শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৪

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলা‌ইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ (১ম পর্ব)

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলা‌ইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ (১ম পর্ব)



বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলা‌ইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ (১ম পর্ব)
(ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রহ. এর যাদুল মা‘আদ হতে সংক্ষেপিত)


ভূমিকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আল-হামদুলিল্লাহ ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসূলিল্লাহ, ওয়া আলা ’আলিহী ওয়া সাহবিহী। ওয়াবা‘দ
অতঃপর নিশ্চয়ই আমাদের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নেয়ামত হলো ইসলাম, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত স্বভাবজাত এবং ন্যায়নীতি-ভারসাম্য, মধ্যমপন্থী দ্বীন, ইসলাম দুনিয়া-আখেরাতের সকল কল্যাণ ও মঙ্গলকে আবেষ্টনকারী এবং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আখলাক- চরিত্রের দ্বীন, ইসলাম স্থান-কাল নির্বেশেষে সবার জন্য উপযোগী, ইসলাম সহজ-সাধ্য ও শান্তির দ্বীন, বরং ইসলামে রয়েছে সব সমস্যার সমাধান। অতএব, বর্তমান যুগে বিশ্ব মানবতার সামনে ইসলামের সৌন্দর্য্য ও মৌলিক বৈশিষ্টাবলীর বর্ণনা কতই না জরুরী; যাতে বিশ্বের সামনে দ্বীন ইসলামের প্রকৃত ছবি ফুটে উঠে। মূলত বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলা‌ইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনাদর্শ হলো এই মহান দ্বীনের বাস্তব প্রয়োগ ও ব্যাখ্যাস্বরূপ, তাঁর আদর্শমালায় রয়েছে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলীর সমাহার, যার ফলে দ্বীন ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাস্তবে প্রয়োগ করা সহজসাধ্য হয়েছে; কারণ ইসলাম মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আবেষ্টন করে তার সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে, তা আক্বীদাহ্-বিশ্বাস হোক কিংবা ইবাদত-উপাসনা হোক, আদর্শ-চরিত্র হোক, পার্থিব কিংবা আধ্যাত্মিক হোক। আর এই বই যেটি আমি ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (র) কর্তৃক রচিত ‘যাদুল মা‘আদ ফী হাদীয়ে খাইরিল ইবাদ’ গ্রন্থ হতে সংকলন করেছি, যেটি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু ‘আলা‌ইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনাদর্শমালা সম্পর্কে রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে অনন্য-অতুলনীয়, যা মূলত তাঁর জীবনাদর্শমালাকে বিশ্ব মানবতার সামনে ফুটিয়ে তোলার একটি প্রয়াস মাত্র; যাতে আমরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারি এবং তাঁর আদর্শে আদর্শবান হতে পারি। আল্লাহর দরবারে আকুল আবেদন: তিনি যেন ইখলাস বা তাঁর জন্য একনিষ্ঠতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেন এবং এ কিতাবে বরকত দান করেন।”
ড. আহমাদ ইবন উসমান আল-মাযইয়াদ
Dr.almazyad@gmail.com


(১) পবিত্রতা অর্জন ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরণ করা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[1]

(ক) প্রাকৃতিক প্রযোজনপূর্ণ করার সময় তাঁর আদর্শমালা :
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়খানায় প্রবেশকালে বলতেন :
«اللهم إني أعوذ بك من الخبث والخبائث»
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু-বিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাব-ইস।’
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অপবিত্র নর জ্বিন ও অপবিত্র নারী জ্বিন হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।[2]
আর পায়খানা হতে বর্হিগমন কালে বলতেন:
(غفرانك)
‘গোফরানাকা’
“হে আল্লাহ! আমি তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করছি।[3]
২. তিনি অধিকাংশ সময় বসে প্রস্রাব করতেন।
৩. তিনি কখনো পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন, আবার কখনো পাথর দিয়ে কুলুখ করতেন, আবার কখনো কুলুখ ও পানি উভয়টি ব্যবহার করতেন।
৪. তিনি ইস্তিঞ্জা ও কুলুখ বাম হাত দিয়ে সম্পাদন করতেন।
৫. তিনি পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা শেষে হাত মাটিতে ঘষে ধৌত করে নিতেন।
৬. তিনি সফরকালে প্রস্রাব-পায়খানায় যাওয়ার সময় সাথীদের থেকে অনেক দূরে চলে যেতেন, যাতে কেউ দেখতে না পায়।
৭. এই উদ্দেশ্যে তিনি কোনো বস্তুর আড়ালে গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন, কখনো খেঁজুর শাখার বৃক্ষরাজী দ্বারা, আবার কখনো উপত্যকার কোনো বৃক্ষ দ্বারা।
৮. তিনি প্রস্রাবের সময় নরম জায়গা বা বালুকাময় ভূমি চয়ন করতেন।
৯. তিনি প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বসার আগেই কাপড় উঠাতেন না।
১০. তিনি প্রস্রাব করার সময় কেউ সালাম করলে উত্তর দিতেন না।

(খ) অযু করার সময় তাঁর আদর্শমালা :[4]
১. রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় প্রত্যেক সালাতের জন্য অযু করতেন, আবার কখনো এক অযু দ্বারা কয়েক ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন।
২. তিনি কখনো এক মুদ[5] পানি দ্বারা অযু করতেন, আবার কখনো মুদের দুই-তৃতীয়াংশ দ্বারা, আবার কখনো মুদের চেয়ে বেশী পানি দ্বারা।
৩. তিনি অযু করার সময় সর্বাধিক কম পানি ব্যবহার করতেন এবং স্বীয় উম্মতকে পানি অপব্যয় করা হতে সতর্ক করতেন।
৪. তিনি অযুর অঙ্গগুলো এক-একবার, দু’-দুবার ও তিন-তিনবার ধৌত করতেন, আবার কোনো অঙ্গ দুবার ও অন্য অঙ্গ তিনবার ধৌত করেন, তবে কখনই তিন বারের অধিক ধৌত করেননি।
৫. তিনি মাযমাযা’- (তথা কুলি করা ও ইস্তিনশাক্ব’-তথা নাকে পানি দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার) করা কখনো এক চিলু পানি দ্বারা সম্পাদন করতেন, আবার কখনো দুই চিলু পানি দ্বারা, আবার কখনো তিন চিলু পানি দ্বারা করতেন, বস্তুত তিনি মাযমাযাইস্তিনশাক্বলাগাতার করতেন।
৬. তিনি ডান হাতে নাকে পানি দিয়ে বাম হাত দ্বারা নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করতেন।
৭. তিনি যখনই অযু করতেন তখনই মাযমাযাইস্তিনশাক্বকরতেন।
৮. তিনি সমগ্র মাথা (একবার) মাসেহ করতেন, আবার কখনো স্বীয় হস্তদ্বয় মাথার অগ্রভাগে রেখে পিছন পর্যন্ত নিয়ে যেতেন এবং পুনরায় পিছন থেকে উভয় হাত অগ্রভাগে টেনে আনতেন।
৯. তিনি মাথার শুধু অগ্রভাগ মাসেহ করলে তখন বাকী অংশ পাগড়ীর উপর মাসেহ করে সম্পূর্ণ করতেন।
১০. তিনি মাথার সাথে স্বীয় কানদ্বয়ের ভিতর ও বাহিরের অংশ মাসেহ্ করতেন।
১১. তিনি স্বীয় পাদ্বয় (গোড়ালি পর্যন্ত) ধৌত করতেন, যখন তাতে চামড়া কিংবা সুতার মোজা না হতো।
১২. তিনি অযুর কার্যাবলী লাগাতার ও ধারাবাহিকতার সাথে সম্পন্ন করতেন, এতে কখনই বিঘ্ন বা ভিন্নতা সৃষ্টি করেন নি।
১৩. তিনি বিসমিল্লাহ্বলে অযু শুরু করতেন এবং অযু শেষে বলতেন:
«أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله، اللهم اجعلني من التوابين واجعلني من المتطهرين»
আশ-হাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু, ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ও রাসুলুহু; আল্লা-হুম্মাজ‘আলনী মিনাত-তাওয়াবীনা, ওয়াজ‘আলনী মিনাল মুতাত্বাহহিরীন।[6]
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত সত্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরীক বা অংশীদার নেই, আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলা‌ইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ ! আমাকে তাওবাহকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
তিনি আরো বলতেন:
(سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك )
সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, আশ্হাদু আল-লা-ইলাহা ইল্ল-আনতা, আস্তাগফিরুকা, ওয়াআতুবু- ইলাইক।
“হে আল্লাহ ! তুমি পাক-পবিত্র, তোমারই প্রশংসা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই, আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার নিকট তাওবাহ করি।
১৪. তিনি অযুর শুরুতে নাওয়্যাইতু রাফআল হাদাসকিংবা নাওয়্যাইতু ইসতেবাহতুস সালাতইত্যাদি গদবাঁধা শব্দ পাঠ করে নিয়্যাত করেননি, তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ কখনই এমনটি করেননি[7]
১৫. তিনি কখনই কনুইদ্বয় ও গোড়ালিদ্বয়ের উপর ধৌত করেননি।
১৬. অযু শেষে অঙ্গগুলি মুছে শুকানো তাঁর অভ্যাস ছিল না।
১৭. তিনি কখনো দাঁড়ির ভিতরে পানি দিয়ে দাঁড়ি খেলাল করতেন, কিন্তু তা নিয়মিত সব সময় করেননি।
১৮. তিনি হাত ধোয়ার সময় এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ভরে দিয়ে খেলাল করতেন, কিন্তু তা নিয়মিত সব সময় করেননি।
১৯. অযু করার সময় সর্বদা অন্যে পানি ঢেলে দেওয়া তাঁর নীতি ছিল না, কিন্তু কখনো তিনি নিজেই পানি ঢেলে অযু করতেন, আবার কখনো প্রয়োজন বিশেষ তাঁর সাহাবীদের কেউ পানি ঢেলে দিতেন।

(গ) মোজার উপর মাসেহ করা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[8]:
১. সহীহ্ সনদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি সফরকালে এবং গৃহে অবস্থানকালে মোজার উপর মাসেহ করেছেন এবং মুক্বিম (মুসাফির নয় এমন) ব্যক্তির জন্যে একদিন একরাত, আর মুসাফিরের জন্য তিনদিন তিনরাত মাসেহ করার সময় সীমা নির্ধারণ করেন।
২. তিনি খুফ্ তথা চামড়ার তৈরী মোজার উপরের ভাগে মাসেহ করতেন এবং ‘জাওরাব’ তথা সুতা বা পশমী মোজার উপরও মাসেহ করেন, তিনি শুধু পাগড়ীর উপরও মাসেহ করেন, আবার কখনো মাথার অগ্রভাগ মাসেহ করে বাকী অংশ পাগড়ীর উপর সম্পূর্ণ করেন।
৩. তিনি বিনা প্রয়োজনে (মোজা পরিধান কিংবা খোলার মাধ্যমে) অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেন না, বরং পাদ্বয়ে মোজা থাকলে মাসেহ করতেন, নচেৎ পাদ্বয় ধৌত করতেন।

(ঘ) তায়াম্মুমে তাঁর আদর্শমালা [9]:
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মাটি দ্বারা যার উপর সালাত আদায় করা যায়, তায়াম্মুম করতেন, তা মাটি হোক কিংবা গন্ধকযুক্ত ভুমি হোক অথবা বালুকাময় ভুমি হোক, আর বলতেন :
“যেখানেই আমার উম্মতের কারো সালাতের সময় উপস্থিত হবে, সেখানেই তার সালাত আদায় করার স্থান ও পবিত্রতা অর্জন করার বস্তু বিদ্যমান রয়েছে।[10]
২. তিনি দূর-দূরান্ত সফরের সময় সাথে মাটি বহন করে নিতেন না এবং এর আদেশও করেননি।
৩. তিনি প্রত্যেক সালাতের জন্য তায়াম্মুম করেননি এবং এর নির্দেশও দেননি, বরং তায়াম্মুমের বিধানকে ব্যাপক করত অযুর বিধানের স্থালাভিষিক্ত করেছেন।
৪. তিনি মুখমণ্ডল, কব্জিদ্বয়ের জন্য যমীনে একবার হাত মেরে তায়াম্মুম করতেন।


(২) সালাত আদায় করা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালার বিবরণ[11]

(ক) সানা পাঠ ও কেরাআত প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:
১. যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতেন, তখন তিনি তাকবীর’-আল্লাহু আকবারবলে সালাত শুরু করতেন এর পূর্বে কিছুই পাঠ করতেন না এবং তিনি কখনই নিয়্যাত মুখে উচ্চারণ করেননি।
২. তিনি তাকবীরে তাহরিমা বলার সময় স্বীয় দুহাতের আঙ্গুলগুলো সোজা করে তালু ক্বিবলামুখী অবস্থান দুকানের লতি বরাবর কিংবা কাঁধ বরাবর উঠাতেন, অতঃপর ডান হাত বাম হাতের পিঠের উপর রাখতেন।
৩. তিনি কখনো নিম্নোক্ত দুআটি দ্বারা ইসতেফ্তাহ্ পাঠ করতেন:
(اللهم باعد بيني وبين خطاياي كما باعدت بين المشرق والمغرب، اللهم نقني من الذنوب والخطايا كما ينقى الثوب الأبيض من الدنس، اللهم اغسلني من خطاياي بالماء والثلج والبرد)
‘আল্লা-হুম্মা বা-‘য়িদ বাইনী ওয়া বাইনা খাত্বা-ইয়া, কামা-বা- ‘আদতা বাইনাল্ মাশারিক্বি ওয়াল মাগরিবি। আল্লা-হুম্মা নাক্কিনী মিনায যুনুবি ওয়াল খাত্বা-ইয়া, কামা ইউনাক্কাস্ সাওবুল আবইয়াদু মিনাদ্ দানাস। আল্লা-হুম্মাগসিলনী মিন খাত্বা-ইয়া-ইয়া, বিলমা-য়ি ওয়াস্ -সালজি ওয়াল-বরদি।[12]
“হে আল্লাহ ! তুমি আমার ও আমার গুনাহ্ -খাতার মাঝে এমন দূরত্ব সৃষ্টি কর যেমনটি দুরত্ব সৃষ্টি করোছো পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। হে আল্লাহ ! আমার পাপ ও ভূলত্রুটিসমূহ হতে আমাকে এমনভাবে পরিষ্কার ও পবিত্র কর যেমনভাবে সাদা বস্ত্র ময়লা হতে পরিস্কার করা হয়। হে আল্লাহ ! আমার যাবতীয় পাপ ও ত্রুটি-বিচ্যূতিগুলো পানি, বরফ ও শিশির দ্বারা ধৌত করে দাও।”
আবার কখনো তিনি নিন্মোক্ত দুআটি পাঠ করতেন:
(وجهت وجهي للذي فطر السماوات والأرض حنيفاً وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين، لا شريك له وبذلك أمرت وأنا أول المسلمين)
‘অজ্জাহতু অজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস্ সামা-ওয়াতি অলআরযা হানীফাউ অয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন, ইন্না স্বালাতী,ওয়া নুসুকী, ওয়া মাহয়্য-য়্যা, ওয়া মামাতী, লিল্লাহী রাবিবল আ’-লামীন, লা-লামীন, লা-শারিকালাহু ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু, ওয়া আনা আওয়ালুল মুসলিমীন
“আমি সেই মহান সত্তার দিকে একনিষ্টভাবে আমার মুখ ফিরাচ্ছি যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী তথা যাবতীয় ইবাদত, আমার জীবন এবং আমার মরণ একমাত্র সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য, তাঁর কোনো শরীক-অংশীদার নেই, আর এরই জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।[13]
৪. তিনি ইসতিফতাহ এর দুআ পাঠ করার পর আউযু বিল্লাহি মিনাশ্ শাইত্বোনির রাজীম-বলে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন।
৫. তিনি সালাতে দুবার সেক্তা বা বাকরুদ্ধ বা নিশ্চুপ থাকতেন, একবার তাকবীরে তাহরীমা ও কেরাতের মধ্যখানে, বস্তুত: দ্বিতীয়টি সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে, কোনো কোন বর্ণনায় তা ছিল সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর, অন্য বর্ণনায় রয়েছে তা ছিল রুকুর পূর্বে।
৬. তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করার পর আরো একটি সূরা পাঠ করতেন। কখনো কেরাত লম্বা করতেন, আবার কখনো সফর বা অন্যকোনো বিশেষ কারণে কেরাত হাল্কা করতেন, তবে তিনি অধিকাংশ সময়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন।
৭. তিনি ফজরের সালাতে প্রায় ষাট আয়াত, এমনকি একশত আয়াত পাঠ করতেন। তিনি ফজরের সালাত সূরা ক্ব-ফদ্বারা পড়েন এবং সূরা আর-রূমদ্বারা, আবার সূরা আত-তাকওয়ীরদ্বারাও পড়েন। তিনি ফজরের উভয় রাকয়াতে সূরা যিলযাল পাঠ করেন। তিনি সফরকালে ফজরের সালাত মোয়াউযাতাইন’-সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস দ্বারা পড়েন। একদা তিনি ফজরের সালাতে সূরা আল-মুমিনুন পাঠ আরম্ভ করেন, অতঃপর প্রথম রাকায়াতে মূসা ও হারূন আলাইহিস সালাম এর ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছলে তাঁর কাশি আসে, তখন তিনি রুকু করে ফেলেন।
৮. তিনি জুমআর দিন ফজরের সালাত আলিফ-লাম-মীম সাজদাহ্ ও আদ-দাহরসূরাদ্বয় দ্বারা পড়তেন।
৯. তিনি যুহরের সালাতে কখনো কেরাত লম্বা করতেন, পক্ষান্তরে আসরের সালাত যুহরের কেরাতের অর্ধেক হতো যদি তা লম্বা হয়ে থাকে, আবার সেই অনুপাতে সংক্ষিপ্ত হতো।
১০. তিনি মাগরিবের সালাত একবার সূরা আত-ত্বূরদ্বারা আদায় করেন, আরেকবার সূরা আল মুরাসালাতদ্বারা।
১১. এশার সালাতে তিনি সূরা আত-তীনপাঠ করেন এবং তিনি মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য এশার সালাতে সূরা আশ-শামসও সূরা আল-আ‘লাএবং সূরা আল-লাইলঅথবা অনুরূপ সূরাসমূহ পাঠ করা নির্ধারিত করে দিয়েছেন, আর মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক এশার সালাতে সূরা বাক্বারা পাঠ প্রসঙ্গে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।
১২. তাঁর আদর্শ ছিল এক রাকাতে পূর্ণ সূরা পাঠ করা, আবার অনেক সময়ে তিনি এক সূরা দুরাকাআতে পূর্ণ করতেন, আবার অনেক সময় তিনি সূরায় প্রথমাংশ পাঠ করতেন, কিন্তু (ফরয সালাতে) সূরার শেষাংশ কিংবা মধ্যমাংশ থেকে পাঠ করতেন বলে বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় না। দুই সূরা এক রাকাআতে পাঠ করা তা নফল সালাতে করতেন। তিনি কোনো নির্দিষ্ট সালাতের জন্য কোনো সূরা এমনভাবে নির্দিষ্ট করতেন না যে ঐ সূরা সেই সালাতেই পড়তে হবে, একমাত্র জুমআ ও দুই ঈদের সালাত ব্যতীত।
১৩. তিনি ফজরের সালাতে এক মাস পর্যন্ত রুকুর পরে দুআ কুনুত পড়েছিলেন, অতঃপর তা পরিত্যাগ করেন, কিন্তু তাঁর এ কুনুত পাঠ কারণবশত ছিল।[14] অতঃপর উক্ত কারণ শেষ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট হুকুমও নিঃশেষ হয়ে যায়, তবে তাঁর আদর্শ ছিল বিশেষ বিপদাপদের সময় কুনুতে নাযিলাহ্ পাঠ করা, কিন্তু তা ফজরের সালাতের সাথে নির্দিষ্ট ছিল না।

(খ) সালাতের পদ্ধতি প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[15]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সালাতের প্রথম রাকাতকে দ্বিতীয় রাকাত অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করতেন।
২. তিনি কেরাত পাঠ শেষে শ্বাস ফিরে আসা পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকতেন। অতঃপর উভয় হাত উঠিয়ে আল্লাহু আকবারবলে রুকু করতেন এবং দু’টো হাত দিয়ে হাঁটু দু’টো ধারণকারীর ন্যায় আঁকড়ে ধরতেন এবং উভয় হাত পাঁজর থেকে তীরের রশির মতো সোজা করে রাখতেন এবং পিঠটা টেনে সোজা রাখতেন, বস্তুত মাথাটা উঁচু করতেন না এবং খুব নিচুও করতেন না, বরং কোমর ও পিঠের বরাবর রাখতেন।
৩. তিনি রুকুতে কখনো বলতেন,
(سبحان ربي العظيم)
“সুব্‌হা-না রাব্বিয়াল ‘আযীম।[16]
“আমি আমার মহান প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।
আবার কখনো বলতেন:
(سبحانك اللهم ربنا وبحمدك، اللهم اغفر لي)
‘সুব্হানাকা আল্লা-হুম্মা, রাববানা ওয়া বিহামদিকা, আল্লা-হুম্মাগ ফিরলী।[17]
“হে আমাদের রব আল্লাহ ! তোমার প্রশংসার সাথে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আবার কখনো বলতেন:
(سبوح قدوس رب الملائكة والروح)
‘সুব্বু-হুন কুদ্দুসুন রাববুল আলাইকাতি ওয়াররুহ।[18]
“সকল ফিরিশতা ও জিবরাইলের প্রতিপালক অত্যন্ত পবিত্র।”
৪. সাধারণত তাঁর রুকু-সিজদাহগুলো দশবার তাসবিহ্ পাঠ করার সমপরিমাণ লম্বা হতো, তবে কখনো রুকু-সিজদাহ্ ক্বিয়ামের সমপরিমাণ দীর্ঘায়িত করতেন, কিন্তু তা শুধুমাত্র সালাতুল লাইলবা রাত্রিকালীন সালাত তাহাজ্জুদে করতেন, নচেৎ অধিকাংশ সময় তাঁর নীতি ছিল যে, সমন্বয় ও সুষ্ঠুরুপে সালাত আদায় করা।
৫. তিনি
(سمع الله لمن حمده)
সামিআল্লা-হু লিমান হামিদা
“যে তাঁর (আল্লাহর) প্রশংসা করেছে আল্লাহ তার সে প্রশংসা শুনেছেন।”
এ কথা বলে স্বীয় মাথা উঠাতেন।[19] তখন উভয় হাত উত্তোলন করতেন এবং স্বীয় পিঠ সোজা করতেন, অনুরূপ যখন তিনি স্বীয় মাথা সিজদাহ্ হতে উত্তোলন করে পিঠ সোজা করতেন, আর সতর্ক করে বলতেন: “যে ব্যক্তি রুকু-সিজদায় তার পিঠ সোজা করে না, তার সালাতই হয় না।[20]
তিনি রুকু থেকে সোজা হয়ে উঠার পর বলতেন:
(ربنا ولك الحمد)
‘রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ।
“হে আমাদের রব! তোমারই জন্যে সকল প্রশংসা।”
আবার অনেক সময়ে বলতেন: ‘রাব্বানা লাকাল হামদ।’
আবার অনেক সময়ে বলতেন: ‘আল্লা-হুম্মা রাব্বানা লাকাল হামদ।
৬. তিনি এই ক্বিয়ামের রুকনকে রুকুর সমপরিমাণ দীর্ঘায়িত করতেন এবং দাঁড়ানো অবস্থায় বলতেন।
(اللهم ربنا ولك الحمد، ملء السموات والأرض وملء ما شئت من شيء بعدُ، أهل الثناء والمجد أحق ما قال العبد، وكلنا لك عبد، اللهم لا مانع لما أعطيت ولا معطي لما منعت ولا ينفع ذا الجد منك الجد)
‘আল্লা-হুম্মা রাব্বানা, ওয়া-লাকাল হামদ্, মিলআসসামা-ওয়াতি ওয়া মিলআল আরদ্বি, ওয়া মিলআ মা-শিতা মিন্ শাইয়িন বা‘দু। আহলাস সানা-য়ি ওয়াল মাজদ, আহাক্কু মা-ক্বালাল আব্দু, ওয়া কুল্লুনা লাকা আব্দু; আল্লা-হুম্মা লা-মানি‘আ লিমা আ‘ত্বাইতা ওয়ালা মু‘ত্বিয়া লিমা মানা‘তা ওয়ালা য়্যানফা‘উ যাল-জাদ্দি মিনকাল জাদ্দু।[21]
“হে আল্লাহ আমাদের রব! তোমার জন্য ঐ পরিমাণ প্রশংসা যা আকাশমণ্ডলী ভর্ত্তি করে দেয়, যা পৃথিবী পূর্ণ করে দেয় এবং যা এই দু‘য়ের মধ্যবর্তী মহাশূন্যকে পরিপূর্ণ করে দেয়, আর এগুলি ছাড়া তুমি অন্য যা কিছু চাও তাও পূর্ণ করে দেয়, হে প্রশংসা ও গৌরবের অধিকারী ! বান্দার সবচেয়ে সত্যকথা, বস্তুত: আমরা সকলই তোমার বান্দা। হে আল্লাহ ! তুমি যা প্রদান কর তা রোধ করার এবং যা তুমি রোধ কর তা প্রদান করার সাধ্য কারো নেই, আর ধনবানের ধন তোমার আযাব থেকে মুক্তি পেতে কোনো উপকারে আসবে না।
৭. অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবারবলে সিজদায় যেতেন এবং তখন হাতদ্বয় উপরে উঠাতেন না। তখন প্রথমে হাঁটুদ্বয় তারপর উভয় হাত, অতঃপর কপাল ও নাক মাটিতে রাখতেন, তিনি কপাল ও নাকের উপর সিজদা করতেন, পাগড়ীর প্যাচের উপর নয়। তিনি বেশী বেশী যমীনের উপর এবং পানিযুক্ত কাদামাটির উপর সিজদা করতেন এবং খেজুরের পাতা দ্বারা বানানো চাটাই ও পাকা চামড়ার বিছানার উপর সিজদা করতেন।
৮. তিনি সিজদা অবস্থায় স্বীয় কপাল ও নাক পুরোভাবে যমীনে রাখতেন এবং উভয় হাত যমীন থেকে উপরে উঠিয়ে শরীরের দুপার্শ্ব হতে পৃথক করে ব্যবধানে রাখতেন, ফলে বগলের সাদা অংশ পর্যন্ত দেখা যেতো।
৯. তিনি সিজদায় স্বীয় হাত কাঁধ বরাবর কিংবা দুকানের লতি বরাবর রাখতেন এবং সিজদায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন পাদ্বয়ের আঙ্গুলগুলো ক্বিবলামুখী করে রাখতেন, দুহাতের তালু ও আঙ্গুলগুলো মাটিতে বিছিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতেন, খোলে কিংবা গুছিয়ে রাখতেন না।
১০. তিনি কখনো বলতেন:
(سبحانك اللهم ربنا وبحمدك، اللهم اغفر لي)
‘সুব্হানাকা আল্লা-হুম্মা, রাববানা ওয়া বিহামদিকা, আল্লা-হুম্মাগ ফিরলী।[22]
“হে আমাদের রব আল্লাহ ! তোমার প্রশংসার সাথে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আবার কখনো বলতেন:
(سبوح قدوس رب الملائكة والروح)
‘সুব্বু-হুন কুদ্দুসুন রাববুল আলাইকাতি ওয়াররুহ।[23]
১১. সিজদার দুআ পাঠ শেষে তিনি আল্লাহু আকবারবলে হাত উত্তোলন না করে মাথা উঠাতেন। অতঃপর সোজা হয়ে বাম-পা বিছিয়ে তার উপর বসতেন এবং ডান পা খাড়া রাখতেন, উভয় হাত উভয় উরুর উপর রেখে উভয় কনুই উভয় উরু বরাবর উপরে রাখতেন, আর ডান হাত হাঁটু সংলগ্ন অংশের উপর রেখে কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুল দু’টো মুঠো করে এবং মধ্যমা ও বৃদ্ধ আঙ্গুল দু’টোর মাথা এক জায়গায় করে শাহাদাত আঙ্গুলটি উপরে তুলে ইশারা ও নড়াচড়া করে বলতেন:
(اللهم اغفر لي وارحمني واجبرني واهدني وعافني وازرقني)
‘আল্লা-হুম্মাগফিরলী, ওয়ার-হামনী, ওয়াজ-বুরনী, ওয়াহ-দিনী, ওয়া‘আ-ফিনী, ওয়ার- যুক্বনী।[24]
“হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি রহম কর, আমার প্রয়োজন মিটাও, আমাকে হেদায়াত দাও, আমাকে নিরাপত্তা দান কর এবং আমাকে রিজেক্ব দাও।
১২. তাঁর আদর্শ ছিল এ রুকন তথা দু'সেজদার মাঝখানের বসাটাকে সেজদার সমপরিমাণ দীর্ঘায়িত করা।
১৩. অতঃপর তিনি উভয় উরুর উপর ভর দিয়ে পাদ্বয়ের প্রথমাংশের উপর (দ্বিতীয় রাকাতের জন্যে) সোজা দাঁড়াতেন, আর দাঁড়ানোর সাথে সাথে কেরাত পাঠ আরম্ভ করতেন এবং প্রথম রাকাতের ন্যায় দুআ ইস্তিফতাহ পাঠ করার জন্য নিশ্চুপ থাকতেন না। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাত প্রথম রাকাতের ন্যায় আদায় করতেন শুধু চারটি বিষয় ব্যতীত, এক. তাকবীরে তাহরীমার পর নিশ্চুপ থাকা, দুই. দুআ ইসতিফতা পাঠ করা, তিন. তাকবীরে তাহরীমা, চার. প্রথম রাকাতকে দীর্ঘায়িত করা।
তিনি প্রথম রাকাতকে দ্বিতীয় রাকাত অপেক্ষা লম্বা করতেন, আবার অনেক সময়ে তিনি প্রকাম রাকাত ততক্ষণ দীর্ঘায়িত করতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আগন্তক ব্যক্তির পায়ের আওয়াজ আর শুনতেন না।
১৪. তিনি যখন তাশাহহুদের জন্য বসতেন, তখন ডান-হাত ডান-উরুর উপর এবং বাম হাত বাম-উরুর উপর রেখে তর্জনী বা শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন, বস্তুত তখন শাহাদাত আঙ্গুলটি সোজা খাড়া কিংবা একেবারে বিছিয়ে রাখতেন না, বরং সামান্য ঝুঁকিয়ে রাখতেন, আর কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুল দু'টো মুঠো করে এবং মাধ্যমা ও বৃদ্ধ আঙ্গুল দুটোর মাথা এক জায়গায় করে শাহাদাত আঙ্গুলটি উত্তোলন করে তাশাহহুদ পাঠ করতেন এবং তার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন।
১৫. তিনি এ বৈঠকে সর্বদা আত্তাহিয়্যাতু পড়তেন এবং সাহাবীদেরকে তা শিক্ষা দিতেন:
(التحيات لله والصلوات والطيبات، السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته، السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين، أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمداً عبده ورسوله)
‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্-স্বালাওয়াতু ওয়াত্ তাইয়্যেবা-তু, আস্-সালামু আলাইকা আইয়্যূহান নাবিইয়্যূ ওয়া-রাহমাতুল্লাহ-হি ওয়া-বারাকাতুহ, আস্-সালামু আলাইনা ওয়া-‘আলা ইবাদিল্লাহিস্ স্বালিহীন, আশ্হাদু আল-লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু, ওয়া-আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু।[25]
“যাবতীয় সাদর-সম্ভাষণ, যাবতীয় সালাত, যাবতীয় পবিত্র ইবাদত খালেসভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। হে নবী ! আপনার উপর সকল প্রকার শান্তি, আল্লাহর রহমত এবং তাঁর বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের উপর ও আল্লাহর সকল নেক বান্দাদের উপরও শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লা্ল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দাহ ও রাসূল।
তিনি এই বৈঠক খুবই সংক্ষেপ করতেন, যেন তিনি কোনো উত্তপ্ত পাথরের উপর বসে সালাত আদায় করছেন।
অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবারবলে উভয় উরুর উপর ভর দিয়ে উভয় পায়ের প্রথমাংশের উপর (তৃতীয় রাকাতের জন্যে) সোজা দাঁড়াতেন এবং স্বীয় হাত উত্তোলন করতেন। অতঃপর সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন, আবার অনেক সময় শেষ দুরাকাতে সূরা ফাতিহার পর কুরআনের কিছু অংশ পড়তেন।
১৬. তিনি শেষ তাশাহহুদে তাওয়াররুক করে বসতেন, “তিনি পাছাকে যমীনে ভর করে বসে স্বীয় পা এক দিকে বের করে দিতেন।”-[26], আর বাম পাকে ডান উরু ও পিন্ডলীর নিচ দিয়ে ডান দিকে বের করে দিয়ে ডান পা খাড়া করে রাখতেন, আবার কখনো ডান -পা বিছিয়ে রাখতেন, তখন ডান-হাত ডান-উরুর উপর করে তর্জনী বা শাহাদাত আঙ্গুলটি খাড়া করে রাখতেন, তিনি সালাতের শেষাংশে এ দুআ দ্বারা প্রার্থনা করতেন
(اللهم إني أعوذ بك من عذاب القبر، وأعوذ بك من فتنة المسيح الدجال، وأعوذ بك من فتنة المسيح الدجال، اللهم وأعوذ بك من المأثم والمغرم)
‘আল্লা-হুম্মা ইন্নি আ‘উযুবিকা মিন্ ‘আযাবিল্-ক্বাবরী, ওয়া-‘আউযুবিকা মিন্ ফিত্নাতিল মাসীহিদ-দাজ্জালি, ওয়া-‘আউযুবিকা মিন্ ফিত্নাতিল মাহইয়া-য়া ওয়া ফিত্নাতিল্ মামা-ত, আল্লা-হুম্মা ইন্নী ‘আউযুবিকা মিনাল্ মাসামি ওয়াল-মাগরাম।[27]
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আরো দাজ্জালের ফিত্না থেকে আশ্রয় চাচ্ছি, আর আশ্রয় চাচ্ছি দুনিয়ার জীবনের বিপর্যয় এবং মৃত্যুর যাতনা হতে, হে আল্লাহ ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি সমস্ত গুনাহ ও সব রকমের ঋণের দায় হতে।”
অতঃপর আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহবলে ডান ও বাম দিকে সালাম ফিরাতেন।
১৭. তিনি মুসল্লিকে সূতরা নিতে বলতেন, যদিও তীর ধনুক কিংবা লাঠি দ্বারা হয়। সফরকালে ও মাঠে-ময়দানে তাঁর জন্যে সুতরাস্বরূপ বর্শা গেড়ে রাখা হতো, তিনি তার দিকে ফিরে সালাত আদায় করতেন। কখনও তিনি স্বীয় সাওয়ারীকে চওড়াভাবে রেখে সে দিকে সালাত আদায় করতেন। কখনও তিনি পাল্কি হাত দ্বারা সোজা করে তার শেষ প্রান্তের কাঠের দিকে ফিরে সালাত পড়তেন।
১৮. তিনি দেওয়ালের দিকে ফিরে সালাত আদায় করলে তাঁর ও দেওয়ালের মাঝখানে একটি বকরী যাতায়াতের পথ বাকী থাকতো। তিনি সুতরা থেকে দূরত্বে দাঁড়াতেন না, বরং সুতরার নিকটবর্তী হতে নির্দেশ দিতেন।

(গ) নামাযের অবস্থায় তাঁর আদর্শমালা:[28]
১. সালাতের মধ্যে এদিক-ওদিক তাকানো তাঁর আদর্শ ছিল না।
২. সালাতের মধ্যে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করা তাঁর নীতি ছিল না।
৩. তিনি সালাত পড়ার সময় স্বীয় মাথা একটু নিচু করে রাখতেন। তিনি সালাত লম্বা করার ইচ্ছায় আরম্ভ করতেন, কিন্তু শিশুর কান্না শুনে তার মায়ের উপর কঠিন হওয়ার ভয়ে তা সংক্ষেপে করে ফেলতেন।
৪. তিনি কখনো তাঁর নাতনী উমামা বিনতে যায়নাবকে কাঁধে বহন করে ফরয সালাত আদায় করতেন, যখন রুকু-সেজদায় যেতেন তখন তাকে কাঁধ থেকে রেখে দিতেন, আবার যখন দাঁড়াতেন তখন তাকে কাঁধে বহন করে নিতেন।
৫. তিনি সালাতরত অবস্থায় কখনো হাসান কিংবা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এসে তাঁর পিঠে সাওয়ার হতো, তখন পিঠ থেকে পড়ে যাওয়াকে অপছন্দ করায় তিনি সেজদা দীর্ঘায়িত করতেন।
৬. তিনি সালাত আদায় করতেন, তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বাহির থেকে এলে হেঁটে গিয়ে তাঁর জন্য দরজা খুলে দিতেন, অতঃপর স্বীয় মুসল্লায় ফিরে আসতেন।
৭. তিনি সালাতরত অবস্থায় হাতের ইশারায় সালামের উত্তর দিতেন।
৮. তিনি সালাতরত অবস্থায় ফুঁক দিতেন এবং (আল্লাহর ভয়ে) স্বশব্দে ক্রন্দন করতেন এবং প্রয়োজনে গলা পরিস্কার করতেন।
৯. তিনি কখনো খালি পায়ে সালাত পড়তেন, আবার কখনো জুতা পরিহিত অবস্থায়। ইয়াহূদীদের বিরোধিতার লক্ষ্যে কখনো জুতা পরিধান করে সালাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন।
১০. তিনি কখনো এক কাপড়ে সালাত আদায় করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ সময় তিনি দুটি কাপড়ে সালাত পড়তেন।

(ঘ) সালাত শেষে তাঁর আদর্শমালা:[29]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের পর তিনিবার বলতেন: আস্তাগফিরুল্লাহ্, অর্থাৎ “আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।অতঃপর বলতেন
(اللهم أنت السلام ومنك السلام، تباركت يا ذا الجلال والإكرام)
‘আল্লা-হুম্মা আন্তাস্ সালামু ওয়া-মিনকাস্ সালামু তাবা-রাক্তা ইয়া-যাল্জালা-লি ওয়াল-ইকরাম।[30]
“হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময় এবং তোমা হতেই শান্তি উৎসারিত হয়, তুমি বরকতময় হে মহত্ন ও সম্মানের অধিকারী।
তিনি উক্ত দুআ দুটি কিবলামুখী পড়ে তাড়াতাড়ি ডান কিংবা বাম দিক দিয়ে ঘুরে মুক্তাদীগণের মুখোমুখি হয়ে বসতেন।
২. তিনি “ফজরের সালাত আদায় করে সালাতের স্থানে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন।[31]
৩. তিনি প্রত্যেক ফরয সালাত শেষে নিম্নোক্ত দু‘আগুলো পাঠ করতেন,
(لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمدُ وهو على كل شيء قدير. اللهم لا مانع لما أعطيت ولا معطي لما منعت، ولا ينفع ذا الجد منك الجد، لا حول ولا قوة إلا بالله، لا إله إلا الله ولا نعبد إلا إياه، له النعمة وله الفضل وله الثناء الحسن، لا إله إلا الله مخلصين له الدين ولو كره الكافرون)
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকা লাহু,লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। আল্লা-হুম্মা লা-মানিয়া লিমা আঅতাইতা ওয়ালা মুআতিয়া লিমা মানাআতা, ওয়ালা ইয়ান্ফায়ূ যাল্জাদ্দি মিনকাল্ জাদ্দু।”-সহীহ বুখারী, লা-হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লা-হ। লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হু, ওয়ালা নাবুদু ইল্লা ইয়্যাহু, লাহুননেআমাতু ওয়ালাহুল ফাযলু ওয়ালাহুস সানাউল হাসান। লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হু, মুখলিস্বীনা লাহুদ্দীন, ওয়ালাও কারিহাল কা-ফিরূন।[32]
“আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, সমগ্র রাজত্ব ও প্রশংসা তাঁরই, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ ! তুমি যা দিয়েছ তা রোধ করার কেউ নেই, আর যা তুমি রোধ করেছ তা দান করার সাধ্য কারো নেই, আর ধনবানের ধন তোমার আযাবের মুকাবিলায় কোনো উপকার করতে পারে না। অসৎ কাজ থেকে বেঁচে থাকার এবং সৎকাজ করার কারো ক্ষমতা নেই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া। আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই, আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি, সকল নে‘আমত ও সকল অনুগ্রহ তাঁরই, আর তাঁরই সকল সুন্দর গুণগান। আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই, আমরা তাঁর ইবাদতের জন্যই নিবেদিত, যদিও তা কাফেরদের নিকট অপছন্দনীয়।”
৪. তিনি স্বীয় উম্মতকে প্রত্যেক ফরয সালাত শেষে সুবহানাল্লাহ্৩৩ বার, আল-হামদু লিল্লাহ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার৩৩ বার পাঠ করে
(لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمدُ وهو على كل شيء قدير)
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর, ১ বার পড়ে মোট ১০০ বার পূর্ণ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেন।

(ঙ) নফল ও রাত্রিকালীন সালাত প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[33]:
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাত সালাত ও সাধারণ নফল সালাতসমূহ সাধারণত স্বগৃহে আদায় করতেন, বিশেষ করে মাগরিবের সুন্নাত।
২. তিনি মুক্বিম অবস্থায় সর্বদা দশ রাকাত সালাত নিয়মিত পড়তেন, যোহরের পূর্বে দুই রাকাত ও পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পর দুই রাকাত, এশার পর ঘরে এসে দুই রাকাত এবং ফজরের পূর্বে দুই রাকাত।
৩. তিনি সকল নফল সালাত হতে ফজরের সুন্নাতের প্রতি সর্বাধিক তৎপর ছিলেন। তিনি ফজরের সুন্নাত এবং বিতরের সালাত কখনই ছাড়েন নি, সফর অবস্থায়ও না আর মুক্বিম অবস্থায়ও না, আর তাঁর থেকে সফরকালীন অবস্থায় এই দুটি সালাত ছাড়া অন্য কোনো নিয়মিত নফল সালাত পড়া প্রমাণিত নেই।
৪. তিনি ফজরের সুন্নাত পড়ে ডান কাতে শুইতেন।
৫. তিনি কখনো কখনো যোহরের পূর্বে চার রাকাত পড়তেন। একদা যোহরের পরের দুরাকাত ছুটে গেলে আসরের পর তা আদায় করেন।
৬. তিনি অধিকাংশ সময়ে তাহাজ্জুদের সালাত দাঁড়ানো অবস্থায় আদায় করতেন, আবার অনেক সময় বসে বসে আদায় করেন, আবার কখনো বসে বসে কেরাত পড়তেন, সামান্য কেরাত অবশিষ্ট থাকতে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং দাঁড়ানো অবস্থায় রুকু করতেন।
৭. তিনি তাহাজ্জুদের সালাত আট রাকাত পড়তেন এবং প্রত্যেক দুরাকাতের পর সালাম ফিরাতেন। অতঃপর তিনি একটানা পাঁচ রাকাতে বিতিরের সালাত পড়তেন এবং সর্বশেষে শুধু একবার বসতেন, অথবা নয় রাকাতে বিতির পড়তেন এভাবে যে, আট রাকাত একটানা পড়ার পর বসে আত্তাহিয়্যাতু পড়ে সালাম না ফিরিয়ে আবার উঠে এক রাকাত পড়ে বসে আত্তাহিয়্যাতু পড়ে সালাম ফিরাতেন, পরন্তু বিতরের সালামের পর আরো দুরাকাত পড়তেন, কিংবা উক্ত নয় রাকাতের ন্যায় সাত রাকাতে বিতর পড়তেন, অতঃপর আরো দুরাকাত বসে পড়তেন।
৮. তিনি রাতের প্রথমাংশে, মধ্যমাংশে ও শেষাংশে বিতরের সালাত আদায় করেন। তিনি ইরশাদ করেন যে, তোমরা তোমাদের রাত্রিকালীন সালাতের শেষাংশ বিতর করো।[34]
৯. তিনি বিতরের পর দুরাকাত কখনো বসা অবস্থায় পড়তেন, আবার কখনো উক্ত দু রাকাতে বসা অবস্থায় কেরাত পাঠ করার পর রুকু করার ইচ্ছা করলে খাড়া হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় রুকু করতেন।
১০. তিনি ঘুমিয়ে পড়া কিংবা অসুখের কারণে তাঁর রাত্রিকালীন সালাত-তাহাজ্জুদ ছুটে গেলে তিনি দিনে (দুপুর হওয়ার পূর্বে ১১ রাকাতের পরিবর্তে) ১২ রাকাত সালাত আদায় করতেন।
১১. তিনি কোনো এক রাতে তাহাজ্জুদে একটি আয়াত {সূরা মায়েদার ১১৮ নং আয়াতটি} তিলাওয়াত করেন এবং সেটি সকাল পর্যন্ত বারংবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন।[35]
১২. তিনি রাত্রিকালীন সালাতে কখনো নিম্নঃস্বরে, আবার কখনো উচ্চঃস্বরে কুরআন পাঠ করতেন, আর ক্বিয়াম কখনো লম্বা, আবার কখনো সংক্ষিপ্ত করতেন।
১৩. তিনি বিতিরের সালাতে সূরাতুল আ‘লা ও সূরা কাফিরূনএবং সূরা ইখলাসপাঠ করতেন, যখন সালাম ফিরাতেন তখন তিনবার বলতেন:
(سبحان الملك القدوس)
‘সুবহা-নাল মালিকিল কুদ্দুস, -তৃতীয়বারে তিনি এই শব্দগুলো একটু বেশী টেনে উচ্চঃস্বরে বলতেন।[36]


(৩) জুমআহ্ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[37]:

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর আদর্শ ছিল জুমআর দিনকে বড় মনে করা ও মর্যাদাবান জ্ঞান করা এবং কতিপয় বৈশিষ্টাবলী সেই দিনের জন্যে নির্ধারণ করা। তন্মধ্যে জুমআর দিনে গোসল করা, সবচেয়ে উত্তম কাপড় পরিধান করা, ইমামের খুৎবা মনোযোগ সহকারে ওয়াজিব মনে করে শ্রবণ করা।
২. লোক সমবেত হয়ে গেলে তিনি মসজিদে প্রবেশ করে উপস্থিত সবাইকে সালাম দিতেন, তারপর মিম্বরে উঠে লোকদের মুখী হয়ে সালাম করতেন, তারপর তিনি মিম্বরে আরোহণ করে বসতেন, তখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আযান শুরু করতেন, আযান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি খুৎবা আরম্ভ করতেন এবং আযান ও খুতবার মধ্যে কোনো কালক্ষেপন করতেন না। তাঁর জন্যে মিম্বর তৈরী করার পূর্বে তিনি ধনুক কিংবা লাঠির উপর ভর দিয়ে খুৎবা দিতেন।
৩. তিনি সর্বদা মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন, অতঃপর সামান্য বসে পুনরায় উঠে দ্বিতীয় খুৎবা দিতেন।
৪. তিনি লোকদেরকে তাঁর নিকটবর্তী হয়ে নীরবে মনোযোগ সহকারে খুৎবা শ্রবণ করার নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন, ‘যে ব্যক্তি খুৎবার সময় তার সাথীকে বললো: তুমি চুপ থাক! সেই ব্যক্তিও অর্থহীন কাজ করলো, আর যে কেউ তখন অর্থহীন কাজ করল তার জুমআ বিনষ্ট হয়ে গেল।”
৫. খুৎবা দেওয়ার সময় তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে যেতো, স্বর উচ্চ হতো এবং তাঁর রাগভাব খুব বেড়ে যেতো, মনে হতো যেন তিনি কোনো সৈন্য বাহিনীকে হামলার ভয় প্রদর্শণকারী।
৬. তিনি খুৎবায়, ‘আম্মা বা‘দুবলতেন এবং খুৎবা সংক্ষিপ্ত, আর সালাত লম্বা করতেন।
৭. তিনি খুৎবায় সাহাবীদেরকে ইসলামী নীতিমালা, শরীয়াতের বিধি-বিধানসমূহ শিক্ষা দিতেন এবং উপস্থিত প্রয়োজন অনুযায়ী আদেশ-নিষেধ করতেন।
৮. তিনি উপস্থিত প্রয়োজনে কিংবা কারো প্রশ্নের উত্তর দানের উদ্দেশ্যে খুৎবা বন্ধ করে দিতেন, প্রয়োজন সেরে পুনরায় খুৎবা সমাপ্ত করতেন, প্রয়োজনে কখনো তিনি মিম্বর থেকে নেমে প্রয়োজন সেরে পুনরায় মিম্বরে ফিরে যেতেন। তিনি উপস্থিত চাহিদা অনুযায়ী বক্তব্য রাখতেন, তিনি সেখানে কোনো ক্ষুধার্ত কিংবা অভাবগ্রন্থ লোক দেখলে তাদেরকে দান-সদকা করার নির্দেশ দিতেন এবং সে জন্যে উৎসাহিত করতেন।
৯. তিনি খুৎবায় আল্লাহর নাম উচ্চারণকালে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। অনাবৃষ্টির কারণে অভাব দেখা দিলে তিনি খুৎবায় বৃষ্টির জন্য দুআ করতেন।
১০. তিনি জুমআর সালাত শেষে ঘরে গিয়ে দুরাকাত সুন্নাত পড়তেন, আর যারা মসজিদে আদায় করতেন তাদেরকে চার রাকাত পড়ার নির্দেশ দিতেন।


(৪) দুই ঈদের সালাতে তাঁর আদর্শমালা[38]

১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের সালাত সর্বদা ঈদগাহে আদায় করতেন এবং সবচেয়ে সুন্দর কাপড় পরিধান করে সুসজ্জিত হতেন।
২. তিনি ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন, পক্ষান্তরে ঈদুল আযহার দিন সকালে ঈদগাহ থেকে আসা পর্যন্ত কিছু খেতেন না, বরং ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোস্ত খেতেন। তিনি ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্বে, আর ঈদুল আযহার সালাত সকাল সকালে আদায় করতেন।
৩. তিনি ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যেতেন এবং তাঁর আগে একটি বর্শা উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, ঈদগাহে পৌঁছার পর তা সুতরাস্বরূপ তাঁর সামনে স্থাপন করা হতো, যাতে তিনি তার দিকে ফিরে সালাত আদায় করেন।
৪. তিনি ঈদগাহে পৌঁছে আযান-ইক্বামত ছাড়াই ঈদের সালাত শুরু করতেন, এমনকি সালাত শুরু হলোএ কথাটিও বলতেন না, ঈদগাহে পৌঁছে তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ ঈদের সালাতের পূর্বে কিংবা পরে কোনো সালাত পড়তেন না।
৫. তিনি খুৎবার পূর্বে ঈদের দুরাকাত সালাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে কেরাতের পূর্বে তাকবীরে তাহরীমাহ্ সহ লাগাতার সাতটি তাকবীর দিতেন, প্রতি দুই তাকবীরের মাঝে সামান্য একটু চুপ থাকতেন, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট দুআ পড়তেন বলে কোনো বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাকবীর শেষে কেরাত আরম্ভ করতেন এবং কেরাত শেষে তাকবীর বলে রুকু করতেন। অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতে লাগাতার আরো পাঁচটি তাকবীর দিতেন, তারপর কেরাত পাঠ করে যথাযথ নিয়মে সালাত সম্পন্ন করে মানুষের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন, এ অবস্থায় মানুষেরা নিজ-নিজ কাতারে বসে থাকতো তিনি তাদেরকে ওয়াজ-নসীহত ও আদেশ-নিষেধ করতেন। তিনি প্রথম রাকাতে সূরা ক্বাফ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ক্বামার পড়তেন, আবার কখনো প্রথম রাকাতে সূরা আ‘লা এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশীয়াহ্ পাঠ করতেন।
৬. তিনি যমীনে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন এবং সেখানে কোনো মিম্বর ছিল না। ৭. তিনি খুৎবা শোনার জন্যে না বসারও অনুমতি দেন। আর পবিত্র ঈদ যদি জুমআর দিনে হয়, তাহলে ঈদের সালাত জুম‘আর জন্য যথেষ্ট হবে বলেন। অর্থাৎ সেদিন জুমআর সালাতের পরিবর্তে যোহরের সালাত আদায় করলে যথেষ্ট হবে তিনি ঘোষণা করেন।
৮. তিনি ঈদের দিন রাস্তা পরিবর্তন করে এক রাস্তায় ঈদগাহে যেতেন এবং অপর রাস্তা দিয়ে বাড়ী ফিরে আসতেন।

(৫) সূর্য গ্রহণ কালে তাঁর আদর্শমালা[39]

১. যখন একবার সূর্য গ্রহণ হলো তখন তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে স্বীয় চাদর টানতে টানতে মসজিদের দিকে বের হন এবং অগ্রসর হয়ে লোকদের নিয়ে দুরাকাত সালাত পড়লেন, তারপর খুব লম্বা করে রুকু করলেন, অতঃপর রুকু থেকে মাথা উত্তোলন করলেন তখন বললেন: সামিআল্লা-হু লিমান হামিদা‘রাববানা ওয়া-লাকাল হামদ’। অতঃপর আবার ক্বেরাত শুরু করেন এবং এরপর পুনরায় রুকু করলেন, তবে এই রুকু তুলনামুলকভাবে প্রথম রুকুর চাইতে হাল্কা ছিল, তারপর রুকু থেকে মাথা উঠালেন, অতঃপর লম্বা সিজদা করলেন। অতঃপর দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় রাকাতে তাই করলেন যা প্রথম রাকাতে করেছিলেন। তাই প্রত্যেক রাকাতে দুই রুকু ও দুই সিজদা ছিল। অতঃপর সালাত শেষে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং উচ্চতর ভাষাসম্পন্ন খুৎবা প্রদান করলেন।
২. তিনি সূর্য গ্রহণের সময় আল্লাহর যিকর-সালাত ও আল্লাহ নিকট দু‘আ-ইসতিগফার, দান-খায়রাত এবং গোলাম আযাদ করার নির্দেশ প্রদান করেন।


(৬) ইস্তেস্কা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[40]

১ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবার সময় মিম্বরের উপর ইস্তিসকা, অর্থাৎ বৃষ্টির জন্য দুআ করতেন। জুমআর দিন ছাড়াও তিনি ইস্তিসকা করেন, একদা তিনি মসজিদে নববীতে বসা অবস্থায় দুহাত উত্তোলন এবং মহান আল্লাহর নিকট ইস্তিস্কা বা বৃষ্টি প্রার্থনা করেন।
২. ইস্তিসকার সময় নিম্নোক্ত কতিপয় দুআ পাঠ করা তাঁর থেকে প্রমাণিত রয়েছে:
(اللهم اسق عبادك وبهائمك وانشر رحمتك وأحي بلدك الميت)
‘আল্লা-হুম্মাসকি ইবা-দাকা, ওয়া বাহাইমাকা, ওয়ানশুর রাহমাতাকা, ওয়া আহয়ী বালাদাকাল মাইয়্যেত।
“হে আল্লাহ ! তুমি তোমার বান্দাদেরকে এবং জীব-জন্তুদেরকে পানি পান করাও, আর তোমার রহমত ছড়িয়ে দাও এবং তোমার মৃত শহরকে সজীব কর।
তিনি আরো বলতেন:
(اللهم اسقنا غيثا مغيثا مريئا مريعا نافعا غير ضار عاجلاً غير آجل)
‘আল্লা-হুম্মাসকিনা গাইছাম-মুগীছান, মুরীআন, না-ফিআন-গায়রা যা-ররিন, ‘আ-জিলান-গায়রা আ-জিলিন।[41]
“হে আল্লাহ ! তুমি আমাদেরকে এমন বৃষ্টির পানি পান করাও যা ফরিয়াদ দূরকারী, পিপাসা নিবারণকারী, সাচ্ছন্দ্য প্রদানকারী, শষ্য-ফসল উৎপাদনকারী, উপকারী-অপকারী নয়, শীর্ঘ্রই, বিলম্বে নয়।”
৩. তিনি যখন মেঘ ও বাতাসের প্রচণ্ডতা দেখতেন, তখন তাঁর মুখমণ্ডলে ভয়-বিষণ্ণতা দেখা যেতো, তবে বৃষ্টি বর্ষণ শেষ হয়ে গেলে তা দূর হয়ে যেতো।
৪. তিনি বৃষ্টির সময়ে এ দু‘আটি বলতেন :
(اللهم صيباً نافعاً)
‘আল্লা-হুম্মা সাইয়্যাবান না-ফি‘আন।[42]
“হে আল্লাহ! মুসলধারায় উপকারী বৃষ্টি বর্ষাও।”
আর তিনি শরীরের কাপড় খুলে দিতেন, যাতে বৃষ্টির ফোটা গায়ে পড়ে, এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলেন: বৃষ্টি তার প্রভুর নিকট হতে নবাগত।[43]
৫. সাহাবীগণ তাঁর নিকট অতি বৃষ্টির অভিযোগ করলে তিনি বৃষ্টি বন্ধের জন্যে দুআ করে বলেন:
(اللهم حوالينا ولا علينا، اللهم على الآكام والظراب وبطون الأودية ومنابت الشجر)
‘আল্লা-হুম্মা হাওয়া-লাইনা ওয়ালা ‘আলাইনা, আল্লা-হুম্মা ‘আলাল-আ-কামে, ওয়ায-যিরাবে, ওয়া বুতুনিল-আওদিয়াতে, ওয়া মানা-বিতিশ শাজারে।[44]
“হে আল্লাহ! আমাদের আশে-পাশে বর্ষণ কর, আমাদের উপর নয়, হে আল্লাহ! টিলা-পাহাড়, নদী-নালা, খাল-বিল, বন-জঙ্গল এবং বৃক্ষ উৎপাদনের জায়গায় বৃষ্টি বর্ষণ কর।


(৭) সালাতুল খাওফ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[45]

১. সালাতুল খাওফ বা যুদ্ধ ও ভয়-ভীতির সময়কার সালাত প্রসঙ্গে তাঁর নীতিমালা ছিল যে, শত্রু সেনাদল যদি তাঁর মাঝে ও ক্বিবলার মাঝে অবস্থান করে থাকে, তবে তিনি মুসলিম সৈন্যদেরকে তাঁর পিছনে দুকাতারে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে সালাতের জন্য তাকবীর বলতেন এবং তাঁরাও তাকবীর বলে সালাত শুরু করতো, অতঃপর তাঁরা সবাই রুকু করতেন এবং একসাথে রুকু থেকে মাথা উঠাতেন, অতঃপর প্রথম কাতারের সেনাদল সিজদায় যেতো এবং দ্বিতীয় কাতারের সেনাদল শত্রু সৈন্যদের মুখোমুখি দণ্ডায়মান হতো, আর যখন তিনি দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াতেন, তখন পিছন কাতারের সেনাদল দু’টি সিজদা করে দাঁড়িয়ে প্রথম কাতারের স্থানে অগ্রসর হতো এবং প্রথম কাতারের সেনাদল দ্বিতীয় কাতারে চলে যেতো, এভাবে সবাই প্রথম কাতারের ফযিলত অর্জন করত এবং দ্বিতীয় কাতারের সেনাদল তাঁর সাথে দ্বিতীয় রাকাতের সিজদায় যেতেন, (সেটার বিস্তারিত রূপ হচ্ছে,) সুতরাং দ্বিতীয় রাকাতের রুকু থেকে দাঁড়ানোর পর উভয় দল তাই করতো যা প্রথম রাকাতে করেছিল, অতঃপর যখন তিনি তাশাহহুদের জন্য বসতেন, তখন পিছনের কাতারের সেনাদল দুটি সিজদা করে তাঁর সাথে তাশাহহুদে মিলিত হতো, আর সবাই এক সাথে সালাম ফিরাতো।
২. শত্রু সেনাদল ক্বিবলা ছাড়া অন্য কোনো দিকে অবস্থান করলে, তখন তিনি কখনো মুসলিম সেনাদলকে দুভাগ করে একভাগকে শত্রু সৈন্যদলের মুখোমুখি করতেন এবং অপর ভাগকে নিয়ে তিনি সালাতে দাঁড়াতেন, তখন এই দল তাঁর সাথে এক রাকাত সালাত আদায় করার পর শত্রু সৈন্যদের মুখোমুখি অবস্থানরত দলের নিকট চলে যেতো এবং শত্রু সৈন্যদের সম্মুখে দন্ডায়মান হতো, অতঃপর দ্বিতীয় দলটি এসে তাঁর সাথে সালাতে শরীক হয়ে এক রাকাত আদায় করতো, অতঃপর তিনি সালাম ফিরালে প্রত্যেক দলই ইমামের সালামের পর নিজে নিজে এক রাকাত পড়ে সালাত পূর্ণ করতো।
৩. আবার কখনো তিনি একদলকে নিয়ে এক রাকাত পড়ার পর যখন দ্বিতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়াতেন, তখন এ দলটি তাদের দ্বিতীয় রাকাত পূর্ণ করে তাঁর রুকুর পূর্বেই সালাম ফিরাতো, অতঃপর দ্বিতীয় দল এসে তাঁর সাথে অপর রাকাত পড়তো, অতঃপর তিনি যখন তাশাহহুদের জন্য বসতেন, তখন এ দলটি দাঁড়িয়ে তাদের অপর রাকাত পূর্ণ করতো, আর তিনি তাশাহহুদে তাদের অপেক্ষা করতেন, পরন্তু এই দলটি তাশাহহুদ পাঠ করার পর তাদেরকে সাথে নিয়ে সালাম ফিরাতেন।
৪. আবার কখনো তিনি একদলকে নিয়ে সালাম ফিরাতেন, অতঃপর দ্বিতীয় দলকে নিয়ে আবার দুরাকাত পড়ে সালাম ফিরাতেন।
৫. আবার কখনো এক দলকে নিয়ে এক রাকাত পড়তেন এবং এ দল চলে যেতো এবং সালাত পূর্ণ করতো না, অতঃপর দ্বিতীয় দলটি এসে তাঁর সাথে এক রাকাত পড়তো এবং সালাত পূর্ণ করতো না, এভাবে তিনি দুরাকাত পড়তেন, কিন্তু তারা এক এক রাকাত আদায় করতো।


(৮) মৃত ব্যক্তির কাফন-দাফন প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[46]

১. মৃতব্যক্তির কাফন-দাফন প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা ছিল সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ এবং অন্যান্য জাতির নীতিমালা হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং মৃতব্যক্তির প্রতি তার পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-পরিজনের দয়া-অনুগ্রহের সর্বোত্তম নিদর্শন; যার প্রথমে ছিল অসুস্থতার সময় তাকে দেখা-শোনা করা, পরকালীন জীবনের সুখ-শান্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং তাকে ওসীয়্যাত ও তাওবা করার জন্য উৎসাহিত করা। আর উপস্থিত লোকদের নির্দেশ প্রদান করা তারা যেন তাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহসাক্ষ্যবাণীর তালক্বীন করে থাকে, যাতে উক্তবাণী তার সর্বশেষ কথা হয়।
২. তিনি ছিলেন আল্লাহর ফায়সালার উপর সৃষ্টির সর্বাধিক সন্তুষ্ট এবং সর্বাধিক তাঁর প্রশংসাকারী, তিনি ছেলে ইবরাহীমের মৃত্যুতে দয়াপরশ হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্রন্দন করেন, কিন্তু তাঁর অন্তর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও শোকরে পরিপূর্ণ এবং যবান মুবারাক আল্লাহর যিকর ও প্রশংসায় মাশগুল ছিল। তিনি বলেন: “চক্ষু অশ্রুসিক্ত এবং অন্তর দুঃখিত, কিন্তু মুখে শুধু এমন কথাই বলব, যাতে প্রভু হন সন্তুষ্ট।[47]
৩. জাহিলী যুগের অনুসরণে গাল চিরে, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ও চিৎকারে করে মৃত্যের জন্য বিলাপ করতে তিনি নিষেধ করেছেন।
৪. তাঁর আদর্শ ছিল মাইয়্যেতের কাফন-দাফনে তাড়াহুড়া করা, মাইয়্যেতকে পরিষ্কার-পবিত্র করা এবং সাদা কাপড় দ্বারা কাফন দেওয়া।
৫. তাঁর আদর্শ ছিল মাইয়্যেতের মুখমণ্ডল ও শরীর ঢেকে দেওয়া এবং চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে দেওয়া।
৬. তিনি কখনো কখনো মাইয়্যেতকে চুমু দিতেন।
৭. তিনি মাইয়্যেতকে তিনবার, পাঁচবার, প্রয়োজনবোধে আরো বেশীবার ধৌত করার এবং শেষ বারে তার গায়ে কর্পুর কিংবা কর্পুর জাতীয় কোনো সুগন্ধ বস্তু ছিটিয়ে দিতে আদেশ করেন।
৮. তিনি যুদ্ধে নিহত শহীদকে গোসল দিতেন না এবং তাঁদের থেকে চামড়ার নির্মিত বস্তু ও লোহা জাতীয় জিনিসগুলো খোলে নিতেন, আর তাঁদেরকে রক্তমাখা কাপড়-চোপড়সহ দাফন করতেন এবং তাঁদের উপর জানাযার সালাত কখনও পড়েননি।
৯. হজ্জ-ওমরার ইহরামকারী ব্যক্তিকে কুল পাতা মিশানো পানি দ্বারা গোসল দিতে এবং তার ইহরামের কাপড় দ্বারা কাফন দিতে নির্দেশ দেন, আর তাকে কোনো সুগন্ধি বস্তু স্পর্শ করানো এবং তার মাথা চাদর দ্বারা ঢেকে দিতে নিষেধ করেন।
১০. তিনি মৃতের অভিভাবককে সুন্দর ও সাদা কাপড়ে কাফন দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং কাফনে বেশী দামী কাপড় ব্যবহার করতে বারণ করেন।
১১. তাঁর আদর্শ ছিল যদি কাফন ছোট-খাট হতো, যাদ্বারা মাইয়্যেতের সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করা যেতো না, তাহলে তিনি তার মাথা ঢেকে পায়ের দিকে কিছু তাজা ঘাস রেখে দিতেন।

(ক) জানাযার সালাত প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[48]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের বাহিরে মাইয়্যেতের উপর জানাযার সালাত আদায় করতেন, আবার কখনো মসজিদের ভিতর জানাযার সালাত পড়েন, কিন্তু তা তাঁর নিয়মিত আদর্শ ছিল না।
২. যখন তাঁর কাছে কোনো মাইয়্যেত আনা হতো, তখন তিনি তার ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন।[49] তার উপর কোনো ঋণ না থাকলে জানাযার সালাত পড়তেন, নচেৎ তিনি নিজে তার উপর জানাযার সালাত পড়তেন না, সাহাবীদেরকে পড়ার নির্দেশ দিতেন। অতঃপর আল্লাহ্ যখন তাঁকে বিজয়ী করেন, তখন তিনি ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির উপর জানাযার সালাত পড়েন এবং নিজেই তার ঋণ পরিশোধ করতেন, আর তার পরিত্যক্ত ধন-সম্পদ তার উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে দিতেন।
৩. তিনি যখন জানাযার সালাত শুরু করতেন তখন তাকবীর দিতেন তারপর আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করতেন এবং দুআ করতেন, আর তিনি চার তাকবীর দ্বারা জানাযার সালাত আদায় করতেন, তবে কখনো কখনো পাঁচ তাকবীর দেন।
৪. তিনি মাইয়্যেতের জন্য নিষ্ঠার সাথে দুআ করার নির্দেশ দেন এবং তাঁর থেকে নিম্নোক্ত দুআ পাঠ সংরক্ষিত আছে:
(اللهم اغفر لحينا وميتنا وشاهدنا وغائبنا وصغيرنا وكبيرنا وذكرنا وأنثانا، اللهم من أحييته منا فأحيه على الإسلام، ومن توفيته منا فتوفه على الإيمان، اللهم لا تحرمنا أجره ولا تفتنا بعده).
‘আল্লা-হুম্মাগফির লিহাইয়িনা ওয়ামায়্যিতিনা, ওয়া শা-হিদিনা ওয়া গা-য়িবিনা, ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা, ওয়া যাকারিনা ওযা উনসানা, আল্লা-হুম্মা মান্ আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহী ‘আলাল ইসলাম, ওয়ামান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু ‘আলাল ঈমান, আল্লা-হুম্মা লা-তাহরিমনা আজরাহু ওয়ালা তাফতিন্না-বা‘আদাহ।[50]
“হে আল্লাহ! আমাদের জীবতি ও মৃত, উপস্থিত-অনুপস্থিত, আর আমাদের ছোট-বড় এবং আমাদের নর-নারী সবাইকে ক্ষমা করে দাও, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্য হতে যাকে তুমি জীবিত রাখতে চাও, তাকে তুমি ইসলামের উপর জীবিত রাখো, আর যাকে তুমি মৃত্যু দিতে চাও, তাকে তুমি ঈমানের উপর মৃত্যু দাও, হে আল্লাহ্! এই মাইয়্যেতের প্রতিদান থেকে আমাদের বঞ্চিত করো না এবং এর পরে আমাদের ফেতনায় লিপ্ত করো না।
(اللهم اغفر له، وارحمه، وعافه، واعف عنه، وأكرم نزله، ووسع مدخله، واغسله بالماء والثلج والبرد، ونقه من الخطايا كما نقيت الثوب الأبيض من الدنس، وأبدله خيراً من داره وأهلاً من أهله، وزوجاً خيراً من زوجه، وأدخله الجنة وأعذه من عذاب القبر ومن عذاب النار)
‘আল্লা-হুম্মাগফির লাহু, ওয়ারহামহু, ওয়া আ-ফিহী, ওয়া‘ফু আনহু, ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি‘ মুদখালাহু, ওয়াগসিলহু বিলমা-য়ি ওয়াস্ সালাজি ওয়াল বারাদি, ওয়া নাককিহী মিনাল খাতায়া কামা-নাক্কাইতাস্ সাওবাল্ আব্ইয়াদ্বা মিনাদ-দানাস, ওয়া আবদিলহু দারান্ খাইরাম মিন্ দা-রিহী ওয়া আহলান্ খাইরাম মিন্ আহলিহী, ওয়া যাওজান্ খাইরান মিন্ যাওজিহী, ওয়া আদ্ খিলহুল জান্নাতা, ওয়া আ‘য়িযহু মিন্ আযাবিল ক্বাবরি ওয়া মিন্ আযাবিন্ না-র।[51]
“হে আল্লাহ্ তুমি তাকে মাফ কর, তার উপর রহম কর, তাকে পূর্ণ নিরাপত্তায় রাখ, তাকে ক্ষমা কর, মর্যাদার সাথে তার আতিথেয়তা কর, তার বাসস্থান প্রশস্ত করে দাও, তুমি তাকে ধৌত কর পানি, বরফ ও শিশির দিয়ে, তুমি তাকে গুনাহ হতে এমনভাবে পরিষ্কার কর যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা হতে পরিষ্কার করা হয়, আর তার পার্থিব ঘরের চেয়ে তুমি তাকে একটি উত্তম ঘর দান কর এবং তার পরিবারের বদলে এক উত্তম পরিবার এবং জোড়ার চেয়ে এক উত্তম জোড়া দান কর, আর তাকে তুমি জান্নাতে দাখিল কর এবং কবরের আযাব ও জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে তাকে মুক্তি দাও।
৫. তিনি পুরুষ লাশের মাথা বরাবর এবং মহিলা লাশের মাঝ বরাবর দাঁড়াতেন।
৬. তিনি নাবালেগ শিশুর উপর জানাযার সালাত পড়তেন, আর তিনি আত্মহত্যাকারী এবং গনীতমের মালে খেয়ানতকারীর উপর জানাযার সালাত পড়তেন না।
৭. তিনি জুহানিয়্যাহ গোত্রের সেই মহিলার উপর জানাযার সালাত পড়েন, যার উপর তিনি ব্যভিচারের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করেছিলেন।
৮. তিনি বাদশাহ নাজাশীর উপর গায়েবী জানাযা পড়েন, কিন্তু প্রত্যেক মাইয়্যেতের উপর গায়েবী জানাযা পড়া তাঁর আদর্শ ছিল না।
৯. তাঁর আদর্শ ছিল কারো উপর জানাযার সালাত ছুটে গেলে, তিনি তা তার কবরের উপর আদায় করতেন।

(খ) দাফন ও তার সংশ্লিষ্ঠ বিষয়াদি প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[52]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাযা শেষে লাশের আগে-আগে পাঁয়ে হেঁটে গোরস্থান পর্যন্ত যেতেন এবং যানবাহনে আরোহণকারীদের জন্য লাশের পিছনে থাকা সুন্নাত করেন, আর পাঁয়ে হেঁটে গমনকারীগণ যেন লাশের নিকটে থাকে সামনে কিংবা পিছনে, ডানে কিংবা বামে এবং লাশ বহন করে তাড়াতাড়ি চলার নির্দেশ দেন।
২. তিনি বসতেন না যতক্ষণ না যমীনে লাশ রাখা হতো।
৩. তিনি জানাযার সম্মানার্থে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন, কিন্তু বসে থাকাও তাঁর থেকে সহীহ্ হাদীসে প্রমাণিত আছে।
৪. তাঁর আদর্শ ছিল সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত এবং ঠিক দুপরের সময় মাইয়্যেত দাফন না করা।
৫. তাঁর আদর্শ ছিল কবর লাহদ করা, কবর গভীর করা এবং মাইয়্যেতের মাথা ও পাঁদ্বয় বরাবর কবরকে প্রশস্ত করা।
৬. তিনি দাফন শেষে মাইয়েতের উপর তার মাথার দিক থেকে তিনবার মাটি নিক্ষেপ করতেন।
৭. তিনি মাইয়্যেত দাফন শেষে তার কবরের উপর দাঁড়িয়ে সাওয়াল-জওয়াবে সাবিত থাকার জন্য দুআ করেন এবং সাহাবীগণকে এ বিষয়ে নির্দেশ দেন।[53]
৮. তিনি কবরের উপর বসে (কুরআনুল কারীম হতে) কিছু পাঠ করতেন না, আর না মাইয়্যেতকে সাওয়াল-জওয়াব শিক্ষা দিতেন।
৯. তাঁর আদর্শ ছিল মাইয়্যেতের জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি না করা, বরং তিনি তা থেকে কঠোরভাবে বারণ করতেন।

(গ) কবর ও শোকবার্তা বা সান্তনা প্রদান প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[54]
১. তাঁর আদর্শ ছিল না কবরসমূহ উঁচু করা, তার উপর ঘর তৈরী করা, পাথর-ইট ইত্যাদি দিয়ে গম্বুজের মত তৈরী করা।
২. তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে ইয়ামেন দেশে প্রেরণ করেন, যাতে সকল মুর্তি ভেঙ্গে চুর্ণ বিচুর্ণ করে ফেলেন এবং উঁচু কবরকে ভেঙ্গে সমান করে দেন। অতএব তাঁর আদর্শ হলো উঁচু কবরকে ভেঙ্গে সমান করে দেওয়া।
৩. তিনি কবর চুনা করা, কবরের উপর ঘর তৈরী করা এবং কবরের উপর নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে নিষেধ করেন।
৪. যে কবরের পরিচয় রাখতে চায়, তিনি তার উপর একটুকরা পাথর রেখে দিতে বলতেন।
৫. তিনি কবরকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করা এবং এসব কর্মে লিপ্ত লোকদের প্রতি অভিসম্পাত করেন।
৬. তাঁর আদর্শ ছিল কবরসমূহ অপমানিত বা পদদলিত না করা, কবরের উপর না বসা এবং তার উপর ঠেস না লাগানো এবং কবরকে মহৎ কিছু মনে না করা।
৭. তিনি সাহাবীদের কবর যিয়ারত করতেন, তাদের জন্য দুআ ও ক্ষমা প্রার্থনা করার লক্ষ্যে, আর কবর যিয়ারতকারীর জন্য এ দুআ পাঠ করা সুন্নাত করেন:
(السلام عليكم أهل الديار من المؤمنين والمسلمين، وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، نسأل الله لنا ولكم العافية)
‘আস্-সালামু আলাইকুম আহলাদ-দিয়ারি মিনাল মুমিনীনা ওয়াল মুসলিমীন, ওয়া ইন্না ইনশা-আল্লাহু বিকুম লাহিকুন, নাছ্আলুল্লাহ লা-না ওয়া লাকুমুল ‘আফিয়াহ।[55]
“হে কবরের অধিবাসী মুমিন-মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক, আর আমরাও ইন-শা-আল্লাহ্ তোমাদের সাথে মিলিত হবো, আমরা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।
৮. তাঁর আদর্শ ছিল মাইয়্যেতের শোকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া, কিন্তু সান্ত্বনা প্রদানের জন্য একত্রিত হওয়া এবং মাইয়্যেতের জন্য কবরের পার্শ্বে কিংবা অন্য কোথাও কুরআনখানী করা তাঁর আদর্শ ছিল না।
৯. তাঁর আদর্শ ছিল মাইয়্যেতের পরিবার যেন লোকদের খাবারের আয়োজনের কষ্ট না করে, বরং তিনি লোকদের নির্দেশ প্রদান করেন: তারা যেন মাইয়্যেতের শোকার্ত পরিবারের জন্য খাবারের আয়োজন করে।


(৯) যাকাত ও দান-সদকা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালার বিবরণ[56]

(ক) যাকাত প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা: -
১. যাকাতের সময়-সীমা, পরিমাণ ও নেসাব এবং যাকাত কার উপর ফরয হবে এবং যাকাতের হকদার কারা? এসব বিষয়ে তাঁর আদর্শমালা সর্বাধিক পুর্ণাঙ্গযাতে ধনী-দরিদ্র উভয়ের কল্যাণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছে এবং ধনীদের সম্পদে সেই পরিমাণ যাকাত ফরয করা হয়েছে যদ্বারা ফকীরের প্রয়োজন পূরণ হয়, কারো প্রতি অবিচার করা ছাড়া।
২. যখন তিনি কোনো ব্যক্তিকে যাকাতের হকদার বলে জ্ঞাত হতেন, তখন তাকে যাকাতের মাল থেকে প্রদান করতেন, আর অপরিচিত কোনো ব্যক্তি যার অবস্থা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন তাঁর নিকট যাকাতের মাল চাইলে, তিনি তাকে এ কথা বলার পর প্রদান করতেন যে, যাকাতের মালে ধনী ও সক্ষম উপার্জনকারী ব্যক্তির কোনো অংশ নেই।
৩. তাঁর আদর্শ ছিল যাকাতের মাল ধনীদের থেকে সংগ্রহ করে সে দেশের দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা, অতঃপর কিছু অতিরিক্ত হলে তাঁর নিকট মদীনায় নিয়ে আসলে তিনি তা বন্টন করে দিতেন।
৪. তিনি শুধু প্রকাশ্য মাল যথা চতুস্পদ জন্তু ও জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের যাকাত সংগ্রহ করার জন্যে দূত প্রেরণ করতেন।
৫. তিনি উৎপাদিত শস্যের অনুমান করার জন্যে লোক প্রেরণ করতেন, যিনি খেজুর বাগানের খেজুর ও আঙ্গুরের লতায় আঙ্গুর অনুমান করতো, অতঃপর কত ওসক্ব হবে[57] অনুমান করে সেই পরিমান যাকাত নির্ধারণ করতো।
৬. তাঁর আদর্শ ছিল না ঘোড়া-গাধা, খচ্ছর এবং ক্রীতদাসের যাকাত গ্রহণ করা, অনুরূপ সব্জী, ফল-ফসলাদি যেগুলো তোলা-ওজন করা হয় না এবং গুদামজাত করা হয় না, কিন্তু তিনি আঙ্গুর ও পাকা খেজুরের যাকাত সংগ্রহ করতেন, তা তাজা হোক কিংবা শুষ্ক হোক এতে কোনো পার্থক্য করেন নি।
৭. তাঁর আদর্শ ছিল না মানুষের উত্তম-উত্তম মালগুলো যাকাত হিসেবে নিয়ে নেওয়া, বরং তিনি মধ্যম মাল গ্রহণ করতেন।
৮. তিনি সদকা গ্রহণকারী ফকীরকে তার সদকা বিক্রয় করতে নিষেধ করতেন, কিন্তু ধনীর জন্য সদকার মাল ভক্ষণ করা জায়েয করেন যদি ফকীর তাকে তা হাদিয়্যাস্বরূপ প্রদান করে থাকে।
৯. তিনি কখনো মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার্থে সদকার মাল থেকে পরিশোধ করার শর্তে ঋণ গ্রহণ করতেন, আবার কখনো সদকার মাল থেকে পরিশোধ করার শর্তে ঋণ গ্রহণ করতেন, আবার কখনো সদকার মাল তার মালিকদের নিকট হতে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতেন।
১০. কোনো ব্যক্তি যাকাতের মাল নিয়ে এলে তিনি তার জন্য এ বলে দুআ করতেন: হে আল্লাহ ! তার এবং তার উটের মধ্যে বরকত দান কর।[58]
আবার কখনো বলতেন :
(اللهم صَلِّ عَلَيْهِ)
‘হে আল্লাহ ! তুমি তার প্রতি সালাত পেশ কর।[59]
(খ) যাকাতুল ফিৎরা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[60]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাকরে খেজুর, যব, পনির ও কিশমিশ হতে সদকায়ে ফিৎরা আদায় করা ফরয করেন[61]
২. তাঁর আদর্শ ছিল সদকায়ে ফিৎর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করা। তিনি ঘোষণা করেন: “যে কেউ তা ঈদের সালাতের আগে আদায় করে তা হবে মাক্ববুল যাকাতুল ফিৎর, আর যে কেউ তা সালাতের পরে আদায় করে, তা হবে শুধুমাত্র এক প্রকার দান-খায়রাত।[62]
৩. তাঁর আদর্শ ছিল সদকাতুল ফিৎর বিশেষভাবে অভাবগ্রস্তদের মাঝে বন্টন করা, অর্থাৎ তিনি তা যাকাতের হকদার আট প্রকারের উপর বন্টন করেন নি।

(গ) নফল সদকা-খায়রাত প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[63]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় মালিকানায় মানুষের মাঝে সর্বাধিক দানশীল ছিলেন, তিনি আল্লাহ্ প্রদত্ত নে‘আমতে সন্তুষ্ট হয়ে অধিক কামনা করতেন না এবং আল্লাহ প্রদত্ত নে‘আমতকে নগণ্য মনে করতেন না।
২. কেউ তাঁর নিকট কোনো কিছু চাইলে, তিনি তাকে তা প্রদান করতেন কম হোক কিংবা বেশী হোক।
৩. তিনি দান করে দানগ্রহণকারী অপেক্ষা অধিক খুশী হতেন।
৪. তিনি কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি দেখলে তাকে নিজের উপর প্রাধান্য দিতেন, কখনো স্বীয় খাদ্যদ্রব্য প্রদান করে, আবার কখনো স্বীয় পোষাক প্রদান করে।
৫. তাঁর উদারতা ও দানশীলতা দেখে তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ নিজেদের উপর কাবু হারিয়ে ফেলতো।
৬. তিনি বিভিন্ন প্রকারের দান-খায়রাত করতেন, কখনো উপহারের মাধ্যমে, আবার কখনো সদকার মাধ্যমে, আবার কখনো উপঢৌকনের মাধ্যমে, আবার কখনো কোনো বস্তু ক্রয় করে বিক্রেতাকে ব্যবসা-পণ্য ও মূল্য উভয়টি দান করে, কখনো তিনি কোনো বস্তু ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে তার চেয়ে অধিক পরিশোধ করতেন, আবার কখনো তিনি উপহার গ্রহণ করে তার চেয়ে অধিক প্রতিদান দিতেন।


(১০) সিয়াম বা রোযা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালার বিবরণ

(ক) রমযানের রোযা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[64]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখে চাঁদ দেখা কিংবা কোনো সাক্ষ্যদাতার সাক্ষ্যবাণী ছাড়া মাহে রমযানের রোযা শুরু করতেন না, নচেৎ শা‘বান মাসের গণনায় ত্রিশ দিন পূর্ণ করতেন।
২. ৩০শে শা‘বানের রাত মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে চাঁদ দেখা না গেলে, তিনি মাহে শা‘বানকে ৩০ দিন পূর্ণ করতেন এবং সন্দেহের দিন তথা মেঘাচ্ছন্ন শা‘বানের ৩০ তারিখ মাহে রমাযানের প্রথম দিন হওয়ার সন্দেহে সেই দিন রোযা রাখতেন না, আর না তার নির্দেশ দেন।
৩. তাঁর আদর্শ ছিল মাহে রমযানের ২৯ তারিখে রোযা শেষ করা দুজন লোকের শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাক্ষ্যবাণীর মাধ্যমে।
৪. ঈদের সালাতের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দুজন ব্যক্তি চাঁদ দেখার সাক্ষ্য প্রদান করলে তিনি রোযা ছেড়ে দেন এবং সাহাবীদেরকে রোযা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন, অতঃপর দ্বিতীয় দিন সকালে ঈদের সালাত আদায় করেন।
৫. তিনি সূর্যাস্তের সাথে সাথে অনতিবিলম্বে ইফতার করতেন এবং তজ্জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন আর সেহরী খেতেন এবং তজ্জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন এবং সেহরী শেষ রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে খেতেন এবং বিলম্ব করে সেহরী খাওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।
৬. তিনি সালাত আদায়ের পূর্বে ইফতার করতেন এবং তিনি তাজা-পাকা খেঁজুর দ্বারা ইফতার করতেন, তা না পেলে শুষ্ক খেঁজুর দ্বারা এবং তাও না পেলে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন।
৭. তিনি ইফতার শেষে বলতেন :
(ذهب الظمأ وابتلت العروق وثبت الأجر إن شاء الله)
‘যাহাবায্ যামায়ু, ওয়াবতাল্লাতিল ‘অরুক্ব, ওয়া সাবাতাল আজরু ইনশা-আল্লাহ্ ।[65]
“পিপাসা দূরীভূত হয়েছে, ধমনীগুলি সিক্ত হয়েছে এবং সাওয়াব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনশা-আল্লাহ।”
৮. তাঁর আদর্শ ছিল মাহে রমাযানে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদত অধিক পরিমাণে করা। মাহে রমযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে পর্যায়ক্রমে কুরআন পাঠ দান করতেন।
৯. তাঁর আদর্শ ছিল মাহে রমযানে অধিক পরিমানে সদকা-খায়রাত, তিলাওয়াতে কুরআন ও যিকর এবং ইতেকাফ করা।
১০. তিনি রমযানে কতিপয় ইবাদত বিশেষভাবে করতেন যা তিনি অন্য কোনো মাসে করতেন না, তিনি কখনো সাওমে বেসাল অর্থাৎ বিরতিহীন রোযা রাখতেন, কিন্তু সাহাবীদেরকে তা থেকে বারণ করেন, তবে তাদেরকে সেহরী খাওয়ার সময় পর্যন্ত বিরতিহীন রোযা রাখার অনুমতি দেন।

(খ) রোযা অবস্থায় জায়েয-নাজায়েয বিষয়াদি প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[66]:
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম পালনকারীকে অশ্লীল কথাবার্তা, গালি-গালাজ ও তার প্রতোত্তর এবং ঝগড়া বিবাদ করা হতে বারণ করেন, বরং যদি কেউ তাকে গালি দেয়, তবে সে উত্তরে আমি সিয়াম পালনকারীবলার নির্দেশ দিতেন।[67]
২. তিনি মাহে রমযানে সফরকালে কখনো রোযা রাখেন আবার কখনো রোযা ছেড়ে দেন, অনুরূপ সাহাবীদেরকে সফরে রোযা রাখা, না রাখা উভয়ের অনুমতি দেন।
৩. তিনি সাহাবীদেরকে রোযা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিতেন যখন তারা রণাঙ্গনে শত্রুসেনার নিকটবর্তী হতো।
৪. তাঁর আদর্শ ছিল না দূরত্ব বা সীমা নির্ধারণ করা যা অতিক্রম করার পর রোযাদার রোযা ছাড়বে।
৫. বরং সাহাবীগণ সফর শুরু করলেই রোযা ছেড়ে দিতেন এলাকার ঘর-বাড়ী অতিক্রম করার চিন্তা-ভাবনা ছাড়া এবং তাঁরা বলেন: এটা তাঁর আদর্শমালা ও সুন্নাতের অন্তর্গত।
৬. কখনো স্ত্রী সহবাসজনিত অপবিত্র অবস্থায় তাঁর ফযর হয়ে যেতো, তখন তিনি ফজরের পর গোসল করতেন এবং রোযা রাখতেন।
৭. তিনি মাহে রমযানে রোযা অবস্থায় কখনো তাঁর কোনো স্ত্রীকে চুমু দিতেন।
৮. তিনি রোযা অবস্থায় মিসওয়াক করতেন এবং রোযা অবস্থায় মাযমাযা বা কুলি ও ইস্তিন্শাক্ব বা নাকে পানি গ্রহণ করতেন এবং রোযা অবস্থায় প্রচণ্ড গ্রীষ্মজনিত তাপ হ্রাস করার লক্ষ্যে স্বীয় মাথার উপর পানি ঢালতেন।
৯. তাঁর আদর্শ ছিল রোযাদার ভুলবশত পানাহার করলে তার থেকে কাযার হুকুম প্রত্যাহার করে রোযা পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া।
১০. তিনি রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ও মুসাফিরের জন্য রোযা না রেখে পরে কাযা করার অনুমতি দেন, অনুরূপ বিধান গর্ভবর্তী ও দুগ্ধদাত্রী মহিলাদের জন্য যদি তারা রোযা রাখার দরুন নিজেদের অথবা তাদের শিশুদের ক্ষতির আশংকা রোধ করে থাকে।

(গ) নফল রোযা প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা[68]:
১. এ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা ছিল পূর্ণাঙ্গ ও উদ্দেশ্য হাসিলে শ্রেষ্ঠতম এবং আত্মার উপর সহজতর। তিনি কখনো এতো অধিক রোযা রাখতেন যে, বলা হতো: হয়তো তিনি রোযা আর ছাড়বেন না, আবার তিনি রোযা ছেড়ে দিতেন এমনভাবে যে, বলা হতো: হয়তো তিনি সহসা আর রোযা রাখবেন না, তিনি মাহে রমযান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ মাস রোযা রাখেননি এবং শাবান মাস ছাড়া আর কোনো মাসে এত অধিক নফল রোযা রাখেননি, আর এমন কোনো মাস অতিবাহিত হতো না যে মাসে তিনি অবশ্যই কয়েক দিন রোযা না রাখতেন।
২. তাঁর আদর্শ ছিল শুধু জুমআর দিনে রোযা রাখা অপছন্দ করা এবং তিনি প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখার জন্য খুবই সচেষ্ট থাকতেন।
৩. তিনি আইয়্যামে বীদ্ব তথা প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখা ছাড়তেন না, না সফরে না গৃহে অবস্থানকালে এবং তিনি আইয়ামে বীদ্বে রোযা রাখার জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।
৪. তিনি প্রত্যেক মাসের শুরুতে তিন দিন রোযা রাখতেন।
৫. তিনি শাওয়ালের ছয় রোযা প্রসঙ্গে বলেন: রমযানের সাথে শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখা সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য।[69]
আর তিনি রমযানের পর আশুরার (১০ই মুহাররামের) দিনের রোযাকে অন্য যে কোনো দিনের রোযা অপেক্ষা মাহাত্ম্যপূর্ণ মনে করতেন।
৬. তিনি আরাফার (৯ই যুলহাজ্জের) দিনের রোযা প্রসঙ্গে বলেন: উক্ত রোযা বিগত এক বছরের এবং আগামী এক বছরের পাপরাশিকে মোচন করে দেয়।[70] তবে তাঁর আদর্শ ছিল আরাফার দিন ময়দানে আরফায় অবস্থানকালে রোযা না রাখা।
৭. তাঁর আদর্শ ছিল না সারা বছর রোযা রাখা, বরং এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: যে কেউ সারা বছর রোযা রাখলো, প্রকৃতপক্ষে সে না রোযা রাখলো, আর না সে রোযা ছাড়লো।[71]
৮. তিনি কখনো নফল রোযার নিয়্যাত করতেন, অতঃপর রোযা ছেড়ে দিতেন, আবার কখনো স্বীয় পরিবারের নিকট এসে জিজ্ঞেস করতেন: তোমাদের নিকট কি খাবারের কিছু আছে? যদি তারা উত্তরে বলতো: না, তখন তিনি বলতেন: তাহলে আমি সিয়াম পালন করলাম।[72]
৯. তিনি বলেছেন : যদি তোমাদের কাউকে খাবারের প্রতি আহ্বান করা হয় অথচ সে রোযাদার, তখন সে উত্তরে বলবে : ‘আমি সিয়াম পালন করছি।

(ঘ) ই‘তেকাফ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:[73]
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিন মসজিদে এ‘তেকাফ করতেন, যতক্ষণ না আল্লাহ্‌ আয্‌যা-ওয়াজাল্লা তাঁকে উঠিয়ে নেন। তবে তিনি একবার ইতেকাফে ছিলেন না, অতঃপর তা শাওয়ালে কাযা করেন।
২. তিনি লাইলাতুল ক্বদরতালাশ করার লক্ষ্যে একবার প্রথম দশ দিনে ইতেকাফ করেন, তারপর মধ্যম দশ দিনে, তারপর শেষ দশ দিনে, অতঃপর যখন তিনি জেনে নিলেন যে, ‘লাইলাতুল ক্বদরশেষ দশ দিনে বিদ্যমান, তখন থেকে তিনি সর্বদা শেষ দশ দিনে ই'তেকাফ করতেন, যতক্ষণ না তিনি আল্লাহর নিকট প্রত্যাগমণ করেন।
৩. তিনি কখনই রোযা ছাড়া ই‘তেকাফ করেননি।
৪. তাঁর নির্দেশে মসজিদে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির তাঁবু স্থাপন করা হতো, আর তিনি তাতে নির্জনতা অবলম্বন করতেন।
৫. তিনি ইতেকাফের ইচ্ছা করলে ফজরের সালাতের পরেই প্রবেশ করতেন।
৬. তিনি ইতেকাফ করলে তাঁর বিছনা-পত্র ইতেকাফস্থলে রাখা হতো এবং তাতে তিনি একলা নির্জনে প্রবেশ করতেন।
৭. তিনি মানবিক প্রয়োজন ছাড়া ঘরে যেতেন না।
৮. তিনি স্বীয় মাথা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর ঘরের দিকে বের করে দিতেন, তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তাঁর মাথা আঁচড়ে দিতেন যখন তিনি হায়েয অবস্থায় থাকতেন।
৯. তিনি ইতেকাফে থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো কোনো স্ত্রী সাক্ষাত করতে যেতেন, সাক্ষাৎ শেষে প্রত্যাবর্তন কালে তিনি তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্যে বের হন, তখন রাত্রিবেলা ছিল।
১০. তিনি ইতেকাফ থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো স্ত্রীর সাথে সহবাস করতেন না, আর না কোনো স্ত্রীকে চুমু দিতেন।
১১. তিনি প্রত্যেক বছর দশ দিন করে ইতেকাফ করতেন, কিন্তু যেই বছর তিনি মারা যান, সেই বছর বিশ দিন ইতেকাফ করেন।


(১১) হজ্জ-ওমরাহ্ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালার বিবরণ[74]

(ক) ওমরাহ্ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা:
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চারবার ওমরাহ্ পালন করেন, (এক) হুদায়বিয়ার ওমরাহ, যখন মুশরিকরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল, তখন তিনি হুদায়বিয়া নামক স্থানে হাদী যবেহ করেন এবং মাথা মুণ্ডন করে হালাল হয়ে যান। (দুই) ওমরাতুল কাযা, যা তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধি মোতাবেক পরবর্তী বৎসর আদায় করেছিলেন। (তিন) যেই ওমরাহ্ তিনি হজ্জের সাথে আদায় করেছিলেন। (চার) তিনি জিয়িররানা থেকে একটি ওমরাহ্ আদায় করেছিলেন।[75]
২. তাঁর জীবনে কোনো ওমরাহ্ মক্কা হতে বর্হিগমনকালে ছিল না, বরং সবকয়টি ওমরাহ্ ছিল মক্কায় প্রবেশকালে।
৩. বৎসরে একাধিক ওমরাহ্ করা তাঁর থেকে প্রমাণিত নেই, তিনি কখনই এক বৎসরে দুইবার ওমরাহ্ করেন নি।
৪. তাঁর সকল ওমরাহ্ আদায় হজ্জের মাসসমূহে ছিল।
৫. তিনি বলেন, মাহে রমযানে ওমরাহ্‌ আদায় হজ্জের সমতুল্য।[76]

(খ) হজ্জ প্রসঙ্গে তাঁর আদর্শমালা [77]:
১. হজ্জ ফরয হওয়ার পর অনতি বিলম্বে তিনি হজ্জ আদায় করেন এবং তিনি জীবনে একবার মাত্র হজ্জ করেন এবং তা ছিল হজ্জে ক্বেরান।
২. তিনি যোহরের সালাতের পর হজ্জের ইহরাম বাঁধেন, অতঃপর তালবিয়া পাঠ করে বলেন:
«لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك، إن الحمد والنعمة لك والملك لا شريك لك».
‘লাব্বাইকা-আল্লাহুম্মা-লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল-হামদা ওয়ান-নে‘অমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক।[78]
“আমি উপস্থিত হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত, আমি উপস্থিত তোমার কোনো শরীক নেই আমি উপস্থিত, নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা এবং নে‘আমতসমূহ তোমার, আর সমুদয় রাজত্ব তোমার, তোমার কোনো শরীক নেই।
আর তিনি এই তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করেন, যাতে তাঁর সাহাবীগণ শুনতে পান। তিনি তাদেরকে উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করার নির্দেশ দেন এবং তিনি লাগাতার তালবিয়া পড়তে থাকেন। লোকেরা তাতে কম-বেশী করছিল কিন্তু তিনি তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেন নি।
৩. তিনি ইহরাম বাঁধার সময় সাহাবীদেরকে হজ্জের তিন প্রকারের যে কোনো একটি মনোনীত করার অনুমতি দেন, অতঃপর তিনি মক্কার নিকটবর্তী হলে হজ্জে ইফরাদ ও হজ্জে ক্বেরানকরীদের মাঝে যাদের সাথে হাদী তথা হজ্জের কুরবানীর পশু ছিল না তাদেরকে হজ্জের ইহরামের বদলে ওমরার নিয়্যাত করার উৎসাহ প্রদান করেন।
৪. তিনি উষ্ট্রীর উপর সাওয়ার হয়ে হজ্জ আদায় করেন, পাল্কি কিংবা হাওদা-ডুলির মধ্যে নয় এবং খাদ্যদ্রব্য ও সফরের সামান তাঁর সাথেই ছিল।
৫. তিনি মক্কায় উপনীত হয়ে এ মর্মে নির্দেশ জারী করেন যে, যাদের সাথে হাদীর পশু নেই তারা যেন হজ্জের ইহরাম ভঙ্গ করে ওমরার নিয়্যাত করে এবং ওমরাহ্ আদায়ের পর ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যায়। আর যাদের সাথে হাদী রয়েছে তারা যেন ওমরাহ্ আদায়ের পর ইহরাম অবস্থায় থাকেঅতঃপর তিনি সওয়ারীতে আরোহন করে যী-তুয়ানামক উপত্যকায় অবতরণ করেন এবং সেখানে মাহে যিল-হজ্জের চতুর্থ তারিখে রবিবারের রাত কাটান এবং সেখানে ফজরের সালাত আদায় করেন। অতঃপর গোসল করে দিনের বেলায় মক্কার হুজুনের দিকে অবস্থিতসানিয়াতুল ‘উলইয়া’-নামক এলাকা দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি মসজিদে প্রবেশ করেই বায়তুল্লাহর অভিমুখে রাওয়ানা হন, তখন তিনি তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়েননি এবং হাজরে আসওয়াদের নিকট এসে তাকে স্পর্শ করেন এবং তার উপর ভীড় করেন নি। অতঃপর বায়তুল্লাহকে বামে রেখে ডান পার্শ্ব দিয়ে তাওয়াফ শুরু করেন এবং কাবার দরজায় কিংবা মীযাবের নিচে অথবা কাবা ঘরের পিছনে কিংবা চারকোণে কোনো নির্দিষ্ট দুআ পাঠ করেন নি। তবে রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে এই আয়াতটি পাঠ করা তাঁর থেকে প্রমাণিত রয়েছে :
﴿رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا حَسَنَةٗ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ حَسَنَةٗ وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ٢٠١ ﴾ [البقرة: ٢٠١]
‘রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাহ্, ওয়াফিল আ-খিরাতে হাসানাহ্, ওয়াক্বিনা ‘আযা-বান্নার।’
‘‘হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে ইহকালে ও পরকালে কল্যাণ দান কর এবং আমাদিগকে জাহান্নামের আগুনের আযাব হতে রক্ষা কর।এটা ছাড়া তাওয়াফের জন্য আর কোনো নির্দিষ্ট দু‘আ নির্ধারণ করেন নি। আর তিনি এর তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করেন- অর্থাৎ ছোট ছোট কদমে বা পদক্ষেপে দ্রুত চলেন এবং এই তাওয়াফে ইদতিবাকরেন- অর্থাৎ পরিহিত চাদরের মধ্যভাগকে ডান কাঁধের নীচ দিয়ে চাদরের উভয় কোণ বাম কাঁধের উপর ধারণ করেন এবং ডান বাহু ও ডান কাঁধ খোলা রাখেন। যখনই তিনি হাজরে আসওয়াদের নিকটবর্তী হতেন তখন আল্লাহু আকবারবলে তার প্রতি ইশারা করতেন কিংবা হাতের ছড়ি দিয়ে ষ্পর্শ করতেন এবং ছড়িকে চুমু দিতেন। (আরবী শব্দ মেহজনমানে মাথা বাঁকা হাতের ছড়ি), আর রুকনে ইয়ামানীর নিকট পৌঁছে সেটাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন কিন্তু তাকে চুমু দেন নি, আর স্পর্শ করার পর হাতেও চুমু দেননি, অতঃপর তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পিছনে এসে এ আয়াতটি পাঠ করেন:
﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ﴾ [البقرة: ١٢٥]
‘‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে প্রহণ কর।[79]
এবং সেখানে দুরাকাত সালাত আদায় করেন তখন মাক্বামে ইবরাহিমী তাঁর ও বায়তুল্লাহর মধ্যস্থলে ছিল, উক্ত দুরাকাতে সূরা ফাতিহার পর ইখলাসের সুরাদ্বয় তথা কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন এবং কুল হুয়াল্লাহ আহাদপাঠ করেন, সালাত শেষে হাজরে আসওয়াদের নিকটবর্তী হয়ে তাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করেন, অতঃপর সাফা পাহাড়ের অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সাফার নিকটবর্তী হলে এই আয়াতটি পাঠ করেন:
﴿ ۞إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨ ﴾ [البقرة: ١٥٨]
‘‘নিঃসন্দেহে সাফাও মারওয়াআল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্গত, সুতরাং যে ব্যক্তি কাবা ঘরের হজ্জঅথবা উমরাহ্ পালন করে, তার জন্যে এতদুভয়ের মাঝে সাঈকরা দোষণীয় নয়, বরং কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সৎকর্ম করলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমলের সঠিক মূল্যায়নকারী, মহাজ্ঞানী।[80]
তিনি বলেন: আমি সেখান থেকেই (অর্থাৎ সাফা থেকেই) আরম্ভ করবো যেখান থেকে আল্লাহ আরম্ভ করেছেন, (অর্থাৎ আল্লাহ যার কথা কুরআনে আগে বলেছেন) অতঃপর সাফা পাহাড়ে আরোহণ করেন যেখান থেকে তিনি বায়তুল্লাহ্ দেখতে পান, তখন তিনি ক্বেবলামুখি হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেন এবং তাকবীর বলে এ দুআ পাঠ করেন:
«لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير. لا إله إلا الله وحده أنجز وعده ونصر عبده وهزم الأحزاب وحده».
লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাবহু লা-শারীকা লাহু, লাহুল মুল্কু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন-ক্বাদীর, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু আনজাযা ওয়া‘দাহ্, ওয়া নাসারা আব্দাহ, ওয়া হাযামাল আহযা-বা ওযাহ্‌দাহ।[81]
‘‘আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরীক নেই, সমগ্র রাজত্ব ও প্রশংসা তাঁরই, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোনো মাবুদ নেই, তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন, তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং তিনি একাই শত্রু সৈন্যদলকে পরাজিত করেছেন।
অতঃপর তিনি দুআ করেন এবং তিনি অনুরূপ তিনবার করার পর মারওয়া অভিমুখে অগ্রসর হন। অতঃপর দুপাহাড়ের মধ্যবর্তী সমভুমিতে পৌছে দৌড়ে দ্রুত গতিতে উপত্যকা অতিক্রম করেন, আর তা হলো দুই সবুজ বাতির মধ্যবর্তী স্থান, তিনি পায়ে হেটে সা‘য়ী শুরু করেন, কিন্তু তাঁর উপর লোকদের অধিক ভীড় হলে তিনি সাওয়ারীর উপর আরোহণ করে সা‘য়ী পূর্ণ করেন। আর তিনি মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে তার উপরাংশে আরোহণ করেন, তখন তিনি ক্বেবলামুখি হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেন এবং তাকবীর বলেন এবং অনুরূপ করেন যেরূপ তিনি করেছিলেন সাফা পাহাড়ের সাফা পাহাড়ের উপর, তারপর যখন সপ্তম চক্করে মারওয়ার নিকটে সায়ী সমাপ্ত করেন, তখন তিনি জরুরীভিত্তিতে নির্দেশ জারী করেন যে, যাদের সাথে হাদী-কুরবানীর পশু নেই তারা যেন ইহরাম থেকে পূর্ণরূপে হালাল হয়ে যায়, যদিও সে হজ্জে কিরান কিংবা ইফরাদের নিয়্যাত করে থাকে। আর যেহেতু তাঁর সঙ্গে হাদী ছিল, তাই তিনি ইহরাম থেকে হালাল হননি এবং বলেন : যদি আমি আগে জানতাম যা পরে জেনেছি, তবে আমি হাদীর পশু সঙ্গে নিয়ে আসতাম না, বরং হজ্জের ইহরামকে ওমরার দ্বারা পরিবর্তন করে দিতাম।[82] আর তিনি মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্যে তিনবার দু‘আ করেন এবং চুল খাটোকারীদের জন্যে একবার। তিনি মক্কায় অবস্থানকালে জিল-হাজ্জ মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত তাঁর বাসস্থানে সালাতসমূহ জামা‘আতের সাথে কসর করে আদায় করেন, তারপর তিনি ৮ তারিখের সকালে সাথীদেরকে নিয়ে মিনায় পৌঁছে যোহর ও আসরের সালাত নির্দিষ্ট ওয়াক্তে আদায় করেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। ৯ তারিখের সূর্যোদয়ের পর আরাফা অভিমুখে যাত্রা করেন, তখন সাহাবীদের কেউ তালবিয়াহ্ পাঠ করছিল, আবার কেউ তাকবীর বলছিল, তিনি তা শুনছিলেন কিন্তু কারো উপর অসম্মতি প্রকাশ করেন নি। অতঃপর নামিরায় পৌঁছে তিনি একটি গোলাকৃতির তাঁবুতে প্রবেশ করেন- যা তাঁর নির্দেশে তাঁর জন্যে স্থাপন করা হয়েছিল, মূলত: নামিরাহ্ নামক স্থান আরাফার অন্তর্গত নয়, বরং সেটি আরাফার পশ্চিমপ্রান্তে একটি এলাকার নাম। সূর্য ঢলা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন, তারপর স্বীয় ক্বাসওয়ানামক উষ্ট্রীর উপর আরোহণ করে ‘ওরানাহ্ উপত্যকায় গমন করেন এবং স্বীয় উষ্ট্রীর উপর বসে একটি মাহাত্ম্যাপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন; যাতে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীর স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং শির্ক ও জাহিলিয়্যাতের ভিত্তিসমূহ ধ্বসিয়ে দেন এবং যেসব বিষয়াবলী সকল ধর্ম ও মিল্লাতে হারাম সেগুলোর নিষিদ্ধতার উপর তাকীদ প্রদান করেন এবং জাহিলী যুগের কুসংস্কার ও সুদকে নিজের পায়ের নিচে রাখেন, সেই খুৎবায় জনগণকে মহিলাদের প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দেন। কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়তার সাথে অবলম্বন করে চলার অসিয়াত করেন, তারপর তিনি সাহাবীদের থেকে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন যে, তিনি আল্লাহর পয়গাম তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আমানত সম্পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে নসীহত করেছেন, অতঃপর উক্ত স্বীকারোক্তির উপর আল্লাহকে সাক্ষী রাখেন। তারপর খোৎবা শেষে বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে আযানের নির্দেশ দিলে তিনি আযান ও ইকামত দেন। তখন তিনি যোহরের সালাত কসর করে দুরাকাত আদায় করেন এবং তাতে নিন্মস্বরে কেরাত পড়েন অথচ সেই দিন শুক্রবার ছিল। তারপর ইকামত দিয়ে আসরের সালাত দুরাকাত আদায় করেন। অথচ তখন তাঁর সঙ্গে মক্কার অধিবাসীগণও ছিল, কিন্তু তিনি তাদেরকে যোহর-আসরের সালাত চার রাকাত পূর্ণ করার নির্দেশ দেন নি, আর না তাদেরকে জম‘য়ে-তাকদীমনা করার হুকুম দেন। অতঃপর সালাত শেষে তিনি সাওয়ারীতে আরোহণ করে আরাফাতের সীমার মধ্যে অবস্থান করার উদ্দেশ্য গমণ করেন। আরাফার দিন তাঁর রোযা রাখার ব্যাপারে লোকদের মাঝে সন্দেহ দেখা দিলে উম্মুল মুমিনীন মায়মুনাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর নিকট একটি পাত্রে সদ্য দোহন করা দুধ পাঠিয়ে দেন, তখন তিনি আরাফায় অবস্থানরত ছিলেন, তিনি তা পান করেন এবং লোকগণ তা দেখছিল। তিনি জাবালে রহমতনামক পাহাড়ের নিচে পাথরসমূহের নিকট জাবালে মুশাত’-কে সম্মুখে রেখে ক্বিবলামুখী হয়ে অবস্থান করেন। তিনি স্বীয় উষ্ট্রীর উপর সাওয়ার ছিলেন এবং তিনি সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নিকট দু‘আ-প্রার্থনা করতে থাকেন, তিনি লোকদেরকে ওরানাহ্নামক উপত্যকায় অবস্থান না করার নির্দেশ দেন এবং বলেন: “আমি এখানে অবস্থান করছি, তবে ‘আরাফার প্রান্তর সবই অবস্থানস্থাল।[83] তখন তিনি দু‘আ করার সময় ভিখারীর ন্যায় সীনা মুবারক পর্যন্ত হাত উত্তোলন করেন এবং বলেন, শ্রেষ্টতম দুআ হলো আরাফার দিনের দু, আর আমি এবং আমার পুর্ববর্তী নবীগণ কর্তৃক উচ্চারিত শ্রেষ্ঠতম বাণী হলো:
«لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير».
‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।[84]
আর যখন আরাফার দিনে সূর্যাস্ত হয়ে যায় এবং সূর্যাস্তের ব্যাপারটি নিশ্চিত হয় এভাবে যে, সূর্যের সোনালী রং শেষ হয়ে যায়, তখন তিনি ওসামা ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সাওয়ারির পিছনে আরোহণ করিয়ে ধীরস্থিরতার সাথে মুযাদালিফার দিকে যাত্রা করেন এবং তিনি উষ্ট্রীর লাগাম নিজের দিকে টেনে রাখেন এমনভাবে যে, তার মাথা সওয়ারীর কিনারায় যেন যোগ করছিলেন এবং তিনি বলছিলেন: ‘‘হে লোক সকল! তোমরা প্রশান্তি ও ধীরস্থিরতার সাথে চলো, কেননা সৎকর্ম তাড়াহুড়া করার মধ্যে নয়।[85] আর তিনি আল-মা’যেমাইননামক রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তিনি ‘দ্বব্ব’ নামক রাস্তা দিয়েই আরাফায় প্রবেশ করেছিলেন, আর প্রত্যাবর্তন কালে তাঁর চলার গতি ছিল মধ্যম, কিন্তু যখন কোনো বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কিংবা ফাঁকা পথে উপনীত হতেন, তখন দ্রুত গতিতে চলতেন এবং তিনি পথ অতিক্রম কালে লাগাতার তালবিয়া পাঠ করছিলেন। তিনি পথিমধ্যে অবতরণ করে পেশাব করেন, তারপর হাল্কা অযু করে পথ চলেন এবং মাগরিবের সালাত পড়েননি যতক্ষণ না তিনি মুযদালিফায় পৌঁছেন। অতঃপর মুযদালিফায় পৌঁছে সালাতের জন্য অযু করেন এবং বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে আযান ও ইকামতের নির্দেশ দেন। অতঃপর উষ্ট্রীর পিঠ থেকে মাল-সামান রাখার এবং উটের পাল বাঁধার পূর্বেই মাগরিবের সালাত তিন রাকাত আদায় করেন, অতঃপর লোকসকল নিজ নিজ জায়গায় নিজেদের উট বসিয়ে দিলে আযান ছাড়া শুধু ইকামত দিয়েই ‘এশার সালাত কসর করে আদায় করেন এবং মাগরিব ও ‘এশার মাঝে তিনি আর কোনো সালাত পড়েননি। তারপর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন ফজর পর্যন্ত এবং সেই রাত জাগ্রত থাকেননি, তবে অর্ধরাত্রি যাপন করার পর পরিবারের দুর্বল লোকদেরকে মিনার দিকে যাত্রা করার অনুমতি প্রদান করেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দেন তারা যেন জমরাতে কংকর নিক্ষেপ না করে যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয়। অতঃপর ফজরের সময় হলে আযান ও ইকামত দিয়ে প্রথম ওয়াক্তেই ফজরের সালাত আদায় করেন। তারপর সাওয়ারীতে আরোহণ করে মাশ‘আরে হারামের নিকট গমন করেন এবং লোকদের লক্ষ্য করে বলেন: ‘‘পুরো মুযদালিফাই অবস্থানস্থল।[86] তখন তিনি ক্বিবলামুখী হয়ে অধিক হারে আল্লাহর যিকির, তাকবীর, তাহলীল, দুআ-প্রার্থনা করতে থাকেন যে পর্যন্ত না প্রভাতের আলো অনেকটা ফর্সা হয়ে উঠে। অতঃপর সূর্যোদয়ের আগেই ফাদল ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-কে সাওয়ারীর পিছনে বসিয়ে মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে যাত্রা করেন।
পথিমধ্যে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে নির্দেশ দেন যে, যেন তিনি জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য সাতটি কংকর বেছে নেন। অতঃপর তিনি সেগুলোকে তাঁর হাতে রেখে তাতে ফুৎকার করতে করতে বলেন: ‘‘তোমরা জামরাতে অনুরূপ ছোট ছোট কংকর নিক্ষেপ করো এবং ধর্মে অতিরঞ্জন করা হতে সতর্ক থেকো।[87] আর তিনি ‘মুহাস্‌সারনামক উপত্রকায় পৌঁছলে দ্রুত গতিতে তা অতিক্রম করেন। আর তিনি মধ্যম পথ দিয়ে চলেন যেটি সোজা জামরাতুল কোবরায় নিয়ে যায়। তিনি কংকর নিক্ষেপ করা পর্যন্ত তালবিয়াহ্ পাঠ করছিলেন। তিনি সূর্যোদয়ের পর উষ্ট্রীর উপর সওয়ার অবস্থায় উপত্যকার নিচ থেকে জামরাতুল ‘আকাবা বা বড় জামরাতে পর পর সাতটি কংকর নিক্ষেপ করেন। তখন তিনি কাবা শরীফকে বাম দিকে এবং মিনাকে ডান দিকে রাখেন এবং প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু-আকবার’-তাকবীর বলেন। অতঃপর মিনায় প্রত্যাবর্তন করে একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ্য ভাষণ প্রদান করেন, যাতে কুরবানীর দিনের ফযীলত এবং মক্কার মান-মর্যাদা সম্পর্কে লোকদের অবহিত করেন এবং শাসকবর্গের যারা কুরআন-সুন্নাহ্ দ্বারা নেতৃত্ব দেয় তাদের কথা শোনা ও মান্য করার নির্দেশ দেন। তাদেরকে হজ্জের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন, তারপর মিনায় পশু যবেহ করার স্থানে গমন করে নিজ হতে ৬৩ টি মোটা-তাজা উট কুরবানী করেন, উট যবেহ করার সময় সেগুলি দাঁড়ানো এবং বাম-পা বাঁধা অবস্থায় ছিল, অতঃপর এক শত উটের অবশিষ্টগুলিকে যবেহ্ করার জন্য ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে নির্দেশ দেন। কুরবানীর পশুর গোশ্‌ত অভাবগ্রস্ত -দরিদ্র লোকদের মাঝে বন্টন করে দিতে বলেন। কিন্ত কসাইকে তার মজদুরী হিসেবে কুরবানীর গোশ্‌ত দিতে নিষেধ করেন। তিনি তাদের আরও জানান যে, পুরো মিনাই যবাই-নাহর করার স্থল এবং মক্কার গিরিপথসমূহ রাস্তাও যবাই-নাহর করার স্থল।
অতঃপর কুরবানীর পশু যবেহ্ করা শেষে নাপিতকে ডেকে পাঠান, নাপিত প্রথমে তাঁর মাথার ডান অর্ধাংশ মুণ্ডন করলে তিনি তা আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রদান করেন, অতঃপর বাম অর্ধাংশ মুণ্ডন করলে তিনি চুলগুলো আবু ত্বালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে দিয়ে বলেন: ‘‘এগুলি জনগণের মাঝে বন্টন করে দাও।[88] তিনি মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্যে তিনবার দুআ করেন এবং চুল খাটোকারীদের জন্যে একবার। আর উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁকে খুশবু মাখিয়ে দেন। অতঃপর যোহরের আগে সাওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কা প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাওয়াফে ইফাদাহ্‌ বা ফরয তাওয়াফ আদায় করেন। সেদিন অন্য কোনো তাওয়াফ করেননি এবং তাওয়াফের সথে সা‘য়ীও করেননি[89], তিনি ফরয তাওয়াফ কিংবা বিদায় তাওয়াফে রমলকরেননি, বরং শুধুমাত্র তাওয়াফে কুদুম বা আগমনী তাওয়াফে রমলকরেন।
অতঃপর তাওয়াফ শেষে যমযমের নিকট আসেন তখন লোকেরা পানি পান করছিল, লোকেরা তাঁকে পানির পাত্র উঠিয়ে দিলে তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় যমযমের পানি পান করেন। অতঃপর মিনায় ফিরে আসেন এবং মিনাতেই রাত্রি যাপন করেন। সেদিন যোহরের সালাত কোথায় আদায় করেন, এ মর্মে মতানৈক্য রয়েছে, ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনায় তিনি সেদিন যোহরের সালাত মিনাতে পড়েন, আর জাবের ও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তিনি সেদিন যোহরের সালাত মক্কাতেই পড়েন।
অতঃপর ১১ তারিখের সকালে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে যাওয়ার অপেক্ষা করেন, অতঃপর সূর্য ঢলার পর তিনি তাবু থেকে জামারাত অভিমুখে পায়ে হেঁটে যাত্রা যাত্রা করেন এবং সেদিন সাওয়ারিতে আরোহণ করেন নি, সেথায় পৌঁছে প্রথমে মসজিদে খাইফের সন্নিকটে অবস্থিত প্রথম জামরাতে কংকর মারা শুরু করেন এবং তাতে একের পর এক সাতটি কংকর নিক্ষেপ করেন এবং প্রত্যেক কংকরের সাথে ‘‘আল্লাহু আকবার”-তাকবীর বলেন।
তারপর জামরাহ থেকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত উত্তোলন করে সূরা বাক্বারার সমপরিমাণ দীর্ঘক্ষণ দুআ-প্রার্থনা করেন।
তারপর মধ্যম জমরায় পৌছে সেখানেও প্রথমবারের ন্যায় কংকর নিক্ষেপ করেন, তারপর কিছুটা সম্মুখে উপত্যকার দিকে সরে গিয়ে জামরাকে ডান দিকে রেখে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে প্রায় প্রথমবারের ন্যায় দীর্ঘক্ষণ দুআ-প্রার্থনা করেন। তারপর তৃতীয় জমরাতুল আক্বাবার প্রতি অগ্রসর হন এবং সেখানে পৌছে বাম দিকে উপত্যকা সংলগ্ন স্থানে গমন করেন এবং জামরাকে সামনে রেখে এবং কাবা শরীফকে বাম দিকে এবং মিনাকে ডান দিকে রেখে অনুরূপ সাতটি কংকর নিক্ষেপ করেন।
আর কংকর নিক্ষেপ সম্পন্ন করে ফিরে আসেন এবং সেথায় দাঁড়াননি।
অধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো যে, তিনি যোহরের সালাতের পূর্বেই কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন। অতঃপর ফিরে এসে সালাত আদায় করেন। তবে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে হাজীদের পানি সরবরাহ করার দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে মিনার দিনগুলোতে মক্কায় রাত কাটানোর অনুমতি দেন। তিনি তাড়াতাড়ি করে ১২ তারিখে মিনা ত্যাগ করেন নি, বরং বিলম্ব করে আইয়্যামে তাশরীক্বের তিন দিনই জামরাহ্‌গুলোতে কংকর নিক্ষেপ করেন। অতঃপর মুহাস্‌সাব নামক স্থানে এসে অবস্থান করেন। সেখানে যোহর, আসর, মাগরিব ও এশার সালাত প্রত্যেকটিকে তার সময়মত আদায় করেন এবং অল্প কিছু সময় নিদ্রা যান। অতঃপর সাওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কা পৌছে রাত সেহেরীর সময় বায়তুল্লাহর বিদায়ী তাওয়াফ করেন এবং এ তাওয়াফে রমলকরেননি, তখন উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ ঋতুবর্তী হয়ে পড়লে তার জন্য বিদায়ী তাওয়াফের হুকুম শিথিল করেন, তাই তিনি বিদায় তাওয়াফ করেন নি।
সে রাতেই আয়েশাহ রাদিয়াল্লাহু আনহার মনস্তুষ্টির জন্য তাঁর ভাই আব্দুর রহমানকে সাথে নিয়ে তান‘ঈমথেকে ইহরাম বেঁধে একটি ওমরাহ্ আদায় করার ব্যবস্থা করে দেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ওরমাহ্ শেষে রাতে ফিরে এলে তিনি সাহাবীদেরকে সফরের নির্দেশ দেন, তখন সবাই মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন।



সংকলন: ড. আহমাদ ইবন উসমান আল-মাযইয়াদ
অনুবাদ: মুহাম্মাদ আলীমুল্লাহ
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ


২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

আরও পড়ুনঃ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলী

আরও পড়ুনঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায আদায়ের পদ্ধতি

আরও পড়ুনঃ দো‘আর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কতিপয় দো‘আর নমুনা

আরও পড়ুনঃ নবীগৃহে ঈদ

আরও পড়ুনঃ বিদায় হজের খুতবা : কিছু আলোকপাত

আরও পড়ুনঃ নবী জীবনী

আরও পড়ুনঃ বিশ্ব মানবতার প্রতি মহানবীর ১০ অবদান

ডাউনলোড করুনঃ ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) - ১ম পর্ব

ডাউনলোড করুনঃ মহানবী (সাঃ) এর জীবনী গ্রন্থঃ আর রাহীকুল মাখতূম – ফ্রি ডাউনলোড


পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন