বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৪

পিতামাতার অবাধ্যতা: কারণ, কিছু বাহ্যিক চিত্র ও প্রতিকারের উপায়

পিতামাতার অবাধ্যতা: কারণ, কিছু বাহ্যিক চিত্র ও প্রতিকারের উপায়


পিতামাতার অবাধ্যতা: কারণ, কিছু বাহ্যিক চিত্র ও প্রতিকারের উপায়

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আর দুরূদ ও সালাম আল্লাহর রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী ও যারা তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের প্রতি।
অতঃপর,
পিতামাতার অধিকারের বিষয়টি অনেক বড় ও মহান এবং দীনের মধ্যে তাদের মর্যাদা ও অবস্থান অনেক উপরে; সুতরাং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের মতই গুরত্বপূর্ণ; আর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত; আর তাদের প্রতি ইহসান করা সবচেয়ে মহান কাজের অন্তর্ভুক্ত এবং মহান আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿۞ وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا ﴾ [النساء: ٣٦]
আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং কোনো কিছুকে তাঁর শরীক করো না; আর পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ۞قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗاۖ ﴾ [الانعام: ١٥١]
বলুন,এস তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তোমাদেরকে তা তিলাওয়াত করি, তা হচ্ছে, ‘তোমরা তাঁর সাথে কোনো শরীক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে[2]
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [الاسراء: ٢٣،  ٢٤]                                                                                                                   
“আর তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত না করতে এবং  পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; আর তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। আর মমতাবেশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলো, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।[3]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ ١٤ ﴾ [لقمان: ١٤]                                                                                                                                                            
আর আমরা মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। ফিরে আসা তো আমারই কাছে।[4]
তাছাড়া এ প্রসঙ্গে বহু হাদিসও বর্ণিত আছে; তন্মধ্যে অন্যতম একটি হাদিস, আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : أَيُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إلَى اللَّهِ ؟ قَالَ : «الصَّلاةُ عَلَى وَقْتِهَا » . قُلْتُ : ثُمَّ أَيُّ ؟ قَالَ : « بِرُّ الْوَالِدَيْنِ » , قُلْتُ : ثُمَّ أَيُّ ؟ قَالَ : « الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ » . ( رواه البخاري و مسلم ) .
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম: আল্লাহ তা‘আলার নিকট কোন আমল সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়? জবাবে তিনি বললেন: সময় মত সালাত আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম: তারপর কোনটি? তিনি বললেন: পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম: তারপর কোনটি? তিনি বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।[5]
বস্তুত পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি এমন একটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা সুস্থস্বভাব ও বিশুদ্ধ প্রকৃতি কর্তৃক স্বীকৃত, যার ব্যাপারে আসমানী শরী‘য়ত একাট্টা; আর তা হল নবীদের চরিত্র এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণের স্বভাব।
যেমনিভাবে তা ঈমানের সত্যতা, ব্যক্তির মহত্ব ও সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালনের উপর উৎকৃষ্ট দলীল ও প্রমাণ।
আর পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি ইসলামী শরী‘য়তের মহান সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত; এটা হল অনুগ্রহের স্বীকৃতি, মর্যাদা সংরক্ষণ, শরী‘য়তের পরিপূর্ণতার উপর প্রমাণ এবং তা অন্তর্ভুক্ত করে সকল প্রকার অধিকারকে।
বস্তুবাদী পৃথিবীর মানব রচিত আইনকানুন তার বিপরীত, যা পিতামাতার জন্য কোনো বিশেষ মর্যাদা নির্ধারণ করে নি এবং তাদের জন্য কোনো অধিকার সংরক্ষণ করে নি; বরং তা তাদেরকে অবজ্ঞা করেছে এবং হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
আর প্রযুক্তিতে অগ্রগামী পশ্চিমা বিশ্বই হলো এর জ্বলন্ত সাক্ষী; কারণ, ঐ শাসন ব্যবস্থায় মা হলেন এমন এক যন্ত্রের মত, যখন তার কার্যকারিতার সময়কাল শেষ হয়ে যায়, তখন তাকে মাটিতে ছুড়ে ফেলা হয়।
আর তাদের চিন্তা-চেতনা থেকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের অতি সীমিত এক পন্থার উদ্ভব হয়েছে যে, তারা একটি বার্ষিক দিবস চালু করেছে, যার নাম দিয়েছে ‘মা দিবস’। সে দিন ছেলে ও মেয়েরা ভালবাসা ও সদ্ব্যবহারের প্রতীক হিসেবে তাদের মাকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল উপহার হিসেবে প্রদান করে।
এটাই হলো তাদের পক্ষ থেকে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার চূড়ান্ত নমুনা; বছরে একদিন, অন্য কোনো দিন নয়! তাহলে সেবা-যত্ন কোথায়? অথবা সহানুভূতি কোথায়? আর দায়িত্ব পালনের বিষয়টি বা কোথায়?
এসব মার্জিত মর্যাদাপূর্ণ অর্থবোধক শব্দের কোনো জ্ঞান তাদের নেই এবং তাদের নিকট এর কোনো অংশের বাস্তবতা নেই।
অপরদিকে ইসলামে মাতাপিতার অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়েছে এবং এটাই শুধু নয়, বরং ইসলাম পিতামাতার অবাধ্য হতে নিষেধ করেছে এবং তার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে; কারণ, তা কবীরাগুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং শিরকের সমমানের অপরাধ। এ ব্যাপারে      আল্লাহ তা‘আলার বাণীই যথেষ্ট, তিনি বলেন:
﴿ فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا ﴾ [الاسراء: ٢٣]
“তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না[6]
আর এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস বর্ণিত আছে; তন্মধ্যে অন্যতম একটি হাদিস, আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনিল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« الكبائرُ : الإشراكُ بالله ، وعُقوقُ الوالدين ، وقتْلُ النفس ، واليمينُ الغموسُ» . ( رواه البخاري) .
“অন্যতম কবীরা গুনাহসমূহ হল: আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কসম করা।[7]
পিতামাতার জন্য এই মর্যাদা, বিশেষ করে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারে জোরালো নির্দেশ এবং তাদের অবাধ্য হতে নিষেধ করে কঠোর ধমক আসা সত্ত্বেও একদল মানুষ তাদেরকে দেওয়া উপদেশের একটা বিরাট অংশকে ভুলে গেছে; ফলে তারা পিতামাতার অধিকারকে সংরক্ষণ করে না এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার বিষয়টিকে পরোয়া করে না।
পৃষ্ঠাসমূহের ধারাবাহিকতায় অচিরেই নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে:
-          অবাধ্যতার সংজ্ঞা
-          পিতামাতার অবাধ্যতার বাহ্যিক রূপ-প্রকৃতি
-          অবাধ্যতার নমুনা কাহিনী
-          অবাধ্যতার কারণ
-          প্রতিকারের উপায়
-          পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের পরিচয়
-          পিতামাতার সাথে আচার-আচরণের লক্ষণীয় দিক
-   সদ্ব্যবহারে সহায়ক বিষয় বা কর্মকাণ্ডসমূহ
-          স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয়
-          সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা কাহিনী।

পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর মহান গুনাবলীর দোহাই দিয়ে তাঁর কাছে আবেদন করছি যে, তিনি যেন আমাদেরকে আল্লাহভীরু পুণ্যবান ব্যক্তি ও যুগশ্রেষ্ঠ খাঁটি বন্ধুগণের অন্তর্ভুক্ত করেন; তিনি হলেন এর অভিভাবক ও এই বিষয়ে ক্ষমতাবান। আর আল্লাহই সকল বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী।
و صلى الله و سلم على نبينا محمد وآله و صحبه .
(আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সঙ্গী-সাথীর উপর)।
* * *

অবাধ্যতার সংজ্ঞা

অবাধ্যতাকে আরবীতে  العقوقবলা হয়। অর্থাৎ অবাধ্য হওয়া, অমান্য করা। শব্দটি  " البر "(তথা সদ্ব্যবহার) শব্দের বিপরীত অর্থবোধক শব্দ; ইবনু মানযূর রহ. বলেন: এর অর্থ হচ্ছে, সে তার পিতার আনুগত্যের লাঠি ভেঙ্গে ফেলল; আর সে তার পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল এবং সে তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেনি।[8]
তিনি আরও বলেন: হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতাগণের অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন; আরالعقوق (অবাধ্য হওয়া) শব্দটি  "البر"(সদ্ব্যবহার) শব্দের বিপরীত অর্থবোধক শব্দ; যা মূলত  "العق "শব্দ থেকে এসেছে; অর্থ: ভেঙ্গে ফেলা; কর্তন করা বা ছিন্ন করা।[9]
* * *

পিতামাতার অবাধ্যতার বাহ্যিক রূপ-প্রকৃতি

পিতামাতার অবাধ্যতার অনকেগুলো বাহ্যিক রূপ ও আকার-প্রকৃতি রয়েছে; সেগুলো নিম্নরূপ[10]:

১. পিতামাতাকে কাঁদানো ও দুঃখ দেওয়া: 
চাই তা কথার দ্বারা হউক অথবা কাজের দ্বারা, অথবা অন্য কোনো পন্থায়।

২. তাদেরকে ধমক ও হুমকি দেওয়া: 
আর এটা হতে পারে উচ্চস্বরে কথা বলার দ্বারা; অথবা তাদেরকে কঠোর ভাষায় শক্ত কথা বলা; আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿  وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ ﴾ [الاسراء: ٢٣ ]
“তাদেরকে ধমক দিও না; আর তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো[11]

৩. পিতামাতার আদেশ-নির্দেশের কারণে ত্যক্ত ও বিরক্ত হওয়া: 
আর এটা এমন এক চরিত্র, যা বর্জন করাটাকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আদব ও শিষ্টাচার বলে শিক্ষা দিয়েছেন; কারণ, এমন অনেক মানুষ আছে, যাকে তার পিতামাতা যখন আদেশ করে, তখন সে ‘উফ্’ বলে তার বিরক্তিসূচক কথা প্রকাশ করে, যদিও সে অচিরেই তাদের আনুগত্য করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ ﴾ [الاسراء: ٢٣]
“তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না[12]

৪. পিতামাতার সামনে ভ্রুকুটি করা এবং কপাল ভাঁজ করে ক্রোধ প্রকাশ করা: 
আপনি কোনো কোন মানুষকে বিভিন্ন মাজলিস ও আসরে দেখতে পাবেন হাস্যোজ্জ্বল, মুচকি হাসিসম্পন্ন, উত্তম চরিত্রবান, উত্তম কথার কারিগর ও মিষ্টিভাষী; অতঃপর যখনই সে বাসায় প্রবেশ করবে এবং পিতামাতার সামনে গিয়ে বসবে, তখন সে প্রভাবশালী সিংহে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কোনো কিছুই পরোয়া করে না; ফলে তার অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়, নম্রতা-ভদ্রতা চলে যায়, উদারতা লোপ পায় এবং তার মাঝে কঠোরতা, রূঢ়তা, হীনতা ও অশ্লীলতার আগমন ঘটে। এটাকে সত্যে পরিণত করে কথকের কথা:
مِنَ النّاسِ مَنْ يصلُ الأبعدينَ
ويشقَى بهِ الأقربُ الأقربُ
(মানুষের মাঝে কেউ কেউ আছে অনেক দূরতমদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে,
আর তার কাছে নিকটমতম থেকে নিকটতম ব্যক্তিরা হতভাগ্য হয়ে যায়)।

৫. পিতামাতার দিকে বাঁকা চোখে তাকানো: 
আর এটা হলো ক্ষুব্ধ ও বিরক্তির চোখে তাদের দিকে তাকানো এবং তাদের দিকে অবজ্ঞা ও ঘৃণার চোখে দৃষ্টি দেওয়া।
মুয়াবিয়া ইবন ইসহাক র. ‘উরওয়া ইবন যুবায়ের রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
" ما بَرَّ والدَه مَنْ شَدَّ الطّرفَ إليه " .
“যে ব্যক্তি তার পিতার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালো সে তার পিতার সাথে ভাল ব্যবহার করল না।”[13]

৬. পিতামাতার প্রতি নির্দেশ জারি করা: 
ঐ ব্যক্তির মত, যে তারা মাতাকে বাড়ি-ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য, অথবা কাপড় ধোয়ার জন্য, অথবা খাবার তৈরি করার জন্য নির্দেশ করে; অথচ এই কাজটি তার জন্য মানানসই নয়, বিশেষ করে মা যখন অক্ষম, বা বয়স্ক, বা অসুস্থ হন।
তবে মা যখন স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কাজগুলো করেন এবং তিনি অক্ষমও নন, এমতাবস্থায় এই ধরনের কাজে কোনো দোষ নেই, তবে এ ক্ষেত্রে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিকটি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং তাঁর জন্য দো‘আ করবে।

৭. মাতা কর্তৃক তৈরি করা খাবারের সমালোচনা করা: 
আর এই কাজটির মধ্যে দু’টি নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে; একটি হচ্ছে: খাদ্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, আর এটি করা বৈধ নয়; কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও কোনো খাদ্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করেন নি; ভাল মনে হলে খেয়েছেন, নতুবা বর্জন করেছেন।
আর দ্বিতীয় অবৈধ বিষয়টি হল: তাতে মায়ের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের কমতি হয় এবং তাকে বিরক্ত করা হয়।  

৮. পারিবারিক কাজে পিতামাতাকে সহযোগিতা না করা: 
চাই তা ঘর সাজানো ও গোছগাছ করার ক্ষেত্রে হউক, অথবা খাবার প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে হউক, অথবা পারিবারিক অন্য যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই হউক।
বরং ছেলেদের কেউ কেউ (আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত করুন) এটাকে তার অধিকার ক্ষুন্ন ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয় বলে মনে করে।
আর মেয়েদের কেউ কেউ (আল্লাহ তাদেরকেও হেদায়েত করুন) মনে করে, তার মাতাই ঘরের অভ্যন্তরীণ কাজ-কর্ম সম্পাদন করবে, সে তার মাকে সহযোগিতা করতে পারবে না। এমনকি তাদের কেউ কেউ তার মাকে কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় রেখে তার বান্ধবীদের সাথে টেলিফোনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে।

৯. পিতামাতা যখন কথা বলেন, তখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া: 
আর এর মানে হল তাদের কথায় কর্ণপাত না করা, অথবা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, অথবা তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা, অথবা তাদের সাথে তর্ক করা এবং তাদের সাথে কঠোরভাবে ঝগড়া-বিবাদ করা।
পিতামাতার ব্যাপারে এ ধরনের কাজে কতই না অপমানজনক এবং তাতে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কমতি বা ঘাটতির বিষয়টি তাদেরকে কত ভাবেই না জানিয়ে দেওয়া হয়!

১০. পিতামাতার মতামত বিবেচনায় কমতি করা: 
কোনো কোনো মানুষ তার কোনো বিষয় বা কাজেই তার পিতামাতার পরামর্শ ও অনুমতি গ্রহণ করে না, চাই তার বিয়ের ক্ষেত্রে হউক, অথবা তালাক প্রদান করার ক্ষেত্রে হউক, চাই ঘর থেকে তার বের হওয়ার ক্ষেত্রে হউক, অথবা ঘরের বাইরে অবস্থান করার ক্ষেত্রে হউক, চাই তার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার ব্যাপারে হউক, অথবা এ ধরনের অন্য কোনো বিষয়ে হউক।  

১১. পিতামাতার নিকট প্রবেশের সময় অনুমতি না নেওয়া: 
এটা পিতামাতার সাথে শিষ্টাচার পরিপন্থী আচরণ; কেননা, কখনও কখনও তারা উভয়ে অথবা তাদের কোনো একজন এমন অবস্থায় থাকেন, তারা পছন্দ করেন না যে, এই অবস্থাটি কেউ প্রত্যক্ষ করুক।

১২. পিতামাতার সামনে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা: 
চাই সেই সমস্যা ভাইদের সাথে সংশ্লিষ্ট হউক, অথবা স্ত্রী’র সাথে সংশ্লিষ্ট হউক, অথবা সন্তানদের সাথে সংশ্লিষ্ট হউক, অথবা অন্য কারও সাথে সংশ্লিষ্ট হউক। কেননা, কোনো কোন মানুষ পরিবারের কেউ কোনো ভুল করলে তাকে তার পিতামাতার সামনেই তিরস্কার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে; অথচ, কোনো সন্দেহ নেই যে, এই কাজটি এমন কার্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত, যা তাদেরকে অস্থির করে তুলে এবং তারা শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। 

১৩. জনগণের নিকট পিতামাতার নিন্দা ও দুর্নাম করা এবং তাদের দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা: 
কোনো কোনো মানুষ যখন কোনো কাজে ব্যর্থ হয়— যেমন সে তার পড়ালেখায় ব্যর্থ হল, তখন সে তার পিতামাতার উপর সকল দোষ ও দায়ভার চাপিয়ে দেয় এবং সে তার নিজের ব্যর্থতা ও অপারগতাকে বৈধতা দিতে থাকে এভাবে যে, তার পিতামাতা তাকে অযত্ন করেছে, তাকে যথাযথভাবে লালন-পালন করে নি, তারা তার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছে, তার ভবিষ্যৎটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি ধরনের রংবেরংয়ের নানা অপবাদ ও দোষারোপ করতে থাকে।     

১৪. পিতামাতাকে গালি ও অভিশাপ দেওয়া: 
তাদেরকে সরাসরি গালি দেওয়া, অথবা গালি দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করা; যেমন— ছেলে কোনো ব্যক্তির পিতা বা মাতাকে গালি দিল, তারপর ঐ ব্যক্তিও পাল্টা তার পিতামাতাকে গালি দিল। কারণ, আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে হাদিস বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« مِنَ الكَبَائِر شَتْمُ الرَّجُل وَالِدَيهِ ! ، قالوا : يَا رَسُول الله ، وَهَلْ يَشْتُمُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ ؟! قَالَ : نَعَمْ ، يَسُبُّ أَبَا الرَّجُلِ ، فَيَسُبُّ أبَاه ، وَيَسُبُّ أُمَّهُ ، فَيَسُبُّ أُمَّهُ » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ) .
“কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার পিতামাতাকে গালি দেওয়া কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত! সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কোনো মানুষ কি তার পিতামাতাকে গালি দিতে পারে?! জবাবে তিনি বললেন: হ্যাঁ, সে অন্য কোনো মানুষের পিতাকে গালি দেয়, তখন ঐ ব্যক্তি তার পিতাকে গালি দেয় এবং সে অন্য ব্যক্তির মাকে গালি দেয়, তখন ঐ ব্যক্তি তার মাকে গালি দেয়।[14]

১৫. ঘরের মধ্যে খারাপ কিছু নিয়ে আসা: 
যেমন খেল-তামাশার সরঞ্জামাদি ও ঘরের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টির যন্ত্রপাতির অনুপ্রবেশ ঘটানো, যা স্বয়ং ব্যক্তির চারিত্রিক বিকৃতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়; আবার কখনও কখনও এগুলো তার ভাই-বোন ও পরিবারের সকলের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে; ফলে সন্তানের অন্যায়-অপকর্ম ও পরিবারের অধঃপতনের কারণে পিতামাতা দুঃখ-কষ্ট অনুভব করেন।

১৬. পিতামাতার সামনে বদ অভ্যাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো: 
যেমন পিতামাতার সামনে ধূমপান করা, অথবা তাদের উপস্থিতিতে খেল-তামাশার উপকরণ উপভোগ করা, অথবা ফরয সালাত বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা এবং তার জন্য তাকে জাগিয়ে দিলে জাগানোর বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করা; আর অনুরপভাবে খারাপ সঙ্গী-সাথীদেরকে বাসায় নিয়ে আসা। আর এই সবগুলোই হল পিতা-মাতার সাথে বেহায়াপনার চূড়ান্ত দলীলস্বরূপ।

১৭. পিতামাতার সুনাম ও সুখ্যাতি নষ্ট করা: 
আর তা হয় এমন মন্দ ও নিকৃষ্ট কাজ করার মাধ্যমে, যা সম্মানহানি করে এবং ব্যক্তিত্ব নষ্ট করে; আবার কখনও কখনও তা কারাগারের দিকে নিয়ে যায় এবং লজ্জজনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব কর্মকাণ্ড পিতামাতার অবাধ্যতার অন্তর্ভুক্ত; কেননা, তা পিতামাতার জন্য দুশ্চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট, অসম্মান ও অপমান বয়ে আনে।

১৮. পিতামাতাকে বিপদে বা জটিলতায় ফেলে দেওয়া: 
যেমন— সন্তান কারও নিকট থেকে অর্থ-সম্পদ ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করে না, অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেয়াদবী করে, তারপর সন্তানের পলাতক অবস্থায় অথবা তার বেয়াদবীর কারণে কর্তৃপক্ষ পিতাকে হাজির হওয়ার জন্য বাধ্য করে।
আবার কখনও কখনও পিতাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, যে পর্যন্ত না সন্তান তার ঋণ পরিশোধ করে, অথবা সে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ না করে।

১৯. ঘরের বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করা: 
আর এটা পিতামাতাকে তার সন্তানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ও অস্থির করে তোলে; তাছাড়া অনেক সময় তাদের সেবা-যত্নের প্রয়োজন হয়; সুতরাং সন্তান যখন ঘরের বাইরে থাকে, তখন তারা তাদের সেবা-যত্ন করার মত কাউকে পায় না।

২০. বেশি বেশি দাবি-দাওয়া ও বায়না ধরে পিতামাতার উপর চাপ সৃষ্টি করা: 
কোনো কোন মানুষ বেশি বেশি দাবি-দাওয়া ও বায়না ধরে তার পিতামাতার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, অথচ অনেক সময় পিতামাতা’র উপার্জনের ক্ষমতা কম হয়ে থাকে, এই সত্ত্বেও দেখা যায় সন্তান তাদেরকে গাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য বাধ্য করে, তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয় এবং তাকে নতুন বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য বলে, অথবা সে তাদের নিকট বেশি বেশি অর্থ-সম্পদ দাবি করে যাতে বন্ধু-বান্ধব ও সমবয়সীদেরকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে।

২১. পিতামাতার উপর স্ত্রীকে প্রাধান্য দেওয়া: 
কোনো কোনো মানুষ তার পিতামাতার আনুগত্য করার চেয়ে তার স্ত্রী’র আনুগত্য করাটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে এবং স্ত্রীকে পিতামাতার উপর প্রাধান্য দেয়; এমনকি স্ত্রী যদি তার নিকট তার পিতামাতাকে তাড়িয়ে দিতে আবদার করে, তাহলে সে তাদেরকে তাড়িয়ে দিবে, যদিও তাদের কোনো আবাসিক ঠিকানা নেই।
আর আপনি কোনো কোনো ছেলে-সন্তানকে দেখবেন যে, সে তার পিতামাতার সামনে স্ত্রী’র জন্য মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা প্রকাশ করে এবং একই সময় তাকে দেখবেন যে, সে তার পিতামাতার প্রতি রূঢ় আচরণ করে, অথচ সে তাদের অধিকারের প্রতি কোনো লক্ষ্য রাখে না।
অচিরেই এই প্রসঙ্গে সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে বিস্তারিত বিবরণ আসবে।

২২. পিতামাতার প্রয়োজনের সময় অথবা বৃদ্ধ বয়সে তাদেরকে পরিত্যাগ করা: 
কেননা, পিতামাতা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং তাদের টাকা-পয়সা লাগে এমন কোনো কাজ দেখা দেয়, তখন কোনো কোনো সন্তান তাদের থেকে সরে যায় এবং নিজেকে নিয়ে বিশেষভাবে ব্যস্ত হয়ে যায়।

২৩. পিতামাতার দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকা এবং তাদের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা: 
আর এটা হল পিতামাতার অবাধ্যতার জঘন্য রূপ; কারণ, কোনো কোনো সন্তানকে দেখা যায়, সে যখন সামাজিকভাবে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন স্থানে উন্নিত হয় অথবা বড় রকমের চাকুরি পেয়ে যায়, তখন সে তার পিতামাতাকে স্বীকার করতে চায় না এবং তাদের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে চায়; আর সে তার ঘরের মধ্যে পুরাতন পোষাক-পরিচ্ছদে তাদের অবস্থান করাটাকে রীতিমত অপমানবোধ করে।
আবার কখনও কখনও তাদের ব্যাপারে তার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, তখন সে বলে দেয়: ওরা আমাদের চাকর-বাকর।
আবার কোনো কোনো সন্তান বিয়ে-সাদী ও সাধারণ অনুষ্ঠানসমূহে লজ্জায় তার পিতার নাম উচ্চারণ করার বিষয়টি এড়িয়ে চলে! আর এই ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট মন-মানসিকতা, দুর্বল বুদ্ধি, মর্যাদাহীনতা ও চরম অধৈর্যের প্রমাণ বহন করে। তবে পিতামাতাকে ভালোবাসে প্রেমিক ভদ্র মানুষ তার উৎসস্থল, প্রজন্ম ও মূলকে নিয়ে গৌরব বর্ণনা করে; আর ভদ্রজনেরা সুন্দরকে ভুলে যায় না। কবির ভাষায়:
" إن الكرام إذا ما أيسروا ذكروا
من كان يألفهم في المنزل الخشن".
(ভদ্রলোকেরা যখন স্বচ্ছল হয়ে যায়, তখন আলোচনা করে তারা
সেই জনদের, জীর্ণ কুঠিরে তাদেরকে আদর-সোহাগ করেছেন যারা)।

২৪. পিতামাতাকে প্রহার করা: 
বড় নিষ্ঠুর ও পাষাণ্ড হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া এই কাজ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়; এমন কাজ তারাই করতে পারে, যাদের হৃদয়ে মায়া-মমতা ও লজ্জা-শরমের ভালাই নেই এবং যাদের জীবনে ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব, গৌরব ও আত্মমর্যাদাবোধ নেই।

২৫. বার্ধক্য ও দেখাশুনা করার প্রয়োজনের সময় পিতামাতাকে ছেড়ে যাওয়া: 
আর এই কাজটি সীমাহীন নোংরামি এবং চরম ঘৃণিত ও মন্দ কাজ; যার ভয়াবহতা বা আতঙ্কে শরীর শিউরে উঠে এবং যার কথা শুনলে মাথার চুল দাঁড়িয়ে যায়; আর যে ব্যক্তি এই কাজ করবে, তার জীবনে কখনও ভাল কিছু হবে না।

২৬. পিতামাতা যখন কোনো অন্যায় কাজ করে ফেলে, তখন তারেকে পরিত্যাগ করা এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার না করা ও তাদের তাদের কল্যাণ কামনা না করা: 
আর এটা এক ধরনের ত্রুটি ও মূর্খতা; কারণ, পিতামাতা কাফির হলেও যেখানে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা ওয়াজিব (আবশ্যক), সেখানে তারা মুসলিম হওয়ার পরেও তাদের সাথে কিভাবে এরূপ ব্যবহার করা বৈধ হবে, না হয় তাদের কিছু ত্রুটি-বিচ্যূতি হয়েই গেল? !

২৭. পিতামাতার ব্যাপারে কার্পণ্য করা: 
সুতরাং কোনো কোন মানুষ এমন প্রকৃতির, যে তার পিতামাতার জন্য ব্যয় করার ক্ষেত্রে কার্পণ্য ও কমতি করে। আবার কখনও কখনও পিতামাতার সম্পদের খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে, এতদসত্ত্বেও তাদের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে করে না এবং তাদের প্রতি কোনো মনোযোগ দেয় না।

২৮. পিতামাতার প্রতি অবদানের খোটা দেওয়া ও বার বার গণনা করা: 
সুতরাং কোনো কোন মানুষ এমন, যে তার পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করে, কিন্তু সে খোটা ও কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে এটাকে নষ্ট করে ফেলে; আর এই ভালটাকে আরও নষ্ট করে ফেলে তাদের প্রতি তার অবদানের বিষয়টি বার বার গণনা করার দ্বারা এবং কারণে অকারণে এই সদ্ব্যবহারের কথা আলোচনা করার মাধ্যমে। 

২৯. পিতামাতার সম্পদ চুরি করা: 
আর এই কাজটি দু’টি হারাম কাজকে একত্রিত করে: চুরি ও অবাধ্যতা; সুতরাং মানুষের মধ্য থেকে এমন মানুষও দেখতে পাবেন, যার অর্থের প্রয়োজন হয় এবং এ প্রয়োজনিয়তা তাকে তার পিতামাতার সম্পদ চুরির দিকে নিয়ে যায়— হয় তাদের বার্ধক্যের কারণে, অথবা তাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে চুরির কাজটি সম্পন্ন হয়।
এ ধরনের চুরির অন্যতম একটি নমুনা হল— কেউ তার পিতামাতার সাথে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তার নিকট আবেদন করল যে, তিনি যাতে তাকে এই এই পরিমাণ সম্পদ অথবা জমি অথবা এ জাতীয় কিছু দেওয়ার ব্যাপারে স্বাক্ষর করে দেন। আবার কখনও কখনও সে তাদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এবং তার পাকাপোক্ত নিয়ত হল সে তা পরিশোধ করবে না।

৩০. পিতামাতার সামনে বিলাপ করা ও দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করা: 
আর এই কাজটি হল নিকৃষ্ট মানের অবাধ্যতার নমুনা; আর এটা এ জন্য যে, পিতামাতা — বিশেষ করে মা সন্তানের বিপদ-মুসিবতের কারণে অস্থির হয়ে পড়েন; তারা তার ব্যথায় ব্যথিত হন; এমনকি কখনও কখনও তারা তার চেয়ে বেশি ব্যথা অনুভব করেন।

৩১. বিনা প্রয়োজনে পিতামাতার অনুমতি ছাড়া দূরে কোথাও প্রবাসজীবনে চলে যাওয়া: 
কোনো কোনো সন্তান তার পিতামাতা থেকে দূরে চলে যাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপলব্ধি করতে পারে না; ফলে আপনি তাকে দেখতে পাবেন যে, সে তার পিতামাতার অনুমতি ছাড়াই তাদের থেকে দূরে প্রবাসজীবনে চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবীর করে, অথচ তার প্রবাসজীবনের কোনো প্রয়োজন নেই; আবার কখনও কখনও তার পিতামাতা যে শহরে বসবাস করেন কোনো কারণ ছাড়াই সে তা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়; আবার কখনও কখনও সে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে নিজ শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে যায়, অথচ এ ধরনের পড়ালেখা ঐ শহরেই সম্ভব, যেখানে তার পিতামাতা বসবাস করে; এগুলো ছাড়াও আরও অনেক কারণে সে প্রবাসে চলে যায়, যেসব কারণ তার এই প্রবাসজীবনকে বৈধ বলে অনুমোদন করে না।
আর সে জানে না যে, তার পিতামাতাকে ছেড়ে তার বিদেশে চলে যাওয়াটা তাদের পরিতাপ ও মনের অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; আবার সে এটাও জানে না যে, কখনও কখনও তার পিতামাতা উভয়ে অথবা তাদের কোনো একজন মারা যেতে পারে এমন অবস্থায় যে, সে তাদের থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে অবস্থান করছে; সুতরাং এ কারণে তাদের প্রতি আনুগত্য, সদ্ব্যবহার ও দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটবে।
তবে ছেলের যখন প্রবাসজীবনে যাওয়ার প্রয়োজন হবে এবং তার পিতামাতা থেকে সে ব্যাপারে অনুমতি নেয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই।

৩২. পিতামাতার মৃত্যু কামনা করা: 
কোনো কোনো সন্তান তার পিতামাতার মৃত্যু কামনা করে, যাতে সে তাদের সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারে, যদি তারা সম্পদশালী হন, অথবা যাতে তাদের থেকে মুক্তি পেতে পারে, যদি তারা অসুস্থ হন বা দরিদ্র হন অথবা সে যাতে মুক্তি পেতে পারে তাদের সেবা-যত্ন করা থেকে এবং তাদের মুখোমুখি অবস্থান করা থেকে— যাতে সে তার ভ্রষ্টতা ও মূর্খতার মধ্যে মনের সুখে দিনকাল অতিবাহিত করতে পারে।

৩৩. পিতামাতাকে হত্যা করা এবং তাদের থেকে মুক্তি পাওয়া: 
কখনও কখনও এমন হতভাগ্য ছেলে-সন্তানও পাওয়া যায়, যে তার পিতামাতার কোনো একজনকে হত্যার জন্য অগ্রসর হয়; হয় প্রচণ্ড মূর্খতার কারণে, অথবা ক্রোধের উত্তেজনার কারণে, অথবা মাতাল অবস্থায় থাকার কারণে, অথবা সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার আশায়, অথবা এগুলো ভিন্ন অন্য কোনো কারণে।
হে দুর্ভাগা! হে কালো মুখওয়ালা! হে মন্দ পরিনাম ও পরিণতির অধিকারী! যদি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রহমত দ্বারা তাকে সংশোধন না করেন, (তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ)।
এ হল পিতামাতার অবাধ্যতার কিছু বাহ্যিক চিত্র ও রূপ-প্রকৃতি; এটা ঘৃণ্য কাজ ও দূষিত কর্মপন্থা, যা জ্ঞানীদের জন্য মানানসই নয় এবং যা তাকওয়া, সততা ও সঠিক পথের অধিকারী ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে সংঘটিত হতে পারে না।
সুতরাং পিতামাতার অবাধ্য সন্তান থেকে কল্যাণ বহু দূরে, শাস্তি তার অতি নিকটে এবং অকল্যাণ তার দিকে দ্রুত ধাবমান।
আর এই বিষয়টি চাক্ষুষ অনুভবযোগ্য, অনেক মানুষ তা জানে এবং তারা তাদের নিজ চোখে তা প্রত্যক্ষ করে; আর তারা একের পর এক ঐসব মানুষের কাহিনী শুনে, যারা তাদের পিতামাতার সাথে অবাধ্য আচরণের কারণে লাঞ্ছিত, অপদস্থ ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে।   
* * *


অবাধ্যতার নমুনা কাহিনী

১. আসমা‘য়ী বলেন: “আমাকে আরবের কেউ কেউ সংবাদ দিয়েছেন যে, আবদুল মালেক ইবন মারওয়ান-এর যামানায় এক ব্যক্তি ছিল এবং তার ছিল এক বৃদ্ধ পিতা; আর যুবকটি ছিল তার পিতার অবাধ্য এবং ঐ যুবকটিকে বলা হত ‘মানাযিল’। অতঃপর এক পর্যায়ে বৃদ্ধ পিতা বলেন:
جَزَتْ رحمٌ بيني وبينَ منازلٍ * جزاءً كما يستنجزُ الدَّينَ طالبُه
(আমার ও মানাযিলের মাঝে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তার পরিণাম হচ্ছে
 যেমনিভাবে ঋণের দাবিদার ঋণ পূর্ণ করতে চায়)।
تَرَبَّت حتى صار جعدًا شمردلًا * إذا قام ساوى غاربَ الفحلِ غاربُه
(সে বেড়ে উঠেছে এমনকি সে লম্বা শক্তিশালী যুবকে পরিণত হয়েছে,
যখন সে দাঁড়ায়, তখন তার কাঁধ শক্তিশালী পুরুষের কাঁধ সমান হয়ে যায়)।
تظلَّمني مالي كذا ولوى يدي * لوى يدَه اللهُ الذي لا يغالبُه
(সে আমাকে আমার এ রকম সম্পদ ছাড়া করেছে এবং আমার হাত বাঁকা করে দিয়েছে,
ঐ আল্লাহ তার হাত বাঁকা করে দিবেন, যাঁকে সে পরাজিত করতে পারবে না)।
وإني لداعٍ دعوةً لو دعوتُها * على جبل الريان لانْهَدَّ جانِبُه
(আর আমি (তার জন্য) এমন বদদোআ করব, যদি সেই বদদোআ আমি করি
রাইয়ান পর্বতের জন্য, তাহলে তার পার্শ্ব ধ্বসে পড়ে যেত)।
এ সংবাদ তাদের বাদশা’র নিকটে পৌঁছে; তারপর তিনি যুবককে ধরে নিয়ে আসার জন্য দূত প্রেরণ করলেন; অতঃপর তাকে তার বৃদ্ধ পিতা বলল: তুমি ঘরের পিছনের দিক দিয়ে বের হয়ে চলে যাও; ফলে সে বাদশা’র দূতের আগে আগে চলে গেল এবং বাদশার পাকড়াও থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু এ মানাযিল যুবকটি তার শেষ জীবনে তার এক অবাধ্য ছেলের দ্বারা কষ্টকর পরিস্থিতির শিকার হল; ছেলেটির নাম ‘খালিজ’। অতঃপর সে (মানাযিল) বলল:
تظلمني مالي خليجٌ وعقني * على حين كانت كالحَنيِّ عظامي
(খালিজ আমাকে আমার সম্পদ ছাড়া করেছে এবং সে আমার অবাধ্য হয়েছে
এমন এক সময়, যখন আমার হাড্ডি ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেছে)।
تخيَّرتُه وازددته ليزيدني * وما بعضُ ما يزدادُ غيرُ عرامِ
(আমি তাকে পছন্দ করেছি এবং তাকে বেশি বেশি দিয়েছি, যাতে সে আমার প্রতি বেশি যত্নবান হয়, অথচ কিছু অসুবিধা ও দুঃখ-কষ্ট ছাড়া আর তেমন কিছু বাড়েনি)।
لعمري لقد ربَّيته فرحًا به * فلا يفرحنْ بعدي امرؤٌ بغلامِ
(আমার জীবনের কসম! আমি তার প্রতি খুশি হয়েই তাকে লালন-পালন করেছি,
সুতরাং আমার পরে কোনো ব্যক্তিই যেন ছেলেকে নিয়ে এত খুশি না হয়)।
অতঃপর শাসনকর্তা তাকে (ছেলেটিকে) মারতে চাইল; তখন ছেলেটি শাসনকর্তাকে বলল: আমাকে মারার ব্যাপারে এত তাড়াহুড়ো করবেন না; এই হলেন (আমার পিতা) মানাযিল ইবন ফার‘আন, যার ব্যাপারে তার পিতা বলেছিলেন:
جَزَتْ رحمٌ بيني وبينَ منازلٍ * جزاءً كما يستنجزُ الدَّينَ طالبُه
(আমার ও মানাযিলের মাঝে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তার পরিণাম হচ্ছে
 যেমনিভাবে ঋণের দাবিদার ঋণ পূর্ণ করতে চায়)।
অতঃপর শাসনকর্তা বলল: হে এই তুমি! তুমি তোমার পিতার সাথে অবাধ্য আচরণ করেছ; আর তাই আজ তোমার সাথেও অবাধ্য আচরণ করা হয়েছে।”[15]
২. আরেক ব্যক্তি তার চরম দুঃখ ও কষ্টের অভিযোগ করে এবং তার অবাধ্য সন্তানকে তিরস্কার করে বলেন: 
غَذَوْتُك مَوْلُودًا وَمُنْتُكَ يَافِعًا * تَعُلُّ بِمَا أَجْنِي عَلَيْك وَتَنْهَلُ
(আমি তোমাকে শিশু অবস্থায় খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তোমার ব্যয়ভার বহন করেছি,
আমি তোমার জন্য যা উপার্জন করেছি, তা আমাকে দুর্বল ও ক্লান্ত করে দিয়েছে)।
إذَا لَيْلَةٌ نالتْك بالشكوِ لَمْ أَبَتْ * لِشكواك إلَّا سَاهِرًا أَتَمَلْمَلُ
 (যখন কোনো রাত্রে তুমি অসুস্থ হয়ে যেতে, তখন আমি রাত্রি যাপন করেছি
তোমার অসুস্থতার কারণে বিনিদ্র অবস্থায় বিছনায় গড়াগড়ি দিয়ে)।
كَأَنِّي أَنَا الْمَطْرُوقُ دُونَك بِاَلَّذِي * طَرَقْت بِهِ دُونِي فَعَيْنِي تُهْمِلُ
(সে কাঁটা যেন তোমাকে নয় আমাকেই আঘাত করেছে,
ফলে আমার চোখ অশ্রু বর্ষণ করেছে)।
تَخَافُ الرَّدَى نَفْسِي عَلَيْك وَإِنَّهَا * لَتَعْلَمُ أَنَّ الْمَوْتَ وقتٌ مُؤجلُ
(আমার মন তোমার ব্যাপারে ধ্বংসের আশঙ্কা করেছিল, যদিও সে
জানত যে, মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়েই হবে)।
فَلَمَّا بَلَغْت السِّنَّ وَالْغَايَةَ الَّتِي * إلَيْها مدى ما كُنْت  فِيك أُؤَمِّلُ
 (অতঃপর তুমি যখন এমন বয়স ও গন্তব্যে পৌঁছে গেছ, যে পর্যন্ত যেখানে পৌঁছার আশা আমি তোমার জন্য করেছি)
جَعَلْت جَزَائِي غِلْظَةً وَفَظَاظَةً* كَأَنَّك أَنْتَ الْمُنْعِمُ الْمُتَفَضِّلُ
(তুমি আমার পুরস্কার নির্ধারণ করেছ কঠোরতা ও অভদ্রতা,
মনে হয় যেন তুমি অনুগ্রহশীল ও দানশীল)।
فَلَيْتُك إن لَمْ تَرْعَ حَقَّ أُبُوَّتِي * فَعَلْت كَمَا الْجَارُ الْمُجَاوِرُ يَفْعَلُ
(হায়রে তুমি! যদি তুমি পিতামাতার অধিকার সংরক্ষণ নাই করতে পার,
তাহলে তুমি এমন আচরণ করতে, যেমন আচরণ প্রতিবেশী তার প্রতিবেশী’র সাথে করে)। 
فَأَوْلَيْتَنِي حَقَّ الْجِوَارِ وَلَمْ تَكُنْ * عَلَيَّ بِمَالي دُونَ مَالِك تَبْخَلُ
(সুতরাং তুমি আমাকে প্রতিবেশিত্বের অধিকার প্রদান করেছে, অথচ তুমি
তোমার সম্পদ ছাড়া শুধু আমার সম্পদ দ্বারাই আমার উপর কৃপণতা করছ)।
تراه مُعِدًا للخلاف كأنه* بردٍّ على أهل الصواب موكَّلُ .
(তুমি তাকে দেখতে পাবে— সে যেন বিরোধিতার জন্যই তৈরী হয়েছে; মনে হয় যেন তাকে
দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সত্যপন্থীদের প্রত্যাখ্যান করার জন্য)।[16]
৩. ডক্টর মুহাম্মদ আস-সাব্বাগ বলেন: “আমি শুনেছি যে, অধঃপতিত পথভ্রষ্ট এক ছেলে তার পিতাকে বৃদ্ধাশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেছে, যাতে সে তাকে কষ্ট দিতে না পারে অথবা তার স্ত্রীকে বিরক্ত করতে না পারে।”[17]
৪. অধ্যাপক আবদুর রউফ আল-হানাভী র. বলেন: “আমার এক নিকটাত্মীয় ছিল, তার জন্য তার পিতা অনেক নগদ স্বর্ণ, উপকারী মালামাল ও বহু জমি রেখে গিয়েছিলেন; আর সে ছিল ব্যবসায়ী দলের অন্যতম একজন; কোনো একদিন তার উপর তার মাতা ক্ষুব্ধ হলেন এবং তার জন্য তিনি কঠিনভাবে একবার বদদোআ করলেন; আর যখন তার বদদো‘আর কারণে তার ক্ষতি অবধারিত হয়ে গেল, তখন সে ফকীর অবস্থায় মারা গেল; অথচ সে কখনও অশ্লীল ও হারাম পথে চলেনি।
আর আমার পিতা (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন) তাকে দান-সাদকা করতেন এবং আমাদের বাড়ি থেকে আমাকে খাবার নিয়ে তার নিকট এবং তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিকট পাঠাতেন।”[18]
* * *


অবাধ্যতার কারণ

পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে, তন্মধ্যে কতগুলো কারণ নিম্নরূপ:

১. অজ্ঞতা ও মূর্খতা: 
কেননা, মূর্খতা হল প্রাণ বিধ্বংসী ব্যাধি; আর মূর্খব্যক্তি তার নিজ জীবনের শত্রু; সুতরাং যখন কোনো ব্যক্তি মাতাপিতার অবাধ্যতার ইহকালীন ও পরকালীন খারাপ পরিণতির কথা না জানে এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ইহকালীন ও পরকালীন সুফলের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকে, তখন এই অজ্ঞতা ও মূর্খতা তাকে অবাধ্যতার দিকে পরিচালিত করে এবং সদ্ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখে।

২. কুশিক্ষা: 
কেননা, পিতামাতা যখন তাদের সন্তানদেরকে তাকওয়া (আল্লাহভীতি), উত্তম আচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও উচ্চ মর্যাদা অনুসন্ধানের বিষয়ে শিক্ষা না দিবে, তখন এটা তাদেরকে ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতার দিকে নিয়ে যাবে।

৩. অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ: 
এটা হল পিতামাতা যখন সন্তানকে কোনো (ভালো) বিষয়ে শিক্ষা দেয়, অথচ তারা তাদের প্রদত্ত শিক্ষা অনুযায়ী আমল করে না, বরং এর বিপরীত কাজ করে, তখন এই বিষয়টি ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতার উপলক্ষ হয়ে উঠে।

৪. সন্তানদের অসৎ সঙ্গ: 
এটা এমন একটি কারণ, যা সন্তানদেরকে নষ্ট করে ফেলে এবং তাদেরকে পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার ব্যাপারে দুঃসাহস যোগায়। যেমনিভাবে তা পিতামাতার প্রতি অত্যাচার ও নির্দয় ব্যবহার করতে উস্কানি দেয় এবং সন্তানদেরকে সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের প্রভাব ঐতিহ্যকে দুর্বল করে দেয়।

৫. পিতামাতা কর্তৃক তাদের পিতামাতার অবাধ্যতার কারণে সন্তান কর্তৃক তাদের অবাধ্যতা: 
এটা হল অবাধ্য হওয়ার আবশ্যকীয় কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ; কেননা, যখন পিতামাতা তাদের পিতামাতার সাথে অবাধ্য আচরণ করে থাকে, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের সন্তানদের অবাধ্যতা দ্বারা শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে; আর এটা দুইভাবে হয়ে থাকে—
প্রথমত: সন্তানগণ অবাধ্য আচরণ করার ক্ষেত্রে তাদের পিতামাতার অনুসরণ করে।
দ্বিতীয়ত: একই রকম কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিদান পাওয়া। 

৬. বিবাহ বিচ্ছেদ অবস্থায় আল্লাহর ভয়ের কমতি: 
কেননা, কোনো কোনো পিতামাতার মাঝে যখন বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে, তখন তারা এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না এবং তাদের মধ্যকার বিবাহ বিচ্ছেদের কাজটি উত্তম পদ্ধিতিতে সম্পাদন হয় না।
বরং দেখা যায়, তাদের প্রত্যেকে একে অপরের বিরুদ্ধে সন্তানদেরকে উত্তেজিত করে তোলে; কেননা, তারা যখন মায়ের কাছে যায়, তখন সে তাদের পিতার দোষ-ত্রুটি চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে তার সাথে কথা না বলতে ও তাকে এড়িয়ে চলতে উপদেশ দেয়; আর অনুরূপভাবে তারা যখন পিতার কছে যায়, তখন সে তাদের মায়ের মত একই কাজ করতে বলে।
ফলে সন্তানেরা পিতামাতা সকলেরই অবাধ্য হয়ে উঠে; আর এই অবাধ্য হয়ে উঠার পিছনে পিতামাতা উভয়ে দায়ী, যেমনটি আবূ যুয়াইব আল-হুযালী বলেন: 
فلا تغضبَنْ في سيرةٍ أنت سرتَها * وأول راضٍ سُنَّةً من يسيرها
(সুতরাং তুমি এমন আচরণের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ো না, যে আচরণ তুমি করেছ,
আর তুমি এ পথে চলতে প্রথম পছন্দ করেছিলে)।

৭.সন্তানদের মাঝে বিভেদ: 
কেননা, এ কাজটি সন্তানদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার জন্ম দেয়, ফলে তাদের আত্মা কলুষিত হয় এবং এটা তাদেরকে পিতামাতার প্রতি ঘৃণা পোষণ ও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার দিকে নিয়ে যায়। 

৮. সুখ-শান্তি ও আবেগকে অগ্রাধিকার দেওয়া: 
কারণ, কোনো কোনো মানুষের নিকট যখন বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতামাতা বিদ্যমান থাকে, তখন সে তার ধারণা ও বিশ্বাস অনুযায়ী নিজের সুখ-শান্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তাদের থেকে মুক্তি পেতে চায়— হয় তাদেরকে অক্ষম অবস্থায় ছেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে, অথবা তাদেরকে বাড়িতে রেখে অন্য কোথাও বসবাস করার মাধ্যমে, অথবা অন্য কোনোভাবে; অথচ সে জানে না যে, তার সুখ-শান্তি নিহিত রয়েছে তার পিতামাতার সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থান ও তাদের সেবা-যত্ন করার মধ্যে।

৯. সঙ্কীর্ণ মানসিকতা: 
কেননা, কিছু কিছু সন্তান সঙ্কীর্ণ মানসিকতার হয়ে থাকে; ফলে সে চায় না যে, তার ঘরে কেউ সার্বক্ষণিক অবস্থান ও চলাফেরা করুক; সুতরাং সে যখন একটা গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে, অথবা ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট করে, তখন সে এ কারণে ভীষণভাবে রেগে যায় এবং ঘরকে সোজাসুজি আগের অবস্থায় ফিরেয়ে নিয়ে যায়। আর এটা পিতামাতাকে কষ্ট দেয় এবং তাদের হৃদ্যতাকে নষ্ট করে দেয়।
অনুরূপভাবে আপনি কোনো কোনো সন্তানকে দেখতে পাবেন যে, সে তার পিতামাতার আদেশ-নিষেধ পালন করতে বিরক্তি প্রকাশ করে, বিশেষ করে পিতামাতা উভয়ে অথবা কোনো একজন যখন রূঢ় ও কঠোর প্রকৃতির হয়, তখন আপনি দেখতে পাবেন যে, সন্তান তাদের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নেয় এবং তাদের জন্য তার হৃদয়কে উদার করে দেয় না।

১০. সন্তানদেরকে সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারে পিতামাতা কর্তৃক সহযোগিতার কমতি: 
কোনো কোনো পিতামাতা সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারে তাদের সন্তানদেরকে সহযোগিতা করে না এবং তারা যখন ইহসান তথা ভাল ব্যবহার করে, তখন তারা তাদেরকে সুন্দর আচরণের জন্য উৎসাহিত করে না। বস্তুত পিতামাতার অধিকারের বিষয়টি অনেক বড় বিষয় এবং এই অধিকার আদায় করা সকল অবস্থায় ওয়াজিব। কিন্তু সন্তানগণ যখন পিতামাতার পক্ষ থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনা, দো‘আ ও সহযোগিতা না পায়, তখন অনেক সময় তারা বিরক্তিবোধ করে এবং পিতামাতার সাথে ভাল ব্যবহার করা ছেড়ে দেয় অথবা এই ক্ষেত্রে কমতি করে।

১১. স্ত্রীর দুশ্চরিত্র: 
কখনও কখনও মানুষ তার মন্দ চরিত্রের অধিকারী স্ত্রীর দ্বারা বিপদগ্রস্ত হয়, সে আল্লাহকে ভয় করে না এবং কারও অধিকার সংরক্ষণ করে না; কারণ সে তার (স্বামীর) গণ্ডিতে মানসিক কষ্টে থাকে; ফলে আপনি তাকে দেখতে পাবেন যে, সে তার স্বামীকে তার পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার জন্য অথবা তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য অথবা তাদের প্রতি ইহসান তথা উত্তম ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে, যাতে তার স্বামীর দ্বারা তার পরিবেশ ঝামেলামুক্ত হয়ে যায় এবং নিজেকে শুধু স্বামীর জন্য নির্দিষ্ট করে নিতে পারে।

১২. পিতামাতার কষ্ট অনুভবের কমতি: 
ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা পিতার খোজ-খবর নেয় না; আর মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা মাতার খোজ-খবর রাখে না; ফলে এমতাবস্থায় আপনি দেখতে পাবেন যে, সে তার পিতামাতার প্রতি কোনো খেয়ালই রাখে না, চাই যখন সে রাতের বেলায় বাসায় আসতে বিলম্ব করুক, অথবা সে যখন তাদের থেকে দূরে থাকে, অথবা সে (সরাসরি) তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করে।
এ হল কতগুলো কারণ, যা পিতামাতার অবাধ্য হওয়ার দিকে ধাবিত করে।
* * *


প্রতিকারের উপায়

আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি পিতামাতার মহান হক সম্পর্কে, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারে উৎসাহ দান ও তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্কীকরণ প্রসঙ্গে; আরো আলোচনা হয়েছে পিতামাতার অবাধ্যতার কিছু বাহ্যিক রূপ, চিত্র, কাহিনী ও কারণ প্রসঙ্গে।
বিষয়টি যখন এই রকম, তখন প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য উচিত হবে তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মনে প্রাণে আগ্রহী হওয়া এবং তাদের সাথে অসদ্ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা— এই আশায় যে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট অনেক সাওয়াবের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এই ভয়ে যে, তাঁর নিকট ইহকালে ও পরকালে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
জানা দরকার— পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার বলতে কী বুঝায়? আর তাদের সাথে কী ধরনের আদব (শিষ্টাচার) রক্ষা করে চলা উচিত? আর সদ্ব্যবহারে সহায়ক কর্মকাণ্ডসমূহ কী কী?
* * *

পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের পরিচয়

পিতামাতার বাধ্য বা অনুগত হওয়া বলতে বুঝায়, অবাধ্য না হওয়া। কুরআনে কারীমে সেটাকে  " البر "বলা হয়েছে। অর্থ বাধ্য বা অনুগত হওয়া, সদ্ব্যবহার করা;
ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৎকর্মশীল বলে নামকরণ করেছেন এই জন্য যে, তারা পিতামাতা ও সন্তানদের সাথে সদ্ব্যবহার করেছেন। তিনি আরও বলেন: যেমনিভাবে তোমার সন্তানের উপর তোমার অধিকার রয়েছে, ঠিক অনুরূপভাবে তোমার উপরও তোমার সন্তানের অধিকার রয়েছে।[19]
* * *

পিতামাতার সাথে আচার-আচরণের লক্ষণীয় দিক

এখানে কতগুলো আদব বা শিষ্টাচারের বিষয় রয়েছে, যেগুলো আমাদের জন্য মেনে চলা উচিত এবং পিতামাতার সাথে সে অনুযায়ী আচরণ করলে আমাদের জন্য তা যথাযথ হবে; আমরা আশা করতে পারি যে, আমরা তাদের কিছু ঋণ পরিশোধ করতে পারব এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাদের উপর তাদের ব্যাপারে যা ওয়াজিব (আবশ্যক) করে দিয়েছেন তার কিছু হলেও বাস্তবায়ন করতে পারব— যাতে আমরা আমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে খুশি করতে পারি, আমাদের হৃদয় উদার ও প্রশস্ত হয়, আমাদের জীবন পবিত্র হয়, আমাদের কর্মকাণ্ডসমূহ সহজ হয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হায়াতে (জীবনকালে) বরকত দান করেন।[20]
সে আদব তথা শিষ্টাচার সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের মধ্য থেকে কিছু বিষয় নিম্নরূপ[21]

১. পিতামাতার আনুগত্য করা ও তাদের সাথে অবাধ্য আচরণ থেকে বিরত থাকা: 
মুসলিম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল, তার পিতামাতার আনুগত্য করা এবং তাদের সাথে অবাধ্য আচরণ করা থেকে বিরত থাকা; আর তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ না দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সকল মানুষের আনুগত্যের উপর তাদের আনুগত্য করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, তবে স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর আনুগত্যের বিষয়টি ভিন্ন; কারণ, সে তার পিতামাতার আনুগত্যের উপর তার স্বামীর আনুগত্য করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিবে।

২. তাদের সাথে উত্তম আচরণ করা: 
কথায়, কাজে ও সামগ্রিক বিষয়ে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।

৩. বিনয় ও নম্রতার ডানা বিছিয়ে দেওয়া: 
আর এটা সম্ভব হবে তাদের প্রতি বিনয়, নম্রতা, কোমলতা প্রকাশ করার মাধ্যমে।

৪. তাদেরকে ধমক দেওয়া থেকে দূরে থাকা: 
আর এটা সম্ভব হবে নরম সুরে ডাকা ও কোমল ভাষায় কথা বলার মাধ্যমে; আর তাদেরকে ধমক দেওয়া ও তাদের সাথে উচ্চঃস্বরে কথা বলা থেকে সর্বোচ্চ সজাগ ও সতর্কতা অবলম্বন করা।

৫. তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা: 
আর এটা সম্ভব হবে যখন তারা কথা বলবেন, তখন সামনাসামনি হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনা এবং কথা বলার সময় তাদের সাথে কথা কাটাকাটি বা তর্ক-বিতর্ক পরিহার করা; আর তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা থেকে অথবা তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করা থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।

৬. তাদের নির্দেশে খুশি হওয়া এবং তাদের কারণে রাগ ও দুঃখ প্রকাশ পরিহার করা: 
যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا ﴾ [الاسراء: ٢٣]
“তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না[22]

৭. তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা: 
আর এটা হবে হাসি-খুশি ও অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে তাদের মুখোমুখি হওয়া এবং ভ্রূকুটিপূর্ণ কঠোর দৃষ্টি ও কপাল ভাঁজ করে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা থেকে দূরে থাকা।

৮. তাদের প্রতি ভালবাসা ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করা: 
যেমন— তাদেরকে আগে আগে সালাম প্রদান করা, তাদের হাত ও মাথায় চুম্বন করা, মাজলিসে তাদের জন্য জায়গা প্রশস্ত করে দেওয়া, তাদের আগে খাবারের দিকে হাত বাড়িয়ে না দেওয়া, দিনের বেলায় তাদের পিছনে পিছনে হাঁটা এবং রাতের বেলায় তাদের সামনে হাঁটা— বিশেষ করে রাস্তা যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন বা ভয়ঙ্কর হয়; আর রাস্তা পরিষ্কার, উজ্জ্বল ও নিরাপদ হলে তাদের পিছনে হাঁটাতে কোনো দোষ নেই।

৯. তাদের সামনে আদব ও সম্মান রক্ষা করে বসা: 
আর এটা হবে সঠিকভাবে বসার মাধ্যমে এবং এমনভাবে বসা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে যা নিকট থেকে বা দূর থেকে তাদের প্রতি অপমান করা হয় বলে অনুভব হয়, যেমন— পা বাড়িয়ে দিয়ে বসা, অথবা তাদের উপস্থিতিতে অট্টহাসি হাসা, অথবা হেলান দিয়ে বসা, অথবা বিবস্ত্র হওয়া, অথবা তাদের সামনে অশ্লীল আচরণ করা, অথবা এগুলো ছাড়া অন্য এমন কোনো আচরণ করা যা তাদের সাথে পরিপূর্ণ শিষ্টাচার পরিপন্থী আচরণ বলে গণ্য। 

১০. সেবা অথবা কোনো অবদানের ক্ষেত্রে খোঁটা পরিহার করা: 
কারণ, খোঁটা সকল অনুগ্রহ বা অবদানকে ধ্বংস করে দেয়; আর এটা মন্দ চরিত্রের অংশবিশেষ, আর এটা যখন হয় পিতামাতার অধিকারের ক্ষেত্রে, তখন তার খারাপি আরও বেড়ে যায়। 
সুতরাং সন্তানের আবশ্যকীয় করণীয় হল সাধ্যানুসারে তার পিতামাতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কমতি বা ঘাটতি হলে তা স্বীকার করে নেওয়া; আর তার পিতামাতার অধিকার পূরণে সক্ষম না হলে অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া।

১১. মায়ের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া: 
এ বিষয়টিও লক্ষ্য রাখা দরকার যে, পিতার আনুগত্য, তার প্রতি সহানুভূতি ও ইহসান করার উপর মাতার আনুগত্য, তার প্রতি সহানুভূতি ও ইহসান করার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে; আর এটা এই জন্য যে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে এসেছে, তিনি বলেন:
« جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِى ؟ قَالَ : « أُمُّكَ » . قَالَ : ثُمَّ مَنْ ؟ قَالَ : « ثُمَّ أُمُّكَ » . قَالَ ثُمَّ مَنْ ؟ قَالَ : « ثُمَّ أُمُّكَ » . قَالَ ثُمَّ مَنْ ؟ قَالَ : « ثُمَّ أَبُوكَ » . ( رواه البخاري و مسلم ) .
“এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞাসা করল: হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন: তোমার মা। লোকটি জিজ্ঞাসা করল: তারপর কে? তিনি বললেন: তারপর তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল: তারপর কে? তিনি বললেন: তারপর তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল: তারপর কে? তিনি বললেন:  তারপর তোমার পিতা।[23]
ইবনু বাত্তাল র. এই হাদিসের ব্যাখ্যা করার সময় বলেন: “তার দাবি হল, মাতার জন্য পিতার তিন গুণ পরিমাণ সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার থাকবে; তিনি বলেন: আর এটা গর্ভধারণের কষ্ট, অতঃপর প্রসব বেদনার কষ্ট এবং তারপর দুধ পান করনোর কষ্টের জন্য; কেননা, এই কষ্টগুলো এককভাবে মা করে থাকেন; অতঃপর পিতা লালনপালন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মায়ের সাথে অংশগ্রহণ করেন।[24]
কখনও কখনও বলা হয়: মাতাকে সদ্ব্যবহার, ইহসান ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে প্রাধান্য ও মর্যাদা দেওয়া হবে; আর আনুগত্যের ক্ষেত্রে পিতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে; কারণ, পিতা হলেন ঘরের কর্তা ও নৌকার মাঝি।

১২. কাজের ক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করা: 
সুতরাং কোনো সন্তানের জন্য শোভনীয় নয় যে, তার পিতামাতা কাজ করবেন, আর সে তাদের সহযোগিতা না করে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে।

১৩. তাদেরকে বিরক্ত করা থেকে দূরে থাকা: 
চাই তারা যখন ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন, তখন বিরক্ত করা হউক, অথবা হৈচৈ ও উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ করে তাদেরকে বিরক্ত করা হউক, অথবা কোনো দুঃসংবাদ দেওয়ার মাধ্যমে, অথবা এগুলো ভিন্ন অন্য কোনো ধরনের বিরক্তিকর কিছু দ্বারা বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকা।

১৪.  তাদের সামনে তর্ক-বিতর্ক করা ও ঝগড়া-বিবাদের উস্কানি দেওয়া থেকে বিরত থাকা: 
আর এটা সম্ভব হবে ভাই-বোন ও পরিবারের লোকজনের সাথে সাধারণভাবে তাদের (পিতামাতার) দৃষ্টির আড়ালে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা।

১৫. তাদের ডাকে দ্রুত সাড়া দেওয়া: 
মানুষ ব্যস্ত থাকুক অথবা অবসর থাকুক— সর্বাবস্থায় কর্তব্য হচ্ছে, পিতামাতার ডাকে দ্রুত সাড়া দেওয়া। কারণ, কোনো কোনো মানুষকে যখন তার পিতামাতার কোনো একজন ডাকে এবং সে তখন ব্যস্ত থাকে, তখন সে এমন ভাব প্রকাশ করে যে, সে কোনো আওয়াজই শুনেনি, আর যদি অবসর থাকে, তবে সে তাদের ডাকে সাড়া দেয়। কবির ভাষায়:
أصمٌّ عن الأمر الذي لا أريده * وأسْمع خلقِِِ الله حين أريدُ
(যা আমি শুনতে চাই না তা শোনার ব্যাপারে আমি বধির,
আর যখন আমি শুনতে চাই তখন আমি আল্লাহর সবচেয়ে অধিক শ্রোতা বান্দা।
সুতরাং সন্তানের জন্য শোভনীয় হল, পিতামাতার ডাক শোনা মাত্রই তাদের ডাকে সাড়া দেওয়া।

১৬. সন্তানদেরকে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে অভ্যস্থ করা: 
আর এটা সম্ভব হবে ব্যক্তিকে তাদের জন্য আদর্শ নমুনা হওয়ার মাধ্যমে; আর সে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করবে তার সন্তানসমষ্টি ও তার পিতামাতার মাঝে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য। 

১৭. পিতামাতার মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হলে তাদের মাঝে শান্তিপূর্ণ সমাধান করে দেওয়া: 
কেননা, অনেক সময় পিতামাতার মাঝে যখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তখন তাদের মাঝে সম্পর্কের উন্নতি ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করার জন্য সন্তানগণ ভালো ভূমিকা নিতে পারে এবং তারা যখন কোনো বিষয়ে মতবিরোধ করবে, তখন সন্তানগণ চাইবে তাদের মধ্যকার দৃষ্টিভঙ্গিকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে। 

১৮. তাদের নিকট প্রবেশ করার সময় অনুমতি প্রার্থনা করা: 
কারণ, তাঁরা উভয়ে অথবা তাঁদের কোনো একজন এমন অবস্থায় থাকেন, যে অবস্থায় তাঁকে কেউ দেখুক তিনি তা পছন্দ করেন না।

১৯. তাদেরকে সবসময় আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া: 
আর এটা হবে দীনের বিষয়ে তারা যা জানে না, তা তাদেরকে শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে; আর তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশনা প্রদান করবে এবং অসৎকাজ থেকে বারণ করবে, যখন তাদের মাঝে কোনো প্রকার অন্যায় ও পাপকর্মের বাহ্যিক রূপ পরিলক্ষিত হবে, তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বোচ্চ বিনয়-নম্রতা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে; আর তাদের ব্যাপারে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিবে, যখন তারা তা গ্রহণ না করবে। 

২০. তাদের থেকে অনুমতি গ্রহণ করা এবং তাদের মতামত চাওয়া: 
চাই বন্ধুবান্ধবের সাথে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে হউক, অথবা দেশের বাইরে পড়ালেখা বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে সফর করার ব্যাপারে হউক, অথবা জিহাদের জন্য যাওয়ার ব্যাপারে হউক, অথবা ঘর থেকে বের হওয়া ও ঘরের বাইরে বসবাস করার ব্যাপারে হউক; সুতরাং তারা যদি অনুমতি দেন, তাহলে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবে; আর অনুমতি না দিলে নিজের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় বর্জন করবে, বিশেষ করে যখন তাদের অভিমতের যুক্তিসংগত কারণ থাকে, অথবা তা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত হয়ে থাকে।

২১. তাদের সুনাম রক্ষা করা: 
আর এটা সম্ভব হবে ভালদের সাথে মিশার মাধ্যমে এবং মন্দদের থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে; আর সন্দেহজনক স্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার মাধ্যমে।

২২. তাদের নিন্দা করা ও মনে আঘাত দেওয়া থেকে দূরে থাকা: 
আর এটা হল যখন তাদের থেকে এমন কোনো কাজ হয়, যা সন্তান পছন্দ করে না, (তখন তাদেরকে তিরস্কার না করা এবং তাদের মনে আঘাত না দেওয়া) যেমন— লালনপালন ও শিক্ষার ব্যাপারে তাদেরকে খাট করা; অতীতে তাদের পক্ষ থেকে ঘটেছে এমন কাজের কথা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যা তারা শুনতে পছন্দ করেন না।  

২৩. তারা নির্দেশ না দিলেও এমন কাজ করা, যা তাদেরকে আনন্দ দেয়: 
যেমন— ভাই-বোনের দেখাশুনা করা, অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলা, অথবা ঘর গোছানো বা কৃষি ক্ষেতের পরিচর্যা করা, অথবা উপহার দেওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করা, অথবা এই জাতীয় কোনো কাজ করা, যা তাদেরকে আনন্দ দেয় এবং তাদের অন্তরে খুশির সঞ্চার করে।

২৪. তাদের স্বভাব ও মেজাজ বুঝা এবং সেই অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করা: 
সুতরাং তারা যখন উভয়ে অথবা তাদের কোনো একজন খুব রাগী বা কঠোর স্বভাবের হয়, অথবা যে কোনো প্রকারের অপছন্দনীয় গুণের অধিকারী হয়, তখন সন্তানের জন্য যথাযথ কর্তব্য হল, তার পিতামাতার মধ্যকার ঐ স্বভাবকে ভালভাবে অনুধাবন করা এবং তাদের সাথে উচিত মত ব্যবহার করা।

২৫. তাদের জীবদ্দশায় তাদের জন্য বেশি বেশি দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা: 
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [الاسراء:  ٢٤]
আর বলো: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।[25]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নূহ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন:
﴿ رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيۡتِيَ مُؤۡمِنٗا وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۖ ﴾ [نوح: ٢٨]
হে আমার রব! আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে।[26]

২৬. তাদের মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা: 
সুতরাং যেসব কারণে পিতামাতার মহান হক বা অধিকারের বিষয়টি প্রমাণিত, জগতসমূহের প্রতিপালকের দয়ার ব্যাপকতার কারণে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি কখনও বন্ধ হয়ে যায় না, বরং মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকে; কারণ, কোনো কোনো মানুষ তাদের পিতামাতার জীবদ্দশায় তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কমতি করে থাকে; অতঃপর যখন তারা মৃত্যুবরণ করেন, তখন সে পিতামাতার অধিকার আদায়ে অবহেলা ও সময় নষ্ট করার কারণে লজ্জিত হয়ে তার হাত কামড়ায় এবং দাঁতে আঘাত করে; আর আফসোসের সুরে কামনা করে তারা যদি আবার দুনিয়ায় ফিরে আসত, তাহলে সে তাদের সাথে ভাল আচরণ করত!
আর সেখান থেকেই মুসলিম ব্যক্তি যে সুযোগ হারিয়েছে সে তা পেতে সক্ষম হবে— সে তার পিতামাতার মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে; আর এটা কয়েকটি কাজের মাধ্যমে হতে পারে, যেমন—
ক. সন্তান স্বয়ং নিজেই ভাল হয়ে যাবে।
খ. তাদের জন্য বেশি বেশি দোআ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
গ. তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা।
ঘ. তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা।
ঙ. তাদের পক্ষ থেকে দান-সাদকা করা।
এ হল কতিপয় বিষয়, যেগুলোর দ্বারা আমরা যথাযথভাবে সুন্দর পদ্ধতিতে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে পারি।  
* * *

সদ্ব্যবহারে সহায়ক কর্মকাণ্ডসমূহ

পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করাটা আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম নি‘আমত, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে এই নি‘আমত দ্বারা ধন্য করেন। এখানে এমন কতগুলো কর্মকাণ্ড বা বিষয় রয়েছে, যেগুলো কোনো মানুষ গ্রহণ করে চেষ্টা-সাধনা করলে সেগুলো তাকে তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে সহযোগিতা করবে; এসব কর্মকাণ্ড ও বিষয়াদির কতিপয় দিক নিম্নরূপ:[27]

১. আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা: 
আর এটা সম্ভব হবে শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন করে ‘ইবাদত ও দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সর্বোত্তম সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে, আশা করা যায় যে, তিনি আপনাকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য তাওফীক দিবেন এবং সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবেন।

২. সদ্ব্যবহারের সুফল ও অবাধ্যতার কুফল সামনে রাখা: 
কেননা, (পিতামাতার আনুগত্যের) কাজটি যথাযথভাবে সম্পাদন করা ও তা বাস্তবায়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করার অন্যতম বড় উপায় হল সদ্ব্যবহার করার ফলাফল সম্পর্কে জানা এবং তার উত্তম পরিণতি সামনে রাখা।
অনুরূপভাবে অবাধ্যতার কুফল এবং তার কারণে যে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, পরিতাপ ও অপমানের আমদানি হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া; আর এসবই পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে সাহায্য করবে এবং তাদের অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত রাখবে। 

৩. অন্যসব মানুষের উপর পিতামাতার মর্যাদার বিষয়টি সামনে রাখা: 
কেননা, তারা হলেন এই দুনিয়ায় তার অস্তিত্বের উপলক্ষ; আর তারা তার জন্য কষ্ট করেছেন, তাকে অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়েছেন এবং বড় হওয়া পর্যন্ত লালনপালন করেছেন; সুতরাং সন্তান তাদের জন্য যত কিছুই করুক না কেন, সে কখনও তাদের হক (অধিকার) আদায় করতে সক্ষম হবে না; অতএব, এই বিষয়টি মনে রাখলে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার মত কাজটি সহজ হবে।

৪. পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারে আত্মনিয়োগ করা: 
ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হলো তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা এবং এর সকল দায়-দায়িত্ব বহন করা; আর এ কাজে নিজেকে এমনভাবে বিলিয়ে দেওয়া, যাতে তা তার স্বভাব ও অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

৫. তালাকের অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করা: 
পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল তারা যদি তাদের মধ্যকার দাম্পত্য জীবন বহাল রাখতে অপারগ হয় এবং তাদের মাঝে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তাহলে তাদের প্রত্যেকেই যেন সন্তানদেরকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দেয় এবং তাদের প্রত্যেকে যেন সন্তানদেরকে পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার করতে প্ররোচিত না করে; কারণ, সন্তানরা যখন পিতামাতার অবাধ্য বলে পরিচিত হবে, তখন এর জন্য পিতামাতাই দায়ী হবেন; ফলে তারা নিজেরা হতভাগ্য হবে এবং সন্তানদেরকেও হতভাগ্য করবে।  

৬. পিতামাতার সততা: 
ছেলে-সন্তানদের সততা ও তাদের কর্তৃক তাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জন্য অন্যতম উপায় ও উপলক্ষ হল পিতামাতার সততা।

৭. পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া: 
আর এটা হবে সদ্ব্যবহারকারীদেরকে উৎসাহ দান এবং তাদেরকে সদ্ব্যবহার করার ফযীলত বর্ণনা করে উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে; আর অবাধ্যদেরকে উপদেশ দান এবং অবাধ্যতার খারাপ পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।

৮. সদ্ব্যবহার করার জন্য সন্তানদেরকে সহযোগিতা করা: 
আর এটা হল সদ্ব্যবহার করার জন্য পিতামাতা কর্তৃক সন্তানদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া; আর এটা সম্ভব হয়ে উঠবে তাদেরকে উৎসাহ ও ধন্যবাদ দেওয়ার মাধ্যমে এবং তাদের জন্য দো‘আ করার মাধ্যমে।
আমি কোনো কোনো পিতামাতার ব্যাপারে জানি, যাকে ছেড়ে তার সন্তান-সন্তুতি ও নাতি-নাতনীগণ এক মুহূর্তও থাকতে পারে না, অথচ তার বয়স একশ বছর পার হয়ে গেছে। কারণ, তারা তার সাথে অনেক বেশি উত্তম আচরণ করে এবং তার সেবায় পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে যায়; বরং তারা এর দ্বারা মজা ও আনন্দ পায়।
আর আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দান করার পর তাদেরকে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করে তা হল— এই পিতা তার সাথে উত্তম ব্যবহার করার ব্যাপারে তাদের (সন্তানদের) উত্তম সাহায্যকারী, যেমন— তিনি তার সন্তানদেরকে ভালবাসেন, তাদের জন্য বেশি বেশি দো‘আ করেন, আগ্রহের সাথে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তাদের প্রশংসা ও গুণ-গান করেন, তাদের মনে আনন্দ দেন এবং তাদেরকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় নামে ডাকেন।

৯. সন্তান কর্তৃক তার নিজকে মাতাপিতার অবস্থানে রেখে চিন্তা করা: 
হে ছেলে! আগামীতে যখন তুমি বার্ধক্যে উপনীত হবে, তোমার অস্থিমজ্জা দুর্বল হয়ে যাবে, চুল সাদা হয়ে যাবে এবং তুমি চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে যাবে, তখন যদি তোমার সন্তানদের কাছ থেকে তুমি দুর্ব্যবহার পাও, নিষ্ঠুর অবহেলার শিকার হও এবং স্পষ্ট অবজ্ঞার পাত্র হয়ে যাও, তাহলে কি তা তোমাকে আনন্দ দিবে?!

১০. সদ্ব্যবহারকারী ও অবাধ্য সন্তানদের জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করা: 
কেননা, সদ্ব্যবহারকারীদের জীবনী আগ্রহ-উদ্দীপনাকে সতেজ ও তীক্ষ্ন করবে, সংকল্প ও সিদ্ধান্তকে পবিত্র করবে এবং সদ্ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করবে।
আর অবাধ্য সন্তানদের জীবনী পাঠ এবং তাদের অর্জিত খারাপ পরিণতি অবাধ্য হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে, তাতে ঘৃণার জন্ম দিবে, সদ্ব্যবহারের দিকে আহ্বান করবে এবং তার ব্যাপারে আগ্রহ ও উৎসাহের জন্ম দিবে।

১১. সদ্ব্যবহার দ্বারা পিতামাতার খুশি ও অবাধ্যতার কারণে তাদের কষ্ট পাওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা: 
মানুষ যদি এই বিষয়টি বুঝতে পারে, তাহলে সে আগ্রহ সহকারে সদ্ব্যবহারের দিকে অগ্রসর হবে এবং তাদের অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকবে। কবি সত্যই বলেছেন:
لو كان يدري الابنُ أيَّة غُصَّةٍ * قد جرَّعتْ أبويه بعد فراقه
(যদি ছেলে জানতে পারত কোন্ যন্ত্রণা
তার পিতামাতাকে গিলতে হয় তার বিচ্ছেদের পর)।
أمٌ تهيمُ بِوجدِهِ حيرانة * وأبٌ يَسِحُّ الدمع من آماقه
(মা তাকে পাওয়ার জন্য দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায়,
আর পিতা তাকে হারিয়ে অবিরত চোখের জলে বুক ভাসায়)।
يتجرعان لبينه غصص الردى * ويبوحُ ما كتماه من أشواقه
(তারা তার বিচ্ছেদের কারণে ধ্বংসের ঢোক গিলতে বাধ্য হন,
তার প্রতি প্রবল আগ্রহের আতিশয্যে যা কিছু তারা গোপন করেছিল তা প্রকাশে করে দিতে বাধ্য হয়)।
لرثا لأمٍّ سُلَّ من أحشائها * وبكي لشيخٍ هام في آفاقه
(অবশ্যই শোক প্রকাশ করতে হবে সে মায়ের জন্য যার পেটের নাড়ি-ভুড়ি থেকে তাকে আলাদা করা হয়েছে,
আর এমন বৃদ্ধ পিতার জন্য ক্রন্দন করতে হবে যিনি তাকে পাগলের মত ভালোবাসত)।
ولبدَّل الخلقَ الأبيَّ بعطفِه * وجزاهما بالعَذْب من أخلاقه
(আর অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে তার দাম্ভিক আচরণকে মায়া-দয়া দ্বারা,
আর তাদেরকে তার মধুর চরিত্র দ্বারা পুরস্কার দিতে হবে)।[28]
* * *


স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয় করা

এ অনুচ্ছেদটি এমনসব আদব বা শিষ্টাচারকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা পিতামাতার সাথে রক্ষা করে চলা আবশ্যক এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারে সহায়ক কর্মকাণ্ডসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে; আর এর কিছু বিষয়ের আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
পৃথক ও এককভাবে এই অনুচ্ছেদটির অবতারণা হয়েছে তার ব্যাপক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কারণে; স্বামী কখনও কখনও তার স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয়সাধন করার ব্যাপারে কথা বলে, যখন তার পিতামাতা ও স্ত্রীর মাঝে পারস্পরিক ঘৃণা ও অবজ্ঞার কারণে বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কারণ, তার স্ত্রী স্বীয় স্বামীকে নিজের জন্য খাস করে নেওয়ার নিমিত্তে অন্ধ ভালবাসার কারণে অনেক সময় আল্লাহকে কম ভয় করে থাকে, যা পূর্বে আলোচনা হয়েছে।
আর কখনও কখনও তার পিতামাতা উভয়ে অথবা তাদের কোনো একজন তীক্ষ্ন মেজাজের হয়ে থাকে, ফলে তাদেরকে কোনো মানুষ পছন্দ করে না; আবার কখনও তারা সন্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করে তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ব্যাপারে, অথচ সে এমন কোনো অপরাধ করেনি, যা তার জীবনে এই তালাকের মত পরিস্থিতিকে অপরিহার্য করে তোলে।
আবার কখনও কখনও তারা তার অন্তরে ক্রেধের সঞ্চার করে এবং তাকে অবহিত করে যে, তার স্ত্রী নিজ ইচ্ছামত কাজ করে, ফলে সে এটাকে বিশ্বাস করে, অথচ সে তাকে তার অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে অথবা তার সাথে অনেক বিষয়ে হক আদায়ে ঘাটতি বা কমতি করেছে।
সুতরাং এই ধরনের পরিস্থিতিতে তার সমাধান কী হবে? মানুষ কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? সে কি তার পিতামাতার অবাধ্য হবে এবং তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে? সে কি তাদের মতামতের অমর্যাদা করবে এবং তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকে তাড়িয়ে দিবে? নাকি তার স্ত্রীর অধিকারের প্রশ্নে তার পিতামাতা তাকে যা কিছুই বলবে, সব ক্ষেত্রেই সে তাদের সাথে একমত হয়ে যাবে এবং তার স্ত্রী নির্দোষ ও পিতামাতা ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তার স্ত্রীকে দোষারোপ করে তারা যত বক্তব্য পেশ করবে, তার সবকিছুকেই সে বিশ্বাস করবে?
না, বিষয়টি আসলে এ রকম নয়; বরং তার দায়িত্ব হল তাদের মাঝে মীমাংসা করা এবং তাদের মধ্যকার ভাঙ্গন রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো।
নিশ্চয় ব্যক্তিত্বের শক্তি মানুষের মধ্যে অধিকার এবং এমন সব দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যকার তুলনা করার মত সামর্থ্য ও ক্ষমতার সূচনা করে, যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য কোনো কোনো মানুষের সামনে কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠে; ফলে তার কাছে ব্যাপারটি সন্দেহপূর্ণ হয়ে উঠে এবং তাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়।
আর তা থেকেই একে অপরের প্রতি কোনো প্রকার অন্যায় ও জুলুমের সম্পৃক্ততা ছাড়াই প্রত্যেক অধিকারওয়ালা ব্যক্তির অধিকার আদায়ের শক্তি ও সামর্থ্যের প্রশ্নে বুদ্ধিমান মানুষের বিচক্ষণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
বস্তুত ইসলামী শরী‘য়তের অন্যতম মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব হল— তা এমন কতগুলো বিধিবিধান নিয়ে এসেছে, যা বিভিন্ন প্রকার কার্যকারণ ও প্রতিকারের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে; আর আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দিলে বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ব্যক্তি প্রত্যেক অধিকারওয়ালা ব্যক্তিকে তার অধিকার বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন।
এ ভারসাম্যতার মাঝে ত্রুটি বা ফাটল সৃষ্টির কারণে অনেক সামাজিক ট্রাজেডি বা দুঃখজনক ঘটনা এবং পারিবারিক সমস্যার জন্ম হয়।
এসব সংঘটিত সমস্যার সমাধানে অন্যতম সহায়ক শক্তি হল এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে সকল পক্ষকে সচেষ্ট হওয়া।
নিম্নে কিছু নির্দেশনা আসছে এবং পূর্বেও কিছু দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করা হয়েছে, যা এই ব্যাপারে সহায়তা করবে:
এসব নির্দেশনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবাহিত পুত্র, তার স্ত্রী এবং তার পিতামাতাকে— বিশেষ করে তার মাতাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো,  

প্রথমত: বিবাহিত ছেলের ভূমিকা:
বিবাহিত ছেলে তার স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয় করার ক্ষেত্রে যে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে তা নিম্নরূপ:

(ক) পিতামাতার সেবা-যত্ন করা ও তাদের মেজাজ অনুধাবন করা: 
আর এটার মানে হল বিয়ের পরেও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার অব্যাহত রাখা এবং পিতামাতার সামনে তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার বিষয়টি প্রকাশ না করা— বিশেষ করে তার পিতামাতা উভয়ে অথবা তাদের কোনো একজন যখন তীক্ষ্ন মেজাজের হয়ে থাকে। কারণ, সে যখন তাদের সামনে এটা প্রকাশ করবে, তখন ক্রোধে তাদের অন্তর পূর্ণ হয়ে যাবে এবং তাদের মাঝে ঈর্ষার জন্ম দিবে, বিশেষ করে মায়ের মনে।
অনুরূপভাবে তার কর্তব্য হল তার পিতামাতার সাথে কোমল আচরণ করা; আর তাদেরকে সন্তুষ্ট করা ও তাদের মন পাওয়ার জন্য আগ্রহ সহকারে চেষ্টা করা।

(খ) স্ত্রীর প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা: 
আর এটা সম্ভব হবে তার অধিকার সম্পর্কে জানার মাধ্যমে এবং তার সম্পর্কে তার পিতামাতার পক্ষ থেকে যা শুনবে, তার সবকিছু গ্রহণ না করার মাধ্যমে; বরং তার দায়িত্ব হল তার সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করা এবং তার সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করা।

(গ) পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও আন্তরিকতা তৈরি করা: 
উদাহরণস্বরূপ সে তার স্ত্রীকে উপদেশ দিবে তার পিতামাতাকে বিভিন্ন ধরনের হাদিয়া বা উপহার সামগ্রী প্রদান করার জন্য, অথবা সে নিজেই কিছু উপহার সামগ্রী ক্রয় করবে এবং তা তার স্ত্রীকে দিয়ে বলবে তা পিতামাতাকে প্রদান করার জন্য— বিশেষ করে মাকে প্রদান করার জন্য; কেননা, এটা এমন জিনিস, যা মনকে বিগলিত করে, আস্তে আস্তে ক্রোধ বা বিদ্বেষ দূর করবে, ভালবাসার আমদানি করবে এবং তার খারাপ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করবে।

(ঘ) স্ত্রীর সাথে বুঝাপড়া বা সমঝোতা করা: 
সুতরাং সে তাকে উদাহরণস্বরূপ বলবে, আমার পিতামাতা এমন এক অংশ, যা আমার থেকে বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়; আর আমার অনুভূতি শক্তি যদি কখনও ক্ষীণও হয়ে যায়, তবুও আমি কিছুতেই তাদের অবাধ্য হব না এবং তাদের কোনো অপমান আমি কখনও সহ্য করব না। আর আমার পিতামাতার ব্যাপারে তোমার ধৈর্যধারণ ও তাদেরকে তোমার সেবা-যত্ন করার দ্বারাই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাবে।
অনুরূপভাবে সে তার স্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিবে যে, সেও অচিরেই কোনো একদিন মা হবে; আর কখনও কখনও তার পিতামাতার সাথে তার অবস্থার অনুরূপ অবস্থা তার জীবনেও আসতে পারে, তখন কি তার সাথে অনুরূপ আচরণ করাটাকে সে পছন্দ করবে? অনুরূপভাবে তাকে আরও স্মরণ করিয়ে দিবে যে, নিশ্চয় কলহ বা কঠোরতা কোনো কাজ বা বিষয়ের শুধু কঠোরতা ও জটিলতাই বৃদ্ধি করে; আর কোনো কিছুর মধ্যকার কোমলতা শুধু তাকে সৌন্দর্য দান করে এবং অনুরূপভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি[29]।  

দ্বিতীয়ত: পুত্রবধুর ভূমিকা:
পুত্রবধু এ ব্যাপারে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম; যেমন— তার পক্ষে সম্ভব তার স্বামীকে তার নিজের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া, তার (স্বামীর) আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান করা এবং তার পিতামাতা তথা শ্বশুর-শাশুড়ীকে বেশি বেশি সম্মান ও সেবা-যত্ন করা, বিশেষ করে তার শাশুড়ীকে; আর এ সবকিছুই মূলত স্বামীকে সম্মান ও তার প্রতি ইহসান করা। ঠিক তেমনিভাবে তাতে রয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা, দাম্পত্য সম্পর্ক শক্তিশালী করা এবং ফেতনা-ফ্যাসাদের আগুন নিভিয়ে দেওয়ার বিষয়।
যখন স্ত্রীর উপর তার (স্ত্রীর) পিতামাতার চেয়ে স্বামীর হক বেশি এবং জাতির সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য সে যখন তার আত্মীয়-স্বজন ও তার পিতার প্রিয় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার জন্য শরী‘আতসম্মতভাবে আদিষ্ট, তখন দাম্পত্য সম্পর্ক মজবুত করার জন্য স্ত্রী তো আরও অতি উত্তমভাবেই তার স্বামীর প্রিয়জনদের অধিকার রক্ষার জন্য শরী‘আতসম্মতভাবে আদিষ্ট।
অতঃপর স্ত্রী কর্তৃক (তার পিতামাতার মত) তার স্বামীর পিতামাতার সম্মান ও সেবাযত্ন করার বিষয়টি তো মৌলিকভাবে ইসলামী নৈতিকতা ও চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়, যা ব্যক্তির আভিজাত্য ও বংশের মহত্ত্বের প্রমাণ বহন করে।
আর যদিও সে এই কাজটি করবে শুধু তার স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য, অথবা নিকটাত্মীয়দের ভালবাসা পাওয়ার জন্য এবং যাবতীয় বিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে নিরাপদে থাকার উদ্দেশ্যে— উপরন্তু দো‘আ তো পাবেই।
অনুরূপভাবে একজন ভাল স্ত্রীর আবশ্যকীয় করণীয় হল, সে শুরু থেকেই একথা ভুলবে না যে, তার স্বামীর ব্যাপারে যে নারীটি মনে করে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, সে নারীটি হল এ স্বামীর মা; আর যতই তার অনুভূতিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাক তার পক্ষে সম্ভব নয় যে, সে তার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে; কারণ, সে তার মা, যিনি তাকে নয় মাস তার পেটে ধারণ করেছেন, তার দুধ খাইয়ে তাকে শক্তিশালী করেছেন, তার আদর ও স্নেহ দ্বারা তাকে উদ্ভাসিত করেছেন এবং তার জন্য নিজের জীবনকে উজাড় করে দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়েছে।
অনুরূপভাবে হে স্ত্রী! তোমার ভুলে গেলে চলবে না যে, এ নারীটি তোমার সন্তানদের আশ্রয়কেন্দ্র; কারণ, তিনি হলেন তাদের দাদী এবং তার সাথে রয়েছে তাদের মজবুত সম্পর্ক; সুতরাং তোমার জন্য তার সাথে সতীনের মত ব্যবহার করা শোভনীয় হবে না; যদিও সে কখনও কখনও তোমার সাথে সতীনের মত ব্যবহার করবে কিন্তু তুমি তার সাথে মায়ের মত ব্যবহার কর, তাহলে সে তোমার সাথে মেয়ের মত ব্যবহার করবে। আর মায়ের নিকট থেকে কখনও কখনও কঠোরতা বা দুর্ব্যবহারের মত আচরণ হলে মেয়ের জন্য উচিৎ হবে সাওয়াব ও প্রতিদানের আশায় ধৈর্যধারণ করা।
অতঃপর যখন ঘরে ও পরিবারে ইসলামের আদব বা শিষ্টাচার ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তার সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন পরিবারটি চলতে থাকবে একটি সন্তোষজনক চরিত্র নিয়ে; আর সেই পরিবারটি অধিকাংশ সময় আনন্দময় জীবনযাপন করবে।
আর জেনে রাখবে, হে স্ত্রী! নিশ্চয় তোমার স্বামী তোমার পরিবারের চেয়ে তার পরিবার-পরিজনকে বেশি ভালবাসবে; আর এ ক্ষেত্রে তুমি তাকে তিরস্কার করো না। আর তুমিও তো তার পরিবারের চেয়ে তোমার পরিবার-পরিজনকে অধিক ভালবাস; সুতরাং তুমি তার পরিবার-পরিজনকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে অথবা তাদেরকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে অথবা তাদের অধিকারের ব্যাপারে কমতি করার মাধ্যমে তাকে আঘাত দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হও; কেননা, তাকে এই ধরনের আচরণ তোমাকে অপছন্দ করতে এবং তোমার থেকে অন্য দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য করবে। 
আর স্বামীর পরিবার-পরিজনকে সম্মান করার ক্ষেত্রে অবহেলা করা মানেই স্বয়ং স্বামীকে সম্মান করার ক্ষেত্রে অবহেলা করা; আর যখন সে অপরিপক্ক চিন্তায় কোনো কিছু দ্বারা এর মোকাবিলা করতে পারবে না তখন সে আঘাত ও বিরক্তির কারণে স্ত্রীর জন্য কখনও তার ভালবাসাকে উজাড় করে দিবে না।
অতঃপর যে ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনকে ভালবাসে এবং তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে, সে তো একজন ভদ্র, সম্মানিত ও সৎ মানুষ; তার স্ত্রীর জন্য যথাযথ হবে— তাকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা এবং তার মধ্যে ভালো কিছু আশা করা; কারণ, যে ব্যক্তির মধ্যে তার পিতামাতার জন্য ভালো কিছু নেই, অধিকাংশ সময় সে ব্যক্তির মধ্যে স্ত্রী, অথবা সন্তান, অথবা অপর কোনো মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ নেই।
হে স্ত্রী! যখন তুমি তোমার স্বামী কর্তৃক তার পিতামাতার সাথে অবাধ্য আচরণ করা এবং তাদের সাথে তোমার দুর্ব্যবহার করাটাকে মেনে নিবে, তখন কি তুমি তোমার ভাইয়ের স্ত্রী তথা ভাবিদের পক্ষ থেকে তোমার মায়ের সাথে অনুরূপ করাটাকে মেনে নিতে পারবে?
নাকি তুমি পছন্দ করবে তোমার পুত্রবধুদের পক্ষ থেকে তোমার সাথে এমন (খারাপ) ব্যবহার করাটাকে, যখন তোমার অস্থি দুর্বল হয়ে যাবে এবং বার্ধক্যে মাথার চুল সাদা হয়ে যাবে?
পরিশেষে, সমস্যাসমূহের সমাধান, জটিলতা নিরসন, মহৎ গুণের সমাবেশ ও ভাঙ্গন বা বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাওফীক দানের পর পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য স্বামীর সহযোগিতার ব্যাপারে অধিকাংশ সময় একজন সৎ স্ত্রী দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে; কারণ, পিতামাতা যখন তাদের পুত্রবধুর কাছ থেকে সত্যিকার ভালবাসা ও উদার সহানুভূতি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা এই চমৎকার অনুগ্রহের কথা অবশ্যই মনে রাখবে।
আর এ কারণেই আমার দেখতে পাই যে, অনেক পিতামাতা তাদের পুত্রবধুদেরকে তাদের আপন মেয়েদের মত করে অথবা তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
আর এটা আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক ছাড়া সম্ভব নয়; অতঃপর ঐসব স্ত্রীদের প্রজ্ঞা এবং স্বামীদের পিতামাতার সাথে উত্তম ব্যবহারের প্রবল আকাঙ্খার কারণেই এটা সম্ভব হয়ে উঠে।
আর পূর্বোক্ত বিষয়গুলো ছাড়া স্ত্রীকে স্বামীর পিতামাতা তথা শ্বশুর-শাশুড়ীর হৃদয়ে প্রবেশ করতে হলে আরও যেসব বিষয় সাহায্য করবে সেগুলো হল: (তাদের পক্ষ থেকে) দুর্ব্যবহারের সময় ধৈর্যধারণ করা, প্রতিদান পাওয়ার বিষয়টি সামনে রাখা, পরিণাম ফল নিয়ে চিন্তাভাবনা করা, তাছাড়া তাদেরকে উপহার সামগ্রী প্রদান করা, তাদের সাথে আগ্রহসহকারে উত্তম কথা বলা এবং মনোযোগ দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর কথা শ্রবণ করা; আর কোমল ভাষায় কথা বলা, সালাম দেওয়া এবং উত্তম প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
এর মধ্য থেকে আরেকটি হল- তার স্বামীকে তার পিতামাতার সেবা-যত্ন করার জন্য উপদেশ দেওয়া এবং সাথে সাথে তাদেরকে একথা বুঝতে না দেওয়া— তার মন তাদেরকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে তার (স্ত্রীর) দিকে ঝুঁকে গেছে।
আর এর মধ্য থেকে আরেকটি হল- আল্লাহ তা‘আলার কাছে বিনয়ের হাতগুলো উত্তোলন করা, যাতে তিনি তার শ্বশুর-শাশুড়ীর হৃদয়কে তার প্রতি দয়াময় করে দেন এবং তাকে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেন।
সুতরাং হে প্রিয় স্ত্রী! এসব কথার তাৎপর্য উপলব্ধি কর; তোমার জন্য দুনিয়ার জীবনে থাকবে সুন্দর প্রশংসা ও সুখ্যাতি এবং পরকালে থাকবে অনেক প্রতিদান ও এক নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।[30]

তৃতীয়ত: স্বামীর মায়ের (শাশুড়ীর) ভূমিকা:
মায়েদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন (আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত করুন), যিনি না বুঝেই তার ছেলেকে জটিলতার মধ্যে ফেলে দেন; কেননা, তিনি তাকে ভালবাসেন এবং তার সৌভাগ্য কামনা করেন; আবার কখনও কখনও তার জন্য পাত্রী দেখা, প্রস্তাব দেওয়া ও তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা-সাধনা করেন।
কিন্তু তার মন্দ হস্তক্ষেপের কারণে কোনো কোনো সময় তার নিজের ও তার সন্তানের জন্য ক্ষতি ডেকে আনেন; কারণ, যখন ছেলে বিয়ে করে, তখন তার মা মনে করে যে, তার কাছ থেকে তার সন্তানকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তার মন তাকে ছেড়ে অন্য দিকে ঝুঁকে গেছে; ফলে সে তাকে এবং হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা আবার ফিরে পেতে চায়; আর সব সময় তার অন্তরে তার স্ত্রীর ব্যাপারে বিদ্বেষের আগুন প্রজ্বলিত করে এবং তার মধ্যে তার (স্ত্রীর) ব্যাপারে অবিশ্বাসের প্ররোচনা চালিয়ে যায়; আবার কখনও কখনও সে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার জন্য তাকে সুন্দর করে বুঝায় এবং তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, সে তার জন্য তার চেয়ে আরও ভাল বউ খুঁজে নিয়ে আসব, অথচ অনেক সময় স্ত্রী চরিত্রবান ও সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও সে এই ধরনের কাজ করে।
আবার কোনো কোনো মা এমন আছেন যখন তিনি দেখেন তার ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দিত ও সুখী, অথবা দেখেন যে সে তার স্ত্রীকে সম্মান বা মর্যাদা প্রদান করে, তখন তার হৃদয়ে হিংসার আগুন জ্বলে উঠে; আবার কখনও কখনও অবস্থা আরও খারাপ পরিণতির দিকে মোড় নেয়...।
আবার কোনো কোনো মা আছেন এমন, যিনি তার পুত্রবধুর সাথে আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর এবং নিষ্ঠুর; ফলে আপনি তাকে দেখতে পাবেন যে, তিনি দোষগুলো বড় করে দেখান এবং ভাল দিকগুলো গোপন করে রাখেন; আবার কখনও কখনও পুত্রবধুর উপর মিথ্যা অপবাদ দেন; আবার কখনও কখনও তার নির্দোষ কর্মকাণ্ড ও অতীতের কথাবার্তার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন জায়গায় চলে যান।
অতএব, হে প্রিয় মা! হে— যিনি আপন ছেলেকে ভালবাসেন এবং তার সৌভাগ্য কামনা করেন! আপনি ধ্বংস ও সর্বনাশের কুঠার হবেন না; আপনার ঈর্ষাকে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত করবেন না, যা পরিবারের পরিবেশকে জ্বালিয়ে দেয়; আর এমন আন্দাজ ও অনুমানের অনুসরণ করবেন না, যা আপনার কল্পনার তৈরি; এমন করলে আপনি পরিষ্কার বিষয়কে ঘোলা করে ফেলবেন এবং কঠিন দুশ্চিন্তা ও সংশয়ের মধ্যে পড়ে যাবেন। সুতরাং আপনার পুত্রবধুর সাথে আপনার সম্পর্ককে দা-কুমড়ার মত শত্রুতার সম্পর্ক বানাবেন না; বরং আপনি তার মা হয়ে যান, সে আপনার মেয়ে হয়ে যাবে। অতএব, আপনার পক্ষে সুন্দর হবে— আপনি তাকে ভালোবাসবেন এবং তার থেকে কোনো (মন্দ) কিছু প্রকাশ হয়ে গেলে দেখেও না দেখার ভান করবেন; আর যখন কোনো ত্রুটি দেখবেন, তখন নরম ও কোমল ভাষায় তাকে উপদেশ দিতে পদক্ষেপ নিন; তখন সেও সৌভাগ্যবান হবে এবং আপনিও সৌভাগ্যবান হবেন।
বরং আপনার জন্য আরও ভালো হবে— উপহার, উপঢৌকন ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি তার নিকট প্রিয় হয়ে উঠবেন; আর আপনি আপনার বড় মন, উদার স্নেহ-মমতা, নির্ভেজাল দো‘আ ও বাস্তবসম্মত প্রশংসা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যান; আর আল্লাহ তা‘আলাও তাঁর তত্ত্বাবধানের দ্বারা আপনাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবেন এবং তাঁর দয়া ও স্নেহ দ্বারা আপনাকে সাহায্য করবেন।
* * *

সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা কাহিনী

পূর্বে আমরা পিতামাতার আনুগত্য ও তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা করেছি; আরও আলোচনা করেছি এমন সব আদব বা শিষ্টাচার সম্পর্কে, আমাদের জন্য তাঁদের সাথে যেসব আদব রক্ষা করা যথাযথ ও একান্তভাবে কাম্য; আরও আলোচনা করেছি এমন সব উপায়, যেগুলো পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারে সহায়তা করে। সুতরাং এসব আদব রক্ষা করাটা আমাদের জন্য কতই না উপযুক্ত! আর ঐসব উপায় গ্রহণ করাটা আমাদের পক্ষে কতটাই না যথাযথ! ফলে আমরা অবশ্যই ঐসব পুণ্যবান ও ভাল মানুষের কাতারে শামিল হতে পারব, যাঁরা যখন তাঁদের রবকে ডাকে, তখন তিনি তাঁদের ডাকে সাড়া দেন এবং তাঁরা যখন তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তখন তিনি তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেন।
অতঃপর এ ব্যাপারে নবী ও রাসূলগণের মধ্যে এবং আমাদের আজকের দিন পর্যন্ত তাঁদেরকে যারা যথাযথভাবে অনুসরণ করেছে তাদের মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ; কেননা, তাঁরা পিতামাতার আনুগত্য ও তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করার প্রশ্নে অতি চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন; ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মর্যাদাকে ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে সমুন্নত করেছেন এবং স্থায়ীভাবে তাঁদের স্মরণকে উন্নত করে রেখেছেন।
আপনার উদ্দেশ্যে নিম্নে এমন কতগুলো সুরভিত নমুনা বা দৃষ্টান্ত ও চমৎকার কাহিনী পেশ করা হল, যা তার সুগন্ধ ছড়াবে যুগ যুগ ধরে ঐসব পুণ্যবান ভাল মানুষের জন্য, যাদেরকে তাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাওফীক দেওয়া হয়েছে; আশা করা যায় এসব দৃষ্টান্ত ও কাহিনী আমাদের প্রাণে উত্তম ও কল্যাণকর দিকগুলো আন্দোলিত করবে এবং সৎকর্ম ও (পিতামাতার) আনুগত্যের দিকে ধাবিত করবে।

• নবীগণ কর্তৃক পিতামাতার প্রতি আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা:

১. এই তো আল্লাহর নবী নূহ ‘আলাইহিস্ সালাম, তিনি তাঁর পিতামাতার সাথে যে সদ্ব্যবহার করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য তার একটা নমুনা উপস্থাপন করেছেন; যেমন তিনি তাঁর পিতামাতার জন্য দোআ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর (নূহ আ. এর) পক্ষ থেকে বলেছেন:
﴿ رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيۡتِيَ مُؤۡمِنٗا وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۖ ﴾ [نوح: ٢٨]
হে আমার রব! আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে।[31]

২. আর তিনি হলেন একত্ববাদীদের নেতা ইবরাহীম খলীল ‘আলাইহিস্ সালাম, যিনি তাঁর পিতাকে নির্মল নম্র ভাষায় ও দরদ ভরা কণ্ঠে সম্বোধন করেছেন তার হোদায়েত ও মুক্তির আশা নিয়ে এবং তার পথভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের আশঙ্কা নিয়ে; সুতরাং তিনি বলেন, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে জানিয়ে দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱذۡكُرۡ فِي ٱلۡكِتَٰبِ إِبۡرَٰهِيمَۚ إِنَّهُۥ كَانَ صِدِّيقٗا نَّبِيًّا ٤١ إِذۡ قَالَ لِأَبِيهِ يَٰٓأَبَتِ لِمَ تَعۡبُدُ مَا لَا يَسۡمَعُ وَلَا يُبۡصِرُ وَلَا يُغۡنِي عَنكَ شَيۡ‍ٔٗا ٤٢ يَٰٓأَبَتِ إِنِّي قَدۡ جَآءَنِي مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَمۡ يَأۡتِكَ فَٱتَّبِعۡنِيٓ أَهۡدِكَ صِرَٰطٗا سَوِيّٗا ٤٣ يَٰٓأَبَتِ لَا تَعۡبُدِ ٱلشَّيۡطَٰنَۖ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ كَانَ لِلرَّحۡمَٰنِ عَصِيّٗا ٤٤ يَٰٓأَبَتِ إِنِّيٓ أَخَافُ أَن يَمَسَّكَ عَذَابٞ مِّنَ ٱلرَّحۡمَٰنِ فَتَكُونَ لِلشَّيۡطَٰنِ وَلِيّٗا ٤٥ ﴾ [مريم: ٤١،  ٤٥]                                                                                                                                                                  
আর স্মরণ করুন এ কিতাবে ইবরাহীমকে; তিনি তো ছিলেন এক সত্যনিষ্ঠ, নবী। যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, ‘হে আমার পিতা! আপনি তার ‘ইবাদাত করেন কেন যে শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোনো কাজেই আসে না?’ ‘হে আমার পিতা! আমার কাছে তো এসেছে জ্ঞান যা আপনার কাছে আসেনি; কাজেই আমার অনুসরণ করুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাব। ‘হে আমার পিতা! শয়তানের ‘ইবাদাত করবেন না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। ‘হে আমার পিতা! নিশ্চয় আমি আশংকা করছি যে, আপনাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করবে, তখন আপনি হয়ে পড়বেন শয়তানের বন্ধু[32]
তিনি এসব প্রভাব বিস্তারকারী কথামালা ও হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর পিতাকে সম্বোধন করে কথা বলেছেন, যা হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত পৌঁছায়।
এ কথাগুলো যদি তার হৃদয়কে কঠোর, শক্ত, আবরণযুক্ত ও কৃষ্ণ কালো অবস্থায় না পেত, তাহলে তা তাকে প্রভাবিত করত এবং তা তার হেদায়েত ও মুক্তির অন্যতম কারণ হতো।

৩. এই তো ইসমা‘ঈল ইবন ইবরাহীম ‘আলাইহিমাস্ সালাম, যাঁকে দিয়ে মানবতার ইতিহাসে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়; আর এটা হল— যখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে তাঁর পিতা বললেন:
﴿ يَٰبُنَيَّ إِنِّيٓ أَرَىٰ فِي ٱلۡمَنَامِ أَنِّيٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ ﴾ [الصافات: ١٠٢]
‘হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কী বল?’।[33]
অতঃপর এই সৎ ছেলেটি কী প্রতিউত্তর করেছিলেন? তিনি কি আমতা আমতা করেছিলেন, নাকি গড়িমসি করেছিলেন? তিনি কি দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রকাশ করেছিলেন, নাকি বিলম্ব করেছিলেন? না, বরং তিনি বলেছেন, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে জানিয়ে দিয়েছেন; তিনি বলেন:
﴿ يَٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِيٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٠٢ ﴾ [الصافات: ١٠٢]
হে আমার পিতা! আপনি যা আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।[34]
বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম যখন তাঁর স্বপ্নের মধ্যে দেখা বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করলেন, তখন তিনি তাঁর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন: হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি রশি ও ছুরি নাও এবং চল ঐ পাহাড়ের গিরিপথে, আমরা সেখানে কাঠ সংগ্রহ করব; অতঃপর তিনি যখন তাঁকে নিয়ে ‘ছাবীর’ নামক গিরিপথে নির্জন এলাকায় পৌঁছলেন, তখন তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হওয়ার বিষয়ে তাঁকে অবহিত করলেন; অতঃপর যখন তিনি তাঁকে যবেহ্ করতে চাইলেন, তখন তিনি (ইসমা‘ঈল আ.) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন: হে আমার আব্বু! আমাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলুন যাতে আমি আপনার কাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারি এবং আমার থেকে আপনি আপনার কাপড় গুটিয়ে নিন, যাতে তাতে কোনো রকম রক্ত লেগে না যায়, অতঃপর তা আমার মা তা দেখে ফেলে; আর আপনার ছুরিতে ভালভাবে ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত ছুরি চালিয়ে দিন, যাতে তা আমার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়; আর যখন আপনি আমার মায়ের নিকট ফিরে যাবেন, তখন আমার পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম দিবেন।
ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম বললেন: হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি কত উত্তম সাহায্যকারী! অতঃপর তিনি তাঁর নিকট এগিয়ে গেলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁরা দু’জনই কাঁদছেন; অতঃপর তিনি তাঁর গলার উপরে ছুরি চালালেন, কিন্তু ছুরি কাটতে পারল না; অতঃপর তিনি ছুরিতে দুইবার বা তিনবার পাথর দ্বারা ধার দিলেন, কিন্তু তার পরেও তা কাটতে ব্যর্থ হল; ঠিক এই মুহূর্তে ছেলে বলল: হে আমার আব্বাজান! আপনি আমাকে উপুড় করে শুইয়ে দিন; কেননা, আপনি যদি আমার চেহারের দিকে নজর করেন, তাহলে আমার প্রতি আপনার মায়া হবে এবং আপনাকে এমন মায়া-মমতায় পেয়ে বসবে, যা আপনার ও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ পালনের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করবে; আর আমিও ছুরির দিকে তাকাতে পারব না, যার ফলে আমি অস্থিরতা প্রকাশ করব; অতঃপর ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম তাই করলেন এবং তাঁর ঘাড়ে ছুরি চালিয়ে দিলেন, কিন্তু ছুরি ফিরে আসল এবং তাঁকে আহ্বান করা হল এই বলে:
﴿ يَٰٓإِبۡرَٰهِيمُ ١٠٤ قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ ﴾ [الصافات: ١٠٤،  ١٠٥]
হে ইবরাহীম! আপনি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যই পালন করলেন![35]

৪. আর তিনিই তো ‘ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিমাস্ সালাম, যাঁর ব্যাপারে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুরভিত প্রশংসা ও উচ্চ মর্যাদার কথা এসেছে, আর তিনি তো দোলনায় থাকা অবস্থায় তাঁর মায়ের অনুগত ছিলেন; আর এটাই তাঁর প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি তাঁর দাসত্বের কথা ইঙ্গিত করে; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআনে জানিয়ে দিয়েছেন; তিনি বলেন:  
﴿ وَبَرَّۢا بِوَٰلِدَتِي وَلَمۡ يَجۡعَلۡنِي جَبَّارٗا شَقِيّٗا ٣٢ ﴾ [مريم: ٣٢]
আর তিনি আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং আমাকে তিনি করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য।[36]

• পূর্ববর্তী কালের সৎ ব্যক্তিগণের পিতামাতার প্রতি আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা:

আমরা যখন পূর্ববর্তী কালের সৎ ব্যক্তিগণের জীবন-বৃত্তান্তের দিকে নজর দিব, তখন আমরা এমন অনেক উজ্জ্বল পৃষ্ঠা দেখতে পাব, যেগুলো প্রমাণ করে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের ব্যপারে তারা কঠোরভাবে গুরুত্বারোপ করতেন; এসব ঘটনা প্রবাহের মধ্য থেকে কয়েকটি নিম্নরূপ:

১. উম্মু হানী বিনতে আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা’র মাওলা (আযাদকৃত গোলাম) আবূ মুর্রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত:
« أنه ركب مع أبى هريرة إلى أرضه بالعقيق ، فإذا دخل أرضه صاح بأعلى صوته : عليك السلام ورحمة الله وبركاته يا أماه . تقول : وعليك السلام ورحمة الله وبركاته . يقول : رحمك الله كما ربيتنى صغيرا . فتقول : يا بنى ! وأنت فجزاك الله خيرا ورضى عنك كما بررتنى كبيرا » . ( رواه البخاري ) .
“একদা তিনি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র সাথে বাহনে করে তাঁর ভূমি ‘আকীকের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তারপর যখন তিনি তাঁর ভূমিতে প্রবেশ করলেন, তখন উচ্চস্বরে আওয়াজ দিয়ে বললেন: হে মা! আপনার উপর শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হউক; তখন প্রতিত্তুরে তাঁর মা বললেন: তোমার উপরও শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হউক। এবার তিনি বললেন: আপনার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা ঠিক তেমনিভাবে রহম করুন, যেমনিভাবে আপনি ছোটকালে আমাকে লালন-পালন করেছেন; অতঃপর মাতা বললেন: হে আমার প্রিয় বৎস! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকেও উত্তম পুরস্কার দান করুক এবং তোমার প্রতি তিনি তেমনি সন্তুষ্ট থাকুক, যেমন সদ্ব্যবহার তুমি আমার বৃদ্ধকালে আমার প্রতি করেছ[37]

২. আর এই তো আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র কথা, জনৈক বেদুঈন তাঁর সাথে মক্কার পথে মিলিত হল। আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তাকে সালাম দিলেন এবং যে গাধার উপর তিনি সওয়ার ছিলেন, তাকেও তাতে উঠিয়ে নিলেন; আর তাকে তাঁর মাথার পাগড়িটি দিয়ে দিলেন।
ইবনু দিনার রহ. বলেন: আমরা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললাম: আল্লাহ আপনাকে কল্যাণ দান করুন, নিশ্চয় তারা বেদুঈন এবং তারা অল্প কিছু পেলেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়।
অতঃপর আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:
« إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ : « إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ » . ( رواه مسلم و أبو داود ) .
এই ব্যক্তির পিতা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র বন্ধু ছিলেন; আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: “সৎকাজগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় সৎকাজ হলো পিতার বন্ধুদের পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।[38]

৩. মুমিন জননী ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« دَخَلْتُ الْجَنَّةَ ، فَسَمِعْتُ فِيهَا قِرَاءَةً ، فَقُلْتُ : مَنْ هذَا ؟ قَالُوا : حَارثَةُ بْنُ النُّعْمَانِ ، كَذَلِكُمُ الْبِرُّ ، كَذَلِكُمُ الْبِرُّ ، وَكَانَ أَبَرَّ النَّاسِ بأُمِّهِ » . ( رواه أحمد و عبد الرزاق ) .
“আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, তারপর সেখানে আমি ক্বিরাত (আবৃতি) শুনতে পেলাম, অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম: এই ব্যক্তি কে? তারা বলল: হারেছা ইবন নু‘মান;  ভালকাজ এ রকমই! ভালকাজ এ রকমই! আর মানুষের মাঝে সে ছিল তার মাতার সাথে সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারকারী ব্যক্তি।[39]

৪. আবূ আবদির রাহমান রহ. থেকে ঘটনা বর্ণিত, তিনি বলেন: “কাহমাস ইবন হাসান ঘরের মধ্যে একটি বিচ্ছু দেখতে পেলেন; তিনি এটাকে হত্যা করতে অথবা ধরতে চাইল, কিন্তু এটা তাকে পিছনে ফেলে দিয়ে এক গর্তের মধ্যে প্রবেশ করল; অতঃপর তিনি তাকে ধরার জন্য গর্তের মধ্যে তার হাত ঢুকিয়ে দিলেন, তারপর বিচ্ছুটি তাকে দংশন করতে শুরু করল; অতঃপর তাকে বলা হল: তুমি কেন এটা করতে গেল? জবাবে সে বলল: আমি আশঙ্কা করেছি যে, গর্ত থেকে বিচ্ছুটি বের হবে, তারপর আমার মায়ের নিকট গিয়ে তাঁকে দংশন করবে।”[40]

৫. আর এই তো আবূল হাসান ইবন আলী ইবন হুসাইন ইবন আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র কথা, আর তিনি যাইনুল ‘আবেদীন নামেও পরিচিত; তিনি তাবে‘ঈদের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, তিনি তাঁর মায়ের সাথে বেশি বেশি ভাল ব্যবহার করতেন, এমনকি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা হত: নিশ্চয় আপনি আপনার মায়ের সাথে সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারকারী মানুষ; আর আমরা আপনাকে আপনার মায়ের সাথে খেতে দেখি না; তখন তিনি বলেন: “আমি আশঙ্কা করি যে, আমার হাত এমন খাদ্য বস্তুর দিকে চলে যাবে, যার দিকে পূর্ব থেকেই তাঁর (আমার মায়ের) পছন্দের চোখ পড়ে আছে, ফলে আমি তাঁর অবাধ্য সন্তানে পরিণত হব।”[41]

৬. হিশাম ইবন হাস্সান বলেন: “হাফসা বিনতে সিরীন আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: মুহাম্মাদ ইবন সিরীনের মা ছিলেন হিজাযী নারী; বিভিন্ন রঙ তাকে মুগ্ধ করত; আর মুহাম্মাদ যখন তার জন্য কাপড় ক্রয় করতেন, তখন তিনি যথাসম্ভব উজ্জ্বল রঙের কাপড় ক্রয় করতেন; অতঃপর যখন ঈদ আসত, তখন তার কাপড়গুলো রঙ করে দিতেন; আর আমি কখনও তাকে তার মায়ের সাথে উচ্চ আওয়াজে কথা বলতে দেখিনি, তিনি যখন তার সাথে কথা বলতেন, তখন তিনি ঐ ব্যক্তির ন্যায় কথা বলতেন, যার কথা কান পেতে শুনতে হয়।”[42]
সিরীনের বংশের কেউ কেউ বলেন: “আমি কখনও মুহাম্মাদ ইবন সিরীনকে তার মায়ের সাথে বিনম্র না হয়ে কথা বলতে দেখিনি।”
ইবনু ‘আউন থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন: “মুহাম্মাদ ইবন সিরীন যখন তাঁর মায়ের কাছে অবস্থান করতেন, তখন যদি কোনো ব্যক্তি তাকে দেখতেন, তখন তার নিকটে তার নিম্নস্বরে কথা বলার কারণে তিনি ধারণা করতেন যে, তিনি মনে হয় অসুস্থ।”[43]
ইবনু ‘আউন আরও বলেন: “এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ ইবন সিরীনের নিকট প্রবেশ করলেন, তখন তিনি তাঁর মায়ের নিকট অবস্থান করছেন; অতঃপর সেই লোকটি বলল: মুহাম্মাদের একি অবস্থা? তিনি কোনো কষ্টে আছেন নাকি? উপস্থিত লোকজন বলল: না; বরং তিনি তাঁর মায়ের নিকট এভাবেই থাকেন।”[44]    

৭. জা‘ফর ইবন সুলাইমান রহ. মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির থেকে বর্ণনা করেন যে, “তিনি তার গাল (গণ্ডদেশ) যমীনের উপর রাখতেন, অতঃপর তিনি তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন: আপনি উঠুন, আপনার পা আমার গালের উপর রাখুন।”[45]

৮. ইবনু ‘আউন আল-মুযানী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “তাঁর মা তাঁকে ডাকলেন, অতঃপর তিনি তার ডাকে সাড়া দিলেন, কিন্তু এতে তাঁর মায়ের আওয়াজের চেয়ে তাঁর গলার আওয়াজ উঁচু হয়ে গেল; ফলে তিনি দু’টি গোলাম আযাদ (মুক্ত) করে দিলেন।”[46]

৯. আর ওমর ইবন যরকে বলা হল: “আপনার প্রতি আপনার ছেলের আনুগত্য বা সদ্ব্যবহারের অবস্থাটা কেমন ছিল? তখন তিনি বলেন: আমি দিনের বেলায় হাঁটলে সে আমার পিছনে পিছনে হাঁটত; আর রাতের বেলায় হাঁটলে সে আমার সামনে সামনে হাঁটত; আর আমি নিচে থাকলে সে কখনও ছাদের উপরে উঠত না।”[47]

১০. সালেহ আল-‘আব্বাসী একবার খলীফা আল-মানসুরের মাজলিসে হাযির হলেন এবং তাকে হাদিস শুনাচ্ছিলেন, আর তিনি তার কথায় বেশি বেশি বলতে লাগলেন: আমার পিতা, তাঁর প্রতি আল্লাহ রহম করুন ( أبي رحمه الله ); তখন রবী‘ তাকে উদ্দেশ্য করে বলল: তুমি আমীরুল মুমিনীনের সামনে তোমার বাপের ব্যাপারে এত বেশি বেশি ‘রহমত’-এর বিষয়টি প্রকাশ করো না। তখন তিনি তাকে বললেন: আমি তোমাকে তিরস্কার করব না; কারণ, তুমি তো পিতার মজা উপভোগ করনি। অতঃপর খলিফা আল-মানসুর মুসকি হাসলেন এবং বললেন: যে ব্যক্তি বনু হাশিমের মুখোমুখি হবে, এটাই তার পুরস্কার।[48]

১১. আর পিতামাতার প্রতি অনুগত ও সদ্ব্যবহারকারীগণের অন্যতম একজন হলেন মুহাদ্দিস বুন্দার; তাঁর ব্যাপারে যাহাবী রহ. বলেন: “তিনি বসরার হাদিস সংকলন করেছেন, কিন্তু তিনি তাঁর মায়ের প্রতি অনুগত থাকার কারণে কোনো সফর করেন নি।”[49]
আবদুল্লাহ ইবন জা‘ফর ইবন খাকান আল-মাররুযী বলেন: “আমি বুন্দারকে বলতে শুনেছি: আমি জ্ঞান অনুসন্ধানে বের হতে বা সফর করার ইচ্ছা করলাম, কিন্তু আমার মা আমাকে নিষেধ করলেন, আমি তার আনুগত্য করলাম, ফলে সে ব্যাপারে আমার বরকত হয়েছে।”[50]

১২. আর আসমা‘য়ী বলেন: আরবের এক ব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি সবচেয়ে অবাধ্য মানুষ ও সবচেয়ে অনুগত মানুষের সন্ধানে বের হলাম; অতঃপর আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত আমি দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় এক বৃদ্ধের দেখা পেলাম, পানি উঠানোর জন্য যার গলায় রশি দিয়ে বালতি বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যা টেনে উঠানো উটের পক্ষেও সম্ভব নয়, আর তার পিছনে চামরার পেঁচানো রশি (চাবুক) হাতে এক যুবক তাকে প্রহার করছে; আর সে এ রশি দ্বারা পিটিয়ে তার পিঠ রক্তাক্ত করে ফেলেছে। অতঃপর আমি বললাম: তুমি কি এই দুর্বল বৃদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে না? তার ঘাড়ে রশি লাগিয়ে দেওয়াটা কি যথেষ্ট হয়নি যে, তুমি তাকে আবার প্রহার করছ?
তখন সে বলে: তাতো আমি আমার পিতার সাথে এই ব্যবহার করছি (তাতে তোমার কি); তখন আমি বললাম: তাহলে তো আল্লাহ তোমাকে ভালো পুরস্কার দিবেন না।
তখন সে বলল: চুপ কর, সে তো তার পিতার সাথে এরূপ ব্যবহার করত; আর তার পিতাও তার দাদার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করত; তখন আমি বললাম: এই হল সবচেয়ে অবাধ্য মানুষ।
অতঃপর আমি ঘুরতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত দেখা পেলাম এক যুবকের, যার ঘাড়ে একটি ঝুড়ির মধ্যে রয়েছে এক বৃদ্ধলোক, মনে হচ্ছিল যেন একটি মুরগীর বাচ্চা; তারপর সে সব সময় তাকে তার সামনে রাখত এবং তাকে খাওয়াতো যেমনিভাবে মুরগীর বাচ্চাকে খাওয়ানো হয়; তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম: ওনি কে? সে বলল: আমার আব্বা, বয়সের ভারে তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আমি তাকে দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছি; তখন আমি বললাম: এই হল আরবের সবচেয়ে অনুগত ও ভাল মানুষ।[51]  

১৩. ত্বলক ইবন হাবীব আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও আলেমগণের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন; তিনি তাঁর মায়ের মাথায় চুম্বন করতেন; আর তাঁর মা ঘরের নীচে অবস্থান করা অবস্থায় তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য তিনি কখনও ঘরের ছাদের উপর হাঁটতেন না।[52]

১৪. ‘আমের ইবন আবদিল্লাহ ইবন যুবায়ের রহ. বলেন: “আমার পিতা মারা গেছেন, আর আমি পরিপূর্ণ এক বছর আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছি।”[53]
« آخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين , و صلى الله و سلم على نبينا محمد و على آله و صحبه أجمعين  » .
(আর আমাদের শেষ ধ্বনি হবে: ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর প্রাপ্য’; আর আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সঙ্গী-সাথীর উপর)।

* * *




সূচীপত্র
- ভূমিকা
-          অবাধ্যতার সংজ্ঞা।
-          পিতামাতার অবাধ্যতার বাহ্যিক রূপ-প্রকৃতি।
-          পিতামাতার অবাধ্যতার ৩৩টি বাহ্যিক রূপ।
-          অবাধ্যতার কিছু নমুনা কাহিনী।
-          অবাধ্যতার ১২টি কারণ।
-          প্রতিকারের উপায়।
-          পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের পরিচয়।
-          পিতামাতার সাথে আচার-আচরণের ২৬টি লক্ষণীয় দিক।
-  সদ্ব্যবহারে সহায়ক ১২টি বিষয় বা কর্মকাণ্ড।
-          স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয়।
প্রথমত: বিবাহিত ছেলে কর্তৃক তার স্ত্রী ও পিতামাতার মাঝে সমন্বয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা।
দ্বিতীয়ত: পুত্রবধুর ভূমিকা।
তৃতীয়ত: স্বামীর মায়ের (শাশুড়ীর) ভূমিকা।
-          সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা কাহিনী।
- নবীগণ কর্তৃক পিতামাতার প্রতি আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা।
- পূর্ববর্তী কালের সৎ ব্যক্তিগণের পিতামাতার প্রতি আনুগত্য ও সদ্ব্যবহারের কিছু নমুনা।
* * *





[1] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬ 
[2] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৫১
[3] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩ - ২৪
[4] সূরা লোকমান, আয়াত: ১৪
[5] বুখারী, হাদিস নং- ৫০৪ ও ৬৫২৫; মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৪
[6] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩
[7] বুখারী, হাদিস নং- ৬২৯৮
[8] লিসানুল আরব: ১০/২৫৬
[9] লিসানুল আরব: ১০/২৫৭
[10] দেখুন: ড. মুস্তফা আস-সাবা‘য়ী, ‘আখলাকুনা আল-ইজতিমা‘য়ীয়্যাহ’ (أخلاقنا الاجتماعية ), পৃ. ১৬৬; আবদুর রউফ আল-হানাবী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ১৪৩; হাসান আইয়ূব, ‘আস-সুলুকুল ইজতিমা‘য়ী’ (السلوك الاجتماعي), পৃ. ২৫৮ - ২৫৯; উম্মু আবদিল কারীম, ‘কুর্রাতুল ‘আইনাইন ফী ফাদায়েলি বির্রিল ওয়ালিদাইন’ (قرة العينين في فضائل بر الوالدين); সা‘আদ বিনতে মুহাম্মাদ ফারাজ, ‘বিল ওয়ালিদাইনে ইহসানা’ (بالوالدين إحسانا ), পৃ. ৪৪ - ৪৮; নিযাম সাকাজিহা, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইনে ফিল কুরআনিল কারীমে ওয়াস সুন্নাহ আস-সহীহা’ (بر الوالدين في القرآن الكريم والسنة الصحيحة), পৃ. ৩৫ - ৪১ ও ৬৩ - ৬৫; ড. আবদুল্লাহ আত-ত্বাইয়ার, ‘ফয়দুর রাহীম আর-রাহমান’ (فيض الرحيم الرحمن ), পৃ. ৯৬; আহমাদ ‘ঈসা ‘আশুরা, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইনে ওয়া হুকুকুল আবায়ে ওয়াল আবনায়ে ওয়াল আরহাম’ (بر الوالدين و حقوق الآباء و الأبناء و الأرحام ), পৃ. ৩৩ - ৪৫; ইবরাহীম আল-হাযেমী, ‘আল-ই‘লাম বেবির্রিল ওয়ালিদাইনে ওয়া সিলাতিল আরহাম’ (الإعلام ببر الوالدين و صلة الأرحام ), পৃ. ৩৫ - ৪১; ড. মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ আস-সালেহ, ‘আত-তাকাফুলুল ইজতিমা‘য়ী ফিশ শারী‘য়াতিল ইসলামিয়্যা’ (التكافل الاجتماعي في الشريعة الإسلامية), পৃ. ৯৮ - ১০৫
[11] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩
[12] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩
[13] যাহাবী, ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ (سير أعلام النبلاء ): ৪/৪৩৩
[14] বুখারী, হাদিস নং- ৫৬২৮; মুসলিম, হাদিস নং- ২৭৩; হাদিসের শব্দগুলো ইমাম মুসলিম রহ. এর।
[15] ইবনু কুতাইবা, ‘উয়ূনুল আখবার’ (عيون الأخبار ): ৩/৮৬ - ৮৭; ‘কিতাবুল ইখওয়ান’ (كتاب الإخوان ); আরও দেখুন: আল-হানাভী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ১৩৮ - ১৩৯
[16] এই পংক্তিগুলো ইয়াহইয়া ইবন সা‘ঈদ, ইবনু আবদুল আ‘লা ও আবূল ‘আব্বাস আল-আ‘মা-এর বলে উল্লেখ করা হয়; তাছাড়া উমাইয়া ইবন আবি সালত-এর সাথেও এই পংক্তিগুলো সম্বন্ধযুক্ত করা হয়। দেখুন: ইবনু কুতাইবা, ‘উয়ূনুল আখবার’ (عيون الأخبار ): ৩/৮৭; আল-‘আজলুওনী, ‘কাশফুল খাফা’ (كشف الخفاء ): ১/২০৭ - ২০৮; ইমাম তারতূশী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ১০৮ - ১০৯
[17] ড. মুহাম্মাদ ইবন লুতফী আস-সাব্বাগ, ‘নাযরাত ফিল উসরাতিল মুসলিমা’ (نظرات في الأسرة المسلمة ), পৃ. ৪৯
[18] আল-হানাভী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ১৩৫
[19] লিসানুল আরব: ৪/৫৩
[20] দেখুন: ‘কাদাউদ্ দাইন’ (قضاء الدين ), পৃ. ১৩ - ২১; ‘ওয়া বিল-ওয়ালিদাইনে ইহসানা’ (و بالوالدين إحسانا ), পৃ. ৬৩ - ৬৬
[21] দেখুন: মুহাম্মদ সা‘ঈদ মুবীদ, ‘আদাবুল মুসলিম ফীল ‘আদাতে ওয়াল ‘ইবাদাতে ওয়াল মু‘আমিলাত’ (أدب المسلم في العادات و العبادات و المعاملات ), পৃ. ১৫৮ - ১৬০; নিজাম ইয়া‘কুবী, ‘কুর্রাতুল ‘আইনাইন ফী ফাদায়েলি বির্রিল ওয়ালিদাইন’ (قرة العينين في فضائل بر الوالدين), পৃ. ৪৬ - ৫২; আবদুল্লাহ ‘উলওয়ান, ‘তারবিয়্যাতুল আওলাদ ফিল ইসলাম’ (تربية الأولاد في الإسلام ), ১/২৮৫ - ২৮৬; আল-হাযেমী, ‘আল-ই‘লাম ফী মা ওয়ারাদা ফী বির্রিল ওয়ালিদাইনে ওয়া সিলাতিল আরহাম’ (الإعلام في ما ورد في بر الوالدين و صلة الأرحام ), পৃ. ২৬; আহমাদ ‘ঈসা ‘আশুর, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইনে ওয়া হুকুকুল আবায়ে ওয়াল আবনায়ে ওয়াল আরহাম’ (بر الوالدين و حقوق الآباء و الأبناء و الأرحام ), পৃ. ১৬ - ২০; ড. মুহাম্মাদ আস-সালেহ, ‘আত-তাকাফুলুল ইজতিমা‘য়ী ফিশ শারী‘য়াতিল ইসলামিয়্যা’ (التكافل الاجتماعي في الشريعة الإسلامية), পৃ. ৯৮ - ১০৫; আলী মুহাম্মাদ জাম্মায, ‘ওয়াসিয়্যাতু লুকামান লি-ইবনেহি’ (وصية لقمان لابنه ), পৃ. ২৩ - ৩৩
[22] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩
[23] বুখারী, হাদিস নং- ৫৬২৬; মুসলিম, হাদিস নং- ৬৬৬৪
[24] ফাতহুল বারী: ১০/৪১৬
[25] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩ - ২৪
[26] সূরা নূহ, আয়াত: ২৮ 
[27] দেখুন: মুহাম্মাদ ইবন লুতফী আস-সাব্বাগ, ‘ওসায়া লিয-যাওজাইন’ (وصايا للزوجين ) [ স্বামী-স্ত্রী’র জন্য অসীয়ত], পৃ. ৫৬ - ৬৪
[28] হাফেয তারতূশী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ১৮৮
[29] দেখুন: লেখক (মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম আল-হামাদ), ‘মিন আখতাইল আযওয়াজ’ (من أخطاء الأزواج ), পৃ. ৫ - ৯ 
[30] দেখুন: লেখকের নিজস্ব গ্রন্থ, ‘মিন আখতাইল আযওয়াজ’ (من أخطاء الأزواج), পৃ. ১১ - ১৬ 
[31] সূরা নূহ, আয়াত: ২৮ 
[32] সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৪১ - ৪৫ 
[33] সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ১০২
[34] সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ১০২
[35] সূরা আস-সাফ্ফাত, আয়াত: ১০৪ - ১০৫
[36] সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৩২ 
[37] বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং- ১৪; আলবানী সহীহ আল-আদাব আল-মুফরাদের মধ্যে বলেন: হাদিসটির সনদ হাসান পর্যায়ের।
[38] মুসলিম, হাদিস নং- ৬৬৭৭; আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৫১৪৫
[39] ইমাম আহমদ: ৬/১৫১; আবদুর রাযযাক, আল-মুসান্নাফ (২০১১৯); বাগভী রহ. ‘শরহুস সুন্নাহ: ১৩/৭; হাকেম রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন: ৩/২০৮ এবং যাহাবী রহ.ও হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
[40] হুল্লিয়াতুল আওলিয়া (حلية الأولياء ): ৬/২১১;  আরও দেখুন: সিয়ারু আলামিন নুবালা (سير أعلام النبلاء ): ৬/৩১৮
[41] ‘উয়ুনুল আখবার (عيون الأخبار ): ৩/৯৭
[42] ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ (سير أعلام النبلاء ): ৪/৬১৯
[43] ইবরাহীম আল-বায়হাকী, ‘আল-মাহাসেন ওয়াল মাসাওয়ী’ (المحاسن والمساوئ), পৃ. ৬১৪; ‘হিলইয়াতুল আওলিয়া’ (حلية الأولياء ): ২/২৭৩
[44] ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’ (سير أعلام النبلاء): ৬/১২৮
[45] সিয়ারু আলামিন নুবালা (سير أعلام النبلاء ): ৪/৬২০
[46] সিয়ারু আলামিন নুবালা (سير أعلام النبلاء ): ৬/৩৬৬
[47] ‘উয়ুনুল আখবার (عيون الأخبار ): ৩/৯৭
[48] আল-হানাওয়ী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ৯৮; উদ্ধৃত: ‘মুহাদারাতুল উদাবায়ে ওয়া মুহাওয়ারাতুশ শু‘য়ারায়ে’ (محاضرات الأدباء و محاورات الشعراء ) নামক গ্রন্থ থেকে: ১/২০৩
[49] সিয়ারু আলামিন নুবালা (سير أعلام النبلاء ): ১২/১৪৪; আরও দেখুন: সিয়ারু আ‘লামিন নুবালায় ‘বুন্দার’ এর জীবনী: ১২/১৪৪ - ১৪৯
[50] সিয়ারু আলামিন নুবালা (سير أعلام النبلاء ): ১২/১৪৫
[51] ইবরাহীম আল-বায়হাকী, ‘আল-মাহাসেন ওয়াল মাসাওয়ী’ (المحاسن و المساوئ ), পৃ. ৬১৪
[52] হাফেয তারতূশী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ৭৮
[53] হাফেয তারতূশী, ‘বির্রুল ওয়ালিদাইন’ (بر الوالدين ), পৃ. ৭৮
_________________________________________________________________________________

সংকলন: শাইখ মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম আল-হামাদ
অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ


আরও পড়ুনঃ মা দিবস!


পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

1 টি মন্তব্য: