ঈমান দুর্বলতার আলামত, কারণ ও চিকিৎসা
ক্রম বিষয়
প্রথমত: ঈমান দুর্বলতার কতিপয় আলামত (১৯টি)
১ পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া
২ অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া
৩ মজবুতভাবে ইবাদত না করা
৪ ইবাদতে অলসতা করা
৫ অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব করা
৬ কুরআনের আয়াত, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, আযাব-গযব এবং কিয়ামতের বিবরণ শুনে প্রভাবিত না হওয়া
৭ আল্লাহর যিকির-আযকার, দুয়া ইত্যাদির ব্যাপারে অমনোযোগী থাকা
৮ আল্লাহ বিধান লঙ্ঘিত হতে দেখলেও মনে রাগ বা ক্ষোভ সৃষ্টি না হওয়া
৯ নিজেকে লোক সমাজে প্রকাশের মনোবাসনা সৃষ্টি হওয়া
১০ প্রচণ্ড অর্থলিপ্সা ও কৃপণতা করা
১১ এমন কথা বলা যা সে নিজে করে না।
১২ কোন মুসলিমের বিপদ দেখে আনন্দিত হওয়া
১৩ কল্যাণকর কাজকে তুচ্ছ মনে করা বা ছোট ছোট নেকীর কাজকে গুরুত্ব না দেয়া
১৪ মুসলিমদের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে গুরুত্ব না দেয়া
১৫ বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া
১৬ বিপদাপদ বা সমস্যায় মুষড়ে পড়া
১৭ তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়াঝাঁটি করা
১৮ দুনিয়ার প্রেমে মগ্ন থাকা
১৯ খাদ্য-পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদিতে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া
দ্বিতীয়ত: ঈমান দুর্বলতার কারণ (৮টি)
তৃতীয়ত: ঈমান দুর্বলতার চিকিৎসা (১৯টি)
১ আল কুরআন অধ্যয়ন করা
২ মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব অনুধাবন করা,তাঁর নাম ও গুণাবলীগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার পর সেগুলোর মর্মার্থ জেনে-বুঝে সেগুলোকে অন্তরে গেঁথে নেয়া এবং কাজে-কর্মে তার প্রতিফলন ঘটানো।
৩ দ্বীনের ইলম অন্বেষণ করা
৪ যে সকল বৈঠকে আল্লাহর যিকির তথা আল্লাহ এবং আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে আলোচনা করা হয় সেগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত হওয়া
৫ অধিক পরিমাণে নেকীর কাজ করা এবং সব সময় নেকীর কাজে লেগে
৬ বিভিন্ন প্রকারের ইবাদত করা
৭ অধিক পরিমাণে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা
৮ ঈমান নবায়নের অন্যতম উপায় হল,আখিরাতের বিভিন্ন মনজিলের কথা স্মরণ করা
৯ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঘটনাবলীতে প্রভাবিত হওয়া
১০ আল্লাহর যিকির
১১ আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের দীনতা তুলে ধরে দুয়া-মুনাজাত করা
১২ বেঁচে থাকার লম্বা আশা না করা
১৩ এ কথা চিন্তা করা যে, পার্থিব জীবন খুবই নগণ্য
১৪ আল্লাহর বিধি-বিধান ও-নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা
১৫ আল ওয়ালা ওয়াল বারা
১৬ বিনয় অবলম্বন করা
১৭ অন্তরের কতিপয় বিশেষ কাজ
১৮ আত্মসমালোচনা
১৯ ঈমান নবায়নের জন্য দুআ
ঈমান দুর্বলতার আলামত
১মত: ঈমান দুর্বলতার কতিপয় আলামত
দুর্বল ঈমানের অনেক আলামত
রয়েছে। তন্মধ্যে এখানে ১৯টি আলামত পেশ করা হল:
১) পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া:
কিছু মানুষ একই পাপ বারবার
করে। কেউ আবার বিভিন্ন প্রকার পাপ করে। পাপ করতে করতে করতে যখন তা অভ্যাসে পরিণত হয়
তখন পাপকে আর পাপ বলে মনে হয় না! পাপের কদর্যতা অন্তর থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এক
পর্যায়ে মানুষ প্রকাশ্যে পাপ করা শুরু করে বা গোপনে পাপ করার পর মানুষের কাছে তা প্রকাশ
করে দেয়!
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
كُلُّ أُمَّتِى مُعَافًى إِلاَّ الْمُجَاهِرِينَ ، وَإِنَّ مِنَ الْمَجَاهرة أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً ، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ ، فَيَقُولَ يَا فُلاَنُ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا ، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ
“আমার উম্মতের সকলকেই ক্ষমা করে দেয়া হবে। তবে ঐ সকল লোককে ক্ষমা করা হবে
না যারা পাপ করার পর তা অন্যের নিকট প্রকাশ করে দেয়। অন্যের নিকট প্রকাশ করার একটি
দিক হল, কোন ব্যক্তি রাতের আঁধারে কোন গুনাহ করল এবং মহান আল্লাহ তার পাপটা গোপন করে
রাখলেন। কিন্তু ভোর হলে সে নিজেই অন্য মানুষের নিকট বলল, হে উমুক, জানো, রাতে আমি এই
এই কাজ করেছি। সারা রাত আল্লাহ তার পাপটাকে ঢেকে রেখেছিলেন কিন্তু ভোর হলে নিজেই আল্লাহর
ঢেকে রাখা বিষয়টি প্রকাশ করে দিল।” (সহীহু বুখারী)[1]
২) অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া:
ঈমান দুর্বলতার একটি আলামত
হল অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া। মনটা পাথরের মত এতটাই শক্ত হয় যে, তাতে কোন কিছুই প্রভাব
সৃষ্টি করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً
“অতঃপর এ ঘটনা (তথা বিস্ময়কর মুজিযা দেখার পরে) তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে
গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন।” (সূরা বাকারা: ৭৪)
কঠিন অন্তরের মানুষের মনে
মৃত্যু সম্পর্কিত নসিহত প্রভাব ফেলে না। মৃত্যু কিংবা জানাযা দেখেও তার মনে দাগ কাটে
না। এমনকি কাঁধে লাশ বহন করলে বা লাশকে কবরের গর্তে রাখতে দেখেও তার মনের মধ্যে ভাবান্তর
ঘটে না। গোরস্থান দিয়ে হেঁটে গেলে তার কাছে মনে হয় যে, কতগুলো ইট-পাথরের মধ্য দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে!!
৩) মজবুতভাবে ইবাদত না করা:
ঈমান দুর্বল হয়ে গেলে মানুষ
নামাজ,কুরআন তেলাওয়াত, দুয়া ইত্যাদিতে মানসিক অস্থিরতা অনুভব করে। দুয়া ও যিকিরগুলো
পড়লেও সেগুলোর মর্মার্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না। মানসিক উদাসীনতা ও অবহেলার সাথে
দুয়া করে। অথচ হাদীসে এসেছে:
ادْعُوا اللَّهَ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالْإِجَابَةِ ، وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ غَافِلٍ لَاهٍ
“তোমরা এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর নিকট দুয়া করো যে, তিনি তা কবুল করবেন।
জেনে রেখো, আল্লাহ তাআলা উদাসীন ও হেয়ালী হৃদয়ের দুয়া কবুল করেন না।” (তিরমিযী,
হা/৩৪৭৯, সিলসিলা সহীহা, হা/৫৯৪-আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত)
৪) ইবাদতে অলসতা করা:
ইবাদতে অলসতা করা ঈমান দুর্বলতার
অন্যতম আলামত। দুর্বল ঈমানের লোকেরা ইবাদত করলেও তা হয় অন্তঃসার শূন্য নড়াচড়া-যার
মধ্যে প্রাণের স্পর্শ থাকে না। মূলত: এটি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللَّـهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَىٰ يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّـهَ إِلَّا قَلِيلًا
“অবশ্যই মুনাফেকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের
প্রতারিত করে। বস্তুত: তারা যখন নামাযে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায়, একান্ত শিথিল ভাবে লোক
দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে।” (সূরা নিসা: ১৪২)
ইবাদতে অলসতার কয়েকটি দিক
হল, সুন্নতে রাতেবা (পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের আগে ও পরে যে সকল সুন্নত নিয়মিতভাবে
পড়া হয়), তাহাজ্জুদ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ নফল সালাত যেমন, সালাতুত তাওবা, সালাতুল
ইস্তিখারা, সালাতুয যুহা (চাশতের সালাত) ইত্যাদি আদায়ের ব্যাপারে অলসতা করা। এমনকি
জানাযার সালাতেও অংশ গ্রহণ করতে অবহেলা প্রদর্শন করা। আগেভাগে মসজিদে না যাওয়া ইত্যাদি।
৫) অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব
করা:
দুর্বল ঈমানের একটি দিক হল
অন্তরে সংকীর্ণতা অনুভব করা এবং মন-মস্তিষ্ক ও আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত
হওয়া।
এ অবস্থায় একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে
এতটাই অস্থিরতা অনুভব করে যে, তার কাছে মনে হয়, বিরাট একটি বোঝা তার মাথার উপর চেপে
আছে।
এ ধরণের মানুষ দ্রুত রেগে
যায়। সামান্যতেই কষ্ট পায়। তার ধৈর্য, সহনশীলতা ও মানসিক উদারতা বিদায় নেয় এবং
চারপাশের মানুষের আচরণে সে খুবই সংকীর্ণতা অনুভব করে। অথচ সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
سُئِلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ” عَنِ الإِيمَانِ ، قَالَ : الصَّبْرُ وَالسَّمَاحَةُ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: ঈমান হল: ধৈর্য ও উদারতা।” (মাকারিমুল
আখলাক-ইবনে আবিদ দুনিয়া, হা/ ৫৬, সিলসিলা সহীহা, হা/৪২৭)
৬) কুরআনের আয়াত, আল্লাহর
আদেশ-নিষেধ, আযাব-গযব এবং কিয়ামতের বিবরণ শুনে প্রভাবিত না হওয়া:
এটি ঈমান দুর্বলতার একটি ভয়াবহ
আলামত। দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তি কুরআনের তিলাওয়াত শুনতে বিরক্ত হয়,নিজে কুরআন
পড়ে না, আর পড়তে বসলেও পড়া অব্যাহত রাখতে পারে না। কুরআন খুলেই আবার বন্ধ করে দেয়!
৭) আল্লাহর যিকির-আযকার, দুয়া
ইত্যাদির ব্যাপারে অমনোযোগী থাকা:
এটি ঈমানী দূর্বলতার প্রমাণ
বহন করে। আল্লাহ তায়ালা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّـهَ إِلَّا قَلِيلاً
“তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে।” (সূরা নিসা: ১৪২)
৮) আল্লাহ বিধান লঙ্ঘিত হতে
দেখলেও মনে রাগ বা ক্ষোভ সৃষ্টি না হওয়া:
এটি ঈমানী দূর্বলতার অন্যতম
প্রমাণ। কারণ মানুষের মনে যখন আত্মসম্মানের আগুন নিভে যায় তখন তার ভেতরের প্রতিবাদের
শক্তি নি:শেষ হয়ে যায়। তখন সে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ বোধ করে না আর মন্দ কাজের প্রতিবাদে
জ্বলে উঠতে পারে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ مُجَخِّيًا لاَ يَعْرِفُ مَعْرُوفًا وَلاَ يُنْكِرُ مُنْكَرًا إِلاَّ مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ
“(ফেতনা-ফ্যাসাদের যুগে কিছু মানুষের) সাদা অন্তরে কালোর মিশ্রণ ঘটবে। অন্তরগুলো
হবে উল্টানো জগের মত। সে কেবল তার কু প্রবৃত্তির চাহিদা ছাড়া কোন ভাল জিনিস চিনবে
না এবং মন্দ জিনিসকে প্রতিহত করবে না।” (সহীহ মুসলিম)
৯) নিজেকে লোক সমাজে প্রকাশের
মনোবাসনা সৃষ্টি হওয়া:
এটি কয়েক ভাবে ভাবে প্রকাশিত
হয়। যথা:
✪ ক) নেতৃত্ব ও পদ গ্রহণে
উদগ্রীব থাকা। অথচ নেতৃত্ব দেয়া যে কত গুরু দায়িত্ব এবং তার পরিণতি যে কত বিপদজনক
সে দিকে তার কোন লক্ষ্য থাকে না!
✪ খ) সভা-সমাবেশে প্রধান
অতিথি হওয়ার বা সামনে থাকার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপাতে সতর্ক করে বলেন:
اتَّقُوا هذه المَذَابِحَ يعني المَحارِيبَ
“তোমরা এ সকল কশাইখানা তথা মেহরাবগুলো থেকে সতর্ক হও।” (বাইহাকী,
সহীহুল জামে/১২০)
ইমাম আলবানী রহ. ‘আস সুমুরুল
মুস্তাতাব’ গ্রন্থে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন:
“আনাস রা. বর্ণিত উক্ত হাদীসে ‘মাহারীব’ বলতে বৈঠকাদিতে সম্মুখভাগে থাকা উদ্দেশ্য। এই শব্দে
বর্ণিত যত হাদীস রয়েছে সবগুলোর অর্থ এটাই।” (আস সুমুরুল মুস্তাতাব)
✪ গ) মানুষ তার সম্মানে উঠে
দাঁড়াক এমন বাসনা থাকা:
একদিন মুয়াবিয়া রা. আগমন
করলেন। এ সময় আব্দুল্লাহ বিন আমের এবং আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর বসে ছিলেন। উসমান রা.
কে দেখে ইবনে আমের উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু ইবনুয যুবাইর বসেই থাকলেন। তখন মুয়াবিয়া
রা. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنٌ سَرَّهُ أن يَتَمَثَّلَ له عِبَادُ اللهِ قِيَاماً ، فليَتَبَوَّأبيتاً مِن النَارِ
“যে ব্যক্তি এতে আনন্দ বোধ করে যে, আল্লাহর বান্দারা তার উদ্দেশ্যে মূর্তির
মত দাঁড়িয়ে থাকুক তবে সে যেন আগুনের ঘরে তার বাসস্থান নির্ধারণ করে নেয়।” (আল
আদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী, তিরমিযী, শারহুস সুন্নাহ ৬/৩৫৮, ইমাম বাগাবী, হাসান)
১০) প্রচণ্ড অর্থলিপ্সা ও
কৃপণতা করা:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন:
إِياكُمْ والشح، فإنما هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بالشح، أمَرَهُمْ بِالبُخْلِ فَبَخلُوا، وأمَرَهُمْ بالقَطيعَة فَقَطَعُوا، وَأمَرَهُمْ بالفُجُورِ فَفَجَرُ
“তোমরা অতিঅর্থলিপ্সার ব্যাপারে সাবধান হও। কারণ,এটি তোমাদের পূর্ববর্তী
লোকদের ধ্বংসের একটি কারণ। এই কারণেই তারা কৃপণতা করেছিল, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট
করেছিল এবং নানা পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছিল।” (নাসাঈ, সহীহুল জামে ১১/২৬৭৮)
যত প্রয়োজন দেখা দেক বা মুসলিমদের
উপর যত দরিদ্রতা, বিপদ ও বিপর্যয় নেমে আসুক দুর্বল ঈমানের অধিকারী কৃপণ ব্যক্তিরা
কোনভাবেই অর্থ খরচ করতে রাজি হয় না!
এ শ্রেণীর লোকদের ব্যাপারে
আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীর চেয়ে শক্ত বাণী আর কী হতে পারে?
هَا أَنتُمْ هَـٰؤُلَاءِ تُدْعَوْنَ لِتُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ فَمِنكُم مَّن يَبْخَلُ ۖ وَمَن يَبْخَلْ فَإِنَّمَا يَبْخَلُ عَن نَّفْسِهِ ۚ وَاللَّـهُ الْغَنِيُّ وَأَنتُمُ الْفُقَرَاءُ ۚ وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُم
“শুন,তোমরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান জানানো হচ্ছে,
অতঃপর তেমদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে।
আল্লাহ অভাব মুক্ত এবং তেমরা অভাবগ্রস্ত। যদি তেমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তেমদের
পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তেমদের মত হবে না।” (সূরা
মুহাম্মদ: ৩৮)
১১) এমন কথা বলা যা সে নিজে
করে না। এমনটি করা দুর্বল ঈমানের লোকদের কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ – كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّـهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ -كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّـهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ
“হে ঈমানদারগণ,তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা কর না? এটা আল্লাহর নিকট খুব
রাগের বিষয় যে, তোমরা যা কর না তা বলে বেড়াও। তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর কাছে
খুবই অসন্তোষ জনক।” (সূরা আস সফ: ২ ও ৩)
নি:সন্দেহে এটি মুনাফিকের
কাজ। যার কথার সাথে কাজে মিল নেই সে যেমন মানুষের চোখে ঘৃণিত তেমনি আল্লাহর চোখেও ঘৃণিত।
১২) কোন মুসলিমের বিপদ দেখে আনন্দিত হওয়া: কোন মুসলিম
ক্ষতিগ্রস্ত হলে, কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে, কোন বিপদে পড়লে তাতে আনন্দিত হওয়া নি:সন্দেহে
ঈমানী দুর্বলতার লক্ষণ।
১৩) কল্যাণকর কাজকে তুচ্ছ মনে করা বা ছোট ছোট নেকীর
কাজকে গুরুত্ব না দেয়া:
আবু জারী আল হুজাইমী রা. হতে
বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা পল্লী-গাঁয়ের মানুষ। আমি আমাদেরকে এমন
কিছু শিক্ষা দিন যাতে আমাদের উপকার হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“لا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا , وَلَوْ أَنْ تُفْرِغَ مِنْ دَلْوِكَ فِي إِنَاءِ الْمُسْتَسْقِي، وَلَوْ أَنْ تُكَلِّمَ أَخَاكَ وَوَجْهُكَ مُنْبَسِطٌ إِلَيْهِ”
“তোমরা কোন ভাল কাজকেই তুচ্ছ মনে কর না। যদিও তা পানি সংগ্রহকারীর পাত্রে
তোমার বালতি থেকে কিছু পানি ঢেলে দেয়া হোক না কেন অথবা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে
কথা বলা হোক না কেন।” (সহীহ আল আদাব আল মুফরাদ-আলবানী, হা/৯০১)
১৪) মুসলিমদের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে
গুরুত্ব না দেয়া:
মুসলিমদের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে
গুরুত্ব না দেয়া ঈমান দুর্বলতার অন্যতম একটি লক্ষণ। দুর্বল ঈমানের মানুষেরা বিশ্বের
দিকে দিকে মুসলিমদের উপর নেমে আসা জুলুম-নির্যাতন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা সংকটের ব্যাপারে
দুআ করতে বা সামান্য আর্থিক সহযোগিতা এমনকি একটু সহানুভূতি প্রকাশ করা থেকেও দূরে থাকে!
অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“الْمُؤْمِنُ
مِنْ أَهْلِ الإِيمَانِ، بِمَنْزِلَةِ الرَّأْسِ مِنَ الْجَسَدِ، يَأْلَمُ الْمُؤْمِنُ لأَهْلِ الإِيمَانِ، كَمَا يَأْلَمُ الْجَسَدُ لِمَا فِي الرَّأْسِ
“ঈমানদারদের জন্য একজন মুমিনের উদাহরণ হল দেহের মাঝে মাথার মত। মুমিন ব্যক্তি
অন্য ঈমানদারদের কষ্টে কাতর হয় যেভাবে মাথায় ব্যথা সৃষ্টি হলে সমগ্র দেহে তা টের
পাওয়া যায়।” (সিলসিলা সহীহা/১১৩৭)
১৫) বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“وَالَّذِي
نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ مَا تَوَادَّ اثْنَانِ فَفُرِّقَ بَيْنَهُمَا إِلَّا بِذَنْبٍ يُحْدِثُهُ أَحَدُهُمَا”
“যার হাতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রাণ তার কসম, দুজন ব্যক্তি (আল্লাহর উদ্দেশ্যে বা ইসলামের স্বার্থে) বন্ধুত্ব স্থাপন করার পর তাদের বন্ধুত্ব কেবল তখনই নষ্ট হয় যখন তাদের দুজনের একজন কোন গুনাহে লিপ্ত হয়।” (আল আদাবুল মুফরাদ, মুসনাদ আহমদ, সিলসিলা সহীহা/৬৩৭)
১৬) বিপদাপদ বা সমস্যায় মুষড়ে পড়া:
এটি ঈমান দুর্বলতার একটি চিহ্ন।
দেখা যায়, কোন বিপদ বা বিপর্যয় নেমে আসলে কিছু মানুষ কাঁপতে শুরু করে, মানসিক ভারসাম্য
হারিয়ে ফেলে, ঘাবড়ে যায় এবং দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়ে। এরা শক্তি, সাহস, মানসিক
দৃঢ়তা ও স্থির চিত্তে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে না। এ সব হয় দুর্বল ঈমানের কারণে।
কেননা কারও যদি আল্লাহর প্রতি যদি আস্থা ও বিশ্বাস মজবুত হয় তবে সে আল্লাহর উপর ভরসা
করে যত কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক না কেন দৃঢ়তা ও মানসিক শক্তি অটুট রেখে তা মোকাবেলা
করতে পারে।
১৭) তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়াঝাঁটি
করা:
দলীল-প্রমাণ উপাস্থাপন ও সৎ
উদ্দেশ্য ছাড়া তর্ক-বিতর্ক করা মানুষকে সিরাতে মুস্তাকীম তথা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত
করে। আবু উমারা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন:
مَا ضَلَّ قَوْمٌ بَعْدَ هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الْجَدَلَ ثُمَّ تَلَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذِهِ الْآيَةَ {مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
“কোন জাতি হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার পরে গোমরাহ হয় না যতক্ষণ না
তারা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়।” অত:পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আয়াতটি
পাঠ করলেন:
مَا ضَرَبُوهُ لَكَ إِلَّا جَدَلًا – بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ
“তারা আপনার সামনে যে উদাহরণ পেশ করে তা কেবল বিতর্কের জন্যেই করে। বস্তুত:
তারা হল এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়।” (তিরমিযী হা/৩১৭৬, ইবনে মাজাহ হা/৪৭, সহীহ তারগীব-হাসান,
আলবানী)[2]
১৮) দুনিয়ার প্রেমে মগ্ন থাকা:
দুনিয়ার জীবন নিয়ে অতিব্যস্ততা
ঈমানী দুর্বলতার চিহ্ন। যখন দেখা যাবে, অর্থ-কড়ি, পদমর্যাদা বা সম্মানহানি ঘটলে মনে
প্রচণ্ড কষ্ট অনুভূত হচ্ছে তখন বুঝতে হবে এটি ঈমানের ঘাটতির আলামত।
অনুরূপভাবে যদি দেখা যায়,
অন্য কেউ এসব দুনিয়াবি জিনিস অর্জন করার কারণে তার প্রতি মনে হিংসা সৃষ্টি হচ্ছে তখন
বুঝতে হবে এটিও ঈমানী দুর্বলতার চিহ্ন।
হিংসা মূলত: ঈমান পরিপন্থী
কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
” لا يَجْتَمِعُ فِي جَوْفِ عَبْدٍ الإِيمَانُ وَالْحَسَدُ ”
“বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না।” (সুনানে
আবু দাউদ, সহীহুল জামে, হা/১৪৬৪)
১৯) খাদ্য-পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদিতে
মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া:
এটি ঈমান দুর্বলতার অন্যতম
লক্ষণ। দেখা যায়, এক শ্রেণীর মানুষ পোশাক-পরিচ্ছদ, বাড়ি-গাড়ি, ঘরসজ্জা ইত্যাদির
পেছনে অপ্রয়োজনীয় প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করে অথচ অন্য মুসলিমগণ অর্থাভাবে কত কষ্টে
দিনাতিপাত করছে!
ইসলামে বিলাসিতাকে অনুৎসাহিত
করা হয়েছে। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুআয বিন জাবাল রা.কে
ইয়েমেনে পাঠালেন তখন তাকে বেশ কিছু উপদেশ দেন। সেগুলোর মধ্যে একটি হল:
إياكَ والتنعُّمَ فإن عِبَادَ اللهِ ليسُوا بالمتنعِّمينَ
“সাবধান! বিলাসিতা করবে না। কেননা, আল্লাহ (খাঁটি) বান্দাগণ বিলাসী হয় না।” (বায়হাকী,
হিলয়া লি আবী নুআইম ৫/১৫৫, সিলসিলা সহীহা, হা/৩৫৩)[3]
ঈমান দুর্বলতার কারণ
দ্বিতীয়ত: ঈমান দুর্বলতার
কারণ (৮টি)
১) দীর্ঘ সময় ঈমানী পরিবেশ
থেকে দূরে থাকা:
মানুষ যখন দীর্ঘদিন ঈমানী
পরিবেশ থেকে দূরে অবস্থান করে তখন তার ঈমানী শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। আল্লাহ তালা বলেন:
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّـهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ
“মুমিনদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে,তার কারণে
হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া
হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে,অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে।
তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (সূরা হাদীদ: ১৬)
২) সৎ, আদর্শবান ও অনুসরণীয়
মানুষের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা:
সৎ, পরহেযগার ও দ্বীনদার মানুষের
সংশ্রব থেকে দূরে অবস্থান করা ঈমান দুর্বলতার অন্যতম একটি কারণ। যে ব্যক্তি সৎ মানুষের
নিকট দ্বীন শিখে সে তার নিকট দ্বীনের জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি সৎকর্ম ও ঈমানী শক্তির
খোরাক পায়। তার নিকট জ্ঞান, সৎচরিত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের দীক্ষা অর্জন করে। এমন
শিক্ষক থেকে দীর্ঘ সময় দূরে অবস্থান করলে শিক্ষার্থী মনের মধ্যে তার অভাব অনুভব করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর তিরোধানের পর সাহাবায়ে কেরাম বলতেন, “আমাদের অবস্থা হয়েছিল বর্ষণমুখর
ঠাণ্ডা রাতে ছাগলের যে অবস্থা হয় সে রকম।” কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন
একদল পর্বতসম মানুষ রেখে গিয়েছিলেন যাদের প্রত্যেকেই রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার উপযুক্ত
ছিলেন। তারা ছিলেন একজন অপরজনের আদর্শ। সুতরাং বর্তমানেও একজন মুসলিমের জন্য এমন একজন
আদর্শ বা অনুকরণীয় মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন যে তার খুব কাছাকাছি থাকবে।
৩) দ্বীনের ইলম (জ্ঞান) অন্বেষণ
থেকে দূরে থাকা:
সালাফ তথা পূর্বসূরীদের লিখিত
কিতাব, ঈমানী কিতাবাদী মানুষের ঈমানকে সঞ্জিবীত করে। এমন অনেক কিতাব আছে যেগুলো হৃদয়কে
আলোড়িত করে এবং নিজের ভিতরে লুকায়িত ঈমানী শক্তিকে উদ্ধেলিত করে। সেগুলোর মধ্যে সর্ব
প্রথম হল, আল্লাহর কিতাব, অত:পর হাদীস, অত:পর উপদেশ মূলক ও মন নরম করার মত কিতাবাদি।
লেখকগণ এ সকল কিতাবে চমৎকারভাবে ঈমান ও আকীদার কথাগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। এগুলো পড়লে
মন চাঙ্গা হয়ে উঠে। প্রদীপ্ত হয় আমাদের ঈমানী শক্তি। যেমন ইবনুল কাইয়েম, ইবনে রজব
রহ. প্রমূখের লিখিত গ্রন্থাদি।
এই কারণে য সকল মানুষ ইসলামী
দৃষ্টিকোন থেকে লেখা হয় নি এমন সব বিষয়ে লিখিত বই-পুস্তক- যেমন, দর্শন, মনোবিজ্ঞান,
সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি পড়তে ব্যস্ত থাকে, যারা গল্পের বই ও রোমান্টিক নোভেল-নাটক সংক্রান্ত
বই পড়ার জন্য পাগলপারা বা যারা উপকারহীন খবরা-খরব, নিউজ পেপার, ম্যাগজিন ইত্যাদি পড়ার
নেশায় ডুবে থাকে বা এগুলোকে অতিগুরুত্বের সাথে নিয়মিত পাঠ করে তাদের মাঝে ঈমানী ঘাটতির
আলামত সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
৪) পাপ-পঙ্কিল পরিবেশে বসবাস
করা:
অহরহ পাপাচার সংঘটিত হয় এমন
পরিবেশে বসবাস করা নি:সন্দেহে ঈমানের মধ্যে দুর্বলতার সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ।
পাপ-পঙ্কিল সমাজে দেখা যায়,
মানুষ পাপ করে গর্বের সাথে তা প্রকাশ করে! কেউ সুর দিয়ে গান ধরে, কেউ ধূমপান করে,
কেউ বসে অশ্লীল ম্যাগাজিন পড়ে, কেউবা নোংরা ও অশ্লীল ভাষায় আরেক জনকে উদ্দেশ্য করে
গালি ও অভিশাপ বর্ষণ করে।
পরনিন্দা, সমালোচনা, চুগলখোরি,
অনর্থক কথা, খেলাধুলা আর ফিল্ম জগতের খরব ইত্যাদির তো সীমা-সংখ্যা নাই।
কিছু বৈঠকে বসলে তো ব্যবসা-বাণিজ্য,
চাকুরী, প্রমোশন, বিনিয়োগ, শেয়ারবাজার ইত্যাদি দুনিয়ার বিষয় ছাড়া আর কিছু শুনা
যায় না।
বাসা বাড়িগুলোতে কী চলে সেগুলো
শুনলে তা অন্তর ফেটে যায়। নোংরা গান-বাদ্য, অশ্লীল ফিল্ম আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা
ইত্যাদি হারাম কাজ দ্বারা বর্তমানে মুসলিমদের ঘরবাড়িগুলো পরিপূর্ণ!
এ ধরণের পরিবেশে বসবাস করলে
অন্তর অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং ঈমান দুর্বল হয়ে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নাই।
৫) দুনিয়াবি ব্যস্ততায় নিমগ্ন থাকা:
ঈমান দুর্বল হওয়ার অন্যতম
কারণ হল,দুনিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে দুনিয়ার দাসে পরিণত হওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عَبْدُ الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ
“দিনার-দিরহাম পূজারী ধ্বংস হোক।” (বুখারী)
বর্তমানে এ বিষয়টি খুব প্রকটভাবে
দেখা যাচ্ছে। মানুষ বর্তমানে অতিরিক্ত অর্থলোভী হয়ে গেছে। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা,
শেয়ার বাজার ইত্যাদির পেছনে পাগলের মত ছুটছে! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর হাদীসে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, আমি
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি,(হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা
বলেন:)
إِنَّا أَنْزَلْنَا الْمَالَ لِإِقَامِ الصَّلَاةِ , وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ , وَلَوْ كَانَ لِابْنِ آدَمَ وَادٍ , لَأَحَبَّ أَنْ يَكُونَ إِلَيْهِ ثَانٍ , وَلَوْ كَانَ لَهُ وَادِيَانِ , لَأَحَبَّ أَنْ يَكُونَ إِلَيْهِمَا ثَالِثٌ , وَلَا يَمْلَأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلَّا التُّرَابُ , ثُمَّ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَى مَنْ تَابَ
“আমি সম্পদ অবতীর্ণ করেছি সালাত কায়েম এবং যাকাত আদায়ের জন্য।যদি আদম সন্তানের
একটি উপত্যকা পূর্ণ ধন-সম্পদ থাকে তবুও সে দ্বিতীয়টার আকাঙ্ক্ষা করবে। দুটি উপত্যকা
পূর্ণ ধন-সম্পদ থাকে তবে সে তৃতীয়টার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর মাটি ছাড়া লোভী আদম সন্তানের
পেট ভরবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি তওবা করবে,আল্লাহ তা আলা তার তওবা কবুল করবেন।” (মুসনাদ
আহমদ, ৪/২১৯, সহীহুল জামে হা/১৭৮১)
৬) ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি
ও স্ত্রী-পরিবার নিয়ে ব্যস্ততায় ডুবে থাকা:
এসব নিয়ে অতি ব্যস্ততা হৃদয়
পটে ঈমানকে দুর্বল করে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّـهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
“আর জেনে রেখো যে, নিঃসন্দেহ তোমাদের ধনদৌলত ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের
জন্য ফিতনা (পরীক্ষা)। আর নি:সন্দেহ আল্লাহ তাঁরই কাছেই রয়েছে বিরাট পুরস্কার।” (সূরা
আনফাল: ২৮)
আরেক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ أُمَّتِي الْمَالُ
“প্রত্যেক উম্মতের ফিতনা রয়েছে। আমার উম্মতের ফিতনা হল অর্থ-সম্পদ।” (তিরমিযী,
সহীহুল জামে, হা/২১৪৮)
প্রখ্যাত সাহাবী কাব বিন মালেক
আনসারী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন:
مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلاَ فِي غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِ
“দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে একপাল বকরীর মধ্যে ছেড়ে দিলে যে ক্ষতি না হবে
তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে যদি কেউ সম্পদ আর মর্যাদা কামাইয়ের লালসায় দ্বীনকে ব্যবহার
করে।”(তিরমিযী, হাসান সহীহ/২৩৭)
একথা বলা উদ্দেশ্য নয় যে,
বিয়ে-শাদী, সন্তান ভূমিষ্ঠ ও সন্তান প্রতিপালন বাদ দিতে হবে। বরং উদ্দেশ্য হল, স্ত্রী-পরিবার
নিয়ে এমন ব্যতিব্যস্ত হওয়া যাবে না যার কারণে হারাম কাজে লিপ্ত হতে হয়। অনুরূপভাবে
অর্থ-সম্পদের পেছনে এত বেশি নিমগ্ন হওয়া যাবে না যার কারণে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী
ও আল্লাহর যিকির থেকে গাফেল হয়ে যায়।
৭) সুদীর্ঘ আশা:
‘আরও বহুদিন বাঁচব’-এমন লম্বা আশা হৃদয়পটে উঁকি দিতে থাকলে বুঝতে হবে
হৃদয় অভ্যন্তরে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। কেননা, প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু আমাদের খুব সন্নিকটে।কেউ
জানি না কখন কার প্রাণপাখি উড়ে যাবে।
কাফেরদের পার্থিব জীবন নিয়ে
দীর্ঘ আশার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সতর্কবাণী নিম্নরূপ:
ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
“আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, খেয়ে নিক এবং ভোগ করে নিক এবং আশায় ব্যাপৃত থাকুক।
অতি সত্বর তারা জেনে নেবে।” (সূরা হিজর: ৩)
আলী রা. হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন, “তোমাদের ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বেশি ভয় হয় দুটি জিনিসের: একটি হল, প্রবৃত্তির
অনুসরণ অপরটি হল, দীর্ঘ আশা। প্রবৃত্তির অনুসরণ বা খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চললে তোমরা
সত্যের পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়বে আর (দুনিয়ার জীবনে) অনেক দীর্ঘ আশা করলে তোমরা আখিরাত
ভুলে যাবে।” (ফাহতুল বারী ১১/২৩৬)
এ জীবনে বেঁচে থাকার লম্বা
আশা করলে, ইবাদতে অলসতা সৃষ্টি হয়, তওবা বিলম্বিত হয়, পার্থিব জীবনের প্রতি আকর্ষণ
বেড়ে যায়, আখিরাতের কথা ভুলে যায় এবং মন শক্ত হয়ে যায়।
তাই আমাদের উচিৎ, ‘দীর্ঘ দিন
বেঁচে থাকব’ এমন ধারণা মন থেকে দূর করা এবং ‘মৃত্যু অতি সন্নিকটে’ এই
চিন্তা করে দ্রুত তওবা করা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে আরও মনোযোগী হওয়া।
৮) অতিরিক্ত পানাহার,অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিঘূর্ম রাত
কাটানো। অনুরূপভাবে মানুষের সাথে মেলামেশা ও উঠবসের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় অপচয় করা।
দুনিয়াবি অতিরিক্ত কোন কিছুই
ভাল নয়। যেমন, হাসি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এই হাসি যখন অতিরিক্ত হয়
তা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَا تُكْثِرُوا الضَّحِكَ فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ
“তোমরা বেশি হাসিও না। কারণ,বেশি হাসলে অন্তর মরে যায়।” (ইবনে
মাজাহ, সহীহুল জামে/ ৭৪৩৫, আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত)
এমন ঈমান দুর্বলতার বহু কারণ
রয়েছে। এখানে কিছু উদাহরণ দেয়া হয়েছে মাত্র। বুদ্ধিমানের কাজ হল, উদাহরণের উপর ভিত্তি
করে অন্যান্যগুলো খুঁজে নেয়া। মহান আল্লাহর নিকট দুআ করি, তিনি যেন আমাদের অন্তরগুলোকে
পবিত্র করে দেন এবং সব ধরণের অনিষ্টকারক জিনিস থেকে রক্ষা করেন। আমীন।
ঈমান দুর্বলতার চিকিৎসা
তৃতীয়ত: ঈমান দুর্বলতার চিকিৎসা
আকাশ যেমন কখনো কখনো ঘনকাল
মেঘের আবরণে ঢেকে যায় ঠিক তেমনি মানুষের হৃদয়গুলো ঢেকে যায় পাপ-পঙ্কিলতায়। কিন্তু
মেঘ সরে গেলে আকাশ যেমন আবার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায় তদ্রূপ অন্তরগুলোও (তওবা,চিকিৎসা
যিকির, দুয়া ও ইবাদতের মাধ্যমে) আলোকোদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
আলী রা. বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি:
مَا مِنَ الْقُلُوبِ قَلْبٌ إِلا وَلَهُ سَحَابَةٌ كَسَحَابَةِ الْقَمَرِ ، بَيْنَمَا الْقَمَرُ مُضِيءٌ إِذْ عَلَتْهُ سَحَابَةٌ فَأَظْلَمَ إِذْ تَجَلَّتْ عَنْهُ فَأَضَاءَ
“চাঁদ যেমন মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায় তেমনি প্রতিটি হৃদয় মেঘাচ্ছন্ন হয়।
চাঁদ আলো ছড়াতে থাকে কিন্তু যখন মেঘমালা তার উপরে চলে আসে তখন তার আলো নিভে যায়।
মেঘমালা সরে গেলে আবার আলো দেয়া শুরু করে।” (হিলিয়া-আবু নাঈম ২/১৯৬,সিলসিলা সহীহা, হা/২২৬৮)
অর্থাৎ মানুষের অন্তর মাঝে-মধ্যে
পাপাচারের ঘন কালো মেঘ এসে ঢেকে দেয়। তখন হৃদয়ের নূর নিভে যায় এবং মানুষ এক গুমোট
অস্থিরতা ও অদ্ভুত অন্ধকার অনুভব করে। কিন্তু যখনই সে ঈমান বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা-সাধনা
শুরু করে ও আল্লাহর সাহায্য চায় তখন সে অন্ধকার বিদূরিত হয়ে অন্তর আবারও আলোকিত হয়ে
উঠে।
ঈমান দুর্বল হওয়া এবং তার
চিকিৎসার বিষয়টি বুঝার জন্য যে জিনিসটি জানা জরুরি তা হল, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের
আকীদা হল, ঈমান বাড়ে ও কমে। নেক কাজের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে আর গুনাহের কাজে ঈমান কমে।
সুতরাং আমরা যদি ঈমান বৃদ্ধি
করতে চাই তাহলে আমাদের কতর্ব্য, আল্লাহর উপর উপর নির্ভর করে অধিক পরিমানে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ
করা।
নিম্নে কতিপয় সৎকর্ম পেশ
করা হল যেগুলো ঈমান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ: (১৯টি)
১) আল কুরআন অধ্যয়ন করা:
কুরআনে রয়েছে সব কিছুর সুস্পষ্ট
বিবরণ। এটি এমন এক আলোকবর্তিকা যা দ্বারা আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে খুশি পথ
দেখান। সুতরাং এ কথায় কোন সন্দেহ নাই যে, আল কুরআনের মধ্যেই রয়েছে ঈমানী দুর্বলতার
কার্যকরী মহৌষধ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ
“আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।” (সূরা
ইসরা: ৮২)
কুরআন থেকে চিকিৎসা গ্রহণের
পদ্ধতি হল,কুরআন পড়া,বুঝা ও গবেষণা করা।
কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআন নিয়ে
চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য সর্বোত্তম
আদর্শ। তিনি একরাতে নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআনের একটি আয়াত বারবার তিলাওয়াত করতে করতে
ভোর করে ফেলেছেন। তিনি কখনও সারা রাত ধরে কুরআন তিলাওয়াত করে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন।
সাহাবী ও পরবর্তী যুগের পূর্বসূরিদের জীবনীতে এ বিষয়ে বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
২) মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব অনুধাবন করা,তাঁর
নাম ও গুণাবলীগুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার পর সেগুলোর মর্মার্থ জেনে-বুঝে সেগুলোকে
অন্তরে গেঁথে নেয়া এবং কাজে-কর্মে তার প্রতিফলন ঘটানো। অন্তরে যা অনুধাবন করা হল তা
যেন কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। কেননা, অন্তর হল শরীরের মূল কেন্দ্রবিন্দু ও পরিচালিকা
শক্তি। অন্তর হল রাজা আর শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হল তার সৈনিক ও অনুগামী। তাই অন্তর ঠিক
থাকলে শরীরের সবকিছই ঠিক থাকবে আর অন্তর নষ্ট হলে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে।
৩) দ্বীনের ইলম অন্বেষণ করা:
দ্বীনের ইলম সেটাই যা মানুষের
হৃদয়ে আল্লাহ ভীতি জাগ্রত করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّـهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
“মানুষের মধ্যে কেবল আলেমগণ (যারা দ্বীনের জ্ঞান রাখে) আল্লাহকে ভয় করে।” (সূরা
ফাতির: ২৮)
যারা দ্বীনের ইলম রাখে আর
যারা রাখে না তাদের ঈমান কিভাবে এক সমান হতে পারে? যারা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত
জ্ঞান রাখে, শাহাদাতাইন তথা আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বীকৃতি
দেয়ার মর্মার্থ বুঝে, মৃত্যুর পরে করবের ফিতনা, হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা, জান্নাতের
নিয়ামতরাজি, জাহান্নামের আযাব, ইসলামে হালাল-হারামের হেমকত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর জীবনীর বিভিন্ন দিক ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান রাখে আর যারা দ্বীন, দ্বীনের
বিধিবিধান ও ইলমে গায়েব ইত্যাদি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে তাদের ঈমান কিভাবে এক সমান হতে
পারে? তাই তো আল্লাহ বলেন:
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ
“বলুন,যারা জানে এবং যারা জানে না;তারা কি সমান হতে পারে” ?
(সূরা যুমার: ৯)
৪) যে সকল বৈঠকে আল্লাহর যিকির তথা আল্লাহ এবং আল্লাহর
দ্বীন সম্পর্কে আলোচনা করা হয় সেগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত হওয়া:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন:
لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
“একদল মানুষ যখন বসে আল্লাহর যিকির করে তখন ফেরেশতা মণ্ডলী তাদেরকে পরিবেষ্টন
করে রাখে,আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে রাখে, তাদের উপর প্রশান্তি বর্ষিত হতে
থাকে এবং মহান আল্লাহ তার নিকটে যে সকল ফেরেশতা রয়েছেন তাদের নিকট ঐ লোকদের কথা আলোচনা
করে থাকেন।” (সহীহ মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
ما اجتمع قومٌ ، على ذِكرٍ فتفرَّقوا عنه إلا قيل لهم : قوموا مَغفورًا لكم
“কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকির করার পর যখন তারা উঠে যায় তখন তাদেরকে
(আল্লাহর পক্ষ থেকে) বলা হয়: তোমরা উঠে যাও, তোমাদের পাপরাশী ক্ষমা করে দেয়া হল।” (সহীহুল
জামে, হা/৫৫০৭-সাহল বিন হানযালা থেকে বর্ণিত)
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. উক্ত
হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, “সাধারণভাবে যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলা যে সব
আমল ওয়াজিব বা মোস্তাহাব করেছেন সেগুলো যত্নের সাথে বাস্তবায়ন করা। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত,
হাদীস পাঠ, দীনী ইলম সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।” (ফাতহুল
বারী ১১/২০৯, দারুল ফিকর প্রকাশনী)
৫) অধিক পরিমাণে নেকীর কাজ করা এবং সব সময় নেকীর
কাজে লেগে থাকা। এটি ঈমান দুর্বলতার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা।
নেকীর কাজ করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত
বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিৎ:
❍ ক) যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি
নেকীর কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করা: আল্লাহ তাআলা বলেন:
سَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা
হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য।” (সূরা
আলে ইমরান: ১৩৩)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّـهِ وَرُسُلِهِ
“তোমরা অগ্রে ধাবিত হও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যা
আকাশ ও পৃথিবীর মত প্রশস্ত। এটা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের প্রতি
বিশ্বাস স্থাপনকারীদের জন্যে।” (সূরা আল হাদীদ: ২১)
❍ খ) অনবরতভাবে নেকীর কাজে
লেগে থাকা: হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন:
مَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ
“আমার বান্দা অনবরতভাবে নফল ইবাদত করে আমার নৈকট্য লাভ করতে চেষ্টা করতে
থাকে। এক পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি।”(বুখারী)
❍ গ) কোন নেকীর কাজ শুরু
করলে তা নিয়মিতভাবে করতে থাকা পরিমাণে অল্প হলেও। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হল,আল্লাহর নিকট সব চেয়ে পছন্দনীয় আমল কোনটি? তিনি বললেন,
أَحَبُّ الأَعمَالِ إِلى اللهِ أَدوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ
“যে আমলটি নিয়মিতভাবে করা হয় সেটি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় যদিও তা পরিমাণে
কম হয়।” (বুখারী)
❍ ঘ) সৎ কর্মে যথাসাধ্য কষ্ট
শিকার ও পরিশ্রম করা:
আল্লাহ তাআলা সাহাবীদের প্রশংসায়
বলেন:
كَانُوا قَلِيلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ- وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ- وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ-
“তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা
করত এবং তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল।” (সূরা
যারিয়াত: ১৭, ১৮ ও ১৯)
৬) বিভিন্ন প্রকারের ইবাদত করা:
আল্লাহ অনুগ্রহ করে আমাদেরকে
বিভিন্ন প্রকার ইবাদত করার সুযোগ দিয়েছেন। কিছু ইবাদত শরীরের সাথে সম্পর্ক। যেমন,
সালাত। কিছু অর্থের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, যাকাত।কিছু শরীর ও অর্থ উভয়টির সাথে সম্পৃক্ত।
যেমন, হজ্জ। কিছু সম্পৃক্ত জিহ্বার সাথে যেমন, যিকির, দুআ ইত্যাদি।
আবার একই প্রকার ইবাদতের মধ্যেও
ভাগ আছে। যেমন, ফরয, সুন্নত, নফল। সুন্নত ও নফলের মধ্যেও মর্যাদাগত তারতম্য আছে।
এভাবে আপনি যদি খোঁজ নিয়ে
দেখেন তাহলে ইবাদতের মধ্যে নানা প্রকারভেদ দেখতে পাবেন। সময়, সংখ্যা, পদ্ধতি, বিধিবিধান
ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারভেদ। এর পেছনে একটি হেকমত হতে পারে যে, মানুষের মন যেন ইবাদত
করতে বিরক্ত না হয় বরং ইবাদতের মধ্যে নতুনত্ব ও ভিন্ন ভিন্ন সাধ খুঁজে পায়। তাছাড়া
সকলের মন-মানসিকতা ও শক্তি-সামর্থ্য এক রকম নয়। কেউ হয়ত অন্যান্য নফল ইবাদতের চেয়ে
তাহাজ্জুদের সালাতে বেশি তৃপ্তি পায়। কারো হয়ত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা সম্ভব হয়
না কিন্তু চাশতের সালাত আদায় করা সহজ হয়…।
এই ইবাদতের ভিন্নতা ও প্রকারভেদ
থেকে আমরা ঈমান দুর্বলতার চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারি। ফরয-ওয়াজিবগুলো আদায়ের পাশাপাশি
মনের আগ্রহ ও টান অনুযায়ী অধিক পরিমাণে নফল ও সুন্নত ইবাদতগুলো আদায় করতে পারি।
একটি ভিন্ন মাত্রার ইবাদতের
উদাহরণ হল, এতিমের প্রতি যত্ন নেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট
এক ব্যক্তি অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করলে তিনি তাকে বললেন:
أَتُحِبُّ أَنْ يَلِينَ قَلْبُكَ وَتُدْرِكَ حَاجَتَكَ؟ ” ارْحَمِ الْيَتِيمَ وَامْسَحْ بِرَأْسِهِ وَأَطْعِمْهُ مِنْ طَعَامِكَ يَلِنْ قَلْبُكَ وَتُدْرِكْ حَاجَتَكَ “.رواه الطبراني وله شواهد
“তুমি কি চাও তোমার অন্তর নরম হোক এবং অভাব দূর হোক? এতিমের প্রতি দয়া কর,
তার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও এবং তাকে তোমার খাবার থেকে খাওয়াও তবে তোমার অন্তর নরম
হবে এবং অভাব দূর হবে।” (ত্ববারানী, এ হাদীসের সমর্থনে আরও একাধিক হাদীস রয়েছে,
হাসান লি গাইরিহী, সহীহুত তারগীব, হা/২৫৪৪)
৭) অধিক পরিমাণে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা:
মৃত্যুর স্মরণ পাপীকে পাপাচার
থেকে নিবৃত করে, কঠিন অন্তরের মানুষের অন্তর নরম করে দেয়।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِي الْمَوْتِ
“তোমরা অধিক পরিমানে আনন্দ বিধ্বংসী বিষয় তথা মৃত্যুর কথা স্মরণ কর।” (সুনান
তিরমিযী, সহীহুল জামে, হাদীস নং ১২১০)
মৃত্যুর কথা স্মরণ করাতে সবচেয়ে
বেশি কার্যকর উপায় হল, কবর যিয়ারত করা। এমনকি শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে কাফেরের কবর
যিয়ারত করাও জায়েয আছে। যেমন নিম্নোক্ত হাদীসটি:
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত
হয়েছে,
زَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ ، ثُمَّ قَالَ : “ اسْتَأْذَنْتُ رَبِّي أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأَذِنَ لِي ، وَاسْتَأْذَنْتُهُ أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَزُورُوا الْقُبُورَ ، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মা’র কবর
যিয়ারত করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং তাঁর সাথে যে সাহাবীগণ ছিলেন তারাও কাঁদলেন। অতঃপর
তিনি বললেন,“আমি আমার মা’র মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম
কিন্তু আমাকে সে অনুমতি প্রদান করা হয়নি। তবে আমি মায়’র কবর
যিয়ারতের জন্যে আবেদন জানালে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব, তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা
কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।”
[সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬,মুসতাদরাক
আলাস সাহীহাইন,অধ্যায়: কিতাবুল জানায়েয,অনুচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম কর্তৃক তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করা। হা/১৪৩০]
যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে মৃত্যুর
কথা স্মরণ করে সে তিনটি জিনিসের মাধ্যমে মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়:
১) তার অন্তরে দ্রুত তওবা
করার প্রেরণা তৈরি হয়
২) অল্পে তুষ্ট থাকার মনোভাব
জাগ্রত হয়
৩) ইবাদতে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মৃত্যু
চিন্তা করে না সে তিনটি শাস্তির সম্মুখীন হয়। যথা:
১) সে তওবা করতে বিলম্ব করে
২) অল্পেতুষ্টি থেকে বঞ্চিত
হয়।
৩) ইবাদতে অলসতা করে।
যে সব কাজের মাধ্যমে খুব বেশি
মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় তন্মধ্যে:
১) জানাযার সালাতে অংশ গ্রহণ
করা
২) কাঁধে লাশ বহন করে নিয়ে
যাওয়া
৩) গোরস্থানে করব যিয়ারত
করতে যাওয়া
৪)কাফন-দাফনে অংশ গ্রহণ করা
৫) লাশ কবর দেয়ার পর কবরে
মাটি দেয়া
৮) ঈমান নবায়নের অন্যতম উপায় হল,আখিরাতের বিভিন্ন
মনজিলের কথা স্মরণ করা:
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহঃ বলেন:
মানুষ যদি সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা
করে তাহলে অবশ্যই তার অন্তরদৃষ্টি সৃষ্টি হবে। এটি মূলত: অন্তরের আলো। এ আলোয় সে দেখতে
পাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির অঙ্গিকার, হুমকি-ধমকি, জান্নাত ও জাহান্নাম। আরও দেখবে
মহান আল্লাহ তার প্রিয়ভাজন বান্দাদের জন্য কত নিয়ামত ও সুখ-সম্ভার আর তার দুশমনদের
জন্য কত কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
সে দেখতে পাবে, আল্লাহর ডাকে
মানুষ কবর থেকে ভয়ে হতবিহবল হয়ে বের হয়েছে, ফেরেশতারা আসমান থেকে নেমে এসে তাদেরকে
ঘিরে রেখেছেন, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আগমন করে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য আসন বসিয়েছেন,
তাঁর আলোর জ্যোতিতে বিশ্ব-ভুবন আলোকিত হয়ে উঠেছে, আমলনামা প্রস্তুত করা হয়েছে, নবী-রসূল
এবং সাক্ষীদেরকে হাজির করা হয়েছে, দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হয়েছে, মানুষের আমলনামাগুলো
উড়া উড়ি করছে,বাদী-বিবাদীরা একত্রিত হয়েছে, ঋণ দাতারা ঋণ গ্রহণকারীদের পিছে লেগে
আছে।
হাউজে কাউসার এবং অগণিত পানপাত্র
ঝকমক করছে, পিপার্ষাত মানুষের সংখ্যা অগণিত কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষ পানি পান করতে
পারছে।
মানুষ পারাপারের জন্য পুলসিরাত
স্থাপন করা হয়েছে। মানুষ সেখানে ভিড় করছে। পুলের নিচে অন্ধকার। পুল পারাপারের জন্য
মানুষের মাঝে আলো বণ্টন করা হয়েছে। পুলের তলদেশে জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন একে অপরকে
চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে! এই আগুনে যারা পতিত হচ্ছে তাদের তুলনায় যারা রক্ষা পাচ্ছে
তাদের সংখ্যা খুব কম…।
মোটকথা, তার হৃদয় পটে আরেকটি
চোখ প্রস্ফুটিত হবে। যার মাধ্যমে সে এ সব দৃশ্য দেখতে পাবে। তার অন্তর স্বাক্ষ্য দিয়ে
বলবে, যে আখিরাত চিরস্থায়ী আর দুনিয়া হবে ক্ষণস্থায়ী। (মাদারিজুস সালেকীন ১/১৩২)
এছাড়াও কুরআনের যে সকল সূরাতে
কিয়ামতের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছে সেগুলো পাঠ করা। যেমন, সুরা কাফ, ওয়াকিয়া, কিয়ামাহ,
মুরসালাত, নাবা, মুতাফফিফীন, তাকবীর ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের অসংখ্য
গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এ সব গ্রন্থ পাঠ করতে হবে তাহলে ঈমান বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।
৯) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঘটনাবলীতে প্রভাবিত হওয়া:
এটি ঈমান দুর্বলতার অন্যতম
চিকিৎসা। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘের ঘনঘটা বা বায়ু প্রবাহ দেখতেন তখন তাঁর
চেহারায় এর প্রভাব দেখা যেত। আয়েশা রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, মানুষ মেঘ দেখলে
বৃষ্টির আশায় আনন্দিত হয় কিন্তু আমি দেখি, মেঘ দেখলে আপনার চেহারায় অসন্তোষের চিহ্ন
ফুটে উঠে।
তিনি বললে, হে আয়েশা, আমি
কিভাবে নিরাপদ হব যে, এতে আল্লাহর আযাব লুকিয়ে নেই? অথচ পূর্ব যুগে একটি জাতিকে ঝড়ো
হাওয়ার মাধ্যমে আযাব দেয়া হয়েছিলো আরেকটি জাতি আল্লাহর আযাব দেখে বলেছিল যে,هَـٰذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ۚ“ এ তো মেঘ,আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে।” (সূরা
আহকাফ: ২৪)
সহীহ বুখারীতে আবু মুসা আশআরী
রা. হতে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার সূর্য গ্রহণ লাগল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম আতঙ্কিত অবস্থায় উঠে দাঁড়ালেন আর কিয়ামত ঘটে যাওয়ার ভয় করতে লাগলেন।
(ফাতহুল বারী ২/৫৪৫)
এ ছাড়া চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের
সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে ভীত-ত্রস্ত হয়ে সালাতে দাঁড়ানোর
নির্দেশ দিতেন আর বলতেন, “এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। তিনি এগুলোর মাধ্যমে তার বান্দাদেরকে
ভীতি প্রদর্শন করেন।”
নি:সন্দেহে এ সকল প্রাকৃতিক
দুর্যোগ ও ঘটনাবলী দেখে মনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া এবং ভয় পাওয়া অন্তরে
ঈমান নবায়নের অন্যতম মাধ্যম।
১০) আল্লাহর যিকির:
ঈমান দুর্বলতার অন্যতম চিকিৎসা
হল, আল্লাহর যিকির করা। যিকিরের মাধ্যমে অন্তরে উজ্জ্বলতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অন্তরের
সকল রোগ-ব্যাধি দূর হয়। যিকির হল সকল নেক কাজের প্রাণ। আল্লাহ তায়ালা অধিকমাত্রায়
যিকির করার নির্দেশ দিয়ে বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّـهَ ذِكْرًا كَثِيرًا
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা প্রচুর পরিমাণ আল্লাহর যিকির কর।” (সূরা
আহযাব: ৪১)
যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে আল্লাহর
যিকির করবে আল্লাহ তার সাফল্যের অঙ্গিকার করেছেন। তিনি বলেন:
وَاذْكُرُوا اللَّـهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে সফলতা অর্জন করতে
পার।” (সূরা আনফাল: ৪৫)
তিনি আল্লাহর যিকিরকে ‘সবচেয়ে
বড়’ জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন:
وَلَذِكْرُ اللَّـهِ أَكْبَرُ
“আল্লাহর যিকির (স্মরণ) সব চেয়ে বড়।” (আনকাবুত: ৪৫)
এভাবে কুরআনে বিভিন্ন স্থানে
তিনি যিকিরের মর্যাদা ও গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ. বলেন: “অন্তরের কাঠিন্ন যিকির
ছাড়া অন্য কিছুতে গলাতে পারে না। সুতরাং বান্দাদের উচিৎ, আল্লাহর যিকিরের সাহায্যে
অন্তরের চিকিৎসা করা।”
মাকহূল বলেন: “মানুষের স্বরণে অন্তরে ব্যাধি সৃষ্টি
হয় আর আল্লাহর স্বরণে অন্তরের ব্যাধি দূর হয়।”
যে সকল মানুষ ঈমান দুর্বলতার
রোগে ভুগছে অথচ নফল সালাত, তাহাজ্জুদ, নফল রোযা ইত্যাদির মাধ্যমে তার উপযুক্ত চিকিৎসা
করতে পারে না তারা যিকিরের চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে। তারা যদি দুআ ও যিকিরগুলো মুখস্থ
করে সেগুলো সার্বক্ষণিক আওড়াতে পারে তাহলে তাদের অন্তরের সকল রোগ-ব্যাধী দূর হয়ে
যাবে ইনশাআল্লাহ।
❑ নিম্নোক্ত যিকিরগুলো অত্যন্ত
ফযিলত পূর্ণ:
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল
মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।”
অর্থ: আল্লাহ ব্যাতীত প্রকৃত
কোন ইলাহ নেই,তিনি একক,তাঁর কোন শরীক নাই। রাজত্ব একমাত্র তাঁরই। সমস্ত প্রশংসাও একমাত্র
তাঁরই জন্য। আর তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।
“সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আ’যীম।
অর্থ: প্রশংসা সহকারে আল্লাহর
পবিত্রতা ঘোষণা করছি। সুমহান আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। (সহীহুল বুখারি ও মুসলিম)
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’’
এ ছাড়াও হাদীসে দৈনন্দিন
জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল দুআ ও যিকির পড়ার নির্দেশনা এসেছে সেগুলো পড়া। এ সব
দুআ ও যিকির নিয়মত পাঠ করলে ঈমানে মজবুতী সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ।
১১) আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের দীনতা তুলে ধরে দুয়া-মুনাজাত
করা:
ঈমান নবায়নের অন্যতম উপায়
হল,আল্লাহ তাআলার কাছে নিজের দীনতা তুলে ধরে দুয়া-মুনাজাত করা। কেননা বান্দা যত বেশি
আল্লাহর প্রতি নত ও নম্র হবে তত বেশি তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে পারবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ“
“বান্দা সেজদা অবস্থায় আল্লাহর সব চেয়ে নিকটে থাকে। অত:এবং,তোমরা বেশি
বেশি দুয়া কর।” (সহীহ মুসলিম)
সেজদা অবস্থায় যতটুকু হীনতা
প্রকাশিত হয় অন্য কোন অবস্থায় ততটুকু হয় না। মানব দেহের সবচেয়ে উন্নত অঙ্গ হল কপাল।
মানুষ যত বেশি এই কপাল মাটিতে লুটাতে সক্ষম হবে সে তত বেশি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে
যাবে।
অনুরূপভাবে আল্লাহর দরবারে
অভাব-অনটন ও দরিদ্রতা প্রকাশ করার মাধ্যমে ঈমান দৃঢ়তা লাভ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের
অভাব-অনটনের কথা তুলে ধরে বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّـهِ ۖ وَاللَّـهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
“হে মানবজাতি, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ হলেন অত্যন্ত
ধনাঢ্য ও পরম প্রশংসনীয়।” (সূরা ফাতির: ১৫)
১২) বেঁচে থাকার লম্বা আশা না করা: এটি ঈমান নবায়ন
করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ.এ ক্ষেত্রে
নিম্নোক্ত আয়াত দুটি তুলে ধরেছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
أَفَرَأَيْتَ إِن مَّتَّعْنَاهُمْ سِنِينَ – ثُمَّ جَاءَهُم مَّا كَانُوا يُوعَدُونَ – مَا أَغْنَىٰ عَنْهُم مَّا كَانُوا يُمَتَّعُونَ
“আপনি ভেবে দেখুন তো, যদি আমি তাদেরকে বছরের পর বছর ভোগ-বিলাস করতে দেই,
অতঃপর যে বিষয়ে তাদেরকে ওয়াদা দেয়া হত,তা তাদের কাছে এসে পড়ে তখন তাদের ভোগ-বিলাস
তা তাদের কি কোন উপকারে আসবে?” (সূরা শুআরা: ১০৫, ১০৬ ও ১০৭)
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন:
(কাফেররা আখিরাতে বলবে):
كَأَن لَّمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِّنَ النَّهَارِ
“যেন তারা (দুনিয়াতে) দিনের এক ঘণ্টাও কাটায় নি!” (সূরা ইউনুস: ৪৫)
এটুকুই হল দুনিয়ার জীবন!
তাই এত লম্বা আশা করা ঠিক নয় যে,আমি বহুদিন বাঁচব।
১৩) এ কথা চিন্তা করা যে, পার্থিব জীবন খুবই নগণ্য:
ঈমান মজবুত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
চিকিৎসা হল, এ কথা চিন্তা করা যে, পার্থিব জীবন খুবই নগণ্য ও তুচ্ছ। এই চিন্তা থাকলে
মন থেকে দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ দূর হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
“আর এই দুনিয়ার জীবন ধোকার সম্বল ছাড়া কিছুই নয়।” (সূরা
আলে ইমরান: ১৮৫)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন:
الدُّنْيَا مَلْعُونَةٌ ، مَلْعُونٌ مَا فِيهَا إِلَّا ذِكْرَ اللَّهِ وَمَا وَالِاهُ ، أَوْ مُعَلِّمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا
“দুনিয়া অভিশপ্ত। আর এ দুনিয়াতে যা কিছু আছে সেগুলোর মধ্যে আল্লাহর যিকির,
আল্লাহ যা কিছু ভালবাসেন,দীনী ইলম শিক্ষা দানকারী ও শিক্ষা গ্রহণকারী ছাড়া সবই অভিশপ্ত।”(ইবনে
মাজাহ,হা/৪১১২ সহীহ তারগীব ওয়া তারহীব,হা/৭১)
১৪) আল্লাহর বিধি-বিধান ও-নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান
প্রদর্শন করা:
আল্লাহর বিধি-বিধান ও-নিদর্শনাবলীর
প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ঈমান নবায়ন করার অন্যতম উপায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّـهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এটি তার আল্লাহ
ভীতির পরিচয় বহন করে।”(সূরা হজ্জ: ৩২)
আল্লাহর নির্দেশনা ও হুকুম-আহকাম
হল আল্লাহর হক। এগুলো কতিপয় ব্যক্তি, স্থান ও কালের সাথে সম্পৃক্ত।
◉ কতিপয় ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত।
যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অধিকার বাস্তবায়ন, তার আদেশ-নিষেধ
মেনে চলা, তাকে ভালবাসা ইত্যাদি।
◉ কিছু স্থানের সাথে সম্পৃক্ত।
যেমন, মক্কা ও মদিনার হারামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
◉ আর কিছু সম্পৃক্ত বিশেষ
সময়ের সাথে। যেমন, রমাযান মাসকে সম্মান দেখানো।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَن يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّـهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبِّهِ
“আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার
নিকট তা তার জন্যে উত্তম।” (সূরা হজ্জ: ৩০)
অনুরূপভাবে ছোট গুনাহগুলোকে
তুচ্ছ মনে না করাও আল্লাহর নির্দেশনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসঊদ রা. বলেন: “তোমারা ছোট গুনাহ থেকেও দূরে থাকবে। কেননা, এগুলো জমা হয়ে মানুষকে
ধ্বংস করে ছাড়ে।”
কবি বলেন, (আরবি কবিতা)
خل الذنوب صغيــــــرها
وكبيـرها فهو التـــــقى
واصنع كمـــــــاش فوق أرض
الشــــوك يحذر ما يرى
لا تحــــقرن صغيـــــرة
إن الجبـــال من الحــصى
সরল অর্থ:
ছোট -বড় সকল পাপকর্ম পরিত্যাগ
কর।
এরই নাম ‘আল্লাহভীতি’।
আর পথ চল ঠিক সেভাবে যেভাবে
একজন মানুষ কণ্টকময় রাস্তা দিয়ে সর্তকতার সাথে পথ চলে।
ছোট বলে কোন পাপকেই তুচ্ছ
মনে করো না।
কেননা, বড় বড় পাহাড়গুলো
ছোট-ছোট নুড়ি পাথর থেকে এত বড় হয়েছে।
১৫) আল ওয়ালা ওয়াল বারা:
আল ওয়ালা ওয়াল বারা তথা
ঈমানদারদের সাথে বন্ধুত্ব এবং কাফেরদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা ঈমান নবায়ন করার অন্যতম
উপায়। কারণ হল, আল্লাহর দুশমনের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক থাকলে ঈমান মারাত্মক দুর্বল
হয়ে পড়ে এবং আকীদার ভীত নড়বড়ে হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ভালবাসা কেবল আল্লাহর জন্য
নিবেদিত হলে এবং আল্লাহর মুমিন বান্দাদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সাহায্য-সহযোগিতার
মনোভাব থাকার পাশাপাশি আল্লাহর দুশমনদের সাথে দুশমনি থাকলে অন্তরে ঈমানের তেজ বহাল
থাকে।
১৬) বিনয় অবলম্বন করা:
ঈমান নবায়ন করার ক্ষেত্রে
ও অহংকার বশত: অন্তরে জমে যাওয়া মরিচা পরিষ্কার করতে বিনয় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা
পালন করে। কেননা, কথা, কাজ ও বাহ্যিক বেশ-ভূষায় বিনয় থাকা অন্তরের বিনয়ের প্রমাণ
বহন করে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন:
الْبَذَاذَةُ مِنَ الْإِيمَانِ
“সাদামাটা জীবন-যাপন ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।”(ইবনে মাজাহ: ৪১১৮, সিলসিলা সহীহাহ, ৩৪১) সাদামাটা জীবন-যাপন
বলতে, বেশ-ভূষায় বিনয়ী থাকা উদ্দেশ্য। (নিহায়াহ লি ইবনে আসীর ১/১১০)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسَ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللَّهُ يَوْمَ القِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلَائِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَيِّ حُلَلِ الإِيمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় বিনয়াবনত হয়ে ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও
(বেশি দামী সুন্দর) পোশাক পরা থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন সৃষ্টিকুলের
সামনে ডেকে তার ইচ্ছেমত ঈমানী পোশাক পরিধান করার সুযোগ দান করবেন।” (তিরমিযী,
হা/২৪৮১, সিলসিলা সহীহাহ, হা/৭১৮)
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুর রহমান
বিন আউফ রা. কে তাকে তার দাসদের থেকে আলাদাভাবে চেনা যেত না।
১৭) অন্তরের কতিপয় বিশেষ কাজ:
এমন কিছু অন্তরের কাজ আছে
যেগুলো ঈমান নবায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আল্লাহকে ভয় করা, তাকে
ভালবাসা, তাঁর নিকট আশা করা, তাঁর প্রতি সুধারণা পোষণ করা ও ভরসা রাখা, তাঁর ফয়সালার
ব্যাপারে মনের পরিতুষ্টি, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, তাঁর সাথে সত্যবাদিতা, তাঁর প্রতি অবিচল
আস্থা ও বিশ্বাস, ভুল করার পর তার কাছেই ফিরে আসা ইত্যাদি অন্তরের কার্যাদি।
এছাড়াও এমন কিছু পর্যায়
রয়েছে ঈমানী চিকিৎসার পূর্ণতার জন্য বান্দার কর্তব্য সে পর্যায়ে উপনীত হওয়া। যেমন,
ইবাদত-বন্দেগীতে অবিচল থাকা,সকল ক্ষেত্রে কেবল তাঁর নিকট ধর্না দেয়া, তাঁকে স্মরণ
করা, কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, তাঁর ভয়ে ভীত থাকা, দুনিয়া বিমুখ হওয়া, পরহেযগারিতা
অবলম্বন করা, ‘আল্লাহ সব কিছু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এই ধ্যান-ধারণা হৃদয়ে জাগ্রত
রাখা।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম রা. তার
মাদারিজুস সালিকীন গ্রন্থে এ সব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
১৮) আত্মসমালোচনা:
ঈমান নবায়নের জন্য আত্ম সমালোচনা
তথা নিজের দোষ-ত্রুটি ও কার্যক্রম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও সমালোচনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّـهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ
“মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের
জন্যে সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা।” (সূরা হাশর: ১৮)
উমর ইবনুল খাত্তাব রা বলেন,
حَاسِبُوا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوا
“তোমরা নিজের হিসেব নিজেই করো (আত্ম সমালোচনা করো) হিসেবের মুখোমুখি হওয়ার
পূর্বে।”
ইবনুল কাইয়েম রহঃ বলেন:
“আত্ম সমালোচনার প্রতি অবহেলা করা, মনে যা যায় তাই করা এবং কু প্রবৃত্তির অনুসরণ করা
মানুষকে ধ্বংস করে ছাড়ে।”
সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের
উচিৎ, অবশ্যই কিছু সময় একান্ত একাকীত্বে আত্ম সমালোচনা করা, নিজের হিসেব-নিকেশ পর্যালোচনা
করা এবং খোঁজ-খবর নেয়া যে, আখিরাতের যাত্রাপথে সে কী পাথেয় সংগ্রহ করেছে।
১৯) ঈমান নবায়নের জন্য দুআ করা:
পরিশেষে ঈমান নবায়নের অন্যতম
শক্তিশালী উপায় হল দুয়া করা। বান্দার উচিৎ এই উপায়টি অবলম্বন করা। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ الْإِيمَانَ لَيَخْلَقُ فِي جَوْفِ أَحَدِكُمْ كَمَا يَخْلَقُ الثَّوْبُ فَاسْأَلُوا اللَّهَ تَعَالَى أَنْ يُجَدِّدَ الْإِيمَانَ فِي قُلُوبِكُمْ . صححه الألباني في صحيح الجامع
“তোমাদের হৃদয়ে ঈমান ঠিক সেভাবে জীর্ণ-শীর্ণ ও দুর্বল হয় যেভাবে তোমাদের
পোশাক জীর্ণ-শীর্ণ হয়। অত: এব দুয়া কর যেন, তোমাদের অন্তরের ঈমান নবায়ন হয়।” (ইমাম
আলবানী রহ. উক্ত হাদীসটিকে সহীহুল জামে গ্রন্থে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।)
❀❀ সমাপ্ত-আল হামদু লিল্লাহ
❀❀
[1] আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে
প্রচলিত কতিপয় প্রকাশ্য পাপাচারের উদাহরণ পেশ করা হল:
১) প্রকাশ্যে ধূমপান করা।
২) পুরুষদের টাখনুর নিচে ঝুলিয়
কাপড় পড়া।
৩) দাড়ি মুণ্ডন করা বা কাটা।
৪) মহিলাদের টাইট-ফিট, পাতলা
এবং পুরুষদের মত পোশাক পরিধান করে পরপুরুষের নিকট সৌন্দর্য প্রকাশ করা।
৫) মহিলাদের সুগন্ধি মেখে
বাইরে বের হওয়া।
৬) পুরুষদের সোনার আংটি বা
রেশমের পোশাক পরিধান করা।
৭) উচ্চ আওয়াজে মিউজিক বাজানো।
৮) পর নারী বা পর পুরুষের
সাথে বাইরে বের হওয়া।
৯) পহেলা বৈশাখ, ভালবাসা দিবস,
ক্রিসমাস (বড়দিন), ঈদে মীলাদুন্নবী,থার্টি ফাস্ট নাইট,জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস ইত্যাদি
পালন করা।
১০) ফেসবুক,টুইটার ইত্যাদি
সোশাল নেটওয়ার্কে বা ব্লগ ও ওয়েব সাইটে গান-বাদ্য, ফিল্ম, অশ্লীল গল্প ইত্যাদি পোস্ট
করা।
১১) বিলবোর্ড বা পোস্টারে
বেপর্দা মহিলাদের এ্যাডভার্টাইজ দেয়া।
১২) কবর-মাযারপুজা,কথিত অলি-আউলিয়াদের
কবরের পাশে ওরস মাহফিল করা।
১৩) জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস,
শবে বরাত, শবে মিরাজ ইত্যাদি বিভিন্ন উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা।
১৪) কবর পাকা করা,কবরে চুনকাম
করা এবং কবরে দেয়ালে কিছু লেখা।
১৫) উচ্চ আওয়াজে সম্মিলিতভাবে
জিকির করা ইত্যাদি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল
প্রকার গুনাহ থেকে হেফাজত করুন।-অনুবাদক
[2] ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
শরীয়তে ঐ তর্ককে তিরষ্কার করা হয়েছে যা ইলম ছাড়া অন্যায়ভাবে করা হয় অথবা সত্য
স্পষ্ট হওয়ার পরও করা হয়।
পক্ষান্তরে বিতর্কের উদ্দেশ্য
যদি হয়,সত্যকে সমর্থন করা বা অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তবে তা কখনও
ফরযে আইন; কখনও ফরযে কেফায়াহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ – وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ- إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ
“ডাক তোমার রবের পথে আহবান কর প্রজ্ঞা এবং সুন্দর উপদেশ বাণীর মাধ্যমে আর
তাদের সাথে বিতর্ক কর সুন্দরতম পন্থায়। নিশ্চয় তোমার রব সব চেয়ে বেশি জানেন,কে তার
পথে থেকে বিচ্যুত হয়েছে।” (সূরা নাহল: ১২৫)
উক্ত আয়াতে কারীমায় দাওয়াতের
দুটি চমৎকার মূলনীতি বলা হয়েছে। যথা:
এক. হেকমত তথা কুরআন-সুন্নাহর
দলীল দ্বারা দাওয়াত দেয়া।
দুই. সুন্দর উপদেশ বাণী তথা
কুরআন-সুন্নায় যে সকল উৎসাহ ব্যাঞ্চক এবং সতর্ক বাণী বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে
দাওয়াত দেয়া।
অনুরূপভাবে বিতর্ক করার একটি
চমৎকার মূলনীতিও বলা হয়েছে। তা হল:
যদি বিতর্কের প্রয়োজন হয়
তবে তবে বিতর্ক করতে হবে। তবে অবশ্যই সুন্দরতম পন্থায় তথা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা,
প্রমাণাদী পেশ এবং যৌক্তিক বক্তব্য পেশের মাধ্যমে বিতর্ক করতে হবে। গালাগালী, চিৎকার-চেচামেচী
করা হলে বিতর্কের উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। বিতর্কের উদ্দেশ্য মানুষকে হেদায়াত করা; প্রতিপক্ষের
উপর বিজয় প্রমাণ করা নয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ও তাফসীরে ইবনে সাদী থেকে সংক্ষেপায়িত)
মোটকথা, সত্য জানার পরেও শুধু
প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে অথবা ব্যক্তি, দল, মত, মাযহাব, সংগঠন, বংশ
ইত্যাদির স্বার্থে অন্যায় জেনেও তার সমর্থনে তর্ক বিতর্ক করা হারাম।- অনুবাদক
[3] বিলাসিতা বলতে বুঝায়,সব
সময় উন্নত খাদ্য-পানীয়, অভিজাত পোশাক-পরিচ্ছদ ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন-যাপন ইত্যাদি।
মাঝেমধ্যে বৈধ পন্থায় ভালো
খাবার-দাবার ও দামি পোশাক পরা জায়েয আছে। কিন্তু সব সময় বিলাসী জীবন যাপন করা আল্লাহর
খাঁটি বান্দাদের পরিচয় নয়। কেননা, বিলাসিতা মানুষকে ক্রমান্বয়ে হারামের দিকে নিয়ে
যায়।-অনুবাদক
মূল: শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
সূত্র : সালাফী বিডি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন