ভূমিকা
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ
وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا
، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ،
وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ
اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ
وَرَسُوْلُهُ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি, তার কাছে
সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টটা ও আমাদের কর্মসমূহের খারাবী থেকে আশ্রয় কামনা করি।
আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে
হেদায়েত দেয়ার কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনও সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নাই। আরও
সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা
কিয়ামত অবধি এহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।
মনে রাখবে, মানুষ মাত্রই তার কিছু না কিছু
আত্মীয়-স্বজন অবশ্যই রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠা
নিতান্তই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ সামাজিক জীব- সমাজ নিয়েই মানুষকে বাস করতে হয়।
তাই মানুষ কখনোই একা বসবাস করতে পারে না। ফলে একজন মানুষ যখন কোনও সমাজে বসবাস
করে, তখন সে সমাজে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী থাকবে এটাই
স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যখন বিভিন্ন মায়ের সন্তান একত্রে এক জায়গায় বসবাস করবে, তখন
দুনিয়ার কোনও ক্ষুদ্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো তাদের পরস্পরের মধ্যে
ঝগড়া-বিবাদ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ, কথা কাটা-কাটি, মারা-মারি ইত্যাদি সংঘটিত
হওয়াও অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে মনে রাখতে হবে এ ধরনের কোনও কিছু দেখা দিলে তা কখনোই
দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যাবে না। বরং তা জায়গায় নিরসন করতে হবে এবং কোনও ক্রমেই তা
সামনে বাড়তে দেওয়া যাবে না। নতুবা তা এক সময় অপরের প্রতি কঠিন বিদ্বেষ ও নির্মম
শত্রুতা পোষণে উৎসাহিত করবে। শয়তান কখনোই মানুষের বন্ধু নয়। শয়তান মানুষের চির
শত্রু। শয়তান মানুষকে কখনোই সুখে শান্তিতে থাকতে দেবে না। শয়তান মানুষের মধ্যে
ঝগড়া-বিবাদ, মারা-মারি, হানা-হানি তৈরি করে মানুষের পারস্পরিক সু-সম্পর্ক নষ্ট করতে
সব সময় সচেষ্ট থাকে। মানুষ ভালো থাকুক এটা কখনোই শয়তানের কাম্য হতে পারে না। এ জন্য শয়তান মানুষের
ছোট খাট বিষয়কে লালন করে ধীরে ধীরে তা বড় আকার ধারণ করাতে চায়। আর তখনই তা একদা সেই পরম আত্মীয়তার বন্ধনটিকে ছিন্ন
করা পর্যন্ত পৌছিয়ে দিবে, যা শরীয়ত কিংবা মানব দৃষ্টিতেও কখনোই কাম্য নয়। কারণ,
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি মহা পাপ ও মারাত্মক অপরাধ। যা
পরস্পর সম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয় এবং যা আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ ও তার নগদ শাস্তির
কারণ হয়ে দাড়ায়। যা আল্লাহর তা‘আলার রহমত লাভ ও জান্নাতে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
এমনকি তা কখনও কখনও একাকীত্ব, নীচতা ও
লাঞ্ছনারও কারণ হয়। উপরন্তু তা কখনও কখনও মানব জীবনের এক মহা দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা
ও পেরেশানির ব্যাপারও হয়ে দাড়ায়। কারণ, যার পক্ষ থেকে সর্বদা ভালো ব্যবহার পাওয়াই
মানুষের একমাত্র কামনা তার পক্ষ থেকে কখনো কোনো দুর্ব্যবহার বা অসদাচরণ সত্যিই
উদ্বেগের বিষয়ই বটে।
বর্তমান বস্তুবাদী মুসলিম সমাজে আত্মীয়তার
বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারটি খুব ব্যাপকতা লাভ করেছে। পরস্পরকে ভালো কাজের পরামর্শ
দেওয়া এবং পরস্পরের মধ্যকার পবিত্র সু-সম্পর্কটুকু অটুট রাখার জন্য পরস্পর
দেখা-সাক্ষাৎ চালু রাখা খুব একটা বেশি চোখে পড়ে না। যা কিছু রয়েছে তাও দুনিয়ার
ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে। উক্ত ব্যাধি বর্তমান স্বার্থান্ধ সমাজের রন্ধ্রে
রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে পড়ছে যা চিন্তা করাই যায় না। কেউ কারোর সাধারণ বৈষয়িক
স্বার্থও অপরের জন্য ছাড়তে চায় না। যার দরুন সেই পরম আত্মীয়তার বন্ধনটুকু আজ বার বার বিশেষভাবে বহুমুখী হুমকির
সম্মুখীন হচ্ছে।
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নের আবার কয়েকটি ধরণও রয়েছে।
আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়ের তিনি কোনও খবরই রাখেন না।
মাসের পর মাস বছরের পর বছর যাচ্ছে; অথচ পরস্পরের মধ্যে কোনও দেখা সাক্ষাতই হচ্ছে
না। না তাদেরকে কোনও দান বা উপটৌকন দেওয়া হচ্ছে, না তাদের কোনও সাথে কোনও ভালো
ব্যবহার দেখিয়ে তাদেরকে সন্তুষ্ট করা হচ্ছে। বরং তাদেরকে সময় সময় কথা বা কাজে কষ্ট
দেওয়া হচ্ছে। আবার আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়-স্বজনের কোনও
অনুষ্ঠানেই তিনি যোগ দেন না। তাদের কোনও দুঃখ-বেদনায় তিনি শরীক হন না। বরং তাদেরকে
কোনও কিছু দান না করে অন্যকে দান করেন; অথচ তারাই তার দানের সর্বপ্রথম হকদার।
আবার
আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে তিনি তখনই
সু-সম্পর্ক বজায় রাখেন যখন তারাও তার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখে। আর যখনই তারা তার
সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তখন তিনিও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এমন আচরণকে
বাস্তবার্থে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা বলা যায় না। কারণ, সম-প্রতিদান তো যে কোনও কারোর
সাথেই হতে পারে। এতে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান
নেই।
বস্তুত: আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা মানে আপনি একমাত্র
আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্যই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবেন। তারা আপনার সাথে
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করুক বা নাই করুক।
আবার আত্মীয় স্বজনদের কেউ এমনও রয়েছেন যে, তার
আত্মীয়-স্বজনকে তিনি দ্বীন-ধর্মের সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জ্ঞান
শিক্ষা দেন না এবং তাদেরকে ইসলামের সব ধর্মীয় অনুশাসন নিজ জীবনে বাস্তবায়নের
দাওয়াতও দেন না; অথচ তিনি সর্বদা অন্যদেরকে ইসলামের খাটি আকীদা-বিশ্বাস ও যাবতীয়
ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতে এতটুকুও ত্রুটি করেন না। বস্তুত এরাইতো উক্ত দাওয়াতের
সর্বপ্রথম হকদার।
পক্ষান্তরে অনেক বংশে ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও খাটি
ধর্মীয় জ্ঞান বহনকারী অনেকে আলিমে দীন, ধর্ম প্রচারক ও সমাজ সংস্কারক রয়েছেন যাদের
সাথে তাদের বংশের লোকেরা পারতপক্ষে ভালো ব্যবহার দেখায় না। তাদের যথাযোগ্য সম্মান
দেয় না। তাদের কাছ থেকে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের খাটি জ্ঞানের আলো তারা আহরণ করে
না। যা তাদের সাথে শুধু আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করারই শামিল নয় বরং এতে করে মানুষের
মাঝে তাদের সম্মান ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সমাজে তাদের প্রভাবও কমে যায়।
আবার আত্মীয় স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে,
তিনি নিজেই তার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে ফাটল ধরাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। যে কোনও
ছোট-খাট বিষয় নিয়ে এক জনকে অন্যের উপর ক্ষেপিয়ে তোলেন। একের কথা অপরের কাছে গিয়ে
লাগিয়ে, একজনকে অপর জনের বিরুদ্ধে ক্রোধান্বিত করে তোলে। ফলে দেখা যায় কেউ কারও
নামও শোনতে পছন্দ করে না।
আত্মীয়তার পরম বন্ধনটুকু ছিন্ন করার উপরোক্ত ধরনসমূহ ও
অন্যান্য নব উদ্ভাবিত ধরন সমষ্টির মূলোৎপাটনের জন্যই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
এ বইটিতে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব, ফযিলত,
লাভ, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার কারণ, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি,
আত্মীয়তা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ, মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা, প্রতিবেশীদের
সাথে সু-সম্পর্ক রাখা, তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব সহজ
ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আমাদের ফরিয়াদ এই যে,
আল্লাহ যেন আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং এর বিনিময় ও সাওয়াব দান
করেন। আমীন।