রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

পাপ : আকার-প্রকৃতি, প্রভাব ও প্রতিকার

পাপ : আকার-প্রকৃতি, প্রভাব ও প্রতিকার



بسم الله الرحمن الرحيم

পাপের সংজ্ঞা

শরীয়তের পরিভাষায় মাসিয়াত বা পাপ হল, আল্লাহ তাআলা যা করা বান্দার জন্য আবশ্যক করেছেন, তা পালনে বিরত থাকা, এবং যা হারাম করেছেন, তা পালন করা। শরীয়তের পরিভাষা ব্যবহারে পাপকে বুঝানোর জন্য বিভিন্ন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন- যান্‌ব, খাতীআ', ইসম, সাইয়্যিআ'- ইত্যাদি।
এর চুড়ান্ত বিপজ্জনক দিক হল, তা মানুষকে দূরে নিক্ষেপ করে আল্লাহ ও তার রহমত হতে, টেনে নেয় আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নামের ভয়ানক পরিণতির দিকে। পাপের ক্রম ও ধারাবাহিকতা মানুষকে মাওলার সান্নিধ্য হতে ক্রমে দূরে নিক্ষেপ করে।
এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে পূণ: পূণ: এ সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, পাপ থেকে দূরে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন ও পাপের কারণে অতীত জাতিগুলোর উপর যে-সকল আযাব-গজব ও নিরন্তর দুর্যোগ নেমে এসেছিল- তার বিবরণ তুলে ধরেছেন সবিস্তারে। সাবধান হতে বলেছেন এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
ইরশাদ হয়েছে :
فإن تولوا فاعلم أنما يريد الله أن يصيبهم ببعض ذنوبهم. (المائدة : ৪৯)
'যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখ, তাদের কিছু পাপের কারণে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতে চান।' [সূরা মায়েদা : ৪৯]
أولم يهد للذين يرثون الأرض من بعد أهلها أن لو نشاء أصبناهم بذنوبهم. (الأعراف : ১০০)
কোন এলাকার অধিবাসী ধ্বংস হওয়ার পর সেই এলাকার যারা উত্তরাধিকারী হয়, তাদের কাছে এটা কি প্রতীয়মান হয় না যে, আমি ইচ্ছা করলে পাপের কারণে তাদের শাস্তি দিতে পারি ?' [সূরা আ'রাফ : ১০০]
অনুরূপভাবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে পাপ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন অসংখ্য হাদীসে। উদাহরণত: তিনি বলেছেন :
'اجتنبوا السبع الموبقات . . .(رواه البخاري -২৫৬০)
'তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক পাপ থেকে দূরে থাকবে ...' (বুখারী -২৫৬০)
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসে 'ইজতিনাব' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শব্দটি খুবই ইঙ্গিতবহ, কারণ, 'ইজতিনাব'-এর মর্মার্থ হল, পাপ ও পাপের প্রতি মানুষের মনকে লালায়িত র্কতেএমন যে কোন কিছুকে সযত্নে এড়িয়ে চলা, কেবল পাপ বর্জনের মাধ্যমে রাসূলের উক্ত বাণীর সার্থক প্রতিফলন হবে না।

পাপের প্রকারভেদ :

পাপ দু'ভাগে বিভক্ত-
(১) কবীর্তামারাত্মক পাপ।
(২) ছগীরা বা লঘুপাপ।
পাপ দু'ভাগে বিভক্ত হওয়ার ব্যাপারে কোরআন-হাদীসের দলীল ও প্রমাণাদি অসংখ্য, নিম্নে তার কয়েকটি উদ্ধৃত করা হল:
(ক) আল-কুরআনে এসেছে :
إن تجتنبوا كبائر ما تنهون عنه نكفر عنكم سيئاتكم. (النساء: ৩১)
'নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মাঝে যা গুরুতর, তা হতে যদি তোমরা বিরত থাক, তবে তোমাদের ছোট পাপগুলো ক্ষমা করে দিব।' [সূরা নিসা : ৩১]
(খ) ভিন্ন এক স্থানে কোরআনের বর্ণনা :
الذين يجتنبون كبائر الإثم والفواحش إلا اللمم. (النجم : ৩২)
'যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্য হতে, ছোট পাপের সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও।' [সূরা নাজম : ৩২]
(গ) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
الصلوات الخمس والجمعة إلى الجمعة كفارة لما بينهن ما لم تغش الكبائر
(رواه الترمذي : ১৯৮)
'পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও এক জুমা' হতে অপর জুমা' হল এসবের মধ্যবর্তী সময়ে কৃত পাপের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।' (তিরমিযী : ১৯৮)


কবীরা ও ছগীরা গোনাহের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

প্রথমত : কবীরা গুনাহ
কিছু কিছু পাপকে কোরাআন ও হাদীসের স্পষ্ট প্রমাণের আলোকে কবীরা গুনাহ হিসেবে শনাক্ত করা যায়, যেমন, আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব সাব্যস্ত করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, অন্যায় হত্যা, যাদু, মিথ্যা সাক্ষ্য্তইত্যাদি।
আর যে সব গুনাহ সম্পর্কে কবীরা হিসেবে স্পষ্ট ঘোষণা কুরআন বা হাদীসে আসেনি এরূপ পাপসমূহের কোনটি কবীরা তা নির্ণয় ও শনাক্তির জন্য আইনজ্ঞ উলামাগণ একটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন।
কবীরা গুনাহের সংজ্ঞা নিরূপনে ইসলামী আইন বিশারদদের মতামত এই যে, যে পাপ কোরআন ও হাদীসের দলীল দ্বারা কঠোরভাবে হারাম হওয়া প্রমাণিত, যার ব্যাপারে লা'নত ও গজবের ঘোষণা এসেছে, কিংবা জাহান্নামের হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, অথবা দুনিয়াতে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছ্তেতাকে ইসলামের পরিভাষায় কবীরা গুনাহ বলা হয়।

দ্বিতীয়ত : ছগীরা গুনাহ
কবীরা গুনাহের উক্ত সংজ্ঞা যে পাপের উপর আরোপ করা যায় না, তাকেই ইসলামের পরিভাষায় ছগীরা গুনাহ বলা হয়। যেমন : আজান হওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হওয়া, দাওয়াত পাওয়ার পর তাতে কোন কারণ ব্যতীত অংশ গ্রহণ না করা, সালামের উত্তর না দেয়া, হাঁচি দিয়ে যে আল্‌হামদুল্লিাহ বলল তার উত্তর না দেয়া ইত্যাদি।

ছগীরা গুনাহকে লঘু মনে করার ব্যাপারে সাবধানতা :
ছগীরা গুনাহকে লঘু মনে করা কোন ক্রমেই উচিত নয়। কেননা, এতে কবীরাহ গুনাহে আক্রান্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়।
ছগীরা গুনাহকে লঘুভাবে নেয়ার ভয়ানক পরিণতি কি হতে পারে, তা এখানে আলোচনা করছি:্ত
(ক) মুসলমানের কর্তব্য, যা কিছু হতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা। কোন্‌টা ছোট আর কোন্‌টা বড়্ততা বিবেচ্য নয়।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
ما نهيتكم عنه فاجتنبوه. )رواه مسلم-৪৩৪(
'যা থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করেছি, তা পরিহার কর।' (মুসলিম : ৪৩৪৮)
(খ) মানুষের কর্তব্য, আল্লাহ তা'আলার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে গুনাহ পরিহার করে চলা। কেননা, যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পরিহার করতে বলেছেন, তা পরিহার না করার অর্থ আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন, অসম্মান দেখানো। সন্দেহ নেই এটা খুবই আপত্তিকর ও গর্হিত কাজ।
তাই, এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাবেয়ী বেলাল ইবনে সা'দ রা.-এর উক্তি এরূপ্ততুমি ছোট অপরাধ করলে, না বড় অপরাধ্ততা ধর্তব্য নয়। মূল দেখার বিষয় তুমি কার কথার অবাধ্য হচ্ছো।
(গ) ছোট গুনাহ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়ে বলেছেন :
إياكم ومحقرات الذنوب، فإنما مثل محقرات الذنوب كقوم نزلوا بطن واد فجاء ذا بعود وجاء ذا بعود، حتى أنضجوا خبزتهم، وإن محقرات الذنوب متى يؤخذ بها صاحبها تهلكه. )رواه أحمد :২১৭৪২وصححه الألباني في الجامع(
'তোমরা ছোট ছোট গুনাহ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করবে। ছোট গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত সেই পর্যটক দলের মত, যারা একটি উপত্যকায় বিশ্রাম নিতে বসল। অতঃপর তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি একটি লাকড়ি নিয়ে উপস্থিত হল, অপর ব্যক্তি আরেকটি; পরিণতিতে তাদের রুটি প্রস্তুত হয়ে গেল। এবং ছোট গুনাহের কারণে যদি কাউকে পাকড়াও করা হয়, তবে, সন্দেহ নেই, তা তার ধ্বংসের কারণ হবে।' [আহমদ-২১৭৪২]
(ঘ) ছগীরা গোনাহে মানুষের অভ্যস্ততার ফলে মানুষ ক্রমে অন্যান্য ছগীরা এবং এক সময়ে কবীরা গুনাহে প্রতি লিপ্ত হয়ে পড়ে। ছগীরা গুনাহকে হাল্কা মনে করে তাতে লিপ্ত হওয়া শয়তানের কুমন্ত্রণা বৈ নয়।
আল্লাহ তা'আলা বলেন :
يا أيها الذين آمنوا لا تتبعوا خطوات الشيطان. ( النور :২১)
'হে বিশ্বাসীগণ ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।' [সূরা আন-নূর : ২১]

যে সব কারণে ছগীরা গুনাহ কবীরা গুনাহে পরিণত হয় :

(১) বার বার ছগীরা গুনাহে লিপ্ত হলে অথবা ছগীরা গুনাহ অভ্যাসে পরিণত হলে তা আর ছগীরা গুনাহে সীমাবদ্ধ থাকে না। কবীরা গুনাহে পরিণত হয়।
প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. বলেন : 'ইস্তেগফার বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে কবীরা গুনাহ থাকে না। তবে বার বার ছগীরা গুনাহ করে গেলে তা আর ছগীরা গুনাহ থাকে না।'
(২) প্রকাশ্যে ছগীরা গুনাহ করলে অথবা তা করে আনন্দিত হলে বা তা নিয়ে গর্ব করলে কবীরা গুনাহে পরিণত হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
كل أمتي معافى إلا المجاهرين، وإن من المجاهرة أن يعمل الرجل بالليل عملا ثم يصبح وقد ستر الله فيقول: يا فلان قد عملت البارحة كذا وكذا، وقد بات يستره ربه ويصبح يكشف ستر الله عنه. (رواه البخاري: ৫৬০৮)
'আমার উম্মতের সকল সদস্য ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, কেবল যারা প্রকাশ্যে পাপ করে যায়, তারা ব্যতীত। প্রকাশ্যে পাপ করার অর্থ : কোন ব্যক্তি রাতে খারাপ কাজ করল। আল্লাহ্‌ তার এ কাজটি গোপন রাখলেন কিন্তু দিনের বেলায় সে লোকদের বলে বেড়াল, হে শুনেছ ! আমি গত রাতে এই এই করেছি। রাতে তার প্রতিপালক যা গোপন করলেন, দিনে সে তা প্রকাশ করে দিল।'
(৩) যিনি ছগীরা গুনাহ করলেন, তিনি যদি মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকেন, তাহলে মানুষ তার কারণে এ গুনাহকে গুনাহ মনে করবে না। মনে করবে, তার মত মানুষ যখন এ কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা করলে দোষ কি ? ফলে তাদের এ গুনাহের অংশ তারও বহন করতে হতে পারে।

পাপের নেতিবাচক প্রভাব :

ব্যক্তি ও সমাজের উপর পাপ ও পাপাচারের নেতিবাচক নানাবিধ প্রভাব রয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে ব্যক্তি বা সমাজকে পাপের খেলায় মত্ত করে তোলে, ধ্বংসের বীজ ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। নিম্নে তারই কয়েকটি তুলে ধরা হল।

(ক) ব্যক্তির উপর পাপের ক্ষতিকর প্রভাব :
পাপের কারণে ব্যক্তির অন্তরাত্মা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, তার আত্মা ঢেকে যায় অন্ধকারাচ্ছন্নতার চাদরে। মনকে সঙ্কুচিত মনে হয় সর্বদা। নানা প্রকার বিপদ-আপদে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভাল কাজের শক্তি-সামর্থ্য ও তাওফীক হ্রাস পায়।
প্রশ্ন হতে পাের্ত যারা পাপাচারে লিপ্ত তারাইতো গড়ে তুলছে প্রাচুর্য্য। যাপন করছে স্বাচ্ছ্যন্দ জীবন ! নেয়ামত ও আনন্দের আবহ ঘিরে সর্বদা তাদের। কথা অসত্য নয়। তবে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ধৃত-পাকড়াও করার কৌশল মাত্র। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে এ প্রসঙ্গে বক্তব্য এসেছে।
وأملي لهم إن كيدي مكين . (القلم : ৪৫)
'আর আমি তাদের সময় দিয়ে থাকি, নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ।' [সূরা আল-কলম : ৪৫]
ولا يحسبن الذين كفروا أنما نملي لهم خير لأنفسهم إنما نملي لهم ليزدادوا إثما ولهم عذاب مهين. (آل عمران : ১৭৮)
'কাফিরগণ যেন কখনো মনে না করে, আমি অবকাশ দেই তাদের মঙ্গলের জন্য; আমি অবকাশ দিয়ে থাকি, যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।' [সূরা আলে ইমরান: ১৭৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إن الله ليملي للظالم حتى إذا أخذه لم يفلته ثم قرأ : 'وكذلك أخذ ربك إذا أخذ القرى وهي ظالمة' ( هود : ১০২)
আল্লাহ অত্যাচারীকে অবকাশ দেন। যখন তাকে পাকড়াও করা হয়, তখন সে দিশেহারা হয়ে যায়। অত:পর তিনি কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন : 'এ রকমই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি। তিনি শাস্তি দান করেন জনপদসমূহকে, যখন তারা জুলুম করে।'
(সূরা হুদ: ১০২)

(খ) সমাজে পাপের ক্ষতিকর প্রভাব :
সমাজে পাপাচার ও তার ক্ষতিকর প্রভাব বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পাপাচারের কারণে বিভিন্ন রোগ-ব্যধির বিস্তার ঘটে, দুষিত হয় পরিবেশ। দেখা দেয় নিরাপত্তার অভাব, বিঘ্ন ঘটে শান্তি-শৃংখলার, ভীতি ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহভাবে। কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ঝড়-তুফানসহ দেখা দেয় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানববিধ্বংসী যুদ্ধ, আগ্রাসন্তইত্যাদি বিবিধ অস্বাভাবিকতা মানুষের পাপাচারেরই ফসল।
তবে কাফিরদের অবাধ বিচরণ ও স্বচ্ছলতা দেখে মুসলিমদের বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ, হয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকে সাময়িক অবকাশ, কিংবা হয়ত আল্লাহ তা'আলা পরোকালের তুলনায় দুনিয়াতেই তাদের জন্য বরাদ্দ সকল সুখ-শান্তি বিলিয়ে দিচ্ছেন,্তরাসূল হতে বর্ণিত হাদীসেও এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।

পাপাচার প্রতিরোধে ব্যক্তি ও সমাজের করণীয়

প্রথমত : সামাজিক দায়িত্ববোধ বিস্তার
সমাজের দায়িত্ব হল সকল প্রকার পাপাচার ও অপরাধ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া। উপদেশ ও নসীহতের মাধ্যমে পাপাচার নির্মূল করা।
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বিরত রাখার কর্মপন্থা গ্রহণ করা। একে ব্যাপারে অলসতা ও গাফিলতি প্রদর্শন প্রকারান্তরে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনবে, সন্দেহ নেই। পাপ নির্মূলের চেষ্টা না করে যদি পাপের সাথে সহাবস্থানের মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে তবে শাস্তি নাযিল হওয়া অবধারিত।
ইরশাদ হয়েছে :
لعن الذين كفروا من بني إسرائيل على لسان داود وعيسى ابن مريم ذلك بما عصوا وكانوا يعتدون. كانوا لا يتناهون عن منكر فعلوه لبئس ما كانوا يفعلون. (المائدة : ৭৮-৭৯)
'বনী ইস্রাইলের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল, তারা দাউদ ও মারইয়াম তনয় ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত হয়েছিল্তএ এজন্য যে, তারা ছিল অবাধ্য ও সীমালংঘনকারী। তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা হতে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত, তা নিয়ত অতিব নিকৃষ্ট।' [সূরা মায়েদা :৭৮-৭৯]
(খ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
'যারা আল্লাহ তা'আলার সীমারেখার ভিতরে এবং যারা সীমারেখা লংঘন করে তাদের দৃষ্টান্ত ঠিক এ রকম যে, কিছু লোক একটি জাহাজের যাত্রী। কিছু সংখ্যক উপর তলায় আর কিছু সংখ্যক নীচ তলায় আরোহণ করেছে। কিন্তু নীচের তলার যাত্রীদের পানির জন্য উপর তলায় যেতে হয়। তারা চিন্তা করল আমরা উপরে পানি আনার জন্য গেলে উপর তলার লোকজন বিরক্ত হয়, তাই আমরা যদি জাহাজ ফুটো করে আমাদের জন্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করি তাহলে ভালই হয়। এমতাবস্থায় যদি উপর তলার লোকজন নীচ তলার এই অবুঝ লোকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা না দেয়, তাহলে জাহাজ ঢুবে গিয়ে উভয় তলার যাত্রীগণ প্রাণ হারাবেন নিঃসন্দেহে। আর যদি তারা বাধা প্রদান করে, তাহলে উভয় তলার যাত্রীরা বেঁচে যাবেন।' [বুখারী : ২৩১৩]
এমনিভাবে সমাজের ভাল লোকেরা যদি পাপাচারে লিপ্তদের পাপ কাজে বাধা না দেন, তাহলে এ পাপের কারণে যে দুর্যোগ নেমে আসবে, তা থেকে কেউ রেহাই পাবে না।

দ্বিতীয়ত : ব্যক্তির দায়িত্ব
মুসলমানের কর্তব্য, অতি তাড়াতাড়ি পাপ থেকে তওবা ও ইস্তেগফার করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের পাপের অংক নিজেই কষে দেখা। অনুরূপভাবে সৎকাজ বেশী-বেশী করা, যাতে সৎকাজগুলো পাপসমূহকে মিটিয়ে দেয়। উপরন্তু যেসব বিষয় মানুষকে পাপকাজে উদ্বুদ্ধ করে তা থেকে সর্বদা দূরত্ব বজায় রাখা।


আমরা কিভাবে পাপ থেকে মুক্ত হতে পারি?

পাপকর্মের সাথে কমবেশী আমরা সবাই জড়িত। তবে পাপীদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাওবা করে। আমাদের মধ্যে কেউ পাপকাজে জড়িয়ে পড়ল। আল্লাহ যা পছন্দ করেন না এমন কাজ করে বসল। একবারের পর আবার করল। অবচেতন নয় বরং সম্পূর্ণ চেতনা নিয়েই করল। তবে পরবর্তীতে সে অনুতপ্ত হল। মানসিকভাবে ব্যাথা অনুভব করল। মনে মনে নিয়ত করল, যদি কাজটা ছেড়ে দিতে পারি তাহলে আর কখনো করব না। কিন্তু কয়েকদিন পর আবার পদস্খলন ঘটল। সে পাপটি আবার করল।
আবার অনেকেই এমন আছেন যারা পাপ করেন সংগোপনে আর মনে মনে বলেন, যদি এই সমস্যাটি না থাকত তাহলে পাপকাজ করতাম না। সমস্যাটি দূর হয়ে গেলে পাপ ছেড়ে ভাল হয়ে যাব।
পাপ করে এ ধরনের মানসিক অবস্থায় যে পড়ে, তার মানবাত্মা জাগ্রত। সে আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন পাপ থেকে বেরিয়ে আসবে, পাপাচারের অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হবে।

পাপাচার থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যম

(১) পাপকে বিপজ্জনক মনে করা ও ক্ষুদ্র হলেও, যে কোন পাপ পরিত্যাগে সচেষ্ট হওয়া :
ঈমানদার ব্যক্তির হৃদয় জুড়ে থাকে প্রতিপালকের ভয়, যার মহিমা-মাহাত্ম্য আলোড়িত করে রাখে তার অন্তর জগৎ সারাক্ষণ। প্রতিপালকের অবাধ্য হওয়া কখনোই শুভ মনে হয় না তার কাছে। পাপ তার কাছে ঘৃণ্য-প্রত্যাখ্যাত বস্তু। ঈমানের পরিধি-পর্যায় অনুযায়ী মুমিন ব্যক্তি আল্লাহকে মনে করে বড়ো, আর পাপকে মনে করে ঘৃণ্য অপরাধ।
উদাহরণত: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঈমানদারদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :
كانوا قليلا من الليل ما يهجعون . وبالأسحار هم يستغفرون. (الذاريات : ১৭-১৮)
'তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করে নিদ্রায়। আর রাতের শেষ প্রহরে নিমগ্ন হয় ক্ষমা প্রার্থনায়।' [সূরা যারিয়াত : ১৭-১৮]
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন :
الذين يقولون ربنا إننا آمنا فاغفر لنا ذنوبنا وقنا عذاب النار. الصابرين والصادقين والقانتين والمنفقين والمستغفرين بالأسحار. (آل عمران : ১৬-১৭)
'যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক ! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং, তুমি আমাদের পাপ ক্ষমা কর এবং আমাদের লেলিহান আগুনের আযাব হতে রক্ষা কর। তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, ব্যয়কারী, এবং শেষ রাতে ক্ষমাপ্রার্থী।' [সূরা আলে ইমরান : ১৬ -১৭]
আল্লাহভীতি ও নৈতিক দায়িত্ববোধের কারণেই উল্লিখিত মুমিনগণ শেষ রাতের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
কিভাবে মুমিনগণ পাপকে ভয়ের বস্তু মনে করে তার একটা দৃষ্টান্ত প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের কথায় পাওয়া যায়।
তিনি বলেন :
إن المؤمن يرى ذنوبه كأنه قاعد تحت جبل يخاف أن يقع عليه، وإن الفاجر يرى ذنوبه كذباب مر على أنفه فقال به هكذا. (رواه البخاري-৬৩০৮(
'পাপ, ঈমানদার ব্যক্তির কাছে এমন মনে হয়্তযেন সে পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে। আর এ ভয়ে ভীত যে, পাহাড়টি পড়ে যাবে তার মাথায়। অপরপক্ষে, একজন দুষ্ট ব্যক্তি তার পাপকে দেখে মনে করে মাছি সম, যা তার নাগের ডগা স্পর্শ করে চলে গেছে।' [বুখারী : ৬৩০৮]
আনাস রা. বলেন :
إنكم لتعملون أعمالا هي أدق في أعينكم من الشعر، إن كنا لنعدها على عهد النبي صلى الله عليه وسلم من الموبقات.(رواه البخاري: ৬৪৯২)
'এমন অনেক কাজ তোমরা কর, যা তোমাদের নজরে চুলের চেয়েও সরু অথচ আমরা নবী কারীম সা. এর যুগে সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক পাপ বলে জ্ঞান করতাম।' [বুখারী : ৬৪৯২]
তাবেয়ীদের লক্ষ্য করে তিনি তার এ মন্তব্য করেছিলেন। আমাদের অবস্থা দেখে তিনি কি মন্তব্য করতেন, তা বলাই বাহুল্য।

(২) পাপ ছোট হলেও তা তুচ্ছ জ্ঞান করতে নেই :
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
إياكم ومحقرات الذنوب، فإنما مثل محقرات الذنوب كقوم نزلوا بطن واد فجاء ذا بعود وجاء ذا بعود، حتى أنضجوا خبزتهم، وإن محقرات الذنوب متى يؤخذ بها صاحبها. رواه أحمد২২৮০৮ وصححه الألباني في الجامع:২৬৮৬
'ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গুনাহ থেকেও সাবধান হও। ক্ষুদ্র গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত সেই পর্যটক দলের মতো যারা একটি উপত্যকায় অবতরণ করল। তাদের একজন একটি কাষ্ঠখন্ড নিয়ে এল। অপরজন আরেকটি। আর এভাবেই তাদের রুটি ছেঁকা সম্পন্ন হল। এবং ছোট গুনাহের কারণে যদি কাউকে পাকড়াও করা হয় তবে তা তার ধ্বংসের কারণ হবে।'
ইবনুল মু'তিয বলেছেন :
خل الذنوب صغيرها وكبيرها ذاك التقى
واصنع كماش فوق أرض الشوق يحذر ما يرى
لا تحقرن صغيرها إن الجبال من الحصى
ছেড়ে দাও পাপ ছোট বড় সব্ত এটাই পরহেযগারী।
কন্টকাকীর্ণ জমিনে পথচলা ব্যক্তির ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি সক্রিয় কর।
তোমাদের পাপের মধ্যে যেগুলো ছোট, তুচ্ছ জ্ঞান করোনা সেগুলোকেও ;
ছোট ছোট পাথর দিয়েই তো বনেছে সুবিশাল পর্বত।

(৩) পাপ করে প্রকাশ না করা :
হাদীসে এসেছ্তে
عن سالم بن عبد الله قال: سمعت أبا هريرة يقول : سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول :كل أمتي معافى إلا المجاهرين، وإن من المجاهرة أن يعمل الرجل بالليل عملا ثم يصبح وقد ستر الله فيقول: يا فلان قد عملت البارحة كذا وكذا، وقد بات يستره ربه ويصبح يكشف ستر الله عنه. (رواه البخاري -৬০৬৯ و مسلم:২৯৯০)
সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবু হুরাইরাহ -কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : 'প্রকাশ্যে পাপকারীরা ব্যতীত আমার সকল উম্মত ক্ষমাপ্রাপ্ত। প্রকাশ্যে পাপ করার মধ্যে এটাও যে, রাতে কোন ব্যক্তি খারাপ কাজ করল। আল্লাহ তার এ কাজটি গোপন রাখা সত্ত্বেও সে দিনের বেলায় বলে বেড়াল: শুনছেন ! আমি গত রাতে এই-এই করেছি। সে রাত কাটাল এ অবস্থায় যে, তার প্রতিপালক তার পাপ গোপন করে রাখলেন। আর তার সকাল হল এ অবস্থায় যে, আল্লাহ যা গোপন করলেন সে তা ফাঁস করে দিল।'
(বুখারী ৬০৬৯, মুসলিম-২৯৯০)
সুতরাং, কোন ব্যক্তি যদি পাপকার্য করে বসে তার উচিত হবে গোপন করে রাখা ; কেননা, আল্লাহ তা গোপন রেখেছেন। পাশাপাশি পাপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
পাপের সম্পৃক্ততায় আসার পর কীভাবে তার প্রতিকার সম্ভব, এ ব্যাপারে প্রাজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তবে প্রশ্ন করার সময় গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশে এভাবে বলতে হবে যে, যদি কোন ব্যক্তি এই ধরনের পাপ করে বসে তাহলে তার প্রতিকার কী ?

(৪) অনতিবিলম্বে খাঁটি তওবা করা :
ইরশাদ হয়েছে :
توبوا إلى الله جميعا أيها المؤمنون لعلكم تفلحون. (النور : ৩১)
'হে মুমিনগণ ! তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।' (সূরা নূর : ৩১)
يا أيها الذين آمنوا توبوا إلى الله توبة نصوحا عسى ربكم أن يكفر عنكم سيئاتكم ويدخلكم جنات تجري من تحتها الأنهار يوم لا يخزى الله النبي والذين آمنوا معه نورهم يسعى بين أيديهم وبأيمانهم يقولون ربنا أتمم لنا نورنا واغفر لنا إنك على كل شيء قدير- (سورة التحريم : ৮)
যারা তওবা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ভালবাসেন।
তিনি বলেন :
إن الله يحب التوابين ويحب المتطهرين. (البقرة :২২২)
'নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।' [সূরা আল-বাকরা: ২২২]
তওবার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য উল্লিখিত কয়েকটি আয়াত যথেষ্ট। তওবা সম্পর্কিত সবগুলো আয়াত লেখার প্রয়োজন নেই। তওবাকারীর প্রতি আল্লাহ তা'আলা কতটা খুশী হন, তা উল্লেখ করাও প্রাসঙ্গিক মনে করি। হাদীসে এসেছে :
لله أشد فرحا بتوبة عبده المؤمن، من رجل في أرض دوية مهلكة معه راحلته عليها طعامه وشرابه فنام فاستيقظ وقد ذهبت فطلبها حتى أدركه العطش ثم قال: أرجع إلى مكاني الذي كنت فيه فأنام حتى أموت، فوضع رأسه على ساعده ليموت ، فاستيقظ وعنده راحلته وعليها زاده وطعامه وشرابه ، فالله أشد فرحا بتوبة العبد المؤمن من هذا براحلته وزاده
) رواه البخاري-৬৩০৮ ومسلم -২৭৪৪(
'আল্লাহ তার বান্দার তাওবায় ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট হারিয়ে ফেলেছে এক জনমানবশূন্য ভয়ংকর প্রান্তরে। উটের পিঠে ছিল খাদ্য ও পানীয়। এরপর সে ঘুমিয়ে পড়ল। জাগ্রত হয়ে সে আবার উটের খোঁজে বের হল। একসময় তার তেষ্টা পেল। সে মনে মনে বলল, যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাই। অতঃপর মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি। মৃত্যু অবধারিত জেনে বাহুতে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল। জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল, হারিয়ে যাওয়া উট তার পাথেয়-খাদ্য-পানীয় নিয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে। এই ব্যক্তি তার উট ও পাথেয় ফিরে পেয়ে যতদূর খুশি হয়েছে তার থেকেও অধিক খুশি হন আল্লাহ তা'আলা বান্দার তাওবায়।' [বুখারী-৬৩০৮ ও মুসলিম-২৭৪৪]
পাপ সংঘটিত হলে উচিত হল অনতিবিলম্বে তাওবা করা; কারণ হায়াত আল্লাহর হাতে। যে কোন মুহূর্তে মৃত্যুর কঠিন থাবা তার জীবনাবসান ঘটাতে পারে।
অপরদিকে উলামায়ে কেরাম বলেছেন, 'পাপ সংঘটিত হলে বিলম্ব না করে তওবা করা ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। যে ব্যক্তি তাওবা করতে দেরী করে, সে আরেকটি পাপে জড়িয়ে পড়ে।'
তাওবা করতে হবে মনে-প্রাণে। এমন যেন না হয় যে, মুখে মুখে বললাম, 'হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা কর' আর অন্তর থাকল গাফেল।

(৫) যতবার পাপ ততবার তওবা :
নবী কারীম  বলেছেন :
إن عبدا أصاب ذنبا فقال رب أذنبت ذنبا فاغفرلي فقال ربه : أعلم عبدي أن له ربا يغفر الذنب ويأخذ به ؟ غفرت لعبدي، ثم مكث ماشاء الله ثم أذنب ذنبا فقال: رب أذنبت ذنبا فاغفرلي فقال ربه : أعلم عبدي أن له ربا يغفر الذنب ويأخذ به ؟ غفرت لعبدي ثم مكث ماشاء الله ثم أذنب ذنبا فقال: رب أذنبت ذنبا فاغفرلي فقال ربه : أعلم عبدي أن له ربا يغفر يغفر الذنب ويأخذ به غفرت لعبدي ثلاثا فليعمل ما شاء. رواه البخاري-৭৫০৭ ومسلم -২৭৫৮
'এক বান্দা পাপ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক ! আমি তো অপরাধ করে ফেলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি অবগত তার একজন প্রতিপালক আছে, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন ? আচ্ছা আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। এরপর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলে সে আরেকটা পাপে জড়িয়ে পড়ল, এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক ! আমার দ্বারা পুনরায় অপরাধ সংঘটিত হয়ে গিয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি অবগত তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন ? আচ্ছা, আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। এরপর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলে আবার সে একটি পাপ করে বসল, ও বলল, হে আমার প্রতিপালক ! আমি তো অপরাধ করে ফেলেছি আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি জানে তার একজন প্রতিপালক আছেন যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন ? আচ্ছা আমি আমার বান্দাকে তিনবার ক্ষমা করলাম। এরপর যা ইচ্ছে সে করতে পারে। [বুখারী -৭৫০৭ও মুসলিম-২৭৫৮]
যে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, সে যখন আল্লাহ তা'আলার ক্ষমার এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবে, তখন সে বলবে, আমি প্রথমবার অন্যায় করে ক্ষমা পেয়েছি। দ্বিতীয়বার অন্যায় করেও যখন ক্ষমা লাভ করেছি, তৃতীয়বার আমি আর অপরাধ করতে চাইনা। বরং এ ক্ষমা নিয়ে যেন আমার ইন্তেকাল হয়। রাসূলুল্লাহ সা.-এর এ হাদীস তাকে বার বার পাপ করার উৎসাহে বাধা প্রদান করবে।

(৬) যে সকল বিষয় পাপের দিকে নিয়ে যায় তা বর্জন করা :
পাপের পিছনে কিছু কারণ ও ভূমিকার উপস্থিতি অনিবার্য। যেগুলোর কারণে পাপের পথে চলা সহজতর হয়। পাপ সংঘঠিত হতে থাকে র্নিবিঘ্নে। পাপী যখন পাপে সর্বশক্তি নিয়োগ করে পাপ থেকে প্রত্যাবর্তনের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে, লুপ্ত হয় তার সজ্ঞান চেতনা, তখন তার সংশোধনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এ কথাটি অনুধাবন করেছিলেন সেই আলেম, যিনি একশ মানুষের খুনী ব্যক্তির ব্যাপারে ফতোয়া দিয়েছিলেন। হাদীসে এসেছে :
عن أبي سعيد الخدري رضى الله عنه أن نبي الله صلى الله عليه وسلم قال: كان فيمن كان قبلكم رجل قتل تسعا وتسعين نفسا، فسأل عن أعلم أهل الأرض ، فدل على راهب، فأتاه فقال: إنه قتل تسعا و تسعين نفسا فهل له من توبة ؟ فقال: لا، فقتله فكمل به المائة، ثم سأل عن أعلم أهل الارض، فدل على رجل عالم، فقال: إنه قتل مائة نفس فهل له من توبة ؟ فقال : نعم ومن يحول بينه وبين التوبة ؟ انطلق إلى أرض كذا وكذا، فإن بها أناسا يعبدون الله فاعبد الله معهم ولا ترجع إلى أرضك فإنها أرض سوء، فانطلق حتى إذا نصفه الطريق أتاه الموت، فاختصمت فيه ملائكة الرحمة وملائكة العذاب، فقال ملائكة الرحمة : جاء تائبا مقبلا بقلبه إلى الله، وقالت ملائكة العذاب : إنه لم يعمل خيرا قط، فأتاهم ملك في صورة آدمي، فجعلوه بينهم فقال : قيسوا ما بين الأرضين، فإلى أيتهما كان أدنى فهو له، فقاسوه فوجدوه أدنى إلى الأرض التي أراد، فقبضته ملائكة الرحمة.
(رواه البخاري:৩৪৭০ ومسلم : ২৭৬৬)
আবু সায়ীদ খুদরী রহ. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সা. বলেন :্ত তোমাদের পুর্ববর্তী যুগে এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করল। এরপর সে তার পাপের পরিণাম জানার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের কথা জিজ্ঞেস করল। লোকেরা তাকে একজন সংসার-বিরাগী পাদ্রীর সন্ধান দিল। সে তার কাছে গিয়ে বলল, আমি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করেছি। এখন তওবার কোন সুযোগ আছে কি? পাদ্রী বলল, না, নেই। এতে লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে সেই পাদ্রীকে হত্যা করে একশ পূর্ণ করল। এরপর সে আবার একজন আলেমের সন্ধান করল তার পাপের পরিণাম জিজ্ঞেস করার জন্য। লোকজন তাকে একজন আলেমের সন্ধান দিলে সে তার কাছে গিয়ে বলল, আমি একশজন মানুষ হত্যা করেছি। এর থেকে তাওবার কোন সুযোগ আছে কি না ? আলেম বললেন, হ্যাঁ, তাওবার সুযোগ আছে। তোমার ও তাওবার মধ্যে প্রতিবন্ধক কোন কিছু থাকতে পারে না। তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছুলোক আল্লাহর ইবাদত করছে। তুমিও তাদের সাথে ইবাদত কর এবং তোমার দেশে ফিরে যেও না। কারণ, তা খারাপ স্থান। লোকটি নির্দেশিত স্থানে গমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। মাঝ পথে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তার প্রাণ গ্রহণের জন্য রহমতের ফেরেশ্‌তা ও শাস্তির ফেরেশ্‌তাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। রহমতের ফেরেশ্‌তারা বলল, লোকটি মনে-প্রাণে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। তাই, আমরা তার আত্মা গ্রহণ করব। শাস্তির ফেরেশ্‌তাদের অভিমত ছিল, লোকটি কখনো ভাল কাজ করেনি। সে পাপী। তাই আমরা তাকে গ্রহণ করব। তখন মানুষের রূপ ধারণ করে একজন ফেরেশ্‌তা এসে তাদের বিতর্কের সমাধান বাতলে দিয়ে বলল, তোমরা তার উভয় পথ্তযে পথ সে অতিক্রম করে এসেছে, ও যে পথ তার সম্মুখে রয়েছ্তেমেপে দেখ। উভয়ের মধ্যে যা নিটকতম, সে অনুযায়ী তার ফয়সালা হবে। মাপ দেয়া হল। দেখা গেল, সে তার গন্তব্যের দিকেই অধিক এগিয়ে আছে। অতঃপর রহমতের ফেরেশতারাই তার প্রাণ গ্রহণ করল এবং। [বুখারী ও মুসলিম]
সে হিসেবে আমাদের কর্তব্য, যে সাহচর্য পাপের পথে নিয়ে যায়, যেসব দেখা-সাক্ষাত পাপের দুয়ার খুলে দেয়, যে সকল দর্শন ও শ্রবণ পাপপ্রবৃক্তিকে সুড়সুড়ি দেয়, তা পরিহার করে চলা।
অনুরূপ যদি বাজারে গমন, টেলিভিশন দেখা, পত্রিকা পড়া ইত্যাদি পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে এগুলোও পরিহার করে চলতে হবে অথবা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে এ জাতীয় সম্পৃক্ততা।

(৭) সর্বদা আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নিকট ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য মানুষকে উৎসাহ ও নির্দেশ দিয়েছেন।
অনুরূপ, নবীগণও মানুষকে ইস্তেগফারের নির্দেশনা দিয়েছেন, উদ্দীপিত করেছেন বিপুলভাবে।
নূহ আ.-এর ইস্তেগফারের আলোচনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। নূহ আ. বলতেন :
رب اغفرلي ولوالدي ولمن دخل بيتي مؤمنا وللمؤمنين والمؤمنات ولا تزد الظالمين إلا تبارا.)سورة نوح : ২৮(
'হে আমার প্রতিপালক ! তুমি ক্ষমা কর আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং যারা ঈমানদার হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে, তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে ; আর যালিমদের বেলায় বৃদ্ধি কর ধ্বংস ও বিলোপ।' [সূরা নূহ : ২৮]
অপরদিকে, মূসা আ. এর ইস্তেগফারের কথা আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এভাবে:
إن هي إلا فتنتك تضل بـها من تشاء وتهدي من تشاء أنت ولينا فاغفرلنا وارحمنا وأنت خير الغافرين. (الأعراف : ১৫৫)
'এ তো শুধু তোমার পরীক্ষা, যা দ্বারা তুমি যাকে ইচ্ছা বিপথগামী কর আর যাকে ইচ্ছা দান কর হেদায়েতের আলো। তুমিই তো আমাদের অভিভাবক; সুতরাং, আমাদেরকে ক্ষমা কর ও আমাদের প্রতি দয়া কর আর ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ।' [সূরা আল আ'রাফ : ১৫৫]
ইব্রাহীম আ. এর ক্ষমা ও ইস্তেগফারের আলোচনা উল্লেখ করে কোরআনে এসেছে :
ربنا اغفرلي ولوالدي وللمؤمنين يوم يقوم الحساب. (سورة إبراهيم : ৪১)
'হে আমার প্রতিপালক ! যে দিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সে দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করে দিও।' [সূরা ইবরাহীম :৪১]
পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার সাথে সাথে ইস্তেগফার করা যায়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
إن المؤمن إذا أذنب كانت نكتة سوداء في قلبه، فإن تاب ونزع واستغفر صقل قلبه، وإن زاد زادت، حتى يعلو قلبه ذاك الران الذي ذكر الله عز وجل في القرآن (كلا بل ران على قلوبهم ما كانوا يكسبون. (رواه الترمذي:৩৩৩৪)
মুমিন ব্যক্তি যখন কোন পাপ কাজে লিপ্ত হয়, তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে। যখন সে তওবা করে, ফিরে আসে, এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তখন তার অন্তরাত্মা পরিস্কার হয়ে যায়, মুছে যায় সে কালো দাগের স্মৃতি। পাপ বেড়ে গেলে অন্তরের কাল দাগও বেড়ে যায়। পরিণতিতে তার হৃদয় ঢেকে যায় প্রবল অন্ধকারাচ্ছন্নতায়। এটা সেই মর্চে, যার কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এভাবে বলেছেন, 'কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে মর্চে ধরিয়েছে।'
[সূরা মুতাফফিফীন:১৪] (তিরমিযী : ৩৩৩৪)
ইস্তেগফার ইবাদতের একটি মহোত্তম অংশ। তাই সালাত আদায়ের পর ইস্তেগফার করতে বলা হয়েছে।
হাদীসে এসেছে :
عن ثوبان رضى الله عنه قال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا انصرف من صلاته استغفر ثلاثا. (رواه مسلم-৫৯১)
ছাওবান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  যখন সালাত শেষ করতেন তিন বার আস্তাগফিরুল্লাহ (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) বলতেন। [মুসলিম-৫৯১]

পবিত্র হজ আদায়কালে ইস্তেগফার করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন :
ثم أفيضوا من حيث أفاض الناس واستغفروا الله إن الله غفور رحيم.
(سورة البقرة :১৯৯)
'অতঃপর লোকেরা যেখান হতে প্রত্যাবর্তন করে, তোমরাও সেখান হতে প্রত্যাবর্তন করবে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' [সূরা বাকারা : ১৯৯]
ইসলামী শরীয়তে যে সকল যিকির-আযকারের প্রমাণ মিলে, সালাতের বইরে কিংবা ভিতরে ; তার মধ্যে ইস্তেগফার একটি গুরুত্বপূর্ণ যিকির। হাদীসে এসেছে :
عن عائشة رضى الله عنها أنها قالت : 'كان النبي صلى الله عليه وسلم يكثر أن يقول في ركوعه وسجوده (سبحانك اللهم ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي' يتأول القرآن . (رواه البخاري-৮১৭ ومسلم -৪৮৪)
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবী কারীম সা. রুকু ও সিজদাতে বেশী করে বলতেন, হে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ ! তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি তোমার প্রসংশা করছি, হে আল্লাহ তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তিনি কুরআনের আয়াতের শিক্ষায় এ কাজটি করতেন। [বুখারী : ৮১৭ও মুসলিম-৪৮৪]
عن أبي هريرة رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يقول في سجوده : اللهم اغفرلي ذنبي كله، دقـه وجله، أولـه وآخره، علانيته وسره . (رواه مسلم-৪৮৩)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. সিজদাবস্থায় বলতেন: 'হে আল্লাহ! আমার সকল পাপ; ছোট ও বড়, সূচনা ও সমাপ্তি, প্রকাশ্য ও গোপন্তক্ষমা করে দাও। [মুসলিম-৪৮৩]
সালাতের বাইরে দিবা-রাত্রির যিকিরের মধ্যেও ইস্তেগফার রয়েছে। হাদীসে এসেছ্তে
عن شداد بن أوس عن النبي صلى الله عليه وسلم : سيد الاستغفار أن تقول: أللهم أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتني وأنا عبدك وأنا على عهدك ووعدك ما استطعت أعوذبك من شر ما صنعت أبوء لك بنعمتك علي وأبوء بذنبي فاغفرلي فإنه لا يغفر الذنوب إلا أنت. قال : ومن قالها من النهار موقنا بـها فمات من يومه قبل ان يمسي فهو من أهل الجنة، ومن قالها من الليل وهو موقن بـها ، فمات قبل أن يصبح فهو من أهل الجنة. (رواه البخاري-৫৮৩১)
সাদ্দাদ বিন আউস রা. নবী কারীম সা. থেকে বর্ণনা করেন, 'শ্রেষ্ঠ ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনার বাক্য) হল, তুমি এভাবে বলবে, হে আল্লাহ ! তুমি আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন মা'বুদ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আর আমি তোমার বান্দা। তোমার সাথে কৃত ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির উপর আমি আমার সাধ্যমত অটল রয়েছি। আমি যা কিছু করেছি তার অপকারিতা হতে তোমার আশ্রয় নিচ্ছি। আমার প্রতি তোমার যে নিআ'মত তা স্বীকার করছি। আর স্বীকার করছি তোমার কাছে আমার অপরাধ। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি ছাড়া আর কেউ ক্ষমা করতে পারে না।'
যে ব্যক্তি সকালে দৃঢ় বিশ্বাসে এটা পাঠ করবে, সে যদি ঐ দিনে সন্ধ্যার পূর্বে মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত হবে। আর যদি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সন্ধ্যায় পাঠ করে, আর সকাল হওয়ার পূর্বে সে ইন্তেকাল করে, তাহলে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।' [বুখারী -৫৮৩১]
রাসূলে কারীম সা. বেশি-বেশি ইস্তেগফার করতেন।

আবু হুরাইরা  বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
والله إني لاستغفر الله وأتوب إليه في اليوم أكثر من سبعين مرة. (رواه البخاري:৬৩০৭)
'আল্লাহ তা'আলার শপথ ! আমি দিনে সত্তর বারের বেশী আল্লাহর নিকট তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করি।' [বুখারী-৬৩০৭]
ইবনে উমর রা. বলেন, একদিন এক মজলিসে আমরা গণনা করলাম যে, রাসূলুল্লাহ সা. একশত বার বলেছেন, হে আমার প্রতিপালক ! আমাকে ক্ষমা করুন। আমার তাওবা কবুল করুন। আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল ও দয়াময়। [আবু দাউদ-১৫১৬]

(৮)পাপের পর সৎ-কর্ম করা যাতে সৎ-কর্ম পাপকে মিটিয়ে দেয়:
হাদীসে এসেছ্তে
عن ابن مسعود رضى الله عنه أن رجلا أصاب امرأة قبلة فأتى النبي صلى الله عليه وسلم فأخبره فأنزل الله : (وأقم الصلاة طرفي النهار وزلفا من الليل إن الحسنات يذهبن السيئات) فقال الرجل : يارسول الله ألي هذا ؟ قال: لجميع أمتي كلهم.(رواه البخاري:৫২৬ ومسلم :২৭৬৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, জনৈক পুরুষ অবৈধভাবে এক মহিলাকে চুমো দিল। সে নবী কারীম সা. এর কাছে পাপের কথা স্বীকার করল। পরক্ষনে আল্লাহ তার বাণী নাযিল করলেন : 'তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দু' প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম অবশ্যই পাপকর্ম মিটিয়ে দেয়।' এ কথা শুনে লোকটি বলল, হে রাসূল ! এ সুসংবাদ কি আমার জন্য ? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন : 'আমার উম্মতের সকলের জন্য।' [বুখারী-৫২৬ ও মুসলিম-২৭৬৩]
অনুরূপভাবের আরো অনেক হাদীস রয়েছে, যা প্রমাণ করে নেক-আমল (সৎকর্ম) পাপসমূহকে মুছে দেয়।
হাদীসে এসেছে :্ত
عن أبي هريرة رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " إذا توضأ العبد المسلم أو المؤمن فغسل وجهه خرج من وجهه كل خطيئة نظر إليها بعينه مع الماء أو آخر قطر الماء ، فإذا غسل يديه خرج من يديه كل خطيئة كان بطشتها يداه مع الماء أو آخر قطر الماء، فإذا غسل رجليه خرجت كل خطيئة مشتها رجلاه مع الماء أو مع آخر قطر الماء حتى يخرج نقيا من الذنوب. (رواه مسلم:২৪৪)
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন : 'মুসলিম বা মুমিন বান্দা যখন অজু করে, অত:পর মুখমন্ডল ধোয়, পানির সাথে অথবা পানির শেষ ফোটার সাথে তার চেহারা থেকে ঐসব পাপ বের হয়ে যায় যা সে চক্ষু দিয়ে দেখেছে। সে যখন হাত ধোয়, পানির সাথে অথবা পানির শেষ ফোটার সাথে তার দু'হাত হতে এমনসব পাপ বের হয়ে যায়, যা সে হাত দ্বারা করেছে। এরপর সে যখন দু'-পা ধৌত করে, তখন পানির সাথে বা পানির শেষ ফোটার সাথে তার পা থেকে এমন সব পাপ বের হয়ে যায়, যা সে পায়ে হেঁটে গিয়ে করেছে। ' [মুসলিম-২৪৪]
এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল অজু পাপসমূহকে মিটিয়ে দেয়। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মতোই যার ব্যাপারে হাদীসে বক্তব্য এসেছ্তে
আবু হুরাইরা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছেন : 'তোমাদের কি মনে হয়, যদি তোমাদের কারো বাড়ীর সম্মুখে একটি প্রবাহমান নদী থাকে আর তাতে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে তাহলে কি তার শরীরে কোন ময়লা থাকবে ? সাহাবীগন বললেন, না, থাকবে না। রাসূল সা. বললেন : 'পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের এটাই উদাহরণ, যার মাধ্যমে পাপসমূহ আল্লাহ তা'আলা দূর করে দেন।' [বুখারী-৫২৮ ও মুসলিম ৬৬৭]

(৯) তাওহীদ বা আল্লাহর একাত্ববাদের যথার্থ বাস্তবায়ন :
عن أبي ذر رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يقول الله عز وجل : " من جاء بالحسنة فله عشر أمثالها وأزيد، ومن جاء بالسيئة فجزاؤه سيئة مثلها، أو أغفر، ومن تقرب مني شبرا تقربت منه ذراعا، ومن تقرب مني ذراعا تقربت منه باعا، ومن آتاني يمشي أتيته هرولـة، ومن لقيني بقراب الأرض خطيئة لا يشرك بي شيئا لقيته بمثلها مغفرة -)رواه مسلم২৬৮৭(
আবু যর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,'আল্লাহ তা'আলা বলেন : 'সৎকাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে দেই দশগুণ বা তার থেকেও বেশী ছোয়াব। আর অন্যায়কারীকে দিই তার পাপের সমপরিমাণ শাস্তি, অথবা ক্ষমা করে দেই। যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে একহাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয় আমি তার দিকে এক কায়া পরিমান এগিয়ে যাই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। আর যদি কোন ব্যক্তি শিরক না করে পৃথিবীভরা পাপ নিয়েও আমার সাক্ষাতে আসে, তাহলে আমি সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তাকে গ্রহণ করি। [মুসলিম : ২৬৮৭]
তাওহীদ বাস্তবায়ন মুসলিম ব্যক্তির আচার-আচরণ পরিশুদ্ধ করে। মানুষকে পাপাচার পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহকে এক বলে জানা, তাঁকে ভালবাসা, আল্লাহ কেন্দ্রিক বন্ধুত্ব ও শক্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলা, সকল কাজে তাওহীদের শিক্ষা-অনুভূতি জাগ্রত রাখা পাপাচার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে সন্দেহাতীতভাবে। যে ব্যক্তির তাওহীদী চেতনা দুর্বল-ম্রিয়মান, জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকা তাঁর পক্ষে দুষ্কর হবে বৈকি। যার তাওহীদী চেতনা সদা-জাগ্রত জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করার অজুহাত খুঁজে পাবে না। তাই, তাওহীদের ভাব-চেতনা-ধারণা সচল ও জাগ্রত রাখা ভিন্ন আমাদের গত্যন্তর নেই।

(১০) সৎলোকের সাহচর্য অবলম্বন করা :
সৎমানুষের সাহচর্য পাপ থেকে দূরে থাকার বড় একটি মাধ্যম। কিন্তু সমস্যা হল, পাপী ব্যক্তি নিজেকে সৎ মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ার উপযোগী মনে করে না। সে ভাবে, আমার মতো একজন পাপীর পক্ষে সৎমানুষের সঙ্গ লাভ কি করে সম্ভব ? আসলে এ ধরনের দৃষ্টিভংগী এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যা সৃষ্টি হয়েছে পাপের আধিক্যের কারণে ও শয়তানের কু-মন্ত্রণায়। এক ধরনের নৈরাশ্যও অবশ্য এর পেছনে কার্যকর, তা স্বীকার করে নিতে হবে কোন বাধা নেই। এ প্রকৃতির মানসিক ব্যধির চিকিৎসা করা জরুরি। নিজেকেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় ভেবে দেখা যেতে পারে।
প্রথমত : সৎলোকের সঙ্গ লাভের চেষ্টা করা একটি ভাল কাজ, আল্লাহর একটি ইবাদত।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله: الإمام العادل، وشاب نشأ في عبادة ربه، ورجل قلبه معلق بالمساجد، ورجلان تحابا في الله اجتمعا عليه وتفرقا عليه، ورجل طلبته امرأة ذات منصب وجمال فقال إني أخاف الله، ورجل تصدق أخفى حتى لا تعلم شماله ماذا تنفق يمينه، ورجل ذكر الله خاليا ففاضت عيناه. (رواه البخاري ومسلم وللفظ للبخاري)
যেদিন আল্লাহ তা'আলার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তার ছায়াতলে স্থান দিবেন।
এক. সুবিচারক ইমাম শাসক।
দুই. আল্লাহর ইবাদতে যে যুবক মগ্ন থেকেছে।
তিন. যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকত।
চার. যে দুজন লোক একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে একে অপরকে ভালবাসে এবং আল্লাহর জন্য একত্র হয় ও আল্লাহর জন্য বিচ্ছিন্ন হয়।
পাঁচ. যাকে কোন সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত নারী ব্যভিচারের জন্য ডেকেছে, কিন্তু সে এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যে আমি আল্লাহকে ভয় করি।
ছয়. যে ব্যক্তি এতটা গোপনে দান করে যে, ডান হাতে যা দান করে বাম হাত তা জানে না।
সাত. যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রু ঝড়ায়। [বুখারী-৬৬০]
এ হাদীসে দু'ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর জন্য সৎসঙ্গ অবলম্বন করেছে ; তারা আমাদের এ আলোচ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই সৎসঙ্গ অবলম্বন করা একটি ইবাদত।
দ্বিতীয়ত : সৎ ও নেককার লোকদের মহব্বত করলে তাদের সাথে অবস্থ্‌ান করার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদিও তাদের মর্যাদা পাওয়া না যায়। হাদীসে এসেছ্তে
عن أبي موسى الأشعري رضى الله عنه قال : قيل للنبي صلى الله عليه وسلم : الرجل يحب القوم ولما يلحق بهم ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : المرء مع من أحب. (رواه البخاري৬১৭০ ومسلم :২৬৪১)
আবু মূসা আশ'আরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সা.-কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি যদি এক সম্প্রদায়কে ভালবাসে তাহলে সে তাদের সাথে কেন অবস্থান করবে না ? উত্তরে রাসূহুল্লাহ সা. বললেন : 'ব্যক্তি তার সাথে থাকবে যাকে সে ভালবাসে।' [বুখারী-৬১৭০ ও মুসলিম-২৬৪১]
রাসূলে কারীম সা. থেকে যখন বিষয়টি প্রমাণিত তখন আমাদের নেক ও সৎলোকদের ভালবাসতে কতটা যত্নবান হওয়া উচিত ? যদি আমরা মনে করি মর্যাদায় আমরা তাদের সমকক্ষ হতে পারব না। কিন্তু এটা অসম্ভব নয় যে আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা দেখে তাদের মত মর্যাদা আমাদের দান করবেন, কিয়ামতে তাদের সাথে আমাদের অবস্থানের সুযোগ করে দিবেন।
তৃতীয়ত : পাপের সংস্পর্শে আসা ও পাপ বর্জন হিসেবে মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত :
এক. যারা নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে, তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করে ও সকল পাপাচার থেকে দূরে থাকে। এরা হল সর্বোত্তম মানুষ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন।
দুই. যারা পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, পাপ করে অনুতপ্ত হয়, অনুশোচনা করে। মনে করে আমি চরম অন্যায় করে ফেলেছি। এবং এ পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠে।
তিন. যারা পাপ করে আনন্দিত হয়। পাপ কাজ খুঁজে বেড়ায়। পাপ করতে না পারলে অনুশোচনা করে বা অনুতপ্ত হয়।
এখন আমাদের ভাবতে হবে যে, যদিও আমরা প্রথম প্রকারের মতো হতে পারিনি কিন্তু আল্লাহর কাছে সর্বদা কামনা করব, আমরা যেন তাদের সমমর্যাদা লাভে ধন্য হই।
আর দ্বিতীয় প্রকারে অন্তর্ভূক্ত হওয়া তৃতীয় প্রকার মানুষদের মধ্যে গণ্য হওয়ার চেয়ে অনেক ভাল ও নিরাপদ।
যদি আমরা সৎ লোকের সঙ্গ লাভ করার চেষ্টা করি তবে হয়ত তৃতীয় প্রকার মানুষদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারব। প্রচেষ্টায় আমরা আন্তরিক হলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়ত বা আমাদের প্রথম প্রকারের মানুষে রূপান্তরিত করে দিবেন।
চতুর্থত : পাপ করে অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা বোধ করা বা মনের বিষণ্নতা যা অনেক ক্ষেত্রে সৎ-সঙ্গের কারণে সৃষ্টি হয়। যখন সৎ-সঙ্গ পরিহার করা হয় তখন পাপের প্রতি ঘৃণা ও অনুশোচনা কমে যেতে থাকে। যদি সৎলোকের সঙ্গ পরিহার করা হয় তাহলে পাপের প্রতি ঘৃণাবোধ চলে যায়। আর যদি সৎলোকের সাথে চলাফেরা করা হয় তখন মনে মনে এমন চিন্তা আসে যে আমার সাথের লোকগুলো আমার চেয়ে কত ভাল ! কত পবিত্র তাদের জীবনযাপন। এ ধরনের চিন্তা ও মানসিকতা পাপকাজ ত্যাগ করতে ভূমিকা রাখে যা সৎসঙ্গের কারণে সৃষ্টি হয়।

(১১) ধৈর্য্য ও অন্তরের দৃঢ়তা :
মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের জন্য ঐ সকল বিষয়ই হারাম বা অবৈধ করেছেন, যা মানুষ পরিহার করে চলতে পারে। তেমনি তিনি ঐ সব বিষয় মানুষকে করতে বলেছেন যা সে করার সামর্থ্য রাখে। যা নিষিদ্ধ, তা আপনি অবশ্যই পরিহার করার ক্ষমতা রাখেন। পাপ পরিহার করা কখনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। প্রয়োজন শুধু অন্তরের দৃঢ়তা, অবিচল সাহস।
মনে রাখা প্রয়োজন 'কঠিন ও অসম্ভব' শব্দ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। পাপ পরিহার করা কারো জন্য কঠিন হতে পারে, তবে কারও পক্ষেই তা অসম্ভব নয়।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
حجبت النار بالشهوات وحجبت الجنة بالمكاره. (رواه البخاري:৬৪৮৭ ومسلم :২৮২৩)
'জাহান্নাম মনের কু-প্রবৃত্তি দ্বারা ঢেকে দেয়া হয়েছে আর জান্নাত কঠিন কাজ দ্বারা আবৃত্ত করা হয়েছে।' [বুখারী : ৬৪৮৭ ও মুসলিম : ২৮২৩]
এ হাদীসের মর্ম কথা হল ভাল কাজ করা ও পাপ থেকে ফিরে থাকা কঠিন। আর পাপ কাজ করা সহজ। যদি এ কঠিনকে জয় করা যায় তাহলে জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। আর মন যা কিছু চায় তা করা সহজ হলেও তা দিয়ে শুধু জাহান্নামের পর্দা উম্মুক্ত করা হয়।
অতএব পাপাচার থেকে বিরত থাকার জন্য ধৈর্য্য, উন্নত মানসিকতা, মনের দৃঢ়তা ও সাহস সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

(১২) পাপের বিপদ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা :
ইবনুল কায়্যিম রহ. এ বিষয়ে 'আল-জওয়াবুল কাফি' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি এক ব্যক্তির উদ্দেশে পাপের কিছু পরিণাম লিপিবদ্ধ করেছেন যা থেকে কোনভাবেই পাপী ব্যক্তি মুক্ত হতে পারে না। তিনি লিখেছেন :্ত
(ক) আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পাপের শাস্তির কথা বলে দিয়েছেন ও পরকালে শাস্তি প্রদানের ওয়াদা করেছেন।
(খ) পাপ তার কর্তার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সমাজের সৎ লোকগুলো তাকে ঘৃণা করে যায়।
(গ) পাপ তার মতো আরেকটি পাপের বীজ বপন করে ও অনুরূপ পাপের জন্ম দেয়।
(ঘ) অব্যাহত পাপের ফলে পাপের প্রতি ঘৃণা কমে যায় ও পাপের ব্যাপারে অন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়।
(ঙ) পাপের আধিক্য অন্তরকে কলুষিত ও অকার্যকর করে দেয় যেমন রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন:
إن المؤمن إذا أذنب كانت نكتة سوداء في قلبه، فإن تاب ونزع واستغفر صقل قلبه، وإن زاد زادت، حتى يعلو قلبه ذاك الران الذي ذكر الله عز وجل في القرآن (كلا بل ران على قلوبهم ما كانوا يكسبون) (رواه الترمذي-৩৩৩৪ وحسنه الألباني في صحيح الجامع)
মুমিন ব্যক্তি যখন কোন পাপ করে তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে। যখন সে তাওবা করে, বিরত হয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন তার অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। পাপ বেড়ে গেলে অন্তরের কলুষতাও বেড়ে যায়। পরিণতিতে অন্তর উদ্ধত হয়ে উঠে। এটা সেই মর্চে, যার কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এভাবে বলেছেন : 'কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে মর্চে ধরিয়েছে।'(তিরমিযী : ৩৩৩৪)

(চ) পাপাচার পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দূর্যোগ নিয়ে আসে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছ্তে
ظهر الفساد في البر والبحر بما كسبت أيدى الناس ليذيقهم بعض الذي عملوا لعلهم يرجعون. (الروم : ৪১)
'মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলেস্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে ; যাতে তিনি তাদেরকে আস্বাদন করান তাদের কৃতকর্মের কিছু ফল। হয়ত তারা (সঠিক পথে) ফিরে আসবে।' [সূরা রূম : ৪১]
(ছ) পাপ আল্লাহর নিয়ামতকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং গজব নামিয়ে আনে। আল্লাহ তা'আলা বলেন :
وما أصابكم من مصيبة فبما كسبت أيديكم ويعفو عن كثير.(الشورى : ৩০)
'তোমরা যে বিপদে আক্রান্ত হও, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।' [সূরা শূরা : ৩০]
(জ) পাপী যখন সারা জীবন নিজের উপর অত্যাচার করে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসমর্থ হয়। এমনকি মৃত্যুকালেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, পাপ করে বসে। এমন ধারণা পুষে বসে থাকা চরম বোকামী হবে যে, আমি মৃত্যুর পূর্বে সকল পাপ ছেড়ে দিয়ে পাক-পবিত্র হয়ে যাবো।

(১৩) অন্তরের প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকা জরূরী :
অজ্ঞতাবশত অনেকে আল্লাহর ব্যাপারে আশা পোষণ করে যে, তিনি দয়াময়, রহমান রহীম, পরম ক্ষমাশীল, তিনি যাবতীয় পাপতাপ ক্ষমা করে দেন। আমি যত পাপই করি না কেন, তিনি তা ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু সে ভুলে যায় যে, আল্লাহর শাস্তি কঠিন শাস্তি, অপরাধীকে কখনো তিনি ছেড়ে দেন না।
আল্লাহ সম্পর্কে আশাবাদী থাকা ভাল ; তবে যে আশাবাদ পাপ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তা শয়তানের কুমন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

(সমাপ্ত)


মূল : গবেষণা পরিষদ
আল-মুনতাদা আল-ইসলামী কেন্দ্রীয় কার্যালয়
অনুবাদক : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদক : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব


আরও পড়ুনঃ একশটি কবীরা গুনাহ

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন