আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার গুরুত্ব
ভূমিকা
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ
وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا
، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ،
وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ
اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ
وَرَسُوْلُهُ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি, তার কাছে
সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টটা ও আমাদের কর্মসমূহের খারাবী থেকে আশ্রয় কামনা করি।
আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে
হেদায়েত দেয়ার কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনও সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নাই। আরও
সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা
কিয়ামত অবধি এহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।
মনে রাখবে, মানুষ মাত্রই তার কিছু না কিছু
আত্মীয়-স্বজন অবশ্যই রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠা
নিতান্তই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষ সামাজিক জীব- সমাজ নিয়েই মানুষকে বাস করতে হয়।
তাই মানুষ কখনোই একা বসবাস করতে পারে না। ফলে একজন মানুষ যখন কোনও সমাজে বসবাস
করে, তখন সে সমাজে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী থাকবে এটাই
স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যখন বিভিন্ন মায়ের সন্তান একত্রে এক জায়গায় বসবাস করবে, তখন
দুনিয়ার কোনও ক্ষুদ্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো তাদের পরস্পরের মধ্যে
ঝগড়া-বিবাদ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ, কথা কাটা-কাটি, মারা-মারি ইত্যাদি সংঘটিত
হওয়াও অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে মনে রাখতে হবে এ ধরনের কোনও কিছু দেখা দিলে তা কখনোই
দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যাবে না। বরং তা জায়গায় নিরসন করতে হবে এবং কোনও ক্রমেই তা
সামনে বাড়তে দেওয়া যাবে না। নতুবা তা এক সময় অপরের প্রতি কঠিন বিদ্বেষ ও নির্মম
শত্রুতা পোষণে উৎসাহিত করবে। শয়তান কখনোই মানুষের বন্ধু নয়। শয়তান মানুষের চির
শত্রু। শয়তান মানুষকে কখনোই সুখে শান্তিতে থাকতে দেবে না। শয়তান মানুষের মধ্যে
ঝগড়া-বিবাদ, মারা-মারি, হানা-হানি তৈরি করে মানুষের পারস্পরিক সু-সম্পর্ক নষ্ট করতে
সব সময় সচেষ্ট থাকে। মানুষ ভালো থাকুক এটা কখনোই শয়তানের কাম্য হতে পারে না। এ জন্য শয়তান মানুষের
ছোট খাট বিষয়কে লালন করে ধীরে ধীরে তা বড় আকার ধারণ করাতে চায়। আর তখনই তা একদা সেই পরম আত্মীয়তার বন্ধনটিকে ছিন্ন
করা পর্যন্ত পৌছিয়ে দিবে, যা শরীয়ত কিংবা মানব দৃষ্টিতেও কখনোই কাম্য নয়। কারণ,
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে একটি মহা পাপ ও মারাত্মক অপরাধ। যা
পরস্পর সম্পর্ক বিনষ্ট করে দেয় এবং যা আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ ও তার নগদ শাস্তির
কারণ হয়ে দাড়ায়। যা আল্লাহর তা‘আলার রহমত লাভ ও জান্নাতে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
এমনকি তা কখনও কখনও একাকীত্ব, নীচতা ও
লাঞ্ছনারও কারণ হয়। উপরন্তু তা কখনও কখনও মানব জীবনের এক মহা দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা
ও পেরেশানির ব্যাপারও হয়ে দাড়ায়। কারণ, যার পক্ষ থেকে সর্বদা ভালো ব্যবহার পাওয়াই
মানুষের একমাত্র কামনা তার পক্ষ থেকে কখনো কোনো দুর্ব্যবহার বা অসদাচরণ সত্যিই
উদ্বেগের বিষয়ই বটে।
বর্তমান বস্তুবাদী মুসলিম সমাজে আত্মীয়তার
বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারটি খুব ব্যাপকতা লাভ করেছে। পরস্পরকে ভালো কাজের পরামর্শ
দেওয়া এবং পরস্পরের মধ্যকার পবিত্র সু-সম্পর্কটুকু অটুট রাখার জন্য পরস্পর
দেখা-সাক্ষাৎ চালু রাখা খুব একটা বেশি চোখে পড়ে না। যা কিছু রয়েছে তাও দুনিয়ার
ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে। উক্ত ব্যাধি বর্তমান স্বার্থান্ধ সমাজের রন্ধ্রে
রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে পড়ছে যা চিন্তা করাই যায় না। কেউ কারোর সাধারণ বৈষয়িক
স্বার্থও অপরের জন্য ছাড়তে চায় না। যার দরুন সেই পরম আত্মীয়তার বন্ধনটুকু আজ বার বার বিশেষভাবে বহুমুখী হুমকির
সম্মুখীন হচ্ছে।
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নের আবার কয়েকটি ধরণও রয়েছে।
আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়ের তিনি কোনও খবরই রাখেন না।
মাসের পর মাস বছরের পর বছর যাচ্ছে; অথচ পরস্পরের মধ্যে কোনও দেখা সাক্ষাতই হচ্ছে
না। না তাদেরকে কোনও দান বা উপটৌকন দেওয়া হচ্ছে, না তাদের কোনও সাথে কোনও ভালো
ব্যবহার দেখিয়ে তাদেরকে সন্তুষ্ট করা হচ্ছে। বরং তাদেরকে সময় সময় কথা বা কাজে কষ্ট
দেওয়া হচ্ছে। আবার আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়-স্বজনের কোনও
অনুষ্ঠানেই তিনি যোগ দেন না। তাদের কোনও দুঃখ-বেদনায় তিনি শরীক হন না। বরং তাদেরকে
কোনও কিছু দান না করে অন্যকে দান করেন; অথচ তারাই তার দানের সর্বপ্রথম হকদার।
আবার
আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে, তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে তিনি তখনই
সু-সম্পর্ক বজায় রাখেন যখন তারাও তার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখে। আর যখনই তারা তার
সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তখন তিনিও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এমন আচরণকে
বাস্তবার্থে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা বলা যায় না। কারণ, সম-প্রতিদান তো যে কোনও কারোর
সাথেই হতে পারে। এতে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান
নেই।
বস্তুত: আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা মানে আপনি একমাত্র
আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্যই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবেন। তারা আপনার সাথে
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করুক বা নাই করুক।
আবার আত্মীয় স্বজনদের কেউ এমনও রয়েছেন যে, তার
আত্মীয়-স্বজনকে তিনি দ্বীন-ধর্মের সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জ্ঞান
শিক্ষা দেন না এবং তাদেরকে ইসলামের সব ধর্মীয় অনুশাসন নিজ জীবনে বাস্তবায়নের
দাওয়াতও দেন না; অথচ তিনি সর্বদা অন্যদেরকে ইসলামের খাটি আকীদা-বিশ্বাস ও যাবতীয়
ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দিতে এতটুকুও ত্রুটি করেন না। বস্তুত এরাইতো উক্ত দাওয়াতের
সর্বপ্রথম হকদার।
পক্ষান্তরে অনেক বংশে ইসলামের সঠিক আকীদা-বিশ্বাস ও খাটি
ধর্মীয় জ্ঞান বহনকারী অনেকে আলিমে দীন, ধর্ম প্রচারক ও সমাজ সংস্কারক রয়েছেন যাদের
সাথে তাদের বংশের লোকেরা পারতপক্ষে ভালো ব্যবহার দেখায় না। তাদের যথাযোগ্য সম্মান
দেয় না। তাদের কাছ থেকে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের খাটি জ্ঞানের আলো তারা আহরণ করে
না। যা তাদের সাথে শুধু আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করারই শামিল নয় বরং এতে করে মানুষের
মাঝে তাদের সম্মান ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সমাজে তাদের প্রভাবও কমে যায়।
আবার আত্মীয় স্বজনদের কেউ তো এমনও রয়েছেন যে,
তিনি নিজেই তার আত্মীয় স্বজনদের মাঝে ফাটল ধরাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। যে কোনও
ছোট-খাট বিষয় নিয়ে এক জনকে অন্যের উপর ক্ষেপিয়ে তোলেন। একের কথা অপরের কাছে গিয়ে
লাগিয়ে, একজনকে অপর জনের বিরুদ্ধে ক্রোধান্বিত করে তোলে। ফলে দেখা যায় কেউ কারও
নামও শোনতে পছন্দ করে না।
আত্মীয়তার পরম বন্ধনটুকু ছিন্ন করার উপরোক্ত ধরনসমূহ ও
অন্যান্য নব উদ্ভাবিত ধরন সমষ্টির মূলোৎপাটনের জন্যই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
এ বইটিতে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব, ফযিলত,
লাভ, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার কারণ, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি,
আত্মীয়তা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ, মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা, প্রতিবেশীদের
সাথে সু-সম্পর্ক রাখা, তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো খুব সহজ
ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আমাদের ফরিয়াদ এই যে, আল্লাহ যেন আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন এবং এর বিনিময় ও সাওয়াব দান করেন। আমীন।
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন
করার পরিণতি
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা শুধু একটি মারাত্মক অপরাধই নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, মানবিক ও আত্মিক ব্যাধি, যা একটি সুস্থ সমাজ,
সুন্দর পরিবেশ, ও মানবতা-বোধকে হত্যা করে এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন,
সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব-বোধকে ব্যাহত করে। যার ফলে ইসলাম
আত্মীয়তার বন্ধনকে অটুট রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যারা আত্মীয়তার
সম্পর্ক নষ্ট করে, তাদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি এবং কঠিন আযাব ও শাস্তির কথা ঘোষণা
করেছে। আল্লাহ তা‘আলা কোরআন মাজীদে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের
নিন্দা করেন এবং তাদেরকে লা‘নত ও অভিসম্পাত দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿فَهَلۡ عَسَيۡتُمۡ
إِن تَوَلَّيۡتُمۡ أَن تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَتُقَطِّعُوٓاْ أَرۡحَامَكُمۡ ٢٢
أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فَأَصَمَّهُمۡ وَأَعۡمَىٰٓ أَبۡصَٰرَهُمۡ
٢٣ ﴾ [محمد : ٢٢، ٢٣]
“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন
করবে। আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন”।[1]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ
عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ
أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱللَّعۡنَةُ وَلَهُمۡ
سُوٓءُ ٱلدَّارِ ٢٥﴾ [الرعد: ٢٥]
“যারা আল্লাহকে দেওয়া দৃঢ় অঙ্গীকার
ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে
আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের জন্য
রয়েছে লা‘নত ও অভিসম্পাত এবং তাদের জন্যই রয়েছে মন্দ আবাস”।[2]
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী
জান্নাতে যাবে না:
হাদিসেও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের কঠিন
শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না-
আল্লাহর দরবারে তাদের আমল কবুল হবে না।
যুবায়ের ইবন মুত‘ইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ»
“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।[3]
আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ: مُدْمِنُ الْخَمْرِ
وَقَاطِعُ الرَّحِمِ وَمُصَدِّقٌ بِالسِّحْرِ»
“তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না: অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও জাদুতে বিশ্বাসী”।[4]
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর নেক
আমল আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করেন না:
আত্মীয়তার বন্ধন
ছিন্নকারীর আমল আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না। সপ্তাহে একদিন আল্লাহর নিকট আদম সন্তানের আমল পেশ
করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমল
প্রত্যাখ্যান করেন। আবু হুরাইরা
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ أَعْمَالَ بَنِيْ آدَمَ تُعْرَضُ كُلَّ خَمِيْسٍ لَيْلَةَ
الْجُمُعَةِ ، فَلاَ يُقْبَلُ عَمَلُ قَاطِعِ رَحِمٍ»
“আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুম‘আর রাত্রিতে [আল্লাহ তা‘আলার নিকট] উপস্থাপন করা হয়।
তখন আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না”।[5]
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি
দুনিয়াতেই হবে:
আত্মীয়তা বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখিরাতেই
সীমাবদ্ধ নয়, তাদের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই দেওয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে
থাকেন। উপরন্তু আখিরাতের শাস্তি-তো তার জন্য প্রস্তুত আছেই। আবু বাকরাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُّعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ
الْعُقُوْبَةَ فِيْ الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِيْ الْآخِرَةِ مِنَ
الْبَغْيِ وَقَطِيْعَةِ الرَّحِمِ»
“দু’টি গুনাহ ছাড়া এমন কোনও গুনাহ নেই যে গুনাহগারের শাস্তি
আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেয়াই উচিৎ; উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ দু’টি হচ্ছে, অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী”।[6]
আত্মীয় স্বজনের সাথে
সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা আল্লাহ
তা‘আলার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা:
কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক
ছিন্ন করেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ اللَّهَ عَزَّ
وَجَلَّ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَامَتِ
الرَّحِمُ فَقَالَتْ: يَا رَبِّ، هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ
الْقَطِيعَةِ. قَالَ: أَلَا تَرْضَيْنَ
أَنْ أَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ وَأَصِلُ مَنْ وَصَلَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ.
قَالَ: فَهُوَ لَكِ ". فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ: " اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: [فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ
تُوُلِّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتَقْطَعُوا أَرْحَامَكُمْ،
أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ]»
الآية
“আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকুল সৃজন শেষে আত্মীয়তার বন্ধন [দাঁড়িয়ে]
বলল: এটিই হচ্ছে
সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর স্থান। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: হ্যাঁ, ঠিকই। তুমি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নও যে, আমি ওর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক
স্থাপন করবে এবং আমি ওর সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক
বিচ্ছিন্ন করবে। তখন সে বলল: আমি এ কথায় অবশ্যই রাজি আছি হে আমার প্রভু! তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: তা হলে তোমার জন্য
তাই হোক। তারপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা চাইলে
﴿فَهَلۡ عَسَيۡتُمۡ
إِن تَوَلَّيۡتُمۡ أَن تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَتُقَطِّعُوٓاْ أَرۡحَامَكُمۡ ٢٢
أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فَأَصَمَّهُمۡ وَأَعۡمَىٰٓ أَبۡصَٰرَهُمۡ
٢٣﴾ [محمد : ٢٢، ٢٣] –
“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন
করবে। আল্লাহ তা‘আলা এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন”।[7] এ আয়াত-
তিলাওয়াত করতে পার”।[8]
অন্য হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ
بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ
اللَّهُ تَعَالَى: «أَنَا الرَّحْمَنُ خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَاشْتَقَقْتُ
لَهَا مِنِ اسْمِي، فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ، وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ»
“আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে
বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, আমি রহমান, আমি রাহেম
(‘আত্মীয়তার বন্ধন’)কে সৃষ্টি করেছি এবং ‘রাহেম’ (তথা আত্মীয়তা বন্ধনের) নামটিকে
আমি আমার নিজের নাম থেকে নির্গত করেছি, সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায়
রাখে আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার
সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব”।[9]
আত্মীয়রা দুর্ব্যবহার
করার পরও তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা
কেউ কেউ মনে করেন, আত্মীয়-স্বজনরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে তাদের সাথে
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা জায়েয। মূলত ব্যাপারটি তেমন নয়। বরং আত্মীয়রা আপনার সাথে
দুর্ব্যবহার করার পরও আপনি যদি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার দেখান তখনই আপনি তাদের
সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেছেন বলে প্রমাণিত হবে। সুতরাং, মনে রাখতে হবে, কোনও আত্মীয় দুর্ব্যবহার করলেও তার সাথে ভালো
ব্যবহার করতে হবে। কেউ আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে, আপনি তার সাথে সম্পর্ক বজায়
রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। কোনোভাবেই কোনও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে
না। অন্যথায় আপনি গুনাহগার হবেন।
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«الرَّحِمُ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ، وَلَيْسَ الْوَاصِلُ
بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ مَنْ إِذَا انْقَطَعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا»
“আত্মীয়তার সম্পর্কের বিষয়টি আল্লাহর আরশের সাথে সম্পৃক্ত। সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে না, যে কেউ তার সাথে
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে। বরং
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী সে ব্যক্তি যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন
করলেও সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”।[10]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ
بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ، ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ
يَرْحَمْكُمْ أَهْلُ السَّمَاءِ، الرَّحِمُ شُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلَهُ، وَمَنْ قَطَعَهَا قَطَعَهُ اللَّهُ» قَالَ
سُفْيَانُ: الشُّجْنَةُ الشَّيْءُ الْمُلْتَزِقُ
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে
বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “দয়ালুদের আল্লাহ তা‘আলা দয়া করেন,
তোমরা যমীনবাসীদের প্রতি দয়া কর, আসমানবাসী তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। আত্মীয়তার
বন্ধন রহমানের সাথে সম্পৃক্ত। যে ব্যক্তি তার সাথে সু-সম্পর্ক রাখে, তিনিও তার সাথে সু-সম্পর্ক রাখেন, আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার
সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তা‘আলাও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন”।[11]
শত্রু
ভাবাপন্ন কোনও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সর্বদা ভালো ব্যবহার দেখালেই আপনি তখন তাদের
ব্যাপারে সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন। তখন তারা কখনোই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়া আপনার এতটুকুও
ক্ষতি করতে পারবে না। প্রমাণ-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ
رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي،
وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ، وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ،
فَقَالَ: «لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ، فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلَا
يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ»
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
উদ্দেশ্য করে বলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমার এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছে যাদের
সাথে আমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করি; অথচ তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি; অথচ তারা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেই; অথচ তারা আমার সাথে মূর্খতামূলক আচরণ (কঠোরতা) দেখায়। অতএব তাদের
সাথে এখন আমার করণীয় কি? তখন রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি
যদি সত্যি কথাই বলে থাক, তা হলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত ছাই খাইয়ে দিচ্ছ। আর তুমি যতদিন
পর্যন্ত তাদের সাথে এমন ব্যবহার করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের উপর তোমার
জন্য একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত থাকবে”।[12]
প্রতিবেশীরা হল, মানুষের পরম আত্মীয়। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের
হক আদায় করা, তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া খুবই জরুরী কাজ। ইসলাম প্রতিবেশীদের হক ও তাদের
খোঁজ-খবর নেওয়া এবং বিপদ-আপদে তাদের সহযোগিতা করার ব্যাপারে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে।
এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ
سَيُوَرِّثُهُ»
“জিবরিল আলাইসিসালাম আমাকে প্রতিবেশীদের প্রতি
এত বেশি সতর্ক করতেন, মনে হয়েছিল যে, আমার প্রতিবেশীদেরকে আমার উত্তরসূরি করে
দেওয়া হবে”।[13]
সুতরাং, প্রতিবেশীদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা ও
তাদের অধিকার আদায় প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের তাওফিক
দিন।
প্রতিবেশীর সাথে
ভালো ব্যবহার তাদের কোনও প্রকার কষ্ট না দেওয়া :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ،
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا
يُؤْذِي جَارَهُ»
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে
কষ্ট না দেয়”।[14]
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَت،
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى ظَنَنْتُ
أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ»
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “জিবরীল আলাইসি সালাম সব সময় প্রতিবেশীদের বিষয়ে আমাকে
সতর্ক করেন। এমনকি মনে হত, সে প্রতিবেশীদের উত্তরসূরি বানিয়ে দিবেন”।[15]
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ،
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يُسْلِمُ عَبْدٌ حَتَّى يُسْلِمَ
قَلْبُهُ وَلِسَانُهُ، وَلَا يُؤْمِنُ حَتَّى يَأْمَنَ جَارُهُ بَوَائِقَهُ».
“আব্দুল্লাহ ইমন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে
বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম হবে না যতক্ষণ মানুষের
অন্তর ও মুখ নিরাপত্তা না পাবে, অনুরূপভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বান্দা মুমিন হবে
না যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতিবেশী তার জুলুম অত্যাচার থেকে নিরাপদ না হবে”।[16]
অনেককে দেখা যায় সালাত আদায়, রোযা পালন ও ইবাদত
বন্দেগীতে খুব পাকা। কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়, তাদের হক আদায় করে না,
তার হাত পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হতে অন্য লোকেরা নিরাপদ নয়। এ ধরনের লোক যতই বুজুর্গ
হোক না কেন এরা আল্লাহর নিকট সত্যিকার ঈমানদার নয়। বরং, তারা সমাজের জন্য বিপদ।
মাতা-পিতার
সাথে ভালো ব্যবহার করা:
দুনিয়াতে একজন মানুষের পরম আত্মীয় হল, তার
মাতা-পিতা। মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের হক আদায় করা, তাদের খেদমত
করার মত ভালো কর্ম দুনিয়াতে আর কোনও কিছুই হতে পারে না। সে ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে
দুনিয়াতে মাতা-পিতার খেদমত করে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছে। যার উপর তার
মাতা-পিতা খুশি তার উপর তার আল্লাহও খুশি। মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার লাভ
অনেক। হাদিসে মাতা-পিতার খেদমত করাকে সর্বোত্তম আমল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন-
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: سَأَلْتُ رَسُولَ
اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَيُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ
تَعَالَى؟ قَالَ: الصَّلَاةُ عَلَى وَقْتِهَا. قُلْتُ: ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ .قُلْتُ: ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ
اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ».أَخْرَجَهُ الْبُخَارِيُّ وَمُسْلِمٌ
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর
নিকট প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, সময় মত সালাত আদায় করা। আমি বললাম, তারপর
কোনটি? তিনি বললেন, মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা, আমি বললাম তারপর কোনটি?
তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা”।[17]
কিভাবে মাতা-পিতার সম্মান করব?
মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করার অর্থ, তাদের সাথে এমন কোনও আচার-ব্যবহার
করবে না, যা তাদের মনে আঘাত হানা বা কষ্ট পাওয়া কারণ হয়। তোমার উঠা-বসা, চলা-ফেরা
ও কথা-বার্তায় তারা যেন কোনও প্রকার কষ্ট না পায় সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
তুমি কখনোই তাদের আগে আগে হাঁটবে না, তাদের কথার উপর কথা বলবে না, তাদের জায়গায়
অনুমতি ছাড়া বসবে না এবং তাদের সম্মানহানি হয় এমন কোনও কাজ করবে না ইত্যাদি।
মায়ের ফযিলত পিতার তুলনায় বেশি:
আল্লাহ তা‘আলা মাতা-পিতা উভয়ের প্রতি সম্মান
প্রদর্শন ও তাদের প্রতি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সন্তান
লালন-পালন ইত্যাদিতে পিতার তুলনায় মায়ের ভূমিকা অধিক হয়ে থাকে। মায়ের অতিরিক্ত
কষ্ট বহন করতে হয় যা পিতার করতে হয় না। যেমন, গর্ভধারণ করার কষ্ট, দুধ পান করানোর
কষ্ট, বাচ্চা বয়সে লালন-পালন করার কষ্ট ইত্যাদি। এ কারণে, মায়ের গুরুত্ব পিতার
তুলনায় বেশি। যেমন, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قَالَ رَجِلٌ: " يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ النَّاسِ أَحَقُّ مِنِّي بِحُسْنِ الصُّحْبةِ؟ قَالَ: أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ:
" ثُمَّ أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ثُمَّ أُمُّكَ. قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟
قَالَ: ثُمَّ أَبُوكَ ". أَخْرَجَاهُ الصَّحِيحَيْنِ
“এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে কোন ব্যক্তি আমার
থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার অধিক উপযুক্ত? রাসূল বললেন, তোমার মা। আবার জিজ্ঞাসা
করলেন, তারপর কে? বললেন, তোমার মা, আবারও বললেন, তারপর কে? বললেন, তোমার মা। আবারও
বললেন, তারপর কে? বললেন, তোমার পিতা”।[18]
মাতা-পিতার
নাফরমানি করা কবিরা গুনাহ:
ذُكِرَتِ الْكَبَائِرُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
فَقَالَ: الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ، وَكَانَ مُتَّكِئًا، فَجَلَسَ،
فَقَالَ: وَشِهَادَةُ الزُّورِ، وَشِهَادَةُ الزُّورِ، أَوْ قَوْلُ الزُّورِ
"
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
সামনে কবিরা গুনাহসমূহের আলোচনা করা হলে, তিনি বলেন, কবিরা গুনাহ হল, আল্লাহর সাথে
শরীক করা, মাতা-পিতার নাফরমানি করা, তিনি হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, এ কথা বলে,
উঠে বসেন এবং বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া বা মিথ্যা কথা বলা”।[19]
অপর বর্ণনায় এসেছে,
ذَكَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْكَبَائِرَ،
أَوْ سُئِلَ عَنْهَا، فَقَالَ: الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَعُقُوقُ
الْوَالِدَيْنِ"
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিরা গুনাহের
আলোচনায় বলেন, অথবা কবীরা গুনাহ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তখন তিনি বলেন, “আল্লাহর
সাথে শরীক করা, কোনও মানুষকে হত্যা করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া”।[20]
সন্তানের প্রতি
মাতা-পিতার দো‘আ:
একটি কথা মনে রাখতে হবে, মাতা-পিতার দো‘আ কখনোই ফেরত বা
বৃথা যায় না। আল্লাহ তা‘আলা তা অবশ্যই কবুল করেন। প্রমান-
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الْوَالِدُ، وَالْمَظْلُومُ،
وَالْمُسَافِرُ"
আব্দুল্লাহ ইমন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিন
ব্যক্তির দো‘আ ফেরত পাঠানো হয় না। পিতা-মাতার দো‘আ, মজলুম ব্যক্তির দো‘আ এবং মুসাফির ব্যক্তির দো‘আ।
সন্তানের প্রতি
মাতা-পিতার বদ-দো‘আ:
যেমনিভাবে সন্তানের জন্য মাতা-পিতার দো‘আ কাজে লাগে
অনুরূপভাবে মাতা-পিতার বদ-দো‘আও সন্তানের বিপক্ষে কাজে লাগে। সুতরাং অবশ্যই আমাদের
মাতা-পিতার বদ-দো‘আ হতেও বেঁচে থাকতে হবে। তাদের সাথে এমন কোনও আচরণ করব না যার দ্বারা তারা
কষ্ট পেয়ে আমার জন্য বদ-দো‘আ করে।
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى
اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:" ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ
لَا شَكَّ فِيهِنَّ: دَعْوَةُ الْمَظْلُومِ، وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ، وَدَعْوَةُ الْوَالِدَيْنِ
عَلَى وَلَدِهِمَا
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, “তিন ব্যক্তির দো‘আ কবুল হওয়ার মধ্যে কোনও সন্দেহ নাই। মজলুম
ব্যক্তির দো‘আ, মুসাফিরের দু্’আ এবং সন্তানের উপর তার
মাতা-পিতার বদ-দো‘আ”।[21]
মাতা-পিতার মৃত্যুর
পর তাদের খেদমত করা:
অনেকেই মনে করে মাতা-পিতা মারা যাওয়ার পর
তাদের আর খেদমত করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু না, মাতা-পিতা মারা যাওয়ার পরও তাদের
খেদমত করার সুযোগ থাকে। একজন ব্যক্তি ইচ্ছা করলে তার মাতা-পিতার মৃত্যুর পরও তাদের
খেদমত করতে পারে। তাদের জন্য দো‘আ করা, তাদের অসমাপ্ত কর্মগুলো সমাপ্ত করা এবং তাদের
বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহার ও তাদের সম্মান করা। এ গুলোই হল, মাতার-পিতার মৃত্যুর পর তাদের খেদমত। প্রমাণ-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى
اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: " إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ
إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ،
أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ".أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন মানুষ মারা যায়, তখন তিনটি আমল ছাড়া সব আমল বন্ধ হয়ে
যায়। সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম এবং নেক সন্তান যারা তার জন্য দো‘আ করে”।[22]
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
জিজ্ঞাসা করে বলল,
" يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلْ بَقِيَ مَنْ بِرَّ أَبَوَيَّ بَعْدَ
مَوْتِهِمَا؟ قَالَ: نَعَمْ، خِصَالٌ أَرْبَعٌ: الدُّعَاءُ لَهُمَا، وَالاسْتِغْفَارُ
لَهُمَا، وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِمَا، وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِمَا، وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتِي
لَا رَحِمَ لَكَ إِلَّا مِنْ قِبَلِهِمَا "
“হে আল্লাহর রাসূল! মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাদের আর কোনও
খেদমত করার সুযোগ থাকে কিনা? বললেন, হ্যাঁ, চারটি আমল মৃত্যুর পরও করা যায়। তাদের
জন্য দো‘আ করা, ক্ষমা প্রার্থনা
করা, তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা এবং এমন আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া
দেওয়া, যাদের সাথে মাতা-পিতার আত্মীয়তা ব্যতীত আর কোনো আত্মীয়তা নেই”।[23]
মাতা-পিতাকে গালি দেওয়া কবীরা গুনাহ:
নিঃসন্দেহে বলা যায়, মাতা পিতার সাথে দুর্ব্যবহার করা তাদের গালি দেওয়া অবশ্যই
একটি ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কর্ম। এটি কোনও সুস্থ মানুষের কর্ম হতে পারে না। রাসূলের
যুগে এ ধরনের গর্হিত কর্মের কথা চিন্তাই করা যেত না। হাদিসে এ ধরনের কর্মকে কবীরা গুনাহ
বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন-
«مِنَ الْكَبَائِرِ أَنْ يَسُبَّ الرَّجُلُ وَالِدَهُ» قِيلَ: كَيْفَ
يَسُبُّ الرَّجُلُ وَالِدَهُ؟ قَالَ: «يَسُبُّ وَالِدَ الرَّجُلِ فَيَسُبُّ
وَالِدَهُ، وَيَسُبُّ أُمَّهُ
فَيَسُبُّ أُمَّهُ»
কবিরা গুনাহ হল, পিতা-মাতাকে গালি দেওয়া।
জিজ্ঞেস করা হল, কীভাবে পিতা-মাতাকে গালি দেওয়া হয়? তিনি বললেন, কোনও ব্যক্তি অপর
ব্যক্তির পিতাকে গালি দিল, তারপর সে তার পিতাকে গালি দিল। কেউ অপরের মা-কে গালি
দিল, আবার সে তার মাকে গালি দিল”।[24]
আত্মীয়-স্বজনকে সদকা করা
সর্বশ্রেষ্ঠ সদকা:
শত্রুভাবাপন্ন কোনও আত্মীয়-স্বজনকে সদকা করা
সর্বশ্রেষ্ঠ সদকা।
উম্মে কুলসুম বিনতে উক্ববাহ, হাকীম ইবন হিযাম ও
আবু আইয়ূব থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ
الصَّدَقَةُ عَلَى ذِيْ الرَّحِمِ الْكَاشِحِ»
“সর্বশ্রেষ্ঠ সদকা
হচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যে আপনার শত্রু তার উপর সদকা করা”।[25]
আত্মীয়তা রক্ষা করা সর্বশ্রেষ্ঠ
আমল:
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর সঙ্গে আত্মীয়তার
বন্ধন রক্ষা করা সর্বশ্রেষ্ঠ আমল।
উক্ববাহ ইবন আমির ও ‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
সর্বশ্রেষ্ঠ আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
« صِلْ
مَنْ قَطَعَكَ ، وَأَعْطِ مَنْ حَرَمَكَ ، وَأَعْرِضْ عَمَّنْ ظَلَمَكَ »
“যে তোমার সঙ্গে সে
সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। আর যে তোমাকে বঞ্চিত করে, তাকে তুমি দাও এবং
যালিমের পাশ কেটে যাও তথা তাকে ক্ষমা কর”।[26]
আত্মীয়-স্বজনকে চেনা-জানা:
আত্মীয়-স্বজনকে চেনা-জানা একজন মুমিনের অবশ্যই
কর্তব্য। তা হলেই কেবল আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা কারোর পক্ষে সম্ভবপর হবে। নতুবা
নয়।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
تَعَلَّمُوْا مِنْ أَنْسَابِكُمْ
مَا تَصِلُوْنَ بِهِ أَرْحَامَكُمْ ؛ فَإِنَّ صِلَةَ الرَّحِمِ مَحَبَّةٌ فِيْ
الْأَهْلِ ، مَثْرَاةٌ فِيْ الْمَالِ ، مَنْسَأَةٌ فِيْ الْأَثَر
“তোমরা নিজ বংশ
সম্পর্কে ততটুকুই জানবে, যাতে তোমরা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে পারো। কারণ, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে আত্মীয়-স্বজনদের ভালোবাসা পাওয়া
যায় এবং ধন-সম্পদ বেড়ে যায় আর পরবর্তী
স্মৃতি বাকী রেখে দেয়”।[27]
আত্মীয়-স্বজনদেরকে সদকা করলে দু’টি সাওয়াব পাওয়া যায়: একটি সদকার সাওয়াব এবং অপরটি
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার।
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে সদকা করার উপদেশ দিলে নিজ স্বামীদেরকেও সদকা করা
যাবে কি না সে ব্যাপারে দু’ জন মহিলা সাহাবী বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন:
«لَهُمَا
أَجْرَانِ : أَجْرُ الْقَرَابَةِ وَأَجْرُ الصَّدَقَةِ »
[স্বামীদেরকে দিলেও চলবে] “বরং তাতে দু’টি সাওয়াব রয়েছে: একটি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার সাওয়াব
এবং আরেকটি সদকার সাওয়াব”।[28]
একদা মাইমূনা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না জানিয়ে একটি বাঁদীকে স্বাধীন করে দিলেন। অতঃপর রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সে সম্পর্কে জানালে তিনি বলেন:
« أَمَا إِنَّكِ لَوْ أَعْطَيْتِهَا
أَخْوَالَكِ كَانَ أَعْظَمَ لِأَجْرِكِ »
“জেনে রাখো, তুমি যদি বান্দিটিকে তোমার মামাদেরকে দিয়ে দিতে, তা হলে তুমি আরও
বেশি সাওয়াব পেতে”।[29]
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার বিশেষ গুরুত্বের কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম নিজ সাহাবিদেরকে
মিসরে অবস্থানরত তাঁরই আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভালো ব্যবহারের ওসিয়ত করেন।
আবু যর
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«إِنَّكُمْ
سَتَفْتَحُوْنَ مِصْرَ ، وَهِيَ أَرْضٌ يُسَمَّى فِيْهَا الْقِيْرَاطُ ، فَإِذَا
فَتَحْتُمُوْهَا فَأَحْسِنُوْا إِلَى أَهْلِهَا ، فَإِنَّ لَهُمْ ذِمَّةً
وَرَحِمًا أَوْ قَالَ: ذِمَّةً وَصِهْرًا »
“তোমরা অচিরেই মিশর
বিজয় করবে। যেখানে কিরাতের [দিরহাম ও দীনারের অংশ বিশেষ] প্রচলন রয়েছে। যখন তোমরা তা বিজয়
করবে তখন সে এলাকার অধিবাসীদের প্রতি দয়া করবে। কারণ, তাদের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি ও আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক
রয়েছে”।[30] [ইসমাঈল এর মা হাজেরা ‘আলাইহাস সালাম সেখানকার] অথবা হয়তো বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কারণ, তাদের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি ও আমার শ্বশুর পক্ষীয়
আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। [রাসূলের স্ত্রী মারিয়া রাদিয়াল্লাহু আন্হা সেখানকার]।
অন্তত পক্ষে সালাম
বিনিময়ের মাধ্যমে হলেও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে হবে।
আব্দুল্লাহ
ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আন্হুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন:
« بُلُّوْا
أَرْحَامَكُمْ وَلَوْ بِالسَّلاَمِ»
“অন্ততপক্ষে
সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন সিক্ত করো”।[31]
নিকট আত্মীয়দের জন্য
খরচা করা:
إِنَّ
النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِعَائِشَةَ: «تَصَدَّقِي يَا عَائِشَةُ
وَلَوْ بِتَمْرَةٍ، فَإِنَّهَا تَسُدُّ مِنَ الْجَائِعِ، وَتُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ
كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ»
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা
রা. কে বলেন, “হে আয়েশা! তুমি একটি খেজুর হলেও আল্লাহর রাস্তায় দান কর। কারণ, এটি
একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবারণে সহায়ক হবে এবং তা তোমার গুনাহগুলো এমনভাবে
নিস্তেজ করে দেবে যেমনি ভাবে পানি আগুনকে নিস্তেজ করে দেয়”।[32]
অমুসলিম আত্মীয়ের
সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা:
আত্মীয় স্বজন যদি অমুসলিম হয়, তাতেও তাদের
সাথে সু-সম্পর্ক রাখবে। তাদের সাথে কোনো প্রকার খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। প্রমাণ-
عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَتْ:
" قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ رَاغِبَةٌ مُشْرِكَةٌ، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ
اللَّهِ، إِنَّ أُمِّي قَدِمَتْ عَلَيَّ وَهِيَ رَاغِبَةٌ مُشْرِكَةٌ، أَفَأَصِلُهَا؟
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صِلِيهَا "
আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন, “আমার নিকট আমার মা আসল, তিনি মুশরিক ও ইসলাম বিমুখ। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার নিকট আমার মা এসেছে, তবে তিনি
মুশরিক ও ইসলাম বিমুখ, আমি কি তার সাথে ভালো ব্যবহার করব? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ” তুমি তার সাথে ভালো ব্যবহার কর”।[33]
ইয়াতীমদের
লালন-পালন:
কারো আত্মীয়-স্বজন
যদি এতিম হয়, তাদের লালন-পালন করাতে আরও অধিক সাওয়াবের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«السَّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ وَالْمِسْكِينَةِ
كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الْقَائِمِ لَيْلَهُ الصَّائِمِ نَهَارَهُ،
وَكَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ أَوْ
لِغَيْرِهِ إِذَا اتَّقَى اللَّهَ فَأَنَا وَهُوَ فِي الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ»
يَعْنِي أُصْبُعَيْهِ
“বিধবা নারী ও গরীব মিসকিনকে সাহায্যকারী আল্লাহর
রাস্তায় জিহাদে অংশগ্রহণকারী ঐ মুজাহিদের মত যিনি রাতে আল্লাহর ইবাদত করে এবং দিনে
রোজা রাখে। নিজেদের কোনো ইয়াতীম অথবা অন্য কারও কোনো ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণকারী
যখন সে আল্লাহকে ভয় করবে, তার জন্য [রয়েছে জান্নাত] আমি এবং সে ব্যক্তি জান্নাতে এ
দুটি আঙ্গুলের মত কাছাকাছি থাকব”।[34]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ،
قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خَيْرُ بَيْتٍ فِي الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُحْسَنُ
إِلَيْهِ، وَشَرُّ بَيْتٍ فِي الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُسَاءُ
إِلَيْهِ» . ثُمَّ قَالَ
بِأُصْبُعَيْهِ: «أَنَا وَكَافِلُ
الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ - وَهُوَ يُشِيرُ بِأُصْبُعَيْهِ -»
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, “মুসলিমদের সর্ব উত্তম ঘর হল, যে ঘরে একজন ইয়াতিমকে লালন পালন
করা হয় এবং তার সাথে ভালে ব্যবহার করা হয়। আর মুসলিমদের সব চেয়ে নিকৃষ্ট ঘর হল, যে
ঘরে একজন ইয়াতিমের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হয়। তারপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দুটি আঙ্গুলের দিক ইশারা করে বলেন, আমি এবং ইয়াতিম
লালন-পালনকারী ব্যক্তি জান্নাতে এ দুটি আঙ্গুলের মত কাছাকাছি থাকব”।[35]
এখন আমাদের জানার বিষয় হল, কি কি কারণে মানুষ তার পরম আত্মীয়তার বন্ধনটুকু ছিন্ন করে
দেয়। যা থেকে নিজে দূরে থাকলে বা অন্যকে দূরে রাখলে আত্মীয়তার বন্ধনটুকু অটুট
থাকবে। যা
নিম্নরূপ:
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার কারণ সমূহ
১. মূর্খতা:
কেউ কেউ হয়তো বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার ইহ-কালীন ও পর-কালীন ভয়ানক
পরিণতির কথা না জানার দরুনই আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার প্রতি উদ্বুদ্ধ হতে পারেন।
তেমনিভাবে কেউ কেউ আবার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ইহ-কালীন ও পর-কালীন লাভ না
জানার কারণেও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ নাও হতে পারেন। তাই উক্ত
সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য উভয় প্রকারের জ্ঞানই প্রয়োজন।
২. তাকওয়া বা আল্লাহ সচেতনতা দুর্বল:
কেউ কেউ
হয়ত বা উপরোক্ত জ্ঞান রাখেন। তবে তার মধ্যে আল্লাহ ভীরুতা খুবই দুর্বল। যার দরুন
সে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে ভয় পায় না অথবা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে উৎসাহী
হয় না। এমনকি সে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার পরিণতি সম্পর্কে একটুও ভেবে দেখে না।
৩. অহঙ্কারঃ
কোনও কোনো আত্মীয়-স্বজন
তো এমনও রয়েছে যে, যখন সে দুনিয়ার কোনও
গুরুত্বপূর্ণ পদ-মর্যাদা লাভ করে অথবা বিশেষ কোনও সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জন করে কিংবা বড়
মাপের একজন ধনী হয়ে যায়, তখন সে নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করা ও তাদের সাথে পরিচয় দেয়াকে মানহানি মনে করে। বরং সে মনে করে, আত্মীয়-স্বজনরা তার সাথেই সাক্ষাৎ করুক এটাই তার অধিকার।
৪. অলসতা করে দীর্ঘদিন সাক্ষাত না করাঃ
কখনো
কখনো যে কোনও কারণে কারোর কোনও আত্মীয়-স্বজনের সাথে তার দীর্ঘ দিন যাবত
দেখা-সাক্ষাৎ না হলে পরবর্তীতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে সত্যিই তার লজ্জা লাগে।
এমনকি দেখা করবো করবো বলে আর তাদের সাথে দেখা করা হয় না। এমনি ভাবেই তা এক সময়
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করায় রূপান্তরিত হয়।
৫. কঠিন তিরস্কার:
কেউ কেউ
তার কোনও আত্মীয়-স্বজন দীর্ঘ সাক্ষাত হীনতার পর তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে
খুব কঠিন ভাবে তিরস্কার করে। আর তখন তার আত্মীয় তার সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করতে
ভয় ও লজ্জা পায়। ফলে তার একে অপরের সাথে দেখা
দেয় না। তখন এমনিভাবেই ধীরে ধীরে তাদের
মধ্যকার সম্পর্কটুকু ছিন্ন হয়ে যায়।
৬. আপ্যায়নে বেশি বাড়াবাড়ি:
কোনও কোনো গরিব
ব্যক্তি আবার তার কোনও আত্মীয়-স্বজন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে তার জন্য
প্রয়োজনাতিরিক্ত অধিক আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে এবং এ জন্য অনেক টাকাও খরচ করে। তখন
তার কোনও বুদ্ধিমান আত্মীয়-স্বজন তার সাথে আর সাক্ষাৎ করতে চায় না। যেন সে
আপ্যায়নের ঝামেলায় পড়ে আরও গরিব ও আরও ঋণগ্রস্ত না হয়ে যায়।
৭. মেহমানের প্রতি গুরুত্বহীনতাঃ
আবার
কেউ কেউ এমনও রয়েছে যে, তার কোনও আত্মীয়-স্বজন
তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে তাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। তার কথা-বার্তা গুরুত্ব
দিয়ে শোনে না। তার আগমনে তেমন একটা খুশি প্রকাশ করে না। বরং তাকে মলিন চেহারায়
অভ্যর্থনা জানায়। এমতাবস্থায় তার আত্মীয়-স্বজনরা তার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করার
উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এ ধরনের আচরণ কোনও ভাবেই
কাম্য নয়। একজন ঈমানদারের জন্য উচিত হল, একজন মেহমানের মেহমানদারি করা। আবু
হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন,
«مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ
وَالْيَوْمِ الْآخَرِ، فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ»
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি
বিশ্বাস করে, সে যেন মেহমানের মেহমানদারি করে।[36]”
৮. অত্যধিক কার্পণ্য:
কেউ কেউ আবার অনেক ধন-সম্পদের মালিক হওয়া
সত্ত্বেও তার আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। তার ধারণা, সে তাদের নিকটবর্তী হলে তারা তার কাছ থেকে ঋণ চাইবে। তার থেকে যে কোনও
আর্থিক সহযোগিতা কামনা করবে। মূলত: সে সম্পদের কোনও মূল্যই নেই যে সম্পদ দিয়ে
কারোর কোনও আত্মীয়-স্বজন তার কাছ থেকে এতটুকুও উপকৃত হতে পারলো না।
৯. মিরাস বণ্টনে অতি বিলম্ব:
কখনো কখনো অলসতা কিংবা কোনও কর্তা ব্যক্তির
হঠকারিতার দরুন ওয়ারিশ আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে মিরাস বণ্টন করা হয় না। তখন মিরাস বণ্টনে
উৎসাহী ও অনুৎসাহীদের মাঝে এক ধরনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। আর এরই পরিণতিতে তাদের
মধ্যকার আত্মীয়তার বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়ে যায়।
১০. যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্য:
কখনো কখনো আবার কেউ কেউ নিজ আত্মীয়-স্বজন ও
বোন-ভাইদেরকে নিয়ে যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে ; অথচ তারা পরস্পরের মধ্যে এ সংক্রান্ত কোনও সুস্পষ্ট
নিয়ম-নীতি ঠিক করেনি। বরং তারা পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণার ভিত্তিতেই তা চালিয়ে
যায়। কিন্তু যখন লাভ বেশি হতে শুরু করে এবং কাজের পরিধিও বেড়ে যায় তখন তাদের
পরস্পরের মাঝে এক ধরনের কু-ধারণা জন্ম নেয়। আর তখনই তারা একে অপরের প্রতি যুলুম
করতে উদ্যত হয়। বিশেষ করে যখন তাদের মাঝে আল্লাহ ভীতি ও একে অপরকে অগ্রাধিকার দেয়ার
নীতি লোপ পায় অথবা কেউ কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয় কিংবা
এক জন অন্যের চাইতে কাজে বেশি উৎসাহী হয়। আর এভাবেই তখন তাদের মধ্যকার আত্মীয়তার
বন্ধনটুকু ছিন্ন হতে শুরু করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِنَّ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلۡخُلَطَآءِ لَيَبۡغِي بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٍ
إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَقَلِيلٞ مَّا هُمۡۗ ٢٤ ﴾ [ص : ٢٤]
“নিশ্চয়ই শরীকদের
অনেকেই একে অন্যের উপর অবিচার করে থাকে। তবে সৎকর্ম-শীল মু’মিনরা নয়। যারা সংখ্যায় খুবই কম”।[37]
১১. দুনিয়া নিয়ে অতি ব্যস্ততা:
কেউ কেউ আবার দুনিয়া নিয়ে অতি ব্যস্ততার দরুন
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগই পায় না। এমনিভাবেই তা এক দিন আত্মীয়তার
বন্ধন ছিন্ন করায় রূপান্তরিত হয়।
১২. আত্মীয়দের মাঝে তালাক:
কখনো কখনো আবার কেউ কেউ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে বিবাহ
করার পর তাকে যে কোনও কারণে তালাক দিয়ে দেয়। তখন তাদের সন্তান কিংবা তাদের মধ্যকার
কোনও লেন-দেন নিয়ে তাদের মাঝে সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে একদা তাদের মধ্যকার
আত্মীয়তার বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়ে যায়।
১৩. অলসতা ও দূরত্ব:
কেউ কেউ
চাকুরীর কারণে আত্মীয়-স্বজন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে থাকে। অলসতা ও দূরত্বের
কারণে ইচ্ছা থাকলেও আত্মীয়-স্বজনের সাথে আর সাক্ষাৎ করা হয় না। এমনিভাবেই তা এক দিন
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করায় রুপান্তরিত হয়।
১৪. আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি
অবস্থান:
আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি অবস্থানও কখনো কখনো আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার কারণ হতে পারে। কারণ, একে অপরের পাশে স্থায়ীভাবে অবস্থান করলে যে কোনও সময় তাদের
মাঝে দ্বন্দ্ব লাগতেই পারে। এ জন্যই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন:
مُرُوْا
ذَوِيْ الْقَرَابَاتِ أَنْ يَّتَزَاوَرُوْا وَلاَ يَتَجَاوَرُوْا
“তোমরা নিজ
আত্মীয়-স্বজনদেরকে আদেশ করো যেন তারা পরস্পর সাক্ষাৎ করে এবং একে অপর থেকে দূরে
অবস্থান করে”।[38]
কারণ, আত্মীয়-স্বজনরা দীর্ঘ দিন যাবত একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করলে নিজ নিজ
অধিকার নিয়ে তাদের পরস্পরের মাঝে কোনও না কোনও সময় দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ স্বভাবতই ঘটে
থাকবে। আর এতে করে তাদের পরস্পরের মাঝে বৈরিতা ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মতো
ঘৃণ্য ব্যাপারটিও ঘটতে পারে।
আবার কখনো কখনো আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের অতি
নিকটে অবস্থান করার দরুন পরস্পরের ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিজেদের মধ্যকার
দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। কারণ, স্বভাবতই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ সন্তানকে অপরের সামনে নির্দোষই প্রমাণ
করতে চায়। আর এতে করে তাদের পরস্পরের মাঝে বৈরিতা ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার
মতো ঘৃণ্য ব্যাপারটিও ঘটতে পারে।
আক্সাম ইবন স্বাইফী বলেন:
تَبَاعَدُوْا
فِيْ الدِّيَارِ تَقَارَبُوْا فِيْ الْمَوَدَّةِ
“তোমরা ঘর বাড়ি বানানো ক্ষেত্রে দূরত্ব বঝায় রাখ, আর ভালোবাসার
ক্ষেত্রে কাছাকাছি থাক”।[39]
১৫. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ধৈর্যের
পরিচয় না দেওয়া:
কোনও কোনো আত্মীয়-স্বজন
তো এমনও রয়েছে যে, অন্য আত্মীয়ের
সামান্যটুকু দোষ-ত্রুটিও তার এতটুকু সহ্য হয় না। কেউ তার প্রতি সামান্যটুকু দোষ
করলেই তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সে উদ্যত হয়।
১৬. যে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে কোনও আত্মীয়-স্বজনকে
দাওয়াত দিতে ভুলে যাওয়া:
কেউ
বিয়ে-শাদি কিংবা আক্বীকা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সে সাধারণত তার নিজ
আত্মীয়-স্বজন এবং নিকটতম বন্ধু-বান্ধবদেরকে মৌখিক, কার্ড দিয়ে অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত
থাকার জন্য দাওয়াত করে থাকে। এ দিকে অনুষ্ঠানের প্রচুর আয়োজনাদির ঝামেলার দরুন
হয়তো বা সে তার আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে দাওয়াত দিতে ভুলে গেলো। আর তখনই তার উক্ত
আত্মীয় মানসিক দুর্বলতা ও অত্যধিক কু-ধারণা প্রবণ হওয়ার দরুন তার সম্পর্কে বাস্তবতা বহির্ভূত নিরেট
খারাপ মন্তব্য করে বসে। তখন সে মনে মনে বলে, আমার আত্মীয়টি আমাকে হীন মনে করেই ইচ্ছাকৃতভাবে দাওয়াত দিতে ভুলে গেলো। আর তখন
এমনিভাবেই তা এক দিন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করায় রূপান্তরিত হয়।
১৭. হিংসা:
আল্লাহ তা‘আলা মানব সমাজের কোনও কোনো ব্যক্তিকে
অন্যান্যদের তুলনায় অত্যধিক জ্ঞান, দুনিয়ার পদ মর্যাদা, ধন-সম্পদ ও মানুষের
ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। তখন তিনি নিজ আত্মীয়-স্বজনদের খবরাখবর নেন এবং তাদেরকে
যথাসাধ্য সহযোগিতা করে থাকেন। আর তখনই তাঁর কোনও হিংসুক আত্মীয়ের তা সহ্য নাও হতে
পারে। তখন সে উক্ত ব্যক্তির নিষ্ঠার ব্যাপারে কথা তোলে এবং তাঁর সাথে হিংসাবশত
শত্রুতা করতে থাকে। আর তখন এমনিভাবেই তা এক দিন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করায়
রূপান্তরিত হয়।
১৮. অতিরিক্ত ঠাট্টা-মশকারা:
কেউ কেউ
আবার স্বভাবগতভাবেই হাসি-ঠাট্টা করাকে বেশি পছন্দ করে। এমতাবস্থায় তার মুখ থেকে
কখনো কখনো এমন শব্দ বা বাক্য বের হওয়া অস্বাভাবিক নয় যা অন্যের অনুভূতিকে
দারুণভাবে আঘাত করে। তখন বক্তার প্রতি তার অন্তরে এক ধরনের ঘৃণা ও শত্রুতা জন্ম
নেয়। আর এ ধরনের ব্যাপার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেই বেশি ঘটতে পারে। কারণ, তারাই তো বেশির ভাগ পরস্পর একত্রিত হয়।
আল্লামা
ইব্নু আব্দিল বার [রাহিমাহুল্লাহ্] বলেন: কিছু কিছু বিজ্ঞ আলিম হাসি-ঠাট্টা করাকে
অপছন্দ করতেন। কারণ, এর পরিণতি ভালো নয়।
এর মাধ্যমে মানুষের ইজ্জত ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হয়। মানুষে মানুষে শত্রুতা বৃদ্ধি
পায়।[40]
১৯. চুগলি করা অথবা তা শুনা:
কিছু
মানুষের এমন কুরুচিপূর্ণ স্বভাব রয়েছে যে, এক জনের কথা অন্য জনের কাছে না লাগালে তার পেটের ভাতই হজম হয় না। তার কাজই
হচ্ছে একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে মানুষের মধ্যকার সুসম্পর্ক বিনষ্ট করা। এভাবে
কখনো কখনো আত্মীয়তার বন্ধনও বিনষ্ট হয়। চুগলির চাইতে চুগলি শুনার অপরাধ কম নয়।
কারণ, কেউ সর্বদা অন্যের কাছ থেকে চুগলি
শুনলে ও বিশ্বাস করলে তার জীবনে একদা এমন এক সময় আসবে যখন সে তার জন্য কোনও খাঁটি
বন্ধুই খুঁজে পাবে না।
২০. স্ত্রীর অসৎ চরিত্র:
কারো
কারোর স্ত্রী তো এমন রয়েছে যে, সে তার স্বামীর কোনও আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে পারে না। সে চায় না যে, কেউ তার স্বামীর অনুগ্রহভাজন হোক। সুতরাং সে তার স্বামীকে
তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি বিষিয়ে তোলে। তাদের সাথে তাকে সাক্ষাৎ করতে দেয় না।
তাদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে সে তাকে নিরুৎসাহিত করে। সে তার বাসায়
স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে আপ্যায়ন করতে দেয় না। হঠাৎ তার স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের কেউ তার বাসায়
এসে পড়লে সে তার প্রতি কোনও ধরনের উৎসাহই প্রকাশ করে না। এমনিভাবেই তা এক দিন
আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করায় রূপান্তরিত হয়।
আর কিছু স্বামী তো এমনও রয়েছে যে, সে তার স্ত্রীর একান্ত গোলাম। তার স্ত্রী চাইলেই সে তার
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনটুকু রক্ষা করবে। নতুবা নয়। এমনকি সে তার
স্ত্রীর একান্ত আনুগত্যের কারণে নিজ মাতা-পিতারও অবাধ্য হয়ে যায়।
যখন
আমরা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার ভয়াবহতা ও তার কারণসমূহ জানতে পারলাম তখন একজন
বুদ্ধিমান মু’মিন হিসেবে আমাদের
একান্ত কর্তব্য হবে, আত্মীয়তার বন্ধন
ছিন্ন না হওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হয় এমন কারণসমূহ
থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা।
এরই
পাশাপাশি আমাদেরকে আরও জানতে হবে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার গুরুত্ব এবং তা রক্ষা করার
নিয়মকানুন ও মাধ্যমসমূহ।
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা উপায়:
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা বলতে নিজ বংশ ও শ্বশুর বংশের আত্মীয়দের প্রতি
দয়া করা, তাদের সাথে নম্র
ব্যবহার করা এবং তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে যথাসাধ্য যথেষ্ট যত্নবান হওয়াকে বুঝায়। যদিও তারা আপনার
থেকে বহু দূরে অবস্থান করুক না কেন কিংবা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করুক না কেন।
কিভাবে আত্মীয়তার
বন্ধন রক্ষা পাবে?
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার অনেকগুলো পথ ও মাধ্যম
রয়েছে যার কিয়দংশ নিম্নে উল্লিখিত হল:
তাদের সাথে বার বার সাক্ষাৎ করা, তাদের খবরাখবর নেওয়া, তাদের সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করা, তাদেরকে মাঝে মধ্যে কোনও কিছু উপঢৌকন দেয়া, তাদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান করা, তাদের গরীবদেরকে সদকা-খায়রাত এবং ধনীদের সাথে নম্র ব্যবহার
করা, বড়দেরকে সম্মান করা এবং ছোট ও
দুর্বলদের প্রতি দয়া করা, আপ্যায়ন করা, তাদের সম্মানের সাথে গ্রহণ করা, তাদের মধ্যে যারা আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে
সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
তাদের বিবাহ-শাদিতে অংশ গ্রহণ করা, দুঃখ-দুর্দশায় পাশে থাকা, তাদের জন্য দো‘আ করা, তাদের সাথে প্রশস্ত অন্তরের পরিচয় দেয়া, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ নিরসনের
চেষ্টা করা তথা পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করা, তাদের রুগ্নের সেবা করা, তাদের দাওয়াত গ্রহণ করা ইত্যাদি।
সব চাইতে বেশি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা পাবে নিজ
আত্মীয়-স্বজনকে হিদায়েতের দিকে ডাকা এবং তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে
নিষেধ করার মাধ্যমে।
উক্ত আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার উপায়গুলো সর্বদা
ওদের সাথেই প্রযোজ্য হবে যারা ইসলামকে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করছেন বলে ধারণা করা হয়
অথবা ইসলাম বিরোধী চাল-চলন তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয়।
তবে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা কাফির, মুশরিক অথবা ইসলাম বিরোধী চাল-চলনে অভ্যস্ত তাদেরকে পরকালে আল্লাহ তা‘আলার কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়ে
সঠিক পথে উঠানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। পক্ষান্তরে তা যদি কোনোভাবেই সম্ভবপর না
হয় তথা তারা ধর্মীয় উপদেশের প্রতি একেবারেই মনোযোগী না হয় এবং আপনিও তাদের সাথে
চলতে গেলে নিজের ঈমান-আমল হারানোর ভয় থাকে তা হলে তাদের সাথে আর চলা যাবে না। বরং
তাদেরকে কোনও ধরনের কষ্ট না দিয়ে সুন্দরভাবেই পরিত্যাগ করবে এবং তাদের জন্য সর্বদা
হিদায়াতের দো‘আ করবে। তবে যখনই তাদেরকে ধর্মের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার কোনও সুবর্ণ সুযোগ মিলে যায়; তবে তা একান্ত
সুযোগ বলে মনে করে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
তবে
আত্মীয়-স্বজনদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাদের সাথে কখনো কোনভাবেই দুর্ব্যবহার করা যাবে না। বরং
তাদেরকে নম্রতা, কৌশল এবং সদুপদেশের
মাধ্যমে ধর্মের দিকে ধাবিত করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে কখনো তাদের সাথে
ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। তবে একান্তভাবে তা কখনো করতে হলে ভালোভাবেই করবে।
অনেক দা‘ঈদেরকেই এমন দেখা যায় যে, তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও বংশীয়দের মাঝে তাঁর কোনও প্রভাব নেই।
তা এ কারণে হতে পারে যে, তিনি তাদেরকে
ধর্মের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে কোনও গুরুত্বই দেন না অথবা তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে
সুন্দর পন্থা অবলম্বন করেন না। তা কখনোই ঠিক নয়। বরং তাদের সামনে বিনম্র ভাবে
উপস্থিত হয়ে তাদেরকে খুব গুরুত্ব ও সম্মান দেখাবে। তা হলেই তারা তাঁকে ভালোভাবে
গ্রহণ করবে। তেমনিভাবে প্রত্যেক পরিবার ও বংশের কর্তব্য, তাদের আলিমদেরকে সম্মান করা, তাঁদের কথা শুনা, তাঁদেরকে নগণ্য মনে না করা। কারণ, তাঁদের সম্মান তাঁদের বংশেরই সম্মান।
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ফযীলতঃ
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ফযিলত সত্যিই অনেক, যা দুনিয়া ও
আখিরাত তথা উভয় জাহানের কল্যাণকেই শামিল করে এবং যা কুরআন-হাদীস: ও বিজ্ঞজনদের
কথায় পরিব্যাপ্ত। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু ফযীলত উল্লেখ করা হল:
আত্মীয়তা
সম্পর্ক রক্ষা করার ফযীলত
১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা একজন
একান্ত আল্লাহ তা‘আলার অনুগত বুদ্ধিমানের পরিচায়ক:
আল্লাহ তা‘আলা সত্যিকার বুদ্ধিমানদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
﴿وَٱلَّذِينَ يَصِلُونَ
مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ وَيَخَافُونَ سُوٓءَ
ٱلۡحِسَابِ ٢١ ﴾ [الرعد: ٢١]
“আর যারা আল্লাহ তা‘আলা যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন তা অক্ষুণ্ণ
রাখে, ভয় করে তাদের প্রভুকে এবং ভয় করে
কঠোর হিসাবকে।[41]
২. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা
ঈমানের একটি বাহ্যিক পরিচয় বহন করে:
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْيَوْمِ الْآخِرِ
فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
“যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন নিজ
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”।[42]
৩. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে
রিযিক ও বয়সে বরকত আসে। উপরন্তু তাদের ভালোবাসাও পাওয়া যায়:
আনাস ও
আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আন্হুমা] থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُّبْسَطَ لَهُ فِيْ رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ
فِيْ أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ»
“যে ব্যক্তি পছন্দ
করে যে, তার রিযিক বেড়ে যাক, তার স্মৃতি বাকী থাকুক সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”।[43]
এখানে রিযিক বাড়া ও স্মৃতি বাকী থাকা বলতে তা সরাসরি বেড়ে যাওয়া অথবা তাতে বরকত হওয়াকে বুঝানো হয়।
রিযিক ও বয়সে বরকত হওয়া মানে আল্লাহ তা‘আলা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারীকে এমন শারীরিক
শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, কর্ম ক্ষমতা ও কর্ম দক্ষতা দান করবেন যাতে করে সে তার সীমিত
বয়স এবং রিযিক নিয়ে এমন সকল মহান কর্মকাণ্ড তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে যা সাধারণত
অন্য কারোর পক্ষে দীর্ঘ বয়স এবং বেশি রিযিক নিয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হবে না।
বয়স ও
রিযিক মুক্বাদ্দার তথা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত। এরপরও তা সরাসরি বেড়ে যাওয়া মানে
বরাদ্দ মূলত দু’ ধরনের। প্রথম
বরাদ্দ চিরস্থায়ী তথা সর্ব চূড়ান্ত যা একমাত্র লাওহে মাহফূজেই লিপিবদ্ধ থাকে। যা
কখনো পরিবর্তন করা হয় না। আর দ্বিতীয় বরাদ্দ হচ্ছে অস্থায়ী যা একমাত্র ফেরেশতাদের
বালামেই লিপিবদ্ধ থাকে। যাতে হ্রাস-বৃদ্ধি
ঘটতে পারে, আল্লাহ এর মধ্য থেকে যা ইচ্ছে মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তা মূল
লেখা লাওহে মাহফূজে যা আছে তার বাইরে কিছু ঘটায় না।
সুতরাং
কখনো কখনো কোনও কোনো কারণে কারোর রিযিক ও বয়সে পরিবর্তন আসতে পারে যা আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব থেকেই জানেন এবং তা
লাওহে মাহফূজে চূড়ান্তভাবে লিপিবদ্ধও করে রেখেছেন। যদিও তা দায়িত্বশীল ফেরেশতা জানেন না। যদি আল্লাহ
তা‘আলা কারোর জন্য তার
কামাইয়ের মাধ্যমে তার জন্য কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তাকে কামাইয়ের
উৎসাহ ও সুযোগ দিবেন। আর যদি আল্লাহ তা‘আলা কারোর জন্য তার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার মাধ্যমে তার
জন্য কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তাকে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার উৎসাহ
ও সুযোগ দিবেন। তেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা যদি কারোর জন্য তার কোনও পরিশ্রম ছাড়াই তথা ওয়ারিশি
সূত্রে কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তার কোনও নিকট আত্মীয়কে যার থেকে
সে মিরাস পাবে তাকে যথা সময়ে মৃত্যু দিয়ে তার উক্ত রিযিকের ব্যবস্থা করবেন।
এগুলো
কখনো চূড়ান্ত লেখা (লাওহে মাহফূযের লেখার) বিরোধী কিছু নয়। বরং কোনও বরাদ্দকে শুধুমাত্র কোনও কারণ সংশ্লিষ্ট করা
যা চূড়ান্তভাবে লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যদিও তা দায়িত্বশীল ফেরেশতাকে পূর্ব
থেকে না জানানোর দরুন তিনি তা চূড়ান্তভাবে তাঁর বালামে লিখে রাখতে পারেননি। বরং
তাঁকে ব্যাপারটি চূড়ান্তভাবে লেখার জন্য উক্ত কারণটি বাস্তবে সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত
অপেক্ষা করতে হয়েছে। যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা পরিতৃপ্তি ও তৃষ্ণা নিবারণকে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, সন্তানকে স্ত্রী সহবাস এবং ফসলকে বীজের সাথে সম্পৃক্ত
করেছেন।
৪. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে আল্লাহ
তা‘আলার সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়:
আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ভালো করা দ্বারা
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো হয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যারা তার স্বীয় স্বজনদের সাথে
সম্পর্কে ভালো রাখে তাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখেন। পক্ষান্তরে যারা তাদের নিজেদের
আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক খারাপ রাখে আল্লাহ তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ রাখেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ اللهَ تَعَالَى خَلَقَ الْخَلْقَ، حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ
خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ: هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ ،
قَالَ: نَعَمْ ، أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ ، وَأَقْطَعَ مَنْ
قَطَعَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ! قَالَ: فَهُوَ لَكِ»
“আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকুল সৃজন শেষে
আত্মীয়তার বন্ধন [দাঁড়িয়ে] বলল: এটিই হচ্ছে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর
স্থান। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: হ্যাঁ, ঠিকই। তুমি কি এ
কথায় সন্তুষ্ট নও যে, আমি ওর সঙ্গেই
সম্পর্ক স্থাপন করি, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আমি ওর সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করি যে তোমার সঙ্গে
সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। তখন সে বলল: আমি এ কথায় অবশ্যই রাজি আছি- হে আমার প্রভু! তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন: তা হলে তোমার জন্য
তাই হোক”।[44]
৫. আত্মীয়তার বন্ধন
রক্ষা করলে জান্নাত অতি নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম অতি দূরবর্তী হয়ে যায়:
আবু আইয়ূব আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«جَاءَ رَجُلٌ إلَى النَبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ:
دُلَّنِيْ عَلَى عَمَلٍ أَعْمَلُهُ يُدْنِيْنِيْ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِيْ
مِنَ النَّارِ، قَالَ: تَعْبُدُ اللهَ، لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيْمُ
الصَّلاَةَ وَتُؤْتِيْ الزَّكَاةَ، وَتَصِلُ ذَا رَحِمِكَ، فَلَمَّا أَدْبَرَ
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : إِنْ
تَمَسَّكَ بِمَا أُمِرَ بِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ»
“জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন:
[হে নবী!] আপনি আমাকে এমন একটি আমল বাতলে দিন, যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে
দূরে সরিয়ে দিবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে; তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে ও নিজ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে। লোকটি রওয়ানা
করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে
বললেন: সে যদি আদিষ্ট বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রাখে তা হলে সে জান্নাতে যাবে”।[45]
৬. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে গুনাহ মাফ হয়।
যদিও তা বড়ই হোক না কেন:
‘আব্দুল্লাহ ইবন উমর [রাদিয়াল্লাহু
আন্হুমা] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
أَتَى رَجُلٌ النَّبِيَّ
صلى الله عليه وسلم
فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ!
إِنِّيْ أَصَبْتُ ذَنْبًا عَظِيْمًا ، فَهَلْ لِيْ مِنْ تَوْبَةٍ؟ قَالَ: هَلْ
لَكَ مِنْ أُمٍّ؟ قَالَ: لاَ ، قَالَ: هَلْ لَكَ مِنْ خَالَةٍ؟ قَالَ: نَعَمْ ،
قَالَ: فَبِرَّهَا
“এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল:
হে আল্লাহ’র রাসূল! আমি একটি
বড় গুনাহ করে ফেলেছি। সুতরাং আমার জন্য কি তাওবা আছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন: তোমার কি মা আছে? সে বলল: নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবারো জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার কি খালা আছে? সে বলল: জি হ্যাঁ। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বললেন: সুতরাং তার
সাথেই ভালো ব্যবহার কর।[46]
৭. আত্মীয়তার
বন্ধন রক্ষা করা ইসলামের একটি বাহ্যিক সৌন্দর্য ধারণ করে:
ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক রক্ষা করে।
ইসলাম অন্য মানুষের প্রতি দয়া ও কল্যাণ শিখায়। তাই ইসলাম মানুষের পারস্পরিক
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে আদেশ করে এবং তা যে কোনও কারণে ছিন্ন করতে নিষেধ করে।
আর এভাবেই একদা একটি মুসলিম সমাজ পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে দৃঢ়, দয়াশীল ও পর কল্যাণকামী হয়। যা অন্য কোনও আধুনিক সমাজে দেখা
যায় না।
৮. বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই আত্মীয়তার বন্ধন
রক্ষা করতে
আদেশ করে এবং তা ছিন্ন করতে নিষেধ করে।
এ থেকেই বুঝা যায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ব্যাপারটি
কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।
৯. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা
দুনিয়ার সুনাম ও জনমানুষের প্রশংসা পাওয়ার একটি বিশেষ মাধ্যম।
তা শুধু মুসলিম সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা যে কোনও
কাফির সমাজেও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।
১০. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশেষ গুণাবলীর পরিচায়ক।
কারণ, তা বদান্যতা, উদারতা, কৃতজ্ঞতা, বংশীয় মর্যাদা, মানসিক স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের পরিচয় বহন করে।
১১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা
আত্মীয়দের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভালোবাসা আরও বাড়িয়ে দেয়।
মনে হবে তারা একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে তাদের
পারস্পরিক জীবন আরও অত্যধিক সুখী ও আনন্দময় হবে।
১২. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মান আরও বাড়িয়ে দেয়।
কারণ, কেউ নিজ আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে এবং তাদেরকে
যথাযোগ্য সম্মান করলে তারাও তাকে সম্মান করবে, যে কোনও কাজে তারা তার একান্ত সহযোগী হবে এবং
তারা তাকে তাদের নেতৃত্বের আসনে বসাবে।
১৩. আত্মীয়দের মধ্যকার পারস্পরিক
আত্মীয়তার বন্ধন সুন্দরভাবে
রক্ষা করা হলে জনসমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ে।
অন্যদেরকে তখন তাদের সাথে বহু হিসাব করে চলতে হয়।
কেউ কখনো তাদের উপর সামান্যটুকুও যুলুম করতে সাহস পায় না।
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা
করার উপায়সমূহ:
আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার অনেকগুলো উপায় আছে। নিম্নে আমরা কয়েকটি উপায় উল্লেখ করছি।
১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে দুনিয়া ও আখিরাতের
যে সব উপকার, ফযিলত ও লাভের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা লাভ
করার প্রতি অধিক খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, কোনও বস্তুর ফলাফল, লাভ উপকারিতা ও পরিণতি
জানলেই তা করার সদিচ্ছা জন্মে এবং তা করতে মানুষ অধিক আগ্রহী হয়।
২. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার ভয়ানক পরিণতি
সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। কারণ, তা ব্যক্তি জীবনে একদা বিশেষ চিন্তা, বিষণ্ণতা, লজ্জা ও আফসোস বয়ে আনে। কেননা, কোনও জিনিসের ভয়ানক পরিণতির কথা
জানা থাকলেই তো তা থেকে দূরে থাকা সহজ হয়।
৩. এ ব্যাপারে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার একান্ত সহযোগিতা কামনা
করবে। কারণ, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার সকল কাজ সহজ করে
দিতে পারেন।
৪. আত্মীয়-স্বজনদের দুর্ব্যবহারকে আপনি নিজ ভালো
ব্যবহার ও দয়া দিয়ে মোকাবিলা করবেন।
আবু হুরাইরা
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা জনৈক ব্যক্তি
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন: হে আল্লাহর রাসূল!
আমার এমন কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়েছে যাদের সাথে আমি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করি; অথচ তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো
ব্যবহার করি; অথচ তারা আমার সাথে
দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে ধৈর্যের পরিচয় দেই; অথচ তারা আমার সাথে কঠোরতা দেখায়। অতএব তাদের সাথে এখন আমার
করণীয় কি? তখন রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
«لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ ،
وَلاَ يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللهِ ظَهِيْرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ»
“তুমি যদি সত্যি
কথাই বলে থাক, তা হলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত ছাই খাইয়ে দিচ্ছ। আর তুমি যতদিন পর্যন্ত তাদের সাথে এমন ব্যবহার
করতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের উপর তোমার জন্য একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত থাকবে”।[47]
৫. আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুলত্রুটির কৈফিয়তসমূহ মেনে
নিবে। কারণ, মানুষ বলতেই তো ভুল
হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে ইউসুফ আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া জ্বলন্ত আদর্শের
কথা মাঝে মাঝে স্মরণ করা যেতে পারে। কেননা, তিনি এতো কিছুর পরও তাঁর ভাইয়েরা যখন তাদের কৃতকর্মের জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা
চেয়েছে তখন তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বরং তিনি তাদের ক্ষমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট একান্তভাবে ফরিয়াদও
করেছেন।
৬. আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা না
চাইলেও নিজের উদারতাবশত তাদেরকে ক্ষমা করে দিবে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি সমূহ
একেবারেই ভুলে যাবে।
কারণ, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উন্নত মানসিকতা ও পরম সাহসিকতার
পরিচয় বহন করে। বুদ্ধিমান ব্যক্তি তো সেই যে নিজ আত্মীয়-স্বজনকে ক্ষমা করে দেয় এবং
তাদের দোষ-ত্রুটিগুলো একেবারেই ভুলে যায়।
৭. নিজ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নম্রতা ও ভদ্রতার
পরিচয় দিবে। কারণ, এতে করে সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনরা তাকে অধিক হারে ভালবাসবে এবং তার নিকটবর্তী হওয়ার জন্য
সর্বদা চেষ্টা করবে।
৮. আত্মীয়-স্বজনদের খুঁটিনাটি ভুল-ত্রুটিসমূহ নিজ চোখে
দেখেও তা না দেখার ভান করবে এবং তা নিয়ে কখনো ব্যস্ত হবে না। কারণ, এটি হল মহান ব্যক্তিদের অনুপম চরিত্র। আর এভাবেই তো
পরস্পরের ভালোবাসা দীর্ঘ দিন টিকে থাকে এবং পরস্পরের শত্রুতা ধীরে ধীরে লোপ পায়।
আর এটি হচ্ছে উন্নত মানসিকতা ও স্বচ্ছতার পরিচায়ক। এতে করে মানুষের মান-সম্মান
ক্রমেই বাড়তে থাকে। কখনো তা কমে না।
আল্লামা
ইব্নু হিব্বান [রাহিমাহুল্লাহ্] বলেন: যে ব্যক্তি মানুষের সাথে চলার ক্ষেত্রে
তাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ এড়িয়ে চলা এবং তাদের থেকে বেশি কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পরিত্যাগ করার নীতি অবলম্বন করে না সে স্বচ্ছ জীবনের চাইতে অস্বচ্ছ জীবনই বেশি ভোগ
করবে। মানুষের বন্ধুত্বের চাইতে তাদের শত্রুতাই তার ভাগ্যে বেশি জুটবে। [রাওযাতুল-উক্বালা’: ৭২]
৯. যথাসাধ্য আত্মীয়-স্বজনদের খিদমত করার চেষ্টা
করবে। চাই তা সরাসরি হোক অথবা নিজের ধন-সম্পদ ও পদ-মর্যাদা দিয়েই হোক না কেন।
১০. আত্মীয়-স্বজনদেরকে কখনো নিজ অনুগ্রহের খোঁটা
দিবে না। এমনকি তাদের থেকে সমপর্যায়ের আচরণের আশাও করবে না। কারণ, ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে, সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে না যে ব্যক্তি কেউ তার
সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই তবে সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।
১১. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে অল্পতে তুষ্ট থাকার
নীতি অবলম্বন করবে। কারণ, এ নীতি অবলম্বন
করলেই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা অতি সহজতর হয়। নতুবা নয়।
১২. আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থা ও মানসিকতা বুঝেই
তাদের সাথে অনুরূপ আচরণ করবে। কারণ, আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ তো এমনও রয়েছে যে, তার সাথে বছরে অন্তত একবার সাক্ষাৎ এবং মাঝে মাঝে সামান্য
ফোনালাপই যথেষ্ট। আবার কেউ কেউ তো এমনও রয়েছে যে, তার সাথে মাঝে মাঝে কিছু হাসিখুশি কথা বললেই সে তাতে খুব
খুশি। আবার কেউ কেউ এমনও রয়েছে যে, তার সাথে বারবার সাক্ষাৎ দিতে হয় এবং সর্বদা তার খবরাখবর নিতে হয়। নতুবা সে
রাগ করে। অতএব আত্মীয়দের প্রত্যেকের সাথে তার মেজাজ অনুযায়ী আচরণ করবে। তা হলেই তাদের
সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা অতি সহজেই সম্ভবপর হবে।
১৩. আত্মীয়দের সাথে আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করবে না।
কারণ, আত্মীয়-স্বজনরা যখন দেখবে আপনি তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি
করছেন না তখন তারা বারবার আপনার সাথে সাক্ষাতে উৎসাহী হবে। আর যখন তারা দেখবে আপনি
তাদের আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি করছেন তখন তারা আপনার সাথে বারবার সাক্ষাতে সঙ্কোচ বোধ
করবে এ মনে করে যে, তারা আপনার সাথে
বারবার সাক্ষাৎ করে আপনাকে বিরক্ত করছে না তো?!
১৪. কোনও কারণে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে একান্ত
তিরস্কার করতে হলে তা হালকাভাবে করবে। কারণ, সত্যিকারার্থে ভদ্র ব্যক্তি সে, যে মানুষের অধিকারগুলো পুরোপুরিভাবে আদায় করে এবং নিজের অধিকারগুলো প্রয়োজন
বোধে ছেড়ে দেয়। যাতে করে আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে। তবে
নিজের অধিকার খর্ব হওয়ার দরুন কাউকে একান্ত তিরস্কার করতে হলেও তা হালকাভাবে করবে।
১৫. আত্মীয়-স্বজনদের তিরস্কার সহ্য করবে এবং তার
একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও বের করবে। এটি হচ্ছে সত্যিকারার্থে বিশিষ্ট গুণীজনদেরই
চরিত্র। যাঁদের মধ্যে মানবিক যাবতীয় গুণাবলী বিদ্যমান এবং যারা শীর্ষ স্থানীয়
চরিত্রবান তাঁরাই তো সমাজের অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তিবর্গই হয়ে থাকেন। তাঁদের কোনও
আত্মীয়-স্বজন তাঁদেরকে তিরস্কার করলে তাঁরা মনে করেন, তাঁদের উক্ত আত্মীয় সত্যিই তাঁদেরকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং
তাঁদের বারবার আসা-যাওয়া ও সাক্ষাৎ তিনি অবশ্যই কামনা করেন। তাই তাঁরা তাঁদের উক্ত
আত্মীয়ের নিকট তাঁদের কৃত অপরাধ স্বীকার করেন। কারণ, দুনিয়াতে কিছু লোক তো এমনও রয়েছে যে, তারা অন্যদেরকে খুবই ভালোবাসেন ঠিকই। তবে তারা অন্যের কোনও দোষ-ত্রুটি
দেখলেই তাকে খুবই তিরস্কার করে।
১৬. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে কোনও ধরনের
হাসি-ঠাট্টা করতে তাদের সার্বিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখবে এবং তাদের মধ্যে যারা
হাসি-ঠাট্টা মোটেই পছন্দ করে না তাদের সাথে তা করবে না।
১৭. আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কোনভাবেই বাগবিতণ্ডা ও
তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়বে না। কারণ, তা ধীরে ধীরে পরস্পরের মাঝে বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। বরং তাদের সাথে এমন
সকল আচরণ করা থেকে দূরে থাকবে যা সাধারণত পারস্পরিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
১৮. কখনো নিজ আত্মীয়-স্বজনদের কারোর সাথে কোনও ধরনের
ঝগড়া-বিবাদ ঘটে গেলে যথাসাধ্য আকর্ষণীয় উপঢৌকনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার পূর্বের ভাব
ও সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। কারণ, হাদিয়া ও উপঢৌকন এমন একটি জিনিস যা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে এবং
পরস্পরের মধ্যকার ভুল ধারণাসমূহ নিরসন করে।
১৯. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনরা হচ্ছে নিজের শরীরের একটি অংশের ন্যায়।
সুতরাং, তাদেরকে পরিত্যাগ করা কখনোই সম্ভবপর নয়। বরং তাদের সম্মানই
নিজের সম্মান এবং তাদের অসম্মানই নিজের অসম্মান। আরবরা বলে থাকে,
«أَنْفُكَ
مِنْكَ وَإِنْ ذَنَّ»
“নাক তো তোমারই যদিও
তা থেকে লাগাতার সিন বের হয়”।
২০. সর্বদা এ কথা মনে রাখবে যে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা সত্যিই একটি নিকৃষ্ট
কাজ।
কেউ এতে
নিজকে লাভবান মনে করলেও মূলত: সে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কেউ এতে নিজকে বিজয়ী মনে করলেও মূলত:
সে পরাজিত।
২১. বিয়ে-শাদি, আক্বীকা ইত্যাদি তথা যে কোনও অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনদেরকে দাওয়াত
দেয়ার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখবে। এ জন্য সহজ উপায় হচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজের সকল আত্মীয়-স্বজনদের একটি লিস্ট সংরক্ষণ
করবে। যাতে থাকবে তাদের নাম ও টেলিফোন কিংবা মোবাইল নম্বর। আর যখনই কোনও অনুষ্ঠান
করার চিন্তা করবে তখনই উক্ত লিস্ট খুলে সবাইকে যথাসাধ্য দাওয়াত দেওয়ার চেষ্টা করবে।
চাই তা সরাসরি হোক অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে। যদি কোনও আত্মীয় যে কোনোভাবে উক্ত দাওয়াত
থেকে বাদ পড়ে যায় তা হলে অতি দ্রুত নিজের ভুল স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে
নিবে এবং তাকে যে কোনোভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে।
২২. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কোনও ধরনের সমস্যা ঘটে
গেলে তাদের মধ্যে যাকে আল্লাহ তা‘আলা সবার ভালোবাসা কুড়ানোর সুযোগ দিয়েছেন তাকে উক্ত সমস্যা
দূর করার জন্য দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। তা না করলে একদা উক্ত সমস্যা বড় থেকে বড় হয়ে
সবাইকেই জড়িয়ে ফেলবে।
২৩. নিজেদের মধ্যকার কেউ মারা গেলে তার রেখে
যাওয়া সম্পত্তি দ্রুত ওয়ারিশদের মাঝে বণ্টন করে দিবে।
যেন
কারোর ওয়ারিশই সম্পত্তি নিয়ে ওয়ারিশ আত্মীয়-স্বজনদের পরস্পরের মাঝে
দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ সৃষ্টি না হয়।
২৪. আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যকার যৌথ
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবাই নিজেদের মধ্যে সর্বদা একতা ও সমঝোতার প্রতি বিশেষ
গুরুত্ব দিবে। আমানতদারিতা, সত্যবাদিতা, পরস্পর দয়া, ভালোবাসা ও পরামর্শ এবং অন্যকে নিজের উপর অগ্রাধিকার দেয়ার
প্রতি সর্বদা যত্নবান থাকবে। প্রত্যেকে অন্যের জন্য তাই ভালবাসবে যা নিজের জন্য
ভালোবাসে এবং প্রত্যেকে নিজের অধিকারের পাশাপাশি অন্যের অধিকারের প্রতিও যত্নবান
হবে।
কখনো কোনও সমস্যা অনুভূত হলে তা
অত্যধিক সুস্পষ্টতার সাথে বিশেষ পর্যালোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করবে। প্রত্যেকেই
নিষ্ঠার সাথে কাজ করার চেষ্টা করবে। অন্যের কাজের প্রতি বেশি দৃষ্টি দিবে না। যে কোনও
ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কোনও সিদ্ধান্ত হলে তা লিখে রাখার চেষ্টা করবে। এভাবে চলতে
থাকলে ইনশাআল্লাহ তাদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত ও বরকত নাযিল হবে এবং নিজেদের
মধ্যকার ভালোবাসা দীর্ঘ দিন অটুট থাকবে।
২৫. মাসে, ছয় মাসে অথবা বছরে
অন্তত একবার হলেও আত্মীয়-স্বজনরা সবাই কোথাও না কোথাও একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে সবাই একত্রিত
হলে পরস্পর পরিচিতি, সহযোগিতা ও
ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে উক্ত বৈঠকগুলোর নেতৃত্বে যদি থাকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা।
২৬. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতার
জন্য নিজেদের মধ্যে সর্বদা একটি ফাণ্ড রাখা উচিত। তাতে সবার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট
হারে মাসিক চাঁদা, নিজেদের মধ্যকার
ধনীদের বিশেষ দান-সদকা সংগ্রহ করা যেতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কোনও সমস্যায়
পড়লে তা বিশেষভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সে ব্যাপারে তাকে যথাযোগ্য সহযোগিতা করবে। এতে করে পরস্পরের
মাঝে ভালোবাসা জন্মাবে ও বৃদ্ধি পাবে।
২৭. আত্মীয়-স্বজনদের একটি ফোন বুক তৈরি করে তা
কপি করে সবার মাঝে বিতরণ করবে। উক্ত ফোন বুকটি সর্বদা নিজ আত্মীয়-স্বজনকে স্মরণ করিয়ে
দিবে। এতে করে ফোনের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের খবরাখবর নেয়া এবং তাদেরকে বিশেষ
অনুষ্ঠানাদিতে দাওয়াত দেওয়া সহজ হবে।
আত্মীয়তার বন্ধনও রক্ষা পাবে।
২৮. আত্মীয়-স্বজনদের যে কাউকে বার বার বিরক্ত করা
ও ঝামেলায় ফেলা থেকে বিরত থাকবে। কাউকে তার সাধ্যাতীত কিছু করতে বার বার বিরক্ত
করবে না। বিশেষ করে আত্মীয়-স্বজনদের কেউ যদি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা ধনী ব্যক্তি হন, তা হলে তাদেরকে
এমন কাজ করতে চাপ সৃষ্টি করবে না যা তাদের সাধ্যের বাইরে অথবা কষ্টসাধ্য। যদি তাঁরা কোনও কারণে
কারোর কোনও আবদার রক্ষা করতে না পারে তা হলে তাঁদেরকে কোনও তিরস্কার করবে না। বরং
তাঁদেরকে এ ক্ষেত্রে অপারগ মনে করবে।
২৯. আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে পারস্পরিক পরামর্শ
আদান-প্রদানের সুব্যবস্থা থাকা উচিত। বরং তাদের মাঝে একটি স্থায়ী মজলিসে শুরা
থাকলে তা আরও ভালো। যাতে করে কারোর কোনও বড়ো সমস্যা দেখা দিলে তাদের উপযুক্ত পরামর্শ নেয়া
যায় এবং এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যাতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট থাকবেন। উপরন্তু আত্মীয়-স্বজনরাও
সবাই খুশি থাকবে। তবে মজলিসে শূরার সদস্যরা এমন হতে হবে যাদের রয়েছে অত্যধিক
দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্বার ক্ষমতা।
৩০. তবে উপরোক্ত সকল বিষয়ে এ কথার খেয়াল রাখবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য হয় এবং পারস্পরিক
সহযোগিতা পরোকল্যাণ ও তাকওয়া তথা আল্লাহ সচেতনতার ভিত্তিতে হয়। জাহিলি যুগের বংশ ও আত্মীয়
প্রেমের ভিত্তিতে যেন না হয়।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এ পরম
আত্মীয়তার বন্ধনটুকু ছিন্ন করা থেকে সর্বদা বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন!
[1] মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩
[2] সূরা রা‘আদ,
আয়াত: ২৫
[3] বুখারী, হাদীস: ৫৯৮৪ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৬; তিরমিযী, হাদীস: ১৯০৯; আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৯৬; আবদুর রায্যাক, হাদীস: ২০২৩৮; বায়হাক্বী, হাদীস: ১২৯৯৭
[4] আহমদ, হাদীস: ১৯৫৮৭; হাকিম, হাদীস: ৭২৩৪; ইবনু হিব্বান, হাদীস: ৫৩৪৬।
[5] আহমদ, হাদীস: ১০২৭৭
[6] আবু দাউদ, হাদীস: ৪৯০২; তিরমিযী, হাদীস: ২৫১১; ইবনু মাজাহ্, হাদীস: ৪২৮৬; ইবনু হিব্বান, হাদীস: ৪৫৫, ৪৫৬; বায্যার, হাদীস: ৩৬৯৩; আহমদ, হাদীস: ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪।
[7] মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩
[8] বুখারী, হাদীস: ৪৮৩০, ৫৯৮৭ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৪
[9] বুখারি,
হাদিস: ৫৯৮৯; আহমদ, হাদিস: ১৬৮৬; তিরমিযি, হাদিস: ১৯০৭
[10] বুখারী, হাদীস: ৫৯৯১; আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৯৭; তিরমিযী, হাদীস: ১৯০৮; বায়হাক্বী, হাদীস: ১২৯৯৮
[11] আহমদ, হাদিস:
৬৪৯৪
[12] মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৮; আহমদ, হাদিস: ৯৩৪৩
[13] বুখারি:
৬০১৫; মুসলিম: ২৬২৫।
[14] বুখারি:
৫১৮৫; মুসলিম: ৪৭
[15] বুখারি:
৬০১৫; মুসলিম: ২৬২৫
[16] মুসনাদে
আহমদ: ৩৬৭২
[17] বুখারি: ৫২৭; মুসলিম:
৮৫
[18] বুখারি:
৫৯৭১; মুসলিম: ২৫৪৮
[19] বুখারি: ২৬৫৪
[20] বুখারি: ৫৯৭৬
[21] আহমদ: ৮৫৮০;
আবু দাউদ: ১৫৩৬ আলবানী রহ. হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।
[22] মুসলিম:
১৬৩১; আবু দাউদ: ২৮৮০
[23] আবু দাউদ:
৫১৪২; আলবানী হাদিসটিকে দূর্বল বলেছেন।
[24] মুসলিম: ৯০;
আহমদ: ৬৫২৯
[25] ইবনু খুযাইমাহ্, হাদীস: ২৩৮৬ বায়হাক্বী, হাদীস: ১৩০০২ দা’রামী, হাদীস: ১৬৭৯ ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস: ৩১২৬, ৩৯২৩, ৪০৫১ আওসাত্ব, হাদীস: ৩২৭৯ আহমদ, হাদীস: ১৫৩৫৫, ২৩৫৭৭
[26] আহমদ, হাদীস: ১৭৩৭২, ১৭৪৮৮; ’হাকিম, হাদীস: ৭২৮৫ বায়হাক্বী, হাদীস: ২০৮৮০
ত্বাবারানী/কাবীর, হাদীস: ৭৩৯, ৭৪০ আওসাত্ব, হাদীস: ৫৫৬৭
[27] তিরমিযী, হাদীস: ১৯৭৯
[28] বুখারী, হাদীস: ১৪৬৬ মুসলিম, হাদীস: ১০০০
[29] বুখারী, ২৫৯২, ২৫৯৪ মুসলিম, হাদীস: ৯৯৯ আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৯০
[30] মুসলিম, হাদীস: ২৫৪৩
[31] বায্যার, হাদীস: ১৮৭৭, ইবনু হিব্বান: ৭৫/১, আল-আহাদিস আস-সহীহা: ১৭৭৭
[32] কিতাবুল বির
ওয়াস সিলা: হাদিস নং ২৭৭
[33] আল মুজামুল
কবীর: ৭৯
[34] বুখারি:
৫৩৫৩; তিরমিযি: ১৯১৮
[35] তিরমিযি:
১৯১৮; ইমাম তাবরানীর মাকারিমুল আখলাক: হাদিস নং ১০৩
[36] বুখারী,
৬০১৮; মুসলিম: ৪৭।
[37] সূরা সদ,
আয়াত: ২৪
[38] উয়ূনুল-আখবার :
৩/৮৮ ইহ্য়াউ উলূমিদ্দীন : ২/২১৬
[39] উয়ূনুল-আখবার ৩/৮৮।
[40] বাহ্জাতুল-মাজালিস
৩/৫৬৯।
[41] সূরা রাআদ, আয়াত: ২১
[42] বুখারী, হাদীস: ৬১৩৮
[43] বুখারী, হাদীস: ২০৬৭, ৫৯৮৫, ৫৯৮৬ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৭ আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৯৩
[44] বুখারী, হাদীস: ৪৮৩০, ৫৯৮৭ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৪
[45] বুখারী, হাদীস: ১৩৯৬, ৫৯৮২, ৫৯৮৩ মুসলিম, হাদীস: ১৩
[46] তিরমিযী, হাদীস: ১৯০৪
[47] মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৮
---------------------------------------------------------------------------------------------------
লেখক: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলামহাউজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন