ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين و العاقبة للمتقين والصلاة و السلام على رسوله الأمين وعلى آله و صحبه أجمعين و بعد ،
বর্তমান পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ মুসলিম হলেও প্রকৃত মুসলিম ও ঈমানদারের সংখ্যা উল্লেখিত অংকের যে বহুগুণ নীচে তা অস্বীকার করার উপায় নেই; কারণ অনেক লোক নামধাম দিয়ে ইসলাম ও ঈমানের দাবী করলেও প্রকৃত অর্থে তারা শির্কের বেড়াজাল থেকে নিজদের মুক্ত করতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ ﴾ [يوسف: ١٠٦]
‘‘অনেক মানুষ আল্লাহর উপর ঈমান আনলেও তারা কিন্তু মুশরিক’’। (সূরা ইউসূফ, আয়াত ১০৬)
অনেক মানুষ তাদের জীবনে কোনো এক সময় ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এ কালেমার মৌখিক স্বীকৃতি দান করেই নিজদেরকে খাটি ঈমানদার মনে করে থাকে, যদিও তাদের কাজ কর্ম ঈমান আক্বীদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী হোক না কেন। এর কারণ হলো ঐ ব্যক্তিরা কেন আল্লাহ্র উপর ঈমান এনেছে, অথবা তাদের নিকট ঈমান কি দাবী করে এবং কি কাজ করলে ঈমানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে এসম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়।
গনেশ নামে কোনো ব্যক্তি একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করার পরেও কালি পূজা করে বলে অথবা লক্ষ্ণীর নিকট কল্যাণ কামনা করে বলে তাকে মুশরিক বলা হয়। আবার ‘আবদুল্লাহ্ নামক কোনো ব্যক্তি আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাস করার পর যদি গোর পূজা বা পীর পূজা করে অথবা খাজাকে সাজদা করে বা মৃত ব্যক্তির নিকট কল্যাণ কামনা করে তাহলে গনেশের মধ্যে ও এ আব্দুল্লার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মূলতঃ এদের দুজনের নামে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের কর্ম এবং পথ কিন্তু একই। দ্বিতীয় ব্যক্তি তার জীবনের কোনো এক সময় ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’’ এ কালেমা সাক্ষ্য দান করে থাকলেও তা ছিল একান্তই গতানুগতিকভাবেই সে তা করেছে, তাই সে তাওহীদের রাজপথকে পরিহার করে ঘুরপাক খাচ্ছে শির্কের অন্ধকার গলিতে। অন্তত মুসলিমদের জীবনে এমনটি যেন না ঘটে এ দৃষ্টিকে সামনে রেখে লেখক এই পুস্তিকাটিতে কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’’ এর অর্থ এবং এর দাবী ইত্যাদি প্রসঙ্গে তথ্য ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। নির্ভেজাল ইসলামী আক্বীদাহ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য বইটিকে মাইল ফলক হিসাবে ধরা যায়। বইটির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলা ভাষায় বইটি অনুবাদ করার জন্য আমি প্রয়াসী হই।
যথাসময়ে অনুবাদের কাজ শেষ করতে পেরে আমি আল্লাহ্র শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। বইটি পড়ে একজন পাঠক ও যদি সঠিক ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারেন তাহলে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সার্থক হবে বলে মনে করি। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে খাঁটি ঈমানদার হয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)
মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম ইবন আলী আহমাদ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। আমরা তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁরই নিকট তওবা করি। আমাদের নাফসের সকল প্রকার বিপর্যয় ও কুকীর্তি হতে রক্ষা করার জন্য তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ্ যাকে হিদায়েত দান করেন তার কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই, আর যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার কোনো পথ প্রদর্শনকারী নেই।
অতঃপর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র বান্দাহ্ ও রাসুল। আল্লাহ্র পক্ষ হতে কিয়ামত পর্যন্ত সালাত ও সালাম বর্ষিত হউক তাঁর রাসূল, আহলে বাইত এবং সমস্ত সাহাবারদের উপর আর ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের উপর যারা অনুসরণ করেছেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এবং আঁকড়ে ধরেছেন তাঁর সুন্নাতকে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর যিকির করার জন্য আদেশ করেছেন এবং তিনি তাঁর যিকিরকারীদের প্রশংসা করেছেন ও তাদের জন্য পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন। তিনি আমাদেরকে সাধারণভাবে সর্বাবস্থায় তাঁর যিকির করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন ইবাদত সম্পন্ন করার পর তাঁর যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন,
﴿ فَإِذَا قَضَيۡتُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمۡۚ﴾ [النساء: ١٠٣]
“অতঃপর তোমরা যখন সালাত সমাপ্ত কর তখন দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহর যিকির কর’’। (সূরা আন্ নিসা, ১০৩) আল্লাহ্ আরো বলেন,
﴿ فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ﴾ [البقرة: ٢٠٠]
‘‘আর যখন তোমরা হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহর যিকির করবে, যেমন করে স্মরণ করতে তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে, বরং (আল্লাহকে) এর চেয়েও বেশী স্মরণ করবে’’। (সূরা আল-বাক্বারাহ, ২০০)
বিশেষ করে হজ্জ পালনের সময় তাঁর যিকির করার জন্য বলেন,
﴿فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ﴾ [البقرة: ١٩٨]
“অতঃপর যখন আরাফাত থেকে তোমরা ফিরে আসবে তখন (মুযদালেফায়) মাশ্আরে হারাম এর নিকট আল্লাহ্র যিকির কর। (সূরা আল-বাক্বারাহ, ১৯৮)
তিনি আরো বলেন,
﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ﴾ [الحج: ٢٨]
“এবং তারা যেন নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আল্লাহ্ তাদেরকে চতুস্পদ জন্তুর মধ্য থেকে যে সমস্ত রিযক দিয়েছেন তার উপর আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে। (সূরা-আল-হাজ্জ, ২৮)
তিনি আরো বলেন,
﴿ ۞وَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡدُودَٰتٖۚ﴾ [البقرة: ٢٠٣]
“আর এই নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েক দিনে আল্লাহর যিকির কর”। (সূরা আল-বাক্বারাহ, ২০৩)
এছাড়া আল্লাহর যিকিরের লক্ষ্যে তিনি সালাত প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
﴿وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِذِكۡرِيٓ ١٤ ﴾ [طه: ١٤]
“আমার যিকিরের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠিত কর”। (সূরা ত্বাহা, ১৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«َإِنَّ هَذِهِ الْأَيَّامَ أَيَّامُ أَكْلٍ وَشُرْبٍ وَذِكْرِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ»
“তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে খাওয়া পানাহার এবং আল্লাহর যিকিরের জন্য।” (মুসলিম: ১১৪১; আবু দাউদ: ২৮১৩)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ ذِكۡرٗا كَثِيرٗا ٤١ وَسَبِّحُوهُ بُكۡرَةٗ وَأَصِيلًا ٤٢ ﴾ [الاحزاب: ٤١، ٤٢]
“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে বেশী বেশী করে যিকির কর এবং সকাল সন্ধ্যা তাঁর তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা আল-আহযাব, ৪১-৪২)
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সবচেয়ে উত্তম যিক্র হলো,
(لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ(
“আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সবচেয়ে উত্তম দো‘আ আরাফাত দিবসের দো‘আ এবং সবচেয়ে উত্তম কথা যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন, তা হলো:
(لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الـمُـلْكُ وَ لَهُ الحَمْدُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ)
উচ্চারণঃ লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা- শারীকালাহু, লাহুল মুলক ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
“আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব একমাত্র তাঁরই জন্য এবং প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য, আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান”।
· ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহর যিকিরসমূহের মধ্যে অন্যতম।
এই মহামূল্যবান বাণীর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন হুকুম আহকামের। আর এই কালেমার রয়েছে এক বিশেষ অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং কয়েকটি শর্ত, ফলে এ কালেমাকে গতানুগতিক মুখে উচ্চারণ করাই ঈমানের জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্যই আমি আমার লেখার বিষয়বস্তু হিসাবে এ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছি এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাকে এবং আপনাদেরকে এই মহান কালেমার ভাবাবেগ ও মর্মার্থ অনুধাবন করতঃ এর দাবী অনুযায়ী তাঁর সমস্ত কাজ করার তাওফিক দান করেন এবং আমাদেরকে ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যাঁরা এই কালেমাকে সঠিক অর্থে বুঝতে পেরেছেন।
প্রিয় পাঠক, এ কালেমার ব্যাখ্যা দানকালে আমি নিম্নবর্তী বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করব:
· মানুষের জীবনে এ কালেমার মর্যাদা
· এর ফযিলত
· এর ব্যাকরণিক ব্যাখ্যা
· এর স্তম্ভ বা রুকনসমূহ
· এর শর্তাবলী
· এর অর্থ এবং দাবী
· কখন মানুষ এ কালেমা পাঠে উপকৃত হবে আর কখন উপকৃত হবে না
· আমাদের সার্বিক জীবনে এর প্রভাব কি ?
এবার আল্লাহর সাহায্য কামনা করে কালেমা " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে এখন আমি আলোচনা শুরু করছি।
1. ব্যক্তি জীবনে কালেমা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর গুরুত্ব ও মর্যাদা
এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বাণী যা মুসলিমগণ তাদের আযান, ইকামাত, বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলিষ্ঠ কন্ঠে ঘোষণা করে থাকে, এটি এমন এক কালেমা যার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আসমান জমিন, সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত মাখলুকাত। আর এর প্রচারের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য রাসুল এবং নাযিল করেছেন আসমানি কিতাবসমূহ, প্রণয়ন করেছেন অসংখ্য বিধান। প্রতিষ্ঠিত করেছেন মীযান এবং ব্যবস্থা করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের, তৈরী করেছেন জান্নাত এবং জাহান্নাম। এই কালেমাকে স্বীকার করা এবং অস্বীকার করার মাধ্যমে মানব সম্প্রদায় ঈমানদার এবং কাফির এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। অতএব সৃষ্টি জগতে মানুষের কর্ম, কর্মের ফলাফল, পুরস্কার অথবা শাস্তি সব কিছুরই উৎস হচ্ছে এই কালেমা। এরই জন্য উৎপত্তি হয়েছে সৃষ্টি কুলের, এ সত্যের ভিত্তিতেই আখেরাতের জিজ্ঞাসাবাদ এবং এর ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হবে সওয়াব ও শাস্তি। এই কালেমার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিমদের কিবলা এবং এ হলো মুসলিমদের জাতি সত্তার ভিত্তি-প্রস্তর এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য খাপ থেকে খোলা হয়েছে জিহাদের তরবারী।
বান্দার উপর এটাই হচ্ছে আল্লাহর অধিকার, এটাই ইসলামের মূল বক্তব্য ও শান্তির আবাসের (জান্নাতের) চাবিকাঠি এবং পূর্বা-পর সকলই জিজ্ঞাসিত হবে এই কালেমা সম্পর্কে।
আল্লাহ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কার ইবাদত করেছ? নবীদের ডাকে কতটুকু সাড়া দিয়েছ? এ দুই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত কোনো ব্যক্তি তার দুটো পা সামান্যতম নাড়াতে পারবে না। আর প্রথম প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ "কে ভালোভাবে জেনে এর স্বীকৃতি দান করা এবং এর দাবী অনুযায়ী কাজ করার মাধ্যমে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সঠিক হবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসাবে মেনে তাঁর নির্দেশের আনুগত্যের মাধ্যমে। আর এ কালেমাই হচ্ছে কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী। এ হচ্ছে আল্লাহ ভীতির কালেমা ও মজবুত অবলম্বন।
এবং এ কালেমাই ইব্রাহীম আলাইহিস্সালাম রেখে গেলেন
﴿ وَجَعَلَهَا كَلِمَةَۢ بَاقِيَةٗ فِي عَقِبِهِۦ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢٨ ﴾ [الزخرف: ٢٨]
“অক্ষয় বাণীরূপে তাঁর পরবর্তীতে তাঁর সন্তানদের জন্য যেন তারা ফিরে আসে এ পথে”। [সূরা আয-যুখরুফ: ২৮]
এই সেই কালেমা যার সাক্ষ্য আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজেই নিজের জন্য দিয়েছেন, আরো দিয়েছেন ফিরিশতাগণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨ ﴾ [ال عمران: ١٨]
“আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন, নিশ্চয় তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং ফিরেশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আলে ইমরান, ১৮)
এ কালেমাই ইখলাস তথা সত্যনিষ্ঠার বাণী, এটাই সত্যের সাক্ষ্য ও তার দাওয়াত এবং শির্ক এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার বাণী এবং এ জন্যই সমস্ত সৃষ্টি জগতের সৃষ্টি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]
“আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি”। (সূরা আয-যারিয়াত-৫৬)
এই কালেমা প্রচারের জন্য আল্লাহ সমস্ত রাসূল এবং আসমানি কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছেন, তিনি বলেন,
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥ ﴾ [الانبياء: ٢٥]
“আমরা তোমার পূর্বে যে রাসূলই প্রেরণ করেছি তাঁর নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর’’। (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ২৫)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ يُنَزِّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ بِٱلرُّوحِ مِنۡ أَمۡرِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦٓ أَنۡ أَنذِرُوٓاْ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱتَّقُونِ ٢ ﴾ [النحل: ٢]
“তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে রূহ (ওহী) সহ ফিরিশ্তা প্রেরণ করেন এই বলে যে, তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, অতএব তোমরা আমাকেই ভয় কর। (আন-নাহল-২)
ইবনে উইয়াইনা বলেন, “বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে প্রধান এবং বড় নিয়ামত হলো তিনি তাদেরকে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ" তাঁর এই একত্ববাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। দুনিয়ার পিপাসা কাতর তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের নিকট ঠাণ্ডা পানির যে মূল্য, আখেরাতে জান্নাতবাসিদের জন্য এ কালেমা তদ্রূপ’’[1]।
তাছাড়া যে ব্যক্তি এ কালেমার স্বীকৃতি দান করল সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করল। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করল সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مَنْ دُونِ اللهِ، حَرُمَ مَالُهُ، وَدَمُهُ، وَحِسَابُهُ عَلَى اللهِ»
“যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এর স্বীকৃতি দান করল এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সব উপাস্যকে অস্বীকার করল, তার ধন- সম্পদ ও জীবন নিরাপদ হল এবং তার কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর উপর বর্তাল। [মুসলিম:২৩]
একজন কাফেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বানের জন্য প্রথম এই কালেমার স্বীকৃতি চাওয়া হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ইয়ামানে ইসলামের দাওয়াতের জন্য পাঠান তখন তাঁকে বলেন,
«إِنَّكَ تَأْتِي قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ، فَادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ»
তুমি আহলে কিতাবের নিকট যাচ্ছ, অতএব সর্বপ্রথম তাদেরকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’’ এর সাক্ষ্য দান করার জন্য আহবান করবে। (বুখারী: ৪৩৪৭; মুসলিম: ১৯)
প্রিয় পাঠকগণ এবার চিন্তা করুন, দ্বীনের দৃষ্টিতে কোনো পর্যায়ে এ কালেমার স্থান এবং এর গুরুত্ব কতটুকু। এজন্যই বান্দার প্রথম কাজ হলো এ কালেমার স্বীকৃতি দান করা; কেননা এ হলো সমস্ত কর্মের মূল ভিত্তি।
2. لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর ফযীলত
এ কালেমার অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে এবং আল্লাহর নিকট এর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
· যে ব্যক্তি সত্য-সত্যিই কায়মনোবাক্যে এ কালেমা পাঠ করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি মিছে-মিছি এ কালেমা পাঠ করবে তা দুনিয়াতে তার জীবন ও সম্পদের হেফাজত করবে বটে, তবে তাকে এর হিসেব আল্লাহর নিকট দিতে হবে।
· এটি একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য, হাতেগোনা কয়েকটি বর্ণ এবং শব্দের সমারোহ মাত্র, উচ্চারণেও অতি সহজ কিন্তু কিয়ামতের দিন মীযানের পাল্লায় হবে অনেক ভারী।
ইবনে হিব্বান এবং আল হাকেম আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«قَالَ مُوسَى يَا رب عَلمنِي شَيْئا أذكرك وأدعوك بِهِ قَالَ يَا مُوسَى قل لَا إِلَه إِلَّا الله قَالَ كل عِبَادك يَقُولُونَ هَذَا قَالَ يَا مُوسَى لَو أَن السَّمَوَات السَّبع وعامرهن غَيْرِي والأرضيين السَّبع فِي كفة وَلَا إِلَه إِلَّا الله فِي كفة مَالَتْ بِهن لَا إِلَه إِلَّا الله»
“মূসা ‘আলাইহিস সালাম একদা আল্লাহ তা‘আলাকে বললেন, হে রব, আমাকে এমন একটি বিষয় শিক্ষা দান করুন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে আহ্বান করব। আল্লাহ বললেন, হে মূসা বলো, " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " মূসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, এতো আপনার সকল বান্দাই বলে থাকে। আল্লাহ বললেন, হে মূসা, আমি ব্যতীত সপ্তাকাশ ও এর মাঝে অবস্থানকারী সকল কিছু এবং সপ্ত জমীন যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এক পাল্লায় রাখা হয় তা হলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর পাল্লা ভারী হবে”। (হাকেম বলেন, হাদিসটি সহীহ)।[2]
অতএব এ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ হচ্ছে, সবচেয়ে উত্তম যিকির।
আব্দুল্লাহ ইবন ওমর হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সবচেয়ে উত্তম দো‘আ আরাফাত দিবসের দো‘আ এবং সবচেয়ে উত্তম কথা যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন, তা হলো,
(لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، لَهُ الـمُـلْكُ وَ لَهُ الحَمْدُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ)
“একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব একমাত্র তাঁরই জন্য এবং প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য, তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান’’।[3]
· এ কালেমা যে সমস্ত কিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও ভারী তার আরেকটি প্রমাণ হলো, আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর থেকে অপর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ سَيُخَلِّصُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوسِ الخَلَائِقِ يَوْمَ القِيَامَةِ فَيَنْشُرُ عَلَيْهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ سِجِلًّا كُلُّ سِجِلٍّ مِثْلُ مَدِّ البَصَرِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا؟ أَظَلَمَكَ كَتَبَتِي الحَافِظُونَ؟ فَيَقُولُ: لَا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: أَفَلَكَ عُذْرٌ؟ فَيَقُولُ: لَا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ: بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَةً، فَإِنَّهُ لَا ظُلْمَ عَلَيْكَ اليَوْمَ، فَتَخْرُجُ بِطَاقَةٌ فِيهَا: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، فَيَقُولُ: احْضُرْ وَزْنَكَ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ مَا هَذِهِ البِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلَّاتِ، فَقَالَ: إِنَّكَ لَا تُظْلَمُ "، قَالَ: «فَتُوضَعُ السِّجِلَّاتُ فِي كَفَّةٍ وَالبِطَاقَةُ فِي كَفَّةٍ، فَطَاشَتِ السِّجِلَّاتُ وَثَقُلَتِ البِطَاقَةُ، فَلَا يَثْقُلُ مَعَ اسْمِ اللَّهِ شَيْءٌ»
“কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতের এক ব্যক্তিকে সকল মানুষের সামনে ডাকা হবে, তার সামনে নিরানব্বইটি (পাপের) নিবন্ধ পুস্তক রাখা হবে এবং একেকটি পুস্তকের পরিধি হবে চক্ষুদৃষ্টির সীমারেখার সমান। এর পর তাকে বলা হবে, এই নিবন্ধ পুস্তকে যা কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে তা কি তুমি অস্বীকার কর? উত্তরে ঐ ব্যক্তি বলবে, হে রব আমি তা অস্বীকার করি না। তারপর বলা হবে, এর জন্য তোমার কোনো আপত্তি আছে কিনা? অথবা এর পরিবর্তে তোমার কোনো নেক কাজ আছে কিনা? তখন সে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বলবে, না তাও নেই। অতঃপর বলা হবে, আমার নিকট তোমার কিছু পুণ্যের কাজ আছে এবং তোমার উপর কোনো প্রকার অত্যাচার করা হবে না, অতঃপর তার জন্য একখানা কার্ড বের করা হবে তাতে লেখা থাকবে,
" أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ "
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’ তখন ঐ ব্যক্তি বিস্ময়ের সাথে বলবে, হে আমার রব, এই কার্ডখানা কি নিরানব্বইটি নিবন্ধ পুস্তকের সমতুল্য হবে? তখন বলা হবে, তোমার উপর কোনো প্রকার অত্যাচার করা হবে না। এর পর ঐ নিরানব্বইটি পুস্তক এক পাল্লায় রাখা হবে এবং ঐ কার্ড খানা এক পাল্লায় রাখা হবে তখন ঐ পুস্তক গুলোর ওজন কার্ড খানার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য হবে এবং কার্ডের পাল্লা ভারী হবে।”[4]
হাফেয ইবনে রজব রহ. তাঁর ‘‘কালেমাতুল ইখলাস’’ নামক গ্রন্থে এ মহামূল্যবান কালেমার আরো বহু ফযীলত বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির সপক্ষে দলীল-প্রমাণাদি উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে, এই কালেমা হবে জান্নাতের মূল্য, কোনো ব্যক্তি জীবনের শেষ মূহুর্তেও এ কালেমা পাঠ করে মারা গেলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, এটাই জাহান্নাম থেকে মুক্তির একমাত্র পথ এবং আল্লাহর ক্ষমা নিশ্চিত করার মাধ্যম, সমস্ত পূণ্য কাজগুলোর মধ্যে এ কালেমাই শ্রেষ্ঠ, এটি পাপ পঙ্কিলতাকে দূর করে, হৃদয় মনে ঈমানের যা কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এ কালেমা সেগুলোকে সজীব করে, স্তুপকৃত পাপ-রাশি সম্বলিত বালাম গ্রন্থগুলোর উপর এ কালেমা ভারী হবে। আল্লাহকে পাওয়ার পথে যতসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সব কিছুকে এ কালেমা ছিন্ন-ভিন্ন করে আল্লাহর নিকট পৌঁছে দিবে। এ কালেমার স্বীকৃতি দানকারীকে আল্লাহ সত্যায়িত করবেন। নবীদের কথার মধ্যে উত্তম কথা হলো এটাই, সবচেয়ে উত্তম আমল হচ্ছে এটিই, আর এটি হচ্ছে এমন আমল যা বহুগুণ বর্ধিত হয়। এটি গোলাম আযাদ করার সমতুল্য। শয়তান থেকে হেফাযতকারী। কবর ও হাশরের বিভীষিকাময় অবস্থার নিরাপত্তা দানকারী। কবর থেকে দণ্ডায়মান হওয়ার পর এ কালেমাই হবে মুমিনদের শ্লোগান।
এ কালেমার ফযীলতের মধ্যে আরো হচ্ছে, এই কালেমার স্বীকৃতি দানকারির জন্য জান্নাতের আটটি দ্বার খুলে দেয়া হবে এবং সে ইচ্ছামত যে কোনো দ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
এ কালেমার অন্য ফযীলত হচ্ছে, এর সাক্ষ্যদানকারী এর দাবী অনুযায়ী পূর্ণভাবে কাজ না করার ফলে এবং বিভিন্ন অপরাধের ফল স্বরূপ জাহান্নামে প্রবেশ করলেও অবশ্যই কোনো এক সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে।
ইবনে রজব রহ. তাঁর উক্ত বইতে এই কালেমার এ সব ফযীলত বর্ণনার জন্য যে পরিচ্ছেদ রচনা করেছেন এ হচ্ছে তার বর্ণনা। তিনি এসবগুলো দলীল প্রমাণাদিসহ বর্ণনা করেছেন।[5]
3. এ কালেমার ব্যকরণগত আলোচনা, এর স্তম্ভ ও শর্তসমূহ
· এ কালেমার ব্যাকরণগত আলোচনা:
যেহেতু অনেক বাক্যের অর্থ বুঝা নির্ভর করে তার ব্যকরণগত আলোচনার উপর, সেহেতু ওলামায়ে কেরাম "لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ" এই বাক্যের ব্যকরণগত আলোচনার প্রতি তাঁদের দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন এবং তারা বলেছেন যে, এই বাক্যে "لا" শব্দটি ‘নাফিয়া লিল জিনস’ (সমগোত্রীয় অর্থ নিষিদ্ধকারী নিষেধসূচক বাক্য) এবং إِله (ইলাহ) শব্দটি এর ইসম (উদ্দেশ্য), মাবনি আলাল ফাতহ্ (যা সর্বাবস্থায় ফাতহ বা যবর বিশিষ্ট হয়)। আর এর খবরটি এখানে উহ্য, যা হচ্ছে حق শব্দটি। অর্থাৎ কোনো হক বা সত্য ইলাহ নেই। إِلاَّ اللهُ হচ্ছে খবর, (বিধেয়) যা মারফু (পেশ হওয়ার স্থানে; কারণ তা) "حق" শব্দ হতে ইসতেসনা বা ভিন্নতর। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত হক বা সত্য ইলাহ বলতে কেউ নেই।
"إِلهَ" শব্দের অর্থ ‘‘মা‘বুদ’’ আর তিনি হচ্ছেন ঐ সত্তা যে সত্তার প্রতি কল্যাণের আশায় এবং অকল্যান থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের আসক্তি সৃষ্টি হয় এবং মন তার উপাসনা করে।
এখানে কেউ যদি মনে করে যে, উক্ত খবরটি হচ্ছে ‘‘মাউজুদুন’’ বা ‘‘মা‘বুদুন’’ অথবা এ ধরনের কোনো শব্দ তা হলে এটা হবে অত্যন্ত ভুল। কারণ বাস্তব তো এই যে, আল্লাহ ব্যতীত অনেক মা‘বুদ বিদ্যমান রয়েছে যেমন মূর্তি, মাজার ইত্যাদি। তবে আল্লাহ হচ্ছে সত্য মাবুদ, আর তিনি ব্যতীত অন্য যত মা‘বুদ রয়েছে বা অন্য যেগুলোর ইবাদত করা হয় তা হচ্ছে অসত্য ও ভ্রান্ত। আর এটাই হচ্ছে " لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ " এর না বাচক ও হাঁ বাচক এ দুই স্তম্ভের মূল দাবী।
· لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এই কালেমার রুকনসমূহ:
এ কালেমার রয়েছে দুটি স্তম্ভ বা রুকন। তন্মধ্যে প্রথম রুকন হচ্ছে না বাচক আর অপরটি হলো হাঁ বাচক।
না বাচক কথাটির অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা, আর হাঁ সূচক কথাটির অর্থ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহই সত্য মা‘বুদ। আর মুশরিকগণ আল্লাহ ব্যতীত যেসব মা‘বুদের উপাসনা করে সবগুলো মিথ্যা এবং বানোয়াট মা‘বুদ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢ ﴾ [الحج: ٦٢]
“এটা এ জন্য যে, আল্লাহ-ই প্রকৃত সত্য, আর তিনি ব্যতীত যাদেরকে তারা ডাকে সে সব কিছুই বাতিল। (আল্ হাজ্ব-৬২)
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ইলাহ বা মাবুদ’’ এ কথার চেয়ে ‘‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই’’ এই বাক্যটি আল্লাহর উলুহিয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য অধিকতর মজবুত দলিল; কেননা ‘‘আল্লাহ ইলাহ’’ একথা দ্বারা অন্যসব যত ভ্রান্ত ইলাহ রয়েছে তাদের ইলাহ বা মা‘বুদ হওয়াকে অস্বীকার করা হয় না। আর ‘‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’ এ কথাটি উলুহিয়্যাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং অন্য সকল বাতিল ইলাহকে অস্বীকার করে। কিছু লোক চরম ভুলবশতঃ বলে থাকে যে, ‘‘ইলাহ’’ শব্দের অর্থ “সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী।”
শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ তাঁর কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘ইলাহ এবং উলুহিয়্যাতের’’ অর্থ তো স্পষ্ট হলো, (অর্থাৎ তা হচ্ছে মা‘বুদ বা উপাস্য) কিন্তু কেউ যদি বলে যে, “ইলাহ” শব্দের অর্থ হচ্ছে, সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী” বা অনুরূপ কোনো কথা, তখন তার উত্তরে কী বলা হবে?
মূলতঃ এই প্রশ্নের উত্তরের দুটি পর্যায় রয়েছে, প্রথমতঃ এটা একটা উদ্ভট, অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। এ ধরনের কথা বিদ‘আতী ব্যক্তিরাই বলে থাকে, কোনো বিজ্ঞ আলেম বা আরবী ভাষাবিদগণ ‘‘ইলাহ’’ শব্দের এ ধরনের অর্থ করেছেন বলে কেউ বলতে পারবে না বরং তাঁরা এ শব্দের ঐ অর্থই করেছেন যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি[6]। অতএব, এখানেই এ ধরনের ব্যাখ্যা ভুল বলে প্রমাণিত হলো।
দ্বিতীয়ঃ ক্ষনিকের জন্য এ অর্থকে মেনে নিলেও এমনিতেই ‘‘সত্য ইলাহ’’ যিনি হবেন তাঁর জন্য সৃষ্টি করার গুণাবলি একান্তই অপরিহার্য, অতএব ‘‘ইলাহ’’ হওয়ার জন্য সৃষ্টি করার সার্বিক যোগ্যতা থাকা তো অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই তার সাথে জড়িত, আর যে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম সে তো ‘‘ইলাহ’’ হতে পারে না, যদিও তাকে ইলাহ রূপে কেউ অভিহিত করে থাকুক না কেন। সুতরাং কেউ যদি ‘ইলাহ’ দ্বারা ‘সৃষ্টি করতে সমর্থ’ এটা বুঝে থাকেন তবে মনে করতে হবে তিনি এটাই উদ্দেশ্য নিচ্ছেন যে যিনি ইলাহ বা মা‘বুদ হবেন তাঁর মধ্যে এ বাধ্যতামূলক ক্ষমতাটি থাকতে হবে। তাঁর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ‘ইলাহ’ বলতে ‘নতুন করে সৃষ্টি করতে সমর্থ’ এটুকু বিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট হবে অথবা এতটুকু কথা কিয়ামতের দিন জান্নাত লাভের জন্যও যথেষ্ট হবে। যদি এতটুকু বিশ্বাসই যথেষ্ট হতো তাহলে আরবের কাফিররাও মুসলিম বলে গণ্য হতো। তাই এ যুগের কোনো লেখক যদি ‘‘ইলাহ’’ শব্দের এ অর্থই করে থাকেন তা হলে তাকে ভ্রান্ত বলতে হবে এবং কুরআন হাদীসের জ্ঞানগর্ভ দলিল দ্বারা এর প্রতিবাদ করা একান্ত প্রয়োজন।[7]
· لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর শর্তসমূহঃ
এই পবিত্র কালেমা মুখে বলাতে কোনই উপকারে আসবে না যে পর্যন্ত এর সাতটি[8] শর্ত পূর্ণ করা না হবে।
প্রথম শর্ত: এ কালেমার না বাচক এবং হাঁ বাচক দুটি অংশের অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থ এবং উদ্দেশ্য না বুঝে শুধুমাত্র মুখে এ কালেমা উচ্চারণ করার মধ্যে কোনো লাভ নেই। কেননা সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি এ কালেমার মর্মের উপর ঈমান আনতে পারবে না। আর তখন এ ব্যক্তির উদাহরণ হবে ঐ লোকের মত যে লোক এমন এক অপরিচিত ভাষায় কথা বলা শুরু করল যে ভাষা সম্পর্কে তার সামান্যতম জ্ঞান ও নেই।
দ্বিতীয় শর্ত: ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয়। অর্থাৎ এ কালেমার মাধ্যমে যে কথার স্বীকৃতি দান করা হলো তাতে সামান্যতম সন্ধেহ পোষণ করা চলবে না।
তৃতীয় শর্ত: ঐ ইখলাছ বা নিষ্ঠা, যা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর দাবী অনুযায়ী ঐ ব্যক্তিকে শির্ক থেকে মুক্ত রাখবে।
চতুর্থ শর্ত: এই কালেমা পাঠকারীকে সত্যের পরাকাষ্ঠা হতে হবে, যে সত্য তাকে মুনাফিকী আচরণ থেকে বিরত রাখবে। মুনাফিকরাও لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এ কালেমা মুখে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু এর নিগূঢ় তত্ত্ব ও প্রকৃত অর্থে তারা বিশ্বাসী নয়।
পঞ্চম শর্ত: ভালবাসা। অর্থাৎ মোনাফেকী আচরণ বাদ দিয়ে এই কালেমাকে সানন্দচিত্তে গ্রহণ করতে হবে ও ভালবাসতে হবে।
ষষ্ট শর্ত: আনুগত্য করা। এই কালেমার দাবী অনুযায়ী তার হকগুলো আদায় করা, আর তা হচ্ছে আল্লাহর জন্য নিষ্ঠা ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ফরয ওয়াজিব কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়া।
সপ্তম শর্ত: আন্তরিক ভাবে এ কালেমাকে কবুল করা এবং এর পর দ্বীনের কোনো কাজকে প্রত্যাখান করা থেকে নিজকে বিরত রাখা[9]। অর্থাৎ আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করতে হবে এবং তাঁর নিষিদ্ধ সব কাজ পরিহার করতে হবে।
এই শর্তগুলো প্রখ্যাত আলেমগণ চয়ন করেছেন কুরআন ও হাদীসের আলোকেই, অতএব এ কালেমাকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট এমন ধারণা ঠিক নয়।
4. لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এ কালেমার অর্থ ও তার দাবী
পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ কালেমার অর্থও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ কথা স্পষ্ট হলো যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থ হচ্ছে, সত্য এবং হক মাবুদ বলতে যে ইলাহকে বুঝায় তিনি হলেন একমাত্র আল্লাহ, যাঁর কোনো শরীক নেই এবং তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার অধিকারী। তাই এ মহান কালেমার অর্থে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে, তিনি ব্যতীত যত মাবুদ আছে সব অসত্য এবং বাতিল, তাই তারা ইবাদত পাওয়ার অযোগ্য।
এজন্য অধিকাংশ সময় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদাতের আদেশের সাথে সাথে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করতে নিষেধ করা সম্বলিত নির্দেশনা এসেছে। কেননা আল্লাহর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা হলে সে ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ﴾ [النساء: ٣٦]
“আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না।” (আন্ নিসা-৩৬)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦ ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“অতঃপর যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে ব্যক্তি দৃঢ় অবলম্বন ধারণ করল যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।” (আল্ বাকারাহ-২৫৬)
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [النحل: ٣٦]
“আর নিশ্চয় আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এ বলে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে পরিহার কর।” (আন্ নাহাল-৩৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مَنْ دُونِ اللهِ، حَرُمَ مَالُهُ، وَدَمُهُ»
“যে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করল তার জীবন ও সম্পদ অন্যের জন্য নিষেধ করল।”[10]
প্রত্যেক রাসূলই তাঁর জাতিকে বলেছেন,
﴿ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓ ﴾ [الاعراف: ٥٩]
“তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই”। (আল-আ‘রাফ, ৫৯) এতদ ব্যতীত এ সম্পর্কে আরো প্রমাণাদি রয়েছে।
ইবনে রজব বলেন, কালেমার এই অর্থ বাস্তবায়িত হবে তখন, যখন বান্দাহ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর স্বীকৃতি দান করার পর এটা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মাবুদ হওয়ার একমাত্র যোগ্য ঐ সত্তা যাকে ভয়-ভীতি, বিনয়-ভালবাসা, আশা-ভরসা সহকারে আনুগত্য করা হয়, যার নিকট প্রার্থনা করা হয়, যার সমীপে দো‘আ করা হয় এবং যার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা হয়। আর এ সমস্ত কাজ একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।
এ জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন মক্কার কাফেরদেরকে বললেন, তোমরা বলো, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ উত্তরে তারা বললো,
﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]
“সে কি সমস্ত ইলাহকে এক ইলাহতে পরিণত করেছে ? এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।” (ছোয়াদ-৫)
এর অর্থ হলো তারা বুঝতে পারল যে, এ কালেমার স্বীকৃতি মানেই এখন হতে মূর্তিপূজা বাতিল করা হলো এবং ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হলো। আর তারা কখনও এমনটি কামনা করে না। তাই এখানেই প্রমাণিত হলো যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থ এবং এর দাবী হচ্ছে ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ইবাদত পরিহার করা।
এজন্য কোনো ব্যক্তি যখন বলে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ তখন সে এ ঘোষণাই প্রধান করে যে, ইবাদতের একমাত্র অধিকারী আল্লাহ তা‘আলাই এবং তিনি ব্যতীত অন্য কিছুর ইবাদাত যেমন, কবরপূজা পীরপূজা ইত্যাদি সমস্ত কিছুই বাতিল। এর মাধ্যমে গোরপূজারী ও অন্যান্যরা যারা মনে করে যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থ হচ্ছে এই বলে স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ আছেন, অথবা তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি কোনো কিছু উদ্ভাবন করতে সক্ষম, তাদের এই সমস্ত মতবাদ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো।
আবার অনেকে মনে করে যে, কালেমা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থ হলো কেবল “হাকেমিয়াহ বা হুকুমদাতা-বিধানদাতা অথবা সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহর” এবং মনে করে যে, যে কেউ তার জীবনে এ বিশ্বাস করল, কেবলমাত্র এর দ্বারা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ এর ব্যাখ্যা করল, সে নিঃশর্ত তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করল, এরপর যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পূজা -অর্চনা করা হয় বা মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশ্বাস করা হয় যে, তাদের নামে মান্নত, কোরবানী ও ভেট প্রদান করার মাধ্যমে তাদের নৈকট্য লাভ করা সম্ভব বা তাদের কবরের চার পার্শ্বে ঘুরে তাওয়াফ করাতে কিংবা তাদের কবরের মাটিকে বরকতময় মনে করাতে কোনো অসুবিধা নেই এবং এতে কিছু আসে যায় না। এ লোকেরা অনুধাবন করতে পারেনি যে এদের মত এ ধরনের আক্বীদা-বিশ্বাস তৎকালীন মক্কার কাফেরগণও পোষণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র উদ্ভাবক এবং তারা অন্যান্য দেব- দেবীর ইবাদত শুধুমাত্র এজন্যই করত যে, তারাই তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার খুব নিকটবর্তী করে দিবে। তারা মনে করত না যে, ঐ সব দেব-দেবী সৃষ্টি করতে কিংবা রিযিক দান করতে সক্ষম। অতএব ‘হাকেমিয়াহ বা বিধানদাতা বা সার্বভৌমত্ব আল্লাহর জন্য’ এবং এটাই ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’এর প্রকৃত অর্থ বা একমাত্র অর্থ এমনটি নয় বরং নিঃসেন্দেহে হাকেমিয়াহ বা বিধান প্রদান বা সার্বভৌমত্ব এগুলো আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট এবং তা এ কালেমার অর্থের একটি অংশ মাত্র। কেননা কেউ যদি এক দিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে যেমন, আইন আদালত বা বিচার বিভাগ ইত্যাদিতে শরীয়তের হুকুম প্রতিষ্ঠা করে অন্য দিকে আল্লাহর ইবাদতে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তা হলে এর কোনো মূল্যই হবে না। সুতরাং শুধু হাকেমিয়্যাহ বা সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, এটা প্রতিষ্ঠাই কালেমা লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ এর প্রকৃত উদ্দিষ্ট অর্থ নয়।
যদি لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থ এটাই হতো যেমনটি ঐ সমস্ত লোক ধারণা করে তাহলে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কোনো দ্বন্দ্বই থাকত না। তিনি তাদেরকে যদি শুধুমাত্র এতটুকু আহবানই করতেন যে, তোমরা এ মর্মে স্বীকৃতি প্রদান কর যে,আল্লাহ তা‘আলা উদ্ভাবন করতে সক্ষম। অথবা আল্লাহ বলতে একজন কেউ আছেন, অথবা তোমরা ধন-সম্পদ এবং অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে শরীয়াত অনুযায়ী ফায়সালা কর। এর সাথে সাথে তিনি যদি তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার কথা বলা থেকে বিরত থাকতেন তাহলে কালবিলম্ব না করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিত। কিন্তু তারা আরবী ভাষী হওয়ার কারণে বুঝতে পেরেছিল যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থই হচ্ছে সমস্ত দেব-দেবীর ইবাদতকে বাতিল বলে ঘোষণা করা। তারা আরো বুঝেছিল যে, এই কালেমা শুধুমাত্র এমন কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, যার কোনো অর্থ নেই বরং এসব কিছু বুঝার কারণেই তারা এর স্বীকৃতি দান থেকে বিরত থাকল এবং বলল,
﴿ أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥ ﴾ [ص: ٥]
“সে কি সমস্ত ইলাহগুলোকে এক ইলাহতে পরিণত করল? এ তো অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়।” [সূরা ছোয়াদ:৫]
যেমন তাদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٥، ٣٦]
“তাদেরকে যখন বলা হতো, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই’ তখন তারা উদ্ধত্য প্রদর্শন করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের সকল উপাস্যকে পরিত্যাগ করব? (আস-সাফফাত-৩৫-৩৬)
অতএব তারা বুঝল যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর মানেই হচ্ছে সমস্ত কিছুর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা। তারা যদি এক দিকে কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলত অন্যদিকে দেব- দেবীর ইবাদতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকত তা হলে এটা হত স্ববিরোধিতা, অথচ এমন স্ববিরোধিতা থেকে তারা নিজদেরকে বিরত রেখেছে। কিন্তু আজকের কবর পূজারীরা এই জঘন্যতম স্ববিরোধিতা থেকে নিজদেরকে বিরত রাখছে না। তারা একদিকে বলে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ অন্যদিকে মৃত ব্যক্তি এবং মাজার ভিত্তিক ইবাদতের মাধ্যমে এ কালেমার বিরোধিতা করে থাকে। অতএব ধ্বংস ঐ সকল ব্যক্তির জন্য যাদের চাইতে আবু জাহাল ও আবু লাহাব ছিল কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অর্থ সম্পর্কে আরো বেশী অভিজ্ঞ।
সংক্ষিপ্ত কথা হলো, যে ব্যক্তি কালেমার অর্থ জেনে বুঝে কালেমার দাবী অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে এর স্বীকৃতি দান করল এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় নিজকে শির্ক থেকে বিরত রেখে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতকে নির্ধারণ করল, সে ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুসলিম। আর যে এই কালেমার মর্মার্থকে বিশ্বাস না করে এমনিতে প্রকাশ্যভাবে এর স্বীকৃতি দান করল এবং এর দাবী অনুযায়ী গতানুগতিকভাবে কাজ করল সে ব্যক্তি মূলত মুনাফিক। আর যে মুখে এ কালেমা বলল এবং শির্ক এর মাধ্যমে এর বিপরীত কাজ করল সে প্রকৃত অর্থে স্ববিরোধী মুশরিক। সুতরাং এ কালেমা উচ্চারণের সাথে সাথে অবশ্যই এর অর্থ জানতে হবে। কারণ অর্থ জানাই হচ্ছে এর দাবী অনুযায়ী আমল করার মাধ্যম। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦ ﴾ [الزخرف: ٨٦]
“তবে যারা জেনে বুঝে সত্যের সাক্ষ্য দিল তারা ব্যতীত (অন্যরা সুপারিশের অধিকারী হবে না)’’ (আয-যখরুফ, ৮৬)
আর এ কালেমার চাহিদা অনুযায়ী আমল হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকল কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা। এ কালেমা দ্বারা মূল উদ্দেশ্য তো তাই।
আর কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অন্যতম দাবী হলো ইবাদত, মোয়ামেলাত (লেন-দেন) হালাল-হারাম, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানকে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও প্রবর্তিত বিধানকে বর্জন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
“তাদের কি এমন কোনো শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি। (সূরা আশ- শুরা, ২১)
এ থেকে বুঝা গেল অবশ্যই ইবাদত, লেন-দেন এবং মানুষের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়সমূহ ফয়সালা করতে আল্লাহর বিধানকে মেনে নিতে হবে এবং এর বিপরীত মানব রচিত সকল বিধানকে ত্যাগ করতে হবে। এ অর্থ থেকে আরো বুঝা গেল যে, সমস্ত বিদ‘আত এবং কুসংস্কার যা জ্বীন ও মানবরূপী শয়তান রচনা করে, তাও পরিত্যাগ করতে হবে। আর যে এগুলোকে গ্রহণ করবে সে মুশরিক বলে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
“তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান রচনা করবে যার অনুমতি আল্লাহ দেন নি?” [সূরা আশ-শূরা:২১]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ وَإِنۡ أَطَعۡتُمُوهُمۡ إِنَّكُمۡ لَمُشۡرِكُونَ ١٢١ ﴾ [الانعام: ١٢١]
“যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা মুশরিক”। (আল-আন‘আম: ১২১)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ ﴾ [التوبة: ٣١]
“আল্লাহ ব্যতীত তারা তাদের পণ্ডিত ও পুরোহিতদেরকে রবরূপে গ্রহণ করেছে’’। (সূরা আত-তাওবাহ, ৩১)
সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আদী ইবনে হাতেম আত-ত্বায়ীর সামনে উল্লেখিত আয়াত পাঠ করেন তখন ‘আদী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আমাদের পীর-পুরোহিতদের ইবাদত করি না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হারাম করেছেন তোমাদের পীর-পুরোহীতরা তা হালাল করেছে, আর আল্লাহ যে সমস্ত জিনিস হালাল করেছেন তা তারা হারাম বা অবৈধ করেছে, তোমরা কি এতে তাদের অনুসরণ কর না ? আদী বললেন, অবশ্যই হাঁ, এতে আমরা তাদের অনুসরণ করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম বললেন, এটাই তাদের ইবাদত[11]।
আশ-শাইখ আবদুর রহমান ইবন হাসান বলেন, সুতরাং অন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করার জন্যই এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদত হয়ে গেল এবং এরই মাধ্যমে পীর পুরোহিতদের তারা নিজেদের রব হিসাবে গ্রহণ করল। আর এ হলো আমাদের বর্তমান জাতির অবস্থা এবং এটা এক প্রকার বড় শির্ক যার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদকে অস্বীকার করা হয়, যে একত্ববাদ বা তাওহীদের অর্থ বহন করে কালেমা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” এর সাক্ষ্য। অতএব এখানে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, এই ইখলাসের কালেমা (লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ) এসব বিষয়কে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে কারণ তা এ কালেমার অর্থের সম্পূর্ণ বিরোধী।
অনুরূভাবে মানব রচিত আইনের কাছে বিচার চাওয়া, বিচারের জন্য সেগুলোর দ্বারস্থ হওয়া পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। কেননা, বিচার ফয়সালাতে আল্লাহর কিতাব কুরআনের কাছে যাওয়া ওয়াজিব। তদ্রূপ আল্লাহর কিতাব ব্যতীত অন্য কোনো আইন ও বিধানের কাছে বিচারের জন্য যাওয়া পরিত্যাগ করাও ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন,
﴿ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ ﴾ [النساء: ٥٩]
“তারপর তোমরা যদি কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর।” (আন্ নিসা-৫৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَا ٱخۡتَلَفۡتُمۡ فِيهِ مِن شَيۡءٖ فَحُكۡمُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبِّي ﴾ [الشورى: ١٠]
“তোমরা যে বিষয়ই মতভেদ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে, আর সে আল্লাহ, তিনিই আমার রব”। (সূরা আশ্-শূরা ১০)
যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ফয়সালা করে না তার বিষয়ে আল্লাহর ফয়সালা হলো এই যে, সে কাফের অথবা যালেম অথবা ফাসেক এবং তার ঈমানদার থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। যা প্রমাণ করে যে, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যে ব্যক্তি ফয়সালা করবে না সে কাফের হয়ে যাবে যখন সে শরীয়ত বিরোধী ফায়সালা দেয়াকে জায়েয বা মোবাহ মনে করবে অথবা মনে করবে যে, তার ফয়সালা আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালা থেকে অধিক উত্তম বা অধিক গ্রহণীয়। এমন বিশ্বাস পোষণ করা হবে তাওহীদ পরিপন্থী, কুফুরী ও শির্ক এবং তা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এই কালেমার অর্থের একেবারে বিরোধী।
আর যদি বিচারক বা শাসক শরীয়ত বিরোধী ফয়সালা দানকে মোবাহ বা জায়েয মনে না করে, বরং শরীয়ত অনুযায়ী ফয়সালা প্রদানকে ওয়াজিব মনে করে কিন্তু পার্থিব লালসার বশবর্তী হয়ে নিজের মনগড়া আইন দিয়ে ফয়সালা করে তবে এটা ছোট শির্ক ও ছোট কুফরীর পর্যায়ে পড়বে। তবে এটাও لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর অর্থের পরিপন্থী। অতএব لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ একটি পূর্ণাঙ্গ পথ ও পদ্ধতি, এ কালেমাই মুসলিমদের জীবনকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পরিচালনা করবে তাদের সমস্ত ইবাদত-বন্দেগী এবং সমস্ত কাজ কর্মকে। এই কালেমা শুধুমাত্র কতগুলো শব্দের সমারোহ নয় যে, না বুঝে একে সকাল সন্ধ্যার তাসবীহ হিসাবে শুধুমাত্র বরকতের জন্য পাঠ করবে আর এর দাবী অনুযায়ী কাজ করা থেকে বিরত থাকবে অথবা এর নির্দেশিত পথে চলবে না। মূলতঃ অনেকেই একে শুধুমাত্র গতানুগতিক ভাবে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস ও কর্ম এর পরিপন্থী।
কালেমা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর আরো দাবী হলো, আল্লাহর যত গুণবাচক নাম ও তাঁর নিজ সত্তার যে সমস্ত নাম আছে যে গুলোকে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন অথবা তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন সে সব নাম ও গুণাবলীকে যথাযথভাবে সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সবচেয়ে উত্তম নামসমূহ, কাজেই সে সমস্ত নাম ধরেই তাঁকে ডাক, আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল অবশ্যই পাবে। (আল-আ‘রাফ: ১৮০)
ফাতহুল মজিদ কিতাবের লেখক বলেন, আরবদের ভাষায় প্রকৃত ‘ইলহাদ’ বলতে বুঝায়, সঠিক পথ পরিহার করে বক্র পথ অনুসরণ করা এবং বক্রতার দিকে ঝুকে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়াকে।
আল্লাহর সমস্ত নাম এবং গুনবাচক নামের মধ্যেই তাঁর পরিচয় এবং কামালিয়াত ফুটে উঠে বান্দার নিকট। লেখক আরো বলেন, অতএব আল্লাহর নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করা মানে ঐ সমস্ত নামকে অস্বীকার করা, অথবা ঐ সমস্ত নামের অর্থকে অস্বীকার বা অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক মনে করা, অথবা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এর সঠিক অর্থকে পরিবর্তন করে দেওয়া, অথবা আল্লাহর ঐ সমস্ত নাম দ্বারা তাঁর মাখলুকাতকে বিশেষিত করা। যেমন ওহদাতুল ওয়াজুদ পন্থিরা স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক করে সৃষ্টির ভাল-মন্দ অনেক কিছুকেই আল্লাহর নামে বিশেষিত করেছে[12]।
অতএব যে ব্যক্তি মুতাযিলা সম্প্রদায় বা জাহমিয়া বা আশায়েরা মতবাদে বিশ্বাসীদের অনুরূপ আল্লাহর নামসমূহের ও গুনাবলীর অপব্যাখ্যা করল, অথবা সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ও অর্থ-সারশুন্য মনে করল, অথবা সেগুলোর অর্থ বোধগম্য নয় বলে মনে করল এবং এসব নাম ও গুণাবলীর সুমহান অর্থের উপর বিশ্বাস আনলো না সে মুলত আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে বক্রতার পথ অবলম্বন করল এবং ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর অর্থ ও উদ্দেশ্যেরই বিরোধিতা করল। কেননা ‘‘ইলাহ’’ হলেন তিনি, যাঁকে তার নাম ও সিফাতের মাধ্যমে ডাকা হয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করা হয়। আল্লাহ বলেন, (فَادْعُوْهُ بِهَا) “ঐ সমস্ত নামের মাধ্যমে তাঁকে ডাক’’। আর যার কোনো নাম বা সিফাত নেই সে কিভাবে ‘‘ইলাহ’’ বা উপাস্য হতে পারে এবং কিসের মাধ্যমে তাকে ডাকা হবে?
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, শরীয়াতের বিভিন্ন হুকুম আহকামের বিষয়ে এ উম্মতের পূর্ববর্তী মানুষগণ বিতর্কে লিপ্ত হলেও সিফাত সংক্রান্ত আয়াতসমূহে বা এসম্পর্কে যে সংবাদ এসেছে তাতে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হয়নি। বরং সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, আল্লাহর এসমস্ত আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের প্রকৃত অর্থ বুঝার পর ঠিক যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে, কোনো প্রকার অপব্যাখ্যা ছাড়াই তা ঐ ভাবেই মেনে নিতে হবে এবং স্বীকৃতি দান করতে হবে। এখানে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহর আসমায়ে হুসনা এবং সিফাতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ তাওহীদ ও রিসালাতকে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করার এটাই মূল উৎস এবং তাওহীদের স্বীকৃতর জন্য এ সমস্ত আসমায়ে হুসনার স্বীকৃতি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন; যাতে কোনো প্রকার সংশয়ের অবকাশ না থাকতে পারে।
হুকুম-আহকাম তথা বিধি-বিধানের আয়াতগুলো বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ব্যতীত সবার জন্য বুঝে উঠা একটু কঠিন কাজ, কিন্তু আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত আয়াতসমূহের সাধারণ অর্থ সব মানুষই বুঝতে পারে। অর্থাৎ তাঁর সত্তা ও আকৃতি বুঝা ব্যতীত আসল অর্থ সকলই বুঝতে পারে[13]।
লেখক আরো বলেন, এটি এমন একটি বিষয় যা সহজাত প্রবৃত্তি, সুস্থ মস্তিস্ক এবং আসমানী কিতাবসমূহের মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় যে, যার মধ্যে পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলী না থাকে সে কিছুতেই ইলাহ বা মা‘বুদ, পরিচালক ও রব হতে পারে না। সে হবে নিন্দিত ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিপক্ক এবং পূর্বাপর কোনো অবস্থায় সে প্রশংসিত হতে পারে না। সর্বাবস্থায় প্রশংসিত হবেন তিনিই যাঁর মধ্যে কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জনের সমস্ত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে। এ জন্যই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের পূর্বকালীন মনীষীগণ সুন্নাতের উপর বা আল্লাহর সিফাত সাব্যস্তকরণ যেমন, তাঁর সকল সৃষ্টির উর্ধ্বে থাকা, তাঁর কথোপকথন ইত্যাদির উপর যে সব গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলোর নাম দিয়েছেন ‘‘আত-তাওহীদ’’ হিসেবে। কারণ এ সমস্ত গুণাবলীকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করা এবং এর সাথে কুফরী করার অর্থ হলো, সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করা এবং তাঁকে না মানা। আর আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহীদের অর্থ হচ্ছে তাঁর সমস্ত কামালিয়তের সিফাতকে মেনে নেওয়া, সমস্ত দোষত্রুটি ও অন্য কিছুর সাথে তুলনীয় হওয়া থেকে তাঁকে পবিত্র মনে করা[14]।
5. একজন ব্যক্তির জন্য কখন "لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ" এর স্বীকৃতি ফলদায়ক হবে আর কখন এর স্বীকৃতি নিষ্ফল হবে?
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর স্বীকৃতির সাথে এর অর্থ বুঝা এবং এর দাবী অনুযায়ী কাজ করাটা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত কিন্তু কুরআন ও হাদিসে এমন কিছু উদ্ধৃতি আছে যা থেকে সন্দেহের উদ্ভব হয় যে, শুধুমাত্র ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট। মূলতঃ কিছু লোক এ ধারণাই পোষণ করে বসে আছে। অতএব সত্যসন্ধানীদের জন্য এ সন্দেহের নিরসন করে দেওয়া একান্তই প্রয়োজন মনে করি।
ইতবান (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে,
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুনকে হারাম করে দিবেন।[15]”
এই হাদীসের আলোচনায় শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ বলেন, মনে রাখবেন অনেক হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখলে মনে হবে যে, কোনো ব্যক্তি তাওহীদ এবং রিসালাতের শুধুমাত্র সাক্ষ্য দান করলেই জাহান্নামের জন্য সে হারাম হয়ে যাবে যেমনটি উপরোল্লেখিত হাদীসে বলা হয়েছে।
এমনিভাবে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসেও এসেছে তিনি বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার সাওয়ারির পিঠে আরোহণ করে কোথাও যাচ্ছেন এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আযকে ডাকলেন। তিনি বললেন, লাব্বাইকা ওয়া সা‘দাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ। এর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে মু‘আয, যে বান্দাই এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, ‘‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’’ আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন[16]।
অনুরূপ ইমাম মুসলিম ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন’’[17]।
এছাড়া অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি দান করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তবে জাহান্নাম তার জন্য হারাম করা হবে এমন কোনো উল্লেখ তাতে নেই।
অনুরূপভাবে তাবুক যুদ্ধ চলাকালিন একটি ঘটনা, আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন,
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।’ সংশয়হীনভাবে এ কালেমা পাঠকারী যদি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে তবে জান্নাতের মধ্যে এবং তার মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।[18]”
এ সব হাদীস ও বর্ণনার বিষয়ে শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ এবং অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা অত্যন্ত চমৎকার।
ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (র.) বলেন, এ সমস্ত হাদীসের অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ কালেমা পাঠ করে এর উপর মৃত্যুবরণ করবে - যে ভাবে নির্দিষ্ট সীমারেখায় বর্ণিত হয়েছ- এবং এই কালেমাকে সংশয়হীনভাবে একেবারে নিরেট আল্লাহর ভালোবাসায় হৃদয় মন থেকে এর স্বীকৃতি দিবে; কেননা প্রকৃত তাওহীদ হচ্ছে সার্বিক ভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা এবং আকৃষ্ট হওয়া। অতএব যে ব্যক্তি খালেস দিলে ‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’’ এর সাক্ষ্য দান করবে সেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঐ আকর্ষণের নাম যে আকর্ষণ বা আবেগের ফলে আল্লাহর নিকট বান্দাহ সমস্ত পাপের জন্য খালেস তওবা করবে এবং যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে তবেই জান্নাত লাভ করতে পারবে। কারণ অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ সে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে যদি তার মধ্যে অণু পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকে। এছাড়া অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, অনেক লোক ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পরেও জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বনি আদম সিজদা করার ফলে যে চিহ্ন পড়ে ঐ চিহ্নকে জাহান্নাম কখনো স্পর্শ করতে পারবে না, এতে বুঝা গেল ঐ ব্যক্তিরা সালাত পড়ত এবং আল্লাহর জন্য সিজদা করত। আর অনেকগুলো মুতাওয়াতির হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’’ এবং এই সাক্ষ্য দান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তার উপর জাহান্নামকে হারাম করা হবে। তবে একথাগুলো কঠোর শর্তে (যেমন ইখলাস, ইয়াকীন, সততা ইত্যাদির সাথে) শর্তযুক্ত করে বর্ণিত হয়েছে। অথচ অধিকাংশ লোক যারা এ কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ মুখে উচ্চারণ করে তারা জানে না ইখলাস এবং ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয় বলতে কি বুঝায়। আর যে ব্যক্তি এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত থাকবে না মৃত্যুর সময় এ কারণে ফিতনার সম্মুখীন হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং ঐ সময় হয়ত তার মাঝে এবং এ কালেমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক লোক এ কালেমা অনুকরণমূলক বা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পাঠ করে থাকে অথচ তাদের অন্তরে ঐকান্তিকভাবে ঈমানের খুশি প্রবেশ করে না। আর মৃত্যুর কালে ও কবরের ফিতনার সম্মুখীন যারা হয় তাদের অধিকাংশই এই শ্রেনীর মানুষ। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এ ধরনের লোকরা কবরে প্রশ্ন করার পর উত্তরে বলবে, ‘‘মানুষকে এভাবে একটা কিছু বলতে শুনেছি এবং আমিও তাদের মত বুলি আওড়িয়েছি মাত্র’’। তাদের অধিকাংশ কাজ কর্ম এবং আমল তাদের পূর্বসূরীদের অনুকরণেই হয়ে থাকে। আর এ কারণে তাদের জন্য আল্লাহর এ বাণীই শোভা পায়:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুনকে হারাম করে দিবেন।[15]”
এই হাদীসের আলোচনায় শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ বলেন, মনে রাখবেন অনেক হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখলে মনে হবে যে, কোনো ব্যক্তি তাওহীদ এবং রিসালাতের শুধুমাত্র সাক্ষ্য দান করলেই জাহান্নামের জন্য সে হারাম হয়ে যাবে যেমনটি উপরোল্লেখিত হাদীসে বলা হয়েছে।
এমনিভাবে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসেও এসেছে তিনি বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার সাওয়ারির পিঠে আরোহণ করে কোথাও যাচ্ছেন এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আযকে ডাকলেন। তিনি বললেন, লাব্বাইকা ওয়া সা‘দাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ। এর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে মু‘আয, যে বান্দাই এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, ‘‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’’ আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন[16]।
অনুরূপ ইমাম মুসলিম ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন’’[17]।
এছাড়া অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি দান করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তবে জাহান্নাম তার জন্য হারাম করা হবে এমন কোনো উল্লেখ তাতে নেই।
অনুরূপভাবে তাবুক যুদ্ধ চলাকালিন একটি ঘটনা, আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন,
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।’ সংশয়হীনভাবে এ কালেমা পাঠকারী যদি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে তবে জান্নাতের মধ্যে এবং তার মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।[18]”
এ সব হাদীস ও বর্ণনার বিষয়ে শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ এবং অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা অত্যন্ত চমৎকার।
ইবনে তাইমিয়্যাহ্ (র.) বলেন, এ সমস্ত হাদীসের অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ কালেমা পাঠ করে এর উপর মৃত্যুবরণ করবে - যে ভাবে নির্দিষ্ট সীমারেখায় বর্ণিত হয়েছ- এবং এই কালেমাকে সংশয়হীনভাবে একেবারে নিরেট আল্লাহর ভালোবাসায় হৃদয় মন থেকে এর স্বীকৃতি দিবে; কেননা প্রকৃত তাওহীদ হচ্ছে সার্বিক ভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা এবং আকৃষ্ট হওয়া। অতএব যে ব্যক্তি খালেস দিলে ‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’’ এর সাক্ষ্য দান করবে সেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঐ আকর্ষণের নাম যে আকর্ষণ বা আবেগের ফলে আল্লাহর নিকট বান্দাহ সমস্ত পাপের জন্য খালেস তওবা করবে এবং যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে তবেই জান্নাত লাভ করতে পারবে। কারণ অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ সে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসবে যদি তার মধ্যে অণু পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকে। এছাড়া অসংখ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, অনেক লোক ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পরেও জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। অনেকগুলো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বনি আদম সিজদা করার ফলে যে চিহ্ন পড়ে ঐ চিহ্নকে জাহান্নাম কখনো স্পর্শ করতে পারবে না, এতে বুঝা গেল ঐ ব্যক্তিরা সালাত পড়ত এবং আল্লাহর জন্য সিজদা করত। আর অনেকগুলো মুতাওয়াতির হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি বলবে, ‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’’ এবং এই সাক্ষ্য দান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তার উপর জাহান্নামকে হারাম করা হবে। তবে একথাগুলো কঠোর শর্তে (যেমন ইখলাস, ইয়াকীন, সততা ইত্যাদির সাথে) শর্তযুক্ত করে বর্ণিত হয়েছে। অথচ অধিকাংশ লোক যারা এ কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ মুখে উচ্চারণ করে তারা জানে না ইখলাস এবং ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয় বলতে কি বুঝায়। আর যে ব্যক্তি এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত থাকবে না মৃত্যুর সময় এ কারণে ফিতনার সম্মুখীন হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং ঐ সময় হয়ত তার মাঝে এবং এ কালেমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। অনেক লোক এ কালেমা অনুকরণমূলক বা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পাঠ করে থাকে অথচ তাদের অন্তরে ঐকান্তিকভাবে ঈমানের খুশি প্রবেশ করে না। আর মৃত্যুর কালে ও কবরের ফিতনার সম্মুখীন যারা হয় তাদের অধিকাংশই এই শ্রেনীর মানুষ। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, এ ধরনের লোকরা কবরে প্রশ্ন করার পর উত্তরে বলবে, ‘‘মানুষকে এভাবে একটা কিছু বলতে শুনেছি এবং আমিও তাদের মত বুলি আওড়িয়েছি মাত্র’’। তাদের অধিকাংশ কাজ কর্ম এবং আমল তাদের পূর্বসূরীদের অনুকরণেই হয়ে থাকে। আর এ কারণে তাদের জন্য আল্লাহর এ বাণীই শোভা পায়:
﴿ إِنَّا وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا عَلَىٰٓ أُمَّةٖ وَإِنَّا عَلَىٰٓ ءَاثَٰرِهِم مُّقۡتَدُونَ ٢٣ ﴾ [الزخرف: ٢٣]
“আমরা আমাদের পিতা- পিতামহদের এই পথের পথিক হিসাবে পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে চলেছি।” (আয-যুখরুফ-২৩)
এই দীর্ঘ আলোচনার পর বলা যায় যে, এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কোনো প্রকার বিরোধিতা নেই। অতএব কোনো ব্যক্তি যদি পূর্ণ ইখলাছ এবং ইয়াকীনের সাথে এ কালেমা পাঠ করে থাকে তা হলে কোনো মতেই সে কোনো পাপ কাজের উপর অবিচলিত থাকতে পারে না। কারণ তার বিশুদ্ধ ইসলাম বা সততার কারণে আল্লাহর ভালোবাসা তার নিকট সকল কিছুর উর্ধ্বে স্থান পাবে। অতএব এ কালেমা পাঠ করার পর আল্লাহর হারামকৃত বস্তুর প্রতি তার হৃদয়ের মধ্যে কোনো প্রকার আগ্রহ বা ইচ্ছা থাকবে না এবং আল্লাহ যা আদেশ করেছেন সে সম্পর্কে তার মনের মাঝে কোনো প্রকার দ্বিধা- সংকোচ বা ঘৃণা থাকবে না। আর এ ধরনের ব্যক্তির জন্যই জাহান্নাম হারাম হবে, যদিও তার নিকট হতে এর পূর্বে কিছু গুনাহ হয়ে থাকে। কারণ তার ঈমান, ইখলাছ, ভালোবাসা এবং ইয়াকীন তার অন্যসব পাপকে এভাবে মুছে দিবে যেভাবে দিনের আলো রাতের অন্ধকারকে দূরিভূত করে দেয়।[19]
শাইখ মুহাম্মদ ইবন আব্দুল ওয়াহাব বলেন, এই প্রসঙ্গে তাদের আরেকটি সংশয় এই যে তারা বলে, উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এক ব্যক্তিকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পরেও হত্যা করার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ কাজকে নিন্দা করেছেন এবং উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি কি তাকে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পর হত্যা করেছ? এ ধরনের আরো অন্যান্য হাদীস যাতে কালেমা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠকারীর নিরাপত্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ থেকে এ সকল মূর্খরা বলতে চায় যে, কোনো ব্যক্তি এ কালেমা পড়ার পর যা ইচ্ছা করতে পারে, এ কারণে আর কখনো কাফের হয়ে যাবে না এবং তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য এটাই যথেষ্ট। এ সমস্ত অজ্ঞদের বলতে হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদীদের সাথে জিহাদ করেছেন এবং তাদের বন্দী করেছেন অথচ তারা ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এ কথাকে স্বীকার করত। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ বনু হানিফা গোত্রের সাথে জিহাদ করেছেন অথচ তারা স্বীকার করত যে, আল্লাহ এক এবং মুহাম্মদ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তারা সালাত পড়ত ও ইসলামের দাবীদার ছিল। এভাবে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যাদেরকে জ্বালিয়ে মেরেছিলেন তাদের কথাও উল্লেখ করা যায়।
এ সমস্ত অজ্ঞরা এ বিষয় স্বীকৃতি দান করে যে, যে ব্যক্তি ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলার পর পুনরুত্থানকে অবিশ্বাস করবে সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যাবে এবং মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে। এছাড়া যে ব্যক্তি ইসলামের স্তম্ভগুলোর কোনো একটিকে অস্বীকার করবে তাকে কাফের বলা হবে এবং মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে, যদিও সে মুখে لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এ কালেমা উচ্চারণ করুক। তা হলে বিষয়টা কেমন হলো? আংশিক দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বক্রতার পথ গ্রহণ করলে যদি ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলা কোনো উপকারে না আসে তা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনিত দ্বীনের মূল বিষয় তাওহীদের সাথে কুফরী করার পর কিভাবে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করাটা তার উপকার সাধন করতে পারে? মূলত আল্লাহদ্রোহীরা এই সমস্ত হাদীসের অর্থ বুঝতে পারেনি[20]।
উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসের ব্যাখ্যায় তিনি আরো বলেন, উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন এই মনে করে যে, ঐ ব্যক্তি মুসলিম হওয়ার দাবী করেছে শুধুমাত্র তার জীবন ও সম্পদ রক্ষার ভয়ে। আর ইসলামের নীতি হচ্ছে কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে ঐ পর্যন্ত তার ধন-সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে যে পর্যন্ত ইসলামের পরিপন্থী কোনো কাজ সে না করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَتَبَيَّنُواْ ﴾ [النساء: ٩٤]
“হে ঈমানদারগণ তোমরা যখন আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য বাহির হও তখন যাচাই করে নিও।” (আন্ নিসা-৯৪) এই আয়াতের অর্থ হলো এই যে, কোনো ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের পর ঐ পর্যন্ত তার জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে যে পর্যন্ত ইসলাম পরিপন্থী কোনো কাজ তার নিকট থেকে প্রকাশ না পায়। কিন্তু যদি এর বিপরীত কোনো কাজ করা হয় তাহলে তাকে হত্যা করা যাবে। কেননা আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ কর। আর যদি তাই না হতো তাহলে এখানে (فَتَبَيَّنُواْ) অর্থাৎ “যাচাই কর” এ শব্দের কোনো মূল্যই থাকে না। এভাবে অন্যান্য হাদীসসমূহ, যার আলোচনা পূর্বে বর্ণনা করেছি অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলাম এবং তাওহীদের স্বীকৃতি দান করল এবং এরপর ইসলাম পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত থাকল তার জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করা ওয়াজিব। আর একথার দলিল হচ্ছে, যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে বললেন, “তুমি কি তাকে لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ বলার পর হত্যা করেছ?” সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বলেছেন, “আমি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই।” আবার তিনিই খারেজিদের সম্পর্কে বলেন, ‘‘তোমরা যেখানেই তাদের দেখা পাও সেখানেই তাদেরকে হত্যা কর, আমি যদি তাদেরকে পেতাম তাহলে ‘আদ জাতির হত্যার মত তাদেরকে হত্যা করতাম’’। অথচ এরাই ছিল তখনকার সময় সবচেয়ে বেশী ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণকারী। এমনকি সাহাবায়ে কেরাম এ দিক থেকে এ সমস্ত লোকদের তুলনায় নিজদেরকে খুব খাটো মনে করতেন। যদিও তারা সাহাবায়ে কেরামের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত, কিন্তু এদের নিকট থেকে ইসলাম বহির্ভূত কাজ প্রকাশ পাওয়ায় এদের “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” বলা বা এর প্রচার করা এবং ইবাদত করা ও মুখে ইসলামের দাবি করা কোনো কিছুই তাদের কাজে আসল না। এভাবে ইয়াহুদীদের সাথে যুদ্ধ করা এবং সাহাবাদের ‘‘বন হানিফা’’ গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়গুলোও এখানে উল্লেখযোগ্য।
এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনে রজব তাঁর ‘‘কালেমাতুল ইখলাস’’ নামক গ্রন্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস ‘‘আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল” এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘উমর ও একদল সাহাবা বুঝে ছিলেন যে, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দান করবে একমাত্র এর উপর নির্ভর করে তাদের দুনিয়াবী শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এ জন্যই তাঁরা যাকাত প্রদান করতে যারা অস্বীকার করেছে তাদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বুঝেছিলেন যে, ‘ঐ পর্যন্ত তাদেরকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে না যে পর্যন্ত তারা এ কালেমার হক্ব (যাকাত) আদায় করতে স্বীকৃতি না দিবে। কেননা; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “অতঃপর যখন তারা এ কালেমার (তাওহীদ ও রিসালাতের) স্বীকৃতি দিবে, তখন তারা আমার নিকট থেকে তাদের জীবনকে হেফাযত করবে তবে এ স্বীকৃতির হক বা অধিকার অনুযায়ী ইসলামী দণ্ডে দণ্ডিত হলে দুনিয়ায় তাদের উপর সে দণ্ড প্রয়োগ করা হবে এবং তাদের পরকালীন হিসাবের দায়িত্ব আল্লাহর উপর বর্তাবে।” আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আরও বলেছিলেন যে, “যাকাত হচ্ছে, সম্পদের হক”[21]।
অবশ্য আবুবকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর এ বুঝ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ইবনে ‘উমর, আনাস ও অন্যান্য অনেক সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম স্পষ্টভাবেই বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ»
‘‘আমি মানুষের সাথে লড়াই করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলবে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর রাসূল এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত করবে ও যাকাত দান করবে”[22]।
তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলার বাণীও এ অর্থই বহন করে। তিনি বলেন,
﴿ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٥ ﴾ [التوبة: ٥]
“অতঃপর তারা যদি তওবা করে এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও।” (আত-তাওবা, আয়াত ৫) আল্লাহ আরো বলেন,
﴿فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَإِخۡوَٰنُكُمۡ فِي ٱلدِّينِۗ ﴾ [التوبة: ١١]
“তারা যদি তাওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই”। এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, কোনো ব্যক্তির সাথে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব ঐ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হবে না, যে পর্যন্ত সে তাওহীদের স্বীকৃতির সাথে সাথে সমস্ত ফরয ওয়াজিব আদায় না করবে। আর শির্ক থেকে তওবা করা ঐ পর্যন্ত প্রমাণিত হবে না যে পর্যন্ত তাওহীদের উপর অবিচল না থাকবে।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন সাহাবীদের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন, তখন তাঁরা এ রায়ের প্রতি ফিরে আসলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক মনে করলেন। এতে বুঝা গেল যে, শুধুমাত্র এই কালেমা পাঠ করলেই যেমন দুনিয়ার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না, তেমনি ইসলামের কোনো বিধি বিধান লংঘন করলেও দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুতরাং আখেরাতের শাস্তির বিষয়টিও একই রকম।
হাফেয ইবন রাজাব আরও বলেন[23], আলেমদের মধ্যে অন্য একটি দল (উক্ত সন্দেহের জবাবে) বলেন, এ সব হাদীসের অর্থ হচ্ছে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ মুখে উচ্চারণ করা জান্নাতে প্রবেশ এবং জাহান্নাম থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার একটা প্রধান উপকরণ এবং এর দাবী মাত্র। আর এ দাবীর ফলাফল সিদ্ধি হবে শুধুমাত্র তখই যখন প্রয়োজনীয় শর্তগুলো আদায় করা হবে এবং এর প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা হবে। ঐ লক্ষ্যে পৌঁছার শর্তগুলো যদি অনুপস্থিত থাকে, অথবা এর প্রতিবন্ধক কোনো কাজ পাওয়া যায় তবে এ কালেমা পাঠ করা এবং এর লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয় না। হাসান বসরী এবং ওয়াহাব ইবন মুনাব্বেহ এ মতই ব্যাক্ত করেছেন এবং এ মতই হলো অধিক স্পষ্ট।
তারপর ইমাম ইবন রাজাব রহ. হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ফারাযদাক নামক কবিকে তার স্ত্রীর দাফনে সময় তাকে বলেন, এ দিনের (মৃত্যু ও আখেরাতের) জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? উত্তরে ফারাযদাক বললেন, সত্তর বৎসর যাবত কালেমা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর যে সাক্ষ্য দিয়ে আসছি সেটাই আমার সম্বল। হাসান বসরী বললেন, বেশ উত্তম প্রস্তুতি; কিন্তু এই কালেমার কতগুলো শর্ত রয়েছে, তুমি অবশ্যই পবিত্রা- নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে কবিতা লেখা থেকে নিজকে বিরত রাখবে।
হাসান বসরীকে প্রশ্ন করা হলো, কিছু সংখ্যক মানুষ বলে থাকে যে, যে ব্যক্তি বলবে, لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এবং এর ফরয ওয়াজিব আদায় করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
এক ব্যক্তি ওয়াহাব ইবন মুনাব্বেহকে বললেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কি বেহেস্তের কুঞ্জি? তিনি বললেন, হাঁ, তবে প্রত্যেক কুঞ্জির মধ্যেই দাঁত কাটা থাকে, তুমি যে চাবি নিয়ে আসবে তাতে যদি দাঁত থাকে তবেই তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খোলা হবে, নইলে নয়।
আমি মনে করছি, আলেমদের এ কথাসমূহ তাদের সন্দেহের যথাযথ অপনোদন করেছে যারা মনে করে, “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” এ কালেমা পাঠ করলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, এর দাবী অনুযায়ী কাজ করা হোক বা নাই হোক, অনুরূপ তাদের সন্দেহও দূরীভূত হলো যারা মনে করে “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” বললেই আর কখনো তাদেরকে কাফের বলা যাবে না, চাই মাজার পূজা ও পীর পূজার মাধ্যমে যত বড় শির্কের চর্চাই তারা করুক না কেন, যা বর্তমানে কোথাও কোথাও চর্চা করা হচ্ছে। কারণ এসব কর্মকাণ্ড কালেমা “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও একেবারেই বিপরীত। বস্তুত এ জাতীয় সন্দেহ তৈরী করা সেসব ভ্রষ্টলোকদেরই কাজ যারা কুরআন ও হাদীসের সেসব সংক্ষিপ্ত ভাষ্যসমূহ গ্রহণ করে থাকে যেগুলোকে তারা নিজেদের মতের সপক্ষে দলীল হিসেবে মনে করে, অন্যদিকে তারা সেসব সংক্ষিপ্ত ভাষ্যসমূহের বর্ণনাকারীভাষ্যসমূহকে পরিত্যাগ করে এবং বিশদ ব্যাখ্যাসম্বলিত ভাষ্যসমূহকেও উপেক্ষা করে। এদের অবস্থা হলো ঐ সমস্ত লোকদের মত যারা কোরআনের কিছু অংশে বিশ্বাস করে আর কিছু অংশের সাথে কুফরি করে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ مِنۡهُ ءَايَٰتٞ مُّحۡكَمَٰتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ وَأُخَرُ مُتَشَٰبِهَٰتٞۖ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمۡ زَيۡغٞ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَٰبَهَ مِنۡهُ ٱبۡتِغَآءَ ٱلۡفِتۡنَةِ وَٱبۡتِغَآءَ تَأۡوِيلِهِۦۖ وَمَا يَعۡلَمُ تَأۡوِيلَهُۥٓ إِلَّا ٱللَّهُۗ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِي ٱلۡعِلۡمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧ رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوبَنَا بَعۡدَ إِذۡ هَدَيۡتَنَا وَهَبۡ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَةًۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ٨ رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ ٱلنَّاسِ لِيَوۡمٖ لَّا رَيۡبَ فِيهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُخۡلِفُ ٱلۡمِيعَادَ ٩ ﴾ [ال عمران: ٧، ٩]
“তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন তাতে কিছু সংখ্যক আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলো কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো অস্পষ্ট। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে তারা ফিতনা বিস্তার ও অস্পষ্ট আয়াত গুলোর অপব্যাখ্যার অনুসরণ করে। মূলত সে গুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলেন, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না। হে আমাদের পালনকর্তা, তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার নিকট থেকে অনুগ্রহ দান কর তুমিই সব কিছুর দাতা, হে আমাদের পালনকর্তা তুমি একদিন মানব জাতিকে অবশ্যই একত্রিত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। (আলে ইমরান-৭-৯)
হে আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন; যাতে আমরা সত্যকে সত্য হিসাবে দেখি এবং তা গ্রহন করতে পারি। আর মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে দেখি এবং তা পরিহার করতে পারি।
6. কালেমা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর প্রভাব
সত্য এবং নিষ্ঠার সাথে এ মহান কালেমা পাঠ করলে এবং এর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য দাবী অনুযায়ী আমল করলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এ কালেমার এক বিশেষ সুফল প্রতিফলিত হবে। তন্মধ্যে নিম্নবর্তী বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য:
ক) এই কালেমা মুসলিমদের মধ্যে একতা সৃষ্টি করে আর এর ফলস্বরূপ তারা আল্লাহর বলে বলিয়ান হয়ে বিজয় সূচিত করতে পারে আল্লাহদ্রোহীদের উপর, কেননা তখন তারা একই দ্বীনের অনুসারি এবং একই আকিদায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ ﴾ [ال عمران: ١٠٣]
“আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর, আর তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (আলে ইমরান-১০৩)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٢ وَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡۚ لَوۡ أَنفَقۡتَ مَا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا مَّآ أَلَّفۡتَ بَيۡنَ قُلُوبِهِمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيۡنَهُمۡۚ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٦٣ ﴾ [الانفال: ٦٢، ٦٣]
“তিনিই তোমাকে শক্তি যুগিয়েছেন আপন সাহায্যে ও মুমিনদের দিয়ে। আর তিনি প্রীতি সঞ্চার করেছেন তাদের অন্তরে। জমিনের সকল সম্পদ ব্যায় করলে ও তুমি তাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মনে পারস্পরিক প্রীতি সঞ্চার করেছেন, নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়’’। (আল-আনফাল-৬২-৬৩)
ইসলামী আকীদায় যদি অনৈক্য সৃষ্টি হয় তাহলে তা থেকে পরস্পরের মধ্যে বিভক্তি এবং ঝগড়া কলহের জন্ম নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍۚ ﴾ [الانعام: ١٥٩]
“নিশ্চয়ই যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড বিখন্ড করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।” (আল আন‘আম-১৫৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿فَتَقَطَّعُوٓاْ أَمۡرَهُم بَيۡنَهُمۡ زُبُرٗاۖ كُلُّ حِزۡبِۢ بِمَا لَدَيۡهِمۡ فَرِحُونَ ٥٣﴾ [المؤمنون: ٥٣]
“অতঃপর তারা তাদের কাজকে বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত।” (আল মুমিনূন -৫৩)
অতএব মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে তাওহীদ ও ঈমানি আকীদার বন্ধনে একত্রিত হওয়া। আর এটাই لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর একমাত্র অর্থ। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে আরবদের অবস্থা এবং তাদের পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করলেই একথা সুস্পষ্ট বুঝা যাবে।
খ) لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এই কালেমার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজের মধ্যে ফিরে আসে শান্তি আর নিরাপত্তার গ্যার্যান্টি; কেননা এ ধরনের ঈমানের ফলে ঐ সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা গ্রহণ করে আর যা হারাম করেছেন তাকে পরিহার করে, সকল মানুষ ফিরে আসে সীমালংঘন অত্যাচার ও শত্রুতার পথ থেকে এবং একে অপরের প্রতি বাড়িয়ে দেয় সহানুভূতি, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের হাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ ﴾ [الحجرات: ١٠]
“নিশ্চয় মুমিনরা একে অপরের ভাই’’। [সূরা আল-হুজুরাত:১০]
আর এই বাণীর অনুসরণে একে অপরকে জড়িয়ে নেয় প্রীতি আর ভালবাসার জালে। এর বাস্তব নিদর্শন হলো আরবদের অবস্থা। তারা এ কালেমার ছায়াতলে একত্রিত হওয়ার পূর্বে একে অপরের চরম দুশমন ছিল। হত্যা, লুন্ঠন আর রাহাজানির জন্য তারা গর্ববোধ করত। আর যখন তারা لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর ঝাণ্ডাতলে একত্রিত হলো তখন গড়ে উঠল তাদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সীসাঢালা প্রাচীর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡ﴾ [الفتح: ٢٩]
“মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর তাঁর সাথীরা কাফেরদের উপর কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহনুভূতিশীল।” (আল-ফাতহ:২৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ إِذۡ كُنتُمۡ أَعۡدَآءٗ فَأَلَّفَ بَيۡنَ قُلُوبِكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم بِنِعۡمَتِهِۦٓ إِخۡوَٰنٗا ﴾ [ال عمران: ١٠٣]
“আর তোমরা সে নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ”। (আলে ইমরান: ১০৩)
গ) এ কালেমার বন্ধনে একত্রিত হয়ে মুসলিমগণ লাভ করবে খেলাফতের দায়িত্ব এবং নেতৃত্বদান করবে এ পৃথিবীর, আর তারা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মোকাবিলা করবে সকল ষড়যন্ত্র ও বিভিন্ন মতবাদের। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَيَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ كَمَا ٱسۡتَخۡلَفَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمۡ دِينَهُمُ ٱلَّذِي ٱرۡتَضَىٰ لَهُمۡ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ أَمۡنٗاۚ يَعۡبُدُونَنِي لَا يُشۡرِكُونَ بِي شَيۡٔٗاۚ﴾ [النور: ٥٥]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে; যে দ্বীনকে তিনি পছন্দ করেছেন তাদের জন্য এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করে এবং আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না।” (আন্ নূর-৫৫)
এখানে এই মহান সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার শর্তারোপ করেছেন আর এটাই হলো ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর দাবী ও অর্থ।
ঘ) যে ব্যক্তি ‘‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’’ এর স্বীকৃতি দান করবে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করবে তার হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পাবে এক অনাবিল প্রশান্তি। কেননা সে এক প্রতিপালকের ইবাদাত করে এবং তিনি কি চান এবং কিসে তিনি রাজি হবেন সে অনুপাতে কাজ করে এবং যে কাজে তিনি নারাজ হবেন তা থেকে বিরত থাকে। আর যে ব্যক্তি বহু দেব-দেবীর পূজা করে তার হৃদয়ে এমন প্রশান্তি আসতে পারে না, কারণ ঐ সমস্ত উপাস্যদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হবে ভিন্ন ভিন্ন এবং প্রত্যেকে চাইবে তাকে ভিন্ন ভাবে পরিচালনা করার জন্য। আল্লাহ বলেন,
﴿ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ ٣٩ ﴾ [يوسف: ٣٩]
“পৃথক পৃথক অনেক রব কি ভালো নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ?! (ইউসুফ-৩৯) আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا رَّجُلٗا فِيهِ شُرَكَآءُ مُتَشَٰكِسُونَ وَرَجُلٗا سَلَمٗا لِّرَجُلٍ هَلۡ يَسۡتَوِيَانِ مَثَلًاۚ ﴾ [الزمر: ٢٩]
“আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, কোনো একজন লোকের উপর পরস্পর বিরোধী কয়েকজন মালিক রয়েছে আরেক ব্যক্তির প্রভু মাত্র একজন, তাদের উভয়ের উদাহরণ কি সমান? (আয্ যুমার-২৯)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, এখানে আল্লাহ একজন মুশরিক ও একজন একত্ববাদে বিশ্বাসী ব্যক্তির অবস্থা বুঝাবার জন্য এ উদাহরণ দিয়েছেন। একজন মুশরিকের অবস্থা হচ্ছে এমন একজন দাস বা চাকরের মত যার উপর কর্তৃত্ব রয়েছে একত্রে কয়েকজন মালিকের। আর ঐ সমস্ত মালিকরা হচ্ছে পরস্পর বিরোধী, তাদের সম্পর্ক হচ্ছে দা-কুমড়ার সম্পর্ক, একজন অপর জনের চির শত্রু। আর আয়াতে বর্ণিত (মোতাশাকেছ) এর অর্থ হলো, ‘‘যে ব্যক্তির চরিত্র অত্যন্ত খারাপ’’ আর মুশরিক যেহেতু বিভিন্ন উপাস্যের পূজা করে সেহেতু তার উপমা দেওয়া হয়েছে ঐ দাস বা চাকরের সাথে যার মালিক হচ্ছে একত্রে কয়েকজন ব্যক্তি, যাদের প্রত্যেকেই তার খেদমত পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে এসব মালিকদের সবার সন্তুষ্টি অর্জন করা অসম্ভব। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করে তার উদাহরণ হচ্ছে ঐ চাকরের মত যে শুধুমাত্র একজন মালিকের অধীনস্ত সে তার মালিকের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত থাকে এবং তার মনোতুষ্টির পথ সে জানে। তাই এ চাকরের জন্য বহু মালিকের অত্যাচার ও নিপীড়নের ভয় থাকে না। শুধু তাই নয় নিজের মনিবের প্রীতি, ভালোবাসা, দয়া ও করুণা নিয়ে অত্যন্ত নিরাপদে সে তার নিকট বসবাস করে। এখন প্রশ্ন হলো এ দু’জন চাকরের অবস্থা কি এক?[24]!
ঙ) এ ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার অনুসারীরা দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও সুমহান মর্যাদা লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿حُنَفَآءَ لِلَّهِ غَيۡرَ مُشۡرِكِينَ بِهِۦۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَتَخۡطَفُهُ ٱلطَّيۡرُ أَوۡ تَهۡوِي بِهِ ٱلرِّيحُ فِي مَكَانٖ سَحِيقٖ ٣١ ﴾ [الحج: ٣١]
“যে আল্লাহর দিকে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর সাথে শরীক না করে এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল”। (আল হাজ্জ-৩১) এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, তাওহীদ সুউচ্চে উঠা ও উন্নত শিখরে আরোহণ পক্ষান্তরে শির্ক হচ্ছে পতিত হওয়া, নীচে নামা ও অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (রহ.) বলেন, ঈমান এবং তাওহীদের সুমহান মর্যাদা, প্রশস্তি ও সম্মানের কারণে এর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সুমহান আকাশের সাথে, যার দ্বারা সে উর্ধ্বলোকে উঠে এবং অবতরণ স্থান, সে সেখান থেকে যমীনে অবতরণ করে এবং যমীন থেকে সেটার দিকেই আরোহণ করে। আর ঈমান ও তাওহীদ পরিত্যাগকারীর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে আকাশ থেকে যমীনের অতল গহ্বরে পড়ে যাওয়ার সাথে, যার ফলে তার হৃদয় মন হয়ে আসে ভীষণ সংকুচিত, আর সে অনুভব করে কষ্টের পর কষ্ট, আঘাতের পর আঘাত। আর যেখানে রয়েছে এমন পাখি যে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে ও ছিন্ন- ভিন্ন করে দিবে। ঐ পাখির উদাহরণ দিয়ে বুঝানো হয়েছে এমন শয়তানদের যারা তার সহযোগী হবে এবং তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য অস্থির ও বিব্রত করতে থাকবে। আর যে বাতাস তাকে দূরবর্তী সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করবে তা হলো তার মনের কামনা বাসনা, যা তাকে আকাশ থেকে মাটির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করতে প্রলুব্ধ করবে।[25]
চ) এ কালেমা তার জীবন সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা দান করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে জিহাদ করার জন্য যে পর্যন্ত না তারা বলবে, ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ আর যখন তারা এ স্বীকৃতি দান করবে তখন আমার নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করবে। তবে তার - ইসলামের - কোনো হক বা অধিকার লঙ্ঘন হলে-তা আর নিরাপদ থাকবে না”।
এখানে “তার হক বা অধিকার” বলতে বুঝানো হয়েছে, তারা যখন এ কালেমার স্বীকৃতি এবং দাবী অনুযায়ী কাজ করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখবে, অর্থাৎ তাওহীদের উপর অবিচল থাকবে না, ইবাদতকে শির্ক মুক্ত করবে না ও ইসলামের প্রধান প্রধান কাজগুলো আদায় করবে না, তখন ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’এর স্বীকৃতি তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দান করবে না বরং এজন্য তাদের জীবন নাশ করা হবে এবং তাদের সম্পদকে মুসলিমদের জন্য গনীমত হিসেবে গ্রহণ করা হবে, যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খলীফাগণ করেছেন।
এছাড়া ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ইবাদত, মু‘আমালাত (লেন-দেন) চরিত্র গঠন, আচার অনুষ্ঠান সবকিছুতেই এ কালেমার প্রভাব পড়বে।
পরিশেষে আল্লাহর তাওফীক কামনা করি। আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম পেশ করা হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামের উপর।
[21] অর্থাৎ সম্পদের হক আদায় করার জন্য হাদীসের মধ্যেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও সে কিন্তু নিরাপদ থাকে নি, কারণ সে কালেমার হক নষ্ট করেছে। সুতরাং যারাই ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ বলবে তারা যদি এ কালেমার অর্থ ও চাহিদা বিরোধী কাজ করে তাহলে তারা কোনোভাবেই নিরাপদ হবে না। [সম্পাদক]
[25] ইবনুল কাইয়্যেম, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘য়ীন, ১/১৮০।
_________________________________________________________________________________
সংকলন: শাইখ সালেহ ইবন ফাওযান আলে-ফাওযান
অনুবাদক: মুহাম্মদ মতিউল ইসলাম ইবন আলী আহমাদ
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
আরও পড়ুনঃ প্রশ্নোত্তরে সহজ তাওহীদ শিক্ষা
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ কিতাবুত্ তাওহীদের ব্যাখ্যা - ফ্রি ডাউনলোড
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন