রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

অন্তর বিধ্বংসী বিষয়: প্রবৃত্তির অনুসরণ

অন্তর বিধ্বংসী বিষয়: প্রবৃত্তির অনুসরণ



ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على نبينا محمد، وعلى آله وصحبه أجمعين.
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সেরা ও সর্বশ্রেষ্ঠ। আরও সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার পরিবার, পরিজন ও সাথী-সঙ্গীদের উপর।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে যাবতীয় কল্যাণ হতে বিরত রাখে এবং মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিকে খর্ব করে। প্রবৃত্তির অনুসরণ দ্বারা মানুষ থেকে দুশ্চরিত্র গুলোই বের হয়ে আসে এবং অশ্লীল ও নোংরা কর্ম প্রকাশ পায়। প্রবৃত্তি মানবতাকে দুর্বল করে এবং অন্যায় অপকর্মের পথকে উন্মুক্ত করে।
প্রবৃত্তি হল ফিতনার বাহক, আর দুনিয়া হল মানুষের পরীক্ষাগার। প্রবৃত্তি থেকে দূরে থাক, তবেই তুমি নিরাপদ থাকবে এবং দুনিয়া হতে বিরত থাক, তাহলে তুমি লাভবান হবে। দুনিয়ার খেল-তামাশার ঘ্রাণ তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে এবং ফিতনায় না জড়ায়। মনে রাখবে দুনিয়ার খেল তামাশা অচিরেই শেষ হয়ে যাবে এবং যুগের ভোগ-বিলাস শীঘ্রই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তুমি যেসব অপকর্ম, অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ কর, তা তোমার বিপক্ষে একাট্টা থাকবে এবং তোমার উপার্জিত গুনাহগুলো তোমার বিরোধিতা করার জন্য অবশিষ্ট থাকবে।
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন মানুষের উপর ফরজ এবং তাকে প্রতিহত করা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আবু হাযেম রহ. বলেন, তুমি তোমার দুশমনের সাথে যেভাবে যুদ্ধ কর, তার চেয়ে আরও বেশি যুদ্ধ কর তোমার প্রবৃত্তির সাথে।[1]    
প্রবৃত্তি হল, সমস্ত ফিতনার মুল এবং যাবতীয় সব ধরনের মুসিবতের কারণ। সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, হে মানবাত্মা তুমি আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে তাওবা কর! কারণ, মৃত্যু তোমার নিকট এসে গেছে। আর প্রবৃত্তির বিরোধিতা কর, কারণ, প্রবৃত্তি সব সময় তোমাকে ফিতনা-ফাসাদের দিকে নিয়ে যাবে। যেহেতু প্রবৃত্তির অবস্থা এত মারাত্মক ও ক্ষতিকর, তাই এ নিয়ে আলোচনা করা এবং মানুষকে এ ধরনের কঠিন ও মারাত্মক রোগ হতে বাঁচানোর চেষ্টা করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। 
এ কিতাবে আমরা প্রবৃত্তির সংজ্ঞা, প্রবৃত্তি অনুসরনের ক্ষতি, বিরোধিতা করার গুরুত্ব, উপকার, অনুসরণ করার কারণ, প্রবৃত্তির চিকিৎসা ও খারাব প্রবৃত্তি এবং প্রশংসনীয় প্রবৃত্তির মধ্যে পার্থক্য ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনা করব।
যারা এ কিতাবটি তৈরি করতে এবং কিতাবের বিষয়গুলোকে একত্র করতে আমাদের সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাদের সবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও যাবতীয় কল্যাণ কামনা করছি এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন তাদেরকে আরও বেশি বেশি করে ভাল কাজ করার তাওফিক দেন। আমীন!
হে আল্লাহ! তুমি হালাল দান করে আমাদের হারাম থেকে বিমুখ কর, আর তোমার আনুগত্য দ্বারা তোমার অবাধ্যতা থেকে আমাদের হেফাজত কর। আর তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদেরকে গাইরুল্লাহ থেকে হেফাজত কর।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.
—মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জেদ

প্রবৃত্তির সংজ্ঞা

আভিধানিক অর্থ: هَويَه শব্দটি মাছদার। যখন কোন বস্তুকে মহব্বত বা পছন্দ করে তখন এ কথা বলে[2]।
পারিভাষিক অর্থ: শরিয়তের অনুমোদন নেই এমন কোন বস্তুকে প্রবৃত্তি পছন্দ করে, তার প্রতি নফসের ঝুকে পড়াকে প্রবৃত্তি বলা হয়[3]।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহ. বলেন, প্রবৃত্তি হল, মানব স্বভাব তার জন্য যা প্রয়োজন ও উপযোগী তার প্রতি ঝুঁকে পড়া। মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই আল্লাহ রাব্বূল আলামীন মানুষকে এ ধরনের-নফসের চাহিদা ও প্রবৃত্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। অন্যথায় যদি মানুষের মধ্যে খাওয়া, পান করা ও বিবাহের চাহিদা না থাকত, তাহলে তারা খাদ্য পানীয় গ্রহণ করত না এবং বিবাহ-সাদি করত না। তখন দুনিয়ার জীবনের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ থাকত না। প্রবৃত্তিই মানুষের জন্য চাহিদাকে জাগিয়ে তুলে। রাগ বা ক্ষোভ যেভাবে একজন মানুষ থেকে কষ্টদায়ক বস্তুগুলো প্রতিহত করে, অনুরূপভাবে নফস বা মানবাত্মা যা চায় তা পূরণ করার জন্য মানুষের প্রবৃত্তি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে[4]।


প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে নিষেধ করা বিষয়ে আলোচনা

নফস বা প্রবৃত্তি দিয়ে মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যে প্রবৃত্তি রয়েছে, যা একজন মানুষকে দুনিয়াতে বেঁচে থাকার আগ্রহকে জাগিয়ে তুলে এবং বেঁচে থাকার সার্থকতা ও অবলম্বনকে সার্থক করে তুলে। এমনকি প্রবৃত্তি বা নফস ছাড়া একজন মানুষ দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পারে না। সুতরাং, বলা বাহুল্য যে, মানুষের মধ্যে এ ধরনের চাহিদা ও প্রবৃত্তি থাকা কোন অপরাধ বা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মানুষের দায়িত্ব হল, প্রবৃ্ত্তি বা নফসের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা,  তার প্রবৃত্তি যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ বা নিষেধের অবাধ্য না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে বিরত থাকা। কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য প্রমাণাদি রয়েছে, যাতে ইসলাম প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে মানবজাতিকে নিষেধ করেছে।

কখনো সময় প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে নিষেধ করার সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়:
যেমন, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ بِٱلۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلَّهِ وَلَوۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِكُمۡ أَوِ ٱلۡوَٰلِدَيۡنِ وَٱلۡأَقۡرَبِينَۚ إِن يَكُنۡ غَنِيًّا أَوۡ فَقِيرٗا فَٱللَّهُ أَوۡلَىٰ بِهِمَاۖ فَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلۡهَوَىٰٓ أَن تَعۡدِلُواْۚ وَإِن تَلۡوُۥٓاْ أَوۡ تُعۡرِضُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٗا ١٣٥﴾
[سورة النساء:135 [.
হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে। যদিও তা তোমাদের নিজদের কিংবা পিতা-মাতার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র, তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা এড়িয়ে যাও তবে আল্লাহ তোমরা যা কর সে বিষয়ে সম্যক অবগত। [সূরা নিসা, আয়াত: ১৩৫] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿ يَٰدَاوُۥدُ إِنَّا جَعَلۡنَٰكَ خَلِيفَةٗ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَٱحۡكُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ ٱلۡهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابٞ شَدِيدُۢ بِمَا نَسُواْ يَوۡمَ ٱلۡحِسَابِ ٢٦ ﴾  [سورة ص : 26[.
(হে দাঊদ), নিশ্চয় আমি তোমাকে যমীনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার কর আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য কঠিন আযাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল। [সূরা সাদ, আয়াত: ২৬]
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে সম্বোধন করে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমরা মানুষের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা কর। প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ন্যায় বিচার ও ইনসাফ করা হতে বিরত থেকো না। যারা ন্যায় বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হতে বিরত থাকে তারা আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং গোমরাহ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর যারা গোমরাহ হবে তাদের আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কঠিন শাস্তি দেবেন। তাদের শাস্তি দেয়ার কারণ হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তারা আখেরাত সম্পর্কে ভূলে গিয়েছিল, তাই তাদের শাস্তি অবধারিত হয়েছে।

আবার কখনো সময় কুরআন ও হাদিসে কাফের মুশরিক ও পথভ্রষ্টদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হতে নিষেধ করার প্রমাণ পাওয়া যায়:
 যেমান-আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
﴿ قُلۡ هَلُمَّ شُهَدَآءَكُمُ ٱلَّذِينَ يَشۡهَدُونَ أَنَّ ٱللَّهَ حَرَّمَ هَٰذَاۖ فَإِن شَهِدُواْ فَلَا تَشۡهَدۡ مَعَهُمۡۚ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا وَٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡأٓخِرَةِ وَهُم بِرَبِّهِمۡ يَعۡدِلُونَ ١٥٠ ﴾ [الأنعام : 150[.
বল, তোমাদের সাক্ষীদেরকে নিয়ে আস, যারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ এটি হারাম করেছেন। অতএব যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তবে তুমি তাদের সাথে সাক্ষ্য দিয়ো না। আর তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং যারা তাদের রবের সমকক্ষ নির্ধারণ করে। [সূরা আনআম, আয়াত: ১৫০]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় নবীকে ঐ সব লোকদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছেন এবং আখেরাতের দিবস ও হিসাবের দিনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার স্বীয় নবীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আপনি কাফেরদের বলুন-
﴿ قُلۡ إِنِّي نُهِيتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِۚ قُل لَّآ أَتَّبِعُ أَهۡوَآءَكُمۡ قَدۡ ضَلَلۡتُ إِذٗا وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦ ﴾ [الأنعام : 150 [.
বল, ‘নিশ্চয় আমাকে নিষেধ করা হয়েছে তাদের উপাসনা করতে, যাদেরকে তোমরা ডাক আল্লাহ ছাড়া। বল, ‘আমি তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করি না, (যদি করি) নিশ্চয় তখন পথভ্রষ্ট হব এবং আমি হিদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হব না। [সূরা আনআম, আয়াত: ৫৬]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নবীকে নির্দেশ দেন যে, হে রাসূল! আপনি তাদের জানিয়ে দেন যে, যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা করে আপনাকে তাদের উপাসনা করতে নিষেধ করেছেন। আর আপনি তাদের আরো বলে দিন, আমি তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবো না, আর আমি যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিধানকে বাদ দিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করি তবে আমি ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবো। তারপর আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার নবীকে নির্দেশ দিয়ে আরও বলেন,
﴿فَٱحۡكُم بَيۡنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُۖ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَهُمۡ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ ٱلۡحَقِّۚ﴾  [سورة المائدة : 48 [.
সুতরাং, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। [সূরা মায়দো, আয়াত: ৪৮]
অর্থাৎ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে তোমাকে যে সত্য ও হক বিধান দেয়া হয়েছে, তুমি তাই পালন করবে। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী তুমি তাদের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে। তোমার মনগড়া বা তাদের প্রবৃত্তি ও চাহিদা অনুযায়ী তাদের মাঝে বিচার ফায়সালা করবে না। হক ও সত্য বিধানকে বাদ দিয়ে বিচার ফায়সালা করতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নবীকে নিষেধ করেন। অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নবীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, এর জন্য তুমি মানুষকে দাওয়াত দিতে থাক, আর আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তুমি সত্যের উপর অটল ও অবিচল থাক। যেমন-আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,
 ﴿ فَلِذَٰلِكَ فَٱدۡعُۖ وَٱسۡتَقِمۡ كَمَآ أُمِرۡتَۖ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَهُمۡۖ ﴾ [ سورة شورى : 15 [.
এ কারণে তুমি আহবান কর এবং দৃঢ় থাক যেমন তুমি আদিষ্ট হয়েছ। আর তুমি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না [সূরা শুরা, আয়াত: ১৫] আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا ٢٨﴾ [ سورة كهف : 150 [.
আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে। তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৮]
আয়াতগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নবীকে ধৈর্য্যের নির্দেশ দেন এবং তাদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন যারা সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর যিকির করেন। আর যারা আল্লাহর যিকির হতে গাফেল এবং তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের অনুসরণ করা হতে নিষেধ করেন। উল্লেখিত আয়াতগুলোতে বিশেষ একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন প্রবৃত্তিকে কাফের মুশরিক ও গোমরাহ লোকদের দিকে সম্বোধন করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হল মানুষ মানেই তাদের মধ্যে প্রবৃত্তি বিদ্যমান আছে, এমন নয় যে যারা ঈমানদার তাদের কোন প্রবৃত্তি বা নফস নাই। কারণ, তাদের প্রবৃত্তি তাদেরকে সত্যের অনুকরণ এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে। অপরদিকে মুমিনরা সম্পূর্ণ তাদের বিপরীত; তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে না এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনা হতে বিরত থাকে না। কারণ, কাফেরদের প্রবৃত্তি ও চাহিদা সবই হল বাতিল এবং গোমরাহ। আর মুমিন যাদের ঈমান মজবুত তাদের প্রবৃত্তি সবসময় আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আদেশের এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান নিয়ে দুনিয়াতে আগমন করেছেন, তার আদর্শ বা সুন্নতের মোতাবেক। তাদের প্রবৃত্তি যখন কোন বস্তুর দিকে ঝুঁকে তখন তা অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নত বা তার নির্দেশের অনুগত হবে। আর যদি তা না হয়, কম পক্ষে তা হবে মুবাহ বা বৈধ। মুমিনদের প্রবৃত্তির চাহিদা শরিয়তের পরিপন্থী হবে না। মুমিনদের উদ্দেশ্যই হল, আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন। দুনিয়াতে এটাই হল, তাদের বড় চাওয়া পাওয়া। তারা এর বাহিরে কোন কিছু চিন্তা করে না। তাই তারা সর্বদা সত্যের অনুসন্ধান করতে থাকে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় স্বচেষ্ট থাকে।    
তারপর অপর আয়াতে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন, যারা তাদের রবের পক্ষ থেকে সু-স্পষ্ট দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত তারা কখনোই তাদের মত হতে পারে না যাদের আমল মন্দ ও খারাপ। আর যারা তাদের খেয়াল খুশি মতে চলে এবং যখন যা ইচ্ছা তা করে তারা কখনোই তাদের মত হতে পারবে না যারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং আল্লাহর পক্ষ হতে যে সত্য ও সঠিক বিধান দেয়া হয়েছে তার অনুসরণ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,  
﴿أَفَمَن كَانَ عَلَىٰ بَيِّنَةٖ مِّن رَّبِّهِۦ كَمَن زُيِّنَ لَهُۥ سُوٓءُ عَمَلِهِۦ وَٱتَّبَعُوٓاْ أَهۡوَآءَهُم ١٤﴾ [ سورة محمد : 14 [.
“যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে আগত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত সে কি তার মত, যার মন্দ আমল তার জন্য চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে এবং যারা তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে?” [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৪]
আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কুফল

আবার কখনো নফস যা মানুষকে খারাপ কাজের নির্দেশ দেয়, তার দুর্নাম সম্বোলিত বিভিন্ন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন-
আবী ইয়ালা সাদ্দাদ ইব্ন আউস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«العَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاَها »
“অক্ষম সে ব্যক্তি যে তার নফসকে তার প্রবৃত্তির অনুসারী বানায়”[5]।
এ হাদিসে যে ব্যক্তি নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তাকে অক্ষম বলা হয়েছে। বাস্তবে সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে যখন তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তার চেয়ে দূর্বল ব্যক্তি দুনিয়াতে আর কেউ হতেই পারে না। হাদিসে নফসকে দোষারোপ করা হয়েছে।   

আবার কখনো সময় অন্তরের দিকে নিসবত করে প্রবৃত্তির নিন্দা করে বিভিন্ন প্রমাণাদি আবর্তিত:
যেমন- হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
 « تُعْرَضُ الفِتنَُ عَلَى القُلُوبِ كَالحَصِيرِ عُوداً عُوداً، فَأَيّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا نُكِتَ فِيهِ نُكْتةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا نُكتَِ فيِهِ نُكْتةٌ بَيْضَاءُ، حَتىَّ تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ: عَلَى أَبْيَضَ مِثلِْ الصَّفَا، فَلَا تَضرُّهُ فتِنْةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالأَرْضُ، وَالآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادّاً كَالكُوزِ مُجَخِّياً، لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفاً وَلَا يُنْكرُ مُنكْراً إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَا هَ »
মানবাত্মার উপর বিভিন্ন ধরনের ফিতনা-ফাসাদ এমনভাবে গেঁথে দেয়া হবে, যেমনভাবে চাটাইতে একটির পর একটি করে পাতা গেঁথে দেয়া হয়। কোন অন্তরে যখন ফিতনা অনুপ্রবেশ করে, তখন তার অন্তরের মধ্যে কালো একটি দাগ পড়ে যায়। আর যখন কোন অন্তর ফিতনাকে গ্রহণ না করে, তখন তার অন্তরে একটি সাদা দাগ দেয়া হয়। সর্বশেষ মানবাত্মা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক- ধবধবে সাদা অন্তর, যা ধবধবে সাদা পাথরের মত। যতদিন পর্যন্ত আসমান যমীন স্বীয় স্থানে বহাল থাকবে কোন প্রকার ফিতনা-ফাসাদ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এখানে প্রবৃত্তিকে অন্তরের দিক নিসবত করা হয়েছে[6]।
অর্থাৎ এ হাদিসে মানুষের খারাপ আমল ও ভালো আমলের চালক হিসেবে অন্তরকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানুষের ভালো বা খারাপ আমলের উদ্রেক প্রথমে অন্তরেই হয়ে থাকে। যখন একজন মানুষ তার অন্তরে ভালো কাজকে স্থান দেবে তখন সে হবে সফল। আর যখন মানুষ তার অন্তরে খারাপ বা মন্দ আমলকে স্থান দেবে তখন সে হবে অক্ষম বা দূর্বল।

কখন প্রবৃত্তির কারণে মানবজাতিকে শাস্তি দেয়া হয়?

প্রবৃত্তি ও নফস মানবজাতির জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। মানবজাতি কখনোই এর বাহিরে থাকতে পারে না এবং সে তার প্রবৃত্তি মুক্ত হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন মানবজাতিকে নফস দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। মানুষ মানেই তার মধ্যে প্রবৃত্তি থাকবে, নফস থাকবে এবং চাহিদা থাকবে। এটি মানবজাতির জন্য কোন দোষণীয় বিষয় নয়। মানবজাতিকে শুধু তার নফস বা প্রবৃত্তির উপর কখনোই শাস্তি দেয়া হবে না। মানুষ যখন কোন কিছু চায় বা পছন্দ করে তা তার জন্য কোন অপরাধ নয় যে, তাকে এ কারণে তার উপর শাস্তি দিতে হবে। তবে কখন মানুষকে তার প্রবৃত্তির কারণে শাস্তি দেয়া হবে ?! এটি একটি যুগান্তকারী প্রশ্ন।
এছাড়াও আরেকটি প্রশ্ন হল, একজন মানুষ তার অন্তর বা আত্মা থেকে প্রবৃত্তি বা নফসের চাহিদাকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে বের করে দিতে বা তা ফেলে দিতে নির্দেশিত কিনা? নাকি তার জন্য কিছু নিয়ম বা কায়দা-কানুন আছে?
এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সমাধানের বিষয়। যুগে যুগে মানুষের মাঝে এ ধরনের প্রশ্ন বিভিন্নভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং বার বার তা মানুষের সামনে উঠে আসছে। ইসলামের বড় বড় মনীষীরাও যুগ যুগ ধরে এ সব প্রশ্নের যথার্থ সমাধান দিয়েছেন।
আল্লামা ইব্ন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, মানবজাতিকে শুধু তার নফস বা প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে কখনোই শাস্তি দেয়া হবে না, তাকে শাস্তি দেয়া হবে, প্রবৃত্তি ও নফসের অনুকরণ ও অনুসরণ করার উপর। যখন মানবাত্মা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু সে তা না করে মানবাত্মাকে তা থেকে বিরত রাখে, তাহলে তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না, বরং তার জন্য এ বিরত থাকা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত ও ইসলামী শরীয়তের নেক আমল বলে পরিগণিত হবে[7]।
এ হল একজন সত্যিকার মুসলিমের অবস্থা। সর্বদা তার নফস তাকে বিভিন্ন খারাপ ও মন্দ কাজের নির্দেশ দিতে থাকে। আর সে তার নফসের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে এবং নফসের নির্দেশ অমান্য ও বিরোধিতা করে আল্লাহকে ভয় করতে থাকে, যার মধ্যে এ ধরনের গুণ পাওয়া যাবে সে ব্যক্তিই হল সত্যিকার ঈমানদার ও প্রকৃত মুমিন। আর এ ধরনের ঈমানদারের জন্য রয়েছে জান্নাত ও উত্তম প্রতিদান।
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
﴿ وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ وَنَهَى ٱلنَّفۡسَ عَنِ ٱلۡهَوَىٰ ٤٠ فَإِنَّ ٱلۡجَنَّةَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٤﴾ [سورة النازعات : 40-41 [.
“আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল”। [সূরা নাজেয়াত, আয়াত: ৪০-৪১]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুটি জিনিষকে স্পষ্ট করেন, এক-যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করে তার প্রবৃত্তির অবস্থান অনুযায়ী। শুধু ভয় করা যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহকে ভয় করতে হবে তার শান ও অবস্থান হিসেবে। দ্বিতীয়ত- এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে আর তা হল প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো হতে তাকে বিরত থাকতে হবে; মনে যা চায় তা করা হতে বিরত থাকতে হবে। নিজের নফস বা নফসের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হতে হবে। তখন তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা হল জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।  
মোট কথা, প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী আমল করা ব্যতীত কাউকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হবে না। কোন মানুষ যখন কোন গুনাহ করার ইচ্ছা করে বা তার গুনাহ করতে মনে চায়, শুধুমাত্র এর উপর তাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তবে যদি লোকটি তার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা অনুযায়ী আমল করে, তখন তাকে তার আমল ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُتِبَ عَلَى ابْنِ آدَمَ نَصِيبُهُ مِنَ الزِّنَى، مُدْرِكٌ ذَلِكَ لَا مَحَالَةَ؛ فَالعَيْنَانِ زِنَاهمَا النَّظَرُ،وَالأُذُنَانِ زِنَاهمَا الاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الكَلَامُ، وَاليَدُ زِنَاهَا البَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الخُطَا، وَالقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنَّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ »
“আদম সন্তানদের জন্য ব্যভিচারের একটি অংশ অবশ্যই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সে তার জীবদ্দশায় তা অবশ্যই অর্জন করবে। তার চক্ষুদ্বয়ের ব্যভিচার হল, খারাপ বস্তুর প্রতি দৃষ্টি, কর্ণদ্বয়ে ব্যভিচার হল, কোন খারাপ বা অশ্লীল কথার শ্রবণ, মুখের ব্যভিচার হল, শরীয়তের পরিপন্থী কথা, হাতের ব্যভিচার হল, নিষিদ্ধ কোন বস্তুকে স্পর্শ করা আর পায়ের ব্যভিচার হল কোন নিষিদ্ধ কাজের প্রতি অগ্রসর হওয়া। অন্তর আশা করে এবং ধাবিত হয়, লজ্জাস্থান তা সত্যে পরিণত করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে[8]। 
হাদিস দ্বারা একটি কথা প্রমাণ হয়, মানুষের অন্তরে যখন কোন খারাপ বা নিষিদ্ধ কাজের উদ্রেক হয়, তার জন্য তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না এবং তাকে তার জন্য ভালো বা খারাপ বলে মন্তব্য করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার অন্তরের কাজটিকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবায়ন না করে। তার হাত পা মুখ যখন তার অন্তরের কোন কাজকে বাস্তবায়ন করবে তখন তার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিধান চালু হবে।

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণসমূহ

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণসমূহ জানা থাকা অতীব জরুরি। যে কোন কিছুর কারণ জানা থাকলে তা করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সহজ হয়। কারণ, যখন কোন কিছুর কারণ অস্বচ্ছ বা অসৎ হয় তার পরিণতিও হবে খারাপ ও অস্বচ্ছ। আর যখন কারণ ভালো ও স্বচ্ছ হবে তখন তার ফলাফল হবে মধুর ও আনন্দদায়ক।
যে সব কারণসমূহ মানুষকে প্রবৃত্তির অনুসরণের দিকে ডাকে সেগুলো অনেক। কেন মানুষ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারা কেন সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণ থেকে বিরত থাকে? তা নিম্নে আলোচনা করা হল। মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তির অনুসরনের অনেকগুলো কারণ আছে।

প্রথমত: বাল্যকাল থেকে প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণের উপর অভ্যস্ত না হওয়া:
অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চারা মাতা-পিতার অধিক আদর-স্নেহে মানুষ হয় এবং বড় হতে থাকে। তারা যখন যা চায় মাতা-পিতা তাদের তাই দিয়ে থাকে এবং তাদের যে কোন চাহিদা পূরণ করে তাদের খুশি রাখতে চেষ্টা করে। কোনটি হারাম আর কোন হালাল তার মধ্যে কোন প্রকার তারতম্য করে না। ছেলে মেয়ে যখন ফজরের সালাতের সময় ঘুমায়, তখন মাতা-পিতা তাকে ঘুম থেকে জাগায় না, তারা বলে তাদের উপর এখনো সালাত ফরজ হয়নি। আর যখন সে কোন খেলা-ধুলা করতে চায়, মাতা-পিতা তাকে সুযোগ দেয়। তাকে বিরত রাখতে কোন প্রকার চেষ্টা তারা করে না। এমনকি তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘরের মধ্যে তাদের জন্য গান-বাজনা, সিনেমা, নাটক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেয়। অনেক সময় দেখা যায় ছেলের জন্য আলাদা ড্রাইভার এবং মেয়ের জন্য আলাদা রুম ইত্যাদি উচ্চ বিলাস ও বিলাসবহুল জীবন ব্যবস্থা তাদের জন্য করে দেয়া হয়। তাদের মতের বিরুদ্ধে কোন কিছুই করা হয় না, তারা যখন যা চায় তাই করে এবং তাদের খুশি রাখতে মাতা-পিতা উভয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টাকা-পয়সা যখন যা লাগে তাদের তা দিয়ে দেয় তারা যা চায় তাই তাদের মাতা-পিতা থেকে তা পায়। ফলে তারা তাদের ইচ্ছা মত যেখানে মনে চায় সেখানে যেতে পারে যা ইচ্ছা তা করতে পারে। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় এমন আসে, ছেলে মেয়েরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণে অভ্যস্ত হয়ে গড়ে উঠে। কোন কিছু চাওয়া মাত্রই সে তা পায় এবং যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তখন সে কারো কথা শোনে না। মাতা-পিতার কথাও তার কাছে আর ভালো লাগে না। কোন উপদেশকারীর উপদেশ তার কাছে তিক্ত মনে হয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলতে পারে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা বললে, সে তাকে তার শত্রু মনে করে। সে যা করতে চায় তা থেকে কেউ তাকে বিরত রাখতে পারে না এবং বাধা দিতে পারে না।
এরপর যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তার চাহিদাও আকাশচুম্বী হয়। তার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার প্রবৃত্তির পিছনে দৌঁড়তে থাকে। বিশেষ করে যখন ছেলে মেয়েরা তাদের বাল্যকাল অতিক্রম করে কৈশোরে পৌঁছে। তখন তাদের প্রবৃত্তি পাগলা হাতির মত লাফালাফি করতে থাকে। তখন তারা বড় বড় অন্যায়, অপকর্ম ও অপরাধ করতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের এ ধরনের অপকর্ম ও অপরাধ করা থেকে বিরত রাখার কোন উপায় থাকে না। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছাহাবীরা ছোট বেলা থেকেই তাদের বাচ্চাদের সু-শিক্ষা দিতেন এবং তাদের চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা তাদের বাচ্চাদের রোজা, নামায, হজ ইত্যাদি শরিয়তের বিধান পালনে ছোট বেলা থেকেই অভ্যাস করাতেন। যার ফলে তাদের সন্তানেরাও তাদের মতই বিখ্যাত ও বড় বড় জ্ঞানী।
রবি বিনতে মুয়াওয়াজ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, 

أرسل النبي غداة عاشوراء إلى قرى الأنصار: « مَنْ أَصْبَحَ مُفْطرِاً فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ، وَمَنْ أَصْبَحَ صَائِماَ فَلْيَصُمْ » قالت : فكنا نصومه بعد، ونصوم صبياننا، ونجعل لهم اللعبة من العهن، فإذا بكى أحدهم على الطعام أعطيناه ذاك حتى يكون عند الإفطار
 “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন দুপুর বেলায় একটি জামাতকে আনসারীদের এলাকায় প্রেরণ করেন। তারা সেখানে গিয়ে তাদের এ কথার দাওয়াত দেয় যে, যে ব্যক্তি রোজা না রেখে সকাল উদযাপন করল, সে যেন বাকি সময়টুকু কোন কিছু না খেয়ে দিন অতিবাহিত করে, আর যে ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় সকাল করল, সে যেন রোজা রাখে। তার কথা শোনে একজন মহিলা বলল, তারপর থেকে আমরা আশুরার দিন রোজা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদের রোজার নির্দেশ দিতাম। আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য গাছের ডাল দিয়ে খেলা-ধুলার সামগ্রী বানাতাম। তারা যদি ক্ষুধার কারণে কান্না-কাটি করত, তাদের এসব খেলা-ধুলার সামগ্রী দিয়ে ইফতারের সময় পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতাম”[9]।
বাচ্চাদেরকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী লালন-পালন করা দ্ধারা শুধু দ্বীনি ক্ষতি তাই নয়, বরং এর দ্বারা তাদের দুনিয়াও নষ্ট হয় এবং তাদের জীবন ধ্বংস হয়। দুনিয়ার জীবনে তারা বিভিন্ন ধরনের মুসিবত ও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়, অর্থের অপচয় হয়, সাংসারিক জীবন সংকীর্ণ হয় এবং তাদের পরিবারের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়। সুতরাং বর্তমান সময়ে আমাদের উচিত হল, বাচ্চাদের নিয়ে খুব সতর্ক থাকা, যাতে তারা নিশ্চিত ধ্বংস হতে মুক্তি পাই। মনে রাখতে হবে, তারা যা চায় তা করা যাবে না, তাদেরকে খেয়াল খুশি মত চলতে দেয়া যাবে না। তাদের চাহিদাকে ছোট থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ইচ্ছা আকাঙ্খাকে ছোট বেলা থেকেই যাচাই বাচাই করতে হবে। বর্তমান সময়ে কেনইবা নিয়ন্ত্রণ করবে না? তাদের সব চাহিদা বা আশা-আকাঙ্ক্ষা কিভাবে পূরণ করবে?!
তারপর এক সময় আসবে যখন তুমি জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, তখন দেখতে পাবে, তার পরিবার তার চাহিদাগুলো ইচ্ছা থাকলেও পূরণ করতে সক্ষম নয়। বিশেষ করে যখন সে নিজেই স্বয়ং সম্পন্ন হবে, বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করবে এবং কর্ম জীবনে পা বাড়াবে, তখন তোমাকে বলবে আমাকে এ কাজ করতে দাও, আমাকে এ কাজ করার জন্য টাকা দাও ইত্যাদি। তখন তুমি তার চাহিদা মোতাবেক যদি তাকে সাপোর্ট দিতে না পার, তাহলে শুরু হবে অশান্তি, ঝগড়া-বিবাদ, দু:সম্পর্ক।
অনুরূপভাবে মেয়েরা যখন বিলাস-বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়, তখন তারাও তাদের ব্যক্তি ও সাংসারিক জীবনে অশান্তিতে পড়তে হবে। অনেক সময় দেখা যাবে, সে এমন এক স্বামীর সংসারে আবদ্ধ হয়েছে, যে আর্থিকভাবে তার থেকে দুর্বল বা সমকক্ষ নয়, তখন সে তার স্বামীকে বাড়তি চাপ দিতে থাকবে, তাকে সার্বক্ষণিক বিরক্ত করবে এবং এটা-সেটা এনে দেয়ার জন্য বলতে থাকবে। যখন সে এনে দিতে পারবে না তখন সে তার স্বামীর উপর চড়াও হবে, স্বামীর থেকে নাক ছিটকাইবে। আবার অনেক সময় দেখা যাবে সে তার স্বামীকে ফকির বলে গালি দেবে। এভাবে দেখা যাবে তাদের সংসারে সব সময় ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান ও অশান্তি লেগে থাকবে। ফলে তাদের আত্মার শান্তি ও পারিবারিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে এবং স্বামীর সাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এ ধরনের ঘটনা বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। সুতরাং, আমরা যদি শুরু থেকে সতর্ক না হই তবে আমাদের আরো দুভোর্গ পোহাতে হবে।

দ্বিতীয়ত: প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা:
মনে রাখতে হবে, বন্ধু নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যারা বন্ধু নির্বাচন করতে ভূল করে, তারা তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারায় ফেলে। যার বন্ধু খারাপ বা চরিত্রহীন হয়, তাকে ভালো রাখার জন্য কোন কৌশলই উপকারে আসে না। কারণ, প্রবাদে আছে, মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তার বন্ধুর দ্বীন যা হবে তার দ্বীনও একই দ্বীন হবে। সুতরাং, আমরা সবসময় সৎ সঙ্গী নির্বাচন করবো, কখনোই অসৎ বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করবো না, তাদের এড়িয়ে চলবো। কারণ, কিয়ামতের ভয়াবহ বিপদের দিন আমার বন্ধু আমার কোন উপকারে আসবে না। সেদিন আমার বন্ধু আমার দুশমণে পরিণত হবে। তারা আমাকে চিনতে পারবে না, একমাত্র মুত্তাকী ছাড়া। যারা মুত্তাকী এবং একমাত্র দ্বীনের স্বার্থে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিনও কাজে লাগবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যারা দ্বীনের কারণে একে অপরকে ভালোবাসতো তাদের ক্ষমা করে দেবেন। এ ছাড়াও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সত্যবাদীদের সাথে উঠবস করার নির্দেশ দেন। কারণ, কথায় আছে, সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ।
মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও তাদের সাথে উঠবস করার ফলে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যারা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারা অবশ্যই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে যখন সে তাদের চেয়ে দুর্বল হয় এবং তার মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করার মত যোগ্যতা থাকে, তখন সে কোন প্রকার হিসাব-নিকাশ ছাড়াই তার বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে থাকে।
এ কারণেই আমাদের মনীষীরা আমাদেরকে প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদআতিদের সাথে উঠবস করতে নিষেধ করেন এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকতে বলেন। আল্লামা আবু কালাবাহ রহ. বলেন,
لا تجالسوا أصحاب الأهواء ولا تجادلوهم؛ فإني لا آمن أن يغمسوكم في الضلالة، أو يلبّسوا عليكم في الدين بعض ما لِّبسَ عليهم
 “তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারিদের সাথে উঠবস করো না[10] এবং তাদের সাথে কোন প্রকার বিতর্কে জড়াবে না। কারণ, আমরা তোমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছি না যে, তারা তোমাদেরকে গোমরাহীতে ডুবাবে না অথবা দ্বীনের বিষয়ে তাদের নিকট যে অস্পষ্টতা রয়েছে তাতে তোমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলবে না”।
আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন,
لا تجالسوا أهل الأهواء          
“তোমরা প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস করো না। একই উক্তি কাইস ইব্ন ইবরাহিম থেকেও বর্ণিত”।

তৃতীয়: আখিরাত ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে সত্যিকার জ্ঞানের অভাব:
যে ব্যক্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সত্যিকার মান-মর্যাদা সম্পর্কে অবগত নয় বা তাকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারে না, সে আল্লাহকে তার বিপক্ষে ক্ষেপিয়ে তুলতে, আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নাফরমানি করতে এবং তার আদেশ নিষেধকে অমান্য করতে সে তেমন কোন পরওয়া করে না; তার অন্তরে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের বড়ত্ব ও তা‘জীম অবশিষ্ট থাকে না। একজন মানুষের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ক্বদর ও মান-মর্যাদা সম্পর্কে জানা থাকা অতীব জরুরি। তার উপর আল্লাহর পক্ষ হতে কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং তাকে কখন কি পালন করতে হবে তা অবশ্যই জানা থাকতে হবে। এ গুলো জানা না থাকলে সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ নিষেধ কিভাবে পালন করবে এবং তার হুকুমের আনগত্য কিভাবে করবে?
যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মান-মর্যাদা সম্পর্কে অবগত আছে আর যারা অবগত নয়, তারা কখনোই সমান হতে পারে না। 
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿ أَفَمَن كَانَ عَلَىٰ بَيِّنَةٖ مِّن رَّبِّهِۦ كَمَن زُيِّنَ لَهُۥ سُوٓءُ عَمَلِهِۦ وَٱتَّبَعُوٓاْ أَهۡوَآءَهُم ١٤ ﴾ [سورة الزمر : 67[.
যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে আগত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত সে কি তার মত, যার মন্দ আমল তার জন্য চাকচিক্যময় করে দেয়া হয়েছে এবং যারা তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে? [সূরা যুমার, আয়াত: ৬৭]

চতুর্থ: প্রবৃত্তির পূজারীদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা দরকার তা পালন করা হতে বিরত থাকা:
যারা প্রবৃত্তির পূজা করে ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্রতি সমাজের মানুষের একটি বড় দায়িত্ব হল, তারা তাদেরকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করবে এবং বিপথগামী হতে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। কারণ, ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে অবহেলা মানুষকে প্রবৃত্তির পূজারি বানিয়ে দেয়। আর মানুষ যখন ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে নিষেধ করার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন প্রবৃত্তির পূজারী যারা তাদের শয়তানি, হঠকারিতা ও অপরাধ প্রবণতা আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। তারা কোন অপরাধকে আর অপরাধ মনে করে না। যে কোন ধরনের অপরাধ করতে তারা কাউকে পরওয়া বা ভয় করে না। তারা অন্যায় অপরাধ করতে করতে তাদের স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি ধীরে ধীরে তাদের প্রবৃত্তি তাদের অন্তরে স্থান করে নেয় এবং তাদের চলা ফেরা ও যাবতীয় কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ তাদের প্রবৃত্তিই করতে থাকে। মানবিক কোন গুণ তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট থাকে না। তাদের মধ্যে পাশবিক চরিত্র ও জীব-জন্তুর চরিত্রই প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই ইসলাম মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা নির্দেশ দেন। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ [ سورة العمران :10 4 [.
“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম”। [আল-ইমরান, আয়াত: ১০৪]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, সমাজে একটি জামাত থাকতে হবে যারা মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ হতে বারণ করার দায়িত্ব পালন করে। আর যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারাই হল, সফল। সমাজে যখন এ ধরনের দায়িত্বশীল লোক থাকবে তখন সমাজিক অপরাধ কমে যাবে এবং প্রবৃত্তির অনুসারীরা ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে যাবে। তবে যারা মানুষকে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করবে তাদের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কিভাবে তারা মানুষকে অন্যায় অনাচার থেকে ফিরাবে। শুধুমাত্র ক্ষমতার ডাণ্ডা দিয়ে মানুষকে থামিয়ে রাখা যায় না। মানুষের অন্তরে খারাপ বা বন্দ কাজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে ওয়াজ নসিহত ও সুন্দর কথা বলে এবং উত্তম বিতর্ক দ্বারা বুঝাতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করার মূলনীতি আলোচনা করে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥﴾ [سورة النحل : 125 [.
“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন”। [সূরা নাহাল, আয়াত: ১২৫]
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا ٦٣﴾ [سورة النساء : 63 [.
ওরা হল সে সব লোক, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও। আর তাদেরকে তাদের নিজদের ব্যাপারে মর্মস্পর্শী কথা বল। [সূরা নিসা, আয়াত: ৬৩]
আর যখন মানুষ অন্যায় ও অপরাধকে প্রতিহত করতে অভ্যস্ত হয়, তখন তাদের দ্বারা কোন প্রকার অন্যায় সংঘটিত হয় না এবং যারা প্রবৃত্তির পূজারী তাদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় না। আর তাদের চলার পথে কোন প্রকার হোঁচট খেতে হয় না। 

পাঁচ. দুনিয়ার মহব্বত এবং দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়া:
যে ব্যক্তি দুনিয়াকে অধিক মহব্বত করে এবং দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে, তার অন্তর সর্বদা দুনিয়ার মহব্বতের দাবি পূরণ ও তার জন্য যা করনীয় তা বাস্তবায়নেই লিপ্ত থাকে। অন্য কোন চিন্তা তার মাথায় প্রবেশ করে না। যদিও তার কার্যক্রম আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের বিধানের পরিপন্থী হয়। আর একেই বলে প্রবৃত্তির পূজা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে এ ধরনের অভ্যাস ও কারণের প্রতি সতর্ক করে বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ لَا يَرۡجُونَ لِقَآءَنَا وَرَضُواْ بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَٱطۡمَأَنُّواْ بِهَا وَٱلَّذِينَ هُمۡ عَنۡ ءَايَٰتِنَا غَٰفِلُونَ ٧ أُوْلَٰٓئِكَ مَأۡوَىٰهُمُ ٱلنَّارُ بِمَا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ ٨﴾ [ سورة يونس : 7-8 [.
“নিশ্চয় যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আছে ও তা নিয়ে পরিতৃপ্ত রয়েছে। আর যারা আমার নিদর্শনাবলী হতে গাফেল তারা যা উপার্জন করত, তার কারণে আগুনই হবে তাদের ঠিকানা”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৭-৮]
আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, যারা আখেরাত দিবসের আশা করে না এবং দুনিয়ার জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে তাদের ঠিকানা হল, জাহান্নাম। আর এটি তাদের কর্মেরই ফলাফল। তারা দুনিয়াতে আখেরাতকে ভূলে গিয়েছিল এবং তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে যখন যা ইচ্ছা তাই করছিল।

ছয়. মানবাত্মা যখন কোন বৈধ বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করে তখন তা অর্জন করার জন্য তাড়াহুড়া করা:
মানুষর স্বভাব হল, সে তাড়াহুড়া করতে পছন্দ করে। কোন কিছুতে মানুষ ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা খুব কমই রাখে। মানবজাতিকে যখন তার নফস কোন বৈধ কর্মের প্রতি আহ্বান করে, তখন সে দ্রুত তার বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়ে; তা তার জন্য ভাল নাকি মন্দ তা সে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখে না। জ্ঞানীরা তাদের বাচ্চাদের এবং নিজেদের ছাত্রদের প্রবৃত্তির বা নফসের চাহিদার বিরোধিতা করার উপর অভ্যস্ত করে গড়ে তুলেন। কোন বৈধ জিনিষও যখন তাদের ছাত্র বা সন্তানেরা হাসিল করতে চাইত, তারা তাদের চাহিদাকে প্রত্যাখ্যান করত। তারা যা চাইতো তা বৈধ হলেও তা থেকে তারা তাদের বাচ্চাদের বিরত রাখত। অনেক সময় ছাত্ররা তাদের ওস্তাদদের বারণ করাকে সহ্য করতে পারে না। ফলে তারা প্রতিবাদ করে এবং বিরোধিতা করে। কিন্তু তখন তারা বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে যখন তারা বড় হয় বা ওস্তাদ হয়, তখন ঠিকই বুঝতে পারে। কেন তাদের এ কাজ করতে নিষেধ করা হল এবং কাজটি কেন করতে দেয়া হল না। আমাদের সময় আমাদের শিক্ষকরা অনেক মুবাহ কাজ করতে আমাদের বারণ করত, তখন আমাদের তা বুঝতে কষ্ট হত। কিন্তু এখন তারা কেন নিষেধ করত তা বুঝতে আর কষ্ট হয় না। বর্তমানে দেখা যায় অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের জন্য মোবাইল ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়। এর যথার্থতা ও যৌক্তিকতা স্পষ্ট। ছাত্ররা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের জীবনের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করে, মাতা-পিতার কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় করে এবং মোবাইল দ্বারা বিভিন্ন লোকজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে সম্পর্ক করার কারণে তাদের পড়া লেখায় বিঘ্ন ঘটে। 
খলফ ইব্ন খলিফা সুলাইমান ইব্ন হাবিব ইব্ন মিহলাব এর নিকট প্রবেশ করে দেখতে পেল, সুলাইমানের একটি বাঁদি, তার নাম বদর। তার চেহারা খুবই সুন্দর এবং সে অত্যন্ত ভাল ও গুণি। সুলাইমান খলফকে জিজ্ঞাসা করে বলল, তুমি এ বাঁদিকে কেমন দেখছ? সে বলল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আমীরকে সংশোধন করুক! আমি ইতিপূর্বে এর চেয়ে সুন্দর কোন নারীকে দেখিনি। সে বলল, তুমি হাত ধর! উত্তরে খলফ বলল, না আমি এ কাজ করব না। আমি জানি আপনি তাকে পছন্দ করেন। তারপর সে আবারো বলল, আমি তাকে পছন্দ করলেও তুমি তাকে ধর কোন সমস্যা নাই। সে এ কথা এ জন্য বলল, যাতে আমার প্রবৃত্তি আমার উপর প্রাধান্য পায় কিনা তা জানতে পারে।  
ধৈর্যের চর্চা করার কারণে মানুষ অনেক সময় প্রবৃত্তির পূজা করা হতে বিরত থাকতে সক্ষম হয়। আর এ ধরনের বঞ্চিত হওয়ার দরুন মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয় না বরং মানুষের যাবতীয় কল্যাণ নিশ্চিত হয়। বিশেষ করে যখন সে তার প্রবৃত্তি ও নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার মুখোমুখি হয়। কিন্তু যখন সে সাধারণত বৈধ ও মুবাহ বস্তু লাভে অভ্যস্ত হয়, তখন মানবাত্মা নিষিদ্ধ ও হারাম বস্তুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে।

সাত. প্রবৃত্তির অনুসরণ করার যে পরিণতি সে সম্পর্কে জানা না থাকা: 
জ্ঞানই হল মানুষের একমাত্র শক্তি। জ্ঞান মানুষকে যাবতীয় অধ:পতন থেকে রক্ষা করে। যে কোন কাজের পরিণতি সম্পর্কে জানা থাকলে, মানুষ সে কাজ করা না করা বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারে। কোন কিছুর পরিণতি সম্পর্কে অজানা থাকা মানুষকে তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রবৃত্তির অনুসরণ করার অনেক ক্ষতি ও ধ্বংস রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এসব সম্পর্কে বেখবর। যখন প্রবৃত্তির অনুসারীরা এ সব ক্ষতিসমূহ জানতে পারবে, তখন সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকবে।
আহমদ ইব্ন কাসেম তিবরানি রহ. কিছু কাব্য পড়েন এবং তাতে তিনি বলেন,
سَأَحْذَرُ مَا يُخَافُ عَلَيَّ مِنْهُ
 وَأَتْرُكُ مَا هَوَيْتُ لِمَا خَشِيْتُ 
“যে কাজ করাকে আমি আমার বিপক্ষে বিপদ সংকুল মনে করি তা করা হতে আমি অবশ্যই বিরত থাকব। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ভয়ে আমার মন যা চায় তা করার অভ্যাসকে ছেড়ে দেব”।       

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতিসমূহ

দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবনের জন্য প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতি অসংখ্য। কিছু ক্ষতি আছে যা নগদ; দুনিয়াতেই তার মুখোমুখি হতে হয় আর কিছু ক্ষতি আছে যেগুলো সময় সাপেক্ষ। এ সব ক্ষতির কারণে মানুষ প্রবৃত্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে না এবং তা মানুষকে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নেয়ামত থেকে ভুলিয়ে রাখে। আলী ইব্ন আবী তালেব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
إياكم وتحكيم الشهوات على أنفسكم؛ فإنّ عاجلها ذميم، وآجلها وخيم، فإن لم ترها تنقاد بالتحذير والإرهاب، فسوّفها بالتأميل والإرغاب، فإن الرغبة والرهبة إذا اجتمعا على النفس ذلت لهما وانقادت
“তোমরা তোমাদের প্রবৃত্তিকে তোমাদের আত্মার জন্য বিচারক বানানো থেকে বেঁচে থাক। কারণ, তার নগদ ক্ষতি হল, খুবই তিক্ত আর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। যদি তুমি তা বুঝতে সক্ষম না হও তবে সে তোমাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বাধ্য করবে। তারপর সে তোমাকে আশা দিতে থাকবে এবং উৎসাহ প্রদান করবে। কারণ, আকাঙ্খা ও ভয় উভয় যখন মানবাত্মার উপর একত্র হয়, তখন মানবাত্মা উভয়ের জন্য আনুগত্য প্রদর্শণ করে এবং সহনশীল হয়”।

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতি কি?

প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতি দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও। প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। সামাজিক শান্তি শৃংখলা ও ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। সামাজের মধ্যে নানাবিধ অন্যায়, অনাচার ও অশ্লীলতা সংঘটিত হতে থাকে। প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। একে অপরের উপর জুলুম নির্যাতন করে এবং অন্যের হক নষ্ট করে। প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। নিম্নে আমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতি সম্পর্কে আলোচনা করব।

প্রথমত: আখিরাতের ক্ষতি:
আখেরাতের ক্ষতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন কুরআনে কারীমে এরশাদ করেন,
﴿فَأَمَّا مَن طَغَىٰ ٣٧ وَءَاثَرَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ٣٨ فَإِنَّ ٱلۡجَحِيمَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٣٩ وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ وَنَهَى ٱلنَّفۡسَ عَنِ ٱلۡهَوَىٰ ٤٠ فَإِنَّ ٱلۡجَنَّةَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٤١﴾ [ سورة النازعات : 37-41 [.
“সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে আর দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয় জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল। আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল”। [সূরা আন-নাযেয়াত, আয়াত: ৩৭-৪১]
আল্লামা শা‘বী রহ. বলেন, প্রবৃত্তিকে নাম করণের কারণই হল, সে মানুষকে তার কু-কর্মের দ্বারা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
 « من كان الأجوفان همّه خسر ميزانه يوم القيامة »

“‍‍যার উদ্দেশ্য হবে দুটি পেটের চাহিদা পূরণ করা কিয়ামতের দিন তার আমলের পাল্লা দুর্বল হবে”।                                          
এখানে দুটি পেটের চাহিদা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পেটের চাহিদা আর যৌবনের চাহিদা।
কিয়ামতের দিন প্রবৃত্তির পূজারীদের তুমি দেখবে, তারা দুনিয়াতে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণে পাগলের মত চট-পট করতে থাকবে এবং কিয়ামতের দিন যারা আল্লাহর আযাব হতে নাজাত পাবে তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। দুনিয়াতে তারা প্রবৃত্তির পূজারীদের সাথে যেভাবে চলাফেরা করত অনুরূপভাবে তারা কিয়ামতের দিন যারা নাজাত পাবে তাদের সাথে নাজাত পাওয়ার জন্য উঠবস করবে এবং তাদের সাথে থাকতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে। কিন্তু সেদিন তাদের চেষ্টা কোন কাজে আসবে না।
আল্লামা মুহাম্মদ ইব্ন আবুল ওয়ারদ রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য এমন একটি দিবস আছে, যেদিন প্রবৃত্তির পূজারীরা তাদের অপকর্মের পরিণতি হতে কোন ক্রমেই বাঁচতে পারবে না। আর কিয়ামতের দিন সবচেয়ে অধিক চটপট কারী হল, সেই লোক, যে দুনিয়াতে তার যৌবনের চাহিদা মেটাতে অধিক ব্যস্ত থাকত। আখেরাতের প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। 
আল্লামা আতা রহ. বলেন, যার প্রবৃত্তি তার জ্ঞানের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং যার ধৈর্যের উপর তার অধৈর্য প্রাধান্য পায়, সে কিয়ামতের দিন বঞ্চনার মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ, জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কিয়ামতের দিন সে বড় ধরনের অপমান ও অপদস্ত হবে।
আল্লামা ইবরাহিম ইব্ন আদহম রহ. বলেন, প্রবৃত্তি মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে দেয় আর আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয় ও তাকওয়া মানুষকে সুস্থতা দেয়। একটি কথা মনে রাখবে, তোমার প্রবৃত্তি তোমার অন্তর থেকে সব কিছুই দূর করতে পারবে যখন তুমি ভয় করবে সে সত্বাকে যার সম্পর্কে তুমি বিশ্বাস কর যে সে তোমাকে সবসময় দেখছে।

প্রবৃত্তি মানুষকে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যায়:
একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সব গোমরাহীর মুল হল, খারাপ ধারনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। ধারণা মানুষকে ধ্বংস করে, মানুষের মনোবলকে দূর্বল করে এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সংঘবদ্ধতাকে বিনষ্ট করে। আর প্রবৃত্তি মানুষকে সঠিক পথ হতে দূরে সরিয়ে দেয়। যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা সঠিক পথের উপর থাকতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোমরাহ লোকদের সম্পর্কে বলেন,
﴿ إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَمَا تَهۡوَى ٱلۡأَنفُسُۖ وَلَقَدۡ جَآءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ ٱلۡهُدَىٰٓ ٢٣﴾ [سورة النجم : 23 [.
“এগুলো কেবল কতিপয় নাম, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোন দলীল প্রমাণ নাযিল করেননি। তারা তো কেবল অনুমান এবং নিজেরা যা চায়, তার অনুসরণ করে। অথচ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াত এসেছে”। [সূরা নজম, আয়াত: ২৩]
মানুষ তাদের নফসের অনুকরণ ও খারাপ ধারণার পূজা করার কারণেই গোমরাহীতে পড়ে। প্রবৃত্তির পূজা করা শুধু তাকে গোমরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং তা অন্য লোকদের গোমরাহ করা এবং তাদের সঠিক পথের অনুকরণ করা হতে বিরত রাখে। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
﴿ وَإِنَّ كَثِيرٗا لَّيُضِلُّونَ بِأَهۡوَآئِهِم بِغَيۡرِ عِلۡمٍۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُعۡتَدِينَ ١١٩﴾ [سورة الأنعام : 119 [.
“এবং নিশ্চয় অনেকে না জেনে তাদের খেয়াল-খুশি দ্বারা পথভ্রষ্ট করে। নিশ্চয় তোমার রব সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত”। [সূরা আনয়াম, আয়াত: ১১৯]
অর্থাৎ, তারা তাদের প্রবৃত্তির দ্বারা অন্য লোকদের গোমরাহ করে। কুরআন, হাদিস ও উপদেশ দ্বারা তারা কোন উপকার লাভ করে না।
প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে কুরআন বুঝা, কুরআন দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করা ও তার বিধান দ্বারা উপকৃত হওয়া থেকে বিরত রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে প্রবৃত্তির অনুসারীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ থেকে সরাসরি কুরআনের তিলাওয়াত শুনত, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা কুরআন দ্বারা কোন উপকার লাভ করতে পারেনি। তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আনেনি। প্রবৃত্তির অনুসরণই তাদের আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আনা হতে বিরত রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করতে পারা সত্ত্বেও তারা তা গ্রহণ করে না। কারণ, তারা তাদের প্রবৃত্তির বিরোধিতা করতে পারে না। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তাদের বিষয়ে বলেন,
﴿وَمِنۡهُم مَّن يَسۡتَمِعُ إِلَيۡكَ حَتَّىٰٓ إِذَا خَرَجُواْ مِنۡ عِندِكَ قَالُواْ لِلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ مَاذَا قَالَ ءَانِفًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَٱتَّبَعُوٓاْ أَهۡوَآءَهُمۡ ١٦﴾ [سورة محمد: 16 [.
“আর তাদের মধ্যে এমন কতক রয়েছে, যারা তোমার প্রতি মনোযোগ দিয়ে শুনে। অবশেষে যখন তারা তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যায় তখন তারা যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এই মাত্র সে কী বলল?’ এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা নিজদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে”। [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৬]
কোরআন ও সুন্নাহের প্রমাণসমূহের অনুকরণ না করা প্রমাণ করে যে, তারা ছিল প্রবৃত্তির অনুসারী। কারণ, কুরআন ও সুন্নাহ হল, মানুষের স্বভাবের অভিন্ন বস্তু। তাই কুরআন ও সুন্নাহের অনুসরণ বাদ দিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করার অর্থই হল, মানবতার বিরোধিতা করা ও চতুস্পদজন্তু জানোয়ারের স্বভাবের অনুকরণ করা। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আরও বলেন,
﴿فَإِن لَّمۡ يَسۡتَجِيبُواْ لَكَ فَٱعۡلَمۡ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهۡوَآءَهُمۡۚ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّنِ ٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ بِغَيۡرِ هُدٗى مِّنَ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥٠﴾ [سورة القصص : 50 [.
“অতঃপর তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রাখ, তারা তো নিজদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে। আর আল্লাহর দিকনির্দেশনা ছাড়া যে নিজের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত করেন না”। [সূরা কাসাস, আয়াত: ৫০]
আলী রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিষ ভয় করি। এক-তোমাদের দীর্ঘ আশা, দুই-প্রবৃত্তির অনুসরণ। কারণ, লম্বা আশা মানুষকে আখিরাত বিমুখ করে আর প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে হকের অনুকরণ হতে বিরত রাখে। মনে রাখবে, দুনিয়া মানুষকে পিট দেখিয়ে পলায়ন করে আর আখিরাত মানুষের সামনে অগ্রসর হতে থাকে। আর উভয় জগতের জন্য রয়েছে, সন্তান। তোমরা আখিরাতের সন্তান হও, দুনিয়ার সন্তান হইও না। কারণ, আজকের দিন, অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন হল কর্মস্থল এখানে কোন হিসাব নাই আর আখিরাত হল হিসাবের জায়গা সেখানে কোন কর্ম বা আমল করার সুযোগ নাই।

অন্তর নষ্ট করে এবং তার মাঝে ও তার শান্তির লাভের মাঝে প্রাচীর তৈরি করে।
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা মানব জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করে। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভে প্রবৃত্তি মানুষের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মানবাত্মা পাঁচটি জিনিষ থেকে নিরাপদ না থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানবাত্মা পরিপূর্ণ নিরাপদ থাকতে পারবে না।
এক- তাওহীদের পরিপন্থী শিরক হতে মুক্ত থাকতে হবে।
দুই- বিদআত যা সুন্নতের পরিপন্থী তার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
তিন- আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আদেশের পরিপন্থী প্রবৃত্তি থেকে নিরাপদ থাকতে হবে।
চার- অলসতা থেকে দূরে থাকতে হবে যা আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের স্মরণ বা জিকিরের পরিপন্থী।
পাঁচ- প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে যা মানুষকে ইখলাস থেকে বিরত রাখে এবং এক আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের জন্য ইবাদত-বন্দেগী করার পরিপন্থী হয়ে থাকে।
এখানে যে পাঁচটি বিষয় আলোচনা করা হল, এগুলো সবই আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরিপন্থী। আর এ পাঁচটি বিষয়ের অধীনে আরও অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যে গুলো গণনা করে শেষ করা যাবে না। এ কারণেই বলা বাহুল্য যে, একজন বান্দার জীবনে সবচেয়ে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, সে সব সময় আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে সঠিক পথের হেদায়েত লাভের জন্য কান্নাকাটি করবে। আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নিকট দো‘আ করবে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন যেন তাকে সঠিক পথের পথ দেখায়। এটি এমন একটি দো‘আ এ দো‘আর প্রতি সে যতটুকু মুখাপেক্ষী, তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কোন কিছুই দুনিয়াতে হতে পারে না। একজন বান্দা আর কোন কিছুর প্রতি এত বেশি মুখাপেক্ষী নয়। দুনিয়াতে এর চেয়ে উপকারী আর কোন বস্তু তার জন্য হতেই পারে না।

প্রবৃত্তির অনুকরণ জ্ঞান-বুদ্ধি হারা হওয়ার কারণ:
মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির পুজা করে, তখন সে জ্ঞান-বুদ্ধি হারা হয়। তার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেতে থাকে।
মুতাছিম বিল্লাহ একসময় আবি ইসহাক আল মুসিলিকে বলেছিলেন, হে আবু ইসহাক যখন কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে সহযোগিতা করে, তখন তার চিন্তা, ফিকির ও বুদ্ধি লোপ পায়।
[প্রবৃত্তিকে সহযোগীতা করার অর্থ হল প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী চলা। মন যা চায় তা করা এবং মনে বিরোধিাত না করা। আর মানুষ যখন তার মনে যা চায় তা করে তখন তার জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাবে এবং ধীরে ধীরে সে জ্ঞান শূন্য হবে।]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, আমার শাইখ ইব্ন তাইমিয়্যাহ রহ. কে বলতে শুনেছি- যখন কোন ব্যক্তি টাকা পয়সা নগদ পরিশোধ করতে খেয়ানত করে, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার থেকে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের মারেফাতকে চিনিয়ে নেয়, অথবা আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তাকে ভুলে যায়। এ কথা শোনে আমার শেখ তাকে বলল, অনুরূপ পরিণতি তাদের হবে যারা শরীয়তের মাসলা-মাসায়েল বিষয়ে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন ও তার রাসূলের খিয়ানত করে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তার রাসূলের খেয়ানত হল, আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ নিষেধের খেয়ানত করা এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যে সব কথা বলে নাই বা কোন কাজকে তারা আমাদের করা বা বর্জন করার নির্দেশ দেন নাই, আমরা যদি এমন কোন কথা বা কাজ আমাদের নিজের থেকে বলে তাদের কথা বলে চালিয়ে দেই বা আমাদের নিজেদের কোন কর্ম ও প্রণীত বিধানকে আল্লাহ ও রাসূলের কর্ম ও বিধান বলে চালিয়ে দেই, তবে তাকেই খিয়ানত বলা হয়। [এ ধরনের খিয়ানত খুবই মারাত্মক। যারা এ ধরনের খিয়ানত করে তাদের মত বড় জালিম দুনিয়াতে আর কেউ হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের বড় জালিম বলে আখ্যায়িত করেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় বাণীতে এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যারোপ করল সে যেন আখেরাতের জীবনে তার ঠিকানা হিসেবে জাহান্নামকে বেছে নেয়। সুতরাং, এ ধরনের খিয়ানত থেকে আমাদের সবাইকে বেঁচে থাকতে হবে।]
ইসলামী শরীয়ত বিষয়ে যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার ইলম ও জ্ঞানকে ছিনিয়ে নেবে। লোকটি ঈমান থেকে এমন ভাবে বের হয়ে আসবে সে টেরও পাবেনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ধরনের লোকের দৃষ্টান্ত দিয়ে তাঁর রাসূলকে বলেন,
﴿ وَٱتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَأَ ٱلَّذِيٓ ءَاتَيۡنَٰهُ ءَايَٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنۡهَا فَأَتۡبَعَهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ١٧٥ وَلَوۡ شِئۡنَالَرَفَعۡنَٰهُ بِهَا وَلَٰكِنَّهُۥٓ أَخۡلَدَ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ ٱلۡكَلۡبِ إِن تَحۡمِلۡ عَلَيۡهِ يَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ يَلۡهَثۚ ذَّٰلِكَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَاۚ فَٱقۡصُصِ ٱلۡقَصَصَ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ١٧٦﴾ [سورة الأعراف: 175-176 [.
“আর তুমি তাদের উপর সে ব্যক্তির সংবাদ পাঠ কর, যাকে আমি আমার আয়াতসমূহ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং শয়তান তার পেছনে লেগেছিল। ফলে সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ইচ্ছা করলে উক্ত নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চ মর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুকুরের মত। যদি তার উপর বোঝা চাপিয়ে দাও তাহলে সে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে অথবা যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলেও সে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে। এটি হচ্ছে সে কওমের দৃষ্টান্ত যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে। অতএব তুমি কাহিনী বর্ণনা কর, যাতে তারা চিন্তা করে”। [আল-আরাফ, আয়াত: ১৭৫-১৭৬]
[আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বনী ইসলাঈলের একজন লোকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন। আল্লাহ তাকে তার আয়াতসমূহের জ্ঞান দান করেছিল। কিন্তু সে আল্লাহর দেয়া জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেনি। সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। শয়তানের ধোকায় পড়ে সে আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল হয়ে যায় এবং পার্থিব জগতের প্রতি সে ঝুঁকে পড়ে। আল্লাহ তা’আলা তার সম্পর্কে বলেন, তার দৃষ্টান্ত হল, কুকুরের মত। যে কুকুর ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে জিহবা বের করে হাপাতে থাকে। আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, আপনি আপনার কওমদের নিকট এ ঘটনা বর্ণনা করেন। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে। আর সামান্য পার্থিব সুবিধা হাসিলের জন্য তারা যাতে আল্লাহর আয়াতসমূহের বিরোধিতা না করে।]
কতক আলেমগণ বলেন, চারটি জিনিষের মধ্যে কুফরি নিহিত থাকে। এক- অতিরিক্ত রাগ, দুই-প্রবৃত্তি, তিন- অধিক আগ্রহ, চার-ভীতি। আর আমি নিজেই এ চারটির পরিণতি স্বচক্ষে দেখেছি। আমি দেখলাম এক ব্যক্তি খুব রাগান্বিত হল, অতঃপর সে তার মাকে হত্যা করল। আর এক ব্যক্তি একজন মেয়ের প্রেমে পড়ে খৃষ্টান হয়ে গেল। কারণ, তার প্রতি তার আগ্রহ এত প্রবল ছিল, সে তার ঈমান আমল সবকিছু ভূলে গেল।
এক লোক বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা অবস্থায় একজন সুন্দর নারীকে দেখে তার পাশে গিয়ে তাওয়াফ করতে আরম্ভ করে। তারপর সে বলল,
أَْهَوى هَوى الدِّينِ وَاللَّذَّاتُ تُعْجِبُنيِ
فَكيْفَ لِي بهَوَى اللَّذَّاتِ وَالدِّينِ
“আমি দ্বীনকে মহব্বত করি। কিন্তু প্রবৃত্তির সাধ আমাকে অভিভুত করল। আমি বুঝতে পারছিনা প্রবৃত্তির সাধ আর দ্বীনের সাধ হতে কোনটিকে প্রাধান্য দেব”।
তার কথা শোনে রমণীটি বলল, তুমি যে কোন একটি ছাড়, তাহলে অপরটি অবশ্যই পাবে। প্রবৃত্তি ও দ্বীন একসাথে একত্র করতে পারবে না।
[যার প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে, তার কাছে আল্লাহর ঘরও তুচ্ছ হয়ে যায়। সে আল্লাহর ঘরের সামনে গিয়েও অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না।] আল্লাহ আমাদের এ ধরনের পরিণতি হতে হেফাজত করুন! আমীন!

প্রবৃত্তি ধ্বংসাত্মক বিষয় সমূহের একটি

প্রবৃত্তি মানুষকে ধ্বংস করে তার জীবনকে কুলসিত করে। যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। এ জন্য রাসূল সা. প্রবৃত্তিকে ধ্বংসাত্মক বিষয় বলে আখ্যায়িত করেন। আনাস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
  « ثَلَاثٌ مُهْلِكَاتٌ شُحٌّ مُطَاعٌ، وَهَوىً مُتَّبَعٌ، وَإِعْجَابُ المَرْءِ بِنَفْسِهِ »   
“তিনটি জিনিষ মানুষকে নিশ্চিত ধ্বংস করে- এক-কৃপণতা যার অনুকরণ করা হয়। দুই- নফসের চাহিদা যার অনুকরণ করা হয়। তিন-মানুষ যখন তার নিজের বিষয়ে অধিক খুশি বা উদাসীন হয়”।
ওহাব ইব্ন মুনাব্বেহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, দ্বীনের উপর চলার জন্য সবচেয়ে অধিক উপকারী বস্তু হল, দুনিয়া হতে বিমুখ থাকা। আর দ্বীনের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হল, প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। আর প্রবৃত্তির অনুসরণ বলতে যা বুঝায়, তা হল, ধন-সম্পদ ও পার্থিব ইজ্জত লাভের আকাঙ্ক্ষা করা। আর মালের মহব্বতের বহি:প্রকাশ হল, হারামকে হালাল করা। আর যে বান্দা হারামকে হালাল করে তার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষুব্ধ হয়। আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ক্ষোভ এমন একটি রোগ এর কোন ঔষধ নাই একমাত্র আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের সন্তুষ্টি ছাড়া। আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের সন্তুষ্টি এমন একটি প্রতিষেধক কোন রোগ তার কাছে আসতেই পারে না। আর যে ব্যক্তি তার প্রভুর সন্তুষ্টি কামনা করে, সে অবশ্যই তার নফসকে নাখোশ করে। যখন কোন ব্যক্তি দ্বীনের কোন কাজকে কঠিন মনে করে ছেড়ে দেয়, হতে পারে এমন একটি দিন আসবে সেদিন তার মধ্যে দ্বীনের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। [দ্বীনের কোন কাজকে কঠিন মনে করা একজন বান্দার ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। যখন কোন বান্দা দ্বীনের কোন কাজকে কঠিন মনে করে, তখন সে তা করতে চায়না। এভাবে যখন সে দ্বীনের একটি কাজকে ছেড়ে দেয়, তখন সে আরো অনেক আমল ছেড়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে সে দ্বীন হতে দূরে সরে যায়। আর যখন কোন বান্দা দ্বীন হতে দূরে সরে যায়, তখন তার মধ্যে কুফরী ও বদ্বীন স্থান করে নেয়।   

প্রবৃত্তির অনুসরণ বান্দার উপর তাওফিকের দরজাসমূহ বন্দ করে দেয়া হবে।
[যখন কোন বান্দা প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে থাকে, তখন তাকে ভালো কাজের তাওফীক দেয়া হয় না। সে সব সময় খারাপ, অন্যায়, অশ্লীল ও অপকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ভালো কাজ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। ভালো কোন কাজের কথা বললে বা ভালো কাজের উপদেশ দিলে তা তার নিকট অসহ্য লাগে। সে সব সময় পাগলা হাতির মত ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।]
ফুজাইল ইব্ন আয়ায রহ. বলেন, যার উপর প্রবৃত্তির অনুসরণ ও মানবিক চাহিদা প্রাধান্য বিস্তার করে, তার থেকে তাওফিক লাভের সব পথ ও উপকরণ দূর হয়ে যায়।
প্রবৃত্তির অনুসারীরা চলার পথে তাদের রাস্তা ভুলে যায় এবং বিভ্রান্ত হয়; তাকে সঠিক ও সরল পথ লাভের তাওফিক দেওয়া হয় না। কারণ, সে হেদায়েত ও তাওফিক লাভের উৎস হতে বিমুখ। সে কুরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে তার প্রবৃত্তিকে গ্রহণ করছে। কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ বাদ দিয়ে সে প্রবৃত্তির অনুসারী হল। সুতরাং, তাকে কীভাবে সঠিক পথের প্রতি তাওফিক দেয়া হবে!
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
﴿أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ وَأَضَلَّهُ ٱللَّهُ عَلَىٰ عِلۡمٖ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمۡعِهِۦ وَقَلۡبِهِۦ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِۦ غِشَٰوَةٗ فَمَن يَهۡدِيهِ مِنۢ بَعۡدِ ٱللَّهِۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٢٣﴾ [ سورة الجاثية 23 [.
“তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? তার কাছে জ্ঞান আসার পর আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন এবং তিনি তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে হিদায়াত করবে? তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?”। [সূরা জাসিয়া , আয়াত: ২৩]
[আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তার পার্থিব জীবনে প্রবৃত্তিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করল এবং তার অনুসরণ করল, আল্লাহ তা’আলা তার চোখ, কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেবে। সে আর সত্য কথা শুনতে পারবে না, সত্যকে প্রত্যক্ষ করত পারবে না আর অন্তরে সত্যকে অনুধাবন করতে পারবে না।]

প্রবৃত্তির অনুসরণ আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগী হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণ:
যারা প্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে থাকে, তারা তাদের প্রবৃত্তির উপর গর্ব-অহংকার করে এবং সে নিজেকে অনেক বড় মনে করে; যার কারণে তারা কারো অনুকরণ করতে চায় না, এমনকি তারা তাদের স্রষ্টার অনুকরণ করা হতেও বিরত থাকে। অনেক মানুষকে তাদের অহংকারই তাদেরকে কুফরিতে লিপ্ত করছে এবং হক্ব ও সত্যের অনুসরণ হতে বিরত রাখছে। যে প্রবৃত্তি তার অন্তরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম, এবং তার উপর সে পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান সেই দুনিয়াতে সফল ব্যক্তি। আর যে ব্যক্তি প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সে তার নফসের ধোঁকায় পড়ে আছে এবং প্রবৃত্তিতে বন্দি হয়ে আছে; এখান থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায় তার নাই। আর একজন মানুষের পেটে দুটি অন্তর নাই যে, সে এক সাথে অনেক কাজ করতে পারবে। ফলে সে হয়তো আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আনুগত্য করবে অথবা সে তার নফস, প্রবৃত্তি ও শয়তানের অনুকরণ করবে। [এক সাথে দুটি কাজ করা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। কোন মানুষ যদি তার প্রবৃত্তি ও শয়তানকে খুশি রাখে, তাহলে তাকে মনে রাখতে হবে, তার উপর তার প্রভূ মহান রাব্বুল আলামীন অখুশি ও অসন্তুষ্ট। কোন মানুষের মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুটি অন্তর দেয় নাই যে, একদিকে সে আল্লাহর মহব্বতকে লালন করবে আবার অপরদিকে সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে।]                

প্রবৃত্তির অনুসরণ গুনাহ, অন্যায় ও অপরাধের কারণ:
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা অপমান অপদস্থ হওয়ার কারণ হয়ে থাকে। যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের পদে পদে লাঞ্চিত হতে হয়। এ ছাড়াও প্রবৃত্তির অনুসারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। যেমন- যারা প্রবৃত্তির অনুকরণ করে তাদের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ ও অপরাধের কারণে অন্তর কঠিন হয়, তখন সে কোন অপরাধকে অপরাধ মনে করে না। যে কোন ধরনের গুনাহ, অন্যায় ও অপরাধ সে করতে পারে। কোন অন্যায়কে সে অন্যায় মনে করে না। কোন অপরাধকে সে বড় মনে করে না। তার নিকট সব ধরনের গুণাহ হালকা মনে হয়। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
  « إِنَّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ  يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ فَقَالَ بِهِ هَكَذَا »
“একজন মুমিন তার গুণাহকে অনেক বড় করে দেখে। মনে হয় সে একটি বিশাল পাহাড়ের নিচে বসা, আশঙ্কা করছে যে পাহাড়টি তার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে। আর গুণাহগার ব্যক্তি সে তার গুণাহকে একটি মাছির মত মনে করে। অর্থাৎ, মাছিটি তার নাকের উপর বসল, আর ঝাড়া দেয়ার সাথে সাথে চলে গেল”

প্রবৃত্তির অনুসরণ দ্বীনের মধ্যে বিকৃতির কারণ:
যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি করতে কোন প্রকার কুন্ঠাবোধ করে না। তারা দ্বীনকে তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী সাজায়। তাদের কাছে যদি সঠিক দ্বীন কোনটি তা তুলে ধরা হয়, তখন তারা প্রবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেয়, দ্বীনকে তারা প্রাধান্য দেয় না।
হাম্মাদ ইব্ন আবি সালমা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাফেজীদের একজন শাইখ তাব, আমাকে হাদিস বর্ণনা করে বলেন, আমরা যখন কোন বিষয়ে একমত হতাম এবং বিষয়টিকে সুন্দর মনে করতাম, তখন তাকে হাদিস বলে চালিয়ে দিতাম। হাদিস আমাদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হতে হবে এমন কোন শর্ত ছিল না।
প্রবৃত্তির অনুসারিরাই যুগে যুগে দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি সাধন করে। বিদআত সৃষ্টি তারাই করেছে, যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে।

প্রবৃত্তির অনুসরণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত করা ও মানুষের রোষানলে পড়ার কারণ:
একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তির অনুসরণের কারণেই মানুষের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়, অনাচার ও দুশমনি সৃষ্টি হয়। প্ক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকে এবং তার বিরোধিতা করে, সে তার দেহ, মন ও যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শান্তি দেয়। তাকে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে হয় না। আর যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করল, সে যেন একটি দুর্বিষহ জীবন যাপন করল। সে কোথাও কোন প্রকার শান্তি পায় না। সব সময় দুশ্চিন্তা ও হতাশায় লিপ্ত থাকে। তার পেরেশানির কোন অন্ত থাকে না। সে মানুষকে খারাপ জানবে আর মানুষ তাকে খারাপ জানবে। তার জীবনে বিপর্যয় ছাড়া কিছুই জুটবে না। তার চাহিদার শেষ নাই। যাদের চাহিদা যত বেশি হবে, সে ততবেশি অশান্তি ভোগ করবে।  
ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা তোমাদের নফসকে তার চাহিদা থেকে ফিরিয়ে রাখ। কারণ, নফস হল এমন একটি চালক, যে তোমাকে অতীব এমন খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে, যার থেকে মুক্তি পাওয়ার মত কোন উপায় তোমার থাকবে না। মনে রাখবে সত্য খুব ভারি ও কঠিন, সত্যের দায়িত্ব মহান। যারা সত্যের দিশারী হয়, তাদের অবশ্যই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর বাতিল খুব সহনীয় ও সহজলভ্য। এর জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। দুনিয়ার শ্রোতের সাথে গা বাসিয়ে দিলেই চলে। বর্তমান যুগটাই হল, খারাপের যুগ। এ যুগে গুনাহ, অন্যায়, অনাচারকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। শয়তান মানুষের জন্য অপরাধকে সুশোভিত করে দিয়েছে এবং গুনাহের যাবতীয় উপকরণ মানুষের দোরগড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আর গুনাহের কাজ ছেড়ে দেয়া, তাওবার মাধ্যমে প্রতিকার করা হতে উত্তম। অনেকে মনে করে আমরা এখন গুনাহ করব, তারপর তাওবা করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিব। তাদের এ ধরনের ধারণা ভ্রান্ত ও বাতিল। আর অনেক দৃষ্টি আছে মানুষের অন্তরে প্রেমের বীজ বপন করে। সুতরাং, খারাপ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে। কারণ, দৃষ্টিকে শয়তানের তীর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তীর দিয়ে যেমন শিকার করা হয়, অনুরুপভাবে দৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ অন্যায় অপকর্ম শিকার করে। আর সামান্য সময়ের জন্য প্রবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়া তোমার মধ্যে দীর্ঘকালের জন্য পেরেশানি ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ, তুমি হয়ত অল্প সময় উপভোগ করবে, কিন্তু তা তোমার জন্য খুব তিক্ত পরিণতি ডেকে আনবে। তোমাকে আমরণ তার যন্ত্রনা সইতে হবে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুক।
আবু বকর আল-ওররাক রহ. বলেন, যখন মানুষের উপর প্রবৃত্তি প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন তার অন্তর আচ্ছন্ন হয়। আর যখন অন্তর আচ্ছন্ন হয়, তখন তার আত্মা সংকীর্ণ ও ব্যাধিগ্রস্ত হয়। আর যখন আত্মা ব্যাধিগ্রস্ত হয়, তার চরিত্র খারাপ হয়। আর যখন চরিত্র খারাপ হয়, তখন সমগ্র মাখলুক তাকে খারাপ জানবে। আর যখন মানুষ তাকে খারাপ জানবে তখন সেও মানুষকে খারাপ জানবে। তারপর যখন মানুষ বুড়ো হয় এবং শাইখের বয়সে উপনীত হয়, তখন সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করার পরিণতি জানতে পারবে। সে তখন বুঝতে পারবে তার অতীত কত মূল্যবান ছিল। কোন এক কবি বলেন,
مَآرِبُ كَانَتْ فِي الشَّبَابِ لَأهْلِهَا
عِذَابُ فَصَارَتْ فِي المَشِيبِ عَذَاباً

অর্থাৎ, যখন একজন মানুষ জোয়ান ছিল, তখন তার নিকট যৌন চাহিদা ও মানবিক চাহিদাগুলো খুব মিষ্টি ও মধুর ছিল এবং অতীব সুন্দর ছিল। কিন্তু যখন সে যৌবনকে পাড়ি দিয়ে, বার্ধক্যে পৌঁছল, তখন তা তিক্ততা ও অশান্তিতে রূপ নিলো।

প্রবৃত্তির অনুসরণ করা দ্বারা মানুষ নিজেকে তার দুশমনের হাতে তুলে দেয়ার নামান্তর:
মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন হল, তার শয়তান, যে মানুষকে খারাপ পথের দিকে ডাকে। আর মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু হল, তার জ্ঞান যা তাকে ভালো উপদেশ দেয়। আর মানুষের অপর বন্ধু হল, ফেরেশতা যে তাকে ভালো কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে। যখন কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তখন সে তার আত্মাকে নিজ হাতে দুশমনের কাছে সোপর্দ করে এবং নিজেকে শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ করে। যখন কোন ব্যক্তি শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়, তখন তার পরিণতি হয় খুবই করুণ। আর একেই বলা হয়, মহা বিপদ ও করুণ পরিণতি, যার থেকে রাসূল সা. আল্লাহর দরবারে মুক্তি কামনা করেন। এছাড়া একে খারাপ ফায়সালা ও দুশমনদের খুশি করাও বলা হয়ে থাকে। এ দুটি থেকেও রাসূল সা. আল্লাহর দরবারে মুক্তি চান।
আগেকার যুগে বলা হত, যখন তোমার উপর তোমার জ্ঞান প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন তা তোমার উপকারে লাগে। আর যখন তোমার উপর তোমার প্রবৃত্তি প্রাধান্য বিস্তার করবে, তখন তা তোমার দুশমনের কাজে লাগবে। 

প্রবৃত্তির অনুসরণ করা মানুষের তিরস্কার ও ভৎসনা লাভের কারণ:
হিসাম ইব্ন আব্দুল মালেক রহ. এ কাব্য ছাড়া আর কোন কাব্য কখনোই বলতেন না।
إذَِا أَنْتَ لَم تَعصِ الهَوَى قَادَكَ الهَوَى
إِلَى بَعْضِ مَا فِيهِ عَلَيْكَ مَقَالُ

“তুমি যদি তোমার প্রবৃত্তির বিরোধিতা না কর এবং তাকে ধমিয়ে রাখতে না পার, তবে তোমার প্রবৃত্তি তোমাকে এমন বস্তুর দিকে টেনে নেবে, যার মধ্যে তোমার ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার থাকবে না”।
আল্লামা ইব্ন আব্দুল বার রহ. বলেন, যদি বলত: তার মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুতে তোমার বিরুদ্ধে কথা আছে, তাহলে তা হত অতি উত্তম ও খুব সুন্দর।
ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন,
إذَِا حارَ وَهْمُكَ فِي مَعْنَيَيْنِ
وَأَعْيَاكَ حَيْثُ الهَوَى وَالصَّوَابْ
فَدع ما هَوْيتَ فَإِنَّ الهَوَى
يَقُودُ النفُّوسَ إلَى مَا يُعَابْ
“যখন তোমার চিন্তা দুটি বিষয়ে অর্থাৎ কোনটি প্রবৃত্তি আর কোনটি সঠিক, এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে এবং তোমাকে অক্ষম করে ফেলে, তখন তোমার নফস তোমাকে এমন বস্তুর দিকে নিয়ে যাবে, যাকে কোন ক্রমেই ভালো বলা যাবে না”।

প্রবৃত্তির অনুসরণ অপমান অপধস্তের কারণ:
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন,
وَمنَ البَلَاءِ وَللْبلَاءِ عَلَامَةٌ
أَنْ لَا تَرَى لَكَ عَنْ هَوَاكَ نُزُوعُ
العَبْدُ عَبْدُ النفَّسِ فِي شَهَوَاتهَ
وَالحُرُّ يَشْبَعُ مَرَّةً وَيَجُوعُ
“বিপদ শুধু বিপদ নয়, বরং সুস্পষ্ট বিপদ, যার আলামত হল, তুমি কখনোই তোমার প্রবৃত্তি থেকে বের হতে পারবে না। আর পরাধীন সে ব্যক্তি যে তার নফসের গোলামী করে এবং নফসের চাহিদা হতে বের হতে পারে না। আর স্বাধীন সে ব্যক্তি যে এক সময় পেট ভরে খায়, আবার ক্ষুধায় কষ্ট পায়”।
কোন এক হাকীমকে প্রবৃত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, সে বলে প্রবৃত্তি হল ‘হাওয়ানুন’ অর্থাৎ অপমান, তা হতে শুধু নুন শব্দকে বাদ দেয়া হয়েছে। একই অর্থ একজন কবি তার আবৃত্তিতে উল্লেখ করেন এবং তিনি বলেন,
نُونُ الهَوَانِ مِنَ الهَوَى مَسْرُوقَةٌ
 فَإِذَا هَوَيْتَ فَقَدْ لَقِيتَ هَوَانَا
“হাওয়ানুন শব্দটি হাওয়া শব্দ থেকে নির্গত, তার নুনকে চুরি করা হয়েছে। যখত তুমি নফসের চাহিদা মেটাতে যাও, তখন তুমি অবশ্যই হাওয়ানুন অর্থাৎ, অপমান ও লাঞ্চনার মুখোমুখি হবে”।

অপর একজন কবি বলেন,
وَلَقَدْ رَأَيْتُ مَعَاشراً جَمَحَتْ بِهِمْ
تِلْكَ الطَّبِيعَةُ نَحْوَ كُلِّ تَبَارِ
تْهوَى نُفُوسُهُمُ هَوَى أَجْسَامِهِمْ
شُغْلاً بِكلِّ دَنَاءَةٍ وَصَغَارِ
تَبعِوا الهَوَى فَهَوَى بِهِمْ وَكَذَا الهَوَى
مِنْهُ الهَوَانُ بِأَهْلِهِ فَحَذَارِ
فَانْظُرْ بِعَيْنِ الحَقِّ لَا عَيْنَ الهَوَى
 فَالحَقُّ لِلْعَينِ الجَلِيَّةِ عَارِي
قَادَ الهَوَى الفُجَّارَ فَانْقَادُوا لَهُ
وأبتْ عَلَيْهِ مَقَادَةُ الأبْرَارِ
অর্থ, আমি একটি জামাতকে দেখলাম তাদের স্বভাব বা নফস তাদের যাবতীয় সব ধ্বংস এ সর্বনাশী কর্মের প্রতি বাধ্য করে, তাদের নফস শত অপমান, অপদস্ত ও বঞ্চনা সত্বেও তাদের দেহের চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট থাকে। তারা তাদের নফসের অনুকরণ করল, ফলে তারা নফসের চাহিদা নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকতে থাকল। আর তাদের প্রবৃত্তি তাদের জন্য কেবল অপমান ও লাঞ্চনাই বয়ে আনল, কোন সুফল দেখাতে পারল না। তুমি তোমার সঠিক দৃষ্টি দিয়ে চিন্তা করে দেখ, প্রবৃত্তির দৃষ্টি দিয়ে নয়। আম মনে রাখবে, সত্য, সত্যের অনুসন্ধানকারীদের সামনে একেবারেই স্পষ্ট ও উম্মুক্ত। ফাজের লোককে তার নফস সব সময় অন্যায়ের দিকে টানতে থাকে। ফলে তারা তারই অনুসরণ করে। আর যারা সত্যিকার জ্ঞানী তারা তাদের নফসের চাহিদা মেটাতে অস্বীকার করে এবং নফসের চাহিদাকে প্রত্যাখ্যান করে।
ওমর ইব্ন আব্দুল আজীজ রহ. বলেন, সর্বোত্তম জিহাদ হল, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। আর সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, সবচেয়ে বড় বাহাদুর ব্যক্তি হল, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক বেশি কঠোর হয়। মনে রাখবে, কোন কিছুকে ছোট মনে করা ধ্বংস ডেকে আনে। অন্তরের ব্যাধিসমূহের সত্যিকার চিকিৎসা ও প্রতিষেধক হল, প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা।
সাহাল ইব্ন আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, তোমার প্রবৃত্তি হল তোমার অন্তরের রোগ। আর যখন তুমি তোমার প্রবৃত্তির বিরোধিতা করবে তখন তা হবে চিকিৎসা।
সুতরাং বান্দা হিসেবে আমাদের উচিত হল, নফসের বিরোধিতা করা। আর নফসের বিরোধিতার অন্তরের চিকিৎসা করতে হবে।

নফস বা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার উপকারিতা

নফসের বিরোধিতা করা দ্বারা একজন মানুষ কি কি উপকার লাভ করে তা নিম্নে আলোচনা করা হল।

প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা জান্নাত লাভ হয়:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿ فَأَمَّا مَن طَغَىٰ ٣٧ وَءَاثَرَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ٣٨ فَإِنَّ ٱلۡجَحِيمَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٣٩ وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِۦ وَنَهَى ٱلنَّفۡسَ عَنِ ٱلۡهَوَىٰ ٤٠ فَإِنَّ ٱلۡجَنَّةَ هِيَ ٱلۡمَأۡوَىٰ ٤١ ﴾  [سورة النازعات : 37-41 [.
সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে আর দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয় জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল। আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল। [সূরা আন-নাযেয়াত, আয়াত: ৩৭-৪১]
যে ব্যক্তি নফসের বিরোধিতা করে এবং প্রবৃত্তির চাহিদাকে প্রতিহত করতে গিয়ে ধৈর্য ধারণ করে, কিয়ামতের দিন তাকে উত্তম বিনিময় দেয়া হবে। তাদের জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে এবং জান্নাতে তাদের দেয়া হবে সুন্দর ও আনন্দদায়ক জীবন। আর তা হল, তারা যে দুনিয়াতে ধৈর্য ধারণ করেছিল তার বিনিময়। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন  বলেন,
﴿ وَجَزَىٰهُم بِمَا صَبَرُواْ جَنَّةٗ وَحَرِيرٗا  ١٢  ﴾  [سورة الإنسان : 12 [.
“আর তারা যে ধৈর্যধারণ করেছিল তার পরিণামে তিনি তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী বস্ত্রের পুরস্কার প্রদান করবেন”। [সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ১২]
আবু সুলাইমান আদ-দারানী রহ. বলেন, অর্থাৎ, তারা তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ না করে, ধৈর্য ধারণ করে।
وَآفَةُ العَقْلِ الهَوَى فَمَنْ عَلَا
عَلَى هَوَاهُ عَقْلُه فَقَدْ نَجَا
একজন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির জন্য বড় বিপদ হল, তার প্রবৃত্তি। যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির উপর বিজয়ী হবে, কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ পরিণতি হতে নাজাত লাভ:
কিয়ামতের দিন মানুষের যে ভয়াবহ অবস্থা হবে তার থেকে মুক্তি পাবে। আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 « سَبْعَةٌ يُظلِّهُمُ الله تَعَالَى فِي ظلِهِ يَوْمَ لَا ظلَِّ إلِّا ظلِّهُ: إمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابٌّ نَشَأ فِي عِباَدَة الله، وَرَجُلٌ قَلْبهُ مُعَلَّقٌ فِي المَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي الله اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنصْبٍ وَجمَالٍ فَقَالَ:إنِّي أَخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَم شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضتْ عَيْنَاهُ»
“কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাত ব্যক্তিকে তার আরশের ছায়ার তলে আশ্রয় দেবেন। সেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তারা হলেন, ন্যায় পরায়ন বাদশা, যুবক যে তার যৌবনকে আল্লাহর রাহে ব্যয় করে, যে ব্যক্তির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত, দুই ব্যক্তি যারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে। আল্লাহর ভালোবাসার ভিত্তি করে তারা একত্র হয় এবং তার উপর ভিত্তি করে তারা পৃথক হয়, এক ব্যক্তি যাকে কোন সন্দর ও সম্ভান্ত রমণী তার সাথে অপকর্মের জন্য ডাকলে সে বলে আমিতো আল্লাহকে ভয় করি। গোপনে সাদকাকারি ব্যক্তি যার বাম হাত জানে না ডান হাতে কি দান করল। যে নির্জনে বসে আল্লাহর জিকির করল এবং তার উভয় চোখ অশ্রু বিসর্জন দিল”।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন যাদের আরশের ছায়ার তলে স্হান দেয়া হবে, তাদের বিষয়ে চিন্তা করল দেখতে পাবে, তাদের এত বড় মর্যাদা লাভের কারণ হল, তারা তাদের নফসের বিরোধিতা করত এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে বিরত থাকত। কারণ, এখানে যে সাতজনের কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই নফসের বিরোধিতা করত। যেমন- ক্ষমতাশীল ও শক্তিশালী বাদশা, ইনসাফ করতে সক্ষম হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার নফসের বিরোধিতা না করবে। তার নফস তাকে ন্যায় বিচার না করতে আদেশ দেয়। কিন্তু সে তার নফসের যা চায় তার বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে। সুতরাং বলা বাহুল্য যে, তাকে ইনসাফ করতে হলে অবশ্যই তার নফসের বিরোধিতা করতে হবে। আর যে যুবক আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে অপকর্ম হতে বিরত থাকল, তাকেও তার নফসের বিরোধিতা করতে হয়েছে। কারণ, তার নফসের বিরোধিতা ছাড়া সে তার যৌবনকে আল্লাহর রাহে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে না। অনুরূপভাবে যে লোকটির অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত তাকে আজীবন তার নফসের বিরোধিতা করেই এ অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়েছে। অন্যথায় সে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের সাথে সম্পৃক্ত থেকে প্রবৃত্তির স্রোতে ঘুরে বেড়াত।
আর যে ব্যক্তি গোপনে সদকা করে এবং তার ডান হাত কি দান করল তা বাম হাত জানে না ইত্যাদি তখন সম্ভব হয় যখন সে তার প্রবৃত্তির সাথে অনবরত যুদ্ধ করে। কারণ, মানবাত্মার স্বভাব হল সে সব সময় তার নিজের গুনাগুণ ও প্রশংসা শোনতে চায়। আর গোপনে সাদকাকারীকে অবশ্যই তার আত্মার চাহিদার সাথে সংগ্রাম করতে হয়। আর যাকে সুন্দর রমণী অপকর্মের দিকে ডাকার পর সে তা হতে একমাত্র আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে বিরত থাকল এবং যে লোকটি একান্তে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের স্মরণে দু-চোখ হতে অশ্রু বিসর্জন দিল এবং নির্জনে বসে বসে কেবল আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের ভয়ে কাঁদল, একমাত্র নফসের বিরোধিতা ও প্রবৃত্তির প্রতি অবিচার করাই তাদের এ অবস্থায় পৌঁছিয়েছে। তারা তাদের জীবনে দুনিয়াতে নফসের বিরোধিতা করেন বলেই কিয়ামতের দিন কিয়ামতের ভয়াবহতা হতে নাজাত পাবে। কিয়ামতের দিনের প্রচণ্ড উত্তাপ, গরম ও ঘাম তাদের কোন প্রকার স্পর্শ করতে পারবে না। অন্যদিকে প্রবৃত্তির পূজারীরা সেদিন অত্যন্ত অসহনীয় বিপদের মুখোমুখি হবে। প্রচণ্ড গরম ও সূর্যের তাপের কারণে তাদের ঘাম তাদের গলদেশ পর্যন্ত পৌছবে। তারা তাদের ঘামের মধ্যে সাঁতরাতে থাকবে। তারপর তারা এ ভয়াবহ শাস্তির বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তারপর তাদের প্রবৃত্তির শাস্তি জেলখানায়-জাহান্নামে-তাদের প্রবেশ করানো হবে।

প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার কারণে ইজ্জত, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা লাভ হবে:
মুয়াবিয়া রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, মানবিকতা হল, প্রবৃত্তির অনুকরণ হতে বিরত থাকা এবং নফসের বিরোধিতা করা। প্রবৃত্তির অনুসরণ মানবিকতাকে কুলসিত করে আর প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা মানবতাকে পুনরুজ্জীবিত করে।
মাহলাব ইব্ন আবী সুফিয়ানকে বলা হল, তুমি যে ইজ্জত সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলে, তা কীভাবে অর্জন করলে? উত্তরে সে বলল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের আনুগত্য ও নফসের বিরোধিতার মাধ্যমে।
আরও কতক আলেম বলেন, সম্মানের অধিকারী আলেম তারা যারা তাদের দ্বীনকে নিয়ে দুনিয়াদারি হতে পলায়ন করেন। আর তারা বিপদে পড়েছে যারা তাদের প্রবৃত্তির নেতৃত্বে চলেছেন।
আবু আলী আদ-দাকাক বলেন, যৌবনে যে তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বুড়ো বয়সে তাকে সম্মান দেবেন।
আল্লামা ইব্ন আব্দুল কাবী রহ. বলেন,
فََمنْ هجََر اللَّذَّاتِ نَالَ المُنىَ وَمَنْ
أَكَبَّ عَلَى اللَّذَّاتِ عَضَّ عَلَى اليَدِ

وَِفي قَْمِع أَْهَواءِ النفُُّوسِ اعْتِزَازُهَا
وَفِي نَيْلِهَا مَا تَشْتَهِي ذُلُّ سَرْمَدِ

وََلا تَْشَتِغْل إلَِّا بمَِا يُكسِبُ العُلَا
وَلَا تُرْضِ النفَّْسَ النفَِّيسَةَ باِلرَّدِي

وَِفي خْلَوِة الإِنْسَانِ بِالعِلْمِ أُنْسُهُ
وَيَسْلَمُ دِينُ المَرْءِ عِنْدَ التَّوَحُّدِ

وََيْسَلُم مِنْ قِيلٍ وَقَالٍ وَمِنْ أَذى
جَلِيسٍ وَمِنْ وَاشٍ بَغِيضٍ وَحُسَّدِ

فَكنْ حِلْسَ بَيْتٍ فَهْوَ سِتْرٌ لعَِوْرَةٍ
وَحِرْزُ الفَتَى عَنْ كُلِّ غَاوٍ وَمُفْسِدِ

وََخْيُر جِليسِ المَرْءِ كُتْبٌ تُفِيدُهُ
عُلُوماً وَآدَاباً وَعَقْلاً مُؤَيَّدِ
“যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করা ছেড়ে দেবে সে অবশ্যই তার উদ্দেশ্যে হাসিলে সফল হবে। আর যে ব্যক্তি তার শয়তানীর উপর অটল থাকবে, সে অবশ্যই একদিন তার ভুল বুঝতে পারবে এবং আফসোস করতে করতে আঙ্গুল কাটতে থাকবে। নফসের চাহিদাকে প্রতিহত করার মধ্যে রয়েছে তোমার ইজ্জত ও সম্মান। আর নফস যা চায় তার অনুকরণ করার মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য আমরণ অশান্তি। এমন কোন কাজে ব্যস্ত হইওনা যা তোমার সম্মানহানি ঘটায়, তবে তুমি কিছু নিয়ে ব্যস্ত হও যা তোমার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। আর ভালো আত্মা কখনোই খারাপ ও নিকৃষ্ট বস্তুর উপর সন্তুষ্ট থাকে না। যখন একজন মানুষ একা হয়, তখন তার জ্ঞানই হবে তার সঙ্গী। একজন মানুষের দ্বীন তখন নিরাপদ হবে যখন তার মধ্যে তাওহীদ থাকবে। মানুষের সমালোচনা ও সহপাঠীদের কষ্ট হতে নিরাপদ থাকবে এবং হিংসুক, নিন্দুক ও দুশমণ থেকে নিরাপদ থাকবে। তুমি তোমার ঘরের ভিতর সু-রক্ষিত থাকো, তাতে তুমি সব কিছু হতে আড়াল থাকতে পারবে। আর তুমি তোমাকে সব ধরনের অনিষ্ঠতা ও ফাসাদ থেকে নিরাপদ থাকবে। একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে উত্তম সাথী হল তার বই পুস্তুক, যা তার উপকারে আসে। কিতাবসমূহ তাকে স্থায়ী ইলম আদব ও জ্ঞানের সন্ধান দেয়”। 
আজীমতকে শক্তিশালী করা:
প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়কে দুর্বল ও নড়-বড় করে। আর প্রবৃত্তির বিরোধিতা মানুষের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও প্রত্যয়কে শক্তিশালী ও সবল করে। আর বান্দার আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা হল, আখিরাত ও আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র মাধ্যম ও বাহন। আর যখন একজন বান্দার বাহন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন আরোহীর অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়।
ইয়াহয়া ইব্ন মুয়াজকে বলা হল, দৃঢ়তার দিক দিয়ে সর্বাধিক সঠিক লোক কে? তিনি উত্তরে বললেন, প্রবৃত্তির উপর বিজয়ী লোক।  

প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা দেহের হেফাজত করা হয়:
যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা তাদের দেহ ও মন উভয়েরই ক্ষতি করে। প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের দিকে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজ করতে বাধ্য করে। এ সব অপকর্ম দ্বারা যেমনিভাবে তার আত্মা দূর্বল হয়, অনুরূপভাবে তার শরীর বা দেহও ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে।
আল্লামা ইব্ন রজব রহ. বলেন, অনেক আলেমদের দেখা যায় সে একশত বছর অতিবাহিত করার পরও সে তার শক্তি, সামর্থ্য ও জ্ঞান-বুদ্ধিতে পরিপূর্ণ।
একদিন এক লোক রাগে ক্ষোভে ভীষণ কুদে উঠলে, তাকে বিভিন্ন ধরনের গাল মন্দ করা হল। তখন সে বলল, আমরা যৌবনে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহের কাজ থেকে হেফাজত করি আর আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আমাদেরকে বৃদ্ধ বয়সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে হেফাজত করেন। আর বিপরীত হল, কোন এক মনীষী বলেন, আমরা একজন বৃদ্ধকে দেখি, সে মানুষের নিকট ভিক্ষা করছে। তারপর সে বলল, লোকটি খুবই দুর্বল, আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের বিধানকে সে ছোট বেলায় নষ্ট করছে, আর বুড়ো কালে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার শক্তি ও সামর্থ্যকে নষ্ট করেছে।

প্রবৃত্তির বিরোধিতা দ্বারা দুনিয়াতে যাবতীয় বিপদ থেকে নিরাপদ থাকে:
যারা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে তারা দুনিয়াতে বিভিন্ন ধরনের জামেলা হতে মুক্ত থাকে। কোন প্রকার বিপদ তাদের স্পর্শ করে না। ইবরাহীম ইব্ন আদহম রহ. বলেন, সবচেয়ে কঠিন জেহাদ হল প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে খারাপ ও অন্যায় কাজ হতে বিরত রাখতে সক্ষম হল, সে অবশ্যই দুনিয়া ও দুনিয়ার মুসিবত হতে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হবে। আর দুনিয়ার জীবনে সে আরাম পাবে এবং দুনিয়ার কষ্ট হতে সে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকবে।

প্রবৃত্তির চিকিৎসা
মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির ধোঁকায় পড়ে যাবে তাকে অবশ্যই পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। সে যখন তার প্রবৃত্তির চিকিৎসার প্রতি মনোযোগ দেবে, তখন হতে পারে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার প্রতি অনুগ্রহ করবে এবং তাকে নেককার লোকদের সাথে সম্পৃক্ত করবে। আমরা নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী কিছু চিকিৎসার কথা আলোচনা করব।

এক. তাওবা ও দো‘আ করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট তাওবা ও প্রার্থনা করা যাতে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তাকে প্রবৃত্তির অনিষ্ঠতা থেকে হেফাজত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পূর্ব মনীষীদের আদর্শ ছিল, তারা আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নিকট তাওবা করত এবং আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে দো‘আ করতেন। গুণাহ হতে তাওবা করা প্রবৃত্তির অনিষ্ঠতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা. নিজে দৈনিক অসংখ্য বার আল্লাহর দরবারে তাওবা করতেন এবং উম্মতদের তাওবা করার প্রতি উদ্ভুদ্ধ করেন। রাসূল সা. বলেন, যারা গুণাহ হতে তাওবা করেন, তারা যেন কোন গুণাহ করেন নাই।  
কুতবা ইব্ন মালেক রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-
« اللَّهُمَّ إنِي أَعُوذُ بكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأخْلَا قِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ »

“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট খারাপ চরিত্র হতে আশ্রয় প্রার্থণা করছি এবং খারাপ আমল ও প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় প্রার্থণা করছি”।
ওমর ইব্ন আব্দুল আজীজ রহ. খালেদ ইব্ন সাফওয়াকে বলেন, তুমি আমাকে সংক্ষিপ্ত ওয়াজ ও নছিহত কর। তখন সে বলল, হে আমীরুল মুমিন! অনেক মানুষকে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের পর্দা ধোঁকায় ফেলছে, আর তাদের প্রশংসা তাদেরকে বিপদে ফেলছে। তোমার সম্পর্কে তোমার জানাকে অন্যের অজানা যেন পরাভূত করতে না পারে। আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আমাকে এবং তোমাকে আমাদের গুনাহসমূহ গোপন রাখার মাধ্যমে ধোঁকায় পড়া থেকে হেফাজত করুন! মানুষের প্রশংসায় খুশি হওয়া থেকে হেফাজত করুন। আর আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আমাদের উপর যা ফরজ করেছেন, তাতে যাতে আমরা পিছপা না হই এবং কোন প্রকার দুর্বলতা প্রদর্শন না করি। আর আমরা যাতে আমাদের প্রবৃত্তির প্রতি না ঝুঁকি। এ কথা শোনে তিনি ক্রন্দন করেন এবং বলেন, আল্লাহ রাব্বূল আলামীন আমাকে এবং তোমাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে হেফাজত করুন।
ইব্রাহীম তাইমী রহ. স্বীয় দো‘আয় বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার কিতাব এবং তোমার নবীর সুন্নত দ্বারা আমাদেরকে হক সম্পর্কে মতবিরোধ করা থেকে হেফাজত কর। হে আল্লাহ! তোমার পথ নির্দেশকে আমাদের জীবনে পাথেয় বানিয়ে দাও। আর তোমার অনুকরণ ছাড়া প্রবৃত্তির অনুকরণ হতে আমাদের রক্ষা কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের আরও রক্ষা কর গোমরাহি ও পথভ্রষ্টটা হতে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের যাবতীয় কর্মে সন্দেহ পোষণ করা, হঠকারীতা, ঝগড়া-বিবাদ ও উল্টা-পাল্টা করা হতে রক্ষা কর।

দুই. প্রবৃত্তির পরিপন্থী বস্তু দ্বারা অন্তর পূর্ণ থাকা:
মনে রাখতে হবে মানবাত্মা কখনোই খালি থাকে না; তাকে যদি আমরা ঈমান ও আমলের নুর দিয়ে পরিপূর্ণ না করি, তাহলে তা অবশ্যই শিরক ও কুফরের অন্ধকারে পরিপূর্ণ হবে। তাতে কুফর শিরক ও বিদআত স্থান করে নেবে। আমাদের অবশ্যই অন্তরকে পরিপূর্ণ রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর তা হল আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে অন্তরকে ঈমানের নুরের দ্বারা পরিপূর্ণ রাখা এবং অন্তর থেকে গাইরুল্লাহ মহব্বতকে দূর করা। আর গাইরুল্লাহর মহব্বতকে অন্তরে কোন প্রকার স্থান না দেয়া। নি:সন্দেহে একটি কথা যায় যে, আল্লাহর মহব্বতকে অন্তরে স্থান দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের নৈকট্য লাভে ধন্য হওয়া যায়। আর যখন মানবাত্মা আল্লাহর মহব্বতে পরিপূর্ণ হবে, তখন মানুষের অন্তর থেকে যাবতীয় খারাপ চাহিদা দূর হয়ে যাবে।

তিন. আলেম ওলামা ও সালে-হীনদের সাথে উঠা-বসা করা:
আল্লামা ইব্ন আব্দুল কাবী রহ. বলেন,
وََخالطِْ إذَِا خَالَطتَّ كُلَّ مُوَفَّقٍ مِنَ العُلَمَاءِ أَهْلِ التُّقَى وَالتَّسَدُّدِ
يُفِيدُكَ مِنْ عِلْمٍ وَيَنْهَاكَ عَنْ هَوىً فَصَاحِبْهُ تْهدَى مِنْ هُدَاهُ وَتَرْشُدِ
وَإيَاكَ وَالهَمَّازَ إِنْ قُمْتَ عَنْهُ وَالبَذِيِّ فَإنَِّ المَرْءَ باِلمَرْءِ يَقْتَدِي
وََلا تَصَحبِ الحَمْقَى فَذُو الجَهْلِ إِنْ يَرُمْ صَلَاحاً لشْيءٍ يَا أَخَا الحَزْمِ يُفْسِدِ

অর্থ, যখন তুমি কারো সাথে উঠবস করতে চাও, তবে তুমি আলেম ওলামা, মুত্তাকী, পরহেজগার এবং আল্লাহ যাদের কবুল করেছেন তাদের সাথে উঠবস কর। তারা তাদের ইলম দ্ধারা তোমার উপকার করবে এবং তোমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হতে নিষেধ করবে। আর তুমি খারাপ ও গোমরাহ লোকদের অনুসরণ করা হতে বিরত থাক। কারণ, মানুষ মানুষের দ্ধারা প্রভাবিত হয়। তুমি যখন খারাপ ও গোমরাহ লোকদের সাথে উঠবস করবে তখন তোমাদের মধ্যে তাদের গোমরাহী ও খারাপ প্রভাব বিস্তার করবে। আর তুমি কোন জাহেল, অজ্ঞ ও আহমক লোকের সাথে মিশবে না। তাদের সাথে মিশলে তুমি তাদের মতই হবে। কারণ, একজন জাহেলের কাজ হল, তুমি যখন কোন বিষয়ে সংশোধন চাইবে তখন সে তা ধ্বংস করে দেবে, তোমাকে সংশোধন হতে দেবে না।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাহায্যের পর এসব বিষয়গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির কু-মন্ত্রণা হতে মুক্তি পেতে পারে। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিতে ডুবে আছে, তার দ্বারা কি তা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব? তাকে বলা হবে, অবশ্যই সম্ভব! আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওফিক ও তার সাহায্য থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। নিম্নে আমরা বিষয়গুলো আলোচনা করব:
এক. একজন স্বাধীন ও সাহসী লোকের সাহস ও প্রত্যয় যা তার আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নফসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ধরনের সাহসী লোক দ্ধারা প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকা সম্ভব।
দুই. ধৈর্য ধারণে সাহসিকতার পরিচয় দেয়া। যখন তার নফস কোন খারাপ কিছু চায়, তখন তা থেকে বিরত থাকার তিক্ততার উপর ধৈর্যধারণ করা।
তিন. আত্মার শক্তি একজন মানুষকে সাহসিকতার যোগান দেয় এবং তাকে সঠিক পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। আর সাহসিকতা পুরোই হল, প্রতিকুল মুহূর্তের সাময়িক ধৈর্য। আর সবচেয়ে উত্তম জীবন যা একজন বান্দা লাভ করে তা হল,  ধৈর্যের দ্বারা জীবন লাভ করা। ধৈর্যের মাধ্যমে যে জীবন লাভ করা যায় তাকে সমৃদ্ধ জীবন লাভ করা বলা চলে।
চার. উত্তম পরিণতির জায়গা কোনটি তা পর্যবেক্ষণ করা এবং সৎ সাহসের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা।
পাঁচ. প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শাস্তি নিয়ে চিন্তা করা:
প্রবৃত্তির পূজা করার কারণে ভীষণ যন্ত্রণা ও শাস্তি কি তা পর্যবেক্ষণ করা। যখন সে তার শাস্তি সম্পর্কে জানতে পারবে তখন সে প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে অবশ্যই বিরত থাকবে।
ছয়. প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করা:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে তাকে নিয়ে যাওয়া এবং মানুষের অন্তরে তার সম্মান ও মর্যাদা প্রতিস্থাপন করা। আর এটি তার জন্য অধিক উত্তম ও প্রশান্তি প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করার মজা হতে।
সাত. পাপাচার বা গুনাহের মজার উপর পাক-পবিত্র থাকা, সম্মান বজায় রাখার যে মজা তাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে।
আট. দুশমনের উপর বিজয় লাভ, দুশমনকে প্রতিহত করা ও তাকে অপমান অপদস্থ করে ক্ষোভ, রাগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়ার আনন্দ উপভোগ করা। কারণ, শয়তান যখন তার আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে না পারে, তখন সে বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত হয়। আর আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার বান্দা থেকে পছন্দ করে যেন সে তার দুশমন শয়তানকে অপমান অপদস্থ করে। যেমন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার মহা কিতাব আল-কুরআনে এরশাদ করেন-
 ﴿ مَا كَانَ لِأَهۡلِ ٱلۡمَدِينَةِ وَمَنۡ حَوۡلَهُم مِّنَ ٱلۡأَعۡرَابِ أَن يَتَخَلَّفُواْ عَن رَّسُولِ ٱللَّهِ وَلَا يَرۡغَبُواْ بِأَنفُسِهِمۡ عَن نَّفۡسِهِۦۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ لَا يُصِيبُهُمۡ ظَمَأٞ وَلَا نَصَبٞ وَلَا مَخۡمَصَةٞ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَطَ‍ُٔونَ مَوۡطِئٗا يَغِيظُ ٱلۡكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنۡ عَدُوّٖ نَّيۡلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِۦ عَمَلٞ صَٰلِحٌۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٢٠﴾ [ سورة التوبة : 120 [.
মদীনার অধিবাসী ও তার আশপাশের মরুবাসীদের জন্য সংগত নয় যে, রাসূলুল্লাহ থেকে পেছনে থেকে যাবে এবং রাসূলের জীবন অপেক্ষা নিজদের জীবনকে অধিক প্রিয় মনে করবে। এটা এ কারণে যে, তাদেরকে আল্লাহর পথে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় আক্রান্ত করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধ জন্মায় এবং শত্রুদেরকে তারা ক্ষতিসাধন করে, তার বিনিময়ে তাদের জন্য সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। [সূরা তাওবা, আয়াত: ১২০]
সত্যিকার মহব্বতের আলামত হল, মাহবুবের দুশমনকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং তাদের অপমান করা।
নয়. এ কথা বিশ্বাস করা যে, প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মানকে বৃদ্ধি করে। একজন বান্দাকে বাহ্যিক ও বাতেনী উভয় প্রকার সম্মানে ভূষিত করে। অপরদিকে যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সম্মানহানি ঘটে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে তারা অপমান, অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হয়।

কোনটি প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি এবং কোনটি নিন্দনীয় প্রবৃত্তি?

 প্রবৃত্তিকে ঢালাওভাবে খারাপ বা ভালো কোনটিই বলা চলে না। তবে যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিভিন্ন ধরেনর খারাপ কাজে লিপ্ত হয়, এবং এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে তাদেরই খারাপ বলা যাবে। প্রক্ষান্তরে যে প্রবৃত্তি মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি মোতাবেক চলতে সাহায্য করে, তা কোনদিন খারাপ হতে পারে না। তাকে অবশ্যই ভালো প্রবৃত্তি বলতে হবে। আর যে প্রবৃত্তি দ্বারা উপকার লাভ ও ক্ষতি দূর করা সম্ভব নয় তা অবশ্যই খারাপ। এ ছাড়া যে প্রবৃত্তি মানুষকে খারাপের দিকে নিয়ে যায় এবং মানবাত্মার উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, তা অবশ্যই খারাপ ও নিন্দনীয়।
এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, কোন কোন প্রবৃত্তি বা নফসের চাহিদা আছে, যেগুলোকে আল্লাহ ও তার রাসূল পছন্দ করে। এ ধরনের প্রবৃত্তি বা চাহিদাকে প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি বা প্রশংসনীয় চাহিদা বলা হয়ে থাকে। সুতরাং, বলা বাহুল্য যে, প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি হল, যে প্রবৃত্তিকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল পছন্দ করে। এ ধরনের প্রবৃত্তি শরীয়তের বিধানের পরিপন্থী হয় না। বরং, তা মানুষকে আল্লাহর মর্জি মোতাবেক চলতে সাহায্য করে। এ ধরনের প্রবৃত্তির দৃষ্টান্ত হাদিস কুরআন দ্বারাও প্রমাণিত।
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
 كنت أغار على اللاتي وهبن أنفسهن لرسول الله وأقول: أتهب المرأة نفسها؟ فلما أنزل الله تعالى: ﴿ تُرۡجِي مَن تَشَآءُ مِنۡهُنَّ وَتُ‍ٔۡوِيٓ إِلَيۡكَ مَن تَشَآء ﴾ [الأحزاب: ٥١] قلت: ما أرى ربك إلا يسارع في هواك
অর্থ, আমি ঈর্ষা করতাম সে রমণীদের উপর যারা তাদের নিজেদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য সোপর্দ করত। আমি বলতাম, নারীরা কি স্বেচ্ছায় তাদের নিজেদের নফসকে সোপর্দ করতে পারে? তারপর যখন আল্লাহ রাব্বূল আলামীন এ আয়াত নাযিল করল,
﴿ تُرۡجِي مَن تَشَآءُ مِنۡهُنَّ وَتُ‍ٔۡوِيٓ إِلَيۡكَ مَن تَشَآءُۖ وَمَنِ ٱبۡتَغَيۡتَ مِمَّنۡ عَزَلۡتَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡكَۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن تَقَرَّ أَعۡيُنُهُنَّ وَلَا يَحۡزَنَّ وَيَرۡضَيۡنَ بِمَآ ءَاتَيۡتَهُنَّ كُلُّهُنَّۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ مَا فِي قُلُوبِكُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَلِيمٗا ٥١ ﴾ [الأحزاب : 51[.
“স্ত্রীদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার পালা তুমি পিছিয়ে দিতে পার, যাকে ইচ্ছা কাছে রাখতে পার; যাকে তুমি সরিয়ে রেখেছ তাকে যদি কামনা কর তাতে তোমার কোন অপরাধ নেই; এটা নিকটতর যে, তাদের চক্ষু শীতল হবে, তারা কষ্ট পাবে না এবং তুমি তাদের যা দিয়েছ তাতে তারা সবাই সন্তুষ্ট হবে। আর তোমাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, পরম সহনশীল”। [সূরা আহযাব, আয়াত: ৫১]
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম, আমি তোমার রবকে দেখতে পেলাম, সে সবসময় তোমার চাহিদার পিছনে দৌঁড়ে।
কোন কোন বিষয় ছিল, যেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিজের জন্য পছন্দ করত বা তার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগ্রহ ছিল, তখন আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার চাহিদা মোতাবেক কোরআন নাযিল করত; ফলে এর দ্বারা প্রমাণিত হত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কামনা করেছেন বা তার মন যা চেয়েছে তা ছিল প্রশংসনীয় ও ভালো চাহিদা বা ভালো প্রবৃত্তি। এখানে যে কথাটি প্রমাণিত হয়, তা হল প্রবৃত্তি বা চাহিদা মানেই কোন খারাপ বা মন্দ কিছু নয়; তা ভালোও হতে পারে আবার মন্দও হতে পারে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিষয়গুলো কামনা করতেন, তার মধ্যে একটি বিষয় ছিল, তিনি কিবলাকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে ফিরিয়ে ক্বাবার দিক করাকে পছন্দ করেন। এর কারণ সম্পর্কে ওলামারা বলেন, তিনি ইবরাহীম আ. এর কিবলার অনুসরণ করাকে পছন্দ করেতেন বলেই, কিবলার পরিবর্তন চাইতেন। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনের চাহিদা ছিল, কিন্তু মনের চাহিদা হওয়ার কারণে একে খারাপ বলা যাবে না। কেননা, এর পিছনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ত সৎ ও ভালো ছিল। তিনি ইব্রাহিম আ. এর নির্মিত কাবার অনুকরণ করাকে পছন্দ করছেন। আর ইব্রাহীম আ. এর নির্মিত কাবাকে পছন্দ করার কামনা করা হল, প্রসংশনীয় কামনা ও প্রসংশনীয় উদ্যোগ।  
আবি বারযা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« إِنَّ مِمَّا أَخْشَى عَلَيْكُم شَهَوَاتِ الغَيِّ فِي بُطُونكُمْ وَفُرُوجِكُمْ، وَمُضِلَّاتِ الَهوَى »
“আমি তোমাদের উপর যে জিনিষটি অধিক ভয় করি তা হল, তোমাদের পেট, লজ্জাস্থান ও গোমরাহ প্রবৃত্তির চাহিদা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের বিষয়ে সব ধরনের প্রবৃত্তিকে ভয় করেননি। বরং তিনি তার প্রবৃত্তির কু-মন্ত্রণা ও প্রবৃত্তির খারাপ চাহিদাসমূহকে ভয় করেন। প্রবৃত্তির চাহিদা কখনো কখনো গোমরাহ হয়ে থাকে। এ ধরনের প্রবৃত্তি মানুষের দ্বীন ও জ্ঞানকে নষ্ট করে। মানুষকে আল্লাহর স্মরণ আখেরাত হতে ফিরিয়ে রাখে। আর যে সব প্রবৃত্তি গোমরাহ হয় না, তা কখনোই মানুষের দ্বীন ও জ্ঞানকে নষ্ট করে না। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সব ধরনের প্রবৃত্তি হতে সতর্ক করেননি। তিনি শুধু যে সব প্রবৃত্তি মানুষকে খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, তাকে খারাপ বলেছেন তার থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে, প্রবৃত্তি মানুষের জন্য খুবই মারাত্মক; একারণেই আমরা দেখতে পাই কুরআনের আয়াত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহীন এবং তাদের পরবর্তী মনিষীরা প্রবৃত্তির অধিক নিন্দা করেন এবং প্রবৃত্তি হতে মানুষকে অধিক সতর্ক করেন। এ সব কুরআন, হাদিস ও সাহাবীদের উক্তি দ্বারা যে প্রবৃত্তির নিন্দা বা সতর্ক করা হয়েছে, তা হল খারাপ প্রবৃত্তি ও কু-প্রবৃত্তি। তবে সব ধরনের প্রবৃত্তিকে নিন্দা করা হয়নি।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, সাধারণত দেখা যায়, মানুষ তাদের চাহিদার পিছনে দৌড়ে এবং প্রবৃত্তির পূজারিই হয়ে থাকে এবং তাদের জন্য যতটুকু উপকারী সে সীমানা পর্যন্ত অবস্থান করে না এবং সীমা অতিক্রম করা হতে বিরত থাকে না। তাই কুরআন ও হাদিসে ঢালাওভাবে প্রবৃত্তির দুর্নাম ও প্রবৃত্তি বিষয়ে অধিক সতর্ক করা হয়েছে। কারণ, প্রবৃত্তি সাধারণত মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতির কারণ অধিক হয়ে থাকে। এ ছাড়া যে ব্যক্তি প্রবৃত্তি বিষয়ে ইনসাফ করে এবং সীমা অতিক্রম করে না এ ধরনের লোক খুব কমই পাওয়া যায়। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বূল আলামীন তার স্বীয় কিতাবে প্রবৃত্তির নিন্দা করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতে দু-একটি জায়গা ছাড়া সব জায়গায় প্রবৃত্তির শুধু নিন্দাই বর্ণিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতে প্রবৃত্তির দুর্নাম বা নিন্দা করা হয়নি এমন একটি হাদিস হল, উপরে উল্লেখিত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহু এর হাদিস।
অপর একটি হাদিস আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَا يُؤْمُن أََحدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاُه تَبعاً لَماِ جِئْتُ بِهِ » 
 “তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যে বিধান নিয়ে এসেছি তার অনুকরণ না করে”।
এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, প্রবৃত্তির একটি প্রকার আছে, যেটি প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি আর তা হল, যে প্রবৃত্তি ইসলামী শরিয়ত যে বিধান নিয়ে আসছে তার অনুগত ও মোতাবেক হয়। আর যে প্রবৃত্তি ইসলামী শরিয়তের সাথে সংঘর্ষিক হয়, তা হল কু-প্রবৃত্তি বা শয়তানি-প্রবৃত্তি।
ওমর ইব্ন খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لما كان يوم بدر، فلما أسروا الأسارى قال رسول الله  لأبي بكر وعمر مَا تَرَوْنَ فِي هَؤُلَاءِ الأسَُارَى فقال أبو بكر: يا نبي الله، هم بنو العم والعشيرة؛ أرى أن تأخذ منهم فدية، فتكون لنا قوة على الكفار، فعسى الله أن يهديهم للإسلام. فقال رسول الله  مَا تَرَى يَا ابْنَ الخَطَّابِ قلت: لا والله، ما أرى الذي رأى أبو بكر، ولكني أرى أن تمكنا فنضرب أعناقهم، فتمكن عليا من عقيل فيضرب عنقه، وتمكني من فلان – نسيبا لعمر- فأضرب عنقه؛ فإن هؤلاء أئمة الكفر وصناديدها. فهوي رسول الله ما قال أبو بكر، ولم يهو ما قلت »
“বদরের যুদ্ধে যুদ্ধ-বন্দীদের বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ চেয়ে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু ও ওমর রাদিআল্লাহু আনহু উভয়কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, তোমরা তাদের ব্যাপারে কি মতামত দাও? উত্তরে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর নবী! তারা আমাদের বাপ-চাচাদের বংশধর এবং আমারা একই বংশের লোক। আপনি তাদের থেকে কিছু ফিদিয়া গ্রহণ করে তাদের ছেড়ে দিন। এতে তারা খুশি হয়ে আমাদের বিরোধিতা করবে না, আমাদের পক্ষের লোক হয়ে যাবে, যা পরবর্তী আমাদের জন্য কাফেরদের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে উপকারে আসবে। আশা করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ইসলামের প্রতি পথ দেখাবেন। আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ইবনুল খাত্তাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, হে ওমর! তোমার মতামত কি? ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলল, না আমি আবু বকর যে মতামত দিয়েছে তার সাথে মোটেও একমত নই। তবে আমার কথা হল, আপনি আমাদের সুযোগ দেবেন আমরা তাদের সকলকে হত্যা করে ফেলবো। আলী রাদিআল্লাহু আনহু কে সুযোগ দেয়া হবে, সে চাচাতো ভাই আকীলকে হত্যা করবে। আমাকে আমার বংশের লোক অমুকের বিষয়ে সুযোগ দেবেন আমি তাকে হত্যা করব। কারণ, এরা সবাই হল কুফরের লিডার ও ইমাম। এদের হত্যার কোন বিকল্প হতে পারে না। তাদের উভয়ের মতামত শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু এর মতামতকে প্রাধান্য দেন। ওমর রাদিআল্লাহু আনহু এর কথার প্রতি তেমন কোন গুরুত্ব দেননি”।
এ হল, আমাদের নবী যিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তিনি প্রথমে আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু এর কথার প্রতি আকৃষ্ট হন। কারণ, তিনি বাহ্যিকভাবে দেখতে পেলেন যে এ মতের মধ্যে রয়েছে ইসলামের কল্যাণ এবং এটি হল প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি। কারণ, সে যে চিন্তা করেছিল তা ছিল ইলমের উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। অথচ কুরআন নাযিল হয়েছে, ওমর রাদিআল্লাহু আনহু এর মতের উপর ভিত্তি করে।

পরিশিষ্ট
মনে রাখতে হবে নফসের বিরোধিতা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, আত্মার জন্য তা অতি কষ্টদায়ক এবং শরীরের উপর অনেক চাপ। কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভালো এবং ফলাফল খুবই মধুর। নফসের বিরোধিতা করার ফলাফল লাভ হতে একমাত্র তারাই বঞ্চিত হয়, যাদের সাহস দুর্বল ও মানসিকতা কুলসিত। আবুল আতাহিয়া রহ. বলেন,
أَشَدُّ الجِهَادِ جِهَادُ الهَوَى
وَمَا كَّرمَ المَرْءَ إِلَّا التُّقَى
“সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হল নফসের সাথে যুদ্ধ করা। আর তাকওয়া ছাড়া একজন মানুষকে আর কিছুই সম্মান দিতে পারে না”।
অপর একজন কবি বলেন,
صَبَرْتُ علَىَ الأيَامِ حَتَّى تَوَلَّتِ
وَأَلْزَمْتُ نَفْسِي صَبْرَهَا فَاسْتَمَرَّتِ
وََما النفّْسُ إلَا حَيْثُ يجْعَلُهَا الفَتَى
فَإِنْ أُطْمِعَتْ تَاقَتْ وَإِلَّا تَسَلَّتِ

“আমি যুগের মুসিবতের উপর ধৈর্যধারণ করি, ফলে তা আমাকে পৃষ্ট পদর্শন করে। আর আমি আমার আত্মার উপর ধৈর্য ধারণ করাকে চাপিয়ে দেই, ফলে তার কখনো বিচ্যুতি ঘটেনি। আর হে যুবক তুমি মনে রাখবে, নফসের বৈশিষ্ট্য হল, তুমি তাকে যেখানে লাগাবে সে সেখানেই ব্যবহৃত হবে। যখন তুমি তাকে প্রলোভন বা যোগান দিবে তখন সে শক্তিশালী হবে, অন্যথায় সে নিস্তেজ হয়ে থাকবে”।
প্রবৃত্তির অনুসরণ না করার বড় আলামত হল, দুনিয়ার জীবনের চাকচিক্য ও সৌন্দর্য হতে বিরত থাকা। মালেক ইব্ন দীনার রহ. বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও ধোঁকা হতে দূরে থাকতে পারবে প্রকৃত পক্ষে সেই তার নফসের উপর বড় বিজয়ী বলে বিবেচিত হবে।
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শুধু মূর্খ-জাহেল বা বাচ্চাদের বৈশিষ্ট্য নয় যা তাদের পথহারা করে বরং প্রবৃত্তির অনুসরণ সব ধরনের মানুষের বৈশিষ্ট্য। এমনকি আলেম-ওলামা, জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক সব ধরনের লোকের অন্তরে প্রবৃত্তি বা খারাপ আত্মা বিদ্যমান থাকে। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, আবাল-বৃদ্ধা কেউ নফস বা প্রবৃত্তির চাহিদা হতে নিরাপদ নয়।
কোন এক জ্ঞানী বলেছিল, একজন অভিজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী সেও অপরের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য যাতে সে তার মতামতকে তার নফসের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পারে।
সুতরাং, কেউ এ কথা বলতে পারবে না যে, প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে যে নিষেধ করা হয়েছে, আমি তার আওতার বাহিরে। কারণ, আমিতো প্রবৃত্তির অনুসরণ করি না। মনসুর আল-ফকীহ রহ. বলেন,
إنَِّ المَرَائِيَ لَا تُرِيكَ خُدُوشَ وَجْهِكَ فِي صَدَاهَا
وَكَذَاكَ نَفْسُكَ لَا تُرِيكَ عُيُوبَ نَفْسِكَ فِي هَوَاهَا
তোমার চেহারায় যে সব দাগ রয়েছে তা তুমি প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। [বরং তোমার চেহারার দাগগুলো অপরের চোখে প্রদর্শিত হবে।] অনুরূপভাবে তুমি তোমার নফসের দোষ-ত্রুটিগুলো কখনোই দেখতে পারবে না। [অপরের নিকট তা অবশ্যই ধরা পড়বে।]
অনেক সময় দেখা যায় আমরা যাদের সবচেয়ে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও দ্বীনদার বলে বিবেচনা করি সেও তার নফসের ধোঁকায় পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে বিরত থাকতে পারে না।
আমরা আল্লাহ রাব্বূল আলামীনের দরবারে কামনা করি আল্লাহ রাব্বূল আলামীন যেন আমাদের প্রবৃত্তির অনুসরণের উপকরণ থেকে রক্ষা করে, আর আমাদের থেকে গোমরাহিকে দূর করে এবং আমাদের যেন তিনি ভালো ও সৎ কাজ করার তাওফিক দান করে।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد، وعلى آله وصحبه أجمعين.
—      মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জেদ


অনুশীলনী
তোমার সামনে দুই ধরনের প্রশ্ন পেশ করা হল, এক ধরনের প্রশ্ন যে গুলোর উত্তর তুমি সাথে সাথে দিতে পারবে। আর এক ধরনের প্রশ্নের উত্তর তুমি সাথে সাথে দিতে পারবে না, বরং তোমাকে একটু চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে হবে।
প্রথম প্রকার প্রশ্ন:                  
১. প্রবৃত্তির আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা কর। 
২ প্রবৃত্তির অনুসরণের কতগুলো কারণ আছে সেগুলো কি তা বর্ণনা কর। 
৩. প্রবৃত্তির অনুসরণে অনেক ক্ষতি ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে সেগুলো কি তা আলোচনা কর। 
৪. প্রবৃত্তির অনুসরণ এর চিকিৎসা কি?
দ্বিতীয় প্রকার প্রশ্ন:
১- প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণে কখন মানুষকে শাস্তি দেয়া হয়?
২- নফসের বিরোধিতা করার অনেকগুলো ফায়দা আছে সেগুলো কি তা তোমার সাধ্য অনুযায়ী আলোচনা কর!
৩- কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে সাতজন ব্যক্তি তার আরশের তলে ছায়া দেবেন তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটি কারণ পাওয়া যায় তার ব্যাখ্যা কি তা আলোচনা কর।
৪- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لا يؤمن أحدكم حتى يكون هواه تبعا لما  جئت به »
[অর্থ, তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসারী না হয়]
এ হাদিস দ্ধারা তুমি কি বুঝলে তা আলোচনা কর।
৫- নফসের বিরোধিতা করা সবচেয়ে বড় আলামত কোনটি? তা আলোচনা কর।


সূচীপত্র
ভূমিকা
প্রবৃত্তির সংজ্ঞা
প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে নিষেধ করা
কখন মানবজাতিকে তার প্রবৃত্তির কারণে শাস্তি দেয়া হয়?
প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণসমূহ
প্রবৃত্তির অনুসরণ করার ক্ষতিসমূহ
নফস বা প্রবৃত্তির বিরোধিতা করার উপকারিতা
প্রবৃত্তির চিকিৎসা
কোনটি প্রশংসনীয় প্রবৃত্তি এবং কোনটি নিন্দনীয় প্রবৃত্তি?
পরিশিষ্ট
অনুশীলনী
সূচীপত্র


[1] হুলিয়্যাতুল আওলিয়াহ ২৩১/৩
[2] আল-মাগরিব
[3] আল্লামা জুরযানীর তারিফাত:৩২০।
[4] রাওজাতুল মুহিব্বি-ন: ৪৬৯।
[5] ইবনে মাযাহ: ৪২৬০ হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[6] মুসলিম: ১৪৪
[7] মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া ৬৩৫/১০
[8] মুসলিম [২৬৫৭]
[9] বুখারি: ১৯৬০, মুসলিম: ১১৩৬।
[10] আব্দুলা আহমদের আস-সুন্নাহ: ৯১ 
_________________________________________________________________________________


মুহাম্মাদ সালেহ্ আল-মুনাজ্জিদ 
অনুবাদ : জাকের উল্লাহ্ আবুল খায়ের 
সম্পাদনা : মো: আবদুল কাদের
 সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন