শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

বিশ্ব মানবতার প্রতি মহানবীর ১০ অবদান

বিশ্ব মানবতার প্রতি মহানবীর ১০ অবদান 



বিশ্ব মানবতার প্রতি মহানবীর ১০ অবদান 

সকল প্রশংসা কেবল নিখিল জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী ও রাসূলগণের সর্বশেষ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
অব্যাহতভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর স্বেচ্ছা বিকৃতির প্রভাবে অমুসলিমদের কেউ কেউ বিশেষত পশ্চিমারা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার জন্য কী উপস্থাপন করেছেন, মানবতার প্রতি তাঁর অবদান কী তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিশ্ববাসীর সামনে নবীয়ে রহমত বা দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ ছাড়াও আমাদের নির্ধারিত কর্তব্যসমূহের একটি হলো বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া। নবীকুল শিরোমনি, নবী ও রাসূলগণের সর্বশেষ আমাদের মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতার জন্য কী উপহার নিয়ে এসেছেন তা সংক্ষেপে তুলে ধরা। নিচে দশটি পয়েন্টে ভাগ করে আমরা সে বিষয়টিই আলোচনার প্রয়াস পাব :

আল্লাহর ওহী লাভের মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতাকে মানুষের দাসত্ব ও তাদের গোলামি থেকে একমাত্র শরীকবিহীন আল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে গেছেন। এতে করে মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর সব কিছুর দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। বলাবাহুল্য এটিই মানুষের সবচে বড় সম্মান।

আল্লাহর ওহী লাভের মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতাকে সকল কল্পকথা ও কুসংস্কার এবং সব রকমের মিথ্যা ও প্রতারণার সামনে শির না নোয়াবার শিক্ষা দিয়েছেন। অক্ষম প্রতিমা ও অলীক প্রভুদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেছেন। মুক্ত করেছেন তিনি সুস্থ বিবেক পরিপন্থী চিন্তাধারার বিশ্বাস থেকে। যেমন : এ কথা বিশ্বাস করা যে মানুষের মধ্য থেকেই আল্লাহর কোনো সন্তান রয়েছেন। যিনি কোনো অপরাধ বা পাপ ছাড়াই মানবতার কল্যাণে উৎসর্গিত হয়ে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ব মানবতার চেতনায় ক্ষমা ও উদারতার ভিতগুলোকে সুদৃঢ় করেছেন। পবিত্র কুরআনে খোদ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’ মর্মে ওহী প্রেরণ করেছেন। এদিকে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মুসলিমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করেছেন। তাদের জীবন, সন্তান, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা ঘোষণা করেছেন। তাইতো আজ অবধি মুসলিম দেশগুলোতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সসম্মানের জীবন যাপন করতে দেখা যায়। অথচ একই সময়ে মুসলিম অস্তিত্ব সংক্রান্ত স্পেনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পশ্চিমাদের প্রকাশ্য মূল্যবোধ বিরোধী বংশধারা থেকে সে ভূমিকে পবিত্র করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধর্ম, বর্ণ ও বংশ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে বরং এমন উপাদানেরও অভাব নেই যা পক্ষী ও প্রাণীকুলের প্রতি মায়া-মমতা ও কোমলতা দেখাতেও গুরুত্ব দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এদের অকারণে কষ্ট প্রদান কিংবা এদের প্রতি বিরূপ আচরণকে।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অগ্রবর্তী সকল নবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল চিত্র উপস্থাপন করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন নবী ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা (আলাইহিমুস সালাম) প্রমুখ নবী-রাসূল। উপরন্তু তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে বাণীই প্রেরণ করেছেন, যে কেউ তাঁদের (আল্লাহর প্রেরিত নবীদের) মধ্যে কাউকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে অথবা তাঁর সম্মানহানী ঘটাবে, সে মুসলিম নয়। কেননা সকল নবী ভাই-ভাই। তাঁরা সবাই মানুষকে লাশরীক এক আল্লাহর প্রতি ডাকার কাজে সমান।

নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট-বড় ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার রক্ষা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তার সামাজিক মর্যাদা বা জীবনযাত্রার মানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন নি। এ ব্যাপারে তিনি চমৎকার একগুচ্ছ নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর অন্যতম হলো প্রস্থানের তিন মাস আগে বিদায় হজে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু বাণী। এতে তিনি মানুষের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে আঘাত হানাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি এ ভাষণ প্রদান করেন এমন সময় বিশ্ব যখন ১২১৫ সালে ম্যাগনাকার্টা লিবার্ট্যাটাম, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৯৮ সালের ব্রিটিশ বিল অব রাটইস, ১৭৭৬ সালের আমেরিকান স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭৮৯ সালের ফরাসি ডিক্লারেশন অব হিউম্যান অ্যান্ড সিভিল রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার কথা পৃথিবীবাসী কল্পনাও করে নি।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জীবনে আখলাক তথা সচ্চরিত্রের মান তুলে ধরেছেন অনেক উঁচুতে। মানুষকে তিনি উত্তম আখলাক তথা সচ্চরিত্র ও তার সহায়ক গুণগুলো বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। যেমন তিনি সততা, সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সামাজিক সম্পর্ক সুদুঢ় করতে তিনি পিতামাতার সঙ্গে সদাচার এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বহাল রাখতে বলেছেন। জীবনে তিনি এর সফল প্রয়োগও ঘটিয়েছেন। পক্ষান্তরে তিনি অসৎ চরিত্র অবলম্বন থেকে বারণ করেছেন। তিনি নিজে যেমন মন্দ স্বভাব থেকে দূরে থেকেছেন, তেমনি অন্যদেরও এ থেকে সতর্ক করেছেন। যেমন : মিথ্যা, ছলনা, হিংসা, যেনা-ব্যভিচার ও পিতামাতার অবাধ্যচরণ করা। শুধু তাই নয়, এসব থেকে সৃষ্ট সমস্যাবলির প্রতিকারও বলে দিয়েছেন তিনি।

আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুদ্ধি কাজে লাগাতে বলেন। সৃষ্টি জগত উদ্ঘাটন ও তার পরিচয় লাভে উৎসাহিত করেন। একে তিনি নেকী তথা পুণ্য কাজ বলে গণ্য করেন। অথচ একই সময়ে অপর সভ্যতাগুলোর জ্ঞানী ও চিন্তা নায়করা নির্যাতন ভোগ করছিলেন। ধর্ম অবমাননা ও ধর্ম বিদ্বেষকে তখন সর্বাধিক মূল্য দেয়া হচ্ছিল। ধর্ম প্রচারকদের শাস্তি ও কারাভোগ এমনকি মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছিল।

আল্লাহর ওহী লাভের মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাব বান্ধব এক দীন নিয়ে আবির্ভুত হন যা আত্মিক খোরাক ও দৈহিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখে। পার্থিব কাজ ও আখিরাতের আমলের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে। পরিশীলিত ও পরিামর্জিত করে মানুষের সহজাত বাসনা ও ঝোঁককে। অপরাপর জাতিগুলোর সভ্যতার মতো একে ধ্বংস বা অবদমিত করে না। অন্য জাতিগুলোর সভ্যতায় দেখা যায়, তারা মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধ মূর্তিপূজোর মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। ধর্ম অন্তপ্রাণ ও তপস্যানুরাগীদেরকে তাদের প্রাকৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। যেমন : বিয়ে-শাদি। বঞ্চিত করেছিল অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের স্বভাবসুলভ মানবিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের অধিকার থেকে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাদেরকে একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন বানিয়ে ছেড়েছিল। যা ওই সভ্যতার সিংহভাগ সন্তানেরই শিক্ষা ও সুরুচিকে করেছিল লুপ্তপ্রায়। পরন্তু তাদের ঠেলে দিয়েছিল নিছক জড় জগতের অন্ধকারে। যা কেবল দেহের চাহিদায় সাড়া দেয় আর আত্মাকে নিক্ষেপ করে বিশাল শুন্যতায়।

মানবতার কল্যাণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের আন্তঃসম্প্রদায়ে ভ্রাতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করেছিলেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কোনো মানব সম্প্রদায়ের ওপর অন্য কোনো মানব সম্প্রদায়ের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মূল সৃষ্টি, অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান। শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবল ঈমান ও তাকওয়া তথা বিশ্বাস ও আল্লাহভীতির নিরিখে। তিনি তাঁর সকল সঙ্গী-সাহাবীকে দীনের খেদমত করার এবং তাতে সম্পৃক্ত হবার সমান সুযোগ দিয়েছেন। তাইতো তাঁদের মধ্যে আরবদের পাশাপাশি ছিলেন (রোম দেশের) সুহাইব রূমী, (হাবশার) বিলাল হাবশী এবং (পারস্যের) সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু আনহুম।

পরিশেষে : এই দশটি পয়েন্টের প্রতিটিই সংক্ষিপ্ত প্রমাণাদি উল্লেখ পূর্বক বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু আল্লাহর ওহী প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার জন্য যা উপহার দিয়েছেন তা উল্লেখের এ জায়গা পর্যাপ্ত নয়। সবিস্তারে এসব পয়েন্ট জানার জন্য নবীয়ে রহমতের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের নিজস্ব ওয়েবসাইট ব্রাউজ করুন : www.mercyprophet.com
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর সকল নবী ভাই এবং তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবা-তাবেঈদের ওপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।


ড. আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী
সাধারণ সম্পাদক : বারনামাজুল আলামী লিত-তারিখ বি নাবিয়্যির রাহমাহ

লেখক: আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী
অনুবাদক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা: মো: আবদুল কাদের
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব


আরও পড়ুনঃ নবী জীবনী

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন