মন পরিষ্কার থাকলে হিজাবের কি দরকার ?
আমি হিজাবের প্রয়োজনীয়তা বুঝি এবং আমি কিছুদিন ধরে হিজাব করছিও, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটা মেনে চলা একটি ভুল। হিজাব আমাকে একজন ভালো মুসলিমাহ হতে সাহায্য করছে, আমি এটা অনুভব করি না। আর আমার মনে হয় যে, আমি যেন লোকদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি ; কারণ আমি দেখি তারা আমাকে একজন উদাহরণ হিসেবে দেখছে অথচ আমি নিজেই কিনা নানা বিষয়াদি নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছি । উপরন্তু, আমি যদি এটা খুলে ফেলি আর হিজাব করা ছেড়ে দেই তাহলে সত্যিই কি আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিবেন? এটা আমার কাছে তুচ্ছ একটা বিষয় মনে হয়, মন যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে কি সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়?
আস-সালামু আলাইকুম হে বোন,
প্রথমেই তোমাকে এই প্রশ্নটি করার জন্যে ধন্যবাদ জানাই, অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার দুয়ার খুলে দিয়েছো তুমি, এবং আমাদেরকে বিশ্বাস করে যেভাবে মনের কষ্টগুলো, নিজের সংকোচ-সংগ্রামের জমানো কথাগুলো খুলে বলেছ তার জন্যেও আল্লাহ তোমার ভালো করুন। আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিকট প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাকে তওফীক দেন তোমার প্রতি আন্তরিকতাপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল কিছু লিখতে পারি, যা তোমার সর্বোত্তম পাথেয় হতে পারে।
শুরুতেই আমি একটা কথা বলে নিতে চাই, এই সমীকরণের সবচেয়ে অ-গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হচ্ছে “আমি কি মনে করি” এবং তার সাথে সাথে “অন্যেরা কি মনে করে”! এমন ঘটনা কখনও হওয়া উচিত নয়, যখন অন্য লোকদের দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের ইসলামী লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন ঘটাবো, কে কি মনে করল কিংবা ধারণা করলো তাতে কি আসে যায়? মানুষ খুব সহজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পছন্দ করে। যদি কেউ কিছু ধারণা-অনুমান করে থাকে, এটা তো যে এরকম চিন্তা-অনুমান করেছে তার নিজের দেখার বিষয় ! আমি কেন এটা নিয়ে এত বেশি ভাববো?
বোন, তুমি আরো বলেছো, তুমি নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়ছো, কারণ তোমার মনে হচ্ছে হিজাব পরিধান করে তুমি অন্যদের ধোঁকা দিচ্ছ, কারণ লোকেরা তোমার সম্পর্কে তুমি যতটা ভালো তার চেয়েও বেশি ভালো ধারণা করে। দেখো, সত্য কথা হচ্ছে আমরা সবাই পাপী, এবং তুমি নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর সেই গুণবাচক নামটি জানো যে, তিনি হচ্ছেন ‘আস-সিত্তার’ যিনি আমাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ গোপন করে রাখেন এবং আমাদেরকে অন্যদের চোখে ভালো হিসেবে দেখান, এটাকে মহান আল্লাহর করুণা ও দয়া ছাড়া কি বলবে? একজন বিখ্যাত মনীষীর কথা মনে পড়লো, “যদি পাপের কোন ঘ্রাণ থাকতো তবে কেউ আমার কাছে ঘেঁষতো না”।
আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে, সবাই আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে কিছু না কিছু ভুল করে ফেলেছি, ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিংবা অনেকে এখনো ভুল করেই চলছি। আমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলায় আমাদের করে যাওয়া উচিত, যেকোন ভালো কাজ করাটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি একটি বিরাট অনুগ্রহ, আর আমাদের এই অনুগ্রহের পূর্ণ সুযোগ নেয়া উচিত নয় কি?
‘আমি অতো ভালো না’ এটা মনে না করে আমাদের এটা মনে করা উচিত যে, এটাই হচ্ছে সুযোগ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার এবং নিজেদের দোষত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখার,
“হে আল্লাহ ! আমার সম্পর্কে তারা যা জানে না তা ক্ষমা করে দাও, এবং তারা যে ভালো ধারণা পোষণ করছে তাকে আরো উত্তমরূপে বর্ধিত করো” [১]
“হে আল্লাহ ! আমার সম্পর্কে তারা যা জানে না তা ক্ষমা করে দাও, এবং তারা যে ভালো ধারণা পোষণ করছে তাকে আরো উত্তমরূপে বর্ধিত করো” [১]
‘এই লোকটাকে দিয়েই ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করানো যায়’, এমন কাউকে খুঁজে পেতে তোমার যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে, কারণ প্রত্যেকের ঈমান কিংবা আমলের ( দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম চর্চা) মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে সে অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছে, তার সীমাবদ্ধতার কারণে। তার মানে এই নয় যে, আমরা অন্যদেরকে ভালো কাজ করতে দেখলে তাকে তার সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে খোঁটা দিব, কিংবা ছোট করব ! আমাদের বরং তাকে উৎসাহিত করা উচিত এজন্য যে, সে তার সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে দমে যায় নি। ‘যতটা ভালো সে নয়, তার চেয়েও বেশি ভালো দেখায়’ নিন্দুকের এমন কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে তার যতটুকু ক্ষমতা আছে সে অনুসারে ভালো কাজ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে ! এটা কি প্রশংসনীয় নয়? এই বিষয়ে খুব চমৎকার একটি হাদীস আছে যা তোমার সাথে শেয়ার না করে পারছি না,
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চাইলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি অন্যদের ভালো কাজের দিকে আহবান করা হতে বিরত হব যদি আমরা নিজেরা সব ভালো কাজ করতে না পারি, এবং আমরা কি ততক্ষণ পর্যন্ত লোকদেরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার আদেশ করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা তা ত্যাগ করতে পারি? ‘না’, তিনি উত্তর করলেন, ‘তোমরা লোকদেরকে ভালোর দিকে আহবান করতে থাকো যদিও তোমরা সকল ভালো কাজ করছো না এবং তোমরা মন্দ কাজের নিষেধ করতে থাকো যদিও তোমরা সকল মন্দ কাজ ত্যাগ করতে পারছো না” (আল-তাবারানি)
বোন আমার, তুমি কি জানো, আমরা সবাই একটা সাধারণ ভুল করি ; কেউ হিজাব মেনে চলছে তার মানে এই নয় যে, ‘আমি হলাম ইসলাম, আমাকে দেখো !’ বরং ‘আমি একজন মুসলিম , আত্মসমর্পণকারী’-মানে হচ্ছে আমি একজন সাধারণ মানুষ যে কিনা এই লাইফ স্টাইল মেনে চলার চেষ্টা করছে, যে একে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। ইসলাম সত্যের ধর্ম, আর সত্য সুন্দর; আমি সেই যে কিনা এই সত্যের সৌন্দর্য্যে নিজেকে সাজাচ্ছি।
ইসলাম মেনে চলা আদতে একটি লাইফ স্টাইল অনুসরণ করারই নামান্তর, কেননা ইসলাম হচ্ছে দীন, অর্থাৎ একটি জীবন বিধান, রোজনামচা, জীবনাচারণ ! কোন আচার সর্বস্ব মৌসুমী ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নাম ইসলাম নয়। ভাই ইউসুফ ইসলাম (প্রাক্তন ক্যাট স্টিভেনস) এর একটা কথা আমার খুব ভালো লাগে, ‘Islam is not a state of being but it is a process of becoming’- দিনশেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গিয়ে আমরা থেমে যাব, ইসলামের যাত্রা এরকম নয়। আমাদেরকে আরো ভালো হতে হবে, আর এই ভালো হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত। লড়াই জয়ের সহজ সূত্র হল, ‘শত্রুর দিকে না তাকিয়ে নিজের শেষ ক্ষমতা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও’ কারণ যে আগে হাল ছেড়ে দেয় সেই হয় বিজিত।
“মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদত করতে থাকো” [আল হিজর ৯৯]
“মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদত করতে থাকো” [আল হিজর ৯৯]
সেই গল্পটা পড়েছো তুমি? যখন গ্রামের বড় বড় কুস্তিগীরেরা এসে অবাক হয়ে দুর্বল লোকটির কাছে জানতে চাইল ‘কিভাবে তুমিই সব সময় বিজয়ী হও?’
-দাঁড়াও বলছি, আমার মুখে তোমার আঙ্গুল দাও, আর আমিও তোমার মুখে আমার আঙ্গুল দিব, এরপর দুজনেই কামড়ে ধরব, মাড়ির দাঁত দিয়ে। ঠিক আছে? কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দুজনেই প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরে উঠছে কিন্তু কেউই অন্যের মুখ থেকে আঙ্গুল বের করছে না।
এভাবে অনেকক্ষণ কেটে গেল। প্রশ্নকারী লোকটি এই একঘেঁয়ে যন্ত্রণাদায়ক লড়াইয়ে আর টিকতে না পেরে একসময় নিজের আঙ্গুল বের করে নিল। তখন দুর্বল লোকটি বলল,
-এখন বল তোমার কি মনে হয় কেন আমি জয়ী হই?
ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে অপর লোকটি মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে বলল,
-কারণ তুমি কখনো হাল ছেড়ে দাও না। আর তুমি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকো।
হ্যাঁ বোন, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়াই তো জয়। আসলে জয় কিসের হয় জানো? লিগ্যাসি বা নীতির; আদর্শের। কেউই চিরদিন টিকে থাকে না, সবাইকেই চলে যেতে হয় কিন্তু যা রেখে যায় তা হল লিগ্যাসি মানুষ বাঁচে তার কর্ম এবং নীতির মাধ্যমে,বয়সের মাধ্যমে নয়।
বোন, তুমি আরো লিখেছো, ‘হিজাব আমাকে একজন ভালো মুসলিমাহ হতে সাহায্য করছে, আমি এটা অনুভব করি না।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যখন আমরা কোন ভালো কাজ শুরু করি আমরা নিজেদের মধ্যে একটা প্রবল জোর বা তাড়না অনুভব করি , এটাকে আমি বলি ‘ঈমানের জোর’ বা ‘বিশ্বাসের শক্তি’। এর ফলে আমরা এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করি যখন প্রথমবারের মতো নতুন কোন ভালো কাজে হাত দেই, কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই প্রথমবারের ভালো কাজটি হয়ে যেতে পারে দৈনন্দিন একটি সাধারণ কাজ ! তখন সেই কাজের প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ কত চমৎকার আমাদের প্রতিপালক, আর কি চমৎকার তার পুরষ্কার! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এজন্যেই বলেছেন,
“যে কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়, তা পরিমাণে অল্প হলেও আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়”[২]
“যে কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়, তা পরিমাণে অল্প হলেও আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়”[২]
কাজেই বিজয়ী মনোভাবের দাবী হল; সেই প্রথমবারের মতো আবেগ, অনুপ্রেরণার দিকে লক্ষ্য না করে বরং শান্ত-সুস্থির, ধারাবাহিকতার সাথে ভালো কাজ করে যাওয়া এবং নিজের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে নেয়া। সুনির্দিষ্ট কোন কাজের উপর নির্ভর করেই আমরা বলতে পারি না, ‘এটা আমাকে একজন ভালো মুসলিম হতে সাহায্য করছে’। বরং, আমাদেরকে ধারাবাহিক আমলের দিকে নজর দিতে হবে যার দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়, যেমন- আল্লাহর বই কুর’আন থেকে তাঁর কথা বেশি বেশি করে তিলাওয়াত করা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে সালাহ আদায় করা, যিকর বা আল্লাহর স্মরণ ইত্যাদি। হ্যাঁ, হিজাব মেনে চলাও নিশ্চয়ই সেই ভালো কাজগুলোর মধ্যে একটি, কিন্তু এটি কেবল একটি অংশ বিশেষ যেমন হয়ে থাকে বড় দালানের একটি ইট। সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার হয় নিয়মিত শরীর চর্চা, কিন্তু শুধুমাত্র শরীর চর্চা করেই কেউ সুস্বাস্থ্য লাভ করতে পারে না, তাকে একটি নিয়মিত সুষম খাদ্যাভ্যাসও গড়ে তুলতে হয় এবং আরো অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়, আর এভাবেই সে একদিন লাভ করে তার কাংক্ষিত ফলাফল।
আর জানো কি, একজন ব্যক্তির কাজকর্মের দ্বারা তার মানসিকতা প্রভাবিত হয়। মানুষের বাহ্যিক আচরণের সাথে তার অন্তরের অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, আমরা জানি যখন কেউ তার ঈমানের দিক থেকে অনেক উঁচু অবস্থায় থাকে যখন তার বিশ্বাস অনেক দৃঢ় থাকে, তখন তার জন্যে বেশি থেকে বেশি ভালো কাজ করা খুব সহজ।
পক্ষান্তরে, এর বিপরীত অবস্থাও হতে পারে ! এটাও সত্য, শুধু ভালো কাজ করছি কিন্তু ‘অনুভব করছি না’, এটাও আমাদের বিপরীতমুখী বিক্রিয়ার মত আক্রান্ত করতে পারে এবং আমাদের বদলে দিতে পারে ! আমাদের কাজ যদি হয় কোমল তবে তা কঠিন অন্তরকেও বিগলিত করে, আলোকিত করে এবং মনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আগ্রহ জন্মে।
আমাকে একজন ইমাম উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দ্রুত ভালো কাজের দিকে মনোযোগ দাও, বেশি করে ভালো কাজ করতে থাকো’ কখন এ কথা বলেছিলেন জানো? যখন আমার এটা মনে হচ্ছিলো, আমি কনফিউসড , যখন ঈমানের স্তর অনেক নিচু-দুর্বল ছিলো, খুব মন খারাপ হচ্ছিল আমার। ‘দ্রুত ভালো কাজের দিকে মনোযোগ দাও, বেশি করে ভালো কাজ করতে থাকো’, আমি এ উপদেশটা বেশ ভালোভাবে মেনে চলার চেষ্টা করতে লাগলাম, কারণ ভালো কাজের ফলেই নিজের ভেতরে সেই জাগরণ তৈরি হয় যার সন্ধানে আমি ব্যাকুল ছিলাম। দেখোনা, যখন কাউকে কিছু উপহার দেই, কিংবা বন্ধুদের সাথে কোন মজার ঘটনা শেয়ার করি, তখন সবার আগে যার মনে এসে ভালো লাগা ভিড় করে সে তো আমি নিজেই !
‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ভালবাসা দেবেন’। [৩]
তখন আমি আমার সেই ইমামের উপদেশের মর্মার্থ বুঝতে পারলাম, ‘বেশি করে ভালো কাজ করতে থাকো’। যদি ভালো কাজ করার পরেও নিজের ভিতরে কোন পরিবর্তন না দেখি তবুও তা চালিয়ে যেতে যেতে আমি আবিস্কার করলাম, ঠিকই একসময় সেই ভরবেগ এসে আমাকে নাড়া দিল যার অভাবে আমি স্থবির আটকে ছিলাম !
‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ভালবাসা দেবেন’। [৩]
তখন আমি আমার সেই ইমামের উপদেশের মর্মার্থ বুঝতে পারলাম, ‘বেশি করে ভালো কাজ করতে থাকো’। যদি ভালো কাজ করার পরেও নিজের ভিতরে কোন পরিবর্তন না দেখি তবুও তা চালিয়ে যেতে যেতে আমি আবিস্কার করলাম, ঠিকই একসময় সেই ভরবেগ এসে আমাকে নাড়া দিল যার অভাবে আমি স্থবির আটকে ছিলাম !
তৃতীয়ত, বোন, তুমি একদম ঠিক বলেছো, ‘মন যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে কি সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয় ?’
অন্তরের সুস্থতা অর্জন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুর’আনে সেই ভয়াবহ বিচারের দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন ‘যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না; কিন্তু যে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ প্রশ্ন হচ্ছে সেই ‘পরিষ্কার মন কিভাবে তা অর্জন করা যাবে’? কখনো কি ভেবে দেখেছি, কিসে আমাদের মনকে পরিষ্কার করে, আর কিসে কলুষিত করে ?
বর্তমান সময়ে অনেকেই মনে করেন, আমরা একটি ‘আলোকিত যুগ’এ বাস করছি যখন আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য দর্শন এবং চিন্তাধারাই পর্যাপ্ত, ধর্মীয় সীমারেখায় নিজেকে আবদ্ধ করার কোন দরকার নেই, দরকার নেই কোন আচার অনুষ্ঠান পালনের । কিন্তু যারা এ ধরণের মতবাদ বিশ্বাস করে নিচ্ছেন তারা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের নিছক ‘mind and soul’ দিয়েই সম্পূর্ণ করেননি, বরং শারীরিক কাঠামোর ভিতরে সেই ‘mind and soul’ কে আটকে দিয়েছেন। মনের পাখি বন্দী আছে দেহের খাঁচায়।
আমরা এই সত্য অস্বীকার করতে পারি না, আমরা হচ্ছি ‘body and soul’ উভয়েই আছে একত্রে এবং অবিচ্ছেদ্যভাবে, এবং মন ও শরীর প্রত্যেকেরই আছে বিশুদ্ধতা অর্জনের নিজস্ব চাহিদা ও পদ্ধতি। এটা আল্লাহর সুন্নাহ যে তিনি আমাদেরকে এভাবেই সৃষ্টি করে থাকেন এবং এ কারণেই সালাহ, সিয়াম এবং অন্যান্য স্পিরিচুয়াল তথা আধ্যাত্মিক ইবাদতে একাগ্রতা ও সমন্বয় সাধনের জন্য শরীর ও মন উভয়েরই রয়েছে পৃথক পৃথক বিশেষ ভূমিকা। কাজেই বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ বা ‘পরিষ্কার মন’ অর্জনের জন্য শরীর ও মন উভয়েরই উন্নতি সাধন আবশ্যক।
অন্তরের বিশুদ্ধতা অর্জন করা হচ্ছে লক্ষ্য, কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে রয়েছে খুবই বাস্তবিক এবং সুনির্দৃষ্ট কিছু পদ্ধতি যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদের ‘দীন’ বা লাইফ স্টাইলের অনুসরণ এবং আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তর পরিষ্কার ও পরিশোধিত হয়। আর এ কারণেই, আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, ‘হিজাব’ কোন তুচ্ছ বিষয় নয়। যেকোন কিছু যা আমাদেরকে আত্মিক সচেতনতা, উন্নয়ন ও সংশোধনের দিকে নিয়ে যায় – আর এভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে ; তা কখনোই ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ হতে পারে না। সত্য হচ্ছে, এ রকম ঘটার সম্ভাবনা খুবই বেশি যে আমরা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখনো বুঝে উঠতে পারছি না কিংবা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে যথাযথ স্থানে স্থাপন করছি না বলে এর সুগভীর উদ্দেশ্য ও অর্থ ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না।
আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কেঃ এই প্রেক্ষাপটে দৃষ্টিপাতের পূর্বশর্ত হল , আমরা প্রতিনিয়ত যে পাপ করছি তাকে ছোট বা তুচ্ছজ্ঞান করার চেয়ে কার বিরুদ্ধে এই পাপকার্য সংঘটিত হচ্ছে তাকে, সেই সুমহান সত্তাকে বড় করে দেখা এবং তাঁর মর্যাদার দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধায় বিনয়াবনত হওয়া। তাঁর অসীম জ্ঞান, যা আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুকে ঘিরে আছে, তা দিয়ে তিনি আমাদের জন্যে সেই সকল কাজগুলো নির্ধারিত করেছেন যা আমাদের কল্যাণ দান করে এবং অকল্যাণ থেকে দূরে রাখে।
কুর’আনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
‘তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।’[৪]
‘তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ [৫]
‘তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।’[৪]
‘তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ [৫]
যখন কোন রোগীকে ডাক্তার সুস্থতার জন্যে প্রেসক্রিপশন দান করেন এবং রোগী তা জেনেশুনে অবজ্ঞা অবহেলা করে তখন তার শারীরিক অসুস্থতা এবং অবনতির জন্য সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারে না। আর এভাবে, আল্লাহ যখন আমাদের আত্মিক উন্নতির পথ বাতলে দিয়েছেন তখন সেই পথ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সরে আসা একটি অপরাধ, এবং যখন তা সবকিছু জেনে বুঝে করা হয় তখন তা আরো গুরুতরো একটি পাপ। এরপরেও আমাদের আশা হারালে চলবে না, বরং আশা এবং ভয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে আল্লাহর দয়া ও করুণা কামনা করে যেতে হবে, তিনিই ক্ষমাশীল এবং পাপ মার্জনাকারী ।
বোন আমার, বিদায় নেয়ার আগে তোমাকে একটি অসাধারণ হাদীসে কুদসী উল্লেখ করছি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
‘আমার বান্দাদের প্রতি আমি যা কিছু অর্পণ করেছি তার বাইরে কোন কিছু পালন করে তারা আমার অধিক নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করে না’ [বুখারি]
‘আমার বান্দাদের প্রতি আমি যা কিছু অর্পণ করেছি তার বাইরে কোন কিছু পালন করে তারা আমার অধিক নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করে না’ [বুখারি]
প্রিয় বোনটি আমার, আমার এ কথাটি স্মরণ রেখো, যদি তুমি এমনটা অনুভব করো যে, তুমি আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করছো না, তাহলে এর সমাধান তো এটা নয় যে, তুমি যা করছো তা ত্যাগ করবে এবং ভিন্ন কোন পথ বেছে নিবে, বরং তুমি সুস্থিরভাবে একাগ্রচিত্ত থেকো এবং পথ চলা কঠিন হলেও থেমে থেকো না। আর এটাই তোমাকে আল্লাহর নিকট অন্যদের থেকে বিশিষ্ট, সুপ্রিয় করে দেবে, যার নৈকট্য আমাদের মনে খুশির ফোয়ারা জাগায়, তাঁর যত্ন এবং ভালোবাসাই তো ঘিরে আছে আমাদের চারপাশ। তিনি যদি আমাদের না দেখেন তাহলে কে আছে এমন যে আমাদের দেখে রাখবে,আগলে রাখবে ?
আল্লাহ যেন আমাদের অন্তরসমূহকে তাঁর স্মরণে সতেজ রাখেন,আলোকিত করেন এবং তাঁর নৈকট্য লাভের সুযোগ দান করেন। আমাদেরকে তিনি যেন সেই লোকদের সাথে রাখেন যারা তাঁর ইবাদত করতে ভালোবাসেন, যেন আমরা তাঁর ভালোবাসা অর্জন করতে পারি। আমাদের দীন-জীবন ব্যবস্থার উপর অবিচল থেকে যেন আত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারি। হে আল্লাহ! আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে চালিত করো এবং কল্যাণ দান করো, আমিন ইয়া রব।
ওয়াল্লাহু আ’লাম - আল্লাহ সবথেকে ভালো জানেন,
ওয়াস-সালামু আলাইকুম।
Collected from : sister Shazia Ahmad
Translated by : সরল পথ
Translated by : সরল পথ
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
[১] কেউ প্রশংসা করলে যা বলে দোয়া করতে হয়। "হে আল্লাহ ! যা বলা হচ্ছে তার জন্যে আমাকে পাকড়াও করো না, আমাকে ক্ষমা কর, যা তারা জানেনা, [আমাকে কল্যাণ দাও, যা তারা ধারণা করছে]
[বুখারী আল আদাবুল মুফরাদ-৭৬১]
[২] ‘যে কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়, তা পরিমাণে অল্প হলেও আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়’ [বুখারী, মুসলিম]
[৩] ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদেরকে দয়াময় আল্লাহ ভালবাসা দেবেন’। [সূরা মরিয়ম ৯৬]
[৪] ‘তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।’ [সূরা বাকারাহ ২১৬]
[৫] ‘তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ [সূরা মায়িদা ১৯]
_________________________________________________________________________________
আরও পড়ুনঃ কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পর্দা
আরও পড়ুনঃ শরঈ পর্দা বলতে কী বুঝায়?
আরও পড়ুনঃ পর্দাঃ নারীর দুর্গ ও রক্ষাকারী ঢাল
আরও পড়ুনঃ পর্দা কেন?
আরও পড়ুনঃ পর্দা একটি ইবাদত
আরও পড়ুনঃ পর্দাহীনতার পরিণতি
আরও পড়ুনঃ জান্নাতী রমণী (১ম পর্ব)
আরও পড়ুনঃ জান্নাতী রমণী (২য় পর্ব)
আরও পড়ুনঃ নারীর জান্নাত যে পথে
আরও পড়ুনঃ পুরুষের মাঝে কর্মরত নারীর প্রতি আহ্বান
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন