বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

সিয়াম ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসায়েল (১ম পর্ব)

সিয়াম ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসায়েল (১ম পর্ব)



১ম পর্ব | ২য় পর্ব 

মহাপরিচালকের কথা

রহমত, মাগফিরাত ও নারকীয় জীবনের স্পর্শ থেকে মুক্তি লাভের অফুরান সম্ভাবনা নিয়ে ফিরে আসে মাহে রমজান। আসে তাকওয়ার উত্তাপ অনুভব করাতে, যা কিছু অকল্যাণকর, অন্ধকারময় তা থেকে ব্যক্তির আন্তর ও বাহ্য জগৎকে বিমুক্ত করে শুদ্ধ-আলোকিত মানুষের উন্মেষ ঘটাতে। তবে তার জন্য প্রয়োজন মাহে রমজানকে যথার্থভাবে যাপন, সিয়াম পালনের নীতি-বিধান বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন, সিয়ামের শিক্ষা ও মাসায়েল বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন।

'সিয়াম ও রমজান : শিক্ষা-তাৎপর্য-মাসাইল' বইটি এ বিষয়ের একটি অনবদ্য গবেষণা। লেখক ও গবেষক হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান কেবলমাত্র সহীহ ও হাসান হাদীসের নির্ভরতায় সিয়াম সাধনা বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ দলীল প্রস্তুত করেছেন বলে তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। মুফতী নোমান আবুল বাশার, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা ইকবাল হোসাইন মাসুম, মুফতী জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের, মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব-এর আন্তরিক সহযোগিতায় গবেষণা কর্মটি আরও উজ্জ্বলতা পেয়েছে নিঃসন্দেহে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে বইটিকে মুদ্রণ উপযুক্ত করে তুলেছেন মুফতী কামাল উদ্দিন মোল্লা, তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মাহে রমজান ও সিয়াম সাধনা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ এই রচনাটি ইমাম ও দায়ীদের জন্য একটি অতি-মূল্যবান তথ্য-ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সাধারণ পাঠক সিয়াম সাধনার খুঁটি-নাটি বিষয়ে অজানা বহু তথ্য খুঁজে পাবেন বইটিতে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম জাযা দান করুন। আমীন।

ড. মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
মহাপরিচালক
আবহাস এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি ঢাকা।

সূচি

রমজান মাসের ফযীলত
এক. এ মাসের সাথে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের সম্পর্ক রয়েছে; আর তা হলো সিয়াম পালন
দুই. রমজান হল কুরআন নাযিলের মাস
তিন. রমজান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় ও জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় শয়তানদের
চার. রমজান মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর
পাঁচ. রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস
ছয়. রমজান পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস
সাত. রমজান জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস
আট. রমজান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়
নয়. রমজান ধৈর্য ও সবরের মাস
সিয়ামের ফযীলত
এক. সিয়াম শুধু আল্লাহর জন্য
দুই. সিয়াম আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন
তিন. সিয়াম ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা
চার. সিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল
পাঁচ. সিয়াম হল জান্নাত লাভের পথ
ছয়. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আ-ল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম
সাত. সিয়াম ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম
আট. সিয়াম কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
নয়. সিয়াম হল গুনাহ মাফের কারণ ও গুনাহের কাফফারা
রমজান মাসে যে সকল নেক আমল করা যায়
(১) কিয়ামুল লাইল
(২) আল-কুরআন খতম ও তিলাওয়াত
(৩) সদকা বা দান
(৪) এতেকাফ
(৫) ওমরাহ আদায়
(৬) রোজাদারদের ইফতার করানো
(৭) দোয়া-প্রার্থনা করা
(৮) তওবা করা
(৯) অধিক হারে নেক আমল করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখা
(১০) ইসলামী শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান
সিয়ামের হিকমত ও তার লক্ষ্য এবং উপকারিতা
(১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি
(২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা
(৩) সিয়াম আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তার দাসত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ
(৪) ঈমানকে দৃঢ় করা, মোরাকাবা ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা
(৫) ধৈর্য, সবর ও দৃঢ় সংকল্পের প্রশিক্ষণ
(৬) আখেরাতমুখী করার প্রশিক্ষণ
(৭) আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া ও সৃষ্টি জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া
(৮) সিয়াম সমাজ সংস্কারের একটি বিদ্যাপীঠ
(৯) শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা অর্জন
সিয়ামের আদব
(১) ইসলামকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা
(২) সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকা
(৩) ইখলাস অবলম্বন করা
(৪) সুন্নতে নববীর অনুসরণ
(৫) সিয়াম ভঙ্গের সহায়ক বিষয়গুলো পরিহার করে চলা
(৬) ভয় ও আশা পোষণ করা
(৭) সাহরী খাওয়া
(৮) দেরি করে সাহরী খাওয়া
(৯) সাহরীর সময়কে সুযোগ মনে করে কাজে লাগানো
(১০) ইফতারি করতে বিলম্ব না করা
কেন বিলম্ব না করে ইফতার ও দেরিতে সাহরী খাবেন
(১১) যে সকল খাদ্য দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব
(১২) ইফতারের সময় দোয়া করা
(১৩) বেশি করে ভাল ও কল্যাণ মূলক কাজ করা এবং কুরআন পাঠ করা
(১৪) ইবাদত-বন্দেগীতে তাওফীক দানের ব্যাপারে আল্লাহর অনুগ্রহ অনুধাবন করা
(১৫) দরিদ্র ও সহায় -সম্বলহীনদের প্রতি মমতা ও তাদের সেবা করা
(১৬) সুন্দর চরিত্র, ধৈর্য ও উত্তম আচরণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করুন
(১৭) অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকুন
(১৮) রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগান
(১৯) দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে দিন
(২০) খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য বজায় রাখুন
সিয়াম পালন যাদের উপর ফরজ
দশ প্রকার মানুষ যাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়
প্রথম : কাফের বা অমুসলিম
দ্বিতীয় : অপ্রাপ্ত বয়স্ক
অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে কখন বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হয়
তৃতীয় : পাগল
চতুর্থ : অশীতিপর বৃদ্ধ যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না
পঞ্চম : যে ব্যক্তি সিয়াম পালনের সামর্থ্য রাখে না
কীভাবে মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করবে
ষষ্ঠ : মুসাফির
সপ্তম : যে রোগী সুস্থ হওয়ার আশা রাখে
অষ্টম : ঋতু-স্রাবগ্রস্ত নারী
নবম : গর্ভবতী ও দুগ্ধ দান কারী নারী
দশম : যে অন্যকে বাঁচাতে যেয়ে সিয়াম ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়
সিয়ামের কাজা আদায়ের বিধান
সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়াবলী ও করণীয়
প্রথম : সহবাস
কীভাবে সিয়ামের কাফফারা আদায় করা যায়
দ্বিতীয় ইচ্ছাকরে বীর্যপাত করা
তৃতীয় : পানাহার করা
চতুর্থ : যা কিছু পানাহারের বিকল্প
পঞ্চম : হাজামা বা শিঙা লাগানো
ষষ্ঠ : ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা
সপ্তম : মহিলাদের মাসিক ও প্রসূতিবস্থা আরম্ভ হলে
যে সকল বিষয় সিয়াম ভঙ্গ করে না
রমজানের শেষ দশকের ফযীলত ও তাৎপর্য
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব
লাইলাতুল কদর কখন
এতেকাফ তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও বিধানাবলী
এতেকাফের সংজ্ঞা
এতেকাফের ফযীলত
এতেকাফের উপকারিতা
এতেকাফের আহকাম
ইসলামী শরিয়াতে এতেকাফের অবস্থান
এতেকাফের উদ্দেশ্য
১- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা
২- পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকা
৩- শবে কদর তালাশ করা
৪-মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা
৫- দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা
৬- ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা
এতেকাফের বিধানাবলী
এতেকাফের সময়সীমা
এতেকাফে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময়
এতেকাফের শর্তাবলী
১-এতেকাফ মসজিদে হতে হবে
২-মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান
৩-এতেকাফকারীর জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ
৪-এতেকাফকারীর জন্য যা অনুমোদিত
৫-এতেকাফকারী যা থেকে বিরত থাকবে
সদকাতুল ফিতর
১-সদকাতুল ফিতরের বিধান
২- সদকাতুল ফিতর কার উপর ওয়াজিব ?
৩- সদকাতুল ফিতর এর পরিমাণ
৪- কখন আদায় করবেন সদকাতুল ফিতর
৫- সদকাতুল ফিতর কাকে দেবেন
ঈদের তাৎপর্য ও করণীয়
ঈদের সংজ্ঞা
ইসলামে ঈদের প্রচলন
ঈদের তাৎপর্য
ঈদের দিনের করণীয়
(১) গোসল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা
(২) ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ প্রসঙ্গে
(৩) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া
(৪) ঈদের তাকবীর আদায়
ঈদের সালাত
(১) ঈদের সালাতের হুকুম
(২) ঈদের জামাতে মহিলাদের অংশগ্রহণের নির্দেশ
(৩) ঈদের সালাত আদায়ের সময়
(৪) ঈদের সালাত কোথায় আদায় করবেন
(৫) ঈদের সালাতের পূর্বে কোন সালাত নেই
(৬) ঈদের সালাতে আযান ও একামত নেই
(৭) ঈদের সালাত আদায়ের পদ্ধতি
(৮) ঈদের খুতবা শ্রবণ
(৯) ঈদের সালাতের কাজা আদায় প্রসঙ্গে
(১০) ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা
(১১) আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া
ঈদে যা বর্জন করা উচিত
(১) কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন ধরনের কাজ বা আচরণ করা
(২) পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ
(৩) ঈদের দিনে কবর যিয়ারত
(৪) বেগানা মহিলা পুরুষের সাথে দেখা সাক্ষাৎ
(ক) মহিলাদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া
(খ) মহিলাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ
(৫) গান-বাদ্য
(ক) বিবাহের অনুষ্ঠানে
(খ) ঈদের সময়ে
অন্যান্য নফল সিয়াম
১- শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা
২- আরাফা দিবসের সওম
৩- মুহাররম মাসের সওম
৪- শাবান মাসে সিয়াম
৫-প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা
৬- সোমবার ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম
৭- একদিন পর একদিন সওম পালন
৮- আশুরার সিয়াম পালন
কীভাবে আশুরার সওম পালন করবেন
নিষিদ্ধ সিয়াম
রমজান মাসে আল-কুরআন কীভাবে তিলাওয়াত করা উচিত

بسم الله الرحمن الرحيم

রমজান মাসের ফযীলত

রমজান মাসের আগমনে মুসলিমগণ আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। আনন্দ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। তারা যা সঞ্চয় করে এটা তার চেয়ে উত্তম।[১]

পার্থিব কোন সম্পদের সাথে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না, তা হবে এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা। যখন রমজানের আগমন হত তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অতিশয় আনন্দিত হতেন, তার সাহাবাদের বলতেন:
أتاكم رمضان شهر مبارك .سنن النسائي : ২১০৫
তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। এরপর তিনি এ মাসের কিছু ফযীলত বর্ণনা করে বলতেন :
فرض الله عز وجل عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب السماء، وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه مردة الشياطين، فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم. رواه النسائي: ২১১৮
আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল।[২]

আমাদের কর্তব্য: আল্লাহর এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করা, এ মাসের ফযীলত ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হওয়া ও ইবাদত-বন্দেগীসহ সকল কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত থাকা।

এ মাসের যে সকল ফযীলত রয়েছে তা হল:

এক. এ মাসের সাথে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকনের সম্পর্ক রয়েছে; আর তা হলো সিয়াম পালন।
হজ যেমন জিলহজ মাসের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে সে মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এমনি সিয়াম রমজান মাসে হওয়ার কারণে এ মাসের মর্যাদা বেড়ে গেছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উর্পতযাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।"[৩]

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ইসলাম যে পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তার একটি হল সিয়াম পালন। এ সিয়াম জান্নাত লাভের একটি মাধ্যম ; যেমন হাদীসে এসেছে :
من آمن بالله ورسولـه، وأقام الصلاة، وآتى الزكاة، وصام رمضان، كان حقاً على الله أن يدخله الجنة ... رواه البخاري: ৭৪২৩
যে আল্লাহর তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রমজান মাসে, আল্লাহ তাআলার কর্তব্য হয়ে যায় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো...।[৪]

দুই. রমজান হল কুরআন নাযিলের মাস :
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
রমজান মাস, এতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারী এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।[৫]

রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশের বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাযিল হয়েছে। সেখান থেকে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর প্রতি নাযিল হতে শুরু করে। কুরআন নাযিলের দুটি পর্বই রমজান মাসকে ধন্য করেছে। শুধু আল-কুরআনই নয় বরং ইবরাহীম আ.-এর সহীফা, তাওরাত, যবুর, ইঞ্জীল সহ সকল ঐশী গ্রন্থ এ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে বলে তাবরানী বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ মাসে মানুষের হিদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দু বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।

তিন. রমজান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় ও জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় শয়তানদের।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة، وأغلقت أبواب النار، وصفدت الشياطين. وفي لفظ (وسلسلت الشياطين). رواه مسلم: ২৫৪৭
যখন রমজান মাসের আগমন ঘটে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের আবদ্ধ করা হয়। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছ্তে'শয়তানদের শিকল পরানো হয়।'[৬]

তাই শয়তান রমজানের পূর্বে যে সকল স্থানে অবাধে বিচরণ করত রমজান মাস আসার ফলে সে সকল স্থানে যেতে পারে না। শয়তানের তৎপরতা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে দেখা যায় ব্যাপকভাবে মানুষ তওবা, ধর্মপরায়ণতা, ও সৎকর্মের দিকে অগ্রসর হয় ও পাপাচার থেকে দূরে থাকে। তারপরও কিছু মানুষ অসৎ ও অন্যায় কাজ-কর্মে তৎপর থাকে। কারণ, শয়তানের কু-প্রভাবে তারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে।

চার. রমজান মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর।
আল্লাহতাআলা বলেন :
লাইলাতুল কদর সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।[৭]

পাঁচ. রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
لكل مسلم دعوة مستجابة, يدعوبهافي رمضان. دروس رمضانية
(রমজান মাসে) প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়।[৮]

অন্য হাদীসে এসেছে,
إن لله تبارك وتعالى عتقاء في كل يوم وليلة، (يعني في رمضان) وإن لكل مسلم في كل يوم وليلة دعوة مستجابة. مجموع مؤلفات الألباني: ১০০২
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজানের প্রতি রাতে ও দিনে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং প্রতি রাত ও দিবসে মুসলিমের দোয়া-প্রার্থনা কবুল করা হয়।[৯]

তাই প্রত্যেক মুসলমান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের কল্যাণের জন্য যেমন দোয়া-প্রার্থনা করবে, তেমনি সকল মুসলিমের কল্যাণ, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করবে।

ছয়. রমজান পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস।
যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপসমূহ ক্ষমা করানো থেকে বঞ্চিত হলো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :
.. رغم أنف رجل، دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له. جامع الأصول في أحاديث الرسول : ১৪১০
ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি।[১০]

সত্যিই সে প্রকৃত পক্ষে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত যে এ মাসেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল।

সাত. রমজান জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إذا كان أول ليلة من رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار، فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب، وينادي مناد كل ليلة : يا باغي الخير أقبل! ويا باغي الشر أقصر! ولله عتقاء من النار، وذلك في كل ليلة. السنن الصغرى: ১৪২৯
রমজান মাসের প্রথম রজনীর যখন আগমন ঘটে তখন শয়তান ও অসৎ জিনগুলোকে বন্দি করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে একটি দরজাও খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে তা আর বন্ধ করা হয় না। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও! এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।[১১]

আট. রমজান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
যেমন হাদীসে এসেছে যে, রমজান মাসে ওমরাহ করলে একটি হজের সওয়াব পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, বরং, রমজান মাসে ওমরাহ করা আল্লাহর রাসূলের সাথে হজ আদায়ের মর্যাদা রাখে। এমনিভাবে সকল ইবাদত-বন্দেগীসহ সকল সৎকাজের প্রতিদান কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।

নয়. রমজান ধৈর্য ও সবরের মাস।
এ মাসে ঈমানদার ব্যক্তিগণ খাওয়া-দাওয়া, বিবাহ-শাদি ও অন্যান্য সকল আচার-আচরণে ধৈর্য ও সবরের এত অধিক অনুশীলন করেন তা অন্য কোন মাসে বা অন্য কোন পর্বে করেন না। এমনিভাবে সিয়াম পালন করে যে ধৈর্যের প্রমাণ দেয়া হয় তা অন্য কোন ইবাদতে পাওয়া যায় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন :
ধৈর্যশীলদের তো বিনা হিসাবে পুরস্কার দেয়া হবে।[১২]

সিয়ামের ফযীলত

রমজান মাসের ফযীলত আলোচনা করার পর এবার সিয়াম বা রোজা রাখার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করতে যাচ্ছি।

সিয়াম পালনের ফযীলত :

এক. সিয়াম শুধু আল্লাহর জন্য। 
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদত-বন্দেগী থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন।

যেমন তিনি এক হাদীসে কুদসীতে বলেন :
قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ هُوَ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِه. مسلم ২৭৬০
মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম তার ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব।[১৩]

এ হাদীস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি।

তাই সাহাবী আবু হুরাইরা রা. যখন বলেছিলেন,
يا رسول الله مرني بعمل قال عليك بالصوم فإنه لا عدل له. السنن الكبرى للنسائي :২৫৩৪
'হে রাসূলুল্লাহ ! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : 'তুমি সিয়াম পালন কর। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোন আমল নেই।'[১৪]

সিয়ামের এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তাআলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত হজ, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মাঝে ইখলাস, আন্তরিকতা বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজাল ও বেশি থাকে।

যেমন আল্লাহ বলেন :
يدع شهوته وطعامه من أجلي. مسلم:২৭৬৩
'সিয়াম পালনকারী আমার জন্যই পানাহার ও যৌনতা পরিহার করে।' 
তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছুর আশা করে না।

দুই. সিয়াম আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন। 
কিন্তু অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী ও সৎ কর্মের প্রতিদান বিনা হিসাবে দেয়া হয় না। বরং প্রত্যেকটি নেক আমলের পরিবর্তে আমলকারীকে দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত প্রতিদান দেয়া হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
كل عمل ابن آدم يضاعف الحسنة بعشر أمثالـها إلى سبع مئة ضعف. قال الله عز وجل: إلا الصوم فإنه لي وأنا أجزى به . . . مسلم:১১৫১
'মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন্তকিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধু আমার জন্য আমিই তার প্রতিদান দেব।'[১৫]

সারা জাহানের সর্বশক্তিমান প্রতিপালক আল্লাহ নিজেই যখন এর পুরস্কার দেবেন তখন কি পরিমাণে দেবেন? ইমাম আওযায়ী রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ যে সিয়াম আদায়কারীকে প্রতিদান দেবেন তা মাপা হবে না, ওজন করা হবে না।

তিন. সিয়াম ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা।
সিয়াম পালনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কু-প্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :
يا معشر الشباب! من استطاع منكم الباءة فليتزوج، فإنه أغض للبصر، وأحصن للفرج، ومن لم يستطع فعليه بالصوم، فإنه له وجاء.مسلم:১৪০০
হে যুবকেরা ! তোমাদের মাঝে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি-কে অবনত করে ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ।[১৬]

এমনিভাবে সিয়াম সকল অশ্লীলতা ও অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
. . والصيام جنة، فإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرأ صائم. رواه مسلم:১১৫১
'সিয়াম হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে সিয়াম পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায় তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী।'[১৭]

সিয়াম পালনকারী যেমনি নিজের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তেমনি সকল অশ্লীল আচরণ, ঝগড়া-বিবাদ, অনর্থক কথা ও কাজ থেকে নিজের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হেফাজত করে।

চার. সিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল।
যেমন হাদীসে এসেছে,
الصيام جنة، وحصن حصين من النار. أحمد:৯২১৪
'সিয়াম হল ঢাল ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার মজবুত দুর্গ।'[১৮]

বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে,
من صام يوما في سبيل الله باعد الله وجهه عن النار سبعين خريفا. مسلم:২৭৬৯
'যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একদিন সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার থেকে জাহান্নাম-কে এক খরিফ (সত্তুর বছরের) দুরত্বে সরিয়ে দেবেন।'[১৯]

উলামায়ে কেরাম বলেছেন, 'আল্লাহর পথে সিয়াম পালনের অর্থ হল: শুধু আল্ল সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম পালন করা।' এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা বহু াহর সিয়াম পালনকারীকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। যেমন হাদীসে এসেছে,
إن لله تعالى عند كل فطر عتقاء من النار، وذلك كل ليلة. البيهقي:৩৬০৫
'ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এটা রমজানের প্রতি রাতে।'[২০]

পাঁচ. সিয়াম হল জান্নাত লাভের পথ
হাদীসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضي الله عنه أنه قال: يا رسول الله مرني بأمر ينفعني الله به، قال: عليك بالصوم فإنه لا مثل له. النسائي:২২২০
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এমন একটি কাজের নির্দেশ দিন যার দ্বারা আমি লাভবান হতে পারি। তিনি বললেন : 'তুমি সিয়াম পালন কর। কেননা, এর সমকক্ষ আর কোন কাজ নেই।'[২১]

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য সিয়ামের সাথে কোন আমলের তুলনা হয় না। সিয়াম পালনকারীদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল তিনি সিয়াম পালনকারীদের জন্য জান্নাতে একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যে দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারীরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إن في الجنة بابا يقال له الريان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة لا يدخل منه أحد غيرهم، يقال: أين الصائمون ؟ فيقومون، لا يدخل منه أحد غيرهم، فإذا دخلوا أغلق، فلم يدخل منه أحد.البخاري:১৭৯৭,مسلم:১১৫২
'জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে। যার নাম রাইয়ান। কেয়ামতের দিন সিয়াম পালনকারীরাই শুধু সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিন ঘোষণা করা হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়িয়ে যাবে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য। যখন তারা প্রবেশ করবে, দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।'[২২]

ছয়. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
والذي نفس محمد بيده لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك. البخاري:১৭৯০,مسلم:১১৫১
'যার হাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জীবন, সে সত্তার শপথ, সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মেশকের ঘ্রাণ হতেও প্রিয়।'[২৩]

মুখের গন্ধ বলতে পেট খালি থাকার কারণে যে গন্ধ আসে সেটাকে বুঝায়। দাঁত অপরিষ্কার থাকার কারণে যে গন্ধ সেটা নয়।

সাত. সিয়াম ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম -
যেমন হাদীসে এসেছে,
للصائم فرحتان : فرحة عند فطره، وفرحة عند لقاء ربه .مسلم :১৫১, البخاري:১৭৯০
'সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ : একটি হল ইফতারের সময় অন্যটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়।'[২৪]

ইফতারের সময় আনন্দ হল এ কারণে যে, সিয়াম পূর্ণ করতে পারল ও খাবার-দাবারের অনুমতি পাওয়া গেল। এটা বাস্তব সম্মত আনন্দের বিষয়, যা আমাদের সকলের বুঝে আসে ও অনুভব করি। অপর দিকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের যে আনন্দ, তা অনুভব করতে আমরা এখন না পারলেও কেয়ামতের দিন পারা যাবে। যখন সকল মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহমুখী থাকবে।

আট. সিয়াম কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে
হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: (الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام أي رب: منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه. ويقول القرآن : منعته النوم بالليل، فشفعني فيه. قال: فيشفعان. أحمد:৬৬২৬
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে হে প্রতিপালক ! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।'[২৫]

নয়. সিয়াম হল গুনাহ মাফের কারণ ও গুনাহের কাফফারা
সিয়াম হল অনেকগুলো নেক আমলের সমষ্টি। আর নেক আমল পাপকে মুছে দেয়। আল্লাহর রাব্বুল আলামীন বলেন :
'সৎকর্ম অবশ্যই পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়।'[২৬]

বহু হাদীস রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, নেক আমলকে বিভিন্ন ছোট খাট পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ নেক আমলের কারণে গুনাহগুলো আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।

যেমন হাদীসে এসেছে,
فتنة الرجل في أهله وماله وجاره تكفرها الصلاة والصيام والصدقة. البخاري: ১৮৯৫ ومسلم: ৭৪৫০
'মানুষ যখন পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও ধন-সম্পদের কারণে গুনাহ করে ফেলে, তখন সালাত, সিয়াম, সদকা সে গুনাহগুলোকে মিটিয়ে দেয়।'[২৭]

আর রমজান তো গুনাহ মাফ ও মিটিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আরো বেশি সুযোগ দিয়েছে।

হাদীসে এসেছে,
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. البخاري : ২০১৪,مسلم : ১৮১৭
'যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[২৮]

ইহতিসাবের অর্থ হল: আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে সন্তুষ্ট চিত্তে সিয়াম ও কিয়াম আদায় করা।

হাদীসে আরো এসেছে,
الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة ورمضان إلى رمضان مكفرات لما بينهن إذا اجتنبت الكبائر. مسلم:৫৭৪
'পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমআ থেকে অপর জুমআ এবং এক রমজান থেকে অপর রমজান হল মধ্যবর্তী সময়ের পাপের কাফফারা, যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেচে থাকা যায়।'[২৯]

সিয়াম ছোট পাপগুলোকে মিটিয়ে দেয় আর তাওবা করলে কবীরা গুনাহ মাফ করা হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
'তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মাঝে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব। এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।'[৩০]

এ আয়াত ও হাদীস দুটো দ্বারা প্রমাণিত হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে।
প্রথম: রমজানের সিয়াম পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এবং সিয়াম যে একটি ফরজ ইবাদত এর প্রতি বিশ্বাস। সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয়: সিয়াম পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ: আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই সিয়াম পালন করা, আর সিয়ামকে বোঝা মনে না করা।
তৃতীয় : কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর তার রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষচর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন কর্তাইত্যাদি।

কোন ধরনের সিয়াম এ সকল ফযীলত অর্জন করতে পারে :

যে সকল ফযীলত ও সওয়াবের কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা শুধু ঐ ব্যক্তি লাভ করবে যে নিম্নোক্ত শর্তাবলি পালন করে সিয়াম আদায় করবে।
(১) সিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য আদায় করতে হবে। মানুষকে দেখানো বা শোনানো অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে সিয়াম আদায় করবে না।
(২) সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের সুন্নত অনুসরণ করতে হবে। সাহরী, ইফতার, তারাবীহসহ সকল বিষয় রাসূলের সুন্নত অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
(৩) শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদ সহ সকল প্রকার অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, পা বিরত থাকব অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে।

সিয়াম পালনের মহান উদ্দেশ্য এটাই যে, সিয়াম পালনকারী শরীয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গহীর্হত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। অতএব সিয়াম হল, সকল ভাল বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গহীর্হত কাজ ও কথা বর্জন অনুশীলনের একটি শিক্ষালয়।

তাইতো দেখা যায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه. البخاري:৬০৫৭
'যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।'[৩১]

তিনি আরো বলেছেন:
رب صائم حظه من صيامه الجوع والعطش، ورب قائم حظه من قيامه السهر. أحمد:৯০৯১
'অনেক সিয়াম পালনকারী আছে, যার সিয়াম থেকে প্রাপ্তি শুধু অভুক্ত ও পিপাসার্ত থাকা। আবার অনেক সালাত আদায়কারী আছে, যার সালাত থেকে প্রাপ্তি শুধু রাত জাগা।'[৩২] 
(এ ছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান লাভ করে না)

রমজান মাসে যে সকল নেক আমল করা যায়

আমরা যখন এ মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করলাম তখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো। এ মাসে হিদায়াতের আলোকবর্তিকা আল-কুরআন নাযিল হয়েছে। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। একজন ঘোষণাকারী ভাল কাজের আহ্বান জানাতে থাকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। সাথে সাথে এটা হল মাগফিরাতের মাস, জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। আমাদের অনেকের ধারণা রমজান মাস সিয়াম পালন ও তারাবীহ আদায়ের মাস। ব্যাস! আর কীসের আমল? দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকছি এটা কম কি? না, ব্যাপারটা শুধু এ টুকুতে সীমিত নয়। রমজান একটি বিশাল বিদ্যাপীঠ।

এ রমজানে আমরা কি কি নেক আমল করতে পারি তা নিম্নে আলোচনা করা হল:

(১) কিয়ামুল লাইল
কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ সালাতে তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. مسلم:১৭৩
'যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[৩৩]

সালাতে তারাবীহ যেমন কিয়ামুল লাইলের মাঝে পড়ে, তেমনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদও সালাতুল লাইল এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে সালাত আদায় করলে রমজানের পূর্ণ রাত সালাত আদায়ের সওয়াব অর্জিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة. سنن النسائي:১৬১৬
'ইমাম সাহেব সালাত শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে যে সালাত আদায় করবে, সে পূর্ণ এক রাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে।'[৩৪]

যে সামর্থ্য রাখে সে ইমামের সাথে সালাত শেষ করে একা একা যত ইচ্ছা তত সালাত আদায় করবে। অনেকে রমজানের শেষ দিকে অলসতায় আক্রান্ত হয়, কিংবা মাত্র আট রাকাআত তারাবীহ আদায় করে মসজিদ হতে চলে যান ; এটা কোন ভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। এর ফলে তারা পূর্ণ রমজানের কিয়ামুল লাইলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।

(২) আল-কুরআন খতম ও তিলাওয়াত : 
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة .أحمد:৬৬২৬
'সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।'[৩৫]

হাদীসে এসেছে, রমজানে জিবরীল রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে কুরআন পাঠ করে শোনাতেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে জিবরীলের কাছে তুলে ধরতেন। আল-কুরআন তিলাওয়াত হল সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির। সিয়াম পালনকারী এ যিকির থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন না। আল-কুরআন তিলাওয়াতের একটি সঠিক দিক-নির্দেশনামুলক প্রবন্ধ এ বইয়ের শেষ দিকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পাঠক এ থেকে উপকৃত হতে পারবেন। যদি কেউ কুরআন তিলাওয়াত করতে অপারগ হন, তাহলে বিভিন্ন তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ আদায়ের মাধ্যমে মুখে আল্লাহর যিকির অব্যাহত রাখবেন।

(৩) সদকা বা দান : 
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. مسلم:২৩০৮
'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেত।'[৩৬]

ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল, রমজান মাসে তারা বেশি করে দান-সদকা করবে। কারণ এ মাসে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকে। অপরদিকে রমজান হল জিহাদের মাস। তাই প্রত্যেকের উচিত অর্থ-সম্পদ দান করার মাধ্যমে জিহাদে অংশ নেয়া।

(৪) এতেকাফ :
ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان . مسلم:১১৭১
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন।'[৩৭]

এতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, 'আশ্চর্যজনক হল মুসলমানরা এতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।'

(৫) ওমরাহ আদায় :
যেমনটি হাদীসে এসেছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
عمرة في رمضان كحجة معي. المجمع الكبير:৭২২,جامع الأحاديث:১৪৩৭৯
'রমজান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সাথে হজ আদায়ের সমতুল্য।'[৩৮]

(৬) রোজাদারদের ইফতার করানো :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من فطر صائما كان له مثل أجره ، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئا. أحمد:২২৩০২
'যে ব্যক্তি কোন সিয়াম পালনকারীকে (রোজাদারকে) ইফতার করাবে সে সিয়াম পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে সিয়াম পালনকারীর সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না।'[৩৯]

(৭) দোয়া-প্রার্থনা করা : 
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন,
'আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে, আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই।'[৪০]

তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া-প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
ثلاث دعوات مستجابة : دعوة الصائم، دعوة المظلوم، دعوة المسافر.البيهقي في شعب الإيمان وصححه الألباني في الجامع:৭২০৫
'তিনজনের দোয়া কবুল করা হয় ; সিয়াম পালনকারীর দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া।'[৪১]

(৮) তওবা করা :
সর্বদা তওবা করা ওয়াজিব। বিশেষ করে এ মাসে তো বটেই। এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া রমজান মাসের সকল ইবাদত বন্দেগী তওবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
رغم أنف رجل دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له. جامع الأصول في أحاديث الرسول:১৪১০
'যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি, তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক।'[৪২]

তাই রমজান মাসটাকে তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।

(৯) অধিক হারে নেক আমল করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখা: 
বিশেষ করে রমজানের শেষ দশক্তে
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيى الليل، وأيقظ أهله، وجد وشد المئزر. مسلم:১১৭৪
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : 'যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবার বর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন।'[৪৩]

তিনি আরো বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجتهد في العشر الأواخر ما لا يجتهده في غيره. مسلم:১১৭৫
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগীতে যে পরিশ্রম করতেন অন্য সময় এ রকম করতেন না।'[৪৪]

(১০) ইসলামী শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান :
ইসলামী শিক্ষা হল সকল প্রকার শিক্ষার মূল। তা ছাড়া দুটি বিষয় লক্ষ্য করা খুব জরুরি -
এক. ইসলামের সকল ইবাদত-বন্দেগী সঠিকভাবে আদায় করতে হলে ইসলামী শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সালাতের নিয়মকানুন, সিয়ামের বিধান, জাকাতের নিয়ম-নীতি, হজের আহকাম না শিখে এগুলো আদায় করা যায় না।
দুই. আল-কুরআনের তাফসীর শেখা ও অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আমরা যে সকল সূরা-কেরাত সালাতের মাঝে পড়ে থাকি, সেগুলোর মর্ম অনুধাবন করে তিলাওয়াত করা দরকার। কাজেই রমজান মাসকে আমরা ইসলামী শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা প্রসারের একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। মূর্খতার অবসান ঘটানো সিয়ামের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه . البخاري:৫৭১০
'যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।'[৪৫]

হাদিসটি দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যদি মূর্খতা পরিহার না করা হয় তবে সিয়াম আল্লাহর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর মূর্খতা ত্যাগ করা যাবে শুধু শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।

সিয়ামের হিকমত ও তার লক্ষ্য এবং উপকারিতা

ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশের কাছে নিজেকে সন্তুষ্ট চিত্তে সঁপে দেয়া। তার প্রতি ঈমান রাখা, তার কাছে প্রতিদানের আশা করা এবং বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনের মাঝে রয়েছে কল্যাণ ও সফলতা। এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা হলেন হাকিম বা মহাজ্ঞানী। তার বিধানই পূর্ণাঙ্গ ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর। তার প্রতিটি বিধানে রয়েছে হিকমত বা কল্যাণকর মহা উদ্দেশ্য। অনেক সময় মানুষ তার বিধানের কল্যাণকর দিক ও হিকমত যথার্থ ভাবে অনুধাবন করতে পারে না। এটা মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আল্লাহতাআলা বলেন :
'তোমাদের খুব অল্পই জ্ঞান দেয়া হয়েছে।'[৪৬]

মানুষের কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহ তাআলার আদেশ-নির্দেশ পালন করা। এ আদেশ-নির্দেশসমূহের হিকমত তথা বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও উপকারিতা অনুধাবন করতে পারা যাক বা না যাক। যদি এমন হয় যে, আল্লাহর যে সকল বিধানের উপকারিতা আমাদের কাছে স্পষ্ট সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করব আর অন্যগুলো গুরুত্ব দেব না তাহলে তো আল্লাহর দাসত্ব করা হলো না। বরং নিজের মনের দাসত্ব করা হলো। এরূপ কেউ করলে এর মাধ্যমে তার ঈমান ও বিশ্বাসের দুর্বলতার পরিচয় দিল। আবার এর অর্থ এটা-ও নয় যে আমরা আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধানের বৈজ্ঞানিক লাভ-ক্ষতি, উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারব না। অবশ্যই পারব, কারণ এটা আমাদের ঈমানকে আরো শক্তিশালী করবে, তাঁর প্রতি বিশ্বাসকে মজবুত করবে। তাই আমরা এখন সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তার কল্যাণ ও উপকারিতার দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

(১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি:
এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সিয়ামের লক্ষ্য হল মানুষ তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করবে। তিনি বলেন :
'হে বিশ্বাসীগণ ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।'[৪৭]

তাকওয়া কী? যা অর্জন করা যাবে সিয়াম পালন করলে।

তাকওয়া হল : আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করা, আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এটা করা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভ ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে যখন বৈধ পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করতে পারে তখন সে অবশ্যই অবৈধ আচার-আচরণ, কথা ও কাজ এবং ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।

(২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা :
শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় প্রবেশ ও চলাচল করতে পারে। আর কু-প্রবৃত্তি যদি যখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে তখন সে উদ্ধত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে। এবং সে তার আরো চাহিদা মিটানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধা ও পিপাসা দিয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সাহায্যে শয়তান ও কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এ কারণে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়াম নামক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেননা নফ্‌সে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সকল প্রকারের পাপাচারে লিপ্ত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يا معشر الشباب! من استطاع منكم الباءة فليتزوج، فإنه أغض للبصر، وأحصن للفرج، ومن لم يستطع فعليه بالصوم، فإنه له وجاء .مسلم:১৪০০
'হে যুবকেরা ! তোমাদের মাঝে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখে ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ।'[৪৮]

সিয়ামের বিধানের এটা একটা হিকমত। এভাবেই সিয়াম মানুষকে তাকওয়ার পথে নিয়ে যায়। মোটকথা সিয়াম যাবতীয় জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও তা বৈধ পথে পরিচালিত করার প্রশিক্ষণ দেয়।

(৩) সিয়াম আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও তার দাসত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ :
মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির গোলামি ও শয়তানের আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করবে তখনই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বান্দা বা দাস হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত তার সামনে আর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তাই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ-নিষেধকে নিজের প্রবৃত্তির দাবির উপর অগ্রাধিকার দেয়। এতে যত কষ্ট হোক, যত ধৈর্যের প্রয়োজন হোক, যত ত্যাগের দরকার হোক সব কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই সিয়াম পালনকারীকে দেখবেন সে দিনের বেলা খাচ্ছে না, খাচ্ছে রাতে। রাতে নিদ্রা যাচ্ছে না, রাত জেগে সে সালাত আদায় করছে। মিথ্যা কথা ও কাজ এবং সব ধরনের অসদাচরণ সে পরিহার করে চলছে। অথচ তার মন ও প্রবৃত্তি নির্দেশ দিচ্ছে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া করতে, রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে, মিথ্যা কথা বলতে ইত্যাদি। এমনিভাবে সিয়াম ও এ সম্পর্কিত কাজগুলো আদায় করার মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী প্রবৃত্তিসহ সকল মানুষের দাসত্ব অস্বীকার করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।

(৪) ঈমানকে দৃঢ় করা, মোরাকাবা ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্ধারণ করা সময়ে তারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য সকল প্রকার পানাহার পরিহার করা, আল্লাহকে ভয় করা ও তার মোরাকাবার একটি বলিষ্ঠ প্রমাণ বহন করে। এটাই প্রকৃত ঈমান। সিয়াম পালনকারী যদি লোক চক্ষুর আড়ালে পানাহার করে আর মানুষের কাছে প্রকাশ করল যে, সে সিয়াম অবস্থায় আছে, তাহলে সে সিয়াম পালনকারী বলে গণ্য হবে না। এমনিভাবে সে দিনের বেলা পানাহার ও যৌনাচার ত্যাগ করল বটে কিন্তু সিয়ামের নিয়ত ধারণ করেনি, তাহলে সে সিয়াম আদায় করেছে বলে ধরা হবে না। সিয়াম পালনকারীর এ অনুভূতি আল্লাহকে ভয় করা ও তার মোরাকাবার প্রমাণ দিতে শিখায়। (মোরাকাবা হল : আল্লাহ আমাকে ও আমি যা করছি তা সর্বদা প্রত্যক্ষ করছেন। এ ধরনের দৃঢ় অনুভূতি ধারণ করা) তাই সিয়াম মুসলিমকে ঈমানের সত্যতার প্রমাণ দিতে প্রশিক্ষণ দেয়। তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মুমিন হিসেবে তার কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহর মোরাকাবা করা অর্থাৎ এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আমার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পর্যবেক্ষণ করছেন। তাই আমাকে কোন কাজে তার অবাধ্য হওয়া চলবে না। তিনি যাতে সন্তুষ্ট হন, শুধু তা-ই আমাকে করতে হবে। যদি এ রকম মোরাকাবার সাথে সিয়াম আদায় করা যায়, তাহলে তার জন্য রয়েছে তা-ই যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
كل عمل ابن آدم يضاعف الحسنة بعشر أمثالـها إلى سبع مائة ضعف، قال الله عز وجل: إلا الصوم فإنه لي وأنا أجزي به، يدع شهوته وطعامه من أجلي ... مسلم:১১৫১
'মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। আমার জন্যই সে পানাহার ত্যাগ করে থাকে।[৪৯]

আর এ বিষয়টা সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীতে থাকতে হয়। যখন মানুষ বিশ্বাস করবে আল্লাহ আমাকে সর্বদা দেখছেন তখন সে বিনা ওজুতে সালাত আদায় করবে না। ঠিক তেমনি কোন কাজে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করবে না। সকল প্রকার কাজ-কর্ম যথাযথ ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে।

(৫) ধৈর্য, সবর ও দৃঢ় সংকল্পের প্রশিক্ষণ :
সিয়ামের মাস মূলত ধৈর্য ও সবরের মাস। সিয়াম মনের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়ার মাধ্যমে সংকল্পের দৃঢ়তার প্রশিক্ষণ দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন না করে তা মেনে চলার অভ্যাস গড়তে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। কখনো তাঁর সীমা লঙ্ঘনের কথা চিন্তা করে না। আল্লাহ তাআলা সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন :
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا (البقرة : ১৮৭)
'ওগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং ওগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না।'[৫০]

সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ নিজের মন ও বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ধরুন কোন ব্যক্তি একটি খারাপ অভ্যাসে লিপ্ত। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে এর থেকে বিরত থাকতে পারছে না। রমজান মাসের সিয়াম তার বদ অভ্যাস উৎপাটন করতে একটা বিরল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এরপর সে যেন আর বলতে না পারে যে আমি পারি না।

(৬) আখেরাতমুখী করার প্রশিক্ষণ :
সিয়াম পালনকারী পার্থিব সকল ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে দুনিয়ার প্রতি বিমুখ হয়ে আখেরাতমুখী হওয়ার দীক্ষা নিয়ে থাকে। তার এ ত্যাগ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখেরাতে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কিছুর জন্যে নয়। এ আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক কমিয়ে আখেরাতের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়ায় সবক নিয়ে থাকে। আর এ লক্ষ্য অর্জনে সে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত-বন্দেগী ও সৎকর্ম সম্পাদন ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে চেষ্টা করে।

(৭) আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া ও সৃষ্টি জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া : 
অনুগ্রহের কথা ভুলে যাওয়া মানুষের একটি স্বভাব। অনুগ্রহ মূল্যায়ন করতে শেখে তখন, যখন সে তা হারিয়ে ফেলে। সিয়াম আদায়ের মাধ্যমে বঞ্চিত ও অভাবী মানুষদের দূরাবস্থা অনুধাবন করতে শেখে। তখন সে যেমন তার প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর শোকর আদায়ে যত্নবান হয়, তেমনি বঞ্চিত, অভাবী, অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয় ও তাদের সেবা করতে উৎসাহ পায়।

(৮) সিয়াম সমাজ সংস্কারের একটি বিদ্যাপীঠ :
সিয়ামের যে সকল হিকমত ব্যক্তিকে পরিশুদ্ধ করে, সে সকল হিকমত সমাজকেও পরিশুদ্ধি করণ ও সংস্কারে ভূমিকা রাখে। কেননা ব্যক্তির পরিশুদ্ধতা হল সমাজ শুদ্ধির পথ। ব্যক্তি সংশোধন হয়ে গেলে সমাজ সংশোধন হয়ে যায়। তাইতো আমরা দেখি, সিয়ামকে সামাজিক ভাবে আদায় করতে হয়। অর্থাৎ একই সাথে একই সময়ে। কিন্তু নফল সিয়াম সকলকে এক সময়ে এক সাথে আদায় করতে হবে বলে কোন বাধ্য-বাধকতা নেই। রমজান আমাদেরকে সমাজ সংস্কারের পথে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজ যতই কলুষিত হয়ে যাক না কেন। রমজান ইসলামী শরিয়া বাস্তবায়নের আন্দোলনের এক অনুকূল সময়। এ সময় যেমন শয়তানের সৃষ্ট প্রতিকূলতা দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে মানুষের মাঝে ইসলামের প্রতি আগ্রহ অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি দেখা যায়। তাই সমাজ সংস্কারের উদ্যোগের এটাই উপযুক্ত সময়। মানুষকে বুঝানোর এটা উত্তম সময় যে, ইসলামী শরিয়ার বাস্তবায়ন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।

(৯) শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা অর্জন :
এক নম্বর থেকে আট পর্যন্ত সিয়ামের যে সকল কল্যাণকর দিক আলোচিত হল তা ছাড়াও সিয়ামের একটি কল্যাণকর দিক হল স্বাস্থ্যের উন্নতি। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে খাবার গ্রহণ, পরিমিত আহার, ঠিক একই সময় পানাহার আবার ঠিক একই সময় বিরতি দেয়া ইত্যাদি পাকস্থলীকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশ্রাম দেয়, ফলে পাকস্থলী শক্তিশালী হয়। এমনিভাবে ইসলাম প্রবর্তিত প্রত্যেকটি ইবাদত-বন্দেগীতে রয়েছে হিকমত ও মানুষের জন্য অসংখ্য পার্থিব কল্যাণ।

সিয়ামের আদব

আদব হল মানুষের জীবনের সৌন্দর্য। ইবাদত-বন্দেগীর আদবসমূহ ইবাদতকে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ করে দেয়। তাই প্রত্যেকটি ইবাদতের রয়েছে কিছু আদব-কায়দা বা শিষ্টাচার। কিছু আদব হল অবশ্য পালনীয় যা বাস্তবায়ন না করলে ইবাদতটি গ্রহণযোগ্য হবে না, আর কিছু হল মুস্তাহাব অর্থাৎ যা পালন করলে ইবাদতটি পরিপূর্ণতার সহায়ক হয় এবং ইবাদতের মাঝে কোন ত্রুটি হয়ে গেলে তা কাটিয়ে উঠা যায় ও পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যায়। তাই আমরা এখানে সিয়ামের কতিপয় আদব নিয়ে আলোচনা করব। আমরা যদি এ আদবসমূহ মান্য করে সিয়াম আদায় করতে পারি, তাহলে আল্লাহর ফজলে আমরা সিয়ামের পূর্ণ সওয়াব লাভ করতে সক্ষম হব।

(১) ইসলামকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করা :
সিয়াম পালনকারী তো বটেই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হল আল্লাহ যা কিছু আদেশ করেছেন তা পালন করা। আর যা কিছু নিষেধ করেছেন তার প্রত্যেকটি বর্জন করা। এর নামই হল ইসলাম বা স্রষ্টার কাছে মানুষের পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একজন মুসলিম যেমন কখনো নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে পারে না, তেমনি অন্য মানুষের খেয়াল-খুশি বা তাদের রচিত বিধানের অনুগত হতে পারে না। যদি হয়, তবে তা স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করা হল না। যদি এভাবে আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবনকে পরিচালিত করা যায়, তাকেই বলা হবে পরিপূর্ণ ইসলাম। আর পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করতে আল্লাহর রাব্বুল আলামীন আদেশ করেছেন মানুষকে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।'[৫১]

ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করার নামই হল তাকওয়া। যে তাকওয়া অবলম্বন করতে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বার বার নির্দেশ দিয়েছেন। এ তাকওয়ার দাবি হল, আল্লাহর আনুগত্য করতে হবে, অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাকে স্মরণ করতে হবে ভুলে যাওয়া চলবে না। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে অকৃতজ্ঞ (কাফির) হওয়া যাবে না। ঈমানদারের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, শিরক ও রিয়া মুক্ত থেকে খালেস আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদতসমূহ সম্পাদন করা। এর মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। সালাত বাদ দিয়ে সিয়ামের কি মূল্য আছে? দৈনিক পাঁচবার সালাত আদায় করতে হবে জামাতের সাথে। জামাতের সাথে সালাত আদায়ের মাধ্যমে মুনাফেকি থেকে মুক্তির সনদ নিতে হবে। এরপর যথা সময় যাকাত আদায় করতে হবে। সত্যিকার হকদারকে যাকাত প্রদান করতে হবে। এমনিভাবে যে সামর্থ্য রাখে তাকে হজ ও ওমরাহ আদায় করতে হবে। সাথে সাথে উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে সকলের সাথে আচরণ করতে হবে। মাতা-পিতার সাথে ভাল আচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক সু-দৃঢ় রাখা, প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ, সাধ্য-মত সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনিভাবে জাদু-টোনা, সুদি কারবার, মিথ্যা কথা, ধোঁকাবাজি, ঘুসসহ সকল প্রকার দুর্নীতি, মাদক সেবন, ব্যভিচার, সৃষ্টি জীবকে কষ্ট দেয়া ও গান-বাদ্য পরিহার করতে হবে। মানুষের অধিকারগুলো যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।

(২) সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত থাকা :
রমজানে সকল প্রকার অন্যায় থেকে বিরত না থাকলে সিয়াম কবুলের বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। অনেককে দেখা যায় সিয়াম পালন করে অযথা কথা-বার্তা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সে খবর রাখে না যে, এ সকল অন্যায় কাজ-কর্ম সিয়ামের প্রতিদান লাভে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ব্যাপারেই হয়তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
كم من صائم ليس له من صيامه إلا الظمأ، وكم من قائم ليس له من قيامه إلا السهر. الدارمي:২৭২০
'অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা উপোস থাকা ছাড়া আর কিছু পায় না। আর অনেক রাতজাগা সালাত আদায়কারী আছে যারা রাত্রি-জাগরণ ব্যতীত আর কিছু লাভ করে না।'[৫২]

অতএব যার উদর সিয়াম পালন করছে তার উচিত তার মুখ, কর্ণ, চক্ষু, হাত ও পা সবকিছুই সিয়াম পালন করবে। সকল অন্যায়-অবৈধ কাজ হতে এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পবিত্র থাকবে। যেমন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
. والصيام جنة، فإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ ولا يصخب، فإن سابه أحد أو قاتله فليقل إني امرأ صائم . مسلم:১১৫১
'সিয়াম হল ঢাল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সাথে কেউ ঝগড়া বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী।'[৫৩]

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন :
ليس الصيام من الأكل والشرب، إنما الصيام من اللغو والرفث، فإن سابك أحد أو جهل عليك، فليقل: إني صائم. الحاكم:১৫২০
'শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম নয়। মূলত সিয়াম হল : অনর্থক-অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। যদি তোমার সাথে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, অথবা মূর্খতা সুলভ আচরণ করে তবে তাকে বলে দেবে আমি সিয়াম পালনকারী।'[৫৪]

যদি সিয়াম পালনকারী নিষিদ্ধ কথা ও কাজ-কর্ম পরিত্যাগ না করেন, তবে তার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে দুঃসংবাদ :
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه. البخاري:৬০৫৭
'যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।'[৫৫]

(৩) ইখলাস অবলম্বন করা:
কোন কাজে ইখলাস অবলম্বন করার অর্থ হল কাজটা করার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। শুধু সিয়াম নয়, এ ইখলাস ব্যতীত কোন আমল কবুল হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন।"[৫৬]

আর সিয়াম পালনে ইখলাসের বিষয়টাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. البخاري :২০১৪, مسلم: ১৮১৭
'যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[৫৭]

এ হাদীসে 'ইহতিসাব' শব্দ এসেছে। এর অর্থ ইখলাসের সাথে সিয়াম পালন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করার নাম হল 'ইহতিসাব।'

(৪) সুন্নতে নববীর অনুসরণ :
কোন আমল্ততা যতই ইখলাসের সাথে সম্পাদন করা হোক না কেন, যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা না হয়, তবে তা কবুল করা হবে না। বরং তা আল্লাহর দরবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হবে।

যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد . مسلم:৪৫৯০
'যে এমন আমল করবে যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।'[৫৮]

'যার প্রতি আমাদের দ্বীনের নির্দেশ নেই'্তকথাটির অর্থ হল, যা আমাদের সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এমন ধরনের আমল যতই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করা হোক, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত না হওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব কোন ধর্মীয় আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য দুটো শর্ত। তা হল : এক. কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করতে হবে। দুই. কাজটি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করতে হবে। কাজটি যদি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে সম্পাদন করা না হয় বা এ কাজে তার অনুমোদনের প্রমাণ না থাকে, তাহলে কাজটি করে কোন সওয়াব অর্জিত হবে না। বরং গুনাহ হবে।

(৫) সিয়াম ভঙ্গের সহায়ক বিষয়গুলো পরিহার করে চলা :
সিয়াম পালনকারীকে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, যে সকল আচার-আচরণ সিয়াম ভঙ্গ করার কারণ হয় অথবা সিয়াম নষ্ট করার সহায়ক হয় এমন সকল বিষয় থেকে দুরত্ব বজায় রাখা। বিশেষত: স্বামী স্ত্রীর আলিঙ্গন, চুম্বন বা এক কাঁথা-কম্বলের নীচে শয়ন ইত্যাদি পরিহার করা উচিত। এ সকল কাজ যদিও সিয়াম অবস্থায় করার অনুমতি আছে কিন্তু দেখা গেছে এ সকল কাজ করতে যেয়ে অনেকে সমস্যায় পড়ে গেছে, ফলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে গেছে। প্রত্যেক বিষয়ের একটি সীমানা আছে, এ সীমা যাতে অতিক্রম না হয়ে যায় এ লক্ষ্যে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য হাদীসে নির্দেশ এসেছে। যদিও সীমানা পর্যন্ত যাওয়া বৈধ কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন বিধেয়। মনে রাখতে হবে রমজানের দিনের বেলা সিয়াম ভেঙে ফেলা একটি কবিরা গুনাহ। 'আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি' বা 'এমনটি হবে বুঝতে পারিনি' বলে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এ ধরনের কথা কখনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

(৬) ভয় ও আশা পোষণ করা :
প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল, সিয়াম-সালাতসহ সকল ইবাদত সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা। কিন্তু তার জানা থাকে না যে, তার এ সালাত ও সিয়াম আল্লাহ কবুল করেছেন না প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব তার সর্বদা এ ভয় থাকা উচিত যে, হয়তো আমি আমার ইবাদত-বন্দেগী এমনভাবে আদায় করতে পারিনি যেভাবে আদায় করলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। ফলে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান হয়তো পাব না। আবার এ আশাও পোষণ করা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে আমার ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে আমার ইবাদত-বন্দেগী কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেবেন। এ অবস্থার নাম হল 'আল-খাওফ ওয়ার রজা' অর্থাৎ 'ভয় ও আশা।' এটা ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকীদা বিষয়ক পরিভাষা।

মনে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলা সকলের নেক আমল কবুল করেন না। যেমন তিনি বলেন :
'অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন।'[৫৯]

হাদীসে এসেছে আয়েশা রা. নিম্নোক্ত আয়াতের অর্থ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলেন :
(والذين يؤتون ما آتوا وقلوبهم وجلة) أي خائفة. أهم الذين يشربون الخمر ويسرقون ؟ قال : لا يا بنت الصديق، ولكنهم الذين يصومون ويصلون ويتصدقون وهم يخافون أن لا تقبل منهم. أولئك يسارعون في الخيرات وهم لها سابقون. الترمذي:৩৪৭৫
'যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে'্তআল্লাহ এ কথা কাদের জন্য বলেছেন, যারা মদ্য পান করে, চুরি করে তাদের জন্য? তিনি উত্তরে বললেন : না, হে সত্যবাদীর কন্যা ! তারা হল, যারা সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে, দান-সদকা করে সাথে সাথে এ ভয় রাখে যে হয়তো আমার এ আমলগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী।' বর্ণনায় : তিরমিযী

বর্ণিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, আল্লাহ ঐ সকল মুমিনদের প্রশংসা করেছেন যারা নেক আমল করে 'কবুল হবে কি হবে না' এরকম একটা ভয় পোষণ করে। এবং আমল আরো সুন্দর করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ ভয় যেন আবার মানুষকে নৈরাশ্যবাদী না করে। কোন অবস্থাতেই কোন মুসলিম আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত থেকে নিরাশ হতে পারে না। আল্লাহর সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী হওয়া একটা কুফরী। নেক আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী হতে হবে কিন্তু এ আশাবাদী মনোভাব যেন অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তিতে ফেলে না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি নেক আমলকে বাতিল করে দেয়। অনেক সময় অলসতা নিয়ে আসে। অপরদিকে ভয় মানুষকে তৎপর ও কর্মঠ হতে সাহায্য করে। তাই সকলের উচিত সকল প্রকার নেক আমল করতে হবে ভয় ও আশা নিয়ে। শুধুই ভয় অথবা শুধুই পাওয়ার আশায় নয়।

(৭) সাহরী খাওয়া:
সিয়াম পালনের জন্য সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
تسحروا فإن في السحور بركة. البخاري:১৯২৩, ومسلم:২৬০৩
'তোমরা সাহরী খাও, কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে।'[৬০]

• সাহরী না খেয়ে সিয়াম পালন করলে যখন সিয়াম আদায় হবে। তবে সাহরী খাবেন কেন ?

(ক) সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহরী খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
(খ) ক্ষুধা-পিপাসা মোকাবিলা করার জন্য।
(গ) সাহরী খেলে সিয়াম পালনে কষ্ট কম হয় ও সিয়াম পালন সহজ হয়।
(ঘ) ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। কারণ তারা সিয়াম পালন করতে সাহরী খায় না। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحور. مسلم:২৬০৪
'আমাদের ও ইহুদী-খ্রিস্টানদের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া।'[৬১]
(ঙ) সাহরীর মাধ্যমে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
(চ) ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করা নিশ্চিত হয়।

তাই সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবে সাহরীর খাবার হালকা হওয়া ভাল। এমন বেশি খাওয়া উচিত নয়, যাতে দিনের বেলা কাজ-কর্মে অলসতা দেখা দেয়। যে কোন হালাল খাবার সাহরীতে গ্রহণ করা যায়। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
نعم سحور المؤمن التمر. أبو داود:২৩৪৭
'মুমিনের উত্তম সাহরী হল খেজুর।'[৬২] 

তিনি আরো বলেন :
السحور أكلة بركة فلا تدعوه، ولو أن يـجرع أحدكم جرعة من ماء، فإن الله وملائكته يصلون على المتسحرين. أحمد:১১৩৮৪
'সাহরী হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সাহরী করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও ফেরেশ্‌তাগণ সাহরীতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।'[৬৩]

(৮) দেরি করে সাহরী খাওয়া :
সাহরীর অর্থ হল যা কিছু রাতের শেষ ভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হল দেরি করে সাহরী খাওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন। ফজরের ওয়াক্ত আসার পূর্ব-ক্ষণে সাহরী খেলে সিয়াম পালন অধিকতর সহজ হয়, ফজরের সালাত আদায় করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে কষ্ট করতে হয় না। সতর্কতা অবলম্বন করে ফজরের অনেক আগে সাহরী শেষ করা সুন্নত নয়। সাহরীর সময় শেষ হলো কি-না তা জানবেন নিজের চোখে পূর্বাকাশের শুভ্রতা দেখে, অথবা ক্যালেন্ডার ও ঘড়ির মাধ্যমে সূক্ষ্ণ হিসাব করে কিংবা নির্ভরযোগ্য মুয়াজ্জিনের ফজরের আযান শুনে।

(৯) সাহরীর সময়কে সুযোগ মনে করে কাজে লাগানো :
সাহরীর সময় অত্যন্ত মর্যাদা-পূর্ণ একটি সময়। এ সময় জাগ্রত হওয়ার কারণে আল্লাহ যা পছন্দ করেন এমন অনেক ভাল কাজ করা যায়। যেমন তিনি মুমিনদের প্রশংসায় বলেছেন :
'তারা শেষ রাতে (সাহরীর সময়) ক্ষমা প্রার্থনা করে।'[৬৪]

তিনি এ আয়াতে ঐ সকল জান্নাতবাসী মানুষদের প্রশংসা করেছেন যারা শেষ রাতে দোয়া-প্রার্থনা করে ও ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছে। এর মাধ্যমে তারা যে জান্নাত লাভ করবে এর সুসংবাদও দেয়া হয়েছে। সাহরীর সময়টা এমন একটি সময় যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন। যে সকল মানুষ তখন তার প্রতি আগ্রহী হয়ে সালাত ও দোয়া-প্রার্থনা করে, তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
ينـزل ربنا تبارك وتعالى كل ليلة إلى السماء الدنيا حين يـبقى ثلث الليل الآخر، فيقول: من يدعوني فأستجيب له، من يسألني فأعطيه، من يستغفرني فأغفرله. البخاري:১১৪৫ ومسلم:১৮০৮
'আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তখন মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যে আমার কাছে দোয়া করবে আমি তাতে সাড়া দেব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব ও যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।'[৬৫]

অতএব সাহরীর সময় হল আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি দান-প্রতিদানের সময়। এ সময় সে ব্যক্তিই তার সামনে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন যিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করেছেন। অনেক মানুষ এমন আছেন যারা এ সময় জাগ্রত হয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ অনেক কাজ সমাধা করেন কিন্তু দোয়া- প্রার্থনা. ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার সুযোগ করে নিতে পারেন না।

শেষ রাতের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أيها الناس أفشوا السلام، وأطعموا الطعام، وصلوا الأرحام، وصلوا بالليل والناس نيام تدخلوا الجنة بسلام. الدارمي:১৪৬০
'হে মানবসকল ! তোমরা সালামের প্রচলন কর। অন্যকে খাবার দাও। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা সালাত আদায় কর তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।'[৬৬]

(১০) ইফতারি করতে বিলম্ব না করা :
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাতের আগমন ঘটে ও ইফতার করার সময় হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
'অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করবে।'[৬৭]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إذا أقبل الليل من هاهنا وأدبر النهارمن هاهنا وغربت الشمس فقد أفطر الصائم. البخاري :১৮৫৩
'যখন এখান থেকে রাত্রির আগমন ঘটে ও ওখান থেকে দিন চলে যায় এবং সূর্য অস্ত যায় তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে।'[৬৮]

তাই ইফতারের আদব হল সূর্যাস্ত মাত্রই দেরি না করে ইফতার করা। সময় হওয়া মাত্র ইফতার করার ব্যাপারে অনেক হাদীসে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر . البخاري : ১৮৫৬ومسلم:১০৯৮
'মানুষ যতদিন পর্যন্ত সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে।'[৬৯]

তিনি আরো বলেছেন :
لا يزال الدين ظاهرا ما عجل الناس الفطر، لأن اليهود والنصارى يؤخرونه. أبو داود:২৩৫৫
'যতদিন মানুষ সময় হওয়া মাত্র ইফতার করবে ততদিন দ্বীন বিজয়ী থাকবে। কেননা ইহুদী ও খ্রিস্টানরা ইফতারিতে দেরি করে।'[৭০]

হাদীসে আরো এসেছে,
قال أبو الدرداء رضي الله عنه : ثلاث من أخلاق النبوة : تعجيل الإفطار، وتأخير السحور، ووضع اليمين على الشمال في الصلاة. مصنف عبد الرزاق:৭৬১৭
আবু দারদা রা. বলেন : 'তিনটি বিষয় নবী চরিত্রের অংশ : সময় হওয়া মাত্র ইফতার করে ফেলা, দেরি করে সাহরী খাওয়া ও সালাতে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।'[৭১]

আমর ইবনে মায়মূন আওদী বলেন:
كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم أسرع الناس إفطارا وأبطأهم سحورا. عبد الرزاق:৭৫৯১
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবীরা সকলের চেয়ে তাড়াতাড়ি (সময় হওয়া মাত্র) ইফতার করতেন ও সকলের চেয়ে দেরিতে সাহরী খেতেন।'[৭২]

কোন ব্যক্তি দেখে-শুনে ধারণা করে নিল যে, সূর্য ডুবে গেছে ও সে ইফতার করে নিল অথচ সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। এমতাবস্থায় তার সওমের কোন ক্ষতি হবে না। তবে ইফতার শুরু করার পর সে যদি বুঝতে পারে সূর্য এখনও অস্ত যায়নি তা হলে সাথে সাথে পানাহার থেকে বিরত হয়ে যাবে। তার বিষয়টা যে ভুলে পানাহার করেছে তার মতই।

• কেন বিলম্ব না করে ইফতার ও দেরিতে সাহরী খাবেন?

প্রথমত: ইসলামী জীবনাদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ধর্মীয়, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও লেবাস-পোশাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অনুকরণ প্রত্যাখ্যান করা। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ. الجاثية :১৮
'যাদের জ্ঞান নেই তুমি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবে না।'[৭৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من تشبه بقوم فهو منهم .سنن أبي داود:৪০৩৩
'যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।'[৭৪]

এ হাদীস দ্বারা বুঝে আসে, যে কাফেরদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি সে কাফের না-ও হয় তবে কাজটি যে হারাম বা নিষিদ্ধ এতে কোন সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের প্রতি পরম দয়ালু। তিনি মানুষদের কষ্ট দিতে চান না কখনো। মানুষের জন্য সব কিছু তিনি সহজ করতে চান। তাই সিয়াম পালনকারীর যাতে অযথা কষ্ট না হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে দেরি করে সাহরী ও সময় হওয়া মাত্র ইফতারের নির্দেশ এসেছে। সিয়াম পালন করা যেমন ইসলামের নির্দেশ, তেমনি সিয়ামের সময় শেষে পানাহার করাও ইসলামের নির্দেশ। এ নির্দেশ পালনে দেরি করা বা গড়িমসি করা কখনো ঠিক নয়।
তৃতীয়ত : রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবীগণ তাঁর অনুসরণের ব্যাপারে কত যত্নবান ছিলেন সেটা লক্ষণীয়। প্রতি পদে পদে রাসূলের অনুসরণ করার জন্য আমাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।

আল্লাহ বলেন :
'বল ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।'[৭৫]

তিনি আরো বলেন :
'রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা ধারণ কর। আর যা থেকে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।'[৭৬]

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে কিছু শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন : অনেকে নিশ্চিত হয়েছেন যে সূর্যাস্ত হয়েছে, তারপরও ইফতার শুরু করার জন্য আজানের অপেক্ষা করেন। আবার অনেকে মনে করেন সূর্য ডুবে গেছে ঠিকই কিন্তু মাগরিবের আযান না শুনে ইফতার করব কীভাবে? আবার অনেকে আযান শোনার পর ইচ্ছে করেই সতর্কতা অবলম্বন করতে যেয়ে কিছুক্ষণ বিলম্ব করেন। অনেক সময় আযান হয়ে যাওয়ার পর দোয়া-প্রার্থনায় রত থাকতে দেখা যায়। এগুলো পরিহার করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সুন্নত অনুযায়ী সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার শুরু করে দেয়া কর্তব্য।

(১১) যে সকল খাদ্য দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব:
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال :كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يفطر على رطبات قبل أن يصلي، فإن لم يكن رطبات فتمرات، فإن لم يكن تمرات، حسا حسوات من ماء. أحمد:১৩০১২
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর না পাওয়া যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।'[৭৭]

এ হাদীস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ইফতারের আদব হল: মাগরিবের সালাতের পূর্বে ইফতার করা। তাজা খেজুর বা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করা। খেজুর দিয়ে ইফতার করার উপকারিতা হল, খেজুর সহজপাচ্য। দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকার কারণে খাওয়ার পর যে সমস্যা হওয়ার কথা খেজুর খেলে তা হয় না। উপরন্তু খেজুর হালকা খাবারের একটি। পানি, খেজুর এগুলো দ্বারা ইফতার করলে অলসতা সৃষ্টি হয় না।

দ্বিতীয়ত পেট পুরে পানাহার ইসলাম সমর্থন করে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
ما وعي ابن آدم وعاء شرا من بطنه، بحسب ابن آدم أكلات يقين صلبه، فإن كان لا محالة فاعلا فثلث لطعامه، وثلث لشرابه، وثلث لنفسه. الحاكم:৭১৩৯
'মানুষ সে সকল পাত্র পূর্ণ করে তার মাঝে মানুষের পেট অপেক্ষা আর কোন খারাপ পাত্র নেই। মানুষের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমা-ই যথেষ্ট। এর থেকেও বেশি যদি প্রয়োজন হয়, তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের জন্য রেখে দেয়া উচিত।'[৭৮]

(১২) ইফতারের সময় দোয়া করা :
সিয়াম পালনকারীর দোয়া কবুল হয়। বিশেষ করে ইফতারের সময়। কারণ ইফতারের সময়টা হল বিনয় ও আল্লাহর জন্য ধৈর্য ধারণের চরম মুহূর্ত। এ সময় জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের মুহূর্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إن لله تعالى عند كل فطر عتقاء من النار، وذلك كل ليلة، لكل عبد منهم دعوة مستجابة. البيهقي:৩৬০৫
'ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এটা রমজানের প্রতি রাতে। সিয়াম পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়।'[৭৯]

ইফতার করার পর এ দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত্ত
ذَهَبَ الظَمَأُ، وَابْتَلَّتِ العُرُوْقُ، وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ. أبو داود :২৩৫৭
অর্থ : 'পিপাসা নিবারণ হল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নির্ধারিত হল।'[৮০]

ইফতারের সময়টা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটা সুযোগ। এ সময়টা যেন বৃথা না যায় এ দিকে খেয়াল রেখে সময়টাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। ইফতারের সময় অন্তর দিয়ে দোয়া-প্রার্থনা করা এবং যা কিছু দোয়া কবুলের অন্তরায় তা থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। যেমন হারাম বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত খাদ্য গ্রহণ। দোয়া কবুলের কত চমৎকার সময় যে, আল্লাহ নিজে যখন দোয়া কবুলের ওয়াদা করেছেন !
'আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে, আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সুতরাং তারা আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক যাতে তারা ঠিক পথে চলতে পারে।'[৮১]

ইফতারের সময় ও আজানের পরের সময়টাও দোয়া কবুলের সময়। হাদীসে এসেছে প্রতি আযান ও একামতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া কবুল হয়।

(১৩) বেশি করে ভাল ও কল্যাণ মূলক কাজ করা এবং কুরআন পাঠ করা।
রমজান হল কুরআন নাযিলের মাস। কুরআন নাযিলের কারণে রমজান মাসের এত মর্যাদা। এ মাসে অবশ্যই অন্য সকল সময়ের চেয়ে বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। হাদীসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمرو أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة، يقول الصيام أي رب: منعته الطعام والشهوات بالنهار، فشفعني فيه. ويقول القرآن : منعته النوم بالليل، فشفعني فيه. قال فيشفعان. أحمد:৬৬২৬
আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'সিয়াম ও কুরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি বলেন, অতপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।'[৮২]

(১৪) ইবাদত-বন্দেগীতে তাওফীক দানের ব্যাপারে আল্লাহর অনুগ্রহ অনুধাবন করা :
একটু চিন্তা করে দেখা যেতে পারে যে, কত মানুষ রয়েছে যাদেরকে আল্লাহর তার ইবাদত-বন্দেগী করতে সামর্থ্য দেননি কিন্তু আমাকে দিয়েছেন। এটা আমার প্রতি তাঁর এক মহা-অনুগ্রহ। এরপর তিনি যদি আমার এ ভাল কাজগুলো কবুল করে আমাকে প্রতিদান দেন তাহলে এটা হবে তাঁর পক্ষ থেকে আরেকটি অনুগ্রহ। কত মানুষ ভাল কাজ করে কিন্তু সকলের ভাল কাজ-তো কবুল করা হয় না।
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ (المائدة : ২৭)
'আল্লাহ মুত্তাকীদের কাজই কবুল করেন।'[৮৩]

এ ধরনের অনুভূতি থাকলে নেক-আমল করে আত্ম-তৃপ্তি ও অহংকার নামক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। কেননা অহংকার ও আত্ম-তৃপ্তি ভাল কাজের প্রতিদান নষ্ট করে দেয়। তখন ভাল কাজগুলো মরীচিকার মত হয়ে যায়।

(১৫) দরিদ্র ও সহায় -সম্বলহীনদের প্রতি মমতা ও তাদের সেবা করা :
সিয়াম পালনের মাধ্যমে অসহায় সম্বলহীন, অভুক্ত মানুষের প্রতি দয়া ও মমতা সৃষ্টি হয়। তাদের অসহায়ত্ব অনুভব করা যায়। তাই এ দান-প্রতিদানের পবিত্র মাসে তাদের জন্য বেশি করে কল্যাণকর কাজ করা উচিত। ইফতার করানো, সদকাতুল ফিতর, যাকাত আদায় করার সাথে সাথে ব্যাপকভাবে দান-সদকা করা যেতে পারে। হাদীসে এসেছে,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. مسلم:২৩০৮
'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।'[৮৪]

(১৬) সুন্দর চরিত্র, ধৈর্য ও উত্তম আচরণ দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করুন :
রমজান হল ধৈর্যের মাস আর সিয়াম হল একটি বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থাকাকালীন অবশ্যই সদাচরণ, ধৈর্য, সুন্দর চরিত্রের অনুশীলন করতে হবে। রোজাদারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সে যেন মূর্খতাপূর্ণ আচরণকারীর জবাব না দেয়, তার সঙ্গে যে ভ্রান্ত আচরণ করে তাকে বলে দেয়,' আমি রোজাদার'। সর্বোপরি তাকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

(১৭) অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকুন :
অপচয় তা যে কোন বিষয়েই হোক ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। পবিত্র মাসে যখন আমাদের বেশি করে সৎকাজ করা উচিত তখন আমরা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোন ধরনের অপচয় করে যেন পাপ অর্জন না করি। রমজান মাসে দেখা যায় অনেকে খেতে পারব মনে করে অনেক কিছু আয়োজন করে। অবশেষে খেতে না পেরে তা নষ্ট করে ফেলে। এটা সত্যিই অন্যায়।

(১৮) রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগান :
রমজানের সময়টা অন্য সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সংক্ষিপ্ত মনে হয়। তাই আপনি রুটিন করে সময়টাকে কি কি কাজে ব্যয় করবেন তা যদি ঠিক করে না নেন তাহলে দেখবেন অনেক কাজই অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অনর্থক কথা-বার্তা, আড্ডা বাজি, গল্পগুজব, নিষ্ফল বিতর্ক ইত্যাদি পরিহার করুন। কোন কথা বা কাজ করার আগে ভেবে দেখুন কথা বা কাজটা আপনার জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনবে। 'আমার পাশে বসে অন্য লোক একটি বিষয় আলোচনা করছে তাই আমাকে অংশ নিতেই হয়্ততাই একটু বললাম' এমন যেন না হয়। অযথা কথা ও কাজ পরিহার করা সিয়ামের একটি শিক্ষা ও দাবি।

(১৯) দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে দিন :
রমজান মাসে নিজের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য দুনিয়াদারির
ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করুন। অনেকেই রমজান মাসকে অর্থ উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা লাভের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ দিকেই বেশি সময় ব্যয় করেন। দুনিয়াদারি যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুতো অবশ্যই করবেন। আর বাকি সময়টা আখেরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যয় করুন।

(২০) খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য বজায় রাখুন :
আমাদের মাঝে অনেকে রমজান মাসে যেমন খাওয়া দাওয়া বেশি করে তেমনি আবার বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটায়। তারাবীহ ও সাহরীর কারণে যদি রাতে দু ঘণ্টা নিদ্রা কম হয় তবে দিনে তার কাফফারা আদায় করে চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে। খাবার ব্যাপারে অনেকে একই নীতি অনুসরণ করে। যদি এরকমই আমাদের অবস্থা হয় তবে আমরা রমজানের জন্য কি কুরবানী করলাম? বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।

সিয়াম পালন যাদের উপর ফরজ

কার জন্য সিয়াম পালন ফরজ ?

প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, মুকীম, সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য সিয়াম পালন ফরজ।

যে ব্যক্তি এ সকল শর্তাবলির অধিকারী তাকে অবশ্যই রমজান মাসে সিয়াম পালন করতে হবে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'সুতরাং তোমাদের মাঝে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে।'[৮৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إذا رأيتم الهلال فصوموا. مسلم:১০৮১
'যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখবে তখন সিয়াম পালন করবে।'[৮৬]

দশ প্রকার মানুষের মাঝে সিয়াম পালনের এ সকল শর্তাবলি অনুপস্থিত। তারা হল :

প্রথম : কাফের বা অমুসলিম
কারণ তারা ইবাদত করার যোগ্যতা রাখে না। ইবাদত করলেও তাদের মধ্যে ইসলাম অনুপস্থিত থাকার কারণে তা সহীহ হবে না, কবুলও হবে না। যদি কোন কাফের রমজানে ইসলাম গ্রহণ করে, তবে পিছনের সিয়ামের কাজা আদায় করতে হবে না। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'যারা কুফরী করে তাদেরকে বল, 'যদি তারা বিরত হয় তবে যা অতীতে হয়েছে আল্লাহতা ক্ষমা করবেন।'[৮৭]

তবে রমজানের দিনে ইসলাম গ্রহণ করলে ঐ দিনের বাকি অংশটা পানাহার থেকে বিরত থাকবে।

দ্বিতীয় : অপ্রাপ্ত বয়স্ক
অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
رفع القلم عن ثلاثة : عن النائم حتى يستيقظ، وعن الصغير حتى يكبر، وعن المجنون حتى يفيق. السنن الكبرى للنسائي:৫৬২৬
'তিন ব্যক্তি থেকে কলমকে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। নিদ্রা মগ্ন ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়। কম বয়সী ব্যক্তি যতক্ষণ না সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়। পাগল ব্যক্তি যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়।'[৮৮]

যদিও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকাদের উপর সিয়াম পালন ফরজ নয় তবে অভিভাবকরা অভ্যস্ত করার জন্য তাদের সিয়াম পালন করতে বলবেন। সাহাবায়ে কেরাম তাদের বাচ্চাদের সিয়াম পালনে অভ্যস্ত করেছেন। তাই আমাদের জন্য মুস্তাহাব হল আমরাও আমাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের সিয়াম পালনে উদ্বুদ্ধ করব, যদি সিয়াম পালন তাদের কোন ক্ষতি না করে।

অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে কখন বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হয় ?
যদি কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক বা বালিকাদের মাঝে তিনটি আলামতের কোন একটি পরিলক্ষিত হয় তখন তাদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে ধরা হবে। আলামত তিনটি হল:
(১) স্বপ্নদোষ অথবা অন্য কোন কারণে বীর্যপাত হলে।
(২) যৌনাঙ্গে কেশ দেখা দিতে শুরু করলে।
(৩) বয়স পনেরো বছর পূর্ণ হলে।

ছেলেদের মাঝে যখন এ তিনটি আলামতের কোন একটি পরিলক্ষিত হবে তখন তাদের পূর্ণবয়স্ক বলে ধরা হবে। অবশ্য মেয়েদের জন্য চতুর্থ একটি আলামত রয়েছে, তা হল মাসিক দেখা দেয়া। যদি দশ বছর বয়সী কিশোরীদেরও মাসিক দেখা দেয় তাহলে তাদের পূর্ণবয়স্ক বলে ধরতে হবে। এবং শরীয়তের সকল আদেশ-নিষেধ তার জন্য অবশ্য পালনীয় বলে গণ্য হবে। কোন কিশোর বা কিশোরী রমজান মাসের দিনের বেলা যদি বয়স প্রাপ্ত হয়, তাহলে তাকে দিনের অবশিষ্ট অংশ পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। এ দিনের সওম তার কাজা করতে হবে না। পিতা-মাতার কর্তব্য হল, এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ও সন্তানকে সচেতন করা। সাথে সাথে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার উপর যে সকল ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনে দিক-নির্দেশনা দেয়া। পাক-পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম-নীতিগুলো সে জানে কি না বা মনে রাখতে পেরেছে কিনা তার প্রতি খেয়াল রাখা।

তৃতীয় : পাগল
পাগল বলতে বুঝায় যার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যার কারণে ভাল-মন্দের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। এর জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। যেমন পূর্বের হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। পাগল যখনই সুস্থ হয়ে যাবে তখনই সে সিয়াম পালন শুরু করে দেবে। যদি এমন হয় যে দিনের কিছু অংশ সে সুস্থ থাকে কিছু অংশ অসুস্থ তাহলে সুস্থ হওয়া মাত্রই সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। সিয়াম পূর্ণ করবে। পাগলামি শুরু হলেই তার সিয়াম ভঙ্গ হবে না, যদি না সে সিয়াম ভঙ্গের কোন কাজ করে।

চতুর্থ : অশীতিপর বৃদ্ধ যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না : 
এমন ব্যক্তি, যার বয়সের কারণে ভাল-মন্দ পার্থক্য করার অনুভূতি চলে গেছে সে শিশুর মতই। শিশু যেমন শরীয়তের নির্দেশমুক্ত তেমনি সেও। তবে অনুভূতি ফিরে আসলে সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে কখনো অনুভূতি আসে আবার কখনো চলে যায়, তাহলে অনুভূতি থাকাকালীন সময়ে তার উপর সালাত, সিয়াম ফরজ হবে।

পঞ্চম : যে ব্যক্তি সিয়াম পালনের সামর্থ্য রাখে না : 
এমন সামর্থ্যহীন অক্ষম ব্যক্তি যার সিয়াম পালনের সামর্থ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। যেমন অত্যধিক বৃদ্ধ অথবা এমন রোগী যার রোগ মুক্তির সম্ভাবনা নেই্তআল্লাহর কাছে আমরা এ ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই- এ ধরনের লোকদের সিয়াম পালন জরুরি নয়। কারণ সে এ কাজের সামর্থ্য রাখে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
لاَ يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا . (البقرة : ২৮৬)
'আল্লাহ কারো উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।'[৮৯]

কিন্তু এমন ব্যক্তির উপর সিয়ামের ফিদিয়া প্রদান করা ওয়াজিব। সিয়ামের ফিদিয়া হল, প্রতিটি দিনের পরিবর্তে একজন মিসকিন (অভাবী) লোককে খাদ্য প্রদান করবে।

কীভাবে মিসকিনকে খাদ্য প্রদান করবে ?
মিসকিনদের দু ভাবে খাদ্য প্রদান করা যায় :
(১) খাদ্য তৈরি করে সিয়ামের সংখ্যা অনুযায়ী সমসংখ্যক মিসকিনকে আপ্যায়ন করাবে। 
(২) মিসকিনদের প্রত্যেককে এক মুদ পরিমাণ ভাল আটা দেবে। এক মুদ হল ৫১০ গ্রাম। (তবে হানাফি ফিকাহ অনুযায়ী দুই মুদ বা এক কেজি বিশ গ্রাম আটা বা সমপরিমাণ টাকা দেয়া যেতে পারে।)

ষষ্ঠ : মুসাফির
মুসাফিরের জন্য সিয়াম পালন না করা জায়েয আছে। তবে সফরকে যেন সিয়াম পালন না করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার না করা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'যে কেউ অসুস্থ থাকে বা সফরে থাকে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টকর তা চান না।'[৯০]

সুতরাং যে ব্যক্তি সফরে থাকে, তার জন্য সিয়াম ভঙ্গের অনুমতি আছে এবং সফর শেষে সে সিয়াম আদায় করবে। এমনিভাবে সে যদি সফরাবস্থায় সিয়াম পালন করে তবে তা আদায় হবে। তবে উত্তম কোনটি, সফরকালীন সময়ে সিয়াম পালন করা, না সিয়াম ত্যাগ করা ? যেটা সহজ মুসাফির সেটাই করবেন। যদি তিনি দেখেন সফরকালীন সময়ে তার সিয়াম পালন বাড়িতে থাকাকালীন সময়ের মতই মনে হয়, তাহলে সফরে তার সিয়াম পালন করা উত্তম। আর যদি দেখেন সফরে সিয়াম পালন করলে অতিরিক্ত কষ্ট হয় তবে সিয়াম ত্যাগ করা তার জন্য উত্তম। বরং বেশি কষ্ট হলে সিয়াম পালন মাকরূহ হবে। যেমন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাথে একদল সাহাবী সফরে থাকাকালীন সময়ে সিয়াম পালন করে খুব কষ্ট সহ্য করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের লক্ষ্য করে বললেন :
أولئك العصاة، أولئك العصاة. مسلم:২৬৬৬
'তারাইতো অবাধ্য ! তারাইতো অবাধ্য !!'[৯১]

সফরে কেউ সিয়াম পালন শুরু করল পরে দেখা গেল সিয়াম অব্যাহত রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে, তখন সে সিয়াম ভঙ্গ করে ফেলবে। এখন কথা হল এক ব্যক্তি সারা জীবনই সফরে থাকে এবং সফরাবস্থায় সিয়াম পালন তার জন্য কষ্টকর সে কীভাবে সিয়াম পালন করবে? সে শীতকালে ছোট দিনগুলোতে সিয়াম পালন করতে পারে।

সপ্তম : যে রোগী সুস্থ হওয়ার আশা রাখে
যে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার অবস্থা তিনটির যে কোন একটি হয়ে থাকে :

প্রথম: এমন রোগী যার পক্ষে সিয়াম পালন কষ্টসাধ্য নয় এবং সিয়াম তার কোন ক্ষতি করে না। এমন ব্যক্তির সিয়াম পালন অপরিহার্য।
দ্বিতীয়: এমন রোগী, সিয়াম পালন যার জন্য কষ্টকর। এমন ব্যক্তির সিয়াম পালন বিধেয় নয়-মাকরূহ। সিয়াম পালন করলে আদায় হয়ে যাবে তবে মাকরূহ হবে। ইসলামী শরীয়তের উদ্দেশ্য মানুষকে কষ্ট দেয়া নয় বরং শরীয়তের উদ্দেশ্য হল মানুষের সমস্যাকে হালকা করা।
তৃতীয়: এমন রোগী যে সিয়াম পালন করলে রোগ বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় তার সিয়াম ত্যাগ করাই হল ওয়াজিব বা অপরিহার্য।

অষ্টম : ঋতুস্রাবগ্রস্ত নারী
ঋতুকালীন সময়ে নারীর জন্য সওম পালন জায়েয নয় বরং নিষেধ। যদি সওম পালন করা অবস্থায় মাসিক দেখা দেয় তাহলে তার সওম ভেঙে যাবে। যদি সূর্যাস্তের এক মুহূর্ত পূর্বেও দেখা যায় তবুও তাকে সওমের কাজা আদায় করতে হবে। মাসিক অবস্থায় রমজানের দিনের বেলা কোন মহিলার মাসিক বন্ধ হয়ে গেল তাহলে তাকে ঐ দিনের বাকি সময়টা খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, পরে এটারও কাজা করতে হবে। যদি সুবহে সাদিকের এক মুহূর্ত পূর্বে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ঐ দিনের সওম পালন অপরিহার্য। এমন ভাবা ঠিক নয় যে, গোসল করা হয়নি তাই সওম পালন থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং তার কর্তব্য হল, রোজার নিয়ত করে নিবে। গোসল পরে করলে সমস্যা নেই। সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে সদ্য প্রসূতি নারীর বিধান ঋতুবতী নারীর অনুরূপ। ঋতুবতী ও সদ্য প্রসূতি নারীরা সুস্থ হয়ে সিয়ামের কাজা আদায় করবে। তবে তাদের সালাতের কাজা আদায় করতে হবে না। আয়েশা রা.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ঋতুবতী নারী সালাতের কাজা আদায় করবে না, কিন্তু তাদের সিয়ামের কাজা আদায় করতে হবে কেন ? তিনি উত্তরে বললেন, 'আমাদের এ অবস্থায় শুধু সিয়ামের কাজা আদায় করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, সালাতের কাজা আদায়ের নির্দেশ দেননি।'

এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক বিরাট অনুগ্রহ যে তিনি মহিলাদের হায়েজ ও নিফাস চলাকালীন সময়ের সালাত মাফ করে দিয়েছেন।

নবম : গর্ভবতী ও দুগ্ধ দান কারী নারী
যদি গর্ভবতী বা দুগ্ধ দান কারী নারী সিয়ামের কারণে তার নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে সে সিয়াম ভঙ্গ করতে পারবে। পরে নিরাপদ সময়ে সে সিয়ামের কাজা আদায় করে নিবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إن الله تبارك وتعالى وضع عن المسافر شطر الصلاة وعن الحامل والمرضع الصوم أو الصيام . مسند أحمد:১৯৫৬৩
'আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসাফিরের অর্ধেক সালাত কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধ দান করী নারীর সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন।'[৯২]

দশম : যে অন্যকে বাঁচাতে যেয়ে সিয়াম ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় : 
যেমন কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ; পানিতে পড়ে যাওয়া মানুষকে অথবা আগুনে নিপতিত ব্যক্তিকে কিংবা বাড়িঘর ধসে তার মাঝে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে যেয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল। এতে অসুবিধা নেই। যদি এমন হয় যে, সিয়াম ভঙ্গ করা ব্যতীত এ সকল মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে সিয়াম ভঙ্গ করে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে। কেননা জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হয়েছে এমন বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করা ফরজ। এমনিভাবে যে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে জিহাদে নিয়োজিত, সে সিয়াম ভঙ্গ করে শক্তি অর্জন করতে পারবে। এ দশ প্রকার মানুষ যাদের জন্য সিয়াম ভঙ্গ করার অনুমতি দেয়া হল, তারা যেন প্রকাশ্যে পানাহার না করে সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত। কারণ এতে অনেক অজানা লোকজন খারাপ ধারণা পোষণ করবে যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সিয়ামের কাজা আদায়ের বিধান :
উপরে বর্ণিত যে সকল কারণে রমজানের সিয়াম ত্যাগ করা হয়, রমজানের পর তা আদায় করাকে 'কাজা' বলে। যেমন আল্লাহতা আলা বলেছেন :
'অন্য সময় এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।'[৯৩]

বিলম্ব না করে কাজা সিয়ামগুলো আদায় করা উত্তম। এমনিভাবে সকল মানুষের উচিত ভালো কাজে কোন বিলম্ব না করা। ভালো কাজ তাড়াতাড়ি করা প্রমাণ করে যে, কাজের প্রতি তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা রয়েছে। অপরদিকে দেরি করা হলে তার অলসতা ও ঈমানের দুর্বলতার পরিচয় বহন করে। পরবর্তী রমজান আসার পূর্বে অবশ্যই কাজা সিয়ামগুলো আদায় করে নিতে হবে।

সিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়াবলী ও করণীয়

যা কিছু সিয়াম ভঙ্গ করে তা থেকে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকার নাম হল সওম, বহু বচনে সিয়াম। সিয়ামভঙ্গকারী সকল প্রকার বিষয় থেকে বিরত না থাকলে সিয়াম আদায় হবে না। যে সকল কাজ সিয়াম ভঙ্গ করে তা সাধারণত সাত প্রকার।

প্রথম : সহবাস
সিয়াম অবস্থায় সহবাস করলে সিয়াম বাতিল হয়ে যায়। সিয়াম ফরজ হোক কিংবা নফল। সহবাসের মাধ্যমে সিয়াম বাতিল করা হলে তার কাজা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করা জরুরি।

কীভাবে সিয়ামের কাফফারা আদায় করা যায় ?
(১) মুসলিম দাস বা দাসী মুক্ত করে দেয়া। বর্তমানে যেহেতু দাস প্রথা নেই। ইসলাম ধাপে ধাপে দাস প্রথাকে উচ্ছেদ করেছে, তাই দাস-দাসী মুক্ত করে কাফফারা আদায় করার সুযোগ নেই।
(২) এক একটি রোজার পরিবর্তে দু মাস বিরতিহীন সিয়াম পালন করা। এ বিরতিহীন সিয়াম পালন করতে গিয়ে সংগত কারণ ব্যতীত যদি বিরতি দেয়া হয়, তবে আবার নতুন করে দু মাস সিয়াম পালন করতে হবে।
(৩) যদি বিরতিহীন ভাবে দু মাস সিয়াম পালনের সামর্থ্য না রাখে তবে এক একটি রোজার পরিবর্তে ষাট জন অভাবী মানুষকে খাদ্য দান করতে হবে। প্রত্যেকের খাদ্য হবে এক ফিতরার সম পরিমাণ।

দ্বিতীয় : ইচ্ছাকরে বীর্যপাত করা
যেমন কাউকে চুমো দেয়ার মাধ্যমে বা স্পর্শ করার কারণে কিংবা হস্ত মৈথুন ইত্যাদি কারণে বীর্যপাত ঘটানো হলে সিয়াম বাতিল হয়ে যায়। তবে এ সকল কারণে কামভাব থাকা সত্ত্বেও যদি বীর্যপাত না হয় তবে সিয়াম বাতিল হবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওম অবস্থায় স্ত্রীকে চুমো দিতেন ও স্পর্শ করতেন। তবে তিনি নিজেকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ ছিলেন। যদি চুমো ও স্পর্শ দ্বারা বীর্যপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে এ সকল কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামী শরীয়তের একটা মূলনীতি হল, যা কিছু অন্যায় বা হারাম কাজের দিকে নিয়ে যায় বা তার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে তা থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব। এ কারণে সিয়াম পালনকারীর জন্য কুলি করা ও নাকে পানি দেয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সে কুলি করার সময় গড়গড়া করবে না। স্বপ্নদোষের কারণে বীর্যপাত হলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কারণ এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে গেছে। যা কিছু অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায় আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেন। এমনিভাবে নিদ্রামগ্ন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়। কাজেই নিদ্রাকালে যা কিছু ঘটে তার জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। এটা আমাদের প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একটি রহমত। কেউ কোন বিষয় কল্পনা করার ফলে যদি বীর্যপাত হয়ে যায়, এতে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
إن الله تجاوز عن أمتي ما حدثت به أنفسها ما لم تعمل أو تتكلم. البخاري:৪৯৬৮
'অবশ্যই আল্লাহ তাআলা আমার উম্মত যা কল্পনা করে তা ক্ষমা করে দেন। যদি না সে কাজ বা কথার দ্বারা তা বাস্তবায়ন করে।'[৯৪]

তৃতীয় : পানাহার করা : 
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :
'আর তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ রাতের কালো রেখা হতে উষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর রাতের আগমন পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর।'[৯৫]

নাক দিয়ে ঔষধ সেবন করা পানাহার করার মতই সিয়াম বাতিল করে দেয়। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
وبالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما (أبو داود:১২৩)
'তোমরা ওজুর সময় নাকে পানি দিতে একটু অতিরিক্ত করবে, তবে সিয়াম অবস্থায় নয়।'[৯৬]

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল সিয়াম অবস্থায় নাকের ভিতরে এমনভাবে পানি দিতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে পানি ভিতরে চলে যায়। অতএব নাক দিয়ে কিছু ভিতরে প্রবেশ করালে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়।

চতুর্থ : যা কিছু পানাহারের বিকল্প, তা সিয়াম ভঙ্গ করে এটা দুইভাবে হতে পারে:
(১) সিয়াম পালনকারী শরীরে রক্ত গ্রহণ করলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পানাহার দ্বারা রক্ত তৈরি হয়। তাই রক্ত গ্রহণ পানাহারের একটি বিকল্প।
(২) খাবারের বিকল্প হিসেবে স্যালাইন বা ইনজেকশন গ্রহণ করা। তবে যে সকল ইনজেকশন ও স্যালাইন খাবারের বিকল্প নয়, তা গ্রহণ করতে বাধা নেই।

পঞ্চম: হাজামা বা শিঙা লাগানো। যে শিঙা লাগায় ও যাকে শিঙা লাগানো হয় উভয়ের সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়। যেমন হাদীসে এসেছে,
أفطر الحاجم والمحجوم أب৬৯و داود:২০২৩
'শিঙা যে লাগাল ও যাকে লাগা৬ে৯না হলো উভয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল।'[৯৭]

শিঙা লাগালে শরীরে এর প্রভাব পড়ে। এটা রক্ত দানের মতই। তাই সিয়াম পালনকারীর জন্য শিঙা ব্যবহার জায়েয নয়। তবে প্রয়োজন হলে সিয়াম ভঙ্গ করে শিঙা ব্যবহার করবে, পরে সিয়াম কাজা করবে। নাক দিয়ে রক্ত পড়লে কিংবা দাঁত ওঠালে অথবা আহত হয়ে রক্ত প্রবাহিত হলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না।

ষষ্ঠ : ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা। 
যদি কেউ ইচ্ছা করে বমি করে তবে তার সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من ذرعه القيئ فليس عليه شيء ومن استقاء عمدا فليقض. الترمذي:৬৫৩
'অনিচ্ছাকৃতভাবে যার বমি হল তার কিছু করণীয় নেই। আর যে নিজের ইচ্ছায় বমি করল সে সিয়াম কাজা করবে।'[৯৮]

তবে বমি আসলে তা আটকে রাখার চেষ্টা করবে না।

সপ্তম : মহিলাদের মাসিক ও প্রসূতিবস্থা আরম্ভ হলে।
যদি সিয়াম অবস্থায় মাসিকের রক্ত দেখা দেয় তাহলে সিয়াম ভেঙে যাবে। এমনিভাবে প্রসবজনিত রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে সিয়াম নষ্ট হয়ে যায়।

যে সকল বিষয় সিয়াম ভঙ্গ করে না

সুরমা ব্যবহার, চোখে বা কানে ঔষধ ব্যবহার করলে সিয়াম নষ্ট হয় না, যদিও তার স্বাদ অনুভূত হয়। কোন কিছুর স্বাদ অনুভূত হলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। সিয়াম ভঙ্গ হওয়ার সম্পর্ক হল পানাহারের সাথে। কোন কিছুর স্বাদ পরীক্ষা করার কারণে সিয়াম ভঙ্গ হয় না, যদি না তা গিলে ফেলে। কোন কিছুর ঘ্রাণ নিলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না। তবে ধুম জাতীয় ঘ্রাণ সিয়াম অবস্থায় গ্রহণ করবে না। যেমন আগরবাতি বা চন্দন কাঠের ধুয়া কিংবা ধুপ গ্রহণ করবে না। কুলি করলে বা নাকে পানি দিলে সিয়াম ভঙ্গ হয় না, তবে গড়গড়া করবে না বা নাকের খুব ভিতরে পানি দেবে না, বা নাকে পানি দিয়ে উপরে টান দেবে না। মিসওয়াক বা ব্রাশ করলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না। সিয়াম অবস্থায় দিনের যে কোন সময় মেস ওয়াক কিংবা ব্রাশ করতে দোষ নেই। এমনিভাবে দাঁতের মাজন বা টুথপেস্ট ব্যবহার করলে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না তবে তা যেন গলার ভিতরে প্রবেশ না করে তার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। 'সিয়াম অবস্থায় দুপুরের পর মেস ওয়াক করা উচিত নয়' বলে যে কথা প্রচলিত আছে তার কোন ভিত্তি নেই। গরম থেকে বাঁচতে পানি গায়ে দেয়া বা ভিজা কাপড় গায়ে জড়াতে কোন দোষ নেই। এতে সিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না।

রমজানের শেষ দশকের ফযীলত ও তাৎপর্য

রমজান মাসের শেষ দশকের বিশেষ ফযীলত রয়েছে এবং আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য। এগুলো হল :

(১) এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে।

(২) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন সহীহ মুসলিমে আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, তিনি এ রাতে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সাহরী গ্রহণ করতেন।

(৩) রমজানের শেষ দশক আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরনের লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। যেমন বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে। তিনি এ দশদিনের রাতে মোটেই নিদ্রা যেতেন না। পরিবারের সকলকে তিনি এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। 'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন' কথাটির অর্থ হল তিনি এ দিনগুলোতে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন।

(৪) এ দশদিনের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ শেষ দশদিনে মসজিদে এতেকাফ করতেন। প্রয়োজন ব্যতীত তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তার কালামে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে যেয়ে এরশাদ করেন :
'আমি তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে। আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।'[৯৯]

বরকতময় রজনী হল লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তাআলা একে বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহ তাআলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।
'নিশ্চয় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনীতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্পর্কে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতেই ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, সে রজনী উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।'[১০০]

এ সূরাতে যে সকল বিষয় জানা গেল তা হল:
(১) এ রাত এমন এক রজনী যাতে মানবজাতির হিদায়াতের আলোকবর্তিকা মহা গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
(২) এ রজনী হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিরাশি বছরের চেয়েও এর মূল্য বেশি।
(৩) এ রাতে ফেরেশতাগণ রহমত, বরকত ও কল্যাণ নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে থাকে।
(৪) এ রজনী শান্তির রজনী। আল্লাহর বান্দারা এ রাতে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তি অর্জন করে থাকে।
(৫) সময়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। এ আয়াতগুলোতে অল্প সময়ে বেশি কাজ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হল। যত সময় তত বেশি কাজ করতে হবে। সময় নষ্ট করা চলবে না।
(৬) গুনাহ ও পাপ থেকে ক্ষমা লাভ। এ রাতের এই ফযীলত সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
إن النبي صلى الله عليه وسلم قال : من قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. البخاري:১২৬৬ ومسلم:৩৪
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'যে লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সালাত আদায় ও ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।'[১০১]

লাইলাতুল কদর কখন ?

আল-কোরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমজান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমজানের শেষ দশকে হবে বলে সহীহ হাদীসে এসেছে। এবং তা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদীসে এসেছে।
تحروا ليلة القدر في العشر الأواخر من رمضان. البخاري:১৮৭৪
'তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।'[১০২]

এবং রমজানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদীসে এসেছে,
... فمن كان متحريا بها فليتحرها في السبع الأواخر. البخاري:১৮৭৪, مسلم:১৯৮
'যে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে চায় সে যেন শেষ সাত দিনে অন্বেষণ করে।'[১০৩]

অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হল রমজান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল উনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয় হল বেশি করে দোয়া করা। আয়েশা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে-
اَللّهُم إِنَّكَ عَفُوٌّ تٌحِبُّ العَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ . ابن ماجه:৩৯৮২
'হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন।'[১০৪]



সংকলন: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা: মুহাম্মদ শামসুল হক সদ্দিকি
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব



আরও পড়ুনঃ রোজার আদব
“রমজান মাস” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
“রোজা” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

1 টি মন্তব্য:

  1. মাশাআল্লাহ সিয়াম সম্পকে কোরআন ও হদীসের আনেক তথ্য জান্তে পারলাম।

    উত্তরমুছুন