রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে পবিত্রতা অর্জন করতেন (২য় পর্ব)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে পবিত্রতা অর্জন করতেন (২য় পর্ব)



১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব

অযু

অযু বলতে ছোট নাপাকী যেমন, মল-মূত্র ও বায়ুত্যাগ, গভীর নিদ্রা, উটের গোশত ভক্ষণ ইত্যাদির পর পবিত্রতার্জনের অনিবার্য পন্থাকে বুঝানো হয়।

কী জন্য অযু করতে হয়:
শরী‘আতের দৃষ্টিতে তিনটি কর্ম যথারীতি সম্পাদনের জন্যই অযু করতে হয়।
১. যে কোনো ধরনের সালাত আদায়ের জন্য:
ফরয, নফল তথা যে কোনো ধরনের সালাত আদায়ের জন্য অযু করতে হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا قُمۡتُمۡ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغۡسِلُواْ وُجُوهَكُمۡ وَأَيۡدِيَكُمۡ إِلَى ٱلۡمَرَافِقِ وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِ﴾ [المائ‍دة: ٦] 
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা সালাতের উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হবে (অথচ তোমাদের অযু নেই) তখন তোমরা তোমাদের সমস্ত মুখমণ্ডল এবং হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে। আর মাথা মাসাহ করবে ও পাগুলো টাখনু পর্যন্ত ধৌত করবে”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ تُقْبَلُ صَلاَةُ أَحَدِكُمْ إِذَا أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ»
“তোমাদের মধ্যকার কোনো অযুহীন ব্যক্তির সালাত গ্রহণ করা হবে না যতক্ষণ না সে অযু করে”।[121]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«لاَ تُقْبَلُ صَلاَةٌ بِغَيْرِ طُهُوْرٍ وَلاَ صَدَقَةٌ مِنْ غُلُوْلٍ».
“পবিত্রতা ব্যতীত কোনো সালাত কবুল করা হবে না। তেমনিভাবে আত্মসাৎ করা গণিমতের মাল থেকে কোনো সদকা গ্রাহ্য হবে না”।[122]
‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مِفْتَاحُ الصَّلاَةِ الطُّهُوْرُ، وَتَحْرِيْمُهَا التَّكْبِيْرُ، وَتَحْلِيْلُهَا التَّسْلِيْمُ».
“পবিত্রতা সালাতের চাবি তথা পূর্বশর্ত। তাকবীর সালাতের ভেতর সালাত ভিন্ন অন্য কর্ম হারামকারী এবং সালাম সালাত শেষে সালাত আদায়কারীর জন্য সকল হারামকৃত কর্ম হালালকারী”।[123]
২. কা‘বা শরীফ তাওয়াফের জন্য:
কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করার জন্য পবিত্রতা আবশ্যক।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الطَّوَافُ حَوْلَ الْبَيْتِ مِثْلُ الصَّلاَةِ، إِلاَّ أَنَّكُمْ تَتَكَلَّمُوْنَ فِيْهِ، فَمَنْ تَكَلَّمَ فِيْهِ فَلاَ يَتَكَلَّمَنَّ إِلاَّ بِخَيْرٍ».
“কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করা সালাত পড়ার ন্যায়। তবে তাওয়াফের সময় কথা বলা যায়। সুতরাং তোমাদের কেউ এ সময় কথা বললে সে যেন কল্যাণমূলক কথাই বলে”।[124]
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজের সময় আমার ঋতুস্রাব হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
«هَذَا شَيْءٌ كَتَبَهُ اللهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ، فَافْعَلِيْ مَايَفْعَلُ الْحَاجُّ، غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوْفِيْ بِالْبَيْتِ حَتَّى تَطْهُرِيْ».
“এটি তোমার হস্তার্জিত কিছু নয়। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে মহিলাদের জন্য একান্ত অবধারিত। তাই হাজী সাহেবগণ যা করেন তুমিও তাই করবে। তবে তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি সম্পূর্ণরূপে পবিত্র হয়ে যাও”।[125]
উক্ত হাদীস তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা অনিবার্য হওয়াকে বুঝায়। বড় পবিত্রতার প্রয়োজন হলে তো তা অবশ্যই করতে হবে। নতুবা ছোট পবিত্রতাই তাওয়াফের জন্য যথেষ্ট।
২. কুরআন মাজীদ স্পর্শ করার জন্য:
কুরআন মাজীদ স্পর্শ করার জন্যও পবিত্রতা আবশ্যক।
‘আমর ইবন হাযম, হাকিম ইবন হিযাম ও আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلاَّ طَاهِرٌ».
“পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে”।[126]

অযুর  ফযীলত

অযুর ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে উহার কিয়দংশ নিম্নরূপ:
ক. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«إِنَّ أُمَّتِيْ يَأْتُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ غُرًّا مُّحَجَّلِيْنَ مِنْ أَثَرِ الْوُضُوْءِ، فَمَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يُطِيْلَ غُرَّتَهُ فَلْيَفْعَلْ».
“কিয়ামতের দিবসে আমার উম্মতের অযুর স্থানগুলো দীপ্তিমান ও শুভ্রোজ্জ্বল হয়ে দেখা দিবে। তাই তোমাদের কেউ নিজ ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সক্ষম হলে সে যেন তা করে”।[127]
খ. উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি উপস্থিত সকলকে ভালোরূপে অযু দেখিয়ে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনিভাবে অযু করতে দেখেছি। তিনি আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوْئِيْ هَذَا ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحْدِثُ فِيْهِمَا نَفْسَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».
“যে ব্যক্তি আমার অযুর ন্যায় অযু করে কায়মনোবাক্যে দু’ রাকাত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন”[128]
. উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لاَ يَتَوَضَّأُ رَجُلٌ مُسْلِمٌ فَيُحْسِنُ الْوُضُوْءَ، فَيُصَلِّيْ صَلاَةً إِلاَّ غَفَرَاللهُ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الصَّلاَةِ الَّتِيْ تَلِيْهَا».
“কোনো মুসলিম ব্যক্তি ভালোভাবে অযু করে সালাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা সে সালাত ও পরবর্তী সালাতের মধ্যকার সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন”।[129]
. উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«مَا مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلاَةٌ مَكْتُوْبَةٌ، فَيُحْسِنُ وُضُوْءَ هَا وَخُشُوْعَهَا وَرُكُوْعَهَا إِلاَّ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوْبِ، مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيْرَةً، وَذَلِكَ الدَّهْرَ كُلَّهُ».
“যখন কোনো মুসলিম ব্যক্তি যে কোনো ফরয সালাতের সময় ভালোভাবে অযু করে কায়মনোবাক্যে রুকু-সাজদাহ সঠিকভাবে আদায় করে সালাতটি সম্পন্ন করে তখন অত্র সালাতটি তার অতীত সকল গুনাহ’র কাফ্‌ফরা (ক্ষতিপূরণ) হয়ে যায়, যতক্ষণ সে কবীরা গুনাহ (বড় পাপ) না করে। আর এ নিয়মটি আজীবন কার্যকর হবে”।[130]
. উক্ববা ইবন ‘আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَامِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوْءَهُ، ثُمَّ يَقُوْمُ فَيُصَلِّيْ رَكْعَتَيْنِ، مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ».
“যখন কোনো মুসলিম ভালোভাবে অযু করে কায়মনোবাক্যে দু’ রাকাত সালাত আদায় করে তখন তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়”।[131]
. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ أَوِالْمُؤْمِنُ فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلُّ خَطِيْئَةٍ نَظَرَ  إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِقَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيْئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيْئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلاَهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوْبِ».
“যখন কোনো মুসলিম বা মুমিন ব্যক্তি অযু করে তখন তার মুখমণ্ডল ধোয়ার সাথে সাথেই চোখ দ্বারা কৃত সকল গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। আর যখন সে দু’হাত ধুয়ে ফেলে তখন উভয় হাত দ্বারা কৃত সকল গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। আর যখন সে দু’পা ধুয়ে ফেলে তখন পা দ্বারা কৃত সকল গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। অতএব, অযুশেষে সে ব্যক্তি সকল পাপপঙ্কিলতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পেয়ে যায়”।[132]
. উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوْءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِهِ حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ».
“যে ব্যক্তি ভালোভাবে অযু করে তার সকল গুনাহ শরীর থেকে বের হয়ে যায় এমনকি তার নখের নীচ থেকেও”।[133]
. ‘আমর ইবন আবাসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْكُمْ رَجُلٌ يُقَرِّبُ وَضُوْءَهُ فَيَتَمَضْمَضُ وَيَسْتَنْشِقُ فَيَنْتَثِرُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِهِ وَفِيْهِ وَخَيَاشِيْمِهِ، ثُمَّ إِذَا غَسَلَ وَجْهَهَ كَمَا أَمَرَهُ اللهُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِهِ مِنْ أَطْرَافِ لِحْيَتِهِ مَعَ الـْمَاءِ، ثُمَّ يَغْسِلُ يَدَيْهِ إِلَى الـْمِرْفَقَيْنِ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا يَدَيْهِ مِنْ أَنَامِلِهِ مَعَ الْـمَاءِ، ثُمَّ يَمْسَحُ رَأْسَهُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا رَأْسِهِ مِنْ أَطْرَافِ شَعْرِهِ مَعَ الـْمَـاءِ، ثُمَّ يَغْسِلُ قَدَمَيْهِ إِلَى الْكَعْبَيْنِ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا رِجْلَيْهِ مِنْ أَنَامِلِهِ مَعَ الـْمَاءِ، فَإِنْ هُوَ قَامَ فَصَلَّى، فَحَمِدَ اللهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَمَجَّدَهُ بِالَّذِيْ هُوَ لَهُ أَهْلٌ، وَفَرَّغَ قَلْبَهُ للهِ، إِلاَّ انْصَرَفَ مِنْ خَطِيْئَتِهِ كَهَيْئَةِ يَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ».
“যখন তোমাদের কেউ অযুর পানি হাতে নিয়ে কুলি করে, নাকে পানি দেয় ও নাক ঝেড়ে নেয় তখন তার মুখমণ্ডল, মুখগহ্বর ও নাসিকাছিদ্র থেকে সকল গুনাহ ঝরে পড়ে। আর যখন সে নিয়মানুযায়ী মুখমণ্ডল ধৌত করে তখন তার মুখমণ্ডলের সকল গুনাহ দাড়ির অগ্রভাগ দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। আর যখন সে কুনুই পর্যন্ত উভয় হাত ধৌত করে তখন তার উভয় হাতের গুনাহগুলো আঙ্গুলাগ্র দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। আর যখন সে মাথা মাসাহ করে তখন তার মাথার গুনাহ্গুলো কেশাগ্র দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। অনন্তর যখন সে পদযুগল উপরের গ্রন্থিসহ ধৌত করে তখন তার উভয় পায়ের গুনাহগুলো আঙ্গুলাগ্র দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। এরপর সে যখন সালাত পড়ে আল্লাহর প্রশংসা, গুণাগুণ ও কায়মনোবাক্যে আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে তখন সে সম্পূর্ণরূপে পাপমুক্ত হয়ে যায় যেমনিভাবে সে পাপমুক্ত ছিল জন্মলগ্নে”।[134]
. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُوْ اللهُ بِهِ الْـخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوْا: بَلَى، يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْـخُطَا إِلَى الْـمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ».
“আমি তোমাদেরকে এমন কিছু ‘আমলের সংবাদ দেবো কি? যা সম্পাদন করলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। সাহাবীগণ বললেন: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল! উত্তরে তিনি বললেন: কষ্টের সময় অযুর অঙ্গগুলো ভালোভাবে ধৌত করবে, মসজিদের প্রতি অধিক পদক্ষেপ দেবে এবং এক সালাত শেষে অন্য সালাতের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। পরিশেষে তিনি বলেন, এগুলো (সাওয়াবে) সীমান্ত প্রহরার ন্যায়। এগুলো (সাওয়াবে) সীমান্ত প্রহরার ন্যায়”।[135]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে অযু করতেন

১. অযুর শুরুতে নিয়্যাত করতেন
নিয়্যাত বলতে কোনো কর্ম সম্পাদনের দৃঢ় মনোপ্রতিজ্ঞাকে বুঝানো হয়। তা মুখে উচ্চারণ করার কিছু নয়। যে কোনো পুণ্যময় কর্ম সম্পাদনের পূর্বে নিয়্যাত আবশ্যক। নিয়্যাত ব্যতীত কোনো পুণ্যময় কর্ম আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না এবং নিয়্যাতের উপরই প্রতিটি কর্মের ফলাফল নির্ভরশীল। ভালোয় ভালো মন্দে মন্দ।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنيِّاَّتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيْبُهَا أَوْ إِلَى اِمْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ».
“প্রতিটি কর্ম নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল। যেমন নিয়্যাত তেমনই ফল। যেমন, কেউ যদি দুনিয়ার্জন বা কোনো রমণীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত (নিজ আবাসভূমি ত্যাগ) করে সে তাই পাবে যে জন্য সে হিজরত করেছে”।[136]
২. “বিসমিল্লাহ” পড়ে অযু শুরু করতেন।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ وَضُوْءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرِ اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ»
“আল্লাহর নাম উচ্চারণ তথা বিসমিল্লাহ পড়া ব্যতিরেকে অযু করা হলে তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না”।[137]
৩. ডান দিক থেকে অযু শুরু করতেন।
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ فِيْ تَنَعُّلِهِ وَتَرَجُّلِهِ وَطُهُوْرِهِ وَفِيْ شَأْنِهِ كُلِّهِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব কাজই ডান দিক থেকে শুরু করা পছন্দ করতেন। এমনকি জুতা পরা, মাথা আঁচড়ানো, পবিত্রতা অর্জন তথা সর্ব ব্যাপারই”।[138]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا تَوَضَّأْتُمْ فَابْدَؤُوا بِمَيَامِنِكُمْ»
“যখন তোমরা অযু করবে তখন তা ডান দিক থেকে শুরু করবে”।[139]
৪. দু’হাত কব্জি পর্যন্ত তিন বার ধুয়ে নিতেন
হুমরান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَفْرَغَ عُثْمَانُ  صلى الله عليه وسلم عَلَى كَفَّيْهِ ثَلاَثَ مِرَارٍ فَغَسَلَهُمَا».
“উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) হাতে পানি ঢেলে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধুয়েছেন”।[140]
৫. হাত ও পদযুগল ধোয়ার সময় আঙ্গুলগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলো কনিষ্ঠাঙ্গুলি দিয়ে খিলাল করে নিতেন
লাক্বীত ইবন সাবিরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَخَلِّلْ بَيْنَ الأَصَابِعِ»
“আঙ্গুলগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলো মলে নাও”।[141]
মুস্তাওরিদ ইবন শাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم تَوَضَّأَ فَخَلَّلَ أَصَابِعَ رِجْلَيْهِ بِخِنْصَرِهِ».
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অযু করার সময় কনিষ্ঠাঙ্গুলি দিয়ে দু’পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতে দেখেছি”।[142]
৬. এক বা তিন চিল্লু (করতলভর্তি পরিমাণ) পানি ডান হাতে নিয়ে তিন তিন বার একই সাথে কুল্লি করতেন ও নাকে পানি দিতেন এবং বাম হাত দিয়ে নাকের ছিদ্রদ্বয় ভালোভাবে ঝেড়ে নিতেন।
‘আমর ইবন আবু হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَضْمَضَ عَبْدُ اللهِ بْنُ زَيْدٍ رضي الله عنه وَاسْتَنْثَرَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ مِنْ غَرْفَةٍ وَاحِدَةٍ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: مَضْمَضَ وَاسْتَنْشَقَ مِنْ كَفَّةٍ وَاحِدَةٍ، فَفَعَلَ ذَلِكَ ثَلاَثًا، وَفِيْ رِوَايَةٍ: مَضْمَضَ وَاسْتَنْشَقَ وَاسْتَنْثَرَ ثَلاَثَ غَرَفَاتٍ» .
“আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) এক বা তিন করতলভর্তি পানি দিয়ে একই সাথে তিনবার কুল্লি ও নাক পরিষ্কার করেছেন”।[143]
‘আবদে খায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَضْمَضَ عَلِيٌّ رضي الله عنه وَنَثَرَ مِنَ الْكَفِّ الَّذِيْ يَأْخُذُ فِيْهِ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: ثُمَّ تَمَضْمَضَ مَعَ الاِسْتِنْشَاقِ بِمَاءٍ وَاحِدٍ».
“আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) একই করতলভর্তি পানি দিয়ে একইসাথে কুল্লি করেছেন ও নাক ঝেড়ে নিয়েছেন”[144]
‘আবদে খায়ের থেকে আরো বর্ণিত, তিনি বলেন,
«دَعَا عَلِيٌّ رضي الله عنه بِوَضُوْءٍ فَتَمَضْمَضَ وَاسْتَنْشَقَ وَنَثَرَ بِيَدِهِ الْيُسْرَى، فَفَعَلَ هَذَا ثَلاَثًا، ثُمَّ قَالَ: هَذَا طُهُوْرُ نَبِيِّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم»
“আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু পানি চাইলে তা আনা হয়। অতঃপর তিনি তা দিয়ে কুল্লি করেন ও নাকে পানি দেন এবং বাম হাত দিয়ে নাক পরিষ্কার করেন। এ কাজগুলো তিনি তিন তিন বার করেন। অতঃপর তিনি বলেন, এ হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্রতা”।[145]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালোরূপে অযু করতেন ও নাকে পানি দিতেন। তবে সাওম পালনকারী হলে তিনি শুধু প্রয়োজন মাফিক কুল্লি করতেন ও নাকে পানি দিতেন- এর চেয়ে বেশি নয়।
লাক্বীত ইবন সাবিরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَسْبِغِ الْوُضُوْءَ، وَخَلِّلْ بَيْنَ الأَصَابِعِ، وَبَالِغْ فِي الاِسْتِنْشَاقِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ صَائِمًا».
“ভালোভাবে অযু কর। আঙ্গুলগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলো মলে নাও এবং ভালোভাবে নাকে পানি দাও। তবে সাওম পালনকারী হলে তখন তা করতে যাবে না”।[146]
৭. তিনবার সমস্ত মুখমণ্ডল (কান থেকে কান এবং মাথার সম্মুখবর্তী চুলের গোড়া থেকে চিবুক ও দাড়ির নীচ পর্যন্ত) ধুয়ে নিতেন
‘আমর ইবন আবু হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ عَبْدُ اللهِ بْنُ زَيْدٍ رضي الله عنه وَجْهَهُ ثَلاَثًا».
“আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) সমস্ত মুখমণ্ডল তিনবার ধুয়েছেন”।[147]
৮. দাড়ি খেলাল করতেন
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يُخَلِّلُ لِحْيَتَهُ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাড়ি খেলাল করতেন”।[148]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم إِذَا تَوَضَّأَ أَخَذَ كَفًّا مِنْ مَاءٍ، فَأَدْخَلَهُ تَحْتَ حَنَكِهِ، فَخَلَّلَ بِهِ لِحْيَتَهُ وَقَالَ: هَكَذَا أَمَرَنِيْ رَبِّيْ عَزَّوَجَلَّ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অযু করতেন তখন এক চিল্লু পানি নিয়ে থুতনির নিচে প্রবাহিত করে দাড়ি খেলাল করতেন এবং বলতেন: আমার রব আমাকে এমনই করতে আদেশ করেছেন”।[149]
৯. উভয় হাত কনুইসহ তিনবার ধুয়ে নিতেন
হুমরান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ عُثْمَانُ رضي الله عنه يَدَيْهِ إِلَى الْـمِرْفَقَيْنِ ثَلاَثًا».
“উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) নিজ হস্তযুগল কনুইসহ তিনবার ধুয়েছেন”।[150]
নু‘আইম ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ رضي الله عنه يَدَهُ الْيُمْنَى حَتَّى أَشْرَعَ فِي الْعَضُدِ، ثُمَّ يَدَهُ الْيُسْرى حَتَّى أَشْرَعَ فِي الْعَضُدِ».
“আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) ডান হাত ধুয়েছেন এমনকি তিনি বাহু ধোয়া শুরু করেছেন। তেমনিভাবে তিনি বাম হাত ধুয়েছেন এমনকি তিনি বাহু ধোয়া শুরু করেছেন”।[151]
১০. সম্পূর্ণ মাথা একবার মাসাহ করতেন
মাসাহের নিয়ম হচ্ছে উভয় হাত পানিতে ভিজিয়ে মাথার অগ্রভাগে স্থাপন করে তা ঘাড়ের দিকে টেনে নিবে। তেমনিভাবে পুনরায় উভয় হাত ঘাড় থেকে মাথার অগ্রভাগের দিকে টেনে আনবে। অতঃপর উভয় হাতের তর্জনী কর্ণযুগলে প্রবেশ করাবে এবং উভয় কর্ণের পৃষ্ঠদেশে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে দিবে। ‘আমর ইবন আবু হাসান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَسَحَ عَبْدُ اللهِ بْنُ زَيْدٍ رضي الله عنه رَأْسَهُ بِيَدَيْهِ، فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ، وَفِيْ رِوَايَةٍ : مَرَّةً وَاحِدَةً، بَدَأَ بِمُقَدَّمِ رَأْسِهِ حَتَّى ذَهَبَ بِهِمَا إِلَى قَفَاهُ ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْـمَكَانِ الَّذِيْ بَدَأَ مِنْهُ».
“আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয় হাত আগে পিছে টেনে একবার মাথা মাসাহ করেছেন। মাথার অগ্রভাগ থেকে শুরু করে উভয় হাত ঘাড়ের দিকে টেনে নিয়েছেন। পুনরায় উভয় হাত ঘাড় থেকে মাথার অগ্রভাগের দিকে টেনে এনেছেন”।[152]
মিকদাম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَسَحَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم بِرَأْسِهِ وَأُذُنَيْهِ ظَاهِرِهِمَا وَبَاطِنِهِمَا، وَفِيْ رِوَايَةٍ : وَأَدْخَلَ أَصَابِعَهُ فِيْ صِمَاخِ أُذُنَيْهِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা ও কর্ণদ্বয়ের ভেতর ও উপরিভাগ মাসাহ করেছেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ অঙ্গুলীটি কর্ণগহবরে প্রবেশ করিয়েছেন”।[153]
১১. উভয় পা টাখনুসহ তিনবার ধুয়ে নিতেন
হুমরান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ عُثْمَانُ رضي الله عنه رِجْلَهُ الْيُمْنَى إِلَى الْكَعْبَيْنِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ، ثُمَّ غَسَلَ الْيُسْرَى مِثْلَ ذَلِكَ».
“উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুয়েছেন। তেমনিভাবে বাম পাও”।[154]
নু‘আইম ইবন ‘আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ أَبُوْ هُرَيْرةَ رضي الله عنه رِجْلَهُ الْيُمْنَى حَتَّى أَشْرَعَ فِي السَّاقِ، ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَهُ الْيُسْرَى حَتَّى أَشْرَعَ فِي السَّاقِ».
“আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) ডান পা ধুয়েছেন। এমনকি তিনি তাঁর পায়ের জঙ্ঘাটুকুও ধোয়া শুরু করেছেন। তেমনিভাবে তিনি বাম পা ধুয়েছেন এমনকি তিনি তাঁর পায়ের জঙ্ঘাটুকুও ধোয়া শুরু করেছেন”।[155]
১২. অযু শেষে নিচের পরিধেয় বস্ত্রে পানি ছিঁটিয়ে দিতেন।
তাতে করে পবিত্রতা সংক্রান্ত মনের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়।
হাকাম ইবন সুফ্ইয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم إِذَا بَالَ يَتَوَضَّأُ وَيَنْتَضِحُ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্রাব করে অযু করতেন এবং নিচের পরিধেয় বস্ত্রে পানি ছিঁটিয়ে দিতেন”।[156]
১৩. অযু শেষে নিম্নোক্ত দো‘আসমূহ পাঠ করতেন।
উক্বা ইবন ‘আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُبْلِغُ أَوْ فَيُسْبِغُ الْوُضُوْءَ ثُمَّ يَقُوْلُ: أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ، إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ، يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ».
“তোমাদের কেউ ভালোভাবে অযু করে যখন পড়বে: “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুল্লাহি ওয়া রাসূলুহু” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল) তখন তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা উন্মুক্ত করা হবে। তখন তার ইচ্ছে সে যে কোনো দরজা দিয়েই প্রবেশ করুক না কেন”।[157]
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوْءَ ثُمَّ قَالَ: أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، اَللَّهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ وَاجْعَلْنِيْ مِنَ الْـمُتَطَهِّرِيْنَ ؛ فُتِحَتْ لَهُ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ»
“যে ব্যক্তি অযু করে পড়বে : “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু। আল্লাহুম্মাজ ‘আলনী মিনাত তাওআবীনা ওয়াজ আলনী মিনাল মুতাতাহ্‌হিরীন (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন) তখন তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা উন্মুক্ত করা হবে। তার ইচ্ছে সে যে কোনো দরজা দিয়েই প্রবেশ করুক না কেন”।[158]
এ ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তেন।
«سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ».
উচ্চারণ: “সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আন্তা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইক।
“হে আল্লাহ! আপনি পাক-পবিত্র এবং সকল প্রশংসা আপনার জন্যই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া সত্যিকার কোনো উপাস্য নেই। উপরন্তু আমি আপনার নিকট তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি”।[159]
১৪. অযু শেষে তিনি দু’ রাকাত সালাত পড়তেন
যে ব্যক্তি অযু শেষে কায়মনোবাক্যে দু’ রাকাত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং জান্নাত হবে তার জন্য অবধারিত।
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوْئِي هَذَا ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ فِيْهِمَا نَفْسَهُ غَفَرَ اللهُ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».
“যে ব্যক্তি আমার অযুর ন্যায় অযু করে কায়মনোবাক্যে দু’ রাকাত সালাত আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন”।[160]
উক্বা ইবন ‘আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوْءَهُ، ثُمَّ يَقُوْمُ فَيُصَلِّيْ رَكْعَتَيْنِ، مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ إِلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ» .
“যে কোনো মুসলিম যখন ভালোভাবে অযু করে কায়মনোবাক্যে দু’ রাকাত সালাত আদায় করে তখন তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়”[161]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু কে ফজরের সময় বললেন:
«يَابِلاَلُ! حَدِّثْنِيْ بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِي الإِسْلاَمِ، فَإِنِّيْ سَمِعْتُ دَفَّ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ فِي الْجَنَّةِ، قَالَ بِلاَلُ: مَاعَمِلْتُ عَمَلًا فِي الإِسْلاَمِ أَرْجَى عِنْدِيْ مَنْفَعَةً، مِنْ أَنِّيْ لاَ أَتَطَهَّرُ طُهُوْرًا تَامًّا فِيْ سَاعَةٍ مِنْ لَيْلٍ وَلاَ نَهَارٍ إِلاَّ صَلَّيْتُ بِذَالِكَ الطُّهُوْرِ مَا كَتَبَ اللهُ لِيْ أَنْ أُصَلِّيَ» .
“হে বিলাল! তুমি ইসলাম গ্রহণ করার পর সবচেয়ে বড় আশাব্যঞ্জক এমন কি আমল করলে তা আমাকে বল। কারণ, আমি জান্নাতের মধ্যে আমার সম্মুখ দিক থেকে তোমার জুতার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর এমন কোনো অধিক আশাব্যঞ্জক ও লাভজনক কাজ করেছি বলে মনে হয় না। তবে একটি কাজ করেছি বলে মনে পড়ে তা হলো আমি দিবারাত্রি যখনই ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করেছি তখনই সে পবিত্রতা দিয়ে যথাসাধ্য সালাত পড়েছি”।[162]

অযুর  অঙ্গগুলো দু’ একবারও ধোয়া যায়:
অযুর অঙ্গগুলো তিন তিন বার ধোয়া পরিপূর্ণ অযুর নিয়ম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সাধারণত প্রতিটি অঙ্গ তিন তিন বার ধুতেন। এ কারণেই অধিকাংশ অযুর বর্ণনায় তিন বারের কথাই উল্লিখিত হয়েছে। তবে কেউ প্রতিটি অঙ্গ এক এক বার বা দু’ দু’ বার অথবা কোনো অঙ্গ দু’বার আবার কোনো অঙ্গ তিনবার ধুলেও তার অযু হয়ে যাবে।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم مَرَّةً مَرَّةً ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ এক এক বার ধুয়ে অযু করেছেন”।[163]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم مَرَّتَيْنِ مَرَّتَيْنِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি অঙ্গ দু’ দু’ বার ধুয়ে অযু করেছেন”।[164]
আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَغَسَلَ وَجْهَهُ ثَلاَثًا، وَغَسَلَ يَدَيْهِ مَرَّتَيْنِ مَرَّتَيْنِ، وَمَسَحَ بِرَأْسِهِ، وَغَسَلَ رِجْلَيْهِ مَرَّتَيْنِ ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে অযু করেছেন ; নিজ মুখমণ্ডল তিন বার ধুয়েছেন। উভয় হাত দু’ দু’ বার ধুয়েছেন। মাথা মাসাহ করেছেন এবং পদযুগল দু’ দু’ বার ধুয়েছেন”।[165]
তবে প্রতিটি অঙ্গ তিন তিন বার ধুলেই অযু পরিপূর্ণ হয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَتَى رَجُلٌ النَّبِيَّ  صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! كَيْفَ الطُّهُوْرُ؟ فَدَعَا بِمَاءٍ فِي إِنَاءٍ فَغَسَلَ كَفَّيْهِ ثَلاَثًا، ثُمَّ غَسَلَ وَجْهَهُ ثَلاَثًا، ثُمَّ غَسَلَ ذِرَاعَيْهِ ثَلاَثًا، ثُمَّ مَسَحَ بِرَأْسِهِ فَأَدْخَلَ إِصْبَعَيْهِ السَّبَّاحَتَيْنِ فِيْ أُذُنَيْهِ، وَمَسَحَ بِإِبْهَامَيْهِ عَلَى ظَاهِرِأُذُنَيْهِ وَبِالسَّبَّاحَتَيْنِ بَاطِنَ أُذُنَيْهِ، ثُمَّ غَسَلَ رِجْلَيْهِ ثَلاَثًا ثَلاَثًا، ثُمَّ قَالَ: هَكَذَا الْوُضُوْءُ، فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا أَوْ نَقَصَ فَقَدْ أَسَاءَ وَظَلَمَ، أَوْ ظَلَمَ وَأَسَاءَ ».
“জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পবিত্রতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি পানি আনতে বলেন। পানি আনা হলে হস্তদ্বয় তিন তিন বার ধৌত করেন। অতঃপর মুখমণ্ডল তিন বার ও হস্তযুগল তিন তিন বার ধৌত করেন। এরপর মাথা মাসাহ করেন। পুনরায় শাহাদাত আঙ্গুল দু’টি উভয়কানে ঢুকিয়ে কান মাসাহ করেন। উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দু’কানের উপরিভাগ ও দুই শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে দু’কানের ভেতরের অংশ মাসাহ করেন। তারপর দুই পা তিন তিন বার ধৌত করেন। অতঃপর তিনি বলেন, এভাবেই অযু করতে হয়। যে ব্যক্তি এর চেয়ে কম বা বেশি করল সে নিজের ওপর অত্যাচার ও অন্যায় করল”।[166]
উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে রচিত কোনো কোনো বই-পুস্তকে অযুর প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার সময় নির্দিষ্টভাবে পাঠ্য কিছু দো‘আর উল্লেখ রয়েছে যা পাঠ করা কুরআন ও সহীহ হাদীসের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আত। কারণ, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের কোনো স্বর্ণ যুগে প্রচলিত ছিল না।

অযুর  কোনো অঙ্গ ধোয়ার সময় চুল পরিমাণ জায়গাও শুকনা রাখা যাবে না:
অযুর কোনো অঙ্গ ধোয়ার সময় চুল পরিমাণ জায়গাও যদি শুকনা থেকে যায় তাহলে অযু কোনোভাবেই শুদ্ধ হবে না।
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মক্কা থেকে মদিনা রওয়ানা করেছিলাম। পথিমধ্যে পানি মিলে গেলে কেউ কেউ তড়িঘড়ি আসরের সালাতের জন্য অযু সেরে নেয়। অথচ আমরা তাদের পায়ের কিছু অংশ শুকনা দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَيْلٌ لِلأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ، أَسْبِغُوْا الْوُضُوْءَ» .
“ধ্বংস! এই গোড়ালিগুলোর জন্যে তা জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে। অতএব, তোমরা ভালোভাবে অযু কর”।[167]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ رَجُلٌ فَتَرَكَ مَوْضِعَ ظُفُرٍ عَلَى قَدَمِهِ فَأَبْصَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَقَالَ: اِرْجِعْ فَأَحْسِنْ وُضُوْءَكَ، فَرَجَعَ ثُمَّ صَلَّى» .
“অযু করার সময় জনৈক ব্যক্তির পায়ে নখ পরিমাণ জায়গা শুকনা থেকে গেলে তা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যাও ভালোভাবে অযু করে এসো। অতঃপর সে অযু করে এসে পুনরায় সালাত আদায় করল”।[168]

এক অযু দিয়ে কয়েক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা যায়:
এক অযু দিয়ে কয়েক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা যায়।
বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«صَلَّى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم الصَّلَوَاتِ يَوْمَ الْفَتْحِ بِوُضُوْءٍ وَاحَدٍ وَمَسَحَ عَلَى خُفَّيْهِ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: لَقَدْ صَنَعْتَ الْيَوْمَ شَيْئًا لَمْ تَكُنْ تَصْنَعُهُ، قَالَ: عَمْدًا صَنَعْتُهُ يَا عُمَرُ!» .
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন একই অযু দিয়ে কয়েক ওয়াক্ত সালাত আদায় করেছেন এবং দুই মোজার উপর মাসাহ করেছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন: আজ আপনি এমন কাজ করেছেন যা ইতোপূর্বে কখনো করেন নি। তিনি বললেন: হে উমার! আমি তা ইচ্ছা করেই করেছি”।[169]

অযুর  ফরয ও রুকনসমূহ

ধর্মীয় কোনো কাজ বা আমলের ফরয বা রুকন বলতে এমন কিছু ক্রিয়াকর্মকে বুঝানো হয় যা না করা হলে ঐ কাজ বা আমলটি সম্পাদিত হয়েছে বলে গণ্য করা হয় না যতক্ষণ না সে ঐ কর্মগুলো সম্পাদন করে। অযুর ফরয বা রুকন ছয়টি যা নিম্নরূপ:
১. সমস্ত মুখমণ্ডল ধৌত করা:
কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া এবং নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করা এরই অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱغۡسِلُواْ وُجُوهَكُمۡ﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমরা নিজ মুখমণ্ডল ধৌত কর”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
লাক্বীত ইবন সাবিরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَبَالِغْ فِي الاِسْتِنْشَاقِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ صَائِمًا».
“খুব ভালোভাবে নাকে পানি দিবে। তবে সাওম পালনকারী হলে একটু কম করে দিবে”।[170]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
«إِذَا تَوَضَّأْتَ فَمَضْمِضْ».
“অযু করার সময় কুলি করবে”।[171]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ تَوَضَّأَ فَلْيَسْتَنْثِرْ».
“যে ব্যক্তি অযু করবে তার জন্য আবশ্যক সে যেন নাক ঝেড়ে নেয়”।[172]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা কুলি করতেন ও নাকে পানি দিতেন।
২. কনুইসহ উভয় হাত ধৌত করা:
প্রথমে ডান হাত অতঃপর বাম হাত ধৌত করবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَيۡدِيَكُمۡ إِلَى ٱلۡمَرَافِقِ﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমরা উভয় হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত কর”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
হুম্রান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«غَسَلَ عُثْمَانُ رضي الله عنه يَدَيْهِ إِلَى الْـمِرْفَقَيْنِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ».
“উস্মান রাদিয়াল্লাহু আনহু (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু দেখাতে গিয়ে) উভয় হাত কনুইসহ তিনবার ধৌত করেন”।[173]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا تَوَضَّأْتُمْ فَابْدَؤُوْا بِمَيَامِنِكُمْ» .
“তোমরা ডান হাত ধোয়ার মাধ্যমে অযু শুরু করবে”।[174]
৩. সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা:
সম্পূর্ণ মাথা একবার মাসাহ করা অযুর রুকন। এ ছাড়া মাথা মাসাহ করার ক্ষেত্রে কানদ্বয় মাথার অধীন হিসেবে গণ্য করা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমরা মাথা মাসাহ কর”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الأُذُنَانِ مِنَ الرَّأْسِ».
“উভয় কান (মাসাহ করার ক্ষেত্রে) মাথার অন্তর্ভুক্ত”।[175]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা মাথা মাসাহ করার সাথে সাথে উভয় কানও মাসাহ করতেন।
হাদীসে মাথা মাসাহ করার তিনটি ধরণ উল্লেখ হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
ক. সরাসরি সম্পূর্ণ মাথা মাসাহ করা
আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَسَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم رَأْسَهُ بِيَدَيْهِ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ، بَدَأَ بِمُقَدَّمِ رَأْسِهِ حَتَّى ذَهَبَ بِهِمَا إِلَى قَفَاهُ، ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْمَكَانِ الَّذِيْ بَدَأَ مِنْهُ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় হাত দিয়ে নিজ মাথা মাসাহ করেন। উভয় হাত মাথার উপর রেখে সামনে ও পেছনে টেনে নেন। অর্থাৎ মাসাহ এভাবে করেন; উভয় হাত মাথার অগ্রভাগে রেখে ঘাড়ের দিকে টেনে নিয়েছেন। পুনরায় হস্তদ্বয় পেছন দিক থেকে সামনের দিকে টেনে এনেছেন”।[176]
খ. মাথায় দৃঢ়ভাবে বাঁধা পাগড়ীর উপর মাসাহ করা
‘আমর ইবন উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَمْسَحُ عَلَى عِمَامَتِهِ».
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাগড়ীর উপর মাসাহ করতে দেখেছি”।[177]
তবে পাগড়ীর উপর মাসাহ করা শর্ত সাপেক্ষ যেমনিভাবে মোজা মাসাহ করা শর্ত সাপেক্ষ।
গ. পাগড়ি ও কপাল উভয়টি মাসাহ করা
মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَمَسَحَ بِنَاصِيَتِهِ وَعَلَى الْعِمَامَةِ وَعَلَى الْـخُفَّيْنِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করার সময় কপাল, পাগড়ি ও মোজা মাসাহ করেছেন”।[178]
বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَسَحَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم عَلَى الْـخُفَّيْنِ وَالْخِمَارِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মোজাদ্বয় ও মস্তকাবরণ মাসাহ করেছেন”।[179]
৪. উভয় পা টাখনুসহ ধৌত করা:
পদযুগল ধোয়ার সময় গোড়ালির প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রাখবে। যেন তা ভালোভাবে ধোয়া হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِ﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমরা পদযুগল টাখনুসহ ধেŠত কর”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ ইবন উমর এবং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَيْلٌ لِلأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ» .
“ধ্বংস! গোড়ালিগুলোর জন্যে তা জাহান্নামের আগুনে বিদগ্ধ হবে”।[180]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা পাযুগল গোড়ালি ও টাখনুসহ ধৌত করতেন।
৫. ধোয়ার সময় অঙ্গগুলোর মাঝে পর্যায়ক্রম বজায় রাখা:
ধোয়ার সময় অঙ্গগুলোর মাঝে পর্যায়ক্রম বজায় রাখা অযুর রুকন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদের মধ্যে অযুর অঙ্গগুলো সারিবদ্ধভাবে উল্লেখ করেছেন এবং এ পর্যায়ক্রম বজায় রাখার জন্যই মাসাহ’র অঙ্গটি পরিশেষে উল্লেখ না করে ধোয়ার অঙ্গগুলোর মাঝেই উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا قُمۡتُمۡ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغۡسِلُواْ وُجُوهَكُمۡ وَأَيۡدِيَكُمۡ إِلَى ٱلۡمَرَافِقِ وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِ﴾ [المائ‍دة: ٦] 
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা সালাতের উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হবে (অথচ তোমাদের অযু নেই) তখন সমস্ত মুখমণ্ডল ও উভয় হাত কনুইসহ ধৌত করবে এবং মাথা মাসাহ করবে ও পদযুগল টাখনু পর্যন্ত ধৌত করবে”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৬]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অঙ্গগুলোর পর্যায়ক্রম বজায় রেখে অযু করতেন।
তিনি বলতেন:
«أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللهُ بِهِ»
“আমি শুরু করছি যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা শুরু করেছেন”।[181]
৬. অযুর সময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মাঝে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা:
অযুর  সময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মাঝে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বলতে একটি অঙ্গ ধোয়ার পর অন্য অঙ্গ ধুতে এতটুকু দেরী না করাকে বুঝানো হয় যাতে করে প্রথম অঙ্গটি শুকিয়ে যায়। কোনো কারণে এতটুকু দেরী হয়ে গেলে আবার নতুনভাবে অযু করবে।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ رَجُلٌ فَتَرَكَ مَوْضِعَ ظُفُرٍعَلَى قَدَمِهِ، فَأَبْصَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَقَالَ: اِرْجِعْ فَأَحْسِنْ وُضُوْءَكَ، فَرَجَعَ ثُمَّ صَلَّى».
“জনৈক ব্যক্তি অযু করেছে ঠিকই তবে তার পায়ে নখ সমপরিমাণ জায়গা শুষ্ক থেকে যায়। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যাও ভালোভাবে অযু করে আসো। অতঃপর সে ভালোভাবে অযু করে পুনরায় সালাত আদায় করল”।[182]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
«رَأَى النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم رَجُلًا يُصَلِّي، وَفِيْ ظَهْرِ قَدَمِهِ لُـمْعَةٌ قَدْرُ الدِّرْهَمِ لَمْ يُصِبْهَا الْـمَاءُ، فَأَمَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم أَنْ يُعِيْدَ الْوُضُوْءَ وَالصَّلاَةَ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে সালাত পড়তে দেখলেন, অথচ তার পায়ের উপরিভাগে এক দিরহাম সমপরিমাণ জায়গা শুষ্ক দেখা যাচ্ছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পুনরায় অযু করে সালাত আদায় করতে আদেশ করেন”।[183]
যদি অযুর অঙ্গগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ওয়াজিব না হতো তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু শুষ্ক স্থানটি ধোয়ার আদেশ করতেন। সম্পূর্ণ অযু পুনরাবৃত্ত করার আদেশ করতেন না। তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারলাম, অযুর অঙ্গগুলোর মাঝে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ফরয বা রুকন।

অযুর  শর্তসমূহ:
অযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য দশটি শর্ত রয়েছে তা নিম্নরূপ:
১. অযুকারী মুসলিম হতে হবে। অতএব, কাফির বা মুশরিক অযু করলেও তার অযু শুদ্ধ হবে না। তাই সে অযু বা গোসল করে কখনোই পবিত্র হতে পারবে না।
২. অযুকারী জ্ঞানসম্পন্ন থাকতে হবে। অতএব, পাগল ও মাতালের অযু শুদ্ধ হবে না যতক্ষণনা তাদের চেতনা ফিরে আসে।
৩. অযুকারী ভালোমন্দ ভেদাভেদজ্ঞান রাখে এমন হতে হবে। অতএব, বাচ্চাদের অযু শরী‘আতে ধর্তব্য নয়। তাদের অযু করা না করা সমান।
৪. নিয়্যাত করতে হবে। অতএব, নিয়্যাত ব্যতীত অযু গ্রহণযোগ্য হবে না।
৫. অযু শেষ হওয়া পর্যন্ত পবিত্রতা অর্জনের নিয়্যাত বহাল থাকতে হবে। অতএব, অযু চলাকালীন নিয়্যাত ভঙ্গ করলে অযু শুদ্ধ হবে না।
৬. অযু চলাকালীন অযু ভঙ্গের কোনো কারণ যেন পাওয়া না যায়। তা না হলে অযু তৎক্ষণাৎই ভেঙ্গে যাবে।
৭. অযুর পূর্বে মলমূত্র ত্যাগ করে থাকলে ঢিলাকুলুপ বা পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতে হবে।
৮. অযুর পানি পবিত্র ও জায়েয পন্থায় সংগৃহীত হতে হবে।
৯. অযুর অঙ্গগুলোতে পানি পৌঁছুতে বাধা প্রদান করে এমন বস্তু অপসারণ করতে হবে।
১০. অযু ভঙ্গের কারণ সর্বদা পাওয়া যাচ্ছে এমন ব্যক্তির জন্য সালাতের ওয়াক্ত উপস্থিত হতে হবে।
“মূলতঃ সালাতের সময় হলেই কেবল এমন ব্যক্তিরা অযু করবে”

অযুর  সুন্নাতসমূহ:
অযুর  মধ্যে যেমন ফরয রয়েছে তেমনিভাবে সুন্নাতও রয়েছে। অযুর সুন্নাতগুলো নিম্নরূপ:
১. মিসওয়াক করা:
অযু করার সময় মিসওয়াক করা সুন্নাত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِيْ لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ وُضُوْءٍ».
“আমার উম্মতের জন্য আদেশটি মানা যদি কষ্টকর না হতো তাহলে আমি ওদেরকে প্রত্যেক অযুর সময় মিসওয়াক করতে আদেশ করতাম”।[184]
২. অযু করার পূর্বে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করা:
তবে ঘুম থেকে জেগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া ওয়াজিব। এ সংক্রান্ত হাদীস পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
৩. অযুর অঙ্গগুলো ঘষেমলে ধৌত করা:
আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم بِثُلُثَيْ مُدٍّ فَجَعَلَ يَدْلُكُ ذِرَاعَهُ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক মুদ (দু’ করতলভর্তি সমপরিমাণ) এর দু’ তৃতীয়াংশ পানি আনা হলে তিনি তা দিয়ে নিজ হস্ত মর্দন করেন”।[185]
৪. অযুর প্রতিটি অঙ্গ তিন তিন বার ধোয়া। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযুর অঙ্গগুলো বেশির ভাগ সময় তিন তিন বার ধুয়েছেন। তেমনিভাবে তিনি কখনো অযুর অঙ্গগুলো দু’ দু’বার আবার কখনো এক একবার এবং কখনো কোনো অঙ্গ দু’বার আবার কোনো অঙ্গ তিনবার ধুয়েছেন। এ সম্পর্কীয় সকল হাদীস পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
৫. অযুর শেষে দো‘আ পড়া। এ সম্পর্কীয় হাদীস পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
৬. অযুশেষে দু’ রাকাত (তাহিয়্যাতুল উযু) সালাত আদায় করা। এ সম্পর্কীয় হাদীসও পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
৭. কোনো বাড়াবাড়ি ব্যতীত স্বাভাবিক পন্থায় ভালোভাবে অযু করা। অতএব, উত্তম পন্থা হচ্ছে ; বাড়াবাড়ি ছাড়া প্রতিটি অঙ্গ তিন তিনবার ধোয়া। চাই তা অযুর মধ্যে হোক বা গোসলে।
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَغْتَسِلُ مِنْ إِنَاءٍ هُوَالْفَرَقُ - مِنَ الْـجَنَابَةِ، قَالَ سُفْيَانُ: وَالْفَرَقُ ثَلاَثَةُ آصُعٍ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন সা’ তথা সাড়ে সাথ লিটার সমপরিমাণ পানি দিয়ে ফরয গোসল করতেন”।[186]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَتَوَضَّأُ بِالْـمُدِّ وَيَغْتَسِلُ بِالصَّاعِ إِلَى خَمْسَةِ أَمْدَادٍ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুদ দিয়ে অযু এবং চার বা পাঁচ মুদ দিয়ে গোসল করতেন”।[187]
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَتْ تَغْتَسِلُ هِيَ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فِيْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ يَسَعُ ثَلاَثَةَ أَمْدَادٍ أَوْ قَرِيْبًا مِنْ ذَلِكَ».
“তিনি ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমবেশি তিন মুদ পানি দিয়ে একত্রে গোসল করতেন”।[188]
উম্মে উমারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَأُتِيَ بِإِنَاءٍ فِيْهِ مَاءٌ قَدْرُ ثُلُثَيِ الْـمُدِّ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক মুদের দু’ তৃতীয়াংশ পানি আনা হলে তিনি তা দিয়ে অযু করেন”।[189]
এ হাদীসগুলো থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ভালোভাবে অযু করতে হবে ঠিকই তবে পানি ব্যবহারে কোনো ধরণের বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
আব্দুল্লাহ ইবন ‘আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بِتُّ عِنْدَ خَالَتِيْ مَيْمُوْنَةَ لَيْلَةً، فَلَمَّا كَانَ فِيْ بَعْضِ اللَّيْلِ قَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَتَوَضَّأَ مِنْ شَنٍّ مُعَلَّقٍ وُضُوْءًا خَفِيْفًا وَقَامَ يُصَلَّيْ».
“একদা আমি আমার খালা মাইমূনাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট রাত্রিযাপন করেছিলাম। রাত্রের কিছু অংশ পেরিয়ে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে টাঙ্গানো এক পুরাতন মশক থেকে পানি নিয়ে হালকাভাবে অযু করে সালাতের জন্য দাঁড়িয়ে যান”।[190]
‘আমর ইবন শু‘আইব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার দাদা বলেছেন:
«جَاءَ أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ  صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُهُ عَنِ الْوُضُوْءِ فَأَرَاهُ الْوُضُـوْءَ ثَلاَثًا ثَلاَثًا، ثُمَّ قَالَ: هَكَذَا الْوُضُوْءُ، فَمَنْ زَادَ عَلَى هَذَا فَقَدْ أَسَاءَ وَتَعَدَّى وَظَلَمَ».
“জনৈক গ্রাম্য সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অযু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে প্রতিটি অঙ্গ তিন তিন বার ধুয়ে অযু করে দেখিয়েছেন। এর পর বললেন: এভাবেই অযু করতে হয়। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করল সে যেন অন্যায়, সীমাতিক্রম ও নিজের উপর অত্যাচার করল”।[191]
আব্দুল্লাহ ইবন মুগাফ্ফাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
«إِنَّهُ سَيَكُوْنُ فِيْ هَذِهِ الأُمَّةِ قَوْمٌ يَعْتَدُوْنَ فِي الطُّهُوْرِ وَالدُّعَاءِ».
“আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় জন্ম নিবে যারা পবিত্রতা ও দো‘আর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে”।[192]

যে যে কারণে অযু নষ্ট হয়

অযু করার পর নিম্নোক্ত কারণগুলোর কোনো একটি কারণ সংঘটিত হলে অযু বিনষ্ট হয়ে যাবে। কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. মল-মূত্রদ্বার দিয়ে কোনো কিছু বের হলে:
বায়ু, বীর্য, মযী, ওদী, ঋতুস্রাব, নিফাস ইত্যাদি এরই অন্তর্ভুক্ত। এ সকল বস্তু মল বা মূত্রদ্বার দিয়ে বের হলে অযু ইবনষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَوۡ جَآءَ أَحَدٞ مِّنكُم مِّنَ ٱلۡغَآئِطِ أَوۡ لَٰمَسۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَلَمۡ تَجِدُواْ مَآءٗ فَتَيَمَّمُواْ صَعِيدٗا طَيِّبٗا﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমাদের কেউ শৌচাগার থেকে মলমূত্র ত্যাগ করে আসলে অথবা স্ত্রী সহবাস করলে (পানি পেলে অযু বা গোসল করে নিবে) অতঃপর পানি না পেলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে”। [সূরা আল-মায়দাহ, আায়াত: ৬]
সাফওয়ান ইবন ‘আস্‌সাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَأْمُرُنَا إِذَا كُنَّا سَفْرًا أَنْ لاَ نَنْزِعَ خِفَافَنَا ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيْهِنَّ إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ ؛ وَلَكِنْ مِنْ غَائِطٍ وَبَوْلٍ وَنَوْمٍ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে রওয়ানা করলে তিনি আমাদেরকে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মলমূত্র ত্যাগ বা ঘুম যাওয়ার কারণে মোজা না খুলতে আদেশ করতেন। বরং মোজার উপর মাসাহ করতে বলতেন। তবে শুধু জানাবাতের গোসলের জন্য মোজা খুলতে বলতেন”।[193]
‘আববাদ ইবন তামীম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার চাচা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অভিযোগ করলেন যে, কারো কারোর ধারণা হয় সালাতের মধ্যে অযু নষ্ট হয়েছে বলে। তখন তাকে কি করতে হবে? তিনি বললেন:
«لاَ يَنْصَرِفُ حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيْحًا».
“সে সালাত ছেড়ে দিবে না যতক্ষণ না সে বায়ু নির্গমনধ্বনি বা দুর্গন্ধ পায়”।[194]
মিকদাদ ইবন আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মযী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا وَجَدَ أَحَدُكُمْ ذَلِكَ فَلْيَنْضَحْ فَرْجَهُ وَلْيَتَوَضَّأْ وُضُوْءَهُ لِلصَّلاَةِ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: يَغْسِلُ ذَكَرَهُ وَيَتَوَضَّأُ».
“তোমাদের কারোর এমন হলে সে তার লজ্জাস্থান ধুয়ে সালাতের অযুর ন্যায় অযু করে নিবে”।[195]
ইস্তিহাযা হলেও অযু করতে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা বিনতে আবু হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহা কে তার ইস্তিহাযা হলে বলেন,
«ثُمَّ تَوَضَّئِيْ لِكُلِّ صَلاَةٍ».
“অতঃপর প্রতি সালাতের জন্য অযু করবে”।[196]
২. ঘুম বা অন্য যে কোনো কারণে অচেতন হলে:
বিশুদ্ধ মতে গভীর নিদ্রায় অযু ভেঙ্গে যায়। এ ব্যাপারে সাফ্ওয়ান ইবন ‘আস্সালের হাদীস পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।
‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وِكَاءُ السَّهِ الْعَيْنَانِ، فَمَنْ نَامَ فَلْيَتَوَضَّأْ».
“চক্ষুদ্বয় গুহ্যদ্বারের পাহারাদার। অতএব, যে ব্যক্তি ঘুমাবে তাকে অবশ্যই অযু করতে হবে”।[197]
এ ছাড়া উন্মাদনা, সংজ্ঞাহীনতা ও মত্ততা ইত্যাদির কারণে চেতনাশূন্যতা দেখা দিলেও সকল আলেমের ঐকমত্যে অযু ভেঙ্গে যাবে।
৩. কোনো আবরণ ছাড়াই হাত দিয়ে লিঙ্গ বা গুহ্যদ্বার স্পর্শ করলে:
বুসরা বিনতে সাফওয়ান ও জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ مَسَّ ذَكَرَهُ فَلْيَتَوَضَّأْ».
“যে ব্যক্তি নিজ লিঙ্গ স্পর্শ করল সে যেন অযু করে নেয়”।[198]
উম্মে হাবিবা ও আবু আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
«مَنْ مَسَّ فَرْجَهُ فَلْيَتَوَضَّأْ».
“যে ব্যক্তি নিজ লজ্জাস্থান স্পর্শ করল সে যেন অযু করে নেয়”।[199]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا أَفْضَى أَحَدُكُمْ بِيَدِهِ إِلَى فَرْجِهِ وَلَيْسَ بَيْنَهُمَا سِتْرٌ وَلاَحِجَابٌ فَلْيَتَوَضَّأْ».
“তোমাদের কেউ কোনো আবরণ ছাড়াই নিজ লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে সে যেন অযু করে নেয়”।
আরবীতে গুহ্যদ্বারকেও ফার্জ বলা হয়। তাই লিঙ্গ ও গুহ্যদ্বারের বিধান একই।[200]
৪. উটের গোশত খেলে:
বারা’ ইবন ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم عَنِ الْوُضُوْءِ مِنْ لُـحُـوْمِ الإِبِلِ؟ فَقَالَ: تَوَضَّؤُوْا مِنْهَا، وَسُئِلَ عَنْ لُحُوْمِ الْغَنَمِ؟ فَقَالَ: لاَ تَوَضَّؤُوْا مِنْهَا».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উটের গোশত খেয়ে অযু করতে হবে কিনা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, উটের গোশত খেলে অযু করতে হবে। তেমনিভাবে তাঁকে ছাগলের গোশত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ছাগলের গোশত খেলে অযু করতে হবে না”।[201]
৫. মুরতাদ (যে ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছে) হয়ে গেলে:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُهُۥ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ﴾ [المائ‍دة: ٥]
“যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর কুফরি করবে তার আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং সে পরকালে সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে”। [সূরা আল-মায়দাহ, আয়াত: ৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ﴾ [الزمر: ٦٥]
“আপনি যদি শির্ক করেন তাহলে আপনার সকল কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৫]

শরীর থেকে রক্ত বের হলে অযু নষ্ট হয় না:
শরীরের কোনো স্থান থেকে রক্ত বের হলে অযু নষ্ট হবে না।
জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«خَرَجْنَا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فِيْ غَزْوَةِ ذَاتِ الرِّقَاعِ، فَأَصَابَ رَجُلٌ اِمْرَأَةَ رَجُلٍ مِنَ الْـمُشْرِكِيْنَ، فَحَلَفَ أَنْ لاَ أَنْتَهِيَ حَتَّى أُهْرِيْقَ دَمًا فِيْ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ، فَخَرَجَ يَتْبَعُ أَثَرَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَنَزَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم مَنْزِلًا، فَقَالَ: مَنْ رَجُلٌ يَكْلَؤُنَا؟ فَانْتَدَبَ رَجُلٌ مِنَ الْـمُهَاجِرِيْنَ وَرَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ، فَقَالَ: كُوْنَا بِفَمِ الشِّعْبِ قَالَ: فَلَمَّا خَرَجَ الرَّجُلاَنِ إِلَى فَمِ الشِّعْبِ اِضْطَجَعَ الْـمُهَاجِرِيُّ، وَقَامَ الأَنْصَارِيُّ يُصَلِّي، وَأَتَى الرَّجُلُ، فَلَمَّا رَأَى شَخْصَهُ عَرَفَ أَنَّهُ رَبِيْئَةٌ لِلْقَوْمِ فَرَمَاهُ بِسَهْمٍ فَوَضَعَهُ فِيْهِ فَنَزَعَـهُ، حَتَّى رَمَاهُ بِثَلاَثَةِ أَسْهُمٍ، ثُمَّ رَكَعَ وَسَجَـدَ، ثُمَّ انْتَبَهَ صَاحِبُهُ، فَلَمَّا عَرَفَ أَنَّهُمْ قَدْ نَذِرُوْا بِهِ هَرَبَ، وَلَمَّا رَأَى الْـمُهَاجِرِيُّ مَا بِالأَنْصَارِيِّ مِنَ الدَّمِ قَالَ: سُبْحَانَ اللهِ! أَلاَ أَنْبَهْتَنِيْ أَوَّلَ مَا رَمَى؟ قَالَ: كُنْتُ فِيْ سُوْرَةٍ أَقْرَأُهَا، فَلَمْ أُحِبَّ أَنْ أَقْطَعَهَا».
“আমরা রাসূল এর সাথে যাতুর্ রিকা’ যুদ্ধে গিয়েছিলাম। অতঃপর জনৈক সাহাবী জনৈক মুশরিকের স্ত্রীকে আঘাত করলে মুশরিকটি কসম করে বসে এ কথা বলে যে, সাহাবীদের রক্ত প্রবাহিত না করা পর্যন্ত আমি কখনো ক্ষান্ত হবো না। এতটুকু বলেই সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছু নিয়েছে। ইতোমধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক গুহায় অবস্থান নিয়ে বললেন: তোমরা কে আছো আমাদের পাহারাদারী করবে? মুহূর্তেই জনৈক মুহাজির ও জনৈক আনসারী এ কাজের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা উভয়ে গুহার মুখে অবস্থান কর। তারা উভয়ে গুহার মুখে পৌঁছলে মুহাজির সাহাবী ঘুমিয়ে পড়েন এবং আনসারী সাহাবী সালাত পড়তে শুরু করেন। ইতমধ্যে মুশরিকটি পৌঁছল। সে আনসারী সাহাবীকে দেখেই বুঝতে পারল যে, সে পাহারাদার। তাই সে সাহাবীকে লক্ষ্য করে পাকা হাতে একটি তীর ছুঁড়তেই তা সাহাবীর শরীরে বিঁধে গেল। তবে বীর সাহাবী তীরটি হাতে টেনে খুলে ফেলতে সক্ষম হলেন। এমনকি মুশরিকটি তাকে তিনটি তীর মারতে সক্ষম হয়। অতঃপর তিনি দ্রুত রুকু সদাহ আদায় করেন। ইতোমধ্যে মুহাজির সাহাবী জেগে যান। মুশরিকটি সাহাবদ্বয় তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়েছে বুঝতে পেরে দ্রুত পালিয়ে যায়। তখন মুহাজির সাহাবী আনসারী সাহাবীর গায়ে রক্ত দেখে বললেন: আশ্চর্য! প্রথম তীরের আঘাতের পরপরই আমাকে জাগালে না কেন? আনসারী বললেন: আমি একটি সূরাহ পড়ায় মগ্ন ছিলাম। তাই তা মাঝ পথে বন্ধ করে দেওয়া পছন্দ করি নি”।[202]
এমন হতে পারে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে কিছুই জানেন নি অথবা জেনে থাকলেও রক্ত বের হলে যে অযু চলে যায় তা তাকে বলে দেন নি বা বলে থাকলেও তা আমাদের নিকট এখনো পৌঁছেনি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শরীর থেকে রক্ত নির্গমন অযু ভঙ্গ করে না।

সালাতে অযু বিনষ্ট হলে ক করতে হবে:
সালাতে কারোর অযু ইবনষ্ট হলে সে নাকে হাত রেখে সালাতের কাতার থেকে বের হয়ে পুনরায় অযু করে সালাত আদায় করবে।
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا أَحْدَثَ أَحَدُكُمْ فِيْ صَلاَتِهِ ؛ فَلْيَأْخُذْ بِأَنْفِهِ ثُمَّ لِيَنْصَرِفْ».
“সালাতে তোমাদের কারোর অযু বিনষ্ট হলে সে নিজের নাকের উপর হাত রেখে সালাত থেকে বের হয়ে যাবে”।[203]

যখন অযু করা মুস্তাহাব

কতিপয় কারণ বা প্রয়োজনে অযু করা মুস্তাহাব। সে কারণ ও প্রয়োজনগুলো নিম্নরূপ:
. যিকির ও দো‘আর জন্য:
যিকির ও দো‘আর জন্য অযু করা মুস্তাহাব।
আবু মূসা ‘আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আমি আবু ‘আমেরকে দেওয়া ওয়াদানুযায়ী তার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সালাম, আল্লাহর নিকট তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন ও তার শাহাদাত সংবাদ পৌঁছালাম তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে তিনি দু’হাত উঁচিয়ে বললেন:
«اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعُبَيْدٍ أَبِيْ عَامِرٍ وَرَأَيْتُ بَيَاضَ إِبْطَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَوْقَ كَثِيْرٍ مِنْ خَلْقِكَ مِنَ النَّاسِ».
“হে আল্লাহ! আপনি উবাইদ আবু ‘আমেরকে ক্ষমা করে দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত খানা খুব উচিয়ে দো‘আ করেন। এমনকি তার বগলের শুভ্রতাও তখন দেখা যাচ্ছিল। অতঃপর তিনি দো‘আয় আরো বললেন: হে আল্লাহ! আপনি তাকে কিয়ামতের দিবসে অনেক মানুষের পর শ্রেষ্ঠত্ব দান করুন”।[204]
২. ঘুমানোর পূর্বে:
ঘুমানোর আগে অযু করা মুস্তাহাব।
বারা’ ইবন ‘আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا أَتَيْتَ مَضْجَعَكَ فَتَوَضَّأْ وُضُوْءَكَ لِلصَّلاَةِ، ثُمَّ اضْطَجِعْ عَلَى شِقِّكَ الأَيْمَنِ».
“যখন তুমি শোয়ার ইচ্ছে করবে তখন সালাতের অযুর ন্যায় অযু করবে। অতঃপর ডান কাত হয়ে শয়ন করবে”।[205]
৩. অযু নষ্ট হলে:
অযু ভঙ্গ হলেই অযু করা মুস্তাহাব।
বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَصْبَحَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَوْمًا فَدَعَا بِلاَلًا فَقَالَ: يَابِلاَلُ! بِمَ سَبَقْتَنِيْ إِلَى الْجَنَّةِ؟ إِنَّنِيْ دَخَلْتُ الْبَارِحَةَ الـْجَنَّةَ، فَسَمِعْتُ خَشْخَشَتَكَ أَمَامِيْ فَقَالَ بِلاَلُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! مَا أَذَّنْتُ قَطُّ إِلاَّ صَلَّيْتُ رَكْعَتَيْنِ، وَلاَ أَصَابَنِيْ حَدَثٌ قَطُّ إِلاَّ تَوَضَّأْتُ عِنْدَهُ».
“একদা ভোর বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু কে ডেকে বললেন: হে বেলাল! কীভাবে তুমি আমার আগে জান্নাতে পদার্পণ করলে? গত রাত্রিতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে আমার সম্মুখ থেকে তোমার পদধ্বনি শুনেছি। বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: হে রাসুল! আমি যখনই আযান দিয়েছি তখনই দু’ রাকাত সালাত পড়েছি। আর যখনই অযু নষ্ট হয়েছে তখনই অযু করেছি”।[206]
৪. প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য:
অযু থাকাবস্থায় প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য আবারো অযু করা মুস্তাহাব।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِيْ لأَمَرْتُهُمْ عِنْدَ كُلِّ صَلاَةٍ بِوُضُوْءٍ، وَمَعَ كُلِّ وُضُوْءٍ بِسِوَاكٍ»
“আদেশটি মানা যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর না হতো তাহলে আমি ওদেরকে প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য অযু করতে আদেশ করতাম। তেমনিভাবে প্রত্যেক অযুর সঙ্গে মিসওয়াক”।[207]
৫. মৃত ব্যক্তিকে কবরমুখে বহন করার পর:
মৃত ব্যক্তিকে কবরমুখে বহন করার পর অযু করা মুস্তাহাব।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ غَسَّلَ الْـمَيِّتَ فَلْيَغْتَسِلْ، وَمَنْ حَمَلَهُ فَلْيَتَوَضَّأْ».
“যে ব্যক্তি মৃতকে গোসল দেয় তার জন্য উচিত এই যে, সে যেন গোসল করে। আর যে ব্যক্তি মৃতকে বহন করে তার উচিত সে যেন অযু করে”।[208]
৬. বমি হলে:
বমি হলে অযু করা মুস্তাহাব।
আবু দারদা’ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قَاءَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَأَفْطَرَ، فَتَوَضَّأَ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বমি করার পর সাওম ভেঙ্গে ফেলেন। অতঃপর অযু করেন”।[209]
৭. আগুনে পাকানো কোনো খাবার খেলে:
আগুনে পাকানো কোনো খাবার খেয়ে অযু করা মুস্তাহাব।
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«تَوَضَّؤُوْا مِمَّا مَسَّتِ النَّارُ»
“তোমরা আগুনে পাকানো খাবার খেয়ে কিন্তু অযু করবে”।[210]
এর বিপরীতে আব্দুল্লাহ ইবন ‘আববাস, ‘আম ইবন উমাইয়া, মাইমূনা ও আবু রাফি’ থেকে বর্ণিত, তারা বলেন,
«أَكَلَ رَسُوْلُ اللهِ  صلى الله عليه وسلمكَتِفَ شَاةٍ ثُمَّ صَلَّى وَلَمْ يَتَوَضَّأ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাগলের উপরিস্থ মাংসল বাহুমূল খেয়ে অযু না করে সালাত পড়েছেন”।[211]
উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, আগুনে পাকানো কোনো খাবার খেয়ে অযু করা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়।
৮. জুনুবী ব্যক্তি কোনো খাবার খেতে ইচ্ছে করলে:
জুনুবী (সহবাসের কারণে অপবিত্র) ব্যক্তি কোনো খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছে করলে তার জন্য অযু করা মুস্তাহাব।
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم إِذَا كَانَ جُنُبًا فَأَرَادَ أَنْ يَأْكُلَ أَوْ يَنَامَ تَوَضَّأَ وُضُوْءَهُ لِلصَّلاَةِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুনুবী হলে এবং তিনি ঘুমানো বা খাদ্য গ্রহণের ইচ্ছে করলে সালাতের অযুর ন্যায় অযু করতেন”।[212]
৯. দ্বিতীয়বার সহবাসের জন্য:
একবার স্ত্রী সহবাস করে গোসল না সেরে দ্বিতীয়বার সহবাস করতে চাইলে অযু করে নেওয়া মুস্তাহাব।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا أَتَى أَحَدُكُمْ أَهْلَهُ ثُمَّ أَرَادَ أَنْ يَعُوْدَ فَلْيَتَوَضَّأْ»
“তোমাদের কেউ স্ত্রী সহবাস করে পুনর্বার সহবাস করতে চাইলে অযু করে নিবে”।[213]
উপরন্তু প্রতিবার সহবাসের জন্য গোসল করতে হয় না। পরিশেষে শুধু একবার গোসলই যথেষ্ট।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَطُوْفُ عَلَى نِسَائِهِ بِغُسْلٍ وَاحِدٍ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল বিবিদের সাথে সহবাস করে একবারই গোসল করতেন”।[214]
১০. জুনুবী ব্যক্তি গোসল না করে শোয়ার ইচ্ছে করলে:
জুনুবী ব্যক্তি গোসল না করে শোয়ার ইচ্ছে করলে তার জন্য অযু করা
মুস্তাহাব।
আবু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম :
«أَكَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَرْقُدُ وَهُوَ جُنُبٌ؟ قَالَتْ: نَعَمْ، وَيَتَوَضَّأُ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি জুনুবী অবস্থায় ঘুমাতেন? তিনি বললেন: হাঁ, তবে অযু করে নিতেন”।[215]
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
«أَيَرْقُدُ أَحَدُنَا وَهُوَ جُنُبٌ؟ قَالَ: نَعَمْ، لِيَتَوَضَّأْ ثُمَّ لِيَنَمْ حَتَّى يَغْتَسِلَ إِذَا شَاءَ».
“আমাদের কেউ জুনুবী অবস্থায় ঘুমাতে পারবে কি? তিনি বললেন: হাঁ, তবে অযু করে ঘুমাবে। পরে যখন মন চায় গোসল করে নিবে”।[216]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো সহবাস করে ঘুমানোর পূর্বে গোসল করে নিতেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আবু কাইস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম:
«كَيْفَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَصْنَعُ فِي الْـجَنَابَةِ؟ أَكَانَ يَغْتَسِلُ قَبْلَ أَنْ يَنَامَ أَمْ يَنَامُ قَبْلَ أَنْ يَغْتَسِلَ؟ قَالَتْ: كُلُّ ذَلِكَ قَدْ كَانَ يَفْعَلُ، رُبَّمَا اغْتَسَلَ فَنَامَ، وَرُبَّمَا تَوَضَّأَ فَنَامَ، قُلْتُ: اَلْـحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ جَعَلَ فِي الأَمْرِسَعَةً».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুনুবী হলে কি করতেন? ঘুমানোর আগে গোসল করতেন নাকি গোসলের আগে ঘুমাতেন। ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, উভয়টাই করতেন। কখনো গোসল করে ঘুমাতেন। আর কখনো অযু করে ঘুমাতেন। আমি বললাম: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি দীন ইসলাম সহজতা রেখেছেন”।[217]
উক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ঘুমানোর পূর্বে জুনুবী ব্যক্তির তিনের এক অবস্থা :
ক. জুনুবী ব্যক্তি অযু-গোসল ছাড়াই ঘুমুবে। তা সুন্নাত বহির্ভূত ও মাকরূহ।
খ. ইস্তিঞ্জা ও সালাতের অযুর ন্যায় অযু করে ঘুমুবে। এটি সুন্নাত সম্মত।
গ. অযু ও গোসল করে ঘুমুবে। এটি সুন্নাত সম্মত ও সর্বোত্তম পন্থা।

মোজা, পাগড়ী ও ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ

ক. মোজার উপর মাসাহ করার বিধান:
মোজার উপর মাসাহ করা কুরআন, হাদীস ও ইজমা’ কর্তৃক প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِ﴾ [المائ‍دة: ٦]
“তোমরা মাথা ও পদযুগল টাখনু পর্যন্ত মাসাহ কর”। [সূরা আল-মায়দাহ, আয়াত: ৬, লামের নিচে যেরের ক্বিরাত অনুযায়ী]
সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস, মুগীরা ইবন শো‘বা, ‘আমর ইবন উমাইয়া, জারীর, হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, তারা বলেন,
«مَسَحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم عَلَى الخُفَّيْنِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোজা জোড়ার উপর মাসাহ করেছেন”।[218]
এ ছাড়াও কমবেশি সত্তর জন সাহাবা মোজা মাসাহ সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে যার জন্য যা সহজ তার জন্য তাই করা উত্তম। অতএব, যে ব্যক্তি মোজা পরিধান করাবস্থায় রয়েছে এবং তার মোজায় মোজা মাসাহ’র শর্তগুলোও পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য উচিত মোজা জোড়া না খুলে মোজার উপর মাসাহ করা। কারণ, তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের অনুসরণ ও অনুকরণ পাওয়া যাচ্ছে। আর যে ব্যক্তির পা উন্মুক্ত মোজা পরিহিতাবস্থায় নয় তার জন্য উচিত পদযুগল ধুয়ে ফেলা।
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى رُخَصُهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ تُؤْتَى مَعْصِيَتُهُ».
“আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া সুবিধাদি গ্রহণ করা। যেমনিভাবে তিনি অপছন্দ করেন তাঁর শানে কোনো পাপ সংঘটন করা”।[219]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ تُقْبَلَ رُخَصُهُ كَمَا يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى عَزَائِمُهُ».
“আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া সুবিধাদি গ্রহণ করা। যেমনিভাবে তিনি পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া ফরযগুলো পালন করা”।[220]
খ. মোজা মাসাহ করার শর্তসমূহ:
১. সম্পূর্ণ পবিত্রতাবস্থায় (অযু অবস্থায়) মোজা জোড়া পরিধান করতে হবে:
মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِيْ سَفَرٍ، فَأَهْوَيْتُ لأَنْزِعَ خُفَّيْهِ فَقَالَ: دَعْهُمَا، فَإِنِّيْ أَدْخَلْتُهُمَا طَاهِرَتَيْنِ. فَمَسَحَ عَلَيْهِمَا».
“আমি কোনো এক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থাকাবস্থায় তিনি অযু করার সময় তাঁর মোজা জোড়া খুলতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, খুলো না। কারণ, আমি মোজাদ্বয় পবিত্রতাবস্থায়ই পরেছি। অতঃপর তিনি মোজা জোড়ার উপর মাসাহ করেন”।[221]
২. ছোট অপবিত্রতার জন্য মোজা মাসাহ করবে:
বড় অপবিত্রতার জন্যে নয়। অতএব, গোসল ফরয হলে মোজার উপর মাসাহ করা যাবে না। বরং মোজাদ্বয় খুলে পদযুগল ধুয়ে নিতে হবে।
সাফওয়ান ইবন ‘আসসাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَأْمُرُنَا إِذَا كُنَّا سَفْرًا أَنْ لاَ نَنْزِعَ خِفَافَنَا ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيْهِنَّ إِلاَّ مِنْ جَنَابَةٍ وَلَكِنْ مِنْ غَائِطٍ وَبَوْلٍ وَنَوْمٍ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সফরে রওয়ানা করলে তিনি আমাদেরকে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মলমূত্র ত্যাগ ও ঘুমের কারণে মোজা না খুলতে আদেশ করতেন। বরং মোজার উপর মাসাহ করতে বলতেন। তবে জুনুবী হলে মোজা খুলতে বলতেন”।[222]
৩. শুধু শরী‘আত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মাসাহ করবে:
তা হচ্ছে মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত এবং মুক্বীমের (যিনি আশি বা ততোধিক কিলোমিটার পথ ভ্রমণের নিয়্যাত করে ঘর থেকে বের হন নি) জন্য এক দিন এক রাত।
‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«جَعَلَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيْهِنَّ لِلْمُسَافِرِ، وَيَوْمًا وَلَيْلَةً لِلْمُقِيْمِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোজা মাসাহ’র সময়সীমা মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত এবং মুক্বীম বা গৃহবাসীর জন্য এক দিন এক রাত নির্ধারণ করেছেন”।[223]
আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«رَخَّصَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم لِلْمُسَافِرِ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ وَلَيَالِيْـهِنَّ، وَلِلْمُقِيْمِ يَوْمًا وَلَيْلَةً، إِذَا تَطَهَّرَ فَلَبِسَ خُفَّيْهِ أَنْ يَمْسَحَ عَلَيْهِمَا».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসাফিরকে তিন দিন তিন রাত এবং মুক্বীমকে এক দিন এক রাত মোজা মাসাহ করার অনুমতি দিয়েছেন যখন তা পবিত্রতাবস্থায় পরা হয়”।[224]
তবে এ সময়সীমা শুরু হবে মাসাহ’র পর অযু ভাঙলে পুনরায় অযু করার পর থেকে। তখন থেকে মুক্বীমের জন্য ২৪ ঘন্টা এবং মুসাফিরের জন্য ৭২ ঘন্টা মাসাহ’র জন্য নির্ধারিত।
৪. মোজা জোড়া সম্পূর্ণরূপে পবিত্র হতে হবে:
অপবিত্র হলে তা যদি মূলগত হয় যেমন, মোজাগুলো গাধার চামড়া দিয়ে তৈরি, তাহলে গুলোর উপর মাসাহ চলবে না। আর যদি মূলগত না হয় তাহলে নাপাকী দূরীকরণের পর গুলোর উপর মাসাহ করা যাবে।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بَيْنَمَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يُصَلِّيْ بِأَصْحَابِهِ إِذْ خَلَعَ نَعْلَيْهِ فَوَضَعَهُمَا عَنْ يَسَارِهِ، فَلَمَّا رَأَى ذَلِكَ الْقَوْمُ أَلْقَوْا نِعَالَهُمْ، فَلَمَّا قَضَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم صَلاَتَهُ قَالَ: مَاحَمَلَكُمْ عَلَى إِلْقَاءِ نِعَالِكُمْ؟ قَالُوْا: رَأَيْنَاكَ أَلْقَيْتَ نَعْلَيْكَ فَأَلْقَيْنَا نِعَالَنَا، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم : إِنَّ جِبْرِيْلَ أَتَانِيْ فَأَخْبَرَنِيْ أَنَّ فِيْهِمَا قَذَرًا أَوْ قَالَ: أَذىً، وَقَالَ: إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ إِلَى الـْمَسْـجِدِ فَلْيَنْظُرْ، فَإِنْ رَأَى فِيْ نَعْلَيْهِ قَذَرًا أَوْ أَذَىً، فَلْيَمْسَحْهُ وَلْيُصَلِّ فِيْهِمَا».
“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে সালাত পড়ছিলেন। হঠাৎ তিনি সালাতের মধ্যেই নিজ জুতা জোড়া পা থেকে খুলে নিজের বাঁ দিকে রাখলেন। তা দেখে সাহাবীগণও নিজ নিজ জুতাগুলো খুলে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষে সাহাবীগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তোমাদের ক হলো, জুতাগুলো খুলে ফেললে কেন? সাহাবীগণ বললেন: আপনাকে খুলতে দেখে আমরাও খুলে ফেলেছি। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, আমার জুতা জোড়ায় ময়লা (নাপাকী) রয়েছে। তাই আমি জুতা জোড়া খুলে ফেললাম। অতএব, তোমাদের কেউ মসজিদে আসলে প্রথমে নিজ জুতা জোড়া ভালোভাবে দেখে নিবে। অতঃপর তাতে কোনো ময়লা বা নাপাকী পরিলক্ষিত হলে তা জমিনে ঘষে নিবে এবং তা পরেই সালাত আদায় করবে”।[225]
উক্ত হাদীস থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, অপবিত্র কোনো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে সালাত আদায় করলে সালাত আদায় হবে না। বরং তা যে কোনো ভাবে পবিত্র করে নিতে হবে। আর মোজা মাসাহ কিন্তু বাহ্যিক নাপাকী দূরীকরণের জন্য কোনোমতেই যথেষ্ট নয়।
৫. মোজা জোড়া টাখনু পর্যন্ত পদযুগল ঢেকে রাখতে হবে:
তেমনিভাবে ঘন সুতর হতে হবে যাতে পায়ের রং বুঝা না যায়। চামড়ার মোজা হলে তো আরো ভালো। কারণ, তাতে মাসাহ’র ব্যাপারে বিজ্ঞ আলিমদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তবে তা শর্ত করা অমূলক। কারণ, মোজা মাসাহ শরী‘আতে যে সুবিধার জন্য চালু করা হয়েছে তা অন্য মোজার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে ঘন সুতর হওয়ার শর্ত এ জন্যই করা হয়েছে যে, যেন তা প্রয়োজনের কারণেই পরা হয়েছে তা বুঝা যায়। শুধু ফ্যাশনের জন্য শরী‘আত এ সুযোগ দিতে পারে না। মোজা সামান্য ছেঁড়া থাকলে তাতে কোনো অসুবিধে নেই। তবে বেশি ছেঁড়া হলে চলবে না।
৬. মোজা জোড়া জায়েয পন্থায় সংগৃহীত ও শরী‘আত সম্মত হতে হবে:
এ জন্যেই চোরিত, অপহৃত, জীবন্ত পশুপাখির ছবি বিশিষ্ট ও পুরুষের জন্য রেশমি কাপড়ের তৈরি মোজার উপর মাসাহ করা যাবে না। কারণ, মোজার উপর মাসাহ করা শরী‘আত প্রদত্ত একটি সুবিধা। তাই এ সুবিধা গ্রহণের জন্য কোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা যাবে না। তেমনিভাবে হারাম মোজা খুলে ফেলা আবশ্যক। কারণ, উহার উপর মাসাহ করার সুবিধে দেওয়া মানে হারাম কাজে রত থাকায় সহযোগিতা করা। আর তা কখনোই ইসলামী শরী‘আত সমর্থন করে না।
৭. মাসাহ’র সময়সীমা পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মোজা খোলা যাবে না:
মোজা খুলে ফেললে পুনরায় পা ধুয়ে অযু করতে হবে। মাসাহ করা চলবে না।

যখন মাসাহ ভঙ্গ হয়:
১. গোসল ফরয হলে তখন গোসলই করতে হবে। মাসাহ’র কোনো প্রশ্নই আসে না।
২. মাসাহ’র পর মোজা জোড়া খুলে ফেললে তখন পা ধুয়ে অযু করতে হবে। মাসাহ করা যাবে না।
৩. মাসাহ’র নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে।
মাসাহ করার পদ্ধতি:
মোজা বা জাওরাবের উপরিভাগ মাসাহ করবে। তলা নয়।
‘আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لَوْ كَانَ الدِّيْنُ بِالرَّأْيِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْـخُفِّ أَوْلَى بِالْـمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ، وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ».
“যদি দীন ইসলাম মানব বুদ্ধিপ্রসূত হতো তাহলে মোজার উপরিভাগের চাইতে নিম্নভাগই মাসাহ’র জন্য উত্তম বিবেচিত হতো। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মোজার উপরিভাগ মাসাহ করতে দেখেছি”।[226]
মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم يَمْسَحُ عَلَى ظَهْرِالْـخُفَّيْنِ».
“রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোজার উপরিভাগ মাসাহ করতেন”।[227]
মোজা মাসাহ’র নিয়ম হচ্ছে: ডান হাত ডান পায়ের অগ্রভাগে এবং বাম হাত বাম পায়ের অগ্রভাগে রেখে উভয় হাত জঙ্ঘার দিকে একবার টেনে নিবে।

জাওরাবের উপর মাসাহ:
আরবী ভাষায় জাওরাব বলতে মোজার পরিবর্তে পায়ের উপর পরা বস্তুকে বুঝানো হয়। মোজা মাসাহ’র ন্যায় জাওরাবের উপরও মাসাহ করা যায়। মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ وَالنَّعْلَيْنِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করার সময় জাওরাব ও জুতার উপর মাসাহ করেছেন”।[228]

পাগড়ীর উপর মাসাহ:
চিবুকের নিচ দিয়ে পেঁচিয়ে মজবুত করে মাথায় বাঁধা পাগড়ীর উপরও মাসাহ করা যায়।
‘আমর ইবন উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَمْسَحُ عَلَى عِمَامَتِهِ».
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাগড়ীর উপর মাসাহ করতে দেখেছি”।[229]
বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَسَحَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم عَلَى الْـخُفَّيْنِ وَالْخِمَارِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোজা ও পাগড়ীর উপর মাসাহ করেছেন”।[230]
সাউবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«بَعَثَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم سَرِيَّةً فَأَصَابَهُمُ الْبَرْدُ، فَلَمَّا قَدِمُوْا عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم أَمَرَهُمْ أَنْ يَسْمَحُوْا عَلَى الْعَصَائِبِ وَالتَّسَاخِيْنِ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে পাঠালে (মাথা ও পা উন্মুক্ত করে মাথা মাসাহ ও পা ধোয়ার কারণে) তাদের ঠাণ্ডা লেগে যায়। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলে তিনি তাদেরকে পাগড়ী ও জাওরাবের উপর মাসাহ করার আদেশ করেন”।[231]
পাগড়ীর উপর মাসাহ করার নিয়ম হচ্ছে: পুরো পাগড়ীর উপর মাসাহ করবে অথবা কপাল ও পাগড়ী উভয়টাই মাসাহ করবে।
মুগীরা ইবন শো‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيه وسلم فَمَسَحَ بِنَاصِيَتِهِ وَعَلَى الْعِمَامَةِ وَعَلَى الْـخُفَّيْنِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করার সময় কপাল, পাগড়ী ও মোজা মাসাহ করেছেন”।[232]
জাওরাব ও পাগড়ী মাসাহ’র ক্ষেত্রে মোজা মাসাহ’র শর্তগুলো প্রযোজ্য।

ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ:
ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার হাদীসগুলো দুর্বল হলেও উহাকে মোজা মাসাহ’র সাথে তুলনামূলক বিবেচনা করলে ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার যুক্তিযুক্ততা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, মোজা মাসাহ’র চাইতে ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। অতএব, সহজতার জন্য যদি শরী‘আতে মোজা মাস্হের বিধান থাকতে পারে তাহলে ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার বিধানও শরী‘আতে অবশ্যই রয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোজা ও ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তা নিম্নরূপ:
১. ব্যান্ডেজ খোলা ক্ষতিকর হলেই উহার উপর মাসাহ করা যায়। নতুবা নয়। মোজা মাসাহ’র ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়।
২. ব্যান্ডেজ পুরোটার উপরই মাসাহ করতে হয়। তবে ধোয়া আবশ্যক এমন স্থানে ব্যান্ডেজটি বাঁধা না হলে উহার উপর মাসাহ করতে হবে না। কারণ, ব্যান্ডেজ পুরোটা মাসাহ করতে কোনো অসুবিধে নেই। এর বিপরীতে মোজা পুরোটা মাসাহ করা কষ্টকর। এ জন্য সুন্নাত অনুযায়ী মোজার উপরিভাগ মাসাহ করলেই চলে।
৩. ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করার নির্ধারিত কোনো সময়সীমা নেই। কারণ, তা প্রয়োজন বলেই করতে হয়। সে জন্য প্রয়োজন যতক্ষণই থাকবে ততক্ষণই মাসাহ করবে।
৪. উভয় নাপাকীর সময় ব্যান্ডেজের উপর মাসাহ করা যায়। কিন্তু মোজা মাসাহ শুধু ছোট নাপাকীর জন্যে।
৫. পবিত্রতার বহুপূর্বে ব্যান্ডেজ বাঁধা হলেও উহার উপর মাসাহ করা যাবে। কিন্তু মোজা মাসাহ’র জন্য পবিত্রতার পরেই মোজা পরতে হয়।
৬. ব্যান্ডেজ প্রয়োজনানুসারে যে কোনো অঙ্গে বাঁধা যায়। কিন্তু মোজা শুধু পায়েই পরতে হয়। অন্য কোথাও নয়।
ক্ষত-বিক্ষত স্থানের শর বিধান:
ধোয়া আবশ্যক এমন কোনো অঙ্গ ক্ষত বিক্ষত হলে তা চারের এক অবস্থা থেকে খালি হবে না। তা নিম্নরূপঃ
১. ক্ষত স্থানটি এখনো উন্মুক্ত এবং তা ধোয়া ক্ষতিকরও নয়। তা হলে অঙ্গটি ধুতে হবে।
২. ক্ষত স্থানটি এখনো উন্মুক্ত তবে তা ধোয়া ক্ষতিকর।
এমতাবস্থায় উহার উপর মাসাহ করতে হবে।
৩. ক্ষত স্থানটি এখনো উন্মুক্ত তবে উহা ধোয়া বা মাসাহ করা উভয়ই ক্ষতিকর।
এমতাবস্থায় উহার উপর ব্যান্ডেজ বেঁধে মাসাহ করতে হবে। তাও সম্ভবপর না হলে তায়াম্মুম করবে।
৪. ক্ষত স্থানটি ব্যান্ডেজ করা আছে।
এমতাবস্থায় উহার উপর মাসাহ করবে। ধুতে হবে না। তেমনিভাবে কোনো অঙ্গ মাসাহ করলে উহার বিকল্প তায়াম্মুমের কোনো প্রয়োজন থাকে না।




 লেখক: মোস্তাফিজুর রহমান ইবন আব্দুল আযীয আল-মাদানী
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সূত্র: ইসলামহাউজ


পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

1 টি মন্তব্য: