মুসলিম নারী এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য (১ম পর্ব)
(শরী‘আত ও বাস্তবতার নিরীখে একটি সুদৃঢ় পর্যালোচনা)
بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি; তাঁর নিকট তাওবা করি; আর আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই; আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٠٢﴾ [ سورة آل عمران: 102 ]
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পনকারী না হয়ে কোন অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করো না।” - ( সূরা আলে ইমরান: ১০২ );
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١﴾ [ سورة النساء: 1 ]
“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন; আর যিনি তাদের দুইজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন; আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট নিজ নিজ হক দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন। - ( সূরা আন-নিসা: ১ );
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ يُصۡلِحۡ لَكُمۡ أَعۡمَٰلَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۗ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِيمًا ٧١ ﴾ [ سورة الأحزاب: 70 – 71 ]
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল; তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।” - ( সূরা আল-আহযাব: ৭০ – ৭১ )।
অতঃপর...
নারীকে সমাজের অর্ধেক বলা হয়ে থাকে; আর নারী তিনি তো মাতা, স্ত্রী, কন্যা, বোন, নিকটাত্মীয়া ...; আর তিনি তো লালনপালনকারিনী, শিক্ষিকা, শিশুদের পরিচর্যাকারিনী...। আর তিনি হলেন পুরুষদের জন্মদাত্রী, বীরপুরুষদের লালন-পালনকারিনী, মহিলাদের শিক্ষিকা ...। আবার তিনি হলেন নেতা, আলেম ও দা‘ঈ তথা আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের গড়ে তোলার অন্যতমা কারিগর।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাকে আদম আ. থেকে সৃষ্টি করেছেন; তিনি বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١﴾ [سورة النساء: 1 ]
“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন; আর যিনি তাদের দুইজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন; আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট নিজ নিজ হক দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন। - ( সূরা আন-নিসা: ১ )।
আর সেখান থেকেই ইসলামী চিন্তবিদগণ নারীদের ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন, যেভাবে আল-কুরআনুল কারীম সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছে; একজন মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা হিসেবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানসমূহ; সাথে সাথে বর্ণিত হয়েছে তার অধিকার এবং আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ।
পরবর্তী যুগে নারীদের অন্যান্য দিকের আলোচনার ব্যাপক আকারে প্রসার লাভ করে, এমনি একটি দিক হচ্ছে, তার আকিদা-বিশ্বাস ও নীতি-নৈতিকতা বর্জনের ব্যাপার; আমরা শুনি ও পড়ি নারীকে তার প্রতিপালকের নির্দেশ ও তার ধর্মীয় শিক্ষাসমূহ থেকে মুক্ত করার দিকে স্পষ্ট আহ্বান সম্বলিত বক্তব্যগুলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের মধ্য থেকে অনেকেই ঐসব বিষয়কে স্বাধীনতা, প্রগতি, পশ্চাৎপশরতা থেকে বিমুক্তি, প্রাচীন রসম রেওয়াজ ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পুরাতন জঞ্জাল, এ ধরনের বিভিন্ন ধুয়া তুলে আল্লাহর শরী‘আতকে প্রত্যাখ্যান করার মত দুঃসাহস দেখাতে আরম্ভ করে।
আর কোন সন্দেহ নেই যে, এটা এমন একটি ভয়াবহ সমস্যা, যা জ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের নিকট দাবি করে যে, তারা যেন এই বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দেন এবং তার কারণ ও প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন, যার মাধ্যমে তারা এ ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার বিধান সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবেন; নারীর অধিকারসমূহ এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ সুস্পষ্ট করবেন; তার (নারীর) ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির উপর যে অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণ পড়ে আছে, তা দূর করবেন; আল্লাহ নিঃস্বার্থভাবে তাকে যে বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য দান করেছেন, তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন এবং ইসলামের শত্রুগণ তাকে ও তার সমাজকে নিয়ে যে ষড়যন্ত্রের জাল বা আবরণ বিস্তার করেছে ও তার সাথে তারা ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যেসব সন্দেহ ও ত্রুটিপূর্ণ দর্শনকে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে, তা উম্মোচন করবেন। আর এই কাজটি তাদের জন্য বাধ্যতামূলক, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা, শিক্ষা ও দাওয়াতের দায়িত্ব প্রদান করেছেন।
আর এই সূত্র ধরেই এই কথাগুলো এসেছে, যাতে করে মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, বিশেষ করে তার জ্ঞানগত, সামাজিক, প্রশিক্ষণগত ও দাওয়াতী দায়িত্বের সংক্ষিপ্ত বিবরণের একটি রূপরেখা পেশ করা যায়। সুতরাং এ কথাগুলো হে মুসলিম নারী তোমার প্রতি, যে তার ধর্মীয় বিষয় এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের ব্যাপারে সচেতন; আর সে নারীর প্রতি, যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার পথ উন্মুক্ত করল; সে দায়িত্ববান মায়ের প্রতি, যিনি জাতি বা প্রজন্মের শিক্ষক ও পুরুষজাতি গঠনের কারিগর; সে মমতাময়ী স্ত্রীর প্রতি! যে তার স্বামীর পাশে তাকে কল্যাণের পথে উৎসাহদানকারিনী, তার চলার পথে সাহায্যকারিনী এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার দায়িত্ব বহনকারিনীর ভূমিকায় অবস্থানকারী; সে দা‘ঈ বা আল্লাহর পথে আহ্বানকারিনীর প্রতি! যে নিজেকে এমন মহান পথের প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে, যে পথ জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেয়; সে নারীর প্রতি যে এসব গুণাবলীর দ্বারা গুণান্বিতা; আমি এই গুণবাচক কথাগুলো বিশেষভাবে তোমাকে উদ্দেশ্য করে লিখছি; আশা করা যায় যে, তা পথ আলোকিত করবে, রাস্তা খোলাসা করবে, অন্ধকার দূর করবে, জ্ঞানকে বর্ধিত করবে, পরস্পরকে শক্তিশালী করবে এবং শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতী কার্যক্রমের পথে কল্যাণকর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
হে অভিভাবক! আপনাকে অনুরোধ করছি, যাতে আপনি দৃষ্টি দিতে পারেন আপনার স্ত্রী, বোন ও কন্যার দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি, যাতে আপনি তাকে এর জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারেন, অতঃপর তার পৃষ্ঠপোষকতা করবেন এবং তার হাত ধরে এ কাজে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
অতঃপর আমি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছি সেগুলোর দিকেই অগ্রসর হচ্ছি, আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করছি, তিনি যেন এর মাধ্যমে উপকৃত করেন এবং এগুলোকে জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য সঞ্চিত সম্পদে পরিণত করেন; তিনি সবকিছুর শ্রবণকারী এবং আবেদন ও নিবেদনে সাড়াদানকারী।
و صلى الله و سلم و بارك على عبده و رسوله محمد و آله و صحبه أجمعين.
(আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর প্রতি রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন)।
লেখক:
ফালেহ ইবন মুহাম্মদ আস-সুগাইর
অধ্যাপক, ইমাম মুহাম্মদ ইবন সা‘উদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ
পোঃ বক্স: ৪১৯৬১, রিয়াদ, ১১৫৩১।
ই-মেইল: falehmalsgair@yahoo.com
নারী এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা কেন?
প্রথমত: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাকে পুরুষের স্বভাব-প্রকৃতি থেকে ভিন্ন বিশেষ স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন; আর সে থেকেই তিনি তাকে এমন কতগুলো বিধিবিধানের সাথে বিশেষিত করেছেন, যেগুলো ঐ বিশেষ স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ হায়েয (ঋতুস্রাব), নিফাস, উভয় অবস্থা থেকে পবিত্রতা অর্জন, দুধ পান করানো এবং সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা), হজ প্রভৃতি ধরনের ইবাদতের কিছু কিছু বিধানের সাথে যা সংশ্লিষ্ট। সুতরাং পুরুষ ও নারী গবেষকদের উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, তারা এ বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট করে তাদের আলোচনা নির্দিষ্ট করবেন।
দ্বিতীয়ত: একজন নারীর উপর কিছু আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও মহান আমানত রয়েছে, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার উপর ন্যস্ত করেছেন। সে সাধারণভাবে আকিদা-বিশ্বাস, পবিত্রতা অর্জন, সালাত (নামায), সিয়াম (রোযা) প্রভৃতির মত শরী‘আতের সকল বিধিবিধানের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর তার জন্য আরও কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে, একাধারে সে লালন-পালনকারিনী, মাতা ও স্ত্রী হওয়ার কারণে তাকে সেগুলোর সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত করা হয়েছে; সুতরাং প্রত্যেক অবস্থায় তার উপর আবশ্যক হল সে ঐ নিয়ম-কানুনসমূহ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। অতএব তাকে নিয়ে মোটামুটিভাবে ও বিস্তারিতভাবে আলোচনা হওয়া আবশ্যক; আরও আবশ্যক সুস্পষ্টভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা, যাতে মুসলিম নারী তার মধ্য দিয়ে ঐসব দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পারে।
তৃতীয়ত: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যব্যাপী ইসলামের শত্রুগণের পক্ষ থেকে বিগত যুগে মুসলিম নারীরা ঐ নগ্ন হামলার শিকার হয়েছে এবং মুসলিম সন্তানদের কেউ কেউ সেই প্রয়াসকে গলধঃকরণ করেছে; ফলে তারা ঐ কলমসমূহ যা লিখেছে, তা-ই আওড়াতে থাকে এবং ঐ আওয়াজসমূহের প্রতিধ্বনি-ই করতে থাকে, যাতে নারী তার আপন গৃহ থেকে বেরিয়ে যায়, সে পুরুষের সাথে অবাধে মেলামেশা করতে পারে এবং তাকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে এবং তার শিশু সন্তানদের যত্ন নেয়ার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ঐ আওয়াজসমূহ মুসলিম নারীকে নিয়ে চিৎকার করে বলে: “তুমি যে অবস্থানে রয়েছো, তা ভেঙ্গে চুরমার করে দাও; তোমার চতুর্পাশে বিস্তৃত পর্দাসমূহ ছিঁড়ে ফেল; আমাদের দিকে বের হয়ে আস, যাতে তুমি আলো দেখতে পাও, যে আলো থেকে তুমি আড়ালে ছিলে যুগ যুগ ধরে; পুরুষের কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীনতা অর্জন কর; মর্যাদার শর্তসমূহ থেকে মুক্তি লাভ কর; তোমার পর্দা খুলে ফেলে দিয়ে বের হয়ে আস; ঘর থেকে বের হয়ে আসার মাধ্যমে তোমার অস্তিত্ব ও কণ্ঠস্বরের প্রমাণ দাও; জীবনের প্রতিটি লোভনীয় বস্তু থেকে তোমার অংশটুকু গ্রহণ করার মাধ্যমে তুমি নিজেকে উপভোগ কর; তোমার স্বাধীন রুচি ব্যতীত অন্য কিছু যাতে তোমাকে শাসন না করে এবং বই পুস্তকের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় তোমার যাদুকরী কোমলতা ছাপিয়ে, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা ও রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুমি ব্যবসা চালিয়ে যাও!”
আরব তরুনী! তুমি কি দারিদ্রতা চাও, অথচ সৌন্দর্য একটি বড় গচ্ছিত সম্পদ
তুমি কি পবিত্রতা চাও, অথচ এ যুগ হচ্ছে উপভোগের যুগ!
আগে অবশ্য মান-মর্যাদা রক্ষার যুগ ছিল, এখন সেটা তো শেষ হয়ে গেছে,
এ যুগ তো নতুন অনেক কিছু করেছে, সুতরাং তুমি চমৎকার কিছু কর![1]
এই নগ্ন হামলা এর বিরুদ্ধে দাবি করে জোটবদ্ধ পরিশ্রম বা চেষ্টা-সাধনা, যাতে মুসলিম নারী তার বিরুদ্ধে প্রণীত পরিকল্পনাকে পরিপূর্ণ মনোযোগের সাথে বুঝতে পারে; অতঃপর সে পর্যবেক্ষণ করবে এবং তার পথ সে সচেতন দৃষ্টিতে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
চতুর্থত: আর তা তৃতীয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট; উপরোল্লেখিত নগ্ন হামলার সাথে সাথে নারী বিষয় নিয়ে অনেক ফেতনা-ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলার উদ্ভব সাধন করা হয়েছে। যেগুলো ইসলামী শরী‘আতের ব্যাপারে সচেতন মুসলিম নারীদের কারও কারও মধ্যেও দেখা যায়। বস্তুত এ ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে এমন কিছু লোক হাঁকডাক দিচ্ছে, যারা চায় নিজেকে প্রকাশ করতে; আরও চায় তার জন্য এমন একটি রায় বা মত হবে, যা তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে। অবশেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নারীর অনেক ব্যাপার নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে দু’ভাগে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর বিষয়টি শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ফলে আমরা দৈনিক সংবাদপত্রগুলো এবং ম্যাগাজিনসমূহে বিখ্যাত ও অখ্যাত ব্যক্তিবর্গের হাতে লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ অধ্যয়ন করি— কারণ, তারা দাবি করে যে, শরী‘আত কারও একান্ত বিষয় নয়, সবাই এতে মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে।[2]
তারা চিকিৎসা, প্রকৌশল ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কোন কথা বলতে রাজি নয়; কারণ, তারা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয়; কিন্তু তারা মূর্খতা ও অজ্ঞতা সত্ত্বেও আল্লাহর শরী‘আতের মধ্যে নাক গলানোটাকে গ্রহণ করেছে; আল্লাহ তুমি পবিত্র! এটা কত বড় অপবাদ!!
এটা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের উপর গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় যে, সত্য বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও গবেষণা চালিয়ে যাবেন, যতটুকু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে বর্ণনা, দলিল-প্রমাণ ও জ্ঞানবুদ্ধির শক্তি থেকে দান করেছেন।
পঞ্চমত: মুসলিম নারী পরবর্তী যুগসমূহে কাফির ও মুনাফিকদের মধ্য থেকে প্রত্যেক হাঁকডাককারী ও হাঁকডাককারিনীর বাহন ও ফটক হিসেবে গৃহীত হয়েছে, যাতে তারা এই দীনের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে; কারণ, তারা জানে যে, নারী যখন তার ঘর থেকে বের হয়ে যাবে, তার শিশুসন্তানদেরকে মুরব্বী ও কাজের মহিলার নিকট রেখে যাবে, পুরুষদের ময়দানসমূহে অনুপ্রবেশ করবে ও তাদের সাথে মেলামেশা করবে, তাদের কাপড় পরিধান করবে, তার চেহারা ও শরীরের কোন কোন অংশ উন্মোচিত করবে, শিল্পকারখানার ধোঁয়ায় নিজেকে কলুষিত করবে এবং খরিদ্দার ও পর্যবেক্ষকদের জন্য তার দেহের বাহ্যিক দিকটিকে সুসজ্জিত করবে, আর এভাবে সে পুরুষের সাথে তার কর্মক্ষত্রে প্রতিযোগিতা করবে এবং তার প্রকৃত ময়দানকে সে উপেক্ষা করবে; তখনই সে বিকৃতির প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করবে এবং সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবে; আর এভাবেই তারা নারীকে নষ্ট-ভ্রষ্ট করে দিবে এবং শিশু ও তার লালন-পালন ও আদব-কায়দার প্রশিক্ষণের ব্যাপারে অবহেলা করবে; আর তার পুরুষের অধিকারের দিকে মনোযোগ দিবে না; আর তা থেকেই পুরো সমাজে বিশৃঙ্খলা পুনঃপ্রবর্তিত হবে।
আমি এখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না, কিন্তা এটা বিজ্ঞজনদের উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করে দেয়; কেননা প্রয়োজনের সময় থেকে আলোচনা বিলম্বিত করা বৈধ নয়।
ষষ্ঠত: দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন দিকে নারীর উদারতার বিষয়ে যা লক্ষ্য করা যায়, সেটি মোটেই সহজ ব্যাপার নয়, চাই তার আচার-আচরণগত দিক হউক, অথবা তার কাজকর্মের দিক হউক, অথবা পুরুষদের সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে বা তাদের সাথে নির্জনে সময় কাটানোর ব্যাপারে হউক, অথবা তাদের সাথে কোনো প্রকার বাধ্য-বাধকতা ছাড়া অবাধ কথা-বার্তা বলার ব্যাপারে হউক, অথবা তার সাজসজ্জা, পোষাক-পরিচ্ছদ, পর্দা ও শরী‘আতের সীমা থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনের ব্যাপারে হউক, অনুরূপভাবে তার নিজ গৃহে তার কাজকর্ম ও ঘর থেকে বেশি বেশি বাইরে গমন করা এবং প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য থেকে আগত বিভিন্ন ফ্যাশান ও শ্লোগানে প্রভাবিত হওয়ার ক্ষেত্র্রে নমনীয়তার ব্যাপারে হউক; আমি বলব: এই উদারতা ও শৈথিল্য থেকে যা দেখা যাচ্ছে, তা অত্যন্ত যত্নসহকারে দাবি করে মুসলিম নারী বিপর্যয়ে পতিত হওয়ার পূর্বেই তাকে উদ্দেশ্য করে আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করা, যেমনিভাবে অনেক দেশে বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে তার বোন ও মুসলিম নারীসমাজ; সুতরাং সে এমন হয়ে গেছে যে, আপনি আকার-আকৃতি ও বেশভূশায় তার মাঝে ও কাফির নারীর মাঝে কোন পার্থক্য করতে পারবেন না।
সপ্তমত: আজকের মুসলিম নারীর সাথে কয়েকটি প্রবণতার দ্বন্দ্ব চলছে, এগুলোকে মোটামুটি নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ করা যায়:
- প্রাচীন সামাজিক প্রবণতা: নির্দিষ্ট প্রকৃতির লোক এবং প্রত্যেক প্রাচীন বিশ্বাস আঁকড়ে ধরার প্রতি আহ্বানকারী ব্যক্তি; এগুলোর মধ্যে কোনটি শরী‘আত স্বীকৃত আর কোনটি শরী‘আত স্বীকৃত নয়, সে দিকে কোন প্রকার দৃষ্টি দেয়া ছাড়াই শুধুমাত্র প্রথার অনুসরণ ও অনুকরণের মাঝে সীমাবদ্ধ।
- প্রত্যাখ্যানকারী প্রবণতা: আর তা এমন এক প্রবণতা, যা প্রতিটি প্রচীন বিষয়কেই প্রত্যাখ্যান করে; আর নারীকে অতীতের আড়াল ও শরী‘আতের শিক্ষাসমূহ থেকে বের হয়ে আসার জন্য আহ্বান করে এবং তাকে ছোট হউক, বা বড় হউক, আকৃতিগত হউক, বা বিষয়বস্তুগত হউক প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাফির নারীর অনুসরণের জন্য ডাকে।
- মাঝামাঝি প্রবণতা: আর তা এমন এক প্রবণতা, যার প্রতি জাতির চিন্তাবিদগণ ও শরী‘আতের অনুসারী ব্যক্তিবর্গ আহ্বান করে এবং বলে: “হে নারী! তুমি বিবেক দিয়ে অনুধাবন কর। কেননা, তুমি মুসলিম নারী, তুমি জান যে, তোমার প্রতিপালকের নির্দেশ গ্রহণ করার মধ্যেই তোমার কল্যাণ; আর তিনিই সে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানেন, যা তোমাকে উপকৃত করবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য অনেক নির্দেশনা অবতীর্ণ করেছেন, তুমি সেগুলো গ্রহণ কর, কারণ তাতে তোমার মুক্তি নিহিত রয়েছে। আর এমন প্রত্যেকটি বিষয়, যেদিকে তারা তোমাকে পরিচালিত করে, চাই তা প্রাচীন প্রথা হউক, অথবা আধুনিক ষড়যন্ত্র হউক, তোমার উচিত হল, তুমি এগুলোকে এই পরিমাপক দ্বারা ওজন করে নেবে, অতঃপর তুমি গ্রহণ করবে অথবা প্রত্যাখ্যান করবে।”[3]
মুসলিম সমাজে অনেক নারী সে যে সমাজে বসবাস করে, সেই সমাজের প্রবাহের শক্তি বিবেচনায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে এবং নারীগণ এসব আওয়াজের ধাক্কাধাক্কির ফলে অনেক দলে পৃথক হয়ে গিয়েছে। ফলে মুসলিম নারীর সামনে বহু পথের উদ্ভব হলো, প্রত্যেকেই নারীর স্বার্থ ও কল্যাণ চিন্তা করার কথা বলে, তার অধিকার দাবি করে এবং তাকে নিয়ে কান্নাকাটি করে ও কান্নার ভান করে। তাই অনেক নারীর নিকটই মিথ্যার সাথে সত্যের মিশ্রণ হয়ে গেছে এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
একদিকে কারও উপর কাফির ও ফাসিকদেরর আওয়াজ ও চেঁচামেচি প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এই গোষ্ঠীর কলমের লেখালেখিতে প্রতারিত হয়ে ভ্রষ্ট এই ধারায় চলে গেছে। ফলে সে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন করে পর্দা খুলে ফেলেছে, পুরুষদের সাথে মেলা-মেশায় গিয়েছে এবং শিল্পকলা, অভিনয়, গান ও নৃত্যের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আরেকদিকে কেউ কেউ আছে এক পা এগুলে দু‘পা পেছায়; সে দ্বিধাগ্রস্ত— একবার সে বস্তুবাদী চিন্তা করে, আরেকবার সে তার স্বভাবধর্ম ও স্রষ্টার শিক্ষাসমূহের দিকে ফিরে আসে।
অন্যদিকে আছেন রক্ষণশীল বুদ্ধিমান নারী, যিনি তার প্রতিপালকের শিক্ষা ও দর্শনসমূহ সংরক্ষণ করেন এবং ঈমান ও তুষ্টতা সহকারে সেই শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করেন। তিনি এই দীনকে শক্তভাবে বহন ও আঁকড়ে ধরেছেন এবং বিজাতীয় বিনষ্ট বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর তিনি তার প্রতিপালকের দিকে অন্যদেরকে মাথা উঁচু করে দৃঢ়তার সাথে আহ্বান করেন এবং তার ব্যক্তিত্ব, পর্দা ও পবিত্রতা রক্ষা করে চলেন। তার স্বামীর অধিকার বাস্তবায়নকারিনী হিসেবে এবং তার শিশুসন্তানদের লালনপালনকারিনী হিসেবে এই জীবনে তিনি তার প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন।
এই প্রতিটি অবস্থাই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে অন্ধকার দূর করার জন্য, যা মুসলিম নারীর বিষয়ে এই যুগ বা সময়কে প্রভাবিত করেছে; যাতে করে প্রত্যেক সত্যানুসন্ধানী মুক্তিকামী পুরুষ অথবা নারীর জন্য পথ স্পষ্ট হয় এবং তার মাইলফলকগুলো পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়ে উঠে।
অষ্টমত: মুসলিম সমাজ তথা মুসলিম জাতির পরিপূর্ণতার জন্য এমন রক্ষণশীল আদর্শ নারীর প্রয়োজন, যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানে এবং তার উপর অর্পিত আমানতকে অনুধাবন করে; যে নিজের পথ দেখতে পায় এবং তার নিজের অধিকার ও অন্যের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।
- আমাদের প্রয়োজন এমন মুসলিম মুমিন নারীর, যার রয়েছে তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস; সুতরাং তিনি তাঁকে প্রতিপালক, স্রষ্টা ও মাবুদ বা উপাস্য বলে বিশ্বাস করেন; আরও বিশ্বাস করেন তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমষ্টি ও রাসূলগণের প্রতি; আর পরকালের প্রতি এবং তাকদীরের ভাল ও মন্দের প্রতি। অতঃপর এই ঈমান অনুযায়ী তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন তার এই জীবনের চিন্তাভাবনাগুলোকে; জগত, জীবন ও মানুষ সম্পর্কে।
- আমাদের প্রয়োজন এমন সচেতন নারীর, যিনি তার প্রতিপালকের শরী‘আত তথা বিধিবিধানকে সংরক্ষণ করেন, অনুধাবন করেন তাঁর আদেশসমূহকে; অতঃপর সে অনুযায়ী কাজ করেন। আর অনুধাবন করেন তাঁর নিষেধসমূহকে, অতঃপর সেগুলো থেকে দূরে থাকেন। তার নিজের অধিকার এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক জানেন, অতঃপর এর মাধ্যমে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
- আর আমাদের প্রয়োজন এমন সচেতন নারীর, যিনি তার প্রকৃত দায়িত্বের বিষয়গুলো এবং তার গৃহরাজ্যের বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন; অতঃপর এই ছোট্ট রাজ্যের অধিকার সংরক্ষণ করেন, যে রাজ্য পুরুষদের প্রস্তুত করে এবং শিশু-কিশোরদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসায় ও তাঁর দীনের সেবায় গঠন করে তোলে।
- আর আমাদের প্রয়োজন এমন নারীর, যার বাহ্যিক দিক তার অভ্যন্তর সম্পর্কে বলে দেয়। কারণ, তিনি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের দ্বারা প্রভাবিত নন, প্রভাবিত নন কোনো প্রবণতা বা ফ্যাশন দ্বারা; যিনি প্রত্যেক ধ্বনি বা চীৎকারের অনুসরণ করেন না। তিনি তার বাহ্যিক ক্ষেত্রে মডেল বা আদর্শ, যেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ দিকেও আদর্শ। তার শরীর সংরক্ষিত; আর তার হৃদয় ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ এবং তার পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার দিকটি সুস্পষ্ট; আর তার পোষাক-পরিচ্ছদ ও অন্তরের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় অবস্থাই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র। তিনি ঈমান এনেছেন, শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং আমল করেছেন।
- আর আমাদের প্রয়োজন এমন আদর্শ আল্লাহ্র পথে আহ্বানকারী নারীর, যিনি তার কথার পূর্বে কাজের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান করেন; তিনি মানুষের জন্য ভাল ও কল্যাণকে পছন্দ করেন, যেমনিভাবে তা তিনি নিজের জন্য পছন্দ করেন; তিনি একে উপদেশ দেন, ওকে নির্দেশনা প্রদান করেন আর আরেকজনের অন্যায় কাজের সমালোচনা করেন; তিনি লালন-পালন করেন, গঠন করেন, ভুলত্রুটি সংশোধন করেন, সমস্যা সমাধান করেন, তার সম্পদ দ্বারা দান-সাদকা করেন, তার সাধ্যানুসারে কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন, দাওয়াতী কাজ নিয়েই তিনি জীবনযাপন করেন, কি দাঁড়ানো অবস্থায়, কি তার বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায়, কি তার কাজের মধ্যে— এক কথায় যে কোন স্থানে, যে অবস্থায়ই থাকেন।
- আর আমাদের প্রয়োজন এমন নারীর, যিনি তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন থাকেন, অতঃপর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের আনুগত হওয়া থেকে, তাদের আহ্বানসমূহে সাড়া দেওয়া থেকে এবং তাদের জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ থেকে সতর্ক থাকেন। তিনি সদা-সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং ঐসব ভ্রান্ত প্রচার-প্রপাগান্ডা থেকে সতর্ক করেন, যেগুলো নারীকে তাদের প্রপাগান্ডার বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে— যার বিবরণ পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
এই প্রয়োজনীয়তাই বিজ্ঞজন ও বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ও লেখনীর মাধ্যমে তাদের চেষ্টা-সাধনা শুরু করতে বাধ্য করে। যাতে তারা মুসলিম নারী ও তার অভিভাবকের দৃষ্টি খুলে দেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন তার কাঁধের উপর অর্পিত আমানতের কথা।
নবমত: পুরুষের উপর প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। তিনি যদি মা হন, তবে তার জন্য নির্দেশ দেয়া ও নিষেধ করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তার (পুরুষের) উপর আবশ্যক হল তার আনুগত্য করা এবং সৎকাজের ব্যাপারে করা তার আদেশসমূহের বাস্তবায়ন করা।
আর সে যদি স্ত্রী হয়, তবে তার অধিকার আছে স্বামীকে আল্লাহ্র আনুগত্যের ব্যাপার উৎসাহিত ও প্রলুব্ধ করার এবং অন্যায় ও অবাধ্যতার ব্যাপারে সতর্ক করার। আর স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রীর ভূমিকাকে গণ্ডমূর্খ ছাড়া অন্য কেউ অস্বীকার করে না। আর অনুরূপভাবে তার প্রভাব বিদ্যমান যদি সে বোন, কন্যা বা নিকটাত্মীয়ও হয়।
আর এই জন্য নারীর উপর আবশ্যক হল, সে এই মহান ভূমিকা অনুধাবন করবে, যাতে তার দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করতে পারে।
দশমত: একজন নারী একজন পুরুষের চেয়ে নারী, নারীসমাজ ও নারীদের মাঝে প্রচলিত প্রবণতা সম্পর্কে বেশি ওয়াকিফহাল। তেমনিভাবে সে তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাব বিস্তারকারী বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি অবগত। সে-ই পুরুষের চেয়ে ক্ষমতাবান এই পথে চলতে।
পটভূমি হিসেবে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিই নারী প্রসঙ্গে এবং নারীর দায়িত্ব, অধিকার, জবাবদিহিতা ও এই সামগ্রিক সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে; যার মাধ্যমে একজন নারী তার ভূমিকা সুন্দরভাবে পালন এবং তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে আদায় করতে পারে।
০ ০ ০
নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এগুলোর প্রকৃতি ও আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের সঠিক দীনের সর্বজনস্বীকৃত ও নিশ্চিত বিধান হচ্ছে: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّا عَرَضۡنَا ٱلۡأَمَانَةَ عَلَى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱلۡجِبَالِ فَأَبَيۡنَ أَن يَحۡمِلۡنَهَا وأَشۡفَقۡنَ مِنۡهَا وَحَمَلَهَا ٱلۡإِنسَٰنُۖ إِنَّهُۥ كَانَ ظَلُومٗا جَهُولٗا ٧٢ ﴾ [ سورة الأحزاب: 72 ]
“আমি তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল। সে তো অতিশয় যালিম, অতিশয় অজ্ঞ।” - ( সূরা আল-আহযাব: ৭২ )।
ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, সা‘ঈদ ইবন জুবায়ের রা. প্রমুখ বলেন: আমানত হল ফরযসমূহ।
আর কাতাদা র. বলেন: আমানত হল দীন, ফরযসমূহ এবং শরী‘আতের সীমারেখা বা দণ্ডবিধিসমূহ।
আর উবাই ইবন কা‘ব রা. বলেন: আমানতের মধ্যে অন্যতম হল নারীকে তার লজ্জাস্থানের ব্যাপারে আমানত রাখা হয়েছে।
আর ইবনু কাছীর র. বলেন: এসব কথার মধ্যে কেনো বিরোধ নেই। বরং এগুলো একই কথা প্রমাণ করছে যে, সেই আমানতটি হচ্ছে তাকলীফ তথা (শরী‘আতের বিধিবিধানের) দায়িত্ব-প্রদান।[4]
আর এই কথাও সর্বস্বীকৃত যে, মুসলিম নারী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করলে সেও পুরুষের মতই প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘আলা কর্মসমূহের প্রতিদানের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
فَٱسۡتَجَابَ لَهُمۡ رَبُّهُمۡ أَنِّي لَآ أُضِيعُ عَمَلَ عَٰمِلٖ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰۖ بَعۡضُكُم مِّنۢ بَعۡضٖۖ فَٱلَّذِينَ هَاجَرُواْ وَأُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأُوذُواْ فِي سَبِيلِي وَقَٰتَلُواْ وَقُتِلُواْ لَأُكَفِّرَنَّ عَنۡهُمۡ سَئَِّاتِهِمۡ وَلَأُدۡخِلَنَّهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ثَوَابٗا مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلثَّوَابِ ١٩٥ ﴾ [ سورة آل عمران: 195 ]
“অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ। সুতরাং যারা হিজরত করেছে, নিজ গৃহ থেকে উৎখাত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি তাদের পাপ কাজগুলো অবশ্যই দূরীভূত করব এবং অবশ্যই তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার; আর উত্তম পুরস্কার আল্লাহরই নিকট। - ( সূরা আলে ইমরান: ১৯৫ )। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤﴾ [سورة النساء: 124 ]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” - ( সূরা আন-নিসা: ১২৪ )।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧ ﴾ [ سورة النحل: 97]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। (সূরা আন-নাহল: ৯৭)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ مَنۡ عَمِلَ سَيِّئَةٗ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَاۖ وَمَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ يُرۡزَقُونَ فِيهَا بِغَيۡرِ حِسَابٖ ٤٠﴾ [ سورة غافر: 40 ]
“কেউ মন্দ কর্ম করলে সে কেবল তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে এবং পুরুষ কিংবা নারীর মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎকাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেথায় তাদেরকে দেয়া হবে অপরিমিত জীবনোপকরণ। - ( সূরা গাফের: ৪০ )।
সুতরাং দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।
আর এই বাস্তবতাটিও আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর মধ্যেও বিদ্যমান; তিনি বলেন:
إِنَّ ٱلۡمُسۡلِمِينَ وَٱلۡمُسۡلِمَٰتِ وَٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ وَٱلۡقَٰنِتِينَ وَٱلۡقَٰنِتَٰتِ وَٱلصَّٰدِقِينَ وَٱلصَّٰدِقَٰتِ وَٱلصَّٰبِرِينَ وَٱلصَّٰبِرَٰتِ وَٱلۡخَٰشِعِينَ وَٱلۡخَٰشِعَٰتِ وَٱلۡمُتَصَدِّقِينَ وَٱلۡمُتَصَدِّقَٰتِ وَٱلصَّٰٓئِمِينَ وَٱلصَّٰٓئِمَٰتِ وَٱلۡحَٰفِظِينَ فُرُوجَهُمۡ وَٱلۡحَٰفِظَٰتِ وَٱلذَّٰكِرِينَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا وَٱلذَّٰكِرَٰتِ أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمٗا ٣٥﴾ [ سورة الأحزاب: 35 ]
“অবশ্যই আত্মসমর্পনকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পনকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সাওম পালনকারী পুরুষ ও সাওম পালনকারী নারী, যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ ও যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী— এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন।” - (সূরা আল-আহযাব: ৩৫)।
দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে সে পুরুষের মতই— এটি নিশ্চিত ও সর্বস্বীকৃত বাস্তবতা।
এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম নারীর উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তাতে পুরুষ ব্যক্তিও অংশীদার। আর তা হচ্ছে: আমানত, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা।
নারীর উপর আবশ্যক হল এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করা। সে তা উপলব্ধি করবে পূর্ণ অনুভূতিসহকারে, সে তা জেনে ও বুঝে উপলব্ধি করবে, সে তা প্রতিষ্ঠিত করে ও কাজে পরিণত করার মাধ্যমে স্মরণ রাখবে এবং সে অন্য নারীদের মাঝে তা প্রচার ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার হেফাজত করবে। এ ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন; তন্মধ্যে আমরা নিম্নে কিছু উল্লেখ করছি:
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« لا تزول قدما عبد يوم القيامة حتى يسئل عن عمره فيم أفناه وعن علمه فيم فعل وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه وعن جسمه فيم أبلا » ( أخرجه الترمذي وقال هذا حديث حسن صحيح ).
“কিয়ামতের দিন বান্দার দু‘পা একটুও নড়বে না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করা হবে তার জীবনকাল সম্পর্কে: সে তা কোন পথে অতিবাহিত করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার জ্ঞান সম্পর্কে, সে জ্ঞান অনুযায়ী কী কাজ করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে এবং জিজ্ঞেস করা হবে তার শরীর সম্পর্কে, কোথায় সে তা ক্ষয় করেছে।” - (ইমাম তিরমিযী হাদিসটি বর্ণনা করেন এবং বলেন: এই হাদিসটি হাসান সহীহ)।[5]
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إذا صلت المرأة خمسها وصامت شهرها وحفظت فرجها وأطاعت زوجها قيل لها: ادخلي الجنة من أي أبواب الجنة شئت» (أخرجه أحمد).
“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।” (ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[6]
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
«كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته الإمام راع ومسؤول عن رعيته والرجل راع في أهله وهو مسؤول عن رعيته والمرأة راعية في بيت زوجها ومسؤولة عن رعيتها والخادم راع في مال سيده ومسؤول عن رعيته . قال وحسبت أن قد قال: والرجل راع في مال أبيه ومسؤول عن رعيته وكلكم راع ومسؤول عن رعيته» (أخرجه البخاري ... عن عبد الله بن عمر ).
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল (রক্ষণাবেক্ষণকারী), আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইমাম বা শাসক হলেন দায়িত্বশীল, আর তাকে তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবার ও সংসারের জন্য দায়িত্বশীল, আর তাকে তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর নারী তার স্বামীর ঘর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর খাদেম (সেবক) তার মনিবের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ধারণা করি যে, তিনি (রাসূল) আরও বলেছেন: পুরুষ ব্যক্তি তার পিতার ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের সকলকেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” - (ইমাম বুখারী র. হাদিসটি আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেন )।[7]
এছাড়াও এ-ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে।
এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আমি নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করছি:—
মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিমণ্ডল
মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিমণ্ডল কয়েকটি ক্ষেত্র বা পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা হল:
প্রথম ক্ষেত্র: তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্য
তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে:
প্রথমত: তার প্রতিপালকের প্রতি তার ঈমান তথা বিশ্বাস প্রসঙ্গে:
আর এটা হল সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং আবশ্যকীয় কর্তব্যকাজ। কেননা পূর্বে উল্লেখিত আয়াতসমূহের[8] মধ্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উত্তম প্রতিদান প্রাপ্তির সাথে তাঁর প্রতি ঈমানের শর্তারোপ করেছেন; তিনি বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤﴾ [سورة النساء: 124 ]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” - ( সূরা আন-নিসা: ১২৪ ); তাছাড়া এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আরও অনেক আয়াত রয়েছে।
এই ঈমানের অনুসরণকারীকে ঈমানের ছয়টি রুকন মেনে চলতে হবে—
(ক) আল্লাহর প্রতি ঈমান: এর মানে আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের তিনটি অংশের প্রতিই বিশ্বাস স্থাপন করা। যথা:
- আল্লাহ তা‘আলার কাজের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হলেন সকল কিছুর মালিক, পরিচালনাকারী, সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। তিনি বলেন:
﴿ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣ مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤ ﴾ [ سورة الفاتحة: 2 – 4 ]
“সকল প্রশংসা সৃষ্টিজগতের রব আল্লাহরই; যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু; কর্মফল দিবসের মালিক।” - (সূরা আল-ফাতিহা: ২ – ৪)। তাছাড়া আরও অনেক আয়াত রয়েছে। আর এটাই হল রব হিসেবে আল্লাহর একত্ববাদ (তাওহীদ আর-রুবূবিয়াহ)।
- বান্দাদের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। একজন মুসলিম নারী ঈমান আনবে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা হলেন একচ্ছত্র মা‘বুদ তথা ইবাদতের উপযুক্ত এবং সে সকল প্রকার ইবাদত তাঁকে উদ্দেশ্য করেই করবে। তাই সে সালাত আদায় করবে আল্লাহর জন্য, পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা অর্জন করবে আল্লাহর জন্য; সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে না; আর সে আল্লাহর কারণেই পিতা-মাতার আনুগত্য করবে; পর্দা করবে আল্লাহ্র আনুগত্য করে; আর আল্লাহর নিকট যা আছে, তা পাওয়ার আশায়ই স্বামীর আনুগত্য করবে ... এভাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [ سورة الذاريات: 56 ]
“আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এইজন্য যে, তারা শুধু আমারই ইবাদত করবে।” - (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬) আর এটাই হল ইলাহ হিসেবে তাঁর একত্ববাদ (তাওহীদ আল-উলূহিয়াহ), অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ (তাওহীদ আল-‘ইবাদাহ্)।
- তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদ। মুসলিম নারী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করবে সকল সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলী। আর তা করতে হবে যেকোনো প্রকার অপব্যাখ্যা, তার ধরন-প্রকৃতি খোঁজা, সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সেগুলোর সাদৃশ্যস্থাপন অথবা এগুলোকে অর্থশূন্য করা ছাড়াই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [ سورة الشورى: 11 ]
“কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” - (সূরা আশ-শুরা: ১১)।
- মুসলিম নারী এসব সুন্দর নামসমূহ এবং মহৎ গুণাবলীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে। সে স্বীকৃতি দেবে যে, আল্লাহ হলেন দয়াময়, পরম দয়ালু; তাই সে তাঁর নিকট রহমত কামনা করবে। তিনি হলেন রিযিকদাতা, পরম শক্তির অধিকারী; তাই সে তাঁর নিকট রিযিকের জন্য আবেদন করবে। তিনি হলেন রোগ নিরাময়কারী ও যথেষ্ট, সুতরাং সে তাঁর নিকট রোগ থেকে মুক্তির জন্য আবেদন করবে। আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, পরম ক্ষমাপরায়ণ; তাই সে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তিনি হলেন মার্জনাকারী ও দানশীল; তাই সে তাঁর নিকটই মাফ চাইবে ... ইত্যাদি।
(খ) ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: সুতরাং মুসলিম নারী বিশ্বাস স্থাপন করবে যে, আল্লাহ তা‘আলার অনেক ফেরেশতা রয়েছে, যারা রাতদিন অক্লান্তভাবে তাঁর দাসত্ব করে; আর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক আছে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে; আর তাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যার নাম ও গুরুত্ব আমাদের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে; যেমন: জিবরাঈল আ. যিনি ওহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত; ইস্রাফিল আ. যিনি সিঙায় ফুঁ দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত; আর সেখানে পাহাড়-পর্বত, বাতাস এবং বান্দাদের হিসাব-নিকাশ ও তাদের কর্মতৎপরতা লিপিবদ্ধ করার জন্য আরও অনেক ফেরেশতা রয়েছে; এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে দু’জন করে ফেরেশতা রয়েছে, যারা ঐ ব্যক্তি থেকে প্রকাশিত প্রতিটি কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِذۡ يَتَلَقَّى ٱلۡمُتَلَقِّيَانِ عَنِ ٱلۡيَمِينِ وَعَنِ ٱلشِّمَالِ قَعِيدٞ ١٧ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨﴾ [ سُورَةُ قٓ: 17-18]
“স্মরণ রাখ, দুই সাক্ষাৎ গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে; মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।” - ( সূরা ক্বাফ: ১৭ - ১৮ )।
(গ) রাসূলদের উপর নাযিলকৃত আল্লাহ তা‘আলার কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: আল-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে তার উল্লেখ রয়েছে; তন্মধ্যে আমাদের জন্য চারটি কিতাবের নাম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: তাওরাত, যা মূসা ‘আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; ইঞ্জিল, যা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; যাবুর, যা দাউদ ‘আলাইহিস সালামকে দেয়া হয়েছে এবং আল-কুরআন, যা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে। আর আল-কুরআনুল কারীম হল সর্বশেষ কিতাব, যার মাধ্যমে কিতাব অবতীর্ণের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং যা বাকি সকল কিতাবের বিধানকে রহিত করে দিয়েছে; আর তার (কুরআনের) মধ্যে যা এসেছে, তা ব্যতীত অন্য কোন কিতাবের বিধান অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা বৈধ নয়।
(ঘ) মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: তারা মানুষকে সুসংবাদ দেয়, সতর্ক করে এবং তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করার আবশ্যকতার কথা তাদের নিকট প্রচার করে। আর ঐসব রাসূলদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, আমাদের জন্য যাদের নাম আলোচিত হয়েছে; আর তাদের মধ্যে এমন অনেক রয়েছেন, যাদের নাম আলোচিত হয় নি; সুতরাং মুসলিম নারী তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, যাদের নাম বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে তাদের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করবে, যাদের নাম উল্লেখ করা হয় নি। আর তাদের মধ্যে প্রথম হলেন নূহ ‘আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যার মাধ্যমে নবুওয়ত ও রিসালাতের ধারার সমাপ্তি ঘটে এবং তিনি তাদের মধ্যে সর্বশেষ, তাঁর পরে আর কোন নবী আসবে না; তাঁকে সকল মানুষ ও জিনের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে; আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শরী‘আত প্রবর্তন করেছেন, সে অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত না হলে তা বৈধ হবে না।
(ঙ) আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা: মানুষের এই জীবনের পরিসমাপ্তির সূচনা হয় কতগুলো ভূমিকা বা উপাদানের মাধ্যমে; আর তা হল তার মৃত্যু ও পরবর্তী জীবনে স্থানান্তরের মাধ্যমে; আর কবরের ফিতনা (পরীক্ষা), তার নিয়ামত ও শাস্তির মাধ্যমে; আর কিয়ামতের ছোট ও বড় শর্ত বা নিদর্শনের মাধ্যমে; অতঃপর পুনরুত্থান বা পুনরায় জীবিত করা, হাশর (সমাবেশ), হিসাব, প্রতিদান ও সিরাত (পুলসিরাত) এবং সব শেষে জান্নাত ও জাহান্নামে মাধ্যমে।
এই হল মুসলিম নারীর আকিদা বা বিশ্বাস, যার উপর ভিত্তি করে তার নিজের জীবনকে গড়ে তোলা এবং সে ব্যাপারে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
অতঃপর এই ঈমান বা বিশ্বাস আরও কতগুলো আবশ্যকীয় বিষয়কে অনুসরণ করে; যেমন: আল্লাহ তা‘আলার ভালবাসা, তাঁর প্রতি একনিষ্ঠতা; তাঁর নিকট প্রত্যাশা করা, তাঁকে ভয় করা; আর সে এগুলো জেনে রাখবে এবং তার উপর ধৈর্যধারণ করবে; আর সে এই আকিদা-বিশ্বাস পরিপন্থী কর্মকাণ্ডসমূহ এবং ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ থেকে সতর্ক থাকবে; আর এগুলোর শীর্ষে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা, কুফরী করা, নিফাকী করা এবং আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর দীন ও তিনি যে শরী‘আত প্রবর্তন করেছেন, তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা; অথবা যে কোন প্রকারের ইবাদত আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারও উদ্দেশ্যে করা; অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের বিধান আল্লাহ তা‘আলার বিধানের সমান বা তার চেয়ে উত্তম বলে বিশ্বাস করা এবং এই বিশ্বাস করা যে, মানবতা এমনিতেই সৌভাগ্যবান হবে, যেমনিভাবে সে আল্লাহ তা‘আলার বিধানের মধ্যে সৌভাগ্যবান হয়; অথবা এই বিশ্বাস করা যে, যুগ-যামানা আল্লাহ তা‘আলার বিধান নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং তা পবিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ হিসেবে অবিশিষ্ট রয়েছে; এই জীবনে তার উপর আমলের প্রয়োজন নেই; অথবা জাদুকর ও জ্যোতিষীর কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস স্থাপন করা এবং ঈমান বিনষ্টকারী জাদুকর, ভেল্কিবাজ ও ভণ্ড-প্রতারকদের অনুসরণ করা।
সুতরাং মুমিন নারীর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল, সে এই ধরনের ভয়াবহ শিরকে নিপতিত হওয়া থেকে সতর্ক থাকবে; অতএব সে ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং আরও দায়িত্বপ্রাপ্ত ঈমান বিনষ্ট করে, এমন বিষয় থেকে সতর্ক থাকার ব্যাপারে।
দ্বিতীয়ত: তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ থেকে অন্যতম হল জ্ঞান অর্জন:
আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল শরী‘আতের জ্ঞান, যার দ্বারা তার দীন প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ, এই দীন জ্ঞান ব্যতীত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; আর তা হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে জ্ঞান এবং তাঁর দীন ও শরী‘আত সম্পর্কিত জ্ঞান। আর এই জ্ঞান দুইভাগে বিভক্ত:
(ক) ফরযে আইন: এই প্রকারের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারীর উপর ফরযে আইন তথা আবশ্যকীয় কর্তব্য; আর তা এমন জ্ঞান, যার দ্বারা দীনের জরুরি বিষয়গুলো জানা ও বুঝা যায়; অথবা অন্যভাবে বলা যায়: এটা এমন জ্ঞান, যা ব্যতীত দীন প্রতিষ্ঠিত হয় না; যেমন: সামগ্রিকভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন সম্পর্কিত বিধানসমূহ, পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিধানসমূহ, সালাত (নামায) সম্পর্কিত বিধানসমূহ; সুতরাং মুসলিম নারী শিক্ষা লাভ করবে সে কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে? কিভাবে সে সালাত (নামায) আদায় করবে? কিভাবে সাওম (রোযা) পালন করবে? কিভাবে সে তার স্বামীর হক আদায় করবে? আর কিভাবে সে তার সন্তানদেরকে লালনপালন করবে? এবং এমন প্রত্যেক জ্ঞান, যা তার উপর বাধ্যতামূলক।
(খ) আরেক প্রকার জ্ঞান অর্জন করা ফরযে কিফায়া: আর তা এমন জ্ঞান, যা কিছুসংখ্যক ব্যক্তি অর্জন করলে বাকিরা অপরাধমুক্ত হয়ে যায়; আর মুসলিম নারীর জন্য এই প্রকার জ্ঞান অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সেই জ্ঞান অর্জন করে পরিতৃপ্তি লাভ করাটা উত্তম বলে বিবেচিত হবে। কুরআন ও সুন্নাহ এই জ্ঞান অর্জনের প্রশংসায়, তার ফযিলত বা মর্যাদা বর্ণনায় এবং এ প্রকার জ্ঞান ও জ্ঞানীদের গুরুত্ব বর্ণনায় অনেক বক্তব্য নিয়ে এসেছে; আরও বক্তব্য নিয়ে এসেছে অন্যদের উপর তাদের উচ্চমর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায়; কারণ, তারা হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তরসুরী।
ইবনু আবদিল বার আল-আন্দালুসী র. বলেন: “আলেমগণ এই ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, ইলম বা জ্ঞানের মধ্যে এক প্রকার এমন রয়েছে, যা প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে ফরযে আইন; আরেক প্রকার হল ফরযে কিফায়া ... অবশেষে তিনি বলেন: এর থেকে যতটুকু সকলের উপর আবশ্যক তা হচ্ছে যে সকল বস্তু তার উপর ফরয করা হয়েছে, যা না জেনে থাকার সুযোগ নেই সে ফরযটুকু জানা।”
মুসলিম নারীকে ইসলাম যে সম্মান দান করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম হল: ইসলাম নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা প্রদান করার মর্যাদা পুরুষের মর্যাদার মত করে সমানভাবে নির্ধারণ করেছে এবং নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জন্য কোন বিশেষ মর্যাদা নির্দিষ্ট করে নি। শিক্ষা এবং শিক্ষা গ্রহণের ফযিলত বা মর্যাদা বর্ণনায় বর্ণিত সকল আয়াত ও হাদিস পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে মর্যাদাবান বলে অবহিত করে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ﴾ [ سُورَةُ المجادلة: 11 ]
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।” - (সূরা আল-মুজাদালা: ১১); তিনি আরও বলেন:
“বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” - ( সূরা আয-যুমার: ৯ ); তিনি আরও বলেন:
“বল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কর।” - ( সূরা ত্বা-হা: ১১৪ )।
অনুরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
« مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللَّهُ بِهِ طَرِيقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِى الأَرْضِ وَالْحِيتَانُ فِى جَوْفِ الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ ». ( أخرجه أبو داود و الترمذي و ابن ماجه ).
“যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করার জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, এর উসিলায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথসমূহ থেকে একটি পথে পরিচালিত করেন। নিশ্চয়ই ইলম (জ্ঞান) অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য ফেরেশতাগণ তাদের পাখাসমূহ বিছিয়ে দেন। আর আলেমের জন্য আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি গভীর পানির মাছও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সুতরাং একজন আবেদের (ইবাদতকারীর) উপর আলেমের মর্যাদা তেমনি, যেমন পূর্ণিমার রাতে সকল তারকার উপর চাঁদের মর্যাদা। নিশ্চয়ই আলেমগণ নবগণের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী)। আর নবীগণ কোন দিনার এবং দিরহামের উত্তরাধিকারী রেখে যাননি; বরং তাঁরা শুধুমাত্র ইলমকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, সে পরিপূর্ণ অংশ (উত্তরাধিকার) গ্রহণ করল।” - ( ইমাম আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবন মাজাহ হাদিসখানা বর্ণনা করেন )।[9]
এগুলো ছাড়াও কুরআন ও সুন্নাহর আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে, যার প্রতিটি বক্তব্যই সমানভাবে পুরুষ ও নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে; আর অনুরূপভাবে প্রথম প্রজন্মের নারীগণ জ্ঞান অর্জনের এই নীতি অবলম্বন করেছেন; মুমিন জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা জ্ঞান অন্বেষণকারিনী এবং সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগী নারীদের জন্য নিজেকে অত্যন্ত চৌকস ব্যক্তি হিসেবে দৃষ্টান্ত পেশ করেন; এমনকি তিনি অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন এবং অনেক মাসআলার ক্ষেত্রে তিনি তাদের তথ্যসূত্র বা আশ্রয়স্থল হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন। আর তিনি সাহাবীদের কারও কারও দেয়া বিধিবিধানের ভুল সংশোধন করে দিতেন।
আর অধ্যাপক ডক্টর আবদুর রহমান আয-যুনাইদী নারীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পর্যালোচনা করেছেন; আর তা আলোচিত হয়েছে ‘নারীর সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য’ (مسئولية المرأة الثقافية) শিরোনামের একটি পুস্তিকায়; সেখানে তিনি প্রথমে কতগুলো চ্যালেঞ্জের চিত্র তুলে ধরেছেন, মুসলিম নারী এই যুগে যেগুলোর মুখোমুখি হয়; আর তা হল:
প্রথম চিত্র: ইসলামী ধ্যানধারণার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকা; অন্যভাবে বলা যায়: তার ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসকে বিশৃঙ্খলামুক্ত না করা; ফলে তার ইলাহ অথবা জীবন অথবা সৃষ্টি সম্পর্কিত বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থাকে বিকৃত; ফলে সে দুর্বল আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে।
দ্বিতীয় চিত্র: পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সামাজিক অবস্থান। অর্থাৎ কোন কোন পুরুষ কর্তৃক তার পরিবারের সাথে বিদ্যমান নেতিবাচক অবস্থান। আর এটাকেই মুসলিম নারী তার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করে, পরিবারে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারটি সে সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে সক্ষম হয় না। যেখানে পরিবারে নারীর সাথে পুরুষের সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার কথা, সেখানে পুরুষ লোকটি সে সম্পর্কে ছেদ ঘটায় এবং সেটাকে পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় না।
তৃতীয় চিত্র: চিন্তাগত অস্থিরতা, যা নিয়ে এই যুগ উত্তাল হয়ে আছে; যেমন আমদানিকৃত সংস্কৃতি, যা মুসলিম নারীর উপর সংকট সৃষ্টি করে এবং তাকে নিক্ষেপ করে ধ্বংস, অপ্রিয় ও ঘৃণ্য চরিত্রের পথে; এমনকি শিল্প, নৃত্য ইত্যাদি হয়ে যায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার পাওয়ার মত বস্তুর অন্তর্ভুক্ত, যাকে আজকের নারীসমাজ গুরুত্ব দিয়ে থাকে; আর এটা বিপজ্জনক ও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
চতুর্থ চিত্র: তথ্যপ্রযুক্তি বা মিডিয়া; আর কোন সন্দেহ নেই যে, এটাও একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, কারণ এতে ভাল ও মন্দ সবই একসাথে রয়েছে। যার দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে এমন সংস্কৃতি, যা দীনের বিরুদ্ধে লড়াই করে, মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্বের উপর আক্রমন করে, শিশুদেরকে তাদের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করার প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের স্বভাব-প্রকৃতিকে সত্য পথ থেকে ভিন্নমুখী করে দেয়। আর মুসলিম নারী এই দূষিত পরিবেশের মধ্যে জীবনযাপন করে, যার কারণে এই জীবনে তার নির্মল জীবনধারা কলুষিত হয়।
পঞ্চম চিত্র: আর আমি এখানে পঞ্চম চিত্রটি বৃদ্ধি করেছি; আর তা হল: নৈতিক বিপর্যয়, যা কোন কোন মুসলিম সমাজের গভীরে গিয়ে পৌঁছেছে এবং তা মুসলিম নারীসমাজের উপর নগ্নভাবে আক্রমন করেছে ও তার জন্য সমাজটিকে বাস্তবতার বিপরীতরূপে চিত্রিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ শিল্পকলা একাডেমিগুলোতে যেসব অনৈতিক বিষয়াদি ও কর্মকাণ্ড পরিবেশিত হয় এবং তাতে দীনের কিছু কিছু শিক্ষা ও দর্শনকে যেভাবে সেকেলে ও পশ্চাৎপদতা দ্বারা চিত্রিত করা হয়, তাতে এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা জাতির অনুসরণ করে ব্যাপক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে; যাতে বলা হয় বিয়ে-সাদী হল বন্দী করা বা আটকিয়ে রাখা; আর তার সমাধান হল ভোগবিলাসে মত্ত থাকা এবং এরূপ আরও অনেক শ্লোগান।
ষষ্ঠ চিত্র: নারী জাতির বিশ্বায়ন; আর তা হল পশ্চিমা নাস্তিকগণ আহ্বান করে যে, আদর্শ নারী হল পশ্চিমা নারী, যে অধিকারের ব্যাপারে পুরুষের সমান; শিল্প-কারখানায় পুরুষের মত শ্রমিক, সৌন্দর্য প্রদর্শনকারিনী ইত্যাদি।
আর এই চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো প্রকাশ হতে শুরু করে তাদের ঐসব সম্মেলনে, যেগুলোতে তারা লোকদের আহ্বান করে, আর জাতিসংঘ যেগুলোর তত্ত্বাবধান করে এবং তার মূলনীতিমালা বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়; যেমন শ্রমজীবি নারীকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচ্য নারী হিসেবে তাদের মূল্যায়ন, হোম মেকার বা গৃহিনীদেরকে বিভিন্নভাবে পশ্চাদপদ বলে অবমূল্যায়ন করে। আর এর মধ্যে আরও রয়েছে, কতগুলো পরিবর্তিত পরিভাষার অনুপ্রবেশ; যেমন: নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর করার তাৎপর্য ব্যাখ্যার জন্য তারা " المساواة " (সমতা) শব্দের ব্যবহার; আর যৌনস্বাধীনতা ও নৈতিকতা বর্জনের জন্য "التنمية" (প্রগতি) শব্দের ব্যবহার।
কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ সত্বেও আশার আলো তাদের মধ্যে তাদের মধ্যে থাকবে যারা তাদের দীনকে উপলব্ধি করেছে এবং তাদের শত্রুদের পাতানো পরিকল্পনার ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন থেকেছে, তাদের ব্যাপারে আশার আলো সুস্পষ্টভাবে আলোকিত হয়ে আছে যা মনকে করে আনন্দিত এবং তাকে আস্থা, বিশ্বাস ও প্রশান্তিতে ভরে দেয়।
মুসলিম নারীর সাংস্কৃতিক ভিত্তির খুঁটিসমূহ:
১. বিশুদ্ধ ইসলামী ধ্যানধারণাকে মৌলিক বিষয় হিসেবে তার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, যার উপর শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রাসাদ নির্মিত হবে।
এই ধ্যানধারণা অন্তর্ভুক্ত করবে:
- ঈমানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
- মুসলিম নারীর জীবনে আল-কুরআনুল কারীম ও পবিত্র সুন্নাহর মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ।
- ইসলামের স্তম্ভ ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ।
- আর মানুষের সাথে সম্পর্কিত জগতের বিষয়সমূহ।
- জীবনের বিভিন্ন স্তর ও স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ
- এবং স্বয়ং মানুষের সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহ।
আর যাতে করে এই ধ্যানধারণাটি বিশুদ্ধ হয়, সেই জন্য মুসলিম নারীর জন্য আবশ্যক হল, সে ঐ ধ্যানধারণাটি ইসলামের মূল দু’টি উৎস আল-কুরআনুল কারীম ও পবিত্র সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করবে; আর পূর্ববর্তী সত্যনিষ্ঠ আলেমগণ এই উভয় উৎস থেকে যা অনুধাবন করেছেন, তা থেকে।
২. তাফসীর, হাদিস, ফিকহ ও সীরাতসহ ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্রে উপর প্রতিষ্ঠিত শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত সংস্কৃতির পূর্ণতা বিধান করা। যা মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে সুদৃঢ় সাস্কৃতিক ভিত প্রতিষ্ঠিত করবে। আর এই সিলেবাসের পরিমাণ কতটুকু? এখানে তার নির্ধারিত কোন পরিমাণ নেই; কারণ, তা প্রত্যেক নারীর স্বভাব-প্রকৃতির উপর নির্ভর করে; কিন্তু তাকে অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকতে হবে:
ক. সে বিভিন্ন শাস্ত্রের ভূমিকাসমূহের ব্যাপারে জানবে, যা ঐ শাস্ত্রের মূলনীতি হিসেবে বিবেচিত; যেমন উসূলে তাফসীরের ভুমিকা, অনুরূপভাবে ‘উলুমুল হাদিসের ভূমিকা ...।
খ. ঐসব শাস্ত্রে নারীর ব্যাপারে যে বিশেষ আলোচনা রয়েছে, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
গ. অনবরত শরয়ী তথা কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জন এবং ইসলামী সংস্কৃতির লালন করতে সচেষ্ট থাকা।
৩. সমসাময়িক আলেমগণ যেসব লেখালেখি করেন, তা পাঠ করা; কেননা তারা যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বসবাস করে, তার বাস্তব চিত্র তাদের জানা রয়েছে। আর মুসলিম নারীর জন্য পূর্ববর্তী লেখকদের লিখিত মূল গ্রন্থপঞ্জির উপর নির্ভর করাই যথেষ্ট নয়। কারণ, তা বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে এবং তার কার্যকারিতা হ্রাস করবে।
৪. চতুর্থ খুঁটি হল, মুসলিম নারীকে অপরাপর সহযোগী বিদ্যা যেমন ভাষা, ইতিহাস, সাহিত্যের মত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে তার সংস্কৃতিকে লালন করা। কারণ, এটি তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে, নিয়মনীতির প্রচলন করবে এবং চিন্তা-ভাবনার খোরাক বৃদ্ধি করবে।
৫. আরও একটি অন্যতম স্তম্ভ হল মুসলিম নারীকে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ভিত নির্মাণে যেসব প্রতিবন্ধকতা বাধা সৃষ্টি করে, সে দিকে মনোযোগ দেয়া; কেননা প্রতিবন্ধকতাসমূহ কোন কোন সময় এই ভীতের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, অথবা তাতে ফাটল দেখা দেবে; আর যেসব বিষয় এই প্রতিবন্ধকতাসমূহ অতিক্রম করতে তাকে সহযোগিতা করবে, তা হল:
ক. সে আকিদা-বিশ্বাস, শরী‘আতের বিধিবিধান, নৈতিকতা, পারিবারিক ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামী জীবনপদ্ধতি এমনভাবে অধ্যয়ন করবে যে, তা একটি পরিপূর্ণ প্রাসাদ, যার একাংশ অপর অংশের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে।
খ. সাংস্কৃতিক ভিত তৈরিতে ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-দর্শনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে; সুতরাং সে কোন নির্দিষ্ট সিলেবাসের উপর সীমাবদ্ধ থাকবে না, অথবা সে তার মেধাকে একেবারে উন্মুক্ত করে দেবে না প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে যা ছড়িয়ে পড়েছে, তা গ্রহণ করার জন্য; সুতরাং এমনটি হলে সে পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।
মুসলিম নারীর সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য
১. সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের উপাদানসমূহ:
ক. মুসলিম নারীদের ব্যক্তিত্ব গঠনে চিন্তাধারায়, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ও জ্ঞানগত দিক থেকে স্বভাব-প্রকৃতির ক্রম উন্নতির মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট ও সহজ-সরল শরী‘আতের কারিকুলামের আলোকে একটি প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রের মাধ্যমে একটি পদ্ধতিগত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা।
খ. তরুণ সমাজের জন্য মাদরাসায় ইসলামী সংস্কৃতি চালু করা এবং সিলেবাস ভিত্তিক শিক্ষাকে যথেষ্ট মনে না করা। কারণ, তা সময়ের সাথে শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত; সুতরাং পাঠ পদ্ধতির বহির্ভূত উদ্যম বা কার্যক্রম থেকে ফায়দা হাসিল করতে হবে এবং আরও ফায়দা হাসিল করতে হবে ঐ পাঠ্যক্রম থেকে, যা সে অধ্যয়ন করে।
গ. শিশুর জন্য বিশ্বস্ত শিশু পরিচর্যাকারিনী হওয়া, তার শিশুই সেখানে প্রথম প্রাধান্য পাবে এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে তাদের (শিশুদের) সাথে যার সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর একজন মা সাধারণত: (যা অচিরেই বর্ণিত হবে ইনশাআল্লাহ) যার কাছে চাওয়া হয় তার সন্তানদের তত্ত্বাবধান এবং ফাসাদ বা বিপর্যয় থেকে তাদেরকে রক্ষা করা, তখন সত্যিকার মুসলিম নারী থেকে এটাই দাবি করা হয় যে, সে তার তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে উপযুক্ত গবেষক ও প্রশাসকদেরকে বের করে দেবে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য এবং তাদের সমাজে ও মহল্লায় তাদের সমবয়সীদের সাথে তারা যেন হতে পারে সৎ প্রভাবশালী আদর্শ জাতি।
ঘ. একজন নারী কর্তৃক তার আশপাশে, তার ঘরের মধ্যে এবং তার প্রতিবেশী ও বান্ধবীদের সাথে যারা আছে, তাদের মধ্যে ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা; সে তাদের মধ্যে আল্লাহর যিকিরের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং দীন শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করবে; আর সে দীন বিরোধিতার পর্যবেক্ষণ করবে এবং সে সব ব্যাপারে সতর্ক করবে।
ঙ. কাজকর্মে সমন্বয় সাধন এবং তার ব্যক্তিগত আচার-আচরণের উপর এই সংস্কৃতির প্রভাবকে ফুটিয়ে তোলা; সুতরাং বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাটাই তার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং তার জন্য আবশ্যক হল, সে তার সংস্কৃতিকে প্রকাশ করবে তার কথাবার্তায়, নীরব থাকায়, বের হওয়ার সময়, পোষাক-পরিচ্ছদে, সঞ্চয় ও রান্নাবান্না করাসহ তার সার্বিক তৎপরতার মধ্যে; আর তার স্বামী, পরিবার-পরিজন, তার স্বামীর পরিবার-পরিজন ও তার প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার সংস্কৃতিকে প্রকাশ করবে। কারণ, অনেক সময় কথাবার্তা সেই পরিমাণ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না, যেই পরিমাণ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে প্রশংসনীয় চরিত্র বা আচার-আচরণ।
চ. তার স্বামীকে সহযোগিতা করা; যখন সে (স্বামী) দা‘ঈ তথা আল্লাহ দীনের পথে আহ্বানকারীর ভূমিকা রাখে, তখন সে হবে তার সর্বোত্তম সাহায্যকারী ও বড় ধরনের পৃষ্ঠপোষক, সে তার জন্য দো‘আ করবে, তার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বা আসবাবপত্রসমূহ গুছিয়ে রাখবে, তার কর্মকাণ্ডকে তার জন্য সহজ করে দেবে এবং তার কাঙ্খিত বস্তু দ্বারা যথাসম্ভব তাকে তুষ্ট করবে; সুতরাং সে তাকে (তার স্বামীকে) নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাস্তবায়ন করবে এবং সে প্রতিদান ও কল্যাণের মধ্যে তাকে অংশীদার করবে।
ছ. জ্ঞানসমৃদ্ধ বার্ষিক ম্যাগাজিন বা সাময়িকীতে অংশগ্রহণ করা; উদাহরণস্বরূপ যা বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, কেন্দ্র ইত্যাদি থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মৌসুমে প্রকাশিত হয়।
জ. ঐসব আলাপ-আলোচনা ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, যা নারী প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে, আরও বিশেষ করে জটিল সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করে; উদাহরণস্বরূপ কিছু বিষয় ও সমস্যা হল: শিক্ষা ও বিবাহ; গৃহ ও কাজ; শিশু ও প্রতিবেশীদের সাথে আচার-আচরণ; সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া; নারী প্রসঙ্গে ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসগত প্রভাব; বিনোদন ও পর্যটনের স্পটসমূহ ইত্যাদি। অতএব একজন বিদুষী সংস্কুতিমনা মুসলিম নারীর জন্য উচিত কাজ হল, সে ঐসব বিষয়ে অংশগ্রহণ করা।
২. এই দায়িত্ব ও কর্তব্য বাস্তবায়ন-পদ্ধতি:
আর এই ব্যাপারে যা সহায়তা করবে, তা কার্যকর করবে এবং তা প্রচার-প্রসার ঘটাবে, তা হচ্ছে, মহিলা সাংস্কৃতিক দায়িত্বশীলা এবং কল্যাণ ও হেদায়েতের পথে আহ্বানকারিনীগণের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা পথ সুগম করা। আর এই পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টি বাস্তবায়িত হবে নম্র ব্যবহার, উন্মুক্ত হৃদয়, ভালবাসা, ঐক্যমত ও বিভিন্ন শাখার সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালনকারিনীদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের উপর ভিত্তি করে, শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির পথে নয়। তাছাড়া আরও যা এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে তা হচ্ছে, বুদ্ধিমত্তা ও আবেগ-আন্তরিকতাকে কাজে লাগানো। সুতরাং কেবলমাত্র জ্ঞান হলেই যথেষ্ট নয়; যদিও এই যুগ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ’; এমন কথার দ্বারা যেন মুসলিম নারী প্রতারিত না হয়, বরং সে আবেগ-আন্তরিকতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে; কারণ, আবেগ-সহানুভূতি হল একটি বড় ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী পদ্ধতি ও কুরআনিক নিয়মনীতি, যা আল-কুরআন (মানুষকে) আগ্রহীকরণ ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার করেছে; আর তা স্বভাবজাত পদ্ধতিও বটে। আর সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন-পদ্ধতির বাস্তবায়নের অন্যতম দিক হল: নিজের সমালোচনা করা ও অনবরত নিজের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ণ করা; যাতে সে নিজের উন্নতির চিন্তা ভুলে না যায়; নতুবা সে অলসতা ও শয়তানের ফাঁদে পতিত হবে। -(যুনাইদী যা উল্লেখ করেছেন তা থেকে সংক্ষেপিত)।
তৃতীয়ত: মুসলিম মহিলার নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের অন্যতম আরেকটি দিক হল: সৎকর্ম করা:
আর সৎকর্ম এমন কাজকে বলে, যার সমর্থনে আল-কুরআনুল কারীম অথবা সুন্নাতে নববী তথা হাদিসের দলিল রয়েছে।
আর সৎকর্ম এমন কাজকে বলে, যার সমর্থনে আল-কুরআনুল কারীম অথবা সুন্নাতে নববী তথা হাদিসের দলিল রয়েছে।
আর সৎকর্মকে তার হুকুম তথা বিধান অনুযায়ী ফরয ও মুস্তাহাবের মত প্রকারে বিভক্ত করা হয়ে থাকে; আর তার প্রকারের মধ্যে এমন ধরনের সৎকর্ম আছে, যার উপকারিতা ব্যক্তির নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; আবার এমন ধরনের সৎকাজ আছে, যার উপকারিতা অপরের দিকে ধাবিত হয়। সহজে বোধগম্য ব্যাপার হল ইসলাম যা স্থির করে দিয়েছে, তা হল: নারী তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দায়বদ্ধ; তাকে প্রতিদান দেয়া হবে এবং তার কাজের হিসাব নেয়া হবে; এর উপর নির্দেশিত আয়াতসমূহের আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿فَٱسۡتَجَابَ لَهُمۡ رَبُّهُمۡ أَنِّي لَآ أُضِيعُ عَمَلَ عَٰمِلٖ مِّنكُم مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰۖ بَعۡضُكُم مِّنۢ بَعۡضٖۖ﴾ [سورة آل عمران: 195]
“অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ।” - (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫); আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤﴾ [سورة النساء: 124 ]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” - ( সূরা আন-নিসা: ১২৪ ); আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:
﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧﴾ [ سورة النحل: 97 ]
“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। -(সূরা আন-নাহল: ৯৭)।
ঈমান ও ইলম (জ্ঞান) অর্জন যেমন একজন মুসলিম নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, তেমনি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, সে এই জ্ঞানের দাবি অনুযায়ী আমল বা কাজ করবে; আর এই আমল ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতে তার কোন ফলাফল অর্জিত হবে না; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ تَبَٰرَكَ ٱلَّذِي بِيَدِهِ ٱلۡمُلۡكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلۡمَوۡتَ وَٱلۡحَيَوٰةَ لِيَبۡلُوَكُمۡ أَيُّكُمۡ أَحۡسَنُ عَمَلٗاۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡغَفُورُ ٢﴾ [سُورَةُ المُلۡك: 1 – 2 ]
“মহামহিমান্বিত তিনি, সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ব; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য— কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” - ( সূরা আল-মুলক: ১ – ২ )।
কাযী ‘আইয়ায র. বলেন: " أحسن " (উত্তম বা সুন্দর) মানে: তার (কাজের) একনিষ্ঠতা ও বিশুদ্ধতা।
সুতরাং আয়াতসমূহ আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত নির্ধারণ করেছে:
- ঈমান ও ইখলাস তথা একনিষ্ঠতাকে এক আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং তার সকল কর্মকাণ্ডকে তার অধীন করা।
- সৎকর্ম; আর সৎকর্ম ততক্ষণ পর্যন্ত সৎকর্ম বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মের মত করে না হবে।
অনুরূপভাবে আয়াতসমূহ আমলের (সৎকাজের) জন্য দু’টি প্রতিদান বা পুরস্কারকে নির্ধারণ করে দিয়েছে: দুনিয়াতে পবিত্র জীবন এবং পরকালে জান্নাত।
আর মুসলিম নারীর উপর আবশ্যক হল এই কাজ বাস্তবায়ন করা। সুতরাং যদি তা ফরয কাজ হয়, যেমন ফরয সালাত, ফরয যাকাত, রমযান মাসের সাওম, সামর্থ্যবান হলে জীবনে একবার হজ করা এবং অপরাপর আবশ্যকীয় কাজস হয়, তবে তার উপর কর্তব্য হচ্ছে কোন প্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি অথবা কমতি অথবা অবহেলা অথবা তুচ্ছ জ্ঞান করা ছাড়াই তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।
পক্ষান্তরে যদি তা ফরয কাজ না হয়ে নফল ও মুস্তাহাবের মত কাজ হয়, যার করার অনুমতি দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে করুণা করেছেন, তাহলে তার উচিত হবে সে কাজগুলো থেকে একটি পূর্ণ অংশ গ্রহণ করা। কারণ,
- ফরযসমূহ পালনের ক্ষেত্রে যে ত্রুটিবিচ্যুতি হয়েছে, এই নফল কাজসমূহ তার ক্ষতিপূরণ করবে।
- তা ঐসব অপকর্ম ও গুণাহসমূহ ক্ষমা করার ব্যবস্থা করবে, যে অপরাধ তার জীবনে সংঘটিত হয়েছে।
- এবং তা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করবে।
আর এর মাধ্যমে সৎকর্মশীল পুরুষ ও নারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে এবং ঈমানের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।
আর সেই হল মুসলিম বুদ্ধিমতী নারী, যে তার জন্য এই সালাত, সাওম, দান-সাদকা, হজ, ওমরা, দাওয়াত, সৎকাজের আদেশ করা, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা, সততা, পরোপকার ইত্যাদি নফল ইবাদতের কিছু অংশ বরাদ্ধ করে রাখে।
আর তার উচিত হবে, সে যেন বিভিন্ন প্রকারের নফল কাজ করার ব্যাপারে যত্নবান হয়, সুতরাং সে নফল কর্মসমূহ থেকে এমন কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, যার ফায়দা বা উপকারিতা তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং এমন কাজ করার উদ্যোগও গ্রহণ করবে, যার ফায়দা অপরাপর ব্যক্তিদের দিকে ধাবিত হবে; আর উভয় শ্রেণীর আমল বা কার্যক্রমের মধ্যে বিরোধের সময় ঐ কাজটিকেই প্রাধান্য দেবে, যার মধ্যে অপরের কল্যাণ বা উপকার নিহিত রয়েছে; আর যখন বিভিন্ন প্রকার নফল কাজ তার সামনে এসে উপস্থিত হবে যেমন, নিজে কুরআন পাঠ অথবা অপরকে কুরআন পাঠ করানো ও তাকে শিক্ষা দেওয়া, এমতাবস্থায় সে ঐ আমলটিকেই প্রাধান্য দেবে, যার উপকারিতা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে; আর তা হল দ্বিতীয় কাজটি (অর্থাৎ অপরকে কুরআন পাঠ করানো ও তাকে শিক্ষা দেওয়া)।
আর সেখান থেকেই আমি বলব: মুসলিম নারীর আবশ্যকীয় কাজ হল সে তার দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি কর্মসূচী তৈরি করবে; অতঃপর তার জন্য একটা সম্ভাব্য ছক তৈরি করবে যাতে সে তার কাজগুলোর অনুশীলন, বাস্তবায়ন ও এগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে; এমনকি সে আল্লাহর ইবাদত করবে তার কার্যক্রমের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে।
আর এভাবেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হবে; যেমন অচিরেই এ গ্রন্থের উপসংহারে তার বিস্তারিত বর্ণনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
তাহলে বুঝা গেল যে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সৎ আমলের অন্তর্ভুক্ত হবে:
- ইসলামের পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভকে বাস্তবায়ণ করা: সুতরাং সে পাঁচবার সময়মত সালাত আদায় করবে; তার শর্ত ও ওয়াজিবসমূহ এবং যথাসম্ভব তার মুস্তাহাবসমূহ যথাযথভাবে আদায় করবে।
- আর সে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে তার সম্পদকে পবিত্র করবে, যদি তার নিকট এমন সম্পদ থাকে, যাতে যাকাত ওয়াজিব হয়।
- আর সে রমযান মাসে সাওম (রোযা) পালন করবে।
- আর সে জীবনে একবার হজ পালন করবে, যদি সে হজ পালনের এই পথে সামর্থ্যবান হয়; আর সামর্থ্যের মধ্যে তার সাথে মাহরাম ব্যক্তি বিদ্যমান থাকা অন্যতম।
- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إذا صلت المرأة خمسها وصامت شهرها وحفظت فرجها وأطاعت زوجها قيل لها: أدخلي الجنة من أي أبواب الجنة شئت» ( أخرجه أحمد).
“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর।” - (ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[11]
- তার বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করা: উদাহরণস্বরূপ সে শরী‘আত কর্তৃক ফরযকৃত পর্দা যথাযথভাবে মেনে চলবে; আর তা হল, সে তার অপরিচিত পুরুষদের থেকে তার চেহারা ও দুই হাতসহ সম্পূর্ণ শরীরকে ঢেকে রাখবে; অনুরূপভাবে সে লজ্জা, শরম ও সচ্চরিত্রের হেফাজত করবে। আর এই বক্তব্যের সমর্থনে অনেক দলিল-প্রমাণ রয়েছে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ كَأَحَدٖ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣﴾ [سورة الأحزاب: 32 - 33]
“হে নবী-পত্নিগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে তোমরা পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে। আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রচীন (জাহেলী) যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত থাকবে। হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” - ( সূরা আল-আহযাব: ৩২ – ৩৩ )।
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَدۡخُلُواْ بُيُوتَ ٱلنَّبِيِّ إِلَّآ أَن يُؤۡذَنَ لَكُمۡ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيۡرَ نَٰظِرِينَ إِنَىٰهُ وَلَٰكِنۡ إِذَا دُعِيتُمۡ فَٱدۡخُلُواْ فَإِذَا طَعِمۡتُمۡ فَٱنتَشِرُواْ وَلَا مُسۡتَٔۡنِسِينَ لِحَدِيثٍۚ إِنَّ ذَٰلِكُمۡ كَانَ يُؤۡذِي ٱلنَّبِيَّ فَيَسۡتَحۡيِۦ مِنكُمۡۖ وَٱللَّهُ لَا يَسۡتَحۡيِۦ مِنَ ٱلۡحَقِّۚ وَإِذَا سَأَلۡتُمُوهُنَّ مَتَٰعٗا فَسَۡٔلُوهُنَّ مِن وَرَآءِ حِجَابٖۚ ذَٰلِكُمۡ أَطۡهَرُ لِقُلُوبِكُمۡ وَقُلُوبِهِنَّۚ وَمَا كَانَ لَكُمۡ أَن تُؤۡذُواْ رَسُولَ ٱللَّهِ وَلَآ أَن تَنكِحُوٓاْ أَزۡوَٰجَهُۥ مِنۢ بَعۡدِهِۦٓ أَبَدًاۚ إِنَّ ذَٰلِكُمۡ كَانَ عِندَ ٱللَّهِ عَظِيمًا٥٣﴾ [سورة الأحزاب: 53]
“হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া না হলে তোমরা খাবার প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্য নবীর গৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদেরকে আহ্বান করলে তোমরা প্রবেশ কর এবং ভোজনশেষে তোমরা চলে যাও; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। কারণ, তোমাদের এই আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়, সে তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে; কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না। তোমরা তার স্ত্রীদের নিকট কোন কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে। এই বিধান তোমাদের এবং তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া সংগত নয় এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য কখনও বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ঘোরতর অপরাধ।” - (সূরা আল-আহযাব: ৫৩ ); আর এই আয়াতটি ‘পর্দার আয়াত’ বলে পরিচিত।
সুতরাং যখন এই আয়াত দু‘টি সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের মুমিনদের স্ত্রীগণের পবিত্রতার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন তাদের পরবর্তী নারীদের জন্য পর্দা তো আরও অতি উত্তমভাবেই জরুরি হয়ে পড়ে; এই বক্তব্যকে সমর্থন করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ٥٩ ﴾ [ سورة الأحزاب: 59 ]
“হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” - ( সূরা আল-আহযাব: ৫৯ )।[12]
- আর সৎ কাজের মধ্যে আরও যা অন্তর্ভুক্ত, তা হল: নফল ও মুস্তাহাবসমূহ, যা সম্পাদনের জন্য প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারী উদ্বুদ্ধ করে, পূর্বে যার বর্ণনা করা হয়েছে; আর তা হল: কুরআন পাঠ, যিকির-আযকার, নফল সালাত, নফল রোযা এবং নফল দান-সাদকা।
- অনুরূপভাবে আদব-কায়দা, শিষ্টাচারিতা ও নৈতিক চরিত্র, যা আত্মস্থ করা মুসলিম নারীর জন্য আবশ্যক; যেমন: কথায় ও কাজে সত্যবাদিতা, মিথ্যা না বলা, ধৈর্যধারণ করা, অপরের সাথে উত্তম ব্যবহার করা, কথার সময় বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করা, সাক্ষাতের সময় প্রফুল্ল থাকা এবং চলাফেরায়, পানাহারে, ঘুমানোর সময়, কথাবার্তায়, উঠা-বসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখা। সুতরাং মুসলিম নারীর উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল এইসব মর্যদাপূর্ণ নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে আত্মনিবেদন করা এবং এসব উত্তম আচরণ ও শিষ্টাচারের অনুসরণ করা।
- আর সৎ কর্মসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম সৎকাজ হল: আন্তরিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড, যেমন আল্লাহ তা‘আলাকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা, তাঁকে ভয় করা, তাঁর নিকট প্রত্যাশা করা, তাঁর ধ্যান করা (সর্বক্ষণ তাঁর কথা খেয়াল রাখা) ইত্যাদি।
- আর সৎ কর্মসমূহের মধ্য থেকে আরও কিছু সৎকাজ হল: এমন কতিপয় কর্মকাণ্ড, যেগুলোর ফায়দা বা উপকারিতা অন্যের প্রতি ধাবিত হয়; যেমন: ইলম বা জ্ঞান শিক্ষা দেয়া, কুরআন পাঠ করানো, উপদেশ দেয়া, দরিদ্রকে দান করা, অভাবীকে সহযোগিতা করা, ইয়াতীম ও বিধবাকে সাহায্য করা, দুঃখ-কষ্ট দূর করা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রশমিত করা, সৎকর্মের আদেশ দেয়া ইত্যাদি; অচিরেই যার বিষদ বর্ণনা আসছে ইনশাআল্লাহ।
- আর সৎ কর্মসমূহের মধ্য থেকে আরও কিছু সৎকাজ হল: লজ্জাস্থান ও জিহ্বা (ভাষা) কে হেফাজত করা এবং দৃষ্টি অবনমিত করা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ ﴾ [ سُورَةُ النُّورِ: 31 ]
“আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” - (সূরা আন-নূর: ৩১); আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বে উল্লেখিত হাদিসে জন্নাতে প্রবেশের কতগুলো শর্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
(সে তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে)।« وحفظت فرجها »
পরিতাপের বিষয় হল, অধিকাংশ মুসলিম নারী তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহের ব্যাপারে উদার বা ছাড় দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে; তারা তাদের চোখের লাগাম ছেড়ে দিয়েছে; ফলে তারা জনসমাবেশ, ম্যাগাজিন, হাট-বাজার ইত্যাদিতে হালাল ও হারাম জিনিস প্রত্যক্ষ করতে থাকে; যেমনিভাবে তারা তাদের জিহ্বাকে মুসলিম পুরুষ ও নারীদের মানসম্মান নিয়ে টানাটানির অনুমোদন দিয়ে থাকে এবং তারা গিবত (পরচর্চা), কুৎসা, মিথ্যা ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে।
- আর সৎ কাজের মধ্যে আরও অন্যতম কাজ হল: তার স্বামীর অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা বা আদায় করা; বস্তুত: এই অধিকারটি বিশেষভাবে আলোচনার দাবী রাখে, তার গুরুত্ব, মহত্ব ও এই ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে দৃঢ় অবস্থান ও গুরুত্ব প্রদানের কারণে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার হক তথা অধিকারসমূহের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হল স্বামীর হক; আর তার স্বামীর অধিকারসমূহ হল:
- তাকে সন্তুষ্ট রাখা এবং তাকে অসন্তুষ্ট বা বিরাগভাজন না করা।
- তার পোষাক-পরিচ্ছদ ও খাবার প্রস্তুতের মত বিশেষ কাজসমূহ সম্পাদন করা।
- তার মন-মানষিকতার প্রতি খেয়াল রাখা।
- বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে তাকে বিব্রত না করা; বিশেষ করে সে যখন স্বল্প আয়ের লোক হয়।
- ভাল কাজে তাকে উৎসাহিত করা।
- তাকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা, যখন সে ক্রটিবিচ্যুতি করে অথবা ভাল কাজে অবহেলা করে; আর তাকে কোমল ভাষায় উপদেশ দেওয়া।
- তাকে তার কর্মকাণ্ডে ও মানসিক অবস্থার উন্নয়নে উৎসাহ প্রদান করা।
- প্রত্যেক কল্যাণকর পথে তার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
- তার নির্দেশসমূহ কাজে পরিণত করা; তবে সেই নির্দেশ অন্যায় কাজের হলে তা বাস্তবায়ন করা যাবে না।
- অন্যায় ও অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তার অনুগামী না হওয়া।
* * *
চতুর্থত:
একজন মুসলিম নারীর নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের অধীনে আরও যা অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হল তার নিজেকে অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করা; শয়তানের পথসমূহ বন্ধ করা এবং কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। আর এখানে কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তার আলোকে কিছু বিশেষ দিক উল্লেখ করা হবে:
একজন মুসলিম নারীর নিজের ব্যাপারে দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের অধীনে আরও যা অন্তর্ভুক্ত হয়, তা হল তার নিজেকে অন্যায় ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করা; শয়তানের পথসমূহ বন্ধ করা এবং কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। আর এখানে কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তার আলোকে কিছু বিশেষ দিক উল্লেখ করা হবে:
- প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে সম্পর্কিত ইবাদতের নির্দেশের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করা থেকে সতর্ক থাকা; যেমন সালাত ও সাওমের ক্ষেত্রে অবহেলা করা; বিশেষ করে সময় মত সালাত আদায় না করা।
- আত্মার দুর্বলতা ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার প্রতি আস্থাহীনতা থেকে সতর্ক থাকা; আরও সতর্ক থাকা জাদুকর, ভেলকিবাজ, ভণ্ড ও প্রতারক, জ্যোতিষী, ভবিষ্যতবাণী পাঠকারী প্রমুখের মত কাফির, ফাসিক ও পথভ্রষ্টদের থেকে; আর আফসোসের বিষয় হল, ঐসব ব্যক্তিদের নিকট বারবার গমনকারীদের অধিকাংশই হল নারী।
- সামগ্রিকভাবে ছোট-বড় সকল প্রকার অন্যায় ও অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা এবং তাতে জড়িয়ে পড়া থেকে সতর্ক থাকা; আর এই ব্যাপারে নির্দেশ সংবলিত কুরআন ও সুন্নাহর অনেক বক্তব্য রয়েছে; সুতরাং যেই নস বা বক্তব্যই আনুগত্যের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করে, ঠিক সেই নস বা বক্তব্যই আবার প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে অন্যায় ও অবাধ্যতা থেকে সতর্ক করে।
- মুসলিম নারীদের মান-সম্মানের মধ্যে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা থেকে সতর্ক থাকা, যা অধিকাংশ নারীর মধ্যে ছড়িয়ে আছে; কারণ, গিবত (পরচর্চা) করা, কুৎসা রটনা করা, মিথ্যা কথা বলা এবং অমুক পুরুষ ও অমুক নারীর সমালোচনা করাটা তাদের মজলিস বা বৈঠকসমূহের মধুতে পরিণত হয়।
- পোষাক-পরিচ্ছদ ও সাধারণ বাহ্যিক দিকের ক্ষেত্রে নমনীয়তা বা ছাড় দেয়ার প্রবণতা থেকে সতর্ক থাকা, যা অধিকাংশ নারীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে; ফলে তারা খাট, খণ্ডিত, হালকা-পাতলা, বাহু নগ্নকারক, দৃষ্টি আকর্ষক ও কাফির নারীদের অনুসরণীয় পোষাক পরিধান করতে শুরু করেছে।
- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন সর্বক্ষেত্রে কাফির নারীদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা থেকে সতর্ক থাকা; আর সতর্ক থাকা তাদের (কাফির নারীদের) কর্মকাণ্ডে বিমুগ্ধ হওয়া থেকে। কারণ, মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ নারী চুল, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির আকৃতি ও ধরন-প্রকৃতির ক্ষেত্রে প্রত্যেক (বহিরাগত ও শরী‘আত গর্হিত) হৈচৈ সৃষ্টিকারী নারী-পুরুষের অনুসরণ করতে শুরু করে দিয়েছে।
এই হল এমন কিছু নমুনা, যা থেকে মুসলিম নারীর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক; আর যেমনিভাবে শরী‘আতের নিয়ম-কানুনের আনুগত্য করলে সাওয়াব দেয়া হয়, ঠিক তেমনিভাবে অন্যায়-অপরাধ পরিত্যাগ করার কারণেও সাওয়াব দেয়া হবে; সুতরাং আনুগত্যের কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে তার যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তেমনিভাবে অন্যায়-অপরাধ পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রেও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বড়।
দ্বিতীয় ক্ষেত্র: মুসলিম নারীর উপর তার ঘরের দায়িত্ব ও কর্তব্য
ঘর বা আবাসগৃহ হচ্ছে এমন একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার এই মৌলিক উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে: স্বামী, স্ত্রী, পিতা ও মাতা এবং সন্তান-সন্তুতি। সুতরাং তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রদত্ত নিয়ামতরাজির মধ্যে অন্যতম; তিনি বলেন:
“আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল।” - (সূরা আন-নাহল: ৮০); আর তার (ঘরের) প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে শুধু তারাই অবগত এবং তার কদর বা মর্যাদা শুধু তারাই অনুমান করতে পারবে, যারা বসবাস করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে, তাঁবুতে, মহাসড়কে, ব্রীজের নীচে ও পথে-ঘাটে। আর ঘরের মধ্যেই পরিবারের সদস্যগণ তাদের বৈশিষ্ট্য ও পরিপূর্ণ মর্যাদার নিয়ামত ভোগ করেন; এই ঘর তাদেরকে কঠিন গরম এবং ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা করে; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই মহান নিয়ামত দ্বারা তাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন; তিনি বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنۢ بُيُوتِكُمۡ سَكَنٗا ﴾ [ سُورَةُ النَّحۡل: 80 ]
“আর আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেন তোমাদের আবাসস্থল।” - ( সূরা আন-নাহল: ৮০ )।
ইবনু কাছির র. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
" يذكر تبارك وتعالى تمام نعمه على عبيده، بما جعل لهم من البيوت التي هي سكن لهم، يأوون إليها، ويستترون بها، وينتفعون بها سائر وجوه الانتفاع ".
“আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি প্রদত্ত পূর্ণ নিয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের জন্য এমন আবাসিক ঘরের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে তার আশ্রয় গ্রহণ করে; যার দ্বারা তারা নিজেদের ঢেঁকে রাখে এবং সকল প্রকার উপকার ভোগ করে।”[13]
আর এই ঘরের গুরুত্ব ও তার মহান মর্যাদার কারণে ইসলাম তার বিষয় ও কার্যক্রমসমূহকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহকে তার মৌলিক উপাদান অনুযায়ী বণ্টন করেছে; বিশেষ করে মৌলিকভাবে মুসলিম নারীর সাথে যা সংশ্লিষ্ট (তা), কেননা সে হচ্ছে ঘরের মধ্যে মা, অনুরূপভাবে স্ত্রী, কন্যা ও বোন; সুতরাং ঘরের মধ্যে তার অনেক বড় করণীয় রয়েছে এবং ঐ ঘর নামক রাষ্ট্রের মধ্যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যও অনেক বড়, যে রাষ্ট্রের অবকাঠামোকে ধ্বংস করার জন্য ইসলামের শত্রুগণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এ রাষ্ট্রটি হচ্ছে সমাজের প্রতি প্রসারিত এক বৃহৎ গবাক্ষ। সুতরাং যখন তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফলে ইসলামের শত্রুরা সমাজের অন্যতম প্রধান দু’টি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে; আর তা হল, যে কোন বয়সের নারী ও শিশু।
১. ঘরের মধ্যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের শর‘য়ী ভিত্তি:
ঘরে নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের ব্যাপারে শর‘য়ী ভিত্তি হচ্ছে, তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ ব্যাপক আমানতদারিতা হিসেবে নির্ধারিত হওয়ার উপর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَخُونُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ وَتَخُونُوٓاْ أَمَٰنَٰتِكُمۡ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٧﴾ [ سُورَةُ الأَنفَالِ: 27 ]
“হে মুমিনগণ! জেনে শুনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও বিশ্বাস ভঙ্গ করো না।” - ( সূরা আল-আনফাল: ২৭ )।
আর এই দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিরক্ষামূলক দায়িত্বে পরিণত হয়ে যায়, যা পালন করা প্রত্যেক নারীর উপর আবশ্যক, যেমনিভাবে তা পালন করা পুরুষের জন্যও আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ عَلَيۡهَا مَلَٰٓئِكَةٌ غِلَاظٞ شِدَادٞ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦﴾ [ سُورَةُ التَّحۡرِيمِ: 6 ]
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে।” - ( সূরা আত-তাহরীম: ৬ )।
আর শরী‘আত এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নজর দেয়, যাতে উভয় গৃহকর্তা স্বামী ও স্ত্রীর কল্যাণকর সীমারেখার মধ্যে ব্যাপক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ থাকে। কারণ, বুখারী ও মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته الإمام راع ومسؤول عن رعيته والرجل راع في أهله وهو مسؤول عن رعيته والمرأة راعية في بيت زوجها ومسؤولة عن رعيتها و في رواية "والمرأة راعية في بيت بعلها و ولده و هي مسؤولة عنهم" والخادم راع في مال سيده ومسؤول عن رعيته . قال وحسبت أن قد قال: والرجل راع في مال أبيه ومسؤول عن رعيته وكلكم راع ومسؤول عن رعيته» ( أخرجه البخاري و مسلم ).
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল (রক্ষণাবেক্ষণকারী), আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইমাম বা শাসক হলেন দায়িত্বশীল, আর তাকে তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবার ও সংসারের জন্য দায়িত্বশীল, আর তাকে তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর নারী তার স্বামীর ঘর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অপর এক বর্ণনায় আছে: ‘নারী তার স্বামীর ঘর ও তার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তাদের ব্যাপারে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ আর খাদেম (সেবক) তার মনিবের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ধারণা করি যে, তিনি (রাসূল) আরও বলেছেন: পুরুষ ব্যক্তি তার পিতার ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের সকলকেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”[14]
তেমনিভাবে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্যের ভারসাম্য রক্ষার করার উপর জোর দেয়।
সুনানের বর্ণনাকারীগণ আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায় হজে ভাষণ দিতে শুনেছেন; সুতরাং তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে যা শুনেছেন, তার অংশবিশেষ হল:
« ألا إن لكم على نسائكم حقا ولنسائكم عليكم حقا فأما حقكم على نسائكم فلا يطئن فراشكم من تكرهون ولا يأذن في بيوتكم لمن تكرهون ألا وحقهن عليكم أن تحسنوا إليهن في كسوتهن وطعامهن » ( أخرجه الترمذي و ابن ماجه ).
“জেনে রাখ! তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, অনুরূপভাবে তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে; সুতরাং তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হল, তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে যেতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর এবং তারা যেন তোমাদের ঘরের মধ্যে এমন কাউকে অনুমতি না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর। আরও জেনে রাখ! তোমাদের উপর তাদের অধিকার হল, তোমরা তাদের বস্ত্র ও অন্যের ব্যাপারে তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে।”[15]
২. ঐসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ:
(ক) আদর্শ স্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:
আর এই কর্তব্যের মূল হলো স্বামীর প্রতি তার দায়িত্ব। তার উপর তার স্বামীর অধিকার অনেক বড়, যা তার পিতা-মাতার অধিকারের চেয়েও বেশি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অধিকারের (হকের) পরেই তার অধিকারের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান। আর এই অধিকারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এসেছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖ﴾ [ سُورَةُ النِّسَاءِ: 34 ]
“পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন...” - ( সূরা আন-নিসা: ৩৪ ); সুতরাং সে তার (স্ত্রীর) ব্যাপারে দায়বদ্ধ ও তার পরিচালক এবং তার সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« لا يصلح لبشر ان يسجد لبشر ولو صلح لبشر ان يسجد لبشر لأمرت المرأة ان تسجد لزوجها من عظم حقه عليها ». ( رواه أحمد ).
“কোন মানুষের জন্য কোন মানুষকে সিজদা করা সঠিক নয়; আর কোন মানুষের জন্য কোন মানুষকে সিজদা করা যদি সঠিক হত, তবে আমি নারীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য; কেননা তার উপর তার স্বামীর বিরাট অধিকার (হক) রয়েছে।”[16]
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« أيما امرأة ماتت وزوجها عنها راض دخلت الجنة ». ( رواه الترمذي و ابن ماجه ).
“নারীদের যে কেউ মারা যাবে এমতাবস্থায় যে তার স্বামী তার উপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[17]
আর এই হক বা অধিকারের বিবরণ হচ্ছে:
- আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা নেই এমন সকল কাজে সাধারণভাবে তার আনুগত্য করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إذا صلت المرأة خمسها وصامت شهرها وحفظت فرجها وأطاعت زوجها قيل لها: أدخلي الجنة من أي أبواب الجنة شئت» ( أخرجه أحمد ).
“যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।” - (ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[18]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
« قيل لرسول الله صلى الله عليه و سلم أي النساء خير قال : التي تسره إذا نظر وتطيعه إذا أمر ولا تخالفه في نفسها ومالها بما يكره» ( أخرجه النسائي ).
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল: কোন নারী সবচেয়ে উত্তম? জবাবে তিনি বললেন: ঐ নারীই উত্তম, যে নারী তার স্বামীকে আনন্দ দেয় যখন সে তার দিকে তাকায়; তার আনুগত্য করে, যখন সে নির্দেশ দেয় এবং তার নিজের ও সম্পদের ব্যাপারে সে যা অপছন্দ করে তার বিরুদ্ধাচরণ করে না।” (ইমাম নাসায়ী হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[19]
- তার সাথে উত্তম আচরণ করা এবং তার কষ্ট লাঘব করা; আর এর উপরই নির্ভর করে তাকে সন্তুষ্ট করা এবং তার ব্যক্তিত্বকে রক্ষা করা; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« لا تؤذي امرأة زوجها في الدنيا إلا قالت زوجته من الحور العين لا تؤذيه قاتلك الله فإنما هو عندك دخيل يوشك أن يفارقك إلينا » ( أخرجه الترمذي و ابن ماجه ).
“দুনিয়াতে কোন স্ত্রী তার স্বামীকে কষ্ট দিলেই তার ডাগড় চক্ষুবিশিষ্ট হুরী স্ত্রী বলে উঠে: তুমি তাকে কষ্ট দেবে না; আল্লাহ তোকে ধ্বংস করুক! কারণ, সে তোর নিকট আগন্তুক, অচিরেই সে তোকে ছেড়ে আমাদের নিকট চলে আসবে। ” - ( ইমাম তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[20]
- তাকে ভালবাসা এবং তার বন্ধুর মতো হওয়া যে, সে তাকে দেখে হাসবে এবং তাকে সম্বোধন করার ক্ষেত্রে নম্রতা প্রদর্শন করবে। আর আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের নারীদের প্রশংসা করেছেন এইভাবে:
“সোহাগিনী ও সমবয়স্কা।” - ( সূরা আল-ওয়াকিয়া: ৩৭ ); العروب মানে- তার স্বামীর নিকট সে সোহাগিনী।
- সে তার (স্বামীর) অনুপস্থিতিতে নিজেকে ও তার ধন-সম্পদকে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এই ব্যাপারে পূর্বে আলোচনা হয়েছে।
- সে তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল সাওম (রোযা) পালন করবে না; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« لا يحل للمرأة أن تصوم وزوجها شاهد إلا بأذنه ولا تأذن في بيته إلا بأذنه ... » ( أخرجه البخاري و مسلم).
“স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীর জন্য সাওম (নফল রোযা) পালন করা বৈধ নয়; আর স্বামীর অনুমতি ছাড়া অন্য কাউকে তার গৃহে প্রবেশ করতে দেবে না ...।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[21]
- স্ত্রী কর্তৃক তার স্বামীর ঘরকে সংরক্ষিত রাখা। সুতরাং সে তার ঘরে কোন অপরিচিত পুরুষ অথবা এমন কোন ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটাবে না, যার অনুপ্রবেশকে তার স্বামী অপছন্দ করে, যদিও সেই ব্যক্তিটি তার ভাই হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« ألا إن لكم على نسائكم حقا ولنسائكم عليكم حقا فأما حقكم على نسائكم فلا يطئن فراشكم من تكرهون ولا يأذن في بيوتكم لمن تكرهون ألا وحقهن عليكم أن تحسنوا إليهن في كسوتهن وطعامهن » ( أخرجه الترمذي و ابن ماجه ).
“জেনে রাখ! তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, অনুরূপভাবে তোমাদের উপরও তোমাদের স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে; সুতরাং তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হল, তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে যেতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর এবং তারা যেন তোমাদের ঘরের মধ্যে এমন কাউকে অনুমতি না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর। আরও জেনে রাখ! তোমাদের উপর তাদের অধিকার হল, তোমরা তাদের বস্ত্র ও অন্যের ব্যাপারে তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে।”[22]
- সে তার উপর অন্ন ও বস্ত্রসহ এমন ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেবে না, যার সামর্থ্য তার নেই। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ لِيُنفِقۡ ذُو سَعَةٖ مِّن سَعَتِهِۦۖ وَمَن قُدِرَ عَلَيۡهِ رِزۡقُهُۥ فَلۡيُنفِقۡ مِمَّآ ءَاتَىٰهُ ٱللَّهُۚ ﴾ [ سُورَةُ الطَّلَاقِ: 7 ]
“বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত, সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে।” - ( সূরা আত-তালাক: ৭ )।
- বিশেষ প্রয়োজনের মুহূর্তে তার চাহিদা পূরণ করা এবং কোন নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়া তাকে নিষেধ না করা। বিশুদ্ধ হাদিসের মধ্যে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« إذا دعا الرجل امرأته إلى فراشه فأبت أن تجيء لعنتها الملائكة حتى تصبح » ( أخرجه البخاري و مسلم).
যখন কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তার সাথে একই বিছানায় শোয়ার জন্য আহ্বান করে, আর তার স্ত্রী সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা ঐ মহিলার উপর লা‘নত (অভিশাপ) বর্ষণ করতে থাকে।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[23]
- স্বামীর জন্য সাজগোছ করা, যাতে নিজের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করা যায়। এর ফলে স্বামী তার দৃষ্টিকে অবনমিত রাখবে এবং তাকে হারামের মধ্যে ছেড়ে দেবে না। স্ত্রীর তাই উচিত নিজেকে এমন বস্তুর দ্বারা সুসজ্জিত করার চেষ্টা করা, যাতে স্বামী আকৃষ্ট হয়; ফলে তার চোখ সুন্দরের প্রতি পড়বে এবং তার নাক দ্বারা সে সুন্দর ঘ্রাণই পাবে; যেমনিভাবে সে তাকে কোমল কথা ও উত্তম বক্তব্য ব্যতীত অন্য কোন মন্দ কথা শুনাবে না।
- তার অনুগ্রহের স্বীকৃতি প্রদান এবং তার নিয়ামতের অকৃতজ্ঞ না হওয়া; আর তার ভাল আচরণকে অস্বীকার করবে না। বিশেষ করে যখন সে তার কাছ থেকে ব্যয় ও দানশীলতার মানসিকতা লক্ষ্য করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« تَصَدَّقْنَ فَإِنَّ أَكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ. فَقَامَتِ امْرَأَةٌ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ سَفْعَاءُ الْخَدَّيْنِ فَقَالَتْ لِمَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: لأَنَّكُنَّ تُكْثِرْنَ الشَّكَاةَ وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيرَ » ( أخرجه مسلم).
“তোমরা সাদকা কর। কারণ, তোমাদের অধিকাংশ হবে জাহান্নামের ইন্ধন। অতঃপর মহিলাদের মধ্য থেকে একজন মহিলা দাঁড়াল, যার উভয় গালে কাল দাগ ছিল; সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! তা কেন? তিনি বললেন: তোমরা বেশি অভিযোগ করে থাক এবং উপকারকারীর উপকার অস্বীকার কর।” - ( ইমাম মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন);[24] অপর এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« لَوْ أَحْسَنْتَ إِلَى إِحْدَاهُنَّ الدَّهْرَ ثُمَّ رَأَتْ مِنْكَ شَيْئًا قَالَتْ مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَطُّ » ( أخرجه البخاري و مسلم).
“তুমি যদি দীর্ঘকাল তাদের কারও প্রতি ইহসান করতে থাক, অতঃপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখলেই বলে, ‘আমি কখনও তোমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাইনি’।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[25]
- স্বামীর অনুমতি ব্যতীত তার ঘর থেকে বের না হওয়া; যদিও পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হোক না কেন। আর এই ব্যাপারে অনেক হাদিস রয়েছে।
- খাওয়া-দাওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির মত স্বামীর ঘর-গৃহস্থালির কাজসমূহ সে সম্পাদন করবে। অনুরূপভাবে তার স্বামীর বিশেষ কাজগুলো সম্পাদন করবে; যেমন: তার পোষাক-পরিচ্ছদ প্রস্তুত করা ও তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেয়া; তার খাবার প্রস্তুত করা ইত্যাদি। ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. আসমা বিনতে আবি বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র হাদিস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
« تزوجني الزبير وما له في الأرض من مال ولا مملوك ولا شي غير ناضح وغير فرسه فكنت أعلف فرسه وأستقي الماء وأخرز غربه وأعجن ... » ( أخرجه البخاري و مسلم).
“যখন যুবায়ের রা. আমাকে বিয়ে করলেন, তখন তার কাছে কোন ধন-সম্পদ ছিল না, এমনকি কোন স্থাবর জমি-জমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধু কুয়ো থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তাঁর উট ও ঘোড়া চরাতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম; ...।”[26]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্য ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা গম পেষার চাক্কি ঘুরানোর কারণে ফোস্কা পড়া হাত নিয়ে তার কষ্টের কথা ব্যক্ত করলেন এবং একজন খাদেম দাবি করলেন, যে এসব কাজে তাঁকে সহযোগিতা করবে; তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
« ألا أدلكما على ما هو خير لكما من خادم ؟ إذا أويتما إلى فراشكما أو أخذتما مضاجعكما فكبرا ثلاثا وثلاثين وسبحا ثلاثا وثلاثين واحمدا ثلاثا وثلاثين فهذا خير لكما من خادم » ( أخرجه البخاري و مسلم).
“আমি তোমাদেরকে এমন একটি আমলের কথা বলে দেবনা, যা তোমাদের জন্য একটি খাদেমের চেয়েও অনেক বেশি উত্তম? যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করতে যাবে, তখন তোমরা “আল্লাহু আকবার” তেত্রিশ বার, “সুবহানাল্লাহ” তেত্রিশ বার এবং “আলহামদু লিল্লাহ” তেত্রিশ বার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য একটি খাদেমের চেয়েও অনেক বেশি উত্তম।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[27]
(খ) মা হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:
মায়ের জন্য রয়েছে বড় রকমের অধিকার; বরং আল্লাহ তা‘আলার অধিকারের পরে সবচেয়ে বড় অধিকার হল মায়ের। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [ سُورَةُ الإِسۡرَاءِ: 23 – 24 ]
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। মমতাবেশে তাদের প্রতি নম্রতার পাখা অবনমিত করবে এবং বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন’।” - ( সূরা আল-ইসরা: ২৩ -২৪ ); এই আয়াতের সাথে অর্থগতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরও অনেক আয়াত রয়েছে।
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال يا رسول الله من أحق الناس بحسن صحابتي ؟ قال ( أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أمك ) . قال ثم من ؟ قال ( ثم أبوك ». (أخرجه البخاري و مسلم).
“এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বললেন: তোমার মা। লোকটি বলল: তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা। লোকটি বলল: তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা। লোকটি বলল: তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার পিতা।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[28]
আর এই অধিকারটি বাস্তবায়িত হয় কথা, কাজ ও সম্পদের মাধ্যমে ইহসানকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর এই অধিকারের বিনিময়ে তার উপর আবশ্যক হয়ে পড়ে গুরু দায়িত্ব পালন ও বড় রকমের আমানতের সংরক্ষণ করা। বরং তা এই জীবনে তার মহান দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহের অন্যতম। আর এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের সূচনা হল— আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ عَلَيۡهَا مَلَٰٓئِكَةٌ غِلَاظٞ شِدَادٞ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦﴾ [ سُورَةُ التَّحۡرِيمِ: 6 ]
“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মমহৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে।” - ( সূরা আত-তাহরীম: ৬ )।
হাসান র. বলেন: তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দাও এবং কল্যাণের প্রশিক্ষণ দাও।
বিশুদ্ধ হাদিসের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته ... » ( أخرجه البخاري و مسلم ).
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল (রক্ষণাবেক্ষণকারী), আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ... ।” - ( ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)। [29]
ইমাম ইবনুল কায়্যিম র. বলেন: “পিতা-মাতার প্রতি তাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ সন্তানদের প্রতি তাদের পিতা-মাতার ব্যাপারে নির্দেশের উপর অগ্রগামী; সুতরাং যে ব্যক্তি তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে অবহেলা করে এবং তাকে অনর্থক ছেড়ে দেয়, তবে সে তার প্রতি চরম খারাপ আচরণ করল। আর অধিকাংশ সন্তানের জীবনে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা নেমে আসে তাদের পিতা-মাতার কারণে; কেননা তারা তাদের প্রতি অযত্ন ও অবহেলা করে এবং তাদেরকে দীনের ফরয ও সুন্নাতসমূহ শিক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকে। তারা তাদেরকে ছোট অবস্থায় নষ্ট করেছে, ফলে বড় হয়ে তারা তাদের নিজেদের ও পিতা-মাতাদের উপকার করবে না। যেমনিভাবে এক ব্যক্তি তার সন্তানের অবাধ্যতার অভিযোগ করলে সন্তান বলে: হে আমার পিতা! আমার ছোট বেলায় তুমি আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছ, আর আমি তোমার বৃদ্ধ বয়সে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি; তুমি আমাকে শিশু অবস্থায় নষ্ট করেছ, আর আমি তোমার বৃদ্ধ অবস্থায় তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি।”[30]
পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে এটা একটা মোটামুটি বর্ণনা; তবে মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল নিম্নরূপ:
প্রথমত: তার সন্তানের পিতা নির্বাচন করা:
নারীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যের সূচনা হল তার শিশু সন্তানদের পিতা গ্রহণের ক্ষেত্রে বর বাছাইয়ের জটিল ধাপ বা স্তরটি। যে কেউ তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা পোষণ করে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেই সে তা গ্রহণ করবে না; বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণযোগ্য স্বামী নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন:
«إذا أتاكم من ترضون خلقه ودينه فزوجوه . إلا تفعلوا تكن فتنة في الأرض وفساد عريض » ( أخرجه الترمذي و ابن ماجه ).
“যখন তোমাদের নিকট এমন কোন ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দীনদারীতে তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না কর, তবে তা পৃথিবীর মধ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।” - (ইমাম তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)। [31]
মানদণ্ড হল তিনটি বিষয়: দীন, চরিত্র ও আকল:
যখন এই তিনটি বিষয় ব্যক্তির মধ্যে পূর্ণতা লাভ করে, তখন সে তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে। বর্তমান দিনের অধিকাংশ মানুষ এর বিপরীতে তার ধন-সম্পদের আধিক্য, অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, অথবা তার সরকারি চাকরি, অথবা সামাজিক মর্যাদা, অথবা তার চেহারা-ছবি, অথবা তার যশ-খ্যাতিসহ ইত্যাদি বিচার করে। অথচ এ ধরনের সকল মানদণ্ড রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ডের মোকবিলায় কিছুই নয়।
কেন? তার কারণ হল, সৌভাগ্য, পবিত্র বা উত্তম জীবন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম পরিণতি এই মানদণ্ডের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
সুতরাং বেদীন স্বামীর কারণে স্ত্রী যুলুমের শিকার হবে; আর তার সন্তানগণ হবে ধ্বংস ও বিচ্যুতির শিকার।
আর স্বামীর নৈতিকতার অভাবে স্ত্রী তার দুর্ব্যবহারের শিকার হবে এবং তার সন্তানগণ ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ধ্বংসের শিকার হবে।
আর স্বামীর নির্বুদ্ধিতার কারণে স্ত্রী অশান্তি ও দুর্বিসহ জীবনের অধিকারী হবে; আর তার সন্তানগণ হবে অস্থিরতার শিকার। সুতরাং ধার্মিক, চরিত্রবান ও বুদ্ধিমান পিতা হলেন এমন, যিনি তার (স্ত্রীর) সন্তানদেরকে প্রতিপালন করবেন ও শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে যথাযথভাবে লালন-পালন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করবেন; আর তাদেরকে উত্তম চরিত্র ও আচার-আচরণের ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন।
দ্বিতীয়ত: ভ্রুণ অবস্থায় তার রক্ষণাবেক্ষণ করা:
তার জরায়ুর মধ্যে বীর্য প্রবেশের দিন থেকেই ভ্রণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা; সুতরাং সে তার সুস্থতা এবং তার জন্য উপকারী বিষয়সমূহের প্রতি যত্নবান হবে; আর তা সম্ভব হবে তার খাওয়া-দাওয়া, পান করা ও নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে। সুতরাং জেনে রাখা দরকার যে, গর্ভবতী তার দীর্ঘ গর্ভাকালীন সময়ের মধ্যে অনেকগুলো পরিস্থিতির শিকার হয়; ফলে সে এই দিকে মনোযোগ দেবে, যাতে তার গর্ভস্থিত সন্তান নিরাপদে বের হয়ে আসে; আর এটা তাকে সুস্থ, স্বাস্থ্যসম্মত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তাকে লালন-পালনে সহযোগিতা করবে।
তৃতীয়ত: প্রসূত সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করা:
- তাকে প্রসব করার সময় তার অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার পিতার সাথে এই পর্যায়ে নিম্নলিখিতরূপে সহযোগিতা করা:
- তার ডান কানে আযান দেয়া, যাতে সে প্রথমেই তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের কথা শুনতে পায়।
- সুন্দর নাম দ্বারা তার নাম রাখা। আর খারাপ নাম দ্বারা নাম রাখা থেকে, অথবা খারাপ অর্থ বহন করে এমন নাম দ্বারা নামকরণ করা, অথবা কাফিরদের নামে নাম রাখা, অথবা শরী‘আত কর্তৃক নিষিদ্ধ নামে নামকরণ করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা।
- তার জন্মের সপ্তম দিনে তার নাম রাখার সাথে সাথে তার মাথার চুল মুণ্ডন করা।
- তার মাথার চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য দ্বারা সাদকা করা।
- তার পক্ষ থেকে আকিকা করা; আর তা এইভাবে যে, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ছাগল দ্বারা, আর মেয়ের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দ্বারা; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
- « الغلام مرتهن بعقيقية يذبح عنه يوم السابع ويسمى ويحلق رأسه ». (أخرجه الترمذي و أبوداود و النسائي و ابن ماجه).
“প্রত্যেক প্রসূত সন্তান স্বীয় আকিকার সাথে আবদ্ধ। তার পক্ষ থেকে তা তার জন্মের সপ্তম দিনে যবাই করতে হবে। সেদিন তার নাম রাখতে হবে এবং তার মাথা মুণ্ডন করতে হবে।” (ইমাম তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[32]
- তাওহীদ তথা একত্ববাদের ভিত্তিতে কথা বলার উপর তাকে অভ্যস্ত করানো এবং তার প্রাণে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিষয়াদির বীজ বপন করা; বিশেষ করে প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই তা করতে হবে। সুতরাং গবেষকদের কেউ কেউ উল্লেখ করেন যে, শিশু তার প্রথম বছরগুলোতেই তার পূর্বপুরুষদের অধিকাংশ চিন্তাচেতনার আলোকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে; কারণ, ৯০% শিক্ষা-বিষয়ক কার্যক্রম তার প্রথম বছরগুলোতেই সম্পন্ন হয়। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল এই সময়কালকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, যা কিছুক্ষণ পূর্বে আলোচিত হয়েছে এবং যার বিস্তারিত আলোচনা অচিরেই আসছে। ইবনুল জাউযী র. বলেন: ছোট বয়সে যা হয়, তাকেই আমি বেশি মূল্যায়ন করি; কেননা যখন সন্তানকে তার স্বভাবের উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তখন সে তার উপরই বেড়ে উঠে; আর স্বভাব একটি কঠিন বিষয়, কবি বলেন:
যখন তুমি গাছের ডালকে সোজা করতে চাইবে, তখন তা সোজা হয়ে যাবে
আর যখন তুমি শুকনো কাঠকে সোজা করতে চাইবে, তখন তা নরম হবে না;
আদব-কায়দা তরুণ সমাজকে উপকার করে, যেমনটি ঘটে লোহার মধ্যে
আর বয়স্ক লোকের মধ্যে আদব-কায়দা তেমন কোন উপকার করে না।
আর এখানে যা উল্লেখ করার মত, তা হলো,
- শিশুকে নিম্নোল্লেখিত যিকিরসমূহ উচ্চারণে অভ্যস্ত করা: لا إله الا الله, محمد رسول الله (আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ), سبحان الله (আল্লাহ পবিত্র), الحمد لله (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য),الله أكبر (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ), لا حول و لا قوة إلا بالله ( আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন ক্ষমতা নেই এবং কোন শক্তি নেই ), ইত্যাদি।
- শিশুর মনে আল্লাহর ভালবাসার বীজ রোপন করা।
- তার মনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তার ভয়ের অপরিহার্যতার বীজ বপন করা।
- তার মনে মানুষের উপর আল্লাহর নজরদারী ও খবরদারীর বীজ রোপন করা।
- তাকে ভাল কথা বলার অভ্যাসে অভ্যস্ত করা, যেমন: أحسنت (তুমি সুন্দর করেছ), شكرا (ধন্যবাদ), جزاك الله خيرا(আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
- তাকে গুরুত্বপূর্ণ দো‘আসমূহ, ঘুম, খাওয়ার (পূর্বাপর) এবং বিভিন্ন স্থানে প্রবেশের যিকির তথা দো‘আসমূহ পাঠ অভ্যস্ত করা।
- শিশুদেরকে (আল্লাহর) আশ্রয়ে দেয়া, যেমনটি করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হোসাইনের সাথে[33]; যেমন অভিভাবক বলবে:
- «أعيذك بكلمات الله التامة من كل شيطان وهامة ومن كل عين لامة»
“আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাসমূহের অসীলায় প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টিসম্পন্ন চোখ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে দিচ্ছি।” যাতে শয়তান তাদেরকে শিকার করতে পারে না।
- আরও বিশেষভাবে তিনি যা উল্লেখ্য, -যদিও তা পূর্বে উল্লেখিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে-: তা হল, তাকে শুরুতে ঘরের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (আল-কুরআনুল কারীম) মুখস্থ করাবে এবং তাকে তা শুনাবে। আর অনুরূপভাবে সুন্নাতে নববী তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস থেকে কিছু মুখস্থ করাবে, বিশেষ করে ছোট ছোট হাদিসসমূহ।
- শিশুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনীসমূহ থেকে কিছু আলোচনা করা; বিশেষ করে সীরাতে নববী তথা নবীর জীবনী থেকে ঐ পর্যায়ের বিষয়গুলো থেকে আলোচনা করা, যা সে বয়সের যে স্তরে জীবনযাপন করছে, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, ঐ কাহিনীসমূহ তার মধ্যে বড় রকমের শিক্ষামূলক প্রভাব ফেলবে এবং তার মনে উন্নত ও শক্তিশালী চরিত্রের বীজ বপন করবে; আর সে প্রত্যাশা করবে, সে যেন ঐসব ব্যক্তিবর্গের মত হতে পারে, যাদের কাহিনী সে শ্রবণ করেছে।
- শিশুর মধ্যে তার ছোটকাল থেকেই উন্নত মানের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের ব্যাপারে আশা-আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলা এইভাবে যে, সে মনে মনে পরিকল্পনা স্থির করবে যে, সে অমুকের মত আলেম (বিদ্বান) হবে, অথবা অমুকের মত ডাক্তার হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
- শিশুর আগ্রহ ও ইচ্ছাসমূহ প্রকাশ করতে এবং তার আল্লাহ প্রদত্ত মেধাসমূহের বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করা; সুতরাং উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: যখন দেখা যায় যে, সে পড়ার প্রতি আগ্রহী, তখন সে তাতেই তাকে নিয়োগ করে দেবে এবং তার জন্য সংশ্লিষ্ট বইপত্রের ব্যবস্থা করে দেবে; আর যখন সে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হবে, তখন তাকে ঐ খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দেবে, যা তার শক্তি ও মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখবে ... অনুরূপভাবে আরও অন্যান্য বিষয়ও হতে পারে।
- আর সাত বছর বয়সের সময় শিশুর সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নতুন আরেক ধাপের সূচনা হয়; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কতগুলো মৌলিক সাইনপোস্ট (Signpost) ঠিক করে দিয়েছেন তাঁর বাণীর মাধ্যমে, তিনি বলেছেন:
«مروا أبناءكم بالصلاة لسبع سنين واضربوهم عليها لعشر سنين وفرقوا بينهم في المضاجع ». (أخرجه الإمام أحمد و أبو داود).
“তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা সালাতের নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয় এবং তার কারণে তাদেরকে প্রহার কর, যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয়। আর তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।” ( ইমাম আহমদ ও আবূ দাউদ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[34] আর এই সাইনপোস্টগুলো হল:
- শিশুকে সালাতের নির্দেশের দ্বারা শুরু করা, যা ইবাদতসমূহের মধ্যে প্রধান এবং তাকে এই দিকে মনোযোগী করা ও তার প্রতি উৎসাহিত করা। আর এই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে সাওমের (রোযার) মত অপরাপর সকল ইবাদতও। আর তাকে এই কাজে অভ্যস্ত করে তোলা। আর সে উপলব্ধি করবে যে, তার সকল কার্যক্রমই ইবাদত, যার মাধ্যমে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করবে।
- দশম বছরে উপনীত হওয়ার পর বার বার নির্দেশ লঙ্ঘন করলে মৃদু প্রহার করা।
- ঘুমের সময় নারী-পুরুষদের পরস্পর থেকে দূরে রাখা।
০ ০ ০
পূর্ববর্তী ধাপগুলোতে যা সহযোগিতা করবে, তা হল নিম্নোক্ত প্রশিক্ষণ পদ্ধতিসমূহ:
(ক) শারীরিক শাস্তি ছাড়া অপরাপর শাস্তি প্রদান:
আর এই শাস্তি তখন দেয়া হবে, যখন তার পক্ষ থেকে বার বার সালাত তরক (পরিত্যাগ) করা হবে; যেমন: তাকে নির্ধারিত উপহার দেয়া থেকে বঞ্চিত করা, প্রহারের হুমকি দেয়া এবং তার চাহিদা পূরণের আহ্বানে সাড়া না দেয়া ...ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর শারীরিক শাস্তি হবে মৃদু শাস্তি, কঠোর নয়; আর এই ধরনের শাস্তি কেবল তখনই কার্যকর করা হবে, যখন তার দশ বছর পূর্ণ হবে এবং তার পক্ষ থেকে বার বার সালাত তরক (পরিত্যাগ) করা হবে; আর এই শাস্তিবিধানের সময় শরীরের স্পর্শকাতর স্থানসমূহ থেকে দূরে থাকতে হবে, যেমন: ঘাড়, পেট ও মাথা।
(খ) পুরুষ ও নারী জাতির জাতিগত বিশেষত্বের তাগিদ দেওয়া:
ছেলে ও মেয়ের প্রত্যেকের জন্য যে একে অপরের থেকে পৃথক বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে বিষয়ে তাকে অবহিত করা; আর এই অবহিতকরণের কাজ শুরু হবে তাদের বয়স দশম বছর পূর্ণ হওয়ার সময় থেকে তাদের বিছানা আলাদা করার মাধ্যমে। আর এটা একে অপরের নিকটবর্তী হওয়ার ও অশ্লিলতার পথ বন্ধ করার জন্য এবং স্বাতন্ত্রবোধ ও একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের অনুশীলনের জন্যও এই ব্যবস্থা।
(গ) নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচারের উপর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ:
আর এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত— চারিত্রিক কর্মকাণ্ডের উপর তাদের অনুশীলন এবং তার উপর তাদেরকে অভ্যস্ত করানো। যেমন: আচার-আচরণে এবং কাজে ও কর্মে সত্যবাদিতার নীতি অবলম্বন করা; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা।
(ঘ) কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দান:
ছোট বয়সে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যা সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে, তা হল শিশুদের কর্মকাণ্ডের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে উৎসাহদান। তারা ছোট হলেও তাদের উপর এর অনেক প্রভাব রয়েছে।
(ঙ) বন্ধু-বান্ধবকে পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ:
ছোটবেলা থেকেই বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীর কর্মকাণ্ডের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা এবং এ ব্যাপারটি উপেক্ষা না করা। কারণ, সে তার বন্ধুর কাছ থেকেই কথা বলা, স্বভাব-প্রকৃতি ও কর্মকাণ্ডের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। অতএব তাকে এমন বন্ধুর নিকটবর্তী করাবে, যে উত্তম পরিবেশে জীবনযাপন করে এবং এমন সাথীর সঙ্গ থেকে দূরে থাকবে, যে মন্দ পরিবেশে জীবনযাপন করে।
চতুর্থত: তাকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তত্ত্ববধান করা:
আর এই বয়সে এসে পিতা-মাতার দায়-দায়িত্ব বেড়ে যায়। এখানে কয়েকটি বিষয়ে মায়ের দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত হয়:
- দায়িত্ব পালন ও যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে তার পিতার সাথে সহযোগিতা করা।
- গৃহে তত্ত্বাবধান। এই তত্ত্বাভধানের অন্তর্ভুক্ত: ভাল ও কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করা এবং এর ব্যতিক্রম করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সাবধান করা।
- ছেলে অথবা মেয়েকে তার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনুভূত করা। সে যদি ছেলে হয়, তবে অনুধাবন করাবে যে, সে পুরুষদের কাতারে পৌঁছেছে; তাকে পুরুষত্ব ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেবে। আর এই দায়িত্বটি যদি সম্ভব হয় তবে পিতার জন্যই বহন করা জরুরি। আর যদি সে কন্যা হয়, তবে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করাবে। যেমন: তার ভবিষ্যত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনুশীলন করা, তাকে বিশেষ তত্ত্বাবধান করা, তার যত্ন নেয়া, তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া, তার পড়াশুনা ও অধ্যাবসায়ের দিকে মনোযোগ দেয়া এবং তারা পাঠসমূহ ও পোষক-পরিচ্ছদের বিষয়টি তদারকি করা।
- মেয়ের কাজে তার সাথে অংশ নেওয়া। এটি শুরু করতে হবে তার সাথে বন্ধুসুলভ ব্যবহারের মাধ্যমে। আর তাকে বোঝাতে হবে যে, সে তার মা হওয়ার সাথে সাথে একজন বান্ধবীও বটে। এতে করে পরবর্তীতে মেয়ে তার কাছ থেকে এমন কোন কিছু গোপন করবে না, যা অনেক সময় তার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- মেয়েকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্মের কিছু দায়িত্ব প্রদান করা এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে এমনভাবে উপেক্ষা না করা, যাতে কোন দায়-দায়িত্ব বহন না করেই সে সকল জিনিস হাতের কাছে প্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যায়।
- সকল সম্পাদিত কাজের ব্যাপারে পিতাকে অবহিত করা এবং বিশেষ করে এই স্তরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে তাকে অংশগ্রহণ করানো, আর ছেলে হউক অথবা মেয়ে হউক সন্তানদের কোন বিষয়ই তার নিকট গোপন না করা।
এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যের গভীরতাই জোর দিয়ে থাকে যে, মা হলেন শিশুর পরিচর্যাকারিনী, লালনপালনকারিনী, তত্ত্বাবধায়ক, শিক্ষিকা, পরিচালিকা ও সম্পাদিকা। তিনি হলেন একাধারে জ্ঞানীদের জননী, কীর্তিমানদের লালনপালনকারিনী ও শিক্ষিকা, শ্রমিক ও কৃষকের প্রশিক্ষক, বীর পুরুষ তৈরির কারিগর এবং মহৎ গুণাবলি রোপণকারিনী। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা মোটেই সহজ কাজ নয়—যেমনটি অনেক মায়েরা ভাবেন— বরং তিনি হলেন পৃথিবীর বুকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর কারণ হল, মহৎ ব্যক্তি, আলেম-জ্ঞানী, মুজাহিদ (আল্লাহর পথে জিহাদকারী), দা‘ঈ (আল্লাহর পথে আহ্বানকারী) এবং সৎকর্মশীলদের কারও আবির্ভাব হত না, যদি না তার পিছনে প্রশিক্ষক জ্ঞানী মায়েরা না থাকতেন।
(গ) আদর্শ কন্যা হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:
কন্যা হচ্ছে সেই মূলেরই শাখা। আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা মহান অনুগ্রহের মাধ্যমে তাকে বিশেষিত করেছেন, যার কারণে সে ছেলের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের হতে পারে, যদি তাকে যথাযথভাবে যেমনটি আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা শরী‘আতের বিধান হিসেবে অর্পণ করেছেন সেভাবে লালনপালন করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ ». وَضَمَّ أَصَابِعَهُ. (أخرجه مسلم)
“যে ব্যক্তি দু’টি কন্যাকে প্রাপ্তবয়স্কা হওয়া পর্যন্ত লালনপালন করে, কিয়ামতের দিন সে হাজির হবে এমতাবস্থায় যে, আমি এবং সে এভাবে থাকব—” বলে তিনি তাঁর আঙুলসমূহকে একত্রিত করে দেখালেন।- (ইমাম মুসলিম র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)।[35]
কন্যা দুর্বলতা ও শান্ত-শিষ্টতার কারণে তার পিতা-মাতার অন্তর বিশেষভাবে দখল করে থাকে।
আর যেমনিভাবে কন্যার জন্য পিতা-মাতার উপর অধিকার স্বীকৃত আছে, যা পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহের মধ্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে কন্যাও এই দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে মুক্ত নয়। কন্যা হিসেবে নারীর অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ নিম্নরূপ:
- ব্যক্তিগত দায়িত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করা, যেমন: শিক্ষালাভ ও শিক্ষা দান। একজন নারী তার মা ও ভাল শিক্ষিকাদের সহযোগিতা নিয়ে নিজের জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত একটি পরিপূর্ণ সিলেবাস/প্রোগ্রাম গ্রহণ করবে, যা শরয়ী জ্ঞান, আরবি, শিষ্টাচারিতা, তাফসীর, হাদিস, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান ও নারী বিষয়ক জ্ঞান ইত্যাদিসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করবে, যার বিবরণ নারীর নিজের প্রতি শিক্ষাবিষয়ক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
- আল্লাহ ত‘আলার বাণীর অনুসরণে পিতা-মাতার আনুগত্য করা এবং এই ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ﴾ [ سُورَةُ الإِسۡرَاءِ: 23 ]
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” - (সূরা আল-ইসরা: ২৩)। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, অধিকাংশ কন্যাদেরকে দেখা যায় তারা এই আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীন। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পিতামাতার চাইতে বান্ধবীদের অনুসরণ করে এবং তাদেরকে অগ্রধিকার দেয়। এটা ছেলে-মেয়ে উভয়েরই বড় ধরনের অন্যায়। এই ক্ষতি ভবিষ্যতে তাদের কাছেই ফিরে আসবে। কেননা, নিঃসন্দেহে পিতা-মাতার আনুগত্য এমন এক ঋণ, যা শীঘ্রই ফেরত আসবে।
- মায়ের বিভিন্ন কর্তব্যে সাধ্যমত সহযোগিতা করা। উদাহরণস্বরূপ:
- রান্নবান্না, ধোয়া-মোছা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করা; পুরাপুরিভাবে কাজের মহিলা-নির্ভর না হওয়া। কারণ, এই নির্ভরতা মেয়েকে এক অদক্ষ বা অকর্মায় পরিণত করবে, ফলে সেই মেয়ে ভবিষ্যতে তার ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হবে।
- ছোট ভাই ও বোনদের লালনপালন এবং নৈতিকতা ও উন্নত চারিত্রিক শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে তার মাকে সার্বিক সহযোগিতা করা (আমরা মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রসঙ্গে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি)।
- পূর্বে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্বে মায়ের প্রতিনিধিত্ব করা।
- মা মুর্খ হলে তাকে শিক্ষা দেওয়া। বিশেষ করে এমন বিষয়গুলো শিখিয়ে দেওয়া, যাতে তার দীন পালন করতে পারে। যেমন: সালাত এবং সালাতের মধ্যে পঠিত কুরআন ও যিকির-আযকারের প্রশিক্ষণ দেয়া; অবসর সময়ে তার নিকট এমন কিছু শিক্ষণীয় বিষয় পাঠ করবে, যা তার উপকারে আসবে। আর এই ব্যাপারে অনেকেই অমনোযোগী ও উদাসীন। নারীদের অনেকের ব্যাপারে এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, তারা (উদাহরণস্বরূপ) সূরা ফাতিহাই পাঠ করতে জানে না অথচ তার কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা উচ্চ-মাধ্যমিক ছাত্রী। সেখানে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের দায়-দায়িত্ব কন্যাদের উপরই বর্তায়।
নিম্নোক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা:
- এমন কাজে সময় অতিবাহিত করা, যাতে কোন উপকার নেই: যেমন: বিভিন্ন প্রকার মিডিয়া অনুসরণ করা এবং অপরাপর এমন সব যোগযাযোগের মাধ্যমের পেছনে আত্মনিয়োগ করা, যার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে বহু সময় অন্যায়-অপরাধে, খেল-তামাশায় ও অনর্থক কাজে নষ্ট হয়। অথচ মানুষকে তার সময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। সময়ই তার বয়স ও জীবন, আর তা জগতের সবচেয়ে দামী জিনিস। যখন তা এসব মিডিয়া ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যয় করবে, তখন তা হবে তার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য খারাপ পরিণতি ও ক্ষতির কারণ। অথচ অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের ব্যাপার হল, অধিকাংশ মেয়ের সময়গুলো বরাদ্দ থাকে এসব মিডিয়া, খারাপ বান্ধবীদের সাথে আড্ডা, মার্কেট এবং টেলিফোনে— যার ফলে নষ্ট হচ্ছে বহু কাজ, ধ্বংস হচ্ছে সময় এবং হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা।
- খারাপ বান্ধবী সকল, যারা জ্বলন্ত আগুনের মত— যখন তার মধ্যে কোন কিছু পতিত হবে, তখন তা তাকে জ্বালিয়ে দেবে। এই যুগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগযাযোগের মাধ্যম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; তাই প্রত্যেকটি মেয়ে যেন এসব খারাপ বান্ধবী থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে। তাদের চিহ্ন হল তারা অন্যদের জন্য খারাপ জিনিস ও উপায়-উপকরণ আমদানি করে; তারা দুষ্কর্ম ও বিশৃঙ্খলাকে পছন্দ করে ও করায়, তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সৎকর্ম ও কল্যাণজনক বিষয় থেকে নিষেধ করে।
- কাফির ও ফাসিকগণ কর্তৃক আমদানি করা ফ্যাশনের অনুসরণ করা: যেমন আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, ইসলামের শত্রুগণ অত্যন্ত আগ্রহী, বরং তারা সচেষ্ট— যাতে মুসলিম মেয়েরা বিশৃঙ্খল হতে পারে। তাদের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে, তাদের বিভিন্ন ফ্যাশন— যা তারা মুসলিমগণের কন্যাদের মাঝে ছড়িয়ে থাকে। তাই মুসলিম কন্যার জন্য গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দেয়া আবশ্যক।
- অপ্রয়োজনে মার্কেটে বের হওয়া: এটি একটি ভয়ানক সমস্যা, যা এই শেষ যামানায় শুষ্ক লাতাপাতায় আগুন ছড়ানোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক মুসলিম কন্যারা বিভিন্ন মার্কেটে-বাজারে (অপ্রয়োজনে) ঘুরে বেড়ায়— যার ফলে তাদেরকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এসব বিপদসমূহের অন্যতম হল শয়তানের শিকার হওয়া; কারণ, বাজার শয়তানেরই অবস্থান কেন্দ্র এবং সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জায়গা হল বাজারসমূহ। যখন মেয়েরা কোন প্রয়োজনের কারণে বাধ্য হবে বাজারে যেতে, তখনই শুধু তার অভিভাবককে সাথে নিয়ে তার প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে বাজারে বের হবে, অতঃপর প্রয়োজন শেষে তার ঘরে ফিরে আসবে। আর এই বের হওয়াটা অনুপ্রেরণা দেয় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বার-বার ঘর থেকে বের হতে। সুতরাং প্রত্যেক মেয়ের উচিত সে যেন তার প্রয়োজনকে হিসাব করে নেয় এবং এই বের হওয়াটা যাতে বেশি না করে, কারণ তা হচ্ছে সকল অনিষ্টের দরজা। নারী যখন তার ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে উঁকি দেয়। এটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত[36]। কত মুসলিম নারী যে এই বেপরোয়া বের হওয়ার কারণে দুষ্টচক্রের রশিতে আবদ্ধ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সুতরাং ময়েদেরকে খুবই সতর্ক থাকা উচিত।
- বিনোদন কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বের হওয়া: এটি খারাপ হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, এটি খেল-তামাশার স্থল, সময় নষ্টকারী এবং অন্যায় ও অপরাধের কারণ।[37]
- অপ্রয়োজনে ফোন ব্যবহার করা: ফোনের উভয়দিকেই ধার আছে। মূলত এটি প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় হল, টেলিফোনের ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। সে যখন ফোন রিসিভার তার কানে নেয়, তখন অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে তা ছাড়ে না। কত দুঃখজনক ও ধ্বংসাত্মক! বর্তমানে তা হয়ে গেছে ধ্বংসের দরজা— যার মাধ্যমে লম্পটরা মুসলিম মেয়েদের পিছনে লেগে তাদেরক নষ্ট করে। সুতরাং এই পথ থেকে সাবধান! সাবধান!!
(ঘ) আদর্শ বোন হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য:
বোন হল তার ভাইয়ের নিকট সকল আত্মীয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম ও ঘনিষ্ঠ; আর তাদের উভয়ের জন্য যৌথ হক বা অধিকার রয়েছে। বরং তার (বোনের) দায়-দায়িত্ব আরও ব্যাপক। তা পালন করতে হয় ঘরের মধ্যে, যেখানে সে জীবনযাপন করে। কন্যা হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে, ছোট ও বড় ভাই-বোনদের সাথে বোনের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে পরিপূর্ণভাবে তাই বলা হয়।
এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোর পাশাপাশি নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বৃদ্ধি করা য়ায়:
- তার চেয়ে বয়সে বড় ভাই ও বোনদের সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। কারণ, বড় বোন হলেন মায়ের মর্যাদায় এবং বড় ভাই হলেন পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। তাদের জন্য আত্মীয়তার সম্পর্কজনিত অধিকার রয়েছে; আর তার উপর কর্তব্য হল সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হলে তাদেরকে সহযোগিতা করা। যেমন: তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করা, বিপদ-মুসিবতের সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করা এবং তাদের পড়াশুনা ও জ্ঞানের ব্যাপারে তাদেরকে সহযোগিতা করা।
- বাড়ির মধ্যে সকল প্রকার কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়া— পাঠের মাধ্যমে, শুনানোর মাধ্যমে, দাওয়াতের মাধ্যমে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধ করার মাধ্যমে ইত্যাদি।
- প্রথম নারীর পরে ঘরের রান্নাবান্না, ধোয়া-মুছা ইত্যাদির মত কাজকর্মের সে অন্যতম খুঁটি।
- ঘরের মধ্যে প্রয়োজন হলে কাউকে উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দেয়া।
* * *
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
আরও পড়ুনঃ জান্নাতী রমণী (১ম পর্ব)
আরও পড়ুনঃ জান্নাতী রমণী (২য় পর্ব)
আরও পড়ুনঃ নারীর জান্নাত যে পথে
আরও পড়ুনঃ মুসলিম নারীর অবশ্যই পালনীয় কতিপয় আমল
আরও পড়ুনঃ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্দা
আরও পড়ুনঃ নারী শিক্ষা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
আরও পড়ুনঃ স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ স্বামীর ভালবাসা অর্জনের উপায়
ডাউনলোড করুনঃ বইঃ জান্নাতী রমণী - ফ্রি ডাউনলোড
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন