শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

ইসলামে নার্সিং পেশার বিধান

ইসলামে নার্সিং পেশার বিধান



প্রশ্ন: ইসলামে নার্সিং পেশার বিধান কী?

উত্তর:

ইসলামে রোগীর পরিচর্যা করার বিষয়টি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। কোনও ব্যক্তি অসুস্থ হলে আমাদের কর্তব্য, তার দেখাশোনা ও প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করা। এটি ইসলামের পাঁচটি পারস্পারিক হকের মধ্য অন্যতম। [সহিহ বুখারি ও মুসলিম] বাড়িতে সাধারণত: আত্মীয়-স্বজন এ কাজটি করে থাকে। কিন্তু জটিল রোগের ক্ষেত্রে মানুষকে অনেক সময় হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নিকট চিকিৎসা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয়। তখন চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর বিশেষ সেবা-যত্নেরও প্রয়োজন হয়। ফলে যুগের প্রয়োজনে নার্সিং একটি পেশায় রূপান্তরিত হয়।

  ইসলামের সূচনা লগ্নে মহিলা নার্স:

 ইসলামের সূচনালগ্নেই এই নার্সিং কর্মের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন: সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, 

عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ قَالَ‏: لَمَّا أُصِيبَ أَكْحُلُ سَعْدٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ فَثَقُلَ، حَوَّلُوهُ عِنْدَ امْرَأَةٍ يُقَالُ لَهَا‏: رُفَيْدَةُ، وَكَانَتْ تُدَاوِي الْجَرْحَى، فَكَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا مَرَّ بِهِ يَقُولُ‏: كَيْفَ أَمْسَيْتَ‏؟‏، وَإِذَا أَصْبَحَ‏: كَيْفَ أَصْبَحْتَ‏؟‏ فَيُخْبِرُهُ

 মাহমুদ ইবনে লাবিদ রা. বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন সাদ রা. এর চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এবং তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে রাফিদা নাম্নী এক মহিলার নিকট পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি আহত রোগীদের চিকিৎসা করতেন। 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তার কাছে যেতে তখন জিজ্ঞেস করতেন, তোমার দিনটা কেমন কাটল? আর সকালে তার কাছে গেলে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার রাত কেমন কাটল? আর তিনি (সাদ রা.) তাঁকে তার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতেন।” [ইমাম বুখারি সংকলিত আল আদাবুল মুফরাদ, অধ্যায়: চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, পরিচ্ছেদ: ৫৩০: আপনার রাত কেমন কাটল?-সনদ সহিহ] 

নার্সিং পেশার ব্যাপারে ইসলামের বিধান এবং এর জন্য শর্তাবলী: 

ইসলামে নার্সিং পেশায় বাধা নেই। বিশেষ করে মহিলা রোগী‌‌, গর্ভবতী নারীদের বিশেষ পরিচর্যা এবং সন্তান ডেলিভারি সংক্রান্ত কাজে মহিলা নার্সের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে এর জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে।‌ 

ইসলামের নীতি হলো, পুরুষ নার্স পুরুষ রোগীদের সেবা করবে আর নারী নার্স নারী রোগীদের সেবা করবে। মধ্যযুগীয় মুসলিম সমাজে নির্মিত হাসপাতালগুলিতে পুরুষ নার্সরা পুরুষ রোগীদের এবং মহিলা নার্সরা মহিলা রোগীদের সেবা দিতেন। [Syed, Ibrahim B. Efficient Hospitals: Islamic Medicine’s Contribution to Modern Medicine]

বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া এর ব্যতিক্রম করা জায়েজ নেই।

একান্ত জরুরি পরিস্থিতিতে এমনটি করার প্রয়োজন দেখা দিলে এ ক্ষেত্রে ইসলামের সাধারণ কতিপয় বিধি-বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। যথা: 

 ১. নারী নার্সের জন্য মুখমণ্ডল সহ (শুধু দুই চোখ ব্যতিরেকে) পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা।

 ২. যথাসম্ভব বিপরীত লিঙ্গের শরীর স্পর্শ না করা। নিরুপায় অবস্থায় হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করে করা যাবে।

 ৩. রোগীর শরীরের শুধু অতটুকু স্থান স্পর্শ করবে যেটুকু না হলেই নয়। ‌

 ৪. অপ্রয়োজনীয় দৃষ্টিপাত থেকে চক্ষুকে হেফাজত করা। অর্থাৎ চিকিৎসার প্রয়োজনে রোগীর শরীরের একান্ত জরুরি স্থান ব্যতিরেকে যথাসম্ভব অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা থেকে বিতর থাকবে।

 ৫. ল্যাবরেটরি, এক্সরে রুম বা অন্য কোথাও বিপরীত লিঙ্গের রোগীর সাথে নির্জনে অবস্থান না করা। এক্ষেত্রে রোগীর সাথে স্বামী/স্ত্রী, বাবা/মা, ভাই/বোন ইত্যাদি কোন মাহরাম ব্যক্তি থাকা আবশ্যক।

 ৬. রোগীর সাথে চিকিৎসা সেবা বা রোগ সংক্রান্ত জরুরি কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোন কথা না বলা।

 ৭. নারী নার্সের জন্য পুরুষ ডাক্তারের এবং পুরুষ নার্সের জন্য নারী ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নির্জন কক্ষে অবস্থান করা, নন মাহরাম সহকর্মী অথবা হাসপাতালে অন্যান্য লোকদের সাথে নির্জনতা অবলম্বন করা, হাসি-মজা ও আড্ডাবাজি করা কিংবা ফিতনা সৃষ্টি হয় এমন কোন কার্যক্রম করা জায়েজ নেই। 

কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যদি এমন পরিবেশ না পাওয়া যায় যেখানে এ সকল বিধি-বিধান মেনে চলা সম্ভব অথবা যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি না দেয় তাহলে অনতিবিলম্বে এ চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে অন্যত্র হালাল ভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে। পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য রিজিকের পথ খোলা রয়েছে। কেউ যদি আল্লাহকে ভয় করে তাহলে আল্লাহ তাকে উত্তম পন্থায় রিজিকের ব্যবস্থা করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। 

আল্লাহ তাআলা বলেন, 

مَن يَتَّقِ اللَّـهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

 “আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।” [সূরা তালাক: ২-৩] 

নার্সিং বিষয়ে আল্লামা বিন বায রাহ. এর ফতোয়া: 

সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি এবং বিশিষ্ট ফকিহ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বাজ রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, পুরুষ নার্স থাকা স্বত্বেও মহিলা নার্সের মাধ্যমে আমাদের পুরুষদের নার্সিং করা কি জায়েজ? 

উত্তরে তিনি বলেন, 

الواجب على المستشفيات جميعًا أن يكون الممرضون للرجال والممرضات للنساء، هذا الواجب، كما أن الواجب أن يكون الأطباء للرجال والطبيبات للنساء، إلا عند الضرورة القصوى إذا كان المرض لا يعرفه إلا الرجل فلا حرج أن يعالج المرأة لأجل الضرورة، وهكذا لو كان مرض الرجل لم يعرفه إلا امرأة فلا حرج في علاجها له، وإلا فالواجب أن يكون الطبيب من الرجال للرجال، والطبيبة من النساء للنساء، هذا هو الواجب، وهكذا الممرضات والممرضون، الممرض للرجال والممرضة للنساء، حسما لوسائل الفتنة، وحذرا من الخلوة المحرمة

مجموع فتاوى ومقالات الشيخ ابن باز (9/425)-

 “হাসপাতালগুলোতে পুরুষ রোগীদের জন্য পুরুষ নার্স এবং মহিলা রোগীদের জন্য মহিলা নার্স থাকা আবশ্যক। এটা ওয়াজিব। যেমন ভাবে পুরুষদের জন্য পুরুষ ডাক্তার এবং মহিলাদের জন্য মহিলা ডাক্তার থাকা আবশ্যক। তবে একান্ত জরুরি হলে ভিন্ন কথা। যদি এমন রোগ হয় যা পুরুষ ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ জানে না তাহলে জরুরতের কারণে পুরুষ ডাক্তার কর্তৃক মহিলার চিকিৎসা করতে সমস্যা নেই। অনুরূপভাবে পুরুষের কোনও রোগ যদি মহিলা ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ না জানে তাহলে তার জন্য পুরুষ রোগীর চিকিৎসা করতে কোনও আপত্তি নেই। অন্যথায় পুরুষদের জন্য পুরুষ ডাক্তার এবং মহিলাদের জন্য মহিলা ডাক্তার থাকা আবশ্যক। এটি ওয়াজিব। একই কথা পুরুষ নার্স ও মহিলা নার্সের ক্ষেত্রেও। ফিতনার সম্ভাবনা এড়াতে এবং হারাম নির্জনতার ক্ষেত্রে সতর্কতার স্বার্থে পুরুষ নার্স হবে পুরুষদের জন্য আর মহিলা নার্স হবে মহিলাদের জন্য।”

[মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতিশ শাইখ বিন বায বিন বায এর ফতোয়া এবং প্রবন্ধ সমগ্র-৯/৪২৫]

  আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.-এর ফতোয়া: 

লিবিয়ার বেনগাজি থেকে এক মহিলা শ্রোতা প্রশ্ন করেন যে, তিনি ২৬ বছরের কাছাকাছি বয়সের এক তরুণী। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন যে, তিনি পর্দা করেন। কিন্তু তিনি একটি ক্লিনিকে নার্স হিসেবে কাজ করেন। তার কাজ হল, আহত রোগীদের ওষুধপাতি দেওয়া এবং ইনজেকশন করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। ফলে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে রোগীর শরীর স্পর্শ করা জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন যে, এটি আমার একমাত্র জীবিকার উৎস। এ ছাড়া অন্য কিছু নেই। হে সম্মানিত শাইখ, আমার এ কাজে কি কোনও সমস্যা আছে? আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুন। আমিন। 

উত্তরে শাইখ বলেন, 

إن عملها هذا ليس فيه شيء؛ لأن الحاجة إذا دعت إلى تمريض المرأة الرجل، فلا حرج في ذلك، وسواء لزم من ذلك أن تمسه أم لم يلزم، لكن ينبغي لها أن تضع على يديها قفازين، حتى لا تباشر المس بالنسبة إلى الرجال.

 “তার এই কাজে কোনও সমস্যা নেই যদি পুরুষ রোগীর নার্সিং করার জন্য মহিলা নার্সের প্রয়োজন হয়। এতে কোনও অসুবিধা নেই। চাই রোগীকে স্পর্শ করা জরুরি হোক বা না হোক। কিন্তু তার হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পড়া উচিৎ যেন, পুরুষ রোগীর শরীর স্পর্শ করতে না হয়।” [binothaimeen] 

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হালাল কর্ম সংস্থানের তাওফিক দান করুন এবং সব ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ ও হারাম কার্যক্রম থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

 

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি

লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব


পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন