আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে রামাদান মাসে একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে রামাদান মাসে একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
রামাদান মাস সিয়াম সাধনা
ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত
ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে
বহু ফযীলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন।
1.
রামাদান আল-কুরআনের মাসঃ আল্লাহ একে কুরআন
নাযিলের মর্যাদাপূর্ণ সময়রুপে চয়ন করেছেন। তিনি বলেন,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ
ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ﴾ [البقرة: 185]
‘‘রামাদান মাস - এতে কুরআন নাযিল হয়েছে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ:
১৮৫)
2. এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃংখলিত করে রাখা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ
أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ»
‘‘রামাদান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা
হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০০, ৩১০৩ ও সহীহ মুসলিম,
হাদীস নং২৫৪৭)
3.
এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনীঃ
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ
خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا
بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥﴾ [القدر: 3-5]
‘‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে
ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময়
এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’’ (সূরা আল-ক্বদরঃ
৩-৫)
4.
এ মাস দো‘আ কবুলের মাসঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّ لِلَّهِ عُتَقَاءَ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ
لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَة»
‘‘(রামাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে)
আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো‘আ
কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।’’ (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কতৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৭৪৫০)
ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক
মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি
হয়েছে পূণ্য অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং
প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ
অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের
উচিত চারিত্রিক অধ:পতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া
চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক
প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের
পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম
অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং
জীবেনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে।
পবিত্র রামাদান মাসে
যেসব দায়িত্ব ও কাজ শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত হয়েছে কিংবা যা পালনে শরীয়ত আমাদের
উদ্বুদ্ধ করেছে ও যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে, পবিত্র আল
কুরআন ও সহীহ্ হাদীসের আলোকে সেগুলো নিচে আমরা দু’ভাগে
আলোচনা করব।
প্রথম ভাগঃ যা
করতে শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে এবং উদ্বুদ্ধ করেছে সেগুলো নিম্নরূপ:
একঃ সিয়াম বা রোযা
রমাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
কাজই হল সিয়াম। আর সিয়াম হল ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যাতসহ
পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা।
সিয়াম পালন তথা রোযা ফরয
এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ
كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ
تَتَّقُونَ ١٨٣ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ﴾ [البقرة: 183-184]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমদের
উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের
উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার -
নির্দিষ্ট কয়েকদিন মাত্র ......।’’ (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৩-১৮৪)
﴿فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ
فَلۡيَصُمۡهُۖ﴾[البقرة: 185]
‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে
যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)
রোযার গুরুত্ব আরো
প্রকটিত হয় সে সব ফযীলতের দ্বারা, যদ্বারা একে বিশেষত্ব দান
করা হয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছেঃ
1.
রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেনঃ
একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেন,
«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ
فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ»
আল্লাহ বলেন, ‘‘বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার
কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস
নং ১৮০৫, ৫৫৮৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬০)
2.
রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا
غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে
রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০ও
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৭)
3.
রোযা জান্নাত লাভের পথঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ
يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ
يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَدْخُلُونَ مِنْهُ فَإِذَا دَخَلَ آخِرُهُمْ أُغْلِقَ
فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ»
‘‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’ - কিয়ামতের
দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে
না..... রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে
প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
২৭৬৬ )
4.
রোযাদারের জন্য রোযা শাফায়াত করবেঃ
উত্তম সনদে ইমাম আহমাদ ও হাকেম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ
بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ
فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»
‘‘রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফায়াত
করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চারিতার্থ করা থেকে
নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন.....।’’ (মুসনাদ,
হাদীস নং ৬৬২৬, আল-মুস্তাদরাক, হাদীস নং ২০৩৬)
5.
রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির
চেয়েও উত্তমঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ
فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ»
‘‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোযাদারের মুখের
গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং
১৮৯৪ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬২)
6.
রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায়ঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ
وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّه»
‘‘রোযাদারের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো
ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী,
হাদীস নং ১৮০৫ ও সহীহ মুসলিম, হদীস নং ২৭৬৩)
7.
রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢালঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ
اللَّهُ وَجْهَهُ عَنْ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا»
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ
তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বৎসরের দূরত্বে নিয়ে যান।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং
২৬৮৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬৭ )
ইমাম আহমাদ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন - রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«الصَّوْمُ جُنَّةٌ مِنْ عَذَابِ اللَّهِ كَجُنَّةِ
أَحَدِكُمْ مِنْ الْقِتَالِ»
‘‘রোযা ঢাল স্বরূপ-যদ্বারা বান্দা নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে
রক্ষা করতে পারে, যেভাবে তোমাদের কেউ একজন যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করে।’’ (মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৯০৯)
রোযার আরো ফযীলতের মধ্যে রয়েছে - এতে ইচ্ছা ও সংকল্পে
দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মাহত্ম্য অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ
করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ্ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তব নিদর্শন।
সিয়ামের সাথে সংশ্লিষ্ট
আমলসমূহ
1.
রোযার নিয়্যাতঃ
রাতেই রোযার নিয়্যাত করতে হবে। সুনান আন-নাসাঈ গ্রন্থে
বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ لَمْ يُبَيِّتِ الصِّيَامَ مِنَ اللَّيْلِ
قَبْلَ الْفَجْرفَلاَ صِيَامَ لَه»
‘‘যে ব্যক্তি ফজর উদয়ের পূর্বে, রাতেই রোযার নিয়্যাত
করেনা, তার রোযা হবে না।’’ (সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস নং ২৩৩২)
2.
দেরী করে সেহেরী খাওয়াঃ
সেহেরী খাওয়া একটি বরকতময় বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ এ
উম্মাতকে দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ
الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَر»
‘‘আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো
সেহেরী খাওয়া।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৪)
সেহেরী বরকতময় হওয়ার প্রমাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের বাণী,
«تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِى السُّحُورِ بَرَكَة»
‘‘তোমরা সেহেরী খাও, কেননা সেহেরীতে রয়েছে বরকত।’’ (সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ১৮২৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৩ )
দেরী করে সেহেরী খাওয়ার দলীল হল, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু
যায়েদ বিন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
«تَسَحَّرْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ قَامَ إِلَى الصَّلَاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ بَيْنَ الْأَذَانِ
وَالسَّحُورِ قَالَ قَدْرُ خَمْسِينَ آيَةً»
‘‘আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে
সেহেরী খেয়েছি। অত:পর তিনি নামাযে দাঁড়ালেন।’’ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন
জিজ্ঞাসা করলেন, আযান ও সেহেরীর মধ্যে কতটুকু সময়ের পার্থক্য ছিল? যায়েদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু বললেন, ‘‘পঞ্চাশটি আয়াত পরিমাণ।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২১ ও সহীহ মুসলিম,
হাদীস নং ২৬০৬ )
3.
তাড়াতাড়ি ইফতার করাঃ
সূর্য অস্ত যাওয়া নিশ্চিত হলে তাড়াতাড়ি ইফতার করা
রোযাদারের জন্য মুস্তাহাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا
الْفِطْرَ»
‘‘মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের উপর থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত
তারা অনতিবিলম্বে ইফতার করবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৬ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস
নং ২৬০৮)
4.
কি দিয়ে ইফতার করবেঃ
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّم يُفْطِرُ عَلَى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّىَ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ
فَعَلَى تَمَرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ»
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘রুতাব’ (শুকনা নয়
এমন) খেজুর দিয়ে নামাযের আগে ইফতার করতেন, রুতাব পাওয়া না গেলে শুকনা খেজুর দিয়ে
ইফতার করতেন। তাও পাওয়া না গেলে তিনি কয়েক ঢোক পানি পানে ইফতার করতেন।’’ (উত্তম
সনদে ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ১২৬৭৬ ও আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫৬)
5.
রোযাদারকে ইফতার করানোঃ
সহীহ সনদে তিরমিযী ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ
إِلَّا أَنَّهُ لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْء»
‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত
রোযাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’’ (সুনান
তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭ ও মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৭০৩৩)
দুই: কিয়ামুল লাইল
তারাবীহ, তাহজ্জুদ
এবং রাতের যে কোন নফল নামায এর অন্তর্ভূক্ত। যে সকল আমলের মাধ্যমে মু’মিন ব্যক্তি রামাদান মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে, তন্মধ্যে কিয়ামুল লাইল সবচেয়ে উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন,
«أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ
الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ»
‘‘ফরয নামাযের পর
সর্বোত্তম নামায হচ্ছে রাতের নামায”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ২৮১২)
রাতের নামাযের প্রশংসায়
আল্লাহ বলেন,
﴿وَعِبَادُ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلَّذِينَ يَمۡشُونَ عَلَى
ٱلۡأَرۡضِ هَوۡنٗا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ
ٱلۡجَٰهِلُونَ قَالُواْ سَلَٰمٗا ٦٣ وَٱلَّذِينَ يَبِيتُونَ
لِرَبِّهِمۡ سُجَّدٗا وَقِيَٰمٗا ٦٤﴾ [الفرقان: 63-64]
‘‘রহমানের বান্দাহ তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খ ব্যক্তিরা যখন
তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ এবং যারা রাত্রিযাপন করে তাদের পানলকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত
হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে’’। (সূরা আল-ফুরকান: ৬৩-৬৪)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧
وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨﴾ [الذاريات: 17-18]
‘‘রাতের কিয়দংশে তারা
নিদ্রা যেত এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।’’ (সূরা
আয-যারিয়াত: ১৭-১৮)
মূলত: কিয়ামুল লাইল ছিল
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীদের নিয়মিত আমল। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু
আনহা বলেন,
«لَا تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ
فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَدَعُهُ وَكَانَ
إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا»
‘‘কিয়ামুল লাইল ত্যাগ করো
না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ত্যাগ করতেন না। অসুস্থ হলে
কিংবা অলসতা বোধ করলে তিনি বসে নামায পড়তেন।’’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২৬১১৪ ও সুনান আবি দাঊদ, হাদীস নং
১৩০৭)। রামাদানে কিয়ামুল লাইলের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا
غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
‘‘যে ব্যক্তি রামাদান মাসে
ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় (রাতের নামাযে) দাঁড়ায় তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ
করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস
নং ১৯০৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৫)
সুনানের গ্রন্থসমূহে
সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন,
«مَنْ قَامَ مَعَ الْإِمَامِ
حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَة»
‘‘যে ব্যক্তি ইমাম নামায
থেকে বিরত হওয়া পর্যন্ত ইমামের সাথে (কিয়ামুল লাইলে) দাঁড়াবে, তাহলে
তার এ আমল রাত্রিভর কিয়ামের সমতুল্য হিসাবে লিখা হবে।’’ (সুনান
আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৬ ও সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস
নং ১৬০৫)
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে
জিজ্ঞাসা করা হলো, রামাদানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের নামায কেমন ছিলো? তিনি বললেন,
مَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ
فِي رَمَضَانَ وَلَا فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
“রামাদানে এবং রামাদান
ব্যতীত অন্য সময়ে এগার রাকআতের বেশী তিনি পড়তেন না।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৯৬ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
১৭৫৭)
তিনঃ
কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা
রামাদান মাস কুরআন
নাযিলের মাস। এ মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীলের সাথে কুরআন
পাঠ করতেন। তার সীরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ
মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা, বুঝা এবং আমল করা। ইবনু
আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«كَانَ جِبْرِيلُ يَلْقَاهُ
فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ»
“জিবরীল রামাদানের প্রতি
রাতে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাকে
নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৪৮)
যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ
করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, তার ব্যাপারে আল্লাহ এ নিশ্চয়তা
দিয়েছেন যে, সে দুনিয়ায় ভ্রষ্ট হবে না এবং আখিরাতে দুর্ভাগা
- হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আল্লাহ বলেন,
﴿فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَنِ
ٱتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشۡقَىٰ ١٢٣ ﴾ [طه: 123]
‘‘সুতরাং যে আমার দেয়া হিদায়াতের পথ অনুসরণ করবে, সে
পথভ্রষ্ট হবে না এবং দু:খ কষ্টে পতিত হবে না।’’ (সূরা ত্বা-হা:
১২৩)
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু
রামাদানে প্রতিদিন একবার কুরআন খতম করতেন। সালাফে সালেহীন নামাযে ও নামাযের বাইরে
কুরআন খতম করতেন। রামাদানের কিয়ামুল লাইলে তাদের কেউ তিনদিনে, কেউ
সাতদিনে এবং কেউ দশদিনে কুরআন খতম করতেন। ইমাম যুহরী রামাদান এলেই হাদীস পাঠ ও ইলমের
মজলিস ত্যাগ করে কুরআন পাঠে লেগে যেতেন।
খেয়াল রাখতে হবে যে, কুরআন কারীম শুধু খতম করার জন্যই নাযিল হয়নি। তাই কোনরূপ অর্থ না
বুঝে, চিন্তাভাবনা না করে অন্তরে আল্লাহ ভীতি ও বিনম্রভাব
সৃষ্টি না করে কবিতার মত কুরআন আবৃত্তি করে যাওয়া আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া ঠিক নয়।
কেননা আল্লাহ নিজেই বলেন,
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ
لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩﴾ [ص: 29]
‘‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে
মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।’’ (সূরা সোয়াদ: ২৯)
চারঃ আল্লাহর রাস্তায় বেশী বেশী দান ও সদকা করা
আল্লাহর রাস্তায়
দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থবান ব্যক্তিবর্গ
এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রামাদান মাসে
এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা ইমাম বুখারী ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে
বর্ণনা করেন যে,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ
فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ ....... فَلَرَسُولُ
اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ
مِنْ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ»
“রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রামাদান মাসে যখন
জিবরীল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন.....।
জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩০৪৮)
রামাদান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের দানশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ মূলত তিনটিঃ
1. রামাদান মাসে দান-সদকাসহ
সকল উত্তম আমলের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
2. রামাদান মাসে তিনি
খুববেশী কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আর কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের প্রতি
উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
﴿مَّن ذَا ٱلَّذِي
يُقۡرِضُ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗا فَيُضَٰعِفَهُۥ لَهُۥٓ
أَضۡعَافٗا كَثِيرَةٗۚ ﴾ [البقرة: 245]
‘‘কে সে, যে আল্লাহকে করযে হাসানা প্রদান করবে? অত:পর
তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন।’’ (সূরা আল-বাকারাহ : ২৪৫)
﴿مَّثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ
أَمۡوَٰلَهُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ
فِي كُلِّ سُنۢبُلَةٖ مِّاْئَةُ حَبَّةٖۗ
وَٱللَّهُ يُضَٰعِفُ لِمَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٢٦١﴾ [البقرة: 261]
“যারা নিজেদের ধনসম্পদ আল্লাহর
পথে ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি শস্যবীজ, যা
সাতটি শীস উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা । আর আল্লাহ
যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন।আর আল্লাহ দানশীল সর্বজ্ঞ।’’ (সূরা
আল-বাকারাহ: ২৬১)
﴿هَٰٓأَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ تُدۡعَوۡنَ لِتُنفِقُواْ فِي سَبِيلِ
ٱللَّهِ فَمِنكُم مَّن يَبۡخَلُۖ وَمَن يَبۡخَلۡ فَإِنَّمَا يَبۡخَلُ عَن
نَّفۡسِهِۦۚ وَٱللَّهُ ٱلۡغَنِيُّ وَأَنتُمُ ٱلۡفُقَرَآءُۚ﴾ [محمد: 38]
‘‘দেখ, তোমরাই
তো তারা, যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার আহবান জানানো হচ্ছে।
অথচ তোমাদের কেউ কেউ কৃপণতা করছে। যারা কৃপণতা করছে, তারা
নিজেদের প্রতিই কৃপণতা করছে। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত।’’(সূরা মুহাম্মাদ: ৩৮)
3. রামাদানের প্রতি রাতে
জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি ভীষণভাবে দান করতে অনুপ্রাণিত হতেন, যেমন সহীহ বুখারীর
বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে।
পাঁচঃ উমরা পালন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন,
«فَإِنَّ عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ
تَقْضِي حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِي»
‘‘রামাদান মাসে উমরা করা
হজ্জের সমতুল্য’’ অথবা ‘‘আমার সাথে
হজ্জ করার সমতুল্য’’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং১৬৯০ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
১২৫৬)
ছয়ঃ ইতেকাফ
রামাদান মাসের শেষ দশদিন
ইতেকাফে বসা অতি উত্তম ইবাদাত। শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
রামাদানের প্রথম দশদিন ইতেকাফে বসেন। এরপর লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে মাঝের
দশদিন ইতেকাফে বসেন। এরপর যখন লাইলাতুল
ক্বদর শেষ দশদিনে হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন থেকে তিনি শেষ
দশদিন ইতেকাফে বসতে লাগলেন। অত:পর তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফে বসেন। হাদীসে
এসেছে,
«اعْتَكَفَ رَسُولُ اللَّهِ
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ الْأُوَلِ مِنْ رَمَضَانَ وَاعْتَكَفْنَا
مَعَهُ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي تَطْلُبُ أَمَامَكَ فَاعْتَكَفَ
الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ فَاعْتَكَفْنَا مَعَهُ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ فَقَالَ إِنَّ الَّذِي
تَطْلُبُ أَمَامَكَ فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْه وَسَلَّمَ خَطِيبًا صَبِيحَةَ
عِشْرِينَ مِنْ رَمَضَانَ فَقَالَ مَنْ كَانَ اعْتَكَفَ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلْيَرْجِع.....
»
“রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদানের প্রথম দশদিন ইতেকাফ করেন। (সাহাবারা
বলেন) আর আমরাও তার সাথে ইতেকাফ করলাম। এরপর জিবরীল আসলেন এবং বললেন,
যা আপনি অনুসন্ধান করছেন তা আপনার সামনে রয়েছে। এরপর তিনি মাঝের দশদিন
ইতেকাফ করলেন। (সাহাবারা বলেন)আমরাও তার সাথে ইতেকাফ করলাম। এরপর জিবরীল আসলেন এবং
বললেন, যা আপনি অনুসন্ধান করছেন তা আপনার সামনে রয়েছে। তারপর
বিশ রামাদান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিলেন এবং বললেন, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ইতেকাফ করেছে সে
যেন ফিরে আসে.....”। (সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ৭৮০)
সাতঃ রামাদানের শেষ দশদিনে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকা
রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ
إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে
এবং সওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রিতে (নামাযে) দাঁড়ায়, তার
পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হল”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০২)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম রামাদানের শেষ দশ রাতে নিজে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত
থাকতেন এবং পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। ইমাম মুসলিম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা
থেকে বর্ণনা করেন,
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم يَجْتَهِدُ فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مَا لاَ يَجْتَهِدُ
فِى غَيْرِه»
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদানের শেষ দশদিনে আল্লাহর ইবাদাতে এতটা পরিশ্রম করতেন যা
তিনি অন্য সময় করতেন না”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৪৫)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমের
বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى
اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ وَأَحْيَا لَيْلَهُ
وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ»
‘‘যখন রামাদানের শেষ দশদিন
এসে যেত, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরনের
কাপড় মজবুত করে বাঁধতেন। (অর্থাৎ দৃঢ়তার সাথে প্রস্তুতি নিতেন) এবং নিজে রাত্রে
জাগতেন এবং পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯২০ ও
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৪৪)
তিনি সাহাবাদেরকেও
লাইতুল ক্বদর অনুসন্ধান এ ব্যাপৃত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
«الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ
الْأَوَاخِرِ فِي كُلِّ وِتْرٍ»
“তোমরা শেষ দশদিনের বেজোড়
রাতে এ রাত্রি তালাশ করো”। (সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯২)
এ সম্পর্কে আরো বহু
হাদীস রয়েছে যার সারকথা হলো - লাইলাতুল ক্বদর রামাদানের শেষ দশদিনের যে কোন রাত্রে
হতে পারে। তবে বেজোড় রাত্রিসমুহের যে কোন একটিতে হুওয়ার সম্ভাবনা বেশী। অনেক
উলামার মতে - সবচেয়ে বেশী সম্ভাবনাময় হল ২৭ তম রাত্রি।
আটঃ বেশী বেশী দো‘আ, যিকর এবং ইস্তেগফার
করা
রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ
বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দো‘আ, যিকর
ও ইসস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রামাদান মাস দো‘আ কবুল হওয়ার
খুবই উপযোগী সময়, যেমন প্রবন্ধের শুরুতে একটি হাদীসের
বর্ণনায় বলা হয়েছে।
নয়ঃ সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসে অন্য মাসের
চেয়েও বেশী বেশী ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রহ. বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল রামাদান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশী
বেশী করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রামাদানে আরো বেশী দানশীল হয়ে যেতেন, কেননা এ সময়ে তিনি সদকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, নামায, যিকর ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদাত অধিক পরিমাণে করতেন।
তিনি রামাদানে এমন বিশেষ ইবাদাত সমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না। (যাদুল
মাআ‘দ ১/৩২১)
সালাফে সালেহীনও নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণে এ মাসকে অধিক গুরুত্ব দিতেন এবং সকল ইবাদাতের জন্য
অবসর হয়ে যেতেন। এমন কি ইমাম মলেক রাহেমাহুল্লাহ ও ইমাম যুহরী রাহেমাহুল্লার ন্যায়
ব্যক্তিবর্গও শিক্ষাদান ও ফাতওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছেড়ে বিশেষ ইবাদাত যা
ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে - তার জন্য নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন।
দ্বিতীয় ভাগঃ শরীয়ত যা
বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে
শরীয়তের পক্ষ থেকে মূলত:
ছোট-বড় সকল গোনাহ ও পাপ সর্বদা বর্জন করার নির্দেশ এসেছে। আর রামাদান মাস ফযীলতের মাস এবং আল্লাহর ইবাদাতের প্রশিক্ষণ লাভের
মাস হওয়ায় এ মাসে সর্বপ্রকার গোনাহের কাজ পরিত্যাগ করা অধিক বাঞ্ছনীয়। তদুপরি
রামাদান মাসে সৎকাজের সওয়াব ও নেকী বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তাই
রামাদানের সম্মান ও ফযীলতের কারণে এ মাসে সংঘটিত যে কোন পাপের শাস্তি অন্য সময়ের
তুলনায় ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক।
এজন্যেই রোযাদারদের উচিত
তাকওয়া বিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ
الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَه»
‘‘যে ব্যক্তি (রোযা রেখে)
মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন
করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৪)
‘‘মিথ্যা কথা ও তদনুযায়ী
কাজ’’ কথাটি দ্বারা মূলত: রোযা অবস্থায় উম্মতের সকলকে
পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। আর ‘‘আল্লাহর
কোন প্রয়োজন নেই’’ কথাটি দ্বারা রোযা অসম্পূর্ণ হওয়ার, কিংবা কবুল না হওয়ার অথবা রোযার সওয়াব না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা
হয়েছে।
অন্য আরেকটি হাদীসে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ
أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ
إِنِّي امْرُؤٌ صَائِم»
‘‘তোমাদের কেউ রোযার দিনে
অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার
সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোযাদার ।’’ (সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫)
উপরোক্ত হাদীস দু’টোর আলোকে সারকথায় আমরা বলতে পারি যে, আমাদের ঈমান, আমল ঠিক রেখে ইসলামী বিরোধী সকল কাজ বিশেষভাবে রামাদানে এবং
আমভাবে সর্বদাই বর্জন করতে হবে। তাহলে আমাদের সিয়াম সাধনা হবে অর্থবহ এবং এ সাধনার
মূল লক্ষ্য তাকওয়া অর্জন করা হবে সহজসাধ্য । আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং
আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
সংকলন : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
আরও পড়ুনঃ রমজান মাসের ফজিলত
আরও পড়ুনঃ রমজানের ফজিলত ও তাৎপর্য
আরও পড়ুনঃ সিয়ামের ফজিলত
আরও পড়ুনঃ মাহে রমযান : তাৎপর্য ও কর্তব্য
আরও পড়ুনঃ রমাদান মাসের ৩০ আমল
আরও পড়ুনঃ মাহে রামাযান: অসংখ্য কল্যাণের হাতছানি
আরও পড়ুনঃ মাহে রামাজানের বিশটি স্পেশাল আমল
আরও পড়ুনঃ রমজানে যা করনীয়
আরও পড়ুনঃ রমজান ও পরবর্তী সময়ে করণীয়
আরও পড়ুনঃ তারবীহর রাকায়াত সংখ্যা ৮ না ২০?
আরও পড়ুনঃ ‘লাইলাতুল কদর’ এ কি কি ইবাদত করবেন?
আরও পড়ুনঃ রমজান বিষয়ক একগুচ্ছ ফাইল
“রমজান মাস” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
“রোজা” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন