আল-কুরআন ও এর সুমহান মর্যাদা
সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর
বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে কোনো বক্রতা রাখেন নি। সরলরূপে; যাতে সে তাঁর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে এবং
সুসংবাদ দেয় সেসব মুমিনকে, যারা সৎকর্ম করে। নিশ্চয় তাদের
জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান, তারা তাতে অনন্তকাল অবস্থান
করবে। আর যেন সতর্ক করে তাদেরকে যারা বলে, আল্লাহ সন্তান
গ্রহণ করেছেন।
আবারও প্রশংসা করছি সেই মহান আল্লাহর, যিনি
তাঁর বান্দার উপর সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেছেন, যা সৃষ্টিকুলের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী। দরূদ ও সালাম আমাদের নবী
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যিনি হিদায়েত ও রহমত নিয়ে প্রেরিত
হয়েছেন। তিনি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী, আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তিনি তাঁর পথে আহ্বানকারী এবং
আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ও তার পরিবার পরিজন, সাহাবায়ে
কিরাম ও কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণকারী সকলের উপর সালাত প্রেরণ করুন।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিকূলের
উপর বিশেষ করে মু’মিনের উপর অনুগ্রহ দান করেছেন যে, তিনি
তাদের মধ্য থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। তিনি তার
সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যা
অন্যান্য সব কিতাবের রক্ষক। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ لَقَدۡ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ بَعَثَ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡ أَنفُسِهِمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ
١٦٤
﴾ [ال عمران: ١٦٤]
“অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ
করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের
প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ
তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়।
যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।” [সূরা আলে-ইমরান: ১৬৪]
সহীহ মুসলিমে এসেছে:
عَنْ عِيَاضِ بْنِ حِمَارٍ الْمُجَاشِعِيِّ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ ذَاتَ يَوْمٍ فِي خُطْبَتِهِ:
«أَلَا إِنَّ رَبِّي أَمَرَنِي أَنْ أُعَلِّمَكُمْ مَا جَهِلْتُمْ، مِمَّا عَلَّمَنِي يَوْمِي هَذَا، كُلُّ مَالٍ نَحَلْتُهُ عَبْدًا حَلَالٌ، وَإِنِّي خَلَقْتُ عِبَادِي حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ، وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِينِهِمْ، وَحَرَّمَتْ عَلَيْهِمْ مَا أَحْلَلْتُ لَهُمْ، وَأَمَرَتْهُمْ أَنْ يُشْرِكُوا بِي مَا لَمْ أُنْزِلْ بِهِ سُلْطَانًا، وَإِنَّ اللهَ نَظَرَ إِلَى أَهْلِ الْأَرْضِ، فَمَقَتَهُمْ عَرَبَهُمْ وَعَجَمَهُمْ، إِلَّا بَقَايَا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ، وَقَالَ:
إِنَّمَا بَعَثْتُكَ لِأَبْتَلِيَكَ وَأَبْتَلِيَ بِكَ، وَأَنْزَلْتُ عَلَيْكَ كِتَابًا لَا يَغْسِلُهُ الْمَاءُ، تَقْرَؤُهُ نَائِمًا وَيَقْظَانَ...... »
সহীহ মুসলিমে ‘ইয়াদ ইবন হিমার আল-মুজাশি‘য়ী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাঁর খুতবায় বলেছেন, জেনে রাখো, আমার
রব আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা যা কিছু জানো না তা যেন
তোমাদেরকে শিখিয়ে দেই, যে ইলম আল্লাহ তা‘আলা
আমাকে আজ পর্যন্ত জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যেসব
সম্পদ আমি আমার বান্দাহকে দান করেছি তা হালাল এবং নিশ্চয়ই আমি আমার সকল
বান্দাহকে জন্মগতভাবেই নিষ্কলুষ তথা সরল
সঠিক পথের অনুসারী করে সৃষ্টি করেছি। এরপরে শয়তান তাদের নিকট এসে তাদেরকে
বিভ্রান্ত করে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং আমি যা তাদের জন্য হালাল করেছি শয়তান
তা তাদের উপর হারাম করে দিয়েছে। তদুপরি শয়তান আমার সাথে এমন কিছুকে শরীক করতে আদেশ
দেয় যে সম্পর্কে আমি কোনো দলিল প্রমাণ অবতীর্ণ করি নি। আর আল্লাহ তা‘আলা জমিনের
অধিবাসীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আরব অনারব সবার প্রতি (তাদের কার্যকলাপের কারণে)
ক্রোধান্বিত হলেন। কেবল আহলে কিতাবের কিছু সংখ্যক লোক যারা সঠিক পথকে ধরে রেখেছে
(তারা স্রষ্টার রোষ থেকে রক্ষা পেলো)। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয়
আমি আপনাকে পরীক্ষা করা ও আপনার দ্বারা সৃষ্টিকুলকে পরীক্ষা করা এ দু’উদ্দেশ্যে
আপনাকে জগতে প্রেরণ করেছি। এবং আমি আপনার উপর এমন কিতাব নাযিল করেছি যা পানি ধুয়ে
মুছে ফেলতে পারে না। তা আপনি শয়নে জাগরণে সর্বাবস্থায় তিলাওয়াত করতে পারেন [1]।
এ কিতাব
পূর্ববর্তী সব কিতাবের রক্ষাকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ ٨ ﴾ [المائدة: ٤٨]
“আর আমি
তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বের কিতাবের সত্যায়নকারী ও এর
উপর তদারককারীরূপে।” [সূরা
আল-মায়েদা: ৪৮]
অর্থাৎ এটি পূর্ববর্তী সব কিতাব
থেকে সুউঁচু ও মর্যাদাবান। অন্যান্য কিতাবের রক্ষাকারী, ফয়সালাকারী, সাক্ষ্যদানকারী ও মূল্যায়ণকারী।
ইবন
জারীর রহ. বলেন, আল কুরআন পূর্ববর্তী সব কিতাবের আমানতদার ও নিরাপত্তাদাতা। সুতরাং
যা কিছু কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে তা সঠিক, আর যা কুরআনের সাথে বিরোধপূর্ণ
হবে তা বাতিল।
সব মুসলিমের অন্তরে আল কুরআনের
রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এটি নিজেই মহিমান্বিত, সম্মানিত, মর্যাদাবান ও শক্তিশালী।
আমরা এ
পুস্তিকাতে ইশারা ইঙ্গিতে সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোকপাত করব। আশা করি আল্লাহ তা‘আলা এর
দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করবেন, সম্মানিত পাঠক পাঠিকাগণ ও যার কাছে এ বাণী পৌঁছবে
সকলেই উপকৃত হবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সর্বশ্রোতা ও দো‘আ কবুলকারী।
আল্লাহর
সাহায্য সহযোগিতায় শুরু করছি:
القرآن (আল কুরআন) শব্দটি قرأ মূলধাতুর
মাসদার। এ শব্দ থেকেই আল্লাহর বাণী:
﴿ إِنَّ عَلَيۡنَا
جَمۡعَهُۥ وَقُرۡءَانَهُۥ ١٧ فَإِذَا قَرَأۡنَٰهُ فَٱتَّبِعۡ قُرۡءَانَهُۥ ١٨ ثُمَّ
إِنَّ عَلَيۡنَا بَيَانَهُۥ ١٩ ﴾ [القيامة: ١٧، ١٩]
“এর
সংরক্ষণ ও পাঠ আমাদেরই দায়িত্ব। অতঃপর আমরা যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ
করুন। এরপর বিশদ বর্ণনা আমারই দায়িত্ব”। [সূরা আল-কিয়ামাহ: ১৭-১৮]
পঠিত
বাক্যকে কুরআন বলা হয়, যেমন আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী:
﴿ فَإِذَا قَرَأۡتَ ٱلۡقُرۡءَانَ فَٱسۡتَعِذۡ بِٱللَّهِ مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ ٱلرَّجِيمِ ٩٨ ﴾ [النحل:
٩٨]
“অতএব, যখন
আপনি কুরআন পাঠ করেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করুন।” [সূরা
আন-নাহল: ৯৮]
আল-কুরআন
প্রকৃতভাবেই আল্লাহর বাণী, এর শব্দাবলী ও অর্থও আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকেই এসেছে।
তিনি তা তাঁর বান্দা মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
উপর ওহী আকারে নাযিল করেছেন।
এটা
নাযিলকৃত কিন্তু মাখলুক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ تَنزِيلُ
ٱلۡكِتَٰبِ
مِنَ
ٱللَّهِ
ٱلۡعَزِيزِ
ٱلۡحَكِيمِ
١ ﴾ [الزمر: ١]
“কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে।” [সূরা
আয-যুমার: ১]
﴿ قُلۡ
نَزَّلَهُۥ
رُوحُ
ٱلۡقُدُسِ
مِن
رَّبِّكَ
١٠٢
﴾ [النحل: ١٠٢]
“বলুন, একে পবিত্র ফেরেশতা আপনার রবের পক্ষ থেকে নাযিল করেছেন”। [সূরা আন-নাহল: ১০২]
﴿ حمٓ
١ تَنزِيلُ
ٱلۡكِتَٰبِ
مِنَ
ٱللَّهِ
ٱلۡعَزِيزِ
ٱلۡعَلِيمِ
٢ ﴾ [غافر: ١، ٢]
“হা-মীম। কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ
থেকে,
যিনি পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ”। [সুরা গাফির: ১-২]
﴿ تَنزِيلٞ مِّنَ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٢ ﴾ [فصلت:
٢]
“এটা অবতীর্ণ পরম করুণাময়, দয়ালুর পক্ষ থেকে”। [সূরা ফুসসিলাত: ২]
﴿وَقُرۡءَانٗا فَرَقۡنَٰهُ
لِتَقۡرَأَهُۥ
عَلَى
ٱلنَّاسِ
عَلَىٰ
مُكۡثٖ وَنَزَّلۡنَٰهُ تَنزِيلٗا ١٠٦﴾ [الاسراء: ١٠٦]
“আর আমরা কুরআনকে নাযিল করেছি কিছু কিছু করে,
যেন আপনি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পারেন ধীরে ধীরে এবং আমরা তা নাযিল করেছি যথাযথভাবে।” [সূরা বনী
ইসরাঈল: ১০৬]
এ ব্যাপারে অনেক আয়াত রয়েছে। উম্মতের সকল উলামা কিরাম এ মতের উপর ঐকমত্য
পোষণ করেছে।
আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছেন। আবার তিনি সেটাকে
নানা বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। এর দ্বারাই এ কিতাবের সুমহান সম্মান ও মর্যাদা
প্রমাণিত হয়। কুরআনের নামসমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: আল কুরআন, আল-ফুরকান, আল-কিতাব,
আল-হুদা (হিদায়েতের পথ প্রদর্শনকারী), নূর (আলো), শিফা (আরোগ্যকারী), বায়ান
(বর্ণনাকারী) মাও‘য়েযা (সুপদেশ), রহমত, বাসায়ের (অন্তর্দৃষ্টি দানকারী), বালাগ (প্রজ্ঞাপন),
আরবী, মুবীন (স্পষ্টকারী), কারীম (অতি সম্মানিত), আযীম (মহান), মাজীদ (সম্মানিত), মুবারক
(বরকতময়), তানযীল (অবতীর্ণ), সিরাতুম-মুসতাকিম (সরল সঠিক পথ), যিকরুল হাকীম
(প্রজ্ঞাময় বাণী), হাবলুল্লাহ (আল্লাহর রশি), যিকরা (উপদেশ), তাযকিরা (স্মরণিকা), বুশরা
(সুসংবাদ), পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী, পূর্ববর্তী কিতাবের
রক্ষাকারী, মাসানী, সব বিষয়ের ব্যাখ্যাকারী, সব বিষয়ের বর্ণনাকারী, সন্দেহাতীত ও
বক্রহীন কিতাব ইত্যাদি নামে পরিচিত। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ قُرۡءَانًا
عَرَبِيًّا
غَيۡرَ
ذِي
عِوَجٖ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٢٨ ﴾ [الزمر: ٢٨]
“আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে।”[ সূরা যুমার:২৮]
﴿ تَبَارَكَ
ٱلَّذِي
نَزَّلَ
ٱلۡفُرۡقَانَ
عَلَىٰ
عَبۡدِهِ
﴾ [الفرقان:
١]
“পরম কল্যাণময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফয়সালার গ্রন্থ
অবতীর্ণ করেছেন।” [সূরা আল-ফুরকান: ১]
﴿ الٓمٓ
١ ذَٰلِكَ
ٱلۡكِتَٰبُ
لَا
رَيۡبَۛ
فِيهِۛ
هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ
٢ ﴾ [البقرة:
١، ٢]
“আলিফ লাম মীম, এ সেই কিতাব যাতে কোনোই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী মুত্তাকীদের জন্য।” [সূরা আল-বাকারা: ১-২]
﴿
قُلۡ
مَن
كَانَ
عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ
فَإِنَّهُۥ
نَزَّلَهُۥ
عَلَىٰ
قَلۡبِكَ
بِإِذۡنِ
ٱللَّهِ
مُصَدِّقٗا لِّمَا
بَيۡنَ
يَدَيۡهِ
وَهُدٗى وَبُشۡرَىٰ
لِلۡمُؤۡمِنِينَ
﴾ [البقرة: ٩٧]
“আপনি বলে দিন, যে কেউ জিবরাঈলের শত্রু হয়-যেহেতু তিনি আল্লাহর আদেশে এ
কালাম আপনার অন্তরে নাযিল করেছেন, যা সত্যায়নকারী
তাদের সম্মুখস্থ কালামের এবং মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা।” [সুরা বাকারা: ৯৭]
﴿ ذَٰلِكَ
نَتۡلُوهُ
عَلَيۡكَ
مِنَ
ٱلۡأٓيَٰتِ
وَٱلذِّكۡرِ
ٱلۡحَكِيمِ
٥٨
﴾ [ال
عمران:
٥٨]
এটা তো তা-ই যা আমরা আপনাকে পড়ে শুনাই, আয়াত এবং প্রজ্ঞাময় যিকির থেকে।” [সূরা আলে-ইমরান: ৫৮]
﴿
يَٰٓأَيُّهَا
ٱلنَّاسُ
قَدۡ
جَآءَكُم
بُرۡهَٰنٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكُمۡ نُورٗا مُّبِينٗا ١٧٤ ﴾ [النساء: ١٧٤]
“হে লোকসকল, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট দলীল-প্রমাণাদি
পৌঁছে গেছে। আর আমরা তোমাদের প্রতি প্রকৃষ্ট আলো অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা আন-নিসা: ১৭৪]
﴿
يَٰٓأَيُّهَا
ٱلنَّاسُ
قَدۡ
جَآءَتۡكُم
مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا
فِي
ٱلصُّدُورِ
وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس: ٥٧]
“হে লোকসকল, তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে উপদেশবাণী এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলিমদের জন্য।” [সূরা ইউনুস: ৫৭]
﴿
إِنَّ
هَٰذَا
ٱلۡقُرۡءَانَ
يَهۡدِي
لِلَّتِي
هِيَ
أَقۡوَمُ
وَيُبَشِّرُ
ٱلۡمُؤۡمِنِينَ
ٱلَّذِينَ
يَعۡمَلُونَ
ٱلصَّٰلِحَٰتِ
أَنَّ
لَهُمۡ
أَجۡرٗا كَبِيرٗا ٩ ﴾ [الاسراء:
٩]
“নিশ্চয় এ কুরআন প্রদর্শন করে সর্বাধিক সরল পথের দিকে এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে রয়েছে মহা পুরস্কার।” [সূরা
বনী ইসরাঈল: ৯]
আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
﴿
ٱلۡحَمۡدُ
لِلَّهِ
ٱلَّذِيٓ
أَنزَلَ
عَلَىٰ
عَبۡدِهِ
ٱلۡكِتَٰبَ
وَلَمۡ
يَجۡعَل
لَّهُۥ
عِوَجَاۜ
١ قَيِّمٗا لِّيُنذِرَ
بَأۡسٗا شَدِيدٗا مِّن
لَّدُنۡهُ
وَيُبَشِّرَ
ٱلۡمُؤۡمِنِينَ
ٱلَّذِينَ
يَعۡمَلُونَ
ٱلصَّٰلِحَٰتِ
أَنَّ
لَهُمۡ
أَجۡرًا
حَسَنٗا ٢ ﴾ [الكهف:
١، ٢]
“সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর বান্দার উপর কিতাব নাযিল করেছেন এবং তাতে রাখেন নি কোনো বক্রতা।
সরলরূপে, যাতে সে তাঁর পক্ষ থেকে কঠিন
আযাব সম্পর্কে সতর্ক করে এবং সুসংবাদ দেয়, সেসব মুমিনকে, যারা সৎকর্ম করে, নিশ্চয় তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান।” [সূরা
কাহাফ, আয়াত ১-২]
﴿ بَلۡ
هُوَ
قُرۡءَانٞ مَّجِيدٞ ٢١
فِي
لَوۡحٖ مَّحۡفُوظِۢ ٢٢ ﴾ [البروج: ٢١، ٢٢]
“বরং এটা মহান কুরআন, লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ”। [সূরা
বুরূজ, আয়াত ২১-২২]
﴿ إِنَّهُۥ لَقُرۡءَانٞ
كَرِيمٞ
٧٧ فِي كِتَٰبٖ
مَّكۡنُونٖ
٧٨ لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ
٧٩ تَنزِيلٞ
مِّن رَّبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ
٨٠ ﴾
[الواقعة: ٧٧، ٨٠]
“নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক গোপন কিতাবে, যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না, এটা সৃষ্টিকুলের
রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।” [সূরা ওয়াক্বি‘আ, আয়াত ৭৭-৮০]
এগুলো ছাড়াও আরো
অনেক আয়াতে এই মহাগ্রন্থের নানা নাম ও গুণাবলীর কথা উল্লেখ হয়েছে, যা
এর সুমহান মর্যাদা, সর্বোচ্চ সম্মানের প্রমাণিত হয়। কেনইবা
হবে না? এর কথক হলেন স্বয়ং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সব বিষয়ের সর্বজ্ঞানী। তিনি বলেনঃ
﴿
وَلَوۡ
أَنَّمَا
فِي
ٱلۡأَرۡضِ
مِن
شَجَرَةٍ
أَقۡلَٰمٞ وَٱلۡبَحۡرُ يَمُدُّهُۥ مِنۢ بَعۡدِهِۦ سَبۡعَةُ أَبۡحُرٖ مَّا
نَفِدَتۡ
كَلِمَٰتُ
ٱللَّهِۚ
إِنَّ
ٱللَّهَ
عَزِيزٌ
حَكِيمٞ ٢٧ ﴾ [لقمان: ٢٧]
“পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথেও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে
কালি হয়, তবুও তাঁর বাক্যাবলী লিখে শেষ করা যাবে
না। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা লোকমান, আয়াত ২৭]
﴿ إِنَّا
نَحۡنُ
نَزَّلۡنَا
ٱلذِّكۡرَ
وَإِنَّا
لَهُۥ
لَحَٰفِظُونَ
٩ ﴾ [الحجر:
٩]
“নিশ্চয় আমরা স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ
করেছি এবং আমরা নিজেই এর সংরক্ষক”। [সূরা হিজর, আয়াত
৯]
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুরআনের যে সব নাম বা সিফাত রয়েছে তার প্রত্যেকটি
বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচনা অতিদীর্ঘ হওয়ার ভয় না হলে বাকী নামসমূহ
বিস্তারিতভাবে এখানে আলোচনা করতাম। এ সম্মানিত কিতাবের সবচেয়ে বড় মহত্ব হলো এর
সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই নিয়েছেন। কোনো সৃষ্ট
জীবের কাছে এর হিফাযতের দায়িত্ব দেননি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ بَلۡ
هُوَ
قُرۡءَانٞ مَّجِيدٞ ٢١
فِي
لَوۡحٖ مَّحۡفُوظِۢ ٢٢ ﴾ [البروج:
٢١، ٢٢]
“বরং এটা মহান কুরআন, লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ”। [সূরা বুরুজ, আয়াত ২১-২২]
ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা নিন্মোক্ত আয়াতে
﴿ بَلۡ
هُوَ
قُرۡءَانٞ مَّجِيدٞ ٢١
فِي
لَوۡحٖ مَّحۡفُوظِۢ ٢٢ ﴾ [البروج:
٢١، ٢٢]
“আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি
এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা হিজর, আয়াত
৯] কুরআনের সংরক্ষণ ও সূরায়ে বুরুজে সংরক্ষণের
জায়গা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে কোনো ধরণের সংযোজন ও বিয়োজন
থেকে মুক্ত রেখেছেন, এর অর্থ বিকৃতি, শব্দ পরিবর্তন ও সংরক্ষণ করেছেন। এর হরফসমূহ
সব ধরণের বাড়ানো বা কমানো থেকে এবং অর্থসমূহ বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে হেফাযত
করেছেন।
আল্লাহর কিতাব আল কুরআন সব ফিতনা ফাসাদ থেকে মুক্ত, তা মু’মিনের নিত্যসঙ্গী,
অন্তরের আলো, হৃদয়ের বসন্ত, দুঃশ্চিন্তা দুর্ভাবনা দূরকারী। আল্লাহর কিতাব আমাদের
পূর্ববর্তীদের ও পরবর্তীদের সংবাদদাতা, পরস্পরের মাঝে ফয়সালাকারী। তা চিরন্তন
ফয়সালা, কোনোরূপ হাসি তামাশার জিনিস নয়। যেসব আল্লাহদ্রোহীরা তাকে ত্যাগ করেছে
আল্লাহ তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, কেউ তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোথাও হিদায়াত অন্বেষণ করলে
আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তা আল্লাহ তা‘আলার শক্ত রজ্জু, প্রজ্ঞাময়
উপদেশবাণী, সরল সঠিক পথ, যা কখনো পথভ্রষ্ট করে না, কাউকে দ্বিধা সংকোচে ফেলে না, উলামায়ে
কিরামগণ কখনো এর মহাজ্ঞান বিজ্ঞান অর্জনে পরিতুষ্ট হতে পারবে না (তারা আরো বেশি
বেশি অর্জন করতে চাইবে), অধিক উত্তর প্রদানের পরও তা পুরাতন হয় না। এর বিস্ময় শেষ
হবার নয়, এর উপদেশ চিরন্তন। তা জ্বীন সম্প্রদায়কে বিরত রাখতে পারেনি যখন তারা এর
তিলাওয়াত শ্রবন করেছিল, তখন তারা বলেছিল,
﴿ إِنَّا
سَمِعۡنَا
قُرۡءَانًا
عَجَبٗا ١ ﴾ [الجن:
١]
“আমরা (জ্বিন জাতি) বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি।” [সূরা আল জিন: ১]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَا مِنَ الْأَنْبِيَاءِ مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا
قَدِ اُعْطِيَ مِنَ الْآيَاتِ مَا مِثْلُهُ آمَنَ عَلَيْهِ الْبَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ
الَّذِي أُوتِيتُ وَحْيًا أَوْحَى اللهُ إِلَيَّ، فَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَكْثَرَهُمْ
تَابِعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক নবীকে
তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের প্রায় অনুরূপ মু‘জিযা দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর লোকেরা তাঁর উপর
ঈমান এনেছে। কিন্তু আমাকে যে মু‘জিযা দেওয়া হয়েছে তা হলো অহী (আল কুরআন), যা আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর নাযিল করেছেন।
আমি আশা করি কিয়ামতের দিবসে তাঁদের অনুসারীদের তুলনায় আমার অনুসারীর সংখ্যা
সর্বাধিক হবে।”[2]
কুরআনের শব্দ ও বর্ণনার অলৌকিকতা:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের শব্দ ও বর্ণনার বিস্ময়করতা সম্পর্কে বলেন,
﴿وَإِن كُنتُمۡ
فِي
رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن
مِّثۡلِهِۦ
وَٱدۡعُواْ
شُهَدَآءَكُم
مِّن
دُونِ
ٱللَّهِ
إِن
كُنتُمۡ
صَٰدِقِينَ
٢٣
﴾ [البقرة: ٢٣]
“এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে যা আমরা আমাদের বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস আর তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে
নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।” [সূরা আল-বাকারা: ২৩]
কুরআনের তিলাওয়াত ও পাঠের ক্ষেত্রে অলৌকিকতাঃ
﴿ وَلَقَدۡ
يَسَّرۡنَا
ٱلۡقُرۡءَانَ
لِلذِّكۡرِ
فَهَلۡ
مِن
مُّدَّكِرٖ ١٧ ﴾ [القمر: ١٧]
“আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে।
অতএব,
কোন চিন্তাশীল আছে কি?”। [সূরা
ক্বামার, আয়াত ১৭]
পূর্ববর্তীদের ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা কুরআনের বিস্ময়, যাতে আমরা উপদেশ গ্রহণ
করতে পারি,
﴿
نَحۡنُ
نَقُصُّ
عَلَيۡكَ
أَحۡسَنَ
ٱلۡقَصَصِ
بِمَآ
أَوۡحَيۡنَآ
إِلَيۡكَ
هَٰذَا
ٱلۡقُرۡءَانَ
وَإِن
كُنتَ
مِن
قَبۡلِهِۦ
لَمِنَ
ٱلۡغَٰفِلِينَ
٣ ﴾ [يوسف: ٣]
“আমরা আপনার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি, যেমনিভাবে আমরা এ কুরআন আপনার নিকট অবতীর্ণ করেছি। আপনি এর আগে অবশ্যই এ ব্যাপারে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।” [সূরা ইউসুফ : ৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ
﴿
لَقَدۡ
كَانَ
فِي
قَصَصِهِمۡ
عِبۡرَةٞ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِۗ مَا كَانَ حَدِيثٗا يُفۡتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصۡدِيقَ ٱلَّذِي بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ
١١١
﴾ [يوسف: ١١١]
“তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোনো মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা ঈমান আনয়ণ করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের
সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ রহমত ও হেদায়াত।” [সূরা ইউসুফ: ১১১]
কুরআনে কারীমে আক্বীদা ও ধর্মীয় যে সব বিধিবিধান রয়েছে তার অলৌকিকতা:
আর তা এ জন্য যে, যাতে আমরা অনুসরণ করতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা এসম্পর্কে
বলেন,
﴿الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ
ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ صِرَٰطِ ٱلۡعَزِيزِ
ٱلۡحَمِيدِ ١ ﴾ [ابراهيم: ١]
“আলিফ-লাম-রা; এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে
আনেন-পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে।” [সূরা ইবরাহীম: ১]
﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا
لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]
“আমরা আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক
বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্যে সুসংবাদ।” [সূরা নাহল, আয়াত ৮৯]
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ
فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢﴾ [الزمر: ٢]
“আমরা আপনার প্রতি এ কিতাব যথার্থরূপে নাযিল করেছি। অতএব, আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন।” [সূরা যুমার, আয়াত
২]
﴿ وَهَٰذَا كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ مُبَارَكٞ فَٱتَّبِعُوهُ
وَٱتَّقُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٥٥ ﴾ [الانعام: ١٥٥]
“এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা আমরা অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়, অতএব, তোমরা এর অনুসরণ কর এবং তার তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।” [সূরা
আন‘আম, আয়াত ১৫৫]
কুরআনে কারীমে গায়েবী বিষয় সম্পর্কে যা এসেছে সেগুলোও অলৌকিক:
যাতে আমরা ঈমান আনি ও আত্মসমর্পন করি: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ الٓمٓ ١ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ
هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ
وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣ ﴾ [البقرة: ١، ٣]
“আলিফ লাম মীম। এ সেই কিতাব যাতে কোনোই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী মুত্তাকীদের জন্য। যারা গায়েবের উপর ঈমান আনে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে। আর আমরা তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।” [সূরা আল-বাক্বারাহ, আয়াত ১-৩]
মহাগ্রন্থ আল কুরআন নবীজির নবুওয়াত লাভের শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত একটি স্পষ্ট নিদর্শন ও অকাট্য প্রমাণ:
আল্লাহ তা‘আলা সকল অধিকতর শুদ্ধভাষীদেরকে চ্যালেঞ্জ করছেন (এর অনুরূপ কিছু বানাতে), বরং তিনি জীন ও ইনসান সকলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, কিন্তু সকলেই অক্ষম ও ব্যর্থ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ قُل لَّئِنِ ٱجۡتَمَعَتِ ٱلۡإِنسُ وَٱلۡجِنُّ
عَلَىٰٓ أَن يَأۡتُواْ بِمِثۡلِ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ لَا يَأۡتُونَ بِمِثۡلِهِۦ وَلَوۡ
كَانَ بَعۡضُهُمۡ لِبَعۡضٖ ظَهِيرٗا ٨٨ ﴾ [الاسراء: ٨٨]
“বলুন, যদি মানব ও জ্বিন এই কুরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে
না।” [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত
৮৮]
আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা আমাদের নবীজীকে অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَٰكَ سَبۡعٗا مِّنَ ٱلۡمَثَانِي
وَٱلۡقُرۡءَانَ ٱلۡعَظِيمَ ٨٧ ﴾ [الحجر: ٨٧]
“আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত
এবং মহান কুরআন দিয়েছি।” [সূরা হিজর, আয়াত
৮৭]
তা সরল সঠিক পথ ও বিশুদ্ধ পদ্ধতির সন্ধান দেয়:
আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي
هِيَ أَقۡوَمُ ٩ ﴾ [الاسراء: ٩]
“এই কুরআন এমন পথ প্রদর্শন
করে, যা সর্বাধিক সরল।” [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৯]
এছাড়াও এ কিতাবের তিলাওয়াতকারীর জন্য রয়েছে অসংখ্য সাওয়াব ও মহাপ্রতিদান:
আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ
وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ سِرّٗا وَعَلَانِيَةٗ
يَرۡجُونَ تِجَٰرَةٗ لَّن تَبُورَ ٢٩ لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن
فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّهُۥ غَفُورٞ شَكُورٞ ٣٠ ﴾ [فاطر: ٢٩، ٣٠]
“যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং আমরা যা দিয়েছি, তা থেকে
গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসা
আশা করে, যাতে কখনও লোকসান হবে না। পরিণামে তাদেরকে আল্লাহ তাদের সওয়াব পুরোপুরি দিবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশী দিবেন। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতীব গুণগ্রাহী।” [সূরা ফাতির, আয়াত
২৯-৩০]
وعن
ابن عمر -رضي الله عنهما- عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
قَالَ: «لَا حَسَدَ إِلَّا فِي
اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْقُرْآنَ فَهُوَ يَقُومُ بِهِ آنَاءَ اللَّيْلِ،
وَآنَاءَ النَّهَارِ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا، فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ،
وَآنَاءَ النَّهَارِ » رواه البخاري ومسلم.
ইবন উমর
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, “দু’টি ব্যাপারে ছাড়া ঈর্ষা পোষণ করা যায় না। একটি হলো এমন
ব্যক্তি যাকে আল্লাহ কুরআনের জ্ঞান দান করেছেন, সে তদনুযায়ী রাত-দিন আমল করে। আরেক
ব্যক্তি হলো যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দান করেছেন, সে রাত-দিন তা আল্লাহর পথে ব্যয়
করে।”[3]
وعن
ابن مسعود - رضي الله عنه- قال: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ: «مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ
بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ الْم حَرْفٌ، وَلَكِنْ
أَلِفٌ حَرْفٌ وَلاَمٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ»
ইবন
মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের
একটি হরফ পাঠ করবে তার জন্য একটি নেকী, আর একটি নেকী দশ গুণ হবে। আমি এ কথা বলব না
যে, আলিফ লাম মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।”[4]
কুরআন ধারণকারী দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানেই সম্মানিত ও অগ্রগামী:
عن
عمر بن الخطاب -رضي الله عنه-: أن النبي -صلى الله عليه وسلم- قال: «إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْقُرْآنِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ»
উমর ইবন
খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবের (কুরআন) দ্বারা এক সম্প্রদায়কে সম্মানিত করেন, আর
অন্য সম্প্রদায়কে অপদস্থ করেন।”[5]
عن
أبي مسعود الأنصاري البدري -رضي الله عنه-، أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم-
قال: «يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ »
আবু
মাসউদ আনসারী আল-বদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, “জাতির নেতৃত্ব সে ব্যক্তি দিবে যে আল্লাহর কিতাব অধিক পাঠ করে
(আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত)।”[6]
وقال
ابن عباس رضي الله عنهما: «كَانَ الْقُرَّاءُ أَصْحَابَ مَجْلِسِ عُمَرَ
وَمُشَاوَرَتِهِ، كُهُولًا كَانُوا أَوْ شُبَّانًا»
ইবন
আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, “ক্বারীগণই (আলিমগণ) উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর
পরামর্শ মজলিশে সভাসদ ও পরামর্শদাতা ছিলেন, চাই তারা বয়ঃবৃদ্ধ হোক কিংবা যুবক।”[7]
عَنْ أَبِي مُوسَى الْأَشْعَرِيِّ، قَالَ:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ
إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ، وَحَامِلِ الْقُرْآنِ غَيْرِ الْغَالِي فِيهِ
وَالْجَافِي عَنْهُ، وَإِكْرَامَ ذِي السُّلْطَانِ الْمُقْسِطِ»
আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“আল্লাহকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, যখন কেউ শুভ্র কেশধারী (বয়স্ক) মুসলিমকে
সম্মানিত করে, অনুরূপভাবে যখন কেউ কুরআনের এমন হাফেযকে যে সম্মান করে, যে কুরআন
নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি কোনোটাই করে না। তদ্রূপ যখন কেউ ন্যায়পরায়ণ ক্ষমতাশীনকে
সম্মান প্রদর্শন করবে।”[8]
عن
أبي موسى الأشعري -رضي الله عنه- قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «مَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ، رِيحُهَا
طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي لاَ يَقْرَأُ القُرْآنَ
كَمَثَلِ التَّمْرَةِ، لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثَلُ المُنَافِقِ الَّذِي
يَقْرَأُ القُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ
المُنَافِقِ الَّذِي لاَ يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ الحَنْظَلَةِ، لَيْسَ لَهَا رِيحٌ
وَطَعْمُهَا مُرٌّ»
আবু মূসা
আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, “কুরআন তিলাওয়াতকারী মু’মিনের উদাহরণ (উতরুজ্জা তথা) জাম্বীর ফলের মতন, এর
গন্ধ ও স্বাদ দু’টোই সুস্বাদু। আর যে মু’মিন কুরআন তিলাওয়াত করে না তার উদাহরণ
খেজুরের মত, যার সুগন্ধ না থাকলেও স্বাদ মিষ্ট। কুরআন তিলাওয়াতকারী মুনাফিকের
উদাহরণ হলো সুগন্ধি ফুলের ন্যায়, এর গন্ধ খুবই সৌরভময়, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। আর যে
মুনাফিক কুরআন তিলাওয়াত করে না তার উদাহরণ হলো হানযালা (লেবু জাতীয় ফল) ফলের মত,
তার কোনো গন্ধ নেই, আর এর স্বাদ হলো তিক্ত।”[9]
এ হলো
দুনিয়ার প্রতিদান,
আর কুরআন অনুযায়ী আমল করলে আখেরাতে রয়েছে মহাপ্রতিদান:
আর কুরআন অনুযায়ী আমল করলে আখেরাতে রয়েছে মহাপ্রতিদান:
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ
الْبَرَرَةِ، وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ، وَهُوَ عَلَيْهِ
شَاقٌّ، لَهُ أَجْرَانِ»
আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কুরআন
সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি সে সব ফেরেশতাদের সাথে থাকবে যারা আল্লাহর অনুগত,
মর্যাদাবান ও লেখক। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং তার জন্য কষ্টকর হওয়া
সত্ত্বেও বারবার পড়ে সে ব্যক্তির জন্য রয়েছে দুটি পুরস্কার।”[10]
وعن
أبي أمامة الباهلي -رضي الله عنه- قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: «اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ
شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ»
আবু উমামা আল-বাহেলী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কেননা কিয়ামতের দিন তার
তার তিলাওয়াতকারীর জন্য শাফায়াতকারী হিসেবে আসবে।”[11]
কুরআন ধারণকারীগণ আখেরাতের মনজিলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্য:
যেমন হাদীসে এসেছে,
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهُمَا: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَجْمَعُ
بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ مِنْ قَتْلَى أُحُدٍ فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ، ثُمَّ يَقُولُ: «أَيُّهُمْ
أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ؟»، فَإِذَا أُشِيرَ لَهُ إِلَى أَحَدِهِمَا قَدَّمَهُ
فِي اللَّحْدِ»
জাবের
ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদের শহীদগণের দু’ দু’ জনকে একই কাপড়ে (কবরে) একত্র করতেন।
অতঃপর জিজ্ঞেস করতেন, তাঁদের উভয়ের মধ্যে কে কুরআন সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত? দু’জনের
মধ্যে এক জনের দিকে ইশারা কর হলে তাকে কবরে আগে রাখতেন। [12]
কুরআন
ধারণকারীর কাছে যে পরিমাণ কুরআন রয়েছে সে অনুযায়ী জান্নাতের উচ্চ আসনে সমাসীন
হবেন।
عن
أبي أمامة الباهلي - رضي الله عنه- أن النبي -صلى الله عليه وسلم- قال: «يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ
فِي الدُّنْيَا، فَإِنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا»
আবু উমামা আল-বাহেলী রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, “কুরআন বহনকারীকে কিয়ামতের দিনে বলা হবে তুমি কুরআন পড়তে থাক এবং
উপরে উঠতে থাক, তারলীলসহকারে পড়তে থাক, যেমনিভাবে দুনিয়াতে তারলীলসহকারে তিলাওয়াত
করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ আসন হবে সেখানে তোমার আয়াত তিলাওয়াত শেষ হবে।”[13]
নিঃসন্দেহে কুরআনের সংরক্ষণের এতো
গুরুত্ব এর বিশেষ মর্যাদার জন্যই, কেননা এর তিলাওয়াতে রয়েছে অপরিসীম প্রতিদান।
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে এ উম্মতের গুণাবলী হিসেবে উল্লেখ ছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের
(এ উম্মতের) কিতাব মানুষের অন্তরে সংরক্ষিত রাখবেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা
বলেন,
﴿ وَمَا كُنتَ تَتۡلُواْ مِن قَبۡلِهِۦ مِن كِتَٰبٖ وَلَا تَخُطُّهُۥ بِيَمِينِكَۖ
إِذٗا لَّٱرۡتَابَ ٱلۡمُبۡطِلُونَ ٤٨ بَلۡ هُوَ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ
أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَۚ وَمَا يَجۡحَدُ بَِٔايَٰتِنَآ إِلَّا ٱلظَّٰلِمُونَ ٤٩ ﴾ [العنكبوت: ٤٨، ٤٩]
“আর আপনি তো
এর পূর্বে কোনো কিতাব তিলাওয়াত করেন নি এবং আপনার
নিজের হাতে তা লিখেন নি যে, বাতিলপন্থীরা এতে সন্দেহ পোষণ করবে।
বরং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের
অন্তরে তা সুস্পষ্ট নিদর্শন। আর যালিমরা ছাড়া আমার আয়াতসমূহকে কেউ অস্বীকার করে না।” [সূরা
আল-‘আনকাবূত, আয়াত ৪৮-৪৯]
আল্লাহ
তা‘আলা এখানে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি এ কুরআন উলামাদের অন্তরে সংরক্ষিত রেখেছেন,
নিন্মোক্ত হাদীসে কুদসীতে এর প্রমাণ মিলে,
«إِنَّمَا
بَعَثْتُكَ
لِأَبْتَلِيَكَ
وَأَبْتَلِيَ
بِكَ،
وَأَنْزَلْتُ
عَلَيْكَ
كِتَابًا
لَا
يَغْسِلُهُ
الْمَاءُ،
تَقْرَؤُهُ
نَائِمًا
وَيَقْظَانَ...... »
“আর আল্লাহ
তা‘আলা বলেন, নিশ্চয় আমি আপনাকে পরীক্ষা করা ও আপনার দ্বারা
সৃষ্টিকুলকে পরীক্ষা করা এ দু’উদ্দেশ্যে আপনাকে জগতে প্রেরণ করেছি এবং আমি আপনার
উপর এমন কিতাব নাযিল করেছি যা পানি ধুয়ে মুছে ফেলতে পারে না” [14]।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি কুরআনের কিছুই মুখস্থ করেনি তাকে বিরান (ধ্বংস প্রাপ্ত)
ঘরের সাথে তুলনা করেছেন।
عن
ابن عباس -رضي الله عنهما- قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «إِنَّ الَّذِي لَيْسَ
فِي جَوْفِهِ مِنَ الْقُرْآنِ شَيْءٌ كَالْبَيْتِ الْخَرِبِ».
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যার অন্তরে কুরআনের কিছুই নেই তা একটা বিরান (ধ্বংস প্রাপ্ত)
ঘরের মত।”[15]
আমরা ইতিপূর্বে কুরআনের ধারণকারীর
সম্মান ও মর্যাদার ব্যাপারে কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছি।
মুসলিমের
জন্য কুরআন মুখস্থ করা মুস্তাহাব, তবে ইবাদত সহীহ হওয়ার জন্য যে টুকু দরকার সে
পরিমাণ মুখস্থ করা ফরয।
ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “পুরা
কুরআন মুখস্থ করা, সব অর্থ বুঝা, এবং সব হাদীস জানা প্রত্যেক মুসমানের জন্য ওয়াজিব
নয়। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ হিফয করা, অর্থ বুঝা ও হাদীস জানা ফরয”।
কুরআন
তিলাওয়াতকারী ও হিফযকারীকে কতিপয় বিষয় গুরুত্ব সহকারে খেয়াল রাখা উচিত:
প্রথমত: সে যে কাজ করছে সে কাজে
একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিষ্ঠা সহকারে হওয়া, তাতে দুনিয়ার কোনো স্বার্থ না থাকা,
কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ
أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ
ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ
فِيهَا وَبَٰطِلٞ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٦ ﴾ [هود: ١٦-١٥]
“যে
ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমরা সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল
পুরোপুরি দিয়ে দেই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরাই তারা, আখিরাতে যাদের জন্য
আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে আর তারা যা করত,
তা সম্পূর্ণ বাতিল।” [সূরা হূদ, আয়াত
১৫-১৬]
﴿ مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ
يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ
٢٠ ﴾ [الشورا: ٢٠]
“যে
আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার
ফসল কামনা করে আমরা তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোনো অংশই থাকবে
না”। [সূরা শূরা, আয়াত ২০]
﴿ مَّن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعَاجِلَةَ عَجَّلۡنَا لَهُۥ فِيهَا مَا نَشَآءُ لِمَن
نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهُۥ جَهَنَّمَ يَصۡلَىٰهَا مَذۡمُومٗا مَّدۡحُورٗا ١٨ ﴾ [الاسراء: ١٨]
“যে
দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেই, যা আমি চাই, যার
জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নাম, সেখানে সে
প্রবেশ করবে নিন্দিত, বিতাড়িত অবস্থায়”। [সূরা
আল-ইসরা, আয়াত ১৮]
عن
أبي هريرة - رضي الله عنه-: أن النبي -صلى الله عليه وسلم- قال:« إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ،
فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ:
قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ
يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى
أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ،
فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ:
تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ،
وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ:
هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ
فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ
كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟
قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ
فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ
قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ».
আবু
হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এমন এক ব্যক্তির ব্যাপারে
ফয়সালা হবে যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আনা হবে এবং তাকে যে সব নিয়ামত দেয়া হয়েছিল তাও
তার সামনে পেশ করা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি
যে সব নিয়ামত তোমাকে দিয়েছিলাম তার বিনিময়ে তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, আমি তোমার
পথে জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। তিনি বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তো এ জন্য জিহাদ
করেছ যে, লোকেরা তোমাকে বীর-বাহাদুর বলবে। আর দুনিয়াতে তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার
ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা
হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, সে ইলম অর্জন করেছে, তা লোকদেরকে শিক্ষা
দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং তাকে দেয়া নিয়ামতের কথা তার
সামনে তুলে ধরা হবে, সে তা দেখে চিনতে পারবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি তোমার
নিয়ামতের কি সদ্ব্যবহার করেছো? সে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছি, লোকদেরকে তা শিক্ষা
দিয়েছি এওং তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা
বলছ। বরং তুমি এ উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করেছিলে যে, লোকেরা তোমাকে আলেম বা বিদ্বান
বলবে, এবং কুরআন এ জন্যে পাঠ করেছিলে যে, তোমাকে ক্বারী বলা হবে। আর তা বলাও
হয়েছে। অতঃপর তার সম্বন্ধে নির্দেশ দেয়া হবে এবং তাকে মুখের উপর উপুর করে টেনে
নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তিকে আনা হবে, তাকে অজস্র ধন-
সম্পদ দান করা হয়েছে এবং নানা প্রকারের সম্পদ দেওয়া হয়েছে। তাকে দেওয়া
সুযোগ-সুবিধাগুলো তার সামনে তুলে ধরা হবে। সে তা চিনতে পারবে। আল্লাহ জিজ্ঞেস
করবেন, তোমার এ সম্পদ দ্বারা তুমি কি কাজ করেছ? সে বলবে, যেখানে ব্যয় করলে তুমি
সন্তুষ্ট হবে এমন কোনো খাত আমি বাদ আমি বাদ দেইনি বরং সেখানেই খরচ করেছি তোমার
সন্তুষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। বরং তুমি এ
জন্যেই দান করেছ যে, লোকেরা তোমাকে দাতা বলবে। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ
দেয়া হবে এবং তদনুযায়ী তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” [16]
ইবন
কাইয়্যেম রহ. এ হাদীস উল্লেখ করে বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. কে বলতে
শুনেছি, তিনি বলেছেন, আম্বিয়াকিরামগণ যেমনিভাবে সর্বশ্রেষ্ট মানব, তেমনিভাবে তাদের
মতো বেশ-ভূষা ধারণকারী মিথ্যাবাদিরা হলো সর্বনিকৃষ্ট মানুষ, তারা দাবী করে তারা
তাদের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। নবী রাসূলদের পরে
সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হলো উলামা কিরাম, শহীদগণ, সিদ্দীকগণ ও মুখলিস বান্দাহগণ। আবার
তেমনিভাবে যারা তাদের বেশ-ভূষা ধারণকারী মিথ্যাবাদিরা হলো নিকৃষ্ট মানুষ, তারা
দাবী করে তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু বাস্তবে তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
দ্বিতীয়তঃ
যারা কুরআন হিফয করতে চায় তাদের উচিত বারবার তিলাওয়াত করা ও অনবরত তেলাওয়াত করতে
থাকা; যাতে হিফয ঠিক থাকে। বান্দার সৎ নিয়্যাত থাকলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিফযের পথ
সহজ করে দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَلَقَدۡ يَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرٖ ١٧ ﴾ [القمر: ١٧]
“আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে।
অতএব,
কোনো চিন্তাশীল আছে কি?” [সূরা
ক্বামার, আয়াত ১৭]
তৃতীয়ত:
যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ হিফয করেছে তার উচিত তা নিয়মিত তিলাওয়াত করা ও স্মরণ
রাখা, যাতে ভুলে না যায়। সালাতের মধ্যে তিলাওয়াত করে হিফয ধরে রাখা যায়, কেননা সালাতে
কুরআনের কিছু অংশ পড়বে সে তা ভুলবে না।
عن ابن عمر -رضي الله عنهما- قال: قال
رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «إِنَّمَا مَثَلُ صَاحِبِ الْقُرْآنِ كَمَثَلِ الْإِبِلِ
الْمُعَقَّلَةِ، إِنْ عَاهَدَ عَلَيْهَا أَمْسَكَهَا، وَإِنْ أَطْلَقَهَا ذَهَبَتْ». وَزَادَ فِي حَدِيثِ مُوسَى بْنِ عُقْبَةَ: «وَإِذَا
قَامَ صَاحِبُ الْقُرْآنِ فَقَرَأَهُ بِاللَّيْلِ، وَالنَّهَارِ ذَكَرَهُ، وَإِذَا
لَمْ يَقُمْ بِهِ نَسِيَهُ»
ইবন উমর
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, “কুরআন হিফযকারির উদাহরণ হলো পা বাঁধা উটের মত, যদি এর মালিক এটির প্রতি
লক্ষ্য রাখে তাহলে ধরে রাখতে পারে। আর যদি তার বাঁধন খুলে দেয় তাহলে সেটি ছাড়া
পেয়ে চলে যায়।”
ইমাম
মুসলিম তার রেওয়ায়েতে আরো সংযোগ করেছে, “কুরআনের হাফেয যদি রাতে ও দিনে কুরআন পড়ে
তাহলে তা স্মরণে থাকে, আর যদি তা নিয়ে তা দাঁড়ায় তবে ভুলে যায়।”[17]
চতুর্থত:
পরস্পর তিলাওয়াত করা কুরআন হিফযে খুবই সাহায্য করে। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রতি
বছর একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে পরস্পর কুরআন
তিলাওয়াত শুনাতেন। তবে রাসূলের মৃত্যুর বছর দু’বার শুনিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরস্পরে কুরআন শোনানোর ফযিলত সম্পর্কে বলেছেন:
«وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ
اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ
السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ
اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ....»
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন কোনো এক দল লোক আল্লাহর ঘরে একত্রিত
হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে ও পরস্পরে শোনায়, তখন তাদের উপর আল্লাহর প্রশান্তি নাযিল
হয়, আল্লহর রহমত তাদেরকে বেষ্টন করে রাখে, ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে রাখেন এবং
আল্লাহ তাঁর নিকট যারা আছেন তাদের সাথে তিনি তাদেরকে স্মরণ করেন।”[18]
পঞ্চমত:
আল্লাহর কিতাব হতে মুসলিমের গাফিল হওয়া উচিত নয়। তিলাওয়াত করে খতম করা উচিত।
সালাফগণের অভ্যাস ছিল কুরআন খতম করা। তাদের কেউ কেউ দু’মাসে এক খতম করতেন, কেউ
আবার মাসে এক খতম করতেন, আবার কেউ দশ দিনে, আট দিনে খতম করতেন। অধিকাংশে সাত দিনে
খতম করতেন, আবার কেউ এর চেয়ে কম সময়েও খতম করতেন।
উত্তম
হলো সাত দিনে খতম করা, কেননা তা এক দল সাহাবীদের থেকে প্রমাণিত, যেহেতু তারা
কুরআনকে সাত হিযবে ভাগ করেছেন। প্রতিদিন এক হিযব পরিমাণ পড়তেন।
عن أوس بن حذيفة قال: سَأَلْتُ أَصْحَابَ رَسُولِ
اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَيْفَ يُحَزِّبُونَ الْقُرْآنَ، قَالُوا:
ثَلَاثٌ، وَخَمْسٌ، وَسَبْعٌ، وَتِسْعٌ، وَإِحْدَى عَشْرَةَ، وَثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَحِزْبُ
الْمُفَصَّلِ وَحْدَهُ
আউস ইবন
হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলের সাহাবীদেরকে
জিজ্ঞেস করলাম, তারা কিভাবে কুরআনকে ভাগ করে তিলাওয়াত করেছেন? তারা বললেন, তিন,
পাঁচ, সাত, নয়, এগারো, তেরো এবং হিযবে
মুফাসসল একত্রে[19]।
হিযবে
মুফাসসল হলো সূরায়ে ক্বাফ থেকে কুরআনের শেষ পর্যন্ত। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «اقْرَإِ القُرْآنَ فِي شَهْرٍ»
قُلْتُ: إِنِّي أَجِدُ قُوَّةً حَتَّى قَالَ: «فَاقْرَأْهُ فِي سَبْعٍ وَلاَ تَزِدْ
عَلَى ذَلِكَ»
“তুমি মাসে একবার কুরআন খুতম কর। আমি বললাম, আমি
আরো বেশি পড়ার শক্তি রাখি। তিনি বললেন, তাহলে সাত দিনে খতম কর। এর চেয়ে বেশি
পড়োনা।[20]
আর যে
ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করে সাধারণত সে এতে তাড়াহুড়া করে, পঠিত আয়াতের
অর্থ বুঝে না। একজন মুসলিমের এ কাজ করা ঠিক নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে বলেছেন:
عنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَفْقَهُ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ
فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ»
আব্দুল্লাহ
ইবন আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে
কুরআন খতম করে সে তা বুঝতে পারে না।” [21]
অতঃএব,
সুন্নত হলো কমপক্ষে তিন দিনে কুরআন খতম করা। মানুষ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, কেউ অধিক
জ্ঞানের অধিকারী, সূক্ষ্ম বুঝ সম্পন্ন, দ্রুত পড়তে পারে এবং অল্প ব্যস্ত। এ ধরণের
লোক তার চেয়ে কম দক্ষ লোকের চেয়ে বেশী দ্রুত পড়তে পারে। পূর্ববর্তী উলামা কিরামগণ
রাতের প্রথমভাগে বা দিনের প্রথম প্রহরে কুরআন খতম করা মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা যে
ব্যক্তি রাতে কুরআন খতম করে তার জন্য ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত দো‘আ করতে থাকেন, আর
যে দিনের বেলায় খতম করে তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দো‘আ করতে থাকেন।
এ মতটি
সা‘দ ইবন আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মাওকুফ
সূত্রে বর্ণিত রয়েছে। ইমাম দারাক্বুতনী একে হাসান বলেছেন।”[22]
ষষ্ঠত:
মুসলিমের উচিত সে যা পড়ে তা বুঝার চেষ্টা করা, যাতে সে যা পড়ে তা বুঝে নিতে পারে
আর এতে তার গভীর জ্ঞান ও খুশু‘ও অর্জন হবে। কেননা তিলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য শুধু
তিলাওয়াত করাই না, কেননা শুধু তিলাওয়াত আহলে কিতাবিদের সাথে সাদৃশ্য রাখে, যাদের
ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ
هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨ ﴾ [البقرة: ٧٨]
“আর
তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর,
তারা কেবল তিলাওয়াত ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই
ধারণা করে থাকে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ৭৮]
অর্থাৎ তারা কুরআন পড়ে, কিন্তু এতে কি রয়েছে তার কিছুই জানে না। অথচ আল্লাহ
তা‘আলা গভীর চিন্তা-ভাবনা ও বুঝে শুনে কুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে কুরআনের বিভিন্ন
স্থানে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ قُرۡءَٰنًا عَرَبِيّٗا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٢ ﴾ [يوسف: ٢]
“নিশ্চয়
আমরা একে আরবী কুরআনরূপে নাযিল করেছি;
যাতে তোমরা বুঝতে পার”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত ২]
তিনি আরো বলেছেন:
﴿ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ
أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩ ﴾ [ص: ٢٩]
“আমি আপনার
প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা
করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” [সূরা ছোয়াদ, আয়াত ২৯]
আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন:
﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ ٢٤
﴾ [محمد: ٢٤]
“তবে
কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা- ভাবনা করে না? নাকি
তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?” [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ২৪]
তিনি আরো
বলেছেন:
﴿ أَفَلَمۡ يَدَّبَّرُواْ ٱلۡقَوۡلَ أَمۡ جَآءَهُم مَّا لَمۡ يَأۡتِ ءَابَآءَهُمُ
ٱلۡأَوَّلِينَ ٦٨ ﴾ [المؤمنون: ٦٨]
“তারা কি
এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে যা তাদের
পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি?” [সূরা আল-মু’মিনুন, আয়াত ৬৮]
[কুরআনের
তাফসীর বা ব্যাখ্যা]
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে যেভাবে কুরআনের শব্দ বলে দিয়েছেন
সেভাবে অর্থও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]
“যাতে আপনি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পারেন, যা
তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত ৪৪]
এমনিভাবে তাবে‘য়ীগণ সাহাবীগণ থেকে কুরআন গ্রহণ করেছেন।
মুজাহিদ (রহ.) বলেছেন, আমি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট কুরআন কাছে কুরআন
শিক্ষা করেছি, প্রত্যেক আয়াতে থেমেছি ও তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। এজন্যই ছাওরী
(রহ.) বলেছেন, মুজাহিদের বর্ণনায় কোনো তাফসীর হলে সঠিক হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট।
এখানে উদ্দেশ্য হলো: আল্লাহর কালামের অর্থ বিদ্যমান ও জানা আছে, আলহামদুলিল্লাহ,
অধিকাংশ তাফসীরই লিখিত ও সর্বত্রে পাওয়া যায়। কুরআনের সবচেয়ে বড় তাফসীর বা
ব্যাখ্যা হলো সেটা যা কুরআন দিয়েই করা হয়, কেননা এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, কুরআন একটি
সাদৃশ্যপূর্ণ কিতাব, যা বারবার তিলাওয়াত করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱللَّهُ نَزَّلَ أَحۡسَنَ ٱلۡحَدِيثِ كِتَٰبٗا مُّتَشَٰبِهٗا مَّثَانِيَ ٢٣
﴾ [الزمر: ٢٣]
“আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী, সাদৃশ্যপূর্ণ একটি
কিতাব (আল কুরআন), যা বারবার আবৃত্তি করা হয়”। [সূরা যুমার, আয়াত ২৩] এ আয়াতের
উদ্দেশ্য হলো, কুরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের সাদৃশ, এক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা
করে, একটি ঘটনা এক স্থানে উল্লেখ হলে অন্য স্থানে ব্যাখ্যা করে থাকে। তা কুরআনে
স্পষ্ট (আলহামদুলিল্লাহ)। আল্লাহর তা‘আলার বাণী অধিক স্পষ্ট ও তা উদ্দিষ্ট অর্থে
অধিক ইঙ্গিতবহ; কারণ আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তা বলেছেন, আর তিনিই অধিক জ্ঞাত তাঁর
কথার উদ্দিষ্ট অর্থ সম্পর্কে। সালাফে সালেহীন এ ধরনের (অর্থাৎ কুরআন দিয়ে কুরআনের)
তাফসীরের উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। এর উদাহরণ অনেক, গণনা করে শেষ করা যাবে না।
কুরআনের
দ্বারা কুরআনের তাফসীরের পরের স্তরে আসে হাদীস দ্বারা কুরআনের তাফসীর। কেননা
আল্লাহর পরে আল্লাহর কালাম সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে
বেশী কেউ জানে না। তাঁর উপর কুরআন নাযিল হয়েছে, আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে তা
বর্ণনা করতে আদেশ করেছেন।
এর পরে সাহাবীদের
কথা, যেহেতু তারা কুরআন নাযিলের যুগে বাস করেছেন, রাসূলের থেকে সরাসরি কুরআন
নিয়েছেন।
এর পরে
তাবে‘য়ী ইমামগণের ব্যাখ্যা।
অতঃপর
অন্যান্য তাফসীরকারকদের ব্যাখ্যা যা কুরআন, হাদীস, সাহাবীদের মতের বেশী কাছাকাছি
হয়।
আর যদি এ
ব্যাপারে তাদের কথা পাওয়া না যায় তবে আরবী ভাষার উপযুক্ত অর্থের অধিক কাছাকাছি
অর্থ গ্রহণ করা হবে। কেননা কুরআন আরবী
ভাষায় নাযিল হয়েছে। তাফসীরকারদের মধ্যে যারা ইজতিহাদ ও ইস্তিম্বাতের পদ্ধতি গ্রহণ
করেন, তাদের মতটি যদি বিশুদ্ধ হয় তবে তাদের জন্য রয়েছে দু’টি সাওয়াব। আর ইজতিহাদে
ভুল হলে একটি সাওয়াব।
এখানে
একটি বিষয় সতর্ক করা দরকার যে, মুসলিম ব্যক্তিকে ইলম ব্যতিত আল্লাহর কালাম
ব্যাখ্যা করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অতঃএব না জেনে তার বলা জায়েয নেই যে, এ আয়াতের
তাফসীর এরকম। কেননা তা মহাপাপ, আল্লাহর ব্যাপারে না জেনে মিথ্যাচার, আর আল্লাহ
তা‘আলা তা হারাম করেছেন:
﴿ قُلۡ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَ
وَٱلۡإِثۡمَ وَٱلۡبَغۡيَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَأَن تُشۡرِكُواْ بِٱللَّهِ مَا لَمۡ يُنَزِّلۡ
بِهِۦ سُلۡطَٰنٗا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٣ ﴾ [الاعراف: ٣٣]
“বলুন, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ
পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের
শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উাপরে এমন
কিছু বলা যা তোমরা জান না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ৩৩]
কুরআন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়া উম্মতের উপর ফরযে
কিফায়া। আর যে ব্যক্তি এ কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে সে এ উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি।
عَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ
القُرْآنَ وَعَلَّمَهُ»
উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে নিজে কুরআন
শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়”।[23]
সপ্তমত: যে কুরআন শিক্ষা করেছে তার উচিত সে অনুযায়ী আমল
করা, কেননা তা হলো ইলমের ফলাফল, আসমানী কিতাব নাযিল ও নবী রাসূলদের প্রেরণ এ
উদ্দেশ্যেই। আমল ছাড়া ইলমের কোনো ফায়েদা নেই; বরং ক্ষতিকর। আলী ইবন আবী তালিব
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “ইলম বা জ্ঞান সেটা অনুযায়ী আমল বা
কাজ করাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে; যদি কেউ সে ডাকে সাড়া দেয় তো সে ইলম অবশিষ্ট থাকে, নতুব
সে ইলম চলে যায়”।
যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের ইলম অর্জন করল কিন্তু সে
অনুযায়ী আমল করল না তার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে জানিয়েছেন এবং তার উদাহরণ
নিকৃষ্টভাবে দিয়েছেন, যাতে অন্যরা এরূপ না করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা
বলেছেন,
﴿ وَٱتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَأَ ٱلَّذِيٓ ءَاتَيۡنَٰهُ ءَايَٰتِنَا فَٱنسَلَخَ مِنۡهَا
فَأَتۡبَعَهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ فَكَانَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ١٧٥ وَلَوۡ شِئۡنَالَرَفَعۡنَٰهُ
بِهَا وَلَٰكِنَّهُۥٓ أَخۡلَدَ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُۚ فَمَثَلُهُۥ كَمَثَلِ
ٱلۡكَلۡبِ إِن تَحۡمِلۡ عَلَيۡهِ يَلۡهَثۡ أَوۡ تَتۡرُكۡهُ يَلۡهَثۚ ذَّٰلِكَ مَثَلُ
ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَاۚ فَٱقۡصُصِ ٱلۡقَصَصَ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ
١٧٦ ﴾ [الاعراف: ١٧٥، ١٧٦]
“আর আপনি তাদের উপর সে ব্যক্তির সংবাদ পাঠ কর, যাকে আমরা
আমাদের আয়াতসমূহ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং শয়তান তার
পেছনে লেগেছিল। ফলে সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর আমি ইচ্ছা করলে
উক্ত নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাকে অবশ্যই উচ্চ মর্যাদা দিতাম, কিন্তু সে পৃথিবীর
প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে
কুকুরের মত। যদি তার উপর বোঝা চাপিয়ে দাও তাহলে সে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে অথবা
যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলেও সে জিহবা বের করে হাঁপাবে। এটি হচ্ছে সে কওমের দৃষ্টান্ত
যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে। অতএব তুমি কাহিনী বর্ণনা কর, যাতে তারা
চিন্তা করে।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ১৭৫-১৭৬]
অনুরূপভাবে
আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿ مَثَلُ ٱلَّذِينَ حُمِّلُواْ ٱلتَّوۡرَىٰةَ ثُمَّ لَمۡ يَحۡمِلُوهَا كَمَثَلِ
ٱلۡحِمَارِ يَحۡمِلُ أَسۡفَارَۢاۚ بِئۡسَ مَثَلُ ٱلۡقَوۡمِ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِ
ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥ ﴾ [الجمعة: ٥]
“যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল তারপর তারা তা
বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু কিতাবের বোঝা বহন করে। সে সম্প্রদায়ের উপমা
কতইনা নিকৃষ্ট, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে। আর আল্লাহ যালিম
সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না”। [সূরা আল্-জুমু‘আ, আয়াত ৫]
অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবের এক দলের প্রশংসা
করেছেন, কেননা তারা কিতাব অনুযায়ী আমল করত। আল্লাহ বলেন,
﴿ ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ
يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ ١٢١ ﴾ [البقرة: ١٢١]
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে।
তারাই তার প্রতি ঈমান আনে”। [সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াত ১২১]
অর্থাৎ তারা আল্লাহর হারামকৃত জিনিসকে হারাম মনে করতেন,
আর হালালকে হালাল মনে করতেন। আর তারা আল্লাহর বিধানের বিকৃতি করত না।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, এ উম্মতের যে
ব্যক্তি কুরআন অনুযায়ী আমল করবে না তার বিরুদ্ধে কুরআন দলিল হিসেবে দাঁড়াবে”।
আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আমাদেরকে ঐ সব লোকদের সংবাদ দিয়েছেন যারা বেশী বেশী নামায রোযা ও তিলাওয়াত করত,
অথচ তাদের শেষ পরিণতি খুবই মারাত্মক ছিল।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهُ، أَنَّهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
يَقُولُ: «يَخْرُجُ فِيكُمْ قَوْمٌ تَحْقِرُونَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ، وَصِيَامَكُمْ
مَعَ صِيَامِهِمْ، وَعَمَلَكُمْ مَعَ عَمَلِهِمْ، وَيَقْرَءُونَ القُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ
حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ،
يَنْظُرُ فِي النَّصْلِ فَلاَ يَرَى شَيْئًا، وَيَنْظُرُ فِي القِدْحِ فَلاَ يَرَى
شَيْئًا، وَيَنْظُرُ فِي الرِّيشِ فَلاَ يَرَى شَيْئًا، وَيَتَمَارَى فِي الفُوقِ»
আবু সাঈদ
খুদুরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ ভবিষ্যতে এমন সব লোকের আগমন ঘটবে, যাদের সালাতের তুলনায়
তোমাদের সালাতকে, তাদের রোযার তুলনায় তোমাদের রোযাকে এবং তাদের আমলের তুলনায়
তোমাদের আমলকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করবে; কিন্তু তা তাদের কন্ঠনালীর
নিচে প্রবেশ করবে না (অর্থাৎ অন্তরে প্রবেশ করবে না এবং তা লোক দেখানো হবে)। এরা
দ্বীন (ইসলাম) থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে
যায়। আর অন্য শিকারী সেই তীরের অগ্রভাগ পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তাতে কোনো চিহ্ন
নেই। সে তীরের ফলার পার্শ্বদেশদ্বয়েও নজর করে অথচ সেখানে কিছু দেখতে পায় না।
অবশেষে ঐ ব্যক্তি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তীরের নিম্নভাগে সন্দেহ পোষণ করে”।[24]
সালফে
সালেহীন সাহাবাগণের অভ্যাস ছিল, তারা কুরআন হিফযের চেয়ে যতটুকু শিক্ষা করেছে সে
অনুযায়ী আমল করতে বেশী উৎসাহী ছিল। আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামী (রহ.) বলেছেন,
আমাদেরকে সে সব সাহাবারা বর্ণনা করেছেন যারা আমাদেরকে কুরআন শিখিয়েছেন, যেমন উসমান
ইবন আফফান, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ প্রভৃতি। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম থেকে দশটি আয়াত শিখলে যতক্ষণ না এর সব ইলম ও আমল শেষ না হতো ততক্ষণ
সামনে এগুতেন না। তারা বলেছেন: এভাবে আমরা ইলম ও আমল উভয়সহকারে কুরআন শিখেছি।
ইমাম আহমদ তার মুসনাদে এ হাদীসটি
এভাবে বর্ণনা করেছেন,
عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ: حَدَّثَنَا
مَنْ كَانَ يُقْرِئُنَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
أَنَّهُمْ كَانُوا " يَقْتَرِئُونَ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ "، فَلَا يَأْخُذُونَ فِي الْعَشْرِ الْأُخْرَى حَتَّى
يَعْلَمُوا مَا فِي هَذِهِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْعَمَلِ، قَالُوا: فَعَلِمْنَا الْعِلْمَ
وَالْعَمَلَ
আবু আব্দুর রহমান (রহ.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদেরকে সাহাবীদের সে সব
কারীগণ বর্ণানা করেছেন যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে কুরআন পড়েছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের থেকে দশটি আয়াত পড়ে নিতেন, যতক্ষণ সে সব আয়াতের উপর আমল না হতো
ততক্ষণ অন্য দশ আয়াত নিতেন না। তারা বলতেন, এভাবে আমরা ইলম ও আমল শিখেছি। [25]
এজন্যই তারা একটি সূরা হিফয করতে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত করতেন। আনাস
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, কোনো ব্যক্তি সূরা বাকারা ও আলে-ইমরান পড়লে তা আমাদের
কাছে অনেক বড় মনে হতো।
মুয়াত্তায়ে মালেকে এসেছে, ইমাম মালেকের কাছে সংবাদ
পৌঁছেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূরা বাকারা আট বছর ধরে শিক্ষা
করেছেন।[26]
এভাবেই
আমরা দেখি যে, সাহাবীদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর কিতাব অর্থসহকারে
চিন্তাভাবনা ও আমলের মাধ্যমে শিক্ষা করা, শুধু শব্দ হিফয করা তাদের লক্ষ্য ছিল না।
অষ্টমত: মুসলিমের
কুরআন পরিত্যাগ করা উচিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ
مَهۡجُورٗا ٣٠﴾ [الفرقان: ٢٩]
“আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে
পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ২৯]
ইবন
কাইয়্যেম (রহ.) কুরআন পরিত্যাগ করার কয়েকটি প্রকার উল্লেখ করেছেন, তাহলো:
প্রথম:
কুরআন শ্রবণ থেকে বিরত থাকা, এর উপর ঈমান না আনা ও এতে মনোযোগ না দেয়া।
দ্বিতীয়:
এর আমল ত্যাগ করা, এর হালাল-হারাম অনুযায়ী আমল না করা, যদিও তা পড়া ও ঈমান আনা হয়।
তৃতীয়:
দ্বীনের মূল ও শাখা প্রশাখায় এর বিধান বর্জন করা, অনুরূপ এ বিশ্বাস করা যে, তা দ্বারা
ইলমে ইয়াকীন তথা দৃঢ় জ্ঞান অর্জিত হয় না, এর দলীল শব্দগত; যা দ্বারা দৃঢ় জ্ঞান লাভ
হয় না, এরূপ মনে করা।
চতুর্থ:
এর গভীর চিন্তা-ভাবনা, অনুধাবন ও আল্লাহর উদ্দিষ্ট অর্থ জানার প্রচেষ্টা থেকে বিরত
থাকা।
পঞ্চম: অন্তরের
সব রোগ-ব্যাধি ও এর নিরাময় হিসেবে কুরআনকে গ্রহণ না করা। ফলে কুরআন ছাড়া অন্যত্রে
এ সব রোগের নিরাময় খোঁজা, এর দ্বারা নিরাময় না খোঁজা। এ সব কিছুই আল্লাহর
নিন্মোক্ত বাণীর অন্তর্ভুক্ত:
﴿ وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ
مَهۡجُورٗا ٣٠ ﴾ [الفرقان: ٢٩]
“আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে
পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ২৯]
যদিও উপরোক্ত
পরিত্যাগের প্রকারসমূহের মধ্যে কোনো কোনোটি অপরটির চেয়ে মারাত্মক।
[কুরআন তেলাওয়াতের আদাব]
কুরআন
তিলাওয়াতকারীর জন্য কতিপয় নিয়ম কানুন তথা শিষ্টাচার রয়েছে, যা তিলাওয়াতের সময়
বাস্তবায়ন করা উচিত। সেগুলো হলো:
প্রথমত:
আল্লাহর কালামের সম্মানে এর তিলাওয়াত সময় সর্বোত্তম অবস্থায় থাকা উচিত,
পাক-পবিত্র, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে তিলাওয়াত করা। পবিত্র অবস্থায় তিলাওয়াত করা
মুস্তাহাব। অপবিত্রাবস্থায় (যার গোসল ফরয নয়) তিলাওয়াত করতে অসুবিধে নেই। কেননা
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মুখমণ্ডল ধৌত করলেন
এবং আলে-ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করেন, তিনি অযু করেন নি।
তাছাড়া উমর
ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এসেছে, তিনি
كَانَ فِي قَوْمٍ وَهُمْ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ
فَذَهَبَ لِحَاجَتِهِ، ثُمَّ رَجَعَ وَهُوَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ. فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ:
يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، أَتَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَلَسْتَ عَلَى وُضُوءٍ؟ فَقَالَ
لَهُ عُمَرُ: «مَنْ أَفْتَاكَ بِهَذَا أَمُسَيْلِمَةُ»
একবার
একদল লোকের মাঝে ছিলেন, তারা কুরআন তিলাওয়াত করছিলো, অতঃপর তিনি ইস্তেঞ্জায় গেলেন,
সেখান থেকে ফিরে কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। এক ব্যক্তি তাকে বললেন: হে আমীরুল
মু’মিনূন! আপনি অযু না করে কুরআন তিলাওয়াত করছেন? তিনি তাকে বললেন: কে তোমাকে এ
ফতওয়া দিয়েছে? মুসাইলামা কি একথা বলেছে?! [27]
ইবন
আব্দুল বার বলেন: এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, অযু ছাড়া কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয, যদি
জুনুবী (গভীর অপবিত্রতা বা ফরয গোসলের অবস্থা) না হয়। অতি অল্প সংখ্যক ব্যতীত
প্রায় সব সম্মানিত আলেম এ মত পোষণ করেন। সালাফে সালেহীন সাহাবীদের মধ্যে উমর
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ মতের পৃষ্ঠপোষক, আর এটাই আমাদের জন্য
যথেষ্ট।
অযু
বিহীন কুরআন তিলাওয়াত জায়েযের ব্যাপারে ইমাম নববী ও ইবন তাইমিয়াহ (রহ.) ইজমা
উল্লেখ করেছেন। আর অপবিত্র (যার গোসল ফরয সে) ব্যক্তির জন্য গোসল করা ব্যতীত তিলাওয়াত
করা জায়েয নেই। কেননা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
عَنْ عَلِيٍّ قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ «لَا يَحْجُبُهُ عَنْ قِرَاءَةِ
الْقُرْآنِ شَيْءٌ إِلَّا أَنْ يَكُونَ جُنُبًا»
তিনি
বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জুনুবী ছাড়া কোনো কিছু কুরআন
তিলাওয়াত থেকে বিরত রাখতো না”।
এ
ব্যাপারে অনেক হাদীস আছে, একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করে। অধিকাংশ ফিকহবিদ এ মত পোষণ
করেন। এমনকি ইবন আব্দুল বার (রহ.) বলেছেন, “দাউদ যাহেরী জুনুবী অবস্থায় কুরআন
তিলাওয়াত জায়েয বলে উলামা কিরামদের দল থেকে বেরিয়ে গেছেন”।
আর হায়েযগ্রস্তদের
জন্য হায়েয অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয, কেননা তাদেরকে নিষেধ করার ব্যাপারে
কোনো হাদীস আসেনি। অন্যদিকে জুনুবীর উপর কিয়াস করা সহীহ নয়, কেননা হায়েযের
অপবিত্রতা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর এ সময়ে তার জন্য কুরআন ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা
থাকে, পক্ষান্তরে জুনুবীর অপবিত্রতা স্বল্প মেয়াদী, যখন খুশী গোসল করে পবিত্র হওয়া
যায়।
আর কুরআন
স্পর্শের ব্যাপারে কথা হলো, ছোট বড় উভয় প্রকার অপবিত্রাবস্থায় ধরা যাবে না। কেননা
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ٧٩ ﴾ [الواقعة: ٧٩]
“কেউ
তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া”। (সূরা আল-ওয়াকি‘আ, আয়াত
৭৯)
এছাড়া
‘আমর ইবন হাযাম এর কিতাবে লিখা ছিল:
أَنْ لاَ يَمَسَّ الْقُرَآنَ إِلاَّ طَاهِرٌ.
“পবিত্র অবস্থা ছাড়া কুরআন
স্পর্শ করবে না”। ইবন
আব্দুল বার রহ. বলেন, ‘আমর ইবন হাযাম এর কিতাব উলামায়ে কিরামগণ গ্রহণ করেছেন ও সে
অনুযায়ী আমল করেন। তা তাদের নিকট প্রসিদ্ধ ও সুস্পষ্ট যা এক সনদে মুত্তাসিল। অতঃপর
তিনি বলেছেন, “ফকীহগণ একমত যে, পবিত্রগণ ছাড়া কেউ
কুরআন স্পর্শ করবে না”। [28]
দ্বিতীয়:
কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে আউযু বিল্লাহ পড়া মুস্তাহাব। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ فَإِذَا قَرَأۡتَ ٱلۡقُرۡءَانَ فَٱسۡتَعِذۡ
بِٱللَّهِ مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ ٱلرَّجِيمِ ٩٨ ﴾ [النحل: ٩٨]
“সুতরাং
যখন তুমি কুরআন পড়বে তখন আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে পানাহ চাও”। [সূরা নাহল,
আয়াত ৯৮]
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
পড়া, কেউ কেউ আবার أعوذ بالله السميع
العليم من الشيطان الرجيم
পড়েন। উভয়টিই সহীহ।
তৃতীয়ত:
তিলাওয়াতকারীকে প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম পড়া, সূরায়ে
তাওবা ছাড়া। কেননা বিসমিল্লাহ কুরআনের আয়াত, যা দু’সূরার মাঝে পার্থক্য করতে
এসেছে। সাহাবীগণ থেকে সূরা তাওবা ব্যতীত অন্যান্য সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া সাব্যস্ত আছে।
চতুর্থত:
পাঠককে ধীরে ধীরে সাবলীল, তারতীলসহকারে চিন্তাভাবনা করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَقُرۡءَانٗا فَرَقۡنَٰهُ لِتَقۡرَأَهُۥ عَلَى ٱلنَّاسِ عَلَىٰ مُكۡثٖ وَنَزَّلۡنَٰهُ
تَنزِيلٗا ١٠٦ ﴾ [الاسراء: ١٠٦]
“আর
কুরআন, আমরা তা নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার
ধীরে ধীরে; আর আমরা তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে”। [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১০৬]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، فِي قَوْلِهِ عَزَّ وَجَلَّ:
{لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ} [القيامة: 16] قَالَ: «كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا نَزَلَ عَلَيْهِ جِبْرِيلُ بِالْوَحْيِ كَانَ مِمَّا يُحَرِّكُ
بِهِ لِسَانَهُ وَشَفَتَيْهِ فَيَشْتَدُّ عَلَيْهِ، فَكَانَ ذَلِكَ يُعْرَفُ مِنْهُ»،
فَأَنْزَلَ اللهُ تَعَالَى: {لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ} [القيامة:
16] أَخْذَهُ {إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ} [القيامة: 17] وَقُرْآنَهُ إِنَّ عَلَيْنَا
أَنْ نَجْمَعَهُ فِي صَدْرِكَ وَقُرْآنَهُ فَتَقْرَؤُهُ {فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ
قُرْآنَهُ} [القيامة: 18] قَالَ: أَنْزَلْنَاهُ فَاسْتَمِعْ لَهُ {إِنَّ عَلَيْنَا
بَيَانَهُ} [القيامة: 19] أَنْ نُبَيِّنَهُ بِلِسَانِكَ فَكَانَ إِذَا أَتَاهُ جِبْرِيلُ
أَطْرَقَ فَإِذَا ذَهَبَ قَرَأَهُ كَمَا وَعَدَهُ اللهُ
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে
নিন্মোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে:
﴿ لَا تُحَرِّكۡ بِهِۦ لِسَانَكَ لِتَعۡجَلَ بِهِۦٓ ١٦ ﴾ [القيامة: ١٦]
“কুরআন
তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহ্বাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না”। [সূরা
কিয়ামাহ, আয়াত ১৬] তিনি বলেন: জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের ওপর ওহী নাযিল করতেন তিনি তা আয়াত্ত করার জন্য জিহ্বা ও ঠোঁট নাড়তেন।
এটা তাঁর জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ত। তাঁর অবস্থা থেকেই এটা প্রতিভাত হত। এর
পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করলেন: “কুরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে
তুমি তোমার জিহ্বাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না।”। [সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৬] অর্থাৎ এটা
তোমার অন্তরে পুঞ্জিভূত করে দেওয়া এবং পড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। অতএব আমরা যখন
তা পাঠ করতে থাকি তখন তুমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক। অর্থাৎ এই ওহী আমরাই নাযিল
করছি, তুমি তা মনোনিবেশ সহকারে শুনো। এর তাৎপর্য বুঝিয়ে দেয়া আমাদেরই দায়িত্ব,
অর্থাৎ তোমার মুখ দিয়ে তা বলিয়ে দেওয়া আমাদেরই দায়িত্ব। এরপর থেকে যখন জিবরীল আলাইহিস
সালাম তাঁর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন, তিনি মনোযোগ সহকারে তা শুনতেন। তিনি চলে যাওয়ার
পর মহান আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা পাঠ
করতেন। [29]
সহীহ বুখারীতে আরো উল্লেখ আছে,
قَالَ رَجُلٌ: قَرَأْتُ المُفَصَّلَ البَارِحَةَ،
فَقَالَ: «هَذًّا كَهَذِّ الشِّعْرِ إِنَّا قَدْ سَمِعْنَا القِرَاءَةَ، وَإِنِّي لَأَحْفَظُ
القُرَنَاءَ الَّتِي كَانَ يَقْرَأُ بِهِنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
ثَمَانِيَ عَشْرَةَ سُورَةً مِنَ المُفَصَّلِ، وَسُورَتَيْنِ مِنْ آلِ حم»
“এক লোক ইবন মাসউদ
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কে বললেন: গত রাতে আমি মুফাসসাল সূরা পাঠ করেছি। এ কথা শুনে
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি পাঠ কর যেন
কবিতা পাঠ করার মতো; অথচ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাঠ শুনেছি এবং তা আমার ভালভাবে স্মরণ আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সব সূরা পাঠ করতে আমি শুনেছি তার সংখ্যা মুফাস্সাল হতে
একসাথে আঠারটি এবং হা-মীম যুক্ত সূরা হতে দু’টি”।[30]
কোনো
কোনো বর্ণনায় এসেছে, লোকটি মুফাস্সল সূরাগুলো এক রাকা‘আতে পড়েছিল। [31]
আবু
দাউদের বর্ণনায় ‘সমজাতীয় (সমান দীর্ঘ) সূরা’র কথা উল্লেখ আছে। তাতে এসেছে,
«لَكِنَّ
النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْرَأُ النَّظَائِرَ السُّورَتَيْنِ
فِي رَكْعَةٍ، الرَّحْمَنَ وَالنَّجْمَ فِي رَكْعَةٍ، وَاقْتَرَبَتْ وَالْحَاقَّةَ
فِي رَكْعَةٍ، وَالطُّورَ وَالذَّارِيَاتِ فِي رَكْعَةٍ، وَإِذَا وَقَعَتْ، وَنُونَ
فِي رَكْعَةٍ، وَسَأَلَ سَائِلٌ وَالنَّازِعَاتِ فِي رَكْعَةٍ، وَوَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ
وَعَبَسَ فِي رَكْعَةٍ، وَالْمُدَّثِّرَ وَالْمُزَّمِّلَ فِي رَكْعَةٍ، وَهَلْ أَتَى
وَلَا أُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فِي رَكْعَةٍ، وَعَمَّ يَتَسَاءَلُونَ وَالْمُرْسَلَاتِ
فِي رَكْعَةٍ، وَالدُّخَانَ وَإِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ فِي رَكْعَةٍ»
“কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সমজাতীয় (সমান দীর্ঘ) দু’টি সূরা এক রাকাতে পড়তেন। সূরা আন-নাজম ও আর-রহমান এক
রাকাতে, সূরা আল-কামার ও আল-হাক্কা এক রাকাতে, সূরা আত-তুর ও যারিয়াত এক রাকাতে,
ওয়াক্বিয়া ও নূন এক রাকাতে, সূরা মা‘আরিজ ও নাযিয়াত এক রাকাতে, সূরা মুতাফফিফীন ও
আবাসা এক রাকাতে, সূরা মুদ্দাসির ও মুযযাম্মিল এক রাকাতে, সূরা ইনসান ও কিয়ামাহ এক
রাকাতে, সূরা নাবা’ ও মুরসালাত এক রাকাতে, এবং সূরা দুখান ও তাকবীর এক রাকাতে পড়তেন”। [32]
সুন্নত
হলো কুরআন শরীফ টেনে টেনে (মাদ্দ) পড়া। সহীহ বুখারীতে এসেছে,
عَنْ قَتَادَةَ، قَالَ: سُئِلَ أَنَسٌ كَيْفَ
كَانَتْ قِرَاءَةُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَ: «كَانَتْ
مَدًّا»، ثُمَّ قَرَأَ: {بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ} [الفاتحة: 1] يَمُدُّ
بِبِسْمِ اللَّهِ، وَيَمُدُّ بِالرَّحْمَنِ، وَيَمُدُّ بِالرَّحِيمِ
“আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টেনে
টেনে (মাদ্দসহকারে) পড়তেন। অতঃপর তিনি পড়লেন:
بسم الله الرحمن الرحيم
, তিনি بسم الله
তে , الرحمن
ও الرحيم
শব্দে মাদ্দ করে টেনে টেনে পড়েছেন। [33]
পঞ্চমত:
তিলাওয়াতকারীর জন্য মুস্তাহাব হলো সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করা।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ،
أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَمْ
يَأْذَنِ اللَّهُ لِشَيْءٍ مَا أَذِنَ لِلنَّبِيِّ أَنْ يَتَغَنَّى بِالقُرْآنِ»
আবু
হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ নবীকে এমন কিছুর অনুমতি দেননি, যা আমাকে দিয়েছেন,
আর তা হলো কুরআন তিলাওয়াত সুষ্পষ্ট
ও মধুর সুরে করা।[34]
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ: «لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالقُرْآنِ»
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি সূর
করে ভালো
আওয়াজে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের
নয়।[35]
আবু মূসা
আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:
«يَا
أَبَا مُوسَى لَقَدْ أُوتِيتَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ آلِ دَاوُدَ»
“হে আবূ মূসা, তোমাকে হযরত দাঊদ (আলাইহিস সালাম) এর সুমধুর কন্ঠ
দান করা হয়েছে”।[36]
ষষ্ঠত:
কুরআন তিলাওয়াতের সময় কান্না করা মুস্তাহাব। আল্লাহ তা‘আলা এগুণের অধিকারীকে
প্রশংসা করে বলেছেন:
﴿ وَيَخِرُّونَ لِلۡأَذۡقَانِ يَبۡكُونَ وَيَزِيدُهُمۡ خُشُوعٗا۩ ١٠٩ ﴾ [الاسراء: ١٠٩]
‘আর তারা
কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে”। [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত
১০৯]
আল্লাহ
তাঁর নবীদের গুণকীর্তন করে বলেছেন:
﴿إِذَا تُتۡلَىٰ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُ ٱلرَّحۡمَٰنِ خَرُّواْۤ سُجَّدٗاۤ وَبُكِيّٗا۩
٥٨ ﴾ [مريم: ٥٨]
“যখন
তাদের কাছে পরম করুণাময়ের আয়াতসমূহ পাঠ করা হত, তারা কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে
পড়ত”। [সূরা মারইয়াম, আয়াত ৫৮]
সহীহ বুখারীতে এসেছে:
عَنْ عَمْرِو بْنِ مُرَّةَ - قَالَ: قَالَ
لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «اقْرَأْ عَلَيَّ» قُلْتُ: آقْرَأُ
عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ؟ قَالَ: «فَإِنِّي أُحِبُّ أَنْ أَسْمَعَهُ مِنْ غَيْرِي»
فَقَرَأْتُ عَلَيْهِ سُورَةَ النِّسَاءِ، حَتَّى بَلَغْتُ: {فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا
مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلاَءِ شَهِيدًا} [النساء:
41] قَالَ: «أَمْسِكْ» فَإِذَا عَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ
‘আমর ইবন মুররাহ রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু বলেন,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন: আমার কাছে কুরআন পাঠ কর। আমি বললাম, আমি
আপনার কাছে পাঠ করব? অথচ তা আপনার কাছেই অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, অন্যের মুখে
শ্রবণ করাকে আমি পছন্দ করি। এরপর আমি তাঁর নিকট ‘সূরা নিসা’ পড়লাম, যখন আমি
পর্যন্ত পাঠ করলাম,
﴿ فَكَيۡفَ إِذَا جِئۡنَا مِن كُلِّ أُمَّةِۢ بِشَهِيدٖ وَجِئۡنَا بِكَ عَلَىٰ
هَٰٓؤُلَآءِ شَهِيدٗا ٤١ ﴾ [النساء: ٤١]
“অতএব কেমন হবে যখন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন
সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে উপস্থিত করব তাদের উপর সাক্ষীরূপে?” [সূরা নিসা, আয়াত
৪১] তিনি বললেন, থাম, থাম, তখন তাঁর দুচোখ থেকে
টপ টপ করে অশ্রু নির্গত হচ্ছিল।[37]
عَنْ مُطَرِّفِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ
أَبِيهِ قَالَ: «رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يصلي وَفِي صَدْرِهِ
أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الْمِرْجَلِ مِنَ الْبُكَاءِ»
মুসনাদে
আহমদে মুতাররিফ ইবন আব্দুল্লাহ তাঁর পিতার থেকে বর্ণনা করেন, “আমি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামাযে দেখলাম, তিনি নামাযে এমনভাবে কাঁদছিলেন
যে, যেন তাঁর বক্ষ থেকে ডেকচি (হাঁড়ি-পাতিল) এর গুঞ্জনের মত আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল”। [38]
বুখারীতে
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন
অসুস্থাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নামায পড়াতে বললেন, তখন আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন:
قَالَتْ عَائِشَةُ: إِنَّهُ رَجُلٌ رَقِيقٌ،
إِذَا قَامَ مَقَامَكَ لَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ
তিনি (আবু
বকর) অতি নরম হৃদয়ের অধিকারী, তিনি আপনার স্থানে দাঁড়িয়ে লোকদের নিয়ে (কান্নার
কারণে) নামায পড়াতে পারবেন না। [39]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, কান্নার কারণে লোকদের নিয়ে নামায পড়াতে পারবেন না।
উমর
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন নামায পড়তেন তখন তাঁর কান্নার আওয়াজ পিছনের কাতার থেকেও
শুনা যেত। আবু রাজা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে
দেখেছি কান্নার কারণে তাঁর চোখের নিচে ফিতার মত জীর্ন দাগ পড়ে গেছে। এজন্যই ইমাম নাওয়াওয়ী
(রহ.) ক্বিরাত পড়া অবস্থায় কান্নাকে বলেছেন: তা আল্লাহ ওয়ালা ও সালেহীন বান্দাহদের
বৈশিষ্ট্য [40]।
একথা
জেনে রাখা উচিত যে, তিলাওয়াতের সময় কান্না করা বা কান্নার ভাব করা উভয়টিই
প্রশংসনীয়, যদি তা আল্লাহর কিতাব চিন্তা-গবেষণা করা ও অন্তরে আল্লাহর ভয় থেকে হয়।
আর এটা আল্লাহর প্রতি বান্দার পূর্ণ ঈমানের কথাই প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা
বলেছেন:
﴿ ٱللَّهُ نَزَّلَ أَحۡسَنَ ٱلۡحَدِيثِ كِتَٰبٗا مُّتَشَٰبِهٗا مَّثَانِيَ تَقۡشَعِرُّ
مِنۡهُ جُلُودُ ٱلَّذِينَ يَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمۡ وَقُلُوبُهُمۡ
إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ ٢٣ ﴾ [الزمر: ٢٣]
আল্লাহ
নাযিল করেছেন উত্তম বাণী, সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কিতাব (আল কুরআন), যা বারবার আবৃত্তি
করা হয়। যারা তাদের রবকে ভয় করে, তাদের গা এতে শিহরিত হয়, তারপর তাদের দেহ ও মন
আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়ে যায়। [সূরা আয-যুমার, আয়াত ২৩]
তবে
লৌকিকতা ও খ্যাতির জন্য কান্নার ভান করা থেকে মুসলিমকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এটা
খুবই ভয়ংকর ও বান্দার উপর শয়তানের দখলদারিত্ব।
সপ্তমত:
তিলাওয়ারকারীর জন্য মুস্তাহাব হলো ফরয নামায ব্যতীত তিলাওয়াতের সময় রহমতের আয়াত
আসলে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ কামনা করা, আর আযাবের আয়াত পড়লে তা থেকে পানাহ চাওয়া।
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ، فَقُلْتُ:
يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ، ثُمَّ مَضَى، فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ،
فَمَضَى، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ بِهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ النِّسَاءَ، فَقَرَأَهَا، ثُمَّ
افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ، فَقَرَأَهَا، يَقْرَأُ مُتَرَسِّلًا، إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ
فِيهَا تَسْبِيحٌ سَبَّحَ، وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ
تَعَوَّذَ»
হুযাইফা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: এক রাতে আমি নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাহাজ্জুদের নামায পড়লাম। তিনি সূরা বাকারা পড়তে শুরু
করলে আমি ভাবলাম তিনি হয়তো একশ আয়াত পড়ে রুকু করবেন। কিন্তু এর পরেও তিনি পড়তে
লাগলেন। তখন আমি মনে মনে ভাবলাম তিনি এর (সূরা বাকারা) এক রাকাতে পড়বেন। কিন্তু
তিনি এরপরেও পড়তে থাকলে আমি ভাবলাম সূরাটি শেষ করে তিনি রুকু করবেন। কিন্তু তিনি সূরা
শেষ করার পরও রুকু না করে এরপরে সূরা নিসা পড়তে শুরু করলেন এবং শেষ করে সূরা
আলে-ইমরান শুরু করলেন। এ সূরাটিও তিনি পড়লেন। তিনি থেমে থেমে ধীরে ধীরে পড়ছিলেন।
তাসবীহর উল্লেখ আছে এমন আয়াত যখন তিনি পড়ছিলেন তখন তাসবীহ পড়ছিলেন। যখন কিছু
চাওয়ার আয়াত পড়ছিলেন তখন প্রার্থনা করছিলেন। আবার যখন আশ্রয় প্রার্থনা করার কোনো আয়াত
পড়ছিলেন তখন আশ্রয় প্রার্থনা করছিলেন। [41]
অষ্টমত:
মুসলিমের উচিত কুরআনের হিফয ধরে রাখা, বার বার তা পড়া। যদি কোনো আয়াত ভুলে যায় তবে
এ কথা বলা উচিত নয় যে, আমি তা ভুলে গেছি, বরং বলবে, আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া
হয়েছে।
يقول النبي -صلى الله عليه وسلم-: « بِئْسَ
مَا لِأَحَدِهِمْ يَقُولُ: نَسِيتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ، بَلْ هُوَ نُسِّيَ »
রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কোনো লোক এ কথা বলা অনেক খারাপ যে, আমি
অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। [42]
এখানে
ভুলে গেছি বলতে নিষেধ করা হয়েছে কেননা এতে আল্লাহর কালামের প্রতি অবহেলা, অযত্ন
বুঝায়। মুসলিমের তো উচিত সে সর্বদা আল্লাহর কালামের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
নবমত:
হাঁটা, দাঁড়ানো বা শোয়া অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করতে কোনো অসুবিধে নেই।
عن عَبْد اللَّهِ بْنَ مُغَفَّلٍ، قَالَ: «رَأَيْتُ
النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ وَهُوَ عَلَى نَاقَتِهِ أَوْ
جَمَلِهِ، وَهِيَ تَسِيرُ بِهِ، وَهُوَ يَقْرَأُ سُورَةَ الفَتْحِ - أَوْ مِنْ سُورَةِ
الفَتْحِ - قِرَاءَةً لَيِّنَةً يَقْرَأُ وَهُوَ يُرَجِّعُ»
আব্দুল্লাহ
ইবন মুগাফ্ফাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উটের পিঠে সাওয়ারী অবস্থায় কুরআন পড়তে দেখেছি। তখন তিনি সূরা
ফাতহ বা সূরা ফাতহের কিছু আয়াত আস্তে আস্তে পড়ছিলেন। তিনি বার বার করে টেনে টেনে
তা তিলাওয়াত করছিলেন। [43]
বুখারী ও
মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত,
عن عائشة - رضي الله عنها- قالت: «كَانَ يَتَّكِئُ فِي حَجْرِي وَأَنَا حَائِضٌ، ثُمَّ
يَقْرَأُ القُرْآنَ»
আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার হায়েয অবস্থায় আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। [44]
আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত তিনি খাটে শুয়ে শুয়ে এক হিজব পড়তেন।
আবু মূসা
আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি নামাযে ও বিছানায় উভয়
অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করি।
দশমত: মুসলিমের
উচিত যতক্ষণ মন চায় ততক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করা, মনের বিরুদ্ধে জোর করে তিলাওয়াত
করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বুখারীতে এসেছে:
عَنْ جُنْدَبِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنِ النَّبِيِّ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «اقْرَءُوا القُرْآنَ مَا ائْتَلَفَتْ قُلُوبُكُمْ،
فَإِذَا اخْتَلَفْتُمْ فَقُومُوا عَنْهُ»
জুনদুব
ইবন আব্দুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তোমরা
যতক্ষণ মন চায় তিলাওয়াত কর এবং মন যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন ছেড়ে দাও। [45] এটা এজন্য যে, যাতে মনের সাথে মতানৈক্য ও
বিচ্ছেদ না হয়।
একাদশতম:
তিলাওয়াতকারীকে সিজদায়ে তিলাওয়াতের আয়াতের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অধিকাংশ আলেমগণের
মতে তিলাওয়াতের সিজদা দেওয়া মুস্তাহাব। কেননা হাদীসে এসেছে:
أنعُمَرَ بْن الخَطَّاب رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَرَأَ يَوْمَ الجُمُعَةِ عَلَى
المِنْبَرِ بِسُورَةِ النَّحْلِ حَتَّى إِذَا جَاءَ السَّجْدَةَ نَزَلَ، فَسَجَدَ وَسَجَدَ
النَّاسُ حَتَّى إِذَا كَانَتِ الجُمُعَةُ القَابِلَةُ قَرَأَ بِهَا، حَتَّى إِذَا
جَاءَ السَّجْدَةَ، قَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا نَمُرُّ بِالسُّجُودِ، فَمَنْ
سَجَدَ، فَقَدْ أَصَابَ وَمَنْ لَمْ يَسْجُدْ، فَلاَ إِثْمَ عَلَيْهِ وَلَمْ يَسْجُدْ
عُمَرُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ»
একদা উমর
ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জুমার দিনে মিম্বারে সূরা আন-নাহল পড়ছিলেন, সিজদার
আয়াত আসলে মিম্বার থেকে নেমে সিজদা দিলেন, লোকজনও তাঁর সাথে সিজদা দিলেন। পরবর্তী
জুমাতে তিনি উক্ত সূরা আবার তিলাওয়াত করলেন, সিজদার আয়াত আসলে তিনি লোকদেরকে
বললেন: হে লোক সকল, আমি সিজদার আয়াত অতিক্রম করছি, সুতরাং যে ব্যক্তি সিজদা দিবে
সে ঠিক করল, আর যে সিজদা করল না তার কোনো গুনাহ হবে না। উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সে
দিন সিজদা দেননি। [46]
তিলাওয়াতকারী
ও শ্রোতা উভয়কেই এ সিজদা দিতে হয়।
কুরআনের
হাফেযকে উত্তম চরিত্র ও সর্বোত্তম গুনাবলীর অধিকারী হতে হবে। আল্লাহর কিতাবের
সম্মানে কুরআনে যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনুরূপ তার জন্য
উচিত হচ্ছে, হীন উপার্জন থেকে নিজেকে বিরত থাকা। আজেবাজে কথাবার্তা থেকে বেঁচে
থাকা ও সর্বদা আল্লাহর বিনয়ী বান্দা হওয়া। এককথায়, তার চরিত্র হওয়া উচিত
আল-কুরআন, যেমনটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র, যা আয়েশা
রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহর
কিতাব ধারণকারীকে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত গুনাবলী
থাকা উচিত। তিনি বলেছেন: কুরআনের হাফেযকে রাত্রি জাগরণ করা উচিত যখন লোকজন ঘুমায়,
দিনে রোযা থাকা উচিত যখন লোকজন পানাহার করে, মানুষ যখন আনন্দ করে তখন তার
চিন্তা-ভাবনা করা উচিত, মানুষ হাসলে তার কাঁদা উচিত, তারা যখন ঝগড়া বিবাদ করে তখন
তাদের চুপ থাকা উচিত, তারা যখন অহংকার করে তাদেরকে বিনয়ী হওয়া উচিত।
কুরআনের
হাফেযের জন্য উচিত হচ্ছে, অন্তর, জিহ্বা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব কিছু দিয়েই সর্বদা
তিলাওয়াত করা। সে দলিল ভিত্তিক সত্যকেই বিশ্বাস করবে, সৎ ও কল্যাণকর ছাড়া কিছু
উচ্চরণ করবে না। ভাল কাজ করবে। ঈমান, কথা, কাজ ইত্যাদি থেকে বাতিলকে প্রতিহত করবে।
মানুষের থেকে কষ্টকর জিনিস দূর করবে।
অতঃপর
প্রত্যেক মুসলিমকে জানা উচিত কুরআন পাঠ কখনও ফরয যেমন: নামাযে তিলাওয়াত, কেননা
ইজমার দ্বারা এটা সাব্যস্ত।
সম্মানিত
আলেমগণ নামাযে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াতের ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন। শুধু সূরা ফাতিহা
পড়লেই কি নামায যথেষ্ট হবে? নাকি এর সাথে অন্য সূরা পড়তে হবে? প্রথম মতটি সহীহ।
অর্থাৎ শুধু সূরা ফাতিহা পড়লেই নামায আদায় যথেষ্ট হবে।
আবার
কখনও কুরআন পড়া মুস্তাহাব, আর তা হলো নামাযে ফরয কেরাত পড়ার পরে অতিরিক্ত পড়া।
এমনিভাবে
অন্যান্য সময় তিলাওয়াত করাও মুস্তাহাব।
আবার
কখনও কুরআন তিলাওয়াত করা মাকরূহ, যেমন এমন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা যা পাশের কাউকে,
নামাযীকে বা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে বিরক্ত করে।
আবার
কখনও কুরআন পড়া হারামও হয়ে থাকে, যেমন কেউ লোক দেখানো বা বিদ‘আতের স্থানে বসে
তিলাওয়াত করল। কেননা এতে বাতিলকে সাহায্য করা হয়। সম্মানিত আলেমগণের কেউ কেউ অতি
টেনে পড়া যা শব্দের উচ্চারণ বিঘ্ন হয় ও
লাহান পড়াকে হারাম বলেছেন। এটা আল্লাহর কিতাবের সম্মান রক্ষা ও অযাচিত সব
কিছু থেকে মুক্ত রাখার জন্য।
এছাড়াও মৃত্যু
ব্যক্তির জন্য সমবেত হয়ে কুরআন পড়ে বিলাপ করে শোক পালন করা বিদ‘আত। এমনিভাবে
মৃত্যু ব্যক্তির রূহের মাগফিরাতে কুরআন পড়ে মজুরি নেয়া ইত্যাদি কাজ যা বর্তমানে মানুষ
করছে করা বিদ‘আত। তা মানুষের স্বল্প ইলম, অজ্ঞতা বিস্তার, অন্যায় কাজ থেকে বিরত না
থাকা ও মানুষকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না জানানোর কারণে হয়ে থাকে। আমরা সকলেই আল্লাহর
জন্য, আর তাঁর সমীপেই প্রত্যাবর্তন করব।
এখানে
আরো একটি বিষয় সব সাধারণ ও নেতা-নেত্রী মুসলিমকে সতর্ক করা দরকার যে, আল্লাহ কুরআন
নাযিল করেছেন আমল ও এর দ্বারা বিচারকার্য
পরিচালনা করার জন্য। এটা আমাদের শরীয়তের মূল বিধান, হুকুম ও আমলের ক্ষেত্রে এটাই
আমাদের উৎস।
আল্লাহ
আমাকে যতটুকু লিখার তাওফিক দিয়েছেন ততটুকু এখানে লিখেছি। তাছাড়া আল্লাহর কালামের
মর্যাদা মহান, কোনো শব্দে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়, হক্ব আদায় করা সম্ভবপর নয়।
এখানে আমি শুধু কিছু সতর্কতা ও উপদেশ আলোচনা করেছি যা আমার ও অন্যান্য মুসলিম
ভাইদের উপকারে আসে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহ কামনা
করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর দ্বীন বুঝার তাওফিক দান করেন, কুরআনের তাফসীর শিক্ষা
দেন, সম্মানিত আল-কুরআনকে আমাদের অন্তরের বসন্ত, হৃদয়ের আলো ও দুশ্চিন্তা ও
দুর্ভাবনা দূরকারী বানিয়ে দেন।
হে
আল্লাহ, আমরা যা ভুলে যাই তা স্মরণ করিয়ে দিন, যা জানি না তা শিখিয়ে দিন, কুরআনের
তিলাওয়াত দিবানিশি করার তাওফিক দান করুন, যেভাবে আপনি আমাদের উপর খুশী হোন।
আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা কুরআন অনুযায়ী আমল করে, এর মুতাশাবিহ
আয়াতগুলোর উপর ঈমান আনে।
হে
আল্লাহ, আপনি কুরআনকে আমাদের জন্য দলিলস্বরূপ করুন, আমাদের বিরুদ্ধে নয়, তা আমাদের
জন্য সাক্ষ্য ও দলিল করুন, চিরস্থায়ী জান্নাতের দিকে চালক বানান। হে আল্লাহ আপনি
এর দ্বারা আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করুন, আমাদের গুনাহ খাতা ও ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন
এবং আপনার দরবারে একে আমাদের জন্য সুপারিশকারী বানান।
আমাদের
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম এবং
কিয়ামত পর্যন্ত যারা তাঁর যথাযথ অনুসরণ করবে তাদের সকলের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে
সালাত ও সালাম বর্ষিত হউক।
[35] বুখারী,
হাদীস নং ৭৫২৭।
____________________________________________________________________________________________________________
শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আবদুল্লাহ আলে শাইখ
গ্র্যান্ড মুফতি ও সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ,
ইলমী গবেষণা ও ফতোয়া বিভাগের প্রধান, সৌদি আরব
অনুবাদক: আব্দুল্লাহ আল মামুন
সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
আরও পড়ুনঃ কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত
আরও পড়ুনঃ কুরআন তিলাওয়াত : ফযীলত ও আদব
আরও পড়ুনঃ কুরআন শিক্ষা: বিধান, পদ্ধতি ও ফযীলত
আরও পড়ুনঃ কুরআনের কয়েকটি বিশেষ সূরা ও আয়াতের ফজীলত
আরও পড়ুনঃ পবিত্র কুরআন পড়ার ফযীলতের হাদিস সমুহ
আরও পড়ুনঃ আমরা কিভাবে কুরআন বুঝব?
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন