পথের হক
পথের হক
عن أبي سعيد الخدري- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أنَّ النَّبِيَّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- قَالَ : إيَّاكُمْ وَ الْجُلُوْسَ فِي الطُّرُقَاتِ، فَقَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ، مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ نَتَحَدَّثُ فِيْهَا، فَقَالَ : فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ الْمَجْلِسَ فَأعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهُ. قَالُوْا: وَمَا حَقُّ الطَّرِيْقِ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ: غَضُّ الْبَصَرِ، و كَفُّ الأذى، وَ رَدُّ السَّلاَمِ، وَ الْأمْرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَ النَّهْيُ عَنِ الْمُنْكَرِ. (متفق عليه)
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. বলেন, তোমরা রাস্তায় বসে থাকা থেকে বিরত থাক। সাহাবিগণ রা. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই। রাসূল সা. বললেন, যদি তোমাদের একান্ত বসতেই হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! রাস্তার হক কি ? তিনি বললেন, চক্ষু অবনত করা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর প্রদান করা, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা।[১]
হাদিস বর্ণনাকারীঃ
তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট সাহাবি সা'দ, উপনাম আবু সাঈদ। পিতা মালেক। পিতামহ সানান। তিনি ছিলেন আনসার অন্তর্গত খুদুর গ্রামের অধিবাসী। মদিনার আনসারদের একটি গ্রামের নাম হল খুদুর। সেই গ্রামেই তার জন্ম, সে জন্য তাকে বলা হয় খুদরী। পিতা মালেক রা. উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক খন্দক তথা পরিখার যুদ্ধে ও বাইআতে রিজওয়ানে অংশগ্রহণ করেছেন। রাসূল থেকে এক হাজার একশ সত্তুরটি হাদিস বর্ণনা করেছেন তিনি। ফিকাহ বিশারদ হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। ৭৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আভিধানিক ব্যাখ্যাঃ
إيَّاكُمْ তোমরা বেঁচে থাক। ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার হয়। উদ্দেশ্য তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর।
وَ الْجُلُوْسَ فِي الطُّرُقَاتِ এখানে س বর্ণে জবর হবে। অর্থাৎ, রাস্তায় বসাকে ভয় কর। উদ্দেশ্য হল রাস্তায় বসা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি।
الطرقات শব্দটি طرق- এর বহুবচন। আর طرق শব্দটি طريق শব্দের বহুবচন। হাদিসে যদিও طريق শব্দ ব্যবহার হয়েছে, উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাপক। অর্থাৎ মানুষের সমস্ত গমনাগমন স্থান যেমন হাটবাজার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছ্তেহাদিস বর্ণনাকারী বলেন, كنا جلوسا بالأفنية অর্থাৎ আমরা যখন বাড়ির সামনে বসে ছিলাম। তখন রাসূল আমাদের বললেন, إياكم و الجلوس في الطرقات অর্থাৎ তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর। এতে বুঝা গেল, রাস্তা মূল উদ্দেশ্য নয়, কেননা, তারা রাস্তায় বসে ছিলেন না। বরং উদ্দেশ্য হল, মানুষের গমনাগমনের পথ।
مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ এখানে د বর্ণে পেশ ও তাশদীদ হবে। অর্থ : আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই।
فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ الْمَجْلِسَ অর্থ যদি তোমাদের এই সমস্ত জায়গায় বসার একান্ত প্রয়োজনই হয়...।
فَأعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهُ কোন কোন বর্ণনায় حقها এসেছে। طريق শব্দটি উভয় লিঙ্গে ব্যবহার হয়। সে জন্য حقه ও حقها উভয়টি ব্যবহার বিধি-সম্মত। অর্থ, যদি তোমরা অপরাগ হয়ে বস, তবে রাস্তার হকগুলো আদায় কর।
غَضُّ الْبَصَرِ শাব্দিক অর্থ হল চোখের দুই পাতাকে এমন ভাবে মিলিয়ে নেওয়া যাতে কিছুই দেখা না যায়। এখানে উদ্দেশ্য, চোখকে হারাম দৃষ্টি থেকে হেফাজত করা।
كَفُّ الأذى অর্থ পথচারীদেরকে উপহাস বা অশালীন কথা বা কাজের দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। পথচারীর কষ্ট হয় এমন সকল কাজ থেকে বিরত থাকা।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
(১) ইসলামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কুরুচিপূর্ণ আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্কলুষ করে সৎ-চরিত্র ও আদর্শবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করে পারস্পরিক মায়া-মমতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। মনে হবে, যেন তারা একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
(২) ইসলাম সর্বাঙ্গ সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। নীতিমালা নির্ধারণ ও অন্যের হক সংরক্ষণ ইত্যাদিতে তা পরিপূর্ণ ও অনন্য। যা অন্য কোন ধর্মে কিংবা মতাদর্শে বিরল্তনেই বললেই চলে।
(৩) এই হাদিস প্রমাণ করে, রাস্তাঘাট তথা মানুষের গমনাগমনের স্থানসমূহ প্রকৃত পক্ষে বসার আসন বা এ কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। অন্যথায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন:
(ক) অন্যায় ও অসামাজিক এবং অশ্লীল কাজের বিস্তার ঘটা
(খ) আকার ইঙ্গিত ও গালি মন্দের দ্বারা পথচারীকে কষ্ট দেয়া
(গ) অনর্থক মানুষের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করা
(ঘ) অযথা সময়ের অপচয়
(৪) এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাস্তার কয়েকটি আদবের কথা বলেছেন। যথা :
(ক) চক্ষুদ্বয়কে হারাম দৃষ্টি থেকে সংযত রাখা। রাস্তায় যেহেতু নারী সম্প্রদায়কে তাদের প্রয়োজনের তাগিদে আসতেই হয় এবং এর কোন বিকল্প নেই, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি স্বেচ্ছায় না তাকাতে বলা হয়েছে। কেননা, স্বেচ্ছায় কোন পর নারীর দিকে তাকানোকে ইসলাম হারাম করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
মুসলিমদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং হেফাজত করে তাদের যৌনাঙ্গের। এতে তাদের জন্য রয়েছে অতিশয় পবিত্রতা। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।[২]
(খ) পথচারীদেরকে যে কোন প্রকার কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। যেমন গালমন্দ ঠাট্টা তিরস্কার ইত্যাদি। এমনিভাবে যে কোন উপায়ে মুসলমানকে কষ্ট দেয়া,্তযেমন কারো ঘরে উঁকি দিয়ে দেখা বা কারো বাড়ির পার্শ্বে বল খেলা ইত্যাদ্তিথেকে বিরত থাকা কর্তব্য। সব ধরনের কষ্টই হারাম ও পরিত্যাজ্য।
(গ) সালামের উত্তর দেওয়া। এর উপর সমস্ত আলেমগণ একমত যে সালামের উত্তর ওয়াজিব। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
আর যদি তোমাদেরকে সালাম পেশ করে তবে তোমরাও তার জন্য এর চেয়ে উত্তম সালাম পেশ কর অথবা তার সমপরিমাণ কর।[৩]
তবে হ্যাঁ, সালাম দেয়া ওয়াজিব নয়। বরং সুন্নত, পুণ্যের কাজ। কেননা, তা মুসলমানের জন্য রহমত, বরকত, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া।
(ঘ) সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। সাধারণত: রাস্তা ঘাটে অন্যায় বা অসৎ কাজের আধিক্য ঘটে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসৎ কাজের নিষেধ রাস্তার হক হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এবং এই কাজ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ এই যে, কোরআনের বহু আয়াত আর রাসূলের বহু হাদিস এ প্রসঙ্গে বিবৃত। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
তোমাদের এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে। এক সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে।[৪]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان.
তোমাদের কেউ যখন কোন মন্দ কাজ দেখবে, তখন সামর্থ্য থাকলে শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত কর। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কথার দ্বারা তার প্রতিবাদ কর। তাও যদি না পার তাহলে অন্তরে ঘৃণা করত: তা প্রতিহতের চিন্তা ভাবনা করতে থাক। আর এ হল ঈমানের সর্বশেষ দাবি বা স্তর।[৫]
(৫) অন্যান্য বর্ণনায় উপরে উল্লেখিত হক ব্যতীত আরো কিছু হকের কথা বলা হয়েছে। যেমন,
(ক) মার্জিত ভাষায় কথা বলা
(খ) হাঁচির উত্তর প্রদান
(গ) বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করা
(ঘ) অক্ষমের সহযোগিতা করা
(ঙ) সন্দিহান ব্যক্তিকে সত্যের সন্ধান প্রদান
(চ) পথহারা ব্যক্তিকে পথের সন্ধান দান
(ছ) অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিহত করা
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজর র. রাস্তার আদব সমূহ বিভিন্ন হাদিস থেকে ছন্দ আকারে একত্রে উল্লেখ করেছেন, যার অর্থ :
جمعت آداب من رام الجلوس على
الطريق من قول خير الخلق إنسانا
أفش السلام، وأحسن في الكلام
وشمت عاطسا، ردّ إحسانا
في الحمل عاون، ومظلوما أعن
وأغث لهفان، اهد سبيلا، واهد حيرانا
بالعرف مر، وانه عن نكر، وكف أذى
وغض طرفا، وكثر ذكر مولانا
সংকলিত করেছি আমি রাস্তায় বসার নিয়মাবলি,
মহামানবের উক্তি থেকে বিস্তারিত শুনে নাও
সালামের প্রচলন কর, মার্জনীয় মন্তব্য কর,
হাঁচিদাতার উত্তর প্রদান কর সালাম দিলে
উত্তমরূপে উত্তর দাও, বোঝা বহনকারীর সহযোগী হও
নিপীড়িতকে সহযোগিতা কর, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য কর
পথহারাকে পথ দেখাও, হতভম্বকে দিশা দাও
ভাল কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে বাধা দাও
কষ্ট দেয়া থেকে দূরে থাক, চক্ষু দ্বয় সংযত রাখ
মাওলা পাকের জিকির কর, (হৃদয়টাকে সতেজ কর)
সমাপ্ত
[১] বোখারি-৬২২৯, মুসলিম-১৪।
[২] সূরা নূর : ৩০
[৩] সূরা নিসা : ৮৬।
[৪] সূরা আলে ইমরান : ১০৪
[৫] মুসলিম-৪৯, তিরমিজি, ইবনে মাজা, নাসায়ী
_________________________________________________________________________________
অনুবাদক : সিরাজুল ইসলাম আলী আকবর
ترجمة : سراج الإسلام على أكبر
সম্পাদনা : নুমান বিন আবুল বাশার
مراجعة : نعمان بن أبوالبشر
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة
আরও পড়ুনঃ মুসলিমের হক
আরও পড়ুনঃ সন্তানের হক
আরও পড়ুনঃ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ স্ত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহার করার অসিয়ত
আরও পড়ুনঃ ইসলামে নারীর অধিকার
আরও পড়ুনঃ ইসলামে শ্রমিকের অধিকার
আরও পড়ুনঃ মুসলমানের আদব বা শিষ্টাচার
আরও পড়ুনঃ সচ্চরিত্র
আরও পড়ুনঃ মুসলমানের চারিত্রিক গুণাবলী
আরও পড়ুনঃ রহমানের বান্দাদের গুণাবলী
আরও পড়ুনঃ একজন সফল অভিভাবকের গুণাবলি
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।
শুকরান
উত্তরমুছুন