ভূমিকা
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ
وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ
أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ
مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ
إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا
عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার
জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা
করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের খারাপ পরিণতি
থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নাই। আর
যাকে গোমরাহ করেন তাকে হেদায়েত দেয়ারও কেউ নাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া
কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নাই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক
তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা কিয়ামত অবধি এহসানের সাথে
তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।
অতঃপর,
প্রতিবেশীর হক বা অধিকার সম্পর্কে সজাগ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ইসলাম প্রতিবেশীর
হককে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে প্রতিবেশীর
হক ও অধিকার সম্পর্কে বে-খবর। প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতার উপলব্ধি থেকে
মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন ও সজাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। তাই প্রতিবেশীর হক, প্রতিবেশী কারা, প্রতিবেশীদের বিষয়ে ইসলাম কি
বলে, ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আশা
করি প্রবন্ধটি পড়ে একজন পাঠক উপকৃত হবেন এবং প্রতিবেশীর হক ও অধিকার সম্পর্কে জানতে
পারবেন।
সংকলক
জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
প্রতিবেশী কে?
প্রতিবেশী শব্দটি একটি ব্যাপক শব্দ। প্রতিবেশী
বলতে মুসলিম, কাফের, নেক বান্দা, ফাসেক, বন্ধু, শত্রু, পরদেশী, স্বদেশী, উপকারী, ক্ষতি সাধনকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, নিকটতম বা তুলনামূলক একটু দূরের প্রতিবেশী সবাই অন্তর্ভুক্ত।
অনেকেই মনে করে প্রতিবেশী বলতে শুধু ঘরের পাশের প্রতিবেশী বুঝানো হয়ে থাকে। বিষয়টি
এমন নয়, যে শুধুমাত্র ঘরের পাশের প্রতিবেশীকেই প্রতিবেশী বলা হবে আর কাউকে নয়। বরং
প্রতিবেশী বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন-
কর্মক্ষেত্রে এক সাথে
কাজ করলে সে আমার একজন প্রতিবেশী, ছাত্র জীবনে যাদের সাথে পড়া লেখা উঠাবসা করি সেও
আমার প্রতিবেশী, আমার জমিনের সাথে যদি কারোও জমি থাকে সে আমার জমিনের প্রতিবেশী,
পাশের দোকানদার সে আমার দোকানের প্রতিবেশী, এক সাথে বাজারে গেলে সে আমার বাজারের প্রতিবেশী,
এমনকি যদি আমি কোনো গাড়ি বা বিমানে একজন ভাইয়ের সাথে একসাথে বসি সেও আমার কিছু
সময়ের জন্য একজন প্রতিবেশী। এ বিষয়ে রয়েছে হাদিসে ব্যাপক দিক নির্দেশনা। যেমন,
جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ،
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْجِيرَانُ
ثَلَاثَةٌ، جَارٌ لَهُ حَقٌ وَاحِدٌ، وَهُوَ أَدْنَى الجيران حقاً. جار لَهُ
حَقَّانِ، وَجَارٌ لَهُ ثَلَاثَةُ حُقُوقٍ وَهُوَ أفضل الجيران حقاً، فأما الجار
الَّذِي لَهُ حَقٌّ وَاحِدٌ فَجَارٌ مُشْرِكٌ لَا رحم له، له حق الجوار، وأما
الجار الَّذِي لَهُ حَقَّانِ فَجَارٌ مُسْلِمٌ لَهُ حَقُّ الْإِسْلَامِ، وَحَقُّ
الْجِوَارِ، وَأَمَّا الَّذِي لَهُ ثَلَاثَةُ حُقُوقٍ فَجَارٌ مُسْلِمٌ ذُو رَحِمٍ
لَهُ حَقُّ الجوار، وحق الإسلام، وحق الرحم» .
“জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ হতে
বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “প্রতিবেশী সাধারণত তিন শ্রেণীর
হয়ে থাকে। ১. যার এক দিক থেকে হক। সে হকের দিক দিয়ে সর্ব
কনিষ্ঠ। ২. যার দুই দিক থেকে হক হয়ে থাকে। ৩. যার
তিন দিক থেকে হক হয়ে থাকে, এ হল, সর্বোত্তম প্রতিবেশী। যার এক দিক থেকে হক সে হল, অনাত্মীয় বিধর্মী প্রতিবেশী। এ ব্যক্তির হক শুধু প্রতিবেশী হওয়ার
ভিত্তিতে আত্মীয়তার ভিত্তিতে নয়। আর যার হক
দুই দিক দিয়ে, সে হল, মুসলিম
প্রতিবেশী, যার সাথে আত্মীয়তার কোনও সম্পর্ক নেই। এ ব্যক্তির
হক প্রতিবেশী এবং মুসলিম হওয়ার দিক থেকে। আর যার হক তিন দিক থেকে, সে হল, মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী
হিসেবে, মুসলিম হিসেবে এবং ও আত্মীয় হওয়ার দিক থেকে”।[1]
সাধারণত পাশের ঘরের লোককে প্রতিবেশী বলা হয়ে থাকে। তবে পাশের ঘর বলতে কি
বুঝায় এ বিষয়ে বিভিন্ন আলেমদের মধ্যে একাধিক ব্যাখ্যা পরিলক্ষিত। আলী রাদিয়াল্লাহু
আনহু বলেন, যে তোমার আওয়াজ শুনতে পায়, সে তোমার প্রতিবেশী। আবার কেউ কেউ বলেন,
যে তোমার সাথে এক মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করে সে তোমার প্রতিবেশী। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু
আনহা প্রতিবেশীর ব্যাখ্যায় বলেন, “তোমার ঘরের চার পাশের ৪০টি ঘরের অধিবাসীরা তোমার
প্রতিবেশী”।[2]
ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. মতে প্রতিবেশী হল, তোমার ঘরের চার
পাশ থেকে চল্লিশটি ঘরের অধিবাসী।
আবার কেউ কেউ বলেন, প্রতিবেশীর নির্ধারিত কোনো সংজ্ঞা
নাই। বিষয়টি সামাজিক ও পারিভাষিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। সমাজ যাদের প্রতিবেশী
বলে তারাই প্রতিবেশী এবং পরিভাষায় যাদের প্রতিবেশী বলে তারাই প্রতিবেশী।
তবে প্রত্যেক শ্রেণীই যেহেতু প্রতিবেশী তাই প্রত্যেকের হকের প্রতি যত্নবান
হওয়া তাদের গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি।
পবিত্র কুরআনে প্রতিবেশীর হক
প্রতিবেশীরা
মানবসমাজের
একটি
অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ।
ফলে
ইসলামে
প্রতিবেশীর
হককে
অনেক
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর
ইবাদত ও তার সাথে কাউকে শরিক না করা-এই বিধানের সাথে প্রতিবেশীর
বিষয়টিও আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। একই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের হক বিষয়ে আলোচনা করেছেন তার মধ্যে
রয়েছে মাতা-পিতার হক, আত্মীয় স্বজনের হক, এতীমের
হক ইত্যাদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সাথে প্রতিবেশীর হককে উল্লেখ করা থেকেই বোঝা যায়, প্রতিবেশীর হককে আল্লাহ তা‘আলা কতটা গুরুত্ব
দিয়েছেন এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য কতটা জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۗ ٣٦ ﴾ [النساء : ٣٦]
“এবং পিতা-মাতার
প্রতি ইহসান, আত্মীয়-স্বজন, এতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও
তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার কর”।[3]
হাদিসে প্রতিবেশীর হক বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান
এক- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি
ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ
رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَا
زَالَ جِبْرِيلُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى
ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ - أَوْ قَالَ: خَشِيتُ أَنْ يُوَرِّثَهُ - »
“জিবরীল আলাইহিস
সালাম আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাসের অংশীদার বানিয়ে
দেওয়া হবে”।[4]
হাদিসে প্রতিবেশীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু
আজকাল
এ বিষয়ে
আমাদের
মাঝে
চরম
অবহেলা
পরিলক্ষিত
হয়।
বিশেষ
করে
শহরের
মানুষের
মাঝে।
বছরের
পর
বছর
পার
হয়
পাশের
বাড়ির
কারো
সাথে
কোনও
কথা
হয়
না,
খোঁজ
খবর
নেওয়া
হয়
না, একজন লোক মারা গেলে পাশের ফ্লাটের লোকের কোনো খবর নাই।
বরং
বিভিন্নভাবে
প্রতিবেশীকে
কষ্ট
দেওয়া
হয়।
অথচ
প্রতিবেশীর
সাথে
সদাচরণ
ও তাকে
কষ্ট
না
দেওয়াকে
ঈমানের
সাথে
যুক্ত
করা
হয়েছে।
দুই- প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে আল্লাহর রাসূল নিষেধ করেন
এবং তার সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। হাদিস-
وعن أبي شريح ـ رضي الله
تعالي عنه ـ قال: قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: «من
كان يؤمن بالله واليوم الآخر فلايؤذ جاره »
আবু শুরাই রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু
আলাইহি
ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
“যে আল্লাহ
ও আখিরাতের
প্রতি
ঈমান
রাখে, সে
যেন
প্রতিবেশীকে
কষ্ট
না
দেয়”।[5]
তিন. আরেক
হাদিসে
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু
আলাইহি
ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
«فليحسن إلى
جاره»
“সে যেন প্রতিবেশীর
সাথে
সদাচরণ
করে”।[6]
চার- প্রতিবেশীরা হকের ক্ষেত্রে সবাই সমান নয়। যারা সম্পর্কের
দিক দিয়ে যত বেশি নিকটে তাদের অধিকার বা হক বেশি। আর যদি প্রতিবেশী সম্পর্কের দিক দিয়ে
সমান হয় এবং একজন কাছে এবং অপর জন দূরে হয় তবে কাছের প্রতিবেশীর অধিকার বা হক বেশি
দূরের প্রতিবেশীর তুলনা। এ বিষয়ে হাদিস-
روى الإمام أحمد عَنْ
عَائِشَةَ: أَنَّهَا سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
فَقَالَتْ: إِنَّ لِي جَارَيْنِ فَإِلَى أَيِّهِمَا أُهْدِي؟ قَالَ: «إِلَى
أَقْرَبِهِمَا مِنْكَ بَابًا» وَرَوَاهُ الْبُخَارِيُّ مِنْ
حَدِيثِ شُعْبَةَ بِهِ.
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার দুই জন প্রতিবেশী আছে, তাদের কাকে আমি হাদিয়া দেব? রাসূল বললেন, যে তোমার দরজার কাছের প্রতিবেশী তাকে তুমি হাদিয়া দেবে”।[7]
পাঁচ- তোমাদের মধ্যে সে উত্তম প্রতিবেশী বা সে উত্তম সাথী যে তার প্রতিবেশী
ও সাথীদের নিকট উত্তম। যেমন হাদিস-
عَنْ
عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: «خَيْرُ الْأَصْحَابِ
عِنْدَ اللَّهِ خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهِ وخير الجيران عند الله خيرهم لجاره»
(رواه أحمد والترمذي)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে স্বীয় সাথীর নিকট
উত্তম সেই আল্লাহর নিকট সর্ব উত্তম সাথী এবং যে স্বীয় প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো
প্রতিবেশী, সেই আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম প্রতিবেশী”।[8]
ছয়- অপর এক বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ
عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَجُلٌ لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله
عليه وسلم كَيْفَ لِي أَنْ أَعْلَمَ إِذَا أَحْسَنْتُ وَإِذَا أَسَأْتُ فَقَالَ
النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم «إِذَا
سَمِعْتَ جِيرَانَكَ يَقُولُونَ قَدْ أَحْسَنْتَ فَقَدْ أَحْسَنْتَ وَإِذَا
سَمِعْتَهُمْ يَقُولُونَ قَدْ أَسَأْتَ فَقَدْ أَسَأْتَ ،»
“আবদুল্লাহ
ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি ভালো করলাম না খারাপ করলাম এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে
আমার নিজের সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারব? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন, “যখন শোন, তোমার প্রতিবেশী তোমাকে বলে, তুমি ভালো করছ, তাহলে
তুমি ভালো করছ, আর যখন শোন, তোমার প্রতিবেশী বলে, তুমি খারাপ করছ, তাহলে তুমি
খারাপ করছ”।[9]
সাত- প্রতিবেশী কষ্ট না
দেওয়া এবং তাদের সাতে ভালো ব্যবহার করা ঈমানের সাথে সম্পর্ক। এ বিষয়ে হাদিস-
عن
أبي هريرة رضى الله عنه قال:
قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: «من كان يؤمن بالله واليوم
الآخر فلا يؤذ جاره، ومن كان يؤمن بالله واليوم الأخر فليكرم ضيفه، ومن كان يؤمن
بالله واليوم الآخر فليقل خيرًا أو ليصمت »
“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে,
সে যেন প্রতিবেশীকে
কষ্ট
না
দেয়। যে আল্লাহ ও আখিরাতের
প্রতি
ঈমান
রাখে, সে
যেন
মেহমানের সম্মান করে, যে
আল্লাহ
ও আখিরাতের
প্রতি
ঈমান
রাখে, সে
যেন
ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে”।
আট- অপর একটি হাদিসে এসেছে-
وقال صلى الله عليه و سلم: «والله لا يؤمن، والله لا يؤمن، والله لا يؤمن» ، قيل: يا رسول الله! خاب وخسر، من
هذا؟ قال صلى الله عليه و سلم :
«من لا يأمن جاره بوائقه
» ،
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে
মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবীরা
জিজ্ঞেস করলেন, কে
সেই বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত লোক হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে
তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়”।[10]
হাদিসে প্রতিবেশীর হকের অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে যাতে কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া না হয় এবং তার যাতে কোনো ক্ষতি করা না হয় সে ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
হাদিসে প্রতিবেশীর হকের অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে যাতে কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া না হয় এবং তার যাতে কোনো ক্ষতি করা না হয় সে ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
নয়- দশগুণ বেশি গুনাহ; প্রতিবেশীর হক আদায় করা যেমন জরুরি
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া বা তার হক নষ্ট করা তেমনি মস্ত বড় গুনাহ। একই অন্যায় প্রতিবেশীর
ক্ষেত্রে করলে অন্যের তুলনায় দশ গুণ বেশি গুনাহ বা বড় অন্যায় বলে গণ্য হয়।
فقد ثبت عنه صلى الله عليه وسلم أنه قال: «ما تقولون في الزنا؟» قالوا: حرام، حرمه الله
ورسوله، قال: «لأن يزني الرجل بعشر نسوة أيسر من أن
يزني بامرأة جاره، ما تقولون في السرقة؟» قالوا:
حرام، حرمها الله ورسوله، قال: «لأن يسرق الرجل من
عشرة أبيات أيسر من أن يسرق من بيت جاره، ومن أغلق بابه من جاره مخافة على أهله أو
ماله فليس الجار بمؤمن».
“মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার
সাহাবীগণকে যিনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, তাতো হারাম।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তা হারাম ঘোষণা করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, কোনও ব্যক্তি দশজন নারীর সাথে যিনা করলে যে গুনাহ প্রতিবেশীর
স্ত্রীর সাথে যিনা করা তার চেয়েও বেশি ও মারাত্মক গুনাহ। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে চুরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল,
তাতো হারাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তা হারাম ঘোষণা করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দশ বাড়িতে চুরি করা যত বড় অন্যায়
প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করা এর চেয়েও বড় অন্যায়”।[11]
দশ- দুই নারীর দৃষ্টান্ত; কে জান্নাতি?
প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ, ব্যক্তির সব আমল বরবাদ করে দেয়। তাকে নিয়ে ফেলে
জাহান্নামে। যেমনটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ،
قَالَ: قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ فُلَانَةَ يُذْكَرُ مِنْ كَثْرَةِ
صَلَاتِهَا، وَصِيَامِهَا، وَصَدَقَتِهَا، غَيْرَ أَنَّهَا تُؤْذِي جِيرَانَهَا
بِلِسَانِهَا، قَالَ: «هِيَ
فِي النَّارِ» ، قَالَ: يَا رَسُولَ
اللهِ، فَإِنَّ فُلَانَةَ يُذْكَرُ مِنْ قِلَّةِ صِيَامِهَا، وَصَدَقَتِهَا،
وَصَلَاتِهَا، وَإِنَّهَا تَصَدَّقُ بِالْأَثْوَارِ مِنَ الْأَقِطِ، وَلَا تُؤْذِي
جِيرَانَهَا بِلِسَانِهَا، قَالَ: «هِيَ فِي الْجَنَّةِ »
“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি
এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, এক নারীর
ব্যাপারে প্রসিদ্ধ, সে বেশি বেশি (নফল) নামায পড়ে, রোযা রাখে, দুই
হাতে দান করে। কিন্তু জবানের দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় (তার
অবস্থা কি হবে?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, “সে জাহান্নামে যাবে”। আরেক নারী বেশি
(নফল) নামাযও পড়ে না, খুব বেশি
রোযাও রাখে না আবার তেমন দান সদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে জবানের দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়
না (এই নারীর ব্যাপারে কি বলেন?)। নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে জান্নাতি”।[12]
عن أبي هريرة ـ رضي الله تعالي عنه ـ قال: قال رسول الله
صلي الله عليه وسلم: «والله لايؤمن والله لايؤمن والله
لايؤمن، قيل من يارسول الله؟ قال: الذي لايأمن جاره بوائقه »
“আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, “আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর
শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!!
সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, কে সেই বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত লোক হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়”।[13]
প্রতিবেশীর হক কি?
প্রতিবেশীর হক কি তা আমাদের জানা থাকা খুবই জরুরি। হক জানা থাকলে, তা আমরা
কিভাবে বাস্তবায়ন করব? নিম্নে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিবেশীর হকগুলো
আলোচনা করব।
এক- প্রতিবেশীর কষ্ট দূর করা:
এটি প্রতিবেশীর হকসমূহের অন্যতম। সাধারণত কাউকে কষ্ট দেওয়া এমনিতেই হারাম।
কিন্তু কোনো প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া এটি আরও জঘন্যতম অপরাধ ও বেশি হারাম। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে আরও বেশি
সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ
করেছেন। যেমন, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«والله لا يؤمن، والله لا يؤمن، والله
لا يؤمن». قيل: مَنْ يا رسول الله؟ قال: «
مَن لا يأمن جاره بوائقه
».
““আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর
শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!!
সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, কে সেই লোক হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে
তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়”।[14]
অনুরূপভাবে মহিলার হাদিস, যে সালাত আদায় করে, রোযা রাখে, কিন্তু তার মুখ খুব ধারালো। সে তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেন,
অনুরূপভাবে মহিলার হাদিস, যে সালাত আদায় করে, রোযা রাখে, কিন্তু তার মুখ খুব ধারালো। সে তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেন,
«لا خير فيها، هي في النار»
“তার মধ্যে
কোনো কল্যাণ নাই। সে জাহান্নামী”।[15]
দুই- প্রতিবেশীর কষ্ট সহ্য করা:
এটি একটি উন্নত চরিত্র ও বড় মাপের আখলাক। কারণ, কাউকে
কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকার মানুষ অনেক পাওয়া যাবে। তবে অপরের নির্যাতন বা কারো
কষ্ট সহ্য করার মত মানসিকতার মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। এ জন্য এটি একটি উন্নত গুণ
এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
﴿ٱدۡفَعۡ بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ ٱلسَّيِّئَةَۚ
نَحۡنُ أَعۡلَمُ بِمَا يَصِفُونَ ٩٦ ﴾ [المؤمنون : ٩٦]
“যা উত্তম তা দিয়ে মন্দ প্রতিহত কর; তারা
যা বলে আমি তা সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী”।[16]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿وَلَمَن صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَٰلِكَ لَمِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ٤٣ ﴾ [الشورى: ٤٣]
“আর যে ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমা করে, তা নিশ্চয়
দৃঢ়সংকল্পেরই কাজ”।[17]
হাসান বসরী রহ. বলেন,
ليس حُسْنُ الجوار كفّ الأذى، حسن
الجوار الصبر على الأذى
প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার তাকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত
থাকা নয়, তার কষ্ট সহ্য করাই হল তার সাথে ভালো ব্যবহার।
وفي مسند الإمام أحمد رحمه الله عن أبي
ذر رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «إن الله عز وجل يحب ثلاثة، ويبغض ثلاثة»، وذكر
في الثلاثة الذين يحبهم: «رجل كان له جار سوء
يؤذيه فيصبر على أذاه حتى يكفيه الله إياه بحياة أو موت».
মুসনাদে আহমদে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা
তিন ব্যক্তিকে ভালোবাসেন এবং তিন ব্যক্তিকে অপছন্দ করেন। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি
সে যার একজন মন্দ প্রতিবেশী ছিল যে তাকে সব সময় কষ্ট দিত এবং তার কষ্টের উপর লোকটি
ধৈর্য ধরছিল যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে জীবন
মৃত্যুর ফায়সালা না করেন”।[18]
আবু হানিফা রহ.-এর একটি ঘটনা:
ইমাম আবু হানিফা রহ. সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত, তার
একজন প্রতিবেশী ছিল, যে তাকে প্রতিদিন তার চলার পথে কষ্ট দিত। ইমাম আবু হানিফা রহ.
প্রতিদিন কষ্টদায়ক বস্তু পথ থেকে দূর করত এবং তার কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করত।
একদিন তিনি ঘর থেকে বের হলেন, কিন্তু নির্ধারিত কোনো কষ্টদায়ক বস্তু পথের মধ্যে
দেখতে পেলেন না। তিনি লোক জনের নিকট তার প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নিলেন। তখন সবাই তাকে
জানালো যে লোকটি একটি ঘটনা ঘটিয়েছে, যার কারণে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে জেল খানায়
প্রেরণ করেছে। এ কথা শোনে আবু হানিফা রহ. থানায় গিয়ে সুপারিশ করে, তাকে জেল খানা
থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। কিন্তু লোকটি জানতো না যে, কে তার জন্য সুপারিশ করল?। জেল
খানা থেকে বের হয়ে সে মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করল, কে আমার জন্য সুপারিশ করল। মানুষ
তাকে বলল, তোমার প্রতিবেশী তোমার জন্য থানায় গিয়ে সুপারিশ করেছে। লোকটি বলল, কোন প্রতিবেশী?
সবাই বলল, আবু হানিফা। তারপর সে তাকে কষ্ট দেয়ার কারণে লজ্জিত হল এবং কষ্ট দেওয়া হতে
বিরত থাকল।
একজন মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা:
প্রতিবেশীর সাথে মানুষের সম্পর্ক সামান্য সময়ের নয়; বরং
সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন, মাস ও বছরের বা সারা জীবনের। এ প্রতিবেশী যদি মন্দ হয় তাহলে ভোগান্তির
আর শেষ থাকে না। তেমনি এক মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
عن أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ جَاءَ رَجُلٌ
إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم يَشْكُو جَارَهُ فَقَالَ اذْهَبْ فَاصْبِرْ
فَأَتَاهُ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلَاثًا فَقَالَ اذْهَبْ فَاطْرَحْ مَتَاعَكَ فِي
الطَّرِيقِ فَطَرَحَ مَتَاعَهُ فِي الطَّرِيقِ فَجَعَلَ النَّاسُ يَسْأَلُونَهُ
فَيُخْبِرُهُمْ خَبَرَهُ فَجَعَلَ النَّاسُ يَلْعَنُونَهُ فَعَلَ اللَّهُ بِهِ
وَفَعَلَ وَفَعَلَ فَجَاءَ إِلَيْهِ جَارُهُ فَقَالَ لَهُ ارْجِعْ لَا تَرَى
مِنِّي شَيْئًا تَكْرَهُهُ
“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ
করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি
যাও, ছবর কর। এভাবে সে দুই বার অথবা তিনবার আসার পর পরের বারে নবীজী তাকে বললেন, তোমার বাড়ির আসবাবপত্র রাস্তায় নিয়ে রাখ। সাহাবী তাই করলেন। মানুষ
সেখান দিয়ে যাচ্ছিল এবং এর কারণ জিজ্ঞেস করছিল আর লোকটি প্রতিবেশীর অত্যাচারের
ঘটনা তাদেরকে জানাচ্ছিল। লোকেরা ঐ লোকটিকে অভিশাপ দিচ্ছিল, আর বলছিল আল্লাহ তার
সাথে এমন এমন করুন, কারণ সে এমন এমন কাজ করেছে। এটা দেখে ঐ লোকের প্রতিবেশী লোকটির
কাছে এসে বলল, আমি আর এমনটি করব না (প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না।)।”।[19]
তিন- প্রতিবেশীর দোষ ঢেকে রাখা ও ইজ্জত
সম্মান বজায় রাখা:
পাশাপাশি থাকার কারণে একে অপরের ভালো মন্দ কিছু জানাজানি হয়ই। গোপন করতে চাইলেও অনেক কিছু গোপন
করা যায় না। প্রতিবেশীর এ সকল বিষয় পরস্পরের জন্য আমানত। নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের
কল্যাণেই একে অপরের দোষ ঢেকে রাখা জরুরি। আমি যদি তার দোষ প্রকাশ করে দিই তাহলে সেও
আমার দোষ প্রকাশ করে দিবে। আর আমি যদি তার দোষ ঢেকে রাখি তাহলে সেও আমার দোষ গোপন রাখবে।
আমাকে তো কারও মন্দ আমলের জবাব দিতে হবে না। প্রত্যেকেই তার নিজের আমলের জবাব
দিবে। প্রত্যেকেই তার আমল অনুযায়ী প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেন,
﴿مَّنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا فَلِنَفۡسِهِۦۖ وَمَنۡ أَسَآءَ فَعَلَيۡهَاۗ ٤٦ ﴾ [فصلت: ٤٦]
“যে ব্যক্তি নেক আমল
করে, তা তার কল্যাণের জন্যই করে, আর যে খারাপ কর্ম করে, তার পরিণতি তার উপরই
বর্তাবে”।[20]
আমি যদি আমার প্রতিবেশীর
দোষ গোপন করি, এর বদৌলতে আল্লাহও আমার এমন দোষ গোপন রাখবেন, যা
প্রতিবেশীও জানে না। হাদিসে এসেছে,
«مَنْ سَتَرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ سَتَرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا
وَالْآخِرَةِ ... »
চার- প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা:
আমরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে না। আমি নিজে ভালো ভালো খেলাম
অথচ আমার প্রতিবেশী না খেয়ে রইল এটি কোনো ঈমানদারের গুণ হতে পারে না। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন,
«ما آمن بي من بات شبعانًا وجاره جائع إلى
جنبه وهو يعلم»
“ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট পুরে খায় অথচ সে জানে যে তার পাশের প্রতিবেশী
না খেয়ে আছে”।[22]
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, অনেক প্রতিবেশীই এমন আছে, যাদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তারা অভাবে
দিন কাটাচ্ছে। তারা কখনোই মানুষের কাছে হাত পাতে না তারা কখনো কেনা কিছু চাইবেও না। কুরআনে এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
﴿ يَحۡسَبُهُمُ ٱلۡجَاهِلُ أَغۡنِيَآءَ مِنَ ٱلتَّعَفُّفِ تَعۡرِفُهُم
بِسِيمَٰهُمۡ لَا يَسَۡٔلُونَ ٱلنَّاسَ إِلۡحَافٗاۗ ٢٧٣ ﴾ [البقرة: ٢٧٣]
“না চাওয়ার কারণে অনবগত ব্যক্তি তাদেরকে অভাব মুক্ত মনে করে। তুমি তাদেরকে
চিনতে পারবে তাদের চিহ্ন দ্বারা। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে চায় না”।[23]
কুরআনের অপর একটি আয়াতে এদেরকে ‘মাহরূম’
বলা হয়েছে, আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
﴿ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩ ﴾ [الذاريات: ١٩]
(অর্থ) “এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের (বঞ্চিতের) হক”।[24]
এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য, নিজে থেকে তাদের খোঁজ খবর রাখা এবং দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন পন্থা অবলম্বন করা যাতে সে লজ্জা না পায়। এ জন্যই তো যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বলে দেওয়া জরুরি নয় যে, আমি তোমাকে যাকাত দিচ্ছি; বরং ব্যক্তি যাকাতের যোগ্য কি না এটুকু জেনে নেওয়াই যথেষ্ট।
এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য, নিজে থেকে তাদের খোঁজ খবর রাখা এবং দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন পন্থা অবলম্বন করা যাতে সে লজ্জা না পায়। এ জন্যই তো যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা বলে দেওয়া জরুরি নয় যে, আমি তোমাকে যাকাত দিচ্ছি; বরং ব্যক্তি যাকাতের যোগ্য কি না এটুকু জেনে নেওয়াই যথেষ্ট।
পাঁচ- প্রতিবেশীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসা:
আর আমি প্রতিবেশীর প্রয়োজন পুরা করব তাহলে আল্লাহ আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন
এবং আমার সহায় হবেন। হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ، كَانَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي
حَاجَتِهِ،»
“যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পুরা করে আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরা করেন”।[25]
ছয়- অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া:
প্রতিবেশী অসুস্থ তাকে দেখতে যাওয়া এটি একটি অন্যতম হক।
তার চিকিৎসার খোজ খবর নেয়া ও তার সেবা করা খুবই জরুরি।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللَّهِ
نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوَّأْتَ مِنَ الجَنَّةِ
مَنْزِلًا»
“আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে
যাবে, অথবা তার কোনো ভাইকে আল্লাহর জন্য দেখতে যাবে, আসমান থেকে একজন ফেরেশতা
আহ্বান করে বলতে থাকে, তুমি সৌভাগ্যবান, তোমার হাটা কল্যাণকর এবং তুমি জান্নাতে
তোমার অবস্থান করে নিলে”।[26]
সাত- প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা:
প্রতিবেশীরা আমাদের জীবনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তাদের সাথে আমার আচরণ সুন্দর
হবে তা কি বলে বোঝাতে হয়? আর আমি যদি মুমিন হই তাহলে তো তা আমার
ঈমানের দাবি। আবু শুরাইহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
আমার দুই কান শ্রবণ করেছে এবং আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে যখন রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«من كان يؤمن بالله
واليوم الآخر فليكرم جاره»
যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে সে
যেন স্বীয় প্রতিবেশীকে সম্মান করে। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে
«فليحسن إلي جاره »
“সে যেন স্বীয়
প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে”।[27]
আট-হাদিয়া আদান-প্রদান
করা:
প্রতিবেশীদের পরস্পরের সুসম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হাদিয়ার আদান-প্রদান খুবই কার্যকর পন্থা। এর মাধ্যমে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয় ও ভ্রাতৃত্বের
বন্ধন মজবুত হয়। যেমন হাদিস-
عن عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ،
عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «تَهَادُوا تَحَابُّوا» [قال الشيخ الألباني] : حسن
“আবু
হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা হাদিয়া
আদান-প্রদান কর। এর মাধ্যমে তোমাদের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি হবে”।[28]
وعن أبي هريرة رضى
الله عنه قال: كان النبي
صلى الله عليه و سلم يقول: «يا نساء المسلمات، لا
تحقرن جارة لجارتها ولو فرسن شاة».
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে অন্য হাদিসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন, “হে
মুসলিম নারীগণ! তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে সংকোচ
বোধ না করে। যদিও তা বকরীর খুরের মত একটি নগণ্য বস্তুও হয়”।[29]
সুতরাং প্রতিবেশী নারীরাও নিজেদের মাঝে হাদিয়া আদান-প্রদান করবেন। যদিও তা একেবারে নগণ্য বস্তু হয়ে থাকে। যা কোনো উপকারে আসবে না।
সুতরাং প্রতিবেশী নারীরাও নিজেদের মাঝে হাদিয়া আদান-প্রদান করবেন। যদিও তা একেবারে নগণ্য বস্তু হয়ে থাকে। যা কোনো উপকারে আসবে না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه
وسلم قَالَ:« تَهَادَوْا
فَإِنَّ الْهَدِيَّةَ تُذْهِبُ وَحَرَ الصَّدْرِ وَلَا تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ
لِجَارَتِهَا وَلَوْ شِقَّ فِرْسِنِ شَاةٍ »
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা হাদিয়া আদান প্রদান কর, কারণ, তা
মানুষের অন্তরের ক্ষোভকে দূর করে। একজন প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে সংকোচ
করবে না। যদিও তা বকরীর খুরের অর্ধেক অংশ হয়ে থাকে”।[30]
আমাদের মনিষীরা প্রতিবেশীদের খোজ খবর নিতেন এবং তাদের প্রয়োজন পূরণে চেষ্টা করতেন। রাসূল সা. এর সাহাবীদের অবস্থা এমন ছিলেন, তারা তাদের প্রতিবেশীকে কোনো কিছু হাদিয়া পাঠাতেন, আবার সে প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর নিকট আবারও হাদিয়া পাঠাতেন। এভাবে বস্তুটি ঘুরে ঘুরে আবার প্রথম ঘরে ফিরে আসত।
আমাদের মনিষীরা প্রতিবেশীদের খোজ খবর নিতেন এবং তাদের প্রয়োজন পূরণে চেষ্টা করতেন। রাসূল সা. এর সাহাবীদের অবস্থা এমন ছিলেন, তারা তাদের প্রতিবেশীকে কোনো কিছু হাদিয়া পাঠাতেন, আবার সে প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর নিকট আবারও হাদিয়া পাঠাতেন। এভাবে বস্তুটি ঘুরে ঘুরে আবার প্রথম ঘরে ফিরে আসত।
নয়-খাবারে প্রতিবেশীকে শরীক করা:
এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেওয়ার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে, সামান্য জিনিস হাদিয়া দিতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক হাদিসে
আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু যর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহুকে বলেন,
«يا أبا
ذر! إذا طبخت مرقة فأكثر ماءها، وتعاهد جيرانك»
“হে আবু যর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার পানি বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক
করো”।[31]
وعن عائشة رضي الله عنها قالت: قلت يا
رسول الله! إن لي جارتين، فإلى أيهما أهدي؟ قال: «إلى
أقربهما منك بابًا»،
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম-আমার দুই প্রতিবেশী। এদের
কাকে হাদিয়া দিব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, যে তোমার ঘরের দরজার বেশি নিকটবর্তী”।
আমার বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে প্রতিবেশীকে না জানালেও রান্নার ঘ্রাণ তো
তাকে জানিয়ে দেয়; পাশের বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হচ্ছে। বড়দের
কথা বাদ দিলাম, ঘ্রাণ পেয়ে ছোটদের মনে তো আগ্রহ জাগবে তা খাওয়ার।
সুতরাং তাদের দিকে লক্ষ্য রেখে ঝোল বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে হোক বা নিজে একটু কম খাওয়ার
মাধ্যমে হোক সামান্য কিছু যদি পাঠিয়ে দিই তাহলে ঐ ছোট্ট শিশুর মনের ইচ্ছা যেমন পুরা
করা হবে তেমনি আল্লাহও খুশি হবেন। যা আমার রিযিকে বরকতের কারণ হবে ইনশাআল্লাহ। যে খাদেম
খানা তৈরি করল তাকেও খানায় শরিক করার কথা হাদিসে এসেছে। কারণ
এ খাবার প্রস্তুত করতে গিয়ে সে এর ধোঁয়া যেমন সহ্য করেছে তেমনি এর সুঘ্রাণও তার নাকে
ও মনে লেগেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,
«إِذَا
أَتَى أَحَدَكُمْ خَادِمُهُ بِطَعَامِهِ فَإِنْ لَمْ يُجْلِسْهُ مَعَهُ
فَلْيُنَاوِلْهُ لُقْمَةً أَوْ لُقْمَتَيْنِ أَوْ أَكْلَةً أَوْ أَكْلَتَيْنِ
فَإِنَّهُ وَلِيَ حَرَّهُ وَعِلَاجَهُ» أَخْرَجَاهُ،
“তোমাদের খাদেম যখন তোমাদের জন্য খানা প্রস্তুত করে নিয়ে আসে তখন তাকে যদি
সাথে বসিয়ে খাওয়াতে না-ও পার তাকে দু এক লোকমা হলেও দাও। (সামান্য কিছু দিয়ে হলেও তাকে এই খানায় শরিক কর) কারণ, সে-ই তো এই খানা প্রস্তুত করার কষ্ট ও আগুনের
তাপ সহ্য করেছে”।[32]
মুসলিমের বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
«فَلْيُقْعِدْهُ
مَعَهُ فَلْيَأْكُلْ، فَإِنْ كَانَ الطَّعَامُ مَشْفُوهًا قَلِيلًا، فَلْيَضَعْ
فِي يَدِهِ أَكْلَةً أَوْ أَكْلَتَيْنِ»
“খাদেমকে তোমরা
তোমাদের সাথে বসতে দেবে, যাতে সেও তোমাদের সাথে খায়, যদি খাওয়ার কম হয়, তাহলে
তোমরা তার হাতে এক লুকমা বা দুই লুকমা খাওয়ার তুলে দেবে”।[33]
ইমাম আহমদ রহ. মিকদাদ ইবনে মা‘দি কারাব
রাদিয়াল্লাহু আনহু হাদিস বর্ণনা করে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ما أَطْعَمْتَ نَفْسَكَ فَهُوَ لَكَ
صَدَقَةٌ، وَمَا أَطْعَمْتَ ولدك فهو لك صدقة، وما أطعمت زووجتك فَهُوَ لَكَ
صَدَقَةٌ، وَمَا أَطْعَمْتَ خَادِمَكَ فَهُوَ لك صدقة» ورواه النسائي وإسناده صحيح.
“যা তুমি নিজে খেলে, তা তোমার জন্য
সদকা, তোমার সন্তানকে যা খাওয়ালে তা তোমার জন্য সদকা, তোমার স্ত্রীকে যা খাওয়ালে
তা তোমার জন্য সদকা আর তোমার খাদেমকে যা খাওয়ালে তা তোমার জন্য সদকা”।[34]
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ভালো কিছু রান্না হলে মাঝে
মধ্যে কাজের বুয়ার সন্তানদের জন্য কিছু দেওয়া উচিত। অনেক সময় খাবার বেঁচে যায়।
হতে পারে আমার ঘরের এ বেঁচে যাওয়া খাবারই কাজের বুয়ার সন্তানদের জন্য হবে ‘ঈদের খাবার’। আর আশা করা যায় এর বিনিময়ে আল্লাহ
আমার জন্য জান্নাতের মেহমানদারির ফয়সালা করবেন।
দশ- প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া:
অনেক সময় এমন হয়, প্রতিবেশীর প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিতে
হয়। কিংবা নিজের কিছু ক্ষতি স্বীকার করলে প্রতিবেশীর অনেক বড় উপকার হয় বা সে অনেক
বড় সমস্যা থেকে বেঁচে যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর উপকারের জন্য নিজের কিছু
ক্ষতি মেনে নেওয়া ও উদারতা দেখানো একজন মুসলিমের বিশেষ গুণ। তেমনি একটি বিষয় হাদিস
শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে, যা মুমিনকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে। আবু
হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« لا يمنع جار جاره أن
يغرز خشبة في جداره » ثم يقول أبو هريرة : مالي أراكم
عنها معرضين ! والله لأرمين بها بين أكتافكم . متفق عليه
“কোনও প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীকে তার দেয়ালে কাঠ স্থাপন করতে বাধা না দেয়,
তারপর আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কি ব্যাপার আমি তোমাদের এটা থেকে মুখ
ফিরিয়ে থাকতে দেখছি, আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আমি তা তোমাদের ঘাঁড়ে নিক্ষেপ করব”।[35]
আরেক হাদিসে এসেছে,
« مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ، كَانَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي
حَاجَتِهِ »
“যে তার (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন
পূরণ করে স্বয়ং আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরা করেন”।[36]
এগার- নিত্য প্রয়োজনীয়
জিনিস আদান-প্রদান করা:
আমাদের প্রায় সকলেরই সূরা মাউন মুখস্থ আছে। ‘মাউন’ অর্থ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ছোট খাট অনেক
জিনিসেরই প্রয়োজন হয়। কোনও বস্তু হয়তো সামান্য, কিন্তু তার
প্রয়োজন নিত্য। যেমন লবণ। খুবই সামান্য জিনিস, কিন্তু তা ছাড়া
আমাদের চলে না। কখনও এমনও হয় দশ টাকার লবণ কেনার জন্য বিশ টাকা রিক্সা ভাড়া খরচ করতে
হবে বা এখন এমন সময় যে তা পাওয়া যাবে না। অথচ লবণ না হলে চলবেই না। তখন আমরা পাশের
বাড়ি বা প্রতিবেশীর দ্বারস্থ হই। এমন সময় এ সাধারণ বস্তুটি যদি কেউ না দেয় তাহলে
নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। কোনও প্রতিবেশী যদি এমন হয় তাহলে তাকে ধিক শত ধিক।
আল্লাহও তাকে ভর্ৎসনা দিয়েছেন। সূরা মাউনে আল্লাহ বলেছেন,
﴿ فَوَيۡلٞ لِّلۡمُصَلِّينَ ٤ ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ
٥ ٱلَّذِينَ هُمۡ يُرَآءُونَ ٦ وَيَمۡنَعُونَ ٱلۡمَاعُونَ ٧ ﴾ [الماعون: ٤، ٨]
“সুতরাং দুর্ভোগ
সেই সালাত আদায়কারীদের, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে, এবং গৃহস্থালির
প্রয়োজনীয় ছোট-খাট সাহায্যদানে বিরত থাকে”।[37]
বার- প্রতিবেশীর সালামের উত্তর দেয়া:
সালামের উত্তর দেওয়া যদিও একজন মুসলিমের হক। কিন্তু একজন প্রতিবেশীর
সালামের উত্তর দেওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে
মহব্বত সৃষ্টি হয়। দুই জনের মধ্যে দূরত্ব দূর হয়। শুধু সালামের উত্তর দেয়ার
অপেক্ষায় না থেকে সালাম দেওয়া আরও অধিক সাওয়াব।
তের- প্রতিবেশীকে উপদেশ দেয়া:
একজন প্রতিবেশীর গুরুত্বপূর্ণ হক হল, তাকে ভালো কাজের আদেশ দেওয়া এবং মন্দ
ও খারাপ কর্ম হতে বিরত রাখতে চেষ্টা করা। তাকে সালাতের দাওয়াত দেয়া, রোজার দাওয়াত
দেয়া, মসজিদে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া। অন্যথায় সে যদি সালাত আদায় না করে,
দ্বীনের উপর না চলে, কিয়ামতের দিন সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। সে বলবে, একসাথে
থাকতাম কিন্তু আমাকে ভালোকাজের আদেশ দেয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
«أَوَّلُ خَصْمَيْنِ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ جَارَانِ »،
“কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বাদী বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী”।[38]
সবচেয়ে বড় অভিযোগ তোমার বিরুদ্ধে দাড় করাবে, তা হল, তুমি তাকে দ্বীনের
ব্যাপারে কোনো নসিহত করোনি। তোমার গলা চেপে ধরে বলবে, হে আমার রব, লোকটি আমাকে
দেখছে আমি সালাত আদায় করিনি, কিন্তু সালাত আদায় করতে বলেননি। হে আমার রব, আমাকে
বিভিন্ন খারাপ কর্মে লিপ্ত হতে দেখছে কিন্তু আমাকে খারাপ কর্ম হতে বিরত থাকতে
উপদেশ দেয়নি। আমাকে আমার পরিবারের মধ্যে নষ্ট দেখছিল কিন্তু সে আমাকে কোনো উপদেশ
দেয়নি...ইত্যাদি।
হে আমার মুসলিম ভাই! তুমি তোমার ক্ষমতা দায়িত্ব অনুযায়ী প্রতিবেশীদের
উপদেশ দাও। যাতে আল্লাহর দরবারে তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে না পারে।
প্রতিবেশীর আরও হক
আর প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা, বিপদে
আপদে এগিয়ে যাওয়া, অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, একে অপরের সুখ-দুঃখের শরিক হওয়া, হাদিয়া আদান প্রদান করা, সেবা শুশ্রূষা করা, প্রতিবেশীর কেউ মারা গেলে সান্ত্বনা দেওয়া, কাফন
দাফনে শরিক হওয়া, একে অপরের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রতিবেশীর
কষ্টের কারণ হয় এমন সব ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা, অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া, ভুল
ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেওয়া, চলাচলের রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক কোনো বস্তু ফেলে না
রাখা, রাস্তা বন্ধ না করা, ছাদ থেকে তাদের গোপনীয় বিষয় না দেখা, দোষ-ত্রুটি ঢেকে
রাখা, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, চোখের হেফাজত করা, তাদের খাদেম বা চাকর-বাকর
ইত্যাদির প্রতি কু-দৃষ্টি না দেওয়া এবং দুনিয়াও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ বিষয়ে
তাদের উপদেশ দেয়া।
ومن حديث معاذ بن جبل عليه السلام: قالوا: يا رسول الله! ما
حق الجار على الجار؟ قال: «إن استقرضك أقرضته، وإن
استعانك أعنته، وإن مرض عدته، وإن احتاج أعطيته، وإن افتقر عدت عليه، وإن أصابه
خير هنيته، وإن أصابته مصيبة عزيته، وإذا مات اتبعت جنازته، ولا تستطيل عليه
بالبناء فتحجب عنه الريح إلا بإذنه، ولا تؤذيه بريح قدرك إلا أن تغرف له، وإن
اشتريت فاكهة فأهدِ له، وإن لم تفعل فأدخلها سرًّا ولا تخرج بها ولدك ليغيظ بها
ولده.»
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীরা
জিজ্ঞাসা করলেন, একজন প্রতিবেশীর উপর তার অপর প্রতিবেশীর হক কি? রাসূল বললেন, যদি
ঋণ চায় ঋণ দেবে, সহযোগিতা চাইলে সাহায্য করবে, অসুস্থ হলে দেখতে যাবে, অভাবে পড়লে
অভাব দূর করবে, তার সুখে সুখী হবে, তার দুঃখে দুখী হবে, মারা গেলে জানাযায় শরিক
হবে, প্রতিবেশীর বাড়ীর হাওয়া বাতাস বন্ধ করবে না, ফল কিনলে, তার বাড়ীতে হাদিয়া
দেবে অন্যথায় লুকিয়ে রাখবে, তোমাদের ছেলেরা হাতে ফল নিয়ে তাদের ছেলেদের দেখাবে না,
যাতে তাদের মনে কষ্ট যায়।
প্রতিবেশীর যত হক উপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো তো প্রতিবেশী মুসলিম হোক অমুসলিম
হোক সবারই হক, সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। আর প্রতিবেশী যদি মুসলিম হয় বা মুসলিম ও
আত্মীয় উভয়টিই হয় তাহলে এসকল হকের সাথে মুসলিম ও আত্মীয় হিসেবে যত হক আছে সবই তাদের
প্রাপ্য। এ বিষয়টিও স্মরণ রাখা জরুরি।
দরিদ্র প্রতিবেশীর হক:
আর প্রতিবেশী যদি দরিদ্র হয় তাহলে এ বিষয়ে তার হক আরও বেশি। কারণ দরিদ্রকে
খানা খাওয়ানো যেমন অনেক সওয়াবের কাজ তেমনি দরিদ্রকে খানা না-খাওয়ানো
জাহান্নামে যাওয়ার একটি বড় কারণ। কুরআন মজীদে ‘ছাকার’ নামক জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে নামায না পড়ার বিষয়টির সাথে
সাথে দরিদ্রকে খানা না খাওয়ানোও গুরুত্ব সহকারে উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ
٤٣ وَلَمۡ نَكُ نُطۡعِمُ ٱلۡمِسۡكِينَ ٤٤ ﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٤]
(জাহান্নামীকে জিজ্ঞেস করা হবে) (অর্থ) “কোন বিষয়টি তোমাদেরকে ‘ছাকার’ নামক জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? (তারা উত্তরে
বলবে) আমরা নামায পড়তাম না এবং দরিদ্রকে খানা খাওয়াতাম না”।[39]
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« ما آمن بي من بات شبعان وجاره جائع إلى جنبه وهو يعلم به »
“ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে
এবং সে তার সম্পর্কে জানে”।[40]
অপর একটি
হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الصَّدَقَةُ عَلَى
الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الرَّحِمِ صدقة وصلة» (أخرجه النسائي حديث سلمان بن عامر) .
নিকটতম প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়া যদিও
সে বিধর্মী হয়:
প্রতিবেশীর মধ্যে যেমন আছে নিকট প্রতিবেশী, নিকটতম প্রতিবেশী
ও তুলনামূলক একটু দূরের প্রতিবেশী তেমনি আছে মুসলিম ও বিধর্মী। এখন কাকে হাদিয়া দিব
বা কাকে আগে দিব?
روى الإمام أحمد عَنْ
عَائِشَةَ: أَنَّهَا سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
فَقَالَتْ: إِنَّ لِي جَارَيْنِ فَإِلَى أَيِّهِمَا أُهْدِي؟ قَالَ: «إِلَى
أَقْرَبِهِمَا مِنْكَ بَابًا» وَرَوَاهُ الْبُخَارِيُّ مِنْ
حَدِيثِ شُعْبَةَ بِهِ.
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম-আমার দুই প্রতিবেশী। এদের
কাকে হাদিয়া দিব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন, যে তোমার বেশি নিকটবর্তী”।
অমুসলিম প্রতিবেশীর হক:
ইসলাম মুসলিম প্রতিবেশীর ব্যাপারে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, অনুরূপভাবে
অমুসলিম প্রতিবেশীর ব্যাপারেও এভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। অমুসলিম হওয়ার কারণে, তার প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য ইসলাম দেখাননি। সুতরাং, প্রতিবেশীর যেভাবে অধিকার ও হক রয়েছে, অমুসলিম
প্রতিবেশীরও অনুরূপ হক ও অধিকার রয়েছে।
عَنْ
مُجَاهِدٍ قَالَ: كُنْتُ عِنْدَ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو - وَغُلَامُهُ
يَسْلُخُ شَاةً - فَقَالَ: يَا غُلَامُ، إِذَا فَرَغْتَ فَابْدَأْ بِجَارِنَا
الْيَهُودِيِّ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: الْيَهُودِيُّ أَصْلَحَكَ اللَّهُ؟
قَالَ: إِنِّي سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوصِي بِالْجَارِ، حَتَّى خَشِينَا أَوْ رُئِينَا أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ [قال الشيخ الألباني] : صحيح
মুজাহিদ রহ. বলেন, “একবার
আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে ছিলাম। তার
গোলাম একটি বকরীর চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, তোমার এ
কাজ শেষ হলে সর্বপ্রথম আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে দিবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ আপনার এসলাহ করুন। আপনি ইহুদীকে আগে দিতে বলছেন! তখন তিনি বললেন, (হাঁ) আমি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রতিবেশীর হকের বিষয়টি এত বেশি গুরুত্ব
দিয়ে বলতে শুনেছি যে, আমাদের আশংকা হয়েছে বা মনে হয়েছে, প্রতিবেশীকে মিরাসের হকদার বানিয়ে দেওয়া হবে”।[42]
জমিনের প্রতিবেশী: হককে শুফ্আ
এটি প্রতিবেশীর গুরুত্বপূর্ণ একটি হক। নিজের জমি বা বাড়ি যদি কেউ বিক্রি করতে
চায়, তাহলে সে ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ, তাকে আগে
জানাতে হবে যে, আমি আমার বাড়ি বা জমি বিক্রি করতে চাই, তুমি
তা কিনবে কি না। যদি সে কিনতে না চায় তাহলে অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে। তাকে না
জানিয়ে কারো কাছে বিক্রি করা যাবে না। করলে সে দাবি করতে পারবে যে,
আমি এই জমি ক্রয় করব। এটা তার হক। কারণ, হতে পারে এ জমিটি
তার প্রয়োজন বা এমন ব্যক্তি তা ক্রয় করল যার কারণে সে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে
ইত্যাদি। আর একেই শরীয়তের পরিভাষায় ‘হককে শুফ্আ’ বলে।
হাদিস শরীফে প্রতিবেশীর এ হকটিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ
كَانَتْ لَهُ أَرْضٌ فَأَرَادَ بَيْعَهَا، فَلْيَعْرِضْهَا عَلَى جَارِهِ»
আরেক হাদিসে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْجَارُ
أَحَقُّ بِشُفْعَةِ جَارِهِ، يَنْتَظِرُ بِهَا إِنْ كَانَ غَائِبًا، إِذَا كَانَ
طَرِيقُهُمَا وَاحِدًا»
“শুফ্আ’-র বিষয়ে
প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেশী উপস্থিত না থাকলেও তার অপেক্ষা করতে হবে। এটা
তখন যখন তাদের উভয়ের চলাচলের পথ এক হয়”।[44]
এ ধরনের আরও অনেক হাদিসে হককে শুফ্আর বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের আরও অনেক হাদিসে হককে শুফ্আর বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ
চাওয়া:
মন্দ প্রতিবেশী থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। কারণ একজন মন্দ প্রতিবেশী
সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে বা আমাকেও মন্দের দিকে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَعَوَّذُوا
بِاللَّهِ، مِنْ جَارِ السَّوْءِ فِي دَارِ الْمُقَامِ، فَإِنَّ جَارَ
الْبَادِيَةِ يَتَحَوَّلُ عَنْكَ»
“তোমরা অবস্থানস্থলের
মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও; কারণ মরু অঞ্চলের অস্থায়ী প্রতিবেশী
পরিবর্তিত হয় (কিন্তু অবস্থানস্থলের প্রতিবেশী সেরূপ নয়)”।[45]
আমি হব না মন্দ প্রতিবেশী:
আমি কারো জন্য মন্দ প্রতিবেশী হব না। যেমনি ভাবে আমি চাই না যে, আমার প্রতিবেশীটি মন্দ হোক তেমনিভাবে আমাকেও ভাবতে হবে, আমিও যেন আমার প্রতিবেশীর কষ্টের কারণ না হই। নাফে ইবনে আব্দুল হারিস
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« مِنْ سَعَادَةِ الْمَرْءِ الْجَارُ الصَّالِحُ، وَالْمَرْكَبُ
الْهَنِيءُ، وَالْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ »
আখিরাতের প্রথম বাদী-বিবাদী:
প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা বা তাকে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। কখনো দুনিয়াতেই
এর সাজা পেতে হয় আর আখিরাতের পাকড়াও তো আছেই। আমার অর্থবল বা জনবল আছে বলে আমি প্রতিবেশীর
হক নষ্ট করে পার পেয়ে যাব এমনটি নয়। হাঁ, দুনিয়ার আদালত থেকে
হয়ত পার পেয়ে যাব, কিন্তু আখিরাতের আদালত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে? উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَوَّلُ خَصْمَيْنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ جَارَانِ»
একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, তুমি আমার হক নষ্ট করেছ। আজ তুমি আমার হক
পরিশোধ করবে। সেদিন কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না, কেউ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হবে না।
আল্লাহ তা‘আলা সেদিন উভয়ের মাঝে ফায়সালা করবেন।
প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না:
প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের
দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন। কোনও ব্যক্তি মুমিন আবার প্রতিবেশীকে কষ্টও দেয় তা ভাবা
যায় না।
প্রতিবেশী কষ্ট দিলে কি করব?
হতে পারে আমার প্রতিবেশী আমাকে কষ্ট দেয় তাই বলে কি আমিও প্রতিবেশীকে কষ্ট
দিব? তা হতে পারে না। মুমিন তো সর্বদা ভালো আচরণ করে। মুমিনের
গুণ তো
أحسن إلى من أساء إليك
“তোমার সাথে যে মন্দ আচরণ করে তুমি তার সাথে ভালো আচরণ কর।’
সে তো কুরআনের ঐ আয়াত শুনেছে, যাতে আল্লাহ বলেন,
সে তো কুরআনের ঐ আয়াত শুনেছে, যাতে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَمَن صَبَرَ
وَغَفَرَ إِنَّ ذَٰلِكَ لَمِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ٤٣ ﴾ [الشورى: ٤٣]
“প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, এটাতো
বড় হিম্মতের কাজ”।[48]
হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তিন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন, তাদের একজন ঐ ব্যক্তি,
وَالرَّجُلُ يَكُونُ لَهُ الْجَارُ
يُؤْذِيهِ جِوَارُهُ، فَيَصْبِرُ عَلَى أَذَاهُ حَتَّى يُفَرِّقَ بَيْنَهُمَا
مَوْتٌ أَوْ ظَعْنٌ
“যার একজন মন্দ
প্রতিবেশী রয়েছে, সে তাকে কষ্ট দেয়। তখন ঐ ব্যক্তি ছবর করে
এবং আল্লাহর ছাওয়াবের আশা রাখে। একপর্যায়ে ঐ প্রতিবেশীর ইন্তেকাল বা চলে যাওয়ার
মাধ্যমে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন”।[49]
প্রতিবেশীর জমির আইল ঠেলা:
অনেক সময় এমন হয় যে দুই প্রতিবেশী তাদের বাড়ির সীমানা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে
পড়ে। যে প্রতিবেশীর শক্তি বেশি সে জোরপূর্বক নিজের সীমানা বাড়িয়ে নেয়। এটা বসতবাড়ির
ক্ষেত্রে যেমন হয় ফসলের জমির প্রতিবেশীর সাথে আরও বেশি হয়। যাকে বলে ‘আইল ঠেলা’। সামান্য জমিন ঠেলে সে নিজের ঘাড়ে
জাহান্নাম টেনে আনল। যতটুকু জমিন সে জবরদস্তি বাড়িয়ে নিলো সে
নিজেকে তার চেয়ে সাতগুণ বেশি জাহান্নামের দিকে ঠেলে নিলো। হাদিস শরীফে এসেছে,
«مَنْ أخَذَ شِبْرًا مِنَ الأَرْضِ ظُلْمًا، طُوِّقَهُ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ »
“যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমি দখল করল, কিয়ামতের
দিন ঐ জমির সাত তবক পরিমাণ তার গলায় বেড়ি আকারে পরিয়ে দেওয়া হবে”।[50]
আল্লাহ আমাদের প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
[19] আল-মুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস: ৭৩০৩; আল-মু‘জামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস: ৩৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস: ৫২০; বাইহাকী শুয়াবুল ঈমান, হাদিস: ৯১০০
[25] সহীহ
বুখারী, হাদিস: ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮০; আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৯৩; তিরমিযি, হাদিস: ১৪২৬
[26] তিরমিযি, হাদিস:
২০০৮
_________________________________________________________________________________
সংকলন: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
আরও পড়ুনঃ মুসলিমের হক
আরও পড়ুনঃ সন্তানের হক
আরও পড়ুনঃ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ ইসলামে নারীর যৌন অধিকার
আরও পড়ুনঃ ইসলামে নারীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
আরও পড়ুনঃ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার
আরও পড়ুনঃ পথের হক
আরও পড়ুনঃ মুসলমানের আদব বা শিষ্টাচার
আরও পড়ুনঃ রহমানের বান্দাদের গুণাবলী
আরও পড়ুনঃ মুসলমানের চারিত্রিক গুণাবলী
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন