রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

মীলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলিয়ন মিলিয়ন দরূদ জমা করার বিদ‘আত প্রসঙ্গ

 মীলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলিয়ন মিলিয়ন দরূদ জমা করার বিদ‘আত প্রসঙ্গ




মীলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলিয়ন মিলিয়ন দরূদ জমা করার বিদআত প্রসঙ্গ

প্রশ্ন : মীলাদুন্নবী উপলক্ষে নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিলিয়ন মিলিয়ন দরূদ জমা করার বিধান জানতে চাই। প্রত্যেক ব্যক্তি তার পরিচিতদের নিকট নির্দিষ্ট সংখ্যক দরূদ ভাগ করে দেয়, অতঃপর তার পরিচিত, বন্ধু-বান্ধব ও নিজ পরিবারের দরূদ পাঠের সংখ্যা জমা করে। উদাহরণত : কোন এক ছাত্র গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক বাড়ির দরোজা নক করে তাদের পরিবার কাছে ১০০০ (এক হাজার) অথবা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক দরূদ পাঠের অনুরোধ করে, আর বলে আপনাদের সংখ্যা জানার জন্য এক সপ্তাহ পর আমি আবার আসছি। তাদের কেউ এক হাজার পুরো করে, কেউ অধিক পড়ে। এভাবে মিলিয়ন, আধা মিলিয়ন দরূদ জমা করে। আবার মাদরাসার ছাত্রদের প্রত্যেককে ৫০০ (পাঁচশত) বার দরূদ পড়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। এভাবে তিন মিলিয়ন দরূদ জমা করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করার বিধান কী ? এভাবে দরূদ জমা করার বিধান কী ? সংক্ষেপে উত্তর আশা করছি, আল্লাহ আপনাদের তাওফিক বৃদ্ধি করুন।

উত্তর : আল-হামদুলিল্লাহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও আদর্শ সম্পর্কে যার জ্ঞান রয়েছে, কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানে যে আলোকিত, ইসলামের ছায়ায় অবস্থান করার যে সুযোগ লাভ করেছে, শরী‘আত ও ইবাদাতের স্বাদ যে আস্বাদন করেছে, তার অবশ্যই জানার কথা যে, প্রশ্নে উল্লেখিত এসব কর্ম বিদআত ও গোমরাহী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের দাবিদার কোন মুসলমানের পক্ষে থেকে এসব কর্ম সম্পাদিত হতে পারে না। অন্যথায় আবু বকর ও সাহাবায়ে কেরাম কোথায় ছিলেন ? সাঈদ ইবন মুসাইয়্যেব ও অন্যান্য তাবেঈগণ কোথায় ছিলেন ? চার ইমাম ও ইসলামের অন্যান্য ইমামগণ কোথায় ছিলেন ? তারা কেন এমন করেননি। তাদের কারো থেকেই তো এ ধরণে কর্মের কোন প্রমাণ নেই, বরং এর সাদৃশ্য কোন আমলেরও নয়।
হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন, খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাদেরকে এ জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন, কিন্তু তাকে সত্যিকার মহব্বতকারী ও সাওয়াবের জন্য অতি আগ্রহী কেউ তো এরূপ আমল বা এর সাদৃশ্য কোন আমল করেননি ?!
রুটিন তৈরিতে সময় অপচয় এবং মাদরাসা মাদরাসা, ঘরে ঘরে ও মজলিসে মজলিসে এসব বিতরণ করায় কোন ফায়দা নেই, উল্টো সময় নষ্ট, বরং পথভ্রষ্টতা ও বিবেকহীন কর্ম ব্যতীত কিছুই নয় !


তারা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করার অর্থ জানত, তাহলে উপকারী কোন বস্তুর জন্য এ শ্রম ব্যয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করত, যেমন স্ত্রীদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ শিক্ষা দেয়া, ওযুর পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া, সালাতের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া ইত্যাদি। তারা মানুষকে সুদ পরিহার করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করত, জামাতের জন্য উদ্বুদ্ধ করত, বরং যারা সালাত আদায় করে না, তাদেরকে সালাত আদায়ে আগ্রহী করত, নারীদেরকে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা থেকে সতর্ক করত ইত্যাদি। এর ফলে অনেক সম্প্রদায় ও দলের নিকট রিসালাতের বাণী পৌঁছত, যারা হিদায়াত ভুলে গেছে, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কিন্তু বিদআতিরা এসব মহান আমলের তাওফিক কিভাবে লাভ করবে, বরং তারা তো রাসূলের সত্যিকার আনুগত্যকে উপহাসের দৃষ্টিতে দেখে, শরয়ী ও বৈধ মহ্বতকে মূর্খতার দৃষ্টিতে দেখে ?!

এসব লোকেরা বিভিন্ন বিদআতে মগ্ন হয়েছে, অথবা একই বিদআতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে লিপ্ত হয়েছে, যেমন :
১. তারা ঈদে ! মীলাদুন্নবী উপলক্ষে এ দরূদের আয়োজন করছে, এ উপলক্ষ বিদআত।
২. নির্দিষ্ট সংখ্যক দরূদ নির্ধারণ করা এবং নিজেদের পাঠ করা ও অন্যদের পাঠ করা দরূদের সংখ্যা জমা করার নির্দেশ আল্লাহ প্রদান করেননি। হাদিসে এসেছে “মুসলিম দশবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়বে, এর অতিরিক্ত যা হবে, সেটা তার জন্যই”। যদিও এ হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রশ্ন বিদ্ধ। কারো অধিকার নেই নির্দিষ্ট সংখ্যার কোন যিকর অনির্দিষ্ট করে দেয়া, অনুরূপ অনির্দিষ্ট কোন যিকরের নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করা।

এসব বিদআতিদের জন্য ইবন মাসউদের বাণীই যথোপযুক্ত, তিনি তাদেরই পূর্বসূরি একদল বিদআতিকে দেখে বলেছিলেন : “তোমরা তোমাদের পাপগুলো গণনা কর, তোমাদের কোন নেকি বরবাদ হবে না, আমি এর জিম্মাদার”। দারামি তার সুনানের : (২০৪) ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। তার উদ্দেশ্য, এসব কর্মে তোমাদের সময় অপচয় হচ্ছে এবং বিদআতে মগ্নতার কারণে তোমাদের গুনা হচ্ছে, এর চেয়ে যদি তোমরা তোমাদের পাপগুলো গণনা কর, তাহলে তোমাদের পাপ হবে না আমি নিশ্চিত।
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করা সম্মিলিত ও সাধারণ ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটা বান্দা ও রবের মধ্যবর্তী বিশেষ এক ইবাদাত। ইবনুল কাইয়ূম -রাহিমাহুল্লাহ- বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ যদিও উত্তম আমল এবং আল্লাহর নিকট খুব প্রিয়, তবুও প্রত্যেক যিকরের নির্দিষ্ট সময় আছে, সে জায়গায় অন্য যিকর শুদ্ধ নয়। আলেমগণ বলেছেন : এ জন্যই রুকু, সেজদা ও রুকু থেকে দাঁড়ানো অবস্থায় দরূদ পাঠ করা বৈধ নয়। “জালাউল আফহাম ফি ফাদলিস সালাতাআলা মুহাম্মদ খায়রিল আনাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” : (১/৪২৪)

এসব বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব এ থেকে তাওবা করা এবং মানুষদেরকে এর প্রতি আহ্বান করা থেকে বিরত থাকা। এসব বিদআত সম্পর্কে অবগত ব্যক্তির কর্তব্য : লোকদেরকে এতে শরিক হতে বারণ করা, অথবা তার দিকে আহ্বান করা থেকে বিরত রাখা ও বিদআতিদের কথায় ধোঁকায় পতিত না হওয়া।
বিবেকবান কোন ব্যক্তিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরূদ থেকে নিষেধ করতে পারে না, যার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা এবং যার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু এসব বিদআতি পদ্ধতিতে এ যিকর বা অন্য কোন যিকর দ্বারা কখনোই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়।
আশা করছি আমাদের এ উত্তরই যথেষ্ট, অতএব এখন প্রয়োজন গভীর মনোযোগ ও দৃঢ় চিত্তে তা অধ্যয়ন করা। দোয়া করছি আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের উপকৃত করুন এবং গোমরাহ মুসলিমদেরকে তাদের নবীর সুন্নত অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ ভাল জানেন।


সমাপ্ত

মুফতী : শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদক : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব


“প্রশ্নোত্তর” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
“ফতোওয়া” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।
“বিদ’আত” বিষয়ের উপর আরও পড়তে এইখানে ক্লিক করুন।

পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন