শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জুমু‘আ: ফযীলত ও বিধি-বিধান



 সূচিপত্র
 
ক্রম   বিষয়
1.     ভূমিকা
2.     জুমু‘আর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য
3.     জুমু‘আর দিনের বিধি-বিধান
4.     জুমু‘আর দিনের ওয়াজিব বা ফরযসমূহ
5.     জুমু‘আর দিনের মুস্তাহাব আমলসমূহ
6.     জুমু‘আর দিনের নিষিদ্ধ কার্যাদি
7.     জুমু‘আর সালাত সম্পর্কে বিভিন্ন আহকাম



ভূমিকা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম
সকল প্রশংসা আল্লাহর, সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর সঠিক অনুসারীদের ওপর
আল্লাহ কোনো কোনো স্থানকে অপর স্থানের চেয়ে বেশি মর্যাদা দান করেছেন এবং কোনো কোনো সময়কে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। মাসসমূহের মধ্যে রমযান মাসকে এবং দিনসমূহের মধ্যে আরাফার দিন, দুই ঈদের দিন ও জুমুআর দিনকে মর্যাদা দান করেছেন। তাই ইসলামে জুমু‘আর দিনের রয়েছে উচ্চ মর্যাদা।

জুমুআর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন সহীহ হাদীসসমূহে জুমুআর দিনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কিছু উল্লেখ করা হলো:

১. জুমুআর দিন দিনসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে জুমুআর দিন সেরা দিন ও আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দিন। আল্লাহর নিকট তা ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিনের চেয়েও উত্তম।”[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘যে সকল দিনে সূর্য উদিত হয়েছে তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো জুমুআর দিন। সেই দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেই দিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং সেই দিনেই জান্নাত থেকে তাকে বের করা হয়েছে।”[2]

২. জুমুআর দিন মুসলিমদের ঈদের দিন:
যদি ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আযহা জুমুআর দিনে হয় তাহলে সেই দিনে দুই ঈদ একত্রে হবে। যে ব্যক্তি সেই দিন ঈদের সালাত আদায় করবে তার ওপর জুমুআর সালাত ফরয না। সে ইচ্ছা করলে জুমুআর সালাতে আসতেও পারে, নাও আসতে পারে (যোহর আদায় করবে) ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি যখন এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন:
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائ‍دة: ٣]
‘‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও তোমাদের ওপর আমার নি‘আমতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দীন হিসাবে প্রদান করে সন্তুষ্ট হলাম।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩] তখন তার নিকট একজন ইয়াহূদী ছিল। সে বলল: যদি আয়াতটি আমাদের ওপর নাযিল হত তাহলে আমরা সেই দিনটিকে ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। অতঃপর ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন: আয়াতটি ঈদের দিনেই নাযিল হয়েছে (আর তা ছিল) জুমুআর দিন ও ‘আরাফার দিন।”[3]

৩. জুমুআর দিন মন্দ কাজ দূর করা ও গুনাহ মাফের দিন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এক জুমআ থেকে অপর জুমুআ এতদুভয়ের মাঝের (গুনাহের জন্য) কাফ্ফারা হয়ে যায়, যদি কবীরা গুনাহের সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে থাকে।”[4]

৪. জুমুআর সালাতে যাত্রাকারীর প্রত্যেক ধাপে এক বছরের সালাত ও সাওম পালনের ছওয়াব হয়:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমুআর দিন ভালো করে গোসল করে সকাল সকাল মসজিদে আসবে এবং ইমামের নিকটবর্তী হবে এবং মনোযোগ দিয়ে (খুৎবা) শ্রবণ করবে ও চুপ থাকবে তার জুমুআর সালাতে আসার প্রত্যেক পদক্ষেপে এক বছরের সালাত ও সাওম পালনের ছওয়াব হবে।”[5]

৫. জুমুআর দিনে একটি সময় আছে যে সময়ে দো‘আ কবুল হয়:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় জুমুআর দিনে এমন একটি সময় আছে যে সময়ে কোনো মুসলিম আল্লাহর নিকট কোনো ভালো জিনিসের প্রার্থনা করলে তিনি তাকে তা দান করেন। তিনি বলেন: আর তা সামান্য সময় মাত্র।”[6]
অধিকাংশ আলেমের মতে, দোআ কবুলের সম্ভাবনার সেই সময়টি হলো আসরের সালাতের পরের সময়। দ্বিপ্রহরের পরের সময়টিতেও দোআ কবুলের আশা করা যেতে পারে। সুতরাং মুসলিমগণের উচিৎ এ সময়টিতে নিজের ও সকল মুসলিমদের  জন্য বেশি বেশি দোআ করা।

৬. অন্যান্য উম্মতকে এ থেকে বিভ্রান্ত করে জুমুআর দিনকে আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য বাছাই করে রেখেছিলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমুআ থেকে আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতকে বিভ্রান্ত করে রেখেছিলেন। ফলে ইয়াহূদীদের জন্য ছিল রবিবার। অতঃপর আল্লাহ  আমাদেরকে  নিয়ে এসেছেন এবং আমাদেরকে জুমুআর দিনের জন্য পথ দেখিয়েছেন অতঃপর শনি তারপর রবি। এমনিভাবে কিয়ামতের দিনও তারা আমাদের পরে হবে। দুনিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে আমরা সবার পরে এবং কিয়ামতের দিন আমাদের ফয়সালা সাবার আগে হবে।”[7]

৭. জুমুআর দিনেই কিয়ামত হবে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘কিয়ামত জুমুআর দিনেই কায়েম হবে।”[8]

৮. জুমুআর দিনে মৃত্যুবরণ করা শুভ মৃত্যুর লক্ষণ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কোনো মুসলিম যদি জুমুআর দিনে অথবা জুমুআর রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন।”[9]

৯. জুমুআর সালাত ত্যাগ করা কবীরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভুক্ত:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআ ত্যাগের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘যে সকল লোক জুমুআ ত্যাগ করে তারা যেন অবশ্যই তা থেকে ফিরে আসে, নচেৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদের হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিবেন অতঃপর তারা গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”[10]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অবহেলা করে তিন জুমুআ ত্যাগ করবে আল্লাহ তার হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিবেন।”[11]
অপর একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আমার ইচ্ছা হয়, কোনো ব্যক্তিকে লোকদের ইমামতি করার আদেশ দেই, অতঃপর যে সকল লোক জুমুআর সালাতে আসে নি তাদের ঘর-বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে সেগুলোকে জ্বালিয়ে দেই।”[12]
উপরোক্ত হাদীসসমূহ জুমুআর সালাতের গুরুত্বের ওপর তাকিদ দিচ্ছে। এর অর্থ এই নয় যেশুধুমাত্র জুমুআর সালাতই ফরয; বরং জুমুআর সালাত যেমন ফরয তেমনিভাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামা‘আতে আদায় করাও ওয়াজিব।

জুমুআর দিনের বিধি-বিধান

জুমুআর দিনের ওযাজিব বা ফরযসমূহ:

১. খুৎবার সময় চুপ থাকা, কথা না বলা ও কোনো অযথা কাজ না করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যদি জুমুআর দিন ইমামের খুৎবারত অবস্থায় তোমার সাথীকে (কাউকে) বল: চুপ কর, তাহলে তুমি নিরর্থক কথা বললে।”[13]

২. মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা, যদিও তা ইমামের খুৎবারত অবস্থায় হয়:
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, জুমুআর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবারত অবস্থায় এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। তিনি তাকে বললেন, ‘‘তুমি সালাত আদায় করেছ?” সে বলল: না, তিনি বললেন, ‘‘দাড়াও! দুই রাকাত সালাত আদায় কর।”[14]
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে: জুমুআর দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুৎবারত অবস্থায় সুলাইক আল-গাতফানী রাদিয়াল্লাহু আনহু মসজিদে এসে বসে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘হে সুলাইক! দাড়াও, দুই রাকাত হালকা সালাত পড়।” অতঃপর তিনি বললেন, ‘‘জুমুআর দিন ইমামের খুৎবারত অবস্থায় তোমাদের কেউ আসলে হালকা করে দুই রাকাত সালাত পড়।”[15]

৩. জুমুআর সালাত আদায় করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জামা‘আতের সাথে জুমুআর সালাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরয, তবে চারজন এর বতিক্রম, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বালক এবং অসুস্থ ব্যক্তি[16]

জুমুআর দিনের মুস্তাহাব আমলসমূহ:

১. জুমুআর দিনে ফজরের সালাতে বিশেষ কিরা‘আত পাঠ করা:
জুমুআর দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে প্রথম রাকাতে সূরা আস-সাজদাহ ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা আদ-দাহার (ইনসান) পড়তেন[17]

২. বেশি বেশী দরূদ শরীফ পাঠ করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে জুমুআর দিন তোমাদের সর্বোত্তম দিনসমূহের মধ্যে অন্যতম। সেই দিনে আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার জান কবজ করা হয়েছে, শিঙ্গায় ফুৎকার হবে এবং (আসমান ও যমীনবাসী) ধ্বংস অথবা বেহুশ হবে। সুতরাং সে দিনে বেশি বেশি করে আমার ওপর সালাত পাঠ কর; কেননা তোমাদের সালাত আমার নিকট পেশ করা হয়।” তারা (সাহাবায়ে কেরাম) জিজ্ঞাসা করলেন: হে  আল্লাহর রাসূল! আমাদের সালাম আপনার নিকটে কিভাবে পেশ করা হবে অথচ তখন আপনি (অর্থাৎ তাঁর হাড্ডি) পুরাতন হয়ে যাবেন? তিনি বললেন, আল্লাহ নবীগণের শরীর মাটির জন্য খাওয়া হারাম করে দিয়েছেন।”[18]

৩. সূরা কাহাফ পাঠ করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমুআর দিন সূরা কাহাফ পাঠ করবে অপর জুমুআ পর্যন্ত একটি নূর তাকে আলোকিত করবে।”[19]

৪. গোসল করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন. ‘‘তোমাদের কেউ জুমুআর সালাতে আসতে চাইলে সে যেন অবশ্যই গোসল করে আসে।”[20]
এ হাদীসে উল্লেখিত আদেশ থেকে গোসল ফরয সাব্যস্ত হবে না; বরং তার অর্থ হলো গোসল উত্তম; কেননা অপর একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কেউ যদি ওযূ করে জুমুআর সালাতে আসে তা যথেষ্ট হবে। তবে গোসল করা উত্তম।”[21]

৫. মেসওয়াক করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা:
 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমুআর দিন প্রত্যেক বালেগ (বয়সপ্রাপ্ত) ব্যক্তি গোসল ও মেসওয়াক করবে এবং সামর্থ্য অনুসারে সুগন্ধি লাগাবে।”[22]

৬. সামর্থ্য অনুসারে সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরিধান করা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমুআর দিন গোসল ও সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে এবং সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরিধান করে, অতঃপর শান্তভাবে মসজিদে আসে, মনে চাইলে সালাত পড়ে, কাউকে কষ্ট না দেয়, ইমাম আসার পর থেকে নিয়ে সালাত আদায় পর্যন্ত চুপ থাকে তার জন্য এটা উভয় জুমুআর মাঝের কাফ্ফারা হবে।”[23]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘তোমাদের কারো যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে সে কাজের দুটি পোশাক ব্যতীত জুমুআর জন্য দুটো আলাদা পোশাক রাখতে পারে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই।[24]

৭. সকাল সকাল সালাতের জন্য যাওয়া:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি জুমুআর দিনে (সহবাসের পর) ফরয গোসল করে অতঃপর (জুমুআর উদ্দেশ্যে) গমন করে সে যেন একটি উট ছদকা করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ভাগে গমন করে সে যেন একটি গরু ছদকা করল। যে ব্যক্তি তৃতীয় ভাগে গমন করে সে যেন একটি মেষ ছদকা করল। যে ব্যক্তি চতুর্থ ভাগে গমন করে সে যেন একটি মুরগী ছদকা করল। যে ব্যক্তি পঞ্চম ভাগে গমন করে সে যেন একটি ডিম ছদকা করল। যখন ইমাম (খুতবার উদ্দেশ্যে) বের হয়ে আসে তখন ফেরেশতাগণ হাজির হয়ে যিকির (খুৎবা) শ্রবণ করতে থাকে।[25]

৮. ইমাম সাহেব খুৎবার জন্য বের হওয়ার আগ পর্যন্ত (নফল) সালাত ও যিকিরে লিপ্ত থাকা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুমুআর সালাতে আসবে অতঃপর ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত তাওফীক অনুসারে সালাত পড়বে ও চুপ থাকবে তারপর ইমামের সঙ্গে জুমুআর সালাত আদায় করবে তাকে (তার গুনাহ) সামনের জুমুআ এবং তার পরের তিন দিন পর্যন্ত ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”[26]

৯. দ্বিপ্রহরের সঙ্গে সঙ্গে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি জুমুআর সালাত কায়েম করা:
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলার পর জুমুআর সালাত আদায় করতেন। তিনি আরো বলেন: আমরা জুমুআর সালাত আগেভাগে পড়ে নিতাম এবং জুমুআর পর (দুপুরের খানা খেয়ে) আরাম করতাম।[27]
সালামা ইবন আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমরা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সূর্য ঢলার পর জুমুআর সালাত আদায় করতাম এবং সালাতের পর (সূর্যের অত্যাধিক তাপের কারণে) ছায়ায় ফিরে আসতাম।[28]

১০. জুমুআর সালাতের দুই রাক‘আতে সূরা আল-আ‘লা ও সূরা আল-গাশিয়া পাঠ করা অথবা সূরা আল-জুমুআ ও সূরা আল-মুনাফিকূন পাঠ করা:
নু‘মান ইবন বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের এবং জুমুআর সালাতে সূরা আল-আ‘লা ও সূরা আল-গাশিয়াহ পড়তেন।[29]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর সালাতে সূরা আল-জুমুআ ও সূরা আল-মুনাফিকূন পাঠ করতেন।[30]

১১. জুমুআর পরে বাড়ীতে দুই রাকাত অথবা মসজিদে চার রাকাত সালাত আদায় করা:
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর পরে (বাড়ীতে) না ফিরা পর্যন্ত কোনো সালাত পড়তেন না। (বাড়ী ফিরার) পরে দুই রাকাত সালাত আদায় করতেন।[31]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমরা যখন জুমুআর সালাত আদায় করবে তখন জুমুআর পর চার রাকাত সালাত পড়বে।[32]

জুমুআর দিনের নিষিদ্ধ কার্যাদি:

১. দ্বিতীয় আযানের পরে বেচা-কেনা:
আল্লাহ তা‘আলা-এর বাণী:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَوٰةِ مِن يَوۡمِ ٱلۡجُمُعَةِ فَٱسۡعَوۡاْ إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَذَرُواْ ٱلۡبَيۡعَۚ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٩﴾ [الجمعة: ٩] 
‘‘হে ঈমানদারগণ! জুমুআর দিনে যখন সালাতের আযান দেওয়া হয়, তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ছেড়ে দাও। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা তা জানো [সূরা আল-জুমুআ, আয়াত: ৯]

২. মানুষের কাঁধের পর দিয়ে অতিক্রম করা এবং দুই জনকে বিচ্ছিন্ন করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খুৎবারত অবস্থায় এক ব্যক্তি এসে লোকদের কাঁধের ওপর দিয়ে অতিক্রম করছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘তুমি আসতে দেরীও করলে এবং (মানুষকে) কষ্টও দিলে।”[33]

৩. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে বসা।
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে বসতে নিষেধ করেছেন। ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার ছাত্র নাফে‘ কে জিজ্ঞাসা করা হলো- এটা কি জুমুআর সালাতের ব্যাপারে? তিনি উত্তরে বললেন: জুমুআ হোক বা অন্য কিছু হোক।[34]

৪. জুমুআর সালাতের পূর্বে মসজিদে দলবদ্ধ হয়ে বসা।
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর সালাতের পূর্বে মসজিদে দলবদ্ধ হয়ে বসতে নিষেধ করেছেন।”[35]

৫. খুৎবা অবস্থায় বৃষ্টির জন্য দো‘আ ব্যতীত অন্য কোনো দোআতে হাত না উঠানো (ইমাম হোক বা মুক্তাদি হোক)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত আছে যে: তিনি যখন জুমুআর খুৎবাতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন, তখন তিনি তাঁর দুহাত উঠান এবং সাহাবায়ে কেরামগণও তাঁদের দু’হাত উঠান।[36]

৬.  জুমুআর দিনকে বিশেষ কোনো সালাত ও সাওমের জন্য নির্দিষ্ট করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘অন্যান্য দিনসমূহের মধ্যে জুমুআর দিনকে বিশেষ কোনো সাওমের জন্য এবং জুমুআর রাতকে বিশেষ কোনো সালাতের জন্য নির্দিষ্ট করো না। তবে যদি তোমাদের কারো কোনো (নফল) সাওমের দিন সেই দিনেই পড়ে যায় (তাহলে তাতে কোনো আপত্তি নেই)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘‘তোমাদের কেউ জুমুআর দিনে রোযা রেখো না। তবে তার আগের একদিন অথবা পরের একদিন সহ রাখতে পার।”[37]

জুমুআর সালাত সম্পর্কে বিভিন্ন আহকাম
১. যে ব্যক্তি জুমুআর সালাতের এক রাকাত পেল সে জুমুআর সালাত পেল। সুতরাং যদি কেউ এক রাকাত পায় তাহলে সে তার সাথে অপর রাকাত মিলাবে, আর যদি এক রাকাতের চেয়ে কম পায় তাহলে সে যোহর আদায় করবে।
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: যদি তুমি জুমুআর সালাতের এক রাকআত পাও, তাহলে তার সাথে অপর এক রাকাত মিলিয়ে পড়। আর যদি তুমি রুকুও না পাও, তাহলে চার রাকাত (যোহর) আদায় করে নাও।[38]
২. (মসজিদে) ঝিমুনি আসলে জায়গা পরিবর্তন করে বসা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জুমুআর দিন (মসজিদে) তোমাদের কারো ঝিমানি আসলে সে যেন তার জায়গা পরিবর্তন করে বসে।”[39]
৩. কোনো শর‘ঈ ওযর যেমন অসুস্থতা অথবা অন্য কোনো কারণে কেউ জুমুআতে হাযির হতে না পারলে যোহরের সালাত আদায় করবে। এভাবে মহিলাগণ, মুসাফির ও লোকালয়ের বাইরের অধিবাসীগণ যোহর আদায় করবেন।
এর দলীল হাদীসে রয়েছে এবং এটাই হলো অধিকাংশ আলেমের মত।[40]
৪. যে ব্যক্তি সফরে থাকবে তার ওপর জুমুআর সালাত ফরয নয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে জুমুআর সালাত পড়তেন না। তাঁর বিদায় হজের আরাফার দিন জুমুআর দিন ছিল, কিন্তু তিনি সেখানে জুমুআর সালাত পড়েন নি; বরং যোহর ও আছরের সালাত যোহরের সময়ে একত্রে আদায় করেছেন। এভাবে তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীনও করেছেন।
৫. জুমুআর সালাত শহরে ও গ্রামে উভয় স্থানেই কায়েম হতে পারে।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদের পরে যেখানে সর্বপ্রথম জুমুআর সালাত কায়েম হয়েছে তা হলো আব্দুল কায়েস গোত্রের মসজিদে। আর সে ছিল বাহরাইনের ‘জুওয়াছা’ নামক স্থানে।[41]
‘জুওয়াছা’ হলো আব্দুল কায়েস গোত্রের একটি অন্যতম গ্রাম।[42]

সমাপ্ত









[1] সহীহ ইবন মাজাহ
[2] সহীহ মুসলিম
[3] সহীহ তিরমিযী
[4] সহীহ মুসলিম
[5] সুনান তিরমিযী ও নাসাঈ
[6] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[7] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[8] সহীহ মুসলিম
[9] ুনান তিরমিযী
[10] সহীহ মুসলিম
[11] ুনান তিরমিযী ও নাসাঈ
[12] সহীহ মুসলিম
[13] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[14] বুখারী ও মুসলিম
[15] সহীহ মুসলিম
[16] ুনান আব দাঊদ
[17] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[18] ুনান নাসাঈ
[19] হাকেম, শাখ আলবানী ইরওয়াতে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[20] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[21] ুনান তিরমিযী
[22] সহীহ মুসলিম
[23] আহমাদ
[24] ুনান আব দাঊদ
[25] সহীহ বুখারী ও মুসলিম
[26] সহীহ মুসলিম
[27] সহীহ বুখারী
[28] সহীহ মুসলিম
[29] সহীহ মুসলিম
[30] সহীহ মুসলিম
[31] সহীহ বুখারী
[32] সহীহ মুসলিম
[33] ুনান নাসাঈ
[34] সহীহ বুখারী
[35] ুনান আবু দাঊদ, হাদীস নং-১০৭৯
[36] সহীহ বুখারী
[37] সহীহ বুখারী
[38] শাখ আলবানী রহ. ইরওয়াতে সহীহ বলেছেন ৩/৮১
[39] ুনান তিরমিযী
[40] মাজমু ফাতাওয়া শায়খ ইবন বায
[41] সহীহ বুখারী, জুমুআ অধ্যায়
[42] সুনান আবু দাঊদ, হাদীস নং ১০৬৮
_________________________________________________________________________________


লেখক: শাইখ আবদুল আযীয ইবন আহমাদ আল-উমাইর
গবেষণা ও অনুবাদ বিভাগ
বিদেশীদের জ্ঞানদানকারী অফিস, আল-আহসা
অনুবাদক: উমর ফারূক আবদুল্লাহ
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
উৎস: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব




পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

২টি মন্তব্য:

  1. "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নাই, তিনি একক ও অদ্বীতিয়, তিনার কোন শরীক নাই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত বান্দা ও রসূল। আর আমি আমার আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করলাম।"
    আমার আল্লাহ 'রাহমান' আল্লাহ, পরম করূণাময় দয়ালু আল্লাহ। তাঁর প্রশংসার শেষ নাই। সৃষ্টির শুরু থেকে সকল বৃক্ষের প্রতিটি পাতা, সমুদ্রের বালুকনা, বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা এবং মহান আরশ পরিমান শোকর আদায় করলাম। কেননা, মহান আল্লাহ তার গোনাহগার বান্দা লোকের মাঝে অপমানিত হোক তা তিনি চান না। তাই তো তিনি কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। আমি প্রশংসার সহিত আমার মহান প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করলাম। আমীন ইয়া রব্বু।

    হে আল্লাহ! আমরা তোমার নিকট সেই কল্যাণ (নূর) প্রার্থনা করছি যা তোমার হাবীব মুহাম্মদ ﷺ তোমার নিকট চেয়েছেন এবং আমরা তোমার নিকট সেই সকল অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যে সকল অনিষ্ট থেকে তোমার হাবীব মুহাম্মদ ﷺ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তুমিই একমাত্র সাহায্যকারী এবং তুমিই (কল্যাণ) পৌঁছিয়ে দাও। আল্লাহ ব্যতীত ক্ষতি রোধ করার এবং কল্যাণ পৌঁছানোর আর কোন শক্তি নেই। হে আমার প্রতিপালক ! আপনার আদেশ নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার তৌফিক প্রার্থনা করলাম। আর তোমার স্মরণ ঘুম ও জাগ্রত উভয় অবস্থায় আমাদের ক্বলবে জারি করে দেন। জাঝাল্লাহু আন্না মুহাম্মাদাম মাহুয়া আহলুহু। আমীন ইয়া রব্বু।

    উত্তরমুছুন
  2. সন্মানিত দিনি ভাই, 'আসছালামালাইকুম আররহমাতুল্লাহি"
    আপনাদের লেখা গুলি আমার অনেক ভালো লাগে আলহামদ্দুলিলাহ্, যদি আপনারা অনুমতি দিতেন তা হলে আপনাদের লেখা গুলি আমি কপি করে পচার করতাম। fb , web side এর মাধ্যমে অবস্যই আপনাদের কৃর্তগতা সিকার করতাম। জাজাকআল্লাহ্খাইরান।

    উত্তরমুছুন