।” (বুখারী ৬৫০২নং)


উল্লেখ্য যে, আল্লাহ বান্দার কান, চোখ, হাত ও পা হওয়ার অর্থ হল, বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি মতেই এ সবকে ব্যবহার করে। যাতে ব্যবহার করলে তিনি অসন্তুষ্ট, তাতে সে ঐ সকল অঙ্গকে ব্যবহার করে না।

নফল নামায ঘরে পড়া ভাল
ফরয নামায বিধিবদ্ধ হয়েছে দ্বীনের প্রচার ও তার প্রতীকের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে। তাই ফরয নামায প্রকাশ্যভাবে লোক মাঝে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পক্ষান্তরে নফল নামায বিধিবদ্ধ হয়েছে নিছক মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাঁর নৈকট্য লাভ করার লক্ষ্যে। সুতরাং নফল নামায যত গুপ্ত হবে, তত লোকচক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ তথা ‘রিয়া’ থেকে অধিক দূর ও পবিত্র হবে। (ফাইযুল ক্বাদীর ৪/২২০)  আর সে জন্যই নফল নামায স্বগৃহে গোপনে পড়া উত্তম।

তাছাড়া নফল নামায ঘরে পড়লে নামাযের তরীকা ও গুরুত্ব পরিবার-পরিজনের কাছে প্রকাশ পায়। আর এ জন্য হুকুম হল, “তোমরা ঘরে নামায পড় এবং তা কবর বানিয়ে নিও না।” (বুখারী ৪৩২, মুসলিম, সহীহ ৭৭৭, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৪৮, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ৩৭৮৪নং)  অর্থাৎ, কবরে বা কবরস্থানে যেমন নামায নেই বা হয় না সেইরুপ নিজের ঘরকেও নামাযহীন করে রেখো না।

মহানবী (সাঃ) আরো বলেন, “তোমরা স্বগৃহে নামায পড় এবং তাতে নফল পড়তে ছেড়ো না।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৯১০, জামে ৩৭৮৬নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউযখন মসজিদে (ফরয) নামায সম্পন্ন করে তখন তার উচিৎ, সে যেন তার নামাযের কিছু অংশ (সুন্নত নামায) নিজের বাড়ির জন্য রাখে। কারণ বাড়িতে পড়া ঐ কিছু নামাযের মধ্যে আল্লাহ কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।” (মুসলিম, সহীহ ৭৭৮নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে মানবসকল! তোমরা স্বগৃহে নামায আদায় কর। যেহেতু ফরয নামায ছাড়া মানুষের শ্রেষ্ঠতম নামায হল তার স্বগৃহে পড়া নামায।” (নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৪৩৭নং)

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) বলেন, “যেখানে লোকে দেখতে পায় সেখানে মানুষের নফল নামায অপেক্ষা যেখানে লোকে দেখতে পায় না সেখানের নামায ২৫ টি নামাযের বরাবর।” (আবূ য়্যা’লা, জামে ৩৮২১নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “লোকচক্ষুর সম্মুখে (নফল) নামায পড়া অপেক্ষা মানুষের স্বগৃহে নামায পড়ার ফযীলত ঠিক সেইরুপ, যেরুপ নফল নামায অপেক্ষা ফরয নামাযের ফযীলত বহুগুণে অধিক।” (বায়হাকী, সহিহ তারগিব ৪৩৮নং)


এমন কি মদ্বীনাবাসীর জন্যও মসজিদে নববীতে নফল নামায পড়ার চাইতে নিজ নিজ ঘরে পড়া বেশী উত্তম। (আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৩৮১৪নং)

নফল নামাযে লম্বা কিয়াম করা উত্তম
নফল নামায সাধারণত: একার নামায। তাই তাতে ইচ্ছামত লম্বা ক্বিরাআত করা যায়। বরং এই নামাযে কিয়াম লম্বা করা মুস্তাহাব। মহানবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সবচেয়ে উত্তম নামায কি? উত্তরে তিনি বললেন, “লম্বা কিয়াম বিশিষ্ট নামায।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৪৪৯নং)


আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (সাঃ) তাহাজ্জুদের নামাযে এত লম্বা কিয়াম করতেন যে, তাতে তাঁর পা ফুলে যেত। সাহাবাগণ বলেছিলেন, আল্লাহ আপনার আগের-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন তবুও আপনি কেন অনুরুপ নামায পড়েন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হ্‌ব না?” (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২২০নং)

নফল নামায বিনা ওজরে বসে পড়াও বৈধ
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, সক্ষম হলে ফরয নামায দাঁড়িয়ে পড়া ফরয। কিন্তু নফল নামায ক্ষমতা থাকতেও বসে পড়াও বৈধ। যদিও বসে নামায পড়ার সওয়াব দাঁড়িয়ে নামায পড়ার সওয়াবের অর্ধেক। মহানবী (সাঃ) বলেন, “বসে নামায পড়ার সওয়াব অর্ধেক নামাযের বরাবর।” (বুখারী, মিশকাত ১২৪৯নং)

বরং নফল নামায চিৎ হয়ে শুয়েও পড়া যায়। তবে এ অবস্থায় বসে পড়ার অর্ধেক সওয়াব হবে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আর শুয়ে নামায পড়ার সওয়াব বসে নামায পার অর্ধেক।” (বুখারী ১১১৬নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১১৩-১১৪)

নফল নামাযের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে এবং কিছু অংশ বসে পড়া যায়। বরং একই কিয়ামের কিছু অংশ দাঁড়িয়ে এবং কিছু অংশ বসে ক্বিরাআত করা যায়। তাতে কিয়ামের প্রথম অথবা শেষ অংশ বসে হলেও কোন দোষাবহ্‌ নয়।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘তিনি বসে ক্বিরাআত করতেন। অতঃপর রুকূ করার ইচ্ছা করলে উঠে দাঁড়িয়ে যেতেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭৩১নং)


মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাতের নামাযে আমি নবী (সাঃ)-কে বসে ক্বিরাআত করতে দেখিনি। অতঃপর তিনি যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন, তখন তিনি বসে ক্বিরাআত করতেন। পরিশেষে যখন ৪০ বা ৩০ আয়াত বাকী থাকত, তখন তিনি খাড়া হয়ে তা পাঠ করতেন। অতঃপর (রুকূ) সিজদা করতেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৭৩১নং, আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌)

সুন্নত নামাযের কাযা

সুন্নত নামায ছুটে গেলে কাযা পড়া সুন্নত, জরুরী নয়। পক্ষান্তরে ইচ্ছা করে ছেড়ে দিলে তার কাযা নেই। পড়লে তা মকবুলও নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০২)

নফল নামাযের প্রকারভেদ

ফরয নামায ছাড়া অন্যান্য নামায দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হল সেই নামায, যা (সময় ও রাকআত সংখ্যা দ্বারা) নির্দিষ্ট নয়। এ নামায নিষিদ্ধ সময় ছাড়া যে কোন সময়ে অনির্দিষ্ট রাকআতে পড়া যায়। আর দ্বিতীয় প্রকার হল সেই নামায, যা (সময় ও রাকআত সংখ্যা দ্বারা) নির্দিষ্ট। যে নামাযের নির্দিষ্ট সময় ও রাকআত সংখ্যা মহানবী (সাঃ) কর্তৃক প্রমাণিত আছে। এই শ্রেণীর নামায আবার দুই প্রকার; সুন্নাতে মুআক্কাদাহ ও গায়র মুআক্কাদাহ।

সুন্নাতে মুআক্কাদাহ ও গায়র মুআক্কাদাহ

যে সুন্নত ফরয নামাযের আগে-পিছে পড়া হয় তা হল দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হল, সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বা সুন্নাতে রাতেবাহ্‌। আর দ্বিতীয় হল, সুন্নাতে গায়র মুআক্কাদাহ বা গায়র রাতেবাহ্‌। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১৬০পৃ: দ্র:)

সুন্নাতে মুআক্কাদাহ বা রাতেবাহ্‌
সুন্নাতে মুআক্কাদাহ সেই সুন্নত নামায, যা মহানবী (সাঃ) ফরয নামাযের আগে-পিছে নিজে পড়েছেন এবং উম্মতকে পড়তে তাকীদ, উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে কোন মুসলিম বান্দা প্রত্যহ্‌ আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে বারো রাকআত নফল (ফরয ব্যতীত সুন্নত) নামায পড়লেই আল্লাহ তাআলা জান্নাতে তার জন্য এক গৃহ্‌ নির্মাণ করেন। অথবা তার জন্য জান্নাতে এক ঘর নির্মাণ করা হয়।” (মুসলিম, সহীহ ৭২৮নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান)

তিরমিযীর বর্ণনায় কিছু শব্দ অধিক রয়েছে, “(ঐ বারো রাকআত নামায;) যোহরের (ফরযের) পূর্বে চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরেবের পরে দুই রাকআত, এশার পরে দুই রাকআত, আর ফজরের (ফরয নামাযের) পূর্বে দুই রাকআত।”


হযরত আয়েশা رضي الله عنها  হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়মনিষ্ঠভাবে দিবারাত্রে বারো রাকআত নামায পড়বে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যোহরের (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরেবের পর দুই রাকআত, এশার পর দুই রাকআত এবং ফজরের (ফরযের) পূর্বে দুই রাকআত।” (নাসাঈ, সুনান, এবং শব্দগুলি তাঁরই, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সহিহ তারগিব ৫৭৭নং)

ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত
এই নামাযের ফযীলত :



হযরত আয়েশা رضي الله عنها হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “ফজরের দুই রাকআত (সুন্নত) পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থিত সকল বস্তু অপেক্ষা উত্তম।” (মুসলিম ৭২৫নং, তিরমিযী)

মা আয়েশা رضي الله عنها বলেন, ‘নবী (সাঃ) ফজরের সুন্নতের মত অন্য কোন নফল নামাযে তত নিষ্ঠা প্রদর্শন করতেন না।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

হযরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “(ফজরের সময়) যে ব্যক্তি (স্বগৃহে) ওযু করে। অতঃপর মসজিদে এসে ফজরের (ফরয) নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়ে। অতঃপর বসে (অপেক্ষা ক’রে) ফজরের নামায (জামাআতে) পড়ে, সেই ব্যক্তির সেদিনকার নামায নেক লোকদের নামাযরুপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তার নাম পরম করুণাময় (আল্লাহর) প্রতিনিধিদলের তালিকাভুক্ত হয়।” (ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৪১৩নং)



এ নামাযকে হাল্কা করে পড়া :

হযরতহাফসা (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) ফজরের নামাযের পূর্বে আমার ঘরে দুই রাকআত সুন্নত পড়তেন এবং তা খুবই হাল্কা করে পড়তেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

হযরত আয়েশা رضي الله عنها বলেন, ‘ নবী (সাঃ) ফজরের নামাযের পূর্বে দুই রাকআত নামায পড়তেন এবং তা এত সংক্ষেপে পড়তেন যে, আমি সন্দেহ্‌ করতাম, তিনি তাতে সূরা ফাতিহা পড়লেন কি না।’ (আহমাদ, মুসনাদ)



এ নামাযের ক্বিরাআত :

এই নামাযের প্রথম রাকআতে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস (ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ) পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ ৭২৬, আবূদাঊদ, সুনান ১২৫৬, তিরমিযী, সুনান ৪১৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৪৯নং)

তিনি বলতেন, “উত্তম সূরা সে দুটি, যে দুটি ফজরের পূর্বে দুই রাকআতে পড়া হয়; ‘ক্বুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন’ এবং ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৫০, ইবনে হিব্বান, সহীহ, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬৪৬নং)

কখনো কখনো তিনি এই নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা বাক্বারার ১৩৬ নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা আলে ইমরানের ৬৪নং আয়াত পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭২৭নং, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী)

আবার কোন কোন সময়ে প্রথম রাকআতে সূরা বাক্বারার ১৩৬নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা আলে ইমরানের ৫২ নং আয়াত পড়তেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১২৫৯নং)

এ ছাড়া ফজরের সুন্নত হাল্কা করে পড়া সুন্নত। অতএব তাতে যদি কেবল সূরা ফাতিহা পড়া যায়, তাহলেও বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌)

প্রকাশ থাকে যে, ফজরের সুন্নত পড়ার পর নির্দিষ্ট কোন দুআ পড়ার হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৩৮-২৩৯পৃ:)

 এই নামাযের পর ডান কাতে শয়ন :

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) যখন ফজরের সুন্নত পড়ে নিতেন, তখন ডান কাতে শয়ন করতেন।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১১৯০নং)

তিনি আরো বলেন, ‘নবী (সাঃ) ফজরের সুন্নত পড়তেন। তারপর যদি আমি ঘুমিয়ে থাকতাম তাহলে তিনি শয়ন করতেন। নচেৎ, আমি জেগে থাকলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১১৮৯নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন ফজরের দুই রাকআত সুন্নত পড়ে নেয়, তখন সে যেন ডান কাতে শয়ন করে।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, জামে ৬৪২নং)

সম্ভবত: উক্ত শয়ন যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়বে তার জন্য সুন্নত। যাতে একটানা নামায পড়ার পর ফরয নামায পড়ার আগে একটু জিরিয়ে নিতে পারে। পরন্তু তার জন্য সুন্নত নয়, যে একবার মাটিতে পার্শ্ব রাখলে চট করে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তার ফলে ফজরের জামাআতই ছুটে যায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০০)

তদনুরুপ উক্ত শয়ন যে ব্যক্তি বাসায় সুন্নত পড়বে তার জন্য সুন্নত ও মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে যে মসজিদে সুন্নত পড়বে তার জন্য মুস্তাহাব নয়। কারণ, মহানবী (সাঃ)-এর শয়নের কথা তাঁর বাসায় থাকা অবস্থায় উল্লেখ হয়েছে। মসজিদে সুন্নত পড়ে যে তিনি শয়ন করতেন, তার উল্লেখ নেই। ইবনে উমার উক্ত মত পোষণ করতেন। তাই মসজিদে কেউ ফজরের সুন্নতের পর শয়ন করলে তাকে কাঁকর ছুঁড়ে উঠিয়ে দিতেন। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার, ইবনে আবী শাইবা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/১৬৬)

এই জন্যই ফজরের সুন্নতের পর মসজিদে শয়নকে অনেকে বিদআত বলে মন্তব্য করেছেন। (মু’জামুল বিদা’ ৩৩৭পৃ:)



এই নামাযের কাযা :

অন্যান্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামাযের তুলনায় উক্ত নামাযের এত বেশী গুরুত্ব যে, মহানবী (সাঃ) ঘরে-সফরে তা পড়তেন এবং তা ছুটে গেলে কাযা করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

একদা মহানবী (সাঃ) সাহাবাবর্গের সাথে এক সফরে ছিলেন। ফজরের নামাযের সময় সকলে গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকলে সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সূর্যের ছটা তাঁদের মুখে লাগলে চেতন হলেন। অতঃপর একটু সরে গিয়ে মহানবী (সাঃ) বিলাল (রাঃ)-কে আযান দিতে বললেন। এরপর ফজরের দুই রাকআত সুন্নত পড়লেন। তারপর ইকামত দিয়ে ফজরের ফরয পড়লেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী,মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং)

উক্ত নামায কাযা করার দুটি সময় হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ফজরের পর কোন নফল পড়া নিষিদ্ধ হলেও ফজরের আগে ছুটে যাওয়া সুন্নতকে ফরযের পর পড়া যায়। আর এটি হল ব্যতিক্রম নামায। একদা এক ব্যক্তি মসজিদে এসে দেখল আল্লাহর নবী (সাঃ) ফজরের ফরয পড়ছেন। সে সুন্নত না পড়ে জামাআতে শামিল হয়ে গেল। অতঃপর জামাআত শেষে উঠে ফজরের ছুটে যাওয়া দুই রাকআত সুন্নত আদায় করল। মহানবী (সাঃ) তার কাছে এসে বললেন, “এটি আবার কোন্‌ নামায? (ফজরের নামায কি দুইবার?)” লোকটি বলল, ‘ফজরের দুই রাকআত সুন্নত ছুটে গিয়েছিল।’ এ কথা শুনে তিনি আর কিছুই বললেন না (চুপ থাকলেন)। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৬৭, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

আর এক হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের ২ রাকআত (সুন্নত) না পড়ে থাকে, সে যেন তা সূর্য ওঠার পর পড়ে নেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৩, জামে ৬৫৪২নং)

এই নামায বিষয়ক আরো কিছু মাসায়েল :


মসজিদে এসে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়লে পৃথক আর তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায পড়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কেউ যদি তা পড়ে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়ে তাহলেও কোন ক্ষতি হয় না। তবুও ফজরের সময় উত্তম হল তাহিয়্যাতুল মাসজিদ না পড়ে কেবল ফজরের সুন্নত পড়া। কারণ, মহানবী (সাঃ) ফজরের সুন্নতই বড় সংক্ষেপে পড়তেন। (ফাতাওয়া তাতাআল্লাকু বিজামাআতিল মাসজিদ ১৭-১৮পৃ:) তাছাড়া তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিকে যেন পৌঁছে দেয় যে, ফজরের (আযানের) পর দু’ রাকআত (সুন্নত) ছাড়া আর কোন (নফল) নামায পড়ো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৭৮ নং)  “ফজরের পর দুই রাকআত ছাড়া আর কোন নামায নেই।” (তিরমিযী, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪৭৮, জামে ৭৫১১নং)

যোহরের সুন্নত
নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) যোহরের সুন্নত কখনো ৪ রাকআত পড়তেন; ২ রাকআত ফরযের পূর্বে এবং ২ রাকআত ফরযের পরে।

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমি নবী (সাঃ)-এর নিকট থেকে ১০ রাকআত নামায ±মরণে রেখেছি; ২ রাকআত যোহরের পূর্বে, ২ রাকআত যোহরের পরে, ২ রাকআত মাগরেবের পরে নিজ ঘরে, ২ রাকআত এশার পরে নিজ ঘরে এবং ২ রাকআত ফজরের নামাযের পূর্বে।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১১৬০নং)

কখনো ৬ রাকআত পড়তেন; ৪ রাকআত ফরযের পূর্বে এবং ২ রাকআত ফরযের পরে।

আব্দুল্লাহ বিন শাকীক মা আয়েশা (রাঃ)কে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর সুন্নত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি যোহরের আগে ৪ রাকআত এবং যোহরের পরে ২ রাকআত নামায পড়তেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১১৬২নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে কোন মুসলিম বান্দা প্রত্যহ্‌ আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে বারো রাকআত নফল (ফরয ব্যতীত সুন্নত) নামায পড়লেই আল্লাহ তাআলা জান্নাতে তার জন্য এক গৃহ্‌ নির্মাণ করেন। অথবা তার জন্য জান্নাতে এক ঘর নির্মাণ করা হয়। (ঐ বারো রাকআত নামায;) যোহরের (ফরযের) পূর্বে চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরেবের পরে দুই রাকআত, এশার পরে দুই রাকআত, আর ফজরের (ফরয নামাযের) পূর্বে দুই রাকআত।” (মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৫৯নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়মনিষ্ঠভাবে দিবারাত্রে বারো রাকআত নামায পড়বে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যোহরের (ফরয নামাযের) পূর্বে চার রাকআত ও পরে দুই রাকআত, মাগরেবের পর দুই রাকআত, এশার পর দুই রাকআত এবং ফজরের (ফরযের) পূর্বে দুই রাকআত।” (নাসাঈ, সুনান, শব্দগুলি তাঁরই, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সহিহ তারগিব৫৭৭নং)

তিনি কখনো বা ৮ রাকআত পড়তেন; ৪ রাকআত ফরযের পূর্বে এবং ৪ রাকআত ফরযের পরে।

হযরত উম্মেহাবীবা رضي الله عنها কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি যোহরের পূর্বে ৪ রাকআত এবং পরে ৪ রাকআত (সুন্নত নামাযের) প্রতি সবিশেষ যত্নবান হবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন।”  (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১১৬৭, সহিহ তারগিব ৫৮১নং)

আব্দুল্লাহ বিন সায়েব বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) সূর্য ঢলার পর যোহরের আগে ৪ রাকআত নামায পড়তেন এবং বলতেন, “এটা হল এমন সময়, যে সময়ে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়। আর আমি পছন্দ করি যে, এই সময়ে আমার নেক আমল উত্থিত হোক।” (তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১১৬৯নং)

যোহরের পূর্বে ৪ রাকআত সুন্নত, সওয়াবে ৪ রাকআত তাহাজ্জুদ পড়ার সমান। (ইবনে আবী শাইবা, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৪৩১নং)

প্রকাশ থাকে যে, যোহরের পূর্বে বা পরে ঐ ৪ রাকআত করে নামায ২ রাকআত করে পড়ে সালাম ফিরা উত্তম। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “রাত ও দিনের নামায ২ রাকআত করে।” (আবূদাঊদ, সুনান) তবে একটানা ৪ রাকআত এক সালামেও পড়া বৈধ। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১/৪৭৭, ২৩৭নং)  মহানবী (সাঃ) বলেন, “যোহরের পূর্বে ৪ রাকআত; (যার মাঝে কোন সালামনেই,) তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ১২৭০, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৫৭, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ১২১৪, জামে ৮৮৫নং, শেষ তাহক্কীকে বন্ধনীর মাঝের শব্দগুলি সহীহ নয়।)

আবূ আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) সূর্য ঢলার সময় ৪ রাকআত নামায প্রত্যহ্‌ পড়তেন। একদা আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি সূর্য ঢলার সময় এই ৪ রাকআত প্রত্যহ্‌ পড়ছেন?’ তিনি বললেন, “সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং যোহরের নামায না পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। অতএব আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক আমল (আকাশে আল্লাহর নিকট) উঠা হোক।” আমি বললাম, ‘তার প্রত্যেক রাকআতেই কি ক্বিরাআত আছে?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ।” আমি বললাম, ‘তার মাঝে কি পৃথককারী সালাম আছে?’ তিনি বললেন, “না।” (মুখতাসারুশ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়্যাহ্‌, আলবানী ২৪৯নং)

অবশ্য অনেকের মতে ঐ নামায যাওয়ালের সুন্নত।

তবে মসজিদে গিয়ে পড়লে জামাআতের সময় খেয়াল রেখে এক সালাম বা ২ সালামের নিয়ত করতে হয়। যাতে সময় সংকীর্ণ হলে এবং ৩ রাকআত পূর্ণ না হতে হতে ইকামত না হয়ে বসে। নচেৎ, সুন্নত ত্যাগ করে জামাআতে শামিল হতে হলে সবটুকুই বরবাদ যাবে। পক্ষান্তরে ২ রাকআত করে পড়লে নষ্ট হওয়ার ভয় থাকবে না।

এই সুন্নতের কাযা :

সুন্নত কাযা পড়া সুন্নত; জরুরী নয়। কারণবশত: যোহরের পূর্বের সুন্নত পড়তে না পারলে ফরযের (পরের সুন্নতের) পরে তা কাযা করা বিধেয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) যোহরের পূর্বের ৪ রাকআত পড়তে না পারলে (ফরযের) পরে তা পড়ে নিতেন।’ (তিরমিযী, সুনান, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪১পৃ:)

তদনুরুপ যোহরের পরের সুন্নত পড়তে সময় না পেয়ে যোহরের ওয়াক্ত অতিবাহিত হলেও আসরের পর (নিষিদ্ধ সময় হলেও) তা কাযা পড়া যায়। উম্মে সালামাহ্‌ (রাঃ) বলেন, ‘একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) যোহরের (ফরয) নামায পড়লেন। ইতি অবসরে কিছু (সাদকার) মাল এসে উপস্থিত হল। তিনি তা ব ন্ট ন করতে বসলেন। এরপর আসরের আযান হয়ে গেল। তিনি আসরের নামায পড়লেন। তারপর আমার ঘরে ফিরে এলেন। সেদিন ছিল আমার (ঘরে তাঁর থাকার পালি)। তিনি এসে ২ রাকআত হাল্কা করে নামায পড়লেন। আমরা বললাম, ‘এ ২ রাকআত কোন্‌ নামায হে আল্লাহর রসূল? আপনি কি তা পড়তে আদিষ্ট হয়েছেন?’ তিনি বললেন, “না, আসলে এটা হল সেই ২ রাকআত নামায, যা আমি যোহরের পর পড়ে থাকি। কিন্তু আজ এই মাল এসে গেলে তা বন্টন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আসরের আযান হয়ে যায়। ফলে ঐ নামায আমার বাদ পড়ে যায়। আর তা ছেড়ে দিতেও আমি অপছন্দ করলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান)

আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (সাঃ) যে আমল একবার করতেন, তা নিয়মিত করে যেতেন এবং বর্জন করতে পছন্দ করতেন না। যার জন্য মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) আসরের পর আমার কাছে ২ রাকআত (তাঁর ইন্তিকাল অবধি) কখনো ত্যাগ করেননি।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১১৭৮নং)


উল্লেখ্য যে, ঐ ২ রাকআত নামায মহানবী (সাঃ)-এর অনুকরণে আমরাও পড়তে পারি। অবশ্য আসরের পর নিষিদ্ধ সময় হলেও সূর্য হ্‌লুদবর্ণ হলে তবেই সে সময় নামায নিষিদ্ধ। (আবূদাঊদ, সুনান ১২৭৪নং)  তার আগে নয়। (বিস্তারিত দ্র: সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/১০১০-১০১৪)

মাগরেবের সুন্নত
পূর্বের কয়েকটি হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যে, মাগরেবের পর ২ রাকআত সুন্নত মহানবী (সাঃ) ত্যাগ করতেন না। তবে এই সুন্নত তিনি ঘরে পড়তেন। একদা মাগরেবের পর তিনি বললেন, “এই ২ রাকআত তোমরা নিজ নিজ ঘরে গিয়ে পড়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১১৮২নং)


মাগরেবের সুন্নতেও ফজরের সুন্নতের মতই প্রথম রাকআতে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া সুন্নত। হযরত ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমি গুনতে পারি না যে, নবী (সাঃ) মাগরেবের পর ও ফজরের পূর্বের সুন্নতে কতবার সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাস পাঠ করেছেন।’ (তিরমিযী, সুনান ৪৩১, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১১৬১নং)

এশার সুন্নত
পূর্বের একাধিক হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যে, এশার পরে মহানবী (সাঃ) ২ রাকআত সুন্নত নিজের ঘরে পড়তেন। পক্ষান্তরে এশার নামায পর বাড়ি ফিরে তাঁর ৪ অথবা ৬ রাকআত নামায পড়ার হাদীস সহীহ নয়।


প্রকাশ থাকে যে, সুন্নত নামায ঘরে পড়ার সুযোগ না থাকলে অথবা সংসারের ব্যস্ততায় পড়ার অবসর না হলে তা মসজিদেই পড়ে নেওয়া যায়।

সুন্নাতে গায়র মুআক্কাদাহ
কিছু সুন্নত আছে যা পড়া মুস্তাহাব, কিন্তু তাকীদপ্রাপ্ত নয়। এমন কিছু সুন্নত নামায নিম্নরুপ:-

আসরের পূর্বে ২ অথবা ৪ রাকআত :

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি কৃপা করেন যে আসরের পূর্বে ৪ রাকআত নামায পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৮৪নং)

হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) আসরের পূর্বে ৪ রাকআত নামায পড়তেন এবং প্রত্যেক দুই রাকআতে আল্লাহর নিকটবর্তী ফিরিশ্‌তা, আম্বিয়া ও তাঁদের অনুসারী মুমিন-মুসলিমদের প্রতি সালাম (তাশাহহুদ) দিয়ে তা পৃথক করতেন। আর সর্বশেষে সালাম ফিরতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩৭নং)

লক্ষণীয় যে, আসরের (দিনের) ৪ রাকআত বিশিষ্ট সুন্নত নামায এক সালামেও পড়া বৈধ।

এ ছাড়া মহানবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক আযান ও ইকামতের মাঝে নামায আছে। (যে পড়তে চায় তার জন্য।) (বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), জামে ২৮৫০নং) আর সে নামায কমপক্ষে ২ রাকআত। যেমন মহানবী (সাঃ) বলেন, “এমন কোন ফরয নামায নেই, যার পূর্বে ২ রাকআত নামায নেই।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩২, জামে ৫৭৩০নং)  অবশ্য হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক ২ রাকআতের বর্ণনাও আবূ দাঊদে এসেছে। কিন্তু তা সহীহ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ২৩৫নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪১পৃ:)

মাগরেবের আগে ২ রাকআত :

মাগরেবের আযানের পর এবং ফরয নামাযের পূর্বে ২ রাকআত সুন্নত গায়র মুআক্কাদাহ।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা মাগরেবের পূর্বে নামায পড়। তোমরা মাগরেবের পূর্বে নামায পড়।” অতঃপর তৃতীয়বারে তিনি বলেন, “যে চায় সে পড়বে।” এ কথা বলার কারণ, তিনি ঐ নামাযকে লোকেদের (জরুরী) সুন্নত মনে করে নেওয়াকে অপছন্দ করলেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১১৬৫নং)

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা মদ্বীনায় ছিলাম। মুআযযিন যখন মাগরেবের আযান দিত, তখন লোকেরা প্রতিযোগিতার সাথে মসজিদের খাম্বাগুলোর পশ্চাতে ২ রাকআত নামায পড়তে লেগে যেত। এমনকি যদি কোন অজানা লোক এসে মসজিদে প্রবেশ করত, তাহলে এত লোকের নামায পড়া দেখে সে মনে করত, হয়তো মাগরেবের জামাআত হয়ে গেছে। (এবং ওরা পরের সুন্নত পড়ছে।)’ (মুসলিম,  মিশকাত ১১৮০ নং)

এ নামায মহানবী (সাঃ) পড়েছেন বলে কোন সহীহ প্রমাণ নেই। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪২পৃ:) বরং হযরত আনাস বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসুল (সাঃ)-এর যুগে সূর্য ডোবার পর মাগরেবের নামাযের আগে ২ রাকআত নামায পড়তাম।’ এ কথা শুনে তাবেয়ী মুখতার বিন ফুলফুল তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) কি ঐ ২ রাকআত নামায পড়তেন?’ উত্তরে আনাস (রাঃ) বললেন, ‘তিনি আমাদেরকে তা পড়তে দেখতেন। কিন্তু সে ব্যাপারে আমাদেরকে কিছু আদেশও করতেন না এবং নিষেধও করতেন না।’ (মুসলিম,  মিশকাত ১১৭৯নং)

এশার পূর্বে ২ রাকআত :

মহানবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক আযান ও ইকামতের মাঝে নামায আছে।” এইরুপ তিনবার বলার পর শেষে বললেন, “যে চাইবে তার জন্য।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৬২নং)

তিনি আরো বলেন, “এমন কোন ফরয নামায নেই, যার পূর্বে ২ রাকআত নামায নেই।” (ইবনে হিব্বান, সহীহ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩২, জামে ৫৭৩০নং) অর্থাৎ, প্রত্যেক ফরয নামাযের পূর্বে ২ রাকআত নামায আছে। সুতরাং এশার ফরযের পূর্বেও আছে। তবে তা সুন্নাতে গায়র মুআক্কাদাহ।


মহানবী (সাঃ) এশার পরে ৪ রাকআত নামাযও ঘরে গিয়ে পড়তেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এক রাত্রে আমার খালা মায়মূনার ঘরে শুলাম। দেখলাম, নবী (সাঃ) এশার নামায পড়ে এলেন এবং ৪ রাকআত নামায পড়লেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী ১১৭নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান)


তাহাজ্জুদ

তাহাজ্জুদ নামায

রাতের নিঃঝুম পরিবেশে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, নিদ্রার আবেশে মানুষ যখন মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের কথা বিস্মৃত হয়, সেই সময় আল্লাহর কিছু খাস বান্দা নিদ্রা, আরাম-আয়েশ ও স্ত্রীর শয্যা ত্যাগ করে আল্লাহকে বিশেষভাবে স্মরণ করার জন্য, তাঁর সাথে মুনাজাতে নিমগ্ন হওয়ার জন্য উঠে ওযূ করে তাহাজ্জুদ পড়েন। আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে প্রয়াস পান। চেয়ে নেন আল্লাহর কাছে অনেক কিছু। নিশ্চয় সে বান্দাগণ বড় ভাগ্যবান, আর নিশ্চয় সে নামায বড় গুরুত্ব ও মাহাত্মপূর্ণ।

এই নামাযের মাহাত্ম
এই নামাযের কথা উল্লেখ করত: মহান আল্লাহ তাঁর রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেন,

(وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ، عَسَى أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوْداً)

অর্থাৎ, রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়; এ তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহ্‌মূদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৯)

“হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী (নবী)! উপাসনার জন্য রাত্রিতে উঠ (জাগরণ কর); রাত্রির কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা অল্প। অথবা তদপেক্ষা বেশী। কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। ইবাদতের জন্য রাত্রি জাগরণ গভীর অভিনিবেশ ও হৃদয়ঙ্গম করার পক্ষে অতিশয় অনুকূল।” (কুরআন মাজীদ ৭৩/১-৫)

“রাত্রিতে তাঁর প্রতি সিজদাবনত হও এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।” (কুরআন মাজীদ ৭৬/২৬)

এ সম্বোধন মহানবীর জন্য হলেও তাঁর অনুসরণ করতে মুসলিম উম্মাহ্‌ অনুপ্রাণিত হয়েছে।

যাঁরা তাহাজ্জুদ পড়েন, তাঁরা অবশ্যই সৎলোক, মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহের অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেন,

(إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ آخِذِيْنَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِيْنَ، كَانُوْا قَلِيْلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ، وَبِالأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই পরহেযগারগণ বেহেশত ও প্রসবণে অবস্থান করবে। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দেবেন তা উপভোগ করবে। কারণ, পার্থিব জীবনে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করত। রাত্রির শেষ প্রহ্‌রে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। (কুরআন মাজীদ ৫১/১৫-১৮)

রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা রহ্‌মানের বান্দাগণের গুণ। তিনি বলেন,

(وَعِبَادُ الرَّحْمنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الأَرْضِ هَوْناً، وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَّقِيَاماً)

অর্থাৎ, রহ্‌মানের বান্দা তারা, যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা প্রশান্তভাবে জবাব দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে। (কুরআন মাজীদ ২৫/৬৩-৬৪)

এই শ্রেণীর মানুষদের জন্য আল্লাহ ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন,

(إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوْا بِهَا خَرُّوْا سُجَّداً وَّسَبَّحُوْا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ، تَتَجَافَى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفاً وَّطَمَعاً وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ، فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرِّةِ أَعْيُنٍ، جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)

অর্থাৎ, কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, যারা ওর দ্বারা উপদিষ্ট হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং অহংকার করে না। তারা শয্যা ত্যাগ করে আশায় ও আশংকায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে। কেউই জানে না তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের নয়ন-প্রDতিকর কি পুরস্কার রক্ষিত আছে। এ হল তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান। (সূরা সিজদাহ ১৫-১৬ আয়াত)

তারা অবশ্যই তাঁদের মত নয়, যারা তাঁদের মত রাত্রি জাগরণ করে মহান আল্লাহর ইবাদত করে না। তিনি বলেন,

(أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِداً وَّقَائِماً يَّحْذَرُ الآخِرَةَ وَيَرْجُوْ رَحْمَةَ رَبِّهِ، قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمْوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ، إِنَّمَا يَتَذَّكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দন্ডায়মান থেকে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা উভয়ে কি এক সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৩৯/৯)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন শয়তান তার মাথার শেষাংশে (ঘাড়ে) তিনটি গাঁট মেরে দেয়। প্রত্যেক গাঁটের সময় এই মন্ত্র পড়ে অভিভূত করে দেয়, ‘তোমার এখনো লম্বা রাত বাকী। সুতরাং এখনও ঘুমাও।’ অতঃপর সে যদি জেগে  আল্লাহর যিক্‌র করে, তবে একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর ওযু করলে আর একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর নামায পড়লে সকল বাঁধনগুলোই খুলে যায়। ফলে ফজরের সময় সে উদ্যম ও ফুর্তিভরা মন নিয়ে ওঠে। নতুবা (তাহাজ্জুদ না পড়লে) আলস্যভরা ভারী মন নিয়ে সে ফজরে উঠে।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী১১৪২নং, মুসলিম, সহীহ ৭৭৬নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

 আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “রমযানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা হল আল্লাহর মাস মুহার্রামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হল রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।” (মুসলিম, সহীহ ১১৬৩নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

 হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সাঃ) এর বাণী হতে সর্বপ্রথম যা শুনেছি তা হল, “হে মানুষ! তোমরা সালাম প্রচার কর, অন্নদান কর, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখ এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা নামায পড়। এতে তোমরা নিবিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক,সহিহ তারগিব ৬১০নং)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন একটি কক্ষ আছে যার বাহিরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে।” তা শুনে আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বললেন, ‘সে কক্ষ কার জন্য হবে, হে আল্লাহর রসূল?’ তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, অন্নদান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাযে রত হয়; তার জন্য।” (ত্বাবারানী,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১১নং)

হযরত জাবের (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “রাত্রিকালে এমন এক মুহূর্ত রয়েছে যখনই তা লাভ করে মুসলিম ব্যক্তি ইহ্‌-পরকালের কোন কল্যাণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে তখনই তিনি তাকে তা প্রদান করে থাকেন। অনুরুপ প্রত্যেক রাত্রিতেই ঐ মুহূর্ত আবির্ভূত হয়ে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৭৫৭নং)

হযরত আবু উমামাহ্‌ বাহে লী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা তাহাজ্জুদের নামাযে অভ্যাসী হও। কারণ, তা তোমাদের পূর্বতন নেক বান্দাদের অভ্যাস; তোমাদের প্রভুর নৈকট্যদানকারী ও পাপক্ষালনকারী এবং গুনাহ হতে বিরতকারী আমল।” (তিরমিযী, ইবনে আবি নয়্যা, ইবনে খুযাইমাহ্‌,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১৮ নং)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও  আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে রাত্রে ঘুম থেকে জাগিয়ে উভয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে অথবা দুই রাকাআত নামায পড়ে তখন তাদের প্রত্যেকের নাম (আল্লাহর) যিক্‌রকারী ও যিক্‌রকারিণীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক সহিহ তারগিব ৬২০ নং)

হযরত আবু দারদা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন, তাদের প্রতি (সন্তুষ্ট হয়ে) হাসেন এবং তাদের কারণে খুশী হন; (প্রথম) সেই ব্যক্তি যার নিকট স্বদলের পরাজয় প্রকাশ পেলে নিজের  জান দিয়ে আল্লাহ আয্‌যা অজাল্লার ওয়াস্তে যুদ্ধ করে। এতে সে হয় শহীদ হয়ে যায় নতুবা আল্লাহ তাকে সাহায্য (বিজয়ী) করেন ও তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার এই বান্দাকে তোমরা লক্ষ্য কর, আমার জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে কেমন ধৈর্য ধরেছে?’

(দ্বিতীয়) সেই ব্যক্তি যার আছে সুন্দরী স্ত্রী এবং নরম ও সুন্দর বিছানা। কিন্তু সে (এসব ত্যাগ করে) রাত্রে উঠে নামায পড়ে। এর জন্য আল্লাহ বলেন, ‘সে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে আমাকে স্মরণ করছে, অথচ ইচ্ছা করলে সে নিদ্রা উপভোগ করতে পারত।’

আর (তৃতীয়) সেই ব্যক্তি যে সফরে থাকে। তার সঙ্গে থাকে কাফেলা। কিছু রাত্রি জাগরণ করে সকলে ঘুমেঢলে পড়ে। কিন্তু সে শেষরাত্রে উঠে কষ্ট ও আরামের সময় নামায পড়ে।” (ত্বাবারানী কাবীর, সহীহ তারগীব ৬২৩ নং)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ৬৩৩ নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমার কাছে জিবরীল এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যত ইচ্ছা বেঁচে থাকুন, আপনি মারা যাবেনই। যাকে ইচ্ছা ভালো বাসুন, আপনি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। যা ইচ্ছা তাই আমল করুন, আপনি তার বদলা পাবেন। আর জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা হল তাহাজ্জুদের নামাযে এবং তার ইজ্জত হল লোকেদের অমুখাপেক্ষী থাকায়।” (ত্বাবরানী, হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৮৩১নং)


হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর কাছে বলল, ‘অমুক রাত্রে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ে। কিন্তু সকাল হলে (দিনে) চুরি করে!?’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, “ঐ নামায তাকে তুমি যা বলছ তাতে (চুরিতে) বাধা দেবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত ১২৩৭নং, সহীহ, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ১/৫৭-৫৮ দ্র:)

তাহাজ্জুদের বিভিন্ন আদব
১। ঘুমাবার আগে তাহাজ্জুদের নিয়ত করে ঘুমাতে হবে। এতে সে শেষ রাত্রে ঘুম থেকে জেগে নামায পড়তে সক্ষম না হলেও তার জন্য তাহাজ্জুদের সওয়াব লিখা হবে।

হযরত আবু দারদা (রাঃ) নবী (সাঃ) এর নিকট হতে বর্ণনা করে বলেন, তিনি বলেছেন, “রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে এই নিয়ত (সংকল্প) করে যে ব্যক্তি নিজ বিছানায় আশ্রয় নেয়, অতঃপর তার চক্ষুদ্বয় তাকে নিদ্রাভিভূত করে ফেলে এবং যদি এই অবস্থাতেই তার ফজর হয়ে যায় তবে তার আমলনামায় তাই লিপিবদ্ধ হয় যার সে নিয়ত (সংকল্প) করেছিল। আর তার ঐ নিদaf তার প্রতিপালকের তরফ হতে সদকাহ্‌ (দান) রুপে প্রদত্ত হয়।” (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্‌, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ৫৯৮নং)

২। ঘুম থেকে উঠে, চোখ মুছে দাঁতন করা এবং সূরা আলে ইমরানের শেষের ১০ আয়াত পাঠ করা সুন্নত। (বুখারী ১৮৩নং, মুসলিম, সহীহ)

৩। ওযূ করার পর হাল্কা দুই রাকআত পড়ে তাহাজ্জুদের নামায শুরু করা কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউ (তাহাজ্জুদের জন্য) রাত্রে উঠলে সে যেন তার নামায হাল্কা দুই রাকআত দিয়ে শুরু করে।” (মুসলিম, সহীহ)

৪। তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে জাগানো মুস্তাহাব। এর জন্য রয়েছে পৃথক মাহাত্ম। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে রহ্‌ম করেন, যে ব্যক্তি রাত্রে উঠে নামায পড়ে ও নিজ স্ত্রীকে জাগায় এবং সেও নামায পড়ে। কিন্তু সে যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ সেই মহিলাকে রহ্‌ম করেন, যে মহিলা রাত্রে উঠে নামায পড়ে ও নিজ স্বামীকে জাগায় এবং সেও নামায পড়ে। কিন্তু সে যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১৩০৮, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৩৪৯৪নং)

তিনি বলেন, “যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রাত্রে উঠিয়ে উভয়ে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়ে অথবা ২ রাকআত নামায পড়ে, তখন তাদের উভয়কে (আল্লাহর) যিক্‌রকারী ও যিক্‌রকারিণীদের দলে লিপিবদ্ধ (শামিল) করা হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৩০৯নং, প্রমুখ)

৫। রাত্রে নামায পড়তে পড়তে ঘুম এলে বা ঢুললে নামায ত্যাগ করে ঘুমিয়ে যাওয়া কর্তব্য। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন নামায পড়তে পড়তে ঢুলতে শুরু করে, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে; যাতে তার ঘুম দূর হয়ে যায়। নচেৎ, কেউ ঢুলতে ঢুলতে নামায পড়লে সে হয়তো বুঝতে পারবে না, সম্ভবত: সে ক্ষমা চাইতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৪৫নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ রাতে উঠে (নামায পড়তে শুরু করে) তার জিভে কুরআন পড়া জড়িয়ে গেলে এবং সে কি বলছে তা বুঝতে না পারলে, সে যেন শুয়ে পড়ে।” (মুসলিম)

তিনি বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকে যেন মনে উদ্দীপনা থাকা পর্যন্ত নামায পড়ে। ক½fন্ত হয়ে পড়লে যেন বসে যায়।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৪৪নং)

একদা তিনি মসজিদে দুই খুঁটির মাঝে লম্বা হয়ে রশি বাঁধা থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি?” সাহাবাগণ বললেন, এটি যয়নাবের। তিনি নামায পড়েন। অতঃপর যখন আলস্য আসে অথবা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন ঐ রশি ধরে (দাঁড়ান)। তিনি বললেন, “খুলে ফেল ওটাকে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন চাঙ্গা থাকা অবস্থায় নামায পড়ে। আর যখন সে অলস অথবা ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

৬। নিজেকে কষ্ট দিয়ে লম্বা তাহাজ্জুদ পড়া বিধেয় নয়। বরং স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় যতটা কুলায়, ততটাই নামায পড়া উচিৎ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা তত পরিমাণে আমল কর যত পরিমাণে তোমরা করার ক্ষমতা রাখ। আল্লাহর কসম! আল্লাহ (সওয়াব দিতে) ক্লান্ত হবেন না, বরং তোমরাই (আমল করতে) ক্লান্ত হয়ে পড়বে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৪৩)

৭। অল্প হলেও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়মিত করে যাওয়া উচিৎ এবং ভীষণ অসুবিধা ছাড়া তা ত্যাগ করা উচিৎ নয়। মহানবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘কোন (ধরনের) আমল আল্লাহর অধিক পছন্দনীয়?’ উত্তরে তিনি বললেন, “সেই আমল, যে আমল নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাওয়া হয়; যদিও তা পরিমাণে কম হয়।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৪২নং) মহানবী (সাঃ)-এর আমল ছিল নিরবচ্ছিন্ন। তিনি একবার যে আমল করতেন, তা বাকী রাখতেন (ত্যাগ করতেন না)।” (মুসলিম, সহীহ) তিনি আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-কে বলেন, “হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মত হয়ো না; যে তাহাজ্জুদ পড়ত, পরে সে তা ত্যাগ করে দিয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

রসূল (সাঃ)-এর কাছে এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হল, যে ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থেকেছে। তিনি বললেন, “ও তো সেই লোক, যার উভয় কানে শয়তান পেশাব করে দিয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)


একদা তিনি ইবনে উমারের প্রশংসা করে বললেন, “আব্দুল্লাহ কত ভাল লোক হয়, যদি সে রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে!” এ কথা শোনার পর ইবনে উমার (সাঃ) রাতে খুব কম ঘুমাতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

তাহাজ্জুদের সময়
তাহাজ্জুদ নামাযের সময় শুরু হয় এশার নামাযের পর থেকে এবং শেষ হয় ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথে। রাতের প্রথমাংশে, মধ্য রাতে এবং শেষাংশে যে কোন সময়ে তাহাজ্জুদ পড়া যায়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাতের যে কোন অংশে নবী (সাঃ)-কে নামায পড়তে দেখতে চাইতাম, সেই সময়ই দেখতে পেতাম, তিনি নামায পড়ছেন। আবার রাতের যে কোন অংশে আমরা তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাইতাম, তখনই আমরা দেখতে পেতাম, তিনি ঘুমিয়ে আছেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১২৪১নং)

সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, এশার পর থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত সময়ের ভিতরে তাহাজ্জুদের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অবশ্য আফযল বা উত্তম সময় হল, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা প্রত্যহ্‌ রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে নীচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, “কে আমায় ডাকে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার নিকট প্রার্থনা করে? আমি তাকে দান করব। এবং কে আমার নিকট ক্ষমা চায়? আমি তাকে ক্ষমা করব।” (বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১২২৩নং)

তিনি বলেন, “শেষ রাতের গভীরে প্রতিপালক নিজ বান্দার সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হন। সুতরাং তুমি যদি ঐ সময় আল্লাহর যিক্‌রকারীদের দলভুক্ত হতে সক্ষম হও, তাহলে তা হয়ে যাও।” (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, জামে ১১৭৩নং)

তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন্‌ সময়ের তাহাজ্জুদ সব চাইতে উত্তম? উত্তরে তিনি বললেন, “বাকী (শেষ) রাতের গভীরে (যা পড়া হয়)। আর খুব কম লোকই তা (ঐ সময়) পড়ে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ)

সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ফজর উদয় হওয়ার আগের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করলে রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ বুঝা যায়।


রাত্রের শেষাংশে মোরগ যখন বাং দেয় তখন উঠলেও তাহাজ্জুদ পড়া যায়। মহানবী (সাঃ) কখনো কখনো এই সময় উঠতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২০৭নং)

তাহাজ্জুদের রাকআত-সংখ্যা
রাতের নামাযের কোন নির্দিষ্ট রাকআত সংখ্যা নেই। এক রাকআত পড়লেও রাতের নামায পড়া হয়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) তাহাজ্জুদের ব্যাপারে বলেন, “(রাতের নামায) অর্ধ রাত্রি, এক তৃতীয়াংশ, এক চতুর্থাংশ, উট বা ছাগলের দুধ দোয়াবার সময় একবার দুইয়ে দ্বিতীয়বার দুয়ানোর জন্য যতটুকু বিরতি দেওয়া ততটুক (সামান্য) সময়ও।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪৮পৃ:)


তবে উত্তম হল প্রত্যেক ২ রাকআতে সালাম ফিরে ৮ রাকআত পড়া। অতঃপর ৩ রাকআত বিত্‌র পড়া। অথবা অনুরুপ ১০  রাকআত পড়ে শেষে ১ রাকআত বিত্‌র পড়া। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ‘রোযা ও রমযানের ফাযায়েল ও মাসায়েল’ তারাবীহ্‌র বিবরণ।)

তাহাজ্জুদের ক্বিরাআত
তাহাজ্জুদ নামাযের ক্বিরাআত লম্বা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ নামায হল লম্বা কিয়াম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  মিশকাত ৪৬, ৮০০নং)

ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, এক রাতে নবী (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়লাম। তিনি কিয়াম করতেই থাকলেন, পরিশেষে আমি মন্দ ইচ্ছা করে ফেলেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে মন্দ ইচ্ছাটি কি? তিনি বললেন, আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বসে যাব! (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

হুযাইফা বিন ইয়ামান বলেন, এক রাতে নবী (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়লাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ্‌ পড়তে শুরু করলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো বা তিনি ১০০ আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করবেন। কিন্তু তিনি তা অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম হয়তো বা তিনি সূরাটিকে ২ রাকআতে পড়বেন। কিন্তু তিনি তাও অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম, তিনি হয়তো সূরাটি শেষ করে রুকূ করবেন। (কিন্তু না, তা না করে) সূরা নিসা শুরু করলেন। তাও পড়ে শেষ করলেন। তারপর সূরা আলে ইমরান ধরলেন এবং তাও পড়ে শেষ করলেন! ([1])

তিনি ধীরে-ধীরে আয়াত পাঠ করছিলেন। তাসবীহর আয়াত পাঠ করলে তাসবীহ পড়ছিলেন। প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে প্রার্থনা করছিলেন। আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে আশ্রয় প্রার্থনা করছিলেন। অতঃপর রুকূ করছিলেন। (মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান)

তিনি এই নামাযে এত দীর্ঘ কিয়াম করতেন যে, তার ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে বলা হল যে, আপনার তো আগে-পিছের সকল ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? (তাও আপনি এত কষ্ট করে ইবাদত করেন কেন?) তিনি বললেন, “আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হ্‌ব না?” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২২০নং)

অবশ্য তিনি এক রাতে কুরআন খতম করতেন না। অবশ্য তিনি তিন রাতে কুরআন খতম করার অনুমতি দিয়েছেন; তার কমে নয়। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি ৩ রাতের কমে কুরআন পড়ে, সে কিছুই বুঝে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান)

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি ১০০টি আয়াত পাঠ করে রাতের নামায পড়বে, তার নাম বিশুদ্ধচিত্ত কিয়ামকারীদের তালিকাভুক্ত হবে।” (দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ১০০টি আয়াত পাঠ করে রাতের নামায পড়বে, সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হবে না।” (দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ৬৩৩ নং)

কখনো তিনি তাহাজ্জুদের নামাযে সূরা বানী ইসরাঈল ও যুমার পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ) কখনো প্রায় ৫০ আয়াতের মত বা তার থেকে বেশী আয়াত তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান) কখনো বা সূরা মুযযাম্মলের মত লম্বা সূরা পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান)  একদা তিনি সূরা মাইদার ১১৮নং আয়াত বারবার পাঠ করতে করতে ফজর করে দিয়েছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১২০৫নং)

এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমার এক প্রতিবেশী রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, কিন্তু ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ছাড়া অন্য কিছু পড়ে না; এটাকেই সে বারবার ফিরিয়ে পড়ে এবং এর চাইতে বেশী কিছু পড়ে না। আসলে এ ব্যক্তি তা খুবই কম মনে করল। কিন্তু নবী (সাঃ) বললেন, “সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! ঐ সূরা এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমতুল্য।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী)

কখনো সশব্দে, কখনো বা নিঃশব্দে এ ক্বিরাআত করা যায়। সাহাবী গুযাইফ বিনহারেস বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) প্রথম রাতে নাপাকীর গোসল করতেন, নাকি শেষ রাতে?’ তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘কোন রাতে তিনি প্রথম ভাগে গোসল করতেন, আবার কোন কোন রাতে শেষ ভাগে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি বিতরের নামায প্রথম রাত্রিতে পড়তেন, নাকি শেষ রাত্রিতে?’ তিনি বললেন, ‘কখনো তিনি প্রথম রাত্রিতে বিত্‌র পড়তেন, আবার কখনো শেষ রাত্রিতে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ পুনরায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি (তাহাজ্জুদের নামাযে) সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন, নাকি নিঃশব্দে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি কখনো সশব্দে পড়তেন, আবার কখনো নিঃশব্দে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ২০৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৬৩নং)

একদা মহানবী (সাঃ) রাত্রিকালে বাইরে এলে তিনি দেখলেন, আবূ বাক্‌র নিম্নস্বরে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ছেন। অতঃপর তিনি উমারের কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি উচ্চস্বরে নামায পড়ছেন। অতঃপর যখন তাঁরা উভয়ে তাঁর নিকট জমায়েত হলেন, তখন তিনি বললেন, “হে আবূ বাক্‌র! আমি তোমার কাছ দিয়ে পার হয়ে গেলাম, দেখলাম, তুমি নিম্নস্বরে নামায পড়ছ।” আবূ বাক্‌র বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি কেবল তাঁকে শুনিয়েছি, যাঁর কাছে আমি মুনাজাত করেছি।’ অতঃপর তিনি উমারের উদ্দেশ্যে বললেন, “আর আমি তোমার কাছ দিয়ে পার হয়ে গেলাম, দেখলাম, তুমি উচ্চস্বরে নামায পড়ছ।” উমার বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি তন্দ্রাভিভূত লোকদেরকে জাগিয়ে দিই এবং শয়তান বিতাড়ণ করি।’ নবী (সাঃ) বললেন, “হে আবূ বাক্‌র! তোমার আওয়াজকে একটু উঁচু কর। আর হে উমার! তোমার আওয়াজকে একটু নিচু কর।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১২০৪নং)


(১) এই হাদিস থেকে বুঝা যায় নে মুশাফের তরতীব অনুজায়ী সূরা পড়া জরুরী নয়। জরুরী হলে তিনি সূরা নিসার আগে আলে-ইমরান পড়তেন।

তাহাজ্জুদ নামাযের কাযা
যে তাহাজ্জুদ-গুযার বান্দার কোন কারণবশত: রাতের ১১ রাকআত নামায ছুটে যায় সে তা দিনে বিশেষ করে চাশতের সময় ১২ রাকআত কাযা করতে পারে।

মহানবী (সাঃ)-এর তাহাজ্জুদ ঘুম বা ব্যথা-বেদনার কারণে ছুটে গেলে দিনে ১২ রাকআত কাযা পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ) হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার (পূর্ণ) অযীফা (তাহাজ্জুদের নামায, কুরআন ইত্যাদি) অথবা তার কিছু অংশ রেখে ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু তা যদি ফজর ও যোহরের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে আদায় করে নেয় তবে তার জন্য পূর্ণ সওয়াবই লিপিবদ্ধ করা হয়, যেন সে ঐ অযীফা রাত্রেই সম্পন্ন করেছে।” (মুসলিম, সহীহ ৭৪৭নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)




তারাবীহ্‌, লাইলাতুল ক্বাদর বা শবে কদরের নামায ও ঈদের নামায ‘রোযা ও রমযানের ফাযায়েল ও মাসায়েল’ দ্রষ্টব্য।


বিত্‌র
বিত্‌র নামায

বিত্‌র নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এ নামায আদায় করতে মহানবী (সাঃ) উম্মতকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতেন। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘বিত্‌র ফরয নামাযের মত অবশ্যপালনীয় নয়; তবে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাকে সুন্নতের রুপদান করেছেন; তিনি বলেছেন, “অবশ্যই আল্লাহ বিত্‌র (জোড়হীন), তিনি বিত্‌র (জোড়শূন্যতা বা বেজোড়) পছন্দ করেন। সুতরাং তোমরা বিত্‌র (বিজোড়) নামায পড়, হে আহলে কুরআন!” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৮৮নং)

বনী কিনানার মুখদিজী নামক এক ব্যক্তিকে আনসার গোত্রের আবূ মুহাম্মাদ নামক এক লোক বলল যে, বিতরের নামায ওয়াজেব। এ কথা শুনে সাহাবী উবাদাহ্‌ বিন সামেত (রাঃ) বললেন, ‘আবূ মুহাম্মাদ ভুল বলছে।’ আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, “পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ বান্দাগণের উপর ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে এবং তাতে গুরুত্ব দিয়ে তার কিছুও বিনষ্ট করবে না, সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি আছে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি তা আদায় করবে না, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দেবেন, নচেৎ ইচ্ছা হলে জান্নাতেও দিতে পারেন।” (মালেক, মুঅত্তা, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৬৩ নং)

মহানবী (সাঃ) সওয়ারীর উপর বিতরের নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌) দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬১৭নং)  অথচ ফরয নামাযের সময় তিনি সওয়ারী থেকে নেমে কিবলামুখ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী)

বিতরের সময়

বিতরের সময় এশার পর থেকে নিয়ে ফজরের আগে পর্যন্ত। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে একটি অতিরিক্ত নামায প্রদান করেছেন। আর তা হল বিতরের নামায সুতরাং তোমরা তা এশা ও ফজরের মধ্যবর্তী সময়ে পড়ে নাও।” (আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১০৮নং)

সাহাবী গুযাইফ বিনহারেস বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘--- নবী (সাঃ) বিতরের নামায প্রথম রাত্রিতে পড়তেন, নাকি শেষ রাত্রিতে?’ তিনি বললেন, ‘কখনো তিনি প্রথম রাত্রিতে বিত্‌র পড়তেন, আবার কখনো শেষ রাত্রিতে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।---’ (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ২০৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৬৩নং)

অবশ্য যে ব্যক্তি মনে করে যে, সে শেষ রাত্রে উঠতে পারবে না, তার জন্য উত্তম হল প্রথম রাত্রে বিত্‌র পড়ে ঘুমানো। পক্ষান্তরে যে মনে করে যে, সে শেষ রাত্রে উঠতে পারবে তার জন্য উত্তম হল শেষ রাত্রে বিত্‌র পড়া।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, সে শেষ রাত্রে উঠতে পারবে না, তার জন্য উত্তম হল প্রথম রাত্রে বিত্‌র পড়ে নেওয়া। পক্ষান্তরে যে ধারণা করে যে, সে শেষ রাত্রে উঠতে পারবে তার জন্য উত্তম হল শেষ রাত্রে বিত্‌র পড়া। কারণ, শেষ রাতের নামাযে ফিরিশ্‌তা উপস্থিত হন এবং এটাই হল শ্রেষ্ঠতম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৬০নং)

একদা তিনি হযরত আবূ বাক্‌র (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কখন বিত্‌র পড়?” আবূ বাক্‌র (রাঃ) বললেন, ‘প্রথম রাত্রে এশার পরে।’ অতঃপর তিনি হযরত উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর উমার তুমি?” উমার (রাঃ) বললেন, ‘শেষ রাতে।’ পরিশেষে তিনি বললেন, “কিন্তু তুমি হে আবূ বাক্‌র! স্থির-নিশ্চয়তা অবলম্বন করে থাক। আর তুমি হে উমার! (শেষ রাতে উঠার পূর্ণ) আত্মবিশ্বাস গ্রহণ করে থাক।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)

শেষ জীবনে মহানবী (সাঃ) শেষ রাতেই বিত্‌র পড়তেন। কেননা, সেটাই ছিল উত্তম। এতদসত্ত্বেও তিনি তাঁর একাধিক সাহাবীকে স্থির-নিশ্চয়তা অবলম্বন পূর্বক প্রথম রাত্রে বিত্‌র পড়ে নিতে বিশেষ উপদেশ দিতেন। যেমন উপদেশ দিয়েছিলেন হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ)-কে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৬২নং) হযরত সা’দ বিন আবী অক্কাস (রাঃ) রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর মসজিদে এশার নামায পড়ে এক রাকআত বিত্‌র পড়ে নিতেন। তাঁকে বলা হল, ‘আপনি কেবল এক রাকআত বিত্‌র পড়েন, তার বেশী পড়েন না (কি ব্যাপার)?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, “যে ব্যক্তি বিত্‌র না পড়ে ঘুমায় না, সে হল স্থির-নিশ্চিত মানুষ।” (আহমাদ, মুসনাদ)


বিত্‌র নামাযের রাকআত সংখ্যা

• বিত্‌র নামায একটানা এক সালামে  ৯, ৭, ৫, ৩ রাকআত পড়া যায়।

৯ রাকআত বিতরের নিয়ম হল, ৮ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহ্‌হুদে বসতে হবে। তাতে আত্‌-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম না ফিরে উঠে গিয়ে আরো এক রাকআত পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (মুসলিম,  মিশকাত ১২৫৭নং)

৭ রাকআত বিতরের নিয়ম হল, ৬ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহ্‌হুদে বসতে হবে। তাতে আত্‌-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম না ফিরে উঠে গিয়ে আরো এক রাকআত পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), আবূদাঊদ, সুনান ১৩৪২, নাসাঈ, সুনান ১৭১৯নং)

কোন কোন বর্ণনা মতে ষষ্ঠ রাকআতে না বসে একটানা ৭ রাকআত পড়ে সর্বশেষে তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (নাসাঈ, সুনান ১৭১৮নং)

৫ রাকআত বিতরের নিয়ম হল, ৫ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহ্‌হুদে বসতে হবে। তাতে আত্‌-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (বুখারী, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান ১৭১৭, মিশকাত ১২৫৬নং)

৩ রাকআত বিতরের নিয়ম হল দুই প্রকার:

(ক) ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরে দিতে হবে। অতঃপর উঠে পুনরায় নতুন করে আরো এক রাকআত পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (ইবনে আবী শাইবা, ইর: ২/১৫০)  ইবনে উমারও এইভাবে বিত্‌র পড়তেন। (বুখারী)

(খ) ৩ রাকআত একটানা পড়ে তাশাহ্‌হুদে বসতে হবে। তাতে আত্‌-তাহিয়্যাত ও দরুদ-দুআ পড়ে সালাম ফিরতে হবে। (হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৪, বায়হাকী ৩/২৮, ৩/৩১) এ ক্ষেত্রে মাগরেবের নামাযের মত মাঝে (২ রাকআত পড়ে) আত্‌-তাহিয়্যাত পড়া যাবে না। যেহেতু আল্লাহর রসূল (সাঃ) বিতরকে মাগরেবের মত পড়তে নিষেধ করেছেন। (ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৪২০,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৪, বায়হাকী ৩/৩১, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬৩৪নং)

এতদ্ব্যতীত ৩ রাকআত বিত্‌র মাগরেবের মত করে পড়া, (দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৬৩৭নং) নতুন করে তাহ্‌রীমার তকবীর দেওয়ার মত (উল্টা) তকবীর দিয়ে পুনরায় হাত বেঁধে কুনূত পড়া ইত্যাদি কিছু সলফ কর্তৃক বর্ণনা করা হলেও তা সহীহ নয়। (ইর: ৪২৭নং, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১/৪৬৪) অতএব তা বিদআত ও পরিত্যাজ্য।

১ রাকআত বিত্‌র :

বিত্‌র এক রাকআতও পড়া যায়। খোদ মহানবী (সাঃ) এক রাকআত বিত্‌র পড়তেন। তিনি বলেন, “রাতের নামায দু রাকআত দু রাকআত। অতঃপর তোমাদের কেউ যখন ফজর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তখন সে যেন এক রাকআত বিত্‌র পড়ে নেয়।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১২৫৪নং)

তিনি আরো বলেন, “বিত্‌র হল শেষ রাতে এক রাকআত।” (মুসলিম,  মিশকাত ১২৫৫নং)

তিনি বলেন, “বিত্‌র হল প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হ্‌ক বা সত্য। সুতরাং যে ৫ রাকআত বিত্‌র পড়তে পছন্দ করে সে তাই পড়ুক, যে ৩ রাকআত পড়তে পছন্দ করে সে তাই পড়ুক এবং যে এক রাকআত পড়তে পছন্দ করে সে তাই পড়ুক।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৪২২, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৬৫নং)

ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলা হল যে, মুআবিয়া (রাঃ) এশার পরে এক রাকআত বিত্‌র পড়লেন (সেটা কি ঠিক)? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি ঠিকই করেছেন। তিনি তো ফকীহ্‌। তাঁকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও, তিনি নবী (সাঃ)-এর সাহাবী।’ (বুখারী, মিশকাত ১২৭৭নং)

এ ছাড়া আরো অন্যান্য বহু সলফ ১ রাকআত বিত্‌র পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবা দ্র:)


বিত্‌র নামাযের মুস্তাহাব ক্বিরাআত

এ নামাযে সূরা ফাতিহার পর যে কোন সূরা পড়া যায়। তবে মুস্তাহাব হল, প্রথম রাকআতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকআতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়া। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১২৭০-১২৭২নং)

মহানবী (সাঃ) কখনো কখনো তৃতীয় রাকআতে সূরা ইখলাসের সাথে সূরা নাস ও ফালাকও পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩০৫)

বিতরের কুনূত


মহানবী (সাঃ) হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ)-কে নিম্নের দুআ বিত্‌র নামাযে ক্বিরাআত শেষ করার পর (রুকূর আগে) পড়তে শিখিয়েছিলেন:-
اَللّهُمَّ اهْدِنِيْ فِيْمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنِيْ فِيْمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنِيْ فِيْمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِيْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِيْ شَرَّ مَا قَضَيْتَ  فَإِنَّكَ تَقْضِيْ وَلاَ يُقْضى عَلَيْكَ إِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَّالَيْتَ وَلاَ يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ لاَ مَنْجَا مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ (وَصَلَّى اللهُ عَلى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ)।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাহ্‌দিনী ফী মানহাদাইত। অআ-ফিনী ফীমান আ ফাইত। অতাওয়াল্লানী ফী মান তাওয়াল্লাইত। অবা-রিকলী ফী মা আ’ত্বাইত। অকি¸নী শার্রামা ক্বাযাইত। ফাইন্নাকা তাক্বয্ব অলা ইউক্বযা আলাইক। ইন্নাহু লা য়্যাযিল্লু মাঁ উওয়া-লাইত। অলা য়্যাইযযু মান আ’-দাইত। তাবা-রাকতা রাব্বানা অতাআ’-লাইত। লা মানজা মিনকা ইল্লা ইলাইক। (অ স্বাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়িনা মুহাম্মাদ।)

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হেদায়াত করে তাদের দলভুক্ত কর যাদেরকে তুমি হেদায়াত করেছ। আমাকে নিরাপদে রেখে তাদের দলভুক্ত কর যাদেরকে তুমি নিরাপদে রেখেছ, আমার সকল কাজের তত্তাবধান করে আমাকে তাদের দলভুক্ত কর যাদের তুমি তত্তাবধান করেছ। তুমি আমাকে যা কিছু দান করেছ তাতে বরকত দাও। আমার ভাগ্য তুমি যা ফায়সালা করেছ তার মন্দ থেকে রক্ষা কর। কারণ তুমিই ফায়সালা করে থাক এবং তোমার উপর কারো ফায়সালা চলে না। নিশ্চয় তুমি যাকে ভালোবাস সে লাঞ্জিত হয় না এবং যাকে মন্দ বাস সে সম্মানিত হয় না। তুমি বরকতময় হে আমাদের প্রভু এবং তুমি সুমহান। তোমার আযাব থেকে তুমি ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নেই। আর আমাদের নবীর উপর আল্লাহ রহ্‌মত বর্ষণ করেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৭৩নং, ইর: ২/১৭২)

প্রকাশ থাকে যে, দুআর শেষে দরুদের উল্লেখ উক্ত হাদীস সমূহে না থাকলেও সলফদের আমল শেষে দরুদ পড়ার কথা সমর্থন করে। আর সে জন্যই দুআর শেষে এখানে যুক্ত করা হয়েছে। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪৩পৃ:, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী)

হযরত আলী (রাঃ) বলেন মহানবী (সাঃ) তাঁর বিতরের শেষ (রাকআতের রুকূর আগে কুনূতে) এই দুআ বলতেন,
 اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوْبَتِكَ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنْكَ لاَ أُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْكَ أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلى نَفْسِكَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিরিযা-কা মিন সাখাতিক, অবিমুআফা-তিকা মিন উক্ববাতিক, অ আঊযু বিকা মিন্‌কা লা উহ্‌সী ষানা-আন আলাইকা আন্তা কামা আসনাইতা আলা নাফসিক।

অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার সন্তুষ্টির অসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে, তোমার ক্ষমাশীলতার অসীলায় তোমার শাস্তি থেকে এবং তোমার সত্তার অসীলায় তোমার আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তোমার উপর তোমার প্রশংসা গুনে শেষ করতে পারি না, যেমন তুমি নিজের প্রশংসা নিজে করেছ। (সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১২৭৬নং, ইর: ২/১৭৫)

প্রকাশ থাকে যে, অনেকে বলেছেন, উক্ত দু'আটি বিতরের নামাযের শেষে অর্থাৎ, সালাম ফিরার পর পড়া মুস্তাহাব। (আউনুল মা’বূদ ৪/২১৩, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১০/৯, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/১৭৪, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু১৮৫পৃ: দ্র:)

পক্ষান্তরে মানারুস সাবীল (১/১০৮) আসসালসাবীল (১/১৬২) প্রভৃতি ফিকহের কিতাবে উক্ত দুআকে দুআয়ে কুনূত বলেই প্রথমোক্ত দুআর পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্‌ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থের পরিচ্ছেদের শিরোনাম বাঁধার ভাবধারায় বুঝা যায় যে, এ দুআ বিতরের কুনূতে পঠনীয়। নাসাঈ শরীফের উক্ত হাদীসের টীকায় আল্লামা সিন্ধী বলেন, ‘হতে পারে তিনি উক্ত দুআ কিয়ামের শেষাংশে (রুকূর আগে) বলতেন। সুতরাং ওটাও একটি দুআয়ে কুনূত; যেমন গ্রন্থকার (নাসাঈর) কথা দাবী করে। আবার এও হতে পারে যে, তিনি (বিতরের) তাশাহহুদের বৈঠকে (সালাম ফিরার পূর্বে) উক্ত দুআ পড়তেন। আর শব্দের বাহ্যিক অর্থও তাই।’ (নাসাঈ, সুনান ১৭৪৬নং, ২/২৭৫) অাল্লাহু আ’লাম।

বিতরের কুনূতকে কুনূতে গায়র নাযেলাহ্‌ বলা হয়। আর তা সব সময় প্রত্যেক রাত্রে বিত্‌র নামাযে পড়া হয়। অবশ্য কুনূতের দুআ পড়া মুস্তাহাব; জরুরী নয়। সুতরাং কেউ ভুলে ছেড়ে দিয়ে সিজদায় গেলে সহু সিজদা লাগে না। যেমন প্রত্যেক রাত্রে তা নিয়মিত না পড়ে মাঝে মাঝে ত্যাগ করা উচিত। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৭৯পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২৭)

প্রকাশ থাকে যে, বিতরের কুনূত (দুআ) মুখস্থ না থাকলে তার বদলে তিনবার ‘ক্বুল’ বা ‘রাব্বানা আতেনা’ পড়ে কাজ চালানো শরীয়ত-সম্মত নয়। মুখস্থ না থাকলে করতে হবে। আর ততদিন কুনূত না পড়ে এমনিই কাজ চলবে।

বিতরের দুআয় ইমাম সাহেব বহুবচন শব্দ ব্যবহার করবেন। এরুপ করা বিধেয়। এটা নিষিদ্ধ নববী শব্দ পরিবর্তনের আওতাভুক্ত নয়। কারণ, এটা কেবলমাত্র শব্দের বচন পরিবর্তন। পক্ষান্তরে হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় বিতরের দুআ বহুবচন শব্দেও বর্ণিত হয়েছে। (ত্বাবারানী, মু’জাম কাবীর ২৭০০নং, শারহুস সুন্নাহ্‌, বাগবী ৩/১২৯, সাতা: ইবনে বায ৪১পৃ:, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১৭১পৃ: দ্র:)


কুনূতের স্থান ও নিয়ম

কুনূতের দুআ (শেষ রাকআতের) রুকুর আগে বা পরে যে কোন স্থানে পড়া যায়। হুমাইদ বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কুনূত রুকূর আগে না পরে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমরা রুকূর আগে ও পরে কুনূত পড়তাম।’ (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১২৯৪নং)

অনুরুপ (দুআর মত)হাত তোলা ও না তোলা উভয় প্রকার আমলই সলফ কর্তৃক বর্ণিত আছে। (তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১/৪৬৪)

অবশ্য দুআর পরে মুখে হাত বুলানো সুন্নত নয়। কারণ, এ ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে সবগুলোই দুর্বল। (ইর: ২/১৮১, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৫) বলা বাহুল্য, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন সুন্নত প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাই কিছু উলামা স্পষ্টভাবে তা (অনুরুপ বুকেহাত ফিরানোকে) বিদআত বলেছেন। (ইর: ২/১৮১, মু’জামুল বিদা’ ৩২২পৃ:)

ইযয বিন আব্দুস সালাম বলেন, ‘জাহেল ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ করে না।’ পক্ষান্তরে দুআয় হাত তোলার ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস এসেছে। তার মধ্যে কোন হাদীসেই মুখে হাত ফিরানোর কথা নেই। আর তা এ কথারই দলীল যে, উক্ত আমল আপত্তিকর ও অবিধেয়। (ইর: ২/১৮২, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৭৮পৃ:)

বিতরের নামাযের সালাম ফিরে দুআ:
سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْقُدُّوْسِ، 
উচ্চারণ: সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দূস।
অর্থ: আমি পবিত্রময় বাদশাহ্‌র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি।

এই দুআটি তিনবার পড়তে হয়। তন্মধ্যে তৃতীয় বারে উচ্চস্বরে পড়া কর্তব্য। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১২৭৪-১২৭৫নং)


এক রাতে দুইবার বিত্‌র নিষিদ্ধ

রাত্রের সর্বশেষ নামায হল বিতরের নামায। বিতরের পর আর কোন নামায নেই। অতএব যদি কেউ শেষ রাত্রে উঠতে পারবে না মনে করে এশার পর বিত্‌র পড়ে নেয় অতঃপর শেষ রাত্রে উঠতে সক্ষম হয়, সে তাহাজ্জুদ পড়বে কিন্তু আর দ্বিতীয় বার বিত্‌র পড়বে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) বলেন, “এক রাতে দুটি বিত্‌র নেই।” (আহমাদ, মুসনাদ, আদ:, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, বায়হাকী, জামে ৭৫৬৭নং) “তোমরা বিত্‌র নামাযকে রাতের শেষ নামায কর।” (বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, ইর: ৪২২নং)


বিতরের পর নফল ২ রাকআত

অবশ্য এ ব্যাপারে একটি ব্যতিক্রম নামায হল, বিতরের পরে ২ রাকআত সুন্নত বসে বসে পড়া। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসূল (সাঃ) (বিত্‌র নামাযের) সালাম ফিরার পর বসে বসে ২ রাকআত নামায পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ) হযরত উম্মে সালামাহ্‌ বলেন। ‘তিনি বিতরের পর বসে বসে (হাল্কা করে) ২ রাকআত নামায পড়তেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১২৮৪নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “নিশ্চয় এই (সফর) রাত্রি জাগরণ ভারী ও কষ্টকর। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন বিত্‌র পড়বে তখন সে যেন ২ রাকআত পড়ে নেয়। অতঃপর সে যদি রাত্রে উঠতে পারে তো উত্তম। নচেৎ, ঐ ২ রাকআত তার (রাতের নামায) হয়ে যাবে।” (দারেমী, সুনান, মিশকাত ১২৮৬, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৯৯৩নং দ্র:)

উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, ঐ ২ রাকআত আমাদেরও পড়া উচিত। আর তা মহানবী (সাঃ)-এর জন্য খাস নয়।

আবূ উমামাহ্‌ বলেন, ‘নবী (সাঃ) ঐ ২ রাকআত নামায বিতরের পর বসে বসে পড়তেন। আর তার প্রথম রাকআতে সূরা যিলযাল ও দ্বিতীয় রাকআতে সূরা কাফিরুন পাঠ করতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১২৮৭নং)


বিতরের কাযা

বিত্‌র নামায যথা সময়ে না পড়া হলে তা কাযা পড়া বিধেয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি বিত্‌র না পড়ে ঘুমিয়ে যায় অথবা তা পড়তে ভুলে যায় সে ব্যক্তি যেন তা স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌),হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫৬২নং)  তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে থেকে বিত্‌র না পড়তে পারে সে ব্যক্তি যেন ফজরের সময় তা পড়ে নেয়।” (তিরমিযী, সুনান, ইর: ৪২২, জামে ৬৫৬৩নং)

খোদ মহানবী (সাঃ)-এর কোন রাত্রে বিত্‌র না পড়ে ফজর হয়ে গেলে তখনই বিত্‌র পড়ে নিতেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৪৩, বায়হাকী ১/৪৭৯, ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/২৪৬)

একদা এক ব্যক্তি মহানবীর দরবারে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ তিনি বললেন, “বিত্‌র তো রাত্রেই পড়তে হয়।” লোকটি পুনরায় বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! ফজর হয়ে গেছে অথচ আমি বিত্‌র পড়তে পারিনি।’ এবারে তিনি বললেন, “এখন পড়ে নাও।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৭১২নং)

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, ফজর হয়ে গেলেও বিতর নামায বিতরের মতই কাযা পড়া যাবে। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৪/২৮৯ দ্র:)


বিত্‌র নামাযে জামাআত

মহানবী (সাঃ) যে কয় রাত তারাবীহ্‌র নামায পড়েছিলেন সে কয় রাতে জামাআত সহকারে বিত্‌র পড়েছিলেন। অনুরুপ সাহাবীগণও রমযান মাসে জামাআত সহকারে তারাবীহ্‌র সাথে বিত্‌র পড়েছেন।


পাঁচ-ওয়াক্ত নামাযে কুনূত

মুসলিমদের প্রতি কাফেরদের অত্যাচারের সময় পাঁচ-ওয়াক্ত নামাযের শেষ রাকআতের রুকূ থেকে মাথা তুলে কুনূত পড়া বিধেয়। (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ১২৯০নং) এই কুনূতকে কুনূতে নাযেলাহ্‌ বলা হয়। এই কুনূতে মুসলিমদের জন্য দুআ এবং অত্যাচারী কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করা বিধেয়। দুই হাত তুলে দুআ করবেন ইমাম এবং ‘আমীন-আমীন’ বলবে মুক্তাদীগণ। এই কুনূতের দুআর ভূমিকা নিম্নরুপ:-
اَللّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِيْنُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُثْنِيْ عَلَيْكَ الْخَيْرَ كُلَّهُ، وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ، اَللّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّيْ وَ نَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعى وَنَحْفِدُ، نَرْجُوْ رَحْمَتَكَ وَنَخْشى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحَقٌ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্না নাসতাঈনুকা অ নাসতাগফিরুক, অনুষনী আলাইকাল খায়রা কুল্লাহ্‌, অনাশকুরুকা অলা নাকফরুক, অনাখলাউঅনাতরুকু মাঁই য়্যাফজুরুক, আল্লা-হুম্মা ইয়্যাকা না’বুদ, অলাকা নুসাল্লী অনাসজুদ, অইলাইকা নাসআ অ নাহ্‌ফিদ, নারজু রাহ্‌মাতাকা অনাখশা আযা-বাক, ইন্না আযা-বাকা বিল কুফফা-রি মুলহাক্ব।

অর্থ: হে  আল্লাহ!  নিশ্চয়  আমরা  তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি এবং ক্ষমা ভিক্ষা করছি, তোমার নিমিত্তে যাবতীয় কল্যাণের প্রশংসা করছি, তোমার কৃতজ্ঞতা করি ও কৃতঘ্নতা করি না, তোমার যে অবাধ্যতা করে তাকে আমরা ত্যাগ করি এবং তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমার জন্যই নামায পড়ি এবং সিজদা করি, তোমার দিকেই আমরা ছুটে যাই। তোমার রহ্‌মতের আশা রাখি এবং তোমার আযাবকে ভয় করি, নিশ্চয় তোমার আযাব কাফেরদেরকে পৌঁছবে।

এরপর অত্যাচারিতদের জন্য দুআ এবং অত্যাচারীদের উপর বদদু’আ করতে হয়। যেমন,
اَللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ، وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِهِمْ، وَانْصُرْهُمْ عَلَى عَدُوِّكَ وَعَدُوِّهِمْ،
اَللَّهُمَّ عَذِّبِ الْكَفَرَةَ الَّذِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِكَ، وَيُكَذِّبُوْنَ رُسُلَكَ، وَيُقَاتِلُوْنَ أَوْلِياَءَكَ، اَللَّهُمَّ خَالِفْ بَيْنَ كَلِمَتِهِمْ، وَزَلْزِلْ أَقْدَامَهُمْ، وَأَنْزِلْ بِهِمْ بَأْسَكَ الَّذِيْ لاَ تَرُدُّهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِيْنَ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাগফির লিল মু’মিনীনা অল মু’মিনা-ত, অলমুসলিমীনা অলমুসলিমাত, অ আল্লিফ বাইনা ক্বুলবিহিম, অ আসলিহ্‌ যা-তা বাইনিহিম, অনসুরহুম আলা আদুউবিকা অ আদুউবিহিম।

আল্লা-হুম্মা আযযিবিল কাফারাতাল্লাযীনা য়্যাসুদ্দূনা আন সাবীলিক, অয়্যুকাযযিবূনা রুসুলাক, অয়্যুক্বা-তিলনা আউলিয়া-আক। আল্লাহুম্মা খা-লিফ বাইনা কালিমাতিহিম, অযালযিল আক্বদামাহুম, অআনযিল বিহিম বা’সাকাল্লাযী লা তারুদ্দুহু আনিল ক্বাউমিল মুজরিমীন।

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি মুমিন ও মুসলিম নারী-পুরুষদেরকে ক্ষমা করে দাও। তাদের হৃদয়ে হৃদয়ে মিল দাও। তাদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি কর। তাদেরকে তোমার ও তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য কর।

হে আল্লাহ! যে কাফেররা তোমার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তোমার রসূলদেরকে মিথ্যা মনে করছে এবং তোমার বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তাদেরকে তুমি আযাব দাও।  হে আল্লাহ! তুমি ওদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি কর। ওদেরকে বিক্ষিপ্ত ও বিচলিত কর এবং ওদের উপর তোমার সেই আযাব অবতীর্ণ কর, যা অপরাধী জাতি থেকে তুমি রদ করো না। (বাইহাকী, ২/২১১, ইবনে আবী শাইবাহ্‌ প্রমুখ, ইরওয়াউল গলীল ২/ ১৬৪- ১৭০)

রমযানের কুনূতে উক্ত দুআ, অর্থাৎ কাফেরদের উপর বদদুআ এবং মুমিনদের জন্য দুআ ও ইস্তেগফার করার কথা সাহাবীদের আমলে প্রমাণিত। (সহীহ ইবনে খুযাইমা ১১০০ নং)

যেমন এরুপ দুআও করা বিধেয়:-
اَللّهُمَّ أَنْجِ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْتَضْعَفِيْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ، اَللَّهُمَّ اشْدُدْ وَطْأَتَكَ عَلَى الطُّغَاةِ الظَّالِمِيْنَ، وَاجْعَلْهَا عَلَيْهِمْ سِنِيْنَ كَسِنِيْ يُوْسُف।
প্রকাশ থাকে যে, সাধারণ দিনসমূহে কেবল ফজরের নামাযে কুনূত বিধেয় নয়; বরং তা বিদআত। আবূ মালেক আশজাঈ বলেন, আমার আব্বা আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর পিছনে এবং আবূ বাক্‌র, উমার ও উসমানের পিছনে নামায পড়েছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কি ফজরে কুনূত পড়তেন? তিনি উত্তরে বললেন, ‘না, বেটা! এটা বিদআত।’ (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বুলুগুল মারাম ৩০৩নং, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৬৮)

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) কোন সম্প্রদায়ের জন্য দুআ অথবা বদদু’আ করা ছাড়া ফজরের নামাযে এমনি কুনূত পড়তেন না। (ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, বুলুগুল মারাম ৩০২নং)

পক্ষান্তরে যে হাদীস দ্বারা ফজরের নামাযে কুনূত প্রমাণ করা হয়, তা হয় দুর্বল, না হয় সে কুনূত হল নাযেলার কুনূত; যা ৫ ওয়াক্ত নামাযেই বিধেয়। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৪৩পৃ:)

চাশত সালাত

চাশতের নামাযের বিবরণ
চাশতের নামায মুস্তাহাব নফল। এই নামাযের রয়েছে বিরাট মাহাত্ম ও সওয়াব।

হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যহ্‌ সকালে তোমাদের প্রত্যেক অস্থি-গ্রন্থির উপর (তরফ থেকে) দাতব্য সদকাহ্‌ রয়েছে; সুতরাং প্রত্যেক  তাসবীহ্‌ হল সদকাহ্‌ প্রত্যেক তাহ্‌মীদ (আলহামদু লিল্লা-হ্‌ পাঠ) সদকাহ্‌, প্রত্যেক তাহ্‌লীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ্‌ পাঠ) সদকাহ্‌, প্রত্যেক তকবীর (আল্লা-হু আকবার পাঠ) সদকাহ্‌, সৎকাজের আদেশকরণ সদকাহ্‌, এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধকরণও সদকাহ্‌। আর এসব থেকে যথেষ্ট হবে চাশতের দুই রাকআত নামায।” (মুসলিম ৭২০ নং)

হযরত বুরাইদাহ্‌ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, “মানবদেহে ৩৬০টি গ্রন্থি আছে। প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ঐ প্রত্যেক গ্রন্থির তরফ থেকে দেয় সদকাহ্‌ রয়েছে।” সকলে বলল, ‘এত সদকাহ্‌ দিতে আর কে সক্ষম হবে, হে আল্লাহর রসূল?’ তিনি বললেন, “মসজিদ হতে কফ (ইত্যাদি নোংরা) দূর করা, পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু (কাঁটা-পাথর প্রভৃতি) দূর করা এক একটা সদকাহ্‌। যদি তাতে সক্ষম না হও তবে দুই রাকআত চাশতের নামায তোমার সে প্রয়োজন পূর্ণ করবে।” (আহ্‌মদ,ও শব্দগুলি তাঁরই, আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, ইবনে হিব্বান, সহীহ তারগীব ৬৬১ নং)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র বিন আস (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) এক যোদ্ধাবাহিনী প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধ সফরে তারা বহু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভ ক’রে খুব শীঘ্রই ফিরে আসে। লোকেরা তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটবর্তিতা, লব্ধ সম্পদের আধিক্য এবং ফিরে আসার শীঘ্রতা নিয়ে সবিময় বিভিন্ন আলোচনা করতে লাগল। তা শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে ওদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্র, ওদের চেয়ে অধিকতর লব্ধ সম্পদ এবং ওদের চেয়ে শীঘ্রতর ফিরে আসার কথার সন্ধান বলে দেব না? যে ব্যক্তি সকালে ওযু করে চাশতের নামাযের উদ্দেশ্যে মসজিদে যায় সে ব্যক্তি ওদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করে, ওদের চেয়ে অধিকতর সম্পদ লাভ করে এবং ওদের চেয়ে অধিকতর শীঘ্র ঘরে ফিরে আসে।” (আহ্‌মদ, ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব ৬৬৩ নং)

হযরত উক্ববাহ্‌ বিন আমের জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল্‌ বলেন, ‘হে আদম সন্তান! দিনের প্রথমাংশে তুমি আমার জন্য চার রাকআত নামায পড়তে অক্ষম হ্‌য়ো না, আমি তার প্রতিদানে তোমার দিনের শেষাংশের জন্য যথেষ্ট হ্‌ব।” (আহ্‌মদ, আবু য়্যালা, সহীহ তারগীব ৬৬৬ নং)


প্রকাশ থাকে যে, যুহার নামায পড়ে ‘বাবুয যুহা’ দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার হাদীস সহীহ নয়। (দেখুন : যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/৩৪৯ টীকা নং ১)

চাশত নামাযের সময়
স্বালাতুয-যুহা বা চাশতের নামাযের সময় শুরু হয় সূর্য যখন দর্শকের চোখে এক বর্শা (এক মিটার) পরিমাণ উপরে ওঠে। অর্থাৎ সূর্য ওঠার মোটামুটি ১৫ মিনিট পরে এই নামায পড়া যায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১২২) আর শেষ হয় সূর্য ঢলার আগে। তবে উত্তম হল, সূর্য পূর্বাকাশে উঁচু হওয়ার পর যখন মাটি গরম হতে শুরু করবে তখন এই নামায পড়া। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সূর্য উঠে গেলে তারপর নামায পড়। কারণ, এই (সূর্য মাথার উপর আসার আগে পর্যন্ত) সময় নামায কবুল হয় এবং তাতে ফিরিশ্‌তা উপস্থিত থাকেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৬৩নং)

যায়দ বিন আরকাম বলেন, একদা মহানবী (সাঃ) কুবাবাসীর নিকটে এসে দেখলেন, তারা চাশতের নামায পড়ছে। তিনি বললেন, “আওয়াবীনের (আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারীদের) নামায যখন উটের বাচ্চার পা বালিতে গরম অনুভব করে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১৩১২নং)

উক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, এই চাশতের নামাযকেই বলে আওয়াবীনের নামায। বলা বাহুল্য, মাগরেবের পর ৬ রাকআত নামাযের ঐ নাম দেওয়া ভিত্তিহীন।

প্রকাশ থাকে যে, এই নামাযকে তার প্রথম অক্তে (সূর্য এক বর্শা বরাবর উপরে উঠার পর) পড়লে ইশরাকের নামায বলা হয়।


আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে পড়ে, অতঃপর সূর্যোদয় অবধি বসে আল্লাহর যিক্‌র করে তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে, সেই ব্যক্তির একটি হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ হয়।” বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ।” অর্থাৎ কোন অসম্পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব নয় বরং পূর্ণ হজ্জ-উমরার সওয়াব। (তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৪৬১নং)

চাশত নামায কত রাকআত?
চাশতের নামাযের কমপক্ষে ২ রাকআত এবং ঊর্ধ্বপক্ষের কোন নির্দিষ্ট রাকআত সংখ্যা নেই। অবশ্য মহানবী (সাঃ) নিজে এই নামায ৮ রাকআত পড়তেন বলে প্রমাণিত। পক্ষান্তরে তাঁর কথায় প্রমাণিত ১২ রাকআত।

উম্মেহানী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন তাঁর ঘরে চাশতের সময় ৮ রাকআত নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৩০৯নং)

মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাঃ) ৪ রাকআত চাশতের নামায পড়তেন এবং আল্লাহর তওফীক অনুসারে আরো বেশী পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  ইমা, মিশকাত ১৩১০নং)

তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি চাশতের ৪ রাকআত এবং প্রথম নামায (যোহরের) পূর্বে ৪ রাকআত পড়বে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে।” (ত্বাবরানী আওসাত্ব, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩৪৯নং)

মা আয়েশা (রাঃ) ৮ রাকআত চাশত পড়তেন আর বলতেন, যদি আমার মা-বাপকেও জীবিত করে দেওয়া হয় তবুও আমি তা ছাড়ব না। (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১৩১৯নং)

হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি চাশতের দু রাকআত নামায পড়বে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হবে না। যে ব্যক্তি চার রাকআত পড়বে সে আবেদগণের তালিকাভুক্ত হবে। যে ব্যক্তি ছয় রাকআত পড়বে তার জন্য ঐ দিনে (আল্লাহ তার অমঙ্গলের বিরুদ্ধে) যথেষ্ট হবেন। যে ব্যক্তি আট রাকআত পড়বে আল্লাহ তাকে একান্ত অনুগতদের তালিকাভুক্ত করবেন। যে ব্যক্তি বারো রাকআত পড়বে তার জন্য আল্লাহ জান্নাতে একটি গৃহ্‌ নির্মাণ করবেন। এমন কোন দিন বা রাত্রি নেই যাতে আল্লাহর কোন অনুগ্রহ নেই; তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা দানস্বরুপ উক্ত অনুগ্রহ দান করে থাকেন। আর তাঁর যিক্‌রে প্রেরণা দান করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে কোন বান্দার প্রতিই করেননি।” (ত্বাবারানীর কাবীর, সহিহ তারগিব ৬৭১ নং)

সলফ কর্তৃক ১২ রাকআতের বেশী পড়ার কথাও প্রমাণিত। অতএব কেউ পড়লে বেশী পড়তে পারে। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/১৮৬)

উল্লেখ্য যে, ২ রাকআতের অধিক চাশত পড়লে প্রত্যেক ২ রাকআতে সালাম ফিরাই উত্তম।


প্রকাশ থাকে যে, এই নামাযে কোন নির্দিষ্ট ক্বিরাআত নেই। সূরা শামস ও যুহা পড়ার হাদীসটি জাল। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৩৭৭৪নং)

চাশতের নামায মসজিদে পড়ার পৃথক ফযীলত

হযরত আবু উমামা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহ রসূল (সাঃ) বলেন “যে ব্যক্তি কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে স্বগৃহে থেকে ওযূ করে (মসজিদের দিকে) বের হয় সেই ব্যক্তির সওয়াব হয় ইহ্‌রাম বাঁধা হাজীর ন্যায়। আর যে ব্যক্তি কেবলমাত্র চাশতের নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই বের হয়, তার সওয়াব হয় উমরাকারীর সমান। এক নামাযের পর অপর নামায; যে দুয়ের মাঝে কোন অসার (পার্থিব) ক্রিয়াকলাপ না থাকে তা এমন আমল যা  ইল্লিয়্যীনে (সৎলোকের সৎকর্মাদি লিপিবদ্ধ করার নিবন্ধ গ্রন্থে) লিপিবদ্ধ করা হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৩১৫নং)


অন্যান্য সালাতসমূহ

যাওয়াল (সূর্য ঢলার) পূর্বে নামায
চাশতের নামায পড়ার পর ঠিক মাথার উপর সূর্য হওয়ার পূর্বে ৪ রাকআত নফল পড়া সুন্নত। এ নামায মহানবী (সাঃ) পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৩৭নং)

অনেকের মতে যাওয়ালের পরেও নির্দিষ্ট ৪ রাকআত নামায রয়েছে।

আবূ আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) সূর্য ঢলার সময় ৪ রাকআত নামায প্রত্যহ্‌ পড়তেন। একদা আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি সূর্য ঢলার সময় এই ৪ রাকআত প্রত্যহ্‌ পড়ছেন?’ তিনি বললেন, “সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং যোহরের নামায না পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। অতএব আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক আমল (আকাশে আল্লাহর নিকট) উঠা হোক।” আমি বললাম, ‘তার প্রত্যেক রাকআতেই কি ক্বিরাআত আছে?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ।” আমি বললাম, ‘তার মাঝে কি পৃথককারী সালাম আছে?’ তিনি বললেন, “না।” (মুখতাসারুশ শামাইলিল মুহাম্মাদিয়্যাহ্‌, আলবানী ২৪৯নং)

আব্দুল্লাহ বিন সায়েব বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) সূর্য ঢলার পর যোহরের আগে ৪ রাকআত নামায পড়তেন এবং বলেছেন, এটা হল সেই সময়, যে সময় আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয়। অতএব আমি পছন্দ করি যে, এই সময় আমার নেক আমল (আকাশে আল্লাহর নিকট) উঠা হোক।” (ঐ ২৫০নং)


কিন্তু অনেকের মতে ঐ নামায যোহরের পূর্বের সুন্নত। অাল্লাহু আ’লাম।

ইস্তিখারার নামায
কোন বৈধ বিষয় বা কাজে (যেমন ব্যবসা, সফর, বিবাহের ব্যাপারে) ভালো মন্দ বুঝতে না পারলে, মনে ঠিক-বেঠিক, উচিৎ-অনুচিত বা লাভ-নোকসানের দ্বন্দ্ব হলে আল্লাহর নিকট মঙ্গল প্রার্থনা করতে দুই রাকআত নফল নামায পড়ে নিম্নের দুআ পাঠ করা সুন্নত।

اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوْبِ، اَللّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هذَا الأَمْرَ(--) خَيْرٌ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ وَعَاجِلِهِ آجِلِهِ فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِيْ دِيْنِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ وَعَاجِلِهِ وَآجِلِهِ فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ وَاقْدُرْ لِىَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ رَضِّنِيْ بِهِ।
উচ্চারণ- “আল্লা-হুম্মা আস্তাখীরুকা বিইলমিকা অ আস্তাক্বদিরুকা বি ক্বুদরাতিকা অ আসআলুকা মিন ফায্বলিকাল আযীম, ফাইন্নাকা তাক্বদিরু অলা আক্বদিরু অতা’লামু অলা আ’লামু অ আন্তা আল্লা-মুল গুয়ূব। আল্লা-হুম্মা ইন কুন্তা তা’লামু আন্নাহা-যাল আমরা (----) খাইরুল লী ফী দ্বীনী অ মাআ’শী অ আ’-ক্বিবাতি আমরী অ আ’-জিলিহী অ আ-জিলিহ, ফাক্বদুরহু লী, অ য়্যাসসিরহু লী, সুম্মা বা-রিক লী ফীহ্‌। অইন কুন্তা তা’লামু আন্নাহা-যাল আমরা শারুল লী ফী দ্বীনী অ মাআ’শী অ আ’-কিবাতি আমরী অ আ’-জিলিহী অ আ-জিলিহ্‌, ফাস্বরিফহু আ ন্নী অস্বরিফনী আনহু, অক্বদুর লিয়াল খাইরাহাইসু কা-না সুম্মা রায্বযিনী বিহ্‌।

অর্থ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট তোমার ইলমের সাথে মঙ্গল প্রার্থনা করছি। তোমার কুদরতের সাথে শক্তি প্রার্থনা করছি এবং তোমার বিরাট অনুগ্রহ থেকে ভিক্ষা যাচনা করছি। কেননা, তুমি শক্তি রাখ, আমি শক্তি রাখি না। তুমি জান, আমি জানি না এবং তুমি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। হে আল্লাহ! যদি তুমি এই (---) কাজ আমার জন্য আমার দ্বীন, দুনিয়া, জীবন এবং কাজের বিলম্বিত ও অবিলম্বিত পরিণামে ভালো জান, তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত ও সহ্‌জ করে দাও। অতঃপর তাতে আমার জন্য বর্কত দান কর। আর যদি তুমি এই কাজ আমার জন্য আমার দ্বীন, দুনিয়া, জীবন এবং কাজের বিলম্বিত ও অবিলম্বিত পরিণামে মন্দ জান, তাহলে তা আমার নিকট থেকে ফিরিয়ে নাও এবং আমাকে ওর নিকট থেকে সরিয়ে দাও। আর যেখানেই হোক মঙ্গল আমার জন্য বাস্তবায়িত কর, অতঃপর তাতে আমার মনকে পরিতুষ্ট করে দাও।

প্রথমে هذا الأمر ‘হা-যাল আমরা’ এর স্থলে বা পরে কাজের নাম নিতে হবে অথবা মনে মনে সেই জ্ঞাতব্য বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করতে হবে।

মহানবী (সাঃ) এই দুআ সাহাবীগণকে শিখাতেন, যেমন কুরআনের সূরা শিখাতেন। আর এখান থেকেই ছোট-বড় সকল কাজেই ইস্তিখারার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।

সে ব্যক্তি কর্মে কোনদিন লাঞ্জিত হয় না যে আল্লাহর নিকট তাতে মঙ্গল প্রার্থনা করে, অভিজ্ঞদের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করে এবং ভালো-মন্দ বিচার করার পর কর্ম করে। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩ /৩৪৪)

জ্ঞাতব্য যে, ইস্তিখারার পূর্বে কাজের ভালো-মন্দের কোন একটা দিকের প্রতি অধিক প্রবণতা থাকলে চলবে না। বরং এই প্রবণতা আল্লাহর তরফ থেকে সৃষ্টি হবে ইস্তিখারার পরেই। আর তা একবার করলেই হবে। ৭ বার করার হাদীস সহীহ নয়। (ইবনুস সুন্নী ৫৯৮নং-এর টীকা দ্র:)

প্রকাশ থাকে যে, সুনানে রাতেবাহ্‌ অথবা তাহিয়্যাতুল মাসজিদ অথবা যে কোন ২ রাকআত সুন্নতের পর রাতের অথবা দিনের (নিষিদ্ধ সময় ছাড়া) যে কোন সময়ে উক্ত দুআ পড়া যায়। উক্ত নামাযের নিয়ম সাধারণ সুন্নত নামাযের মতই।

এ নামাযের প্রত্যেক রাকআতে কোন নির্দিষ্ট পঠনীয় সূরা নেই। যে কোন সূরা পড়লেই চলে।


এই নামায অন্য দ্বারা পড়ানো যায় না। যেমন স্বপ্নযোগে স্পষ্ট কিছু দেখাও জরুরী নয়।

স্বালাতুত তাসবীহ্‌
মহানবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত করা হয়ে থাকে যে, একদা তিনি তাঁর চাচা আব্বাস (রাঃ)-কে বললেন, “হে আব্বাস, হে চাচা! আমি কি আপনাকে দেব না? আমি কি আপনাকে দান করব না? আমি কি বিশেষভাবে আপনাকে একটি জিনিস দান করব না? আমি কি আপনাকে এমন জিনিস শিখিয়ে দেব না, যা আপনার ১০ প্রকার পাপ খন্ডন করে দিতে পারে? যদি আপনি তা করেন তাহলে আল্লাহ আপনার প্রথম ও শেষের, পুরাতন ও নূতন, অনিচ্ছাকৃত ও ইচ্ছাকৃত, ছোট ও বড়, গুপ্ত ও প্রকাশ্য এই ১০ প্রকার পাপ মাফ করে দেবেন।

সেটা হল এই যে, আপনি ৪ রাকআত নামায পড়বেন। প্রত্যেক রাকআতে আপনি সূরা ফাতিহার পর একটি সূরা পড়বেন। অতঃপর প্রথম রাকআতে সূরা পড়া শেষ হলে আপনি দাঁড়িয়ে থেকেই ১৫ বার বলবেন,

سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ للهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ।

সুবহানাল্লাহি অলহামদু লিল্লাহি অলা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অল্লাহু আকবার।

এরপর আপনি রুকূ করবেন। রুকূ অবস্থায় (তাসবীহর পর) ১০ বার ঐ যিক্‌র বলবেন। অতঃপর রুকূ থেকে মাথা তুলবেন। (রাব্বানা লাকালহাম্‌দ বলার পর) ঐ যিক্‌র ১০ বার বলবেন। অতঃপর আপনি সিজদায় যাবেন। (সিজদার তাসবীহ পড়ে) ঐ যিক্‌র ১০ বার বলবেন। অতঃপর সিজদা থেকে মাথা তুলে (দুআ বলার পর) ঐ যিক্‌র ১০ বার বলবেন। তারপর পুনরায় সিজদায় গিয়ে (তাসবীহর পর) ঐ যিক্‌র ১০ বার বলবেন। অতঃপর সিজদা থেকে মাথা তুলে (ই স্তি রাহার বৈঠকে) ঐ যিক্‌র ১০ বার বলবেন। এই হল প্রত্যেক রাকআতে ৭৫ বার পঠনীয় যিক্‌র। (৪ রাকআতে সর্বমোট ৩০০ বার।)

এইভাবে আপনি প্রত্যেক রাকআতে পাঠ করে ৪ রাকআত নামায পড়েন। পারলে প্রত্যেক দিন ১বার পড়েন। তা না পারলে প্রত্যেক জুমআয় ১বার পড়েন। তা না পারলে প্রত্যেক মাসে ১বার। তা না পারলে প্রত্যেক বছরে ১বার। তাও না পারলে সারা জীবনেও ১বার পড়েন। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৬৭৪নং, জামে ৭৯৩৭নং)

এক বর্ণনায় আছে, “আপনার গুনাহ যদি সমুদ্রের ফেনা বা জমাট বাঁধা বালির মত অগণিত হয় তবুও আল্লাহ আপনার জন্য সমস্তকে ক্ষমা করে দেবেন।” (তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী, ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৬৭৫নং)

প্রকাশ যে, তাশাহহুদের বৈঠকে তাসবীহ তাশাহহুদ পড়ার আগে পড়তে হবে। (নামাযে নববী, সাইয়েদ শাফীকুর রহ্‌মান, লাহোর ছাপা ২৩৮পৃ:)


এই নামাযের সময়

আব্দুল্লাহ বিন আম্‌র অথবা আব্দুল্লাহ বিন উমার অথবা আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস বলেন, একদা নবী (সাঃ) আমাকে বললেন, “তুমি আগামী কাল আমার নিকট এস। আমি তোমাকে কিছু দান করব, কিছু প্রতিদান দেব, কিছু দেব।” আমি ভাবলাম, হয়তো তিনি আমাকে কোন জিনিস উপহার দেবেন। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন, “দিন (সূর্য)ঢলে গেলে (যোহরের পূর্বে) ওঠ এবং ৪ রাকআত নামায পড়।” (আউনুল মা’বূদ ৪/১২৭, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ২/৪৯১)

অতঃপর আব্দুল্লাহ পূর্বোক্ত হাদীসের মত উল্লেখ করলেন। পরিশেষে মহানবী (সাঃ) তাঁকে বললেন, “যদি তুমি পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় পাপীও হও তবুও ঐ নামাযের অসীলায় আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দেবেন।”

আব্দুল্লাহ বলেন, আমি যদি ঐ সময় ঐ নামায পড়তে না পারি? তিনি বললেন, “রাতে দিনে যে কোন সময়ে পড়।” (আবূদাঊদ, সুনান ১২৯৮নং)

প্রকাশ থাকে যে, এই নামাযে ভুল হলে সহু সিজদায় ঐ যিক্‌র পাঠ করতে হবে না। (আউনুল মা’বূদ ৪/১২৬, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ২/৪৯০)

জ্ঞাতব্য যে জামাআত করে এ নামায পড়া বিধেয় নয়। আরো সতর্কতার বিষয় যে, এ নামাযকে অনেকে বিদআত বলে উল্লেখ করেছেন। শায়খ ইবনে উষাইমীন বলেন,

‘দুর্বল হাদীসকে ভিত্তি করে মতভেদ সৃষ্টি হওয়ার একটি উদাহ্‌রণ ‘স্বালাতুত তাসবীহ্‌।’ এ নামায কিছু উলামার নিকট মুস্তাহাব। এর পদ্ধতি হল এই যে, চার রাকআত নামাযে নামাযী সূরা ফাতিহা পাঠ করবে এবং তারপর ১৫ বার তাসবীহ্‌ পড়বে। অনরুপ রুকূ ও সিজদায় (১০ বার) তাসবীহ্‌ পাঠ করবে---। এইভাবে শেষ রাকআত পর্যন্ত যে নিয়ম-পদ্ধতি আছে, যার বর্ণনা আমি সঠিকভাবে দিতে পারছি না। কারণ, উক্ত নামাযের হাদীসকে শরীয়তের হাদীস বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

অন্যান্য উলামাগণ মনে করেন যে, ‘স্বালাতুত তাসবীহ্‌’ নামায অপছন্দনীয় বিদআত এবং তার হাদীস সহীহ নয়। এঁদের মধ্যে একজন হলেন ইমাম  আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)। তিনি বলেছেন, ‘নবী (সাঃ) থেকে এ হাদীস সহীহ সূত্রে বর্ণিত নয়।’

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ বলেন, ‘উক্ত নামাযের হাদীসটি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর প্রতি আরোপিত মিথ্যা।’

প্রকৃত প্রস্তাবে যে ব্যক্তি এ নামাযটি (হাদীসটি) নিয়ে বিচার-বিবেচনা করবে, সে দেখতে পাবে যে, এতে রয়েছে একাধিক উদ্ভট্টি। এমনকি নামাযটি বিধিবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও উদ্ভট্টি লক্ষণীয়। কেননা, ইবাদত হয় হৃদয়ের জন্য উপকারী হবে। আর তা হলে ঐ ইবাদত সর্বকাল ও সর্বস্থানের জন্য বিধিবদ্ধ হবে। নচেৎ তা উপকারী হবে না। আর তা হলে তা বিধিবদ্ধই নয়। বলা বাহুল্য, উক্ত হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে যে, তা প্রত্যেক দিন অথবা প্রত্যেক সপ্তাহ্‌ অথবা প্রত্যেক মাস অথবা প্রত্যেক বছরে একবার। আর তা না পারলে জীবনেও একবার পড়বে -এমন কথার নযীর শরীয়তে মিলে না। সুতরাং উক্ত হাদীসটি তার সনদ ও মতন (বর্ণনা-সূত্র ও বক্তব্য) উভয় দিক দিয়েই যে উদ্ভট, তা স্পষ্ট হয়। আর যিনি হাদীসটিকে মিথ্যা বলেছেন -যেমন শায়খুল ইসলাম বলেছেন -তিনি ঠিকই বলেছেন। এ জন্য শায়খুল ইসলাম আরো বলেছেন, ‘ইমামগণের কেউই এই নামাযকে মুস্তাহাব মনে করেননি।’

এখানে ‘স্বালাতুত তাসবীহ্‌’ দিয়ে উদাহ্‌রণ দেওয়ার একমাত্র কারণ এই যে, নারী-পুরুষ অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন করে থাকে। যাতে আমার ভয় হয় যে, এই নামাযের বিদআতটি বিধেয় (শরয়ী) বিষয়ে পরিণত হয়ে যাবে। আর যদিও কিছু মানুষের নিকট ভারী, তবুও আমি এই নামাযকে বিদআত এই কারণে বলছি যে, আমরা বিশ্বাস করি, মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কোন ইবাদতের বর্ণনা কিতাব অথবা তাঁর রসূলের (সহীহ) সুন্নায় না থাকলে তা বিদআত।’  (লেখক কর্তৃক অনূদিত উলামার মতানৈক্য ২৪-২৫পৃ:)

পক্ষান্তরে ইবনে হাজার, শায়খ আহমাদ শাকের ও আল্লামা মুবারকপুরী প্রমুখ উক্ত হাদীসকে হাসান বলেন। ইমাম হাকেম ও যাহাবীও হাদীসটিকে শক্তিশালী বলে মন্তব্য করেন। খতীব বাগদাদী, ইমাম নওবী, ইবনে স্বালাহ্‌ এবং মুহাদ্দেস আল্লামা আলবানী (রহঃ) প্রমুখ উলামাগণ উক্ত নামাযের হাদীসকে সহীহ বলেন। (দ্র: মিশকাত ১৩২৮নং, ১/৪১৯, ১নং টীকা) অতএব আল্লাহই ভালো জানেন।


 স্বালাতুলহা-জাহ্‌
স্বালাতুলহা-জাহ্‌ বা প্রয়োজন পূরণের নামায অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু চাইতে ২ রাকআত এই নফল নামায বিধেয়। মহানবী (সাঃ) যখন কোন কঠিন বিপদে বা সমস্যায় পড়তেন, তখন নামায পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১৩১৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১৩২৫নং) আর মহান আল্লাহ বলেন,

(يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ)

অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) সাহায্য প্রার্থনা কর। (কুরআন মাজীদ ২/৪৫, ১৫৩)

এক অন্ধ ব্যক্তি নবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, ‘আপনি আল্লাহর নিকট দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করেন।’ তিনি বললেন, “যদি তুমি চাও তোমার জন্য দুআ করব। নচেৎ যদি চাও ধৈর্য ধর এবং সেটাই তোমার জন্য শ্রেয়।”  লোকটি বলল, ‘বরং আপনি দুআ করুন।’

সুতরাং তিনি তাকে ওযু করতে বললেন এবং ভালোরুপে ওযু করে দু’ রাকআত নামায পড়ে এই দুআ করতে আদেশ দিলেন:-

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। তোমার নবী, দয়ার নবীর সাথে তোমার অভিমুখ হ্‌চ্ছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার সাথে আমার প্রতিপালকের প্রতি আমার এই প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে অভিমুখী হয়েছি। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তুমি এর সুপারিশ গ্রহণ কর এবং এর ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’

বর্ণনাকারী বলেন যে, অতঃপর ঐ ব্যক্তি ঐরুপ করলে সে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল। (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৬৭৮নং)

প্রকাশ থাকে যে, অভাব মোচনের নামায ও লম্বা দুআর হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল। (তিরমিযী, সুনান ৪৭৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১৩২৭নং, টীকা দ্র:)

স্বালাতুত তাওবাহ্‌
স্বালাতুত তাওবাহ্‌ বা তওবা করার সময় বিশেষ ২ অথবা রাকআত নামায পড়া বিধেয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গুনাহ করে ফেলে অতঃপর উঠে ওযূ করে ২ রাকআত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে ব্যক্তিকে আল্লাহ মাফ করে দেন।” অতঃপর মহানবী (সাঃ) এই আয়াত তেলাওয়াত করেন:-

(وَالَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوْا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوْا لِذُنُوْبِهِمْ، وَمَنْ يَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ الله، وَلَمْ يُصِرُّوْا عَلَى مَا فَعَلُوْا وَهُمْ يَعْلَمُوْنَ، أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا)

অর্থাৎ, আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেলে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে (পাপ করে) ফেলে অতঃপর সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; আর আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা জেনে-শুনে নিজেদের অপরাধের উপর হ্‌ঠকারিতা করে না। ঐ সকল লোকেদের পুরস্কার হল তাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা এবং সেই বেহেশ্‌ত যার পাদদেশে নদীমালা প্রবাহিত; সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে। (কুরআন মাজীদ ৩/১৩৫-১৩৬) (আবূদাঊদ, সুনান ১৫২১, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, বায়হাকী, সহিহ তারগিব ৬৭৭নং)


তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি উত্তমরুপে ওযূ করে অতঃপর উঠে ২ রাকআত অথবা ৪ রাকআত ফরয অথবা অফরয (সুন্নত বা নফল) নামায উত্তমরুপে রুকূ ও সিজদা করে পড়ে, অতঃপর সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (ত্বাবারানী, মু’জাম)

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের নামায
স্বালাতুল কুসূফ অল-খুসূফ বা চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের নামায ৪ রুকূতে ২ রাকআত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। এই নামাযের নিয়ম নিম্নরুপ :-

চন্দ্রে অথবা সূর্যে গ্রহণ লাগা শুরু হলে ‘আস-স্বালা-তু জামেআহ’ বলে আহবান করতে হবে মুসলিমদেরকে।

জামাআতে কাতার বাঁধা হলে ইমাম সাহেব নামায শুরু করবেন। সশব্দে সূরা ফাতিহার পর লম্বা ক্বিরাআত করবেন এবং তারপর রুকূতে যাবেন। লম্বা রুকূ থেকে মাথা তুলে পুনরায় বুকেহাত রেখে (সূরা ফাতিহা পড়ে) আবার পূর্বাপেক্ষা কম লম্বা ক্বিরাআত করবেন। অতঃপর দ্বিতীয়বার অপেক্ষাকৃত কম লম্বা রুকূ করে বাকী রাকআত সাধারণ নামাযের মত শেষ করে দ্বিতীয় রাকআতেও অনুরুপ ২ বার ক্বিরাআত ও ২ বার রুকূ করে নামায সম্পন্ন করবেন। এ নামাযের সিজদাও হবে খুব লম্বা। প্রথম রাকআতের চেয়ে দ্বিতীয় রাকআত অপেক্ষাকৃত ছোট হবে। মুক্তাদীগণ যে নিয়মে ইমামের অনুসরণ করতে হয়, সেই নিয়মে অনুসরণ করবে। এই নামায এত লম্বা হওয়া উচিৎ যে, যেন নামায শেষ হয়ে দেখা যায়, সূর্য বা চন্দ্রের গ্রহণ ছেড়ে গেছে।

অনুরুপভাবে নামায শেষ করে দাঁড়িয়ে মহানবী (সাঃ) খুতবা দিয়েছিলেন। হাম্‌দ ও সানার পর বলেছিলেন, “সূর্য ও চন্দ্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার অন্যতম নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের জন্য উভয়ে গ্রহণ লাগে না। অতএব তাতে গ্রহণ লাগতে দেখলে তোমরা আতঙ্কিত হয়ে নামাযে মগ্ন হও।” (বুখারী ১০৪৭নং, মুসলিম, সহীহ)

নামাযের সাথে সাথে এই সময় দুআ, তকবীর, ইস্তিগফার ও সদকাহ্‌ করা মুস্তাহাব। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “সূর্য ও চন্দ্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার অন্যতম বড় নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের জন্য উভয়ে গ্রহণ লাগে না। অতএব তাতে গ্রহণ লাগতে দেখলে তোমরা আল্লাহর কাছে দুআ কর, তকবীর পড়, সদকাহ্‌ কর এবং নামায পড়।” (বুখারী ১০৪৪নং, মুসলিম,  মিশকাত ১৪৮৩নং) অন্য এক বর্ণনায় আছে, “তোমরা আতঙ্কিত হয়ে আল্লাহর যিক্‌র, দুআ ও ইস্তিগফারে মগ্ন হও।” (ঐ, মিশকাত ১৪৮৪নং)

এই সময় তিনি ক্রীতদাস মুক্ত করতে (বুখারী ১০৫৪নং) এবং কবরের আযাব থেকে পানাহ চাইতেও আদেশ করেছেন। (বুখারী ১০৫০নং)

উল্লেখ্য যে, কারো যদি দুই রুকুর একটিও ছুটে যায়, তাহলে রাকআত গণ্য করবে না। কারণ, একটি রুকূ ছুটে গেলে রাকআত হবে না। ইমামের সালাম ফিরার পর ২টি রুকূ বিশিষ্ট ১ রাকআত নামায কাযা পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৫০, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৩/৯৮, ২৩/৯৩, মুখতাসারু মুখালাফাতু ত্বাহারাতি অসস্বালাহ, আব্দুল আযীয সাদহান ১২৯-১৩০পৃ:)

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। কিন্তু এর তুলনায় যে নামাযের গুরুত্ব বেশী সেই নামাযের সময়ে এই নামাযের সময় হলে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নামাযই পড়তে হবে। যেমন, জুমুআহ বা ঈদের সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হলে, অথবা তারাবীহ্‌র সময় চন্দ্রগ্রহণ শুরু হলে গ্রহণের নামাযের উপর ঐ সকল নামায প্রাধান্য পাবে।

নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে; যেমন ফজর ও আসরের পর গ্রহণ লাগলেও ঐ নামায পড়া যায়। ফরয নামাযের সময় এসে গেলে ঐ নামায হাল্কা করে পড়তে হবে। নামাযের পরও গ্রহণ বাকী থাকলে দ্বিতীয়বার ঐ নামায পড়া বিধেয় নয়।

যেমন গ্রহণ প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত কেবল পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করে ঐ নামায পড়া বিধেয় নয়। অনুরুপ বিধেয় নয় গ্রহণ দৃশ্য না হলে।

ভূমিকম্প, ঝড়, নিরবচ্ছিন্ন বজ্রপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্নি উদগিরণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও গ্রহণের মত নামায পড়ার কথা হযরত আলী, ইবনে আব্বাস ও হুযাইফা সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত আছে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৫৫)


প্রকাশ থাকে যে, সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের সময় গর্ভবতীকে এ করতে নেই, সে করতে নেই, শুয়ে থাকতে হয় বা তার এই করলে সেই হয় প্রভৃতি কথা শরীয়তে নেই। সুতরাং বিজ্ঞান যদি তা সমর্থন না করে তাহলে তা অমূলক ধারণাপ্রসূত কথা। পরন্তু শরীয়তে আছে মনে করে এ কথা বলা ও মানা হলে তা বিদআত। অবশ্য খালি চোখে গ্রহণ দেখলে চোখ খারাপ হতে পারে, সে কথা সত্য।

স্বালাতুল ইস্তিসকা
স্বালাতুল ইস্তিসকা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামায অনাবৃষ্টির সময় মহান প্রতিপালকের নিকট বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে পড়া সুন্নত।

বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কারণ, মানুষের পাপ ও বিশেষ করে যাকাত বন্ধ করে দেওয়া। মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে মুহাজিরদল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে (উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে)। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর।

যখনই কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারী ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না।

যে জাতিই মাপ ও ওজনে কম দেবে সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, কঠিন খাদ্য-সংকট এবং শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে।

যে জাতিই তার মালের যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে সে জাতির জন্যই আকাশ হতে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণীকুল না থাকত তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হত না।

যে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে সে জাতির উপরেই তাদের বিজাতীয় শত্রুদলকে ক্ষমতাসীন করা হবে; যারা তাদের মালিকানা-ভুক্ত বহু ধন-সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করবে।

আর যে জাতির শাসকগোষ্ঠী যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুযায়ী দেশ শাসন করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব অবস্থায়ী রাখবেন।” (বাইহাকী, ইবনে মাজাহ্‌ ৪০১৯নং, সহীহ তারগীব ৭৫৯নং)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “ পাঁচটির প্রতিফল পাঁচটি।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! পাঁচটির প্রতিফল পাঁচটি কি কি?’ তিনি বললেন, “যে জাতিই (আল্লাহর) প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে সেই জাতির উপরেই তাদের শত্রুকে ক্ষমতাসীন করা হবে। যে জাতিই আল্লাহর অবতীর্ণকৃত সংবিধান ছাড়া অন্য দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সেই জাতির মাঝেই দরিদ্রতা ব্যাপক হবে। যে জাতির মাঝে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ পাবে সে জাতির মাঝেই মৃত্যু ব্যাপক হবে। যে জাতিই যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে সেই জাতির জন্যই বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যে জাতি দাঁড়ি-মারা শুরু করবে সে জাতি ফসল থেকে বঞ্চিত হবে এবং দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হবে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৭৬০নং)

বলা বাহুল্য, বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য তওবা ও ইস্তিগফার জরুরী। মহান আল্লাহ হযরত নূহ্‌ (আঃ)-এর কথা উল্লেখ করে বলেন,

(فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّاراً، يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَاراً، وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَّبَنِيْنَ وَيَجْعَلْ لَكُمْ جَنَّاتٍ وَّيَجْعَلْ لَكُمْ أَنْهَاراً)

অর্থাৎ, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) কর। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত করবেন। তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। আর তোমাদের জন্য বাগান তৈরী করে দেবেন এবং প্রবাহিত করে দেবেন নদী-নালা। (কুরআন মাজীদ ৭১/১০-১২)

একান্ত বিনয়ের সাথে, সাধারণ আটপৌরে বা কাজের (পুরাতন) কাপড় পরে, ধীর ও শান্তভাবে কাকুতি-মিনতির সাথে সকালে ঈদগাহে বের হয়ে এই নামায পড়তে হয়।

এই নামায ঈদের নামাযের মতই আযান ও ইকামত ছাড়া ২ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে সশব্দে সূরা ফাতিহার পর যে কোন সূরা পড়া যায়। নামাযের আগে অথবা পরে হবে খুতবা। খুতবায় ইমাম সাহেব বেশী বেশী ইস্তিগফার ও দুআ করবেন। মুক্তাদীগণ সে দুআয় ‘আমীন’ বলবে। এই দুআয় বিশেষ করে ইমাম (এবং সকলে) খুব বেশী হাত তুলবেন। মাথা বরাবর হাত তুলে দুআ করবেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৬৮, ইবনে হিব্বান, সহীহ, মিশকাত ১৫০৪নং) এমন কি চাদর গায়ে থাকলে তাতে বগলের সাদা অংশ দেখা যাবে। (বুখারী ১০৩১, মুসলিম, সহীহ ৮৯৫নং)

বৃষ্টি প্রার্থনার সময় উল্টা হাতে দুআ করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, সাধারণ প্রার্থনার করার সময় হাতের তেলো বা ভিতর দিকটা হবে আকাশের দিকে এবং বৃষ্টি প্রার্থনার সময় হবে মাটির দিকে; আর হাতের বাহির দিকটা হবে আকাশের দিকে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (সাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করলে তিনি তাঁর হাতের পিঠের দিকটা আকাশের দিকে তুলে ইঙ্গিত করলেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৮৯৫-৮৯৬নং)

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ প্রমুখ উলামাগণ বলেন, কোন কিছু চাওয়া হয় হাতের ভিতরের অংশ দিয়েই, বাইরের অংশ দিয়ে নয়। আসলে আল্লাহর নবী (সাঃ) হাত দুটিকে মাথার উপরে খুব বেশী উত্তোলন করলে দেখে মনে হয়েছিল যে, তিনি হাতের বাইরের অংশ আকাশের দিকে করেছিলেন। (আল-ইনসাফ ২/৪৫৮, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৮৩)

অতঃপর কিবলামুখ হয়ে চাদর উল্টাবেন; অর্থাৎ, চাদরের ডান দিকটাকে বাম দিকে, বাম দিকটাকে ডান দিকে করে নেবেন এবং উপর দিকটা নিচের দিকে ও নিচের দিকটা উপর দিকে করবেন। মুক্তাদীগণও অনুরুপ করবে। এরপর সকলে পুনরায় (একাকী) দুআ করে বাড়ি ফিরবে।

চাদর উল্টানো এবং দুআর সময় উল্টাহাত করা আসলে এক প্রকার কর্মগত দুআ। অর্থাৎ, হে মওলা! তুমি আমাদের এই চাদর ওহাত উল্টানোর মত আমাদের বর্তমান দুরবস্থাও পাল্টে দাও। আমাদের অনাবৃষ্টির অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দাও। (নামাযে নববী, সাইয়েদ শাফীকুর রহ্‌মান, লাহোর ছাপা ২৩৪পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, ইস্তিসকার জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন নেই। যে কোন একটি দিন ঠিক করে সেই দিনে নামায পড়া যায়। রোযা রাখা, পশু নেওয়া ইত্যাদির কথাও হাদীসে নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৭১-২৭২)

বৃষ্টি প্রার্থনার দ্বিতীয় পদ্ধতি :

জুমআর খুতবায় ইমাম সাহেব হাত তুলে দুআ করবেন এবং মুক্তাদীরাও হাত তুলে ‘আমীন-আমীন’ বলবে।

একদা মহানবী (সাঃ) জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী (বেদুঈন) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেল আর পরিবার পরিজন (খাদ্যের অভাবে) ক্ষুধার্ত থেকে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’ তখন নবী (সাঃ) নিজের দুইহাত তুলে দুআ করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সাথে দুআর জন্য হাত তুলল। ফলে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে পরবর্তী জুমআতে উক্ত (বা অন্য এক) ব্যক্তি পুনরায় খাড়া হয়ে  বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! ঘর-বাড়ি ভেঙে গেল এবং মাল-ধন ডুবে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দুআ করুন!’ মহানবী (সাঃ) তখন নিজেরহাত তুলে  পুনরায় বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করলেন এবং বৃষ্টিও থেমে গেল। (বুখারী ৯৩২, ৯৩৩, ১০১৩, ১০২৯, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/২৫৬, ২৭১) 

বৃষ্টি প্রার্থনার তৃতীয় পদ্ধতি :

শুরাহ্‌বীল বিন সিমত একদা কা’ব বিন মুর্রাহ্‌কে আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর হাদীস বর্ণনা করতে বললে তিনি বললেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর নিকট এসে বলল, ‘আপনি মুযার (গোত্রের) জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করুন।’ তিনি বললেন, “তুমি তো বেশ দুঃসাহ্‌সিক! (কেবল) মুযারের জন্য (বৃষ্টি)?” লোকটি বলল, ‘আপনি আল্লাহ আযযা অজাল্লার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তিনি আপনাকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ আযযা অজাল্লার কাছে দুআ করেছেন, তিনি তা কবুল করেছেন।’ এ কথা শোনার পর মহানবী (সাঃ) দুইহাত তুলে বৃষ্টি প্রার্থনার দুআ করলেন এবং এত বৃষ্টি হল যে, তা বন্ধ করার জন্য পুনরায় তিনি দুআ করলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১২৬৯নং, বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবা,হাকেম, মুস্তাদরাক)

বৃষ্টি প্রার্থনার চতুর্থ পদ্ধতি :

ইমাম শা’বী কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা উমার (রাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করতে বের হয়ে কেবল ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে ফিরে এলেন। লোকেরা বলল, ‘আমরা তো আপনাকে বৃষ্টি চাইতে দেখলাম না?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি সেই নক্ষত্রের মাঝে বৃষ্টি প্রার্থনা করেছি, যাতে বৃষ্টি হয়ে থাকে। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন,

(اِسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّاراً، يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَاراً)

অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) কর। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত করবেন। (কুরআন মাজীদ ৭১/১০-১১)

(اِسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَاراً وَّيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُمْ وَلاَ تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِيْنَ)

অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তিগফার) কর। অতঃপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর; তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদেরকে আরো শক্তি দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না। (কুরআন মাজীদ ১১/৫২) (সুনানু সাঈদ বিন মানসূর, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবা ৮৩৪৩নং)



বৃষ্টি-প্রার্থনার কতিপয় দুআ

১-  اَلْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، اَلرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ ، مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ، لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ يَفْعَلُ مَا يُرِيْدُ، اَللّهُمَّ أَنْتَ اللهُ لاَ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَنْتَ الْغَنِيُّ وَنَحْنُ الْفُقَرَاءُ، أَنْزِلْ عَلَيْنَا الْغَيْثَ وَاجْعَلْ مَا أَنْزَلْتَ لَنَا قُوَّةً وَّبَلاَغاً إِلىحِيْن।

 উচ্চারণ:- আলহামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন আর রাহ্‌মা-নির রাহীম, মা-লিকি য়্যাউমিদ্দ্বীন, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু য়্যাফআলু মা য়্যুরীদ, আল্লা-হুম্মা আন্তাল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত, আন্তাল গানিইয়্যু অনাহ্‌নুল ফুক্বারা-’, আনযিল আলাইনাল গাইসা অজ্‌আল মা আনযালতা লানা ক্বুউওয়াতাউঅ বালা-গান ইলা-হীন।

অর্থ:- সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর নিমি ত্তে। যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। যিনি অসীম করুণাময়, দয়াবান। বিচার দিবসের অধিপতি। আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই, তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন। হে আল্লাহ! তুমিই আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোন সত্য আরাধ্য নেই। তুমিই অভাবমুক্ত এবং আমরা অভাবগ্রস্ত। আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর এবং যা বর্ষণ করেছ তা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত শক্তি ও যথেষ্টতার কারণ বানাও। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৭৩নং)

২- اَللّهُمَّ اسْقِنَا غَيْثاً مُّغِيْثاً مَّرِيْئاً مَّرِيْعاً نَافِعاً غَيْرَ ضَارٍّ عَاجِلاً غَيْرَ آجِلٍ।

উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মাসক্বিনা গাইষাম মুগীষাম মারীআম মারীআ’ন না-ফিআন গাইরা যা-রিGন আ’-জিলান গাইরা আ-জিল।

অর্থ-  আল্লাহ গো! আমাদেরকে বৃষ্টি দান কর, প্রয়োজন পূর্ণকারী স্বাচ্ছন্দ্য ও উর্বরতা আনয়নকারী, লাভদায়ক ও হিতকর, এবং বিলম্বে নয় অবিলম্বে বর্ষণশীল বৃষ্টি। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৬৯নং)

 ৩-  اَللّهُمَّ أَغِثْنَا، اَللّهُمَّ أَغِثْنَا، اَللّهُمَّ أَغِثْنَا।

  উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা আগিষনা, আল্লা-হুম্মা আগিষনা, আল্লা-হুম্মা আগিষনা।

অর্থ- হে আল্লাহ! আমাদের জন্য পানি বর্ষণ কর। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং)

 ৪-  اَللّهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَكَ وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ وَأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ।

উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মাসক্বি ইবা-দাকা অবাহা-ইমাকা অনশুর রাহ্‌মাতাকা অআহ্‌য়ি বালাদাকাল মাইয়্যিত।

অর্থ:- হে আল্লাহ! তোমার বান্দাদের ও প্রাণীদের উপর পানি বর্ষণ কর এবং  তোমার রহ্‌মত ছড়িয়ে দাও। আর তোমার মৃত দেশকে জীবিত কর। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৭৬নং) [1]



অতিবৃষ্টি হলে

  اَللهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اَللّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالظِّرَابِ وَ بُطُوْنِ الأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ।

উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মাহাওয়া-লাইনা অলা আলাইনা, আল্লা-হুম্মা আলাল আ-কামি অযযিরা-বি অবুতূনিল আউদিয়াতি  অমানা-বিতিশ শাজার।

অর্থ:- হে আল্লাহ! আমাদের আশে-পাশে বর্ষাও, আমাদের উপরে নয়। হে আল্লাহ! পাহাড়, টিলা, উপত্যকা এবং বৃক্ষাদির উদগত হওয়ার স্থানে বর্ষাও। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং)

জানাযার নামায সম্পর্কে লেখক কর্তৃক প্রণীত ‘জানাযা দর্পণ’ দ্রষ্টব্য।


([1] ) প্রকাশ থাকে যে, বৃষ্টি-প্রার্থনার জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া, গোবর-কাদা বা রং ছিটাছিটি করে খেল খেলা, কারো চুলো ভেঙ্গে দেওয়া ইত্যাদি প্রথা শিরকী তথা বিজাতীয় প্রথা।


বিভিন্ন সিজদা সমূহ

কুরআন তিলাওয়াতের সিজদাহ
কুরআন মাজীদের সিজদার আয়াত তিলাঅত করলে অথবা শুনলে তকবীর দিয়ে একটি সিজদাহ করা এবং তকবীর দিয়ে মাথা তোলা মুস্তাহাব। এই সিজদার পর কোন তাশাহহুদ বা সালামনেই। তকবীরের ব্যাপারে মুসলিম বিন য়্যাসার, আবূ কিলাবাহ্‌ ও ইবনে সীরীন কর্তৃক আষার বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে আবী শাইবা, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, বায়হাকী, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৬৯পৃ:)

এই সিজদাহ করার বড় ফযীলত ও মাহাত্ম রয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করে, তখন শয়তান দূরে সরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘হায় ধ্বংস আমার! ও সিজদাহ করতে আদেশ পেয়ে সিজদাহ করে, ফলে ওর জন্য রয়েছে জান্নাত। আর আমি সিজদার আদেশ পেয়ে তা অমান্য করেছি, ফলে আমার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৯৫নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তিলাওয়াতের সিজদা কুরআন তেলাওয়াতকারী ও শ্রোতার জন্য সুন্নত। একদা হযরত উমার (রাঃ) জুমআর দিন মিম্বরের উপরে সূরা নাহল পাঠ করলেন। সিজদার আয়াত এলে তিনি মিম্বর থেকে নেমে সিজদাহ করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সাথে সিজদাহ করল। অতঃপর পরবর্তী জুমআতেও তিনি ঐ সূরা পাঠ করলেন। যখন সিজদার আয়াত এল, তখন তিনি বললেন, ‘হে লোক সকল! আমরা (তিলাওয়াতের সিজদাহ করতে) আদিষ্ট নই। সুতরাং যে সিজদাহ করবে, সে ঠিক করবে। আর যে করবে না, তার কোন গুনাহ হবে না।’

অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের উপর (তিলাওয়াতের) সিজদাহ ফরয করেন নি। আমরা চাইলে তা করতে পারি।’ (বুখারী ১০৭৭নং)


যায়দ বিন সাবেত (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছে সূরা নাজম পাঠ করলাম। তিনি সিজদাহ করলেন না।’ (বুখারী ১০৭৩, মুসলিম,  মিশকাত ১০২৬নং)

সিজদার স্থানসমূহ
কুরআন মাজীদে মোট ১৫ জায়গায় সিজদাহ করা সুন্নত। তা যথাক্রমে নিম্নরুপ:-

সূরা আ’রাফ ২০৬ নং আয়াত।
সূরা রা’দ ১৫নং আয়াত।
সূরা নাহল ৫০নং আয়াত।
সূরা ইসরা’ (বানী ইসরাঈল) ১০৯নং আয়াত।
সূরা মারয়্যাম ৫৮নং আয়াত।
সূরাহাজ্জ ১৮নং আয়াত।
সূরাহাজ্জ ৭৭নং আয়াত।
সূরা ফুরক্বান ৬০নং আয়াত।
সূরা নামল ২৬নং আয়াত।
সূরা সাজদাহ ১৫নং আয়াত।
সূরা স্বা-দ ২৪নং আয়াত।
সূরা ফুস্‌সিলাত (হা-মিম সাজদাহ) ৩৮ নং আয়াত।
সূরা নাজম ৬২নং আয়াত।
সূরা ইনশিক্বাক্ব ২১নং আয়াত।

সূরা আলাক্ব ১৯নং আয়াত।

সিজদার জন্য ওযূ জরুরী কি?

তিলাওয়াতের সিজদার জন্য ওযূ শর্ত নয়। শরমগাহ্‌ ঢাকা থাকলে কেবলামুখে এই সিজদাহ করা যায়। যেহেতু ওযূ শর্ত হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। (নাইলুল আউতার, শাওকানী, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১২৬, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/১৯৬)

তিলাওয়াতের সিজদার দুআ
১-  سَجَدَ وَجْهِىَ لِلَّذِيْ خَلَقَهُ وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ بِحَوْلِهِ وَقُوَّتِهِ।
উচ্চারণ- সাজাদা অজহিয়া লিল্লাযী খালাক্বাহু অশাক্বক্বা সামআহু  অবাস্বারাহু বিহাউলিহী অক্বুউওয়াতিহ্‌।

অর্থ- আমার মুখমন্ডল তাঁর জন্য সিজদাবনত হল যিনি ওকে সৃষ্টি করেছেন এবং স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতায় ওর চক্ষু ও কর্ণকে উদগত করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, সহীহ তিরমিযী, সুনান৪৭৪নং, আহ্‌মদ ৬/৩০)

আবূ দাউদের বর্ণনায় আছে, এই দুআ সিজদায় একাধিকবার পাঠ করতে হয়।

  ২- اَللّهُمَّ اكْتُبْ لِيْ بِهَا عِنْدَكَ أَجْراً، وَّضَعْ عَنِّيْ بِهَا وِزْراً، وَّاجْعَلْهَا لِيْ عِنْدَكَ ذُخْراً، وَّتَقَبَّلْهَا مِنِّيْ كَمَا تَقَبَّلْتَهَا مِنْ عَبْدِكَ دَاوُوْدَ।
  উচ্চারণ:- আল্লাহুম্মাকতুব লী বিহা ইন্দাকা আজরা, অযা’ আন্নী বিহা বিযরা, অজ্‌আলহা লী ইন্দাকা যুখরা, অতাক্বাব্বালহা মিন্নী  কামা তাক্বাব্বালতাহা মিন আবদিকা দাঊদ।


  অর্থ- হে আল্লাহ! এর (সিজদার) বিনিময়ে তোমার নিকট আমার জন্য পুণ্য লিপিবদ্ধ কর, পাপ মোচন কর, তোমার নিকট এ আমার জন্য জমা রাখ এবং এ আমার নিকট হতে গ্রহণ কর যেমন তুমি তোমার বান্দা দাঊদ (আহমাদ, মুসনাদ) থেকে গ্রহণ করেছ। (সহীহ তিরমিযী, সুনান ৮৭নং,হাকেম১/২১৯, ইবনে মাজাহ্‌ ১০৫৩নং)

নামাযের ভিতরে তিলাওয়াতের সিজদাহ
একাকী বা ইমাম সকলের জন্য নামাযে সিজদার আয়াত তেলাওয়াত করা বৈধ এবং সকলের জন্য সিজদাহ করা সুন্নত। অবশ্য সির্রী নামাযে ইমামের জন্য সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে সিজদা না করাই উত্তম। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ১/২৭০পৃ:)  কারণ, এতে মুক্তাদীদের মাঝে গোলমাল সৃষ্টি হয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩২৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/৩০০)  মুক্তাদীর জন্য ইমামের ইক্তিদায় ঐ সিজদাহ করা জরুরী। যেমন, সিজদার আয়াত তিলাঅত করতে শুনলেও যদি ইমাম সিজদাহ না করেন, তাহলে মুক্তাদী সিজদাহ করতে পারে না।

প্রকাশ থাকে যে, একই সঙ্গে কয়েকটি সিজদার আয়াত পড়লে সবশেষে একটি সিজদাই যথেষ্ট। যেমন হিফয করার সময় সিজদার আয়াত বারবার পড়লেও সবশেষে একটি সিজদাহ করে নেওয়া যথেষ্ট।

সিজদার আয়াত পাঠ বা শ্রবণ করার পর সিজদাহ করার সুযোগ না হলে সামান্য ক্ষণ পরে সিজদাহ কাযা করে নেওয়া যায়। দেরী লম্বা হয়ে গেলে কাযা করা যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/১৯৮)


প্রকাশ থাকে যে, এই সিজদার পরহাত তুলে মুনাজাত করা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ২৮০পৃ:)

শুকরিয়ার সিজদাহ
মহান প্রতিপালক আল্লাহ আমাদেরকে কত নেয়ামত দান করেছেন, তা গুনে শেষ করা যায় না। এই সকল নেয়ামতের শুক্‌র আদায় করা বান্দার জন্য ফরয। শুক্‌র আদায়ের নিয়ম হল, প্রথমত: অন্তরে এই স্বীকার করা যে, এই নেয়ামত আল্লাহর তরফ থেকে আগত। দ্বিতীয়ত: মুখে তার শুক্‌র আদায় করা। তৃতীয়ত: কাজেও শুক্‌র প্রকাশ করা। অর্থাৎ, সেই নেয়ামত তাঁরই সন্তুষ্টির পথে খরচ করা। অন্যথা নাশুকরী বা কৃতঘ্নতা হবে।

হ্‌ঠাৎ কোন সুসংবাদ, সুখের খবর বা সম্পদ লাভের খবর পেলে অথবা বড় বিপদ দূর হওয়ার সংবাদ শুনলে মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শুকরানার (একটি) সিজদাহ মুস্তাহাব।

মহানবী (সাঃ) কোন আনন্দদায়ক সংবাদ শুনলে অথবা শুভ সংবাদ পেলে আল্লাহ তাআলাকে শুকরিয়া জানানোর জন্য সিজদায় পতিত হতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১৪৯৪নং)

হযরত আলী (রাঃ) যখন মহানবী (সাঃ)-কেহামাযান গোত্রের লোকেদের ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কথা লিখলেন, তখন তিনি সিজদাহ করলেন এবং উঠে বললেন, “হামাযানের উপর সালাম,হামাযানের উপর সালাম।” (বায়হাকী)

আব্দুর রহ্‌মান বিন আওফ (রাঃ) বলেন, একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) বের হয়ে এক খেজুর বাগানে প্রবেশ করে সিজদায় গেলেন। তিনি এত লম্বা সময় ধরে সিজদায় থাকলেন যে, আমি আশঙ্কা করলাম, হয়তো বা আল্লাহ তাঁর প্রাণ হ্‌রণ করে নিয়েছেন। আমি নিকটে উপস্থিত হয়ে দেখতে গেলাম। তিনি মাথা তুলে বললেন, “আব্দুর রহ্‌মান! কি ব্যাপার তোমার?” আমি ঘটনা খুলে বললে তিনি বললেন, “জিবরীল (আঃ) আমাকে বললেন, আমি কি আপনাকে সুসংবাদ দেব না? আল্লাহ আয্‌যা জাল্ল্‌ আপনাকে বলেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার প্রতি দরুদ পড়বে, আমি তার প্রতি রহ্‌মত বর্ষণ করব। আর যে ব্যক্তি তোমার প্রতি সালাম জানাবে, আমি তাকে শান্তি দান করব।’ এ খবর শুনে আমি আল্লাহ আয্‌যা অজাল্লার নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক)

তওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ এলে কা’ব বিন মালেক সিজদাহ করেছিলেন। (বুখারী)


শুকরানার সিজদার জন্য ওযূ জরুরী নয়। জরুরী নয় তকবীরও।

সহু সিজদাহ
সহু সিজদা বা সিজদা-এ সাহও (ভুলের সিজদাহ) ফরয বা নফল নামাযে ভুল করে কোন ওয়াজেব অংশ ত্যাগ করলে ঐ ভুলের খেসারত স্বরুপ এবং ভুল আনয়নকারী শয়তানের প্রতি চাবুক স্বরুপ দুটি সিজদাহ করতে হয়। ভুল অনুপাতে সিজদার আগে বা পরে হাদীসে বর্ণিত নিয়মানুসারে সিজদাহ করা জরুরী।



নামায কম পড়ে সালাম ফিরে দিলে :

ভুলবশত: ১ বা ২ রাকআত নামায কম পড়ে সালাম ফিরে থাকলে যদি অল্প (৫/৭ মিনিট) সময়ের মধ্যে মনে পড়ে, তাহলে (মাঝে কথা বলে থাকলেও) নামাযী বাকী নামায সম্পন্ন করে সালাম ফিরার পর তকবীর ও তাসবীহ সহ্‌ দুটি সিজদাহ করে পুনরায় সালাম ফিরবে।

এ ব্যাপারে যুল-য়্যাদাইনের হাদীস প্রসিদ্ধ। একদা মহানবী (সাঃ) যোহ্‌র কিংবা আসরের নামায ভুল করে ২ রাকআত পড়ে সালাম ফিরে উঠে অন্য জায়গায় বসলেন। লোকেরা ভাবল, নামায সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আবূ বাক্‌র, উমার কেউই ভয়ে তাঁর সাথে কথা বললেন না। অবশেষে যুল-য়্যাদাইন বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ভুলে গেছেন, নাকি নামায কম হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, “আমি ভুলিও নি, নামায কমও হয় নি।” অতঃপর সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “যুল-য়্যাদাইন যা বলছে তা কি ঠিক?” সকলে বলল, ‘জী হ্যাঁ।’ সুতরাং তিনি অগ্রসর হয়ে বাকী নামায পূরণ করে সালাম ফিরলেন। অতঃপর তকবীর দিয়ে অনুরুপ অথবা তার চেয়ে লম্বা সিজদা দিলেন। তারপর আবার তকবীর দিয়ে মাথা তুললেন। পুনরায় তকবীর দিয়ে অনুরুপ অথবা তার চেয়ে লম্বা আরো একটি সিজদাহ করলেন। তারপর আবার তকবীর দিয়ে মাথা তুলে সালাম ফিরলেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১০১৭নং)

অবশ্য দীর্ঘ সময়ের পর মনে পড়লে নূতন করে পুরো নামাযটাই পুনরায় ফিরিয়ে পড়তে হবে।

নামাযের কোন রুক্‌ন (যেমন কিয়াম, রুকূ, সিজদাহ প্রভৃতি) ভুলে ত্যাগ করলে নামাযই হবে না। যে রাকআতের রুক্‌ন ত্যক্ত হবে, সে রাকআত বাতিল গণ্য হবে। ঐ ভুল নামাযের মধ্যে প্রথম রাকআতের রুক্‌ন ছেড়ে দ্বিতীয় রাকআতে মনে পড়লে, দ্বিতীয়কে প্রথম রাকআত গণ্য করে বাকী নামায সম্পন্ন করবে নামাযী। অতঃপর সালাম ফিরার পর দুই সিজদা করে পুনরায় সালাম ফিরবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৭/৩৯) পক্ষান্তরে নামাযের সালাম ফিরার পর মনে পড়লে এক রাকআত নামায পড়ে ঐরুপ সিজদাহ করবে।

নামায বেশী পড়লে :

নামাযে ভুলবশত: ১ রাকআত বা ১টি সিজদাহ বা বৈঠক অতিরিক্ত হয়ে গেলে সালাম ফিরার পর ২টি সহু সিজদা করে পুনরায় সালাম ফিরবে নামাযী।

একদা মহানবী (সাঃ) ৫ রাকআত নামায পড়ে সালাম ফিরলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, নামায কি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? তিনি বললেন, “ব্যাপার কি?” লোকেরা বলল, ‘আপনি ৫ রাকআত নামায পড়লেন।’ এ কথা শুনে তিনি দুটি সিজদাহ করলেন। (অতঃপর সালাম ফিরলেন।) (বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০১৬নং)

রাকআতে সন্দেহ্‌ হলে :

নামায পড়তে পড়তে কয় রাকআত হল -এই সন্দেহ্‌ হলে যেদিকের সঠিকতার ধারণা অধিক প্রবল হবে, তার উপর ভিত্তি করে নামায শেষ করে সালাম ফিরার পর ২টি সিজদাহ করে পুনরায় সালাম ফিরবে।

যদি দুই দিকের মধ্যে কোন দিকেরই সঠিকতার ধারণা প্রবল না হয়, তাহলে দৃঢ় প্রত্যয়ের উপর আমল করবে নামাযী। অর্থাৎ, কম সংখ্যার উপর ভিত্তি করলে নামায অসম্পূর্ণ হওয়ার আশংকা থাকবে না। সুতরাং সেই প্রত্যয়ের সাথে বাকী নামায সম্পন্ন করে সালাম ফিরার পূর্বে দুটি সিজদা-এ সাহও করে সালাম ফিরবে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ নামাযে সন্দেহ্‌ করে এবং বুঝতে পারে না যে, সে কয় রাকআত পড়েছে; ৪ রাকআত, না ৩ রাকআত? তখন তার উচিৎ, সন্দেহ্‌ দূর করে দিয়ে যা একীন (দৃঢ় প্রত্যয়) হয় তার উপর ভিত্তি করা। অতঃপর সালাম ফিরার পূর্বে দুটি সিজদাহ করা। এতে সে যদি ৫ রাকআত পড়ে থাকে তাহলে ঐ সিজদাহ মিলে তার নামায জোড় হয়ে যাবে। অন্যথা যদি পূর্ণ ৪ রাকআত পড়ে থাকে, তাহলে ঐ সিজদাহ শয়তানের জন্য লাঞ্ছনাকর হবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  মিশকাত ১০১৫নং)



প্রথম তাশাহহুদ ত্যাগ করলে :

নামাযী নামাযের প্রথম তাশাহহুদের বৈঠকে বসতে ভুলে গেলে যদি অর্ধেক উঠে খাড়া না হয়ে যায়, (হাঁটুদ্বয় মাটি ত্যাগ না করে) তাহলে মনে পড়লে পুনরায় বসে ‘আত্‌-তাহিয়্যাত’ পড়ে নেবে। আর এতে সাহও সিজদার প্রয়োজন নেই। অর্ধেকের বেশী উঠে খাড়া হয়ে গেলে এবং সম্পূর্ণ খাড়া না হয়ে মনে পড়লে পুনরায় বসে ‘আত্‌-তাহিয়্যাত’ পড়ে নেবে এবং শেষে সহু সিজদাহ করবে। কিন্তু যদি সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে যায়, তাহলে আর পুনরায় না বসে বাকী নামায পূর্ণ করে সালাম ফিরার পূর্বে দুই সিজদা করে সালাম ফিরবে।

অবৈধ জানার পরেও সম্পূর্ণ খাড়া হওয়ার পর পুনরায় বসে তাশাহহুদ পড়লে নামায বাতিল নয়। কিন্তু ক্বিরাআত শুরু করার পর বসলে নামায বাতিল গণ্য হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৫১১-৫১৩)

একদা মহানবী (সাঃ) নামাযে প্রথম বৈঠকে না বসে উঠে পড়েন। লোকেরা তাসবীহ বললেও তিনি না বসে নামায শেষে দুই সিজদাহ করে সালাম ফিরেন। (বুখারী, মুসলিম,  সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্‌), মিশকাত ১০১৮নং)

তিনি বলেন, “ইমাম ভুলে গিয়ে (তাশাহহুদ না পড়ে) সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে গেলে তাকে ২টি সহু সিজদাহ করতে হবে। অবশ্য সম্পূর্ণ খাড়া না হলে সহু সিজদাহ করতে হবে না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম জামে ৬২৩নং)

প্রকাশ যে, ৪ রাকআত পড়ে ৫ রাকআতের জন্য ভুলে উঠে সম্পূর্ণ খাড়া হয়ে গেলেও স্মরণ হওয়া বা করানোর সাথে সাথে নামাযী বসে যাবে। কিন্তু প্রথম বৈঠকের জন্য স্মরণ হওয়া বা করানোর পরেও বসবে না।



সহু সিজদার আনুষঙ্গিক মাসায়েল :

ভুলবশত: যে কোনও ওয়াজেব (যেমন রুকূ বা সিজদার তাসবীহ ইত্যাদি মূলেই) ত্যাগ করলে ঐ একই নিয়মে সিজদাহ করতে হবে।

ইমাম সহু সিজদাহ করলে মুক্তাদী ভুল না করলেও তাঁর অনুসরণে তাঁর সাথে সিজদাহ করতে বাধ্য। ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদী ভুল করলে যদি সে প্রথম রাকআত থেকেই ইমামের সাথে থাকে, তাহলে তাকে পৃথকভাবে সিজদাহ করতে হবে না। কারণ, তার এ ভুল ইমাম বহন করে নেবে। অবশ্য মসবূক (জামাআতে পিছিয়ে পড়া মুক্তাদী) হলে, ইমামের সালাম ফিরার পর তার বাকী নামায আদায় করতে উঠলে শেষে ভুল অনুসারে যথানিয়মে সিজদাহ করবে।

কিন্তু যদি ইমাম সালাম ফিরার পর সিজদাহ করেন, তাহলে তাঁর সাথে মসবূকের সহু সিজদাহ করা সম্ভব নয়। কারণ সে সালাম ফিরতে পাবে না। তাই সে উঠে বাকী নামায আদায় করে শেষে যথানিয়মে একাকী সিজদাহ করে নেবে। অবশ্য সে যদি ইমামের ভুলের পর জামাআতে শামিল হয়ে থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে সিজদাহ করতে হবে না।

ইমাম ভুল করে এক রাকআত নামায বেশী পড়লে এক রাকআত ছুটে গেছে এমন মসবূক (পিছে পড়ে যাওয়া) নামাযী সেই রাকআত গণ্য করতে পারে না। সে রাকআত যেহেতু ইমামের বাতিল, সেহেতু তারও বাতিল। তাকে নিয়ম মত উঠে বাকী এক রাকআত কাযা পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০৯)

সতর্কতার বিষয় যে, ভুল করে নামাযের কোন রুক্‌ন ছুটে গেলে নামাযই হয় না। কোন ওয়াজেব ছুটে গেলে সিজদা-এ সাহও দ্বারা পূরণ হয়ে যায় এবং কোন সুন্নত ছুটে গেলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না তথা সহু সিজদারও প্রয়োজন হয় না।


ক্বিরাআত করতে করতে ভুলে গেলে অথবা কাশিতে ধরলে যদি পরিমাণ মত পড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম তখনই রুকূতে চলে যাবেন। অবশ্য ক্বিরাআত ছোট মনে হলে অন্য সূরাও পড়তে পারেন। আটকে যাওয়ার পর সূরা ইখলাস পড়েও রুকূ যেতে পারেন। অবশ্য ক্বিরাআত ভুল পড়লে শেষে ঐ সূরা পড়তে হয় -এ কথা মনে করা ঠিক নয়।


 বিদআতী নামায

কতিপয় বিদআতী নামায
এ কথা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার মূল ভিত্তি হল তওহীদ। আর তা শুদ্ধ হওয়ার মৌলিক শর্ত হল ২টি; ইখলাস ও মুহাম্মাদী তরীকা। সুতরাং যে নামায মুহাম্মাদী তরীকায় নেই, তাতে পূর্ণ ইখলাস থাকলেও তা বিদআত। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীন) ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে যা তার পর্যায়ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৪০নং) “যে ব্যক্তি এমন আমল করে, যাতে আমাদের কোন নির্দেশ  নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম, সহীহ ১৭১৮নং) “আর নবরচিত কর্মসমূহ থেকে দূরে থেকো। কারণ, নবরচিত কর্ম হল বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত১৬৫নং) “আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই হল জাহান্নামে।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১৪৮৭নং)

সাধারণ নফল নামায নিষিদ্ধ সময় ছাড়া যে কোন সময়ে ইচ্ছামত সংখ্যায় পড়া যায়। কিন্তু সেই সাধারণ নামাযকে নিজের তরফ থেকে সময়, সংখ্যা, পদ্ধতি, স্থান, গুণ (ফযীলত) বা কারণ দ্বারা নির্দিষ্ট করলে তা বিদআত বলে পরিগণিত হয়।

যে নামাযের কথা কেবল যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং কোনহাসান বা সহীহহাদীসে তার বর্ণনা নেই, সে নামায বিদআত।


উপরোক্ত পটভূমিকায় নিম্নে এমন কতিপয় নামাযের কথা আলোচনা করব, যা বিদআত। আর তা কেবল জানার জন্যই; যাতে কেউ অজান্তে সেই বিদআত না করে বসে।

মা-বাপের জন্য নামায

প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়ে বসে বসে ২ রাকআত নফল। মা-বাপের উদ্দেশ্যে এমন নামায বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪৫পৃ:)

ঈদের রাতের নামায
উভয় ঈদের রাতে বিশেষ নামায (যইফ জামে ৫৩৫৮, ৫৩৬১) এবং এই রাত্রি জেগে ইবাদত বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৩২পৃ:) ঈদুল ফিতরের রাতের ১০০ রাকআত এবং ঈদুল আযহার রাতের ২ রাকআত নামাযও বিদআত। (ঐ ৩৪৪পৃ:)


যে হাদীসে বলা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও আযহার রাত্রি জাগরণ (ইবাদত) করবে, তার হৃদয় সেদিন মারা যাবে না, যেদিন সমস্ত হৃদয় মারা যাবে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম)  সে হাদীসটি জাল ও মনগড়া হাদীস। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৫২০, যইফ জামে ৫৩৬১নং দ্র:)

কাযা উমরী (উমরী কাযা)
এই পুস্তকের প্রথম অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাযা উমরী বা উমরী কাযা নামাযের অস্তিত্ব শরীয়তে নেই। বিধায় তা বিদআত।


বিদআতীরা বলে, যদি কোন লোকের বহু সময়ের নামায কাযা হয়ে থাকে এবং সে তার সংখ্যা জানে না, তবে সে জুমআর দিন ফরয নামাযের পূর্বে ৪ রাকআত নফল নামায এক সালামে আদায় করবে। এই নামাযে প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসী ৭ বার এবং সূরা কাওসার ১৫ বার পড়বে। এই নামায পড়লে নামাযী ও তার পিতা-মাতার (?) অসংখ্যকাযা নামায নাকি আল্লাহ মাফ করে দিবেন!

স্বালাতুল আওয়াবীন
আওয়াবীনের নামায আসলে চাশতের নামাযের অপর নাম। মহানবী (সাঃ) বলেন, “চাশতের নামায হল আওয়াবীনের নামায।” (জামে ৩৮২৭নং) আর এ হাদীস এ কথারই দলীল যে, মাগরেবের পর উক্ত নামের নামাযটি ভিত্তিহীন ও বিদআত। যেমন এই নামাযের খেয়ালী উপকার বর্ণনায় বলা হয়ে থাকে যে, সৃষ্টিজগৎ ঐ নামাযীর অনুগত হয়ে যায় এবং ১২ বছরের কবুল হওয়া ইবাদতের সওয়াব লিখা হয়।

যে হাদীসে মাগরেব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ের নামাযকে আওয়াবীনের নামায বলা হয়েছে, তা সহীহ নয়; যয়ীফ। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৪৬১৭, যইফ জামে ৫৬৭৬নং)

তিরমিযী ও ইবনে মাজাতে যে ৬ রাকআত নামায মাগরেবের পর পড়লে ১২ বছর ইবাদতের সমান হওয়ার কথা বলা হয়েছে তা সহীহ নয়। বরং তা খুবই দুর্বল হাদীস। (তিরমিযী, সুনান ৬৬, সিযা: ৪৬৯, যইফ জামে ৫৬৬১নং) যেমন ৫০ বছরের গুনাহ মাফ হওয়ার হাদীসও দুর্বল। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৪৬৮, যইফ জামে ৫৬৬৫নং)

তদনুরুপ এই সময়ে ২০ রাকআত নামাযে বেহেশ্তে একটি গৃহ্‌ লাভের হাদীসটিও জাল ও মনগড়া। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৪৬৭, যইফ জামে ৫৬৬২নং)


অবশ্য সাধারণভাবে নফল নামায যেমন নিষিদ্ধ সময় ছাড়া যে কোন সময়ে পড়া যায়, তেমনি মাগরেব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে সাধারণ নফল অনির্দিষ্টভাবে পড়া যায়। মহানবী (সাঃ) এই সময়ে নফল নামায পড়তেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। (জামে ৪৯৬২নং)

এহ্‌তিয়াতী যোহ্‌র

জুমআর নামাযের পর অনেকে যোহরের নিয়তে ৪ রাকআত নামায পড়ে থাকে। যা ভিত্তিহীন, মনগড়া ও বিদআত। (আল-আজবিবাতুন নাফেআহ্‌, আন আসইলাতি লাজনাতি মাসজিদিল জামেআহ্‌, মুহাদ্দিস আলবানী ৭৪পৃ:, মু’জামুল বিদা’ ১২০, ৩২৭পৃ:)

স্বালাতুল হিফয

কুরআন হিফয সহজ হওয়ার উদ্দেশ্যে জুমআর রাতে ৪ রাকআত এই নামায পড়া হয়। এর প্রথম রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইয়াসীন, দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা দুখান, তৃতীয় রাকআতে ফাতিহার পর সূরা সাজদাহ এবং চতুর্থ রাকআতে ফাতিহার পর সূরা মুলক পড়া হয়। আর এর শেষে লম্বা দুআ করা হয়। এ আমলের জন্য যেহাদীস বর্ণনা করা হয় তা জাল ও মনগড়া হাদীস। (তিরমিযী, সুনান ৭১৯, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৩৩৭৪নং) বিধায় তা বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৩৯পৃ:)

মৃতের জন্য ঈসালে সওয়াবের নামায

মৃতব্যক্তির কল্যাণের জন্য সওয়াব পৌঁছবার উদ্দেশ্যে নামায পড়া এবং তার সওয়াব তার নামে বখশে দেওয়া বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪০পৃ:)

মনগড়া প্রাত্যহিক নামায ও তার খেয়ালী সওয়াব
শুক্রবার :

শুক্রবারে যোহ্‌র ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে (?) ২ রাকআত; প্রথম রাকআতে আয়াতুল কুরসী ১ বার ও সূরা ফালাক্ব ২৫ বার এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস ১ বার এবং সূরা ফালাক্ব ২০ বার পড়া।
ফযীলত: মরার পূর্বে স্বপ্নে আল্লাহর ও বেহেশ্তে নিজের জায়গার দর্শন লাভ!
এই দিনে মাগরেব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাকআত নামায।
ফযীলত: বেহেশ্তে মহল লাভ, সমগ্র মুসলিম জাতির তরফ থেকে সদকাহ্‌ দেওয়ার সওয়াব লাভ এবং পাপ নাশ হবে।
এই দিনে চাশতের সময় নির্দিষ্ট সূরার সাথে ৪ অথবা ১০ রাকআত নামায পড়া। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪১পৃ:)
ফযীলত: নবীর সুপারিশে বেহেশ্‌ত লাভ, মা-বাপেরও গুনাহ মাফ!
মহানবী (সাঃ)-কে দেখার উদ্দেশ্যে অনেকে জুমআর রাতে ২ রাকআত নামায পড়ে। প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ২৫ বার, সালামের পর নবীর প্রতি দরুদ ১০০০ বার। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪৩পৃ:)
শনিবার :

শনিবারের যে কোন সময়ে ৪ রাকআত এক সালামে; প্রত্যেক রাকআতে ৩ বার সূরা কাফিরুন এবং নামায শেষে ১ বার আয়াতুল কুরসী।
ফযীলত: ১ বছরের রোযা ও রাতের ইবাদতের এবং শহীদের সওয়াব লাভ, প্রত্যেক হ্‌রফের বদলে এক হজ্জ ও ওমরার সওয়াব লাভ, কিয়ামতে নবী ও শহীদানের সাথে আরশের ছায়া লাভ!!!
শনিবার দিনগত রাতের ২০ রাকআত নামায; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৫০ বার, সুরা ফালাক্ব একবার এবং সূরা নাস একবার। তারপর নানান দুআ ১০০ বার।
ফযীলত: পৃথিবীর সকল মানুষের সংখ্যার সমান (প্রায় ৬০০ কোটি) সওয়াব লাভ, কিয়ামতে নিরাপত্তা লাভ এবং নবীদের সাথে বেহেশ্‌ত প্রবেশ!!!


রবিবার :

রবিবার যে কোন সময়ে ৪ রাকআত ১ সালামে, প্রত্যেক রাকআতে সূরা বাক্বরারা শেষ ২ আয়াত পড়া।
ফযীলত: নাসারাদের নর-নারীর সংখ্যার সমান নেকী লাভ, নবীর সওয়াব লাভ, হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ, প্রত্যেক রাকআতের বদলে ১০০০ নামাযের সওয়াব লাভ এবং প্রত্যেক হ্‌রফের বদলে বেহেশ্তে মিসকের শহর লাভ!!!
রবিবার দিনগত রাত্রে যে কোন সময়ে ৪ রাকআত ১ সালামে, প্রথম রাকআতে সূরা ইখলাস ১০ বার, দ্বিতীয় রাকআতে ২০ বার, তৃতীয় রাকআতে ৩০ বার এবং চতুর্থ রাকআতে ৪০ বার পড়া। নামাযের পর নির্দিষ্ট অযীফা ৭৫ বার করে।
ফযীলত: দোযখী হলেও বেহেশ্‌ত লাভ হবে! সমস্ত জাহেরী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। প্রত্যেক আয়াতের বিনিময়ে হজ্জ ও উমরার সওয়াব লাভ এবং আগামী সোমবারের ভিতরে মরলে শহীদ হবে।
সোমবার :

সোমবার চাশতের সময় ২ রাকআত নামায, প্রত্যেক রাকআতে আয়াতুল কুরসী ১ বার, সূরা ইখলাস ১ বার, সূরা ফালাক্ব ১ বার এবং সূরা নাস ১ বার পড়া।
ফযীলত: সমস্ত গুনাহ মাফ হবে।
এই দিনে আরো ১২ রাকআত নামায।
ফযীলত: কিয়ামতে এক হাজার বেহেশতী যেওর ও তাজ পরানো হবে, ১ লক্ষ ফিরিশ্‌তা এই নামাযীকে নিয়ে যাবে এবং প্রত্যেক ফিরিশ্‌তার অসংখ্য উপহার থাকবে!
সোমবার দিবাগত রাত্রে ১২ রাকআত এবং প্রত্যেক রাকআতে সূরা নাসর ৫ বার করে পড়া।
ফযীলত: বেহেশ্তে ৭ পৃথিবীর সমান বিরাট ঘর তৈরী হবে!


মঙ্গলবার :

মঙ্গলবার দিনে চাশতের সময় অথবা সূর্য ঢলার সঙ্গে সঙ্গে ১০ রাকআত এবং প্রত্যেক রাকআতে আয়াতুল কুরসী ১ বার ও সূরা ইখলাস ৩ বার পড়া।
ফযীলত: ৭০ দিন কোন লিখা হবে না! ৭০ বছরের গুনাহ মাফ। আর ঐ দিনে মরলে সে শহীদ হবে!
মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে ২ রাকআত; প্রথম রাকআতে ১০ বার সূরা ফালাক্ব এবং দ্বিতীয় রাকআতে ১০ বার সূরা নাস পড়া।
ফযীলত: ৭০ হাজার ফিরিশ্‌তা আসমান থেকে নাজেল হয়ে এই নামাযীর জন্য কিয়ামত পর্যন্ত সওয়াব লিখতে থাকবে !!!
বুধবার :

বুধবার দিনে সকালে ১২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে আয়াতুল কুরসী ১ বার, সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা ফালাক্ব ৩ বার এবং সূরা নাস ৩ বার পড়া।
ফযীলত: সমস্ত গুনাহ মাফ, কবরের আযাব, সংকীর্ণতা ও অন্ধকার দূর হবে, নবীদের মত আমল নিয়ে কিয়ামতে উঠবে (?!) এবং কিয়ামতের কষ্ট দূর হবে।
বুধবার মাগরেব ও এশার মাঝে ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে আয়াতুল কুরসী ৫ বার, সূরা ইখলাস ৫ বার, সূরা ফালাক্ব ৫ বার এবং সূরা নাস ৫ বার পড়া।
ফযীলত: মা-বাপের নামে বখশালে মা-বাপের হ্‌ক আদায় হয়ে যাবে; যদিও দুনিয়াতে তারা তার উপর নারাজ ছিল (?!) সিদ্দীক ও শহীদগণের সওয়াব লাভ হবে!
বৃহ্‌স্পতিবার :

বৃহ্‌স্পতিবার দিনে যোহ্‌র ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে (?) ২ রাকআত; প্রথম রাকআতে আয়াতুল কুরসী ১০০ বার এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস ১০০ বার পড়া। সালামের পর দরুদ শরীফ ১০০ বার।
ফযীলত: রজব, শা’বান ও রমযান মাসের রোযাদারদের মত, কা’বা শরীফের হাজীদের মত এবং মুমিনদের সংখ্যা অনুপাতে সওয়াব লাভ হয়!
বৃহ্‌স্পতিবার মাগরেব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১০ বার পড়া।

ফযীলত: ১২ বছরের দিনের রোযার এবং রাতের ইবাদত করার সওয়াব লাভ হয়!

মনগড়া মাসিক নামায ও তার খেয়ালী সওয়াব
মহ্‌ররম মাসের খেয়ালী নামায :

মহ্‌রম মাসের প্রথম তারীখের রাতে ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১১ বার।

এই রাতে আরো ৬ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১০ বার। এতে বেহেশ্তে ২০০০ মহল লাভ হবে; প্রত্যেক মহলে ইয়াকূতের ১০০০ দরজা এবং প্রত্যেক দরজায় সবুজ রঙের তখতার উপর হুর বসে থাকবে। ৬০০০ বালা দূর হবে এবং ৬০০০ সওয়াব লাভ হবে!

এই তারীখে দিনে ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৩ বার। এতে দু জন ফিরিশ্‌তা বডিগাডG পাওয়া যায় এবং সারা বছর শয়তান থেকে নিরাপত্তা লাভ।

আশুরার রাতে ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৩ বার। এতে কিয়ামত পর্যন্ত রেশন থাকবে।

এই রাতে আরো ৪ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৫০ বার। এতে ৫০ বছরের আগের ও পরের গুনাহ মাফ হয়!

আশুরার দিনে ৪ রাকআত নামায; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৫০ বার। এতে ৫০ বছরের আগের ও পরের গুনাহ মাফ হয়! বেহেশ্তে ১০০০ নূরের মহল তৈরী হয়। এই দিনে রয়েছে আরো ৪ রাকআত খেয়ালী নামায।

অথবা যোহ্‌র ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসী ১০ বার, সূরা ইখলাস ১১ বার এবং নাস ও ফালাক্ব ৫ বার। নামায শেষে ইস্তিগফার ৭০ বার। এ নামাযও বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪০-৩৪১পৃ:)

এই মাসের ১ থেকে ১০ তারীখ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন যোহরের পর ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১৫ বার। এ নামায হযরতহাসান-হোসেনের রুহের উপর বখশে দিলে কিয়ামতে তাঁদের সুপারিশ (!) লাভ হবে।



সফর মাসের খেয়ালী নামায :

প্রথম তারীখের রাতে এশার পর ৪ রাকআত; প্রথম রাকআতে সূরা কাফিরুন ১৫ বার। দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস ১৫ বার। তৃতীয় রাকআতে সূরা ফালাক্ব ১৫ বার এবং চতুর্থ রাকআতে সূরা নাস ১৫ বার। এতে সমস্ত বালা থেকে রেহাই পাওয়া যায় এবং খুব বেশী সওয়াব লাভ হয়।

এই মাসের শেষ বুধবার বা আখেরী চাহার শোম্বার চাশতের সময় ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১১ বার।

এ মাসের ১ম স প্তা হের জুমআর রাতে এশার পরে ৪ রাকআত নফল এবং তার খেয়ালী সওয়াবের কথার উল্লেখ রয়েছে অনেক কিতাবে।



রবিউল আওয়াল মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের প্রথম হতে ১২ তারীখ পর্যন্ত প্রত্যেক দিন ২০ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ২১ বার। এই নামায নবী (সাঃ)-এর নামে বখশে দিলে তিনি নামাযীকে বেহেশ্তের সুসংবাদ দেবেন!

অনেকের মতে এ মাসে নিয়মিত দরুদ পড়লে ধনী হওয়া যায়।



রবিউস-সানী মাসের বিদআতী নামায :

এই মাসের ১, ১৫ ও ২৯ তারীখে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ৫ বার। এতে ১০০০ সওয়াব লাভ, ১০০০ পাপ মাফ এবং ৪টি হুর লাভ হবে।

অনেকের খেয়াল মতে এ মাসের ১৫ তারীখে মাগরেবের পর ৪ রাকআত নামায পড়লে উভয়কালে কামিয়াবী লাভ হয়। এ মাসের শেষ রাতে ৪ রাকআত নামায পড়লে কবরের আযাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।



জুমাদাল আওয়াল মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের প্রথম তারীখের রাতে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১১ বার। এতে ৯০,০০০ বছরের নেকী লাভ হবে এবং ৯০,০০০ বছরের গুনাহ মোচন হয়ে যাবে!

কারো খেয়াল মতে এ মাসের প্রথম তারীখে ২০ রাকআত নামায পড়তে হয়।



জুমাদাস সানী মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের প্রথম তারীখের রাতে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১৩ বার। এতে ১ লাখ নেকী লাভ হবে এবং ১ লাখ গুনাহ মোচন হবে!

এ রাতে ১২ রাকআত নামাযের কথাও বর্ণনা করা হয়ে থাকে।



রজব মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসে ১, ১৫, ও শেষ তারীখে গোসল করলে (গঙ্গাজলে স্নান করার মত) প্রথম দিনকার শিশুর মত নিষ্পাপ হওয়া যায়! এই মাসে ৩০ রাকআত নামায এবং তার ৫টি রাত ইবাদত করার খেয়ালী ফযীলত বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

কারো মতে এ মাসের ১৫ তারীখে এশার পরে ৭০ রাকআত নামায পড়লে পৃথিবীর বৃক্ষরাজি পরিমাণ সওয়াব লাভ হয়। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪১পৃ: দ্র:)



স্বালাতুর রাগায়েব :

এই মাসে জুমআর রাতে এশার পরে ১২ রাকআত নামায পড়া হয়ে থাকে। ৬ সালামে প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ক্বাদর ৩ বার এবং সূরা ইখলাস ১২ বার পড়তে হয়। নামায শেষে ৭০ বার দরুদ শরীফ এবং আরো অন্যান্য দুআ ও সিজদাহ। এ সবই বিদআত। (বিশেষ দ্র: তাবয়ীনুল আজাব, বিমা অরাদা ফী ফাযলি রাজাব, মাজমূউফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ ২/২, মু’জামুল বিদা’ ৩৩৮-৩৩৯, ৩৪২পৃ:)



শবেমি’রাজের নামায :

এই মাসের ২৭ তারীখে এশা ও বিতরের মাঝে ৬ সালামে ১২ রাকআত নামায। আর নামাযের পর ১০০ বার কলেমায়ে তামজীদ (?) এবং নির্দিষ্ট দুআ পাঠ। এই দিন দান করতে হয়। ঐ দিনের রোযা এবং ঐ রাতের ইবাদত ১০০ বছর রোযা এবং ১০০ রাত ইবাদত করার সমান! (মু’জামুল বিদা’ ৩৪১ ও ৩৪৫পৃ:)



শা’বান মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের ১ তারীখের রাতে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ১৫ বার। এতে বেশুমার সওয়াব লাভ হয়।

এই মাসে যে কোন রাতে ১ সালামে ৮ রাকআত নামায পড়ে হযরত ফাতেমার নামে বখশে দিলে তিনি ঐ নামাযীর জন্য শাফাআত না করে বেহেশ্তে এক পা-ও দিবেন না!



শবেবরাতের নামায :

শবেবরাত আসলে শবেকদরের ভ্রান্ত রুপ। শবেকদরের আসল ছেড়ে শবেবরাতের নকল ইবাদত নিয়ে মাতামাতি করে ভাল বরাত বা ভাগ্য লাভের জন্য লোকে ১০০ রাকআত নামায পড়ে থাকে। আর প্রত্যেক রাকআতে ১০ বার সূরা ইখলাস পড়ে থাকে। এ নামাযও মনগড়া বিদআত। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪১-৩৪২পৃ:) শবেবরাতের নামায পড়লে নাকি ২০টি হজ্জের এবং ২০ বছর একটানা ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়! আর ১৫ তারীখে রোযা রাখলে নাকি অগ্র-পশ্চাৎ ২ বছর রোযা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।

এ রাতে নামায আদায়ের পূর্বে নাকি গোসলও করতে হয়। আর সে গোসলের সওয়াবও রয়েছে নাকি খেয়ালী; এ গোসলের প্রতি ফোঁটার পানির বিনিময়ে ৭০০ রাকআত নফল নামায আদায়ের সওয়াব আমল-নামায় লিখা হয়ে থাকে!!!

এ রাতে বালা দূর করা, আয়ু বৃদ্ধি করা এবং অভাবমুক্ত হওয়ার নিয়তে ৬ রাকআত নামায পড়া হয়। পড়া হয় সূরা ইয়াসীন সহ্‌ আরো মনগড়া দুআ। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪২পৃ:) ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় দীপাবলী। বানানো হয় নানা রকম খাবার। আর এ সবের পশ্চাতে এক একটি মাহাত্ম বর্ণনা করা হয়।

এ ছাড়া আরো কত শত খেয়ালী ইবাদত ও সওয়াবের কথা পাওয়া যায় একাধিক বাজারী বই-পুস্তকে; যার সবগুলোই বিদআত এবং সে সবের একটিও সহীহ দলীল নেই।



রমযান মাসের খেয়ালী শবেকদরের নামায :

শবেকদরের সারা রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করতে হয়, নামায পড়তে হয়। কিন্তু কেবল ২৭ তারীখের রাতে তারাবীহ্‌র পর খাস শবেকদরের নামায পড়ে বিদআতীরা। তাতে তারা প্রত্যেক রাকআতে সূরা ক্বাদর এত এত বার এবং সূরা ইখলাস এত এত বার পড়ে থাকে। যার কোন দলীল ও ভিত্তি নেই। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪৫পৃ:)



শওয়াল মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের ১ তারীখের রাতে অথবা ঈদের নামাযের পর ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ২১ বার। এতে বেহেশ্তের ৮টি দরজা খোলা এবং দোযখের ৭টি দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মরার পূর্বে বেহেশ্তে নিজের স্থান দেখা যায়।

এ ছাড়া দিনে অথবা রাতে আরো ৮ রাকআত নামাযের কথা বলা হয়।



যুলক্বা’দাহ্‌ মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের ১ তারীখের রাতে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ২৩ বার। এতে বেহেশ্তে ৪০০০ লাল ইয়াকূতের ঘর তৈরী হয়! প্রত্যেক ঘরে জওহারের সিংহাসন থাকবে!! প্রত্যেক সিংহাসনে হুর বসা থাকবে; তাদের কপাল সূর্য অপেক্ষা বেশী উজ্জ্বল হবে!!!

এ ছাড়া এই মাসের প্রত্যেক রাতে ২ রাকআত নামায পড়লে ১ জন শহীদ ও ১ হজ্জের সওয়াব লাভ হবে! আর এই মাসের প্রত্যেক শুক্রবার ৪ রাকআত নামায পড়লে ১টি হজ্জ ও ১টি উমরার সওয়াব হবে!!



যুলহজ্জ মাসের খেয়ালী নামায :

এই মাসের ১ তারীখের রাতে ৪ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা ইখলাস ২৫ বার। এতে বেশুমার সওয়াব লাভ হয়।

এ মাসের প্রথম ১০ দিনের বিতরের নামাযের পর ২ রাকআত; প্রত্যেক রাকআতে সূরা কাওসার ৩ বার এবং সূরা ইখলাস ৩ বার পড়লে ‘মাকামে ইল্লীন’ (?) লাভ হবে, প্রত্যেক কেশের বদলে ১০০০ নেকী এবং ১০০০ দ্বীনার সদকা করার সওয়াব লাভ হবে!


এ ছাড়া আরো কত মনগড়া নামাযের কথা রয়েছে অনেক বই-পুস্তকে। আসলে সওয়াব তাদের নিজের পকেট থেকে বলেই এত এত সওয়াব অর্জনের ব্যাপারে আশ্চর্য ও অবাক হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রাত্যহিক ও মাসিক ঐ শ্রেণীর নির্দিষ্ট নামায যে বিদআত, সে প্রসঙ্গে উলামাদের স্পষ্ট উক্তি রয়েছে। (মু’জামুল বিদা’ ৩৪২পৃ: দ্র:)





লেখক: শায়খ আব্দুল হামীদ আল ফাইযী আল-মাদানী
লিসান্স: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদিআরব
(সৌদী আরবের আল-মাজমাআ অঞ্চলের দাওয়াত সেন্টারে কর্মরত দাওয়াত-কর্মী এবং বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক ও অনুবাদক।)



বইটি ডাউনলোড করুন (পিডিএফ ভার্সন - ২.৫৪ মেগাবাইট)



“সালাত” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন