সোমবার, ২০ জুলাই, ২০১৫

তওবা: জান্নাতের সোপান

তওবা: জান্নাতের সোপান



তওবা: জান্নাতের সোপান

ভূমিকা: কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে সে ব্যক্তিই উত্তম যে ভুল করার পর তওবা করে। আমাদের সবারই ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। কখনও মুখ ফসকে মুখের দ্বারা গুনাহ হয়েছে। অসাক্ষাতে কারও সমালোচনা করেছি, কাউকে গালি দিয়েছি, কখনো অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদের প্রতি হাত বাড়িয়েছি, কখনও এমন জিনিসের দিকে তাকিয়েছি যাতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। এভাবে কত ধরণের গুনাহর কাজ আমরা করেছি! এজন্যই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর তওবা করা অপরিহার্য করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর। যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।”[1]

তিনি আরও বলেছেন,
تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا
“তোমরা আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে তওবা কর।”[2] 
সুতরাং প্রতিটি পাপের জন্য বান্দার তওবা করা অপরিহার্য।

তওবা কারীদের প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত আনন্দিত হন

আল্লাহ তায়ালা তওবা কারীদের অত্যন্ত ভালবাসেন। বান্দা যখন তার অপরাধের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বান্দার তওবাতে কী পরিমাণ আনন্দিত হন তা নিম্নোক্ত হাদীসটিতে দেখুন,

প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খাদেম আবু হামযা আনাস বিন মালিক রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
اللَّهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلَى بَعِيرِهِ ، وَقَدْ أَضَلَّهُ فِى أَرْضِ فَلاَةٍ
“কোনও লোক বিজন মরু প্রান্তরে উট হারিয়ে যাবার পর পুনরায় তা ফেরত পেলে যে পরিমাণ আনন্দে উদ্বেলিত হয় মহান আল্লাহ বান্দার তওবাতে তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হন।”[3]

আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
“বান্দার তওবাতে আল্লাহ তোমাদের ঐ ব্যক্তি থেকে অধিক আনন্দিত হন, যে বিজন মরু প্রান্তরে তার উট হারিয়ে ফেলল। যাতে তার খাদ্য-পানীয় ছিল। উট হারানো কারণে হতাশ হয়ে গাছের ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে সে হঠৎ দেখতে পেল তার উট তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে উটের লাগাম ধরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলতে লাগল, “হে আল্লাহ,তুমি আমার বান্দা আমি তোমার প্রভু!” অতি আনন্দের কারণে সে এভাবে ভুল কথা বলে ফেলল।”[4]

আল্লাহু আকবর! কত বিশাল এ আনন্দ! নি:সন্দেহে এটি এত বড় আনন্দের বিষয় যা কারও পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়। আপনি নিজের কথা কল্পনা করুন যে, আপনি এমন এক মরুভূমিতে অবস্থান করছেন যেখানে আপনার আশে পাশে কোন মানুষ নেই। নেই কোন খাদ্য ও পানীয়। এমন জনমানব শূন্য মরুভূমিতে আপনার উট হারিয়ে গেছে যাতে আপনার খাদ্য-পানীয় মজুদ ছিল। আপনি অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও উটের কোন হদিস পেলেন না। পরিশেষে, বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়ে কোন গাছের নিচে শুয়ে অনিবার্য মৃত্যুর প্রহর গুণতে লাগলেন।

এমন পরিস্থিতি চোখ খুলেই হঠাৎ দেখতে পেলেন, আপনার উট আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের সাথে তার লাগাম বাঁধা রয়েছে। তার উপরে খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সব কিছু ঠিকমত আছে। তখন আপনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উটের লাগাম হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ তুমি আমার বান্দা; আমি তোমার প্রভু”। আনন্দে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আপনি উল্টো কথা বলে ফেললেন। আপনার উদ্দেশ্য ছিল এ কথা বলা, “হে আল্লাহ,তুমি আমার প্রভু;আমি তোমার বান্দা।”

আপনি কি কল্পনা করতে পারেন এ আনন্দ? আমার ধারণা,আপনি বলবেন, হ্যাঁ। তাহলে জেনে রাখুন, এমন অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর দুয়ার থেকে পুনর্জীবন লাভকারী ব্যক্তির চেয়েও আল্লাহ বান্দার তওবায় বেশি খুশি হন।

এটি মূলত: দয়াময় আল্লাহর সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের অনুপম প্রমাণ বহন করে। তিনি এ কারণে বান্দার তওবাতে আনন্দিত হন না যে, আমাদের তওবা তাঁর বড় প্রয়োজন। তিনি এসব থেকে মুখাপেক্ষী হীন। বরং এটা তাঁর অন্তহীন দয়া, অপরিসীম ক্ষমা ও অনুপম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।

সুতরাং হে প্রিয় মুসলিম ভাই, কাল বিলম্ব না করে দ্রুত ছুটে আসুন এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করুন।

মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল; তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করতে চান

আল্লাহ তায়ালা দিনের অপরাধীকে ক্ষমা করার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। যেমন, ইমাম মুসলিম রহ. আবু মূসা আশয়ারী থেকে বর্ণনা করেছেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا
“আল্লাহ দিনের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। আর রাতের অপরাধীকে ক্ষমার জন্য দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন। (তিনি এরূপ করতেই থাকেন) যে পর্যন্ত না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (তথা কিয়ামত পর্যন্ত)।[5]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের অনুসরণীয়

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব বেশী তওবা-ইস্তেগফার করতেন। যেমন আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,
وَاللَّهِ إِنِّى لأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِى الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً
“আল্লাহর শপথ, আমি দিনে সত্তর বারের অধিক আল্লাহর নিকট তওবা-ইস্তেগফার করি।”[6]

সহীহ মুসলিমে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ
“হে মানব মণ্ডলী, তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর। কেননা, আমি দিনে একশ বার তওবা করি।” [7]

তওবার উপকারিতা

তওবা করলে তিনটি বড় বড় উপকারিতা লাভ হয়। যথা:

১ম: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ পালন। আর তাঁর নির্দেশ পালনেই নিহিত আছে ইহ ও পরকালের পরম সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ।

২য়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ। কারণ,তিনি দিনে একশ বার তওবা করতেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ
“হে নবী,আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাসো তবে আমার অনুসরণ কর তবে আল্লাহ ও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)

৩য়: তওবার মাধ্যমে গুনাহ সমূহ কেবল মোচন করা হয় না বরং সেগুলো নেকীতে রূপান্তরিত করে দেয়া হয়।  আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ
“কিন্তু যারা তওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহ গুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তিত করে দিবেন।” (সূরা আল ফুরকান: ৭০)

সুপ্রিয় দীনি ভাই ও বোন,‌ আমরা তওবার মহত্ব ও মর্যাদা এবং তওবা কারীর প্রতি মহান আল্লাহর ভালবাসা সম্পর্কে জানতে পারলাম। আরও জানতে পারলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও সর্বাধিক আল্লাহকে ভয় কারী হওয়া স্বত্বেও কত অধিক পরিমাণে তওবা করতেন। তাহলে এখন আমাদের চিন্তা করার দরকার আমাদের কী করণীয়? বাস্তবতা হল, আমরা তো বড়ই দুর্বল। আমরা অসংখ্য পাপের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই নয় কি?

অতএব, এখন আমাদের কর্তব্য, কাল বিলম্ব না করে তওবা করা এবং পাপের পুঁতি দুর্গন্ধময় জগত হতে বের হয়ে অনাবিল সুন্দর ও আলোকিত ভুবনে ফিরে আসা। আমাদের উচিৎ চির শান্তির নীড় জান্নাতের প্রত্যাশা করা এবং জান্নাতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিবেশী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা।

কবি বলেন,

কাজ কর সে শাশ্বত: গৃহের তরে

রেজওয়ান যার দারোয়ান।

পড়শি যার আহমদ আর নির্মাতা রহমান।

কুস্তরী সম মৃত্তিকা আর স্বর্ণ ছাড়ানো ভূমি।

সবুজ প্রকৃতি লতা-গুল্ময় জাফরান রয়েছে চুমি।

সে আবাস ভূমির দিলেন দিশা আহমদ প্রিয়তম।

বিক্রেতা যার দয়ার পাথার মনিব আপন জন।

নিশিত রাতে ডাকে জিবরীল কিনবে সে ঘর কে গো?

আঁধার মাড়িয়ে সালাতের তরে রাত্রিতে তব জাগো।

তওবার শর্তাবলী

জেনে রাখা দরকার যে, তওবার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। এ সকল শর্ত সাপেক্ষে কেবল তওবা কবুল হতে পারে; অন্যথায় নয়। গুনাহ যদি বান্দা ও আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়; অপর কোন মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয় তবে তার জন্য তিনটি শর্ত। যথা:

১ম শর্ত: তৎক্ষণাৎ গুনাহ হতে বিরত থাকা।
২য় শর্ত: গুনাহের জন্য লজ্জিত হওয়া।
৩য় শর্ত: পুনরায় উক্ত গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
উল্লেখিত তিনটি শর্ত পূরণ না হলে তওবা কবুল হবে না।

আর অন্যায় যদি অন্য মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট হয় তবে তার জন্য চার টি শর্ত। উল্লেখিত তিনটি শর্তের সাথে চতুর্থ শর্ত হল, সম্ভব হলে যার অধিকার হরণ করা হয়েছে তার সাথে বিষয়টি সুরাহা করে নেয়া। যেমন, কারও অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করা হলে তা মালিকের নিকট ফিরিয়ে দিতে হবে। অগোচরে  কারও সমালোচনা করা হলে তার সাথে বিষয়টি মিটমাট করে নেয়া। তবে যদি তা সম্ভব না হয় তবে উক্ত ব্যক্তির জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে এবং তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করতে হবে।

যে ব্যক্তি ক্ষমার যোগ্য নয়

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক প্রকার মানুষের কথা বলেছেন, যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। আমরা যেন এ প্রকার লোকদের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে যাই সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহর নিকট এদের থেকে পানাহ চাই।

সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
كُلُّ أُمَّتِى مُعَافًى إِلاَّ الْمُجَاهِرِينَ ، وَإِنَّ مِنَ الْمَجَاهرة أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً ، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ ، فَيَقُولَ يَا فُلاَنُ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا ، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ
“আমার উম্মতের সকলকেই ক্ষমা করে দেয়া হবে। তবে ঐ সকল লোককে ক্ষমা করা হবে না যারা পাপ করার পর তা অন্যের নিকট প্রকাশ করে দেয়। অন্যের নিকট প্রকাশ করার একটি দিক হল, কোন ব্যক্তি রাতের আঁধারে কোন গুনাহ করল এবং মহান আল্লাহ তার পাপটা গোপন করে রাখলেন। কিন্তু ভোর হলে সে নিজেই অন্য মানুষের নিকট বলল, হে উমুক, জানো, রাতে আমি এই এই কাজ করেছি। সারা রাত আল্লাহ তার পাপটাকে ঢেকে রেখেছিলেন কিন্তু ভোর হলে নিজেই আল্লাহর ঢেকে রাখা বিষয়টি প্রকাশ করে দিল।”[8]

যারা পাপাচার কারার পর আবার মানুষের সামনে বলে বেড়ায় যে, আমি এই এই কাজ করেছি আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহর নিকট এ কাজ থেকে পানাহ চাই।

সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তওবা করা আবশ্যক

তওবার সময় ফুরিয়ে যাবার পূর্বেই আমাদের তওবা করা আবশ্যক। কারণ, তওবার জন্য নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে আল্লাহ তওবা কবুল করবেন না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ الْعَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ
“আল্লাহ বান্দার তওবা কবুল করেন যতক্ষণ না কণ্ঠনালীর নিকট দম আসে (কিন্তু কণ্ঠনালীর নিকট দম এসে গেলে তখন আর তওবা কবুল করা হয় না)।”[9]

আল্লাহ বলেন,
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّىٰ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ
“ঐ সব  লোকের জন্য তওবা নেই, যারা পাপ করতে থাকে-এমন কি যখন মৃত্যু এসে যায় তখন বলতে থাকে এখন তওবা করছি।” ( নিসাঃ ১৮)

প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত।  তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ
“পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয়ের পূর্বে (কিয়ামতের পূর্বে) যে তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।”[10]

সুতরাং আমরা কি জানি কখন মৃত্যু দূত আমাদের দুয়ারে এসে উপস্থিত হয়? এমনও তো হতে পারে যে, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত পৌঁছতে পারব না- এমন কি এই লিখাটিও পড়ে শেষ করার পূর্বেই আমার-আপনার দেহ হতে প্রাণ পাখি উড়ে যাবে। অতএব,আসুন আমরা দ্রুত তওবা করি। তওবার পথ এখনো উন্মুক্ত। আল্লাহ আমাদেরকে তওবা কারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

তওবাকারীদের দুটি ঘটনা

প্রথম ঘটনা: আবু সাঈদ সাদ বিন মালিক মিন সিনান খুদরী রা. হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَسَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الْأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَاهِبٍ فَأَتَاهُ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ فَقَالَ لَا فَقَتَلَهُ فَكَمَّلَ بِهِ مِائَةً ثُمَّ سَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الْأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَجُلٍ عَالِمٍ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ مِائَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ فَقَالَ نَعَمْ وَمَنْ يَحُولُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ التَّوْبَةِ انْطَلِقْ إِلَى أَرْضِ كَذَا وَكَذَا فَإِنَّ بِهَا أُنَاسًا يَعْبُدُونَ اللَّهَ فَاعْبُدْ اللَّهَ مَعَهُمْ وَلَا تَرْجِعْ إِلَى أَرْضِكَ فَإِنَّهَا أَرْضُ سَوْءٍ فَانْطَلَقَ حَتَّى إِذَا نَصَفَ الطَّرِيقَ أَتَاهُ الْمَوْتُ فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ فَقَالَتْ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ جَاءَ تَائِبًا مُقْبِلًا بِقَلْبِهِ إِلَى اللَّهِ وَقَالَتْ مَلَائِكَةُ الْعَذَابِ إِنَّهُ لَمْ يَعْمَلْ خَيْرًا قَطُّ فَأَتَاهُمْ مَلَكٌ فِي صُورَةِ آدَمِيٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ فَقَالَ قِيسُوا مَا بَيْنَ الْأَرْضَيْنِ فَإِلَى أَيَّتِهِمَا كَانَ أَدْنَى فَهُوَ لَهُ فَقَاسُوهُ فَوَجَدُوهُ أَدْنَى إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي أَرَادَ فَقَبَضَتْهُ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ
“তোমাদের আগের উম্মতে এক লোক ছিল। সে নিরানব্বই জন লোক খুন করার পর জিজ্ঞেস করল, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আলেম কে? তাকে এক খৃষ্টান পাদ্রীর সন্ধান দেয়া হল। সে উক্ত পাদ্রীর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এ পরিস্থিতিতে তার কি তওবা করার সুযোগ আছে? পাদ্রী জবাব দিল: “না।” এতে সে ক্রুদ্ধ হয়ে পাদ্রীকে হত্যা করে একশ খুন পূর্ণ করলো।

অতঃপর আবার সে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আলেম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। এবার তাকে এক আলেমের সন্ধান দেয়া হল। তাঁর নিকট গিয়ে সে বলল: সে একশ মানুষ খুন করেছ। তার কি কোন তওবার সুযোগ আছে? আলেম বললেন, “হ্যাঁ, তওবার পথ তো খোলা আছে। তওবার সামনে কোন কিছু প্রতিবন্ধক নাই। তবে তুমি অমুক এলাকায় যাও, সেখানে আল্লাহর ইবাদত গুজার কিছু মানুষ বসবাস করে। তাদের সাথে তুমিও আল্লাহর ইবাদত কর। আর তোমার এলাকায় ফিরে এসো না। ওটা খারাপ এলাকা।

এ কথা শুনে সে ব্যক্তি উক্ত এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। পথের মাঝখানে আসলে সে মৃত্যু বরণ করল। অতঃপর রহমতের ফিরিশতাগণ এবং আজাবের ফিরিশতাগণ এসে তার ব্যাপারে বিবাদে লিপ্ত হল। রহমতের ফিরিশতাগণ বললেন, এই ব্যক্তি যেহেতু তওবা করেছে এবং আল্লাহর প্রতি মন-প্রাণ সমর্পণ করে এসেছে। (সুতরাং আমরা তাকে নিয়ে যাব।)

আজাবের ফিরিশতাগণ বললেন, এ লোকটি কখনো কোন সৎকাজ করে নি। (সুতরাং আমরা তাকে নিয়ে যাব।) এহেন অবস্থায় তাদের নিকট অন্য এক ফিরিশতা মানুষের রূপ ধরে এসে দু দলের মাঝে ফয়সালা করে দিলেন। তিনি বললেন, লোকটি যেখান থেকে এসেছিল এবং যেখানে যাচ্ছিল এই দুই এলাকার দূরত্ব পরিমাপ কর। যে এলাকার নিকটবর্তী হবে তদনুযায়ী সে পক্ষ তাকে নিয়ে যাবে।

তারা দূরত্ব মাপল এবং যে এলাকায় যাওয়ার সে ইচ্ছা করেছিল তার নিকটবর্তী পেল। অতঃপর রহমতের ফিরিশতাগণ তাকে নিয়ে চলে গেল।[11]

সহীহ বুখারীর এক বর্ণনায় রয়েছে, উক্ত লোকটি ভাল গ্রামটির এক বিঘত নিকটে ছিল। বিধায় তাকে সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হল। সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে,
فَأَوحَى الله تَعَالَى إِلى هذِهِ أَنْ تَبَاعَدِي ، وإِلَى هذِهِ أَنْ تَقَرَّبِي ، وقَالَ : قِيسُوا مَا بيْنَهُما ، فَوَجَدُوهُ إِلى هذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَهُ
“আল্লাহ খারাপ গ্রামটিকে একটু দূরে সরে যাওয়ার এবং ভাল গ্রামটিকে একটু নিকটে আসার নির্দেশ দিয়ে বললেন, দুটি গ্রামের দূরত্ব মাপ। ফিরিশতাগণ দূরত্ব পরিমাপ করে উক্ত লোকটিকে ভালো গ্রামটির এক বিঘত পরিমাণ নিকটে পেলেন ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেয়া হল।

২য় ঘটনা: প্রখ্যাত সাহাবী আবু নহাইদ ইমরান বিন হুসাইন খুযাঈ রা. হতে বর্ণিত। জুহাইনা গোত্রের এক নারী ব্যভিচারের মাধ্যমে গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিল। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি হদ বা শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গেছি। আমার উপর তা কার্যকর করুন।

নবী তার অভিভাবককে ডেকে বললেন, একে নিয়ে যাও। তার সাথে ভাল ব্যাবহার করবে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তাকে আমার নিকট নিয়ে এসো।

মহিলাটির অভিভাবক তাই করলেন। এবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাকে কাপড় দিয়ে বাঁধার নির্দেশ দিয়ে রজম (পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা) কার্যকর করার ফরমান জারি করলেন।

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলার জানাযা পড়ার জন্য অগ্রসর হলে উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি এ মহিলার জানাযা পড়বেন অথচ সে তো ব্যভিচার করেছে? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন,
لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِمَتْ بَيْنَ سَبْعِينَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ لَوَسِعَتْهُمْ وَهَلْ وَجَدْتَ تَوْبَةً أَفْضَلَ مِنْ أَنْ جَادَتْ بِنَفْسِهَا لِلَّهِ تَعَالَى
“এ মহিলা এমনভাবে তওবা করেছে যে, তা যদি মদীনার সত্তর জন অধিবাসীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় তবে সকলের জন্য তা যথেষ্ট হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেকে পবিত্র করল, তার চেয়ে উত্তম আর কাকে পাবে?”[12]

হে যুবক,

হে যুবক, তুমি কি ঐ জিনিসের কথা স্মরণ করো যা তোমার জীবনের  সব সুখ ও আনন্দ-বিলাসকে ধূলিসাৎ করে দিবে ?
তুমি কি স্মরণ করো সে দিনের কথা যে দিন তুমি হবে নির্জন কবরের বাসিন্দা?
সে দিনের কথা কি তোমার স্মরণ হয় যে দিন তোমাকে স্ত্রী-পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ধন-সম্পদ, বন্ধু-বান্ধব সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে?
কবরের সংকীর্ণতা ও ঘুটঘুটে অন্ধকারের কথা কি তোমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে?
কবরের বিভীষিকাময় ও ভয়ঙ্কর অবস্থা কি তোমার স্মরণ হয়?
কবরের শাস্তির নিষ্ঠুরতা এবং বিষধর সাপ-বিচ্ছুর দংশনের কথা কি তোমার মনে ভয় সৃষ্টি করে?
চাবুকের নিষ্ঠুর কষাঘাতে জর্জরিত হওয়ার কথা কি তোমার হৃদয়কে নাড়া দেয়?
কবরের শাস্তির ভয়ে কি তোমার অন্তরাত্মা প্রকম্পিত হয়?
মুনকার-নাকির ফিরিশতা দ্বয়ের প্রশ্নের সঠিক জবাব কি দিতে পারবে তুমি?
অনুরূপভাবে কবরের অফুরন্ত সুখ ও অনাবিল শান্তির কথা কখনও কি তোমাদের হৃদয় পটে জাগ্রত হয়েছে?

কবরের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন

কবরের প্রশ্নের জবাব প্রস্তুত করুন। প্রস্তুত হোন সঠিকভাবে উত্তর দেয়ার জন্য। আউন বিন আব্দুল্লাহ পাপের কথা স্মরণ করে কাঁদতেন আর বলতেন,

“হায় আফসোস! আমি কতভাবে না আল্লাহর নাফারমানী করেছি!
আল্লাহ আমাকে কত-শত নিয়ামত দিয়েছেন তারপরও আমি তাঁর অবাধ্যতা করেছি!
হায় আফসোস! প্রবৃত্তির তাড়নায় কত অন্যায় করলাম! কিন্তু প্রবৃত্তির সে আকর্ষণ চলে গেলেও তাঁর কুপ্রভাব তো আমার নিকট রয়ে গেছে!
আফসোস! কিভাবে মৃত্যুকে ভুলে থাকি অথচ মৃত্যু তো আমাকে ভুলে না!
হায়! আমাকে যদি কেয়ামতের দিন প্রভুর সম্মুখীন না হতে হত!
কিভাবে মৃত্যু থেকে বেপরোয়া থাকি অথচ মৃত্যু তো  এতটুকুর জন্যও আমাকে ভুলে না!
কিভাবে রঙ্গিন জীবন আমাকে হাতছানিতে দিতে পারে অথচ এক ভয়াবহ কঠিন দিন আমার সামনে অপেক্ষা করছে!
কেন আমার পরিতাপ দীর্ঘ হয় না অথচ আমি জানি না আমার পরিণতি কী হবে?
যে গৃহ আমার নয় সে গৃহের প্রতি কি ভাবে আমার আসক্তি বৃদ্ধি পেতে পারে?
কি ভাবে এটাকে আমার চিরস্থায়ী আবাসস্থল বানাতে পারি অথচ আমার আবাস ভূমি তো অন্যত্র?
কিভাবেই এর প্রতি আমার আসক্তি এবং আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল হতে পারে অথচ এর চেয়ে অল্পই তো আমার জন্য যথেষ্ট?
কিভাবে এ পার্থিব জগতকে অগ্রাধিকার দিতে পারি অথচ ইতোপূর্বে যারা একে অগ্রাধিকার দিয়েছিল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
কেন তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে নেক কাজ করার জন্য ছুটতে পারছি না?
এ নশ্বর জগতের প্রতি আমার কেনই বা এতো প্রবল আকর্ষণ যা একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
অতএব হে যুবক, তওবা করতে অলসতা করো না। আল্লাহ মাফ করে দিবেন-এই ভরসায় তওবা করতে কাল বিলম্ব করো না।  কখনও একথা বলো না যে, এখন তো যৌবন কাল; বয়স হলে তওবা করে নেব। কারণ, মৃত্যু বুঝে না কোন যুবক-বৃদ্ধ,ধনী-দরিদ্র, কিংবা কোন আমীর-মন্ত্রী। যে যাই হোক না কেন সবাইকে মৃত্যু অবশ্যই গ্রাস করবে।

কবি বলেন,

বল পাপীরে, নেয় যেন আজি মৃত্যুর প্রস্তুতি।

মৃত্যু তাহারে লইবে ঘিরি; নেই কোন গতি।

যুবক কত বৃদ্ধ হল কালের চক্রবাঁকে।

অতীত কেবল অতীত রয় ফেরানো যায় না তাকে।

পাপীজন হায় সেই স্বত্বায় হয় না কেন সন্ত্রস্ত

শক্ত হাতে ধরেন যিনি পাপাচারীদের হস্ত।

কোন এক দিন দেখবে সে যে সঙ্কট অফুরান।

অগণন ক্লান্তি, কষ্ট প্রকোপে কেঁপে উঠে দেহ-প্রাণ।

আর কতদিন এমনি করে আবীর মাখা গায়

থাকবে ডুবে যুবক তুমি ভবের তামাশায়?

দুনিয়া পিয়াসী হয়েছো ব্যাকুল দুনিয়াদারীর মাঝে।

ডাকছে তোমায় মৃত্যুর দূত সকাল, বিকেল, সাঁঝে।

ক্ষণিকের পরে হয়ত হবে আবাস কবর গায়।

তবু কিনা সে গর্ব ভরে জীবন কাটিয়ে দেয়।

দিবস-যামী কমছে মোদের বয়সের গতিধারা

কামনা-বাসনা বাড়াতে মোরা তবুও আত্মহারা!

আল্লাহ আমাদেরকে এ ঘুম থেকে জাগ্রত করুন। আমাদেরকে মৃত্যুও তার পরবর্তী জীবনের কথা স্মরণ করার চেতনা দান করুন এবং আমাদের অন্তরে দান করুন তাঁর নেয়ামত রাজীর কৃতজ্ঞতা আদায় ও তার স্তুতি জ্ঞাপনের অনুপ্রেরণা।

তওবার প্রতিদান

আমার বক্তব্য শেষ করার পূর্বেই হয়ত আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন তওবা করলে এবং আল্লাহ মুখী হলে আমার কী লাভ হবে? আমি এতে কী প্রতিদান পাব? আমি বলব, এর একমাত্র প্রতিদান- চির শান্তির নীড় জান্নাত।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন,
أَعْدَدْتُ لِعِبَادِيَ الصَّالِحِينَ مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ
“আমি আমার সৎকর্ম শীল বান্দাদের জন্য এমন সব সামগ্রী প্রস্তুত করে রেখেছি যা কোন মনব চক্ষু অবলোকন করে নি কিংবা কোন মানব মনে যার কল্পনাও উদ্রেক হয় নি।”[13]

সহীহ বুখারীতে আরও বর্ণিত হয়েছে, আবু হারায়রা রা.  বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
“জান্নাতের এক ধনুক সমপরিমাণ স্থান দুনিয়া ও তম্মধ্যস্থিত সবকিছু থেকে উত্তম।”[14]

সহীহ বুখারীতে সাহল বিন সাদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি,
مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
“জান্নাতের এক ছড়ি সমপরিমাণ স্থান দুনিয়া ও তম্মধ্যস্থিত সব কিছু হতে উত্তম।” (সহীহ বুখারী)

জগত বিখ্যাত মনিষী ইমাম ইবনে কাইয়েম র. বলেন, যে গৃহ আল্লাহ স্বহস্তে নির্মাণ করার পর তা তাঁর প্রিয় বান্দা-বান্দীদেরর জন্য আবাসস্থল হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং রহমত ও সন্তোষ দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন সে গৃহের কিভাবে মূল্য পরিমাপ করা যায়?

জান্নাতের নির্মাণশৈলী ও উপকরণ সামগ্রী

 আপনি যদি জান্নাতের নির্মাণশৈলী ও উপকরণ সামগ্রী সম্পর্কে জানতে চান তাহলে নিম্নে তা উপস্থাপন করছি:

জান্নাতের মাটি কুস্তরী ও জাফরান সমৃদ্ধ।
জান্নাতের ছাদে আল্লাহর আরশ অবস্থিত।
জান্নাতের নুড়ি পাথর গুলো এক একটি মহামূল্যবান মনি-মুক্তা।
প্রাসাদের প্রতিটি ইট স্বর্ণের তৈরি।
বৃক্ষরাজির গোড়া গুলো সাধারণ কাঠ নয় বরং স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি।
এগুলোর ফল-ফলাদি মটকার মত বড়, মাখনের চেয়ে নরম এবং মধুর চেয়ে মিষ্টি।
এগুলোর পত্র-পল্লব মসৃণ কাপড়ের চেয়ে সুন্দর।
এর নদী-প্রস্রবণ কোনটি দুধের, যার সাধ পরিবর্তন হয় না। কোনটি শরাবের যা পানকারীদের রসনা তৃপ্ত করবে। আর কোনটি পরিষ্কার-স্বচ্ছ মধুর।
এর খাদ্য সামগ্রী হল জান্নাতিদের পছন্দ মাফিক বিচিত্র ধরণের ফলমূল ও নানা জাতের পাখির মাংস।
পানীয় হল তাসনীম ( সুমধুর পানীয় বিশেষ) যানজবীল (আদা) ও কর্পূর মিশ্রিত।
জান্নাতের প্রাসাদগুলোর দুই দরজার চৌকাঠের মধ্যে চল্লিশ বছরের পথের ব্যবধান।
এর মধ্যস্থিত বৃক্ষরাজির ছায়ার দৈর্ঘ্য হচ্ছে, একেকটি বৃক্ষের ছায়াতলে একজন দ্রুত গতি সম্পন্ন ঘোড়া সওয়ার এক হাজার বছর ধরে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটিয়েও অতিক্রম করতে পারবে না।
এর পরিধি হল, একজন নিম্ন মর্যদার অধিকারী জান্নাতী তার রাজত্বের পরিসীমা, খাট-পালং, প্রাসাদ এবং বাগ-বাগিচার ভিতর দিয়ে দু হাজার বছর চলতে পারবে।
জান্নাতের তাঁবু এবং গম্বুজগুলো মণি-মুক্তার তৈরি। প্রতিটি তাঁবুর ভিতরের প্রশস্ততা ষাট মাইলের পথ।
আর জান্নাতিদের পরিধেয় হল, স্বর্ণ খচিত রেশমি পোশাক।
তাদের স্ত্রীগণ হবে উন্নত বক্ষা, সমবয়স্কা তরুণী। যাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যৌবনের সুধা প্রবহমান। গোলাপের পাপড়ি এবং আপেল সদৃশ গণ্ডদেশ। ডালিম সদৃশ উন্নত বক্ষদেশ। মনি-মুক্তা সদৃশ সারিবদ্ধ দন্তরাজি। পাতলা, কমনীয় ও আকর্ষণীয় কোমর। মুখ মণ্ডলের সৌন্দর্য ছটায় যেন চন্দ্র-সূর্য প্রবাহিত হয়, আর মৃদু হাসিতে যেন বিদ্যুৎ চমকায়। এরা তারুণ্যে সকলেই সমবয়স্কা। তাদের সৌন্দর্য যেন আকাশের চন্দ্র-সূর্য কেও হার মানায়।
পরিশেষে দুয়া করি, মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে তওবা করার তওফীক দান করেন এবং তাঁর তওবা কারী বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। তিনি সর্ব শ্রোতা ও দুয়া কবুল কারী।

_______________________________________________________________________________________

[1] সূরা নূর: ৩১
[2] (তাহরীম: ৮)
[3] সহীহ বুখারী,অনুচ্ছেদ: তওবা, হা/৫৮৩৪, শামেলা
[4] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: তওবা করার প্রতি উৎসাহ দান এবং এতে খুশি হওয়া, হা/৪৯৩৪, শামেলা
[5]  সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: গুনাহ থেকে তওবা করলে তা কবুল হওয়া যদিও বারবর গুনাহ সংঘটিত হয়, হা/৪৯৫৪, শামেলা
[6] সহীহ বুখারী। অনুচ্ছেদ: দিনে-রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তওবা, হা/৫৮৩২, শামেলা
[7] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা মুস্তাহাব, হা/৪৮৭১
[8] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: ঈমানদার ব্যক্তির নিজের গোপনীয়তা রক্ষা করা, হা/ ৫৬০৮
[9] তিরমিযী, সুনান ইবনে মাজাহ, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাসান, আলবানী
[10] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা মুস্তাহাব, হাদীস নং ৭০৩৬
[11]  সহীহ মুসলিম। অনুচ্ছেদ: হত্যা কারীর তওবা কবুল হবে যদিও হত্যার সংখ্যা প্রচুর পরিমান হয়। হা/৪৯৬৭
[12] সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: যে ব্যক্তি নিজের জিনার কথা স্বীকার করে। হা/৩২০৯
[13] সহীহ বুখারী হা/৩০০৫ ও মুসলিম, হা/৫০৫০(হাদীসে কুদসী)
[14] সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: জান্নাতের বিবরণ এবং জান্নাত সৃষ্টি করা হয়েছে। হা/৩০১১
_______________________________________________________________________________________


মূল: শাইখ খালিদ আল ফুরাইজ
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আবদুল জলীল
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।



আরও পড়ুনঃ তাওবার ফজিলত
আরও পড়ুনঃ তওবার বিবরণ

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

২টি মন্তব্য:

  1. الحمد الله والصلوات والسلام على رسول الله আল্লাহ পাকের যাবতীয় শোকরিয়া এবং অগণিত সালাত ও সালাম পেশ করছি প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।
    লেখকের এ লেখাটি প্রজ্ঞাপূর্ণ, তথ্য সমৃদ্ধ ও সর্বযুগোপযোগী হয়েছে এজন্য তাঁকে শুধু ধন্যবাদ জানালেই যথেষ্ট নয় তার জন্য প্রাণ ভরে আল্লাহর নিকট দু’আ করি যেন আল্লাহ পাক তার এ পরিশ্রম সার্থক করেন এবং এর জাযা স্বরূপ তাঁকে পরকালে নবী সিদ্দিক সালেহ দের সাথে জান্নাতের সৌভাগ্য নসীব করেন আর দুনিয়াতে তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং তাঁর সকল সমস্যা দূরীভুত করেন।
    আর মহান আল্লাহর নিকট সবিনয় প্রার্থনা তিনি যেন আমাকে এবং সকল পাঠককে এ প্রবন্ধের আলোকে তাওবাতান নাসুহা (আন্তরিক ও পরিপূর্ণ তাওবা) দান করেন। আমীন!!!

    উত্তরমুছুন
  2. আল্লাহ পাকের যাবতীয় শোকরিয়া এবং অগণিত সালাত ও সালাম পেশ করছি প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।
    আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে তওবা করার তৌফিক দান করেন । আল্লাহর নিকট দু’আ করি যেন আল্লাহ পাক লেখকের এ পরিশ্রম সার্থক করেন এবং এর জাযা স্বরূপ তাঁকে পরকালে নবী সিদ্দিক সালেহদের সাথে জান্নাতের সৌভাগ্য নসীব করেন আর দুনিয়াতে তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং তাঁর সকল সমস্যা দূরীভুত করেন।

    উত্তরমুছুন