শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

অন্তর বিধ্বংসী বিষয়: দুনিয়ার মহব্বত

ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف المرسلين، نبينا محمد، وعلى آله وأصحابه أجمعين.
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক সমস্ত নবীগণের সেরা ও সর্ব শ্রেষ্ঠ নবী আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। আরও সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার পরিবার, পরিজন ও সাথী-সঙ্গীদের উপর।
মনে রাখতে হবে, মানুষের অন্তর হল, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হল, তার অধীনস্থ প্রজা। যখন রাজা ঠিক হয়, তখন তার অধীনস্থ প্রজারাও ঠিক থাকে। আর যখন রাজা খারাপ হয়, তার অধীনস্থ প্রজারাও খারাপ হয়। নোমান ইবনে বাসির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَلا وَإِنَّ فِي الجَسِد مُضْغَةً إِذَا صَلَحتْ صَلَح الجَسَدُ كُلُّهُ، وَإذَِا فَسَدتْ فَسَد الجَسَدُ كُلُّهُ، أَلا وَهِيَ اْلَقْلبُ»
অর্থ, সাবধান! তোমাদের দেহে একটি গোস্তের টুকরা আছে, যখন টুকরাটি ঠিক থাকে তখন সমগ্র দেহ ঠিক থাকে, আর যখন গোস্তের টুকরাটি খারাপ হয় তখন তোমাদের পুরো দেহ খারাপ হয়ে যায়, আর তা হল, মানবাত্মা বা অন্তর।
মানবাত্মা হল, শক্তিশালী দুর্গের মত, যার আছে অনেকগুলো দরজা, জানালা ও প্রবেশদ্বার। আর শয়তান হল, অপেক্ষমাণ সুযোগ সন্ধানী শত্রুর মত, যে সব সময় দুর্গে প্রবেশের জন্য সুযোগ খুঁজতে এবং চেষ্টা করতে থাকে; যাতে দুর্গের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিজেই করতে পারে।
এ দুর্গকে রক্ষা করতে হলে, তার দরজা ও প্রবেশদ্বারসমূহে অবশ্যই পাহারা দিতে হবে। দুর্গের প্রবেশ দ্বারাসমূহ রক্ষা না করতে পারলে দুর্গকে রক্ষা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং, একজন জ্ঞানীর জন্য কর্তব্য হল, তাকে অবশ্যই দুর্গের দরজা ও প্রবেশদ্বারসমূহ চিহ্নিত করে তাতে প্রহরী নির্ধারণ করে দেয়া, যাতে সে তার স্বীয় দুর্গ- মানবাত্মা-কে অপেক্ষমাণ, সুযোগ সন্ধানী শত্রু-শয়তান হতে রক্ষা ও মানবাত্মা হতে তাকে প্রতিহত করতে পারে। আর শয়তানটি যাতে তার কোন ক্ষতি করতে তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে মানবাত্মার জন্য শয়তানের প্রবেশদ্বার অসংখ্য অগণিত; সব গুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি বলা যেতে পারে, যেমন: হিংসাবিদ্বেষলোভ-লালসাকৃপণতারাগক্ষোভদুশমনিখারাপ ধারণাদুনিয়ার মহব্বততাড়াহুড়া করাদুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্যের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াঘর-বাড়ী এবং নারী-গাড়ীর মোহে পড়া ইত্যাদি।
আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর অপার অনুগ্রহে এ কিতাবে মানবাত্মার জন্য বিধ্বংসী বিষয়সমূহের আলোচনার ধারাবাহিকতায় শয়তানের প্রবেশদ্বারসমূহ হতে সর্বশেষটি অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত বিষয়ে আলোচনা করব। দুনিয়ার হাকিকত কি, দুনিয়াতে মুমিনদের অবস্থান ও দুনিয়ার সাথে তাদের সম্পর্কের মান-দণ্ড কেমন হওয়া উচিত, তা এ কিতাবে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরতে প্রয়াস চালাবো। তারপর দুনিয়ার মহব্বত ও আসক্তির কারণে মানব জীবনে কি কি প্রভাব পড়তে পারে, কি ক্ষতি হতে পারে, তার প্রতিবিধান কি এবং দুনিয়ার প্রতি আসক্তির কারণসমূহ আলোচনা করব।
এ পুস্তিকাটি তৈরি করা ও এটিকে একটি সন্তোষজনক অবস্থানে দাঁড় করাতে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি কখনোই ভুলবো না।
আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন দুনিয়াকে আমাদের লক্ষ্য না বানান, আমাদের জ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায় নির্ধারণ না করেন এবং আমাদের গন্তব্য যেন জাহান্নাম না করেন। 
আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট আরও প্রার্থনা করি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন, আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের স্থায়ী ও চিরন্তন কল্যাণ দান করেন এবং আমাদের ক্ষমা করেন। আমীন।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.
  সালেহ আল-মুনাজ্জেদ

  
দুনিয়ার হাকীকত

দুনিয়ার হাকীকত কি এ বিষয়ে অনেক কথা আমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। তবে এ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের যে ধারণা বা জ্ঞান দিয়েছেন, তাই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই এ জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক; তার চেয়ে অধিক জানার অধিকার আর কারো হতে পারে না। তিনিই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে কুরআনে করীমের বিভিন্ন জায়গায় মানবজাতিকে বুঝান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿ٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا لَعِبٞ وَلَهۡوٞ وَزِينَةٞ وَتَفَاخُرُۢ بَيۡنَكُمۡ وَتَكَاثُرٞ فِي ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَوۡلَٰدِۖ كَمَثَلِ غَيۡثٍ أَعۡجَبَ ٱلۡكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَىٰهُ مُصۡفَرّٗا ثُمَّ يَكُونُ حُطَٰمٗاۖ وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٞ شَدِيدٞ وَمَغۡفِرَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٞۚ وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلۡغُرُورِ ٢٠  [الحديد: 20[
তোমরা জেনে রাখ যেদুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুকশোভা-সৌন্দর্যতোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হল বৃষ্টির মতযার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়তারপর তা শুকিয়ে যায়তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাওতারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২০]
আয়াতের তাফসীর: আল্লামা কুরতবী রহ. বলেনএ আয়াতে ما শব্দটি সম্পর্ক স্থাপনকারী। আয়াতের অর্থ হলতোমরা জেনে রাখ! দুনিয়ার জীবন হলনিষ্ফল ও অনর্থক খেলাধুলা এবং আনন্দদায়ক কৌতুক ও বিনোদন তারপর তা অচিরেই নি:শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লামা কাতাদাহ রহ. বলেনক্রীড়া ও কৌতুক শব্দদ্বয়ের অর্থ হলখাওয়া ও পান করা। অর্থাৎদুনিয়ার জীবন হলকেবলই খাওয়া ও পান করার নাম; এ ছাড়া আর কিছু না আবার কেউ কেউ বলেন, শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নাই এখানে উভয় শব্দ তার নিজস্ব অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেনশব্দদ্বয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই; দুটির অর্থ একই অর্থাৎসব খেলাধুলাই কৌতুক আবার সব কৌতুকই খেলাধুলা।[1]
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনের বিষয়টিকে নিকৃষ্ট ও নগণ্য আখ্যায়িত করে বলেন, ﴿أَنَّمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا لَعِبٞ وَلَهۡوٞ وَزِينَةٞ وَتَفَاخُرُۢ بَيۡنَكُمۡ وَتَكَاثُرٞ فِي ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَوۡلَٰدِۖ   “দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুকশোভা-সৌন্দর্যতোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র” অর্থাৎ, দুনিয়াদারদের নিকট দুনিয়ার নির্যাস ও সারসংক্ষেপ এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্যত্র বলেন,
﴿زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ ٱلشَّهَوَٰتِ مِنَ ٱلنِّسَآءِ وَٱلۡبَنِينَ وَٱلۡقَنَٰطِيرِ ٱلۡمُقَنطَرَةِ مِنَ ٱلذَّهَبِ وَٱلۡفِضَّةِ وَٱلۡخَيۡلِ ٱلۡمُسَوَّمَةِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ وَٱلۡحَرۡثِۗ ذَٰلِكَ مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلۡمَ‍َٔابِ، [آل عمران : 14[.
মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারীসন্তানাদিরাশি রাশি সোনা-রূপাচিিহ্নত ঘোড়াগবাদি পশু ও শস্যখেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগ সামগ্রী। আর আল্লাহতাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তন স্থল। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪] তারপর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনের একটি উপমা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, দুনিয়ার জীবন হল, সাময়িক চাকচিক্য ও সৌন্দর্য এবং ক্ষণস্থায়ী নেয়ামত; যার কোন স্থায়িত্ব নেই। তিনি আরও বলেন, দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত হল,كَمَثَلِ غَيۡث  সেই বৃষ্টির মত; যে বৃষ্টির প্রতীক্ষা করতে করতে মানুষ হতাশ হয়, তারপর হঠাৎ বৃষ্টি এসে যায়। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ﴿وَهُوَ ٱلَّذِي يُنَزِّلُ ٱلۡغَيۡثَ مِنۢ بَعۡدِ مَا قَنَطُواْ وَيَنشُرُ رَحۡمَتَهُۥۚ وَهُوَ ٱلۡوَلِيُّ ٱلۡحَمِيدُ ٢٨  [ [الشورى: 28আর তারা নিরাশ হয়ে পড়লে তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন। আর তিনিই তো অভিভাবকপ্রশংসিত। [সূরা শূরা, আয়াত: ২৮] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বাণী: أَعۡجَبَ ٱلۡكُفَّارَ نَبَاتُهُۥ অর্থ, বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদের খুশি করে ও আনন্দ দেয়। যেমনি ভাবে বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদের খুশি করে এবং আনন্দ দেয়, অনুরূপভাবে কাফেরদেরও দুনিয়ার জীবন সাময়িক খুশি করে এবং আনন্দ দেয়। কারণ, তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি সর্বাধিক আসক্ত ও লোভী এবং দুনিয়ার সব মানুষের তুলনায় তারাই দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে। ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَىٰهُ مُصۡفَرّٗا ثُمَّ يَكُونُ حُطَٰمٗاۖ অত:পর উৎপাদিত ফসল শুকিয়ে যায়তখন তুমি দেখতে পাবে ফসলগুলো হলুদ বর্ণের। অথচ এসব ফসল একটু আগেও তরতাজা ও সবুজ বর্ণের ছিল। তারপর তুমি দেখতে পাবে এ ফসলগুলো সব শুকিয়ে খড়-কুটো ও ধুলায় পরিণত। এটিই হল দুনিয়ার জীবনের উপমা ও দৃষ্টান্তপ্রথমে দুনিয়ার জীবনকে আমরা দেখতে পাই সবুজ শ্যামল ও তরতাজা। তারপর ধীরে ধীরে তা দুর্বল হতে থাকে। অত:পর একটি সময় আসেতখন সে বুড়ো হয়ে যায়তার নিজস্ব কোন শক্তিজ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। একজন মানুষ তার জীবনের শুরুতে তরতাজা ডালের মত যুবককর্মক্ষম ও শক্তিশালী থাকেতা শক্তি সামর্থ্য বাহাদূরী ও কর্মতৎপরতা মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয় এবং মানুষ তাকে দেখে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়। তারপর সে ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হতে থাকে, অবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়; কর্মক্ষমতা, শক্তি ও সামর্থ্য লোপ পায় এবং বার্ধক্য তার উপর অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমণ ও আগ্রাসন চালায়। ফলে সে ধীরে ধীরে একেবারেই নি:শক্তিদুর্বল, কুনকুনে বুড়ো হয়ে যায়; এখন আর নড়চড় করতে পারে না এবং কোন কিছুই জয় করতে পারে না; সবকিছু তাকেই জয় করে। যার হুংকারে থরথর করত মাটি, আজ সে মাটিতেই লোকটি গড়াগড়ি করেনিজের শরীর থেকে কর্দমাক্ত মাটিগুলো পরিষ্কার করার কোন শক্তি তার নেই। আহ! কি করুণ পরিণতি! কি নিদারুণ এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও এরশাদ করেন,
﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعۡفٖ ثُمَّ جَعَلَ مِنۢ بَعۡدِ ضَعۡفٖ قُوَّةٗ ثُمَّ جَعَلَ مِنۢ بَعۡدِ قُوَّةٖ ضَعۡفٗا وَشَيۡبَةٗۚ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُۚ وَهُوَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡقَدِيرُ ٥٤ [الروم: 54[.
“আল্লাহযিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল বস্তু থেকে এবং দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন। আর শক্তির পর তিনি আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞসর্বশক্তিমান” [সূরা রুম, আয়াত: ৫৪]
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দৃষ্টান্ত ও উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, দুনিয়ার জীবনের অবস্থা ও পরিণতি কি হবে এবং তাদের গন্তব্য কোথায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে আরও জানিয়ে দেন, দুনিয়ার জীবন কখনোই চিরস্থায়ী নয়, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার জীবন নি:সন্দেহে শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনে মানুষ অনন্ত অসীম কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। অত:পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আখিরাতের অফুরন্তঅসংখ্যঅগণিত ও চিরস্থায়ী নেয়ামতসমূহের প্রতি অগ্রসর হতে তাগিদ ও নির্দেশ দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,﴿وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٞ شَدِيدٞ وَمَغۡفِرَةٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٞۚ وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلۡغُرُورِ ٢   [আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।] অর্থাৎ, আসন্ন আখিরাতের জীবনে তোমাদের জন্য কেবলই আছে, এটি বা ওটি। অর্থাৎ, হয়  জাহান্নামের কঠিন আযাব অথবা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পক্ষ হতে তোমাদের প্রতি সন্তুষ্টি, অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও দণ্ড-হীন ক্ষমা।
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বাণী:وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلۡغُرُورِ  দুনিয়ার জীবন শুধুই ধোঁকার সামগ্রী। এর অর্থ হল, যারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে তাদের এ জীবন দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী সামগ্রী শুধুই ধোঁকা দেয়। কারণ, সে দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এ ধারণা করে যে, এ দুনিয়াই তার শেষ গন্তব্য, এ জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নেই এবং এ দুনিয়ার জীবনের পর কোন উত্থান নেই। অথচ আখিরাতের চিরস্থায়ী হায়াতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য।[2]  
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿وَٱضۡرِبۡ لَهُم مَّثَلَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا كَمَآءٍ أَنزَلۡنَٰهُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَٱخۡتَلَطَ بِهِۦ نَبَاتُ ٱلۡأَرۡضِ فَأَصۡبَحَ هَشِيمٗا تَذۡرُوهُ ٱلرِّيَٰحُۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ مُّقۡتَدِرًا ٤٥ [الكهف: 45[.
আর আপনি তাদের জন্য পেশ করুন দুনিয়ার জীবনের উপমা: তা পানির মতযা আমি আসমান থেকে বর্ষণ করেছি। অতঃপর তার সাথে মিশ্রিত হয় জমিনের উদ্ভিদ। ফলে তা পরিণত হয় এমন শুকনো গুঁড়ায়বাতাস যাকে উড়িয়ে নেয়। আর আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৫]
আল্লামা তাবারী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনসম্পদশালীরা তাদের অধিক সম্পদের কারণে যেন অহংকার না করে এবং ধন-সম্পদের কারণে অন্যদের উপর অহংকার ও বড়াই করা হতে তারা যেন বিরত থাকে দুনিয়াদাররা যেন দুনিয়ার দ্বারা ধোঁকায় নিমজ্জিত না হয়। দুনিয়ার দৃষ্টান্ত শস্যশ্যামলসুজলাসুফলা ফসলের মতবৃষ্টির পানির কারণে যা সৌন্দর্য-মণ্ডিত ও দৃষ্টি-বান্ধব হয়ে উঠেছিল, মানুষ যার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ ও মোহিত হত। কিন্তু যখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে মাটি শুকিয়ে যায়, তখন ফসলের সেই সৌন্দর্য, গৌরব ও উজ্জ্বলতা আর বাকী থাকে না, ফসল হয়ে যায় হলুদ। তারপর আরও কিছুদিন অতিবাহিত হলে তা শুকিয়ে খড়-কুটে পরিণত হয়ে অবস্থা এতই করুণ হয়, বাতাস সেগুলোকে এদিক সেদিক উড়িয়ে নিয়ে যায়। বাতাসকে প্রতিহত করার কোন ক্ষমতা ফসলের আর অবশিষ্ট থাকে না এবং মানুষের দৃষ্টি এখন আর এ সবের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। দুনিয়ার জীবনও ঠিক এসব ফসলের মত। সুতরাং, যে জীবনের এ পরিণতি তার জন্য ব্যস্ত না হয়ে আমাদের উচিত এমন এক জীবনের জন্য কাজ করা যার কোন ক্ষয় নাই, যে জীবন চিরস্থায়ী যার কোন পরিবর্তন ও বার্ধক্য নাই।[3] 
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, “আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার স্বীয় রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেনহে মুহাম্মদ তুমি মানবজাতির জন্য দুনিয়ার জীবনের উদাহরণ তুলে ধর! তাদের বলে দাও! দুনিয়ার জীবন হল সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী তা একদিন শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে; দুনিয়ার কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। যেমনআমি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন পানি জমিনে ছিটানো বীজের সাথে মিশে তা হতে ফসল উৎপন্ন হয়ে তা যৌবনে উপনীত হয়। তারপর সবুজ শ্যামল হয়ে তা এক অপরূপ সৌন্দর্যে পরিণত হয়। একজন কৃষক এ অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকনে মুগ্ধ হয়। কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। তারপর নেমে আসে বিপর্যয় ও দুর্ভোগ। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর ফসল ধীরে ধীরে শুকিয়ে খড়-কুটে পরিণত হয়। বাতাস তখন এদিক সেদিক উড়িয়ে নিয়ে যায়; কখনো ডান দিকে নেয়, আবার কখনো বাম দিকে নেয়। বাতাসের গতিরোধ করার মত নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ফসলের থাকে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি এ অবস্থার সৃষ্টিকর্তা আবার পরবর্তী অবস্থারও সৃষ্টিকর্তা” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করিমে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে এ ধরনের দৃষ্টান্ত একাধিক বার বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿إِنَّمَا مَثَلُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا كَمَآءٍ أَنزَلۡنَٰهُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَٱخۡتَلَطَ بِهِۦ نَبَاتُ ٱلۡأَرۡضِ مِمَّا يَأۡكُلُ ٱلنَّاسُ وَٱلۡأَنۡعَٰمُ حَتَّىٰٓ إِذَآ أَخَذَتِ ٱلۡأَرۡضُ زُخۡرُفَهَا وَٱزَّيَّنَتۡ وَظَنَّ أَهۡلُهَآ أَنَّهُمۡ قَٰدِرُونَ عَلَيۡهَآ أَتَىٰهَآ أَمۡرُنَا لَيۡلًا أَوۡ نَهَارٗا فَجَعَلۡنَٰهَا حَصِيدٗا كَأَن لَّمۡ تَغۡنَ بِٱلۡأَمۡسِۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢٤  [يونس: 24[.
“নিশ্চয় দুনিয়ার জীবনের তুলনা তো পানির ন্যায় যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করিঅতঃপর তার সাথে জমিনের উদ্ভিদের মিশ্রণ ঘটেযা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু ভোগ করে। অবশেষে যখন জমিন শোভিত ও সজ্জিত হয় এবং তার অধিবাসীরা মনে করে জমিনে উৎপন্ন ফসল করায়ত্ত করতে তারা সক্ষমতখন তাতে রাতে কিংবা দিনে আমার আদেশ চলে আসে। অতঃপর আমি সেগুলোকে বানিয়ে দেই কর্তিত ফসলমনে হয় গতকালও এখানে কিছু ছিল না। এভাবে আমি চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করি” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৪]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেনআয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে এ ধরনের আরও একটি উপমা পেশ করেন। দুনিয়ার জীবন দেখতে একজন পরিদর্শকের দৃষ্টিতে খুবই সুন্দরসে যখন নীরবে এ জীবনের সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকেতখন এ জীবন তাকে অনাবিল আনন্দে ভরে দেয়। ফলে সে এ জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং এ জীবনকে তার জীবনের স্থায়ী সমাধান ভাবতে থাকে। আর সে মনে করে, সে নিজেই এ জীবনের মালিক এবং এ জীবনকে ধরে রাখতে সে নিজেই সক্ষম। ঠিক এ মুহূর্তে আকস্মিকভাবে যে জীবনের প্রতি এত নির্ভরশীল ও আসক্ত ছিলসে জীবনকে তার থেকে চিনিয়ে নেয়া হয়। তৈরি করা হয় তার ও জীবনের মাঝে সুবিশাল নিশ্ছিদ্র প্রাচীর। তখন তার হতভম্ব হয়ে চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার এ জীবনকে জমিনের সাথে তুলনা করেন। জমিনে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন এ বৃষ্টির পানি বীজের সাথে মিশে খুব সুন্দর ও দৃষ্টি নন্দন ফসল উৎপন্ন হয়। ফসলের অপরূপ সৌন্দর্য একজন দর্শকের দৃষ্টিকে ভরে দেয় অনাবিল আনন্দে। তখন সে ধোঁকার বশবর্তী হয়ে ধারণা করে যে, সে নিজেই ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম এবং এ ফসলের সে নিজেই প্রকৃত মালিক ও নিয়ন্ত্রক। তখন হঠাৎ করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নির্দেশ এসে যায় এবং আক্রান্ত হয় জমিনের ফসল। আর ফসলের অবস্থা এতই করুণ হয় যে, যেন এখানে কখনোই কোন ফসলী জমি ছিল না। তখন তার ধারণা ও বিশ্বাস একেবারেই পর্যবসিত হয়, তার হাত একদম খালি হয়ে যায়। অনুরূপভাবে দুনিয়ার জীবনের অবস্থা এবং যারা দুনিয়ার জীবনে আঁকড়ে ধরে তাদের পরিণতি। এ দৃষ্টান্ত হল, দুনিয়ার জীবনের সর্ব উৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত।[4]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَمَا هَٰذِهِ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا لَهۡوٞ وَلَعِبٞۚ وَإِنَّ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ لَهِيَ ٱلۡحَيَوَانُۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ٦٤  [العنكبوت: 64[.
আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হল প্রকৃত জীবনযদি তারা জানত” [সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৬৪]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ الدُّنْيَا حُلَوةٌ خَضَرة وَإِنَّ اللهَ مسْتخْلفِكُمْ فيِهَا، فَينْظُر كَيفَ تَعمَلُونَ، فَاتَّقُوا الدُّنْيَا، وَاتَّقُوا النسَّاءَ، فَإن أَوَّلَ فتْنَة بْنيِ إسَرائيِلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ « وفي رواية»:ليِنظْر كْيفَ تْعمَلُونَ»
“অবশ্যই দুনিয়ার জীবন খুবই মজাদার ও সুন্দর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের এ দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি দেখেন তোমরা জমিনে কোন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা কর। তোমরা দুনিয়াকে ভয় কর এবং নারীদের ভয় কর। কারণ, বনী ইসরাইলদের মধ্যে প্রথম ফিতনা ছিল নারীদের নিয়ে। অপর একটি বর্ণনায় আছে: যাতে তিনি অবলোকন করেন তোমরা কি কাজ কর”। আব্দুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الدنَيا متَاعٌ، وَخْيُر متَاعِ الدُّنْيَا المَرْأَةُ الصَّالحَةُ»
“দুনিয়া হল, ভোগের পন্য আর সর্বাধিক উত্তম ভোগের পন্য হল, নেক-কার নারী”।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু  হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الُّدْنَيا سِجْنُ المُؤْمِنِ وجَنة الْكَافر»
 “দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য জান্নাত” [মুসলিম: ]
একজন মুমিন ইচ্ছা করলে দুনিয়াতে যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। তাকে একটি নিয়ম কানুন এবং বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। পক্ষান্তরে একজন কাফেরকে কোন বিধি-বিধান কিংবা নিয়ম কানুনের পাবন্দি করতে হয় না, সে যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ কারণেই হাদিসে দুনিয়াকে মুমিনদের জন্য জেলখানা বলা আর কাফেরদের জন্য জান্নাত বলা হয়েছে। এ ছাড়া কাফেররা যখন মারা যাবে তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। আর জাহান্নামের শাস্তি যে কত ভয়াবহ তা আমাদের কারো অজানা নয়। জাহান্নামে নিদারুন বেদনাদায়ক শাস্তির তুলনায় দুনিয়া কাফেরদের জন্য জান্নাত স্বরূপ আর মুমিনদের জন্য জাহান্নাম। মুমিনরা তাদের মৃত্যুর পর তাদের গন্তব্য হবে জান্নাত। জান্নাতে তারা পরম সুখ ও অনাবিল আনন্দ ভোগ করতে থাকবে। চিরদিন তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দেয়া নাজ-নেয়ামত ভোগ করতে থাকবে। তা হতে তারা বের হবে না। জান্নাতের এ পরম সুখের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটি তাদের জাহান্নাম তথা কারাগারের মত। তাই হাদিসে দুনিয়াকে মুমিনদের জন্য কারাগার বা জেলখানা বলা হয়েছে। মুস্তাওরাদ ইবনে সাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا الدُّنْيَا في الآخرة إلَّا مِثْلُ مَا يَجعلُ أَحَدُكُمْ أُصبعهُ في الْيَمِّ فَلَينظُر بمَا تَرْجِعُ »
“দুনিয়ার জীবন দৃষ্টান্ত আখিরাতের জীবনের তুলনায় এমন, যেমন তোমাদের কেউ অকুল সমুদ্রে একটি আঙ্গুল রাখল, তারপর তা তুলে ফেলল, তখন তার আঙ্গুলের সাথে যতটুকু পানি উঠে আসে দুনিয়ার জীবনও আখিরাতের তুলনায় তার মত। সে যেন চিন্তা করে দেখে সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানির পরিমাণ কতটুকু”
সমুদ্রের পানির তুলনায় আঙ্গুলের সাথে উঠে আসা পানি কোনো পরিমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তা এতই নগণ্য যে দুনিয়ার কোন অংক তা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে পারবে না। আখিরাতের জীবন অনন্ত অসীম যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই হিসাবের বাহিরে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোঝানের জন্য একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন মাত্র।

দুনিয়া ও ঈমাদার

মুমিনদের দুনিয়ার জীবন মুল লক্ষ্য হতে পারে না। তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হল আখিরাত। তাই মুমিনরা দুনিয়াতে তাদের যাবতীয় কর্ম দ্বারা আখিরাত লাভের চেষ্টা চালিয়ে যায়। দুনিয়া মুমিনদের জন্য আখিরাতের পথ চলার সাময়িক বিশ্রামাগার। পথিক যেমন পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কোথাও ছায়া তালাশ করে সেখানে বিশ্রাম নেয় অনুরূপ একজন মুমিনের জন্য আখিরাতের কল্যাণ হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করতে করতে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। আর দুনিয়া হল, তাদের বিশ্রামাগার। 

দুনিয়ার জীবন বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থান

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে প্রেরণ করছে মানবজাতিকে দুনিয়ার অন্ধকার থেকে বের করে আলোর সন্ধান দিতে এবং সরল পথ দেখাতে। দুনিয়ার রাজত্ব বা বাদশাহি করতে তাকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়নি। দুনিয়ার কোন কিছুর প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। তাকে দুনিয়ার নারীবাড়ীগাড়ী ও রাজত্ব সবকিছুই দেওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তিনি কোন কিছুই গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন আমি এক বেলা খাব অপর বেলা উপবাস থাকবো এটাই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয়। তিনি সাদাসিধে জীবন-যাপন করতে পছন্দ করতেন। কোন প্রকার উচ্চাভিলাষ ও রং তামাশা করতে পছন্দ করতেন না ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
...] وإنه لعلى حصير ما بينه وبينه شيء، وتحت رأسه وسادة من آدم حشوها ليف ، وإن عند رجليه قَرَظَاً مصبوباً، وعند رأسه أَهَبٌ معلقة، فرأيت أثر الحصير في جنبه فبكيت، فقال: ما يُبكْيِكَ؟ يا رسول الله إن كسرى وقيصر فيما هما فيه وأنت رسول الله. فقال: «أمَا تَرْضى أَنْ تَكُونَ لهُمْ الدُّنْيَا وَلَناَ الِآخرَةُ»
একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে খেজুর পাতার বিছানা শুয়ে থাকতে দেখি। খেজুর পাতার বিছানার উপর আর কিছুই বিছানো ছিল না, তার মাথার নিচে একটি চামড়ার বালিশ ছিল পায়ের দিক দিয়ে একটি উন্মুক্ত তলোয়ার আর মাথার পার্শ্বে খাবারের একটি পোটলা। আমি তার মুবারক দেহে বিছানার দাগ দেখে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন, তুমি কি কারণে কাঁদছ? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! রোম ও পারস্যের রাজা-বাদশাহরা দুনিয়ার কত শান শওকত নিয়ে থাকে, আর আপনি আল্লাহর রাসূল; উভয় জাহানের বাদশাহ হয়ে একটি খেজুরের পাতার বিছানায় শুয়ে আছেন আমার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদের জন্য দুনিয়া, আমাদের জন্য আখিরাত হওয়াতে তুমি কি সন্তুষ্ট নও[5]     
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট দুনিয়ার সবকিছু তুলে ধরা হল এবং তাকে দুনিয়াদারি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হল। কিন্তু তিনি দুনিয়াকে গ্রহণ না করে তা প্রত্যাখ্যান করেন দু‍’হাত দিয়ে দুনিয়াকে না করেন এবং দুনিয়ার প্রস্তাবকে প্রতিহত করে দুনিয়াকে পিছনে ফেলে দেন। তারপর তার সাহাবীদের কাছে দুনিয়াকে তুলে ধরা হল এবং তাদের নিকটও দুনিয়া পেশ করা হল। তাদের কেউ কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পথ অবলম্বন করল এবং দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করল; তবে তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আবার তাদের মধ্যে কতক আছে যাদের নিকট দুনিয়াকে পেশ করা হলে তারা বলে, হে দুনিয়া! তুমি বল, তোমার মধ্যে কি কি রয়েছে? তখন বলা হল, হালাল, হারাম, মাকরুহ ও সংশয়যুক্ত বিষয়ের সমন্বয়েই দুনিয়া। তখন তারা বলল, দুনিয়া থেকে যা হালাল তা আমাদের দাও, এছাড়া অন্য গুলোতে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। তারা দুনিয়ার হালাল বস্তুকে অবলম্বন করল আর হারাম, মাকরূহ ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করল। তারপর তাদের পরবর্তীদের জন্য দুনিয়াকে পেশ করা হলে, তারা বলল, দুনিয়ার হালাল বস্তুসমূহকে আমাদের জন্য রেখে যাও। তাদের জন্য হালাল বস্তুসমূহ তালাশ করে পাওয়া গেল না। তখন তারা মকরুহ ও সংশয়যুক্ত বস্তুসমূহ তালাশ করলে, দুনিয়া তাদের জানিয়ে দিল, তা তো তোমাদের পূর্বের লোকেরা গ্রহণ করে ফেলছে। তখন তারা বলল, তাহলে তুমি আমাদেরকে তোমার হারাম বস্তুসমূহ দাও, তখন তাদের হারাম বস্তুসমূহ দেয়া হলে তারা তা গ্রহণ করল তারপর তাদের পরবর্তীরা দুনিয়া তালাশ করলে তাদের দুনিয়া জানিয়ে দেয় যে, দুনিয়া অত্যাচারীদের কবজায় চলে গেছে। তারা দুনিয়া বিষয়ে তোমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করছে। তখন তারা দুনিয়া হাসিলের জন্য অতি উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন কলা, কৌশল ও তাল-বাহানা অবলম্বন করে তখন অবস্থা এত নাজুক হবে যে, কোনো অপরাধী হারাম বস্তুর দিক হাত বাড়ালে দেখতে পাবে, তার চেয়ে আরও অধিক খারাপ ও শক্তিশালী অপরাধী তার প্রতি তার পূর্বেই হাত বাড়িয়ে আছে। অথচ একটি কথা মনে রাখতে হবে,  দুনিয়াতে আমরা সবাই মেহমান, আমাদের হাতে যেসব ধন-সম্পদ আছে, তা সবই আমাদের নিকট আমানত। যেমনটি আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
"ما أصبح أحد في الدنيا إلا ضيف، وماله عارية، فالضيف مرتحل، والعارية مؤادة "
“দুনিয়াতে সবাই মেহমান, আর তার ধন-সম্পদ হল আমানত, মেহমান অবশ্যই বিদায় নেবে, আর আমানতকে প্রকৃত মালিকের নিকট আদায় করা হবে”
এ ছিল নবী ও রাসূলগণের অবস্থা- তাদের যখন দুনিয়ার ধন-সম্পদ লাভ হত, তখন তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোন কৌতূহল, উল্লাস বা আনন্দ পরিলক্ষিত হত না, তারা এ নিয়ে গর্ব, অহংকার করত না। আল্লামা কুরতুবি রহ. বলেন, কোন নবীই দুনিয়ার কোন বিষয় নিয়ে আনন্দ ও উল্লাস করেননি”[6]

দুনিয়া বিষয়ে সাহাবীদের অবস্থান

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীরা দুনিয়ার প্রতি কখনোই লোভী ছিলেন না। তারা ছিলেন রাসূল সা. এর আদর্শে অনুপ্রাণিত ও তার শিক্ষা-দীক্ষার অগ্রপথিক। তাই তারাও ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত দুনিয়া বিমুখ এবং আখিরাত অভিমুখী। সাহাবীরা কখনো ভোগ-বিলাসের জীবন যাপন করেননি। তারাও সাদা সিদা জীবন-যাপন করতেন। তারা ছিলেন কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির আদর্শ। সাহাবীগণ সবসময় আখিরাতকে দুনিয়ার জীবনের উপর প্রাধান্য দিতেন
খলিফাতুল মুসলিমীন ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু অনেক ভালো ভালো ও সু-স্বাদু খাওয়ার খাওয়া এবং পানীয় পান করা হতে বিরত থাকতেন এবং অভিজাত ও দামি খাওয়া ও পানীয় হতে নিজেকে দূরে রাখতেন। আর তিনি বলতেন, আমি আশংকা করি আমি যেন তাদের মত না হই, যাদের বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে বলেন,
﴿وَيَوۡمَ يُعۡرَضُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ عَلَى ٱلنَّارِ أَذۡهَبۡتُمۡ طَيِّبَٰتِكُمۡ فِي حَيَاتِكُمُ ٱلدُّنۡيَا وَٱسۡتَمۡتَعۡتُم بِهَا فَٱلۡيَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ ٱلۡهُونِ بِمَا كُنتُمۡ تَسۡتَكۡبِرُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَبِمَا كُنتُمۡ تَفۡسُقُونَ ٢٠   [الأحقاف: 20[.
আর যেদিন কাফিরদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে (তাদেরকে বলা হবে) তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সুখ সামগ্রীগুলো নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ। তোমরা যেহেতু অন্যায়ভাবে জমিনে অহংকার করতে এবং তোমরা যেহেতু নাফরমানী করতেসেহেতু তার প্রতিফলস্বরূপ আজ তোমাদেরকে অপমানজনক আযাব প্রদান করা হবে [সূরা আহকাফ, আয়াত: ২০] আবু মিজলায বলেন, কতক সম্প্রদায় এমন আছে, যারা দুনিয়ার অনেক কল্যাণ যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তা তারা হারাবে, তখন তাদের বলা হবে, أَذۡهَبۡتُمۡ طَيِّبَٰتِكُمۡ فِي حَيَاتِكُمُ ٱلدُّنۡيَا وَٱسۡتَمۡتَعۡتُم بِهَا তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনে তোমাদের সুখ সামগ্রীগুলো নিঃশেষ করেছ এবং সেগুলো ভোগ করেছ। [সূরা আহকাফ, আয়াত: ২০]
আল্লামা ইবনে জারির রহ. বলেন, আমাকে হাদিস বর্ণনা করেন ইবন হুমাইদ, আর তিনি বলেন, আমাকে হাদিস বর্ণনা করেন, ইয়াহিয়া ইবন ওয়াজিহ, তিনি বলেন, আমাকে হাদিস বর্ণনা করেন, আবু হামযা আর তিনি আতা হতে এবং আতা আরফাযা ইবন আস্-সাকাফী হতে হাদিস বর্ণনা করে বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে সূরা আলা- سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى -র তিলাওয়াত শুনতে চাইলে, তিনি আমাদের সূরাটির তিলাওয়াত শোনান। তারপর তিলাওয়াত করতে করতে যখন﴿بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ  আয়াত পর্যন্ত পৌঁছল, তখন তিনি তিলাওয়াত বন্ধ করে দেন এবং সাহাবীদের দিকে অগ্রসর হয়ে বলেন, আমরা কি আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেইনা? তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে সাহাবীরা চুপ করে বসে থাকেন। তারপর তিনি আবারো বললেন, আমরা কি দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি? কারণ, আমরা দুনিয়ার সৌন্দর্য, নারী, বাড়ী, গাড়ী ও ভালো ভালো খাদ্য-পানীয় অবলোকন করি আর আখিরাত থেকে আমরা অনেক দূরে থাকি। তাই আমরা নগদ অর্থাৎ দুনিয়াকে গ্রহণ করি, বাকী অর্থাৎ আখিরাতের প্রতি আমাদের কোন আগ্রহ নাই কথাগুলো আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বিনয় অবলম্বন ও নিজেকে ছোট করে স্বীয় মর্তবা থেকে নিচে নেমে এসে বলেন, অন্যথায় তার মত এমন একজন ছাহাবী দুনিয়াকে প্রাধান্য দিবেন, তা কখনো চিন্তাই করা যায় না। অথবা তিনি কথাগুলো দ্বারা মানবজাতির অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে জানিয়ে দেন। আল্লাহই ভালো জানেন[7]
আখনফ ইবন কায়েস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তারপর আমরা মদিনায় ফিরে এলাম এবং কুরাইশের লোকদের একটি মজলিশে উপস্থিত হলাম। তখন মোটা কাপড় পরিহিত, সুঠাম দেহের অধিকারী ও বিবর্ণ চেহারার একলোক এসে তাদের মধ্যে উপস্থিত হল। তারপর সে তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা যারা ধন-সম্পদ একত্র করে- যাকাত আদায় করে না তাদের সু-সংবাদ দাও আগুনের তখতির; যাকে জাহান্নামের আগুনের উপর গরম করা হবে। অত:পর তা তাদের স্তনের বোটার উপর রাখা হলে তা তাদের দুই কাঁধের পার্শ্ব দিয়ে নির্গত হবে। আর তার দুই কাঁধের উপর রাখা হলে তা তার দুই স্তনের বোটা দিয়ে বের হয়ে আসবে তার কথা শোনে সমবেত লোকেরা সবাই মাথা নিচু করে রাখল কেউ তার কথার কোন প্রকার জবাব দিল না। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর লোকটি চলে গেলে আমি তার পিছু নিলাম এবং দেখতে পেলাম লোকটি একটি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসল। আমি তাকে বললাম, তুমি তাদের যা বললে তারা তা অপছন্দই করল।  তিনি বললেন, ঐ সব লোকেরা কিছুই বুঝে না। আমার বন্ধু আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলে আমি তার ডাকে সাড়া দিলে তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি কাউকে দেখতে পাচ্ছ? আমি তাকিয়ে দেখলাম সূর্য ছাড়া আর কিছুই আমি দেখতে পেলাম না। আমি ধারণা করছিলাম তিনি হয়তো আমাকে কোথাও  কোন কাজে পাঠাবেন আমার নিকট যদি সূর্যের সমপরিমাণ স্বর্ণ থাকত, আর আমি তা তিনটি দিনার ছাড়া সবই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর রাহে ব্যয় করাতে তেমন কোন আনন্দ অনুভব করি না। অর্থাৎ তিনটি দিনারও একত্র করা বা জমা রাখা তার নিকট অ-পছন্দনীয় ছিল। তারা আসলে কিছুই বুঝে না এ কারণে তারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ একত্র করতে ব্যস্ত। আমি তাকে বললাম, তোমার ও তোমার কুরাইশ ভাইদের কি হল, তাদের তুমি একত্র করছ না এবং তাদের থেকে তুমি আক্রান্ত হচ্ছ না। সে বলল, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর শপথ করে বলছি, আমি আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকট দুনিয়া রবিষয়ে কোন প্রকার প্রশ্ন করব না এবং দ্বীনের বিষয়ে কোন কিছু জানতে চাইব না।
ওয়াবরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করল, আমি হজের ইহরাম বেঁধেছি বায়তুল্লাহর তওয়াফ করব কি? তিনি বললেন, তাতে তোমাকে কে বাধা দেয়? তিনি বললেন, আমি অমুকের ছেলেকে দেখেছি, সে তা অপছন্দ করে আর তুমি আমার নিকট তার চেয়ে অধিক উত্তম, তাকে আমি দুনিয়ার ফিতনায় নিপতিত হতে দেখছি। তিনি বললেন, আমাদের বা তোমাদের মধ্যে কে আছে? যাকে দুনিয়ার ফেতনায় আক্রমণ করেনি[8] সাহাবীদের যুগেই মানুষকে দুনিয়ার মহব্বত আক্রান্ত করে ফেলেছে। তাহলে বর্তমান যুগে আমাদের অবস্থাতো আরও অনেক নাজুক। বর্তমানে খুব কম লোকই পাওয়া যাবে যাদের দুনিয়ার মহব্বত আক্রমণ করেনি। মানুষ দুনিয়ার উপার্জনের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। কিন্তু আখিরাত লাভের জন্য সামান্য সময়ও ব্যয় করতে রাজি হয় না।   
আমর ইবন কাইস রহ. হতে বর্ণিত, এক লোক তার নিকট মুয়ায বিন যাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে হাদিস বর্ণনা করে বলেন, যখন তার মৃত্যু উপস্থিত হল, তখন সে বলল, হে মৃত্যু তোমাকে ধন্যবাদ! তুমি একজন দূরের মেহমান। তুমি আমার বন্ধু আমার অভাবের সময় তুমি এসেছ। হে মৃত্যু! আমি তোমাকে ভয় করতাম, কিন্তু আজ আমি তোমার হিতাকাংখি। হে মৃত্যু! তুমি জান আমার দুনিয়াকে মহব্বত ও দুনিয়াতে দীর্ঘদিন থাকাকে মহব্বত করা দুনিয়ার সৌন্দর্য, নদ-নদী ও গাছ-পালা ইত্যাদি অবলোকন করার জন্য নয়। আমি দুনিয়াতে থাকতে চাই তৃষ্ণার্তদের পিপাসা নিবারণ করতে, দু:সময়ের বন্ধু হতে ও আলেমগণের জিকিরের অনুষ্ঠানে ভিড় জমাতে[9] 

দুনিয়া বিষয়ে তাবেয়ীনদের অবস্থান

..আমরা মালেক ইবনে দীনার রহ. এর মুমূর্ষু অবস্থায় তার ঘরে প্রবেশ করি। তখন মৃত্যুর সঙ্গে তার পাঞ্জা লড়ছে। তিনি মাথা আসমানের দিকে ওঠালেনতারপর বললেনহে আল্লাহ! তুমি জান আমি দুনিয়াতে বেঁচে থাকাকে মহব্বত করা আমার পেট বাচানো বা যৌবনের তাড়নায় নয়।   একদিন আবু মুসলিম আল-খাওলানী রহ. মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন, এক জামাত লোক একটি মজলিসে একত্র হয়ে বসে আছে। তাদের দেখে তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, লোকেরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির বা অন্য কোন ভালো কাজে এখানে একত্র হয়েছে। তাই তিনি নিজেও গিয়ে তাদের সাথে বসলেন। মজলিসে গিয়ে দেখলেন, একজন বলছে আমার গোলাম ফিরে এসেছে! তার এ সমস্যা অপরজন বলছে আমার গোলামের মাল-সামান ও প্রয়োজনীয় সব কিছু যোগাড় করছি ইত্যাদি। তিনি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে বললেনসুবহানাল্লাহ! হে লোক সকল! তোমরা কি জান আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত কিরূপশোনএক লোক খুব ভারি মুষলধার বৃষ্টিতে আক্রান্ত হলতখন সে আত্মরক্ষার জন্য এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে পেল, দুটি বিশাল প্রাচীর। লোকটি মনে মনে চিন্তা করল, যদি আমি এ প্রাচীরে গিয়ে আশ্রয় নিই, তাহলে হয়ত বৃষ্টি হতে রক্ষা পাব এবং বৃষ্টির বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে পারব। লোকটি দৌঁড়ে গিয়ে ঐ ঘরটিতে প্রবেশ করলে দেখতে পেল ঘরটির উপরে কোন ছাঁদ নাই। আমি তোমাদের নিকট বসলাম, আশা করছিলাম তোমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির বা কোন কল্যাণ মুলক কাজে লিপ্ত আছ। কিন্তু না, দেখি তোমরা আসলে দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছ। এ কথা বলে লোকটি চলে গেল[10]
এখানে পূর্বের মনীষীগণের সীরাত থেকে কিছু নমুনা পেশ করা হল, আর আপনি যদি এ বিষয়ে আরও বেশি জানতে চান, তাহলে ওলামাগণ এ বিষয়ের উপর যেসব কিতাবাদি লিপিবদ্ধ করেছেন তা অধ্যয়ন করতে পারেন

দুনিয়ার মহব্বতের বহি:প্রকাশ

দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বতের কারণে সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মারা-মারি কাটা-কাটি ইত্যাদির মুল কারণ, হলো দুনিয়ার মহব্বত। বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই ভাই ভাইয়ে সাথে, পিতা পুত্রের সাথে এবং পাড়া প্রতিবেশীর সাথে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে। অনেক সময় তা শুধু ঝগড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা হত্যা জেল-জুলুম ইত্যাদিতে রূপ নেয়। মোটকথা দুনিয়ার মহব্বত হলো সব গুনাহ পাপাচার ও অপরাধের মূল। নিম্নে এ বিষয়ের কিছু প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হল। আশা করি আপনারা উপকৃত হবেন।

১. মানুষকে দুনিয়ার মধ্যে ডুবে থাকতে বাধ্য করা:
দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে গুনাহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য করে। তারা দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে হালাল হারাম ন্যায় অন্যায় কোন কিছুকে তোয়াক্কা করে না। যেখানেই দুনিয়া লাভ দেখে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ ইবন হারেস ‌ইবন নওফল রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন,
]لا يزال الناس مختلفة أعناقهم في طلب الدنيا[
“মানুষ সব সময় দুনিয়ার অনুসন্ধানে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে”[11]

২. আখিরাতের নাম বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করা:
বর্তমান সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা দ্বীন দ্বারা দুনিয়া কামাই করে। দ্বীনকে দুনিয়ার সামান্য লাভের বিনিময় বিক্রি করে দেয়। দ্বীনের নামে ইসলামের নামে বিভিন্ন ধরনের কুকর্ম বিদআত শিরক করে দুনিয়া উপার্জন করছে। তারা দুনিয়ার সামান্য লাভের জন্য দ্বীনকে নষ্ট করছে। 
মুতাররফ রহ. বলেন: “দুনিয়ার প্রতি সর্বনিকৃষ্ট চাহিদা হল, আখিরাতের নাম বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করা[12] ফুজাইল ইবন আয়াজ রহ. বলেন, “দ্বীনের মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জনের তুলনায় ডোল তবলা বাজিয়ে দুনিয়া উপার্জন করা আমার নিকট বেশি প্রিয়”[13] জুনাইদ রহ. বলেন, “আমি ছুররি রহ. কে যারা দ্বীনের দ্বারা যে দুনিয়া কামাই করে তাদের দুর্নাম করতে শুনেছি। তিনি বলতেন, “অপবিত্র কাজ হল, একজন বান্দা তার দ্বীন দ্বারা তার জীবিকা উপার্জন করা”
মালেক বিন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “মালিকের ওস্তাদ রবিয়া আর-রাঈ বলতেন, হে মালেক! হতভাগা কমবখত কে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি বললাম, যে দ্বীন দ্বারা জীবিকা উপার্জন করে। তারপর সে আবার জিজ্ঞাসা করল, কে তার চেয়ে আরও নিকৃষ্ট কমবখত? সে উত্তরে বলল, যে অন্যের দুনিয়াকে সুন্দর করে নিজের দ্বীনকে বাদ দিয়ে। সে বললেন, আমার উত্তর শুনে আমার উস্তাদ খুব খুশি হলেন এবং আমাকে সাবাস দিলেন”[14]
আব্দুল্লাহ ইবন মুবারককে জিজ্ঞাসা করা হলো, প্রকৃত মানুষ কে? উত্তরে সে বলল, আলেমগণ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হল, বাদশাহ কারা? উত্তরে সে বলল, আবেদগণ। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কমবখত কারা? উত্তরে সে বলল, যারা দ্বীনের দ্বারা দুনিয়া কামাই করে[15]

৩. খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাক ইত্যাদিতে সীমাতিরিক্ত অপচয় করা:
মুয়াজ ইবন জাবাল হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে ইয়ামনের দিকে পাঠান, তখন তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন,
»إيَّاكَ وَالتَّنَعُّمَ فَإنَ عِبَادَ اللهِ لَيْسُوا بالمتَنَعِّمِينَ «
“তোমরা ভোগ-বিলাস ও অপচয় করা হতে সতর্ক থাক। কারণ, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বান্দারা কখনোই ভোগ-বিলাস ও অপচয় করেন না”[16]

৪. ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার লোভ:
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوّٗا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادٗاۚ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ٨٣  [القصص: 83[.
এই হচ্ছে আখিরাতের নিবাসযা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করিযারা যমীনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩]
কা‘ব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
»مَا ذِئْبَانِ جَائعَانِ أُرْسِلا فِي غَنم بأفْسَدَ لهَا مِنْ حِرْصِ المَرْءِ عَلَى المَالِ وَالَّشَرفِ لدِِينهِِ«
“দুটি ক্ষুধার্ত বাঘকে কোন ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দেয়া, ছাগলের পালের জন্য ততটা ক্ষতিকর নয়, যতটা ক্ষতিকর হয় একজন মানুষের দ্বীনের জন্য, যখন তার মধ্যে ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার লোভ থাকে”[17]

দুনিয়ার মহব্বতের কারণসমূহ

সব কিছুর পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে। কারণজানা থাকলে তা হাসিল করা কিংবা তা হতে বিরত থাকা সহজ হয়। দুনিয়ার মহব্বতের অনেকগুলো কারণ আছে। এগুলো যখন আমাদের জানা থাকবে তখন তা নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকা সহজ হবে। দুনিয়ার মহব্বতের অনেক কারণ আছে। আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোচনা করব।

১. দুনিয়ার সৌন্দর্য ও বাহ্যিক চাকচিক্য:   
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿ٱلۡمَالُ وَٱلۡبَنُونَ زِينَةُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَٱلۡبَٰقِيَٰتُ ٱلصَّٰلِحَٰتُ خَيۡرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابٗا وَخَيۡرٌ أَمَلٗا ٤٦  [الكهف: 46[.
সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা। আর স্থায়ী সৎকাজ তোমার রবের নিকট প্রতিদানে উত্তম এবং প্রত্যাশাতেও উত্তম। [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ৪৬]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «إِنَّ الدُّنْيَا حْلَوةٌ خَضرة، وَإن الله مسْتَخْلفُكُمْ فيِهَا، فَينظْر كْيفَ تَعمَلُونَ، فَاتَّقُوا الدُّنْيَا، وَاتَّقُوا النسِّاءَ، فَإنَ أَوَّلَ فتْنَة بني إسْرائيِلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ»
“অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দুনিয়া খুব সুন্দর, উপভোগ্য, সজ্জিত ও আনন্দদায়ক। আর  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তোমাদের দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তিনি দেখেন তোমরা কেমন আমল কর। তোমরা দুনিয়া বিষয়ে সতর্ক থাক, আর নারীদের বিষয়ে সতর্ক থাক। কারণ, বনী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম ফিতনা সংঘটিত হয় নারীদের নিয়ে”[18]

২. মানবাত্মা ও অন্তর দুনিয়ার দিকে অধিক ঝুঁকে পড়া: 
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ ٱلشَّهَوَٰتِ مِنَ ٱلنِّسَآءِ وَٱلۡبَنِينَ وَٱلۡقَنَٰطِيرِ ٱلۡمُقَنطَرَةِ مِنَ ٱلذَّهَبِ وَٱلۡفِضَّةِ وَٱلۡخَيۡلِ ٱلۡمُسَوَّمَةِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ وَٱلۡحَرۡثِۗ ذَٰلِكَ مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلۡمَ‍َٔابِ ١٤   [آل عمران : 14[.
মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারীসন্তানাদিরাশি রাশি সোনা-রূপাচিহ্নত ঘোড়াগবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহতাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করে বলেন,
«قَلْبُ الشَّيْخِ شَاٌّب عَلى حُبِّ اثْنَتَيْنِ، حُبِّ اْلعْيشِ وَالمَالِ»
“বৃদ্ধ মানুষের অন্তর দুটি জিনিষের মহব্বতে যুবক। দুনিয়ার মহব্বত ও ধন-সম্পদের মহব্বত”[19]
অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,
«يَهْرَمُ اْبنُ آَدَم وَيشب مِنهُ اثْنتَانِ الْحرْصُ عَلَى المَالِ، وَالْحرْصُ عَلَى الْعُمُرِ»
“আদম সন্তান বুড়ো হয়, তবে তার দুটি জিনিষ জোয়ান হতে থাকে। এক-ধন-সম্পদের লোভ, দুই- দুনিয়ার জীবনের লোভ”
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে আরও বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« لَوْ كَانَ لابْنِ آدَمَ وَادِيَان مِنْ مَالٍ لابْتَغَى وَادِيَا ثَالثًا، وَلا يمْلأ جَوْفَ ابْن آدَمَ إِلاّ التُّرَاب، وَيَتُوُب اللهُ عَلَى مَن تاَب »
যদি আদম সন্তানের ধন-সম্পদের দুটি উপত্যকা থাকেতখন সে আরও একটি উপত্যকা তালাশ করবে। আর আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোন কিছু দ্বারাই পুরো করা যাবে না। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করবেন যাকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করেন
অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَوْ كَانَ لابنِ آدَمَ وَادٍ مْن ذََهبٍ ، أَحَبَّ أَنْ لهُ وَاديَا آخَر، ولَنْ يمَلَأ فاهُ إلَّا الُّتَرابُ، وَيَتُوُب اللهُ عَلَى مَنْ تَاَب»
যদি আদম সন্তানের উপত্যকা থাকেতখন সে আরও একটি স্বর্ণ-মুদ্রার উপত্যকা চাইবে। আর আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোন কিছু দ্বারাই পুরো করা যাবে না। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করবেন যাকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করেন

৩. বর্তমানকে প্রাধান্য দেয়া প্রতীক্ষিত ভবিষ্যতের উপর:
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٧  [الأعلى: 17[.
বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী। [সূরা আলা, আয়াত: ১৭]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, [বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের নিকট প্রেরণ করেন তার রাসূলগণ, নাযিল করেন কিতাবসমূহ। তাদের নিকট আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বার্তা পাঠান এবং  সুস্পষ্ট বর্ণনা করেন, কোন কাজে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি আর কোন কাজে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর অসন্তুষ্টি। মানুষ যদি তাদের প্রবৃত্তির পূজা ও মানবিক চাহিদা থেকে বের হয়ে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর হুকুমের আনুগত্য করে তবে আল্লাহ তাদের জান্নাতে চিরস্থায়ী নেয়ামতের প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরও অধিকাংশ জ্ঞানীদের জ্ঞান এ দুনিয়া খতম হওয়ার পর, নগদ, উপস্থিত ও চাক্ষুষের উপর প্রতীক্ষার পরবর্তী ভবিষ্যৎকে প্রাধান্য দিতে রাজি হয় না। তারা বলে নগদ পন্য যা আমার কব্জায় রয়েছে, তা কিভাবে সুদীর্ঘ কালের জন্য বাকী বিক্রি করবো? যা পৃথিবীর ধ্বংস ও দুনিয়ার নি:শেষ হওয়ার পর লাভ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ লোকের অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা বলে, তুমি এখন যা দেখছ, তা গ্রহণ কর, আর যা শুনছ তা ছাড়। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে তাওফিক দেয়, সেই আখিরাতের মূল্য বুঝতে পারে এবং ঈমানের শক্তি ও জ্ঞান দ্বারা আখিরাতের স্থায়িত্ব ও রহস্য সম্পর্কে জানতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যারা আনুগত্য করে তাদের জন্য যে সব নেয়ামত আর যারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নাফরমানি করে তাদের জন্য যেসব আযাব নির্ধারণ করেছেন তা তারা বুঝেন। তারা দুনিয়ার বাস্তবতা, পরিবর্তন, অল্প সময়ে নি:শেষ হওয়া, দুনিয়ার গাদ্দারী ও অত্যাচার, অনাচার সবই দেখতে পান। তারা জানেন, দুনিয়া হল  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  যেমন বর্ণনা করেছেন, খেলাধুলা, ক্রীড়া, কৌতুক ও ধন-সম্পদ ও ছেলে সন্তান নিয়ে প্রতিযোগিতা আর ধন-সম্পদ নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অহংকার। আর দুনিয়া হল, বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসলের মত যা একজন কৃষককে খুশি করে ও আনন্দ দেয়। অত:পর তুমি দেখতে পাবে, উৎপাদিত ফসলগুলো শুকিয়ে হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে অথচ এসব ফসল একটু আগেও তরতাজা ও সবুজ বর্ণের ছিল। তারপর এ ফসলগুলো  খড়-কুটো ও ধুলায় পরিণত হয়
আমাদের ও ছেলে সন্তানদের সৃষ্টি এ জগতেই। ফলে আমরা এ ছাড়া কিছুই বুঝি না এবং এর বাইরে কোন কিছু বুঝতে রাজি না। আমাদের অভ্যাস আমাদের বিচারক আর আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাদশাহ। আমাদের জ্ঞানের উপর ইন্দ্রসমূহ ক্ষমতাশীল ও রাজা। নফসের চাহিদা ও দাবি অনুযায়ী চলে আমাদের জীবন।
মোট কথা, দুনিয়ার মহব্বত ও দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয়া দুই কারণে হয়ে থাকে।
প্রথম কারণ: দ্বীন ও ঈমান ধ্বংস হওয়া। 
দ্বিতীয় কারণ: জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্ট হওয়া।

দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি

দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত থাকার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। দুনিয়া মানুষের জন্য অনিবার্য ও জরুরি, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, এ দুনিয়াই হবে একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও জীবনের সবকিছু। দুনিয়া হল একজন মানুষের জন্য আখিরাতের ক্ষেত ও সেতুবন্ধন স্বরূপ। একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও গন্তব্য হল, আখিরাতের জীবন ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি অর্জন। দুনিয়াতে তার যাবতীয় কাজ ও আমল হবে তার আসল গন্তব্য ও শেষ ঠিকানার জন্য। দুনিয়া তার আসল গন্তব্য বা শেষ ঠিকানা নয়। এ কারণেই  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  আমাদের দুনিয়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হতে বা ঝুঁকে পড়তে নিষেধ  করেন এবং দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা যাতে ধোঁকায় না পড়ি এ জন্য তিনি আমাদের সতর্ক করেন। দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়াতে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তা চাই নগদে হোক অথবা পরবর্তীতে হোক। নিম্নে কয়েকটি ক্ষতি ও পরিণতির কথা আলোচনা করা হল।

এক. দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের চাবিকাঠি:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়াতে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতির চাবি হলআশাকে খাট করা বা অধিক আশা করা হতে বিরত থাকা আর যাবতীয় সব কল্যাণের চাবি হলআখিরাতের আকাঙ্ক্ষা করা ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর প্রতি বেশি বেশি ধাবিত হওয়া। আর সমস্ত অনিষ্টের চাবি হলদুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত ও লম্বা আশা। এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে আমরা অনেকেই আছি এমন যারা কোন জিনিষে কল্যাণ আর কোন জিনিষে অকল্যাণ তা আমরা ভালোভাবে জানি না। অথচ এ বিষয়সমূহের ইলম হল অত্যন্ত উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ। কল্যাণ ও অকল্যাণের চাবি কি তা জানা অনেক বড় ইলম।  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  আমাদেরকে তা জানা ও তার উপর আমল করার তাওফিক দেন না। আল্লাহ যাদের  চান কেবল তাদের কল্যাণ দেন। আর যাদের তিনি চান না তাদের চেয়ে হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ হতে পারে না। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  ভালো ও খারাপ সব কিছুর জন্য চাবি ও দরজা নির্ধারণ করে রেখেছেন। একজন মানুষ  তা দিয়ে তার নিকট প্রবেশ করেন[20]

দুই. দুনিয়ার মহব্বত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সাথে কুফরী করা ও তার নাফরমানির কারণ:
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« يُصبحُِ الرَّجُلُ مُؤْمِناً وَيُمْسِي كَافرا، وَُيمْسِي مُؤْمِناً وَيُصْبحُِ كَافرا، يَبيِعُ دِينهَ ُبعِرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا »
“মানুষ ঈমানদার অবস্থায় সকাল উদযাপন করে, আর বিকালে সে কাফের আবার ঈমানের অবস্থায় বিকাল অতিবাহিত করে কিন্তু সকালে সে ঈমান হারা হয়ে যায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য সে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেয়”[21]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “একজন কাফের সেও কুফরের ক্ষতি সম্পর্কে জানে, কিন্তু দুনিয়ার মহব্বত তাকে কুফরের উপর উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন
﴿مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا عَلَى ٱلۡأٓخِرَةِ وَأَنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ١٠٧ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ طَبَعَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَسَمۡعِهِمۡ وَأَبۡصَٰرِهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ ١٠٨ لَا جَرَمَ أَنَّهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٠٩[النحل: 106,109[.
“যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছেতাদের উপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। এটা এ জন্য যেতারা আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে পছন্দ করেছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফির কওমকে হিদায়াত করেন না। এরাই তারাযাদের অন্তরসমূহশ্রবণ সমূহ ও দৃষ্টিসমূহের উপর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই হচ্ছে গাফেল। সন্দেহ নেইতারাই আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত” [সূরা নাহালআয়াত: ১০৬ -১০৯]

তিন. আখিরাতের শাস্তির পূর্বে দুনিয়াতেই শাস্তির সম্মুখীন হওয়া:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বতকারী তার দুনিয়া দ্বারা সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক শাস্তি ভোগ করবে। সে তার জীবনের তিনটি স্তরে সর্বাধিক বেশি আযাবের সম্মুখীন হবে। দুনিয়াতে তার শাস্তি হল, ধন-সম্পদ অর্জন করার জন্য চেষ্টা করা ও এর জন্য দুনিয়াদারদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা ইত্যাদির কষ্ট। আর আলমে বরযখেও সে অধিক কষ্ট পাবে। সেখানে সে দুনিয়া হারানোর কষ্টে ও বেদনা অনুভব করবে এবং আফসোস করতে থাকবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, তার মধ্যে ও তার সম্পদের মাঝে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ ঘটেছে আর কখনোই তার সাথে এবং তার সম্পদের সাথে দেখা  হবে না এবং দুনিয়ার বিনিময়ে এখানে আর কোন বন্ধু সে পাবে না যা তার সমপর্যায়ের হবে, তখন তার কষ্টের আর অন্ত থাকবে না আর লোকটি কবরের মধ্যেও অনেক আযাবের অধিকারী হবে। ধন-সম্পদ হারানো চিন্তা, আফসোস, পেরেশানি তার আত্মায় এমনভাবে আঘাত করতে থাকবে যেমনটি সাপ, বিচ্ছু ও পোকা-মাকড় তার দেহে আঘাত করতে থাকে”
তিনি আরও বলেন, “দুনিয়াদারকে কবরে শাস্তি দেয়া হবে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সাথে সাক্ষাতের দিন তথা কিয়ামতের দিনও অধিক শাস্তি দেয়া হবে।  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿فَلَا تُعۡجِبۡكَ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُهُمۡۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُم بِهَا فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَتَزۡهَقَ أَنفُسُهُمۡ وَهُمۡ كَٰفِرُونَ  ٥٥ [التوبة: 55[.
অতএব তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদিআল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের আযাব দিতে চান দুনিয়ার জীবনে এবং তাদের জান বের হবে কাফির অবস্থায়। [সূরা তাওবা, আয়াত: ৫৫] 
কোন কোন মনীষী বলেন, “তাদের ধন-সম্পদ একত্র করার কারণে শাস্তি দেয়া হবে। আর তাদের অবস্থা এমন হবে ধন-সম্পদের মহব্বতে তাদের জান যাওয়ার উপক্রম হবে। শুধুমাত্র সম্পদের মহব্বতে দুনিয়াতে তারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর হক আদায়ে অস্বীকার করেছিল”[22]

চার. অন্তর আখিরাতের প্রতি অমনোযোগী হওয়া ও নেক আমলে ত্রুটি করা:  
দুনিয়াদারদের অন্তর আখিরাত বিমুখ হয়ে থাকে। ফলে তারা কোন নেক আমল করতে চায় নাতারা সবসময় তাদের লক্ষ্য দুনিয়া কামাই করাতে ব্যস্ত থাকে। তাদের সব ধরনের চেষ্টাকষ্ট-ক্লেশ ও পরিশ্রম দুনিয়া কামাইর জন্যই ব্যয় হয়ে থাকে। ফলে তারা আখিরাত হতে বঞ্চিত হয়।
আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مْن أَحبَّ دنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ، وَمَن أََحبَّ آخِرَتَهُ أَضَر بدُِنْيَاهُ، فَآثرُِوا مَا يَبْقَى عَلى مَا يَفْنىَ»
“যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভ করতে বেশি পছন্দ করে, সে তার আখিরাত লাভ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে অর্জন করতে মহব্বত করে, তাকে অবশ্যই দুনিয়া অর্জন করতে লোকসান দিতে হবে। সুতরাং, তোমরা যা চিরস্থায়ী তার অর্জনকে ক্ষণস্থায়ী বস্তুর অর্জনের উপর প্রাধান্য দাও”।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বাণী-﴿قُتِلَ ٱلۡخَرَّٰصُونَ ١٠ ٱلَّذِينَ هُمۡ فِي غَمۡرَةٖ سَاهُونَ ١١ [الذاريات: 10,11[.
মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক! যারা সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিতউদাসীন" [সুরা যারিয়াত, আয়াত: ১০, ১১] সম্পর্কে বলেন, অর্থাৎ, তারা আখিরাতের বিষয়ে অমনোযোগী, দুনিয়ার মহব্বতে তারা ডুবে আছে। অর্থাৎ তাদের অন্তর দুনিয়া ও দুনিয়ার ধন-সম্পদের মহব্বতে আখিরাত হতে ও তাদের যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হতে সম্পূর্ণ বেখবর। তাদের অবস্থা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর এ আয়াতেরই নামান্তর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا ٢٨ [الكهف : 28[.
আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো নাযার অন্তরকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। [সূরা কাহাফআয়াত: ২৮]
আয়াতে الغمرة উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি সাধারণত প্রবৃত্তির পূজা করার কারণেই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর আয়াতে السهو শব্দের অর্থও একই ধরনের।  এ কারণেই বলা হয়ে থাকে-
          السهو الغفلة عن الشيء وذهاب القلب عنه،
السهو হল, কোন বস্তু হতে গাফেল হওয়া ও তার থেকে মনোযোগ ছুটে যাওয়া।  আর সমস্ত অনিষ্টের কেন্দ্র বিন্দু হল, গাফলত ও কু-প্রবৃত্তি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও আখিরাত হতে গাফেল হওয়ার ফলে কল্যাণের সমস্ত দরজা- মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জন্য জাগ্রত থেকে ইবাদত বন্দেগী করা- বন্ধ হয়ে যায়। আর কু-প্রবৃত্তি সমস্ত অনিষ্ট, গাফলত ও আতঙ্কের দরজা খুলে দেয়। ফলে মানবাত্মা কুপ্রবৃত্তির মধ্যে ডুবে থাকে এবং আল্লাহ হতে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থাকে। অন্তরে গাইরুল্লাহ স্থান করে নেয়ার ফলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির ভুলে থাকে। গাইরুল্লাহকে নিয়ে ব্যস্ত হয়, অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত বিশাল আকার ধারণ করে। যেমন, সহীহ বুখারি ও হাদিসের আরও অন্যান্য কিতাবে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«تَعس عْبدُ الدِّيناَرِ، تَعِس عَبْدُ الدِّْرهَمِ، تعس عَبْدُ اَلخِميصة، تَعَس عبْدُ الْقَطيفة، تَعِسَ وَاْنَتكَسَ، وَإذَِا شِيكَ فَلَا انْتَفَش، إنْ أُعْطيَِ رَضِيَ، وَإنْ مُنِعَ سَخِطَ»
অর্থের গোলাম ধ্বংস হোকধ্বংস হোক সম্পদের গোলামধ্বংস হোক পোশাকের গোলামধ্বংস হোক জামা-কাপড়ের গোলাম। ধ্বংস হোকধ্বংসেই নিমজ্জিত থাকুক সে। যখন দুনিয়ার মুসিবতে পতিত হয়তা যেন হটানো না হয়। তাকে যখন দুনিয়া দেয়া হয় তখন সে খুশি হয়আর যখন তাকে দুনিয় দেয়া হয় না তখন সে অসন্তুষ্ট হয়
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বত বান্দা ও তার আখিরাতের উপকারী কর্মের মাঝে প্রাচীর তৈরি করে। কারণ, তার সামনে যখন দুনিয়া পেশ করা হয় তখন সে আখিরাতকে বাদ দিয়ে দুনিয়াকে সে অধিক মহব্বত করে তা নিয়েই ব্যস্ত হয়। মানুষ এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকেকতক লোক আছে যাদের দুনিয়ার মহব্বত ঈমান ও শরীয়ত থেকে বিরত রাখে। কতক আছে যাদের উপর  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  সন্তুষ্টি লাভ ও তার মাখলুকের খেদমতের জন্য যা পালন করা ওয়াজিব, তা পালন করা হতে তাদের বিরত রাখে। ফলে সে তার ওপর যে সব ওয়াজিব রয়েছে সে গুলো না বাহ্যিকভাবে পালন করে, না গোপনে পালন করে। আবার কতক আছে যাদের দুনিয়ার মহব্বত অসংখ্য করনীয় কাজ হতে বিরত রাখে। কতক আছে তাদের দুনিয়ার মহব্বত শুধুমাত্র দুনিয়া লাভের প্রতিবন্ধক হয় এমন ওয়াজিব থেকে বিরত রাখে অন্যগুলো সে ঠিকই পালন করে। আবার কতক লোক এমন আছে তারা যে সময় ওয়াজিবটি আদায় করা দরকার তখন আদায় করা হতে বিরত থাকে। ফলে সে সময়মত আদায় করতে অলসতা করে এবং যথাযথ পালন করে না। আবার কতক আছে কোন ওয়াজিব আদায় করতে গিয়ে অন্তর দিয়ে এবং কেবল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জন্য তা আদায় করে না। ফলে সে লোক দেখানোর জন্য করে থাকে অন্তর থেকে আদায় করে না। দুনিয়ার মহব্বতের সর্বনিম্ন স্তর হলতা একজন বান্দাকে সৌভাগ্য লাভ হতে বিরত রাখে। আর তা হলমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বতে অন্তর ব্যস্ত হওয়াজবান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর স্মরণে তরতাজা থাকাতার অন্তর তার জবানের উপর একত্র হওয়া এবং তার জবান ও অন্তর তার প্রভুর উপর একত্র হওয়া। সুতরাংবলাবাহুল্য দুনিয়ার মহব্বত ও তার প্রতি ভালোবাসা আখিরাতের ক্ষতি করে, যেমন আখিরাতের মহব্বত দুনিয়ার উপার্জনের ক্ষতি করে। হাদিস শরিফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মারফু সনদে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مْن أَحبَّ دنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ، وَمَن أََحبَّ آخِرَتَهُ أَضَر بدُِنْيَاهُ، فَآثرُِوا مَا يَبْقَى عَلى مَا يَفْنىَ»
 “যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভ করতে বেশি পছন্দ করে, সে তার আখিরাত লাভ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে অর্জন করতে মহব্বত করে, তাকে অবশ্যই দুনিয়া অর্জন করতে লোকসান দিতে হবে। সুতরাং, তোমরা যা চিরস্থায়ী তার অর্জনকে ক্ষণস্থায়ী বস্তুর অর্জনের উপর প্রাধান্য দাও”।

পাঁচ. অন্তরে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বত সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধক হয় ও বিঘ্ন ঘটায়।
ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “যখন অনেক বড় বড় ও শক্তিশালী উপাস্য- দিরহাম, দিনার, কুপ্রবৃত্তি ও নফস-যেগুলো অন্তরকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহ্ববত ও তার ইবাদত থেকে বিরত রাখে তা অন্তরের উপর কর্তৃত্ব করে, তখন সে অন্তরে কিভাবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বত থাকতে পারে। কারণ, এ সবের মহব্বত অন্তরে থাকার দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বত তার প্রতিবন্ধক হয়। আর কারো অন্তর যদি দুনিয়ার মহব্বতে ভর্তি হয়ে থাকে তা মাখলুকের সাথে আল্লাহকে শরীক করারই নামান্তর। যে অন্তর তার রবের পরিপূর্ণ মহব্বত ও ইবাদত করে, সে অন্তরে আর কারো প্রতি মহব্বত থাকতে পারে না। অন্তর গাইরুল্লাহর মহব্বতকে কিভাবে প্রতিহত করবে ও  দূরে সরাবে; কারণ, প্রতিটি প্রেমিক তার প্রেমিকার অন্তরকে তার নিজের দিকেই আকৃষ্ট করতে থাকে এবং তার দিকে টানতে থাকে এবং সে তার প্রেমিকাকে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে মহব্বত করা হতে বিরত রাখে”[23]।  

ছয়. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকীরে অন্তর স্বাদ-আস্বাদন না করা:
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইব্ন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “অন্তরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকিরের জন্য। এ কারণেই সিরিয়ার পূর্বসূরি জ্ঞানীদের থেকে একজন জ্ঞানী- আমার জানা মতে তার নাম সুলাইমান আল খাওয়ায রহ.- তিনি বলেন, জিকির অন্তরের জন্য দেহের জন্য খাদ্যের মত। দেহ যখন অসুস্থ হয়, তখন সে যেমন খাওয়ারের মজা পায় না অনুরূপভাবে যে অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত থাকে সে অন্তর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকিরের মজা পায় না”[24]
আবি ইমরান আল মিসরী বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দাউদ আ. এর নিকট ওহী প্রেরণ করে বলেন, হে দাউদ তুমি আমার ও তোমারা মাঝে এমন কোন আলেমকে নির্বাচন করো না যার অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত জায়গা করে আছে। যেসব আলেমদের অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত গেঁথে আছে তারা আমার বান্দার জন্য পথের কাটা। আমি তাদের সর্বনিকৃষ্ট যে শাস্তি দেব, তা হল, তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আমার সাথে মুনাজাতের স্বাদ চিনিয়ে নেব”[25]

সাত. সর্বদা দুশ্চিন্তা অভাব অনটন ও মতবিরোধ:
যারা দুনিয়াকে অধিক মহব্বত করে তাদের মধ্যে সর্বদা দুশ্চিন্তা ও হতাশা বিরাজ করে। তারা কোন কিছুতে শান্তি পায় না। সব সময় তাদের মন মগজ দুনিয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে। তারা ঠিক মত খেতে পারে না ঘুমাইতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَصَبحَ والدُّْنيَا أكْبَر هِّمهِ شَتتَ اللهُ عَلَيْهِ شَملَهُ، وجَعَلَ فقْرَهُ بيَن عَيْنْيهِ، وَلَمْ يَأْتِهِ منْ الدُّنْيَا إلَّا مَا كُتبَِ لَهُ، وََمْن أَصَبحَ واْلآخِرة أكْبُر هِّمهِ، جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ، وََجَمَع عَلَيْهِ ضيعَتُه، وَأَتَتْهُ الدُّْنيَا وَهِي راغِمةٌ»
যে ব্যক্তির জীবনে দুনিয়া অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার উপর বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেন। আর দরিদ্রতা ও অভাব তার চোখের সামনে তুলে ধরেন। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার ভাগ্যে যতটুকু দুনিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন তার বাহিরে সে দুনিয়া হাসিল করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তির জীবনে আখিরাত অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকেআল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অন্তরকে অভাব মুক্ত করে দেন। তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সম্পদকে সহজ করে দেন। আর দুনিয়া তার নিকট অপমান অপদস্থ হয়ে আসতে থাকে[26]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “অনুরূপভাবে যদি কোন ব্যক্তি এমন হয় তার যাবতীয় চিন্তা দুনিয়া অর্জন করা অথবা তার বড় চিন্তা হল দুনিয়া উপার্জন করা, তার অবস্থা উল্লেখিত হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী হবে। তার পরিণতিও এমন হবে যেমনটি রাসূল সা. বর্ণনা করেন। তিরমিযি ও অন্যান্য হাদিসের কিতাবে আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ كَانَتِ الِآخرَةُ هُمه، جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ في قَلْبهِِ، وَجَمَع لَه شَمْلَهُ، وَأَتَتْهُ الدُّْنيَا وَهِىَ راغِمةٌ، وََمْن كَانَتِ الدُّْنيَا هَّمُه، جَعَلَ اللهُ فقْرَُه بيَن عَيْنْيهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شْملَهَ، وَلَم يَأْتِهِ منَ الدُّنْيَا إلِا مَا قُدِّرَ لَهُ»
“যে ব্যক্তির জীবনে আখিরাত অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার অন্তরকে অভাব মুক্ত করে দেন। তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সম্পদকে সহজ করে দেন। আর দুনিয়া তার নিকট অপমান অপদস্থ হয়ে আসতে থাকে। আর যে ব্যক্তির জীবনে দুনিয়া অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  দরিদ্রতা ও অভাব তার চোকের সামনে তুলে ধরেন এবং তার উপর বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেন। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন আল্লাহ রাব্বুল আলামী তার ভাগ্যে যতটুকু দুনিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন, তার বাহিরে সে দুনিয়া হাসিল করতে পারবে না[27]
দুনিয়াতে সবচেয়ে বড় আযাব হল, অনৈক্য, বিচ্ছিন্নতা ও অভাব অনটনের নিত্য সঙ্গী হওয়া। যদি দুনিয়া পিপাসুদের মাথায় পাগলামি না থাকত এবং দুনিয়ার মহব্বতে মাতাল না হত, তাহলে তারা এ আযাব হতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দরবারে পরিত্রাণ চাইত[28]

আট. দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির হতে বিরত রাখে:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির ও তার ভালোবাসা হতে মানুষকে বিরত রাখে। আর যার ধন-সম্পদ তাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির হতে বিরত রাখে, সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। মানবাত্মা যখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর জিকির হতে গাফেল হয়, তখন শয়তান তাতে স্থান করে নেয় এবং সে যেদিক ইচ্ছা করে তাকে সেদিক নিয়ে যায়”[29]
আল্লামা ইবনুল জাওজী রহ. বলেন, “আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি দুনিয়া প্রত্যেক তৃষ্ণার্তের জন্য নিরেট পরিচ্ছন্ন হয়, প্রতিটি অনুসন্ধানকারীর জন্য সহজলভ্য এবং দুনিয়া আমাদের জন্য স্থায়ী হয়; কোন ছিনতাইকারী চিনিয়ে না নেয়, তাহলেও দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়া ফরয ও ওয়াজিব। কারণ, দুনিয়া মানুষকে আল্লাহ হতে বিরত রাখে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়। আর যে নেয়ামত নেয়া-মতদাতা হতে বিরত রাখে তাকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে”[30]

নয়. একজন দুনিয়াদারের জন্য দুনিয়াই হল, তার শেষ গন্তব্য:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “যখন কোন বান্দা দুনিয়াকে মহব্বত করে, তখন দুনিয়াই তার লক্ষ্য হয়ে থাকে; সে দুনিয়া ছাড়া আর কোন কিছুই বুঝতে রাজি হয় না। তার কাছে আর কোন কিছুই ভালো লাগে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেসব আমলকে আখিরাত লাভ ও দুনিয়ার কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করছেসেসব আমলগুলোকে সে দুনিয়া উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ফলে বিষয়টি পাল্টে যায় আর অর্ন্তনিহিত হিকমত উলটপালট হয়ে যায়। মোট কথা, এখানে দুটি বিষয় আছে, এক- মাধ্যমকে লক্ষ্য বানিয়ে নেয়া, দুই- আখিরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া উপার্জন করা। আর এ হল সর্বনিকৃষ্ট উলটপালট এবং মানবাত্মার জন্য সবচেয়ে জঘন্য ও মারাত্মক পরিণতি। এ ধরনের লোকের ক্ষেত্রে  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  বাণী  হুবহু প্রযোজ্য  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِلٞ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٦ [الهود : 15,16[.
“যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করেআমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দেই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরাই তারাআখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে আর তারা যা করততা সম্পূর্ণ বাতিল”। [সূরা হুদআয়াত: ১৫১৬]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন,
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ  ٢٠ [الشورى: 20[.
“যে আখিরাতের ফসল কামনা করেআমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করিআর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখিরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না”। [সূরা শূরাআয়াত: ২০]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন
﴿مَّن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعَاجِلَةَ عَجَّلۡنَا لَهُۥ فِيهَا مَا نَشَآءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهُۥ جَهَنَّمَ يَصۡلَىٰهَا مَذۡمُومٗا مَّدۡحُورٗا ١٨ وَمَنۡ أَرَادَ ٱلۡأٓخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعۡيَهَا وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ كَانَ سَعۡيُهُم مَّشۡكُورٗا ١٩ [الإسرا:  18, 19[.
“যে দুনিয়া চায় আমি সেখানে তাকে দ্রুত দিয়ে দেইযা আমি চাইযার জন্য চাই। তারপর তার জন্য নির্ধারণ করি জাহান্নামসেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিতবিতাড়িত অবস্থায়। আর যে আখিরাত চায় এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মুমিন অবস্থায়তাদের চেষ্টা হবে পুরস্কারযোগ্য”। [সূরা আল ইসরাআয়াত: ১৮১৯] এখানে তিনটি আয়াত আছে একটি আয়াত অপর আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য এবং আয়াত তিনটির অর্থ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের কল্যাণকে বাদ দিয়ে, দুনিয়া ও দুনিয়া সৌন্দর্য কামনা করে, তার ভাগে তাই মিলবে সে যা চায়; সে আর কোন কিছু পাবে না। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে একাধিক বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো আয়াতের ব্যাখ্যা করে এবং আয়াতের অর্থকে সমর্থন করে”[31]

দশ: বান্দার আমল নষ্ট হয় এবং সাওয়াব ও বিনিময় হতে বঞ্চিত হয়:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “তোমরা একটু চিন্তা করে দেখ! দুনিয়াদারের পরিণতি কতই খারাপ এবং সে কত বড় বড় ছাওয়াব ও বিনিময় হতে বঞ্চিত হয়ে থাকে। একজন মুজাহিদ যখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর রাস্তায় পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলে লক্ষ্যে জিহাদ করে শহীদ হয়, তখন সে আর কোন সাওয়াব বা বিনিময় পায় না, তার আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং সে সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়[32]

এগার. হঠকারিতা:
দুনিয়ার মহব্বতের কারণে একজন মানুষের মধ্যে হঠকারীতা সৃষ্টি হয়। ফলে সে আর কাউকে মানতে চায়না এমনকি আল্লাহর আদেশ নিষেধও তার নিকট গুরুত্বহীন হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿كَلَّآ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَيَطۡغَىٰٓ ٦ أَن رَّءَاهُ ٱسۡتَغۡنَىٰٓ ٧ [العلق: 6-7[.
কখনো নয়নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। [সূরা আলাকআয়াত: ৬-৭] আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, “ইবনে আবী হাতেম রহ. বলেনআমাকে হাদিস বর্ণনা করেন যায়েদ ইবনে ইসমাইল তিনি বলেনআমাকে হাদিস বর্ণনা করেনজাফর ইবনে আওন... আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«منهومان لا يشبعان صاحب العلم وصاحب الدنيا، ولا يستويان فأما صاحب العلم فيزداد رضى الرحمن،وأما صاحب الدنيا فيتمادى في الطغيان»

“দুই লোভী ব্যক্তি কখনো পরিতৃপ্তি লাভ করে না। এক হলজ্ঞানী-লোক দ্বিতীয় হলদুনিয়াদার।  তারা উভয় কখনো সমান হয় না। জ্ঞানী লোক তার জ্ঞানের কারণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়। আর দুনিয়াদার তার দুনিয়ার কারণে  হৎকারীতা ও সীমালঙ্ঘন বৃদ্ধি পায়।“ তারপর আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু كَلَّآ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَيَطۡغَىٰٓ ٦ أَن رَّءَاهُ ٱسۡتَغۡنَىٰٓ ٧ ﴿“কখনো নয়নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ” আয়াত তিলাওয়াত করেন, কখনো নয়নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। [সূরা আলাকআয়াত: ৬-৭] আর অপর লোকের বিষয়ে বলেন, এ হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মারফু সনদে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«منهومان لا يشبعان طالب علم وطالب دنيا»
“দুই লোভী তাদের লোভ কখনোই শেষ হয় না। এক- ইলম পিপাসী, দুই- দুনিয়া লোভী”

বার. দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া ক্রয় করা:
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«بَادِرُوا باِلأعْمَالِ فتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ المُظْلِمِ، يْصبحُِ الرَّجُل مُؤمًنا وَيُمْسِي كَافرًا، وَيمْسِي مُؤْمِناً وَيُصْبحُِ كَافرا، يَبيِعُ دِينَهُ بعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا»
“আমবস্যার রাতের মত অন্ধকার ফিতনা তোমাদের ঘ্রাস করার পূর্বে তোমরা নেক আমলসমূহ করার জন্য প্রতিযোগিতা কর। কারণ, তখন একজন লোক দিনের শুরুতে মুমিন থাকবে আর দিনের শেষে সে কাফের হয়ে যাবে। আর দিনের শেষে সে মুমিন থাকবে আবার দিনের শুরুতে সে কাফের হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময় সে তার দ্বীনকে বিক্রি করে দেবে”।

তের. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে না জেনে কথা বলা এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার করা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “মহা মূল্যবান বাণী: যে সব আহলে ইলমগণদুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় ও মহব্বত করেসে অবশ্যই ফতওয়া বা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে না হক কথা বলবে। কারণআল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতির জন্য যে বিধান নাযিল করেছেন তা অনেক সময় মানুষের মতের পরিপন্থী হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা দুনিয়াদারনেতৃত্বের লোভী ও কুপ্রবৃত্তির পূজারী। কারণতাদের উদ্দেশ্য কখনোই হকের বিরুদ্ধাচরণ বা বিরোধিতা করা ছাড়া হাসিল হয় না। যখন কোন আলেম বা জ্ঞানী নেতৃত্ব-লোভী ও প্রবৃত্তির পূজারী হয়তখন সে তার উদ্দেশ্যে সত্যের বিরোধিতা করা ছাড়া সফল হতে পারে না। বিশেষ করে যখন তার মধ্যে সন্দেহ, সংশয় তৈরি হয়তখন তার সন্দেহ ও কুপ্রবৃত্তি তার নফসের চাহিদাকে আরও উসকিয়ে দেয়। তখন তার থেকে সত্য সুস্পষ্ট বা তার মধ্যে কোন প্রকার আবরণ না থাকা স্বত্বেও আত্মগোপন করে এবং সত্যের বিরোধিতা  করতে সে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করে না। আর সে বলে আমার জন্য তাওবার পথ খোলা আছে, আমি মৃত্যুর আগে তাওবা করে নেব মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এদের মত লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন-
﴿فَخَلَفَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ أَضَاعُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُواْ ٱلشَّهَوَٰتِۖ فَسَوۡفَ يَلۡقَوۡنَ غَيًّا ٥٩ إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ شَيۡ‍ٔٗا ٦٠ [مريم: 59,60[.
তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। তবে তারা নয় যারা তাওবা করেছেঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছেতারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোন যুলম করা হবে না। [সূরা মারয়াম, আয়াত: ৫৬, ৬০]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের বিষয়ে আরও বলেন,
﴿فَخَلَفَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٞ وَرِثُواْ ٱلۡكِتَٰبَ يَأۡخُذُونَ عَرَضَ هَٰذَا ٱلۡأَدۡنَىٰ وَيَقُولُونَ سَيُغۡفَرُ لَنَا وَإِن يَأۡتِهِمۡ عَرَضٞ مِّثۡلُهُۥ يَأۡخُذُوهُۚ أَلَمۡ يُؤۡخَذۡ عَلَيۡهِم مِّيثَٰقُ ٱلۡكِتَٰبِ أَن لَّا يَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡحَقَّ وَدَرَسُواْ مَا فِيهِۗ وَٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ١٦٩ [الأعراف: 169[.
অতঃপর তাদের পরে স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এমন অযোগ্য বংশধর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছেতারা এ নগণ্যতর (দুনিয়ার) সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, ‘শীঘ্রই আমাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে। বস্তুত যদি তার অনুরূপ সামগ্রী (আবারও) তাদের নিকট আসে তবে তারা তা গ্রহণ করবে। তাদের কাছ থেকে কি কিতাবের অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যেতারা আল্লাহর ব্যাপারে সত্য ছাড়া বলবে নাআর তারা এতে যা আছেতা পাঠ করেছে এবং আখিরাতের আবাস তাদের জন্য উত্তমযারা তাকওয়া অবলম্বন করে। তোমরা কি বুঝ না? [সূরা আরাফআয়াত ১৬৯]
তারা দুনিয়ার নিকৃষ্ট ও পচা-গন্ধ জিনিষকে গ্রহণ করলঅথচ তারা জানে এগুলোকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের জন্য হারাম ঘোষণা করছে। তারা বলেমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের ক্ষমা করবেন। আবার যখন তাদের সামনে অপর কিছু তুলে ধরা হয়তারা তাও গ্রহণ করে। তারা দুনিয়ার কোন বস্তু পেলেই তা গ্রহণ করতে থাকে। দুনিয়ার প্রতি তাদের অধিক লোভই তাদের মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর উপর না হক ও অসত্য কথা বলার প্রতি প্রেরণা যোগায়। তখন তারা বলেএটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বিধান শরীয়ত ও দ্বীন অথচ তারা জানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দ্বীন শরীয়ত ও বিধান তার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথমত তারা জানে এটি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দ্বীন শরীয়ত ও বিধান আবার কখনো কখনো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে এমন কথা বলে যা তারা জানে না। আবার কখনো কখনো এমন কথা বলেযে কথা যে বাতিল তা তারা জানে। আর যারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করে তারা জানে যে আখিরাত দুনিয়া হতে অতি উত্তম। দুনিয়ার মহব্বত ও নেতৃত্বের লোভ তাদেরকে দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয়ার প্রতি উৎসাহ দেয় না।

চৌদ্দ. ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বারণ করা ছেড়ে দেয় এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর রাস্তায় জেহাদ করা ছেড়ে দেয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَا لَكُمۡ إِذَا قِيلَ لَكُمُ ٱنفِرُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱثَّاقَلۡتُمۡ إِلَى ٱلۡأَرۡضِۚ أَرَضِيتُم بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا مِنَ ٱلۡأٓخِرَةِۚ فَمَا مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ٨ [التوبة: 38[.
“হে ঈমানদারগণতোমাদের কী হলযখন তোমাদের বলা হয়আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধে) বের হওতখন তোমরা যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলেঅথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য”। [সূরা তাওবাআয়াত: ৩৮]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَلالا يمْنعَنَّ أَحدَكُمْ رهْبَةُ الناَّسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا رَآهُ أَو شَهِدَهُ؛ فَإنهُ لَا يَقِّربُ مِن أَجلٍ، وَلَا يُبَاِعدُ مِنْ رِزْقٍ أَنْ يَقُولَ بحقٍ أَوْيُذَِّكَر بعظيِم»  
“সাবধান! মানুষের ভয় যেন তোমাদের কাউকে সত্য কথা বলা হতে বিরত না রাখে যখন তুমি কোনটি সত্য তা জান বা প্রত্যক্ষ কর। কারণ, তুমি যদি যদি সত্য কথা বল বা কোন মহান কাজকে স্মরণ করিয়ে দাও তবে মানুষ তোমার মৃত্যুকে কাছে টেনে আনতে পারবে না এবং তোমাকে তোমার রিজিক হতে দূরে সরাতে পারবে না”।

পনের: মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সাহায্য বিলম্ব হবে এবং দুশমনদের অন্তর হতে তোমাদের ভীতি দূর হবে:
সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিতরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يُوشِكُ الْأممُ أَْن تَدَاعَى عَلْيُكْم كَما تَدَاعَى الْأَكَلَةُ إلِى قَصْعَتِهَافقال قائل: ومن قلة نحن يومئذ؟ قالبَلْ أَنْتُمْ يوَْمئِذٍ كَثيِرٌ وَلَكِنَّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السَّيْلِ، وَلَيَنْزَعَنَّ اللهُ من صُدورِ عَدُِّوكُمْ المَهَابَةَ مِنْكُمْ، وَلَيَقْذِفَنَّ اللهُ فِي قُلُوبكِمْ الْوَهْنَ، فقال قائليا رسول الله وما الوهن؟ قالحُبُّ الُّدْنيَا وََكرَاهِيةُ المَوْتِ»
“অচিরেই এ উম্মতের লোকদের উপর এমন একটি সময় আসবে তোমাদের বিপক্ষে তোমাদেরকে এমনভাবে ডাকা হবে যেমনটি মেজবান মেহমানদের খাওয়ারের টেবিলের দিকে ডাকতে থাকে।  একজন এ কথা শোনে একজন সাহাবী বলল, সেদিন কি আমাদের মুসলিমদের সংখ্যা কম হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। বরং, সেদিন তোমাদের সংখ্যা আরও বেশি হবে! তবে তোমরা সেদিন বন্যার পানিতে ভেসে আসা আবর্জনার মত।  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তোমাদের দুশমনদের অন্তর থেকে তোমাদের ভীতিকে দুর করে দেবে এবং তোমাদের অন্তরসমূহে ওহান ঢেলে দেবে। তারপর একজন সাহাবী দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ওহান জিনিষটি কি? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওহান হল, দুনিয়ার মহব্বত ও মৃত্যুকে অপছন্দ করা”।

ষোল. দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া:
  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন, 
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَعۡبُدُ ٱللَّهَ عَلَىٰ حَرۡفٖۖ فَإِنۡ أَصَابَهُۥ خَيۡرٌ ٱطۡمَأَنَّ بِهِۦۖ وَإِنۡ أَصَابَتۡهُ فِتۡنَةٌ ٱنقَلَبَ عَلَىٰ وَجۡهِهِۦ خَسِرَ ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةَۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡخُسۡرَانُ ٱلۡمُبِينُ ١١ [الحج: 11[.
মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছেযারা দ্বিধার সাথে আল্লাহর ইবাদাত করে। যদি তার কোন কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোন বিপর্যয় ঘটেতাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি। [সূরা আল-হজআয়াত: ১১]
হাসান রহ. বলেন, প্রতিটি মানুষের উপার্জন হল সে যে নিয়ে চিন্তা করে তা। যে ব্যক্তি কোন কিছুর ইচ্ছা করে সে তারা আলোচনা বেশি করে। মনে রাখবে, যার আখিরাত নাই তার বর্তমানও নাই আর যে ব্যক্তি দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেবে তার দুনিয়াও নাই আখিরাতও নাই।

সতের. পেটের পূজা করা ও আত্মার মৃত্যু হওয়া:
আল্লামা ইবনুল যাওজী রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বত-কারীর দৃষ্টান্ত যদিও সে ইবাদত বন্দেগীতে খুব কষ্ট করে থাকে, ধান ছিটানোর মত একজন উঠায় অপরজন রাখে। ফলে তা আর তার জায়গা থেকে সরে না, কমও হয় না আবার বেশিও হয় না। অনুরূপভাবে যার অন্তর দুনিয়ার মহব্বতে মশগুল, আর তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল, বাহ্যিক দিক দিয়ে সে আজীবন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নৈকট্য লাভে পরিশ্রম করে যাচ্ছে, আর অন্তরের দিক দিয়ে সে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে দূরে সরছে। তার অবস্থার কোন পরিবর্তন নাই। সে তা জায়গাই অবস্থান করছে, জায়গা থেকে সরতে পারছ না।  

আঠার. খারাপ পরিণতি:
হাফেয আবু মুহাম্মদ আব্দুল হক বিন আব্দুর রহমান আল-আসবিলি রহ. বলেন: খারাপ পরিণতির -মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের তা হতে রক্ষা করুক-একাধিক কারণ, ও মাধ্যম আছে। খারাপ পরিণতির সবচেয়ে বড় কারণ হল, দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়া, অধিক লোভ করা এবং শুধুমাত্র দুনিয়ার অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করা; আখিরাত হতে মুখ ফিরিয়ে রাখা ও আখিরাতের কল্যাণের প্রতি কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করা। একটি কথা মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নাফরমানি ও গুনাহের দু:সাহস মানুষকে খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এ ছাড়াও অনেক সময় দেখা যায়মানুষের মধ্যে এক ধরনের গুনাহ প্রাধান্য বিস্তার করেফলে সে সত্যকে অস্বীকার করতে ঔদ্ধত্য হয়। আবার একধরনের মানুষ আছে তার মধ্যে কোন একটি বিষয়ে তার সাহস অতিরিক্ত হয়ে থাকে, তখন  অতিরিক্ত সাহসের কারণে সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার অন্তর বা আত্মা নিয়ন্ত্রণ হারা হয়, জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায় এবং তার অন্তর থেকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নুর নিবে যায় তখন তার নিকট তাকে তার এ করুণ পরিণতি হতে বাঁচানোর জন্য উপদেষ্টা বা বার্তাবাহক পাঠানো হয় কিন্তু তার উপদেশ, আদেশ নিষেধ তার কোন উপকারে আসে না এবং ওয়াজ নছিহত কোন কাজে লাগে না। অনেক সময় এমন হয়, লোকটি এ করুণ অবস্থায় মারা যায়। তখন সে অনেক দুর থেকে একজন আহ্বানকারীর আহ্বান শুনতে পায়, যে তাকে ডেকে বলে এখন তোমার কি হবে? তোমাকে কত শত শত বার সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু তুমি আমাদের কথায় কর্ণপাত করনি। এখন তার নিকট আহ্বানকারী কি বলে তার অর্থ স্পষ্ট হয় না, সে কি চায় তা এখন আর কেউ জানতে পারে না। যদিও আহ্বানকারী বার বার আহ্বান করে এবং পুনরায় ডাকতে থাকে। 

দুনিয়ার মহব্বতের চিকিৎসা

দুনিয়ার মহব্বত মানবাত্মার জন্য একটি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধি । এ ব্যাধির চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরী। আর মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা আছে। চিকিৎসা ছাড়া কোন রোগ নেই। চাই দৈহিক রোগ হোক অথবা আত্মার রোগ। দৈহিক রোগের চেয়ে আত্মার রোগ মানুষের জন্য আরও অধিক ক্ষতিকর ও মারাত্মক। মানুষ দুনিয়াতে দৈহিক রোগকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে, আত্মার রোগকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। যার ফলে মানুষের ব্যক্তিগতপারিবারিকসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অশান্তির সৃষ্টি হয়। মানবাত্মার ব্যাধি একজন মানুষের জীবনকে বিষণ্ণ করে তুলে। সুতরাং, মানবাত্মায় যে সব সংক্রামক ও ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় তার চিকিৎসা কি তা জানা ও তদনুযায়ী চিকিৎসা করা ফরয। দুনিয়া মহব্বত এটি মানবাত্মার একটি ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধি। অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাধিতে আক্রান্ত ও জর্জরিত। এ ব্যাধির  চিকিৎসা কি তা নিম্নে আলোচনা করা হল।

এক. দুনিয়া হাকিকত ও বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর ইলম থাকতে হবে।
দুনিয়ার হাকীকত ও বাস্তবতা বিষয়ে আমরা উপরে আলোচনা করেছি।

দুই. দুনিয়াকে নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ বলে জানা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন,
“ইসহাক ইবনে হানী রহ. তার মাসায়েল সমূহের আলোচনায় বলেন: “একদিন আবু আব্দুল্লাহ রহ. হাসান রহ. এর কথা নকল করে বলেনএকদিন আমি তার ঘর থেকে বের হই: তখন হাসান রহ. বলেনতোমরা দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে কর। আল্লাহর শপথ করে বলছি! তুমি দুনিয়াকে একবারেই তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট পাবে, যখন তুমি তাকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট বলে জানবে। হাসান রহ. আরও বলেনআমি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে থাকলাম নাকি পূর্ব প্রান্তে তাতে আমি কোন পরওয়া করি না। আমাকে আবু আব্দুল্লাহ রহ. বলেছেনহে ইসহাক!  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  নিকট দুনিয়া কতনা নিকৃষ্ট![33]

তিন. দুনিয়া খুব দ্রুত ধ্বংস আর আখিরাত অতি নিকটে এ বিষয়ে চিন্তা করা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন“যে দুনিয়া প্রেমিক ও দুনিয়ার মহব্বত-কারী দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেসে দুনিয়াতে সবচেয়ে নির্বোধবোকা ও জ্ঞানহীন। কারণসে বাস্তবতার উপর নিছক ধারণাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আর নিদ্রাকে প্রাধান্য দিয়েছে জাগ্রত থাকার উপর। দুনিয়াতে সে ক্ষণস্থায়ী ছায়া যা একটু পর থাকবে না, তাকে বেঁচে নিয়েছেচিরস্থায়ী নিয়ামত যার কোন শেষ বা পরিণতি নাই তার বিপরীতে। আর সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী জীবনকে স্থায়ী জীবনের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে। চিরস্থায়ী হায়াত, উন্নত জীবন ব্যবস্থাকে ক্ষণস্থায়ী, পথনিন্দ্রা ও স্বপ্নের বিনিময় বিক্রি করে দিয়েছে। কোন জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক এ কাজ করতে পারে না এবং এ ধরনের ধোঁকায় পড়তে পারে না। তাদের দৃষ্টান্ত হল, একজন লোক অপরিচিত লোক কোন সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট আসল, তখন তারা তার সামনে খাওয়া, দাওয়া পেশ করলে, সে খেয়ে একটি তাঁবুর ছায়াতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর তারা যখন তাঁবুটি খুলে ফেলল, তখন লোকটি আক্রান্ত হলে ঘুম থেকে উঠে বলল,
وان امرؤ دنياه أكبر همه
لمستمسك منها بحبل غرور
“যদি কোন মানুষের নিকট তার বড় চাওয়া পাওয়া দুনিয়াই হয়ে থাকে। তাহলে মনে রাখতে হবে সে অবশ্যই একটি ধোঁকার রশিকে মজবুত করে ধরে আছে। এ ছাড়া আর কিছুই না”
এ কবিতার মতই আরও একটি কবিতা কোন এক মনীষী বলেছিলেন,
يا أهل لذات دنيا لا بقاء لها
إن اغترارا بظل زائل حمق
“হে দুনিয়ার মজা উপভোগকারী! মনে রেখো! দুনিয়ার কোন স্থায়িত্ব নেই এবং দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এ তো শুধু সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী ছায়া, যদ্বারা আহমকরা ধোঁকায় পতিত হয়”
ইউনুস ইবনে আব্দুল আলা রহ. বলেন, “দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হল, ঐ লোকের মত যে ঘুমল এবং ঘুমের মধ্যে কিছু খারাপ স্বপ্ন দেখল, আবার কিছু ভালো স্বপনও দেখল। স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ঘুম থেকে উঠে গেল। তখন সে দেখতে পেল আরে আমিতো আমার বিছানায় শুয়ে আছি! আর এতক্ষণ আমি কত জায়গায় না ঘুরে বেড়াচ্ছি। অর্থাৎ, দুনিয়া কেবলই স্বপ্ন, এছাড়া অন্য কিছু নয়”[34]
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
“আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,ذَٰلِكَ مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ  অর্থাৎ, এ তো হল, দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সৌন্দর্য ও ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্য। وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلۡمَ‍َٔابِ আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিকট রয়েছে, তোমাদের উত্তম প্রত্যাবর্তন ও বিনিময়”
আল্লামা ইবনে জারির রহ. বলেন, ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর বাণী زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ ٱلشَّهَوَٰتِ [মানুষের জন সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা] নাযিল হলে, আমি বললাম এখনই সময় হে আমার রব! তুমি আমাদের জন্য দুনিয়াকে সজ্জিত করলে! তারপর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আয়াত নাযিল করেন,قُلۡ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيۡرٖ مِّن ذَٰلِكُمۡۖ لِلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন, قُلۡ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيۡرٖ مِّن ذَٰلِكُمۡۖ لِلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ  অর্থাৎ হে মুহাম্মদ তুমি মানুষকে জানিয়ে দাও, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবন, যে জীবনের সৌন্দর্য ও নেয়ামত অবশ্যই নি:শেষ হয়ে যাবে, তা থেকে তোমাদের কি আমি চিরন্তন ও উত্তম জীবন সম্পর্কে সংবাদ দেব? তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বিষয়ে বলেন, قُلۡ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيۡرٖ مِّن ذَٰلِكُمۡۖ لِلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ عِندَ رَبِّهِمۡ جَنَّٰتٞ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও উত্তম বস্তুর সংবাদ দেবযারা তাকওয়া অর্জন করেতাদের জন্য রয়েছে তাদের রবের নিকট জান্নাতযার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর পবিত্র স্ত্রীগণ ও আল্লাহর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টি আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা। [আলে ইমরানআয়াত: ১৫]
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
﴿وَلَا تَشۡتَرُواْ بِعَهۡدِ ٱللَّهِ ثَمَنٗا قَلِيلًاۚ إِنَّمَا عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ   [النحل: 95[.
আর তোমরা স্বল্প মূল্যে আল্লাহর অঙ্গীকার বিক্রি করো না। আল্লাহর কাছে যা আছেতোমাদের জন্যই তাই উত্তম যদি তোমরা জানতে” [সূরা নাহাল, আয়াত: ৯৫]
ঈমানের বিনিময়ে দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও সৌন্দর্যকে ক্রয় করো না। কারণ, আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া একেবারেই নগণ্য যদি আদম সন্তানকে সমগ্র দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা আছে সব দেয়া হয়, তবুও  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  নিকট যা আছে তা অবশ্যই সমগ্র দুনিয়া হতে উত্তম হবে। আর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিকট যে সব বিনিময় ও সাওয়াব রয়েছে, তা তাদের জন্য অতি উত্তম, যারা ঈমান আনে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নিকট সাওয়াব ও বিনিময় চায়, সাওয়াবের আশায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সাথে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এ কারণে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন,
 ﴿مَا عِندَكُمۡ يَنفَدُ وَمَا عِندَ ٱللَّهِ بَاقٖۗ وَلَنَجۡزِيَنَّ ٱلَّذِينَ صَبَرُوٓاْ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٦ [النحل: [96.
তোমাদের নিকট যা আছে তা ফুরিয়ে যায়। আর আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। আর যারা সবর করেছেতারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব। [সূরা নাহাল, আয়াত: ৯৬]

চার: অল্পে তুষ্টি:
 আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿أَلۡهَىٰكُمُ ٱلتَّكَاثُرُ ١ [التكاثر: 1[.
প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে। [সূরা তাকাসুর, আয়াত: ১]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ كَانَتِ الآخرَةُ هَّمهُ، جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ  في قَلْبهِِ، وَجَمَع لَه شَمْلَهُ، وََأتَتْهُ الدُّنْيَا وهِىَ راغِمةٌ، وََمْن كَانَتِ الدُّْنيَا هَّمهُ، جَعَلَ اللهُ فقْرَه بيَن عَيْنْيهِ، وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَملَهَ، وَلَم يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إلا مَا قُدِّرَ لَهُ»
“যে ব্যক্তির জীবনে আখিরাত অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার অন্তরকে অভাব মুক্ত করে দেন। তার জন্য  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার সম্পদকে সহজ করে দেন। আর দুনিয়া তার নিকট অপমান অপদস্থ হয়ে আসতে থাকে আর যে ব্যক্তির জীবনে দুনিয়া অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  দরিদ্রতা ও অভাব তার চোখের সামনে তুলে ধরেন এবং তার উপর বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেন। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তার ভাগ্যে যতটুকু দুনিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন, তার বাহিরে সে দুনিয়া হাসিল করতে পারবে না[35]
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন,  হাসান রহ. আরও বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি তোমার অন্তরকে দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করো না। যদি তাই কর, তবে তুমি খুব খারাপ বস্তুর সাথে তোমার অন্তরকে সম্পৃক্ত করলে। তুমি তার সাথে সম্পর্কের রশি কেটে দাও, দরজাসমূহ বন্ধ করে দাও। হে আদম সন্তান! তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যতটুকু তোমাকে তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছাবে”[36]

পাঁচ. দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন“দুনিয়ার মহব্বত অন্তরে মানুষের পেটে খাওয়ারের ক্ষুধার মত। বান্দা যখন মৃত্যু বরণ করে তখন সে অবশ্যই তার অন্তরে মহব্বতের পরিণতি দুর্গন্ধ ও খারাবী দেখতে পাবে। মানুষের খাওয়ার যখন হজম হয়ে যায়তখন তা ঘৃণিত, পচা ও দুর্গন্ধ হয়ে মলদ্বার দিয়ে বের হয়। অনুরূপভাবে দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি। মানুষ যখন মারা যাবে তখন সে দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি কি তা চাক্ষুষ দেখতে পাবে। দুনিয়ার মহব্বতের দুর্গন্ধ সে অনুভব করবে। দুনিয়াতে খাদ্য যত উন্নত ও মজাদার হয় তার দুর্গন্ধ তত বেশি হয়। মানুষের নিকট প্রবৃত্তির চাহিদা যত বেশি আনন্দ দায়ক বা মজাদার হয়তার মৃত্যু যন্ত্রণাও হবে বেশি কষ্টদায়ক ও যন্ত্রণাদায়ক মানুষ যখন কাউকে অধিক ভালবাসে, তখন তাকে হারালে সে অধিক কষ্ট পায়; তার মহব্বত অনুযায়ী সে কষ্ট পেতে থাকবে। ভালোবাসা বেশি হলে কষ্ট বেশি আর ভালোবাসা কম হলে কষ্ট কম।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহহাক ইবনে সুফিয়ানকে বলেন,
«يَا ضحَّاكُ مَا طَعَامُك» قال: اللحم واللبن قال: ثُمَّ يَصِيرُ إلَى مَاذَا؟  قال: إلى ما قد علمت، قال: « فَإنَ اللهَ ضَرَبَ مَا يَخرُُج مِن اْبِن آدَمَ مثَلًا للِدُّنْيَا»
“হে যাহহাক তোমার খাদ্য কি? উত্তরে সে বলল, গোস্ত ও দুধ। রাসূল বললেন, খাওয়ার পর এগুলো কি হয়? তখন সে বলল, যা আপনি জানেন। তখন রাসূল বললেন,  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  আদম সন্তানের পেটের থেকে যা বাহির হয় তাকে দুনিয়ার উপমা হিসেবে বর্ণনা করেছেন”[37]
অনেক মনিষী তার সাথীদের বলতেন, চল আমার সাথে, আমি তোমাদের দুনিয়া দেখাবো। তারপর তাদের তিনি পায়খানায় নিয়ে যেতেন আর বলতেন, দেখ তোমরা তোমাদের ফলফলাদি, গোস্ত, মাছ ও পোলাও কোরমার পরিণতি”[38]

ছয়. সত্যিকার মজার কারণ লাভের জন্য ব্যস্ত হওয়া অনর্থক কোন লাভের দিকে না তাকানো।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন“দুনিয়াতে সবচেয়ে মজা ও উপভোগ্য বস্তু হল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মারেফাত লাভ ও তার মহব্বতের মজা; এর চেয়ে অধিক মজা বা স্বাদ আর কোন কিছুতে হতে পারে না। কারণ, এটাই হল দুনিয়ার আসল মজা ও সর্বোচ্চ নেয়ামত। এ ছাড়া দুনিয়াতে আর যে সব ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক উপভোগ্য রয়েছে, তা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত; যার কোন স্থায়িত্ব নেই। মানবাত্মা, দেহ ও অন্তরকে  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  ভালোবাসা ও তার মহব্বতের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই দুনিয়াতে সব চেয়ে উত্তম জিনিষ হল, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বত ও তার মারেফাত হাসিল করা। আর জান্নাতে সবচেয়ে উপভোগ্য ও মজাদার বস্তু হল মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দিদার ও তার সাথে সাক্ষাত ও তাকে স্বচক্ষে দেখা। সুতরাং, বলা যায় যে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বত ও তার মারেফাত লাভ করা চক্ষুর শীতলতা আত্মার প্রশান্তি ও অন্তরের তৃপ্তিদায়ক। আর দুনিয়ার নেয়ামত ও আনন্দ হল, ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক। আজকে যারা আনন্দ উপভোগ করছে বা শান্তিতে আছে আগামী দিন তারা এ শান্তিতে থাকতে পারবে না; তার শান্তি অশান্তিতে পরিণত হবে এবং তার খুশি দু:খে পরিণত হবে। অবশেষে লোকটি এক অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কালাতিপাত করবে। সুতরাং, মনে রাখতে হবে আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে কখনোই হায়াতে তাইয়েবার চিন্তা করা যায় না। অনেক আল্লাহ প্রেমিক সময় সময় বলতেন, আমরা যে শান্তিতে আছি জান্নাতিরা যদি এ ধরনের শান্তিতে থাকে তাহলে অবশ্যই বলতে হবে তারা কতনা শান্তিতে আছে। অপর এক আল্লাহ প্রেমিক বলেন, আমরা যে শান্তিতে আছি, তা যদি রাজা-বাদশাহ ও তাদের সন্তানেরা জানত, তাহলে আমাদের এ শান্তি কেড়ে নেয়ার জন্য তারা আমাদের সাথে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করত[39]। 

সাত. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টিকে যাবতীয় সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেয়া।
আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, “পূর্বেকার কোন কোন মনীষীদের কিতাবে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে মহব্বত করে, তার নিকট মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বতের চেয়ে প্রিয় আর কোন কিছু হতেই পারে না; সে সব সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর মহব্বতকে প্রাধান্য দেবে, অন্য কিছুকে সে প্রাধান্য দেবে না। আর যদি কোন ব্যক্তি দুনিয়াকে মহব্বত করে, তাহলে তার নিকট দুনিয়া ছাড়া আর কোন কিছু প্রাধান্য পাবে না।  ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. স্বীয় সনদে হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করে বলেন, আমি কোন বস্তুকে আমার চক্ষু দ্বারা দেখিনি, কোন কথা আমর জবান দ্বারা উচ্চারণ করিনি, কোন বস্তুকে আমার হাত দ্বারা স্পর্শ করিনি এবং পা দ্বারা পদপিষ্ট করিনি যতক্ষণ না, আমি চিন্তা করে দেখি যে এতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি নাকি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নাফরমানি। যদি দেখতাম এতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর সন্তুষ্টি রয়েছে, তখন আমি তা অতি তাড়াতাড়ি স্বআগ্রহে পালন করতাম আর যদি দেখতাম না এতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নাফরমানি রয়েছে, তাহলে তা হতে আমি বিরত থাকতাম।

আট. জান্নাতের নিয়ামতসমূহে ফিকির করা:  
আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «اللَّهُمَّ لَا عَيشَْ إلَّا عَيْشُ الآخِرَةِ »
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আল্লাহ আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নাই। আখিরাতের জীবনই একমাত্র জীবন”[40]
এর কারণ, হল, আদম সন্তানকে রুহ ও দেহের সমন্বয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর রুহ ও দেহ উভয়টি বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য-বস্তু ও যা দ্বারা তার শক্তি সঞ্চার হয় তার প্রতি রুহ ও দেহ উভয় মুখাপেক্ষী। এর এটাই হল তার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এবং এটাই হল একমাত্র জীবন। খাদ্যপানীয়বিবাহ লেবাসপোশাক ইত্যাদি আরো যে সব জীবেনাপকরণ আছে তা নিয়ে হল দেহের জীবন। এ গুলো ছাড়া দেহ টিকে থাকতে পারে না। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই মানুষের সাথে জীব-জন্তুর একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আর মানবাত্মা হল, একেবারেই সূক্ষ্ম ও আধ্যাত্মিক; যার তুলনা হল ফেরেশতা তার বেচে থাকার জন্য খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজন হয় না। তার শক্তি, আরাম, আয়েশ, আনন্দ, খুশি সব কিছুই হল, তার স্রষ্টা, প্রতিপালক ও তার প্রভুকে চেনা, তার সাক্ষাত লাভের আকাঙ্ক্ষা, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং যে সব ইবাদত বন্দেগী, জিকির-আজকার ও মহব্বত করলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নৈকট্য লাভ করা যায় তা পালন করা আর এটাই হল, মানবাত্মার জীবন। আর যখন মানবাত্মার এ সব খোরাক না থাকে দেহ যেমন খাদ্যের অভাবে হালাক হয়, অনুরূপভাবে মানবাত্মাও অসুস্থ ও ধ্বংস হয়। বরং মানব আত্মার পরিণতি আরও করুন হয়ে থাকে। এ কারণেই দেখা যায় অনেক ধনী ও সম্পদশালী সে তার দেহের চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করা সত্ত্বেও সে তার অন্তরে ব্যথা ও ভয়ভীতি অনুভব করকে থাকে দুনিয়ার নারী বাড়ী গাড়ী সব কিছু থাকা সত্ত্বে সে অস্থির তখন অনভিজ্ঞ লোকেরা মনে করে লোকটিকে খাদ্য-পানীয় বাড়িয়ে দিতে হবে, তাহলে সে সুস্থ হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ ধারণা করে তার মাতলামি দুর হলে, তার ব্যথা ও যন্ত্রণা দুর হয়ে যাবে। কিন্তু না!  এগুলো সবই তার ব্যথা ও ভীতিকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কারণ, তার ব্যথা ও ভীতির আসল কারণ হল, তার আত্মার শক্তির অভাব ও তার আত্মার খাদ্যাভাব সে তার আত্মার চাহিদার যোগান দিতে পারছে না; ফলে সে ব্যথা অনুভব করছে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ছে[41]   

নয়. বিশ্বাস করতে হবে যে দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবনের মাঝে একত্র করা একটি কঠিন কাজ। সুতরাং, কেবল আখিরাতের জীবনকে দুনিয়ার জীবনের উপর প্রাধান্য দিতে হবে।  
আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন,
মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার জীবনে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনকে একত্র করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি আত্মা ও অন্তরের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হবে, সে অবশ্যই এ জীবন থেকে অনেক কিছুই লাভ করতে পারবে। তবে সে তার দেহ ও শরীরের সব চাহিদা মিটাতে পারবে না। তার দ্বারা তার মানবিক সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। ইন্দ্রিয় চাহিদাগুলো পূরণ করা তার জন্য সহজ হবে না। কেবল যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই সে পূরণ করতে পারবে এতে করে তার দৈহিক জীবনে কিছু ক্ষতি হতে পারে এবং কিছু চাহিদা অপূরণীয় থেকে যেতে পারে। নবী রাসূলগণ ও তাদের অনুসারীদের জীবন এ ধরনেরই ছিল। তারা তাদের মানবিক জীবনের সব চাহিদা কুরবান করে দিয়েছেন।  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  তাদের বস্তুগত জীবনের উপকরণগুলো কমিয়ে দেন। পক্ষান্তরে তাদের আত্মার ও আধ্যাত্মিক জীবনের উপকরণ অফুরন্ত করে দেন। তারা দুনিয়ার জীবনে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেন। আর আখিরাতের জীবনেও তাদের জন্য রয়েছে চিরন্তন শান্তি ও অনাবিল আনন্দ। আল্লামা সাহাল আত্ তাসতরী রহ. বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার কোন বান্দাকে যে পরিমাণ নৈকট্য ও তার মারেফাত দান করেছেন, সে পরিমাণ তাকে দুনিয়ার জীবন থেকে কমিয়ে দিয়েছেন এবং তার জন্য সে পরিমাণ দুনিয়া হারাম করে দিয়েছেন। আর যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবন থেকে কিছু অংশ দিয়েছেন, সে পরিমাণ অংশ তার জন্য আখিরাত থেকে কমিয়ে দিয়েছেন বা সে পরিমাণ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর নৈকট্য ও মারেফাত লাভ হতে সে বঞ্চিত হয়েছে[42]

দশ. দুনিয়ার জীবন যে ক্ষণস্থায়ী এ বিষয়ে ফিকির করা:
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন“দুনিয়াদার লোকদের দৃষ্টান্ত সে সম্প্রদায়ের কাওমের মত যারা একটি নৌকায় আরোহণ করলনৌকাটি তাদের নিয়ে একটি দ্বীপের নিকট পৌঁছল। সেখানে পৌছার পর নৌকার মাঝি তাদের পায়খানা পেশাবের জন্য নৌকা হতে নামতে বলল। তারা সবাই পায়খানা পেশাব করার জন্য নৌকা হতে নামল। নামার সময় নৌকার মাঝি তাদের সবাইকে সতর্ক করে বলল তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, অন্যথায় নৌকা তোমাদের রেখে চলে যাবে। আরোহী যাত্রীরা সবাই নৌকা থেকে নেমে পুরো দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে গেল। তাদের কেউ কেউ নিজ নিজ প্রয়োজন শেষ করে দ্রুত নৌকায় আরোহণ করল। যারা তাড়াতাড়ি ফিরে আসল, নৌকায় এসে তারা দেখতে পেল নৌকা একেবারেই খালি, তাই তারা তাদের পছন্দমত ভালো ভালো জায়গাগুলো তাদের বসার জন্য বেছে নিল এবং উত্তম ও মনোরম আসনগুলো তারা তাদের বসার জন্য দখল করে নিল। আর কিছু লোক ছিল তারা দ্বীপের মধ্যে অনেক সময় অবস্থান করলসেখানে তারা সুন্দর সুন্দর ফুলগাছপালা, তরুলতা ও বাগ বাগিচা দেখতে লাগল এবং বিভিন্ন ধরনের পশু পাখির আওয়াজ ও গান শুনতে লাগল। তারা দ্বীপের সুন্দর সুন্দর পাথর দেখে অভিভূত হল এবং তা উপভোগ করতে লাগল। তারপর তাদের মনে পড়ল নৌকার কথা! আমরাতো আরও দেরি করলে নৌকা হারাবো; নৌকা আমাদের রেখে চলে যাবে। তাই তারা তাড়াতাড়ি গিয়ে নৌকায় আরোহণ করল, তখন তারা গিয়ে দেখল নৌকা তাদের আসার আগেই ভরে গেছে। তখন তারা তুলনামূলক সংকীর্ণ জায়গা পেল এবং তাতে তারা বসে পড়ল। আর এক শ্রেণির লোক তারা সুন্দর সুন্দর ও মহামূল্যবান পাথরের উপর একবারে আসক্ত হয়ে পড়ল; তারা কিছু পাথর সেখান থেকে নিয়ে আসল। তারপর যখন তারা ফিরে আসল, তারা দেখতে পেল নৌকায় তাদের পাথর রাখার জায়গা-তো দুরের কথা তাদের জন্যও সংকীর্ণ জায়গা ছাড়া খোলামেলা কোন বসার জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। ফলে তাদের বহন-কৃত পাথর তাদের কষ্টের কারণ হল এবং এগুলো তাদের জন্য এক মহাবিপদ হল। লজ্জায় তারা পাথরগুলো ফেলেও দিতে পারছে না এবং বহন করা ছাড়া কোন উপায়ও দেখতে পারছে না। তারপর তারা নিরুপায় হয়ে পাথরগুলোকে তাদের কাঁধে নিল। এতে তারা খুব লজ্জা পাচ্ছিল; কিন্তু তাদের লজ্জা তাদের কোন উপকারে আসেনি। কিছু সময় অতিবাহিত হলে, তাদের ফুলগুলো শুকিয়ে দুর্গন্ধ বের হল এবং উপস্থিত লোকদের কষ্টের কারণ হল। আর কিছু লোক দ্বীপের সৌন্দর্য ও চাকচিক্য দেখে এমনভাবে ডুবে পড়ল, সে নৌকার কথা পুরোই ভুলে গেল এবং উপভোগ করতে করতে অনেক দূরে চলে গেল। নৌকা ছাড়ার সময় যখন মাঝি উচ্চস্বরে তাদের ডাক দিল, তারা তাদের খেল তামাশার কারণে মাঝির চিৎকার একটুও শুনতে পেল না। তারা তাদের কাজেই ব্যস্ত ছিল; কোন সময় ফুলের ঘ্রাণ নেয়, আবার কোন সময় ফল ছিঁড়ে, আবার কোন সময় তারা গাছের সৌন্দর্য অবলোকন করে। তারা এ অবস্থার উপর থাকতে থাকতে এমন একটি সময় আসল, এখন তারা বাঘের আতংকে ভুগতে ছিল, না জানি বাঘ এসে তাদের খেয়ে ফেলে। কাঁটাযুক্ত গাছ তাদের ঘিরে ফেলছে যা তাদের কাপড়কে নষ্ট করে ফেলে এবং পায়ের মধ্যে বিধে। চতুর্দিক থেকে গাছ-পালা ও ডালপালা তাদের উপর ছিটকে পড়ার আশঙ্কায় তারা আতংকিত[43]

এগার. দুনিয়াকে মহব্বত করা হতে বিরত থাকার উপর ধৈর্য ধারণ করা:
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন,
“আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে কারুণ সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে বলেন, একদিন কারুণ অত্যন্ত সেজে গুজে তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট উপস্থিত হল। তার সাথে ছিল খুব সুন্দর সুন্দর যানবাহন ও মূল্যবান পোশাক। চতুর পাশে চাকর-বাকর ও খাদেমগণ ছিল তার নিরাপত্তা প্রহরী। তাকে দেখে যারা দুনিয়ার প্রতি দুর্বল এবং দুনিয়ার সৌন্দর্য ও চাকচিক্যের প্রতি লোভী, তারা বলল, হায়! কারুণের মত যদি তাদেরও এ ধরনের ধন-সম্পদ থাকত! ... যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা যখন তাদের কথা শুনল, তখন তারা বলল,
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আখিরাতে তার মুমিন ও নেককার বান্দাদের যে ছাওয়াব ও বিনিময় দিয়ে থাকেন, তা তোমরা এখন যা দেখছ, তা হতে অধিক উত্তম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
﴿فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧[السجدة:17]
অত:পর কোন ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী জিনিস লুমিয়ে রাখা হেয়ছে, তারা যা করতে তার বিনিময় স্বরূপ। [সূরা সেজদা, আয়াত: ১৭]

«أَعْدَدْتُ لِعِبَاِدي الصَّالحِينَ مَا لاعَيْن رَأَتْ، وَلا أَذُنٌ سَمِعَتْ، وَلا خَطرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ واقرؤوا إن شئتم»
“আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন কিছু বস্তু তৈরি করছি, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কর্ণ কোনদিন শোনেনি এবং কোন মানুষের অন্তর তা চিন্তাও করেনি। তোমরা যদি চাও পড়তে পার আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে করীমে এরশাদ করেন,
﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ وَيۡلَكُمۡ ثَوَابُ ٱللَّهِ خَيۡرٞ لِّمَنۡ ءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗاۚ وَلَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلصَّٰبِرُونَ ٨٠﴾[القصص:80]
আর যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলতারা বলল, ‘ধিক তোমাদেরকে! আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তার জন্য। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।’ [সূরা কাসাসআয়াত: ৮০]
আল্লামা সুদ্দি রহ. বলেন, জান্নাতে কেবল ধৈর্যশীলদেরই প্রবেশ করানো হবে। এ কথাটি যেন যাদের মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর পক্ষ হতে ইলম দেয়া হয়েছে তাদের কথারই প্রতিধ্বনি। আল্লামা ইবনে জারির রহ. বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যারা দুনিয়ার মহব্বত হতে বিরত থাকছেন এবং তার উপর ধৈর্য ধারণ করছেন আর দুনিয়ার তুলনায় আখিরাতের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ছেন। এ কথাটি যেন তাদের কথারই একটি অংশ।

পরিশিষ্ট
তুমি তোমার দুনিয়া বিষয়ে চিন্তা কর তুমি কত সময় নষ্ট করছ! তারপর তুমি স্মরণ কর সেদিনগুলোকে যে গুলো তুমি তোমার বন্ধু-বান্ধবের সাথে নষ্ট করছ; তুমি তাদের সাথে কীভাবে জীবন যাপন করছ। তুমি সতর্ক হও কারণ, তুমি তোমার করনীয় ও আবশ্যকীয় কাজ হতে একেবারেই বেখবর। আর তুমি সাবধান হও দুনিয়া তোমার মধ্যে স্থান করে নেয়া হতে। কারণ, সে যখন তোমার মধ্যে নামবে সাথে সাথে চলে যাবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত তিনি বলেন,
«مر رسول الله بشاة ميتة قد ألقاها أهلها، فقال: «وَالَّذِي نَفْسِي بيَدِهِ إنَ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ هذِهِ عَلى أهْلهِا»
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি মৃত ছাগলের পাশে অতিক্রম করেন। যাকে ছাগলের মালিক রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। তারপর তিনি বললেন, যে কুদরতের হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, নিশ্চয় এ মৃত ছাগলটি তার মালিকের নিকট যতটুকু মূল্যহীন,  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন  নিকট দুনিয়া তার চেয়ে আরও অধিক মূল্যহীন তুচ্ছ”। 
মুস্তাওরেদ ইবনে সাদ্দাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 
«مَا الدُّنْيَا في الآِخرَِة إلَا مِثْلُ مَا يَجعلُ أَحَدُكمْ أصْبعَهُ فِي الْيَمِّ فَلَينظُر بمَا تَرْجِعُ»
“আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হল, তোমাদের কেউ অথৈই সমুদ্রে তার স্বীয় আঙ্গুল ডুবাইলে কুল কিনারা-হীন সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আঙ্গুলের সাথে কতটুকু পানি আসে”
আমরা  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর  দরবারে প্রার্থনা করি যে তিনি যেন আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা এ ধোঁকার দুনিয়া হতে দুরে থাকেন এবং চিরস্থায়ী ও চির সুখের জীবন আখিরাতের প্রতি ধাবিত হন।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.


অনুশীলনী
তোমার সামনে দুই ধরনের প্রশ্ন পেশ করা হল এক ধরনের প্রশ্ন যে গুলোর উত্তর তুমি সাথে সাথে দিতে পারবে। আর এক ধরনের উত্তর তুমি সাথে সাথে দিতে পারবে না, বরং তোমাকে একটু চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে হবে।
প্রথম প্রকার প্রশ্ন:
১. দুনিয়ার মহব্বতের নিদর্শনসমূহ কি?
২. দুনিয়ার মহব্বতের উল্লেখ যোগ্য কারণ সমূহ কি আলোচনা কর।
৩. দুনিয়ার মহব্বতের কারণে যে সব ক্ষতি ও অনিষ্ট সংঘটিত হয় তা কি?
৪. দুনিয়ার মহব্বতের চিকিৎসা কি?
দ্বিতীয় প্রকার প্রশ্ন:
১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «الُّدْنَيا سِجْنُ المُؤْمِنِ وجَنةَُّ الْكَافرِ»
“দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য জান্নাত” এ কথাটি ব্যাখ্যা কি?
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থা দেখে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কাঁদল এবং তাকে কোন কথাটি বলল? তার কথার উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন?
৩. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর উপর মিথ্যা কথা বলা আর দুনিয়ার মহব্বত উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কি?


সূচীপত্র
ভূমিকা
দুনিয়ার হাকীকত
দুনিয়া ও ঈমাদার
দুনিয়ার জীবন বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থান
দুনিয়া বিষয়ে সাহাবীদের অবস্থান
দুনিয়া বিষয়ে তাবেয়ীনদের অবস্থান
দুনিয়ার মহব্বতের বহি:প্রকাশ
দুনিয়ার মহব্বতের কারণসমূহ
দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি
দুনিয়ার মহব্বতের চিকিৎসা
পরিশিষ্ট
অনুশীলনী



[1] তাফসীরে কুরতবী [২৫৪/১৭]
[2] তাফসীরে ইবনে কাসীর ২৪/৮
[3] তাফসীরে তাবারী ৩০/১৮
[4]  এলামুল মুউকীয়ীন ১৫৩/১
[5] বুখারি ৪৯১৩
[6] তাফসীরে কুরতবী ১৭/১৩
[7] তাফসীরে ইবনে কাসীর
[8] মুসলিম
[9] মৃত্যুর সময় ঈমানের উপর অবিচল থাকা ১১৮-১১৯
[10] আয-জুহুদ লি-ইবনুল মুবারক (৩৩৮)।
[11] মুসলিম ২৮৯৫
[12] বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩০
[13] বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩১
[14] বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩২
[15] বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩৩
[16]  আহমদ: ৬১৬০০
[17] তিরমিযি ২৩৭২ ইমাম তিরমিযি হাদীসটিকে সহীহ ও হাসান বলেন আখ্যায়িত করেন।
[18] মুসলিম ২৭৪২
[19] মুসলিম ১০৪৬
[20] হাদীউল আরওয়াহ ৪৭
[21] মুসলিম [১১৮]
[22]  উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৯
[23] যুহুদ ও পরহেজগারী ৩৮
[24] মাজমুয়ুল ফাতওয়া ৩১৬/৯
[25] হাদীসে খাইসামাহ ১৬৬।
[26] তিরমিযি ২৪৬৫ আল্লামা আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[27]  তিরমিযি ২৪৬৫ আল্লামা আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[28] উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬
[29] উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬
[30] তাজকিরাতুল ওয়াজ ৭১
[31] উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬
[32] উদ্দাতুস সাবেরীন ১৮৬
[33] উদ্দাতুস-সাবেরীন ১৮৫
[34] উদ্দাতুস-সাবেরীন ১৮৫
[35] তিরমিযি ২৪৬৫ আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[36] উদ্দাতুস-সাবেরীন
[37] আহমদ ২০৭৩৩, ইবনে হাব্বান ৭০২
[38] উদ্দাতুস-সাবেরীন
[39]  আল-জাওয়াবুল কাফী ১৬৮
[40] আল্লামা তাবরানী হাদীসটি সাহাল ইব্ন সায়াদ রা. হতে বর্ণনা করেন।
[41]  হাদীসে লাব্বাইয়িকের ব্যাখ্যা
[42]  হাদীসে লাব্বাইয়িকের ব্যাখ্যা
[43] উদ্দাতুস-সাবেরীন ১৯৫-১৯৬। 
_________________________________________________________________________________

লেখক: মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জেদ
অনুবাদক : জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা : ড. আবদুল কাদের
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন