রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৪

‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলার বিধান

‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলার বিধান



‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলার বিধান

কতিপয় কারি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ বলেন।[1] এরূপ বলার কোনো ভিত্তি নেই। এতে সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা সত্যবাদী, তার কালাম চিরসত্য। ইমাম নাসাঈ রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন:
((إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ، وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ».
“নিশ্চয় সবচেয়ে সত্যকথা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ হচ্ছে মুহাম্মদের আদর্শ”[2] 
তিলাওয়াতের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্ত কথার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। 

ড. বকর আবু জায়েদ রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
﴿ قُلۡ صَدَقَ ٱللَّهُۗ فَٱتَّبِعُواْ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِيمَ حَنِيفٗاۖ ٩٥ [ال عمران: ٩٥]  وقال تعالى: ﴿ وَمَنۡ أَصۡدَقُ مِنَ ٱللَّهِ حَدِيثٗا ٨٧ [النساء : ٨٧]  وقال تعالى: ﴿ وَمَنۡ أَصۡدَقُ مِنَ ٱللَّهِ قِيلٗا ١٢٢ [النساء : ١٢٢] 
“বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন, সুতরাং তোমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ কর একনিষ্ঠভাবে”।[3] 
অপর আয়াতে তিনি বলেন: “আর কথায় আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী কে?”[4] 
অপর আয়াতে তিনি বলেন: “আর কথায় আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী কে?”[5]
এসব আয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাব তাওরাত ও অন্যান্য গ্রন্থে যা বলেছেন সত্য বলেছেন, অনুরূপ কুরআনুল কারিমে তিনি যা বলেছেন তাও সত্য বলেছেন; তবে এ থেকে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে সাদাকাল্লাহুল আজিম বলার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তার কোনো সাহাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে কখনো ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলেননি, অথচ তারা এ আয়াতসমূহ আমাদের চেয়ে বেশী পড়তেন এবং বেশী বুঝতেন। যদি তার দাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলা হত, তারা তার উপর আমল করতেন এবং আমরা তাদের অনুসরণ করতাম, তাদের অনুসরণ করাই আমাদের জন্য কল্যাণকর

সমকালীন কতক ভাই বলেন, ইমাম বায়হাকির গ্রন্থ ‘আল-জামে লি-শুআবিল ঈমান’[6]-এ তার পক্ষে দলিল রয়েছে, এটা তাদের ভুল। আমাদের জানা মতে গ্রহণযোগ্য কোনো আলেম ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলা বৈধ বলেননি, না-প্রসিদ্ধ কোনো ইমাম; বস্তুত এটা মানুষের বানানো প্রথা ও নতুন আবিষ্কৃত, শরিয়তের পরিভাষায় তার নাম বিদআতআল্লাহ ভালো জানেন”[7]

কোনো উপলক্ষকে কেন্দ্র করে কেউ যদি صَدَقَ اللهُ  বলে, তাহলে সমস্যা নেই; কারণ এরূপ বলা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খুতবা দিচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় হাসান ও হুসাইন চলে আসল। তাদের গায়ে ছিল দু’টি লাল জামা, তারা হোঁচট খেতে ছিল ও চলতে ছিলরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে তাদের তুললেন ও সামনে বসালেন। অতঃপর তিনি বললেন:
صدق الله: ﴿ إِنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞۚ ١٥ ﴾ [التغابن : ١٥] 
“আল্লাহ সত্য বলেছেন: ‘নিশ্চয় তোমাদের সম্পদ ও সন্তান ফিতনা”[8] তাদেরকে দেখলাম হাঁটছে ও হোঁচট খাচ্ছে, আমি সহ্য করতে পারলাম না, কথা বন্ধ করে তাদেরকে উঠিয়ে নিলাম”[9]

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও’, তিনি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে কুরআন পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে! তিনি বললেন: ‘আমি অপর থেকে কুরআন শুনা পছন্দ করি’অতঃপর আমি তাকে সূরা নিসা পাঠ করে শুনাই, যখন নিম্নোক্ত আয়াতে পৌঁছি:  
﴿ فَكَيۡفَ إِذَا جِئۡنَا مِن كُلِّ أُمَّةِۢ بِشَهِيدٖ وَجِئۡنَا بِكَ عَلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ شَهِيدٗا ٤١ ﴾ [النساء : ٤١] 
‘অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর স্বাক্ষীরূপে?’[10] তিনি বললেন, ‘হাসবুক’[11]আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার দু’চোখ অশ্রু ঝরাচ্ছে”[12]

শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “আমাদের জানা-মতে কোনো আহলে ইলম ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেননি যে,  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের حسبك». বলার পর তিনি صَدَقَ اللهُ الْعَظِيْمُ বলে কুরআন তিলাওয়াত শেষ করেছেন”[13]

শায়খ উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘সাদাকাল্লাহু বলে কুরআন তিলাওয়াত শেষ করা বিদআত, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত নেই যে, তারা ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলে তিলাওয়াত শেষ করেছেন”[14]


সাদাকাল্লাহু বলার প্রচলন

‘কাতারে’র ওয়াকফ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ‘ইসলাম ওয়েব’[15] সাইটের (139452)-নং ফতোয়ায় ‘সাদাকাল্লাহু’ বলা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে: “কবে ও কিভাবে সাদাকাল্লাহুল আজিম বলার প্রচলন ঘটেছে জানা যায়নি। পূর্ববর্তী কতক নেককার লোক ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার পশ্চাতে তারা কোনো দলিল পেশ করেননি; যেমন হাফিয ইবনুল জাযারি ‘আন-নাশর’ কিতাবে বলেন: আমার কতক শায়খকে দেখেছি, তারা কুরআন খতম করে বলতেন:
«صدق الله العظيم وبلغ رسوله الكريم، وهذا تنزيل من رب العالمين، ربنا آمنا بما أنزلت واتبعنا الرسول فاكتبنا مع الشاهدين».
ইমাম কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসিরে বলেন, হাকিম আবু আব্দুল্লাহ তিরমিযি ‘নাওয়াদিরুল উসুল’ কিতাবে বলেন: কুরআনুল কারিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে তিলাওয়াত শেষে আল্লাহকে সত্বারোপ করা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীন প্রচার করেছেন তার সাক্ষী প্রদান করা, যেমন বলা:
«صدقت رب وبلغت رسلك، ونحن على ذلك من الشاهدين، اللهم اجعلنا من شهداء الحق، القائمين بالقسط، ثم يدعو بدعوات».    
এ থেকে আমাদের ধারণা চতুর্থ হিজরিতে ‘সাদাকাল্লাহু’ বলার প্রচলন ঘটেছে, কারণ হাকিম তিরমিযি চতুর্থ শতাব্দীর আলেম ছিলেন, তবে তার পূর্বেও তার প্রচলন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহ ভালো জানেন”

সৌদি আরবের উলামা পরিষদের ফতোয়া[16]

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে সাদাকাল্লাহুল আজিম বলা বিদআত, 
কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদা ও কোনো সাহাবী থেকে এরূপ বলা প্রমাণিত নেই, পরবর্তী কোনো ইমাম থেকেও নয়। অথচ কুরআনুল কারিমের প্রতি তাদের গুরুত্ব বেশী ছিল, তারা বেশী তিলাওয়াত করতেন এবং কুরআন সম্পর্কে তারা বেশী জানতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ ».
“যে আমাদের দীনে নতুন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা পরিত্যক্ত”।[17] 
ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন:
 «مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ ».
“যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যার উপর আমাদের দীন নেই, তা পরিত্যক্ত”।[18]





[1] ‘সাদাকাল্লাহুল আযিম’ অর্থ ‘মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন’
[2] নাসায়ি আস-সুগরা: (১৫৭৮)
[3] সূরা আলে-ইমরান: (৯৫)
[4] সূরা নিসা: (৮৭)
[5] সূরা নিসা: (১২২)
[6] আরবি নাম নিম্নরূপ: الجامع لشعب الإيمان للبيهقي
[7] দেখুন: ‘বিদাউল কুররা’ গ্রন্থ।
[8] সূরা তাগাবুন: (১৫)
[9] তিরমিযি: (৩৭৭৪), হাকিম: (১/২৮৭), হাকিম বলেন: হাদিসটি মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহি, ইমাম যাহাবি রহ. তার সমর্থন করেছেন, তবে বুখারি-মুসলিম তারা কেউ হাদিসটি বর্ণনা করেননি, আলবানি রহ. হাদিসটি সহি বলেছেন।
[10] সূরা নিসা: (৪১)
[11] তুমি এখানে পড়া ক্ষান্ত কর, এখানে পড়া শেষ কর।
[12] বুখারি: (৫০৪৯), মুসলিম: (৮০২)
[13] মাজমু ফতোয়া ও মাকালাত: (খ.৭)
[14] ফতোয়া নুরুন ‘আলাদ-দারব: (খ.৫, পৃ.২), সংক্ষিপ্ত।
[16] লাজনায়ে দায়েমা: (., পৃ.১১৮)
[17] বুখারি: (২৬৯৭)
[18] মুসলিম: (১৭২১)
_________________________________________________________________________________

সংকলন: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব


পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন